Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1863 Mins Read0

    ঈশ্বরের বাগান – ৩৪

    ।। চৌত্রিশ ॥

    আজ বাবা আসবেন। সঙ্গে পঞ্চতীর্থ কাকার আসার কথা। এই প্রথম তার কলকাতার বাসাবাড়িতে বাবা আসছেন। টুটুলের বিদ্যারম্ভ নিয়ে বাবার মাথায় পোকা ঢুকে গেছে। তিনি তাঁর মেজ পুত্রটির উপর ভরসা রাখতে পারছেন না বলে নিজে আসছেন। বংশের প্রথম পুত্র সন্তান—তার জলদানে পিতৃলোক পরিতৃপ্ত হবে—এমন এক অমোঘ বিশ্বাস বাবার। পুত্রটি তার এ-সব শাস্ত্রীয় বিধি অবহেলা করতে এতটুকু দ্বিধাবোধে বিন্দুমাত্র বিচলিত নাও হতে পারে।

    কলকাতার নামে বাবার ভীতি প্রবল। চিঠিতে সতর্কতার শেষ নেই। তবু একান্ত অনন্যোপায় হয়েই তিনি আসছেন।

    অতীশ কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। রাত থাকতেই তার ঘুম ভেঙে গেছে। পাশে টুটুল মিণ্টু ঘুমোচ্ছে। নির্মলা উঠে পড়েছে কখন টের পায়নি। একবার ডেকে গেছে, এই ওঠো। চা হয়ে গেছে। কত কাজ! তোমরা কেউ উঠছ না! কিরে বাবা, তোমাদের কি হল!

    আসলে অতীশের কি হয়েছে সে নিজেও ঠিক বলতে পারছে না। টুটুলকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার পর তার মনে হয়েছে, সুদূরে সে ঠিক আছে। তার ভালমন্দ সে সব লক্ষ্য রাখছে। সে কোনও এক দূরাতীত রহস্য। না হলে টুটুল যেন নিরাময় হয়ে ফিরত না। কুলুঙ্গিতে সেই দেবীমূর্তি। ঠিক মাথার ওপরে অতীশ তাকে রেখে দিয়েছে। সংসারের শুভাশুভের সবটাই এখন দেবী নির্ভর। কে বলবে, আসলে এটা একটা ধূপবাতিদান। পরীর মতো দেখতে। কালো কষ্টিপাথরের মূর্তিটির হাতে দুটো পদ্মফুল। ফুলে অজস্র ফোকর। ধূপবাতি গুঁজে দেবার জন্য ফোকরগুলি রাখা হয়েছে। দুটো পাখা—কোনও উড্ডীয়মান পাখির মতো, যেন এইসব জগৎ সংসারের বাইরেও এক রহস্যময় জগৎ রয়ে গেছে—যেখানে অবলীলায় কোনও প্রাণপ্রবাহ বিরাজমান। বাবা এই দেবীমূর্তি দেখে বলতে পারেন, এ আবার কোন দেবতা। তুমি আবার কার ঘোরে পড়ে গেলে!

    মূর্তিটি সন্তর্পণে লুকিয়ে ফেলা দরকার। কিংবা অগোচরে তুলে নিয়ে কোথাও রেখে দিলে ভাল হয়। নির্মলা মাঝে মাঝেই সংশয় প্রকাশ করেছে, এটা তুমি কোথায় পেলে! এত ওপরে তুলে রেখেছ কেন! টুটুল মিণ্টু ধরলে রাগ কর কেন। বাড়ি থেকে বের হবার মুখে কুলুঙ্গির নিচে দাঁড়িয়ে থাক কেন!

    সে জবাব দেয়নি।

    নির্মলা অবশ্য জানে মানুষটা মাঝে মাঝে ঘোরে পড়ে যায়—এই ঘোর থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত মূর্তিটির কাছে তার মানুষটা কোনও অবলম্বন খুঁজে পায় হয়তো। সে খুব বেশি প্রশ্ন করে না এ- জন্য। সামান্য অবহেলা দেখালে নির্মলা দেখেছে, মানুষটা তার গুম মেরে যায়। কথা বলে না। কি বলবে! অতীশের যে মনে হয়—নির্মলার জরায়ু থেকে রক্তপাত, টুটুলের এতবড় দুর্ঘটনা, কোনো অশুভ আত্মার প্রতিশোধস্পৃহা থেকে। এই যে এখন, নির্মলা সুস্থ, স্বাভাবিক এবং প্রায় তরুণীর মতো উচ্ছল, সব এই এক বিগ্রহের কৃপা।

    টুটুল কতদিন বলেছে, মা পুতুলটা নামিয়ে দাও, আমরা খেলব।

    মিণ্টু বলেছে, আমার আর একটা পুতুল হবে। দাও না। নির্মলার এক কথা, তোমার বাবা রাগ করবে।

    নির্মলা টের পেয়েছে, এই কষ্টিপাথরের মূর্তিটির প্রতি তার মানুষটার দুর্বলতা জন্মে গেছে। না হলে ভোররাতে হাসপাতাল থেকে ফোনে কেউ কথা বলতে চাইছে বলার সঙ্গেই অতীশ পাগলের মতো ছুটে গিয়ে মূর্তিটিকে তুলে বলত না, টুটুলের কিছু হলে আমি তোমায় ভেঙে চুরমার করে ফেলব।

    .

    বাবা আসছেন। টুটুলের বিদ্যারম্ভ। অতীশ অফিস ছুটির পর নির্মলাকে নিয়ে সব কেনাকাটা করেছে। বাবার ফর্দ মিলিয়ে দেখেছে প্রায় সব কেনা হয়ে গেছে। টুটুলের সাদা পাঞ্জাবি ধুতি আজই আসবে। তিনটে কম্বলের আসন লাগবে। এই প্রথম অতীশ তার পুত্রের জন্য পুজো-আর্চার ব্যবস্থা করছে। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে বাবা দেবীর সামনে তার নাতির হাতেখড়ি দেবেন। জীবনের প্রথম কাজ এটা অতীশের। কোনও অনিয়ম বাবা সহ্য করবেন না।

    তখনই মনে হল, বাবা চিঠিতে কবে যেন জানিয়েছিলেন, বর্তমানে তার গ্রহ অবস্থান ভাল যাচ্ছে না। পঞ্চতীর্থকাকা সঙ্গে আসছেন, গ্রহের কোপ থেকে আত্মরক্ষার নিমিত্ত তিনি কিছু ব্যবস্থাদি করতে পারেন।

    আসলে বাবার একরকমের জীবন গেছে, তার আর একরকমের। দুই জীবনে এত তফাত মাঝে মাঝে তাকে বিমূঢ় করে দেয়।

    নির্মলা না পেরে এবারে কম্বল সরিয়ে দিল, এই ওঠো। বাজারে যাবে না!

    তার আজ ছুটি। রবিবার। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। বাবা কি খেতে ভালবাসেন নির্মলা জানে।

    সে উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল।

    টুটুল উঠে বসেছে। মিণ্টু বাবার সঙ্গে সঙ্গে নেমে গেছে। কারণ এরা যেন টের পায় বাবার সঙ্গে তারা উঠে না পড়লে মা রাগ করবে। বাবা শুয়ে থাকলে তারাও শুয়ে থাকতে পারে। শীতের জন্য সহজে উঠতে ইচ্ছে করে না। টুটুল উঠেই দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। জীবনের এ মুহূর্তগুলিতে এক আশ্চর্য মাধুর্য আছে। ক’মাস ধরে একের পর এক অসুখ-বিসুখ দুর্ঘটনা লেগে ছিল। প্রতি মুহূর্তে এই সব আতঙ্ক মানুষকে কতটা কাবু করে রাখে এ ক’মাসে তারা তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। মিণ্টু জলে ডুবে গেছিল, সে অসুস্থ হয়ে বাপের বাড়ি। পরে হাসপাতাল। টুটুল পড়ে গিয়ে হাসপাতালে, নির্বান্ধব এই শহরে তারা একা। তাদের ওপর দিয়ে এতো সব ঝড় গেছে এ মুহূর্তে যেন তা বিশ্বাসই করা যায় না।

    অতীশ বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখল, টেবিলে চা বিস্কুট। সে তাড়াতাড়ি চায়ে চুমুক দিয়ে দেখল বেশ বেলা হয়ে গেছে। এবং বাজার সেরে ফিরে এসে দেখল, কুম্ভবাবু বসে আছে।

    কুম্ভবাবু অকারণে আসে না, কারখানার কোথাও কোনও নতুন সমস্যা, কিংবা বউরানীর মেজাজ অথবা কুমারবাহাদুরের কারখানা নিয়ে নতুন কোনও পরিকল্পনা, অর্থাৎ এমন সব খবর নিয়ে সে আসবে, যাতে করে অতীশ আবার আর এক বিপাকে পড়ে যায়।

    অন্তত আজকের দিনটা অতীশ ভেবেছে নিজের মত করে ভোগ করবে। কারখানার চিন্তা মাথায় রাখবে না। বাবা আসছেন, দুদিন বাদে টুটুলের হাতেখড়ি। কুম্ভর স্ত্রী হাসিকে নির্মলা বলে এসেছে, সেদিন যেন তাকে কাজে একটু সাহায্য করে। ভোগ হবে। এক হাতে নির্মলা করে উঠতে পারবে না। তার ঠিক এসব কাজে বিশেষ অভিজ্ঞতাও নেই।

    বাড়িতে থাকতে মা তাকে রান্নাঘরে বেশি ঢুকতে দিত না। নির্মলাও ঠিক রান্নাবান্না জানে না, ধরা পড়ে যাবে বলে এড়িয়ে গেছে। বরং সে বাবার গৃহদেবতার ফুল তোলা থেকে ঠাকুরের বাসনকোসন ধোওয়ার মধ্যে নিজেকে বেশি খুশি রাখতে পারত। এসব কারণে নির্মলার ভয় আছে, কাজের দিনে সে ঠিক পেরে যদি না ওঠে, অতীশ তার দু’একজন বন্ধুবান্ধব এবং যাদের কাছে সে উপকৃত হয়েছে এমন সব লোকজনকে বলে ফেলেছে। এখনও দুদিন বাকি, কিন্তু নির্মলার তাড়া দেখলে মনে হবে আজই যেন সেই দিন। সে এসে বসতে না বসতেই আবার চা এল। আসলে কুম্ভবাবু সম্ভবত এসেই বলেছে, বৌদি চা। নির্মলা কুম্ভবাবুর মধ্যে যে একটা ধূর্ত মানুষের বাস আছে আজ পর্যন্ত টের পায়নি। সেও কুম্ভর সম্পর্কে নির্মলাকে কোনও কথা বলেনি। তিন বছরে কুম্ভ কি প্রকৃতির, কেন এই সকালে আসা, নিশ্চয়ই কোনো গোপন খবর নিয়ে আসবে, যা শুনলে সে আবার ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বসে থাকতে পারে, কিংবা পচা টাকার গন্ধ এসব ভেবে সে কেন যে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে গেল।

    ডাক খোঁজে কুম্ভবাবু ওস্তাদ। সে টুটুলকে এসেই আদর করছে। বাবা টুটুল, তোমার হাতেখড়ি! তুমি স্কুলে যাবে। কত বড় হবে! মিণ্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, কিরে, তুই এত কাজের কবে থেকে হলি!

    কাপ প্লেট নিয়ে যাবার সময় কুম্ভর কথায় ফিক করে হেসে দিল মিণ্টু।

    অতীশ বসে আছে। ওর ঘরে আসবাবপত্র কম। করিডর পার হয়ে সামনের ঘরটায় লোকজন এলে বসে। একটা তক্তপোশ, তোষক ভাঁজ করা। কেউ এলে তক্তপোশেই বসে। কুন্তবাবু জানালায় গিয়ে একবার কি দেখে এল। জানালার পাশে পাতাবাহারের গাছ। গাছের ফাঁক দিয়ে নতুন বাড়ির পাশের রাস্তাটা দেখা যায়। জানালা বরাবর বিশ ত্রিশ গজ দূরে কুম্ভবাবুর বাসার সদর দরজা। এই সকালে তার বাড়িতে কেউ এল বোধহয়। আসতেই পারে। কুম্ভবাবুর বাসায় লোকজনের কামাই থাকে না। তার কাছে আসে, তার বাবার কাছে আসে, ছোট দুই ভাই শম্ভু দুলাল তাদের কাছেও আসে। কুন্তবাবু বোধহয় টের পেয়েছে, যে এল সে তার কাছে আসেনি। এমন কি তার স্ত্রী হাসির কাছেও কেউ কেউ আসে।

    নির্মলা ঘর পার হয়ে ভেতরের দিকে যাচ্ছে। কুম্ভ ফিরে এসে বলল, বলতে নেই বৌদির শরীরটা ফিরেছে। টুটুলের মাথার চুল ফাঁক করে ক্ষতস্থানটা দেখতে দেখতে বলল, খুব বেঁচে গেছিস বাবা। যা দেখালি!

    অতীশ কথা বলছে না। অতীশ জানে, কুম্ভবাবু আসল কথায় আসার আগে অনেক কথা বলে নেয়। আরও কি বাকি আছে দেখা যাক।

    আপনার বাবা আসছেন আজ।

    আসার কথা।

    থাকবেন ক’দিন।

    থাকার কথা।

    অতীশের কথায় কোনও আগ্রহের প্রকাশ নেই। এসেছে, কথা না বললে খারাপ ভাবতে পারে, সেই ভেবেই যেন বলা। আসলে কুম্ভ এই সকালে কেন হাজির তাও বুঝতে পারছে না। কুম্ভ সিগারেট বের করে প্যাকেট পকেটে রাখার সময় বলল, আপনার বাবা তো বউরাণীকে চেনে শুনেছি।

    চেনে।

    বউরাণীর বাবা কি আপনাদের কেউ হয়?

    হয়ও আবার কিছু হয়ও না।

    তার মানে?

    মানে, বাবা, জ্যাঠামশাই বউরাণীর ঠাকুর্দার জমিদারীতে কাজ করতেন। আমার মেজ জ্যাঠামশাইকে বউরাণী ভূঁইঞা দাদু ডাকত। বাবাকেও। তখন বউরাণী ফ্রক পরত। ভারি মিষ্টি ছিল দেখতে।

    এখন মিষ্টি না!

    মিষ্টি কথাটা না বলাই ঠিক ছিল। বউরাণী বলতে গেলে পরীর মতো—এখনও বউরাণী সেই শৈশবের সুবাস শরীরে টিকিয়ে রেখেছে। কাছে গেলেই তার কেমন মোহ সৃষ্টি হয়। তার প্রতি বউরাণীর দুর্বলতার কথাও গোপনে কিভাবে যে চাউর হয়ে গেছে রাজবাড়িতে। এই একটা ভয় মাঝে মাঝে তাকে বিচলিত করে। বউরাণীর মেজাজ সে এই তিনবছরেও বুঝতে পারছে না। শৈশবের সেই শ্যাওলা ধরা ঘরে সে আর অমলা, ফ্রক তুলে অমলার সেই হাত টেনে নেওয়া—এবং সেই থেকে সে পৃথিবীর আর এক মজার খবর পেয়ে গেছিল, যা আজও তাকে তাড়া করছে।

    কুম্ভ দেখল, অতীশবাবু ভিতরের ঘরে ঢুকে কি খুঁজছে। তার কথার কোনও জবাব না দিয়েই উঠে গেছে। আসলে শৈশবের সেই স্মৃতি মনে হলে তার চোখ মুখ রক্তাভ হয়ে যায়—সেই নারী এখন এই রাজবাড়ির প্রায় বলতে গেলে ক্লিওপেট্রার ভূমিকায়। কুমারবাহাদুরকে নাকি বউরাণী শরীর দেখিয়ে বোকা বানিয়ে রেখেছে, অথবা এও চাউর হয়ে যায়, বউরাণীর মতো কুমারবাহাদুরেরও আরও যে কেউ নেই তা নয়, বছরে ছ’মাস সে বিদেশে পড়ে থাকে কিসের টানে! রাজার অন্দরের খবর নানারকম পাখা গজিয়ে উড়ে বেড়াবেই, যে যার মতো অর্থ করে নেয়।

    কুম্ভ ফের বলল, বউরাণী কি জানেন আপনার বাবা আসছেন?

    ঠিক জানি না।

    সে আসলে কিছুই খুঁজছে না। এই সকালে এসে কুম্ভবাবুর বাবা-রহস্য নিয়ে পড়ার মধ্যে কি মজা আছে বুঝতে পারছে না।

    আপনি তো ঈশ্বর-টিশ্বর মানেন না। মেসোমশাই শুনেছি উল্টো। আমার বাবা তো বলেন, কি বাপের কি ছেলে!

    বাবা এখন মেসোমশাই হয়ে গেছেন আরও কি হবে কে জানে। শুরু যখন করেছে, শেষ না করে ছাড়বে না। মোসোমশাইকে দেখলে না জানি কি বলত! অতীশ সাধারণত এমনিতেই কম কথা বলে। বাবাকে নিয়ে এখন কুম্ভবাবু পড়েছে। বাবার যশোগান শুরু হয়েছে। দেখলে কিনা জানি হবে। বাবা তার সুপুরুষ, দীর্ঘকায়, চুল ছোট করে ছাঁটা। কাঁচাপাকা। মাথায় বাবার লম্বা শিখাটি যাতে স্পষ্ট ফুটে ওঠে সেজন্য চুল এক-আধ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেন না। বাড়িতে খড়ম পায়ে দেন। যজনযাজনে গেলেও তাই। সাদা ধবধবে উপবীত। সেলাই করা জামা গায়ে পারতপক্ষে দেন না। নামাবলি সম্বল।

    কুম্ভ বলল, বাবা বলেছেন, দেখলেও নাকি পূণ্য। কবে আসছেন?

    আজই আসার কথা। সকালের ট্রেনে আসতে পারেন। তারপরই কি মনে পড়ায় সে ডাকল, নিমু নিমু!

    নির্মলা রান্নাঘর থেকেই বলল, দেখতো মিণ্টু তোর বাবা কি বলছে।

    মিণ্টুর বদলে টুটুল দৌড়ে হাজির—বাবা তুমি কিছু বলছ?

    তোর মাকে জিজ্ঞেস করত নবর বাবা গঙ্গাজল দিয়ে গেছে কিনা!

    অতীশের বাসায় গঙ্গাজলের পাট নেই। সে এ-সবের খুব প্রয়োজনও বোধ করে না। কিন্তু বাবা এসেই গঙ্গাজল চাইবেন সে জানে। রাস্তাঘাটের ছোঁয়াছুঁয়ি, তারপর বাড়ির গৃহদেবতা শালগ্রামশিলা গলায় গামছা বেঁধে নিয়ে আসবেন। গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেই বাবার কাছে পৃথিবী পবিত্র। সেই জলই এখনও আনা হয়নি। বাবা চিঠিতে সব লিখে দিয়েছিলেন, কিন্তু গঙ্গাজলের কথা উল্লেখ করেন নি। নির্মলাই মনে করিয়ে দিয়েছিল, নবর বাবাকে বলো, যেন এক ঘড়া গঙ্গাজল নিয়ে আসে। অতীশ তখন শুনতে পাচ্ছে, মিণ্টু আর টুটুল দু’জনই দৌড়ে গিয়ে বলছে, মা, বাবা গঙ্গাজল চাইছে।

    তোমার বাবার সাত সকালে গঙ্গাজলের কি দরকার পড়ল!

    লুচি ভাজার গন্ধ আসছে। নির্মলা উঠে আসতে পারছে না। অতীশ বিরক্ত হয়ে নিজেই উঠে গেল। এক একটা বিচ্চু, কি বললাম, আর কি গিয়ে বলল। সে উঠে গিয়ে দেখল, নির্মলা এক হাতে লুচি বেলছে, ভাজছে। আলু কাটা। আলুর ছেঁচকি, ডিম ভাজা লুচি, ছুটির সকালে এই জলখাবার। অন্যদিন রুটি। নির্মলাদের বাড়িতে, সঙ্গে দুটো মিষ্টি থাকে। নির্মলা বাপের বাড়ির প্রাচুর্যের অভ্যাস অন্তত ছুটির দিনটায় জলখাবারে বজায় রাখার চেষ্টা করে। অতীশ বুঝতে পারে গরীব মানুষের হাতে পড়ে নির্মলা নাজেহাল, অন্তত ছুটির দিনটাতে বাপের বাড়ির মতো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে সে খুশি হয়।

    ওকে দেখেই নির্মলা মুখ তুলে চাইল। নির্মলা দীর্ঘাঙ্গী এবং ঋজু চেহারা। মেদ কম, দীপ্তি আছে। শীতের দিনে নাকে অল্প ঘাম জমলে দেবী দেবী লাগে। জীবনে এই বাস্তবতার মধ্যে অতীশ তার জীবনের সৌন্দর্যকে খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে।

    নির্মলা বলল, গঙ্গাজল কেন? কি হবে!

    আরে না! গঙ্গাজল কি নবর বাপ দিয়ে গেছে? বাবা তো এসেই…..

    দিয়ে যায় নি। একবার দেখনা গিয়ে। ওকে তো বলেছি ট্যাক্সি করে নিয়ে আসতে। টাকাও দিয়ে দিয়েছি। গঙ্গাজলই আসেনি!

    পুত্রের নাস্তিকতায় চন্দ্রনাথের ক্ষোভ আছে। এসে গঙ্গাজল না পেলে নিজের অপমান, পঞ্চতীর্থকাকার অপমান—বাবা এমন ভাবতেই পারেন এই আমার কপাল। বামুনের বাড়ি, গঙ্গাজল নেই!

    অতীশ ভেতরে ঢুকে কুম্ভের দিকে তাকিয়ে বলল, একটু বসুন, আসছি।

    আরে গঙ্গাজল তো! এই মিণ্টু, যা-তো তোর কাকিকে গিয়ে বল, বাড়িতে গঙ্গাজল আছে। একটা ঘটি নিয়ে যা। আপনি ভাববেন না। কুম্ভ মজা পাচ্ছিল, এই মানুষ গঙ্গাজল আসেনি ভেবে বিপাকে পড়ে গেছে। আর এই মানুষ কোম্পানির দু’নম্বরী মাল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। গঙ্গাজল সার জীবনে হলে পাপপুণ্য থাকে না। দু’নম্বরী মাল দিলে যত পাপই হোক, গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেই পুণ্য। এত মাহাত্ম্য গঙ্গাজলের। সেই গঙ্গাজলের মাহাত্ম্য কত বুঝে ফেলেছে, সুতরাং বাবুটি পথে আসছে। আর বোধহয় তাকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। জীবনের পাপ-পূণ্য নিয়ে ভাবার মত আহাম্মকি আর কিছু নেই।

    সে বলল, দাদা গঙ্গাজল নিয়ে দেখছি ফাঁপরে পড়ে গেছেন।

    অতীশ বুঝল কুম্ভ তার নরম জায়গায় খোঁচা মারার চেষ্টা করছে। সে বলল, বাবার জন্য আনাচ্ছি। বাবার জন্য দরকার। সে বলতে পারত, এই জল পূত-পবিত্র ভাবার কিছু নেই। সে জানে, বাবা এসেই সকালে গঙ্গাস্নানে যেতে পারেন। সেরকম বাসনা থাকতেই পারে। কতটা রাস্তা হেঁটে গেলে জননী জাহ্নবী এমন প্রশ্নও করতে পারেন। তার বাসা থেকে খুব একটা বেশি দূর না। কুম্ভবাবুর বাবা রোজ গঙ্গায় প্রাতঃস্নান করেন। ঘটি করে গঙ্গাজল নিয়ে আসেন। সংসারের অশুভ প্রভাব দূর করার এই জাদুমন্ত্রটি বাবার মত কুন্তবাবুর বাবাও জেনে গেছে। এরই নাম বোধহয় ঈশ্বরে বিশ্বাস। নদী যে আর নির্মল জল বহন করে না, হাজার হাজার মাইল নেমে এসে মোহনায় নেমে যাবার আগে আঘাটা কু-ঘাটার যত নোংরা এবং বীজাণু বহন করে বেড়াচ্ছে, ডুব দিলে অপবিত্র হবারই কথা, সেতো ভাবতেই পারে না, এই নোংরা জলে অবগাহনে কি তৃপ্তি থাকতে পারে, অন্ধ কুসংস্কার মানুষের জীবন বিপন্ন করে তোলে। সে বাবার এই কুসংস্কার মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারবে না জানে। কিন্তু একটা ভয় থেকেই যাচ্ছে, এই পবিত্র জল বাবা যদি চরণামৃতে ব্যবহার করেন, তবে বীজাণুর আক্রমণ টুটুল মিণ্টু এমন কি তাকেও গ্রাস করতে পারে। কেন জানি এখন মনে হল, নবর বাবাকে গঙ্গাজল আনতে না দিলেই হতো। কত মরা জীবজন্তু ভেসে যেতে সে দেখেছে, নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালে এটা দেখা যায়। শ্যামনগরের গঙ্গার ঠিক পাড়ে বড় মামা থাকেন। কিছুদিন সে সেখানে ছিল। নদীর পাড়ে বাড়ি। কাশবনে কিংবা চড়ায় মড়ার দুর্গন্ধে ঢেঁকা যেত না। অদূরে ঘাট, হাজার হাজার মানুষ নির্বিকারচিত্তে স্নান সেরে কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গা উচ্চারণ করছে। গঙ্গাজল নিয়ে কেমন একটা অস্বস্তি দেখা দিলে সে সহসা উঠে গেল। টুটুল মিণ্টুকে সাবধান করে দিল, তোমরা কিন্তু ছোঁবে না।

    মিণ্টু বলল, কি ছোঁব না বাবা?

    কুম্ভবাবু চা খাচ্ছে। লুচি খাচ্ছে। তার খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, সে কেমন যেন বিপাকে পড়ে গেছে। বাবা সেই নোংরা জল ছিটিয়ে দেবেন বাড়িতে, এবং ঠাকুরের নৈবেদ্য কুশাগ্রে জল ছড়িয়ে দিয়ে ফুল এবং বিশ্বপত্র এমন কি আসন, দেবীর ঘট সর্বত্র এই নোংরা জলে পবিত্র করে নেবেন।

    টুটুল দিদির দেখাদেখি এক কথা, কি ছোঁব না বাবা।

    কিছু না, যাও!

    নির্মলা এসে দেখল, অতীশ হাতই দেয়নি। সে এসেছিল, আর দুটো লুচি দেবে কিনা জিজ্ঞেস করতে।

    এসে হতভম্ব।

    কি হয়েছে তোমার!

    না কিচ্ছু হয়নি।

    খাচ্ছ না কেন! চুপচাপ বসে আছ

    কুম্ভ বলল, দাদার এই অভ্যাসটা গেল না। কেন যে হঠাৎ হঠাৎ গুম মেরে যান বুঝি না।

    অতীশ ব্যস্ত হয়ে খেতে শুরু করল। যেন সে কিছুই ভাবেছ না। সে ধরা পড়তে চায় না। শত হলেও পুত্রের মঙ্গল কামনায় এসব করা হচ্ছে। পুত্রের হাতেখড়ি না দিয়ে স্কুলে সে ভর্তি করে দিতেই পারে। জীবনে অনেক অনাবশ্যক ফ্যাকড়া দিন দিন গজিয়ে উঠছে। নাতির মঙ্গল কামনায় বাবা তাকে একটা বড় খরচের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন! কারখানার এখন বলতে গেলে নাভিশ্বাস—কবে দুম করে বন্ধ হয়ে যায়, কিংবা আরও অধিক কিছু অর্থাৎ বউরাণী কিংবা কুমারবাহাদুর ডেকে যদি বলেন, তিন বছরেও যখন কিছু হল না, আর হবে না। কারখানা ক্লোজার করে দেব ভাবছি। তুমি বাসা ছেড়ে দাও। বিনা ভাড়ায় বিশাল কোয়ার্টার অন্দরের দিকে, খরচ শুধু কি একটা, পঞ্চতীর্থকাকাকে নতুন কাপড় দিতে হবে, দেবীর নতুন বস্ত্র। তারপর বাবা থলের মধ্যে করে যে তালপাতার পুঁথি আনবেন, সেটির পাঠ ক’দিন চলবে, কে জানে। আজন্মকালের সংস্কার বাবাকে অনেক কিছু জল এবং বাতাসের মত প্রয়োজনীয় ভাবতে শিখিয়েছে। হেন পিতার সন্তান হয়ে সে না করেও পারবে না। হেন পিতার সন্তান, পুত্রের মঙ্গল কামনায়, সে ঠিক আগের মত দৃঢ়তার সঙ্গে বলতেও পারবে না, বাবা এসব আপনাদের অন্ধ কুসংস্কার। আমি টুটুলের হাতে খড়িই দেব না। তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেব। লেখাপড়ার সঙ্গে হাতেখড়ির কি সম্পর্ক আমার মাথায় আসে না।

    কুম্ভবাবু বাথরুমে ঢুকে হাত ধুয়ে এল। সে এ বাসায় এলে তার চেয়ে টুটুল মিণ্টুকে বেশি গুরুত্ব দেয়। অজস্র কথা তাদের সঙ্গে বলে যাচ্ছে। সে যে অতীশকে কোনও গূঢ় খবর দিতে এসেছে হাবভাবে বোঝা যায় না। কুম্ভবাবু তার বাবার বাসায় থাকে। তার বাসা ছেড়ে দেবার প্রশ্ন নেই। তার বাবা দু’হাতে রাজার ভান্ডার লুটছে। কুমারবাহাদুরের স্থাবর অস্থাবর মিলে বিশাল সম্পদের হিসাব তার কাছে। এতো অধিক স্থাবর সম্পত্তি রাখাও কঠিন। দিন দিন আইন পাল্টাচ্ছে। সরকার কি করবে কোন আইন পাস করিয়ে কখন কি কেড়ে নেবে, এই এক উৎপাতে কুমারবাহাদুরেরও মন মেজাজ ভাল না।

    ঘরের এক কোণায় তার লেখার টেবিল চেয়ার। কুম্ভ চেয়ারটা টেনে এবার অতীশের মুখোমুখি বসল। ইদানীং অতীশবাবু আর চারু চারু করে না। কি ফ্যাসাদেই না তাকে ফেলে দিয়েছিল! ধরা পড়লে তার লোটাকম্বল নিয়ে টানাটানি পড়ত। কিন্তু মগজে ঘা শুকোবার নয়, পিয়ারিলাল ক্রমেই মরিয়া হয়ে উঠছে। দু’নম্বরী মাল সে ঠিকই তুলছে, তবে বেশি দামে। সিটমেটাল থেকে সে জলের দরে মাল তুলছিল, তা বন্ধ হয়ে যাবার পর পিয়ারিলাল সাপের মত ফুঁসছে। চারুকে দিয়ে হল না।

    চারু এখন নাকি পিয়ারিকেও গ্রাহ্য করে না। বখা চারু ফোনে বাবুটির সঙ্গে কথাও বলছে না।

    বাবুটির কথা উঠলেই চারুর এক কথা, না কিছু হয়নি। চেষ্টার শেষ ছিল না, অতীশবাবু জানালায় মুখ রেখে বসেছিল। আকাশের নক্ষত্র বাদে আর কিছু দেখছিল বলে মনে হয় না। বাবুজী কোন দেবতার উপাসক আমি বলতে পারব না। আমাকে তোমরা বেশি ঘাঁটাবে না। তিনি যে দেবী উপাসক নন এটা টের পেয়েছি।

    কুম্ভবাবু পিয়ারি দু’জনই চারুকে আর ঘাঁটায় না। একদিন কুম্ভ ক্ষেপে গিয়ে চারুকে বলেছিল, হারামজাদি তুই পিয়ারির খাস পরিস, পিয়ারি তোর জন্য কী না করেছে! ফুটপাথের মেয়েছেলের এতো রোয়াব। পাছায় লাথি মেরে ভাগিয়ে দিতে পারো না। বেশ্যামাগী তুই। তোর মাথাটিও শেষে বাবুজী খেল! বলে কিনা বাবুজীর মত মানুষ হয় না!

    কুম্ভ বলল, দাদা উঠি।

    আচ্ছা। যেন অতীশ ভারি হাল্কা হয়ে গেল, যাক তবে যাচ্ছেন। বাবার খবরই নিতে এসেছিল তা হলে!

    দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যেন মনে পড়ে যাবার মত কুম্ভ ফিরে এল, দাদা শুনেছেন।

    কি!

    রেডিওর খবর।

    না তো।

    সকালের কাগজেও বের হয়েছে। ম্যানেজার খুন।

    কোথায়?

    দমদমের ওদিকের একটা কারখানায়। কি যে হচ্ছে। দিন দুপুরে লাশ পড়ে থাকছে। তোরা নিরীহ মানুষ খুন করছিস। কোনো আইন নেই! শাসন নেই। একেবারে মগের মুল্লুক হয়ে গেল!

    অতীশ জানে, এখন দেওয়ালে দেওয়ালে সর্বত্র এক অতীব সতর্কবাণী ফুটে উঠছে সত্তর দশক মুক্তির দশক। মনীষীদের মাথা কেটে শুরু। স্কুল কলেজে ঢুকে সব তছনছ করে দিচ্ছে। জোতদার খুন। কাগজ খুললে শুধু খুনের খবর। কিন্তু ম্যানেজার খুন এই যেন প্রথম সে শুনল। তার মুখ শুকিয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে উঠছে। ধরা পড়ে যাবে ভয়ে সে বেশ জোরেই হেসে উঠল, আসলে এই নকল হাসি যেন আরও বেশি তাকে কাতর করে ফেলছে।

    সে উঠে এগিয়ে দেবার মত করিডর ধরে কিছুটা গেল। যেতে যেতে বলল, কিছু একটা হবে। এ-ভাবে একটা দেশ চলতে পারে না। রাস্তায় বের হওয়া যায় না, ভিক্ষুকে ছেয়ে আছে, ফুটপাথ ধরে হাঁটা যায় না, যেখানে সেখানে প্লাইউডের আস্তানা। বাজারের উচ্ছিষ্ট সব এনে সেদ্ধ করে খায়। এমন দেশে মানুষ খুন ছাড়া অবলীলায় আর কি মহৎ কাজ করতে পারে বলুন!

    একজন ম্যানেজার খুনের সঙ্গে অতীশের যে সম্পর্ক আছে কুম্ভবাবু তাই যেন জানাতে এসেছিল। অতীশবাবু কারখানার ম্যানেজার। মৃতপ্রায় কারখানাটিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য তাকে আনা, সে এসে দেখছে, সর্বত্র ফাঁক ফোকর। হাত দিলেই ছোবল খেতে হচ্ছে। নানা গর্তে সাপের জিভ লকলক করছে।

    কুম্ভ দরজার কাছে এসে বলল, ওরা ছাড়বে না। বোধহয় গো-স্লো শুরু করবে।

    আসলে কুম্ভ কি বলতে এসেছে, কোন খবর জরুরী, ম্যানেজার খুন, না গো-স্লো, কোনটা। এই সকালে অতীশ ভেবেছিল, কারখানা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সে জানে কারখানা ক্রমেই অচল হতে শুরু করেছে। যতই রাজা টাকা ঢালুক, জোড়াতালি দিয়ে কাজ চলে না। ক্যানেস্তারা মেশিন আসছে। অতীশ বলেছে, কোটার টিন না পেলে মেশিন চালু রাখা যাবে না। তারপর নতুন বাড়ি হচ্ছে কারখানার। প্রিন্টিং ডিপার্টমেন্ট নতুন বাড়িতে উঠে যাবে। লিথো প্রিন্টিং অচল সেও বোঝে। জিংক প্লেটে ছাপা হবে। সবই ঠিক আছে, শুধু ঠিক নেই যারা কাজ করবে। টাকা না ছড়ালে কিছু হয় না। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি, সর্বত্র এক অরাজক অবস্থা চলছে। সে ইতিমধ্যে এই জটিল আবর্ত থেকে রক্ষা পাবার জন্য রাত জেগে লিখছে। দ্বিতীয় একটা উপার্জনের পথ খোলা না রাখলে সেও রাস্তার পাগলা হরিশ। যেন মাথায় উকুন গিজগিজ করছে। এবং এই সংসার, বাবার সংসার সব মাথার ওপর। কতদূর আর হাঁটতে পারবে এত বড় বোঝা নিয়ে সে জানে না।

    আজ বাবা আসবেন। পঞ্চতীর্থকাকা আসবেন। নির্মলার কথা বলার সময়ও কম। অতীশ এক ফাঁকে বের হয়ে সুরেনের বড় মেয়েটাকে বলে এল, তোকে তোর কাকিমা ডাকছে। ফিরে এসে বলল, সুরেনের মেয়েটাকে বলে এলাম। ওর সঙ্গে কথা বলে নাও। একা তুমি পেরে উঠবে না। খুব সকালে আসতে বলবে। দুপুরে এখানেই খাবে। বছরকার শাড়ি ব্লাউজ পাবে। কি নেবে জেনে নাও।

    নির্মলা রান্নাঘরে অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি ব্যস্ত। বাবা কি খেতে ভালবাসেন সে জানে। সকালের জল খাবারের পাট সেরে বঁটি নিয়ে বসেছে। সে অতীশের শুধু কথা শুনে যাচ্ছিল। সুরেনের মেয়েটা নিরীহ গোবেচারা। স্বামী পরিত্যক্তা। সুরেনের অন্য মেয়েরাও, এ-বাসায় ও-বাসায় কাজ করে। এতদিন সে রাজি হতে পারেনি। সংসারে তারা চারটে প্রাণী, কি বা মাইনে, লেখার টাকা মাঝে মাঝে পায় বলে, ভদ্রতা বজায় রাখতে পারছে। ছোট্ট কারখানা, নামেই সিট মেটাল, নামেই ম্যানেজার। যা মাইনে, কাউকে বলা যায় না। তবু মানুষের মধ্যে থাকে এক অহংকার, জীবন বাজি রেখে যেন দু’জনেই সেই অহংকার আগলে বসে আছে। অতীশ কোনো কারণে ছোট হলে নির্মলার কোথায় যেন কে পেরেক পুঁতে দেয়। অতীশকে তার কাজের কথা এখনও কিছু বলেনি। বললে রাজি হবে কিনা তাও জানে না। শহরে হলেও কথা ছিল, অতদূরে রাজি হতে নাও পারে। সে জানে, খুব নিরুপায় বোধ না করলে সে রাজী হবে না। চাকরিটা পেয়ে সে খুশিই হয়েছিল, কিন্তু স্বামী পুত্র-কন্যা ফেলে এতদূরে চলে যাবে ভাবতেই ভেতরে সে ভেঙে পড়ছে। আড়ালে চোখের জল মুছছে। এবং এ-সময় বাবা আর পঞ্চতীর্থকাকা হাজির। সঙ্গে পোঁটলা পুঁটলি। টুটুল বলল, বাবা কারা দরজায় দাঁড়িয়ে।

    অতীশ করিডরের দরজা খুললে তাঁরা ঢুকলেন। অতীশ প্রণাম করল, নির্মলা হাত মুছে গড় হয়ে প্রণাম করল। কেবল টুটল মিণ্টুর দেখা নেই। কারা এসেছে ওরা ঠিক জানে। বাবার বাবা। কতদিন টুটুল বলেছে, বাবা, তোমার বাবা আমাদের কে হয়?

    তোমাদের ঠাকুরদা হয়।

    বাবার বাবা ঠাকুরদা হয়?

    আসলে টুটুল সব ভুলে গেছে।

    হঠাৎ টুটুল বলল, আমার ঠাকুরদার নাম চন্দ্রনাথ ভৌমিক।

    এখন এস তো। এস। প্রণাম করবে। বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলে বাবা দুজনকেই বুকে তুলে নিলেন। বললেন, আমার দিদিভাই, আমার দাদুভাই। বাবা ওদের নিয়ে পঞ্চতীর্থকাকার সঙ্গে ঘরে ঢোকার মুখে বললেন, ঘরগুলো দেখছি খুবই বড় ঘর। আলো হাওয়া আছে। বাসাটা তোমার ভালই দিয়েছে দেখছি। অমলারা কোন দিকটায় থাকে?

    সামনের দিকটায়।

    এটা তবে রাজবাড়ির অন্দর!

    বাবাকে খুব প্রসন্ন দেখাল, একজন সাধারণ মানুষের পুত্র এতবড় রাজবাড়ির অন্দরের দিকে বাসা পেয়েছে—এটা যেন তাঁর কাছে গর্বেরও। জমিদার বাড়ির কাজে বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে, এবং অন্দরমহলের মতো জায়গায় পুত্রের বাড়িঘর দেখে বললেন, কোনো উচাটনে থাকবে না। তোমার তো খামখেয়ালির শেষ নেই। লেগে থাকলে সব হয়।

    এ-সব কথা অতীশ শুনছিল না। বাবার এ-ধরনের কথা বলার চিরদিনের অভ্যাস। যেন সে বাবার কাছে সেই আগের ছোট্ট সোনাই আছে। তার মজাও লাগছিল আবার রাগও হচ্ছিল। বাবা জানেই না, এই কিছুক্ষণ আগে তারই অধস্তন কুম্ভবাবু খবর দিয়ে গেছে, ম্যানেজার খতমের তালিকা তৈরি।

    বাবাও জানে, তার মাঝে মাঝে কি হয়। না হলে শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে এই কলকাতায় কেউ চলে আসে! বাড়ি থেকে করছিলি, একসঙ্গে বেশ চলে যাচ্ছিল। বনিবনা হল না। দুম করে কাজে ইস্তফা দিয়ে বসলি। কলকাতায় যা অরাজক অবস্থা। এত মানুষের নিঃশ্বাসে বাতাস দূষিত না হয়ে পারে! পোকামাকড়ের মতো মানুষ গিজগিজ করছে। শিয়ালদা থেকে এই পথটুকু আসতেই মনে হয়েছে এ-তো এক জনারণ্য। গাছপালা নেই, ফুল ফোটে না, পাখি ওড়ে না, সব ন্যাড়া। মরীচিকার মতো মানুষের তৃষ্ণা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে কলকাতা।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
    Next Article মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }