Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1863 Mins Read0

    ঈশ্বরের বাগান – ১

    ॥ এক ॥

    পাগল হাঁকছে দু-ঘরের মাঝে অথৈ সমুদ্দুর। পাগল হাঁকছে—ছবি গণ্ডারের এক ঝুলে থাকে সদর দেউড়িতে। এইসব হাঁকডাক যেন কোন এক অদৃশ্য গোপন অভ্যন্তর থেকে ভেসে আসছিল। সদর দেউড়িতে এসে এমন সব শব্দে থমকে দাঁড়াতেই সে দেখল, সত্যি সত্যি মাথার ওপরে একটা গণ্ডারের ছবি, একটা দেড় হাত গণ্ডারের ছবি, নাকটা লম্বা হয়ে ঝুলে আছে—নীল রঙের ছবি, তেড়ে ফুঁড়ে যাচ্ছে আর বাতাসে ওটা পতপত করে উড়ছে। দেউড়িতে এক সিপাই—লম্বা, ততোধিক তালপাতার শামিল। হাতে জীর্ণ একটা একনলা বন্দুক। মরচে-পড়া। খাঁকি পোশাক গায়ে, মাথায় লম্বা টুপি জোকারের মতো। বুট-জুতোর একটা ফিতা বাঁধা। অন্যটা হাঁ হয়ে আছে। লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছিল। এই সকালে, এখন আর কটা হবে, নটাও বাজেনি অথচ লোকটা বসে নেই, শুয়ে নেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। চোখ কোটরাগত, বহুদিনের উপবাসে এমন একটা ভঙ্গী মানুষের মুখে থাকে।

    সে বলল, এটা রাজবাড়ি?

    সিপাই হাই তুলল। বন্দুকটা নিয়ে সটান এটেনসান, তারপর খুব তাচ্ছিল্য—যেন কিছুই আসে যায় না, কে কখন যায় আসে খবর রাখার কথা না তার। এই লোকটা তাকে রাজার বাড়ি সম্পর্কে প্রশ্ন করছে—বেয়াদপ আর কাকে বলে! চোখ নেই! সামনে অতবড় পাথরে লেখা কুমারদহ রাজবাটী! লোকটা কি লেখাপড়া শেখেনি? তারপরই হুঁশ ফিরে আসার মত—অর্থাৎ এমন আহাম্মক যে এত বড় রাজবাড়ির মানুষের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় জানে না! বরং ধিক্কার দিতে গিয়ে ভাল করে তাকাতেই অবাক! এক উঁচু লম্বা সৌম্যকান্তি যুবক দেউড়িতে দাঁড়িয়ে। মুখে বড়ই ভালমানুষের ছাপ। সে রাজার বাড়িতে ঢুকতে চায়।

    তখনই সৌম্যকান্তি যুবক লক্ষ্য করল বিশাল পেল্লাই দেউড়ির এক কোণে ছোট্ট চৌকো মতো ফুট তিনেকের দরজা। কুকুর বেড়াল লাফিয়ে ঢুকতে পারে। দুজন মানুষও ঢুকে গেল। ঘাড় মাথা হেঁট করে ঢুকে যাচ্ছে তারা। এই তবে সেই দরজাটা, যা দিয়ে মানুষ এই বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে। সে ভাবল, কি করবে! মাথা হেঁট করে ঢুকবে, না সোজা মাথায় অপেক্ষা করবে। আর তখনই তালপাতা ঘটাং ঘটাং করে কি সব খুলে ফেলছিল, টেনে নিচ্ছিল জোরে দেউড়ির এক কপাট। সে তার জান কবুল করে কোনরকমে একটা পাট কিছুটা ঠেলে দিতেই হাঁ হয়ে গেল রাজার বাড়ি। যুবক ভিতরে ঢুকে সিপাইকে বলল, রাজেনবাবুর সঙ্গে দেখা করব।

    এতো ভাল কথা নয়—বাড়ির হালচাল জানে না মানুষটা! এই বাড়ির মধ্যে কার বুকের পাটা আছে রাজার নাম নিয়ে কথা কয়। যুবকের কথায় সিপাই খুবই হকচকিয়ে গিয়েছিল। বলল, কুমার বাহাদুর?

    সে সহসা ভুল হয়ে গেছে মতো বলল, কুমার বাহাদুর।

    সিপাই এতক্ষণে কিছুটা আশ্বস্ত হল যেন। হাত তুলে বলল, সামনে যান। বাবুরা আছে, বলে দেবে সব।

    যেন বাবুরা তাকে প্রথম এ-বাড়ির সহবত শেখাবে। এখানে এলে এমনিতেই রাজার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার কথা না। কত বড় আহাম্মক আর কিছুটা গেলেই টের পাবে। মনে মনে কিঞ্চিৎ শঙ্কা। সেখানে গিয়ে না আবার বলে ফেলে, রাজেনবাবু। তোবা তোবা সে কান ছুঁল। এরকম এ বাড়িতে কেউ ভাবতেও ভয় পায়। লোকটা এত সুন্দর দেখতে। এমন উঁচু লম্বা, মুখে চোখে আশ্চর্য আচ্ছন্ন এক ভাব, যেন এত সবের মধ্যেও কি সব গভীর ভাবনা মানুষটার মধ্যে কাজ করছে। সিপাই সাদেক আলি একটু এগিয়ে বলবে ভাবল, হুজৌরের নাম লেবেন না বাবু। সম্মানে লাগে। কিসে কি বিপদ আসবে কে বলতে পারে। কিন্তু কিছুটা গিয়েও যুবককে দেখতে পেল না। গাড়িবারান্দার পাশে বড় বড় থামের আড়ালে পড়ে গেছে। তার এতদূরে যাওয়া আর সম্ভব না। খোঁজা সম্ভব না। অষ্ট প্রহর দেউড়ি আগলানো তার কাজ। এদিক ওদিক হলেই কৈফিয়ত তলব।

    আসলে নবীন যুবক যায়, কেউ হাঁকে, সেই কোন গোপন গভীর অদৃশ্য অন্তরাল থেকে হাঁকে, নবীন যুবক যায়। সে হেঁটে যায়, চারপাশ দেখে। দেউড়িতে দাঁড়িয়ে ভেবেছিল, বড় ভগ্ন প্রাসাদ। রাজার বাড়ি ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ভেতরে যত ঢুকছে জেল্লা বাড়ছে। বাঁদিকে বড় লন। সবুজ ঘাস, কিছু বিদেশী ফুলের গাছ, ঝাউগাছ, পাম-ট্রি, ছোট্ট জলাশয়। সেখানে শালুক এবং পদ্মপাতা তারপরই লতানে গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ পাতার প্রাচীর। বাড়িটা কত বড় ভেতরে! যেন শেষ নেই। ডানদিকে পথ, বাঁদিকে পথ। একটা দোতলা বাড়ি কতদূর চলে গেছে পাশ দিয়ে। সে গাড়ি-বারান্দায় উঠে যেতেই এ-সব দেখল। তবু সব কিছু পুরানো। প্রাচীন এবং একটা সোঁদা গন্ধ। গাড়ি-বারান্দায় উঠতেই সে এটা টের পেল। গাড়ি-বারান্দা পার হলে লম্বা আর একটা বারান্দা—বিশাল চত্বর জুড়ে যেন। কোণায় কোণায় গোল শ্বেত-পাথরের টেবিল, কারুকাজ করা চেয়ার। দেয়ালে বড় বড় আয়না। যুবক সেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বুঝল, চোখে মুখে ক্লান্তি জমেছে। রাত জেগে গাড়িতে আসায় এটা হয়েছে। তখনই কেউ দরজায় উঁকি মেরে বলল, কাকে চাই?

    যুবক বলল, রাজেনবাবুর সঙ্গে আজ দেখা করার কথা।

    লোকটা যেন কি বুঝে ফেলল, আরে এত সেই লোক—যে আসবে আসবে কথা হচ্ছে। ভালমানুষ সত্যবাদী এবং যাকে দিয়ে কুমার বাহাদুরের অনেক উপকার হবে। পলকে চিনে ফেলে বলল, বসুন বাবু। হুজুর এখনও নামেন নি। তারপরই কি ভেবে বলল, দাঁড়ান। লোকটা জাদুকরের মতো প্রাসাদের ভিতরে অন্তর্হিত হয়ে গেল। এবার সে একা এল না। আরও একজন সঙ্গে। সঙ্গের বাবুটি বলল, —কুমার বাহাদুরের কাছে যেতে চান?

    —তেমনই কথা আছে।

    —কোত্থেকে আসছেন?

    —অনেক দূর থেকে।

    —নাম?

    —অতীশ দীপঙ্কর ভৌমিক।

    —মানে আপনি আমাদের নতুন—বাবুটি আর কথা শেষ করতে পারল না। দত্তপাটি নিমেষে বের করে দিল। কিছুটা কুঁজো হয়ে গেছে অল্পবয়সেই। যুবক চোখ তুলে লোকটিকে দেখে রাজেনবাবুর কথাবার্তার সঙ্গে কি যেন মিল খুঁজে দেখার চেষ্টা করল। যখন কুঁজো হয়ে গেছে তখন বুঝতে বাকি থাকল না, রাজেনবাবুর বড় বিশ্বাসীজন

    ওরে সুরেন। কোথায় গেলি বাবা?

    ও-পাশের একটা ঘর থেকে সুরেন হাঁকল, আজ্ঞে যাই বাবু।

    এবার অতীশের দিকে তাকিয়ে বলল, বসুন। এখনও নামার সময় হয়নি। ও সুরেন, কি করছিস?

    —আজ্ঞে যাই।

    অন্যপাশের টেবিলগুলিতেও কিছু দর্শনার্থী।

    বাবুটি বলল, ভিতরে এসে বসুন।

    যুবক বলল, বেশ হাওয়া দিচ্ছে। বারান্দাটা খুব খোলামেলা মনে হল তার।

    সুরেন কোথায় গেল কে জানে। সেই বোধ হয় খবর দেবে কুমার বাহাদূর নেমেছেন কিনা। সেই এখন তার কান্ডারী। সেই লোকটি হারিয়ে গেলে যা বিরাট প্রাসাদ তার পক্ষে রাজেনবাবু ওরফে কুমার বাহাদুরকে খুঁজে বার করা কঠিন হবে।

    বাবুটি বলল, পথে কোন কষ্ট হয়নি ত?

    —ঘুম হয়নি। গরম। রাতের ট্রেনে এত ভিড় জানতাম না।

    —তাহলে খুব কষ্ট গেছে। ওরে সুরেন বাবা, তোর হল? রাত জেগে এসছেন বাবু। তুই কোথায়?

    —আজ্ঞে যাই।

    অতীশ এই কথাগুলিতে মজা পাচ্ছে। সুরেন ভেতর থেকে যাই করছে, আর বাবুটি অনবরত হেঁকে যাচ্ছে, তোর হল?

    শেষ পর্যন্ত যা হল তাতে অতীশ আরও মজা পেল। হল অর্থাৎ এক কাপ চা এবং দুটো বিস্কুট। এই হতে এত সময়! এ বাড়িতে একসময় দানধ্যান পূজা-পার্বণ দোল দুর্গোৎসব বাই-নাচ, সঙ্গীত সম্মেলন এবং রাজা-বাদশা-মহাত্মারা পায়ের ধুলো রেখে গেছেন কত। সে এখন এই বাড়ির বিশাল বারান্দায় বসে এক কাপ চা দুটো ক্রিমকেকার খাচ্ছে।

    খেতে খেতে তার ওপরের দিকে চোখ গেল। বড় বড় তৈলচিত্র। কবেকার কে জানে। অধিকাংশ ছবি উলঙ্গ যুবতীদের। বিদেশিনী। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় কোন সুদূরের এক বাসভূমি তার চোখে ভেসে উঠল। সমুদ্রবেলায় সে। আর পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অথবা কোনও ভাঙা জাহাজের মাস্তুলে সে, দূরে সমুদ্রগর্ভে অতিকায় সেই ক্রস। কখনও ঢেউয়ে ভেসে উঠছে কখনও ডুবে যাচ্ছে। মাস্তুলের ডগায় সে লম্ফ জ্বালিয়ে নেমে আসছে। এইসব স্মৃতি মনে হলেই তার ভেতরে হাহাকার বাজে। কত বছর আগেকার এক দৈব ঘটনা তাকে এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এবং সেই আচ্ছন্ন ভাবটা আবাব তার মধ্যে ঢুকে গেলে সে কেমন আনমনা হয়ে গেল। সে চুপচাপ বসে দেয়ালের ছবি দেখতে দেখতে দূরের অদৃশ্য দিগন্তে বালুবেলা অথবা নীল সমুদ্রে সেই অতিকায় পাখির আর্ত চিৎকারে মুহ্যমান হয়ে পড়ল।

    —বাবু।

    অতীশ চোখ তুলে তাকাল।

    —আসুন।

    সে উঠে গেল ভিতরে। ঘরটা ফাঁকা। ডানদিকে কাঠের পার্টিসান দেয়া দেয়াল। পাশে দরজা। ভেতরে কিছু বাবু। টেবিলে দলিল দস্তাবেজের পাহাড়। তারা মনোযোগ দিয়ে কি-সব দেখছে। ঘরটা অতিক্রম করতেই বড় একটা হলঘর পড়ল। সেই ঘরটাও বড় বড় তেলরঙের ছবিতে সাজানো। কোথাও একটা লোক উবু হয়ে কি যেন করছে। ভাল করে লক্ষ্য করতে গিয়ে বুঝল লোকটার সম্বল বলতে একটা বালতি কিছু জল এবং ন্যাতা। সে টেনে টেনে ঘর মুছে যাচ্ছে।

    বাইরে থেকে সে ভাবতেই পারেনি ভেতরে এখনও সেই জাঁকজমক আছে। হাতীশালায় হাতী ঘোড়াশালায় ঘোড়া। সব কিছু এখানে বড় বেশি মহার্ঘ মনে হচ্ছিল। ঘরটার মাঝখানে কাশ্মীরী কার্পেট, সোফা, মাথায় রকমারি কাঁচের ঝালর। দুপাশে সেই বড় বড় বেলজিয়াম কাঁচের আয়না। একটি ঘড়ি লম্বা কালো রঙের। চারপাশটা সোনার জলে কাজ করা। থেকে থেকে বাজছে। ঠিক যেন জলতরঙ্গ বাজনা। ঘড়িটার দিকে তাকাতেই সুরেন বলল, দাঁড়ান। সুরেন চবর চবর করে পান চিবুচ্ছিল। মুখের গহ্বর আগুনের মতো লাল।

    সে দাঁড়াল।

    সামনে আবার একটা লম্বা ঘর। দেয়াল জুড়ে বুক-সমান উঁচু লম্বা সব কালো রঙের বেতের চেয়ার। এখানে দাঁড়ালে সে পর পর আরও সামনে তিনটে অতিকায় দরজা দেখতে পেল। কতবড় এই বাড়ি সব ঘুরে না দেখলে বোঝা যাবে না। সে পেছনে তাকালে বুঝল, ওদিকের দরজাটা কেউ বন্ধ করে দিয়ে গেছে। এখান থেকে একা পালাতে চাইলেও সে আর পালাতে পারবে না।

    সুরেন পরেছে একটা খাটো কাপড়। গায়ে রাজবাড়ির ছাপ মারা খাকি উর্দি। বোতামেও রাজবাড়ির ছাপ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গালে। মাঝারি হাইট। চোয়ালে মাংস কম। এক সময় শক্ত মজবুত ছিল মানুষটা, এখন হাড় কখানা ছাড়া কিছুই সম্বল নেই। হাতের রগ ভেসে উঠেছে। চোখে-মুখে সব সময় কেমন শঙ্কা। সে সুরেনের দিকে তাকিয়ে থাকলে বলল, ওখানটায় গিয়ে বসুন। এখনি নামবেন।

    সেই উঁচু মতো লম্বা চেয়ারটায় সে উঠে গিয়ে বসল। সামনে বিলিয়ার্ড টেবিল। লালরঙের সিল্ক কাপড়ে সবটাই ঢাকা। কোণায় একটা রিংয়ের মধ্যে ছোট বড় মাঝারি স্টিক। এ ঘরে রাজেনবাবুর পূর্বপুরুষদের তৈলচিত্র। নিচে কোনো এক বড়লাটের সঙ্গে গ্রুপ ছবি। রাজেনবাবুর প্রপিতামহের আমলে বড়লাট এ বাড়িতে পদার্পণ করেছিলেন বলে একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি কোণায় সযত্নে এখনও রাখা। তার নিচের ছবিটা যেমন ছোট তেমনি বিদঘুটে। একটা কালো কোট ছবিটাতে ঝুলছে। খালি কোট, ভেতর থেকে একটা হাত ফুটে বের হচ্ছে। কাঠের বেড়া ফাঁক করে হাতটা নিচে জলে কিছু যেন খুঁজছে। ছবিটা ভাল করে দেখার জন্য অতীশ নিচে নেমে গেল। কেউ নেই। কেমন এক নিঃসঙ্গ পুরী, বাইরে ট্রাম-বাসের শব্দ কান পাতলে শোনা যায়। আর মনে হচ্ছিল আর একটু গেলেই অন্দর মহল—সেখানে রাজেনবাবুর পিতৃপুরুষদের কেচ্ছা-কাহিনীর কূট-গন্ধ এখনও নাক টানলে পাওয়া যাবে। বিলিয়ার্ড টেবিলের অদূরেই পিয়ানো। ঢাকনাটায় ময়লা জমে আছে। একসময় এই ঘরটা ময়ফেলের জায়গা ছিল বোঝা যায়। সাহেব-সুবোরা আসত। মেমসাবরা আসত। সারারাত খানাপিনা চলত। কতকাল আগে সে-সব পাট উঠে গেছে বোধহয়। মানুষ মরে গেলে সাদা চাদরে ঢেকে দেবার মতো বিলিয়ার্ড টেবিল, পিয়ানো—সব ঢেকে রাখা হয়েছে এখন।

    সে এই প্রথম এখানে। রাজেনবাবুর বাইরে একটা পোশাকী ভালমানুষের চেহারা আছে। তার সঙ্গে কথাবার্তায় প্রথম দিন এমন মনে হয়েছিল। আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই তাকে অতীশের খুব ভাল লেগেছিল। কিন্তু যত বাড়ির অভ্যন্তরে ঢুকছে, তত এক সংশয় দানা বাঁধছে। ওর কিছুটা ভয় ভয়ও করছিল। রাজেনবাবুর বাড়ির ভেতরের হালচাল ওর কাছে কিছুটা অস্বাভাবিক ঠেকছে। এ সময় এক ধু-ধু মরুভূমির বুকে কোনো এক জরদগব পাখি তার চোখে ভেসে উঠল। এই এক ল্যাটা তার। সে অনেক কিছু দূরে অদূরে দেখতে পায়। পাখিটা ঠোঁট গুঁজে বসে আছে। একটা মরুভূমির কাঁকড়া গোপনে হেঁটে আসছে। টুক করে গলায় থাবা বসাবে। সে সহসা হাত তুলে কাঁকড়াটাকে তাড়াতে গেল। সে ভাবল, এটা কি করতে যাচ্ছে সে!

    তারপরই মনে হল ছবির জলটা নড়ে কি নড়ে না, সে প্রায় ছবির মধ্যে মুখ গুঁজে দেখার মত দাঁড়িয়ে থাকল। এবং বুঝল মনের ভুলে সে এ-সব দেখে ফেলে—এটা তার সেই কবে থেকে যে হয়ে আসছে। ছবিটা থেকে ভয়ে ভয়ে সে দূরে সরে দাঁড়াল। আজীবন এই এক ভয় সে বয়ে বেড়াচ্ছে। তখনই মনে হল ও-পাশের কোনও অদৃশ্য অন্ধকার সিঁড়িতে কেউ নেমে আসছে। সে দ্রুত তার নির্দিষ্ট জায়গায় ফিরে এসে বসে পড়ল। এটা তার নির্দিষ্ট জায়গা। এখানে সুরেন তাকে বসতে বলে গেছে। তার এদিক ওদিক যাবার নিয়ম নাও থাকতে পারে। আসলে সে সেই সরল ভীতু স্বভাবের মানুষ। ভেতরে কখনও কখনও যে গোঁয়ার মানুষটা উঁকি দেয়, তা নিতান্ত ফেরে পড়ে গেলে।

    বাড়িটাতে সোজা টানা লম্বা দরজা একের পর এক। একটা পার হলে আর একটা। যেখানটায় বসেছিল, সেখান থেকে ডাইনে বাঁয়ে দু-দুটো দরজা চোখে পড়ছে। সেই লোকটা এখনও ঘরের মেঝে মুছে যাচ্ছে। প্রচণ্ড ঘাম হচ্ছিল তার। মারবেল পাথরের মেঝে সে ঘষে চকচকে করে তুলছে। এই একমাত্র মানুষ তার কাছাকাছি। সিঁড়িতে তখন আর পায়ের শব্দ হচ্ছে না। পাশের ঘরে সরে যাচ্ছে। সে উঁকি দিয়ে দেখল রাজেনবাবু, সাদা শার্ট, গলায় টাই, সাদা জিনের প্যান্ট বড় গম্ভীর। কোন দিকে না তাকিয়ে তিনি দেয়ালের আড়ালে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন। আর তার ঠিক পিছু পিছু ফতুয়া গায়ে একজন মাঝবয়সী মানুষ কাঠের একটা ছোট্ট বাক্স নিয়ে রাজেনবাবুকে অনুসরণ করছে। অতীশের মনে হল, এক্ষুনি সেই হা হা হাসি শুনতে পাবে। আরে এস এস। কটায় এলে! সব ঠিক ত! কারণ অতীশের ধারণা তার আসার খবর রাজেনবাবু পেয়ে গেছে। এত অন্তরঙ্গ কথাবার্তার পর তাকে আর দশটা আমলার মতো দেখতে না পারারই কথা। সেই বাক্সধারী লোকটা তখন পাশের দরজা দিয়ে বের হয়ে এল। হাতে বাক্স নেই। ভেতরে কোন ঘরে রাজেনবাবু আর তার বাক্স বুঝি রেখে এল। মাঝবয়সী লোকটা একা এদিকের দরজায় আসতেই কুরকুর করে দৌড়ে এল সুরেন।

    মাঝবয়সী মানুষটা এত্তেলা দিল—কুমার বাহাদুর নেমেছেন। তার আগে মহারাজাধিরাজ গণ-নারায়ণ বীর বিক্রম এমন সব কিছু কি হাবিজাবি কথা—এবং অতীশের বুঝতে দেরি হল না, জমিদারী চলে গেলেও ঠাট বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন রাজেনবাবু। তার ফিক করে হাসি পেল।

    খবর পেয়ে সুরেন কোথায় আবার কুরকুর করে দৌড়ে গেল। তাকে কেউ কোন আমলই দিচ্ছে না। মাঝবয়সী মানুষটা তার দিকে ফিরেও তাকাল না—সোজা দরজাগুলির একটা দিয়ে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল। এবং দেখতে দেখতে মনে হল সারি সারি ক’জন নানা বয়সী মানুষ। পাটভাঙা ধুতি, পায়ে পামশু। পাশের অফিসটাতে ওদের সে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখেছিল। ওরা ঘরটায় ঢুকে প্রথম একে একে জুতো খুলে ফেলল। অতীশের বড় বেশি কৌতূহল—কোথায় এরা যায় দেখার বড় বাসনা। দেখলে মনে হবে ঈশ্বর দর্শনে যাচ্ছে। সে গুটি গুটি নেমে গেল। দেখল বড় কাঠের দরজা খুলে একে একে সবাই প্ৰণিপাত করছে। তারপর বেরিয়ে আসছে। টের পেলে অধম্ম হতে পারে—অতীশ তাড়াতাড়ি দেয়ালের ছবিতে মনোযোগ দিল।

    পাশ থেকে তখনই সেই বাবু, বাবা সুরেন তোর হল—সেই বাবু কালো আবলুশ কাঠের রং, চুল কাঁচাপাকা, চাঁচা মুখ, তেমনি দাঁত বের করে হাসল। বলল, এই হয়ে গেল। এবারে আপনাকে ডেকে পাঠাবেন কুমার বাহাদুর। আর একটু অপেক্ষা করুন। খবর দেওয়া হয়েছে।

    অতীশ ভারি বিভ্রমের মধ্যে পড়ে গেল। সবাই জুতো খুলে ঘরে ঢুকছে। বের হচ্ছে। তার পায়ে শু। কালো টেরিকটনের প্যান্ট সে পরে আছে। ফুল ফল আঁকা হাওয়াইন শার্ট গায়ে। সে জুতো খুলে ঢুকবে কি ঢুকবে না, জুতো খুলে ঢুকলে রাজদর্শন বড়ই পুণ্য কাজ, প্রায় ঈশ্বর দর্শনের শামিল—নেহাত দৈব বলে এই ঘরানার একমাত্র উত্তরাধিকারের সঙ্গে তার যোগাযোগ। অত সহজে হেলায় নষ্ট করার মতো আহাম্মক সে নয়। কিন্তু তখনই তার ভেতরের গোঁয়ার মানুষটা ফুঁসে উঠল। এই গোঁয়ার মানুষটাকে অতীশ বড় ভয় পায়। গোঁয়ার মানুষটার মাথা গরম হলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ঘিলু ফেটে যায়। রক্ত ঝরে। খুন খারাপি করতে দ্বিধা করে না। সে জুতোর ফিতা আলগা করে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু পা থেকে জুতো খুলতে তার সম্ভ্রমে বাধল

    সুরেন আবার কুরকুর করে হাজির। বলল, আজ্ঞে আপনি অতীশবাবু?

    অতীশ বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

    —হুজুর ডেকেছেন।

    সে দরজার কাছে যেতেই সুরেন হা-হা করে উঠল! অতীশ পেছন ফিরে তাকাল। দেখল সুরেন কাঠ হয়ে গেছে। চোখ ওর পায়ের দিকে।

    অতীশ কিছু বলল না। আসলে অতীশের ভেতরে সেই রাগী মানুষটা এখন একটা দৈত্যের মত সব অগ্রাহ্য করতে চাইছে। সে দরজা ঠেলে গট গট করে ঢুকতেই রাজেনবাবুর অন্তরঙ্গ সেই ডাক—আরে এস এস। কি রকম আছ? রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি ত! কটার গাড়িতে এলে?

    সঙ্গে সঙ্গে অতীশের রাগী মানুষটা ভোঁ করে কোথায় ছুটে পালাল। সে আবার সেই অতীশ দীপঙ্কর। সোজা সরল মানুষ। বলল, আর বলবেন না, বড় বেশি নিয়ম-কানুন বাড়িতে। সব ঠিক বুঝি না দাদা।

    —ও ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এ জন্য ব্যস্ত হবার কোনও কারণ নেই।

    অতীশ সোজা হয়ে বসল। না, সেই এক অন্তরঙ্গ কথাবার্তা। বড় সহজে দাদা, মানুষকে কাছে টেনে নিতে পারেন। এটা একটা মানুষের বড় গুণ। অতীশ এতক্ষণ অযথা ভয় পেয়েছে। এবং মনে হল সব নতুন কাজেই সে এভাবে সবসময় একটা শঙ্কা বোধ করে আসছে। আগে সে কম বয়সের ছিল, এখন বয়স হয়েছে অথচ সেই এক শঙ্কাবোধে সে পীড়িত হচ্ছিল। এটা তার ভারি দুর্বলতা জীবনে। সে নিজেকে সাহসী করে তোলার জন্য বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না আপনার এখানে আমাকে কি করতে হবে।

    ঘরে ভারি সুঘ্রাণ। যেন কেউ এইমাত্র কিছু স্প্রে করে দিয়ে গেছে। গোল অতিকায় মেহগনি কাঠের টেবিলের ও পাশে রিভলবিং চেয়ারে কথা বলতে বলতে রাজেনবাবু ঘুরে ফিরে যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে কান চুলকাচ্ছেন পেনসিল দিয়ে। কাচের রং-বেরংয়ের দোয়াতদানি, নানা সাইজের বিদেশী কলম। একটা লাল পেন্সিল। এক পাশে ডাঁই করা কাটা এনভেলাপ। তিনি কথা বলতে বলতে কাজ সারছিলেন। চিঠিপত্র দেখছিলেন। দরকার মতো জায়গায় জায়গায় লাল টিক-মার্ক। মাঝে মাঝে বেল টেপা। উর্দি-পরা সুরেন হাজির। এটা ওটা এগিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। অতীশের কথায় কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। বললেন, ও তেমন কিছু না। আমার একজন ভালমানুষের দরকার। জান তো সৎ মানুষের বড় অভাব আজকাল। তোমার কথা আমি গোবিন্দের কাছে শুনি প্রথম। তোমাকে দেখি বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে। গোবিন্দই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল—নিশ্চয়ই তোমার মনে পড়ছে সব।

    অতীশ তাকিয়েই আছে, কি বলবে বুঝতে পারছে না।

    —আজকাল অকপট কথাবার্তা কেউ বলে না। তোমার কিছু কথাবার্তা আমার কাছে ভারি অকপট মনে হয়েছিল।

    অতীশ বলল, তাই বুঝি!

    অতীশ কি ভেবে বলল, আপনি একবার শুনেছি বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন, একজন সৎ মানুষ চাই। ভাল মানুষ। বেঁচে থাকার সব রকমের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে।

    —তুমি দেখেছিলে বিজ্ঞাপনটা?

    —দেখিনি। গোবিন্দদাই বলেছেন। তিনিই আপনার কাছে চলে আসতে বললেন, কলকাতায় না এলে মানুষের নাকি কপাল খোলে না।

    —তাহলে এটা বিশ্বাস কর?

    বিশ্বাস করা ঠিক কি ঠিক না অতীশ বুঝতে পারছে না। সে স্কুলে চাকরি করত। বেশ ছিল। তখনই ঘুণপোকার মতো মাথায় কিটকিট করে অদৃশ্য এক চক্র ঢুকে যাচ্ছে। সে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল। কে যেন কোন সুদূর থেকে বলছে, ছোটবাবু মনে রাখবে, ইউ হ্যাভ এ গুড সোল। লার্ন টু বি ওয়াইজ। ডেভালাপ গুড জাজমেন্ট অ্যান্ড কমনসেন্স। সমুদ্র তোমাকে অযথা তবে ভয় দেখাতে পারবে না। জল এবং খাবার ফুরিয়ে গেলে মরীচিকা দেখবে সব অদ্ভুত রকমের। ভয় পাবে না। দেন প্রেজ দ্য লর্ড।

    রাজেনবাবু বললেন, তুমি কিছু বলছ না কেন?

    সংবিৎ ফিরে পাবার মতো অতীশ তাকাল। বড় বড় চোখ—কেমন অসহায় ছেলেমানুষের মতো চোখ দুটো এবং সে মাথা নিচু করে বলল, জীবনে খুব বড় হতে চাই না। সৎভাবে বাঁচতে চাই। আমায় শুধু এ সুযোগটুকু দেবেন। স্কুল আমাকে সে সুযোগটুকু পর্যন্ত দিতে চায় নি।

    —আলবাৎ। তুমি কি ভয় পাচ্ছ! তোমার সঙ্গে সবার আলাপ করিয়ে দেব। এরা আমার বিশ্বস্ত লোক। তুমি খুশী হবে।

    অতীশ বলল, শহর আমার এমনিতে ভাল লাগে না। বেশ ছিলাম। জানেন, আমার স্কুলের সামনে ছিল রেল-লাইন, তারপর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। স্কুল ছুটির পর কতদিন একা একা কতদূরে চলে গেছি। গাছপালার মধ্যে আলাদা একটা মজা আছে।

    —থাকতে থাকতে এই শহরও একদিন ভাল লেগে যাবে।

    অতীশ কি বলবে ভেবে পেল না। চাকরিটা সে প্রায় বলতে গেলে দুম করেই ছেড়ে দিয়েছিল। চাকরি ছাড়ার আগে কে যেন কেবল সুদূর থেকে বলত, ফলো ওনলি হোয়াট ইজ গুড।

    অতীশের এমনই হয়। নতুন কাজে ঢুকলেই এমন হয়। কে যেন দূর থেকে তাকে বার বার সতর্ক করে দেয়। কবে সেই যে মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল তারপর থেকে বিচলিত বোধ করলে, শুনতে পায় তিনি দূর অতীত থেকে বলে যাচ্ছেন, কেউ আমাদের ডাঙায় পৌঁছে দেয় না ছোটবাবু। নিজেকে সাঁতরে পার হতে হয়।

    রাজেনবাবু বললেন, আমাদের একটা কারখানা আছে। আমার ঠাকুরদা কারখানাটা করে গেছিলেন। জানই ত জমিদারদের ওসব পোষায় না। বাবা-দাদাদেরও পোষাত না। এই শখ আর কি। কিন্তু এখন ত আমাদের শখ নয়। এটা প্রফেশান বলতে পার। তাই জায়গায় জায়গায় ঠিক ঠিক লোক বসিয়ে দিচ্ছি।

    অতীশ বলল, কি করতে হবে?

    —দেখাশোনা।

    ঠিক বুঝতে না পেরে বলল, আমি ওসব ভাল বুঝি না। ওখানে কি হয়?

    —কনটেনার। টিন কনটেনার। দেখলে সব বুঝতে পারবে।

    —ওগুলো কোথায় যায়?

    রাজেনবাবু হেসে ফেললেন। অনভিজ্ঞ। জানে না। কিন্তু ঐ যে বলে না, চোর-ছ্যাঁচোড়ের হাত থেকে কেড়ে নিতে না পারলে, ঠিক মানুষ বসাতে না পারলে কাজ হবে না। সময় এবং চর্চা সব ঠিক করে দেয় মানুষকে। রাজেনবাবু তক্ষুনি বেল টিপলেন, যেন যা বলার ছিল শেষ। সুরেন হাজির। কি বলতেই কেউ আর একজন ঘরে ঢুকল। রাজেনবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবেন। আজ থেকেই কাজে লেগে যাও। থাকার কোনও অসুবিধা হবে না। মেস বাড়ি আছে। সেখানে খেতে পার। স্কুলে যা পেতে তার চেয়ে বেশিই পাবে। কি ঠিক! পরে কোম্পানির উন্নতি হলে তোমারও উন্নতি।

    অতীশ এ-রাজেনবাবুকে যেন চিনতে পারল না। ব্যস্ত, তক্ষুণি যেন কোথাও জরুরী কাজে যাবেন—কেমন গম্ভীর কথাবার্তা। তার সরল সহজ মানুষটা বিচলিত বোধ করল। এবং ভেতরে অস্বস্তি। তবু হাতের কাছে কাজ, সে ছেড়ে দিতে পারে না। তার এখন যেভাবে হোক আবার ঝুলে পড়া দরকার। কলকাতায় এটা ১৯৬৪ সাল। সে বহু দেশ-বিদেশ করে, স্কুলের জীবন সাঙ্গ করে শেষে এক রাজার বাড়িতে হাজির। জীবনের নতুন পালা।

    কথাবার্তা সারতে সময় বেশি লাগল না। প্রাইভেট অফিসের নধরবাবু তাকে সঙ্গে নিয়ে অতিথিশালার দোতলার একটা এক কামরার ঘর দেখালেন। আপাতত এখানেই থাকা। পাশে বাথরুম—সামনে লম্বা বারান্দা। দোতলার নিচের ঘরগুলিতে বচসা চলছিল—ওপরের ঘরগুলির চার নং ঘরটা তার জন্য বরাদ্দ। অন্য সব ঘরগুলোয় তালা মারা। দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়ছে। দেয়ালে ফাটল বড় বড়। যে কোন মুহূর্তে সব ভেঙে পড়তে পারে। সে বুঝতে পারল, তার কপালই এমন লঝঝড়ে। সে ঘুরে ফিরে দেখতে চাইল, কোথায় কতটা রেলিং ভাঙা, কোথায় কখন ফাটল আরও প্রশস্ত হতে হতে আকাশ দেখা যেতে পারে, এবং সে বিস্মিত হল দেখে, শেষ ঘরে কেউ বসে আছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আশ্চর্য সুপুরুষ। তার পাগল জ্যাঠামশাইর মতো চুপচাপ। দেয়ালের দিকে নিথর চোখ। জানালায় সে, নতুন লোক—কিছু আসে যায় না যেন। তারপরই সে কেমন বিমূঢ় হয়ে গেল—দরজার বাইরে থেকে তালা মারা। লোকটাকে আটকে রাখা হয়েছে তবে!

    এই রাজবাড়ির কেতাকানুন ঠিক সে জানে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক কিনা তাও সে জানে না। তাড়াতাড়ি সে সরে যাবার সময়ই লোকটি ডাকল, হেই নবীন যুবক।

    অতীশ ঘুরে দাঁড়াল।

    —হেই নবীন যুবক তালাটা খুলে দেবে?

    অতীশ বুঝল পাগল মানুষ। আটকে রাখা হয়েছে। সে চলে যাচ্ছিল, আবার ডাক—হেই নবীন যুবক দরজাটা খুলে দাও। ভগবান তোমার ভাল করবেন।

    কথাবার্তা খুবই স্বাভাবিক। তার বলতে ইচ্ছে হল, আপনাকে কে আটকে রেখেছে?

    —ঈশ্বর। তিনি মাথার ওপরে হাত তুলে দেখালেন। তারপর বললেন, রাজার বাড়িতে ঢুকে খুব ঘাবড়ে গেছ দেখছি!

    অতীশ ভাবল বারে বা, এত প্রায় অর্ন্তযামী। লোকটা মুখ দেখলে মানুষের ভেতরটা দেখতে পায়। তার কৌতূহল হল। বলল, পাশের ঘরগুলিতে কারা থাকে?

    —বাবুরা থাকে।

    তখনই অতীশ লক্ষ্য করল বারান্দার ওপর আর একটা দরজা বসানো। দরজাটা দিয়ে এই মানুষটির ঘর একেবারে আলাদা করে রাখা হয়েছে। দরজা খোলা রেখে গেছে কেউ ভুলে। সে এ জন্য এদিকটায় ঢুকতে পেরেছে। পৃথিবী থেকে লোকটাকে গোপন করে রাখার জন্য বড়ই সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে। লোকটার কি অপরাধ জানার ইচ্ছে হল তার। নীচে দেখল নধরবাবু সিঁড়ি ধরে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন। হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠলেন, ওকি করছেন অতীশবাবু! দরজা খুলল কে? ওখানে না, ওখানে না। সঙ্গে সঙ্গে বড় একটা তালা ঝুলিয়ে চলে গেলেন। এবার বারান্দা থেকে সোজা পুবের দিকে তাকালে বড় তালাটাই কেবল চোখে পড়ে। ওখানে একটা আলাদা ঘর, কার বাপের সাধ্যি আছে আর টের পায়।

    বিকেলের দিকে অতীশ নিজের ঘরে শুয়েছিল। একটা তক্তপোশ চাদর তোষক বালিশ রাজবাড়ি থেকেই এসেছে। সবই নধরবাবু ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলে গেছেন, আজ বিশ্রাম করুন। কাল খবর দেব। রাতের খাবার ঘরেই আসবে। চা আসছে। কিছু দরকার হলে বলবেন। কোন সংকোচ করবেন না। নিজের বাড়ি মনে করবেন। একই পরিবারের লোক ভাববেন। তবে আর কোন কষ্ট থাকবে না। আমি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ওদিকের কোয়ার্টারগুলোর একটাতে থাকি। নিচের তলায় আমার ঘর। বলে তিনি চলে গেছিলেন। তারপর এলেন আরও একজন প্রবীণ মানুষ। লম্বা, বেশ সৌখিন। কানে আতর মাখানো তুলো গোঁজা। মাথায় প্রশস্ত টাক। বিছানায় বসে বললেন, তোমার বাবা আমাকে চেনেন। আমার নাম রাধিকাবাবু

    অতীশ রাধিকাবাবুর নাম শুনেছে। কুমার বাহাদুরের বাবার আমলের লোক। তিনি বললেন, যে ক’দিন ঠিকঠাক না হয়ে বসছ, সে ক’দিন আমার বাড়িতে ডালভাত খাবে। কাল থেকে। মনে থাকে যেন। এরপরই এল গোলগাল চেহারার একজন মানুষ। বলল, আমার নাম রজনীবাবু। একে একে অনেকেই এল, পরিচয় দিল কুমারবাহাদুরের কোন কোন কনসার্নে কে আছে, কি করে এবং দুটো চারটে উড়ো কথাও বলে গেল। মশাই, স্কুলে ছিলেন বেশ ছিলেন। এখানে মরতে এলেন কেন? সে ঠিক বুঝল না কি জবাব দেবে। তারপরই সে শুয়ে পড়েছিল। নতুন জায়গায় এলেই তার মন খারাপ হয়ে যায়। মুখচোরা মানুষদের যা হয়। প্রায় লাইনবন্দী হয়ে লোক এসে দেখা করে যাওয়ায় কিছুটা ঘাবড়েও গিয়েছিল। এত খাতির! তারপর সে দেখল, একজন লাঠি হাতে লোক সেই আটকে রাখা মানুষটাকে নিয়ে তার দরজার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। মানুষটা তার জানালায় এসে নড়তে চাইল না। অতীশ কেন জানি সম্ভ্রমবোধে নিজেই উঠে গেল। মানুষটা সহসা কানের কাছে মুখ এনে কি বলতে চাইল—সবটা সে শুনল না। খুন-টুনের কথা। নবীন যুবক তুমি খুন হয়ে যাবে এমন কথাটথা। সবটা শোনার আগেই লোকটা ঠেলতে ঠেলতে সেই মানুষটাকে সিঁড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকল। অতীশ দরজা থেকে নড়তে পারছে না। কেমন আড়ষ্ট ভাব। সুদূরে তখন কেউ যেন হেঁকে যাচ্ছে, হাই ছোটবাবু ভয় পাচ্ছ কেন! স্ট্রাগল ইজ দ্য প্লেজার, গো অন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
    Next Article মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }