Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আকাশের নিচে মানুষ – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প368 Mins Read0

    আকাশের নিচে মানুষ – ৩২

    বত্রিশ

    আজ ছুটির শেষ দিন। আবার কাল থেকে হাল বয়েল নিয়ে গোটা দোসাদপাড়াকে রঘুনাথ সিংয়ের ক্ষেতিতে নামতে হবে। কাজেই যা করার আজকের ভেতরেই করে ফেলতে হবে ধর্মাকে। কারণ কাল থেকে ক্ষেতে নামলে তার হাতে কতটুকু আর সময় থাকবে! সারাদিন জমি চষার পর জঙ্গলে যেতে যেতেই তো রাত নেমে যাবে। খতরনাক জন্তু জানোয়ারে বোঝাই শাল-কেঁদের ঐ বনভূমি খুবই বিপজ্জনক। তাছাড়া হুট করে এক-আধদিন ক্ষেতির কাজ ফেলে যে জঙ্গলে যাবে তার উপায়ও নেই। বারিষ নামার আগে জমি পুরো চষে ফেলতেই হবে। চুনাও বলে এখন বড়ে সরকার বা তাঁর লোকেরা খাতিরদারি করছে। কিন্তু চুনাও তো মাসভর সালভর থাকবে না? তখন?

    আজ যদি সারারাত জঙ্গলে কাটাতেও হয় তাই কাটাবে ধর্মা। মোট কথা, দক্ষিণ কোয়েলের পাড়ের ঐ বনভূমি তোলপাড় করে চিতার বাচ্চা তাকে আনতেই হবে।

    আগের দু দিনের মতো আজও দুপুরবেলা ঘুম ভাঙল ধর্মার। তবে মা-বাপ এখনও ঘুমোচ্ছে। তাদের না জাগিয়ে গতকাল এবং পরশুর মতো চান করে টাঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ধর্মা।

    কুশী রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। ছায়ার মতো মেয়েটা তার সঙ্গে চলতে থাকে।

    হাইওয়ে থেকে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাত ধরে চলতে চলতে হঠাৎ ধর্মাদের চোখে পড়ে, ধুলো উড়িয়ে বড়ে সরকারের ছাদখোলা প্রকাণ্ড মোটরটা বিজুরি তালুকের দিক থেকে আসছে। কৌতূহলের বশে ধর্মা আর কুশী দাঁড়িয়ে যায়।

    মোটরটা যখন কাছাকাছি এসে পড়েছে তখন দেখা যায়, ভেতরে বড়ে সরকার রঘুনাথ সিংয়ের পাশাপাশি বিজুরি তালুকের মালিক মিশিরলালজী এবং তাঁদের আরো কয়েকজন প্যারা দোস্ত বসে আছেন। ধর্মারা বুঝতে পারে, মিশিরলালজীদের আনবার জন্যই রঘুনাথ সিং বিজুরি তালুকে গিয়েছিলেন। ধর্মারা যা জানে না তা এইরকম। রঘুনাথ সিংয়ের নির্বাচনী এলাকা গারুদিয়া এবং বিজুরি—এই দুই তালুকের ত্রিশ বত্রিশটা গ্রাম জুড়ে পড়েছে। গারুদিয়া তালুকের গাঁওবালাদের ভোট সম্পর্কে রঘুনাথ মোটামুটি দুশ্চিন্তামুক্ত। কিন্তু বিজুরির ভোট সম্বন্ধে জোর দিয়ে কিছু বলা না।

    তবে মিশিরলালজী যদি তাঁর হয়ে একবার আঙুল তোলেন বকরীর পালের মতো ওখানকার সবাই গিয়ে ভোটের কাগজে মোহর মেরে আসবে। মিশিরলালজীকে একটু খুশী করার জন্য তিনি আজ তাঁকে গারুদিয়ায় তোয়াজ করে নিয়ে এসেছেন।

    মিশিরলালজী সম্পর্কে এখানে কিছু বলে নেওয়া যেতে পারে। ষাটের কাছাকাছি বয়েস হলেও আজ প্রচুর সাজগোজ করে এসেছেন তিনি। কাঁচা-পাকা চুল পাট করে মাথার বাঁ দিকে ফেলে রাখা হয়েছে। ডান দিকে সিঁথি। প্রচুর ভয়সা ঘি আর দুধ-মাখন-শক্কর খাওয়া শরীরে এখন মখমলের পাঞ্জাবী আর ফিনফিনে ধুতি। দুহাতে কম করে আটটা আংটি। তার মধ্যে একটা হীরে-বসানো, একটা মুক্তো বসানো, একটা চুনী আর একটা পান্না-বসানো। তাঁর পাঞ্জাবীর বোতামগুলোতেও হীরে সেট-করা, কানে সোনার মাকড়ি। পায়ে কারুকাজ-করা লক্ষ্ণৌর নাগরা। তবে তিনি যে ব্রাহ্মণ সেটা প্রমাণ করার জন্য কপালে এবং কানের লতিতে চন্দনের ছাপ মারা রয়েছে। মলমলের পাঞ্জাবীর তলায় এক গোছা মোটা পৈতাও দেখা যাচ্ছে।

    এ অঞ্চলে গারুদিয়া বিজুরি এবং চারপাশের দশ বিশটা তালুকের সবাই তাকে বলে ‘চরণ ছুঁ জমিন্দার’। জমিদারিপ্রথা উঠে গেলেও ঐ নামটা মিশিরলালজীর গায়ে আঠার মতো আটকে আছে।

    এছাড়াও চরণ-ছুঁ জমিদারের অন্য কারণে খ্যাতি আছে। চারপাশের দশ-বিশটা তালুকের সব মানুষ জানে এই লোকটার ভীষণ আওরতের দোষ। রোজ রাতে একটা না একটা ছুকরিকে তাঁর কাছে যোগান দিতেই হয়। মেয়েমানুষের ব্যাপারে মিশিরলালজীর বাছবিচার নেই।

    ওরাও-সাঁওতাল, মুণ্ডা-ভুঁইহার, ধোবি-দোসাদ-জল-চল জল-অচল অচ্ছুৎ যাই-হোক না, যুবতী মেয়ে পেলেই তিনি খুশী। এজন্য বিজুরি তালুকের অল্প বয়সের ছুকরিরা সর্বক্ষণ তটস্থ হয়ে থাকে। মিশিরলালজীর লোকেরা কখন যে কাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাবে, কেউ জানে না। অবশ্য এজন্য তিনি আওরতের ন্যায্য দামও দিয়ে থাকেন।

    বড়ে সরকারের ছাদখোলা প্ৰকাণ্ড গাড়িটা সামনে দিয়ে চলে গেল। সেটা দেখতে দেখতে ধর্মা ভয়ে ভয়ে বলে, ‘আওরতখোর (মেয়েখোর) লাকড়াটা এখানে এল কেন? আমার ডর লাগছে। হোশিয়ার থাকবি কুশী’

    কুশী বলে, ‘হুঁ হুঁ, থাকব। তুই ডরাস না।’

    ‘এখন চল—’ আবার হাঁটতে শুরু করল দুজনে। কিছুক্ষণ পর টাঙ্গি কাঁধে করে জঙ্গলের দিকে চলে যায় ধর্মা আর সাবুই ঘাসের বনে ঢোকে কুশী।

    কাল বিকেলেই ফাঁদ পেতে রেখে গিয়েছিল কুশী। আজ এসে দেখল সাত-আটটা বগেড়ি পড়ে আছে।

    পাখিগুলোকে ফাঁদ থেকে বার করে পায়ে দড়ি বেঁধে বালির ওপর ফেলে রাখে কুশী। তারপর নতুন করে ফাঁদ পেতে পাখিগুলো হাতে ঝুলিয়ে নেয়। এখন সে যাবে ঠিকাদারদের কাছে।

    ধর্মা সঙ্গে থাকে না। তাই আজকাল আর বালি খুঁড়ে পয়সার কৌটো বার করে মাস্টারজীর কাছে গোনাতে যায় না কুশী। একলা মেয়ে সে, কেউ তাকে মেরেধরে কৌটোটা লুটে নিতে পারে। দুনিয়ায় বদমাস দুশমনের তো অভাব নেই।

    ঠিকাদারদের কাছে বগেড়ি বেচে যে ক’টা পয়সা পাওয়া যায় তা ইদানীং নিজের ঘরে নিয়ে লুকিয়ে রাখে কুশী। ধর্মা জঙ্গল থেকে চিতার বাচ্চা ধরে আনার পর পয়সাগুলো তার হাতে তুলে দেবে।

    ঠিকাদারদের কাছে বগেড়ি বেচে আজ আড়াইটা টাকা পাওয়া গেল। পেটের কাছের শাড়িতে টাকাটা গিট দিয়ে বেঁধে গুঁজে রাখল কুশী। তারপর যখন নিজেদের মহল্লায় ফিরে এল, বিকেল হয়ে গেছে।

    দোসাদদের পাড়ায়, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে সাজগোজের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যে। সন্ধ্যে হলেই তারা নৌটঙ্কী শুনতে যাবে।

    গরীবের চাইতেও গরীব ভূমিদাস অচ্ছুৎদের ঘরে সাজসজ্জার কী উপকরণই বা থাকতে পারে! সাজি-মাটি দিয়ে চুল ঘষে ক্ষারে-কাচা শাড়ি-জামা পরে, চোখে ঘরে পাতা কাজল টেনে, চুলে ফুল গুঁজে নেওয়া—এই তো সাজের বহর। এটুকুর জন্যই বিকেল থেকে তারা শীশা, কাকুই আর ধোয়া শাড়ি-জামা নিয়ে বসে গেছে।

    কুশী আসতেই তাদের উল্টোদিকের বারান্দা থেকে গিধনী চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুরন্ত সেজে নে; সূরয ডুবতে বসেছে।’

    কুশী বলে, ‘এখনও অনেক বেলা আছে। নওটঙ্কী শুরু হবে তো আন্ধেরা নামার পর।’

    কুশী নিজেদের ঘরে ঢুকে কোমরের গিট খুলে সেই আড়াই টাকা বার করে বালিশের খোলের ভেতর পুরে রাখল। তারপর বাইরের বারান্দায় এসে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসল। সেই দুপুর থেকে ঝাঁ ঝাঁ রোদ মাথায় নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে একবার সাবুই ঘাসের জঙ্গলে গেছে সে, সেখান থেকে ঠিকাদারদের কাছে। তারপর ঘরে ফিরেছে। এখন খানিকটা না জিরিয়ে নিলে এক পাও হাঁটতে পারবে না।

    দোসাদটোলার যুবতী মেয়েরা সবাই দল বেঁধে রোজ নৌটঙ্কী দেখতে যায়। তাদের ভয়, দেরি করে গেলে আসরের সামনের দিকে জায়গা পাওয়া যাবে না। সূরয ডুববার অনেক আগেই এ-গাঁও সে-গাঁও থেকে গাদা গাদা লোক এসে ভালো ভালো জায়গাগুলো দখল করে বসে থাকবে। তাই সকলেরই আগে যাবার গরজ।

    এদিক সেদিক থেকে গিধনী কুঁদরি, ভিসি, মুংলী, সোমবাবীবা তাড়া লাগায়, ‘অ্যাই কুশী ওঠ না, তাড়াতাড়ি কর। দেরি করে গেলে শামিয়ানার বাইরে বসতে হবে।’ আসলে কেউ কুশীকে ফেলে যেতে চায় না।

    কুশী বলে, ‘উঠছি উঠছি। আরেকটু জিরিয়ে নিই।’

    কুঁদরীরা আবার কী বলতে যাচ্ছিল, সেইসময় ঝুম ঝুম আওয়াজ কানে আসে। কুশীরা দেখল, সামনের কাঁকুরে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটো ফীটন গাড়ি ছুটে আসছে। ঘোড়ার গলায় ঘুন্টি বাধা। তাই ওইবকম শব্দ হচ্ছে।

    দূর থেকে দেখামাত্র কুশীরা চিনতে পারল—বড়ো সরকার রঘুনাথ সিংয়ের ঘোড়ার গাড়ি। কিন্তু ফীটন দুটো এখানে এল কেন? বড়ে সরকারের ঘোড়ার গাড়ি তো কখনও এদিকে আসে না।

    বিমূঢ়ের মতো সবাই তাকিয়ে থাকে।

    কাছাকাছি এসে ফীটন দুটো দাঁড়িয়ে গেল। আর সামনের গাড়িটা থেকে নেমে এল বগুলা ভকত রামলছমন।

    দোসাদটোলার লোকজন অবাক। চোখের পলকে বকের মতো লম্বা পা ফেলে ভেতরে ঢুকে পড়েছে রামলছমন। তাকে দেখে সবাই উঠে দাড়ায়।

    রামলছমন বড় বড় ট্যারা বাঁকা দাঁত বার করে বলে, ‘সবাই শোন আজ তোদের ছুটির শেষ দিন। বড়ে সরকার খুশী হয়ে তোদের নওটঙ্কীর আসরে নিয়ে যাবার জন্যে ঘোড়ার গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনা হাতে বড়ে সরকার তোদের মরদানাদের ধোতিকুর্তা আর আওরতদের শাড়ি-জামা দেবেন।’

    বলে কি বগুলা ভকত! ক’দিন ধরে এসব কী হচ্ছে! রাতারাতি তাদের ভাগ্য কি নতুন করে ফিরে গেল!

    ভিড়ের ভেতর থেকে বুধেরি ভয়ে ভয়ে, খানিকটা অবিশ্বাসের গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘সচমুচ দেওতা?’

    ‘সচমুচ না তো ঝুট নাকি? দেখবি?’ বলেই সামনের ফীটনটার দিকে দৌড়ে যায় রামলছমন। ভেতর থেকে চারটে চটকদার রঙিন শাড়ি এনে ফের শুরু করে, ‘তোদের বিশোয়াসের জন্যে এগুলো নিয়ে এসেছি। সমঝা?’

    বিহ্বলের মতো সবাই শাড়ি ব্লাউজগুলো দেখতে লাগল। এরপর তারা যে কী বলবে, ভেবে উঠতে পারছিল না।

    রামলছমন এবার এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড করে বসে। একটা করে শাড়ি জামা গিধনী, কুশী, সোমবারী আর তিসির দিকে ছুড়ে দিতে দিতে বলে, ‘যা, তুরন্ত পরে আয়। ফীটনে তো বেশি লোকের জায়গা হবে না। আগে তোদের বড়ে সরকারের মকানে রেখে আসি। তারপর এসে এক এক করে সবাইকে নিয়ে যাব।’

    দামী শাড়ী-জামা পেয়ে যুবতী দুসাদিনরা একেবারে ডগমগ। চূনাওর কল্যাণে ঝকঝকে হাওয়া গাড়িতে সেদিন চড়িয়েছিলেন প্রতিভা সহায়। সেটা বাদ দিলে যারা চোদ্দ পুরুষে কোনদিন ভাল গাড়িতে চড়েনি তাদের নিয়ে যাবার জন্য বড়ে সরকার তেজী ঘোড়ায়-টানা ঝকঝকে ফীটন পাঠিয়ে দিয়েছেন। অল্পবয়সী সরল গরীব মেয়েগুলো একেবারে দিশেহারা হয়ে যায়। কোন চিন্তা ভাবনা না করেই নতুন শাড়ি-জামা বুকে চেপে দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে যায়। কিছুক্ষণ পর যখন বেরিয়ে আসে তাদের আর চেনাই যায় না।

    বগুলা ভকত রামলছমন চোখ গোল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর লুব্ধ গলায় বলে, ‘তোদের যা দেখাচ্ছে না—বিলকুল স্বরগকা পরী য্যায়সা। কা খুবসুরতী!’ বলেই তাড়া লাগায়, ‘চল চল, তুরন্ত গাড়িতে উঠে পড়।’

    গিধনী কুশী সোমবারী আর তিসি দৌড়ে গিয়ে ফীটনে ওঠে।

    রামলছমন দোসাদপাড়ার বাদবাকি লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোরা কোথাও যাস না। আমি আবার ফীটন নিয়ে আসছি। বলতে বলতে লাফ দিয়ে সামনের গাড়িটায় উঠে কোচোয়ানের পাশে গিয়ে বসতে বসতে বলে, ‘হাঁকাও গাড়ি—’

    বহুদর্শী এবং অভিজ্ঞ গণেরি এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। তবে তীক্ষ্ণ চোখে রামলছমনের কাণ্ডকারখানা লক্ষ্য করছিল। আচমকা তার কী যেন মনে পড়ে যেতে জোরে জোরে পা ফেলে ফীটনটার দিকে এগিয়ে যায়। ডাকে, ‘বরাম্ভনজী—’

    ফীটন ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে। ঘাড় ফিরিয়ে রামলছমন, বলে, ‘কা—’

    ‘আমাকে ঐ লেড়কীদের সাথে নিয়ে চলুন—’

    ‘তু পিছা যাওগে।’

    ‘মগর—’

    ‘ডরো মাত। বড়ে সরকার যেতে বলেছে; ডরের কী? বড়ে সরকার সব কোইকা মা-বাপ।’

    গণেরি আবার কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে ফীটনদুটো ঝড়ের গতিতে প্রায় উড়েই হাইওয়েতে গিয়ে ওঠে। এতদূর থেকে গলা ফাটিয়ে ফেললেও তার কথা রামলছমন শুনতে পাবে না।

    মেয়ে চারটেকে এভাবে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে কী যেন আছে! ঠিক কী আছে, বুঝতে পারছে না গণেরি। তবে তার মনে খিঁচ লাগার মতো কিছু একটু লেগে থাকে।

    কুশীদের নিয়ে ফীটনদুটো চলে যাবার পর অনেকটা সময় কেটে গেছে। ভূমিদাসদের মহল্লায় সবাই উন্মুখ হয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে—কখন রামলছমন আসবে, কখন ঘোড়ার গাড়িতে তুলে তাদের সবাইকে নৌটঙ্কার আসরে নিয়ে যাবে।

    কিন্তু নৌটঙ্কী নিয়ে গণেরির দুর্ভাবনা নেই। নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে গালে হাত দিয়ে অনবরত সে ভেবে চলেছে, রামলছমন এভাবে মেয়েগুলোকে নিয়ে গেল কেন?

    দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে আসে। ক্রমশ রাত বাড়তে থাকে। কিন্তু না দেখা যায় রামলছমনকে, না তার ফীটনদুটোকে।

    অনেকক্ষণ বসে থেকে থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই নৌটঙ্কী শুনতে বেরিয়ে পড়ে।

    রঘুনাথ সিংয়ের হাভেলিতে বিশাল শামিয়ানার তলায় এসে দোসাদপাড়ার লোকজন ঠাসাঠাসি ভিড়ের ভেতর জায়গা করে বসে পড়ে। আপাতত গান শোনা যাক। পরে নয়া জামা-কাপড়ের জন্য রামলছমনকে ধরা যাবে। কিন্তু গণেরির দুশ্চিন্তা কাটে না। সে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল কিন্তু আসরের কোথাও রামলছমন কিংবা কুশীদের দেখা যাচ্ছে না। ভয়ে ভাবনায় তার রক্ত যেন জমাট বেঁধে যেতে থাকে। তাদেরই মেয়ে। দোসাদটোলার সবাই তাকে মুরুব্বি বলে মানে। গণেরির একটা দায়িত্ব তো আছে। কিন্তু গেল কোথায় ওরা?

    হঠাৎ গণেরির চোখে পড়ে নৌটঙ্কীর আসরের একেবারে ধার ঘোঁষ গদী আর মখমল মোড়া দুটো সিংহাসনে পাশাপাশি বসে আছেন বড়ে সরকার রঘুনাথ সিং আর বিজুরি তালুকের মিশিরলালজী।

    মিশিরলালজীকে দেখামাত্র বুকের ভেতর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় গণেরির। আওরৎখোর চরণ-ছুঁ জমিদার এখানে কেন? গারুদিয়া তালুকে মিশিরলালজীর নৌটঙ্কী শুনতে আসার সঙ্গে কুশীদের ফীটনে করে নিয়ে যাওয়ার কোনরকম সম্পর্ক আছে কি?

    একসময় গান শুরু হয়ে যায়। আজ উত্তরপ্রদেশের মীর্জাপুর আর আজমগড় থেকে সেরা নৌটঙ্কীর দল আনিয়েছেন রঘুনাথ সিং।

    মীর্জাপুরের দলটা এখন গাইতে শুরু করেছে।

    দধিয়া ক্যায়সে রে মথু
    কানহা ধাইলে রে মনথনিয়া
    অভন ডোলে, পবন ডোলে
    আউর ডোলে সারি দুনিয়া
    শেষনাগকা মস্তক ডোলে নাগিনকে রে নাথুনিয়া
    তবলা বোলে ঢোলক বোলে
    আউর বাজে হারমুনিয়া—
    শ্রী কিষুণকি মুরলা বোলে
    রাধাকে হো পায়জুনিয়া
    দখিয়া ক্যায়সে রে মথু—

    কিন্তু সেদিকে লক্ষ্য নেই গণেরির। শামিয়ানার ধার দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মিশিরলালজীর ওপর সে নজর রাখতে লাগল।

    গান যখন জমে উঠেছে সেই সময় আচমকা উঠে পড়লেন রঘুনাথ সিং আর মিশিরলালজী। লোকজন সরে সরে তাঁদের বেরুবার রাস্তা করে দিল।

    গণেরি দাঁড়িয়ে ছিল অনেকটা দূরে—শামিয়ানার আরেক মাথায়। আচমকা বিজুরি চমকানোর মতো একটা ভাবনা সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার ভেতর দিয়ে খেলে গেল। শামিয়ানার বাইরে দিয়ে সে রুদ্ধশ্বাসে ছুটল। রঘুনাথ সিংরা যেদিকে ছিলেন অনেকটা ঘুরে যখন সে পৌঁছুল, অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। রঘুনাথ সিং আর মিশির লালজীকে নিয়ে পুরনো আমলের একটা হুডখোলা মোটর তখন হুস করে তার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল!

    .

    বিকেলবেলা রামলছমন যখন ফীটন নিয়ে ভূমিদাসদের পাড়ায় এসেছিল, সেই সময় শাল-কেঁদের জঙ্গলে কাঁধে টাঙ্গি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধর্মা।

    দুপুরের কিছু পর বেলা যখন হেলতে শুরু করেছে বনভূমিতে ঢুকেছিল সে। সেই থেকে অনবরত ঘুরেই চলেছে।

    ঘুরতে ঘুরতে ঘন জঙ্গলের মাথায় রোদের রং বদলে যখন হলুদ হয়ে যেতে শুরু করেছে সেই মুহূর্তে তিনটে চিতার বাচ্চা তার চোখে পড়ল। দক্ষিণ কোয়েলের খাত থেকে একটা সরু স্রোত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেছে। অনেকটা নহরের মতো। নানা গাছের ডালপালা স্রোতটার ওপর ঝুঁকে পড়েছে। জঙ্গল অবশ্য এখানে খুব ঘন নয়। বেশ পাতলাই। শাল কি কেঁদ কি কড়াইয়া গাছগুলো ছাড়া ছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। একটা পীপর গাছের তলায় জলের ধার ঘেঁষে চিতার বাচ্চা তিনটে খেলা করছে।

    দেখতে দেখতে ধর্মার চোখ ঝকমকিয়ে উঠল। পুরো তিনটে দিন সে এখানে ঘুরছে।

    তার আগেও কয়েকটা দিন ক্ষেতিতে কাজকর্ম চুকিয়ে সে এখানে ঘুরে গেছে। কিন্তু চিতা দূরের কথা, তার গায়ের একটা ফুটকিও চোখে পড়েনি। আশেপাশে বাচ্চা তিনটের বাপ-মা নেই। এমন অরক্ষিত অবস্থায় চিতার ছানা যে পাওয়া যাবে, ভাবতে পারেনি ধর্মা। তাড়াহুড়ো না করে ধীরে-সুস্থে সে পীপর গাছটার দিকে এগুতে লাগল। যখন ধর্মা বাচ্চাগুলোর কাছাকাছি এসে পড়েছে সেই মুহূর্তে সমস্ত বনভূমি কাঁপিয়ে গর্জন উঠল।

    চমকে বাঁ দিকে তাকায় ধর্মা। একটা ঝাঁকড়া মতো ঝোপের পাশ থেকে একটা চিতা বাঘিন গুড়ি মেরে বেরিয়ে আসছে। তার চোখদুটো জ্বলছে। ধারালো দাঁতগুলো বার করে পায়ে পায়ে এগুচ্ছে জানোয়ারটা। গলার ভেতর থেকে গর-র-র্, গর-র-র্ করে একটা হিংস্র আওয়াজ বেরিয়ে আসছে।

    চিতার বাচ্চাগুলোকে যত সহজে তুলে নেওয়া যাবে ভাবা গিয়েছিল, ব্যাপারটা তত সোজা না। কাঁধ থেকে টাঙ্গিটা নামিয়ে ধর্মা সতর্ক ভঙ্গিতে একটু তেরছা হয়ে দাড়ায়। ওদিকে চোখের পলক পড়তে না পড়তেই বাঘিনটা হাওয়ায় ভর করে উড়ে এল যেন। সঙ্গে সঙ্গে আরো খানিকটা সরে গিয়ে শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে ঘাড়ের কাছে কোপ মারে ধর্মা।

    বাঘিনটার গা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে আর জন্তুটা ছিটকে গিয়ে পড়ে হাত দশেক তফাতে, পড়েই বনভূমিকে চমকে দিয়ে গর্জে ওঠে।

    কয়েক পলক মাটিতে পড়ে থাকে বাঘিনটা। তারপর উঠেই আবার ধর্মার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। টাঙ্গির ঘা খেয়ে জন্তুটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।

    ধর্মা এবারও আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল। বাঘিনটার মুখে টাঙ্গির ঘা ঝাড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে মুখটা রক্তাক্ত হয়ে গেল সেটার। নিজেকে পুরোটা বাঁচাতে পারল না ধর্মা। বাঘিনীটার সামনের দিকের একটা থাবা লেগে তার কাঁধের খানিকটা মাংস উপড়ে গেল।

    তবে ওদিকে দ্বিতীয় কোপটা খেয়ে বাঘিনটা খানিকটা দমে গেল বোধহয়। মাটিতে পড়ে ছটফট করতে করতে খানিকক্ষণ গড়াগড়ি দিয়েই দূরে ঘন জঙ্গলের দিকে দৌড়ুল।

    ধর্মা তারপরও খানিকক্ষণ দাড়িয়ে থাকে। কিন্তু না, বাঘিনিটার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

    খুব সম্ভব পর পর দুটো মারাত্মক যা খেয়ে জানোয়ারটা পালিয়ে গেছে। এদিকে জঙ্গলের মাথার ওপর রোদ নিভু নিভু হয়ে আসতে শুরু করেছে। বনভূমির ভেতরটা আরো ছায়াচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। রাতের অন্ধকার নামার আগে এখান থেকে বেরিয়ে যেতেই হবে। ঐ বাঘিনটা ছাড়াও জঙ্গলে আরো অগুনতি হিংস্র জানোয়ার রয়েছে। বেকায়দায় পেলে ধর্মাকে তারা ছাড়বে না।

    ধর্মা আর দেরি করে না। চিতার বাচ্চা তিনটেকে কোলে তুলে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায়।

    খানিকটা যাবার পরই ডান দিক থেকে গর-র-গর-র-র্ আওয়াজ আসতে লাগল। চমকে ঘাড় ফেরাতেই ধর্মা দেখতে পায়, খানিকটা দূরে কেঁদ গাছের আড়াল দিয়ে বাঘিনটা সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। জানোয়ারটা তা হলে পালায় নি।

    ধর্মা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে, বাঘিনটাও দূরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাচ্চা তিনটেকে নিয়ে এই বনভূমির বাইরে ধর্মাকে সে যেতে দেবে না।

    মনে মনে ধর্মা ঠিক করে ফেলে, জঙ্গল যেখানে বেশি ঘন সেখান দিয়ে যাবে না। গাছপালা যেখানে পাতলা সেখান দিয়েই যাওয়া দরকার। কেননা ঘন ঝোপঝাড়ের ভেতর জখমী বাঘিনের ওপর লক্ষ্য রাখা সম্ভব না।

    মোটামুটি ফাঁকা জায়গা দেখে দেখে এগুতে থাকে ধর্মা। বাঘিনটা দূরে দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে চলেছে। তার ক্রুদ্ধ গর-র-র্ গর-র-র্ গর্জন এই অরণ্যকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

    অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেরুবার পর ফের জঙ্গল ঘন হয়ে আসে। খুব সাবধানে চারদিকে নজর রাখতে রাখতে ধর্মা চলেছে। হঠাৎ মাথার ওপর গর্জন শোনা গেল। বাচ্চাগুলো কোল থেকে নামিয়ে টাঙ্গি বাগিয়ে ধরতে ধরতেই বাঘিনটা উঁচু গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ল। এক থাবায় ধর্মার বুকের খানিকটা মাংস এবার ছিঁড়ে নিল জানোয়ারটা। রক্তে গোটা শরীর ভিজে যেতে লাগল তার। আর এরই মধ্যে দ্রুত কোমর থেকে ছুরি বার করে বাঘিটার পেটে আমূল ফলাটা বসিয়ে দেয় ধর্মা। যন্ত্রণায় জানোয়ারটা চিৎকার করে দৌড় লাগায়।

    ধর্মা অপেক্ষা করল না। বাচ্চা, তিনটেকে ফের কোলে তুলে নিয়ে জোরে জোরে ঊর্ধ্বশ্বাসে হাঁটতে লাগল। এই নিবিড় জঙ্গলে দৌড়নো অসম্ভব।

    ছুরির ঘা খাবার পরও বাঘিনটা যে পিছু ছাড়েনি, একটু পরেই সেটা টের পাওয়া যায়। সামনে পেছনে ডাইনে বায়ে এবং মাথার ওপর—সব দিক থেকে তার গর-র-র্ গর-র-র্ আওয়াজ শোনা যেতে থাকে।

    এদিকে শেষ বেলার নিভু নিভু আলোটুকু জঙ্গলের মাথা থেকে একটানে কেউ সরিয়ে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে বনভূমিতে ঝপ করে সন্ধ্যে নেমে আসে।

    সতর্ক ভঙ্গিতে জঙ্গলটা পার হয়ে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতের বালির ডাঙায় এসে পড়ে ধর্মা। এখানে অন্ধকারটা বনভূমির ভেতরকার মতো অত ঘন নয়।

    হঠাৎ সে দেখল, খানিকটা দূরে সেই বাঘিনটা আস্তে আস্তে পা ফেলে আসছে। অর্থাৎ জানোয়ারটা তাকে কিছুতেই ছাড়বে না।

    গা থেকে অনেকটা টাটকা রক্ত পড়েছে। মাথাটা ঝিম ঝিম করছিল ধর্মার। বাঘিনটার সঙ্গে লড়াই করার ইচ্ছা তার আর নেই! জানোয়ারটাকে পাশ কাটিয়ে কোন রকমে হাইওয়েতে যেতে পারলেই হয়। ওখানে মানুষজন গাড়িঘোড়া রয়েছে। বাঘিনটা হাইওয়েতে যেতে সাহস করবে না।

    এবার লুকোচুরি শুরু করে ধর্মা। নদীর মরা খাত ধরে সোজা না গিয়ে কখনও অনেকখানি ডাইনে যায় সে, কখনও অনেকখানি বায়ে। বাঘিনটা খুব সম্ভব তার মতলব বুঝতে পেরেছে। সে-ও মাঝখানে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে তার সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে।

    সাবুই ঘাসের জঙ্গলটার কাছাকাছি আসার পর হঠাৎ কী যেন হয়ে যায় বাঘিনটার।

    আর দূরে দূরে না, একেবারে সামনে এসে দাড়ায়। হয়ত জানোয়ারটা বুঝতে পেরেছে আর দেরি করা ঠিক নয়, খানিকটা যেতে পারলেই ধর্মা বাচ্চাগুলোকে নিয়ে তার হাতের বাইরে চলে যাবে।

    ধর্মাও বুঝতে পারছিল বাঘিনটার সঙ্গে যুদ্ধ না করে তার বাচ্চা তিনটেকে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব।

    একবার সে ভাবল, মায়ের ছানা মায়ের কাছেই ফেরত দেবে। পরক্ষণেই মনে পড়ল, এই বাচ্চাগুলোর ওপর তাদের এবং কুশীদের স্বাধীনতা নির্ভর করছে।

    বাচ্চাগুলো তাদের ছ ছ’জন মানুষের মুক্তির দাম। সে ঠিক করে ফেলল, লড়াই-ই করবে। বাচ্চাগুলোকে বালির ডাঙায় নামিয়ে রেখে ধর্ম টাঙ্গি উচিয়ে দাড়াল। বাঘিনটাও ওত পেতেই রয়েছে।

    দেখতে দেখতে দক্ষিণ কোয়েলের মরা খাতটা পৃথিবীর আদিম রণভূমি হয়ে উঠল। ঘণ্টা তিনেক পর দেখা গেল, বাঘিনটা বালির ডাঙার ওপর মরে পড়ে আছে। আর রক্তাক্ত ধর্মা মড়ার মতো ঘাড় গুঁজে রয়েছে। তির তির করে নাকের ভেতর দিয়ে একটু একটু নিঃশ্বাস পড়ছে তার।

    অনেকক্ষণ ওভাবে পড়ে থাকার পর একসময় উঠে বসে ধর্মা চিতার বাচ্চাগুলো একধারে শুয়ে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সেগুলোকে তুলে নিয়ে ধুকতে ধুকতে হাইওয়েতে চলে এল ধৰ্মা।

    এখন মাঝরাত। চারদিকের সীমাহীন শস্যক্ষেত্র জুড়ে আশ্চর্য নিষুতি।

    হাইওয়েতে দাঁড়িয়ে ধর্মা ভাবল দোসাদটোলায় ফিরে যাবে। পরমুহূর্তেই মনে পড়ল, সেখানে এখন কেউ নেই। সবাই নৌটঙ্কী শুনতে চলে গেছে। সে ঠিক করে ফেলল, সিধা রাঁচী চলে যাবে। এই সময়টায় একটা দূর পাল্লার বাস পাটনা থেকে রাঁচীর দিকে যায়। আগেও দু-একবার হরিণের শিং কি বাঘছাল নিয়ে ধর্মা এই বাসে রাঁচী গেছে। টিরকের কাছে মাল ‘ডিলভারি’ দিয়ে দাম-টাম নিয়ে ভোরের বাস ধরে ফিরে এসে জমি চষতে নেমেছে।

    কোমরে প্যান্টের পটির ভেতর সবসময় দু-চারটে টাকা থাকে তার। কাজেই ভাড়ার জন্য চিন্তা নেই। এক অসুবিধা নিজের জখমী চেহারা। আঁচড়ে কামড়ে বাঘিনটা তার হাল ‘বুরা’ করে দিয়েছে। জামা-প্যান্ট ছিড়েটিড়ে গেছে। কিন্তু কী আর করা যাবে।

    বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। একটু পরেই রাঁচীর বাস এসে ধর্মাকে তুলে নিয়ে গেল।

    শেষ রাতে রাঁচীর হোটেলে গিয়ে টিরকেকে জাগায় ধর্মা। তার অবস্থা দেখে টিরকে ভয় পেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি হোটেল-এর মেডিক্যাল অফিসারের নিদ ভাঙিয়ে ধর্মার হাতে-পায়ে-বুকে ব্যাণ্ডেজ করিয়ে দেয়।

    তারপর তাকে নিয়ে যায় আমরিকী সাহেবের কাছে। সাহেব সব দেখেশুনে এবং দুটোর জায়গায় তিনটে চিতার বাচ্চা পাওয়ায় দারুণ খুশি হয়ে ধর্মাকে ছশো টাকা বখশিসও করে। টিরকে কথামতো দাম আগেই চুকিয়ে দিয়েছিল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইতিহাসের গল্প – প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
    Next Article পাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }