Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আদর্শ হিন্দু-হোটেল

    আদর্শ হিন্দু-হোটেল – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় Adarsha Hindu Hotel
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প252 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৮

    হাজারির হোটেলে রাত্রে এক মজার ব্যাপার ঘটিল সেদিন।

    দশ-পনেরোটি লোক একই সঙ্গে খাইতে বসিয়াছে–হঠাৎ একজন বলিয়া উঠিল–ঠাকুর, এই যে ভাতটা দিলে, এ দেখছি ও বেলার বাসি ভাত।

    বংশী ঠাকুর ভাত দিতেছিল, সে অবাক হইয়া বলিল—আজ্ঞে বাবু সে কি? আমাদের হোটেলে ওরকম পাবেন না। আধ মণ চাল এক-একবেলা রান্না হয়, তাতেই কুলোয় না– বাসি ভাত থাকবে কোথা থেকে?

    –আলবাৎ এ ও-বেলার ভাত। আমি বলচি এ ও-বেলার ভাত–

    গোলমাল শুনিয়া হাজারি আসিয়া বলিল–কি হয়েছে বাবু?…বাসি ভাত? কক্ষনো না। আপনি নতুন লোক, কিন্তু এঁরা যাঁরা খাচ্ছেন তাঁরা আমায় জানেন–আমার হোটেল না চলে না চুলক কিন্তু ওসব পিরবিত্তি ভগবান যেন আমায় না দেন—

    লোকটা তখন তর্কের মোড় ঘুরাইয়া ফেলিল। সে যেন ঝগড়া করিবার জন্যই তৈরী হইয়া আসিয়াছে। পাত হইতে হাত তুলিয়া চোখ গরম করিয়া চীৎকার করিয়া বলিল তবে তুমি কি বলতে চাও আমি মিথ্যে কথা বলছি?

    হাজারি নরম হইয়া বলিল–না বাবু তা তো আমি বলচি না। কিন্তু আপনার ভুলও তো হতে পারে। আমি দিব্যি করে বলচি বাবু, বাসি ভাত আমার হোটেলে থাকে না–

    –থাকে না? বড্ড নবাবী কথা বলছ যে। বাসি ভাত আবার এ বেলা হাঁড়িতে ফেলে দাও না তুমি?

    –না বাবু।

    –পষ্ট দেখতে পাচ্ছি– আবার তবুও না বলছ? দেখবে মজা?

    এই সময়ে নরেন ও হোটেলের আরও দু একজন সেখানে আসিয়া পড়িল। নরেন গরম হইয়া বলিল–কি মজা দেখাবেন আপনি?

    –দেখবে? সরে এসো দেখাচ্ছি–জোচ্চোর সব কোথাকার–

    এই কথায় একটা মহা গোলমাল বাধিয়া গেল। পুরানো খরিদ্দাররা সকলেই হাজারির পক্ষ অবলম্বন করিল। লোকটা রাস্তায় দাঁড়াইয়া চীৎকার করিতে লাগিল–রাস্তার সমবেত জনতার সামনে দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিল–শুনুন মশাই সব বলি। এই এর হোটেলে বাসি ভাত দিয়েছিল খেতে–ধরে ফেলেছি কিনা তাই এখন আবার আমাকে মারতে আসছে–পুলিশ ডাকবো এখুনি–স্যানিটারি দারোগাকে দিয়ে রিপোর্ট করিয়ে তবে ছাড়বো–জোচ্চোর কোথাকার–লোক মারবার মতলব তোমাদের?

    এই সময় হোটেলের চাকর শশী হাজারিকে ডাকিয়া বলিল–বাবু, এই লোকটাকে যেন আমি বেচু চক্কত্তির হোটেলে দেখেছি। সেখানে যে ঝি থাকে, তার সঙ্গে বাজার করে নিয়ে যেতে দেখেছি–

    নরেনের সাহস খুব। সে হোটেলের রোয়াকে দাঁড়াইয়া চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল–মশাই, আপনি বেচু চক্কত্তির হোটেলের পদ্মঝিয়ের কে হন?

    তবুও লোকটা ছাড়ে না। সে হাত-পা নাড়িয়া প্রমাণ করিতে গেল পদ্মঝিয়ের নামও সে কোনোদিন শোনে নাই। কিন্তু তাহার প্রতিবাদের তেজ যেন তখন কমিয়া গিয়াছে।

    কে একজন বলিয়া উঠিল–এইবার মানে মানে সরে পড় বাবা, কেন মার খেয়ে মরবে।

    কিছুক্ষণ পরে লোকটাকে আর দেখা গেল না।

    এই ঘটনার পরে অনেক রাত্রে হাজারি বেচু চক্কত্তির হোটেলে গিয়া হাজির হইল। বেচু চক্কত্তি তহবিল মিলাইতেছিল, হাজারিকে দেখিয়া একটু আশ্চর্য্য হইয়া বলিল–কি, হাজারি যে? এসো এসো। এত রাত্রে কি মনে করে?

    হাজারি বিনীতভাবে বলিল–বাবু, একটা কথা বলতে এলাম।

    –কি–বল?

    –বাবু আপনি আমার অন্নদাতা ছিলেন একসময়ে–আজও আপনাকে তাই বলেই ভাবি। আপনার এখানে কাজ না শিখলে আজ আমি পেটের ভাত করে খেতে পারতাম না। আপনার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা আছে বলে আমি তো ভাবিনে।

    –কেন, কেন, একথা কেন?

    হাজারি সব ব্যাপার খুলিয়া বলিল। পরে হাত জোড় করিয়া বলিল–বাবু, আপনি ব্রাহ্মণ, আমার মনিব। আমাকে এভাবে বিপদে না ফেলে যদি বলেন হাজারি তুমি হোটেল উঠিয়ে দাও, তাই আমি দেবো। আপনি হুকুম করুন–

    বেচু চক্কত্তি আশ্চর্য হইবার ভান করিয়া বলিল–আমি তো এর কোনো খবর রাখিনে– আচ্ছা, তুমি যাও আজ, আমি তদন্ত করে দেখে তোমায় কাল জানাবো। আমাদের কোন লোক তোমার হোটেলে যায় নি এ একেবারে নিশ্চয়। কাল জানতে পারবে তুমি।… তারপর হাজারি চলচে-টলচে ভাল?

    –একরকম আপনার আশীর্বাদে–

    –রোজ কি রকম বিক্রীসিক্রি হচ্ছে? রোজ তবিলে কি রকম থাকে। তুমি কিছু মনে কোরো না–তোমাকে আপনার লোক বলে ভাবি বলেই জিজ্ঞেস করচি।

    –এই বাবু পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ টাকা–ধরুন না কেন আজ রাত্তিরের বিল দেখে এসেছি ছত্রিশ টাকা স’বারো আনা।

    বেচু চক্কত্তি আশ্চর্য্য হইলেন মনে মনে। মুখে বলিলেন–বেশ, বেশ। খুব ভালো–শুনে খুশি হলাম। আচ্ছা, তাহলে এসো আজগে। কাল খবর পাবে।

    হাজারি চলিয়া গেলে বেচু চক্কত্তি পদ্মঝিকে ডাকাইলেন। পদ্ম আসিয়া বলিল–হাজারি ঠাকুরটা এসেছিল নাকি? কি বলচিল?

    বেচু চক্কত্তি বলিলেন –ও পদ্ম, হাজারি যে অবাক করে দিয়ে গেল। রাণাঘাটের বাজারে হোটেল করে পঁয়ত্রিশ টাকা থেকে চল্লিশ টাকা রোজকার দাঁড়া-তবিল, এ তো কখনো শুনি নি। তার মানে বুঝচো? দাঁড়া-তবিলে গড়ে ত্রিশ টাকা থাকলেও সাত-আট টাকা দৈনিক লাভ, ফেলে-ঝেলেও। মাসে হোল আড়াইশো টাকা। দুশো টাকার তো মার নেই–হ্যাঁ পদ্ম?

    পদ্মঝি মুখভঙ্গি করিয়া বলিল–গুল দিয়ে গেল না তো?

    –না, গুল দেবার লোক নয় ও। সাদাসিধে মানুষটা–আমায় বড্ড মানে এখনও। ও গুল দেবে না, অন্তত আমার কাছে। তা ছাড়া দেখছ না রেলবাজারে কোন হোটেলে আর বিক্রী নেই। সব শুষে নিচ্ছে ওই একলা।

    –আজ নৃসিংহ গিয়েছিল বাবু ওর হোটেলে। খুব খানিকটা রাউ করে দিয়েও এসেছে নাকি। খুব চেঁচিয়েছে বাসি ভাত পচা মাছ এই বলে। আর কিছু হোক না হোক লোকে শুনে তো রাখলে?

    –যদু বাঁড়ুয্যেরাও আমায় ডেকে পাঠিয়েছিল, ওর হোটেল ভাঙতেই হবে। নইলে রেলবাজারে কেউ আর টিকবে না। এই কথা যদু বাঁড়ুয্যেও বললে। কিন্তু তাতে কি হবে না–ওর এখন সময় যাচ্ছে ভালো। নৃসিংহ আছে?

    –না বেরিয়ে গেল। পুলিশে সেই যে খবর দেবার কি হোল?

    –দেখ পদ্ম, আমি বলি ওরকম আর পাঠিয়ে দরকার নেই। হাজারি লোকটা ভালো–আজ এসেছিল, এমন হাত জোড় করে নরম হয়ে থাকে যে দেখলে ওর ওপর রাগ থাকে না।

    –খ্যাংরা মারি ওর ভালমানষেতার মুখে–ভিজে বেড়ালটি, মাছ খেতে কিন্তু ঠিক আছে –পুলিশের সেই যে মতলব দিয়েছিল যদুবাবু, তাই তুমি করো এবার। ওর হোটেল না ভাঙলে চলবে না। নয়তো আমাদের পাততাড়ি গুটুতে হবে এই আমি বলে দিলাম–এবেলা তবিল কত?

    বেচু চক্কত্তি অপ্রসন্ন মুখে বলিলেন–মোট ছ’টাকা সাড়ে তিন আনা–

    পদ্মঝি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বলিল–দু’মাসের বাড়ীভাড়া বাকী ওদিকে। কাল বলেছে অন্ততঃ একমাসের ভাড়া না দিলে হৈ চৈ বাধাবে। ভাড়া দেবে কোত্থেকে?

    –দেখি।

    –তারপর কানাই ঠাকুরের মাইনে বাকী পাঁচ মাস। সে বলছে আর কাজ করবে না, তার কি করি?

    –বুঝিয়ে রাখো এই মাসটা। দেখি সামনের মাসে কি রকম হয়—

    পদ্মঝি রান্নাঘরে গিয়া ঠাকুরকে বলিল–আমার ভাতটা বেড়ে দাও ঠাকুর, রাত হয়েছে অনেক, বাড়ী যাই।

    তারপর সে চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। ছন্নছাড়া অবস্থা, ওই বড় দশ সেবী ডেকচিটা আজ তিন-চার মাস তোলা আছে–দরকার হয় না। আগে পিতলের বালতি করিয়া সরিষার তৈল আসিত, এখন আসে ছোট ভাঁড়ে–বালতি দরকার হয় না। এমন দুরবস্থা সে কখনো দেখে নাই হোটেলের।

    তাহার মনটা কেমন করিয়া ওঠে।…

    নানারকমে চেষ্টা করিয়া এই হোটেলটা সে আর কর্তা দুজনে গড়িয়া তুলিয়া ছিল। এই হোটেলের দৌলতে যথেষ্ট একদিন হইয়াছে। ফুলেনবলা গ্রামের যে পাড়ায় তাহার আদি বাস ছিল, সেখানে তার ভাই এখনও আছে– চাষবাস করিয়া খায়–আর সে এই রাণাঘাটের শহরে সোনাদানাও পরিয়া বেড়াইয়াছে একদিন–এই হোটেলের দৌলতে। এই হোটেল তার বুকের পাঁজর। কিন্তু আজ বড় মুশকিলের মধ্যে পড়িতে হইয়াছে। কোথা হইতে এক উনপাঁজুরে গাঁজাখোর আসিয়া জুটিল হোটেলে–হোটেলের সুলুকসন্ধান জানিয়া লইয়া এখন তাহাদেরই শীলনোড়ায় তাহাদেরই দাঁতের গোড়া ভাঙিতেছে। এত যত্নের, এত সাধ-আশার জিনিসটা আজ কোথা হইতে কোথায় দাঁড়াইয়াছে! যাহার জন্য আজ হোটেলের এই দুরবস্থা,–ইচ্ছা হয় সেই কুকুরটার গলা টিপিয়া মারে, যদি বাগে পায়। তাহার উপর আবার দয়া কিসের? কর্তা ওই রকম ভালমানুষ সদাশিব লোক বলিয়াই তো আজ পথের কুকুর সব মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছে।—দয়া!

    .

    একদিন রাণাঘাটের স্টেশন মাস্টার হাজারিকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।

    হাজারি নিজে যাইতে রাজী নয়–কারণ স্টেশন মাস্টার সাহেব, সে জানে। নরেন যাওয়াই ভাল। অবশেষে তাহাকেই যাইতে হইল। নরেন সঙ্গে গেল।

    সাহেব বলিলেন–টোমার নাম হাজারি? হিণ্ডু হোটেল রাখো বাজারে?

    -হ্যাঁ হুজুর।

    –টুমি প্ল্যাটফর্মে কেটার করবে? হিণ্ডু ভাত, ডাল, মাছ, দহি?

    হাজারি নরেনের মুখের দিকে চাহিল। সাহেবের কথা সে বুঝিতে পারিল না। নরেন ব্যাপারটা সাহেবের নিকট ভাল করিয়া বুঝিয়া লইয়া হাজারিকে বুঝাইল। রেলযাত্রীর সুবিধার জন্য রেল কোম্পানী স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা হিন্দু ভাতের হোটেল খুলিতে চায়। সাহেব হাজারির নামডাক শুনিয়া তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছে। আপাততঃ দেড়শো টাকা জমা দিলে উহারা লাইসেন্স মঞ্জুর করিবে এবং রেলের খরচে হোটেলের ঘর বানাইয়া দিবে।

    হাজারি সাহেবের কাছে বলিয়া আসিল সে রাজী আছে।

    স্টেশন মাস্টার নরেনকে একখানা টেণ্ডার ফর্ম দিয়া ঘরগুলি পুরাইয়া হাজারির নাম সই করিয়া আনিতে বলিয়া দিলেন। স্টেশনের এই হোটেল লইয়া তারপর জোর কমপিটিশন চলিল। নৈহাটির এবং কৃষ্ণনগরের দুইজন ভাটিয়া হোটেলওয়ালা টেণ্ডার দিল এবং ওপর ওয়ালা কর্মচারীদের নিকট তদ্বিরতাগাদাও শুরু করিল।

    নিজ রাণাঘাটের বাজারে এ খবরটা কেহ রাখিত না–শেষের দিকে, অর্থাৎ যখন টেণ্ডারের তারিখ শেষ হইবার অল্প কয়েকদিন মাত্র বাকী, যদু বাঁড়ুয্যে কথাটা শুনিল। স্টেশনের একজন ক্লার্ক যদুর হোটেলে খায়, সেই কি করিয়া জানিতে পারিয়া যদুকে বলিল–একটু চেষ্টা করুন না। আপনি–টেণ্ডার দিন। হয়ে যেতে পারে।

    যত্ন চুপি চুপি টেণ্ডার সই করিয়া পাঁচ টাকা টেণ্ডারের জন্য জমা দিয়া আসিল।

    সেদিন বেচু চক্কত্তি সবে হোটেলের গদিতে আসিয়া বসিয়াছে এমন সময় পদ্মঝি ব্যস্তসমস্ত হইয়া আসিয়া বলিল–শুনেছ গো? শুনে এলাম একটা কথা–

    –কি?

    –ইস্টিশানে ভাতের হোটেল খুলে দেবে রেল কোম্পানি, দরখাস্ত দাও না কর্তা।

    –ইস্টিশানে? ছোঃ, ওতে খদ্দের হবে না। দূরের যাত্রীদের মধ্যে কে ভাত খাবে? সব কলকাতা থেকে খেয়ে আসবে–

    –তোমার এই সব বসে বসে পরামর্শ আর রাজা-উজীর মারা; সবাই দূরের যাত্রী থাকে না –যারা গাড়ী বদলে খুলনে লাইনে যাবে, তারা খাবে, দুপুরে যে সব গাড়ী কলকাতায় যায়–তারা এখানে ভাত পেলে এখানেই খেয়ে যাবে। শুনলাম বাঁড়ুধ্যে মশায় নাকি দরখাস্ত দিয়েছে পাঁচ টাকা জমা দিয়ে–

    বেচু চক্কত্তির চমক ভাঙিল। যদু বাঁড়ুয্যে যদি দরখাস্ত দিয়া থাকে, তবে এ দুধে সর আছে, কারণ যদু বাঁড়ুয্যে ঘুঘু হোটেলওয়ালা। পয়সা আছে না বুঝিয়া সে টেণ্ডারের পাঁচ টাকা জমা দিত না। বেচু বলিল–যাই, একবার দরখাস্ত দিয়ে আসি তবে–

    পদ্মঝি বলিল–কেরানী বাবুদের কিছু খাইয়ে এস–নইলে কাজ হবে না। আমাদের হোটেলে সেই যে শশধরবাবু খেতো, তার শালা ইষ্টিশানের মালবাবু, তার কাছে সুলুকসন্ধান নিও। না করলে চলবে কি করে? এ হোটেলের অবস্থা দেখে দিন দিন হাত-পা পেটের ভেতর সেঁদিয়ে যাচ্ছে।

    –কেন ওবেলা খদ্দের তো মন্দ ছিল না?

    পদ্মঝি হতাশার সুরে বলিল–ওকে ভাল বলে না কর্তা। সতেরো জন থাড কেলাসে আর ন’জন বাধা খদ্দেরে টাকা দিচ্ছে তবে হোটেল চলছে–নইলে বাজার হোত না। মুদি ধার দেওয়া বন্ধ করবে বলে শাসিয়েছে, তারই বা দোষ কি–একশো টাকার ওপর বাকী।

    বেচু বলিল–টেণ্ডারের দরখাস্ত দিতে গেলে এখুনি পাঁচটা টাকা চাই, তবিলে আছে দেখছি এক টাকা সাড়ে তের আনা মোট, ওবেলার দরুন। তার মধ্যে কয়লার দাম দেবো বলা আছে ওবেলা, কয়লাওয়ালা এল বলে। টাকা কোথায়?

    পদ্মঝি একটু ভাবিয়া বলিল–ও-থেকে একটা টাকা নাও এখন। আর আমি চার টাকা যোগাড় করে এনে দিচ্ছি। আমার লবঙ্গফুল থাকে এপাড়ায় তার কাছ থেকে। কয়লা-ওয়ালাকে আমি বুঝিয়ে বলবো–

    –বুঝিয়ে রাখবে কি, সে টাকা না পেলে কয়লা বন্ধ করবে বলেছে। তুমি পাঁচ টাকাই এনে দ্যাও–

    সন্ধ্যার পূর্কে বেচুও গিয়া টেণ্ডার দিয়া আসিল। পদ্মঝি সাগ্রহে গদির ঘরের দ্বারে অপেক্ষা করিতেছিল, এখনও খরিদ্দার আসা শুরু হয় নাই। বলিল–হয়ে গেল কর্তা? কি শুনে এলে?

    –হয়ে যাবে এখন? ছেলের হাতের পিঠে বুঝি? তবে খুব লাভের কাণ্ড যা শুনে এলাম। যদু পাকা লোক–নইলে কি দরখাস্ত দেয়? আমি আগে বুঝতে পারি নি। মোটা লাভের ব্যবসা। ইস্টিশানের ক্ষেত্রবাবু আমার এখানে খেতো মনে আছে? সে আবার বদলি হয়ে এসেছে এখানে। সে-ই বল্লে–যাত্রীরা রেলের বড় আপিসে দরখাস্ত করেছে আমাদের খাওয়ার কষ্ট। তা ছাড়া, রেল কোম্পানী এলেটিক আলো দেবে, পাখা দেবে, ঘর করে দেবে–তার দরুন কিছু নেবে না আপাতোক। রেলের বোর্ড না কি আছে, তাদের অর্ডার। যাত্রীদের সুবিধে আগে করে দিতে হবে। যথেষ্ট লোক খাবে পদ্ম, মোটা পয়সার কাণ্ড যা বুঝে এলাম।

    পদ্মঝি বলিল–জোড়া পাঁঠা দিয়ে পুজো দেবো সিদ্ধেশ্বরীতলায়। হয়ে যেন যায়–তুমি কাল আর একবার গিয়ে ওদিগের কিছু খাইয়ে এসো—

    –বলি যদু বাঁড়ুয্যে টের পেলে কি করে হ্যাঁ?

    –ও সব ঘুঘু লোক। ওদের কথা ছাড়ান দ্যাও।

    ক্রমে এ সম্বন্ধে অনেক রকম কথা শোনা গেল। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দেখা গেল রেলের তরফ হইতে একটি চমৎকার ঘর তৈয়ারী করিতেছে–আসবাবপত্র, আলমারি, টেবিল, চেয়ার দিয়া সেটি সাজানো হইবে, সে-সব কোম্পানী দিবে।

    এই সময় একদিন যদু বাঁড়ুয্যেকে হঠাৎ তাহাদের গদিঘরে আসিতে দেখিয়া বেচু ও পদ্মঝি উভয়েই আশ্চর্য হইয়া গেল। যদু বাঁড়ুয্যে হোটেলওয়ালাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি–কুলীন ব্রাহ্মণ, মাটিঘরার বিখ্যাত বাঁড়ুয্যে-বংশের ছেলে। কখনও সে কারো দোকানে বা হোটেলে গিয়া হাউ-হাউ করিয়া বকে না–গম্ভীর মেজাজের মানুষটি।

    বেচু চক্কত্তি যথেষ্ট খাতির করিয়া বসাইল। তামাক সাজিয়া হাতে দিল।

    যদু বাঁড়ুয্যে কিছুক্ষণ তামাক টানিয়া একমুখ ধোঁয়া ছাড়িয়া বলিল–তারপর এসেছি একটা কাজে, চক্কত্তি মশায়। হোটেল চলছে কেমন?

    বেচু বলিল–আর তেমন নেই, বাঁড়ুয্যে মশায়। ভাবছি, তুলে দিয়ে আর কোথায়ও যাই! খদ্দেরপত্তর নেই আর–

    –আপনার কাছে আমার আসার উদ্দেশ্য বলি। ইস্টিশানে হোটেল হচ্ছে জানেন নিশ্চয়ই। আমি একটা টেণ্ডার দিই। শুনলাম আপনিও নাকি দিয়েছেন?

    –হ্যাঁ—তা—আমিও—

     –বেশ। বলি, শুনুন। নৈহাটির একজন ভাটিয়া নাকি বড্ড তদ্বির করচে ওপরে–তাই হয়ে যাবে। মোটা পয়সার কারবার হবে ওই হোটেলটা। আসাম মেল, শান্তিপুর, বনগাঁ, ডাউন চাটগাঁ মেল–এসব প্যাসেঞ্জার খাবে–তা ছাড়া থাউকো লোক খাবে। ভাল পয়সা হবে এতে। আষন আপনি আর আমি দু’জনে মিলে দরখাস্ত দিই যে রাণাঘাটের আমরা স্থানীয় হোটেলওয়ালা, আমাদের ছেড়ে ভাটিয়াকে কেন দেওয়া হবে হোটেল। স্থানীয় হোটেলওয়ালারা মিলে একসঙ্গে দরখাস্ত করেছে এতে জোর দাঁড়াবে আমাদের খুব।

    বেচু বুঝিল নিতান্ত হাতের মুঠার বাহিরে চলিয়া যায় বলিয়াই আজ ষদু বাঁড়ুয্যে তাহার গদিতে ছুটিয়া আসিয়াছে–নতুবা ঘুঘু যদু কখনও লাভের ভাগাভাগিতে রাজী হইবার পাত্র নয়। বলিল–বেশ দরখাস্ত লিখিয়ে আনুন–আমি সই করে দেবো এখন।

    যদু বাঁড়ুয্যে পকেট হইতে একখানা কাগজ বাহির করিয়া বলিল–আরে, সে কি বাকি আছে, সে অশ্বিনী উকীলকে দিয়ে মুসোবিদে করে টাইপ করিয়ে ঠিক করে এনেছি। আপনি এখানটায় সই করুন–

    যদু বাঁড়ুয্যে সই লইয়া চলিয়া গেলে পদ্মঝি আসিয়া বলিল–কি গা কর্তা?

    বেচু হাসিয়া বলল–কারে না পড়লে কি ঘুঘু যদু বাঁড়ুয্যে এখানে আসে কখনো? সেই হোটেল নিয়ে এসেছিল। শুনবে?

    পদ্ম সব শুনিয়া বলিল–তাও ভালো। বেশী যদি বিক্রী হয়, ভাগাভাগিও ভালো। এখানে তোমার চলবেই না, যেরকম দাঁড়াচ্চে তার আর কি। হোক ইষ্টিশানে আধা বখরাই হোক।

    দিন কুড়ি-বাইশ পরে একদিন যদু বাঁড়ুয্যে বেচুর গদিঘরে ঢুকিয়া যে ভাবে ধপ করিয়া হতাশ ভাবে তক্তপোশের এক কোণে বসিয়া পড়িল, তাহাতে পদ্মঝি (সেখানেই ছিল) বুঝিল স্টেশনের হোটেল হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে।

    কিন্তু পরবর্তী সংবাদের জন্য পদ্মঝি প্রস্তুত ছিল না।

    যদু বলিল–শুনেছেন, চক্কত্তি মশাই! কাণ্ডটা শোনেন নি?

    বেচু চক্কত্তি ওভাবে যদু বাঁড়ুয্যেকে বসিতে দেখিয়া পূর্বেই বুঝিয়াছিল সংবাদ শুভ নয়। তবুও সে ব্যস্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করিল–কি। কি ব্যাপার?

    –ইষ্টিশানের থেকে আসছি এই মাত্তর, আজ ওদের হেড অফিস থেকে টেণ্ডার মঞ্জুর করে নোটিশ পাঠিয়েছে–

    বেচু একথার উত্তরে কিছু না বলিয়া উদ্বিগ্ন মুখে যদু বাঁড়ুয্যের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

    –কার হয়ে গেল জানেন?

    –না–সেই ভাটিয়া ব্যাটার বুঝি

    –তা হলেও তো ছিল ভাল। হল হাজারির, তোমাদের হাজারি—

    বেচু ও পদ্মঝি দু’জনেই বিস্ময়ে অস্ফুট চীৎকার করিয়া উঠিল প্রায়।

    বেচু চক্কত্তি বলিল–দেখে এলেন?

    –নিজের চোখে। ছাপা অক্ষরে। নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দিয়েছে–

    পদ্মঝি হতবাক হইয়া যদু বাঁড়ুয্যের দিকে চাহিয়া রহিল, বোধ হইল কথাটা যেন সে এখনও বিশ্বাস করে নাই।

    বেচু চক্কত্তি বলিল–তা হলে ওরই হল!

    এ কথার কোন অর্থ নাই, যদুও বুঝিল, পদ্মঝিও বুঝিল। ইহা শুধু বেচুর মনের গভীর নৈরাশ্য ও ঈর্ষার অভিব্যক্তি মাত্র।

    যদু বাঁড়ুয্যে বলিল–ওঃ, লোকটার বরাত খুবই ভাল যাচ্ছে দেখছি। ধূলো মুঠো ধরলে সোনা মুঠো হচ্ছে। আজ একুশ বছর এই রেলবাজারে হোটেল চালাচ্ছি, আমরা গেলাম ভেসে, আর ও হাতাবেড়ি ঠেলে আপনার হোটেলে পেট চালাত, তার কিনা–সবই বরাত–

    বেচু বলিল–কেন হল, কিছু শুনলেন নাকি? টাকা ঘুষ দিয়েছিল নিশ্চয়–

    –টাকার ব্যাপার নেই এর মধ্যে। হেড অফিসের বোর্ড থেকে নাকি মঞ্জুর করেছে– এখানকার ইষ্টিশান মাষ্টার সাহেব নাকি ওর পক্ষে খুব লিখেছিল। কোন কোন প্যাসেঞ্জার ওর নাম লিখেছে হেড অফিসে, খুব ভাল রান্না করে নাকি, এই সব।

    আর কিছুক্ষণ থাকিয়া যদু চলিয়া গেলে পদ্মঝি বলিল–বলি এ কি হল, হ্যাঁ কর্তা?

    –তাই তো!

    –মড়ুই পোড়া বামুনটা বড় বড় বাড়িয়েচে, আর তো সহ্যি হয় না—

    –কি আর করবে বল। আমি ভাবছি

    –কি?

    –কাল একবার হাজারির হোটেলে আমি যাই

    –কেন, কি দুঃখে?

    –ওকে বলি আমার হোটেলে তুমি অংশীদার হও, ছেলের হোটেলের অংশ কিছু আমায় দাও–

    পদ্মঝি ভাবিয়া বলিল–কথাটা মন্দ নয়। কিন্তু যদি তোমায় না দিতে চায়?

    –আমাকে খুব মানে কিনা তাই বলচি। এ না করলে আর উপায় নেই পদ্ম। হোটেল আর চালাতে পারবো না। একরাশ দেনা–খরচে আছে আর কুলোয় না। এ আমায় করতেই হবে।

    পদ্মঝিয়ের মুখে বেদনার চিহ্ন পরিস্ফুট হইল। বলিল–যা ভাল বোঝ কর কর্তা। আমি কি বলব বল!

    কিছুক্ষণ পরে যদু বাঁড়ুয্যে পুনরায় বেচুর হোটেলে আসিয়া বসিল। বেচু চক্কত্তি খাতির করিয়া তাহাকে চা খাওয়াইল। তামাক সাজিয়া হাতে দিল।

    তামাক টানিতে টানিতে যদু বলিল–একটা মতলব মনে এসেছে চক্কত্তি মশায়–তাই আবার এলাম।

    বেচু সকৌতূহলে বলিল–কি বলুন তো?

    –আমি পালচৌধুরীদের নায়েব মহেন্দ্রবাবুকে ধরেছিলাম। ওঁরা জমিদার, ওঁদের খাতির করে রেল কোম্পানী। মহেন্দ্রবাবুর চিঠি নিয়ে কাল চলুন, আপনি আর আমি কলকাতা রেল আপিসে একবার আপীল করি গিয়ে।

    পদ্মঝি দোরের কাছেই ছিল, সে বলিল–তাই যান গিয়ে কর্তা, আমিও বলি যাতে কক্ষনো ও মডুই পোড়া বামুন হোটেল না পায় তা করাই চাই, দু’জনে তাই যান–

    বেচু চক্কত্তি ভাবিয়া বলিল–কখন যেতে চান কাল?

    যদু বলিল–কাল সকাল যাওয়াই ভাল। বড় বাবুকে ধরতে হবে গিয়ে–পালচৌধুরীদের পুকুরে মাছ ধরতে আসেন প্রায়ই। গরফেতে বাড়ী, বড় ভাল লোক। মহেন্দ্রবাবুর চিঠি নিয়ে গিয়ে ধরি।

    যদু চলিয়া গেলে বেচু চক্কত্তি পদ্মকে বলিল–কিন্তু তাহলে হাজারির কাছে আমার ওভাবে যাওয়া হয় না। ও সব টের পাবেই যে আমরা আপীল করেছি, ওকেও নোটিশ দেবে কোম্পানী। আপীলের শুনানী হবে। তারপর কি আর ওর কাছে যাওয়া যায়?

    –না হয় না গেলে। ওর দরকার নেই, যাতে ওর উচ্ছেদ হয় তাই কর।

    –বেশ, যা বল।

    পরদিন যদু বাঁড়ুয্যের সঙ্গে বেচু চক্কত্তি কয়লাঘাটে রেলের বড় আপিসে যাইবে বলিয়া বাহির হইল এবং সন্ধ্যার পরে পুনরায় রাণাঘাটে ফিরিল। বেচু যখন নিজের হোটেলে ঢুকিল, তখন খাওয়াদাওয়া আরম্ভ হইয়াছে। পদ্মঝি ব্যস্তভাবে বলিল–কি হল কর্তা।

    বেচু বলিল–আর কি, মিথ্যে যাতায়াত সার হল, দুটো টাকা বেরিয়ে গেল। তারা বল্লে–এ, আমাদের হাতে নেই, টেণ্ডার মঞ্জুর হয়ে বোর্ডের কাছে চলে গিয়েছে। এখন আর আপীল খাটবে না।

    –তবে যাও কাল হাজারির কাছেই যাও–

    তার দরকার নেই। বাঁড়ুয্যে মশায় আসবার সময় বল্লেন–ওঁর হোটেল আর আমার হোটেল একসঙ্গে মিলিয়ে দিতে। এ ঘর ছেড়ে দিয়ে সামনের মাসে ওঁর ঘরেই–

    পদ্মঝি বলিল–এ কিন্তু খুব ভাল কথা। ও ছোটলোকটার কাছে না গিয়ে বাঁড়ুয্যে মশায়ের সঙ্গে কাজ করা ঢের ভাল।

    .

    পরবর্তী পনেরো দিনের মধ্যে রাণাঘাট রেলবাজারে দুইটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটিয়া গেল।

    স্টেশনের আপ, প্ল্যাটফর্মে নূতন হিন্দু-হোটেল খোলা হইল। শ্বেতপাথরের টেবিল, চেয়ার, ইলেকট্রিক আলো, পাখা দিয়া সাজানো আধুনিক ধরনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অতি চমৎকার হোটেলটি। হোটেলের মালিকের স্থানে হাজারির নাম দেখিয়া অনেকে আশ্চর্য হইয়া গেল।

    আর একটি বিশিষ্ট ঘটনা, বেচু চক্কত্তির পুরানো হোটেলটি উঠিয়া যাইবে এমন একটা গুজব রেলবাজারের সর্বত্র রটিল।

    সেদিন বিকালের দিকে হাজারি তাহার পুরানো অভ্যাসমত চূর্ণীর ধার হইতে বেড়াইয়া ফিরিতেছে, এমন সময় পদ্মঝিয়ের সঙ্গে রাস্তায় দেখা।

    হাজারিই পদ্মকে ডাকিয়া বলিল–ও পদ্মদিদি, কোথায় যাচ্ছ?

    পদ্মঝি দাঁড়াইল। তাহার হাতে একটা ছোট্ট পাথরের বাটি। সম্ভবত কাছেই কোথাও পদ্মঝিয়ের বাসা।

    হাজারি বলিল–বাটিতে কি পদ্মদিদি?

    -একটু দম্বল, দই পাতবো বলে গোয়ালাবাড়ী থেকে নিয়ে যাচ্ছি।

    –তারপর, ভাল আছ?

    –তা মন্দ নয়। তুমি ভাল আছি ঠাকুর।

    এখানে কাছেই থাকো বুঝি?

    এ কথার উত্তরে পদ্মঝি যাহা বলিল হাজারি তাহার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না। বলিল– এস না ঠাকুর, আমার বাড়ীতে একবার এলেই না হয়–

    –তা বেশ বেশ, চলো না পদ্মদিদি।

    ছোট্ট বাড়ীটা, একপাশে একটা পাতকুয়া, অন্যদিকে টিনের রান্নাঘর এবং গোয়াল। পদ্মঝি রোয়াকটাতে একখানা মাদূর আনিয়া হাজারির জন্য বিছাইয়া দিল। হাজারি খানিকটা অস্বস্তি ও আড়ষ্ট ভাব বোধ করিতেছিল। পদ্ম যে তাহার মনিব, তাহাদেরই হোটেলে সে একাদিক্রমে সাত বৎসর কাজ করিয়াছে, এ কথাটা এত সহজে কি ভোলা যায়? এমন কি, পদ্মঝিকে সে চিরকাল ভয় করিয়া আসিয়াছে, আজও যেন সেই ভাবটা কোথা হইতে আসিয়া জুটিল।

    পদ্মঝি বলিল–পান সাজবো খাবে?

    হাজারি আমতা আমতা করিয়া বলিল–তা–তা বরং একটা–

    পান সাজিয়া একটা চায়ের পিরিচে আনিয়া হাজারির সামনে রাখিয়া বলিল–তারপর, রেলের হোটেল তো পেয়ে গেলে শুনলাম। ওখানে বসাবে কাকে?

    –ওখানে বসাবো ভাবছি বংশীর ভাগ্নে সেই নরেন–নরেনকে মনে আছে? সেই তাকে।

    –মাইনে কত দেবে?

    –সে সব কথা এখনও ঠিক হয় নি। ও তো আমার এই হোটেলে খাতাপত্র রাখে, দেখাশুনো করে, বড় ভাল ছেলেটি।

    –তা ভালো।

    –চক্কত্তি মশায়ের শরীর ভাল আছে? ক’দিন ওদিকে আর যেতে পারি নি। হোটেল চলছে কেমন?

    –হোটেল চলছে মন্দ নয়। তবে আমি কি বলচিলাম জানো ঠাকুর, কর্তামশায়কে রেলের হোটেলে একটা অংশ দিয়ে রাখো না তুমি? তোমার কাজের সুবিধে হবে।

    হাজারি এ প্রস্তাবের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। একটু বিস্ময়ের সুরে বলিল–কৰ্ত্তা কি করে থাকবেন? ওঁর নিজের হোটেল?

    –সেজন্যে ভাবনা হবে না। সে আমি দেখব। কি বল তুমি?

    –এখন আমি কোন কথা দিতে পারব না পদ্মদিদি। তবে একটা কথা আমার মনে হচ্ছে তা বলি। রেল-কোম্পানী যখন টেণ্ডার নেয়, তখন যার নাম লেখা থাকে, তার ছাড়া আর কোন লোকের অংশটংশ থাকতে দেবে না হোটেলে। হোটেল ত আমার নয়–হোটেল রেল-কোম্পানীর।

    –ঠাকুর একটা কথা বলব? তুমি এখন বড় হোটেলওয়ালা, অনেক পয়সা রোজগার কর শুনি। কিন্তু আমি তোমায় সেই হাজারি ঠাকুরই দেখি। তুমি এস আমাদের হোটেলে আবার।

    হাজারি বিস্ময়ের সুরে বলিল–চক্কত্তি মশায়ের হোটেলে? রাঁধতে?

    সে মনে মনে ভাবিল–পদ্মদিদির মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? বলে কি?

    পদ্ম ঝিন্তু বেশ দৃঢ় স্বরেই বলিল–সত্যি বলচি ঠাকুর। এস আমাদের ওখানে আবার।

    –কেন বল তো পদ্মদিদি? একথা তুললে কেন?

    –তবে বলি শোন। তুমি এলে আমাদের হোটেলটা আবার জাঁকবে।

     এমন ধরনের কথা হাজারি কখনও পদ্মঝিয়ের মুখে শোনে নাই। সেই পদ্মঝি আজ কি কথা বলিতেছে তাহাকে?

    হাজারি গলিয়া গেল। সে ভুলিয়া গেল যে সে একজন বড় হোটেলের মালিক –পদ্মদিদি তাহার মনিবের দরের লোক, তাহার মুখের একথা যেন হাজারির জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এই আশায় যেন সে এতদিন রাণাঘাটের রেলবাজারে এত কষ্ট করিয়াছে।

    অন্য লোকে হাজার ভাল বলুক, পদ্মদিদির ভাল বলা তাদের চেয়ে অনেক উঁচু, অনেক বেশ মূল্যবান।

    কিন্তু পদ্ম যাহা বলিতেছে, তাহা যে হয় না একথা সে পদ্মকে কি করিয়া বুঝাইবে! যখন সে গোপালনগরের চাকুরি ছাড়িয়া পুনরায় চক্কত্তি মশায়ের হোটেলে চাকুরি লইয়াছিল– তখনও উহারা যদি তাহাকে না তাড়াইয়া দিত, তবে তো নিজ হোটেল খুলিবার কল্পনাও তাহার মনে আসিত না। উহাদের হোটেলে পুনরায় চাকুরি পাইয়া সে মহা সৌভাগ্যবান মনে করিয়াছিল নিজেকে–কেন তাহাকে উহারা তাড়াইল।

    এখন আর হয় না।

    এখন সে নিজের মালিক নয়, কুসুমের টাকা ও অতসীমা’র টাকা হোটেলে খাটিতেছে, তাহার উন্নতি-অবনতির সঙ্গে অনেকগুলি প্রাণীর উন্নতি-অবনতি জড়ানো। নিজের খেয়াল খুশিতে যা-তা করা এখন আর চলিবে না।

    টেঁপির ভবিষৎ দেখিতে হইবে–টেঁপি আর নরেন।

    অনেক দূর আগাইয়া আসিয়াছে–আর এখন পিছানো চলে না।

    হাজারি পদ্মঝিয়ের মুখের দিকে দুঃখ ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল–

    –আমার ইচ্ছে করে পদ্মদিদি। কিন্তু এখন যাওয়া হয় কি করে তুমিই বল।

    পদ্ম যে কথাটা না বোঝে তা নয়, সে নিতান্ত মরীয়া হইয়াই কথাটা বলিয়া ফেলিয়াছিল। হাজারির কথার সে কোনো জবাব না দিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিল এবং কিছুক্ষণ পরে একটা কাপড়-জড়ানো ছোট্ট পুঁটুলি আনিয়া হাজারির সামনে রাখিয়া বলিল–পড়তে চান তো, পড়ে দেখ না?

    হাজারি পড়িতে জানে না তাহা নয়, তবে ও কাজে সে খুব পারদর্শী নয়। তবু পদ্মদিদির সম্মুখে সে কি করিয়া বলে যে সে ভাল পড়িতে পারে না! পুঁটুলি খুলিয়া সে দেখিল খান কয়েক কাগজ ছাড়া তার মধ্যে আর কিছু নাই।

    পদ্মঝি তাহাকে বিপদ হইতে উদ্ধার করিল। সে নিজেই বলিল–ক-খানা হ্যাণ্ডনোট, তা সবসুদ্ধ সাতশ টাকার হ্যাণ্ডনোট। কর্তাকে আমি টাকা দেই যখনই দরকার হয়েছে তখন। নিজের হাতের চুড়ি বিক্রি করি, কানের মাকড়ি বিক্রি করি–ছিল তো সব, যখন এইস্তিরি ছিলাম, দুখানা সোনাদানা ছিল তো অঙ্গে।

    হাজারি বিস্মিত হইয়া বলিল–তুমি টাকা দিয়েছিলে পদ্মদিদি?

    –দেই নি তো কার টাকায় হোটেল চলছিল এতদিন? যা কিছু ছিল সব ওর পেছনে খুইয়েছি।

    –কিছু টাকা পাও নি?

    –পেটে খেয়েছি আমি, আমার বোনঝি, আমার এক দেওর-পো এই পর্যন্ত। পয়সা যে একেবারে পাই নি তা নয়–তবে কত আর হবে তা? বোনঝির বিয়েতে কর্তা-মশায় একশ টাকা দিয়েছিলেন–সে আজ সাত বছরের আগের কথা। সাতশ টাকার সুদ ধর কত হয়?

    –টাকা অনেক দিন দিয়েছিলে?

    –আজ ন-বছরের ওপর হ’ল। ওই একশ টাকা ছাড়া একটা পয়সা পাই নি-–কর্তা মশায় কেবলই বলে আসছেন একটু অবস্থা ভাল হোক হোটেলের–সব হবে, দেব।

    –ওঁকে আগে থেকে জানতে নাকি, না রাণাঘাটে আলাপ?

    –সে-সব অনেক কথা ঠাকুর। উনি আমাদের গাঁ ফুলে-নবলার চক্কত্তিদের বাড়ীর ছেলে। ওর বাবার নাম ছিল তারাচাঁদ চক্কত্তি–বড় ভাল লোক ছিলেন তিনি। অবস্থাও ভাল ছিল তার–আমাদের কর্তা হচ্ছেন তারাচাঁদ চক্কত্তির বড় ছেলে। লেখাপড়া তেমন শেখেন নি, বললেন রাণাঘাটে গিয়ে হোটেল করব, পদ্ম কিছু টাকা দিতে পার? দিলাম টাকা। সে আজ হয়ে গেল–

    হাজারি ঠাকুরের মনে কৌতূহল জাগিলেও সে দেখিল আর অন্য কোনো প্রশ্ন পদ্মদিদিকে না করাই ভাল। গ্রামে এত লোক থাকিতে তারাচাঁদ চক্কত্তির বড় ছেলে তাহার কাছেই টাকা চাহিল কেন, সেই বা টাকা দিল কেন, রাণাঘাটে বেচুর হোটেলে তাহার ঝি-গিরি করা নিতান্ত দৈবাধীন যোগাযোগ না পূর্ব হইতেই অবলম্বিত ব্যবস্থার ফল–এসব কথা হাজারি জিজ্ঞাসা করিলে তাহাকে দোষ দেওয়া যাইত না।

    কিন্তু হাজারির বয়স হইয়াছে, জীবনে তাহার অভিজ্ঞতা হইয়াছে কম নয়, সে এ-বিষয়ে কোনো প্রশ্ন না করিয়া বলিল–হ্যাণ্ডনোটগুলো তুলে রেখে দাও পদ্মদিদি ভাল করে। সব ঠিক হয়ে যাবে, টাকাও তোমার হয়ে যাবে–এগুলো রেখে দাও।

    পদ্ম ঝি রকম এক ধরনের হাসি হাসিয়া বলিল–ও সব তুলে রেখে কি করব ঠাকুর? ও সব কোন কালে তামাদি হয়ে ভূত হয়ে গিয়েছে। পড়ে দেখ না ঠাকুর–

    হাজারি অপ্রতিভ হইয়া শুধু বলিল–ও!

    –যা ছিল কিছু নেই ঠাকুর, সব হোটেলের পেছনে দিয়েছি–আর কি আছে এখন হাতে, ছাই বলতে রাইও না।

    শেষের কথাগুলি পদ্মঝি যেন আপন মনেই বলিল, বিশেষ কাহাকেও উদ্দেশ করিয়া নহে। হাজারি অত্যন্ত দুঃখিত হইল। পদ্মঝির এমন অবস্থা সে কখনও দেখে নাই–ভিতরের কথা সে জানিত না, মিছামিছি কত রাগ করিয়াছে পদ্মদিদির উপর।

    আরও কিছুক্ষণ বসিয়া হাজারি চলিয়া আসিল, সে কিছুই যখন করিতে পারিবে না আপাতত–তখন অপরের দুঃখের কাহিনী শুনিয়া লাভ কি?…

    বাসায় ফিরিতেই সে এমন একটি দৃশ্য দেখিল যাহাতে সে একটি অদ্ভুত ধরনের আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করিল।

    বাহিরের দিকে ছোট ঘরটার মধ্যে টেঁপির গলা। সে বলিতেছে–নরেনদা, চা না খেয়ে কিছুতেই আপনি এখন যেতে পারবেন না। বসুন।

    নরেন বলিতেছে–না, এবার হোটেলে যেতে হবে, তুমি বোঝ না আশা, ইষ্টিশানের হোটেল এখন তো বন্ধ–কিন্তু মামাবাবু আসবার আগে এ-হোটেলের সব দেখাশুনো আমার করতে হবে।

    টেঁপির ভাল নাম যে আশালতা, হাজারি নিজেই তা প্রায় ভুলিতে বসিয়াছে–নরেন ইতিমধ্যে কোথা হইতে তাহার সন্ধান পাইল!

    টেঁপি পুনরায় আবদারের সুরে বলিল–না ওসব কাজটাজ থাকুক, আপনি আমাকে আর মাকে টকি দেখাতে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন–আজ নিয়ে যেতেই হবে।

    –কি আছে আজ?

    –আনব? একখানা টকির কাগজ রয়েছে ও ঘরে। ঢাক বাজিয়ে কাগজ বিলি করে যাচ্ছিল ওবেলা, খোকা একখানা এনেছে–

    –যাও চট করে গিয়ে নিয়ে এস।

    হাজারির ইচ্ছা ছিল না উহাদের কথাবার্তায় সে বাধা দেয়। এমন কি সে একপ্রকার নিঃশব্দেই রোয়াক পার হইয়া যেমন উত্তরের ঘরটার মধ্যে ঢুকিয়াছে, অমনি টেঁপি টকির কাগজের সন্ধানে আসিয়া একেবারে বাবার সামনে পড়িয়া গেল।

    টেঁপি পাছে কোনপ্রকার লজ্জা পায়–এজন্য হাজারি অন্যদিকে চাহিয়া বলিল–এই যে টেঁপি। তোর মা কোথায়?

    টেঁপি হঠাৎ যেন কেমন একটু জড়সড় হইয়া গেল। মুখে বলিল–কে, বাবা! কখন এলে? টের পাই নি তো?

    হাজারির কিন্তু মনে হইল টেঁপি তাহাকে দেখিয়া খুব খুশি হয় নাই। যেন ভাবিতেছে, আর একটু পরে বাবা আসিলে ক্ষতিটা কি হইত।

    হাজারি বুকের ভিতটা কোথায় যেন বেদনায় টনটন করিয়া উঠিল। মেয়েসন্তান, আহা বেচারী! সব কথা কি ওরা গুছিয়ে বলতে পারে, না নিজেরাই বুঝিতে পারে? টেঁপি কি জানে তার নিজের মনের খবর কি?

    হাজারি বলিল–আমি এখুনি হোটেলে বেরিয়ে যাব টেঁপি। বেলা পাঁচটা বেজে গিয়েছে, আর থাকলে চলবে না। এক গ্লাস জল বরং আমায় দে–

    ওঘর হইতে নরেন ডাকিয়া বলিল–মামাবাবু কখন এলেন?

    হাজারি যেন পূর্বে নরেনের কথাবার্তা শুনতে পায় নাই বা এখানে নরেন উপস্থিত আছে বিষয়ে কিছু জানিত না, এমন ভাব দেখাইয়া বলিল–কে নরেন? কখন এলে বাবাজী?

    –অনেকক্ষণ এসেছি মামাবাবু–চলুন, আমিও হোটেলে বেরিয়েছি—

    বলিতে বলিতে নরেন সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।

    হানারি বলিল–একটু জলটল খেয়ে যাও না? হোটেলে এখন ধোঁয়ার মধ্যে গিয়েই বা করবে কি? বস বস বরং। টেঁপি তোর নরেনদা’র জন্য একটু চা–

    –না না থাক মামাবাবু, হোটেলে তো চা এমনিই হবে এখন।

    –তা হোক, আমার বাসায় যখন এসেছ, তখন এখান থেকেই চা খেয়ে যাও।

    বলিয়া হাজারি বাড়ীর মধ্যের ঘরের দিকে সরিয়া গেল। টেঁপির মা তখনও রান্নাঘয়ের দাওয়ায় একখানা মাদুর বিছাইয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে দেখিতে পাইল। বেচারী চিরকাল খাটিয়াই মরিয়াছে এঁড়োশোলা গ্রামে–এখন চাকরে যখন প্রায় সব কাজই করিয়া দেয় তখন সে জীবনটাকে একটু উপভোগ করিয়া লইতে চায়।

    হাজারি স্ত্রীকেও আগাইল না। সবাই মিলিয়া বড় কষ্ট করিয়াছে চিরকাল, এখন সুখের মুখ যখন দেখিতেছে–তখন সে তাহাতে বাদ সাধিবে না। টেঁপির মা ঘুমাইয়া থাকুক।

    .

    বাড়ীর বাহির হইতে যাইতেছে, নরেন মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে একটু লাজুক সুরে বলিল–মামাবাবু–এই গিয়ে আশা বলচিল–মামীমাকে নিয়ে আর ওকে নিয়ে একবার টকি দেখিয়ে আনার কথা–তা আপনি কি বলেন?

    টেঁপিই যে একথা তাহার কাছে বলিতে নরেনকে অনুরোধ করিয়াছে, এ-বিষয়ে হাজারির সন্দেহ রহিল না। তাহার মনে কৌতুক ও আনন্দ দুই-ই দেখা দিল। ছেলেমানুষ সব, উহারা কি করে না-করে বয়োবৃদ্ধ লোকে সব বুঝিতে পারে, অথচ বেচারীরা ভাবে তাহাদের মনের খবর কেহ কিছু রাখে না।

    সে ব্যস্ত হইয়া বলিল–তা যাবে যাও না! আজই যাবে? পয়সা-কড়ি সব তোমার মামীমার কাছে আছে, চেয়ে নাও! কখন ফিরবে?

    –রাত আটটা হবে মামাবাবু–আপনি নিজে ইষ্টিশানে যদি গিয়ে বসেন একটু–

    –আচ্ছা তাহোক, ইষ্টিশানে আমি যাব এখন, সে তুমি ভেবো না। তুমি ওদের নিয়ে যাও–ও টেঁপি, ডেকে দে তোর মাকে। অবেলায় পড়ে ঘুমুচ্চে, ডেকে দে। যাস যদি তবে সব তৈরি হয়ে নে–

    হাজারি আর বিলম্ব না করিয়া বাড়ীর বাহির হইয়া পড়িল। বালকবালিকাদের আমোদের পথে সে বিঘ্ন সৃষ্টি করিতে চায় না। প্রথমে বাজারের হোটেলে আসিয়া এবেলার রান্নার সব ব্যবস্থা করিয়া দিয়া বেলা পড়িলে সে আসিল স্টেশন প্ল্যাটফর্মের হোটেলে। এখানে সে বড় একটা বসে না। নরেনই এখানকার ম্যানেজার। এ সব সাহেবী ধরনের ব্যবস্থা তাহার যেন কেমন লাগে।

    সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। চাটগাঁ মেল আসিবার বেশী বিলম্ব নাই–বনগ্রামের গাড়ীও এখনি ছাড়িবে। এই সময় হইতে রাত্রি সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ, ঢাকা মেল, নর্থ বেল এক্সপ্রেস প্রভৃতি বড় বড় দূরের ট্রেনগুলির ভিড়। যাত্রীরা যাতায়াত করে বহু, অনেকেই খায়। হাজারির আশা ছাড়াইয়া গিয়াছে এখানকার খরিদ্দারের সংখ্যা।

    স্টেশনের হোটেলে দুজন নূতন লোক রান্না করে। এখানে বেশীর ভাগ লোকে চায় ভাত আর মাংস–সেজন্য ভাল মাংস রান্না করিতে পারে এরূপ লোক বেশী বেতন দিয়া রাখিতে হইতেছে। পরিবেশন করিবার জন্য আছে তিনজন চাকর–এক-একদিন ভিড় এত বেশী হয় যে, ও হোটেল হইতে পরিবেশনের লোক আনাইতে হয়।

    হাজারিকে দেখিয়া পাচক ও ভৃত্যেরা একটু সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। সকলেই জানে হাজারি তাহাদের আসল মনিব, নরেন ম্যানেজার মাত্র। তাহারা ইহাও ভাল জানিয়াছে যে হাজারির পদতলে বসিয়া তাহারা এখন দশ বৎসর রান্না-কাজ শিখতে পারে–সুতরাং হাজারিকে শুধু তাহারা যে মনিব বলিয়া সমীহ করে তাহা নয়, ওস্তাদ কারিগর বলিয়া শ্রদ্ধা করে।

    একজন রাঁধুনীর নাম সতীশ দীঘড়ি। বাড়ী হুগলী জেলার কোনো পাড়াগাঁয়ে, রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। খুব ভাল রান্নার কাজ জানে, পূর্বে ভাল ভাল হোটেলে মোটা মাহিনায় কাজ করিয়াছে–এমন কি একবার জাহাজে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত গিয়াছিল–সেখানে এক শিখ হোটেলেও কিছুদিন কাজ করিয়াছে। সতীশ নিজে ভাল রাঁধুনী বলিয়া হাজারির মর্ম খুব ভাল করিয়াই বোঝে এবং যথেষ্ট সম্মান করিয়া চলে।

    হাজারি তাহাকে বলিল–কি দীঘড়ি মশাই, রান্না সব তৈরী হোল?

    সতীশ বিনীত সুর বলিল–একবার দয়া করে আসুন কর্তা, মাংসটা একবার দেখুন না? .

    –ও আমি আর কি দেখব, আপনি যেখানে রয়েছেন–

    –অমন কথা বলবেন না কৰ্ত্তা, অন্য কেউ আপনাকে বোঝে না-বোঝে আমি তো আপনাকে জানি–এসে একবার দেখিয়ে যান–

    হাজারি রান্নাঘরে গিয়া কড়ার মাংসের রং দেখিয়া বলিল–রং এরকম কেন দীঘড়ি মশায়?-

    সতীশ উৎফুল্ল হইয়া অপর রাঁধুনীকে বলিল–বলেছিলাম না কার্তিক? কর্তা চোখে দেখলেই ধরে ফেলবেন? কুঁদের মুখে বাঁক থাকে কখনো? কর্তা যদি কিছু মনে না করেন, কি দোষ হয়েছে আপনাকে ধরে দিতে হবে আজ।

    হাজারি হাসিয়া বলিল–পরীক্ষা দিতে হবে দীঘড়ি মশাই আবার এ বয়সে? লঙ্কার বাটনা হয় নি–পুরনো লঙ্কা, তাতেই রং হয় নি। রং হবে শুধু লঙ্কার গুণে।

    –কর্তা মশাই, সাধে কি আপনার পায়ের ধূলো মাথায় নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আর একটা দোষ হয়েছে সেটাও ধরুন।

    হাজারি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাংসের কড়ার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া বলিল–কষামাংসে যে গরম জল ঢেলেছিলেন, তা ভাল ফোটে নি। সেই জন্যে প্যাঁজা উঠেছে। এতে মাংস জঠুর হয়ে যাবে।

    সতীশ অন্য পাচকের দিকে চাহিয়া বলিল–শোন কার্তিক, শোন। আমি বলচিলাম না তোমায় জল ঢালবার সময় যে এতে প্যাঁজা উঠেছে আর মাংস নরম হবে না? আর কর্তা মশায় না দেখে কি করে বুঝে ফেলেচেন দ্যাখ। ওস্তাদ বটে আপনি কর্তা।

    হাজারি হাসিয়া কি একটা বলিতে যাইতেছিল, এমন সময় চট্টগ্রাম মেল আসিয়া সশব্দে প্ল্যাটফর্মে ঢুকিতেই কথার সূত্র ছিঁড়িয়া গেল। হোটেলের লোকজন অন্যদিকে ব্যস্ত হইয়া পড়িল।

    বেশ ভালো ঘর। বিজলী আলো জ্বলিতেছে। মার্বেল পাথরের টেবিলে বাবু খরিদ্দারেরা খাইতেছে চেয়ারে বসিয়া। ভীষণ ভীড় খরিদ্দারের–ওদিকে বনগাঁ লাইনের ট্রেনও আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। কলরব, হৈ-চৈ, ব্যস্ততা, পয়সা গুনিয়া কুল করা যায় না–এই তো জীবন। বেচু চক্কত্তির হোটেলের ঘরে বসিয়া হাতাবেড়ি নাড়িতে নাড়িতে এই রকম একটা হোটেলের কল্পনা করিতে সে কিন্তু কখনও সাহস করে নাই। এত সুখও তার অদৃষ্টে ছিল! পদ্মদিদির কত অপমান আজ সার্থক হইয়াছে এই অপ্রত্যাশিত কৰ্ম্মব্যস্ত হোটেল-জীবনের মধ্যে। আজ কাহারও প্রতি তাহার কোন বিদ্বেষ নাই। হঠাৎ হাজারির মনে পড়িল চাকদহ হইতে হাঁটাপথে গোপালনগরে যাইবার সময় সেই ছোট গ্রামের গোয়ালাদের বাড়ীর বধুটির কথা। হাজারি তাহাকে কথা দিয়াছিল তাহার টাকা হাজারি ব্যবসায়ে খাটাইয়া দিবে। সে কাল যাইবে। গরীব মেয়েটির টাকা খাটাইবার এই ভাল ক্ষেত্র। বিশ্বাস করিয়া দিতে চাহিল হাজারির দুঃসময়ে–সুসময়ে সেই সরল মেয়েটির দিকে তাহাকে চাহিতে হইবে। নতুবা ধৰ্ম্ম থাকে না। 

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবদাস
    Next Article ব্যবধান

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }