Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আদর্শ হিন্দু-হোটেল

    আদর্শ হিন্দু-হোটেল – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় Adarsha Hindu Hotel
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প252 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৭

    দিন দুই পরে একদিন সকালে পদ্মঝি বলিল–ও ঠাকুর, শুনে রাখো, আজ কোথাও যেও না সব ছুটির পরে। আজ ও-বেলা সত্যনারায়ণের সিন্নি–খদ্দেরদের ভাত দেবার সময় বলে দিও ও-বেলা যেন থাকে–আর তোমরা খেয়ে-দেয়ে আমার সঙ্গে বেরুবে সত্যনারায়ণের বাজার করতে।

    বংশী ঠাকুর হাজারির দিকে চাহিয়া হাসিল–অবশ্য পদ্মঝি চলিয়া গেলে।

    ব্যাপারটা এই, হোটেলের এই যে সত্যনারায়ণের পূজা, ইহা ইহাদের একটি ব্যবসা। যাহারা মাসিক হিসাবে হোটেলে খায় তাহাদের নিকট হইতে পূজার নাম করিয়া চাঁদা বা প্রণামী আদায় হয়। আদায়ী টাকার সব অংশ ব্যয় করা হয় না বলিয়াই হাজারি বা বংশীর ধারণা। অথচ, সত্যনারায়ণের প্রসাদের লোভ দেখাইয়া দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা তাহাদেরও রাত্রে আনিবার চেষ্টা করা হয়–কারণ এমন অনেক নগদ খরিদ্দার আছে, যাহারা একবেলা হোটেলে খাইয়া যায়, দু-বেলা আসে না।

    বংশী ঠাকুর পরিবেশনের সময় প্রত্যেক ঠিকা খরিদ্দারকে মোলায়েম হাসি হাসিয়া বলিতে লাগি—আজ্ঞে বাবু, ও-বেলা সত্যনারাণ হবে হোটেলে, আসবেন ও-বেলা–অবিশ্যি করে আসবেন–

    বাহিরে গদির ধরে বেচু চক্কত্তিও খরিদ্দারদিগকে ঠিক অমনি বলিতে লাগিল।

    বংশী ঠাকুর হাজারিকে আড়ালে বলিল–সব ফাঁকির কাজ, এক চিলতে কলার পাতার আগায় এক হাত করে গুড় গোলা আটা আর তার ওপর দুখানা বাতাসা–হয়ে গেল এর নাম তোমার সত্যনারাণের সিন্নি। চামার কোথাকার–

    সন্ধ্যার সময় পূর্ণ ভটচাজ সত্যনারায়ণের পূজা করিতে আসিলেন। বাসনের ঘরে সত্য নারায়ণের পিঁড়ি পাতা হইয়াছে। হোটেলের দুই চার মিলিয়া ঘড়ি ও কাঁসর পিটাইতেছে, পদ্মঝি ঘন ঘন শাঁকে ফুঁ পাড়িতেছে–খানিকটা খরিদ্দার আকৃষ্ট করিবার চেষ্টাতেও বটে।

    স্টেশনে যে চাকর ‘হি-ই-ই-ন্দু হো-টে-ল-ল’ বলিয়া চেঁচায়, তাহাকেও বলিয়া দেওয়া হইয়াছে, সে যাত্রীদের প্রত্যেককে বলিতেছে–‘আসুন বাবু, সিমি পেশাদ হচ্চেন হোটেলে, খাওয়ার বড্ড জুৎ আজগে–আসুন বাবু–’

    যাহারা নগদ পয়সার খরিদ্দার, তাহারা ভাবিতেছে–অন্য হোটেলেও তো পয়সা দিয়া খাইবে যখন তখন সত্যনারায়ণের প্রসাদ ফাউ যদি পাওয়া যায়, বেচু চকত্তির হোটেলেই যাওয়া যাক না কেন। ফলে যদু বাঁড়ুয্যের হোটেলের দৈনিক নগদ খরিদ্দার যাহারা, তাহারাও অনেকে আসিয়া জুটিতেছে এই হোটেলে। এদিকে নগদ খরিদ্দারদের জন্য ব্যবস্থা এই যে, তাহাদের সিন্নি খাইতে দেওয়া হইবে ভাতের পাতে অর্থাৎ টিকিট কিনিয়া ভাত খাইতে ঢুকিলে তবে। নতুবা সিন্নিটুকু খাইয়া লইয়াই যদি খরিদ্দার পালায়?

    মাসিক খরিদ্দারের জন্য অন্য প্রকার ব্যবস্থা। তাঁহারা চাঁদা দিয়াছে, বিশেষতঃ তাহাদের খাতির করাও দরকার। পূজা সাঙ্গ হইলে তাহাদের সকলকে একত্র বসাইয়া প্রাসাদ খাইতে দেওয়া হইল–বেচু চক্কত্তি নিজে প্রত্যেকের কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন তাহারা আর একটু করিয়া প্রসাদ লইবে কি না।

    যখন ওদিকে মাসিক খরিদ্দাগণকে সিন্নি বিতরণ করা হইতেছে, সে সময় হাজারি দেখিল রাস্তার উপর যতীন মজুমদার দাঁড়াইয়া হাঁ করিয়া তাহাদের হোটেলের দিকে চাহিয়া আছে। সেই যতীন…

    হাজারির মনে হইল লোকটার অবস্থা আরও খারাপ হইয়া গিয়াছে, কেমন যেন অনাহার-শীর্ণ চেহারা। সে ডাকিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, কেমন আছেন?

    যতীন মজুমদার অবাক হইয়া বলিল–কে হাজারি নাকি? তুমি আবার কবে এলে এখানে।

    –সে অনেক কথা বলবো এখন। আসুন না—আসুন—

    যতীন ইতস্ততঃ করিয়া রান্নাঘরের পাশে বেড়ার গায়ের দরজা দিয়া হোটেলে ঢুকিয়া রান্নাঘরের দোরে আসিয়া দাঁড়াইল।

    হাজারি দেখিল তাহার পায়ে জুতা নাই, গায়ে অতি মলিন উড়ানি, পরনের ধুতিখানিও তদ্রূপ। আগের চেয়ে রোগাও হইয়া গিয়াছে লোকটা। দারিদ্র্য ও অভাবের ছাপ চোখে মুখে বেশ পরিস্ফূট।

     যতীন কাষ্ঠহাসি হাসিয়া বলিল–আরে, তোমাদের এখানে বুঝি সত্যনারায়ণ হচ্চে আজগে? আগে আমিও কত এসেছি খেয়েছি–

    –তা খাবেন না? আপনি তো ছিলেন বারোমাসের বাঁধা খদ্দের–তা আসুন পেরসাদ খেয়ে যান–

    যতীন ভদ্ৰতা করিয়া বলিল–না না, থাক থাক–তার জন্যে আর কি হয়েচে–

    হাজারি একবার এদিক ওদিক চাহিয়া দেখিল কেহ কোনোদিকে নাই। সবাই খাবার ঘরে মাসিক খরিদ্দারের আদর আপ্যায়ন করিতে ব্যস্ত–সে কলার পাত পাতিয়া যতীনকে বসাইল এবং পাশে বাসনের ঘর হইতে বড় বাটির একবাটি সত্যনারায়ণের সিন্নি, একমুঠা বাতাসা ও দুটি পাকা কলা আনিয়া যতীনের পাতে দিয়া বলিল–একটু পেরসাদ খেয়ে নিন–

    যতীন মজুমদার দ্বিরুক্তি না করিয়া সিন্নির সহিত কলাদুটি চটকাইয়া মাখিয়া লইয়া যেভাবে গোগ্রাসে গিলিতে লাগিল, তাহাতে হাজারিরও মনে হইল লোকটা সত্যই যথেষ্ট ক্ষুধার্ত ছিল, বোধ হয় ওবেলা আহার জোটে নাই। তিন চার গ্রাসে অতখানি সিন্নি সে নিঃশেষে উড়াইয়া দিল।

    হাজারি বলিল–আর একটু নেবেন?

    যতীন পূর্বের মত ভদ্রতার সুরে বলিল–না না, থাক থাক আর কেন–

    হাজারি আরও এক বাটি সিন্নি আনিয়া পাতে ঢালিয়া দিতে যতীনের মুখচোখ যেন উজ্জল হইয়া উঠিল।

    তাহার খাওয়া অর্ধেক হয়েছে এমন সময় পদ্মঝি রান্নাঘরের দোরে আসিয়া হাজারিকে কি একটা বলতে গেল এবং গোগ্রাসে ভোজনরত যতীন মজুমদারকে দেখিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইল বলিল–ও কে?

    হাজারি হাসিয়া বলিল–ও যতীনবাবু, চিনতে পাচ্ছ না পদ্মদিদি? আমাদের পুরোনো বাবু। যাচ্ছিলেন রাস্তা দিয়ে, তা আমি বল্লাম আজ পুজোর দিনটা একটু পেরসাদ পেয়ে যান বাবু–

    পদ্মঝি বলিল—বেশ–বলিয়াই সে ফিরিয়া আবার গিয়া মাসিক খরিদ্দারদের খাবার ঘরে ঢুকিল।

    যতীন ততক্ষণ পদ্মঝিকে কি একটা কথা বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু সে কথা বলিবার সুযোগ ঘটিল না তাহার। সে খাওয়া শেষ করিয়া এক ঘটি জল চাহিয়া লইয়া খাইয়া চোরের মত খিড়কি দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল।

    অল্পক্ষণ পরেই গোবরা চাকর আসিয়া বলিল–ঠাকুর, কৰ্ত্তা তোমাকে ডাকছেন—

    হাজারি বুঝিয়াছিল কর্তা কি জন্য তাহাকে জরুরী তলব দিয়াছেন। সে গিয়া বুঝিল তাহার অনুমান সত্য–কারণ পদ্মঝি মুখ ভার করিয়া গদির ঘরে বেচু চক্কত্তির সামনে দাঁড়াইয়া। বেচু চক্কত্তি বললেন–হাজারি, তুমি যতনেটাকে হোটেলে ঢুকিয়ে তাকে বসিয়ে সিন্নি খাওয়াচ্ছিলে?

    পদ্মঝি হাত নাড়িয়া বলিল–আর খাওয়ানো বলে খাওয়ানো! এক এক গামলা সিন্নি দিয়েছে তার পাতে–ইচ্ছে ছিল নুকিয়ে খাওয়াবে, ধর্মের ঢাক বাতাসে নড়ে, আমি গিয়ে পড়েছি সেই সময় বড় ডেক নামলো কি না তাই দেখতে–আমায় দেখে–

    হাজারি বিনীত ভাবে বলিল–সত্যনারাণের পেশাদ বলেই বাবু দিয়েছিলাম–আমাদের পুরোনো খদ্দের–

    বেচু চক্কত্তি দাঁত খিঁচাইয়া বলিলেন–পুরোনো খদ্দের? ভারি আমার পুরোনো খদ্দের রে? হোটেলের একটি মুঠো টাকা ফাঁকি দিয়ে চলে গিয়েছে, ভারি খদ্দের আমার! চার মাস বিনি পয়সায় খেয়ে গেল একটি আধলা উপুড়-হাত করলে না, পয়লা নম্বরের জুয়াচার কোথাকার-খদ্দের! তুমি কার হুকুমে তাকে হোটেলে ঢুকতে দিলে শুনি?

    পদ্মঝি বলিল–আমি কোনো কথা বল্লেই তো পদ্ম বড় মন্দ। এই হাজারি ঠাকুর কি কম শয়তান নাকি–বাবু? আপনি জানেন না সব কথা, সব কথা আপনার কানে তুলতেও আমার ইচ্ছে করে না। নুকিয়ে নুকিয়ে হোটেলের আদ্ধেক জিনিস ওঠে ওর এয়ার বকশীদের বাড়ী। যতনে ঠাকুর ওর এয়ার, বুঝলেন না আপনি? বহাল করেন লোক, তখন আমি কেউ নই– কিন্তু হাতে হাতে ধরে দেবার বেলা এই জনা না হোলেও দেখি চলে না–এই দেখুন আবার চুরি-চামারি শুরু যদি না হয় হোটেলে, তবে আমার নাম–

    বেচু চক্কত্তি বলিলেন–এটা তোমার নিজের হোটেল নয় যে তুমি হাজারি ঠাকুর এখানে যা খুশি করবে। নিজের মত এখানে খাটালে চলবে না জেনো। তোমার আট আনা জরিমানা হোল।

    হাজারি বলিল–বেশ বাবু, আপনার বিচারে যদি তাই হয়, করুন জরিমানা। তবে যতীন বাবু আমার এয়ারও নয় বা সে সব কিছুই নয়। এই হোটেলেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ–ওঁকে দেখিনিও কতদিন। পদ্মদিদি অনেক অনেয্য কথা লাগায় আপনার কাছে–আমি আসছে মাস থেকে আর এখানে চাকরি করবো না।

    পদ্মঝি এ কথায় অনর্থ বাধাইল। হাত পা নাড়িয়া চীৎকার করিয়া বলিল–লাগায়? লাগায় তোমার নামে? তুমি যে বড় লাগাবার যুগ্যি লোক। তাই পদ্ম লাগিয়ে লাগিয়ে বেড়াচ্ছে তোমার নামে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। তোমার মত লোককে পদ্ম গেরায্যির মধ্যে আনে না তা তুমি ভাল করে বুঝো ঠাকুর। যাও না, তুমি আজই চলে যাও। সামনের মাসে কেন, মাইনেপত্তর চুকিয়ে আজই বিদেয় হও না–তোমার মত ঠাকুর রেল-বাজারে গণ্ডায় গণ্ডায় মিলবে–

    বেচু চক্কত্তি বলিলেন–চুপ চুপ পদ্ম, চুপ করো। খদ্দেরপত্র আসচে যাচ্চে, ওকথা এখন থাক। পরে হবে–আচ্ছা তুমি যাও এখন হাজারি ঠাকুর–

    অনেক রাতে হোটেলের কাজ মিটিল।

    শুইবার সময় হাজারি বংশীকে বলিল–দেখলে তো কি রকম অপমানটা আমার করলে পলদিদি? তুমিও ছাড়, চল দুজনে বেরিয়ে যাই। দ্যাখো একটা কথা বংশী, এই হোটেলের ওপর কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিল, মুখে বলি বটে যাই যাই–কিন্তু যেতে মন সরে না। কতকাল ধরে তুমি আর আমি এখানে আছি ভেবে দ্যাখো তো? এ যেন আপনার ঘর বাড়ী হয়ে গিয়েছে–তাই না? কিন্তু এরা–বিশেষ করে পদ্মদিদি এখানে টিকতে দিলে না–এবার সত্যিই যাবো।

    বংশী বলিল–ষতীনকে তুমি ডেকে দিলে না ও আপনি এসেছিল?

    –আমি ডেকেছিলাম। ওর অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েচে, আজকাল খেতেই পায় না। তাই ডাকলাম। বলি পুরোনো খদ্দের তো, কত লোক খেয়ে যাচ্চে, ও একটু সিন্নি খেয়ে যাক। এই তো আমার অপরাধ।

    .

    পরের মাসের শুভ পয়লা তারিখে রেলবাজারে গোপাল ঘোষের তামাকের দোকানের পাশেই নূতন হোটেলটা খুলিল! টিনের সাইনবোর্ড লেখা আছে—

    আদর্শ হিন্দু-হোটেল 
    হাজারি ঠাকুর নিজের হাতে রান্না করিয়া থাকেন।
    ভাত, ডাল, মাছ, মাংস সব রকম প্রস্তুত থাকে।
    পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সস্তা।
    আসুন! দেখুন!! পরীক্ষা করুন!!!

    বেচু চক্কত্তির হোটেলের অনুকরণে সামনেই গদির ঘর। সেখানে বংশী ঠাকুরের ভাগ্নে সেই ছেলেটি কাঠের বাক্সের উপর খাতা ফেলিয়া খরিদ্দারগণের আনাগোনার হিসাব রাখিতেছে। ভিতরে রান্না করিতেছে বংশী ও হাজারি–বেচু চক্কত্তির হোটেলের মতই তিনটি শ্রেণী করা হইয়াছে, সেই রকম টিকিট কিনিয়া ঢুকিতে হয়।

    তা নিতান্ত মন্দ নয়। খুলিবার দিন দুপুরের খরিদ্দার হইল ভালই! বংশী খাইবার ঘরে ভাত দিতে আসিয়া ফিরিয়া গিয়া হাজারিকে বলিল–থাড কেলাস ত্রিশ খানা। প্রথম দিনের পক্কে যথেষ্ট হয়েছে। ওবেলা মাংস লাগিয়ে দাও।

    বহুদিনের বাসনা ঠাকুর রাধাবল্লভ পূর্ণ করিয়াছেন। হাজারি এখন হোটেলের মালিক। বেচু চক্কত্তির সমান দরের লোক সে আজ। অত্যন্ত ইচ্ছা হইল, যত জানাশোনা পরিচিত লোক যে যেখানে আছে–সকলকেই কথাটা বলিয়া বেড়ায়। মনের আনন্দ চাপিতে না পারিয়া বৈকালে কুসুমের বাড়ী গিয়া হাজির হইল। কুসুম বলিল–কেমন চললো হোটেল জ্যাঠামশায়?

    –বেশ খদ্দের পাচ্চি। আমার বড্ড ইচ্ছে তুমি একবার এসে দেখে যাও–তুমি তো অংশীদার–

    –যাবো এখন। কাল সকালে যাবে। আপনার মনিব কি বল্লে?

    –রেগে কাই। ও মাসের মাইনে দেয় নি–না দিকগে, সত্যিই বলচি কুসুম মা, আমার বয়েস কে বলে আটচল্লিশ হয়েচে? আমার যেন মনে হচ্চে আমার বয়েস পনের বছর কমে গিয়েচে। হাতপায়ে বল এসেচে কত! তুমি আর আমার অতসী মা–তোমরা আর জন্মে আমার কি ছিলে জানিনে—তোমাদের–

    কুসুম বাধা দিয়া বলিল–আবার ওই সব কথা বলছেন জ্যাঠামশায়? আমার টাকা দিইচি সুদ পাবো বলে। এ তো ব্যবসায় টাকা ফেলা–টাকা কি তোরঙ্গের মধ্যে থেকে আমার স্বগগে পিদিম দিতো? বলি নি আমি আপনাকে? তবে হ্যাঁ, আমাদের বাবুর মেয়ের কথা যা বল্লেন, সে দিয়েছে বটে কোন খাঁই না করে। তার কথা, হাজার বার বলতে পারেন। তার বিয়ের কি হোল?

    –সামনের সোমবার বিয়ে। চিঠি পেয়েছি–যাচ্ছি ওদিন সকালে।

    –আমার কাকার সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে এসব টাকাকড়ির কথা যেন বলবেন না সেখানে।

    –তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে না মা, যতবার দেখা হয়েচে তোমার নামটি পর্যন্ত কখনো সেখানে ঘূণাক্ষরে করি নি। আমারও বাড়ী এঁড়োশোলা, আমায় তোমার কিছু শেখাতে হবে না।

    কথামত পরদিন সকালে কুসুম হোটেল দেখতে গেল। সে দুধ দই লইয়া অনেক বেলা পৰ্য্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় বেড়ায়– তাহার পক্ষে ইহা আশ্চর্যের কথা কিছুই নহে।

    হাজারি তাহাকে রান্নাঘরে যত্ন করিয়া বসাইতে গেল–সে কিন্তু দোরের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল, বলিল–আমি গুরুঠাকরুন কিছু আসি নি যে আসন পেতে যত্ন করে বসাতে হবে।

    হাজারি বলিল–তোমারও তো হোটেল কুসুম-মা–তুমি এর অংশীদারও বটে, মহাজনও বটে। নিজের জিনিস ভাল করে দেখে শোনো। কি হচ্ছে না হচ্চে তদারক করো–এতে লজ্জা কি? বংশী, চিনে রাখো এ একজন অংশীদার।

    এ কথায় কুসুম খুব খুশি হইল–মুখে তাহার আহ্লাদের চিহ্ন ফুটিয়া উঠিল। এমন একটা হোটেলের সে অংশীদার ও মহাজন–এ একটা নতুন জিনিস তাহার জীবনে। এ ভাবে ব্যাপারটা বোধ হয় ভাবিয়া দেখে নাই। হাজারি বলিল–আজ মাছ রান্না হয়েছে বেশ পাকা রুই। তুমি একটু বোসো মা, মুড়োটা নিয়ে যাও।

    –না না জ্যাঠামশায়।–ওসব আপনাকে বারণ করে দিইচি না! সকলের মুখ বঞ্চিত করে আমি মাছের মুড়ো খাবো–বেশ মজার কথা!

    –আমি তোমার বুড়ো বাবা, তোমাকে খাইয়ে আমার যদি তৃপ্তি হয়, কেন খাবে না বুঝিয়ে দাও।

    হোটেলের চাকর হাঁকিল–থাড কেলাস তিন থালা–-

    হাজারি বলল–খদ্দের আসছে বোসো মা একটু। আমি আসছি, বংশী ভাত বেড়ে ফেলো।

    আসিবার সময় কুসুম সলজ্জ সঙ্কোচের সহিত হাজারির দেওয়া এক কাঁসি মাছ তরকারি লইয়া আসিল।

    .

    এক বছর কাটিয়া গিয়াছে।

    হাজারি এঁডোশোলা হইতে গরুর গাড়ীতে রাণাঘাট ফিরিতেছে, সঙ্গে টেঁপির মা, টেঁপি ও ছেলেমেয়ে। তাহার হোটেলের কাজ আজকাল খুব বাড়িয়া গিয়াছে। রাণাঘাটে বাসা না করিলে আর চলে না।

    টেঁপির মা বলিল–আর কতটা আছে হ্যাঁ গা?

    –ওই তো সেগুন বাগান দেখা দিয়েছে–এইবার পৌঁছে যাবো

    টেঁপি বলিল–বাবা, সেখানে নাইবো কোথায়? পুকুর আছে না গাঙ?

    –গাঙ আছে, বাসায় টিউব কল আছে।

    টেঁপির মা বলিল–তাহোলে জল টানতে হবে না পুকুর থেকে। বেঁচে যাই–

    ইহারা কখনো শহরে আসে নাই–টেঁপির মার বাপের বাড়ী এঁডোশোলার দু ক্রোশ উত্তরে মণিরামপুর গ্রামে। জন্ম সেখানে, বিবাহ এঁড়োশোলায়, শহর দেখিবার একবার সুযোগ হইয়াছিল অনেকদিন আগে, অগ্রহায়ণ মাসে গ্রামের য়েদের সঙ্গে একবার নবদ্বীপে রাস দেখিতে গিয়াছিল।

    হোটেলের কাছেই একখানা একতলা বাড়ী পূৰ্ব্ব হইতে ঠিক করা ছিল। টেঁপির মা বাড়ী দেখিয়া খুব খুশি হইল। চিরকাল খড়ের ঘরে বাস করিয়া অভ্যাস, কোঠাঘরে বাস এই তাহার প্রথম।

    –কখানা ঘর গা? রান্নাঘর কোন্ দিকে? কই তোমার সেই টিউকল দেখি? জল বেশ ও তো? ওরে টেঁপি, গাড়ীর কাপড়গুলো আলাদা করে রেখে দে–একপাশে। ও-সব নিয়ে ছিষ্টি ছোঁয়ানেপা করো না যেন, বস্তার মধ্যে থেকে একটা ঘটি আগে বের করে দাও না গো, এক ঘটি জল আগে তুলে নিয়ে আসি।

    একটু পরে কুসুম আসিয়া ঢুকিয়া বলিল–ও জেঠিমা, এলেন সব? বাসা পছন্দ হয়েছে তো?

    টেঁপির মা কুসুমকে চেনে। গ্রামে তাহাকে কুমারী অবস্থা হইতেই দেখিয়াছে। বলিল– এসো মা কুসুম, এসো এসো! ভাল আছ তো? এসো এসো কল্যেণ হোক।

    হোটেলের চাকর রাখাল এই সময় আসিল। তাহার পিছনে মুটের মাথায় এক বস্তা পাথুরে কয়লা। হাজারিকে বলিল–কয়লা কোনদিকে নামাবো বাবু?

    হাজারি বলিল–কয়লা আনলি কেন রে? তোকে যে বলে দিলাম কাঠ আনতে? এর কয়লার আঁচ দিতে জানে না।

    কুসুম বলিল–কয়লার উনুন আছে? আমি আঁচ দিয়ে দিচ্ছি। আর শিখে নিতে তো হবে জেঠিমাকে। কয়লা সস্তা পড়বে কাঠের চেয়ে এ শহর-বাজার জায়গায়। আমি একদিনে শিখিয়ে দেবো জেঠিমাকে।

    রাখাল কয়লা নামাইয়া বলিল–বাবু, আর কি করতে হবে এখন?

    হাজারি বলিল–তুই এখন যাসনে–জলটলগুলো তুলে দিয়ে জিনিসপত্তর গুছিয়ে রেখে তবে যাবি। হোটেলের বাজার এসেছে?

    –এসেছে বাবু।

    –তা থেকে এবেলার মত মাছ-তরকারি চার-পাঁচ জনের মত নিয়ে আয়। ওবেলা আলাদা বাজার করলেই হবে। আগে জল তুলে দে দিকি।

    টেঁপির মা বলিল–ও কে গো?

    –ও আমাদের হোটেলের চাকর। বাসার কাজও ও করবে, বলে দিইছি।

    টেঁপির মা অবাক হইল। তাহাদের নিজেদের চাকর, সে আবার হাজারিকে ‘বাবু’ সম্বোধন করিতেছে–এ সব ব্যাপার এতই অভিনব যে বিশ্বাস করা শক্ত। গ্রামের মধ্যে তাহারা ছিল অতি গরীব গৃহস্থ, বিবাহ হইয়া পৰ্য্যন্ত বাসন-মাজা, জল-তোলা, ক্ষার-কাঁচা, এমন কি ধান ভানা পর্যন্ত সৰ্বরকম গৃহকৰ্ম্ম সে একা করিয়া আসিয়াছে। মাস চার পাঁচ হইল দুটি সচ্ছল অন্নের মুখ সে দেখিয়া আসিতেছে, নতুবা আগে আগে পেট ভরিয়া দুটি ভাত খাইতে পাওয়াও সব সময় ঘটিত না।

    আর আজ এ কি ঐশ্বর্যের দ্বার হঠাৎ তাহার সম্মুখে উন্মুক্ত হইয়া গেল। কোঠাবাড়ী, চাকর, কলের জল–এ সব স্বপ্ন না সত্য?

    রাখাল আসিয়া বলিল–দেখুন তো মা এই মাছ-তরকারিতে হবে না আর কিছু আনবো?

    বড় বড় পোনা মাছের দাগা দশ-বারো খানা। টেঁপির মা খুশির সহিত বলিল–না বাবা আর আনতে হবে না। রাখো ওখানে।

    –ওগুলো কুটে দিই মা?

    মাছ কুটিয়াও দিতে চায় যে! এ সৌভাগ্যও তাহার অদৃষ্টে ছিল।

    হাজারি বলিল–আগে জল তুলে দে তারপর কুটবি এখন। আগে সব নেয়ে নিই।

    কুসুম কয়লার উনুনে আঁচ দিয়া আসিয়া বলিল–জেঠিমা আপনিও নেয়ে নিন। ততক্ষণ আঁচ ধরে যাক। বেলা প্রায় এগারোটা বাজে। রান্না চড়িয়ে দেবার আর দেরি করবার দরকার কি? আমি এবার যাই।

    টেঁপির মা বলিল–তুমি এখানে এবেলা খাবে কুসুম।

    কুসুম ব্যস্তভাবে বলিল–না না, আপনারা এলেন তেতেপুড়ে এই দুপুরের সময়। এখন কোনোরকমে দুটো ঝোলভাত রেঁধে আপনারা এবেলা খেয়ে নিন–তার মধ্যে আবার আমার খাওয়ার হাংনামায়–

    –কিছু হাংনামা হবে না মা। তুমি না খেয়ে যেতে পারবে না। ভাল বেগুন এনেছি গাঁ থেকে, তোমাদের শহরে তেমন বেগুন মিলবে না–বেগুন পোড়াবো এখন। বাপের বাড়ীর বেগুন খেয়ে যাও আজ। কাল শুটকে যাবে।

     হাজারি স্নান সারিয়া বলিল–আমি একবার হোটেলে চল্লাম। তোমরা রান্না চাপাও। আমি দেখে আসি।

    আধঘণ্টা পরে হাজারি ফিরিয়া দেখিল টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনে উনুনে পরিত্রাহি ফুঁ পাড়িতেছে। আঁচ নামিয়া গিয়াছে, তনও মাছের ঝোল বাকি।

    টেঁপির মা বিপন্নমুখে বলিল–ওগো, এ আবার কি হোল, উনুন যে নিবে আসছে। কি করি এখন?

    কুসুম বাড়ীতে স্নান করিতে গিয়াছে, রাখাল গিয়াছে হোটেলে, কারণ এই সময়টা সেখানে খরিদ্দারের ভিড় অত্যন্ত। এবেলা অন্ততঃ একশত জন খায়। বেচু চক্কত্তি ও যদু বাঁড়ুয্যের হোটেল কানা হইয়া পড়িয়াছে। হাজারি নিজের হাতে রান্না করে, তাহার রান্নার গুণে–রেলবাজারের যত খরিদ্দার সব ঝুঁকিয়াছে তাহার হোটেলে। তিনজন ঠাকুর ও চারিজন চাকরে হিমসিম খাইয়া যায়। ইহারা কেহই কয়লার উনুনে আঁচ দেওয়া দূরের কথা, কয়লার উনুনই দেখে নাই। আঁচ কমিয়া যাইতে বিষম বিপদে পড়িয়া গিয়াছে। ইহাদের অবস্থা দেখিয়া হাজারির হাসি পাইল। বলিল-শেখো, পাড়াগেঁয়ে ভূত হয়ে কতকাল থাকবে? সরে দিকি? ওর ওপর আর চাট্টি কয়লা দিতে হয়–এই দেখিয়ে দিই।

    টেঁপির মা বলিল–আর তুমি বড্ড শহুরে মানুষ! তবুও যদি এঁডোশোলা বাড়ী না হোত!

    –আমি? আমি আজ সাত বছর এই রাণাঘাটের রেলবাজারে আছি। আমাকে পাড়াগেঁয়ে বলবে কে? ওকথা তুলে রাখোগে ছিকেয়।

    টেঁপি বলিল–বাবা এখানে টকি আছে? তুমি দেখেছ?

    হাজারি বিশ হাত জলে পড়িয়া গেল। টকি বাইস্কোপ এখানে আছে বটে কিন্তু বাইস্কোপ দেখার শখ কখনও তাহার হয় নাই। কিন্তু টেঁপি আধুনিকা, এঁড়োশোলায় থাকিলে কি হয়, বাংলার কোন্ পাড়াগাঁয়ে আধুনিকতার ঢেউ যায় নাই?…বিশেষত অতসী তার বন্ধু…অতসীর কাছে অনেক জিনিস সে শুনিয়াছে বা শিখিয়াছে যাহা তাহার বাবা (মা তো নয়ই) জানেও না।

    টেঁপির মা বলিল–টকি কি গা?

    হাজারি আধুনিক হইবার চেষ্টায় গম্ভীর ভাবে বলিল–ছবিতে কথা কয়, এই। দেখেছি অনেকবার। দেখবো না আর কেন? হুঁ–

    বলিয়া তাচ্ছিল্যের ভাবে সবটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিতে গেল–কিন্তু টেঁপি পরক্ষণেই জিজ্ঞাসা করিল–কি পালা দেখেছিলে বাবা?

    –পালা! তা কি আর মনে আছে। লক্ষণের শক্তিশেল বোধহয়, হাঁ–লক্ষণের শক্তিশেল।

    মনের মধ্যে বহু কষ্টে হাতড়াইয়া ছেলেবেলায় দেখা এক যাত্রার পালার নামটা হাজারি করিয়া দিল। টেঁপি বলিল–লপের শক্তিশেল আবার কি পালার নাম? ওর নাম তো টকি, পালার থাকে না? তাদের নাম আমি শুনেছি অতসীদির কাছে, সে তো

    –হাঁ হাঁ–তুই আর অতসীদি ভারি সব জানিস আর কি! যা–সর দিকি–ওই কয়লার ঝুড়িটা–

    –ও মামাবাবু, খাওয়া-দাওয়া হোল–বলিয়া বংশীর ভাগ্নে সেই সুন্দর ছেলেটি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিতেই টেঁপির মা, পাড়াগেঁয়ে বউ, তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিতে গেল। টেঁপি কিন্তু নবাগত লোকটির দিকে কৌতূহলের দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল।

    হাজারি বলিল–এসো বাবা এসো–ঘোমটা দিচ্ছ কাকে দেখে? ও হোল বংশীর ভাগ্নে। আমার হোটেলে খাতাপত্র রাখে। ছেলেমানুষ–ওকে দেখে আবার ঘোমটা–

    বংশীর ভাগিনেয় আসিয়া টেঁপির মার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল।

    হাজারি মেয়েকে বলিল–তোর নরেন দাদাকে প্রণাম কর টেঁপি। এইটি আমার মেয়ে, বাবা নরেন। ও বেশ লেখাপড়া জানে–সেলাইয়ের কাজটাজ ভাল শিখেছে আমাদের গাঁয়ের বাবুর মেয়ের কাছে।

    টেঁপির হঠাৎ কেমন লজ্জা করিতে লাগিল। ছেলেটি দেখিতে যেমন, এমন চেহারার ছেলে সে কখনো দেখে নাই–কেবল ইহার সঙ্গে খানিকটা তুলনা করা যায় অতসীদি’র বরের। অনেকটা মুখের আদল যেন সেই রকম।

    বংশীর ভাগ্নেও তাহার স্বচ্ছন্দ হৃদ্যতার ভাব হারাইয়া ফেলিয়াছে। চোখ তুলিয়া ভাল করিয়া চাওয়া যেন একটু কষ্টকর হইয়া উঠিতেছে। টেঁপির দিকে তো তেমন চাহিতেই পারিল না।

    হাজারি বলিল–মুর্শিদাবাদের গাড়ী থেকে ক’জন নামলো আজ?

    –নেমেছিল জনদশেক, তার মধ্যে তিনজনকে বেচু চক্কত্তির চাকর একরকম হাত ধরে জোর করেই টেনে নিয়ে গেল। বাকি সাতজন আমরা পেয়েছি–আর বনগাঁর ট্রেন থেকে এসেছিল পাঁচজন।

    –ইস্টিশানে গিয়েছিল কে।

    –ব্রজ ছিল, রাখালও ছিল বনগাঁর গাড়ীর সময়। ব্ৰজ বল্লে বেচু চক্কত্তির চাকরের সঙ্গে খদ্দের নিয়ে তার হাতাহাতি হয়ে যেতো আজ।

    –না না, দরকার নেই বাবা ওসব। হাজার হোক, আমার পুরোনো মনিব। ওদের খেয়েই এতকাল মানুষ–হোটেলের কাজ শিখেছিও ওদের কাছে। শুধু রাঁধতে জানলে তো হোটেল চালানো যায় না বাবা, এ একটা ব্যবসা। কি করে হাট-বাজার করতে হয়, কি করে খদ্দের তুষ্ট করতে হয়, কি করে হিসেবপত্র রাখতে হয়–এও তো জানতে হবে। আমি দু’বছর ওদের ওখানে থেকে কেবল দেখতাম ওরা কি করে চালাচ্ছে। দেখে দেখে শেখা। এখন সব পারি।

     বংশীর ভাগ্নে বলি–আচ্ছা মামীমা, খাওয়া দাওয়া করুন, আমি আসবো এখন ওবেলা।

    হাজারি বালল–তুমি কাল দুপুরে হোটেলে খেও না–বাসাতে খাবে এখানে। বুঝলে?

    বংশীর ভাগ্নে চলিয়া গেলে টেঁপির অনুপস্থিতিতে হাজারি বলিল–কেমন ছেলেটি দেখলে?

    –বেশ ভাল। চমৎকার দেখতে।

    –ওর সঙ্গে টেঁপির বেশ মানায় না?

    –চমৎকার মানায়। তা কি আর হবে। আমাদের অদৃষ্টে কি অমন ছেলে জুটবে?

    –জুটবে না কেন, জুটে আছে। ওকে আনিয়ে রেখেচি হোটেলে তবে কি জন্যে? তোমাদের রাণাঘাটের বাসায় আনলাম তবে কি জন্যে?…টেঁপিকে যেন এখন কিছু–বোঝ তো? কাল ওকে একটু যত্ন-আত্যি করো। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ওর সঙ্গে টেঁপির–তা এখন অনেকটা ভরসা পাচ্ছি। ওর বাপের অবস্থা বেশ ভাল, ছেলেটাও ম্যাট্রিক পাস। বিয়ে দিয়ে হোটেলেই বসিয়ে দেবো–থাক আমার অংশীদার হয়ে। কাজ শিখে নিক–টেঁপিও কাছেই রইল আমাদের–বুঝলে না, অনেক মতলব আছে।

    টেঁপির মা বোকাসোকা মানুষ–অবাক হইয়া স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার কথা শুনিতে লাগিল।

    .

    সন্ধ্যার পরে খবর আসিল স্টেশনে বেচু চক্কত্তির হোটেলের লোকের সঙ্গে হাজারির চাকরে খরিদ্দার লইয়া মারামারি হইয়া গিয়াছে। হাজারির চাকর নাথনি বলিল–বাবু, ওদের হোটেলের চাকর খদ্দেরের হাত ধরে টানাটানি করে– আমাদের খদ্দের, আমাদের হোটেলে আসচে–তার হাত ধরে টানবে আর আমাদের হোটেলের নিন্দে করবে। তাই আমার সঙ্গে হাতাহাতি হয়ে গিয়েছে।

    –খদ্দের কোথায় গেল?

    –খদ্দের সেচে আমাদের এখানে। ওদের হোটেলের লোকের আমাদের ওপর আকচ আছে, আমরাই সব খদ্দের পাই, ওরা পায় না–এই নিয়েই ঝগড়া বাবু। ওদের হোটেলের হয়ে এল বাবু। একটা গাড়ীতেও খদ্দের পায় না।

    রাত আটটার সময়ে হাজারি সবে মাছের ঝোল উনুনে চাপাইয়াছে, এমন সময় বংশী বলিল–হাজারি-দা, জবর খবর আছে। তোমার আগের কর্তা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কেন দেখে এসো গে। বোধ হয় মারামারি নিয়ে–

    –ঝোলটা তুমি দেখো। আমি এসে মাংস চাপাবো–দেখি কি খবর।

    অনেকদিন পরে হাজারি বেচু চক্কত্তির হোটেলের সেই গদির ঘরটিতে গিয়া দাঁড়াইল। সেই পুরোনো দিনের মনের ভাব সেই মুহূর্তেই তাহাকে পাইয়া বসিল যেন ঢুকিবার সঙ্গে সঙ্গেই। যেন সে রাঁধুনী বামুন, বেচু চক্কত্তি আজও মনিব।

    বেচু চক্কত্তি তাহাকে দেখিয়া খাতির করিবার সুরে বলিলেন–আরে এস এস হাজারি এস–এখানে বসো।

    বলিয়া গদির এক পাশে হাত দিয়া ঝাড়িয়া দিলেন, যদিও ঝড়িবার কোন আবশ্যক ছিল না। হাজারি দাঁড়াইয়াই রহিল। বলিল–না বাবু, আমি বসবো না। আমায় ডেকেচেন কেন?

    –এসো, বসোই এসে আগে। বলচি।

    হাজারি জিভ কাটিয়া বলিল–না বাবু, আপনি আমার মনিব ছিলেন এতদিন। আপনার সামনে কি বসতে পারি? বলুন, কি বলবেন–আমি ঠিক আছি।

    হাজারির চোখ আপনা-আপনি খাওয়ার ঘরের দিকে গেল। হোটেলের অবস্থা সত্যই খুব খারাপ হইয়া গিয়াছে। রাত ন’টা বাজে, আগে আগে এসময় খরিদ্দারের ভিড়ে ঘরে জায়গা থাকিত না। আর এখন লোক কই? হোটেলের জলুসও আগের চেয়ে অনেক কমিয়া গিয়াছে।

    বেচু চক্কত্তি বলিলেন–না, বোসো হাজারি। চা খাও, ওরে কাঙালী, চা নিয়ে আয় আমাদের।

    হাজারি তবুও বসিতে চাহিল না। চাকর চা দিয়া গেল, হাজারি আড়ালে গিয়া চা খাইয়া আসিল।

    বেচু চক্কত্তি দেখিয়া শুনিয়া খুব খুশি হইলেন। হাজারির মাথা ঘুরিয়া যায় নাই হঠাৎ অবস্থাপন্ন হইয়া। কারণ অবস্থাপন্ন যে হাজারি হইয়া উঠিয়াছে, তাহা তিনি এতদিন হোটেল চালানোর অভিজ্ঞতা হইতে বেশ বুঝিতে পারেন।

    হাজারি বলিল–বাবু, আমায় কিছু বলচিলেন?

    –হ্যাঁ-বলচিলাম কি জানো, এক জায়গায় ব্যবসা যখন আমাদের তখন তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই তো–তোমার চাকর আজ আমার চাকরকে মেরেছে ইস্টিশনে। এ কেমন কথা?

    এই সময় পদ্মঝি দোরের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। হোটেলের চাকরও আসিল।

    হাজারি বলিল–আমি তো শুনলাম বাবু আপনার চাকরটা আগে আমার চাকরকে মারে। নাথনি খদ্দের নিয়ে আসছিল এমন সময়–

    পদ্মঝি বলিল–হ্যাঁ তাই বৈকি! তোমাদের নাথনি আমাদের খদ্দের ভাগাবার চেষ্টা করে–আমাদের হোটেলে আসছিল খদ্দের, তোমাদের হোটেলে যেতে চায় নি–

    একথা বিশ্বাস করা যেন বেচু চক্কত্তির পক্ষেও শক্ত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন–যাক, ও নিয়ে আর ঝগড়া করে কি হবে হাজারির সঙ্গে। হাজারি তো সেখানে ছিল না, দেখেও নি, তবে তোমায় বল্লাম হাজারি, যাতে আর এমন না হয়–

    হাজারি বলিল–বাবু, বেশ আমি রাজী আছি। আপনার হোটেলের সঙ্গে আমার কোনো বিবাদ করলে চলবে না। আপনি আমার পুরোনো মনিব। আসুন, আমরা গাড়ী ভাগ করে নিই। আপনি যে গাড়ীর সময় ইস্টিশানে চাকর পাঠাবেন, আমার হোটেলের চাকর সে সময় যাবে না।

    বেচু চক্কত্তি বিস্মিত হইলেন। ব্যবসা জিনিসটাই রেষারেষির উপর, আড়াআড়ির উপর চলে–তিনি বেশ ভালই জানেন। মাথার চুল পাকাইয়া ফেলিলেন তিনি এই ব্যবসা করিয়া। এস্থলে হাজারির প্রস্তাব যে কতদূর উদার, তাহা বুঝিতে বেচুর বিলম্ব হইল না। তিনি আমতা আমতা করিয়া বলিলেন–না তা কেন, ইস্টিশান তো আমার একলার নয়–

    –না বাবু, এখন থেকে তাই রইল। মুর্শিদাবাদ আর বনগাঁর গাড়ীর মধ্যে আপনি কি নেবেন বলুন মুর্শিদাবাদ চান, না বনগাঁ চান? আমি সে সময় চাকর পাঠাবো না ইস্টিশানে।

    পদ্মঝি দোর হইতে সরিয়া গেল।

    বেচু চক্কত্তি বলিলেন–তা তুমি যেমন বলো। মুর্শিদাবাদখানাই তবে রাখো আমার। তা আর একটু চা খেয়ে যাবে না?–আচ্ছা, এসো তবে।

    হাজারি মনিবকে প্রণাম করিয়া চলিয়া আসিল।

    পদ্মঝি পুনরায় দোরের কাছে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল—হাঁ বাবু, কি বলে গেল?

    –গাড়ী ভাগ করে নিয়ে গেল। মুর্শিদাবাদখানা আমি রেখেছি। যা কিছু লোক আসে, মুর্শিদাবাদ থেকেই আসে–বনগাঁর গাড়ীতে কটা লোক আসে? লোকটা বোকা, লোক মন্দ নয়। দুষ্টু নয়।

    –আমি আজ সাত বছর দেখে আসছি আমি জানিনে? গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকে, হোটেলের ছাই দেখাশুনো করে। রেঁধেই মরে, মজা লুটচে বংশী আর বংশীর ভাগ্নে। ক্যাশ তার হাতে। আমি সব খবর নিইচি তলায় তলায়। বংশীকে আবার এখানে আনুন বাবু, ও হোটেল এক দিনে ভুস্যিনাশ হয়ে বসে রয়েচে। বংশীকে ভাঙাবার লোক লাগান আপনি–আর ওর ভাগ্নেটাকেও—

    .

    পরদিন দুপুরে বংশীর ভাগ্নে সসঙ্কোচে হাজারির বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিল। হাজারি হোটেল হইতে তাহাকে পাঠাইয়া দিল বটে, কিন্তু নিজে তখন আসিতে পারিল না, অত্যন্ত ভিড় লাগিয়াছে খরিদ্দারের, কারণ সেদিন হাটবার।

    মায়ের আদেশে টেঁপিকে অতিথির সামনে অনেকবার বাহির হইতে হইল। কখনও বা আসন পাতা, কখনও জলের গ্লাসে জল দেওয়া ইত্যাদি। টেঁপি খুব চটপটে চালাকচতুর মেয়ে, অতসীর শিষ্যা–কিন্তু হঠাৎ তাও কেমন যেন একটু লজ্জা করিতে লাগিল এই সুন্দর ছেলেটির সামনে বার বার বাহির হইতে।

    বংশীর ভাগ্নেটিও একটু বিস্মিত হইল। হাজারি-মামারা পাড়াগাঁয়ের লোক সে জানে– অবস্থাও এতদিন বিশেষ ভাল ছিল না। আজই না হয় হোটেলের ব্যবসায়ে দু-পয়সার মুখ দেখিতেছে। কিন্তু হাজারি-মামার মেয়ে তো বেশ দেখিতে, তাহার উপর তার চালচলন ধরন-ধারণ যেন স্কুলে পড়া আধুনিক মেয়েছেলের মত। সে কাপড় গুছাইয়া পরিতে জানে, সাজিতে গুজিতে জানে, তার কথাবার্তার ভঙ্গিটাও বড় চমৎকার।

    তাহার খাওয়া প্রায় শেষ হইয়াছে এমন সময় হাজারি আসিল। বলিল–খাওয়া হয়েছে বাবা, আমি আসতে পারলাম না–আজ আবার ভিড় বড্ড বেশী।

    –ও টেঁপি আমায় একটু তেল দে মা, নেয়ে নিই, আর তোর ঐ দাদার শোওয়ার জায়গা করে দে দিকি–-পাশের ঘরটাতে একটু গড়িয়ে নাও বাবা।

    বংশীর ভাগ্নে গিয়া শুইয়াছে–এমন সময় টেঁপি পান দিতে আসিল। পানের ডিবা নাই, একখানা ছোট রেকাবিতে পান আনিয়াছে। ছেলেটি দেখিল চুন নাই রেকাবিতে। লাজুক মুখে বলিল–একটু চুন দিয়ে যাবেন?

    টেঁপির সারা দেহ লজ্জার আনন্দে কেমন যেন শিহরিয়া উঠিল। তাহার প্রথম কারণ তাহার প্রতি সম্ভ্রমসূচক ক্রিয়াপদের ব্যবহার এই হইল প্রথম। জীবনে ইতিপূর্বে তাহাকে কেহ ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ করিয়া কথা বলে নাই। দ্বিতীয়ত: কোনও অনাত্মীয় তরুণ যুবকও তাহার সহিত ইতিপূৰ্ব্বে কথা বলে নাই। বলে নাই কি একেবারে! গাঁয়ের রামু-দা, গোপাল-দা, জহর-দা-ইহারাও তাহার সঙ্গে তো কথা বলিত! কিন্তু তাহাতে এমন আনন্দ তাহার হয় নাই তো কোনোদিন? চুন আনিয়া রেকাবিতে রাখিয়া বলিল–এতে হবে?

    –খুব হবে। থাক ওখানেই–ইয়ে, এক গেলাস জল দিয়ে যাবেন?

    টেঁপির বেশ লাগিল ছেলেটিকে। কথাবার্তার ধরন যেমন ভাল, গলার সুরটিও তেমনি মিষ্ট। যখন জলের গ্লাস আনিল, তখন ইচ্ছা হইতেছিল ছেলেটি তাহার সঙ্গে আর একবার কিছু বলে। কিন্তু ছেলেটি এবার আর কিছু বলল না। টেঁপি জলের গ্লাস নামাইয়া রাখিয়া চলিয়া গেল।

    বেলা যখন প্রায় পাঁচটা, বৈকাল অনেক দূর গড়াইয়া গিয়াছে –টেঁপি তখন একবার উঁকি মারিয়া দেখিল, ছেলেটি অঘোরে ঘুমাইতেছে।

    হঠাৎ টেঁপির কেমন একটা অহেতুক স্নেহ আসিল ছেলেটির প্রতি।

    আহা, হোটেলে কত রাত পর্যন্ত জাগে। ভাল ঘুম হয় না রাত্রে!

    টেঁপি আসিয়া মাকে বলিল–মা সেই লোকটা এখনও ঘুমুচ্ছে। ডেকে দেবো, না ঘুমুবে।

    টেঁপির মা বলিল–ঘুমুচ্ছে ঘুমুক না। ডাকবার দরকার কি? চাকরটা কোথায় গেল? ঘুম থেকে উঠলে ওকে কিছু খেতে দিতে হবে। খাবার আনতে দিতাম। উনিও তো বাড়ী নেই। 

    টেঁপি বলিল–লোকটা চা খায় কিনা জানিনে, তাহলে ঘুম থেকে উঠলে একটু চা করে দিতে পারলে ভাল হোত।

    টেঁপির মা চা নিজে কখনো খায় নাই, করিতেও জানে না। আধুনিকা মেয়ের এ প্রস্তাব তাহার মন্দ লাগিল না।

     মেয়েকে বলিল–তুই করে দিতে পারবি তো?

    মেয়ে খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল–তুমি যে কি বল মা, হেসে প্রাণ বেরিয়ে যায়– পরে কেমন একটি অপূৰ্ব ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়া নাড়িয়া হাসিভরা মুখের চিবুকখানি বার বার উঠাইয়া-নামাইয়া বলিতে লাগিল–চা কই? চিনি কই? কেটলি কই? চায়ের জল ফুটবে কিসে? ডিস-পেয়ালা কই? সে সব আছে কিছু?

    টেঁপির মায়ের বড় ভাল লাগিল টেঁপির এই ভঙ্গি। সে সস্নেহে মুগ্ধদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। এমন ভাবে এমন সুন্দর ভঙ্গিতে কথা টেঁপি আর কখনও বলে নাই।

    এই সময় হাজারি বাড়ীর মধ্যে ঢুকিল, হোটেলেই ছিল। বলিল–নরেন কোথায়? ঘুমুচ্ছে নাকি?

    টেঁপির মা বলিল–তুমি এতক্ষণ ছিলে কোথায়? ওকে একটু খাবার আনিয়ে দিতে হবে। আর টেঁপি বলছে চা করে দিলে হোত।

    হাজারির বড় স্নেহ হইল টেঁপির উপর। সে না জানিয়া যাহাকে আজ যত্ন করিয়া চা খাওয়াইতে চাহিতেছে, তাহারই সঙ্গে তার বাবা-মা যে বিবাহের ষড়যন্ত্র করিতেছে–বেচারী কি জানে?

    বলিল–আমি সব এনে দিচ্ছি। হোটেলেই আছে। হোটেলে বড় ব্যস্ত আছি, কলকাতা থেকে দশ-বারো জন বাবু এসেছে শিকার করতে। ওর। অনেকদিন আগে একবার এসে আমার রান্না মাংস খেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। সেই আগের হোটেলে গিয়েছিল, সেখানে নেই শুনে খুঁজে খুঁজে এখানে এসেছে। ওরা রাত্রে মাংস আর পোলাও খাবে। তোমরা এবেলা রান্না কোরো না–আমি হোটেল থেকে আলাদা করে পাঠিয়ে দেবো এখন। নরেনকে যে একবার দরকার, বাবুদের সঙ্গে ইংরিজিতে কথাবার্তা কইতে হবে, সে তো আমি পারবো না, নরেনকে ওঠাই দাঁড়াও–

    টেঁপির মা বলিল–ঘুম থেকে উঠিয়ে কিছু না খাইয়ে ছাড়া ভাল দেখায় না। টেঁপি চায়ের কথা বলচিল–তা হোলে সেগুলো আগে পাঠিয়ে দেওগে, এখন জাগিও না।

    .

    বৈকালের দিকে নরেন ঘুম ভাঙিয়া উঠিল। অত্যন্ত বেলা গিয়াছে, পাঁচিলের ধারে সজনে গাছটার গায়ে রোদ হলদে হইয়া আসিয়াছে। নরেনের লজ্জা হইল– পরের বাড়ী কি ঘুমটাই ঘুমাইয়াছে। কে কি–বিশেষ করিয়া হাজারি-মামার মেয়েটি কি মনে করিল। বেশ মেয়েটি। হাজারি-মামার মেয়ে যে এমন চালাক-চতুর, চটপটে, এমন দেখিতে, এমন কাপড়-চোপড় পরিতে জানে তাহা কে ভাবিয়া ছিল?

    অপ্রতিভ মুখে সে গায়ে জামা পরিয়া বাহির হইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় টেঁপি আসিয়া বলিল–আপনি উঠেছেন? মুখ ধোবার জল দেবো?

    নরেন থতমত খাইয়া বলিল–না, না, থাক আমি হোটেলেই–

    –মা বললে আপনি চা খেয়ে যাবেন, আমি মাকে বলে আসি—

    ইতিমধ্যে হাজারি চায়ের আসবাব হোটেলের চাকর দিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল, টেঁপি নিজেই চা করিতে বসিয়া গেল। তাহার মা জলখাবারের জন্য ফল কাটিতে লাগিল।

    টেঁপি বলিল–মা চায়ের সঙ্গে শসা-টসা দেয় না। তুমি বরং ঐ নিমকি আর রসগোল্লা দাও রেকাবিতে–

    –শসা দেয় না? একটা ডাব কাটবো? বাড়ীর ভাব আছে—

    টেঁপি হাসিতে হাসিতে গড়াইয়া পড়ে আর কি। মুখে আঁচল চাপা দিয়া বলিল–হি হি, তুমি মা যে কি!…চায়ের সঙ্গে বুঝি ডাব খায়?

    টেঁপির মা অপ্রসন্ন মুখে বলিল–কি জানি তোদের একেলে ঢং কিছু বুঝিনে বাপু। যা বোঝো তাই করো। ঘুম থেকে উঠলে তো নতুন জামাইদের ডাব দিতে দেখেছি চিরকাল দেশেঘরে-

    কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই টেঁপির মা মনে মনে জিভ কাটিয়া চুপ করিয়া গেল। মানুষটা একটু বোকা ধরনের, কি ভাবিয়া কি বলে, সব সময় তলাইয়া দেখিতে জানে না।

    টেঁপি আশ্চর্য্য হইয়া বলিল–নতুন জামাই? কে নতুন জামাই?

    –ও কিছু না; দেশে দেখেছি তাই বলচি। তুই নে, চা করা হোল?

    টেঁপির মনে কেমন যেন খটকা লাগিল। সে খুব বুদ্ধিমতী, তাহার উপর নিতান্ত ছেলে মানুষটিও নয়, যখন চা ও খাবার লইয়া পুনরায় ছেলেটির সামনে গেল তখন তাহার কি জানি কেন যে লজ্জা করিতেছে তাহা সে নিজেই ভাল ধরিতে পারিল না।

    ছেলেটি তাহাকে দেখিয়া বলিল–ও কি! এই এত খাবার কেন এখন, চা একটু হোলেই–

    টেঁপি কোনো রকমে খাবারের রেকাবি লোকটার সামনে রাখিয়া পলাইয়া আসিলে যেন বাঁচে।

    ছেলেটি ডাকিয়া বলিল–পান একটা যদি দিয়ে যান—

    পান সাজিতে বসিয়া টেঁপি ভাবিল–বাবা খাটিয়ে মারলে আমায়! চা দেও–পান সাজো–আমার যেন যত গরজ পড়েছে, বাবার হোটেলের লোক তা আমার কি?

    টেঁপি একটা চায়ের পিরিচে পান রাখিয়া দিতে গেল। ছেলেটি দেখিতে বেশ কিন্তু। কথাবার্তা বেশ, হাসি-হাসি মুখ। কি কাজ করে হোটেলে কে জানে?

    পান লইয়া ছেলেটি চলিয়া গেল। যাইবার সময় বলিয়া গেল–মামীমা আমি যাচ্ছি, কষ্ট দিয়ে গেলাম অনেক, কিছু মনে করবেন না। এত ঘুমিয়েছি, বেলা আর নেই আজ।

    বেশ ছেলেটি।

    নতুন জামাই? কে নতুন জামাই? কাহাদের নতুন জামাই?

    মা এক-একটা কথা বলে কি যে, তার মানে হয় না।

    .

    টেঁপির মা কখনও এত বড় শহর দেখে নাই।

    এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখিয়া সে অবাক হইয়া গিয়াছে। মোটর গাড়ী, ঘোড়ার গাড়ী, ইস্টিশানে বিদ্যুতের আলো, লোকজনই বা কত! আর তাদের এঁড়োশোলায় দিনমানেই শেয়াল তাকে বাড়ীর পিছনকার ঘন বাঁশবনে। সেদিন তো দিনদুপুরে জেলেপাড়ার কেষ্ট জেলের তিন মাসের ছেলেকে শেয়ালে লইয়া গেল।

    ইতিমধ্যে কুসুম আসিয়া একদিন উহাদের বেড়াইতে লইয়া গেল। কুসুমের সঙ্গে তাহার রাধাবল্পভতলা, সিদ্ধেশ্বরীতলা, চূর্ণীর ঘাট, পালচৌধুরীদের বাড়ী–সব ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিল। পালচৌধুরীদের প্রকাণ্ড বাড়ী দেখিয়া টেঁপির মা ও টেঁপি দু-জনেই অবাক। এত বড় বাড়ী জীবনে তাহারা দেখে নাই। অতসীদের বাড়ীটাই এতদিন বড়লোকের বাড়ীর চরম নিদর্শন বলিয়া ভাবিয়া আসিয়াছে যাহারা, তাহাদের পক্ষে অবাক হইবার কথা বটে।

    টেঁপির মা বলিল–না, শহর জায়গা বটে কুসুম! গায়ে গায়ে বাড়ী আর সব কোঠাবাড়ী এদেশে। সবাই বড়লোক। ছেলেমেয়েদের কি চেহারা, দেখে চোখ জুড়ায়। হাঁরে, এদের বাড়ী ঠাকুর হয় না? পুজোর সময় একদিন আমাদের এনো মা, ঠাকুর দেখে যাবো।

    সে আর ইহার বেশী কিছুই বোঝে না।

    একটা বাড়ীর সামনে কত কি বড় বড় ছবি টাঙানো, লোকজন ঢুকিতেছে, রাস্তার ধারে কি কাগজ বিলি করিতেছে। টেঁপির মনে হইল এই বোধ হয় সেই টকি যাকে বলে, তাহাই। কুসুমকে বলিল–কুসুম দি, এই টকি না?

    –হ্যাঁ দিদি। একদিন দেখবে?

    -–এক দিন এনো না আমাদের। মা-ও কখনো দেখে নি–সবাই আসবো।

    একখানা ধাবমান মোটর গাড়ীর দিকে টেঁপির মা হাঁ করিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল, যতক্ষণ সেখানা রাস্তার মোড় ঘুরিয়া অদৃশ্য না হইয়া গেল।

    কুসুম বলিল–আমার বাড়ী একটু পায়ের ধূলো দিন এবার জ্যাঠাইমা

    কুসুমের বাড়ী যাইতে পথের ধারে রেলের লাইন পড়ে। টেঁপির মা বলিল–কুসুম, দাঁড়া মা একখানা রেলের গাড়ী দেখে যাই–

    বলিতে বলিতে একখানা প্রকাণ্ড-মালগাড়ী আসিয়া হাজির। টেঁপি ও টেঁপির মা দুজনেই একদৃষ্টে দেখিতে লাগিল। গাড়ী চলিয়াছে তো চলিয়াছে–তাহার আর শেষ নাই।

    উঃ, কি বড় গাড়ীটা!

    কুসুম বলিল–জ্যাঠাইমা, রাণাঘাট ভাল লাগছে?

    -লাগচে বৈকি, বেশ জায়গা মা।

    আসলে কিন্তু এঁড়োশোলার জন্য টেঁপির মায়ের মন কেমন করে। শহরে নিজেকে সে এখনও খাপ খাওয়াইতে পারে নাই। সেখানকার তালপুকুরের ঘাট, সদা বোষ্টমের বাড়ীর পাশ দিয়া যে ছোট নিভৃত পথটি বাঁশবনের মধ্য দিয়া বাঁড়ুয্যে-পাড়ার দিকে গিয়াছে, দুপুর বেলা তাহাদের বাড়ীর কাছে বড় শিরীষ গাছটায় এই সময় শিরীষের সুঁটি শুকাইয়া ঝুন ঝুন শব্দ করে, তাহাদের উঠানের বড় লাউমাচায় এতদিন কত লাউ ফলিয়াছে, পেঁপে গাছটায় কত পেঁপের ফুল ও জালি দেখিয়া আসিয়াছিল–সে সবের জন্য মন কেমন করে বৈকি।

    তবে এখানে যাহা সে পাইয়াছে টেঁপির মা জীবনে সে রকম সুখের মুখ দেখে নাই। চাকরের ওপর হুকুম চালাইয়া কাজ করাইয়া লওয়া, সকলে মানে, খাতির করে–অমন সুন্দর ছেলেটি তাহাদের হোটেলের মূহুরী– এ ধরনের ব্যাপারে কল্পনাও কখনও সে করিয়াছিল?

    কুমের বাড়ী সকলে গিয়া পৌঁছিল। কুসুম ভারি খুশি হইয়া উঠিয়াছে–তাহার বাপের বাড়ী দেশের ব্রাহ্মণ-পরিবারকে এখানে পাইয়া। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া টেঁপির মায়ের পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–আমাদের বড্ড ভাগ্যি মা, আপনাদের চরণ-ধূলো পড়লো এ বাড়ীতে।

    টেঁপির মাকে এত খাতির কবিয়া কেহ কখনো কথা বলে নাই–এত সুখও তাহার কপালে লেখা ছিল! হায় মা ঝিটকিপোতার বনবিবি, কি জাগ্রত দেবতাই তুমি! সেবার ঝিটকিপোতায় চৈত্র মাসে মেলায় গিয়া টেঁপির মা বনবিবিতলায় স-পাঁচ আনার সিন্নি দিয়া স্বামীপুত্রের মঙ্গলকামনা করিয়াছিল, এখনও যে বছর পার হয় নাই! তবুও লোকে ঠাকুর দেবতা মানিতে চায় না।

    কুসুম সকলকে জলযোগ করাইল। পান সাজিয়া দিল। কুসুমের শাশুড়ী আসিয়া কতক্ষণ গল্পগুজব করিল। কুসুম গ্রামের কথাই কেবল শুনিতে চায়। কতদিন বাপের বাড়ী যায় নাই, বাবা-মা মরিয়া গিয়াছে, জ্যাঠামশায় আছে, কাকারা আছে–তাহারা কোনো দিন খোঁজও নেয় না। খোঁজ করিত অবশ্যই, যদি তাহার নিজের অবস্থা ভাল হইত। গরীব লোকের আদর কে করে?…এই সব অনেক দুঃখ কৰিল। আরও কিছুক্ষণ বসিবার পরে কুসুম উহাদের বাসায় পৌঁছিয়া দিয়া গেল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবদাস
    Next Article ব্যবধান

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }