Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1863 Mins Read0

    ঈশ্বরের বাগান – ৬৭

    ।। সাতষট্টি ॥

    বাস থেকে নেমেই অতীশ কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল।

    বাসটা ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে। ক’দিন রোদ ওঠায় রাস্তার কাদা শুকিয়ে গেছে। পাকা সড়কের দু’পাশে সব সবুজ ঘাস মরে গেছে। বাস চলে গেলেই ধুলো। অন্য সময় হলে অতীশ নাকে রুমাল চাপা দিত। কিন্তু এখন ভিতরে এক আশ্চর্য কৌতূহল অথবা বলা যায় মায়া তাকে কেমন মুগ্ধ করে রেখেছে। সে হাতে লেদার এটাচিটা নিয়ে চুপচাপ হাঁটছে। নিজের গাঁয়ে ফিরে এসেছে। অথচ কিছুই চিনতে পারছে না। কেমন সব বদলে গেছে।

    সে ঠিক এ-ভাবে তার নিজের দেশে ফিরে আসতে পারবে কোনদিন ভাবে নি। ওর ভারী ভাল লাগছে হাঁটতে। সে সোজা শহর থেকে বাসে এখানে চলে এসেছে। ওর পকেটে চিঠিটা ঠিক তেমনি ভাঁজ করা। চিঠিটা মঞ্জুর চিঠি। লিখছে, এখন তো আর আসতে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। সোজা প্লেনে ঢাকায়। তারপর বাসে অথবা ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ। সেখানে থেকে হয়তো ভাববে, নৌকা ছাড়া গতি কি! না সে-সব একেবারে বদলে গেছে। আগে শহরে পৌঁছাতে আট-ন ঘণ্টা লাগত। এখন বাসে উঠলে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। দেখতে দেশটা আর তোমার সত্যি আগের মতো নেই। তারপরই যেন লেখার কথা ছিল—তোমাদের মঞ্জুও ঠিক আগের মতো নেই। এত বছর পরে কেউ আগের মতো থাকতে পারে না। অবশ্য সে এ-সব লেখে নি। দেশটা আগের মতো নেই বলতে সে বলতে চেয়েছে বুঝি সব পাল্টে যায়। শরীর মন এবং যে সব ইচ্ছারা শরীরে খেলা করে বেড়ায় তারা পর্যন্ত।

    সূর্য এখন ফাওসার বটগাছটার মাথায়। আর চারপাশে ধানখেত। সড়কের দু’ধারে জল। দূরে দূরে সব গ্রাম। সে গ্রামগুলো ঠিক চিনতে পারে না যেন। কেমন সত্যি বদলে গেছে। এ-সব গ্রামে কোঠা বাড়ি ছিল বলে তার জানা নেই। এ-অঞ্চলে কেবল দুটো বাড়ি ছিল ইট কাঠের। অন্য সব বাড়ি টিনের দোচালা, চৌচালা, দাওয়া মাটির, নিকানো উঠোন, কোণায় শেফালী গাছ, এবং অতীশের মনে হল, শরৎকালে এলেই গাছে গাছে শেফালী ফুল ফোটে।

    শৈশবের ভেতর ফিরে এলে সব কিছুই মনোরম লাগে। মঞ্জু ওকে কোন খবরই দেয় নি। এই যে ন’মাসের ওপর নির্বাসনের দেশ ছিল এটা, এখানে নিষ্ঠুর সব গণহত্যা এবং কঠিন সব ইতিহাস তৈরী করে গেছে মানুষেরা, মঞ্জু তার সম্পর্কে কিছু লেখে নি। যেন এক আশ্বিনের ভোরে ঘুম থেকে উঠে মঞ্জু ওদের অর্জুন গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে সোনা নামক এক বালকের জন্য ভীষণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল, তার-পরই চিঠি —তুমি এস। আসা চাই। আজ বিশ একুশ বছর পর তোমার ঠিকানা পেয়ে, হাতের কাছে বাঁচার মতো আবার একটা প্রেরণা পেয়েছি। তুমি এস। তোমাকে আমার খুব দরকার।

    এমন ভাবে কখনও মঞ্জু তাকে চিঠি লিখবে সে কল্পনাও করতে পারে নি। এমন কি মঞ্জুর কথাও ফতিমা মনে করিয়ে না দিলে জীবনে যেন আর তাকে মনে করতে পারত না। আসলে সে যেন মঞ্জু নামে এক মেয়ের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। তার মনেই ছিল না, মঞ্জু নামে এক মেয়ে সকালের রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে ভীষণ স্নিগ্ধ দেখাতো। কতদিন সে সেই মেয়েটার সঙ্গে রোদে রোদে টোটো করে ঘুরে বেড়িয়েছে। কতদিন ওদের লাল রঙের ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিলে সে আর মঞ্জু তার পেছনে পেছনে ছুটে গেছে গোপাটে। এ-ভাবে মঞ্জু তাকে নিয়ে এই যে গ্রাম মাঠ এবং সব শেষে ফাওসার বিল, নির্জন বকুল গাছের ছায়ায় চুপচাপ বসে থাকত। সে কেমন মুগ্ধ বিশ্বাসে সব কিছু দেখতে দেখতে এখন এগুচ্ছে।

    বর্ষা পার হয়ে শরৎ আসছে। ক’দিন রোদ ওঠায় মাঠঘাট শুকনো। চারপাণে সবুজের সমারোহ। বাতাস দিচ্ছে সামান্য। হাওয়ায় শাপলা শালুকের পাতা কাঁপছে। সড়কের দু’পাশে জল। জল টলটল করছে। জলের নীচে শ্যাওলা, মাছ সব দেখা যায়—সে যেতে যেতে এসবই দেখছিল। জলের নীচে মাছ দেখলেই সে মনে করতে পারে—এ-সময় পুঁটি মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে জলের নীচে ঘুরে বেড়ায়। রোদ উঠলে ওরা শ্যাওলা খায় জলের নীচে এবং নানা ভাবে চিৎ হয়ে কাত হয়ে রুপোলি খেলা জলের নীচে আরম্ভ করে দিলে বড় মনোরম। সে ফতিমা মঞ্জু কতদিন কত বর্ষায়, কত বিকেলে হেঁটে কোথাও না কোথাও এ-সব মাছের খোঁজে থাকত। এ-সব মাছের খেলা দেখার জন্য চুপি চুপি বের হয়ে পড়ত। কখনও আবু শোভা মঞ্জুকে নিয়ে জ্যাঠামশাইকে খুঁজতে বের হত।

    রাস্তাটা বড় শিমুল গাছটার নীচে এসেই বাঁক নিয়েছে। এটা ছিল নরেন দাসের বাড়ি। ওদের বাড়ির ওপর দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। মাঠের সেই শ্যাওরা গাছটাও নেই—সড়ক তৈরী করতে গিয়ে বোধ হয় কাটা পড়েছে। সেকালে গাছটার ডালে লীগের ইস্তাহার ঝুলত। কেউ নেই বাড়িতে কেবল আছে সেই কৎবেল গাছটা। যেটা থেকে একটা কৎবেল চুরি করে নিলে মালতি পিসি দিন রাত গাছটার নীচে বসে গালাগাল দিত। সর্বনাস হবে। বংশ লোপ পাবে এমন কথা বলত। এখানে এসে দাঁড়াতেই অতীশের সেই মুখ প্রথম ভেসে উঠল। যেন সেই আগের দিনগুলোর মতো মালতি পিসি চুপচাপ গাছটার নীচে বসে আছে, হ্যারে, সোনা না? এলি! কতদিন তোরা এদিকে আসিনি।

    সোনা থামল। দু’ তিনজন মানুষ, বোধহয় ওরা পাট কেটে মাঠ থেকে উঠে এসেছে। পরনে গামছা। সারা শরীর সাদা হয়ে গেছে জলে থাকায়। কোথাও থেকে ঘাস কেটে এনেছে আঁটি আঁটি। নিখোঁজ মালতি পিসি বাড়ি ফিরে এসে কেমন পাগল হয়ে গেছিল। অতীশের কতদিন পরে তা মনে পড়ছে। ঘাসের আঁটি থেকে জল পড়ছে গড়িয়ে গড়িয়ে। সারা শরীর ভেজা। ওরা ওকে দেখে বলল, কর্তা কার খোঁজে আছেন?

    অতীশ বলল, আমি সেনেদের বাড়ি যান।

    ওরা বলল, সোজা চইলা যান। সড়কের পাশেই লাল ইটের বাড়ি।

    ওরা কিছুক্ষণ অতীশের দিকে তাকিয়ে থাকল। চেনার চেষ্টা করছে। কিছু না জিজ্ঞসা করে চিনতে পারে কিনা। আজকাল এটা হচ্ছে। গ্রামে আবার সব পুরানো মানুষেরা ঘুরে যাচ্ছে। দু’চার দিন থাকছে। তারপর বিষয়-আশয়ের খবর নিয়ে অথবা বন্দোবস্ত দিয়ে চলে যাচ্ছে। ওরা দেখে দেখে চিনতে পারল না, তখন যেন না বলে পারল না, সেনবাবু আপনের কে হয়?

    —আমি সোনা। ধনঠাকুরের মেজ ছেলে।

    —অঃ আপনে ঠাকুরবাড়ির মানুষ। তা যান। কতদিন পর আইলেন। আপনেগ দ্যাখলে কত কথা মনে হয়। তারপর ওরা দাঁড়াল না। হন হন করে চলে যাচ্ছে। এ-ভাবে অতীশ যেতে যেতে দুটো একটা কথা, যা না বললে নয়, বলে যাচ্ছে। সে যেন চারপাশটা দেখতে দেখতে যাচ্ছে। সে পালবাড়ি উঠে যাবার মুখে দেখল পাকা রাস্তাটা ওদের বাড়ির ঠিক দক্ষিণ দিয়ে চলে গেছে। ওখানে ছিল একটা বড় খালের মতো, এবং কত ঝোপ আর বড় বড় কড়ই গাছ। আর সব নানা রঙের পাখি। তিন চারটে গাব গাছ। গাব গাছের নীচে সব সময় অন্ধকার থাকত। ওখানে একবার একটা ভূত দেখে শশী মালোর মেজবৌ ভয় পেয়েছিল। ভয় পেলে যা হয়, রাতে বিরেতে ওরা লণ্ঠন হাতে খুঁজতে বের হত, এবং অবাক হত, ওরা এসে দেখতে পেত, মেজবৌ গাছগুলির নীচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।

    এবং এ-ভাবে সারাটা আকাশ আর তার নীচের গাছপালা সবই কেমন অতীশের কাছে এখন নতুন। অনেক সময় সে ঠিকই করতে পারছে না, এখানে আগে কি ছিল। মাত্র বিশ বাইশ বছরে এমন হয়ে যায়!

    একটা বড় পাকারাস্তা গ্রামের ওপর দিয়ে চলে গেলে এমন নতুন হয়ে যায় সবকিছু, তার যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। শশী মালোর মেজবৌ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, গাছের নীচে প্রতিমা নিরঞ্জনের মতো পড়ে আছে, তার এমনই কেবল বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।

    অতীশ দেখল ওদের পুকুর পাড়ে এসেই বাঁক নিয়েছে রাস্তাটা। অজুন গাছটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। কেন যে গাছটায় সে হাত বুলালো তাও বুঝতে পারছে না। দত্তদের আম বাগানের ভিতর দিয়ে রাস্তাটা বড় মাঠের দিকে নেমে গেছে। এই বাগান পার হলেই সেনেদের ছাড়াবাড়ি। পুকুর পাড়ে তাদের বড় শিমুল গাছ। সে কেমন ভেতরে ভেতরে ভীষণ আবেগ প্রবণ হয়ে উঠেছে! এমন একটা নির্জন পৃথিবী এখনও আছে। ঠাকুরবাড়ির চিহ্ন বলতে কিছু নেই। কোনও বাড়ির উঠোনে বেগুনের চাষ। এবং ভুতুড়ে ব্যাপার যেন। এমন একটা গ্রামে মঞ্জু এখনও বেঁচে আছে ভাবতেই ওর কেমন ভয় করতে থাকল ভেতরে।

    কারণ সেতো এ-গ্রামে আসার আগে ভাবতেই পারে নি—এ-ভাবে গ্রামের দৃশ্য পাল্টে গেছে। সে বুঝি ভেবেছিল সে যাচ্ছে, তেমনি সেই গ্রামে—সেখানে হলুদ রঙের লটকন গাছটি না জানি এত দিনে কত বড় হয়েছে! অথচ অতীশ দেখল তার প্রিয় লটকন গাছের কোনও চিহ্ন নেই। সে এখানে তার আবেগ দমন করতে পারল না। চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। বড় বড় টিনের ঘর ছিল, চারপাশে চারটা। ইঁদারা ছিল। সেটা এখনও আছে। তবে জল ব্যবহারের অযোগ্য। কয়েতবেল গাছটা আরও বড় হয়েছে। ঠাকুরঘরের পাশটায় রঙনের ঝাড় ছিল। তাও নেই। ঠাকুরঘরের চিহ্ন সে খুঁজে পেল না।

    আর চারপাশটা খাঁ খাঁ করছে। সে কেমন শুকনো মুখে সব কিছু দেখতে থাকল। সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই যেন টের পায় তাকে বড় জেঠিমা বড় ঘর থেকে ডাকছে, সোনা বৃষ্টিতে ভিজতে নেই। আয় চলে আয়। সে দেখতে পায় তার অন্ধ ঠাকুরদা পুকুরপাড়ে থাবড়ে থাবড়ে মাটি ঠিক করছে। উঠোনের সব মাটি বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে নিলে থাকে কি!

    মাটির জন্য প্রাণের কি ব্যাকুলতা। ছোট ছোট বাঁশ পেতে আপ্রাণ খোঁটা পুঁতে দিচ্ছেন তিনি। এ-সব ব্যাপারে তাঁর চাকর-বাকরের ওপর এতটুকু ভরসা নেই। অতীশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখতে পাচ্ছিল।

    মাথার ওপর সেই আকাশ, দক্ষিণে সেই খালগাড়ে তেমনি তক্ষক কি কিছু একটা হবে ডেকে যাচ্ছে। অনবরত। সে চোখ বুজলে, রাতের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে তার শব্দ শুনতে পেত, এখন যেন চোখ বুজলে তেমনি সব কীট-পতঙ্গের আওয়াজ শুনতে পাবে। যেমন বৃষ্টি হলে এক ভেজা সবুজের গন্ধ এসে নাকে লাগত, এখনও মনে হয় তেমনি বৃষ্টি হলেই গন্ধটা তার নাকে এসে লাগবে। এ- ভাবে কেমন এক দূরাগত স্মৃতি তাকে ক্রমে শিথিল করে ফেলছে।

    অথচ আশ্চর্য নীবরতা। গাছগুলো কিছু কিছু কারা কেটে নিয়ে গেছে। বাড়িটা দেখা শোনা করার কেউ শেষ পর্যন্ত ছিল না বোধ হয়। চন্দরাও শেষ পর্যন্ত চলে এসেছিল সীমানা পার হয়ে। এ-ভাবে এখানে একটা বাড়ি, কি জাঁকজমকই না ছিল বাড়িটার, এবং উঠোনে মানুষের প্রায় মিছিল বলা চলে, সব স্মৃতিতে দেখতে পেল। এখন শুধু বড় বড় গাছ মাথার ওপর। লতাপাতায় গাছগুলো সব বন- জঙ্গল হয়ে গেছে। তার নীচে অতীশ এক প্রাচীনতার ভেতর ফিরে এসে দুঃখী সোনা হয়ে গেছে। পাগল জ্যাঠামশাই যদি ফিরেও আসেন তিনি হয়তো কোথাও এর মধ্যে বৃক্ষ হয়ে আছেন।

    আর কিছুদূর হেঁটে গেলেই সেনেদের বাড়ি। মঞ্জু সেন। মঞ্জুর বয়স তখন আর কত! সেও তেমনি বয়সের। এখন এমন একটা ছাড়াবাড়ির মতো রুক্ষ, দুঃখী মঞ্জুকে যদি সে দেখতে পায় তবে ভীষণ কষ্টের ভেতর পড়ে যাবে। ফতিমার একটাই অভিযোগ ছিল, আপনি বইয়ে নিজের গাঁয়ের কথা এত লিখলেন। মঞ্জুর কথা কোথাও খুঁজে পেলাম না।

    সোনা আসলে আর এগুতে সাহস পাচ্ছে না। শুধু রোদের ছায়া ওর চারপাশে জাফরি কাটা আকাশের মতো। সে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। গাছ লতা পাতা ওর শরীর থেকে সরে সরে যাচ্ছে। কেমন যেন সে কোনও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ভেতরে ঢুকে গিয়ে আর বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। অথবা বের হতে চাইছে না। কারণ আর কিছু ইট কাঠ তুলে ফেললেই এক সুন্দরী কিশোরীর কঙ্কাল বের হয়ে আসবে। সে একটু এগোতে গিয়ে কেমন থমকে দাঁড়াল। সত্যি এত বড় উপন্যাসে মঞ্জুর কেন জায়গা হল না!

    না, সে আর বেশি ভেতরে ঢুকতে সাহস পেল না। ওর ইচ্ছে ছিল বাড়ির রান্নাঘরটা পর্যন্ত সে যাবে। কিন্তু ঠিক উঠোনের ওপরই এত বন-জঙ্গল যে তার ভেতরে যাওয়া কঠিন। রান্নাঘরের পাশে বড় একটা জামরুল গাছ ছিল। গাছটা বেঁচে আছে না নেই দেখার বড় ইচ্ছে। অথচ সে যেতেও পারছে না। সেই যে থমকে দাঁড়িয়ে গেল আর নড়তে পারছে না। কামরাঙ্গা গাছটা অবশ্য জঙ্গলের মধ্যে সে দেখতে পেল। মনে হল তখনই কেউ যেন বন-জঙ্গলের গভীরে ছায়া ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    আসলে এটা মানুষের ছায়া, না অন্য কিছু সে বুঝতে পারছে না। এই নির্জন পরিত্যক্ত বাসভূমিতে সে একা। পাশাপাশি বাড়িগুলোতে কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। কোনও ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে না। কেবল আগাছা আর জঙ্গল। অথচ এরই ভেতর সে দেখতে পেল মানুষের চলার পথ। কেউ যেন এ-সব পথে কোথাও যায় আসে। ভিতরে বন-জঙ্গলের অনেক গভীরে সাদা মোমের মতো রঙের এক বালিকা কখনও দেখা যায়, আবার দেখা যায় না, গাছপাতার আড়ালে ঢেকে যায়—ওর সঙ্গে কেউ লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে। অনেকক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকলে যা হয়—একটা ঝিলিমিলি ভাব, যেন হাওয়ায় মিলে মিশে গেল। বন-জঙ্গলের ভেতরে আশ্চর্য সুন্দর এক বালিকার ছবি হারিয়ে গেলে তার মনে হল সে মরীচিকা প্রায় কিছু দেখে ফেলেছে।

    কারণ সে ভেবে ফেলেছে, রোদ বন-জঙ্গলের ভেতরে লুকোচুরি খেলে বেড়ালে এমন হতে পারে। সামান্য হাওয়ায় পাতা নড়ছে। রোদ পিছলে যাচ্ছে গাছের পাতা থেকে, যেন একটা সাদা খরগোস লাফিয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর চোখের ওপর ঝিলিমিলি রোদ আশ্চর্য মায়াজালে ভরা। সে সারাটা পথ মঞ্জুর কথা ভেবেছে। মঞ্জু এখন উত্তর ত্রিশের যুবতী। সে মঞ্জুকে ফ্রক প্যাণ্ট গরতে দেখে গেছে। তারপর সে আর কিছু জানে না।

    অতীশ আর দাঁড়াল না। সে হাতের ব্যাগটা ফের হাতে তুলে নিল।

    বরং সে ভাবল, এসব জায়গা সে মঞ্জুকে নিয়ে দেখতে আসবে। মঞ্জু যেহেতু এখানে এখনও রয়েছে সে সব খবরই ওকে দিতে পারবে। এবং জামরুল গাছটা এখনও বেঁচে আছে কিনা সে ঠিক বলতে পারবে। কারণ শীতের সময়ে অথবা বসন্ত সমাগমে এখানে তেমন বন-জঙ্গল থাকার কথা নয়। এখানে অনায়াসে মানুষেরা চলে আসতে পারে। এখনও যাওয়া যে না যায়, তা না, তবু সে শহরের মানুষ, সামান্য বন-জঙ্গলেই সে কেমন ভয় পেয়ে যায়!

    আর আশ্চর্য সে এ-সব বন-জঙ্গলে শৈশবে ঘুরে বেড়াতে না পারলে তার ভীষণ খারাপ লাগত। জামরুল গাছটায় সাদা ফল। ফলের ভারে গাছটার ডাল নুয়ে পড়ত। গাছটার নীচে খৈ-এর মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত জামরুল। প্রায় তুষার পাতের মতো মনে হত। খণ্ড খণ্ড বরফের টুকরো গাছের নীচে সবুজ ঘাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। তখন ছিল তাদের কে কত তুলে নিবি আয়। ওরা কোঁচড় ভরে জামরুল তুলে আনত। গাছটার জন্য অতীশের বড় মায়া ছিল।

    মায়া ছিল সব কিছুর জন্য। চারপাশে তাকালেই সে তা টের পায়। টের পায় চুপ-চাপ হেঁটে গেলে, সে যেন আর হাঁটছে না। ছোট সোনা এখন তার চারপাশে দৌড়াচ্ছে।

    তার এ-ভাবে বেশ লাগছিল হেঁটে যেতে! ঐতো সেই ছাড়াবাড়ি। ওখানে কবিরাজদার ঘোড়া বাঁধা আছে। যেন সেই ঘোড়াটা।

    সে বিশ্বাস করতে পারছে না। চারপাশের সব বাড়িগুলো যখন ছাড়াবাড়ি, তখন এখানে পুরানো দৃশ্য চোখে পড়ায় সে ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেল।

    অতীশ এবার চোখ কচলাল। আসলে লাল রঙের ঘোড়াটা তাকে ছেলেবেলার মতো এত বেশি সারাটা পথ তাড়না করেছে যে সে এখন সত্যি সত্যি তেমনি চোখের ভুলে একটা লাল রঙের ঘোড়া দেখে ফেলছে নাতো! লাল রঙের ঘোড়াটার কথাও ভুলে গেছিল।

    না, ঘোড়াটা চোখের ভুল নয়। বেশ পা ছুঁড়ছে, লেজ নাড়ছে। ঘাস খাচ্ছে। পা ছুঁড়লে, লেজ নাড়লে, ঘাস খেলে ঘোড়ার ছবি মিথ্যা হয় না। সে সত্যি সত্যি যখন বুঝতে পারল, না ওটা লাল রঙেরই ঘোড়া এবং তেমনি সেই বড় অর্জুন গাছ, গাছের পাশে পাকা সড়ক, এখন বর্ষাকাল বলে বাড়িটার চারপাশে জল, শাপলা শালুকের ফুল, জল ফটিক জলের মতো। সে নিবিষ্ট মনে এসব দেখতে দেখতে কখন যে লাল রঙের ঘোড়ার ছবি তার চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    চোখের সামনে সেই লাল ইটের বাড়ি। বাড়ির সামনে লন সবুজ ঘাসের। ডান পাশে ছোট্ট টিনকাঠের ঘর। ঘরের দেওয়ালে ডাকবাক্স, বাঁদিকে ডিসপেনসারি। সেনবাবুর কবিরাজির জন্য বড় বড় মাটির জার। আশে-পাশে ডাঁই করা গুল্মলতা, ওষুধ তৈরির জন্য উদখল –কি বিশালকায় সব পাথরের উদখল বারান্দায়, ভেতরে কাঁচের আলমারি বড় বড়। ছোট ছোট শিশিতে নানারকম লাল নীল রঙের বড়ি। একজন বৃদ্ধ মানুষ চশমা কানে বেঁধে জানালা দিয়ে ওকে দেখছে।

    সব ঠিকঠাক আছে। এতগুলো বাড়িতে যখন পরিত্যক্ত ছবি—তখন এ বাড়ি হুবহু এখনও আগের মতো আছে দেখে অতীশের মনে হল, মঞ্জু হয়তো এক্ষুনি দরজা খুলে ছুটে আসবে। আরে তুমি। এস এস। রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি ১ো? কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে এক বৃদ্ধের মুখ। মুখে কঠিন রেখা। মুখ দেখলেই মনে হয় নানাভাবে কঠিন সংশয়ে ভুগছেন। বৃদ্ধের গলায় খুব জোর। তিনি বললেন, কারে চান?

    —মঞ্জু আছে?

    —অঃ মঞ্জুরে চান। তা আসেন। ভিতরে বসেন। আমি ভিতরে খবরটা দিয়া আসি। মানুষটা পরেছে খোপকাটা লুঙ্গি। পা খালি। একটা ছেঁড়া হাফশার্ট গায়ে। জামা ছেঁড়া পরলেও মানুষটা খুব খবরদারি করতে জানে।

    অতীশ ভেতরে ঢুকে দেখল, একটা বড় তক্তপোশ। পাটি পাতা। পাশে ছোট একটা উদখল। এই উদখলে ওষুধ ঘষে ঘষে মিহি করছিলেন তিনি। অতীশকে দেখেই জানালায় যে উঁকি দিয়েছিলেন তাও বোঝা যায়। যেন খুব সতর্ক নজর চারপাশে। ওঁর নজর এড়িয়ে কেউ ঢুকতে পারে এ বাড়িতে এমন আশা করা ঠিক না। তারপরই মানুষ সমান উঁচু সেই মাটির বোয়েম। এ-সব বোয়েমে আগে অতীশ গাদা গাদা ভাস্কর লবণ রাখতে দেখেছে। কবিরাজ দাদাকে দেখলেই অতীশ বলত, আমারে ভাস্কর লবণ দিবেন। খুব খাইছি। প্যাটটা কি উচা দ্যাখেন।

    কবিরাজ দাদা এক পুরিয়া ভাস্কর লবণ দিতেন। দাদা না থাকলে সূর্য থাকত। যেন এই ডিসপেনসারি, বিশেষ করে ভাস্কর লবণের জারগুলি ছিল ওদের জন্য। সে তখন ছোট। ডিসপেনসারিতে ঢুকে দেখেছে কেউ নেই। এত উঁচু বোয়েম যে সে নাগাল পর্যন্ত পায় না। অথচ কুলের সময় সেটা! ভাস্কর লবণ দিয়ে কুল খেতে বড় ভালো লাগে। দাদা থাকলে পেট দেখিয়ে, সূর্য থাকলে হাত পেতে, আর কেউ না থাকলে সিঁড়ি লাগিয়ে মাথা সমান উঁচু বোয়েম থেকে নুন নিয়ে সে যেত পুবের বাড়ি। ওরা অর্থাৎ ফুলু টুলু রসো আর শোভা সবাই গাছের নীচে বসে কুল খেত। মঞ্জু আসত না। মঞ্জু ছিল তখন শহরের মেয়ে। সে আসত পুজোর ছুটিতে, গ্রীষ্মের ছুটিতে। সোনাকে ওদের সঙ্গে মিশতে দেখলেই কেন জানি তখন মঞ্জু ভীষণ রাগ করত। ফতিমার সঙ্গেও।

    তিনি ফিরে এসে বললেন, বসেন, বসেন, মঞ্জু ছান করতাছে। আপনারে বসতে বলছে।

    অতীশ যেন এমনটা আশা করেনি। ওর নাম শুনেই কথা ছিল যেন মঞ্জু ছুটে আসবে। মঞ্জুকে

    দেখার জন্য সে কেমন ব্যাকুলতা বোধ করল। অমন সুন্দর যার হাত-পা, চোখ, গায়ের রঙ, চোখ তুলে চাইলে কেবল যার হাসি ঝরে পড়ত, ঘাস মাড়িয়ে গেলে মনে হত যার পা ভীষণ অহংকারী, সে এখন যে আসবে না, একটু যে সে দেরি করবেই এটা তার বোঝা উচিত। সুতরাং সে আলাপ করার মতো যখন কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছে না তখনই তিনি প্রশ্ন করলেন, আপনে ধনঠাকুরের পোলা না?

    অতীশ বলল, হ্যাঁ।

    —দ্যাখাই চিনছি। কর্তা বাইচা আছে?

    —আছেন।

    —ঠাইরেন?

    —আছেন। বলে অতীশ হাসল।—আপনাকে আমি চিনতে পারলাম না।

    —চিনতে পারলেন না?

    —না।

    —একবার আপনাগ হাঁস চুরি গেল মনে আছে?

    —আছে।

    —পাড়ায় তখন হাঁস-মুরগি কারো থাকত না।

    —হ্যাঁ, মনে আছে।

    —পাঁঠার বাচ্চা যত সব চুরি গ্যাল।

    অতীশ বলল, সে তো তারপর সব খোঁজ পাওয়া গেল।

    —কি কইরা পাইলেন। কেডা তারে ধরল?

    অতীশ এবার ঠিক হয়ে বসল। মনে পড়ছে। তবে এই মানুষই কি সেই ভয়াবহ মানুষটি। এতটুকু সে মিল খুঁজে পাচ্ছে না। তখন ওঁর চুল ছিল খাটো। অজুত হস্তীর বল। মালতি পিসিকে নৌকায় তুলে কোথায় নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন!

    তিনি বললেন, বড় বড় চোখে কি দ্যাখতাছেন?

    —কিছু না।

    —না ঠিক দ্যাখতেছেন। ভাবছেন, মনে করতে পারেন কিনা। আপনের পাগল জ্যাঠারে একবার খুঁজতে বাইর হই নাই বইলা বাপ আমারে নিমকহারাম কইছিল, জানেন। বলেই তিনি আবার জানালায় ডাক দিলেন—কেডা?

    —আমি রোফ্

    —তা তুমি এমন অবেলায় ক্যান?

    —একটু কাশির ওষুধ দিবা।

    —বস বাইরে।

    —আলমারি খুলে গুনে গুনে কটা বড়ি বের করে দিলেন তিনি।

    —কৃষ্ণচতুর্মুখ দিলাম। তুলসী পাতার রস দিয়া খাইয়। মধু দিবা দুই ফোঁটা। তোমার যা কাশি চরণামৃত রস কাজে দিব না। ছাড়ে কিনা দ্যাখ। না হইলে বাসবলেহ নিয়া যাইবা। পয়সা কি আনছ দ্যাখি।

    রোফ্ পয়সা বের করলে কেমন ক্ষেপে গেল মানুষটা।—হারামজাদা চোট্টা, বেইমানি করার আর জায়গা পাওনা। পয়সা না দিয়া ওষুধ খাইবা! তুমিত মিঞা দ্যাখছি খানেগ চাইতেও হারাম আছ। বলে সে জোরজার করে ওষুধ আবার রোফের কাছ থেকে কেড়ে নিল।

    এমন একটা অবস্থায় অতীশ ভীষণ বিব্রত বোধ করল।

    রোফও দেবে না, আর এই মানুষটাও ছাড়বে না। শেষে এক টাকা বিশ পয়সা রফা হল। লোকটা গালাগাল দিতে দিতে চলে গেল। বলল, সেনবাবু বাইচা থাকলে তর মজাটা দেখাইতাম।

    অতীশ বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালে আবার গলা পেল। কি মনে হইতাছে? লোকটারে আপনে জানেন না, আপনের বাপ জ্যাঠারা চিনত। লোকের গলা কাইটা পয়সা। এখন শ্বাসকষ্ট। যারে কয় হাঁপানি। অরে আমি কিছুতেই বাসবলেহ দেই না। দিলেই শুয়োরের বাচ্ছা ভাল হইয়া যাইব। আর মানুষের ফের গলা কাটব।

    অতীশ কোনও জবাব দিচ্ছে না। কেমন সবই ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। কেবল এই বড় পাকা সড়কের পাশে বাড়িটা আছে বলে রক্ষা। মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। মঞ্জুদের বাড়ির সামনে লম্বা বারান্দা খোলা বারান্দা বলে ভেতরটা সব দেখা যায়। নীল রঙের সব জানালা। জানালাগুলো সব খোলা। পুকুরের দিকটায় বড় একটা ডালিমের গাছ ছিল। ওটা ছিল ওদের পুবের পুকুর। গাছটা ছিল পুকুরে নেমে যাবার পথে। মঞ্জুর মা আত্মহত্যা করেছিল। ডালিম গাছটার নীচে সে ভাসতে দেখেছিল। এসব কারণে সে এখন সব কিছুই কেমন যেন সন্দেহের চোখে দেখছে। এবং মানুষটার তখন আবার ডাকাডাকি। আস্তাবলের পাশে হাতির শুঁড়ের গাছ। বড় বড় পাতা। জায়গাটা বর্ষায় জঙ্গল হয়ে আছে।

    তিনি দু’পা ছড়িয়ে বসেছেন। মাঝখানে উদখল। তিনি দু’হাতে টেনে টেনে ওষুধ ঘষে যাচ্ছেন। তার একটানা শব্দ।—তা কলকাতায় এখন মাছ পাওয়া যায় কেমন?

    —পাওয়া যায়। তবে খুব দাম।

    —ক্যান এই যে শোনতাছি, বাংলাদেশের সব মাছ আপনারা খাইয়া ফ্যালতাছেন।

    —না না, কে বলছে! মাছ এখনও যায়নি।

    —কিন্তু মাইনসে যে কয়, আর মাছ খাইতে হইব না, সব মাছ ইণ্ডিয়ায় চালান! সবার কচু পোড়া খাইতে হইব কেবল।

    অতীশ কি জবাব দেবে ভেবে পেল না। এতক্ষণ মঞ্জুর চান করতে লাগে! সে বুঝতে পারল না আসলে মঞ্জু কোনও খবর পেয়েছে কিনা। খবর পেলে মঞ্জুর এত দেরি করার কথা না।

    আর তখনই মনে হল দরজা খুলে কেউ বের হয়ে আসছে। অতীশ দাঁড়িয়ে আছে ডিসপেনসারির বারান্দায়। বড় বড় কাঠের থাম। থামের আড়ালে সে দাঁড়িয়ে আছে। সে অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট টানছে। চশমার ভেতর চোখ দুটো তার ভীষণ চেনা দেখলেই টের পাওয়া যায়। মঞ্জু তারপর আর কত লম্বা হয়েছে। ওর চুল আর কত বড় হয়েছে! মঞ্জুর ছিল ভারি সুন্দর কোঁকড়ানো চুল। নীল রঙের সে ফিতা ব্যবহার করত। কখনও লাল রঙের। আর স্বভাব ছিল মঞ্জুর সাদা রঙের ফ্রক পরার ফ্রকের রঙ এমন ভাবে শরীরের সঙ্গে মিশে যেত যে বোঝাই যেত না মঞ্জু একটা ফ্ৰক গায়ে দিয়ে আছে। সে মঞ্জুকে কখনও শাড়ি পরতে দেখে নি। মঞ্জু শাড়ি পরলে কেমন না জানি দেখাবে!

    অতীশ দেখল, সেই অহংকারী পা। ঘাসের ওপর যেন পড়ছে না। কিছুটা হাওয়ায় ভেসে আসার মতো যেন। অনেক লম্বা হয়েছে। সাদা জমিনের শাড়ি। চওড়া নীল পাড়। গলায় পেণ্ডেন্ট হার। হাতে একগাছা করে পাতলা সোনার চুড়ি। চোখে চশমা। ভারি লেনসের। চোখ খুব খারাপ চশমার পুরো লেনস্ দেখে বোঝা যাচ্ছে। কপাল সাদা। সিঁথি শূন্য।

    মঞ্জু বলল, তুমি আসবে জানতাম।

    অতীশ প্রথম কথা বলতে পারল না। কেমন বিষণ্ণ চোখ মুখ মঞ্জুর। এবং চোখের নীচে কালো ছায়া যেন কত কাল থেকে এক দুঃখের ছবি নিয়ে জেগে আছে। অতীশ বলল, তুমি জানতে?

    —জানতাম—

    —ফতিমা ঠিকানা না দিলে তোমাকে আর চিঠি লেখাও হত না—

    —তবু জানতাম তুমি আসবে।

    অতীশ স্যুটকেসটা হাতে নিলে বলল, ওটা থাক। সে ডাকল, জব্বার চাচা ভেতরে স্যুটকেসটা পাঠিয়ে দিন।

    জব্বর চাচা বাইরে এসে বলল, মায় কিছু কইলেন?

    অতীশ বুঝতে পারল লোকটি কানে কম শোনে।

    —অতীশের স্যুটকেসটা পাঠিয়ে দিন ভেতরে। বলে মঞ্জু পেছনে তাকাল না। কি যে সুন্দর এক ছবি এখন ঘাসের ওপর ছড়িয়ে যাচ্ছে। এমন বর্ষার দিনে মঞ্জু একা। এই যে নির্জন পরিত্যক্ত সব বাসভূমি, তার ভেতর মঞ্জু কি ভাবে যে বেঁচে আছে, বেঁচে ছিল জানার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে অতীশের। মঞ্জুকে সে প্রশ্ন করল, কি করে বুঝলে আমি ঠিক আসব?

    মঞ্জু বারান্দায় উঠে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, জব্বার চাচা একটা কথা বলে থাকে প্রায়ই।

    —কি কথা?

    —মানুষ যেখানে জন্মায়, বড় হয়, বার বার সেখানে সে ফিরে আসার চেষ্টা করে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
    Next Article মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }