Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1863 Mins Read0

    ঈশ্বরের বাগান – ৫৯

    ।। উনষাট ॥

    ওদের আর দেখা গেল না। মিনু-বৌদি, আমিনুল, আবুল, নদীর পাড়ে উঠে গেল। খুব খাড়া পাড় সোজা ওপরে উঠে গেছে মত। অবনী দেখল গাছপালার ভিতর তিনটে ছায়ামূর্তি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এখন তার কাজ নৌকাটাকে ঠেলে মাঝগাঙে নিয়ে যাওয়া। পানি সেখানে বেশী। নৌকা টেনে নিতে কষ্ট কম হবে।

    এখন নৌকাটাকে নৌকা না বলে ঝোপ বলাই ভাল। বনঝোপ। নদীর ওপারে নৌকাটাকে আশ্চর্য একটা ছোট্ট মায়াবী দ্বীপের মত লাগছে। সে গলুইতে একটু সামান্য জায়গা রেখেছে দাঁড়াবার। সে সেখানে দাঁড়িয়ে নৌকা বাইছে। ধামরাই পর্যন্ত সে এভাবে যাবে। তারপর দু-পাড় আরও খাড়া। সেখানে খানসেনাদের ছাউনি এবং পাহারায় আছে তারা, কেউ শহর থেকে পালাতে না পারে। ওদের কাছে খবর আছে, বন্দর থেকে প্রতি রাতে একটা করে কাঠের পেটি যাচ্ছে। কোথায় যে যাচ্ছে, কিভাবে যাচ্ছে ওরা ধরতে পারছে না। ওরা দু-পাড় এবং এ অঞ্চলে যেখানে যত জায়গা আছে, গলিঘুঁজি আছে, মেশিনগান দাগতে দাগতে ঢুকে পড়ছে। আশ্চর্য, ওরা কিছুই পায়নি। কেবল মৃতদেহ—মানুষের এবং কুকুরের। ছোট বড় সব রকমের মানুষ। ওরা মরে পড়ে আছে। পথের উপর ওরা থেকে থেকে ফুলে-ফেঁপে গেছে। শকুন, কাক উড়ছে এবং যে সব কুকুর মরেনি, তারা মড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। অথচ একটা রাইফেল অথবা কার্তুজ উদ্ধার করতে পারে নি। ফিরে আসার সময় ওদের গাড়িগুলির ভিতর কিছু সৈনিকের মৃতদেহ, যারাই একা অথবা দুজন করে গলি-ঘুঁজিতে ঢুকে গেছিল—তারা আর ফিরে আসতে পারে নি। ওরা আক্রোশে, ভয়ে, খালি জায়গায় অথবা বলা যায় তখন নিরাপদ জায়গা থেকে কামানের গোলা ফেলতে ফেলতে পিছু হটে এসেছে।

    অবনী জানে এভাবেই এ অঞ্চলে রণক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এবং এ-ভাবেই দিনযাপন হবে, এ-ভাবেই মানুষের বিনিময়ে রাইফেল—আর মানুষ তাই সম্বল করে লড়বে। যখন তেমন কিছু মিলছে না, তখন রাইফেল একটা থাকবে। একটা মানুষ মরে যাবে, ট্রেন্‌চে সে পড়ে গেলে পাশ থেকে আর একটা মাথা উঁকি দেবে। এ-ভাবে দশটা মানুষ একটা রাইফেল, মনোবল রাইফেলের অজস্র। মানুষের কাছে একটা রাইফেল থাকলে ওরা এক পল্টন খানসেনার বিরুদ্ধে লড়তে পারবে।

    সে গলুইতে দাঁড়িয়ে লগি মারতে থাকল। নদীর পশ্চিম তীরে বড় বড় চর। এবং সেখানে তরমুজের জমি করার বাসনা মানুষের। আর কিছু রাতের পাখি তখনও ডাকছিল—টিট্টিভ। অবনী বেশি দূর আর যেতে পারছে না। একটু পরেই নৌকাটাকে ফের কিনারে নিয়ে যেতে হবে। এবং লাফিয়ে জলে পড়তে হবে।

    খানেরা সার্চ-লাইট দিয়ে টর্চ মেরে দেখার মত আকাশ দেখছে এখন। এত কাছাকাছি যে ওরা আলোটা ঘুরিয়ে ফেললেই দেখতে পাবে সহসা নদীতে এক বনের সৃষ্টি হয়েছে। মাঝনদীতে বনঝোপ দেখলে সন্দেহ হতে পারে। ওখানে সাঁতার-পানি, অবশ্য সাঁতার-পানি কিনা ওরা জানে না। ওরা জানে শুধু ওটা নদী, নদীর পরিমাপে খবর আছে পানি ওখানে বেশি। প্রায় সাত ফুটের মত। পানি সাঁতরে পার হওয়া যায় না, অথচ আশ্চর্য এমন খোলা মেলা নদীতে বন সৃষ্টি হয়ে গেল সহসা! বন না অন্য কিছু, মর্টার দেগে দেখে নিলেই অবনী খতম। সে তাই মাঝগাঙে বেশিক্ষণ আর নৌকা রাখতে ভরসা পেল না। নৌকার মুখ পাড়ের দিকে ঘুরিয়ে দিল।

    আর ঘুরিয়ে দেবার সময়ই মনে হল যেন একটা সার্চলাইট আকাশ থেকে নেমে আসছে। লাইটহাউসের আলোর মত আবার ঘুরে ঘুরে ডানদিক, বাঁ-দিক দেখতে দেখতে ঠিক মাঝগাঙে নেমে এসেছে। তাকে দেখে ফেলতে পারে ভয়ে সে লাফ মেরে জলে নেমে গেল, এবং নৌকার নিচে ডুবে থাকল। নৌকাটাকে আপ্রাণ একহাতে শক্ত করে টেনে রাখল। যেন নড়ে না। যেন ভেসে যায় না। একটা বনঝোপ সচল হয়ে গেছে দেখলে ব্যাপারটা ওদের কাছে ভৌতিক মনে হবে। ওরা আলোটা সেই ভৌতিক বনঝোপের সঙ্গে সঙ্গে টেনে আনবে, তারপর কামানের মুখ ঘুরিয়ে দিতে বলবে, শালা ভূত ভি খতম।

    ওরা খতমের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। অবনী হুঁশিয়ার। খুব হুঁশিয়ার। সে মাঝে মাঝে ভোঁস করে পানির উপরে ভেসে উঠে দেখছে আলোটা নৌকার উপর স্থির হয়ে আছে না আগু পিছু নড়ছে। ভোঁস করে ভেসে উঠতেই সে দেখল আলোটা চরের ওপর এবং ওপারের কল-কারখানা পার হয়ে আবার আকাশের দিকে উঠে স্থির হয়ে আছে।

    সুতরাং ওরা এটা ঝোপই ভেবে ফেলেছে, অথবা দূর থেকে একখণ্ড কচুরি পানার ঝাঁকও পারে। কারণ এতওপর থেকে কিছু বোঝা অসম্ভব। সন্দেহ হলে ওরা বার বার ঘুরিয়ে এনে আলোটা এখানেই ফেলত। সে আর দেরি করল না। গলুইতে উঠে সে আপ্রাণ লগিতে ভর দিতে থাকল। সে লগিটা দিয়েই হালের কাজ চালাচ্ছে, সাধারণ নৌকা হলে ওকে এত বেগ পেতে হত না। অনেকটা জায়গা জুড়ে ঝোপ-জঙ্গল, এবং কিছু ডালপালা জলের ভিতর পর্যন্ত নেমে গেছে। ফলে নৌকাটা এগুচ্ছে না। জলের ভিতর ডালপালা নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করছে।

    সে কখনও ডুবে, কখনও লগি মেরে, নৌকা একেবারে কিনারায় নিয়ে এল। এবং দেখল এখানে নদীর পাড় খাড়া না। বরং এখানে এত বেশি গাছপালা যে সে ভাবতেই পারে নি একটা বনের ভিতর আর একটা বন সেঁধিয়ে গেছে। সে তখনই দেখল মাঝ-গাঙে আলোটা ফেলে ওরা আবার কি যেন খুঁজছে। বুঝি কিছুক্ষণ আগে যে কচুরিপানার মত বনঝোপ দেখেছিল, এখন সেটা না দেখে বিস্ময়ে ওরা চারপাশটা খুঁজছে। মনের ভুল কি চোখের ভুল টের করতে না পেরে নিজেরা হয়তো এখন ছাউনির ভিতর গুঁতোগুঁতি করছে। অবনী মনে মনে না হেসে পারল না। বস্তুত, গোটা ব্যাপারটাই তার কাছে ভারি মজার হয়ে গেছে। যেন সে খেলায় মেতে গেছে, লুকোচুরি খোলায়। প্রাণের বিনিময়ে এ-খেলা তার মনেই হচ্ছে না। সে জলে ভেসে নৌকাটাকে কিনারে কিনারে ভাসিয়ে নিতে লাগল। শরীরে জোঁক এবং শত সহস্ৰ উলানি পোকা ঘিরে ধরেছে অথবা সে যে একজন মানুষ, তার চলা- ফেরাতে টের পাওয়া যাচ্ছে না। সে এখানে একটা বকুল গাছের নিচ দিয়ে নৌকা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তাও টের পাচ্ছে। কারণ বকুল ফুলের গন্ধে সে টের পাচ্ছে—এই হচ্ছে বাংলাদেশ। যেমন নদী- নালা, সূর্যকিরণ এবং আকাশ দেখলে টের পায় এ বাংলাদেশের আকাশ, বাংলাদেশের সূর্যকিরণ, বাংলাদেশের নদ-নদী, তেমনি সে এখন টের পাচ্ছে এ বাংলাদেশের বকুল ফুলের গন্ধ। নৌকাটাকে ঠেলে নিতে গিয়ে যে ক্লান্তি এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল, বকুল ফুলের গন্ধে কেমন তা নিমেষে উবে গেল।

    তাকে এখন নানাভাবে হুঁশিয়ার হতে হবে। কারণ সামান্য সন্দেহ খানসেনাদের প্রাণে দেখা দিয়েছে, সেটা সে আলোটার একটু সময়ের জন্য থেমে থাকা এবং যে জায়গায় সে ছিল তার চারপাশটা খুঁজে দেখা, দেখেই টের পেয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার দেখলে ওরা মর্টার দাগতে পারে। আর, হয়েছে বেশ। সে কখনও মর্টার অথবা কামানের ব্যবধানটা ধরতে পারে না। সে যে রাইফেল চালাতে শিখেছে সেও সামান্য ক’দিনের ব্যাপার। মোটকথা বলতে গেলে সে মাত্র ট্রিগার টিপতে জানে। সে বার বার রাইফেল নিয়ে বসে থাকলে অথবা পাহারায় থাকলে কেমন বিড়বিড় করে মনে মনে বকতে থাকে, এমিং, হোল্ডিং, ট্রিগারিং এক হতে হবে। মনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। সেরা মার্কসম্যান হতে গেলে এসব লাগে। সে যতবার যেখানে যে ট্রেনচে ছিল ততবার সে এমন কথা ভেবেছে। প্রায় মনের ভিতর কথাটা ওর মন্ত্রের মত হয়ে গেছে, এখনও তাই হচ্ছে। ওর শেষ রক্ত-বিন্দু এবং এমিং ট্রিগারিং হোল্ডিং এই হচ্ছে তার শেষ সম্বল। কিন্তু সে অন্ধকারে কি ভাবে যুঝবে ওদের সঙ্গে মনে মনে স্থির করে উঠতে পারছে না। তাকে সেজন্য বেশি করে পালাবার ফন্দিই আঁটতে হবে। রক্তের ভিতর যে তাজা ভাবটা আছে, ওকে কখন তা গ্রাস করবে, কখন সে মরিয়া হয়ে সব ফেলে রাইফেল নিয়ে বসে যাবে বনের ভিতর অথবা চুপি চুপি সিঁড়ি ভাঙার মত খাড়া পাড় ভেঙে বনঝোপের আড়ালে উঠে যাবে এবং ঠিক ছাউনির সামনে গিয়ে এক দুই তিন, ওর কাছে যদি তিনটে কার্তুজ থাকে অথবা তার পি-ফোরটিন রাইফেলের ম্যাগজিনে যদি পাঁচটা কার্তুজ থাকে সে এক দুই তিন চার পাঁচ পাঁচটা লাশ ফেলে দিতে পারলে ম্যাগজিন সাফ করবার জন্য একটু সময় পাবে।

    সে নিশ্বাস ফেলার সময় বললে, আঃ কি আরাম! মিনুভাবি তোমরা কত দূরে গেছ! সমসের তুই কোথায় আছিস? মঞ্জু, নীলু তোরা কেমন আছিস! আমরা যেখানে যাচ্ছি যদি সেখানে কোনও এনকাউন্টার হয়, তুই থাকবি তো পাশে? সে ভাববার সময় খুব সুন্দর করে সব ভাবতে চাইল সুন্দর ভাষায়, কি যে মাধুর্য তাতে, ভাববার চেষ্টা করল। কিন্তু সময় কম। এখন বসে বসে স্বপ্ন দেখলে চলবে না। তাকে এই বনঝোপ, নদীর জল এবং কিনারে ঝিনুক পচা গন্ধ পার হয়ে যেতে হবে। এবং দুটো একটা যে মানুষের মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে, কিনারায় শেয়ালের আর্তনাদে তা সে ধরতে পারছে। সে নাকে কোনও রুমাল চাপা দিতে পারল না অথচ সে এগিয়ে যেতে যেতে এসব কি দেখছে! সে প্রথম ভেবেছিল শুধুই ঝিনুক পচা গন্ধ। কিন্তু সে এসব কি দেখছে! এখন ভাবছে মিনুভাবি আবুল আমিনুলকে পাঠিয়ে ভালই করেছে। জলে কাদায় সে দেখতে পেল সারি সাড়ি মড়া ভাসছে। সে তখনই দেখল আলোটা তার নৌকা বরাবর এগিয়ে আসছে। এতক্ষণ সে ভেবেছিল বুঝি ঝিনুকের পচা গন্ধটাই উঠছে—কিন্তু এখন সে টের পাচ্ছে ওটা মানুষ পচা গন্ধ। যারাই এই পথে পালাতে গেছে তারাই খুন হয়েছে। মাস কিলিং। সে ঠেলে ঠেলে কারু হাত পা মাথা মুখ গলা সব পার হয়ে যাচ্ছে। আহা এটা কি হয়েছে, আহা এ-পোড়া বাংলাদেশের জন্য খোদা আল্লা ভগবান তুমি যেই থাক কাউকে ক্ষমা কর না। ওর ভিতর থেকে বমি উঠে আসছিল। এত সব মৃতদেহ, সংখ্যায় কত সে টের পাচ্ছে না, যেন এক যোজন প্রমাণ মানুষ ফেলে রেখে গেছে। সে টের পেল আলোটা আর কিছুতেই এগোতে পারছে না।

    বাতাসটা বাড়ছে। নদীর জলে দক্ষিণা বাতাস। এত কাছে যে খাড়া পাড় থেকে এবার পানির ভিতর ছপছপ শব্দ টের পেতে পারে, সে এই ভয়ে জলে যাতে শব্দ না হয়, সে ডুবে ডুবে নৌকা টানছে। এবং বাতাস দক্ষিণ থেকে বইছে বলে ওর কষ্ট কম হচ্ছে। সে যতটা না টানছে তার চেয়ে দ্বিগুণ বাতাস ওকে সাহায্য করছে। যদি আগে থেকে বাতাসটা এমনভাবে বইত, তবে সে এতক্ষণে জায়গাটা পার হয়ে যেতে পারত।

    বোধহয় সংসারে এ-ভাবে কোথাও কিছু ঘটছে। না ঘটলে সে যে এতটা পথ এসে গেছে এবং একেবারে ছাউনির সামনে, ওরা টের পাচ্ছে না, ওদের ছাউনির নিচে প্রায় শ’ খানেক ফুট নিচে একটা ঝোপ ক্রমান্বয়ে স্থান পরিবর্তন করে খাড়ি নদীতে ঢুকে যাবার মতলবে আছে, এবং একবার ঢুকে যেতে পারলে আর কে পায়, নদীর পাড়ে সড়ক নেই, যে সড়ক ধরে ওরা কামান বন্দুক এবং ট্যাংক নিয়ে তাড়া করবে—তারা তখন একটা ঘাসি নাওকে বন-জঙ্গল ভেবেই বসে থাকবে। নড়তে চাইবে না। ভয়ে ওরা দশ পাঁচজনের দল কোথাও নেমে যেতে চায় না। ওরা এক পল্টন সৈন্য নিয়ে পর্যন্ত চলাফেরা করতে ভয় পাচ্ছে। এক কোম্পানি হলে যেন ওদের সাহসে বুক ভরে যায়। এক কোম্পানি যেতে গেলেই সাঁজোয়া গাড়ি লাগবে। তা না হলে কাঁচা রাস্তায়, জলে কাদায় সব খেলনার গাড়ি হয়ে যাবে। সেজন্য অবনী ঘাপটি মেরে ঝোপের নিচে বসে রয়েছে। আলোটা ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে গেলেই সে অন্ধকারে নৌকাটাকে আর একটা ঠেলা দেবে। ব্যাস, তারপর গাজীর গীত গাও, গলুইতে বসে পান বাতাসা চিবাও, দেখতে কেউ আসছে না। সে খাঁড়ি নদীতে অদৃশ্য হয়ে গেলে তাকে আর কেউ দেখতে পাবে না। তখন সে নদীর জলে এক এক করে সব হিজলের ডাল ফেলে দেবে।

    সে বসে বসে বার বারই আলোটার দিকে লক্ষ্য রাখছে। উপরে নানা রকমের বাতি জ্বলছে। ওরা উপরের খাড়া পাহাড় মত জায়গাকে শহর বানিয়ে ফেলেছে। দুপারেই ওদের পল্টনের লোকরা টহল দিচ্ছে। সে এত নিচ থেকেও ওদের বুটের শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছে। অথচ আশ্চর্য সেই আলোটা ঠিক ওর ঝোপ-জঙ্গল থেকে প্রায় দশ গজ দূরে স্থির হয়ে আছে। এতটুকু নড়ছে না। যেন ওরা টের পেয়ে গেছে এবার। খাড়ি নদীতে ঢুকে গেলেই তারা আর কিছু করতে পারবে না।

    না, কিছু আর করণীয় নেই। কেউ কি খাড়ি নদীতে এখন নেমে আসছে? সে দেখল, এবং দেখে ওর বুক শুকিয়ে গেল, প্রায় আট দশজন খান সেনা খাড়া-পাড় ভেঙে যেমন পাহাড় বেয়ে নিচে নেমে আসে তেমনি নেন আসছে। এবং যেখানে আলোটা স্থির হয়ে আছে সেদিকে হেঁটে যাচ্ছে। কাদামাটি বলে ওরা একটা স্টিক দিয়ে প্রথম দেখে নিচ্ছে পা দেবে যাবে কি না। পায়ে ভারি বুট। ওরা গভীর জলে নেমে যেতে পারছে না। ওরা ডানদিকে সামান্য এগিয়ে গেলেই ঝোপটা দেখতে পেত। এখানে এখন নানা প্রকারের আগাছা। কিছু ওবোৎলেঙরার গাছ এবং বিশকাটালির গাছ। সেই গাছের ভিতর কিছু হিজল অথবা শ্যাওড়ার বন অনায়াসেই গজাতে পারে। ওরা টর্চ জ্বেলে দেখতে পারে, এই ভয়ে অবনী কোন রকমে নাকটা জলে জাগিয়ে রেখেছে। আর গলুইয়ের দিকটা পানির দিকে রেখেছে। ফলে ওরা যাবার সময় টর্চ মারতেই দেখল, বাতাসে হিজলের ফুল দুলছে। ভারি সুন্দর ফুল। কানের দুল করে দিতে পারলে বিবিকে ভারি খুবসুরত লাগত। এমন কি ওরা টর্চ জ্বেলে দুটো একটা হিজলের ফুল তুলে নিয়ে গেল স্টিক দিয়ে। এবং অবনী গলুয়ের নিচে পানির ভিতর ডুবে ডুবে ইষ্টনাম জপ করল।

    ঠিক একে ইষ্টনাম বলা যায় না। ভিতরে তার রক্ত টগবগ করে ফুটছে। সে গলুই থেকে ওটা টেনে বের করে নিলে অনায়াসে ওদের ফেলে দিতে পারত। এতে কাজের কাজ তেমন হবে না। তাছাড়া তার অধিকারও নেই। তার কাজ শুধু এই কাঠের পেটিটাকে জায়গামত পৌঁছে দেওয়া। দিলেই সে আবার অন্য নির্দেশ পাবে। খুশী মত সে যা কিছু ইচ্ছা করতে পারে না। সুতরাং সম্বল ইষ্টনাম। এবং তার তখন মনে হচ্ছে সব আকাশের গ্রহপুঞ্জ যেন তার গলগ্রহ হয়ে আছে। ঘাড় ধরে গেছে। কারণ চিত হয়ে থাকলে আকাশ বাদে আর কিছু দেখা যায় না।

    ওরা পানির ভিতর ঢিল ছুঁড়ল। যেখানে আলোটা বৃত্তাকারে স্থির হয়ে আছে ঠিক সেখানে একজন অফিসার মত মানুষ দুবার ঢিল ছুঁড়ল। ঢিল ছুঁড়ে কি যেন পরীক্ষা করছে। জলে ঢিল ছুঁড়লে একটা বৃত্তাকার ঢেউ উঠে চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আলো অন্ধকারে ঢেউ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কেবল বাতাসের ভিতর বোঝা যাচ্ছে নদীর সেই জলে ওদের কিছু পড়ে গেছে। এবং মনে হল একজন খান সৈন্য উলঙ্গ হয়ে জলে নেমে যাচ্ছে। জল কম হওয়ারই কথা। গ্রীষ্মের নদীতে জল প্রায় থাকে না বললেই হয়। মজা নদী। জলে পচা গন্ধ। পানির রং নীল।

    লোকটা কিছু মাটি তুলে পাড়ে উঠে গেল। পাড় থেকে আবার খাড়া উতরাই পার হয়ে ওরা ছাউনিতে ঢুকে যেতেই সে জয় বাংলা বলে ঠেলে দিল নৌকাটাকে। সে খুব বোকামী করল কি চালাকের কাজ করল তা টের পাওয়া যাবে পরে। কারণ বৃত্তের মুখের আলোর রশ্মির খানিক অংশে ঝোপটা যে সচল ধরা পড়ে গেছে। সে পাগলের মত নৌকা উত্তর দিকে টেনে যাচ্ছে। আগে সে ছিল নদীর দক্ষিণ দিকে, এখন উত্তর দিকে। আবার সে কচুরিপানার মত ঝোপের আশ্রয়ে নদীর জলে ভেসে চললে দেখল সে বেশ দূরে এসে গেছে। আলোটা ওকে পিছু পিছু অনুসরণ করছে। দক্ষিণা বাতাস এবং সে নদীর স্রোতে ঝোপ-জঙ্গল যত দূরে নিয়ে যাচ্ছে তত বেশী ধীর স্থির একটা আলো ওর পিছনে সন্তর্পণে অনুসরণ করছে। ওপর থেকে সেই আলোর এমন লঘু গতি দেখে মনে হল, ওরা টের পেয়ে গেছে। কোনদিক থেকে যে আক্রমণ ঘটবে বোঝা যাচ্ছে না। একবার ভাবল সে ঝোপের ভিতর রাইফেল তুলে বসে থাকে। কিন্তু তার একার পক্ষে এটা অসম্ভব। কারণ, হালে কেউ না থাকলে এলোপাথাড়ি নৌকা ভেসে গিয়ে চড়ায় আটকে যেতে পারে। তার কিছু করণীয় নেই। কেবল দেখা লঘুপক্ষ হয়ে যে আসছে, আলোর ফ্ল্যাশটা ওর দিকে যে আসছে তাকে শুধু দেখা। সে নিরুপায় মানুষের মত যত দ্রুত পাারছে নৌকা কেবল টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। আর একটু সময় ওরা যদি তখন মাঠ ভেঙে নেমে আসে তবে মোকাবিলা করা যাবে। ততক্ষণে সে ভৈরবতলা ঘাটে আমিনুলকে পেয়ে যাবে। আমিনুলের উপর নৌকার ভার দিয়ে সে মাঠের ভিতর একেবারে লায়িং পোজিসন—একটা ক্রুদ্ধ বাঘের মত সে গর্জে উঠবে। হট্। তারপর বন্দুকের নল থেকে এক দুই ফোঁটায় ঘাসের উপর বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরবে। সে দু-হাত পা ছড়িয়ে দুই নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় শুয়ে তার প্রিয় আজন্মকালের কবিতা আবৃত্তি করবে, সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি। সে শুয়ে থাকবে তখন, পড়ে থাকবে মাটির কাছাকাছি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
    Next Article মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }