Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈশ্বরের বাগান – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প1863 Mins Read0

    ঈশ্বরের বাগান – ৮৪

    ।। চুরাশি ।।

    তখন একজন মানুষ একটা সবুজ বৃক্ষ বনের ভিতর খুঁজে বেড়াচ্ছে। চারপাশে যা গাছপালা, তাকে বন-জঙ্গল বলাই ভাল। কারণ এখন এ-সব গাছপালায় কোনও যত্নের ছাপ নেই। অবিনাশ কবিরাজের আমলেই এটা হতে থাকে। বিশেষ করে মঞ্জুর মার আত্মহত্যার পর যেন অবিনাশ কবিরাজ কোনও ব্যাপারে তেমন উৎসাহ পেত না। ওদের কবিরাজ বংশ, বাপ ঠাকুরদা একই ভাবে চারপাশ থেকে সব গাছপালা সংগ্রহ করে এনেছে। যেমন অর্জুন গাছ, চন্দন গাছ, দারুচিনি গাছ, হরিতকি গাছ, আমলকি, বয়ড়া যা যা দরকার কবিরাজী মতে সব চারপাশে রয়েছে। এবং নানাভাবে সব গাছপালাগুলি একটা কবিরাজী গন্ধ বাড়ির চারপাশে ছড়িয়ে রাখত।

    সুতরাং জব্বার চাচার কাঁধে কুঠার, তিনি সবচেয়ে তাজা এবং সবুজ বৃক্ষ খুঁজছেন। এখানে এসেই কবিরাজ বংশ শেষ হয়ে গেল! এবং একটা ধারা এ-ভাবে যেন নষ্ট হয়ে যায়। কি হবে আর এ- সব দামী দামী গাছ রেখে। কারণ তিনিও তো আর বেশিদিন নেই। কেয়া এবং মঞ্জু আর তিনি, তিনজনের যা আছে ওতে চলে যাবে। কিছু ফসলের জমি রয়েছে কবিরাজ মশাইর, মঞ্জুর শিক্ষকতা আছে, সব মিলে যখন গাছপালার আর দরকার হচ্ছে না তখন, সেই সবুজ গাছটি তার চাই।

    আসলে জব্বার এই বাড়ির গাছপালার ভিতর আশ্চর্য মমতার সন্ধান পেয়েছিল। কারণ এত যে অকারণ নিষ্ঠুরতা হয়েছে, এবং চোখের ওপর সব দেখেও আল্লার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, কিছু বলতেন না, মঞ্জুকে কারা জিপে নিয়ে যেত, সকালে দিয়ে যেত, ঠিক এমনি প্রথম দিকে কেয়া, এবং কেয়াকে নিয়ে পালালে যেন বদলি হিসাবে মঞ্জু, কোথায় কি হত তিনি জানতেন না, তিনি যেহেতু ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ, এবং এটা যেন এ-বাড়িতে আশ্রয় পাবার পর বেশি তাঁর ধারণা হয়েছে। যখন কেউ আশ্রয় দিতে ভয় পাচ্ছিল, তখন একমাত্র কবিরাজ মশাই ডেকে বললেন, এবার থেকে এখানে, ব্যাস এখানে আর কোথাও যাওয়া হল না। যেন কবিরাজ় মশাই ওকে বলেছিলেন, চারপাশে দ্যাখো জব্বার কত গাছপালা। আমার পূর্বপুরুষেরা এনে লাগিয়েছে। একটা বড় জাবদা খাতা খুললে সব পেয়ে যাবে, কবে কোথা থেকে এ-সব গাছ আনানো হয়েছে, কোনটা বাঁচে নি, কোনটা বড় হতে হতে মরে গেছে, কোনও গাছ বুড়ো হয়ে মরে গেছে সব হিসাব আছে জাবদা খাতায়। আমার তো এখন এ-সব লেখা হয় না, তুই তবু গাছপালাগুলো দেখাশোনা কর। কোনটা কবে মরেছে তার হিসাব দরকার হবে না। কি ভাবে সব বেঁচে থাকে তাই দেখলে হবে

    প্রথম তিনি এ-সবই শুনেছিলেন, অথবা অন্য কিছু হতে পারে। তবে বনের ভিতর একটা তাজা গাছ খুঁজতে গিয়ে আর কিছু মনে করতে পারছেন না। কারণ ওষুধ বানানোর কাজটা বোধ হয় তিনি পরে পেয়েছিলেন। আগে এই সব গাছপালার ভিতর এত বেশি কাজ করেছেন যে, সেই ভাষা আন্দোলনের দিনগুলিতেও কেউ একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে নিলে প্রাণে বড় লাগত। কারণ এখানে আছে প্রচুর বাসকের জঙ্গল, শেফালী গাছ, আনারসের গাছ, গাছের মূল, কেউ কাঁচা হলুদ চুরি করতে এলে ঠ্যাঙ ভেঙ্গে দেবার জন্য ছুটতেন তিনি। কেউ একটা গাছের নিচে আমলকি পেলে বিশ্বাস হত না, আমলকি গাছতলায় পড়ে থাকতে পারে। ওঁর চোখকে ফাঁকি দিয়ে একটা আমলকি গাছতলায় পড়ে থাকবে ওঁর বিশ্বাস হয় না। কেউ কিছু নিলেই ওঁর ভীষণ কষ্ট হত। অর্জুনের ছাল কেউ চুরি করে তুলে নিলে তিনি তেড়ে যেতেন। অথচ সকালে একটা জিপ এসে মঞ্জুকে রেখে গেছে। কেয়াকে পালিয়ে রাখতে হচ্ছে বনে জঙ্গলে। আর মানুষটা তবু গাছপালা পাহারা দিয়ে বেড়াচ্ছে।

    বোধ হয় এ-ভাবে বোঝা যায়, মানুষটার এইসব গাছপালার জন্য বড় মায়া আছে। তবু কত অধীর শোকে, বোঝা যায়, কারণ তিনি সবচেয়ে তাজা গাছটা খুঁজছেন। কি হবে সব রেখে, এবং নীলুর সৎকার শেষে ওঁর মনে হয় এক এক করে সব গাছপালা কেটে ফেলা ভাল। এখানে একজন কবিরাজ বংশ কবে থেকে আবাস তৈরী করেছিল, এখন সে আবাস ছিন্ন ভিন্ন। এবং সে প্রায় শেষদিকে পাহারাদারের কাজ করে গেছে, কোন লাভ হয়নি। নীলুকে সে রক্ষা করতে পারেনি। ঈশ্বরের পৃথিবীতে মানুষ না থাকলে কে আল্লা কার আল্লা! ওর ইচ্ছা সে-জন্য অন্তত নীলুর সৎকারে সবচেয়ে নামী এবং দামী গাছটা কাজে লেগে যাক। শোকের সময় মাথা ঠিক রাখা কঠিন তবু তিনি সতর্ক। পঞ্চমীঘাটে লোক পাঠাতে হবে। দাহকার্যে তন্ত্রমন্ত্র কে পড়বে। কুশ আতপ চাল, ঘি, তিল, তুলসি, তামার পাত্র, মালশা কত কিছু এখন দরকার।

    এই যে পুকুর পাড়ে সর্বত্র যে গাছ তার ভিতর বোধ হয় এখনও একটা চন্দন গাছ আছে। তার ডালপালা বাড়ছে। অনেক আয়াসে জব্বার এটা জিইয়ে রেখেছেন। এখানকার আবহাওয়ায় এ-সব গাছ টেকে না। বর্ষাকালে জলে ডুবে যায় চারপাশ, সেজন্য পুকুরের পাড় খুব উঁচু করে বাঁধানো। তার পাড়ে, এবং একটা নিরিবিলি জায়গায় গাছটা আছে বলে বোধহয় বেঁচে আছে। তার চারপাশে অন্য কোনও গাছ নেই। এমন কি কোন বড় গাছও নয়। তবুও গাছের ডাল রাখা যায় না। একটু বড় হলেই চুরি হয়ে যেত। জব্বার চাচা ভীষণ হিসেবী মানুষ। কেউ গাছটার খবর না পায়। এ-জন্য তিনি চারপাশে বেত ঝোপ তৈরী করেছিলেন। ওটা ডিঙ্গিয়ে যায় মানুষের সাধ্য কি।

    সুতরাং ও-গাছটাই জব্বার চাচার পছন্দ। একটা আম গাছও লাগবে। আমগাছের ডাল যত ভিজে হোক ধরে গেলে জ্বলতে থাকে। এ-নিয়ে পাঁচ-সাত বার তিনি এটা দেখেছেন। প্রমাণ পেয়েছেন তার চেয়েও বেশি। কবিরাজমশাই শেষ বয়সে খুব ভুগে মারা গেছেন। এবং শরীরে জল জমে গিয়েছিল। শুকনো কাঠ ঘরে থাকে না, যে কবে কে মরবে, ঘরে কাঠ থাকবে। তার ওপর বর্ষাকাল তখন, অথচ কি সুন্দর আমকাঠে অবিনাশ কবিরাজের শরীর জ্বলে ছাই হয়ে গেল।

    ডাকবাক্সে যারা চিঠি ফেলতে এসে,ি ওরা দেখল, বারান্দায় নীলুর শরীর সাদা চাদরে ঢাকা। ওরা জানত, এ বাড়ির সুন্দর একটি ছেলে সবসময় ধবধবে বিছানায় শুয়ে থাকে। অনেকদিন ওরা জানালা দিয়ে ওর সঙ্গে কথাও বলে গেছে। কথা পেলে নীলু আর কিছু চাইত না। বাইরের পৃথিবী ওর কাছে স্বপ্নের মতো ছিল বোধ হয়। ওরা ছিল নীলুর কাছে আশ্চর্য জগতের মানুষ। সে জানালায় বসে বসে অনেকদিন দেখেছে সামনের মাঠে জল থৈ থৈ করছে। সে দেখেছে, কত নৌকা, পালতোলা নৌকা সোনালি বালির নদীতে ভেসে যাচ্ছে। সে দেখেছে শহরের বাস পাকা সড়ক ধরে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সে ঠিক টের পায় কখন ডাকঘরের দরজা খোলা হবে। কখনও কেয়া কোলে করে বারান্দায় বসালে সে যেন রাজা হয়ে যেত। সব পাখিরা যেন বুঝতে পারত, একজন দুঃখী ছেলে বারান্দায় বসে আছে। ওরা চারপাশে এসে বসত। ওদের সঙ্গে নীলু ভীষণ গল্প করতে ভালবাসত। কোন কিছুই নীলুর কাছে সাধারণ মনে হত না। যেন নীলু না জন্মালে এই যে সব গাছপালা, পাখি অথবা উত্তরের বড় বটগাছটা, ঠাকুরবাড়ির বড় অর্জুন গাছটা, গাছটার নিচে ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে, ডাকঘরে চিঠির ওপর খটখট শব্দে ছাপমারা ক্রমাগত, সবই অর্থহীন। নীলু আছে বলেই সব কিছু চারপাশের প্রাণ পেয়ে যেত। একটা জগৎ নীলু এখানে তৈরী করেছিল, আজ থেকে সে জগৎটা আর চারপাশে থাকবে না।

    ক্রমে উঠোনে ভীড় বাড়ছিল। খবর হলে যা হয়, চারপাশের গ্রাম থেকে যেই ডাকঘরে খবর নিতে এসেছিল তারা আর যেতে পারল না। ওরা কবিরাজ মশাইর শেষ বংশধরকে দেখতে পাচ্ছে, নিঃশেষ হয়ে গেছে। ওরা ভেবে পেল না, এরপর এতবড় বাড়ি, কবিরাজী ওষুধের প্রয়োজনে যে বনের গোড়াপত্তন, তার আর থাকার অর্থ কি।

    ওরা কেউ বলল, গেল। আর কি মঞ্জুদি এখানে থাকবে?

    কেউ বলল, গ্রামের শেষ হিন্দু বাড়িটি শেষ হয়ে গেল।

    কেউ বলল, আসলে এ-ভাবে সব কিছু কখনও শেষ হয়ে যায়। কেউ কিছু করতে পারে না।

    কেউ বলল, কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক না আমরা জানি না।

    —তার মানে?

    —মানে এই যে সেই কবে থেকে আমাদের বিতাড়ন পর্ব শুরু হয়েছিল, কেবল ঘর ছাড়া হয়েছে সবাই, কেউ ফিরে আসেনি।

    —কেউ ফিরে না এলেও, কিছু শূন্য থাকে না।

    —শূন্য থাকে না, কিন্তু বৈচিত্র্য নষ্ট হয়। এবং এই যে দুনিয়া আল্লা বানিয়েছেন, ওটার ভিতর একঘেয়ে বলে কিছু নেই। আমরা লাঠালাঠি করে ওটাকে এক রকমের বানাতে চাইছি। তখন একজন বলল, আরে ওটা মুর্শেদ না?

    —কোনটা।

    —ঐ যে ধুতি পরে আছে!

    —মুর্শেদ ধুতি পরবে কেন। মুর্শেদ হিন্দু হয়ে গেল নাকি! মুর্শেদ তো শুনেছি নিখোঁজ। কবে থেকে সে ভেগেছে, তাকে তুই কি করে ধুতির ভিতর ন’মাস পরে দেখে ফেললি!

    লোকটা কেমন লজ্জা পেল। সত্যি, মুর্শেদ তো একেবারে পাক্কা মুসলমান, ও ওটা কিছুতেই করতে পারে না। সে একেবারে আহম্মকের মতো কথা বলে ফেলেছে। কট্টর পাকিস্তানী, শালা হিন্দু বাঙ্গালীর পোশাক মরে গেলেও পরবে না।

    সুতরাং ওরা ঠিক করে ফেলল, দেখতে হুবহু মুর্শেদ হতে পারে, তাই বলে লোকটা মুর্শেদ নয় নিশ্চয় মঞ্জুদির বাড়িতে কেউ এসেছে। ধনকর্তার পোলায় আইছে, অর লগে আইতে পারে। ওর বন্ধু হবে, ওরা দেশ ভাগের পর আর আসেনি। এখন বেড়িয়ে যাচ্ছে। দেশের কলাটা মুলোটা খেতে এসেছে। একজন বলল, সব নিয়ে যাবে। মাছের দামতো চড়ে গেল। এবার থেকে আর মাছ খেতে হবে না। সব হিন্দুস্থানে। তোমরা কচু খাবে।

    —সব চলে যাচ্ছে, পাট চা মাছ। তোমরা পাচ্ছ শুধু নকল কয়লা।

    —নকল কয়লা!

    —আরে ও দেশে যা কেউ কেনে না। তোমরা সে সব পাবে।

    এ-সব যদিও এখন অর্থহীন কথা তবুও ভিড়ের মানুষেরা কেউ কেউ এ-সব না বলে থাকতে গারল না। কেয়াকে মঞ্জুদি মানুষ করেছে, এটাও এখন কেমন যেন ঠিক মনে হচ্ছে না। এখন তো

    —মুর্শেদ ধুতি পরবে কেন। মুর্শেদ হিন্দু হয়ে গেল নাকি! মুর্শেদ তো শুনেছি নিখোঁজ। কবে থেকে সে ভেগেছে, তাকে তুই কি করে ধুতির ভিতর ন’মাস পরে দেখে ফেললি!

    লোকটা কেমন লজ্জা পেল। সত্যি, মুর্শেদ তো একেবারে পাক্কা মুসলমান, ও ওটা কিছুতেই করতে পারে না। সে একেবারে আহম্মকের মতো কথা বলে ফেলেছে। কট্টর পাকিস্তানী, শালা হিন্দু বাঙ্গালীর পোশাক মরে গেলেও পরবে না।

    সুতরাং ওরা ঠিক করে ফেলল, দেখতে হুবহু মুর্শেদ হতে পারে, তাই বলে লোকটা মুর্শেদ নয় নিশ্চয় মঞ্জুদির বাড়িতে কেউ এসেছে। ধনকর্তার পোলায় আইছে, অর লগে আইতে পারে। ওর বন্ধু হবে, ওরা দেশ ভাগের পর আর আসেনি। এখন বেড়িয়ে যাচ্ছে। দেশের কলাটা মুলোটা খেতে এসেছে।

    একজন বলল, সব নিয়ে যাবে। মাছের দামতো চড়ে গেল। এবার থেকে আর মাছ খেতে হবে না। সব হিন্দুস্থানে। তোমরা কচু খাবে।

    —সব চলে যাচ্ছে, পাট চা মাছ। তোমরা পাচ্ছ শুধু নকল কয়লা।

    —নকল কয়লা!

    —আরে ও দেশে যা কেউ কেনে না। তোমরা সে সব পাবে।

    এ-সব যদিও এখন অর্থহীন কথা তবুও ভিড়ের মানুষেরা কেউ কেউ এ-সব না বলে থাকতে পারল না। কেয়াকে মঞ্জুদি মানুষ করেছে, এটাও এখন কেমন যেন ঠিক মনে হচ্ছে না। এখন তো ওরা স্বাধীন, কেউ ওদের কেশাগ্র ছুঁতে পারবে না। একেবারে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।

    তখন কুঠারের শব্দ উঠছে। জব্বার চন্দন গাছটা কেটে ফেলছেন।

    ওরা দুজন, অর্থাৎ অতীশ মুর্শেদ বসে আছে দু’পাশে। নীলুর মাথার কাছে। পাশে কেয়া। আরও সব মানুষ জন ক্রমে ঘিরে ফেলছে। চারপাশে তারা আছে। সিঙপাড়া থেকে নৌকা করে এসেছে ছেলে বুড়ো বউ ঝি সবাই। ওরা এখন এ-বাড়ির চারপাশে নানারকম কাজের ভিতর ভিড়ে গেছে। মঞ্জুর ভীষণ উদাস চোখ। সে বসে রয়েছে একটু দূরে। ও যেখানে বসে রয়েছে, সেখান থেকে নীলুর কিছুই দেখা যায় না।

    জব্বার যাদের নিয়ে কাঠ কাটছিল তারা খুব সহজে ফালা ফালা করে ফেলেছে গাছটাকে। চন্দনের কাঠে কিছুক্ষণ পর নীলু শুয়ে থাকবে। সব নিয়মকানুন জব্বার জানে। কারণ এ-বাড়ীর অবিনাশ কবিরাজ এবং অবনী ওর হাতে গেছে। সে জেনে ফেলেছে, কি কি দরকার। সে এখন যারা এসেছে, যেমন সিঙপাড়ার বয়সী বৌটিকে সব বলে যাচ্ছে। ওরাই কাজ করে যাচ্ছে। ওদের অবশ্য কেয়াকে নিয়ে একটা বিরোধ আছে। ওরা চাইত না কবিরাজ মশাইর জেদ এমন ভাবে ধর্মবোধকে আঘাত করুক। তবু বিপদের মুখে মানুষের ধর্মাধর্ম দেখতে নেই খুব মহৎ কিছু ওরা করে যাচ্ছে, এসে উদ্ধার করে দিয়েছে এমন একটা ভাব চোখে মুখে রয়েছে। তাছাড়া যতই এখন আঙ্গুল ফুলে কালাগাছ হোক হিন্দুদের এ-নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে সাহস পাচ্ছে না।

    এ-ভাবেই মানুষেরা বোধ হয় বেঁচে থাকে। সেই আদিম কাল থেকে নিজেদের ভিতর এক অসীম গন্ডিবদ্ধভাব, নিজেদের ছাড়া অন্য সবই ভুল, ঠিক না, এ-যে সে তার নিজের দেশ মাটি এবং গাছপালাকে পর্যন্ত অবিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে। এটা এখন যদিও ভাববার সময় নয়। কারণ মঞ্জুর দুঃখে সবাইকে খুব কাতর দেখাচ্ছে। যে সবচেয়ে কাতর, সেই মেয়ে কেয়া, তার জন্য কেউ ভাবছে না। মঞ্জুকে বুদ্ধিমতী মনে করার কারণ থাকতে পারে, সে তার দুঃখকে কেয়ার সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে।

    যেমন মুর্শেদ এখন কিছুতেই ভাবতে পারে না, সে এদের কেউ নয়। সে যতই চেষ্টা করুক, কিছুতেই ভুলতে পারবে না নীলুর সে আত্মীয় ছিল না। মঞ্জুর সে কেউ নয়। এবং কেয়া যতটা কাছের সে তার চেয়ে কম কাছের কিছুতেই প্রমাণ দিতে পারবে না। এসব দুঃখ মুর্শেদের মুখ চোখ দেখলে বোঝা যায়। সে গোপনে বারবার চোখের জল মুছছে। নীলুর কথা মনে হলেই, সে তখন যেখানেই থাকুক, কোনও মরুভূমির ক্যাকটাসের নিচেও যদি দাঁড়িয়ে থাকে সে না ভেবে পারবে না, এক সুন্দর শৈশবকে সে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে দাহ করেছে।

    অতীশ কেয়ার দিকে তাকালে দেখল, এক রাতে মেয়েটা কি অস্বাভাবিক বদলে গেছে। সেই দরজায় দাঁড়িয়ে বলা, আপনি কাপুরুষ মশাই, এখন সেটা বিশ্বাস করতে পর্যন্ত কষ্ট হচ্ছে। কেয়াকে ভীষণ পবিত্র লাগছে দেখতে। শোকের সময় মেয়েদের ভীষণভাবে পবিত্র দেখায়। সে তো এই যে ছেলে নীলু তার জন্য ভিতরে তেমন কোন কষ্ট পাচ্ছে না। মঞ্জুর জন্য মনটা খুবই খারাপ হয়ে আছে। মঞ্জুর কোনও অবলম্বন থাকল না। মঞ্জু একা নিঃসঙ্গ। আর এমন একটা নিরিবিলি গাঁয়ে মঞ্জু বাকি দিনগুলো কাটাবে কি করে! সে যতই দেরি করে যাক, দশ পনের দিনের বেশি থাকতে পারছে না। কাজ কর্ম মিটলেই সে না হয় যাবে, মঞ্জু কি তখন ওকে কিছু বলবে, বলবে সোনা আমার কি হবে।

    তা ছাড়া অতীশের যে দুঃখটা এখন ভেতরে সেটা কেয়ার জন্য। কেয়া নীলুর জন্য এমন একটা মায়া বুকের ভিতর গড়ে তুলেছে বিশ্বাসই করতে পারে না। মেয়েটার মা নেই, বাবা কোনও কিছু দেখে না, মঞ্জুর অভিভাবকত্বে এ-বাড়িতে বড় হচ্ছে। আর এই মেয়েটা ভিতরে ভিতরে এত বড় হয়ে গেছে যে মঞ্জুও বোধ হয় জানে না।

    সে বলল, কেয়া তুমি বড় হয়েছ। কথা ছিল নীলুর যে অসুখ, সে কখনও বাঁচতে পারে না। এটা মানুষেরই অসুখ। আমরা এ-অসুখটাকে নিরাময় করার এখনও কোন ওষুধ আবিষ্কার করতে পারিনি। তুমি সবই জানতে। তোমাকে বেশি বলারও দরকার হবে না। মানুষ এ-ভাবে মরে যায়। তুমি কাঁদলে মঞ্জু শক্ত থাকবে কি করে। একবার মঞ্জুকে দ্যাখো। আর বলার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল সে খুব হাস্যকর কথা বলে যাচ্ছে। এ সময় এমন কথার কোন মানে হয় না। সে তারপর বলল, এস আমরা নীলুকে অর্জুন গাছের নিচে নিয়ে যাই। ওকে সেখানে দাহ করা হবে, তার জায়গাটি তুমি ঠিক করে দাও।

    বোধ হয় অতীশ এ-ভাবে কেয়াকে অন্যমনস্ক করতে চাইছিল। কারণ এখন ওদের অন্যমনস্ক করার দরকার আছে। জীবন কত অর্থহীন হয়ে গেছে কেয়ার চোখ না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, কেয়াকে স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বকে অত্যন্ত জরুরী ভাবতেই দেখল, মঞ্জুর চোখ শূন্যতায় ভরা। এ চোখ আরও কঠিন। সে ভিতর থেকে কেন যে সায় পাচ্ছে না, মঞ্জুর জন্য সে তেমন কিছু কেন যে ভাবতে পারছে না। এবং এটা সে ভীষণ নিষ্ঠুরতার সামিল ভাবল।

    আর তখনই চন্দনের কাঠ, আমের কাঠ কারা নিয়ে যাচ্ছে মাথায় করে। মঞ্জু দেখছে সব। অতীশের মনে হল, মঞ্জু হয়তো কাঁদতে পারে। না কিছুই হচ্ছে না। মঞ্জু বরং যতক্ষণ ওরা কাঠ বয়ে নিয়ে গেল ততক্ষণ তাকিয়ে থাকল। কাছে যে নীলু আছে, সে যে শুয়ে আছে সাদা বিছানায়, ওর চোখ দুটো যে বোজা, সে যে ঘুমিয়ে আছে দেখলে মনে হয়, তার সে যেন কিছুই জানে না। এমন কি এখন মনে হচ্ছে মৃত্যুর পর নীলুর মুখ মঞ্জু দেখেনি। অবনীর মুখ ই তার বার বার মনে পড়ছে বোধ হয়। নীলুর জন্ম এবং ধর্ষণের ছবিও মনে পড়ছে। এবং শক্ত সামর্থ মানুষ অবনী জোরজার করে কিছু করে ফেলার ভিতর যে নিষ্ঠুরতা আছে তা ভেবে সে আরো নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে।

    অতীশ বলল, মুর্শেদ আপনিও দেখছি ভেঙ্গে পড়ছেন। এ-ভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে কেন। মঞ্জুকে দেখুন। সে কিন্তু কাঁদছে না।

    মুর্শেদ বলল, আমি জানি, আমি গিয়ে পাশে দাঁড়ালে সান্ত্বনার কথা বললে সে আর স্থির থাকতে পারবে না। কিন্তু আমার ভীষণ ভয় হয়!

    —কি ভয়।

    অতীশ হতবাক। আশ্চর্য, মঞ্জুর কোনো শোক সন্তাপ নেই। পুত্রের দাহকার্যের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তাকে বলছে, দেখতো ভট্টাচার্য মশাই কেন এত দেরি করছেন! কতক্ষণ লাগে! সাইকেলে বেশি দূরও না। জব্বার চাচাকে বলছে, কাকে পাঠালেন! তারপর লন পার হয়ে অর্জুন গাছটার নিচে চলে এল। সঙ্গে সে, মুর্শেদ। মানুষ জনের ভিড়। টোডার বাগ থেকে ছলিমুল্লা সাহেব খবর পেয়ে চলে এসেছেন। সবাই ডাক-ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। কেয়া কেবল নড়ছে না। বাসি মড়া না হয়, সে জন্য ঘর থেকে বার করে বারান্দায় নীলুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে।

    মঞ্জু গাছটার নিচে এসে বলল, এদিকটায় রাখা হোক। এখানে সে তার বাবার পাশেই থাকুক সোনার ঠাকুরদাকেও এখানে দাহ করা হয়েছিল।

    অতীশ একটা কথা বলতে পারছে না। পুত্রশোক মানুষকে কতটা বিচলিত করে হাসপাতাল, ইমারজেনশি, ইনটেনসিভ কেয়ার ভাবলেই সে টের পায়, কেমন পাগলের মতো ছুটে গিয়ে বাতিদানটা আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিল। আসলে কি মঞ্জু শেষ খবর পেয়ে গেছে বলে আর বিচলিত বোধ করছে না। না কি সে যথার্থই প্রাজ্ঞ রমণী। অথবা কোনো স্থির সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেনি তো—সে কিছু করে ফেলবে নাতো! কোনও ঘোর থেকে যে করছে না কে বলবে! এক বিন্দু অশ্রুপাত নেই। অতীশ আতঙ্কে মঞ্জুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত সাহস পাচ্ছে না।

    মঞ্জু যেন তাদের নিয়ে মজা করছে।

    —কি ব্যাপার, সোনা চুপচাপ কেন! আমি ঠিক বলিনি। সে তার বাবার পাশেই থাকুক। তোমরা কথা বলছ না কেন? তার বাবা, তার দাদু, তোমার ঠাকুরদা সবাই মিলে নীলু ভালই থাকবে মনে হয়।

    মুর্শেদ বলল, মঞ্জু প্লিজ তুমি যাও। নীলুর পাশে গিয়ে বোস। আমরা দেখছি।

    —এই সোনাবাবু তোমার কি মত!

    —ঠিক আছে।

    অতীশ যেন এখন ছুটে পালাতে পারলে বাঁচে। তার মুখে রা সরছিল না!

    নীলুর দাহ কার্য নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি অতীশকে বিভ্রমে ফেলে দিচ্ছে। এখানেই তার ঠাকুরদার শরীর পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেছিল। পাগল জ্যাঠামশাই অর্জুন গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। সে দেখতে পায় সেই অগ্নি এবং লোমহর্ষক দাহ তাকে ফের গ্রাস করছে। সে সব স্মৃতি। এবং পাগল জ্যাঠামশাই নিখোঁজ হয়ে যাওয়া থেকে, তাদের দেশত্যাগ, অর্জুন গাছে বড় বড় করে লিখে রাখা, জ্যাঠামশাই, আমরা হিন্দুস্থানে চলিয়া গিয়াছি। গাছটা বিশাল ডালপালা মেলে দিয়েছে ঠিক, কারণ শেকড় অনেক গভীরে। গাছের ছাল বাকল তুলে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলা হয়েছে ঠিক, সে তবু দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায়।

    অতীশ বলল, ভট্টাচার্য মশাই এসে গেছেন

    মঞ্জুর সম্বিত ফিরে এল যেন।

    সে ছুটে চলে গেল। চঞ্চলা বালিকার মতো তার গমন। যেন কেউ তার জন্য জলছবির বাক্স নিয়ে এসেছে। সে গিয়ে দ্রুত ঘর থেকে কম্বলের আসন বের করে দিল। তিনি তার বিধান দেবেন! ত্রিপাদ দোষ পেলে কি করা, কিংবা মঘা নক্ষত্রে গেল কি না নীলু, এধরনের কিছু অতিশয় সংস্কার গ্রাস করছে বোঝা গেল। পাঁজি খুলে, মৃতের সঙ্গে সময়ে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। কোনও দোষ পায়নি। শুধু তিনি উচ্চারণ করলেন, ওঁ কেশবায় নম, ওম মাধবায় নম। তারপর তিনি সামান্য কুশ এবং তামার পাত্র থেকে আচমণ পূর্বক মাথায় জল সিঞ্চন করলেন। এই গৃহ এবং নিকটবর্তী সব গাছপালা সমূহকে তিনি পবিত্র করে নিলেন। বললেন, হে মেরুদেশোৎপন্ন জল! তোমরা আমাদের মঙ্গল কর। হে জলোময় দেশোৎপন্ন জল, তোমরা আমাদের মঙ্গলদায়ক হও। হে সমুদ্রোৎপন্ন জল, তোমরা আমাদের মঙ্গলবিধান কর। এবং হে কূপোপন্ন জল, তোমরা আমাদের হৃদয় স্পর্শ কর।

    নীলুকে স্নান করাবার সময় তিনি বললেন, ঘর্মাক্ত ব্যক্তি তরুমূলে বসিয়া যেরূপ ঘর্ম হইতে মুক্ত হয়, স্নাতব্যক্তি যেরূপ শরীরের মল হইতে মুক্ত হয়, ঘৃত যেমন সংস্কার বিধি দ্বারা পবিত্র হয়, সেইরূপ নীলুকে অগ্নি পাপমুক্ত করুক।

    তারপর তিনি বললেন, হে জলসমূহ! যেহেতু তোমরা সুখদায়ক, সেই হেতু তোমরা আমাদের অন্নভোগে অধিকারী কর এবং মহৎ রমণীয় ব্রহ্মার সহিত সংযোজিত কর।

    নীলুর শব তার স্বজাতি ছাড়া স্পর্শ করতে পারে না। কেয়া মাথার কাছে, এটা অনাচার, মঞ্জু বলল, কেয়া তুই উঠে আয়। আমরা ধরছি।

    সে অতীশের দিকে তাকিয়েছিল।

    নীলুর শরীর খুবই হাল্কা। মুর্শেদ দূরে দাঁড়িয়ে। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। অতীশই ডাকল, অনিল মাধব, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। এস। ধর। আশ্চর্য মঞ্জু কোন বাধা দিল না।

    আপাত এই দেশে আত্মরক্ষার্থে মুর্শেদের বাবা নীলমাধব সেন।

    সে অনিলমাধব সেন।

    অনিলমাধব নীলুর মাথাটা আলগা করে ধরতেই সে বালকের মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

    অতীশ বলল, না না, এটা কি হচ্ছে, আরে এখন কান্নার সময়! অতীশ একদিকে, মঞ্জু একদিকে, মাথার দিকে মুর্শেদ। হরিবল।

    মুর্শেদ তাকিয়ে থাকল।

    মঞ্জু এবং অন্য যারা ছিল তারা রীতি অনুযায়ী হরিবল ধ্বনি দিয়েছিল—হিন্দুদের শব এ-ভাবেই দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও বামুন ঠাকুর শবের অনুসরণরত। হাতে তাম্রপাত্র, জল, কুশাগ্রে জল—তিনি মৃতের অনুসরণ করছেন, আর জল সিঞ্চন করছেন কুশাগ্রে।

    আর বলছেন, মহা প্রলয় সময়ে কেবল ঘৃত ও সত্যস্বরূপ পরম ব্রহ্মই ছিলেন—তখন রাত্রি অর্থাৎ সমস্ত জগৎ গাঢ় অন্ধকারময় ছিল।

    তিনি কুশাগ্রে জল সিঞ্চন করছেন।

    তিনি বললেন, তারপর সর্বতোভাবে ফলন্মোথ অদৃষ্ট বশত অর্থাৎ পূর্বকল্পস্থিত জীবগণের প্রাক্তন কর্ম বশত প্রথমে জলময় সমুদ্র উৎপন্ন হইল। অতঃপর সেই জলময় সমুদ্র হইতে প্রকাশমান জগতের নির্মাণে সমর্থ ব্রহ্মা আবির্ভূত হইলেন। তিনি যথাক্রমে সূর্য ও চন্দ্রকে সৃষ্টি করলেন—দিন রাত্রি হইতে লাগিল। দিন রাত্রি হওয়ায় সংবৎসর সৃষ্টি হইল। অনন্তর ব্রহ্মা পৃথিবী, আকাশ, স্বর্গ এবং মহঃ প্রভৃতি লোকের সৃষ্টি করিলেন।

    মঞ্জু, অতীশ সেই কথা সমূহ মনে মনে স্মরণ করছে।

    কেবল মুর্শেদ মনে মনে বলছে, কেমন করে তোমরা আল্লাহতে অবিশ্বাস কর, যখন তোমরা ছিলে মৃত আর তিনি করলেন জীবিত? পুনরায় যিনি তোমাদের মৃত্যু দেবেন, আর পুনরায় জীবিত করবেন, তখন ফিরিয়ে আনা হবে তোমাদের তাঁর কাছে।

    তারপর ফের মুর্শেদ জপ করছে, তিনিই তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তারপর তিনি ফিরলেন অন্তরীক্ষের দিকে আর তৈরি করে তুললেন সাত আকাশ। আর তিনি জ্ঞাতা সব কিছুর।

    আশ্চর্য এক ঘোরে পড়ে যাচ্ছে অতীশ। সে দেখতে পাচ্ছে মুর্শেদের পাশে আর এক নারী! কে সে! কে, কে। প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল—তারপরই মনে হল যেন খুবই চেনা। বনি। সেই চুল, সেই আশ্চর্য গভীর চোখ এবং সে অতীশকে যেন বলছে, প্রেইজ গড ফর এভার! হাউ হি মাস্ট রিজয়েস ইন অল হিজ ওয়ার্ক। দ্য আর্থ ট্রেমবেলড্ অ্যাট হিজ গ্ল্যান্স। দ্য মাউন্টেস বার্স্ট ইনটু ফ্লেম অ্যাট হিজ টাচ। ইউ উইল সিঙ টু দ্যা লর্ড অ্যাজ লঙ অ্যাজ ইউ লিভ। ইউ উইল প্রেইজ গড টু ইয়োর লাস্ট ব্রেথ। ছোটবাবু প্লিজ প্রেইজ হিম। হি ইজ দ্য সোর্স অফ অল ইয়োর লাইফ এ্যান্ড ডেথ। আই থিংক ইয়ো উইল প্রেইজ হিম হেলেলুজা!

    তখনও সেই মন্ত্রোচ্চারণ চলছে। অতীশ শুনতে পাচ্ছে—যিনি সূর্যমণ্ডল মধ্যবর্তী-তেজের প্রাণস্বরূপ, সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়কারিণী শক্তির আধারস্বরূপ, যিনি জন্মমৃত্যু দুঃখাদি বিনাশের নিমিত্ত উপাস্য সেই পরব্রহ্মকে আমরা চিন্তা করি। তিনিই জগতের কারণস্বরূপ, জলস্বরূপ—তৃণ বৃক্ষ ওষধী প্রভৃতির অন্তরে রসরূপে অবস্থিত। তিনিই মনুষ্য পশু পক্ষী কীট প্রভৃতি জঙ্গমের হৃদয়ে চেতনাস্বরূপ বিরাজমান তিনিই ত্রিগুণাতীত পরমেশ্বর এবং তিনিই পৃথিবী, আকাশ ও স্বর্গ এই ত্রিলোকস্বরূপ

    নীলুকে ঘিরে তখন অগ্নি সর্বভূতে বিরাজমান

    মঞ্জু ব্রতকথা শোনার মতো হাতে যেন ধান্য দূর্বা নিয়ে বসে আছে। চিতাগ্নির দিকে তার চক্ষু স্থির। অপলক। বীজস্বরূপ আধার অগ্নিস্বরূপ কালাধারে ভস্মীভূত হচ্ছে।

    .

    ।। পুনশ্চ।।

    তারপর দিন যায়, বয়স বাড়ে। ঘরবাড়ি থেকে ক্রমে আলগা হয়ে পড়ি। আরও দিন যায়, বয়স বাড়ে। বাবার মৃত্যুসংবাদ আসে। বাড়ি গেলে টের পাই, আমাদের এক সময় কিছু ছিল না। বাবা সম্বল ছিল। এখন আমাদের সব হয়েছে, ঘরবাড়ি গাছপালা। কেবল আমাদের বাবা নেই।

    কিছুদিন থেকে মার একটা চিঠি পাচ্ছি। তাতে একটাই অভিযোগ—বিলু তুই আসছিস না। গাছটা ওরা কেটে ফেলবে বলছে। সময় করে উঠতে পারছি না। সাংসারিক ঝামেলা চাকরির ঝামেলা এবং স্ত্রীর অসুখ-বিসুখ যাচ্ছে। রোজই ভাবি দু দিনের সময় হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। মার চিঠিতে এমন অভিযোগ কখনও বড় থাকে না। একটা গাছের জীবন রক্ষা মা’র কাছে এত জরুরী হয়ে পড়েছে যে নিজের অভাব অনটনের কথাও লিখতে ভুলে গেছে। নবমীর জমিজমা কবেই খাস হয়ে গেছে। সরকার দখলও করে নিয়েছে। সেখানেও লোকজন বসে গেছে।

    পিলু নিজের সংসার এবং চারটি পুত্র কন্যা নিয়ে বিব্রত। তার কাছে মা-র আর প্রত্যাশার কিছু নেই। প্রত্যাশার কথা বললে উল্টো এমন চাপ আসে যে মাকেই চিন্তায় পড়ে যেতে হয়। এই চিন্তার ফল হচ্ছে পিলু তার বড় মেয়েটিকে মা’র কাছে শেষ পর্যন্ত গছিয়ে দিতে পেরেছে। ছোট থেকে মাই বড় করেছে। কাছাকাছি থাকলে যা হয় মা-র এখন তার নাতনি সম্বল করে বাবার ঘরবাড়ি পাহারা দিচ্ছে। পাহারা দিচ্ছে না, এরই মধ্যে এক নতুন জীবন কিংবা বলা যায় বাবার স্মৃতিসৌধ আগলাচ্ছে বোঝা কঠিন। কিছুতেই তাঁকে ঘরবাড়ি থেকে আলাদা করে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারছি না।

    এই নিয়ে আমার স্ত্রীর একটা ক্ষোভ আছে। তার ধারণা মা’র সঙ্গে আমার শুধু টাকার সম্পর্ক। এমন কি আমার অসুখ-বিসুখেও মা বিচলিত হয় না। একবার প্রস্টেট সংক্রান্ত চিকিৎসায় হাসপাতালে থাকাকালে মা একদিনের জন্য এসে থেকে দেখে গেছে। সেখানে তাঁর কী যে রাজসূয় যজ্ঞ চলছে আমার স্ত্রী সেটা ভেবে পায় না। একবার মাত্র মাস তিনেক কলকাতার বাড়িতে এক টানা রাখা গেছিল। চোখের যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে এক সময় মনে হয়েছিল বোধ হয় কলকাতায় না গেলে সারবে না। তার ছোট নাতি ডাক্তারি পড়ে। সে ঠাকুমার নিরাময়ের কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারবে এমন ধারণার বশবর্তী হয়েই তার চলে আসা। আমার ছোট পুত্র অর্থাৎ তার নাতিটির দুষ্টু বুদ্ধি পাকিয়েছিল। সে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ঠাকুমাকে দেখাল ঠিক, কবে যেতে পারবে বাড়িতে তা বলতে পারল না। আসলে ঠাকুমাকে কাছে রাখার জন্য কেবল সময় নিতে থাকল।

    মা কিছু বললেই নাতিটি বলত, আবার দেখবে বলেছে।

    কবে দেখবে?

    ছোট নাতি বলেছিল ডাক্তার জানাবে। সময় হলেই জানাবে।

    সেই সময়টাতে মা দোতালার বারান্দায় বসে কেবল বাড়ির কথা বলত। বাড়িতে গাছপালা কত কে কোনটা না নষ্ট করে। আমার ছোট দুই ভাই একই বাড়িতে থেকেও দুই ভিন্ন গ্রহের মানুষ। মা যে তাদেরও মা এটা আর তাদের আচরণে বোঝা যায় না। বাড়িটা যেহেতু পাঁচ বিঘার উপরে, সামনের দিকের অংশ ছোট ভাইকে দেওয়া হয়েছে। পিলুকে দেওয়া হয়েছে বাড়ির শেষের দিকের কিছুটা জায়গা। মাঝখানটায় বাড়িটার তিন-চতুর্থাংশ জায়গা নিয়ে এবং ভরভরতি গাছপালা নিয়ে মা’র পৃথিবী। এই ভাগটাগ করার সময় একটা শর্ত ছিল মা যতদিন বেঁচে থাকবে বাড়ির গাছপালায় কেউ হাত দিতে পারবে না। ফলপাকুড় যা হবে সব মা’র। হাত ধরে দিলে খাবে না দিলে খাবে না। দু ভাই বিষয়টা নিয়ে কোন গোল পাকায়নি। ভাইরা এক অন্নে থাকতে রাজি ছিল না। ঝগড়া বিবাদ যখন চরমে তখনই মা’র চিঠি। চিঠি পেয়ে বাড়ি এবং জায়গা দেখিয়ে দিয়ে আমার আবার চলে আসা। ওরা যেহেতু আর্থিক দিক থেকে খুব একটা সচ্ছল নয় সে জন্য ঠিক থাকল মা যতদিন বেঁচে থাকবে, বাড়ির গাছপালা সহ উত্তরের জমি মা-র দখলে থাকবে। মাসান্তে আমার পাঠানো টাকা এবং গাছপালার আয় নিয়ে সংসারে কোথাও মা-র আটকে থাকবে না এমন একটা বোধ থেকেই কিছুটা নিশ্চিন্ত হওয়া গেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়টা এভাবে একটা আবর্ত সৃষ্টি করবে বুঝতে পারিনি। কারণ শেষ পর্যন্ত যে যার হিসাব বুঝে নেবার জন্য বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

    এই ভূমিকা আমার উপন্যাসকে বোঝার জন্য। গল্পটা শুরু করা যেতে পারে। এর আগে আরও দু-একটা কথা বলিনি। গল্পটা বুঝতে সুবিধে হতে পারে। আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য দায়ে অনাদায়ে আমিই ছোটভাইদের ভরসা। সে জন্য কোন ঝগড়া বিবাদে আমার সালিশিই শেষ কথা। গাছটা ওরা কেটে ফেলবে, ওরা বলতে কাকে বোঝাচ্ছে জানি না, বাড়ি গেলে টের পাব।

    এখন বাড়ির কথা।

    শহর থেকে মাইল দুই তিন দূরে স্টেশন থেকে রিকশায় গেলে বাড়িটা পাওয়া যায়। বাদশাহী সড়কের পাশে আগে যেখানে পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল এখন সেখানে এম আই টি কলেজ। ঠিক তার পেছনটাতেই আমাদের বাড়িঘর। ত্রিশ বত্রিশ বছর আগে গভীর বনজঙ্গল ছিল এই জনপদ কে বলবে। আমার বাবা যে সাংসারিক মানুষ ছিলেন না সে বিশ্বাস এখনও মা’র অটুট।

    বাবার কোন এতে যেত আসত না—কারণ বাবার কাছে মা যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা—সুতরাং মা’র রাগ পড়ে গেলেই যে ফের বাড়ি এসেই অধিষ্ঠান হবেন তাতে বাবার কোন সংশয় ছিল না। শেষদিকে রাগ কিংবা অভিমান বলা চলে, বাবার উপর এতই বেশি যে কখনও কখনও না বলে না কয়ে মায়ার বাড়িতে, কিংবা আমার কলকাতার বাড়িতে এসে মা উঠত। মার ধারণা, বাবাকে আজীবন সবাই ঠকিয়েছে, হেলাফেলা করেছে। সবই হয়েছে বাবার নির্বুদ্ধিতার জন্য। বাউন্ডুলে স্বভাবের জন্য সংসারে যে চরম দারিদ্র্য ছিল সেও বাবার অসংসারী মনোভাবের জন্য। অর্থাৎ এক কথায় মা-র কাছে বাবা ছিলেন একজন অনাসৃষ্টিকারী মানুষ। গাছপালা লাগানো বাদে মানুষটার জীবনে আর কোন সখ ছিল না। উদ্যোগী হলে মানুষের কী হয় না! কার কোথায় কী গাছের ফল মুখে লেগে রয়েছে বলে, তার কলম করা থেকে তার রোপণ এবং সেবাযত্ন ছাড়া জীবনে আর কিছু বুঝতেন না। সংসার ভেঙে গেল কী থাকল তাতে তাঁর কিছু আসত যেত না। এই নিয়ে বাবার উপর মা’র চরম গঞ্জনা ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। বাবা কিছু বললেই বলত, ছেলেরা তোমার সব বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ। যা লাগিয়ে গেলাম, জীবনেও তারা বেইমানি করবে না। এই করে বাবা মাকে যেন তখন আরও বেশি করে ক্ষিপ্ত করে তুলে মজা দেখতেন।

    এখন আর আমার বাবা নেই। বাবার বাড়িটা আছে। আর অসংখ্য গাছপালা জঙ্গল সাফ করে পাঁচ বিঘে জমিতে হেন গাছ নেই যা লাগিয়ে যাননি। আগের ঘরবাড়িও ছন্নছাড়া। পিলু এখন আর সে পিলু নেই। দাদারে বলে সেই যে সুমার মাঠে দাঁড়িয়ে ডাক তা আর বাড়ি গেলে শোনা যায় না। পিলু পুনু। আমার মেজ আর ছোট। দুজন দুই মেরুর বাসিন্দা। গাছটা ওরা কেটে ফেলবে এই একটা লাইনই চিঠিতে বার বার ভেসে উঠছে।

    বাড়ি পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। শরতের আকাশ নির্মল। একটু শীত শীত পড়েছে। রাস্তাটা আমার বড়-চেনা। যেন কত কাল পার হয়ে আবার একই রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছি। মা’র চিঠির উদ্বেগের চেয়েও আমার এই নিজের কাছে বার বার ফিরে আসার মধ্যে কেমন এক স্বস্তি থাকে। চারপাশে আগের মতো আর শস্যক্ষেত্র নেই। করাত কলটা কবেই হয়েছে। আরও সব নতুন ঘরবাড়ি। পঞ্চাননতলায় দোকানপাট, গমের কল। সবই বদলাচ্ছে। আগে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের বাড়ি এবং একটা কালীমন্দির বাদে রেল-লাইন পার হলে কিছুই চোখে পড়ত না। মাঝে মাঝে বড় বড় আমবাগান, বাগ্দিদের ছোট কুঁড়েঘর এবং দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ ক্রমশ মানুষের ঘরবাড়ি উঠে জায়গাটার সেই পুরানো মাহাত্ম্য যেন একেবারেই নষ্ট করে দিয়েছে।

    বাড়িতে ঢুকে অবাক। আগে রিকশা থামলেই ভাইঝিটার গলা পেতাম, ঠাকুমা বড়জেঠু এয়েছে। পুনুর ঘরটা রাস্তার পাশে। পুনুর ছেলেটা দৌড়ে আসত উলঙ্গ শরীরে। প্যান্ট জামা জোরজার করে পরিয়ে রাখতে হয়। আমি গেলে তার একটাই প্রশ্ন, জেঠু আমার জন্যে কি এনেছ? সেও নেই। বৌমা বের হয়ে প্রণাম করে তার দেখাও নেই। মা’র সাদা ধবধবে চুল। এখনও ঋজু শরীর। বার্ধক্য এতটুকু নোয়াতে পারেনি। হাতে এদিক ওদিক কিছু কাজ থাকে। কাজ ফেলে বড় পুত্রটি যে তবে সত্যি এসেছে যেন বের হয়ে দেখা। কেবল দেখলাম একটা গরুর গাড়ি এবং সেই সুস্বাদু সাদুল্লা আমগাছটি নেই। তার কান্ড আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন ডালপালা কেটে গাড়িতে বোঝাই করা হচ্ছে। গাড়োয়ান এবং তার লোকজন আমাকে দেখছে বিস্ময়ের চোখে। ধনঠাকুরুণের এমন লায়েক শহুরে ছেলে তাদের বোধহয় বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। গাছটা নেই। বাবা গাছটার নিচে বসে কতদিন যজমানদের কাজ কামের লিষ্টি করে দিয়েছেন। একটা গাছ না থাকলে বাড়িটা কি শ্রীহীন হয়ে যায় এই প্রথম টের পেলাম। মা’র আশঙ্কা তবে ঠিক। গাছটা পুনুর সীমানার মধ্যে। বোধ হয় সে গাছটা কেটে বিক্রি করে বাবার একজন যথার্থ উত্তরাধিকার প্রমাণ করতে চেয়েছে।

    বাবার করা চার ভিটায় চারটা ঘরও এখন নেই। ঠাকুরের নামে কিছু জমি এখনও আছে। জমির লোভে পিলু ঠাকুরকে নিয়ে তার বাড়িতে তুলেছে। টিনের বেড়া দিয়ে ফুল জল দেয় এবং জমি ভোগ করে। ঘরটার দরজা ভেজানো। ডাকলাম, মা। কোন সাড়া পেলাম না। দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। দেখি ভাইঝিটা শুয়ে ঘুমোচ্ছে। বললাম, কীরে কোনো সাড়া শব্দ নেই। মা কোথায়।

    চোখ মুছতে মুছতে উঠে বসল। তারপর ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলল।

    —কী হয়েছে!

    —ঠাকুমা রাগ করে কোথায় চলে গেছে।

    —বলিস কী!

    —সকালে উঠে দেখি নেই।

    —মায়ার বাড়িতে গেছে কি না!

    —না যায় নি। পিসি বলল, আপনার ওখানে হয়ত গেছে।

    যেতে পারে। মা একা আমার বাড়ি যেতে পারে। আগেও গেছে। সকালের ট্রেনে যদি যায়, এখন হয়ত পৌঁছে গেছে। চিঠির জবাব দিইনি বলে ক্ষেপেও যেতে পারে। আমার মাকে সেই কবে থেকে দেখছি বড় জেদি। কিন্তু যদি না যায়।

    বললাম, কী হয়েছে। হঠাৎ না বলে চলে গেল।

    —কাল খায়নি কিছু। সারাদিন কান্নাকাটি করেছে।

    একটা গাছের জন্য মা’র এত মায়া আমারও কেমন চোখে জল এসে গেল। তোরা মানুষ না! পুনু তুই বুঝলি না। গাছগুলো বাবার স্মৃতি। মা আর ক’দিন। তারপরই মনে হল, পুনু তুই পারলি!

    ভাইঝিটা কল থেকে জল তুলে আনছে। বাড়ি এসেই বারান্দায় একটা হাতল ভাঙা চেয়ারে আমি বসি। বাবাও এখানে বসে থাকতেন সব সময়। যতবার বাড়ি এসেছি, দেখেছি তিনি খালি গায়ে বসে আছেন। পায়ে একজোড়া খড়ম। আর সুযোগ পেলেই মা’র নামে নালিশ। তোমার মা’র বড় বেশি অভাব। টাকা পয়সার দরকার সবার। তোমার হয়ে বেশি হলে তো দেবে। তোমার সংসার আছে, ছেলেপুলে মানুষ করা আছে—কত দায়। সংসারে টানাটানি পড়লেই খোঁটা দেবে, বোঝ সব তোমার কেমন সুপুত্তুর। শেষ বয়েসে একটু দুধ পর্যন্ত জোটে না। যে মা বাবাকে এক খোঁটার উপর রাখত তারই একটা গাছ কেটে ফেলায় সারাদিন কিছু খায়নি, সকালে কোথায় বের হয়ে গেল না বলে না কয়ে। আমার হাত মুখ ধোওয়ার কথা মনে থাকল না। পুনু পিলুর এখন বাড়ি থাকার কথা না। একজনের অফিস, অন্যজনের দোকান। এ ছাড়া মনে হল মা যে না বলে না কয়ে কোথা গেল, সে জন্যও ভাবনা নেই তাদের তেমন। কোথায় আর যাবে, গেছে বড়দার কাছে নালিশ দিতে এই আপ্তবাক্য সার করে বোধহয় নিশ্চিন্তে নিজেদের কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে আছে।

    ডাকলাম, বৌমা!

    ছোট বৌ জড়সড় হয়ে এসে দাঁড়াল।

    —মা কোথায় গেছে জান?

    ঘোমটার আড়াল থেকে বলল, না।

    পুনুর ছেলেটা কেমন আমার দিকে ভয়ের চোখে তাকাচ্ছে। সে তার মা-র হাঁটু জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তালপাতার একটা বই করে দিয়েছে পুনু। ওতে অ আ ক খ লেখে। স্কুলে যায় একটা পাঁউরুটি পাবে বলে। বৌমার শাড়ি সায়াও মনে হল তালিমারা। বললাম, পুনুর দোকান কেমন চলছে?

    ছোট বৌ কিছু বলল না। ভাল চলছে না বলতেও বোধহয় সাহস পেল না। গত বছর পুনু দোকান চলছে না, কিছু নগদ টাকার দরকার এই সব অজুহাত দেখিয়ে বেশ কিছু টাকা আমার কাছ থেকে নিয়ে এসেছে। এরপরও দোকান যদি ভাল না চলে তার দায় নিতে যেন বৌমা রাজি না। এ-সব কথায় না থাকাই ভাল। বললাম, মা তোমাদের কিছু বলে গেছে?

    —মা আমাদের সঙ্গে কথা বলে না।

    মার এই দোষ। ক্ষেপে গেলে মাথা ঠিক রাখতে পারে না। এই পুনুকে নিয়েই এক সময় আমার সঙ্গে কত অশান্তি গেছে। যেখানে যখন গেছি সঙ্গে নিয়ে গেছি পুনুকে। পুনু আর আমার বয়সের তফাৎ অনেক। ওর বৌদি পুনুর জন্য আলাদা মাস্টার, আলাদা দুধ রেখেছে। কিন্তু যে পড়াশোনা করবে না তাকে পড়ায় কে? সামান্য ছোটখাট অজুহাতে পুনুকে নিয়ে মা’র অশান্তি ছিল চরম। সেই পুনু এখন বাবার সেই দশ ক্রোশ থেকে বয়ে আনা, শুধু কি বয়ে আনা, জীবনের অন্য অনেক গভীর অতল রহস্য—বলা যায় বাবার যৌবনকালের এক সঙ্গী সেই গাছ—তাকে হত্যা করেছে। বললাম, বৌমা পুনু এটা ঠিক কাজ করেনি।

    বৌমাটি আমার পায়ে গড় হল। চোখে জল। দারিদ্র্য মানুষের কত বড় অভিশাপ টের পেলাম। আসলে পুনু চোখের সামনে কোনো কুলকিনারা দেখতে না পেয়েই হয়তো গাছটা বিক্রি করে টাকা নিয়েছে। ডাকলাম, এই কুন্তল, চল তোর খ্যাপা ঠাকুমাকে খুঁজতে বের হই। সঙ্গে সঙ্গে কুন্তলের চোখ থেকে ভয় সরে গেল। সে ওর মাকে বলল, প্যান্ট পরিয়ে দাও মা। জেঠুর সঙ্গে যাব।

    বললাম, রসগোল্লা খাবি।

    —হ্যাঁ খাব।

    কুন্তলের হাত ধরে বের হতেই ভাইঝিটি বলল, খেয়ে বের হন।

    না, দেখি আমার মা আমাদের ফেলে কোথায় গেল! কোথায় যেতে পারে।

    কিছু গাছগাছালি পেরিয়ে পিলুর বাড়ি। গাছপালার ছায়ায় আমরা দু’জন কেমন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে গেছি। কুত্তলকে বললাম, তোর ঠাকুরদা এ-সব লাগিয়ে গেছে। বলে গেছে, আমার নাতিরা বড় হলে খাবে। জাম, জামরুল, সফেদা, কাঁঠাল, নারকেল, কাগজি লেবু, বাতাবি লেবু, লিচু কী নেই যা বাবা তার সন্তান-সন্ততিদের জন্য লাগিয়ে যান নি। বাবা বোধহয় ভেবেছিলেন, সব কিছুর ক্ষয় আছে, কেবল এই গাছগাছালির ক্ষয় নেই। না কি বাবা বুঝেছিলেন, গাছই মানুষের একমাত্র সঙ্গী। সে জীবনেও বেইমানী করতে জানে না।

    পিলুর বাড়ি এসে ডাকলাম, পিলু ফিরে এয়েছে? পিলুর সেজ মেয়েটা ঘর থেকে বের হয়ে আমাকে দেখল, ভিতরে গিয়ে ওর মাকে কি বলল, তারপর ছুটে এল আমার কাছে। আমাকে প্রণাম করে বলল, জান ঠাকুমা না তোমাদের সবার উপর রাগ করে কোথায় চলে গেছে।

    আমার এখন কাজ মাকে খোঁজা। এত কাজ আমার, চিঠিটার জবাব পর্যন্ত দিইনি। নিজের স্বার্থপরতার কথা ভেবেও বড় কষ্ট হল। আমরা কেউ মানুষ না। মার কথা মনে রাখি না। নেপাল গোপালেরা পাশের সীমানায়, সেখানেও খোঁজ করা গেল। কাছাকাছি আত্মীয়স্বজন এমনকি মায়াদের বাড়ি গেলাম। মায়ার দৃঢ় ধারণা মা আমার কাছেই চলে গেছে। ফিরতি ট্রেনে যে যাব তারও উপায় নেই। রাতে ট্রেন। পরদিন সকালের ট্রেন ছাড়া যেতে পারছি না। নিজের স্বার্থপরতার কথা ভেবে মাঝে মাঝে আমারও চোখে জল চলে আসছিল। আসলে মাকে আমরা আর কোথাও নিয়ে যেতে পারি না। বাড়ির গাছপালার মতো মাও এই জমিতে বাবার স্মৃতি অবলম্বন করে শেকড় চালিয়ে দিয়েছে গভীরে। সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে পুনুর মত আর একটি গাছকে হত্যা করা।

    রাস্তায় কুন্তলকে পেট ভরে রসগোল্লা খাওয়ালাম। সে কেবল ঠাকুমার কথাই বলছে। ওর মা ঠাকুমার কোনো দেওয়া জিনিস খেতে দেয় না। আরও কত নালিশ মার নামে। আমি বললাম, সবই বাবা একটা বয়সে, আর একটা বয়সে এরা কেউ তোমার না। তুমি তোমার নিজের। তোমার গাছ তোমার মধ্যে বড় হচ্ছে। সে নিজের মর্জিমতো শেকড় ছড়ায়। আমরা কেউ তার হয়ে কিছু করতে পারি না।

    রাত হয়ে গেল ফিরতে। ভাইঝিটা একা থাকবে ভয়ে পাশের বাড়ির একটা মেয়েকে সঙ্গে শুতে বলেছিল। সেও এসেছে। আমি আসায় তার একা থাকার ভয়টা নেই। সে ওকে বাড়ি চলে যেতে বলেছে। বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে আছি। দুশ্চিন্তা। কোথায় গেল আমাদের মা। আমার কাছে! তাই যেন হয়। মা’র জন্য এভাবে ভেতরে কতদিন যেন আমার এমন তোলপাড় হয়নি। ভাইঝিকে খাওয়াদাওয়ার পর বললাম, বারান্দায় বিছানা করে দিতে। ঘরের জানালা ছোট, কেমন এখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট। অভ্যাস সব। এ-ঘরেই আমার কৈশোর প্রাক যৌবন কেটেছে। এখন একটু বেশি বড় জানালা শিয়রে থাকায় নতুন এক অস্বস্তি। তবু ঘুম আসছিল না। আসবে না। মা বাড়ি না থাকলে এতবড় শূন্যতা পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় আগে কখনও টের পাইনি।

    বেশ রাত হয়েছে। গাছপালাগুলি হাওয়ায় দুলছে। কত রকমের পাখি আসে বাড়িটাতে। বাবা বলতেন মানুষের বসবাসের জন্য চাই গাছপালা পাখি। মানুষ থাকবে, গাছপালা থাকবে না, পাখপাখালি থাকবে না সে কী করে হয়। সংসারে সবচেয়ে বড় অভাবের দিকটাতেই ছিল তাঁর আজীবন লক্ষ্য। মা শেষ বয়সে সেটা টের পেয়ে অভিমানে কোথায় যে চলে গেল!

    আর এ-সময় মনে হল জ্যোৎস্নায় কাটা গাছটার গুঁড়ির পাশে কেউ বসে আছে। সারাক্ষণ মনটা মা মা করছে বলে এমন একটা দৃশ্য চোখে ভেসেও উঠতে পারে। উঠে বসলাম। সাদা ধবধবে জ্যোৎস্নায় আরও অধিক সাদা কিছু উবু হয়ে বসে কী যেন হাতড়াচ্ছে। দৌড়ে গেলাম। দেখি মা আমার গাছটার গুঁড়ির পাশে বসে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মা বাড়ি ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারেনি। বললাম, মা আমি।

    আমার মা লুটিয়ে পড়ল কাটা গাছটার গুঁড়ির পাশে। একটা কথাও বলতে পারলাম না। নিজেকে বললাম, মা তুমি বড় বৃক্ষ। দাঁড়িয়ে আছ ডালপালা মেলে। ফুল ফোটে। ফল ধরে। হাওয়ায় কে কোথায় সব বীজ উড়িয়ে নিয়ে যায়। জল পড়ে। শস্য দানার মতো তারাও মাটির নিচে শেকড় চালিয়ে দেয়। বড় দূরের হয়ে যায় সব কিছু। সারা পৃথিবী জুড়ে কত গাছপালা, ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে তারও ফুল ধরে ফল হয়। আবার ঝড়ো হাওয়ায় বীজ উড়িয়ে কোন এক সুদূরে নিয়ে যায়। আমরা তোমার সেই বীজ উড়ে গেছি।

    সমাপ্ত

    ।। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে সিরিজ সমাপ্ত ।।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
    Next Article মানুষের ঘরবাড়ি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    অগ্রন্থিত লেখার সংকলন – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    বন্দিনী – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

    August 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }