Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1863 Mins Read0

    ঈশ্বরের বাগান – ৭৭

    ।। সাতাত্তর।।

    কেয়া বলল, সোনাবাবু ওটা কাদের বাড়ি ছিল বলুন তো?

    —মাঝিবাড়ি

    —মাঝিরা ক’ভাই ছিল?

    —ওরা ছিল চার ভাই। নিবারণ মাঝি, প্রফুল্ল মাঝি, অবনী মাঝি, জগদীশ মাঝি।

    —কেউ নেই এখন। ওরা কোথায় গেছে জানেন?

    —না।

    —কেয়া বলল, আন্দামানে।

    —আন্দামনে সবাই চলে গেল!

    —বা’জান তাই বলেছেন, ওরা জমি-জমা বিক্রি করতে বছর দশেক আগে এসেছিল। বা’জানকে এমন ওরা বলেছিল।

    —কে কোথায় গেছে তুমি সব জান?

    —আমি কিছুই জানি না। বা’জানের একটা খারাপ স্বভাব আছে। কে কোথায় বা’জানকে ফেলে চলে গেল সব মনে গেঁথে রেখেছে।

    কেয়া এবং অতীশ পুকুরপাড়ে এসে সেই কয়েৎবেল গাছটায় নিচে দাঁড়াল। দত্তদের বাড়িতে আলতাফ আর তার বিবি থাকে। ওর দুই ছেলেকেই খানেদের সেনারা ধরে নিয়ে গেছিল। ওরা আর ফিরে আসেনি। কোথাও আশেপাশে কেউ এসে দাঁড়ালে আলতাফ ভেবে থাকে, ওর দুই ছেলে ফিরে এসেছে। আলতফ এমনিতেই চোখে ভাল দেখে না, ছেলে দুটো নিখোঁজ হবার পর একেবারে দেখতে পায় না। আলতাফের পরিবার ফল-পাকুড়, কিছু জমির ফসল দেখেশুনে করে তুলতে পারলে ওদের মোটামুটি চলে যায়। কেয়া বাবার কথা সহসা থামিয়ে আলতাফের কথা বলছিল, আর আলতাফ বারান্দায় বসে হুঁকা খাচ্ছে, কে-ডা। তোমরা কে-ডা? আলি, বরকত! তরা আইলি!

    কেয়া বলল, চাচা আমরা।

    —তরা কে-ডা?

    —আমি আর সোনাবাবু। কেয়া জানে সোনাবাবু বললে আলতাফ চাচা কিছু বুঝবে না। সে অতীশের পরিচয়, কার ছেলে, কেন এসেছে সব বললে আলতাফ কেমন যেন চুপ করে গেল। ওর ভেতরে কোনও উৎসাহ নেই কারো সম্পর্কে। সে ছেঁড়া শীতলপাটিতে বসে তামাক খাচ্ছে। শোকে মানুষটা সব পূর্বস্মৃতি ভুলে গেছে।

    কেয়া বলল, মাথা ঠিক নেই।

    কেয়া এমনভাবে কথা বলছিল, যেন সে এ-সবের ভেতর ছিল না। অন্য কোথাও ছিল। ফিরে এসে সব শুনেছে। আসলে, এই যে গাছপালা, অথবা ঝোপ জঙ্গল সর্বত্র, তখন এখানে এক নিদারুণ হাহাকারের ছবি, কেয়াকে দেখলে এখন বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেয়া কোথায় যেন একটা ভীষণ সংকোচের ভেতর মাথা গুঁজে রেখেছে। মাঝে মাঝে কেয়া অন্যমনস্ক হলে অতীশ সেটা ধরতে পারে।

    অতীশ বলল, তুমি তো সেদিনের মেয়ে। এত জানো কি করে!

    —বা’জান সব বলেন। বাজানের কোন কাজ না থাকলে বলে যান। যখন খেতে বসেন, কথায় কথায় কার বাড়ি কত বড় উৎসব হত সব বলেন। কোন বাড়ির কি মাহাত্ম্য ছিল বলেন। কে তাঁকে কি ভাবে কতবার জেল থেকে বাঁচিয়েছে বলতে বলতে চুপ করে থাকেন। আর আপনার পাগল জ্যাঠামশাইর কথা উঠলে চোখের জলে ভেসে যান।

    অথবা যেন এখন কেয়ার বলার ইচ্ছে, বা’জান যখন এ-গ্রামের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ান তিনি যেন দেখতে পান, কত মানুষ, তারা, এই জল-হাওয়ায় নিঃশ্বাস ফেলেছে, একসঙ্গে বড় হয়েছে সহসা দেশে যে কি এল, কেন যে দেশ থেকে সবাই চলে গেল—এসব পূর্বস্মৃতি বা’জানকে ভীষণ কাতর করে রাখে। বা’জানের শরীর ভাল না থাকলে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। তখন ওঁকে বার্লি খাওয়াতে এলে এ-গ্রামের বৈভবের কথা বলেন।

    অতীশ বলল, মঞ্জুরা বাদে আর কেউ নেই এ-গাঁয়ে? তারপর অতীশ ভাবল, জব্বার চাচা নিজেই তো লীগের পাণ্ডা ছিলেন। সামু চাচার চ্যালা। সেই মানুষটাই কী হয়ে গেছে! তিনিও বোধ হয় সব ভুলে থাকতে চান।

    —আছে। পশ্চিম পাড়াতে ক’ঘর। সিং-এরা আছে। ফণী দফাদার গত সালে মারা গেছে।

    —দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারল না।

    —না।

    কেয়া পরেছে একটা হলুদ রঙের শাড়ি। ওর চুল বেশ আঁট করে বাঁধা। কেয়ার পায়ে নীলরঙের স্লিপার। সে আগে, অতীশ পেছনে।

    অতীশ এ-বাড়িতে এলে নানাভাবে সব আত্মীয়-স্বজনের মুখ দেখতে পায়। ওদের পৈতের সময় অনেকে খেয়েছিল, পৈতের সময় সে পালকিতে চড়ে গ্রাম ঘুরেছিল। ফতিমা তার নানীর সঙ্গে এসেছিল। মঞ্জুকে সে সেদিন দেখতে পায়নি। মঞ্জুদের সবার নেমন্তন্ন ছিল, কিন্তু মঞ্জু খেতে আসেনি। আর সে দেখেছিল, সে যখন পাল্কি চড়ে চলন দিচ্ছিল, তখন অনেক দূরে মনে হয়েছিল সাদা ঘোড়ায় চড়ে মঞ্জু কোথাও যাচ্ছে। সেই চালতা গাছ, সেই লটকন গাছ, সেই তালগাছ এবং সেই সব এক রকমের পাখি। কাকার বিয়েতে এই পুকুরে তিনটে তিনমাল্লা নৌকা এসেছিল। অতীশ সেবারই প্রথম বরযাত্রী যায়। বরযাত্রী যাবার তার আর কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না।

    অতীশ বলল, কেয়া, মানুষ যে দেশে থাকে, তার সেটাই দেশ হয়ে যায়।

    —সে হয়তো ঠিক। তবু মায়া থাকে। শৈশবের জন্য মায়া থাকে। আপনি যেখানে ছোট বয়সে থেকেছেন, কখনও তাকে ভুলতে পারেন না।

    —হয়তো হবে। হয়তো এজন্যই মঞ্জুর চিঠি পেয়ে দেরি করতে পারিনি, কিন্তু এখানে আসার পর মঞ্জু কিছুই বলছে না। কেন যে আসতে বলল, কিছুই বুঝছি না।

    —এইতো এলেন। ক’দিন তো থাকবেন। ঠিকই বলবে। বলেই কেয়া সামনের ঝোপ লাফ দিয়ে পার হল। কেয়া পার হতে গিয়ে একটু শাড়ি তুলে ফেলেছিল। ওর হলুদ পা দেখা যাচ্ছিল, আর ওর পা এবং হলুদ রঙের শাড়ির কোথায় যেন মিলে মিশে গেছে। সে তাকাতে গিয়ে কেমন লোভে পড়ে গেল।

    অতীশ বলল, বন-জঙ্গলে ঘুরে কি হবে। চল বরং নৌকা নিয়ে জলে ভেসে পড়ি।

    কেয়া বলল, মঞ্জুদি বলেছে যাবে। বিকেলে আমরা বিলে শাপলা তুলতে যাব। আপনি নৌকা বাইতে পারেন তো। ভুলে যাননি তো সব!

    —ভুলে যাইনি। তবে অভ্যাস নেই। কতটা পারব জানি না।

    —অভ্যাস না থাকলে সাহস কেন জলে ভাসার!

    অতীশ কোনও কিছু ভেবে বলেনি, আসলে মেয়েটা ঠিক বাংলা দেশেরই মতো। জল-হাওয়ায় সজীব। ফুল ফলের মতো তাজা। কেয়ার এ-বয়সে, যে কোনও মানুষের পক্ষে লোভ হওয়া স্বাভাবিক। সে কথার কথা বলেছে। তাছাড়া ভালই লাগে, জলে ভেসে গেলে। যুবতী মেয়ে পাটাতনে, চারপাশে বর্ষাকাল। চারপাশে শাপলা শালুকের পাতা, ফুল। ফড়িং উড়বে। প্রজাপতি বসবে গলুইয়ে আর অজস্র পাখি বাংলাদেশের। কতরকমের পাখা, কতরকমের চোখ। ওরা যখন মাথার ওপর উড়ে যাবে, তখন এ-পৃথিবীতে কেউ কেয়াকে না ভালবেসে পারবে না। সেতো অতীশ। বয়স বেশি। সবল চেহারা। চোখে ভারি চশমা। সে কালো রঙের দামী টেরিলিনের প্যান্ট, আর সাদা জামা পরেছে, সে পরেছে কোলাপুরি চটি। সে সব সময় সু পরে বলে, পা একেবারে মাখনের মতো লাবণ্যময়। চটির ভেতর পা দুটো ভারি সুন্দর লাগছিল।

    কেয়া বলল, ওদিকটাতে একটু বসি। অতীশের কি মনে হল। সে বলল, মঞ্জু আবার আমাদের জন্য ভাববে নাতো।

    —মঞ্জুদি তো আপনাকে চেনে।

    অতীশ আর ওর সঙ্গে না গিয়ে পারল না, অতীশ ভাবল, সে খুব ভীতু মানুষ। কেয়া সেটা টের পেয়ে গেছে। এ-ব্যাপারে ভীতু মানুষদের মেয়েরা ভয় পায় না। বরং করুণা করে থাকে। কেয়া হয়তো ওকে করুণাই করছে।

    অতীশ বসে বলল, এমন একটা নির্জন জায়গায় তোমরা থাকতে সাহস পেলে কি করে। পাশেই মিলিটারি ছাউনি! তোমাদের ভয় করত না!

    —এসব জায়গা নির্জন ছিল কে বলেছে আপনাকে!

    —কে বলবে! দেখে শুনে মনে হচ্ছে।

    —এ-রাস্তায় কত সব যুদ্ধের গাড়ি গেছে জানেন?

    —কি করে জানব!

    —তবে যে বলছেন! এদিকে সব সময় একটা মহামারির মতো ব্যাপার ছিল। এখন বর্ষাকাল। পানিতে সব ভেসে গেছে, শীতকালে এখানে কোথাও এতটুকু পানি থাকে না। প্রভাকরদির মাঠে যে সব পরিখা খুঁড়েছিল ওরা, দুঃখের বিষয় একটিও আপনাকে দেখাতে পারছি না। তবে একদিন গোপের বাগ আপনাকে নিয়ে যাব। ঐ তো, চেনেন না?

    —খুব চিনি।

    —একটা বড় আমবাগান ছিল না!

    —হ্যাঁ। ওটার ওপর দিয়ে আমরা স্কুলে যেতাম।

    —সেখানে একটা অস্থায়ী ঘাঁটি ছিল। এখন গেলে শুধু কিছু ভাঙা ইট কাঠ, লোহা-লক্কড়, চোখে পড়বে। আর কিছু না। কে বলবে, ওখানে বছর খানেক আগেও রোজ প্যারেড হত। গাড়িতে সারি সারি খান-সেনা কেবল আসছে তো আসছেই। মাঝে মাঝে অন্ধকার রাতে শুনতে পেতাম, দূরে কারা মেশিন গান দাগছে। আমাদের তখন দিনগুলো পাখির ডানায় ভর করা ছিল, যে কোন মুহূর্তে টুপ করে ঝরে পড়তে পারতাম। মেয়েটা তো ভারি সুন্দর কথা বলতে পারে। এটুকু বলেই কেমন কেয়া বিষণ্ণ হয়ে গেল। কথা বলতে পারল না। সে কি যেন গোপন করার চেষ্টা করছে ভীষণভাবে। অতীশ কেয়ার এমন মুখ, অনেকবার দেখেছে। সকালে মেয়েটা তাকে বিশ্বাস করেছিল, এখন দেখে মনে হয়, আবার চোখে ভয়, অবিশ্বাস। এ-সময় অতীশ কেন যে কিছু বলতে পারে না। সে বলল, কেয়া চল ওঠা যাক, মঞ্জু এবার আমাদের জন্য সত্যি ভাববে।

    .

    তখন মঞ্জু এসে দেখল মুর্শেদ নীলুর সঙ্গে বেশ গল্প জুড়ে দিয়েছে। যেমন মুর্শেদ বলছিল, আমরা ষষ্ঠীতলার মাঠে ঘুড়ি ওড়াতাম। আমাদের ছিল নুরুল মিঞা, আমাদের ছিল এক মানুষ, ঘোড়ায় চড়ে আসত, আমরা ঈদের দিনে চিৎপুর পার হয়ে চলে গেছি, বড় মসজিদে নামাজ পড়েছি, আমাদের রাজাবাজারে ঈদের দিন, কি বড় জালসা হত, কত মানুষ! রঙ বেরঙের টুপি, পোশাক। বর্শা, তরবারি। মহরমের দিনে, নানারকম সাজে সাজতাম। ইন্টালির পীরের দরগা থেকে হাতে করে নিতাম তাজিয়া। কি যে বড়, একেবারে ট্রাম লাইনের তার ছুঁয়ে যেত। বড় বড় ঘোড়ায় সব পুলিশের দল যেত আগে—আর কি বড় মিছিল! বুক থাবড়ে বলতাম হায় হাসান, হায় হোসেন।

    নীলু, মুর্শেদ বুক থাবড়ে কথা বললে মজা পায়। আসলে সে নীলুকে দেখলেই ছেলেমানুষ হয়ে যায়। সে নীলুর সামনে একজন মোহরমের দিনের মানুষ হয়ে পৃথিবীর মঙ্গল আকাঙ্খায় ছেলেমানুষের মত বুক থাবড়ে বুঝি কাঁদতে ভালবাসে। অথবা মুর্শেদ বুঝি মনে করতে পারে সেই শৈশবের দিন সে আর ফিরে পাবে না। তার বারবার এক আকাঙ্খা, ঐ যে একটা লোক এসেছে, যে এখনও জানে না সে কে, কিন্তু কলকাতা থেকে এসেছে, যেন প্রথম দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করবে আচ্ছা বাবুজী, পুলের পাশে পীরের দরগা আছে জানেন? সেই ষষ্ঠীতলার মাঠ আছে? সেই জলাভূমি, সেই কবরখানা ওখানে একটা চাঁপা ফুলের গাছ ছিল, গাছটা আছে? আমরা রোজ চাঁপা ফুল চুরি করতে যেতাম। পাঁচিল টপকে সরকার বাড়ির একটা ফলের বাগান ছিল। কত রকমের ফল, আতা যে কত রকমের ছিল, আম জাম জামরুল ছিল। গাছ ছিল কতরকমের। খুব বড়, চারপাশে পাঁচিল, টপকে ভিতরে ঢুকে গেলে কেউ টের পেত না! ভেতরে ঢুকলে অন্য একটা দুনিয়া মনে হত। মাঝে মাঝে সেই দুনিয়ার খোয়াব আমি দেখি। কাউকে বলতে পারি না, বর্ণনা দিতে পারি না। মিনার কত যে বলে, তুমি না নিয়ে গেলে বুঝতে পারব না। তুমি দেশটাকে এত ভালবাস!

    মঞ্জু তখন বলল, নীলু, চাচাকে এমন করতে নেই। ওকে ঘাঁটিও না।

    মুর্শেদ নীলুকে খুশি রাখার জন্য দুহাতে বুক থাবড়ে, যেন সে মিছিল নিয়ে যাচ্ছে মোহরমের, হায় হাসান, হায় হোসেন করছে। আসলে সে বুক থাবড়ে এমনভাবে ঘুরে বেড়ালে মনে হয় শৈশবে সে ফিরে গেছে। মঞ্জু দেখল, মুর্শেদ ভীষণ ঘামছে। সে কাছে যেতেই মুর্শেদ কেমন শিশুর মতো হেসে দিল। তারপর আর কিছু না বলে শিয়রে বসে পড়ে মঞ্জুকে মুর্শেদ দেখতে থাকল। মঞ্জু বলল, কিসব ছেলেমানুষী হচ্ছিল! ঘরে বুক থাবড়ে দাপাদাপি করছিলে!

    মুর্শেদ মাথা নিচু করে বসে থাকল। এখন বুঝতে পারছে সে খুব ছেলেমানুষী করে ফেলেছে। একেবারে শৈশবে ফিরে গেলে ওটা হয়।

    মঞ্জু বুঝতে পারছে, মুর্শেদ নিজের ছেলেমানুষীর জন্য নিজেই অবাক হয়ে গেছে। নীলুর বিছানার চাদর একটু উঠে গেছে, মঞ্জু টেনে ঠিকঠাক করে দিল। সে রান্নাঘরে দৌড়ে গেল। একদন্ড সে বসতে পায় না। মুর্শেদ যখন দেখতে পায়, সকালে উঠে সব সময় কাজ করছে মঞ্জু তখন সে মর্জিনার সঙ্গে মঞ্জুর কোন তফাৎ খুঁজে পায় না। সব চেয়ে ওর কষ্ট হয় যখন সারা সকাল খেটে এবং এগারোটায় প্রায় রান্না শেষ করে মঞ্জু স্নান করতে যায়। স্নান সেরে এসে সে নিজের জন্য সামান্য ডাল, ভাত একটু তরকারি করে নেয়। মুর্শেদ কতদিন বলেছে, কেয়া করে নেবে, জব্বার চাচা কতদিন বলেছেন, মা মঞ্জু ওডা ইবারে কেয়ার হাতে দিয়া দ্যাও। মঞ্জু হাসত। বলত, চাচা কেয়া ছেলেমানুষ, ও পারবে কেন!

    আসলে মঞ্জু বুঝি বুঝতে পারে, কেয়ার রান্না ওরা খেতে পারবে না। মেয়েটা এখনও নুন ঝালের পরিমাণ ঠিক বোঝে না। এক মাছই মঞ্জু কত রকমের যে রান্না করে। এখানে এসে এমন স্নিগ্ধ খাবার মুর্শেদকে ভীষণ পারিবারিক করে রেখেছে। কখনও কখনও মুর্শেদ মাছ-গুলোর পাশে বসে, যেন সরল বালকের মতো বিস্ময়ে, কত বড় পাবদা মাছ! মঞ্জু বেশ বেগুন দিয়ে জিরে বাটা দিয়ে একটা পাতলা ঝোল করেছে। কৈ মাছ হলে বলবে, সরষে আদা পেঁয়াজ। ভাল বেলে মাছ হলে বলবে, পাতুড়ি, অথবা লাউপাতার ভেতরে মাছ আর পেঁয়াজ রসুন পুরে চপ। এবং মঞ্জু এই ক’মাস এ-ভাবেই খাইয়েছে। আর মুর্শেদ খেতে বসলে কেমন আনমনে খায়। সে তাকায় না মঞ্জুর দিকে। সে প্রথম মঞ্জুকে মঞ্জুবৌদি বলত, তারপর যখন সে গাড়িতে সন্ধ্যায় নিয়ে যেত এবং সকাল হবার আগে আবার রেখে যেত বাড়ি তখন ডাকত মঞ্জু। আবার কখনও কখনও সে মঞ্জুকে, মঞ্জু না বলে মঞ্জুদি বলে ডাকত। আসলে মঞ্জুর চোখে মুখে এমন এক চেহারা আছে, তাকে বুঝি কখনও এক সম্পর্কে ডাকা যায় না। খুব গম্ভীর থাকলে, মুর্শেদ মঞ্জু ডাকতে সাহস পায় না। বয়সে ছোট মঞ্জুকে সে ডাকে তখন, মঞ্জুদি।

    কখনও খেতে বসলে মনে হয় মুর্শেদের, সব কেমন উগলে আসছে। এটা রোজ হয় না। কখনও কখনও হয়। যেদিন খুব বেলা হয়ে যায় রান্না করতে করতে অথবা যেদিন মঞ্জু মুর্শেদকে খাইয়ে আর সময় পায় না রান্নার, নিজের জন্য তাড়াতাড়ি স্নান সেরে সামান্য সেদ্ধভাত করে নেয়, তখন মনে হয় যা খেয়েছে সব উঠে আসবে। এতদিন এ-ভাবে সে এখানে থাকত না। কিন্তু মঞ্জু বলেছে, যে করে হোক ওকে ইন্ডিয়াতে পাঠিয়ে দেবে। সেখান থেকে সে হোসেনিয়ালার কাছে ঠিক পার হবার মতো দেশের বর্ডার পেয়ে যাবে। এখন তার একমাত্র ভয় বাঙ্গালী মুসলমানদের হাতে না পড়ে যায়। জাত ভাইরা যদি জানে সে ডেজার্টার, সে খান-সেনা, তবে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।

    এ-ভাবে আর থাকাও যায় না। সে পালাতেও পারে না, তাকে চেনে সবাই—খবর রটে গেলে মঞ্জুদির বাড়িতে হামলাও হতে পারে—বের করে দিন—আল্লাহ আকবর। খুন খুন। সামান্য মুখের কথায় এতদিন কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থাকে না। আসলে কি মুর্শেদ এই মেয়ে মঞ্জুর ভেতর কখনও কখনও মর্জিনাকে আবিষ্কার করে ফেলে অথবা মনে হয়, স্বামীর মৃত্যুর পর, এবং যে মৃত্যু সে নিজে দাঁড়িয়ে…., সে এখনও ভাবলে কেমন অসহায় বোধ করে। ধরে নিয়ে যাওয়া, জানালায় মঞ্জু দাঁড়িয়েছিল, চোখে জল ছিল না, কেমন অসহায়, নিষ্ঠুর এবং দুঃখজনক পরিস্থিতিতে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, না কি মুর্শেদ অতদূর থেকে মঞ্জুর সঠিক মুখ দেখেনি, চোখের জল কি অতদূর থেকে দেখা যায়! আর খেতে বসলেই মঞ্জুদির এটা ওটা এগিয়ে দেওয়া দেখলেই সে শুনতে পায় এক রেলগাড়ি যাচ্ছে। দ্রুত এক রেলগাড়ি চলে যাচ্ছে বুকের ওপর দিয়ে। সে তখন আর কিছুতেই কিছু খেতে পারে না। কিছু না খেয়ে উঠে পড়লেই মঞ্জুর ছুটে যাওয়া, এই মুর্শেদ কি হচ্ছে। খাও

    —আমি খেতে পারছি না।

    —কেন কি হল। রান্না ভাল হয়নি। ঝাল কম হয়েছে?

    —না মঞ্জুদি, এমন রান্না আমি কোথাও কখনও খায়নি। ও-জন্য নয়। খেতে ভাল লাগছে না।

    — আমি তো চিঠি লিখেছি। সে ঠিক চিঠি পেলে চলে আসবে। ঠিকানা সংগ্রহ করতে দেরি হয়ে গেল। কে কোথায় আছে জানব কি করে! ভাগ্যিস ফতিমা ছিল!

    —মঞ্জুদি, তুমি অত ভাববে নাতো।

    —না না, আমি তো বুঝি, তোমার এখন বাংলাদেশ থেকে পালানো দরকার। যা সব ধরপাকড় হচ্ছে, যাকে তাকে খানসেনা সন্দেহে মারছে, খুন করছে, আবার একটা কি না হয়, তুমি না খেলে বাঁচবে কি করে।

    মুর্শেদ হাসত। আর তখনই সে তাকাত নীলুর দিকে। অসুখ, নীলু মরে যাবে। অবনীকে সে মেরে ফেলেছে, অবনীকে সে ভেবেছে কলাবরেটর। এখন অবনী এ-দেশের শহীদ। অবনীকে যেখানে মেরে রেখেছিল, সেখানে কখনও কখনও সে গিয়ে রাতের অন্ধকারে বসতে ভালবাসে। আকাশে নক্ষত্র জ্বলে। জ্যোৎস্না রাত থাকলে সে শিশিরের টুপটাপ শব্দ শুনতে পায়। বর্ষাকালে জলে ভেসে গেছে জায়গাটা। সে আর সেখানে এখন যেতে পারে না। সে বলল, মঞ্জুদি, তোমার সেই লোকটা কোথায় গেল!

    —ওরা গেছে দালান বাড়ির দিকটায়।

    —তুমি কিছু বলেছ?

    —না।

    —কবে বলবে?

    —দেখি।

    তারপরেই কেমন আবার ছেলেমানুষ হয়ে যায় মুর্শেদ। কেয়া ভয় দেখাচ্ছে ও আমাকে ধরিয়ে দেবে।

    নীলু বলল, কে তোমাকে ধরিয়ে দেবে মুর্শেদ চাচা।

    —কেয়া। কেয়া আমাকে ধরিয়ে দেবে।

    —পিসি ধরিয়ে দেবে না। পিসি তোমাকে খুব ভালবাসে।

    এবং মুর্শেদ কখনও কখনও এমন ছেলেমানুষ হয়ে যায় যে সে নীলুকেই একমাত্র বিশ্বাসী ভেবে ফেলে। সত্যি যেন কেয়া ওকে ধরিয়ে দিতে পারে। বেয়া ক্ষেপে গেলে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। তাকে তখন পাগল পাগল লাগে। মুর্শেদ কিছুতেই বুঝতে পারে না, এটা ঠাট্টা। নীলুর কথায় সে কেমন গভীর জলে ডুবে যাচ্ছে। কেয়া তাকে ভালবাসে।

    মঞ্জু নীলুকে ওষুধ দেয় তখন। জলটা তখন মঞ্জুর হাতে থাকে।

    মুর্শেদ ডোরাকাটা জামা পাজামা, গালে বাসি দাড়ি, বাসি দাড়ি সকালে মঞ্জুর খুব খারাপ লাগে। সে বলল, যাও দাড়ি কামাও গে। কেয়া ধরিয়ে দিলে দেবে। কি করবে। মঞ্জুও রাগে অথবা ওর ছেলেমানুষীতে বিরক্ত হয়ে এমন বলে ফেলল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
    Next Article মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }