Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1863 Mins Read0

    ঈশ্বরের বাগান – ৫২

    ॥ বাহান্ন ॥

    পুনশ্চ :

    মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি। সমসের দাঁড়িয়েছিল। ওর ছায়াটা লম্বা হয়ে জলে ভাসছে। ছায়াটা আরও লম্বা হবে। যতক্ষণ না রেল-স্টেশনের পেছনে হাজিদের বড় পাটগুদামের ওপাশে সূর্য অস্ত যাবে ততক্ষণ এই ছায়া ক্রমশঃ লম্বা হবে। ওর মনে হয়, একসময় ছায়াটা এত লম্বা হয়ে যাবে যে সে চারপাশের সব গাছপালার সঙ্গে, সাঁতরে নদীর ওপারে চলে যেতে পারবে। পিছনে সেই পাটগুদাম। এবং কিছু কলের চিমনি। আর আশেপাশে সব ছোট বড় নৌকা। কোষানৌকা, গয়নানৌকা, গাদাবোট। কিছু ভাঙা নৌকা কিনারে। জল নেমে গেছে বলে যারা জলে নৌকা ডুবিয়ে রেখেছিল, তাদের নৌকা জলের উপর ভেসে উঠেছে। রোদ্দুরে কাঠ ফাটছে।

    সে ঠিক জেটির উপর দাঁড়িয়ে নেই। কিছুটা আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে অজস্র খুঁটি। নদীর পাড় ভাঙার জন্য এখানে এই খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়েছে। নদীর ওপারে বন্দর। ওপার থেকেই তিনজন লোক আসবে, চিঠিতে এমন লিখেছে কামাল। নৌকাটা ঘাসি নৌকার মতো দেখতে হবে। ছোট আকারের নৌকার ছই থাকবে। দরমার ছই। কাঁচা বাঁশের মতো দেখতে হবে। নৌকার তিন নম্বর গুড়াতে পাল পুঁতে দেবার ব্যবস্থা থাকবে। দুটো বৈঠা, একটা লগি, গুন টানার জন্য লাল রঙের দড়ি।

    শহর থেকে সব মানুষেরা গ্রামের দিকে সরে পড়ছে বলে, হুড়মুড় করে নৌকা ভিড়ছে, লটবহর তুলে নিচ্ছে এবং মেয়েরা শিশুরা সব উঠে গেলে সব নৌকা ওপারে চলে যাচ্ছে। সে একা একটা কাঠের সিঁড়িতে নদীর চরে দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। দুটো একটা মিলে গেলেও সবটা মিলে যাচ্ছে না। ওর ছায়াটা সেজন্য লম্বা হয়ে যাচ্ছে; এবং পাটগুদামের ওপাশে সূর্য হেলে পড়তেই নদীর ওপারে আর রোদ থাকল না। সব ছায়া—গাছের অথবা পাখির, সব ছায়া—মানুষের অথবা খুঁটির, নিমেষে নদীর জলে হারিয়ে গেল। সমসের চশমাটা খুলে একবার রুমালে কাঁচ মুছে নিল। ওর যেমন অভ্যাস, চশমাটা নাকে দেবার সময় একটু ঠেলে দেয় এবং কানের দুপাশ থেকে চুল সরিয়ে আলগাভাবে রেখে দেয়, এখনও তেমনি রাখল। এতটুকু সে উদ্বিগ্ন নয়। দেখলে মনে হয় ওর আত্মীয়- স্বজন আসার কথা স্টীমারে, সেজন্য সে এখানে একা বসে দাঁতে ঘাস-বিচালি কাটছে।

    এভাবে বসে থাকলে শত্রুপক্ষ তাকে সন্দেহ করতে পারে। পিছনে বড় রাস্তা। ট্রাক-বাসগুলো সে চলে যেতে দেখল। বড় বড় বাড়ি। সব খান সাহেবদের। সে হেলমেটধারী কিছু সৈনিককে বাড়িগুলো পাহারা দিতে দেখে এসেছে। চারপাশে তাকালেই মনে হয়, দুঃখিনী বর্ণনমালা মা আমার। ওপারের গাছপালার দিকে তাকালেই মনে হয় সে এবং অন্য সব মানুষের ডাক এসেছে—আমাদের বড় মাঠে যেতে হবে। আর দেরি করলে চলবে না। সময় হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়াল।

    সে যতটা ভাবছিল মুখের রেখাতে কোন দুশ্চিন্তার ছাপ রাখবে না, যেন তার মেমান আসবে বলে বসে আছে, ঘাসি নৌকা না এলে সে যে কি করে! এই সময় কাঠের বাক্সটা তুলে না দিতে পারলে ওরা রাতারাতি শহর ছেড়ে শীতলক্ষ্যার জলে ভাসতে পারবে না। ওদের এটা পঞ্চমীঘাটে পৌঁছে দেবার কথা। সে যে কি করে!

    সে নদীর জলের কাছে নেমে গেল। কাদামাটি। ডানদিকে শুধু একটা বালির চর। সেখানে কিছু জলজ ঘাসের শুকনো জমি। ভাঙা নৌকা, শ্যাওলা ধরা খুঁটি, রোদে পোড়া মাঠ-ঘাট ভেঙে সে চরের কাছে এসে দাঁড়াল। এখান থেকে সে ওপারের মানুষজন এবং তাদের চলাফেরা দেখার চেষ্টা করছে। জায়গাটাতে পুরানো গাব পচানো জলের গন্ধ। এখানে সারি সারি নৌকা সব উল্টে রাখা হয়েছে। নৌকাগুলোতে বর্ষার আগে গাবের কষ খাওয়াতে হবে। কষ খেলে কাঠ শক্ত থাকে। জলে পচে না। নৌকাগুলোর বয়েস হয়ে গেছে এবার বর্ষায় সব নৌকা ওদের যুদ্ধ জাহাজ হয়ে যাবে।

    ওরা এখন থেকেই গাবের কষ খাওয়াতে শুরু করেছে। গাবের পচা গন্ধ, আলকাতরার গন্ধ, জল নেমে গেছে বলে ঘোলা জলের মাটি-মাটি গন্ধ সমসেরকে ভারি আকুল করে তুলেছে। সে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছিল—স্বাধীনতা! স্বাধীনতা! সে বিড়বিড় করে স্বাধীনতার গান গাইতে থাকল। ভিতরে ভয় জাগলেই সে গায়—ও আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। তার তখন ভয় থাকে না। ভিতরে ভিতরে সে এক আশ্চর্য রকমের শক্তি পায়। যেন সে তখন তার মাকে দেখতে পায়, গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ডাকছে, সমুবাপ আয়। আর দুষ্টুমি করিস নে। এখনি বৃষ্টি আসবে। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে তোর জ্বর হবে সমু!

    সমুর কাছে তখন সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। কোনও ভয় থাকে না। সে যেন দেখতে পায়, এক মানুষ দূরের মাঠে দাঁড়িয়ে ডাকছে। বলছে, সমু এই তোমার বাংলা দেশ। এস তুমি আমার সঙ্গে। মাঠ-ঘাট চিনিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। লতাপাতা, ঝোপঝাড় যেখানেই দাঁড়াবে, দেখবে কি সুন্দর এক সজীব খন্ড খন্ড ভালবাসা তোমার এই জমির জন্য। সমু, তুমি এই দেশের মানুষ, এই দেশ তোমার। তখন সমুর আর কিছু ভাববার অবকাশ থাকে না। মানুষটা কেবল তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে চৈত্রের এই সন্ধ্যায় আজ বড় বেশি তা টের পাচ্ছে। সে যে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবতীয় কিছু উৎসর্গ করে দিচ্ছে, সে যে আর নিজের জন্য নয়, সে যে মাটি এবং ভালবাসার জন্য, মাটি বলতে সে বোঝে এই বাংলাদেশ, ভালবাসা বলতে বোঝে জীবনকে উৎসর্গ করা, আজ সে এবং মিনু, ওর ছেলে আবুল এটা টের পেয়ে গেছে।

    ঘাসি নৌকাটা এলে সে মিনুকে, আবুলকে নৌকাতে তুলে দেবে। আর সঙ্গে যাবে কাঠের বাক্সটা। কাঠের বাক্সটা ভাঙা জেটির নীচে, সেখানে মানুষজনের যাতায়াত কম। কিছু খড়কুটো দিয়ে ঢেকে রেখে গেছে কামাল। সঙ্গে একটা মানচিত্র। কোথায় কোন পয়েন্টে তাকে হাঁক দিতে হবে, আমি বাংলাদেশের মানুষ—এবং বাংলাদেশের মানুষ বললেই ছেড়ে যেন দেবে তাদের। তারপর নদীর কোন খাঁড়িতে ঢুকে গেলে সে দু’পাশে, নাঙ্গলবন্দ, মাঝেরচর, অলিপুরা এই সব গ্রাম পাবে। তার কাছে একটা মানচিত্র আঁকা আছে। পঞ্চমীঘাটে যদি কোনও কারণে তাদের বাক্সটা নামাতে অসুবিধা হয়, তবে তাদের আরও চার মাইল পথ এগিয়ে যেতে হবে। এবং গ্রামের নাম দন্দি। এখানে ব্রহ্মপুত্রের একটা খাড়ি নদী অদ্ভুত দ্বীপের সৃষ্টি করেছে। চারপাশে তার গ্রাম, দক্ষিণে লাদুরচর, উত্তরে দন্দি। নদীর পাড়ে শ্মশান। ডানদিকে এক ফসলি জমি। জমি পার হলে ঘন এক বড় অশ্বত্থ গাছ। গাছে একটা পতাকা উড়বে। পতাকা উড়লেই টের পাওয়া যাবে, ওরা এসে গেছে। তখন পায়ে হেঁটে অথবা যে- কোনও ভাবে ফিরে আসা। ফিরে আসার কোনও প্রোগ্রাম নেই! বাংলাদেশের মাঠে-ঘাটে তখন তুমি হিতৈষী মানুষ। তোমাকে তারা ঠিক ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে।

    সমসের এমন সময় দেখল একটা নাও ওর সেই ভাঙা জেটির দিক এগিয়ে আসছে। সে তাড়াতাড়ি ডিঙিগুলো লাফ দিয়ে পার হয়ে এল। সে নদীর চর থেকে নেমে যাবার মুখে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। হাতে পায়ে ব্যথা লাগতে পারে। সে কিছুই খেয়াল করছে না। কারণ তাড়াতাড়ি তাকে সেখানে পৌঁছাতে হবে। এবং অন্ধকার নামার আগে সে কাঠের বাক্সটা তুলে দেবে। আবুল, মিনু স্টেশনের ওপাশে একটা শেডের নিচে অপেক্ষা করছে। যেন ওরা স্টেশনে এসেছে কোথাও যাবে বলে, ট্রেন পাচ্ছে না, কবে ট্রেন আসবে তাও কেউ বলতে পারছে না। কি যে হয়ে গেল দেশটা—এমন মুখ করে বসে রয়েছে। তারা যাবে একটা বড় কাজে। এ কাজে যেতে হলে খুব একটা সাহসের দরকার হয় না, মা আর ছেলের চোখ-মুখ দেখলে এমন মনে হয়।

    আবুল তুই ভয় পাচ্ছিস না তো? আমরা খুব একটা বড় কাজে যাচ্ছি। তোর বাবাকে কি যে আজ ভালবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে না! আবুল যেন বলছে, মা তুমি দেখো আমি ঠিক পৌঁছে দেব তোমাদের। আমরা এভাবে ঠিক পৌঁছে যাব। বাবা কেন যে আমাদের সঙ্গে হেসে কথা বলছে না। বাবা ভয় পেয়ে গেছে, না মা? বস্তুত মা আর ছেলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। মিনু বোরখার নীচে। আবুল লুঙ্গি পরেছে নীল রঙের। মাথায় সবুজ রঙের টুপি। গায়ে লাল রঙের শার্ট। সে তার মাকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে, মেমান বাড়ি যাবে। একটা পুঁটলি। কিছু সেউই বাঁধা পুঁটলিতে। যেন মিনু তার মা বাবার জন্য সেউই নিয়ে যাচ্ছে। আর একটা পুঁটলিতে বেঁধে নিয়েছে শুকনো কুল। তারপর দুটো নতুন কাপড় এবং একটা টিনের বাক্স। বাক্সটাতে মিনুর শাড়ি সায়া সেমিজ। এবং তালপাতার পাখা হাতে। আর ছোট্ট আয়না। আয়নাটা আবার ভাঙা। এখনও অবনী অথবা আমিনুল আসছে না। সে বোরখার ভিতর থেকে সন্তর্পণে চারপাশটা দেখছে। একটা শালপাতা উড়ছে স্টেশনে। দুটো কুকুর ঘেউঘেউ করে ডাকছে। দশ বারো জন খান সেনা রাইফেল হাতে স্টেশনটা পাহারা দিচ্ছে। কাছে এলেই মিনু আবুলকে জড়িয়ে ধরে বলছে, এদিকে আয় আবুল। ওরা তোকে দেখছে। তুই আমার কাছে থাকলে আর কোন ভয় থাকে না।

    আবুল এমন শুনে নাচতে থাকল, মা, দেব নাকি ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে?

    আবুলকে মিনু জড়িয়ে ধরে বলল, না বাবা, এমন করলে চলবে কেন!

    বস্তুত আবুলের কাছে এখন এটা খেলা হয়ে গেছে। সে জানে তারা হয়ত কেউ বাঁচবে না, কিন্তু কেন জানি ভয়-ডর কিছু নেই তার। সে, সে বলতে সব মানুষ এই বাংলাদেশের, ভেবে ফেলেছে এখন শুধু জান দেবার সময়। এই জান দেবার সময়ে শুধু সে হাতের নিচে লুকানো একটা কালো জীবের মুখ খুলে দিলে হাওয়ায় আতসবাজি উড়বে। চৈত্রের ধূলায় গাছের পাতার মত খানেদের মাথা উড়ে যাবে। হাত আবুলের বড্ড চুলকাচ্ছিল।

    কিন্তু আবুল টের পেল কে যেন তার পিছন থেকে ফিসফিস করে বলছে, আবুল কালো জীবের মুখ খুলবে না। বড় দামী জীব। তাকে হেলাফেলা করতে নেই। তুমি মনে রাখবে তোমার চেয়ে ওর দাম বেশী। ওকে ঘাঁটাবে না। যখন সময় আসবে, মা বলে দেবে। মা বলে দিলেই তুমি যে ক’টা পার ফেলে দেবে। যদি একটা হয় বাহবা থাকবে না। দুটো হলে বলব, আবুল সমসের মিঞার ছেলে। তিনটে হলে বলব আবুল সমসের আর মিনুর ছেলে। আবুল তখন হাসতে হাসতে বলেছিল, যদি দশটা হয় বাবা? তখন কি বলবে?

    বলব, তুমি বাংলাদেশের ছেলে। মা জননী তোমার বাংলাদেশ। আবুলের চোখ চিকচিক করে উঠেছিল। সে এখন প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে মায়ের হাত ধরে তা টের পাচ্ছে। এখন শুধু তার বাংলাদেশের মানুষ হয়ে বাঁচতে ইচ্ছা হয়। মাকে তার মাঝে মাঝে কেন জানি বড় অপরিচিত মনে হয়। বাবাকে মাঝে মাঝে খুব দূরের মানুষ মনে হয়, তার প্রিয় এই মাটি, ফুল-ফল, নদীর জল, আর মাঠে দাঁড়ালে সে বাংলাদেশের বাতাস বুক ভরে নিতে পারে। বুকের ভিতর তখন মৃত্যু-ভয় থাকে না। তার মা যেন ঘোমটা দেওয়া জননী নয়। তার মা-র হাতে বন্দুকের নল। দাঁড়িয়ে আছে সামনে।

    শেডের নিচে এক দুই করে, কারা আলো জ্বেলে দিয়ে গেল। এখন শেডের নিচটাতে জাফরি কাটা হলুদ রঙের ছবি। স্টেশনের কোয়ার্টারগুলোর সার্শি বন্ধ। দরজা-জানালা বন্ধ। যারা পালাবে শহর থেকে, তারা শুধু রাস্তায়। যাদের শহর ছেড়ে যাবার জায়গা নেই তারা সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে রয়েছে। মিনু আবুল শহর ছেড়ে গ্রামে পালাচ্ছে এমন একটা মুখ করে রাখতে পারত। কিন্তু পারছে না, কারণ সব সময় মনের ভিতর আশ্চর্য এক ভালবাসা তৈরী হচ্ছে। মাটির জন্য ভালবাসা। ওরা সেজন্য কিছুতেই মুখের রেখাতে হাহাকারের ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারছে না। কি যে এক ব্যাকুলতা এখন ওদের, কখন—কখন আসবে সমসের! ওদের নিয়ে যাবে। নৌকায় তুলে দেবে। জলের উপর দুলতে দুলতে যাবে তারা। পাটাতনের নিচে কাঠের বাক্সটা। নৌকায় উঠলে মিনু বোরখা তুলে গলুইতে বসে পাহারা দেবে। অবনী, আমিনুল, আবুল আর মিনু। কাঠের বাক্সটা ওদের সকাল হতে না হতে পৌঁছে দিতে হবে। মিনু স্টেশনে আলো জ্বলে উঠতেই কেমন অধীর হয়ে উঠল। সমসের ওদের সঙ্গে যাচ্ছে না। তার কাজ ঠিকঠাক সব জায়গা মতো পৌঁছে দেওয়া। সে এখনও আসছে না। আবুলের হাতে বদনা। যেন ভীষণ তেষ্টা, জল খাচ্ছে তেষ্টা মেটাবার জন্য। আবুলের হাত থেকে বদনা নিয়ে সেও ঢকঢক করে জল খাচ্ছে।

    খটখট শব্দ। সে এমন শব্দ পেলেই কেমন ভয়ে গুটিয়ে আসে। সে মুখ দেখলেই খানেদের চিনতে পারে। এদের মুখ পাথরের মতো, চোখ কেবল চকচক করছে। মনে হয় সব সময় বোরখার নিচে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে, কেমন তাকাতে তাকাতে চলে যায়। –আবুল, আবুল তুই কাছে থাক। মিনু আবুলকে জড়িয়ে থাকল।

    তখন জ্যোৎস্না নদীর পাড়ে। আলো জ্বলছে না। কারা তার কেটে এ অঞ্চলে অন্ধকার করে রেখেছে। মেরামত করে গেলে কে যে আবার তার কেটে অন্ধকার করে দিয়ে যায়! সমসের একটা সিগারেট খাচ্ছিল—জ্যোৎস্না রাত বলে ওর চশমার ভিতর সিগারেটের আগুনটা জ্বলছে। সে এখন নৌকার পর নৌকা লাফিয়ে পার হচ্ছে। কার নৌকা? গোপালদির চৌধুরীসাহেবের। কার নৌকা—ফাউসার গয়না। কার নৌকা —রূপগঞ্জ থানার। তাদের নৌকাটা কোথায়।

    –অ মিঞা, কই যাবেন? সমসের চোখ তুলে দেখল, অবনী বেশ সং সেজে বসে রয়েছে।

    –নৌকা এখানে রেখেছিস কেন?

    –কেনাখানে রাখুম কন?

    –এদিকে নিয়ে আয় নৌকা। যেন সমসের কেরায়া নৌকা ঠিক করে রেখেছিল, জায়গামতো না থাকায় বিরক্ত হচ্ছে। সে এবার ফিসফিস করে বলল, এত দেরি কেন?

    –খুব খারাপ খবর।

    সমসের বলল, কিছু খবর খারাপ থাকবেই। তার জন্য বসে থাকলে চলে!

    –থাকে না মিঞা! সে এবার নৌকা থেকে লাফিয়ে নামল। জলে নামায় কিছুটা জল নাকে- মুখে এসে উঠেছে। অবনী নৌকাটাকে টানতে টানতে সেই জেটির নিচে নিয়ে যাচ্ছিল। অবনীর পরনে লুঙ্গি। সে, কথা আছে হাল ধরবে। সে একটা ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে দিয়েছে। খোপ কাটা লুঙ্গি পরেছে। মুখে ওর ক্লান্তির ছাপ। সে গত রাতে মেঘনার পারে যে সব গ্রাম আছে, যেমন বৈদ্যেরবাজার, উদ্ধবগঞ্জ এবং দামোদরদিতে কিছু কাঠের বাক্স নামিয়ে এসেছে। ওরা চারজন ছিল। ঠিক মতো ওরা পৌঁছে দিতে পেরেছে, কিন্তু ফেরার পথে মকবুল, নলিনী, রহমান তিনজনেই গেছে। নদীর জলে ওদের লাশ ডুবে যেতে দেখেছে। সে যে কি করে বেঁচে এল, এখন ঠিক বলতে পারবে না। আর বলার সময়ও নেই। এই সব উৎসর্গীকৃত প্রাণের জন্য ওরা নদীর পাড়ে দাঁড়াল। ওরা ওদের ধর্মমতে যে যার মতো ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল। দেশের জন্য ওরা প্রাণ দিয়েছে। সমসের চুপচাপ। কামালের কথামত এক ফ্যামিলি ইউনিটের সঙ্গে পাঠাচ্ছে শেষ কাঠের বাক্সটা। সে এটা পাঠিয়ে দিতে পারলেই নিজে আবার অন্য ফ্রন্টে লড়তে পারবে। একটা ঠিকানা রেখে দিয়েছে মিনুর কাছে। ওটা পৌঁছে দিলেই আবার ওদের দেখা হবে। সে আসার আগে আজ মিনুর সামনে প্রথমে কথাটা বলতেই মিনু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল।

    মিনু রান্নাঘরে ছিল তখন। সে চাল-ডাল সেদ্ধ করে তাড়াতাড়ি কিছু যেমন রোজ রান্না করে দেয় আজও তা দিচ্ছিল। কিন্তু সকাল থেকেই সমসেরকে বড়ই চিন্তিত দেখাচ্ছে। সমসের কথা বলছে না। রাতেই সমসের খবর পেয়ে গেছে নদীর পাড়ে চারজনই ডুবেছে। তারপর খবর পেয়েছে না চারজন নয়, তিনজন। অবনী নদী সাঁতারে পাড়ে উঠে যেতে পেরেছে। গুলি অবনীর গায়ে লাগে নি। সে ভেবেছিল সব একবার বলবে মিনুকে। সকালের চিঠিটা ওকে আরো বেশী উত্তেজিত করে রেখেছিল। সমসের এমনিতেই কম কথা বলে, আজ সকালে সে তাও বলছিল না। কামালের চিঠি। চিঠিতে লেখাঃ ওরা টের পেয়ে গেছে সব। তোমাকে এ বাক্সটা পাঠিয়ে দিতে হবে। আমার মনে হয় এবার একটা ফ্যামিলি ইউনিট গড়ে নাও। দেশে বৌ-বিবি নিয়ে পালাচ্ছ, তেমন যেন আমাদের ক্যামোফ্লেজটা হয়। তোমার স্ত্রীকে এবং ছেলেকে এ ব্যাপারে নেবে। ওদের মত চেয়ে নিও। অমতে কিছু করবে না। যদি অসুবিধা থাকে হাসিনা যাবে। হাসিনা কামালের স্ত্রী। হাসিনা এবং অনি যাবে। দুপুরের ভিতরে তোমাকে সব স্থির করে নিতে হবে।

    .

    সমসের জানালায় দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ। চিঠিটা সে হাতে রেখেছিল। রান্নাঘর থেকে মিনুর কোনও সাড়া-শব্দ আসছে না। সকাল থেকে কারফু শিথিল বলে মানুষজন যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। শহরের বড় বটগাছটায় বসে কিছু কাক ডাকছে। চারপাশে রুদ্ধ জীবন ভেঙে পড়েছে। কাক ডাকছিল আর কোথাও থেকে ঝিঁঝি পোকার কান্না ভেসে আসছে। সে জানালা বন্ধ করে রেখেছে, কারণ যে-কোনও সময় মিলিটারি এসে ব্রাস ফায়ার করতে পারে। এবং সারাদিন পচা ভ্যান্সা গন্ধ উঠছে। উকিলপাড়ার আশে-পাশে কোর্ট-ময়দানে কিছু লাশ পড়ে আছে। দক্ষিণের হাওয়া, গন্ধটা শহরময় ছড়িয়ে দিচ্ছিল। হাতে তার চিঠি। সে যে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। আবুলের মুখ ভেসে উঠছে। আবুলের একবার অসুখ হয়েছিল। খুব ছোট আবুল। সে আর মিনু তখন একটা গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করত। সেখান থেকে শহরে আসা যায় না। আবুলের বড় অসুখ। আবুলকে নিয়ে নৌকায় শহরে। দিন-রাত আবুলের জন্য ভেবে ভেবে সারা। মিনু চুপচাপ, সব দুঃসময়েই মিনু চুপচাপ। আবুল ভাল হয়ে গেলে মিনুর চোখে সে এক আশ্চর্য মায়া দেখেছিল। এখন মিনুকে এমন বললে, ওর সেই চোখ দেখতে পাবে। দেখলেই ভিতরটা কেমন কেঁপে ওঠে। সে যে কি করবে, সে কেবল ঘরের ভিতর পায়চারি করছিল। এক রাত লেগে যাবে। সন্ধ্যায় রওনা হলে ওরা ভোর রাতের দিকে কাঠের বাক্সটা দন্দির বাজারে নামিয়ে দিতে পারবে। হাট-বার হলে অসুবিধা। বোধহয় হাট-বার হবে না। সে অবনীর কাছে সব জানতে পারবে। নদীর জলে নৌকা, দুপাশে বন অথবা গ্রাম পড়বে এবং মাঠের উপর এখন শুধু রোদ। রাতে গরম থাকবে না তেমন। ঠাণ্ডা বাতাস সব কিছু ঠান্ডা করে রাখবে—আর আশেপাশে সড়ক। সড়কে মিলিটারি, সাঁজোয়া গাড়ি। গনা রকমের চেক পোস্ট। সব নৌকা ওরা সার্চ করতে পারে নাঙ্গলবন্দের ঘাটে। অথবা যা হয়, মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠলে নদীতে, আবুল ভয় পেয়ে যেতে পারে। সে আবুলকে নানা ভাবে এ-ক’দিন শিখিয়েছে সব কিছু। কারণ সে জানে সে এবং তারা আজ অথবা কাল কোন গঞ্জের সোয়ারি হয়ে যাবে।

    সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ডেকেছিল, মিনু

    কোন সাড়া পায়নি। চাল-ডাল সেদ্ধ করতে করতে মিনু জানালা একটু ফাঁক করে কিছু দেখছিল। সেই মাঠ, বাংলাদেশের মাঠ, সেই বড় বাড়িটা মিশনারি স্কুলের, সেই লালদীঘি এবং দু’পাশে সব কেয়ারি করা ফুলের বাগান। আর সেই সব অশ্বত্থ গাছ, গাছ পার হলে নদী, নদীর জল, খেয়াঘাট, এবং নদীতে কলমিলতায় ফুল ফুটল না বুঝি আর! সে মনে মনে বলল, ফুল ফুটবেই। নদীতে জল থাকবে, মাঠে মাঠে ঘাস, ঘুঘুপাখি ডাকবে, আকাশে শরতের মেঘ আর পরবের দিনে ঈদ মুবারক। সে বুঝতে পেরেছিল সমসের ওকে ডাকছে। সমসের কিছু দরকারি কথা ওকে শোনাবে। ওর পরামর্শ চাইবে।

    খিচুড়িটা ধরে যেতে পারে ভেবে সে নামিয়ে রাখল। হাতা দিয়ে নাড়ল। একটু আদা-হলুদ দিয়ে সে নামিয়ে রেখেছে। গন্ধ উঠছিল বেশ। ক্ষুধার সময় প্রায় জিভে জল চলে আসার মতো। চারপাশে ভয়ংকর অভাব হাঁ করে আছে। যা ঘরে আছে, কোনরকমে মিনু আর চার-পাঁচদিন একবেলা করে চালিয়ে নিতে পারবে। ওদের এখন থেকেই মেপে মেপে খেতে হচ্ছে। স্কুল-কলেজ বাজার-হাট কতদিন থেকে বন্ধ। মিলিটারির লোকগুলি এসে দোকানপাট জোর করে খুলে রাখতে চেষ্টা করছে। ওরা গত রাতে দোকান পাট খুলতে গিয়ে লুটতরাজ করেছে। ওরা সঙ্গিনের খোঁচা মারছে। যারাই দোকানপাট খুলতে চাইছে না, তাদের ওরা সঙ্গিনের খোঁচা মেরে হত্যা করছে। এবং গতকালই কালিবাজারের মিশনারি স্কুলের পাশে কয়েকটা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে হত্যা করেছে সব মানুষজন। ট্রাকে করে মরা মানুষগুলো নিয়ে যাবার সময় মিনু দেখতে পেয়েছিল, ওদের কারু কারু হাত ঝুলে আছে। এমন একটা দৃশ্য দেখলে আগে হয়ত মিনু রাতের পর রাত বিভীষিকায় না ঘুমিয়ে থাকত। কিন্তু এখন আর কোনও আতঙ্ক হয় না। ওর মা বাবা দুই ভাই এবং বোন কেউ বেঁচে নেই। বাবা হিন্দুস্থানে কাজ করতেন। রিটায়ার করে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। মিনু সেই কবে এসেছিল। দেশ ভাগের সময় সে কত ছোট। সে তার দাদা তার এক মামার সঙ্গে এখানে চলে আসে। ওরা যখন নিতাইগঞ্জে বাসা নিল, তখন মিনু বালিকা। মিনুর বাবা রহমান সাহেব সবাইকে এ-দেশে পাঠিয়ে, বাকি জীবন হিন্দুস্তানে চাকরি করে শেড়ে চলে আসেন। এসেই তিনি কেমন ভীত হয়ে পড়েন।

    মিনু সেটা একবার বেড়াতে গিয়ে টের পেয়েছিল। বাবাকে ওরা মেরে না ফেললেও যেন মরে যেতেন। তাঁর ভয় ছিল—কোথায় যেন একটা ভয়, যা তিনি চোখ বুজলে টের পেতেন। আর কি আশ্চর্য, মিনু এতটুকু আজকাল আর কাঁদে না। চোখ দুটো বড় হয়ে যায়। চুপচাপ বড় বটগাছের মাথায় কি দেখে। সমসের এসে বলেছিল, নিতাইগঞ্জে কেউ বেঁচে নেই। তোমাদের সবাই গেছে। খুব ঠান্ডা গলায় বলেছিল সমসের। তার মুখে কোন শোকের ছবি ছিল না, মিনু কেমন ঠান্ডা চোখ-মুখ করে রেখেছিল। ওরা কেউ বেঁচে নেই! ওরা কারা এমন পর্যন্ত সে প্রশ্ন করেনি। ওরা বলতেই সে টের পেয়ে গেছে—ওর বাবা, মা সবাই। কামানের গোলাতে গাড়াটা নিশ্চিহ্ন। কেউ পালাতে পারেনি। চারপাশ ঘিরে ওরা কামান দেগেছে। ওদের কাছে বুঝি খবর ছিল, মুক্তিফৌজের বড় একটা দল সেখানে আত্মগোপন করে আছে।

    এই সব দেখে দেখে মিনু কি করে যেন ভেবে ফেলেছে, সে, সমসের, আবুল কেউ বাঁচবে না। সমসের যখন ছাত্রনেতা ছিল এবং সমসের যখন বড় নদীতে নৌকায় করে ভেসে যেত, যখন “াসের গাইত-আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি –মিনুর ভারি রাগ হত। আমরা বুঝি তোমার কেউ না? সমসের চশমাটা খুলে রুমালে চোখ মুত। সে চশমা খুলে মিনুর মুখের কাছে মুখ এনে বলত, তুমিই তো আমার সোনার বাংলা মিনু। তুমি, আবুল, এই নদীমাঠ, বন এবং ঘাস, অথবা যা কিছু পাখ-পাখালি—সব মিলে আমার এই বাংলাদেশ। বলেই চশমাটা আবার পরত চোখে। তারপর নিবিষ্ট মনে আবার গাইত—ও আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। নদীর দু-পারে গঞ্জ, গঞ্জের হাট থেকে ইলিশ কিনে নৌকায় রান্না। পালে বাতাস লাগলে সমসের পাটাতনে চুপচাপ শুয়ে থেকে কি যেন তখন আকাশ-পাতাল ভাবত। মিনু বার বার ডেকেও সাড়া পেত না। যেন নদীর অতল জলে সে কিসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। হাজার লক্ষ মানুষ দামামা বাজিয়ে চলে যাচ্ছে বুঝি। বড় নদী, দু-পার দেখা যায় না। নদীর জলে সুর্যের আলো আর ঢেউ। অজস্র ঢেউয়ের সেই গর্জন শুনলেই সাসের কিসের আওয়াজ শুনতে পেত। যেন কারা দু’হাত তুলে বলতে বলতে যাচ্ছে, আর দেরি নয়, এবার শুরু করে দাও। ওদের হাতে মশাল। আর ধ্বনি দিচ্ছে। সে কান পাতলে নদীর জলে, আস্কাশে বাতাসে এবং দু-পারে যত গাছপালা আছে সর্বত্র শুনতে পায়—সবাই হাত তুলে দিচ্ছে আকাশের দিকে—গাইছে—সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।

    সমসের আবার ডাকল, মিনু।

    –যাই

    –করছ কি?

    –এই আসছি। বলে আঁচল দিয়ে হাত মুছে কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

    সমসের কিছু না বলে ওকে চিঠিটা পড়তে দিয়েছিল। কেবল চিঠিটা দেবার সময় বলেছিল, কামাল লিখেছে। তুমি চিঠিটা পড়। পড়ে মতামত দেবে, এক্ষুনি। হাতে আমাদের আর সময় নেই।

    এটা যে জুরুরী চিঠি, না হলে সমসের এমন বলত না, সমসেরের চোখ-মুখ দেখেই তা টের পেয়েছে মিনু। সে চিঠির ভাঁজ খুলে কিছু পড়তে পারছিল না। জানালা বন্ধ বলে অন্ধকার লাগছিল। সে দরজার কাছে চলে গেল। এবং চিঠিটা খুলে পড়ল। সে একবার পড়ে যেন বুঝতে পারল না। এবং শেষ লাইনটা ওর ভিতরে কেমন জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। যদি ওরা যেতে না পারে, তবে হাসিনা আর অনি যাবে। কত কারণ থাকতে পারে না যাওয়ার, যেন সাধারণ সুবিধা-অসুবিধার কথা লিখেছে কামাল। কোন গুরুত্ব দিয়ে লেখেনি, বড় সহজভাবে লিখেছে। কোনও মেলায় যেতে হবে, এমন একটা ভাব চিঠির ভাষাতে। সে সমসেরের কাছে এগিয়ে গেল। জানালাটা খুলে দিল সামান্য। অস্পষ্ট অন্ধকারে সমসেরের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। আবুল বারান্দার ও-পাশে বুবুর সঙ্গে লুডু খেলছে। স্কুল বন্ধ বলে পড়শোনা বন্ধ। বাড়ির বাইরে বের হতে পারছে না বলে সারাদিন লুডু খেলে। কি আর করবে, বড় মাঠে বের হতে পারছে না। তবু সে সদর খুলে কতবার এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে আসে। মিনু বকলে সে চুপচাপ রান্নাঘরের ও-পাশের চালাঘরটার নিচে বসে থাকে। সে পালিয়ে থেকে মাকে ভয় দেখাতে ভালবাসে।

    মিনু চারপাশে তাকাল। সমসেরের মুখ দেখার আগে সে দেখে নিল আবুল কোথায়। কারণ মিনু অনেকক্ষণ সোজাসুজি তাকিয়ে ওকে দেখবে, এমন ভেবেছিল। সমসের কেমন ভীত। মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে। সে তার দিকে সোজা তাকাতে পারছিল না।

    মিনু বলেছিল, চিঠিটা রাখো।

    সমসের কাঠ হয়ে গিয়েছিল যেন, চিঠি সম্পর্কে মিনু কিছু বলছিল না বলে। সমসের চিঠিটা ভাঁজ করতে করতে বলেছিল, তাহলে হাসিনা আর অনি যাচ্ছে?

    –তা যাবে। ওরা যদি যেতে চায় যাবে। আমি বারণ করার কে?

    সমসের বুঝল মিনু কামালের উপর রাগ করেছে। অথবা সমসেরের উপর। সে বলেছিল, তোমাকে তবে চিঠিটা দেখাব কেন?

    –দেখানোর কি দরকার। কামাল কি তবে আমাদের এই বুঝছে এতদিনে?

    সমসের আর কোন জবাব দিতে পারে নি। মিনু আবুলের অসুখে কি ভেঙে পড়েছিল! সে ভাল করে খেতে পারত না, ঘুমাতে পারত না। চোখে কালি পড়ে গিয়েছিল। অথচ মিনু এতটুকু ভেঙে পড়েনি। ভেতর থেকে এক ভয়ংকর দৃঢ়তা ওকে আশ্চর্য ভাবে শক্ত করে রেখেছে।

    .

    সমসের অবনীর কাছে এগিয়ে গেল। বলল, নীলু কেমন আছে? কতদিন দেখি না।

    অবনী জানে নীলু ভাগ নেই। সে আজ হোক কাল হোক মরে যাবে। তবু বলল ভাল আছে।

    –মঞ্জুদি, কেয়া?

    –সবাই ভাল আছে।

    –ওদিকে কোন গোলমাল হয়নি ত?

    –না।

    এর পরই কেমন চিন্তিত মুখে সমসের বলল, আমিনুল এত দেরি করছে কেন?

    –ও চরের ওপর দিয়া হাইটা আইতাছে।

    –তোর কাছে সিগারেট আছে?

    অবনী পকেটের ভিতর হাত দিয়ে দেখল, কিছু বিড়ি আছে। সিগারেট নেই। বলল, বিড়ি খাইবি একটা?

    –দে তাই খাই।

    আমিনুল দু-প্যাকেট সিগারেট, এক প্যাকেট বিড়ি আনতে গেছে। তারে আমি কালিবাজারের ওদিকটায় নামাইয়া দিছি।

    –কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে?

    –আরে কতক্ষণ আর লাগব। দক্ষিণা বাতাস আছে। পালে হাওয়া লাগলে রাইত বারটা বাজতে না বাজতে চইলা যামু।

    সমসের বলল, স্টেশনে যা। তোর ভাবিকে নিয়ে আয়। গেলে দেখবি হাতে বদনা নিয়ে একটা বাচ্ছা দাঁড়িয়ে আছে। আর বিবির হাতে তালপাতার পাখা। পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কোড বলবি। এতদিন পর তোকে নাও চিনতে পারে। আজকের কোড আমাদের সজনে ফুল। বললেই ওরা তোর পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করবে।

    সে বলল, সজনে ফুল। মুখস্থ করার কায়দায় সে আবার বলল, সজনে ফুল। তারপর বলল, মঞ্জু সজনে ফুলের চচ্চড়ি যা করে না। খাইতে ভাল।

    সমসের মঞ্জুদির হাতের রান্না খেতে খুব ভালবাসত। মঞ্জুদি স্কুলের ছুটির পর মাঠ পার হয়ে চলে যেত–দেখা হলে বলত, আমাদের বাড়িতে আসবেন সমসের সাব। আর গেলেই অবনীর হামান দিস্তার শব্দ শুনতে পেত। গল্প করতে করতে রাত হলে বলত, তর মঞ্জুদি কইছে খাইয়া যাইতে। মঞ্জুদি রান্নায় খুব কদাচিৎ রসুন পেঁয়াজ ব্যবহার করত। কেমন নির্মল মনে হত মঞ্জুদির হাতের রান্না। হিন্দু সধবাদের যা হয়, মঞ্জুদি তার কোনও ব্যতিক্রম ছিল না। আলাদা ঘরে খেতে দিত অবনী আর তাকে। বড় তৃপ্তি বড় আরাম। এ-সময় মঞ্জুদির কথা কেন এত মনে পড়ছে সে বুঝতে পারল না। আসলে দেশটাতে এখন কে কার, কার সঙ্গে কি সম্পর্ক মনে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। তবু মঞ্জুদি আর নীলু যেন তারই মত, যেন, সেই আবুল আর মিনু—কতদিন পর আবার তাদের সঙ্গে এই সুযোগে দেখাও হয়ে যেতে পারে। ভাবতে গিয়ে মনের ভিতর সমসের কতকটা যেন জোর পেল।

    .

    অবনী লুঙ্গি পরেছে। ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে। থুতনিতে সামান্য দাড়ি, সে মিঞা মানুষ এবং মাঝি নৌকার। সে দাঁড়ে থাকবে। এখন নদীতে জল কম বলে জায়গায় জায়গায় সে লগি বাইতে পারবে। কোথাও নৌকা চরে আটকে গেলে সে যখন খুশি ইচ্ছা করলে জলে ঝাঁপ দিয়ে নৌকা ঠেলে নিতে পারে। এমন ভাবে সে লুঙ্গিটা পরেছে, দরকার হলে সে লুঙ্গি খুলে মাথায় পাগড়ি বেঁধে নেবে।

    সে এখন একেবারে বাংলাদেশের বান্দা মানুষ। সে এখন আজ্ঞাবহনকারী। তার এখন কিছু আর করার নেই। সে জেনে ফেলেছে সন্ধ্যার ভিতর একটা ঘাসি নাও যোগাড় করতে হবে এবং এবার আর স্থলপথে না গিয়ে জলপথে ওকে যেতে হবে। কারণ আর্মির লোকেরা টের পেয়ে গেছে, বন্দরের ঠিক ওপারে কিছু বিচ্ছিন্নতাকামী মানুষ রাইফেল পাচার করতে শুরু করে দিয়েছে। ওরা বড়রাস্তা ধরে যাবার সময় জেটির ঢালু জমি, নদীর চর, অসংখ্য নাও, গাদাবোট, স্টীমার এবং মোটরলঞ্চের ভিতর স্থির করতে পারছে না কোথায় ঘটনাটা ঘটছে। কাল থেকে ঠিক আছে সমসের আর এ-জায়গাটা ব্যবহার করবে না। যখন তখন আক্রমণ ঘটতে পারে। অসংখ্য লোক নদীর ওপারে চলে যাচ্ছে। মেশিনগান দাগিয়ে যেকোন সময় এই সব মানুষ, যারা ওপারে যাচ্ছে, প্রাণভয়ে পালাচ্ছ শহর ছেড়ে, তাদের সাফ করে দিতে পারে। ওরা পাখি মারার মত, অথবা মনে হয় বাংলাদেশের মানুষেরা ওদের কাছে মানুষ না, সাধারণ পাখ-পাখালি, ওরা শিকারী বেড়ালের মত সব সময় পাখি ধরার জন্য ওত পেতে আছে।

    অবনীর যেতে যেতে এমন সব মনে হচ্ছিল। ভিড় শহরে নেই। ভিড় যত এই অঞ্চলে। এখান থেকে যারা যে-ভাবে পারছে পালাচ্ছে। স্টেশনে অসংখ্য মানুষের ভিড়। মানুষেরা ট্রেনের আশার বসে রয়েছে। নানা রকমের কাহিনী ফিসফিস করে সবাই বলছে। মুখে ওদের দুশ্চিন্তার ছাপ। চোখে ক্লান্তি। যেন কতকাল এইসব মানুষজন অন্নাভাবে অথবা এক হাহাকারে ভুগছে। আবুলের মুখ অবনী মনে করতে পারছে না। বোরখার নিচে মিনু-বৌদির মুখ সে চিনতে পারবে না।

    সে মিনু-বৌদিকে খুব কম দেখেছে ওদের আড্ডায়। স্কুলের চাকরি করে মিনু-বৌদি। কোনওদিন সময় করে আড্ডা দিতে আসেনি। বড্ড ঘর-মুখী মেয়ে। সারাক্ষণ ঘর আর সংসার। এবং ঘর সাজাবার বড় বাতিক তার। আড্ডায় এসে সমসের হাসতে হাসতে বলেছে, তোদের ভাবির কান্ড আর বলিস না। মাসের শেষ। একগাদা আবার বই আনিয়েছে ও-পার থেকে। একদিন তোরা আয়। খাবি আমার বাড়িতে। আমরা তারপর গান গাইব। মিনু কতদিন বলেছে, অবনীবাবুর কোনও খবর নেই কেন? আসে না কেন? ও কি কবরাজি করে আর সময়ই পায় না।

    –না রে না। তা না। অবনী মনে মনে কথাটা উচ্চারণ করে নিজের কাছেই বোকা বনে গেল। সে এত উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, পুরানো স্মৃতি তাকে এত বেশি উত্তেজিত করছে, যেন সে তার সেই ডিসপেনসারিতে বসে আছে। এবং বড়রাস্তা সামনে, সন্ধ্যা হলে ডিসপেনসারিতে সবাই আসত। এবং ছ’টা বাজলে আসবে সমসের, আনোয়ার, মলয়, আমিনুল, তারপর ওরা সারা সন্ধ্যা কি যে বলাবলি করত, দেশের রাজনীতির সঙ্গে ওরা তেমন জড়িত ছিল না। শৈশবে সোনা বলে যে ছেলেটি বড় হয়ে উঠেছিল তার কথাও বাদ যেত না, কোথায় আছে কে জানে।

    তবু ওরা জানত, ডাক এলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সবাইকে। কেবল কামাল ছিল ওদের ভিতর সবচেয়ে দামী মানুষ, সে কথা কম বলত। বলত আমরা একদিন এই বাংলাদেশে সবাই মিলে সমস্বরে গান গাইতে পারব। সবাই মিলে যখন উদাত্ত কণ্ঠে গাইব, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর—কি আশ্চর্য, শরীরের লোমকূপে এক তীর্যক বহ্নি ফুটে উঠত। সবার ভিতর এক আশ্চর্য ভালবাসা গড়ে উঠত তখন। কেউ আর নীচ হীন অথবা সংকীর্ণতায় ভুগে অন্য রকমের চোখ করে রাখতে পারত না। ওরা তখন কোনও গাছের নীচে অথবা মাঠ পার হলে বড় অর্জুন গাছ, তারপর নদী, নদীর চর, ওরা চরে বসে চুপি চুপি গাইত, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ আর খুঁজিতে চাই না।

    এসব মনে হলেই মনে আসে, যেন কবে, দিনক্ষণ সে এখন ঠিক বলতে পারে না, মনে আছে একবার অবনী, কামাল আনোয়ারকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ওর বাড়ি। ঘরে ঢুকতেই কামাল দেখল, দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি, নজরুলের ছবি। আর আশ্চর্য, এই বাংলাদেশে সে কি জীবনানন্দেরও একটা ছবি টাঙিয়ে রেখেছে। মিনু-বৌদি বলেছিল, বাংলাদেশ বলতে যা বুঝি—বলে সে তিনজনের ছবির দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল।

    কামাল বলেছিল, মিনু তোমার ভয় করে না?

    –কিসের ভয়?

    —সরকার। সরকারের ভয়?

    –কোন সরকারের কথা বলছ কামাল?

    –এই সরকার। যে সরকার আমাদের বেয়নেটের তলায়, বুটের তলায় পিষে মারছে।

    –তাদের ভয় পেলে আমাদের চলবে কেন? তারা কে এদেশের?

    কামাল বলছিল সমসেরকে—তোর বিবির এত সাহস কি করে হল রে?

    –কি জানি।

    মিনু ছবিগুলোর দিকে হাত তুলে দেখিয়েছিল। তারপর এক অদ্ভুত মায়াবী চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ওরা আমাকে সাহস দিয়েছে কামাল, ওরা।

    কামালের চোখে সেদিন এক বেদনাকাতর ছবি। সে-ও যেন এটা মনে মনে বোঝে। অথচ কিছু করতে পারছে না। মিনু-বৌদির কথাগুলো অন্য সময় হলে বড় নাটকীয় মনে হত। অথচ আশ্চর্য, সেদিন ওর কাছে মিনু-বৌদির সে-সব কথা রক্তে আগুন ধরানোর মত। আদৌ নাটকীয় মনে হয়নি। মিনু-বৌদি কি করে তাদের সবার প্রাণের কথা খুব সহজে বলে দিতে পেরেছিল।

    অবনী লুঙ্গিটা এক হাতে ধরে হাঁটছে। সে মেহনতী মানুষের ভঙ্গীতে হাঁটছে। শহরে এসে যেন সে তাজ্জব বনে গেছে। দাড়ি গালে। একেবারে ধর্মীয় চেহারা করে রেখেছে। সে খুঁজছিল ভিড়ের ভিতর কোথায় সেই তালপাতার পাখা। প্ল্যাটফরমে কোথায় বদনা হাতে নাবালক দাঁড়িয়ে আছে ভিড়ের ভিতর, কারণ কেউ কেউ বসে আছে, বিছানাপত্র, তোরঙ্গ যে যা সঙ্গে পেরেছে এনেছে। কেউ কেউ দু-দিনের উপর হবে এখানে আটকা পড়েছে। লাকসাম যাবে কেউ, কেউ ভৈরব সেতু পার হবে। কেউ যাবে নসিন্দি-জিনার্দি হয়ে আরও দূরে। কেউ যাবে বাবুর হাটে অথবা গোপালদি। আড়াইহাজার যারা যাবে তারা ট্রেনের কোন খবরই পাচ্ছে না। সে ভিড় ঠেলে যাচ্ছে। শহর খালি করে যারা চলে যাচ্ছিল, তারা একটা এমন গেঁয়ো লোক দেখে ভাবল, মানুষটা কোনও খবর রাখে না।

    যেন এখন মনে হয় ওর হাতে বাঁশি থাকলে, এই তালপাতার বাঁশি, সে বাঁশি বাজিয়ে ভিক্ষা করতে পারত। সে খানেদের কাছে গিয়ে রঙ্গতামাসা করতে পারত। পরাণে তার ভয়-ডর বলে কিছু নেই। ওদিকে শহরের বড় স্কুলবাড়ি আগুনে পুড়ছে। কামানের গোলায় কলেজের উঁচু থাম্বা অথবা সব মীনার গম্বুজ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, মানুষটাকে দেখলে তা পর্যন্ত কেউ টের পাবে না।

    .

    তালপাতার পাখাটা তখনও নাড়ছে মিনু। আর অধীর চোখে কেবল তাকাচ্ছে। কখন যে পাশে দাঁড়িয়ে কেউ বলবে ‘সজনে ফুল’ চেনার উপায় থাকবে না। কিছু মানুষ এরই ভিতর খানেদের টাকার গোলাম হয়ে গেছে। সুতরাং মিনু আবুলকে কাছে টানলে শুনতে পেল, সজনে ফুল।

    এদিক-ওদিক না তাকিয়ে মিনু খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেলল, সজনে ফুল। এবং কোন দিক থেকে কে বলছে, চোখ তুলে তাকাতেই সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। মানুষটাকে অন্য সময় দেখলে ভয় পেত। চোখ মুখের কি চেহারা করে রেখেছে! তবু এর ভিতর বুঝতে আদৌ কষ্ট হল না, অবনীবাবু সে অবনীবাবুকে বছর তিন আগে দেখেছে, তারপর নানা কারণে দেখা হয় নি। অথচ এখন দেখে সে তাজ্জব বনে গেছে।

    অবনী বলল, তাড়াতাড়ি হাঁটেন।

    মিনু আবুলের হাত ধরে তাড়াতাড়ি হাঁটতে থাকল।

    অবনী বলল, আয় বেটা তরে কান্দে লই।

    –না আমি হেঁটে যাব।

    –তাড়াতাড়ি যাইতে হইব।

    –আমি খুব তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারি।

    –তুই আমার লগে হাঁইটা যাইতে পারবি না।

    –ঠিক পারব। ঢলুন।

    স্টেশন থেকে একটু নেমে যেখানে নবগোপাল দাসের মিষ্টির দোকান ছিল, এবং একটা সরু গলি নদীর দিকে চলে গেছে সেখানে অবনী বলল, দ্যান সব আমার হাতে।

    মিনু বোরখাটা খুলে ফেলতে চাইলে, আরে না, এহনে খুইলা ফ্যাললে চলব না। কখন খুলতে হইব কমু

    মিনু বলল, আপনাকে প্রথমে চিনতেই পারছিলাম না।

    –এখন তো চিননের কথা না। কাইল সারারাত ঘুমাই নাই। মকবুল, নলিনী, রহমান সবাই এক এক কইরা জলের অতলে ডুইবা গেছে। সব খবর পাইছেন আশা করি।

    –পেয়েছি।

    ওরা এখন যে পথ দিয়ে হাঁটছে সেখানে কোন আলো নেই। আলোর থাম সব কারা উপড়ে ফেলেছে। এটা শহরের নদীর পাড়ের দিক। এখানে কিছু বড় বড় কলকারখানা আছে। এবং একটু দূরে বড় মসজিদ পার হলে আদমজীর জুটমিল পড়বে এক এক করে। নদীর চরে দাঁড়ালে জুটমিলের চিমনিগুলো সারি সারি দেখা যায়। ওরা সরু গলি থেকে যেই নদীর চরে পড়বে তখনই চিমনিগুলো আকাশে ভেসে উঠবে। কিন্তু আজ তারা জানে, কিছুই দেখতে পাবে না। শহরের এ-পাশটায় মুক্তি ফৌজের লোকেরা অতর্কিতে আক্রমণ করে জায়গাটাকে এখনও নিজেদের দখলে রেখে দিয়েছে। ফলে যে- কোনও সময় এদিকটাতে বড় বড় ট্যাঙ্ক এসে নদীর চরে যত মানুষ আছে, এবং জলে যত নৌকা অথবা লঞ্চ আছে, কামান দেগে বিনষ্ট করে দিতে পারে।

    মিনু হাঁটতে হাঁটতে বলল, আপনারা দুপুরে খেয়েছেন তো?

    –খাইছি! রাস্তার এক মিঞাজানের বাড়িতে মুরগির মাংস ভাত।

    –ফিরে এলে একদিন আমি আপনাদের সবাইকে মুরগির গোস্ত ভাত খাওয়াব।

    –তাহলে কিন্তু আমার জন্য আলাদা আস্ত একটা মুরগী লাগব।

    আবুল ছিল মাঝখানে। ওর মানুষটার খাই খাই ভাল লাগছিল না। সে বলল, আপনি আস্ত খেলে আমরা খাব কি?

    –না না, আস্ত খামু না। তুই আমি ভাগ কইরা খামু।

    এদের দেখলে কে বলবে, এখন ওরা যাচ্ছে জীবনপণ করে, ওরা যাচ্ছে নদীর জলে ঘাসি নৌকায়, ওরা যাবে একটা কাঠের পেটি নিয়ে। ওটা ওদের শুধু পৌঁছে দেবার কথা। কোনরকমে পৌঁছে দিলেই ওদের ছুটি। ওরা আবার অন্য জায়গায়, সব বোধ হয় কামাল ঠিকই করে রেখেছে, খুব নির্বিঘ্নে শুধু পৌঁছে দেওয়া। পৌঁছে দিলেই ওদের ছুটি। ওরা রাস্তায় যে ভয়াবহ সব জায়গা আছে, মিলিটারি ছাউনি আছে নদীর পারে এবং যে-কোন সময় অতর্কিতে আক্রমণ ঘটলে ওদের জান মান কবুল করতে হবে—এসব এখন আদৌ ভাবছেই না। বরং যদি বলা যায়, এমন চাঁদের রাতে একটু গান গাইলে কেমন হয়। ওরা এখন যেন গান গাইতে গাইতে নেমে যাবে। প্রায় কোন শুভ কাজে যেন যাবে। কোন উৎসবে যোগদান করতে যাবে- ওরা কেউ এখন নিজের কথা ভাবছে না।

    তবু যা হয়, অসময়ে কত কথা মনে আসে। একবার মনে আছে, মিনু অবনীকে বলেছিল, আপনি বাপের এক ছেলে, মঞ্জুদির মতো বউ পেয়েছেন, ঘরের লক্ষ্মী। অবনী তখন বাধা দিয়ে বলেছিল, না আমি এক ছেলে না ভাবি। আমার আর এক দাদা ছিল।

    –কৈ আগে তো বলেননি!

    –কথাটা কওয়নের না।

    –কেন এ-কথা বলছেন?

    –যে আছিল সে এখন আকাশে বাতাসে বাইচা নাই।

    –কি হয়েছিল তার?

    –কি আর হইব।

    –বিনা অসুখে মরে গেল?

    –অসুখ বিসুখে মরে নাই।

    –তবে কিসে!

    –দাঙ্গায়। দেশ-ভাগের কিছু পরের কথা। মনে নাই সব। তখন আমার বয়স আর কত! পঞ্চাশ সালে হইব। কদমপুরের ঘাটে দাদায় আমার চিন্ত হইয়া পইড়া আছিল।

    মিনু আর কোনও কথা বলতে পারেনি! মানুষে মানুষে এটা কেন যে হয়। তার নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হয়েছিল সেদিন। যেতে যেতে কি ভেবে বলল, আপনার দাদা বেঁচে থাকলে আপনাদের আরও একজন মুক্তি যোদ্ধা বাড়ত।

    –তা হইত।

    –মিনু বলল, দেশ স্বাধীন হলে ওর একটা ছবি আমাকে দেবেন।

    –ছবি দিয়া কি হইব।

    –ঘরে টাঙিয়ে রাখব।

    –আপনের না বৌদি, এই ছবি টানানোর বড় বাতিক।

    –কি আর করব বলুন। ছবিতে মানুষকে ধরে রাখা যায় না। তার স্মৃতিকে আমরা ধরে রাখি।

    –এটা আমার ভাল লাগে।

    —যান, দিমু! দ্যাশে শান্তি আসুক, আইলে দিমু।

    আবুল বলল, আমার ছবি টাঙাবে না?

    —তোর ছবি তো ঘরে আছে।

    —আরও বড় ছবি।

    —বড় কাজ যারা করে তাদের বড় বড় ছবি টাঙাতে হয়।

    —অবনী কাকা তাই বুঝি?

    —মাইনষে তো তাই কয়

    ওরা এবার ডিঙিগুলো পার হয়ে যাচ্ছে।

    অবনী আঙুল তুলে বলল, ঐ জেটির নীচে সমসের বইসা আছে। আর কিছু সময় আপনাকে হাঁটতে হইব।

    —তবু যাই হোক আমি বুদ্ধি করে স্টেশনে এসে বসেছিলাম। তা না হলে কালীবাজার পার হয়ে আমাকে নিতে আসতে আপনাদের অনেক দেরি হয়ে যেত।

    অবনী এত কথা বলছে, এত যে খোলামেলা কথা, তবু কেন জানি মিনু এবং আবুলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভয়াবহ ব্যাপার, এটা ঠিক করেনি সমসের, এমন ভাবছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী সে সমসেরের আজ্ঞা শুধু মাথা পেতে নেবে। এ-সময় তার কোন প্রশ্ন করার অধিকার নেই। নতুবা এখানেই সে একটা গন্ডগোল পাকিয়ে বসত। কি দরকার এত বড় একটা রিস্ক নেওয়ার? কিন্তু কাকে বলবে? সবাই কেবা আগে প্রাণ করিবেক দান এই আশায় বসে রয়েছে। এখন কিছু বলতে গেলেই মিনু বলবে, মশাই আপনি বড় স্বার্থপর মানুষ। আমাদের এত ছোট ভাবেন কেন? এমন বড় কাজে কিছু করতে না দিয়ে, একা খুব বাহবা লুটতে চান?

    কিন্তু এই ছোট্ট ছেলে আবুল। ওকে সঙ্গে কেন? সে কি করবে? তার করার কি থাকতে পারে?

    অবনী তখনই দেখল ওরা জেটির কাছে এসে গেছে।

    আমিনুল আর সমসের ওদের দেখে এগিয়ে আসছে।

    আবুল ছুটে গিয়ে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

    মিনু বোরখাটা খুলে ফেলল। ভিতরে সে ঘেমে গেছে। শাড়ি সায়া পর্যন্ত ভিজে গেছে ঘামে। সে বুঝতে পারেনি, স্টেশনে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিল। কি গরম, আর তার ভিতর বোরখার অন্তরালে থাকা কি ভীষণ কষ্টকর। এতটা পথ সে হেঁটে এসেছে না ছুটে এসেছে, বলতে পারছে না। সে বোরখাটা খুলে সমসেরের হাতে দিল। সমসের কিছুতেই মিনুর দিকে তাকাচ্ছে না।

    মিনুই প্রথমে বলল, আর কত দূর?

    আমিনুল বলল, এসে গেছি ভাবি।

    ওরা চরের উপর দিয়ে হেঁটে গেল। ওরা যতটা পারছে নদীর জলের কাছাকাছি থাকছে। এবং এ সময়েই মনে হল ঠিক ঢাকা কটন মিলের গফুর মিঞার সরাইখানার গলি থেকে কেউ ফ্ল্যাশলাইট ফেলছে। আলোটা ঘুরে ঘুরে চারপাশে কি খুঁজছে। সমসের বলল শীগগির্ শুয়ে পড়। ওরা নৌকার আড়ালে শুয়ে মাথা তুলে রাখল। এবং সঙ্গে সঙ্গে শব্দ—ব্যাঙ্ ব্যাঙ্। মনে হল নদীর ওপার থেকে মেশিনগান দাগছে।

    অবনী সমসেরকে বলল, বোধহয় টের পাইয়া গেছে।

    সমসের চিৎকার করে বলল, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যা। তোরা দেখ নৌকায় উঠতে পারিস কিনা।

    মিনু আঁচল কোমরে গুঁজে নিয়েছে। সে ফিসফিস করে সমসেরকে বলল, তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি।

    সমসের কথা না বলে খুব কাছে এগিয়ে গেল। ওরা ডাঙ্গার বাতিল নৌকাগুলোর আড়ালে হামাগুড়ি দিচ্ছে। গাবের গন্ধ কাঠের গন্ধ এবং বাঁশ পচা গন্ধ উঠছে জায়গাটাতে। পিছনে আমিনুল আবুলকে নিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে। অবনী মাঝে মাঝে হামাগুড়ি দিচ্ছে এবং যখনই আলোটা ঘুরে অন্যদিকে পড়ছে তখুনি সে উঠে দৌড়ে যাচ্ছে। কোনরকমে কাঠের বাক্সটাকে জলে ভাসিয়ে দিতে পারলে ওদের কষ্ট হবে না টেনে নিতে। প্লাষ্টিকের আবরণে ভেতরটা মোড়া। দরকার হলে জলে ডুবিয়ে দিলেও সেই সব প্রাণের চেয়ে দামী গুলি-গোলা বন্দুক নষ্ট হবে না। কখন কি ঘটবে কেউ বলতে পারছে না। যতটা পেরেছে কামাল, প্যাকিংয়ে কোন দুর্বলতা থাকতে দেয়নি।

    সমসের বলল, কিছু বলবে বলছিলে?

    ওরা এখন পাশাপাশি। মিনু সমসেরের হাতে হাত রাখতেই টের পেল হাতটা ভীষণ গরম। শরীরে হাত রাখলে টের পেল গা-টা পুড়ে যাচ্ছে। সে বলল, তোমার জ্বর।

    —তুমি যে বলছিলে মিনু কিছু আমাকে বলবে? সমসের চেষ্টা করছে মিনুকে অন্যমনস্ক করে দিতে।

    —তুমি বের হয়ে যাবার পর কামাল লোক পাঠিয়েছিল।

    —আবার লোক পাঠাতে গেল কেন?

    —খানেরা বিকেলে এসে আমাদের পাড়াটা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে ঠিক করেছে।

    সমসের খুব শক্ত হয়ে গেল।

    —আমার যা কিছু ছিল সব নষ্ট করে দেবে।

    —এখন ওসব ভেবে লাভ নেই।

    —বাড়ির বাইরে এসে দেখলাম কারা দেয়ালে ক্রশ-চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে। তুমি কিন্তু আমাদের নৌকায় তুলে দিয়ে সেখানে আর যেও না।

    সমসের এখন চুপচাপ। এই ক্রস-চিহ্ন মানে, ওদের বিনষ্ট করা। ওরা পাকিস্তানের শত্রু।

    —ওরা আমাদের আর সহজে খুন করতে পারবে না মিনু। আমরা আর দাঁড়িয়ে মার খাব না। এবং এটুকু ভাবতেই সে কামালের উপর কৃতজ্ঞতায় খুশি হয়ে উঠল। কামালের পরামর্শমতো বের না হয়ে পড়লে খানেরা ওকে, ওর আবুলকে, মিনুকে দেয়ালে দাঁড় করিয়ে গুলি করত। সমসের এবার মিনুর খুব কাছে গিয়ে বলল, তোমার মুখটা দেখি মিনু।

    মিনু আরও কাছে মুখ তুলে আনলে আবার অন্ধকারে সেই গুলির শব্দ এবং ফ্ল্যাশলাইট। ঠিক জাহাজের বাতিঘরের মতো ঘুরে ঘুরে চারপাশটায় আলো ফেলছে এবং মাঝে মাঝে সেই শব্দ—ব্যাঙ্ ব্যাঙ্ ব্যাঙ্। ঝনঝন করে বাজছে, যেন কোথাও কাঁচ ভেঙে ছত্রখান হয়ে যাচ্ছে অথবা প্রতিধ্বনি উঠছে। লন্‌চগুলোতে আলো নেই। কেবল মরাজ্যোৎস্না চারপাশে, আর অদ্ভুত সেই ভয়ঙ্কর ফ্ল্যাশলাইট, জ্বলে উঠলেই মনে হয় অতিকায় এক সরীসৃপ নিশ্বাস ফেলছে—নিশ্বাসের সঙ্গে আগুনের হলকা ছড়াচ্ছে। মিনু ভয়ে সমসেরের বুকে মুখ লুকিয়ে রাখছে।

    মিনু আজ সুন্দর একটা নীল রঙের শাড়ি পরে এসেছে। মিনু কপালে সুন্দর কাচপোকার টিপ পরেছে এবং মনেই হয় না সে যাচ্ছে একটা ভয়ংকর কাজে। সাজের ভিতর মিনু বড় বেশি সরল সহজ হয়ে আছে—সে মিনুর চিবুক তুলে চুমো খেল, আমি মিনু তোমার, চিরদিনের তোমার, এই মাটিতে আমি যেখানেই পড়ে থাকি, মরে থাকি তুমি জানবে মিনু, আমি তোমার সমসের। আমি তোমার বাংলাদেশের মাটিতে অঘ্রানের ঘাসে ডুবে যাব, মরে যাব আমরা তবু স্বাধীনতার কথা ভুলব না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
    Next Article মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }