Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1863 Mins Read0

    ঈশ্বরের বাগান – ৭৪

    ।। চুয়াত্তর।

    মঞ্জু খাটে বসে বেশ জোর নিশ্বাস নিতে থাকল। সে বেশ ছুটে এ-ঘরে এসেছে। সে কি বুঝতে পেরেছিল অতীশ মঞ্জুকে শৈশবের কথা বলে বলে কিছু একটা করে ফেলবে! সেটা তার অবশ্য নানাভাবে খুব সহজ হয়ে গেছে। অতীশের কাছে তার ভীতির কিছু নেই। সে বরং আগের মতোই আছে। মঞ্জু ওর সামনে বসে এটা টের পেয়েছে।

    অথচ সে ছুটে এল কেন! আসলে মনে মনে সে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ভেতরে ভেতরে তার আশ্চর্য হাহাকার। প্রায় এক বছরের কাছাকাছি সে অবনীকে হারিয়েছে। অথচ শরীরের ভেতরে তেমনি কীটেরা ঘুরে বেড়ায়, রক্তে তাদের চলাফেরা সে টের পেলে বুঝতে পারে মাঝে মাঝে আকাঙ্খার অসহ্য জ্বালা শরীরে। সে তখন কেমন দিশেহারা হয়ে যায়, এবং মনে হয় সংসারে সে ভারি একা হয়ে গেল।

    মঞ্জু ঘরে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে রাখে। তার ভেতর মঞ্জুকে দেখতে ভীষণ একাকী লাগে। সে বসে আছে খাটে। দু’পা মেঝেতে ছড়ানো। শাড়ির আঁচল একটু আলগা। দেখলেই মনে হয় মঞ্জু ভীষণ কিছু ভাবছে। তার আর ঘুম আসবে না। অতীশের শরীর এখনও তেমনি সুন্দর। তার তেমনি চোখ না তুলে কথা বলার অভ্যাস। এত রাতে মঞ্জু তার ঘরে একা, সে ভীষণ তাতে অস্বস্তি বোধ করছিল। মঞ্জু তো অতীশের সমবয়সী, না, সে তার কিছু ছোট হবে! মা বলতেন সোনা তোর দু’বছরের বড়। সোনাকে তুই কাকা ডাকবি। মঞ্জু কেমন ঠোঁট বাঁকিয়ে এবার হাসল।

    .

    ঘুম ভেঙ্গে গেলে মঞ্জুর কিছু কাজ থাকে। যেমন দেখা, ও-ঘরে নীলুর শরীরে চাদর আছে কিনা, গরমে নীলু ঘামলে চাদরটা মঞ্জু ফেলে দেয়। পাখার হাওয়া কমিয়ে, সে নিজে নিচে দাঁড়িয়ে টের পেতে চেষ্টা করে এই হাওয়ায় নীলুর শীত করে কিনা। এবং মঞ্জু জানে, ওঘরে গেলেই সে কেয়াকে দেখতে পাবে কি নিরীহ মুখ মেয়েটার। স্কুল থেকে সবে পাশ করেছিল, এবং তাকে শহরে পাঠিয়ে দেবে বোর্ডিং-এ কথা ছিল। কেয়া কলেজে পড়বে এমন বাসনা জব্বার চাচার। ঘুমিয়ে থাকলে কেয়াকে আরও নিরীহ দেখায়। শিশু বয়সে কেয়া তার মাকে হারাবার পর থেকেই এখানে আছে।

    জব্বার চাচা তখন জেলে। জেল থেকে বের হয়ে এলে, তিনি বিবির কাছে যেতে সাহস পাননি। তিনি ছিলেন দাগি চোর, চোরের যা স্বভাব, জেল থেকে বের হয়ে এলেই আবার জেলে যাবার ইচ্ছে, কিন্তু সেবারে কি হল বাবার, বাবা বললেন, জব্বার তুই আমার এখানে থাকবি। খাবি। উদখলে ওষুধ বানাবি। জেলে যাবি না।

    —আমার বিবি কি খাবে?

    —তুই যা খাবি।

    —বাচ্চাটা?

    —বাচ্চাটাও তাই খাবে।

    —অষুধপত্র! বিবির হাত-পা ফোলা।

    —হারামজাদা! ওষুধপত্র নিয়ে তুই কবে পয়সা দিয়েছিস!

    আসলে জব্বার চাচার সঙ্গে বাবার কি একটা আঁতাত ছিল।

    শিশু বয়সে থেকে গেলে যা হয়, কেয়ার জন্য এ সংসারে প্রথম প্রথম বেশ ভিন্ন ব্যবস্থা ছিল। তার আলাদা ঘর, সে এ-সব ঘরে ঢুকতে সাহস পেত না। সে সব সময় বাইরের মানুষের মতো এ-বাড়িতে থাকত। কিন্তু অবনী কি বুঝেছিল, এটা বুঝি ঠিক না, কেয়াকে তো আর আলাদা করে ভাবা যায় না। সে বেশ আছে এ-বাড়িতে। নিজের মতো করে যখন আছে তাকে দূরে ঠেলে ফেলে দেয়া কেন।

    যেহেতু গ্রামটা ছিল নির্জন, জব্বার ছিল সমাজের বাইরের মানুষ তাই বোধ হয় বশির মিঞা কিংবা অন্য মাতব্বরদের পাশাপাশি গাঁয়ের তেমন মাথাব্যথা হয় নি। স্কুলে যাবার সময় কেয়া ছিল মঞ্জুর সঙ্গী। ওরা দু’জনে কথা বলতে বলতে চলে যেত এক মাইলের মতো রাস্তা। আবার ফিরে আসত। যতদিন রাস্তাটা পাকা হয়নি ততদিন এমনটা ছিল। কেয়াকে মঞ্জুর দরকারও ছিল। এমন মেয়ের পক্ষে একা বাড়ি থেকে এতটা পথ স্কুল করতে যাওয়া অসুবিধেই ছিল। বরং কেয়াই ছিল তখন তার নির্ভর করার মতো মেয়ে। বাবা মরে গেলে অবনী তো আর তেমন দাপট নিয়ে কবিরাজি করে যেতে পারেনি।

    এসব কথা মঞ্জুর মনে হচ্ছিল। কারণ সকাল হলেই অতীশ আবার সব খবরাখবর নিতে চাইবে। তার প্রত্যেকটা জবাব সোজাসুজি হওয়া চাই কারণ মঞ্জু এটা ভেবে থাকে সে অতীশের মতো মানুষের সঙ্গে কোনও ছলনা করতে পারবে না। আর ছলনা করার কি আছে! অবনী বেঁচে নেই ওর এমনিতে বোঝা উচিত ছিল। অবনী, যে তার স্বামী এটা অতীশ জানে কি না, সে জানত না। নানাভাবে দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার কথা। কেউ না কেউ খবর ওকে পৌঁছে দিয়েছে এমন ধারণা ছিল মঞ্জুর। অতীশ যে একেবারে অন্ধকারে ছিল, আর অতীশ যে মনে মনে এখন সেই টানে পড়েই চিঠি পাওয়া মাত্র ছুটে এসেছে সে সেটা বুঝতে পেরে খুবই বিস্মিত হয়েছিল। অতীশ একা, না সংসারী মানুষ!

    তার দ্বিধার শেষ ছিল না। চিঠি পেয়েই অতীশ ছুটে আসবে এটাও ছিল দুরাশা। সে এবার উঠে দাঁড়াল। দরজা পার হয়ে জানালায় দাঁড়ালে একটা বাঁধানো সিঁড়ি পুবের ঘাটে। অব্যবহারে ঘাটে শেওলা জমেছে। দুপাশে জঙ্গল। সেখানে একটা আলো জ্বালা থাকে। বেশ উজ্জ্বল। এতদিন সে জানালায় এসে দাঁড়াতে পর্যন্ত ভয় পেত। অন্ধকার দেখলেই সে দূরে সরে দাঁড়ায়। আজ অনেকদিন পর এখানে আলো জ্বলছে, চারপাশটা কি সুন্দর দেখাচ্ছে, দূরের আকাশটা পিটকিলা গাছের ভেতর দিয়ে দেখা যায়—এবং এমন যখন নিরিবিলি আকাশ তখন সে এত একা, আর সারাজীবন এ-ভাবে কেটে যাবে সে ভাবতে পারে না। সে কেন যে অতীশকে লিখেছে আসতে! ওর নিজেরই তো সংকোচ হবার কথা। অতীশ শৈশবে বলেছিল, মঞ্জু আমি বড় হলে তোমাকে বউ করব। তুমি রাজী।

    কাল ওর একটা কথাই হবে অতীশের সঙ্গে, মনে আছে সেই কথাটা। সে মুর্শেদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে। যদি মনে থাকে কথাটা তবে ওর ওপর প্রথম ভার—তুমি ওকে পৌঁছে দাও। কলকাতায় নিয়ে যাও, যেন সে তোমার নিজের কেউ। ইন্ডিয়া থেকে লোক প্রচুর আসছে। কড়াকড়ি নেই। ওকে তুমি অনায়াসে নিয়ে যেতে পার। সে নিরুপায়। বোকার মতো কাজটা করে সে ভেবে পাচ্ছে না ঠিক করেছে কি বেঠিক করেছে। কেন যে সে আমার জন্য নিজের জীবনে এমন একটা বিপদ ডেকে আনল!

    অতীশ, আমার আর ঘুম আসবে না। তোমার চোখ দেখে আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আমাকে ভুলে যাওনি। তুমি আমার সেই শৈশবের সোনাবাবু। তোমাকে আমি লুকিয়ে চা খাইয়েছিলাম। আজকে দেখার পর মনে হয়েছে, লুকিয়ে তুমি সব কিছু করতে পছন্দ কর।

    এই সেপ্টেম্বরের রাত্রিতে মঞ্জুর শীত শীত করছিল। সেপ্টেম্বরের এটা প্রথম সপ্তাহ। এখন এ- অঞ্চলে আর পুজো হয় না। সাত আট মাইল দূরে পানামের পোদ্দারেরা পূজা চালিয়ে যাচ্ছে। আগে ভুইঞা বাড়িতে পুজো হলে এটা মহালয়া টয়া হোত। তার এখন হিসেব পর্যন্ত নেই কবে মহালয়া

    তবে জব্বার চাচা সব মনে করিয়ে দেয়। ডিসপেনসারিতে একটা পাঁজি থাকে, সেটা দেখে যখনকার যা করার তিনি করেন। জব্বার চাচা এ-বাড়ির এতদিনের আচার অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাক চান না।

    মঞ্জুর সব ব্যাপারেই ছিল ভীষণ আলগা আলগা ভাব, অবনীর মৃত্যুর পর এটা আরও বেড়েছে। কিন্তু পরে যখন, মেজর সাবের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল মুর্শেদের তখন বোধহয় মনে হয়েছিল, এ-ভাবে বাঁচলে, তার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না! মঞ্জু জানালায় দাঁড়িয়ে মনে করতে পারল, প্রথম দিন প্রায় সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল। বাড়িতে তাকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল ভোর রাতের দিকে। নীলুর ঘুমের ভেতর সে গেছে, নীলু টের পায়নি, তার মা বাড়ি নেই। মাইল পাঁচেক দূরে কোম্পানি কমান্ডারের ওপর তার ভার। তাকে নিয়ে যাওয়া কারো কাছে, আবার রাত পোহাতে না পোহাতে পৌঁছে দেওয়া। সে বেশ চতুর, সেখানে কোথাও কেয়া আছে, থাকতে পারে এমন ধারণা। কেয়াকে মেরে ফেলতেও পারে। কেয়ার জন্য যত না, তার কষ্টের কথা ভেবে আরও বেশি, মেয়েটা তখনও এ-সবের কিছু জানে না, সে সংজ্ঞা হারিয়েছিল। আর মেয়েটা হয়ত মরেই যেতে পারে, মরে যাওয়া খারাপ না, সে নিজেও তা করলে পারত, কিন্তু আকাঙ্খার ভেতর আছে এক কঠিন কামনা, সে অবনীর মৃত্যুর পর পাঁচ-সাত মাসও যায়নি, ভেতরে ভেতরে কোনও সুপুরুষের জন্য তার ভীষণ লোলুপতা ছিল—তাকে সেখানে নিয়ে গেলে সে বেশ চতুর রমণীর মতো মেজরকে নিজের মানুষ করে এক আশ্চর্য গোপনীয়তা ভেঙ্গে কেয়াকে পরে ফিরিয়ে এনেছিল। এ-ব্যাপারে মুর্শেদ ছিল তার একান্ত সহায়। মুর্শেদের ঋণ সে কিছুতেই শোধ করতে পারবে না। নিজের কথা সে এখন যত না ভাবে—এই মানুষ মুর্শেদের জন্য এখন তার বেশি ভাবনা।—সে জানালা থেকে সরে এসে ভাবল, কাল অতীশকে এই অভিযানের কথা হুবহু সে বলে যাবে, বলে যাবে, না, মুক্তি যুদ্ধের দিনগুলিতে যা সে লিখে রেখেছিল প্রতিদিন, সেটা ওর কাছে ফেলে দেবে। সে তো মেয়ে, সে তো সব তাকে বলতে পারবে না। তারপর আবার একদিন খোঁজ হয়েছিল কেয়ার। সে অন্য সুবাদার মেজর। মুর্শেদকে বলেছিল, সে নেই, আমি আছি।

    মঞ্জুর সকালবেলা ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে গেল। সে উঠে দেখল, বারান্দায় অতীশ বসে রয়েছে। মঞ্জু যে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে লক্ষ্য করছে না। সামনে ঘাসের লন, বার চাচা সেই নিয়মিত ঘোড়া বের করে নিয়ে যাচ্ছে। জব্বার চাচার এখন অনেক কাজ। অতীশ জব্বার চাচার সঙ্গে কথা বলছিল। জব্বার চাচা এখন এ-দেশে মাছ আর দুধের কি যে আকাল তাই বোঝাচ্ছেন অতীশকে।—আর সে কাল নাই। এমন বলছেন। জব্বার চাচা তারপর ডাকঘরের তালা খুলে দিলো। মাস্টার সাহেব এখুনি এসে যাবেন। তার আগে মেলব্যাগ নিয়ে আসে ইসমাইল। দরজা খোলা ন। পেলে সে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। ডাকঘরের ভেতরে পার্টিশান করা। মাস্টার সাহেব এসে পার্টিশানের দরজা খোলেন। এ-পাশে তখন ইসমাইল। সে একটা টুলে বসে থাকে। যতক্ষণ মাস্টার সাহেব না ডাকবে ততক্ষণ সে এভাবে বসে থাকবে। বোধহয় অতীশ সবই দেখছিল বসে। অথবা সে হয়তো ভাবছে সেই পুরোনো ট্রেডিশানই চলছে। যেমন চশমাটা খুলে পোস্টমাস্টার দেরাজ থেকে গুনে গুনে সিল বের করে দিতেন এখনও সে দেখতে পাচ্ছে তেমনি আতাউর সাহেব খুলে দিচ্ছেন সিল, রেজিস্টার খাতা, স্ট্যাম্পের হিসাব। টাকার হিসাব যেমন যেভাবে হরেন মাস্টার করত, তিনিও তাই করে যাচ্ছেন।

    অতীশ সিগারেট খাচ্ছিল। এখন শরতের সকাল বোঝাই যায়। শেফালী গাছটা আরও বড় হয়েছে। ডাকঘরের পেছনে গাছটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। সকালে ফুল তোলার কথা মনে হলে নিশ্চয়ই অতীশ গাছটার নিচে কিভাবে ফুল তোলার জন্য ছুটে আসত মনে করতে পারবে। আসলে সে কি আর তেমন আছে! তার কি এসব এখন আর ভাল লাগবে! সে তো এখন এখান থেকে চলে যেতে পারলে বাঁচে! কেন যে চিঠি পেয়ে মরতে ছুটে এল। নির্মলা বলেছে, মঞ্জু আবার কে! তার নামতো শুনিনি। তোমার দেশের মেয়ে। ওদেশে পড়ে আছে কেন! কি মেয়েরে বাবা! ওদেশে মানুষ থাকে! মানুষ বলতে নির্মলা হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা বোঝাতে চেয়েছে। মঞ্জু তখন বলল, কি ব্যাপার খুব সকাল সকাল উঠে বসে আছ?

    —তুমিও তো বেশ সকালে ওঠো দেখছি।

    —আরও সকালে ওঠার অভ্যাস, আজ বরং দেরি হয়ে গেছে।

    —আমার অনেক দেরি করে ওঠার অভ্যাস মঞ্জু। কিন্তু খুব সকালে কেন যে ঘুম ভেঙ্গে গেল! মঞ্জু বলল, ঘুরে ফিরে দ্যাখো—বিকেলে তোমাকে নৌকা করে নিয়ে যাব। গ্রামের চারপাশটা ঘুরে দেখতে পাবে। হাসান পীরের দরগায় যেতে পার। ফাওসার বিলে ঘুরে আসতে পার। সোনালি বালির চরে যেতে পার।

    অতীশ বলল, ঘুম থেকে উঠেই কিন্তু আমার চা লাগে।

    —হাত মুখ ধোবে না?

    —পরে।

    —কেয়াকে ডেকে দিচ্ছি। তোমার ব্রাস টুথপেস্ট বের করে দিক।

    —আরে না, তোমায় ব্যস্ত হতে হবে না। স্নান করার সময় আমার দাঁত মাজার অভ্যাস।

    —শহুরে মানুষেরা বুঝি এ-ভাবে তবে সকালে দাঁত না মেজে থাকে?

    সেই অনেক দিনের পুরানো স্মৃতি মনে হয় কিনা অতীশের, এমন কথায়, সেই আশ্চর্য দিনগুলো ফিরে পায় কিনা দেখার জন্য যেন মঞ্জুর এমন বলা। অতীশ হাসতে হাসতে বলল, শহরে থাকলে বুঝি ছোট মেয়েদেরও চা খেতে হয়।

    —তোমার সব মনে আছে দেখছি।

    —সব।

    মঞ্জুর মুখ বেশ হাসিখুশি আজ। সকালবেলাতে মঞ্জুর মুখ আরো তাজা লাগল দেখতে। মঞ্জু উঁচু লম্বা মেয়ে। ওর চুল এত বেশি যে খোলা রাখলে পিঠ দেখা যায় না। অবনীর মৃত্যুর পর সে বেশি দামের শাড়ি পরে না বোধ হয়। খুব সাধারণ শাড়ি, সাদা জমিন, নীল পাড়, খুব উজ্জ্বল সাদা রঙ অথবা হলুদ রঙের পাড় এখন মঞ্জুর পছন্দ। সে কালো হলুদ রঙের পাড় দেয়া শাড়ি পরেছিল। এমনিতেই মঞ্জুর রঙ আশ্চর্য রকমের উজ্জ্বল, তার ওপর সাদা শাড়ি ওকে ভীষণ পবিত্র করে রাখে। মঞ্জু বলল, আমার এখনও হাসি পায়।

    —কি হাসি পায়?

    —ঐ যে তোমাকে ডেকে বললাম, সোনা কাকা চা!

    —তখন আমাদের ছোট বয়সে চা খাওয়া বারণ ছিল মঞ্জু।

    —কি গোপনে, যেন তুমি চুরি করে একটা ভীষণ অপরাধ করছ।

    অতীশ বলল, তাই মঞ্জু। তুমি চা খাও শুনে মনে হয়েছিল, শহরে থাকলে খায়। গ্রামের এসব মানায় না। বড়দা মেজদা টের পেলে ঠিক ছোট কাকাকে লাগাত

    তারপর মঞ্জু কি বলতে বলতে চলে গেল, সে বুঝতে পারল না। ঘোড়াটাকে নিয়ে শিমুল গাছের নিচে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন চারপাশে জল বলে ঘোড়াটা বাড়ির চারপাশেই ছাড়া থাকে। কোথাও যেতে পারে না ঘোড়াটা। সে চারপাশে ঘাস খেয়ে পেট ভরে গেলে শিমুল গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। জব্বার চাচা এমন সব বলে সেনবাড়ির সব খবর যেন অতীশকে দিচ্ছিলেন।

    মঞ্জুর চলে যাওয়ার ভেতরও এক ভীষণ টান থাকে। যেন যতক্ষণ মঞ্জু ফিরে না আসবে ততক্ষণ সে ওর আসার আশায় বসে থাকবে। মঞ্জু এখন চা করতে গেছে। ওর উচিত ছিল প্রথম জিজ্ঞাসা করা নীলু কেমন আছে! রাতে ওর ভাল ঘুম হয়েছে কিনা। হার্টের অসুখে ঘুম ঠিক হয় কিনা, না রাত জেগে কষ্ট সে এ-সব না বলে স্বার্থপরের মতো বলল, আমার চা। আর আশ্চর্য মঞ্জুও ছেলেবেলার কথা মনে করতে পেরে খুশি—তার মুখে এই সকালে নীলুর জন্য বুঝি সত্যি কোন দুঃখ জেগে ছিল না। সে যেন আবার আগের মঞ্জু হয়ে গেছে।

    অবনী বলত ওর বাপটাই বুঝলি যত নষ্টের গোড়া। টের পেয়েছে মঞ্জু এলে আমরা বাড়িটার চারপাশে ঘুব ঘুর করি।

    সে বলেছিল, তোর মাথায় বুদ্ধি বটে অবনী! আমাদের ভয়ে সেনদাদা মঞ্জুকে আসতে বারণ করেছে, আর মানুষ পেলি না।

    অবনী বলত, তোরা সেনদাদাকে বলবি, ওকে তো নাগাল পাব না, ওর ঘোড়ার ঠ্যাঙ ভেঙ্গে দেব। কেউ টের পাবে না।

    তার পক্ষে সেনদাদাকে কিছু বলা সম্ভব ছিল না। সেনদাদা মাঝে-মাঝে তাকে পড়াশুনা কোন হচ্ছে জিজ্ঞাসা করতেন। ভাল রেজাল্ট না করতে পারলে তাঁর ক্ষোভ হত। বলতেন ঠাকুরবাড়ির পোলা না তুমি! যেন ভাল ফল হয়, সেজন্য সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করত। সেনদাদা মানী লোক, তাঁর মান থাকবে না ভাবতে ভীষণ খারাপ লাগত তার।

    কখনও কখনও ডেকে সেনদাদা ওর হাতে টাকা দিতেন, বলতেন, চা আনবি। ব্রুকবন্ড চা। ওদের স্কুল ছিল গঞ্জের মতো জায়গায়। মাইল তিনেক দূরে স্কুল। সে মাঠে যখন দৌড়ে নেমে যেত, ব্যাগের ভিতর বই, তখন আবার সেনদাদা ডাকতেন।—কত আনবি শুনে গেলি নাতো। সে রাস্তা থেকেই বলত হাফ পাউন্ড।

    —হাফ পাউন্ড হলে চলবে না। এক পাউন্ড আনবি। মঞ্জু, মঞ্জুর কাকারা এসেছে। সে তখন পেছন ফিরে ভাল করে তাকালেই বুঝতে পারত, ডানদিকের ছোট্ট ঘরের জানালাতে মঞ্জু উঁকি দিয়ে আছে। মঞ্জুকে দেখলেই ওর বুকটা ধড়াস করে উঠত। কত কথা যে মনে পড়ছে।

    স্কুল থেকে ফেরার পথে ওর হাতে হলুদ রঙের প্যাকেট। হলুদ জ্যাকেটে মোড়া। রুপোলি রাংতায় মোড়া, ভেতরে অদ্ভুত অলিভ অয়েলের মতো রঙের পাতা বুঝি। মাঝে মাঝে নাকের কাছে নিয়ে এলে কেমন একটা সুন্দর গন্ধ। ওর কাছে গন্ধটা ছিল তখন রোদের ভেতর কলমিলতার ঘ্রাণের মতো। অবনী ঘোড়াটার পা ভাঙতে না পেরে রাগে দুঃখে ওর হাত থেকে একবার প্যাকেটটা থাবা মেরে ফেলে দিয়েছিল। তারপর প্যাকেটটা নিয়ে ফুটবল খেলার মতো খেলতে গেলে ওর প্রাণে কি যে ভয়! তাড়াতাড়ি সে লাফিয়ে ওর পায়ে পড়ে দুটো পা জড়িয়ে ধরেছিল, যেন দ্বিতীয়বার আর পা ছুঁড়তে না পারে অবনী।

    অবনী তখন মাঠে চিৎকার করে বলেছিল, তুই একটা চাকর। তোর জন্য আমাদের মান সম্মান থাকবে না। বড়দা মেজদার সঙ্গে সে স্কুলে যেত। শশি মাস্টার সঙ্গে থাকতেন। দেড় ক্রোশ রাস্তা হেঁটে স্কুল। সেনদাদা চা আনার জন্য তাকে এতটা নির্ভরযোগ্য কেন মনে করতেন আজও সে বুঝতে পারে না। অবনী ফেউএর মতো লেগে থাকত। সে পছন্দ করত না সেনদাদা তাকে দিয়ে চা আনায়। ওর মনে আছে, তারপর থেকে সেনদাদা চা আনতে দিলে, সে কিছুতেই অবনীর সঙ্গে ফিরত না। সে দাদাদের সঙ্গে মাঠ পার হয়ে চলে আসত।

    অথচ এক আশ্চর্য বিকেলে চায়ের প্যাকেটটা এনে সেনদাদার হাতে দিলে কে যেন ফিসফিস গলায় ডেকেছিল! ইশারায়। সেনদাদা খড়ম পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন বলে শুনতে পায়নি। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিল, না কেউ নেই, সে তখন বারান্দা থেকে নেমে আসবে, আবার ডাক, এই সোনা শোনো। সে দেখেছিল, সামনেই আছে মঞ্জু। আমলকি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। রোদের ভিতর এক রঙ থাকে, গল্প থাকে, সময় সময় তা ধরা যায়—মঞ্জুর চোখ-মুখ দেখে সে তেমন কিছু যেন ধরতে পেরেছিল। সে কিছুতেই তাকে ফেলে চলে আসতে পারেনি। কারণ সে মঞ্জুর এমন মুখ দেখলেই টের পায়, আবার নিশ্চয় মঞ্জুর মাথায় কোনো দুষ্টুবুদ্ধি খেলছে। সে তাকে নিয়ে কোথাও যাবে। তাকে নিয়ে যেমন শিশুরা নিজের খুশিমতো পুতুলের বিয়ে দেয় তেমনি তাকে নিয়ে মঞ্জু যা খুশি করবে। বোকার মতো সে একটা সামান্য পুতুল হয়ে যাবে।

    মঞ্জু বলেছিল, হাতে করে চা এনেছো, একটু চা খেয়ে যাবে না? এস ভেতরে বসবে।

    চা খাওয়া ছিল তখন ওদের বারণ। চা খেলে অজীর্ণ রোগ হয়। ওর সোনা জ্যাঠামশাই চা সম্পৰ্কে এমন একটা ফিরিস্তি দিয়েছিল, চা মানে সিগারেটের সমতুল্য। চা একটা পাজি নেশা। প্ৰায় যেন এটা গ্যাজার নেশার কাছাকাছি। এত বড় একটা পাপ কাজ মঞ্জু তাকে করতে বলছে। অবশ্য সে জানে মঞ্জুর জন্য নানাভাবে অনেক পাপ কাজ সে করেছে। ফতিমা টের পেয়ে ছিল কি না সে জানে না। তাকে দেখলেই বলত, আমি সব জানি। মঞ্জুর জন্য তখন সে সব করতে পারত। তবু যেন একটা নিষিদ্ধ ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে, ওর আর মঞ্জুর মধ্যে। মঞ্জুকে সে খুব ধীরে ধীরে বলেছিল, ছোটরা চা খায় না মঞ্জু।

    মঞ্জু বলেছিল, ছোটরা অনেক কিছু খায় না। তুমি আর ছোট নও। ছোট থাকলে খেতে বলতাম না। বলে মুচকি হেসেছিল মঞ্জু। তারপর বলেছিল, ফতিমার সঙ্গে যখন ঘুরে বেড়াতে তখন বুঝি কিছু হত না!

    কি যে এক অতীব ভালবাসার রঙ তখন মঞ্জুর চোখে। সে তখন সব টের পেত। সে যে বড় হয়ে গেছে, আশ্চর্য, মঞ্জু তা কি ভাবে যে বুঝে ফেলেছে। ফতিমা তখন ঢাকায় চলে গেছে। গাঁয়ে বড় একটা আর আসে না। না আসতে দেওয়া হয় না—কে জানে! মঞ্জু বলেছিল, তুমি একটু বসো। তারপর হাত ধরে বলেছিল, ভেতরে এস না, লজ্জা কি। বলে মঞ্জু ওর ছোট্ট সাজানো ঘরটাতে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, এখানে এলে আমি থাকি। এই আমার খাট। আমি একা শুই। আমার একা শুতে এখন ভয় করে না। একটু থেমে আবার মঞ্জু বলেছিল, তুমি রাতে একা শোও।

    সে বলেছিল, না।

    —কে থাকে?

    —মা।

    মঞ্জু কেমন বিস্মিত! চোখ ওপরে তুলে বলল, অমা! তুমি এখনও মার সঙ্গে শোও।

    সে বুঝতে পারেনি, মার সঙ্গে শুলে কি অপরাধ। কেন যে মঞ্জু এ-ভাবে চোখ কপালে তুলে বিস্ময় প্রকাশ করছে! সে বলেছিল, মার সঙ্গে শুয়েছি তো কি হয়েছে।

    —বড় হলে মার সঙ্গে আর শুতে নেই। তুমি আর কচি খোকা নেই।

    —মাকে ছাড়া শুলে আমার ঘুম আসে না। অতীশ তখন সোজাসুজি কথাটা না বলে পারেনি।—মাকে বাদে শুলে মনে হয়, আমি একা। মা আমার পাশে নেই, কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

    —তুমি মাকে ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকোনি?

    —থেকেছি। কিন্তু খুব খারাপ লেগেছে। বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত আমার মনটা ভাল হত না। মুড়াপাড়ায় গেলে মা-র জন্য কষ্ট হয়।

    তার মনে পড়ল অমলা কমলার কথা। সেবারে বাবুদের বাড়ি থেকে ফিরে তার মনটা বড় দুর্বল হয়ে গেছিল। অমলাই তাকে নিয়ে কি সব করেছিল। তার কেন যে মনে হয়েছিল, তার পাপ, পাপে ‘তাপে সব যায়। মা-র যদি কিছু হয়। সারা সকাল সে একটা গাছের ডালে উঠে চুপচাপ বসেছিল। ডাকাডাকি করেও ঈশমদাদা তার সাড়া পায়নি। সহসা মঞ্জু কি ভেবে বলেছিল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছ কেন! আমার বিছানায় উঠে বোস না। লজ্জা কি। বোস না।

    চারপাশে নানারকমের ছবি। দেয়ালে ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট ঝুলছে। শীতকালে অঞ্জু পিসি, মঞ্জু এবং ঢাকা থেকে মন্টু, দেবী এলে ওরা সামনের লনে হাতে র‍্যাকেট নিয়ে খেলা করে। অতীশের মনে হত তখন কি আশ্চর্য খেলা! ওরা সাদা পোশাক পরে সবুজ লাল একটা সাদা নেট টানিয়ে সাদা কর্কে খেলা করত। কি সুন্দর যে লাগত তখন গোটা বাড়িটা। এমন সুন্দর লাল রঙের ইটের বাড়ি, সামনে সবুজ লন, লনে দুটো মেয়ে সাদা ফ্ৰক গায়ে দিয়ে দুটো ছেলে সাদা কেড্স পরে অনবরত ছোটাছুটি করছে। তারা কাছে পর্যন্ত যেতে সাহস পেত না। শহরে যারা থাকে তারা খুব অহংকারী হয়। সোনা অবনী কম যায় না এ ব্যাপারে। ওরা দূরে তখন ফুটবল এ ওর কাছে ছুঁড়ে মারত। আসলে তখন তাদের ইচ্ছা ছিল, ওরা কে কতটা বল ছুঁড়ে দিতে পারে মঞ্জু অঞ্জু দেখুক। ওরা বাড়ির ভেতরে না গেলেও কাছাকাছি থাকতে ভালবাসত।

    মঞ্জুর মার ছবি দেয়ালে। মুখে খুব একটা ঘোমটা নেই। বিয়ের পরে পরেই ছবিটা তোলা হয়েছিল বোধ হয়। মঞ্জুর মা বয়সকালে ঠিক মঞ্জুর মতোই দেখতে ছিল। ছবিটা দেখলে ওর তখন এমন মনে হত। মঞ্জুদের পুরোহিত বংশের ছেলে সে। মঞ্জুকে ওর মা বলেছিল একবার, তুমি ওকে কাকু ডাকবে মঞ্জু। তোমার কাকু হয়।

    মঞ্জু তাকে চা দেবার সময় ঠাট্টা করে বলেছিল, কাকু তোমার চা।

    মঞ্জুর হাত থেকে চা নেবার সময় বলেছিল সে, এই মঞ্জু তুমি কিন্তু বলে দিও না কাউকে, আমি চ। খেয়েছি। জ্যাঠামশায় জানলে ভীষণ রাগ করবে।

    —এত ভয় কেন তোমার, কাকু? মঞ্জু চোখ তুলে বলেছিল। তারপর কথা নেই বার্তা নেই সে ওর পাশে গা লাগিয়ে বসেছিল। পা দুলিয়েছিল। কি যেন ভাবছিল মঞ্জু আর মঞ্জুর গায়ে সেই গন্ধ। মঞ্জু পাশে বসে চা খাচ্ছে। ওর ভেতরটা কেমন যেন করছিল। এখন আর এ-বয়সে ভেতরটা তেমন করে না কেন? মঞ্জু চা খেতে খেতে বেণী দুটো একবার কাঁধে এনে ফেলল, আবার পিছনে, সে তার চুল নিয়ে কি করবে যেন ঠিক করতে পারছিল না। আর কেবল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক ফিক করে হাসছিল। বোধহয় ওর মুখ দেখে মঞ্জুর ভীষণ মায়া হচ্ছিল। সে যে সত্যি চুরি করে একটা ভীষণ কিছু করে ফেলেছে সেটা বোধ হয় মুখে চোখে ধরা পড়ছিল। হাতে ছিল ওর সোনালি রঙের কাপ, কেমন গোলাপ জামের মতো রঙের চা। কি সুন্দর ঘ্রাণ চায়ের। চা খেতে খেতে সারাদিন পর সুন্দর এক জ্যোৎস্নার কথা মনে পড়েছিল তার। যেন মঞ্জু আর সে সেই সাদা জ্যোৎস্নায় ঘোড়ায় চড়ে কোথাও যাচ্ছে। মঞ্জুর মুখটা মসলিন দিয়ে ঢাকা। আসলে মানুষ শৈশবই এক অশ্বমেধের ঘোড়া ছেড়ে দেয়। সেই ঘোড়াটিই বুঝি দেশভাগের হেতু, সেই বুঝি তাকে সমুদ্রে নিয়ে গেছে। সেই বুঝি বনিকে আবিষ্কার করার পর ভেবেছে যজ্ঞ শুরু—তারপর জাহাজ অচল—নিরন্তর সেই সমুদ্রযাত্রা—এখন কেন যে মনে হয় সব কুহেলিকা। অথবা ঘোড়াটার মতো কপালে বড় চাঁদমালা।

    সাদা পোশাকের ওপর জরির কাজ। সোনালি ঝালরে ঢাকা তার মুখ। সে আর মঞ্জু ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে। কেবল যাচ্ছে। সে আগে, মঞ্জু পেছনে। মঞ্জু ওর কোমরে এক হাত রেখেছে। অন্য হাতটা ওর চুলের ভেতর। সুন্দর সুদৃশ্য হাতে ওর চুলে বিলি কাটার মতো করে যেন বলছে, কাকু তোমার চুলে ফুলের গন্ধ কেন?

    সে কোনও উত্তর দেয় নি। সে সামনে ঘোড়া দ্রুত ছুটিয়ে দিয়েছে। কারা যেন পেছনে আসছে ছুটে। কারা যেন হাজারে হাজারে ঘোড়ায় চড়ে ওকে ধরার জন্য ছুটছে। যে সবার আগে ছিল, তার মুখ অবনীর মতো। অবনী তাকে ধরতে আসছে।

    কিন্তু সে তখন অনেক দূরে। কোথায় পাবে অবনীরা তাকে আর মঞ্জুকে। ঘোড়াটা তখন তাদের নিয়ে যেন কোথায় কোনও বড় পাহাড় আছে, চারপাশে নানাবর্ণের ফুল ফুটে আছে, ঝর্ণা নামছে জলের, সোনার চাঁপা ফুল ভেসে যাচ্ছে, সে আর মঞ্জু সেই সোনার চাঁপার সন্ধানে চলে যাচ্ছে। কেউ আর এ-পৃথিবীতে নেই, তাদের তখন বাধা দিতে পারে। সোনার চাঁপা ফুলটা সে সবার আগে মঞ্জুর খোঁপায় গুঁজে দেবে ভেবেছিল।

    দেশভাগ, উদ্বাস্তু জীবন, সমুদ্রযাত্রা, বনির অন্তর্ধান—দেশে ফিরে আসা, নির্মলাকে আবিষ্কার, টুটুল মিণ্টু জীবনে আর এক গ্রহ। সব মিলে সে ভুলেই গেছিল, এক জীবনে তার ফতিমা ছিল, মঞ্জু ছিল, পাগল জ্যাঠামশাই ছিলেন। তখনই দেখল মঞ্জু সেই সোনালি কাপে ওর জন্য চা এনেছে। চায়ে ঠিক সেই আগের মতো গোলাপ জামের রঙ।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
    Next Article মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }