Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কিরীটী অমনিবাস ১১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত এক পাতা গল্প468 Mins Read0

    ০১. তখনও সানাইয়ে বাজছে মধুর ইমন কল্যাণ

    তখনও সানাইয়ে বাজছে মধুর ইমন কল্যাণ। মধ্যরাত্রির স্তব্ধতায় সানাইয়ের ক্লান্ত রাগিণী মিলন-রাত্রির কথাই জানিয়ে দিচ্ছিল।

    নিমন্ত্রিতের দল একে একে চলে গিয়েছে। শূন্য বিরাট প্যাণ্ডেলটায় জ্বলছে চোখ-ধাঁধানো শক্তিশালী বিদ্যুত্বাতিগুলো। সারি সারি তখন সাজানো রয়েছে টেবিল-চেয়ারগুলো। এখানে-ওখানে ফুলের মালা আর ছিন্ন পাপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে, উৎসবের চিহ্ন।।

    সন্ধ্যার আগে থাকতেই সারি সারি যে গাড়িগুলো বাড়ির সামনের রাস্তাটায় ভিড় করেছিল, সেগুলো আর এখন নেই, রাস্তাটা একেবারে খালি।

    কেবল বাড়ির সামনে রাস্তার উপরে এঁটোপাতা-কাগজ-গ্লাস-প্লেটগুলো নিয়ে গোটা দুই কুকুর মহোৎসব লাগিয়েছে। আর কিছু ভিখারী—তারাও যোগ দিয়েছে সেই ভোজন-উৎসবে।

    বাড়ির সবাই প্রায় তখন ক্লান্ত, কেউ কেউ শোবার ব্যবস্থা করছে।

    বাড়ির কর্তা শিবতোষবাবু তাঁর শয়নঘরে পাখার হাওয়ার নীচে বসে একটা সিগারেট টানছিলেন।

    হঠাৎ একটা দীর্ণ চিৎকার যেন সানাইয়ের রাগিণী ছাপিয়ে শিবতোষবাবুর কানের গোড়ায় এসে আছড়ে পড়ল। জ্বলন্ত অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা আঙুলের ডগা থেকে খসে নীচে পায়ের কাছে কার্পেটের উপর পড়ে গেল শিবতোষের।

    চিৎকারটা একবারই শোনা গেল। সানাই তখনো বেজে চলেছে। সোফা থেকে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি কোনমতে স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে বের হয়ে এলেন ঘর থেকে সামনের বারান্দায় শিবতোষবাবু।

    সামনেই পড়ে গেল শিখেন্দু।

    কে অমন করে চিৎকার করল শিখেন্দু!

    ধরতে পারলাম না কাকাবাবু, শিখেন্দু বললে,মনে হল, যেন তিনতলা থেকেই—

    যারা তখনও জেগেছিল দোতলায়, তাদেরও কারও কারও কানে চিৎকারের শব্দটা পৌঁছেছিল—শিবতোষবাবুর বোন রাধারাণী দেবী, তাঁর স্ত্রী কল্যাণী, বড় মেয়ে স্মৃতি–

    শিবতোষবাবুর একমাত্র ছেলে নির্বাণীতোষের বৌভাত ছিল।

    ফুলশয্যার ব্যবস্থা হয়েছিল তিনতলায় নির্বাণীতোষেরই ঘরে।

    সবাই যেন কেমন হতম্ব, কেমন যেন অকস্মাৎ বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কেউ কোন কথা বলে না, কিন্তু সকলেরই চোখেমুখে যেন একটা প্রশ্ন স্পষ্ট, কিসের চিৎকার শোনা গেল? কে চিৎকার করে উঠেছিল একটু আগে?

    শিখেন্দুই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললে, আমি দেখে আসি একবার তিনতলাটা।

    কথাগুলো বলে শিখেন্দু আর দাঁড়াল না, এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে তিনতলায় উঠে গেল।

    ওরা সকলে দাঁড়িয়েই থাকে। একটা অজ্ঞাত বোবা ভয় যেন ওদের সকলের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অকস্মাৎ। কিসের ভয়, কেন ভয়—তা জানে না ওরা। বোধ হয় ভাবতেও পারে না কেউ কথাটা। ভয় বস্তুটা এমনিই একটা ব্যাপার। এমনই সংক্রামক—এক মন থেকে অন্য মনে ছড়িয়ে পড়ে।

    পাঁচ মিনিট দশ মিনিট পনেরো মিনিট প্রায় হতে চলল, এখনও কই শিখেন্দু তো উপর থেকে নীচে নেমে এল না, কি করছে এখনো ও উপরে! সকলেই যেন ঐ প্রশ্নটা করতে চায়, কিন্তু কেউ করছে না কাউকে। কারও মুখেই কোন কথা নেই তখনও।

    শেষ পর্যন্ত স্মৃতিই যেন অপেক্ষা করে করে অধৈর্য হয়ে প্রশ্নটা উচ্চারণ না করে আর পারে না। বললে, শিখেন্দু কি করছে ওপারে? আসছে না কেন? ওপরে গিয়ে দেখে আসব আমি একবার বাবা?

    শিবতোষবাবু যেন কেমন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন একবার, তারপর কোন কথা না বলে নিজেই পায়ে পায়ে এগুলেন সিঁড়ির দিকে।

    ঝকঝকে চওড়া মোজাইক করা সিঁড়ি। সিঁড়ির পথ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। কিন্তু ক্ষণপূর্বের সেই ভয়টা যা তখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেটাই যেন পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে, তাঁর গতি শ্লথ করে দিচ্ছে প্রতি পদবিক্ষেপে।

    উপরে তিনতলাতেও ঠিক দোতলার মতই টানা বারান্দা—আগাগোড়া ডিজাইন টালিতে সব তৈরী। উপরের বারান্দাতেও আলো জ্বলছিল।

    বারান্দাটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে, উপরের তলায় চারখানি ঘরের মধ্যে, শেষের দুটি ঘর নিয়েই নির্বাণীতোষ থাকত। তার শয়নকক্ষেই ফুলশয্যার ব্যবস্থা হয়েছিল।

    ঘরের দরজাটা খোলা।

    কোন সাড়া শব্দ নেই, কেবল সানাই তখনও বেজে চলেছে, ইমন কল্যাণের সুর।

    খোলা দরজাপথে ভিতরে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালেন শিবতোষ।

    শিখেন্দু স্তব্ধ হয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার ঠিক সামনেই দামী কার্পেটে মোড়া মেঝের উপরে পড়ে আছে নববধূ, নির্বাণীতোষের সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী দীপিকা।

    পরনে দামী আকাশ-নীল রংয়ের বেনারসী, হাতে চুড়ি, জড়োয়ার চূড়। কানে হীরের দুল-সিঁথিতে সিঁথিমৌর।

    কাত হয়ে পড়ে আছে দীপিকা।

    একটা হাত তার প্রসারিত, অন্য হাতটা দেহের নীচে চাপা পড়েছে, ঘোমটা খুলে গিয়েছে, জরির ফিতে দিয়ে বাঁধা বেণীটা কার্পেটের উপরে লুটোচ্ছে।

    দুটি চক্ষু বোজা। কপালে চন্দন, সিঁথিতে সিঁদুর।

    পদশব্দে ফিরে তাকাল শিখেন্দু।  কি ব্যাপার বৌমা, কথাটা শেষ করতে পারলেন না শিবতোষ। গলাটা তাঁর কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল। শেষ কথাটা উচ্চারিত হল না।

    বুঝতে পারছি না কাকাবাবু। ঘরে ঢুকে দেখি এখানে এইভাবে দীপিকা পড়ে আছে—

    খোকা—খোকা কোথায়?

    তাকে তো ঘরের মধ্যে দেখি নি। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল, হাত দিতেই খুলে যেতে ভেতরে ঢুকে দেখি ঐভাবে দীপিকা পড়ে আছে–।

    কিন্তু খোকা! খোকা কোথায় গেল? এবারে যেন আরও স্পষ্ট করে প্রশ্নটা উচ্চারণ করলেন। শিবতোষ।

    তার বন্ধুরা শেষ ব্যাচ খেয়ে চলে যাবার পরই, রাত তখন পৌনে এগারটা হবে, নির্বাণী আমাকে বললে মাথাটা বড় ধরেছে, আমি ওপরে চললাম। সেও ওপরেই চলে এসেছিল। ধীরে ধীরে বললে শিখেন্দু।

    তবে কোথায় গেল সে? কেমন যেন অসহায়ভাবে আবার প্রশ্নটা করলেন শিবতোষ।

    বাথরুমের দরজাটা তো খোলাই দেখছি, আলো জ্বলছে ভিতরে, ওখানে কেউ আছে বলে। তো মনে হচ্ছে না কথাটা বলতে বলতেই শিখেন্দু বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।

    বাথরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল।

    কি! কি হল শিখেন্দু! শিবতোষ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন। এবং বাথরুমের মধ্যে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালেন।

    নির্বাণীতোষের দেহটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে বাথরুমের মেঝের উপরে। ঠিক বেসিনের নিচে, সামনে পিঠের বাঁ দিকে একটা ছোরা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে। গায়ে গরদের পাঞ্জাবিটা রক্তে লাল। হাত দুটো ছড়ানো।

    প্রথম বিহ্বল মুহূর্তটা কাটবার পরই দীর্ণ কষ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন শিবতোষ, খোকা—তারপরই দুম করে বাথরুমের মেঝেতেই পড়ে গেলেন অজ্ঞান হয়ে।

    আরো ঘণ্টা দুই পরে।

    রাত তখন দুটো সোয়া দুটো হবে।

    সানাই থেমে গিয়েছে।

    শিবতোষের জ্ঞান ফিরে এসেছে। তাঁকে ধরাধরি করে আগেই নিচে তাঁর দোতলার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছিল। কেমন যেন প্রস্তরমূর্তির মত নিষ্প্রাণ বসেছিলেন শিবতোষ সোফাটার উপরে।

    একটা কান্নার সুর ভেসে আসছে রাত্রিশেষের স্তব্ধতার উপর থেকেও। করুণ। কল্যাণী কাঁদছে। শিবতোষের স্ত্রী কল্যাণী কাঁদছে। নির্বাণীর মা।

    দীপিকারও জ্ঞান ফিরে এসেছে, কিন্তু সে যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে। একটি প্রশ্নেরও জবাব এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

    শিখেন্দু এ-বাড়ির ছেলে নয়, শিবতোষের বন্ধু সুখেন্দুর ছেলে। সুখেন্দু বিশ্বাস ভারত সরকারের একজন পদস্থ কর্মচারী, বর্তমানে দিল্লী রাজধানীতেই তাঁর কর্মস্থল।

    শিখেন্দু তাঁর তৃতীয় পুত্র, কলকাতার মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করবার জন্য অনেক দিন থেকেই সে কলকাতায় আছে।

    হস্টেলে থাকে। গত বছর ডাক্তারী পাস করে বর্তমানে হাউস স্টাফ, কয়েক মাসের মধ্যেই সে আবার উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাতে যাবে, সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছে।

    কলেজ-জীবন থেকেই শিবতোষ ও সুখেন্দুর মধ্যে বন্ধুত্ব এবং দুই পরিবারে ঘনিষ্ঠতা। শিবতোষ সুখেন্দুর চাইতে কয়েকমাসের ছোট, তাই সুখেন্দুর ছেলেমেয়েরা শিবতোষকে কাকাবাবু বলে আর শিবতোষের ছেলেমেয়েরা সুখেন্দুকে জ্যাঠাবাবু বলে ডাকে।

    শুধু বন্ধুত্বই নয়, সুখেন্দু ও শিবতোষের মধ্যে পরস্পরের ভাইয়ের মতই প্রীতির ও ভালবাসার সম্পর্ক একটা গড়ে উঠেছিল।

    নির্বাণীতোষ শিবতোষের একমাত্র পুত্র, শিখেন্দুরই সমবয়সী, সেও শিখেন্দুর সঙ্গেই গত বৎসর ডাক্তার হয়ে বের হয়েছে এবং তারও একই সঙ্গে বিলেত যাবার কথা ছিল।

    বিবাহের ব্যাপারে আজ দিন দশ বারো থেকেই, বেশীর ভাগ সময়েই শিখেন্দু শিবতোষের বাড়িতেই আছে। সব কাজে সাহায্যও করেছে, পরিশ্রম করেছে।

    নির্বাণীতোষের স্ত্রী অর্থাৎ শিবতোষের পুত্রবধূ দীপিকাও ছিল নির্বাণীতোষ ও শিখেন্দুর সহপাঠিনী, সেও ডাক্তার। গত বৎসর একই সঙ্গে পাস করেছে সে।

    পড়তে পড়তেই উভয়ের আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা, নির্বাণীতোষ ও দীপিকা প্রায় সমবয়সী, তাই শিবতোষের ইচ্ছা ছিল না খুব একটা দীপিকা তাঁর পুত্রবধূ হয়ে আসে।

    শিবতোষ বলেছিলেনও ছেলেকে কথাটা, কিন্তু নির্বাণী কান দেয়নি বাপের কথায়।

    সেকেণ্ড ইয়ারে পড়তে পড়তেই আমরা ঠিক করেছিলাম বিয়ে করব। অতএব আজ আপনি যা বলছেন তা সম্ভব নয় বাবা। স্পষ্ট করেই নির্বাণীতোষ তার সিদ্ধান্তের কথাটা শিবতোষকে জানিয়ে দিয়েছিল।

    একটি মাত্র ছেলে এবং বরাবরই অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে একটু বেশী জেদী ছিল নির্বাণীতোষ, তাই শিবতোষ অনিচ্ছা এবং আপত্তি থাকলেও বিবাহে আর বাধা দেননি।

    তাছাড়া স্ত্রী কল্যাণীও বলেছিল, ছেলে যখন বিয়ে করতে চাইছে করুক, আপত্তি করো না।

    শিবতোষ জবাবে বলেছিলেন, তোমাদের মা ও ছেলের যখন ইচ্ছে হাক বিয়ে, করুক বিয়ে ওকেই, তবে বলে রাখছি এ-বিয়ে সুখের হবে না।

    লে হবে না শুনি? কল্যাণী বলেছিল। কেন হবে না, অত কথা বলতে পারব না। তবে হবে না বলে রাখলাম, দেখে নিও।

    অমতের কারণ ছিল শিবতোষের, কারণ দীপিকারা ঠিক তাদের সমতুল্য পাল্টিঘর নয়। শিবতোষ ধনী, কলকাতা শহরের একজন ধনী ব্যক্তি। চার-পাঁচটা কয়লাখনির মালিক। পৈতৃক সূত্রেই খনিগুলির মালিক হয়েছিলেন শিবতোষ অবিশ্যি। এবং কেবল ওই খনিই নয়, শিবতোষের বাবা রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক কলকাতা শহরে খান পাঁচেকবাড়িও করেছিলেন। সেগুলো থেকেও বৎসরের ভাড়া আদায় বেশ মোটা অঙ্কের টাকাই হয়। ব্যাঙ্কেও মজুত টাকা অনেক।

    আর দীপিকার বাবা, সদানন্দ রায় বেসরকারী কলেজের সাধারণ একজন অধ্যাপক মাত্র, খুবই সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘর। চার মেয়ে, দুই ছেলে—ঐ দীপিকাই বড় মেয়ে, অত্যন্ত মেধাবী ছিল দীপিকা বরাবর, বৃত্তি নিয়েই পড়ে এসেছে।

    শ্যামবাজার অঞ্চলে ছোট একটা ভাড়াটে বাড়িতে থাকেন সদানন্দ রায়। সামান্য মাইনে। যত্র আয় তত্র ব্যয়। নির্বাণীতোষের মত ছেলের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে হবে বা কোনদিন হতে পারে স্বপ্নেরও অগোচর ছিল তাঁর।

    তাছাড়া তিনি ব্রাহ্মণ, আর নির্বাণীতোষ কায়স্থ। তবু বিয়ে হয়ে গেল, বিয়েতে তিনি বাধা দেননি—মেয়ের কথা ভেবেই। ঘটনার আকস্মিকতায়, বীভৎসতায় ও বেদনায় বাড়ির সকলেই বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। সবাই বোবা, কেবল কল্যাণী কাঁদছিল। সমস্ত বাড়ির মধ্যে কেবল তার করুণ বিলাপধ্বনি একটানা সকলের কানে এসে বাজছিল।

    কাকাবাবু!

    শিখেন্দুর ডাকে শিবতোষ মুখ তুললেন।

    পুলিসে তো একটা খবর দেওয়া দরকার।

    পুলিস! কেমন যেন বোকার মতই কথাটা উচ্চারণ করে ফ্যালফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইলেন শিবতোষ শিখেন্দুর মুখের দিকে, কথাটা যেন তাঁর আদৌ বোধগম্য হয়নি।

    হ্যাঁ, পুলিস,মানে থানায় একটা খবর দেওয়া তো দরকার।

    কেন?

    মানে, যে ভাবে ওর মৃত্যু হয়েছে, বোঝাই তো যাচ্ছে কেউ ওকে খুন করে গেছে।

    খুন করে গিয়েছে, কেন, কে করল? সমস্ত বুকটা নিংড়ে যেন অসহায় বিমূঢ় শিবতোষের মুখ থেকে কথাগুলো বের হয়ে এল কেঁপে কেঁপে।

    কেন খুন করল, কে খুন করল নির্বাণীতোষকে তা শিখেন্দুই বা কেমন করে বলবে!

    তবু সে বললে, অস্বাভাবিক মৃত্যু, থানায় তো একটা খবর দিতেই হবে।

    বেলতলা রোডে শিবতোষের বাড়ি মল্লিক ভিলা, ভবানীপুর থানার আণ্ডারেই পড়ে এবং সেখানকার থানার বড়বাবু অর্থাৎ ও.সি.বীরেন মুখার্জীর সঙ্গে শিবতোষের আলাপও আছে। এদিন রাত্রে বীরেন মুখার্জীও এসেছিলেন উৎসবে নিমন্ত্রিত হয়ে।

    শিবতোষের বীরেন মুখার্জীর কথা মনে পড়ল, তিনি বললেন, তাহলে বীরেন বাবুকে একটা ফোন করে দাও, শিখেন্দু।

    শিখেন্দু আর কালবিলম্ব করে না, বারান্দায়ই ফোন ছিল, দেয়ালের গায়ে ব্রাকেটের উপর বসানো। এগিয়ে গিয়ে থানায় ফোন করল।

    ফোন ধরল থানার ছোটবাবু, ভবানীপুর থানা—

    ও.সি, আছেন?

    তিনি ওপরে ঘুমোচ্ছেন।

    তাঁকে একটু বলবেন এখুনি একবার বেলতলা রোডে মল্লিক ভিলায় আসতে।

    ছোটবাবু রণজিৎ সিনহার মল্লিক ভিলাটা ও তাঁর অধিকারী শিবতোষ মল্লিক অপরিচিত নয়। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন, কেন? কি দরকার?

    দেখুন এ বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে—

    ঐ বাড়িতে তো আজ উৎসব ছিল—

    হ্যাঁ, তাঁর ছেলের বৌভাত ছিল—

    তা হঠাৎ আবার কি দুর্ঘটনা ঘটল?

    তাঁর ছেলে—

    কি হয়েছে তাঁর?

    সে মারা গেছে।

    মারা গেছে নির্বাণী–তোষবাবু! শিবতোষবাবুর একমাত্র ছেলে!

    হ্যাঁ।

    কি করে মারা গেল? কি দুর্ঘটনা ঘটল? কখন?

    সে তো বলতে পারব না—ঘণ্টা দুই আগে তিনতলায় তার শোবার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে তাকে ছোরাবিদ্ধ মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে—

    সে কি–কি বলছেন!

    হ্যাঁ। ও.সি.-কে পাঠিয়ে দিন, না হয় আপনিই একবার আসুন।

    এখুনি আসছি।

    শিখেন্দু ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

    কেউ বারান্দায় নেই।

    সবাই শিবতোষবাবুকে ঘিরে তখনও তাঁর ঘরের মধ্যেই নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে।

    মিনিট কুড়ির মধ্যেই বীরেন মুখার্জী, থানার ও.সি. নিজেই এসে হাজির হলেন। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে, অত্যন্ত কর্মঠ ও তৎপর একজন অফিসার। এতদিন তাঁর প্রমোশন হওয়া উচিত ছিল, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের সুনজরে না থাকার দরুন আজ পর্যন্ত কোন প্রমোশনই হয়নি। তার জন্য বীরেন মুখার্জীর অবিশ্যি কোন দুঃখও নেই। লম্বা চওড়া বেশ বলিষ্ঠ গঠন।

    জীপের শব্দ শুনে শিখেন্দুই নীচে নেমে এসেছিল, তার সঙ্গেই প্রথমে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল বীরেন মুখার্জীর, গেটের ভিতরে ঢুকে জীপ থেকে নামতেই।

    দুপাশে বিরাট লনে তখনও প্যাণ্ডেলের মধ্যে আলো জ্বলছে।

    বীরেন মুখার্জী বললেন, শিবতোষবাবু কোথায়?

    চলুন ওপরে দোতলায়, তাঁর ঘরে— আপনি কে?

    আমি এ বাড়ির কেউ নই—শিবতোষবাবুর বাল্যবন্ধু সুখেন্দু বিশ্বাসের ছেলে আমি আমার নাম শিখেন্দু বিশ্বাস।

    উৎসবের ব্যাপারেই বোধ হয় এসেছিলেন আপনি?

    নির্বাণীতোষ আমার ক্লাসফ্রেণ্ড, একসঙ্গেই আমরা ডাক্তারী পাস করেছি। গত দশদিন থেকেই এ বাড়িতে আমি আছি।

    নির্বাণীতোষবাবু আপনার ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন?

    হ্যাঁ।

    ফোন করেছিল কে থানায়?

    আমিই।

    চলুন–বীরেন মুখার্জী একজন কনস্টেবলকে নীচে রেখে অন্য একজনকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগুলেন।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন, মৃতদেহ ডিসটার্ব করা হয়নি তো?

    না। তিনতলায় তার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যেই এখনও আছে, শিখেন্দু বললে।

    দুদিনের খাটাখাটুনির ক্লান্তিতে যারা হাঁপ ছেড়ে বিশ্রামের জন্য শয্যা নিয়েছিল, তারা সবাই একে একে জেগে উঠেছে ততক্ষণে। বাড়িতে উৎসব উপলক্ষে দুই মেয়ে এসেছে, বড় মেয়ে স্মৃতি—তার জামাই বীরেন, ছোট মেয়ে স্বাতী—তার জামাই ভবেশ, শিবতোষের একমাত্র বোন রাধারাণী—তার ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছে, ভগ্নীপতি সমরবাবু আসতে পারেন নি।

    তাছাড়া চাকর ও দাসীরা। তাদের মধ্যে দুজন ভৃত্য অনেক দিন ধরেই শিবতোষের গৃহে আছে, গোকুল আর রাজেন। দাসী বেলা, রাঁধুনীবামুন নরেন আর শিবতোষের গৃহ-সরকার যতীশ সামন্ত।

    যতীশ সামন্তও বছর দশেক আছেন ঐ বাড়িতে। বয়েস হয়েছে তা প্রায় পঞ্চাশ বাহান্ন। অকৃতদার মানুষ, ঐ বাড়ির নীচের তলাতেই একটা ঘরে থাকেন।

    অন্যান্য দূর ও নিকট-সম্পর্কের আত্মীয় যারা এসেছিল, তারা উৎসব চুকে যাবার পর যে যার গৃহে চলে গিয়েছিল।

    সবাই জেগে উঠেছিল। সবাই দুঃসংবাদটা শুনেছিল।

    সবাই যেন সংবাদটা শুনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই বাড়িটাও একেবারে স্তব্ধ।

    যতীশ সামন্তই সংবাদটা পেয়ে সানাইওয়ালাদের থামিয়ে দিয়েছিলেন।

    বাড়িতে কে কে আছেন? বীরেন মুখার্জী জিজ্ঞাসা করলেন।

    শিখেন্দুই বলে গেল কে কে আছে।

    শিবতোষবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন? শিখেন্দু প্রশ্ন করে।

    না। আগে চলুন ডেডিটা দেখে আসি। বীরেন মুখার্জী বললেন।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলার বারান্দা অতিক্রম করো দুজনে গিয়ে নির্বাণীতোষের শয়নকক্ষে প্রবেশ করল।

    বিরাট একটা খাট, দামী শয্যা বিছানো। খাটটা ফুলে ফুলে সাজানো। রজনীগন্ধার মৃদু সুবাস ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

    ঘরে কেউ ছিল না।

    দীপিকার জ্ঞান হবার পর তাকে স্বাতী ও স্মৃতি নীচে দোতলায় নিয়ে গিয়েছিল।

    শিবতোষ মল্লিক শহরের একজন বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি। তাঁর যে কেবল অর্থ ও সম্পদের জন্যই সমাজে তিনি পরিচিত ছিলেন তা নয়, নানা সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি নানাভাবে জড়িত বলে ঐ অঞ্চলে তাঁর একটা বিশেষ পরিচয়ও আছে।

    মানুষটিনিরহংকারী সদালাপী ও সহৃদয় বলেপাড়ার সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেও ভালবাসে। বীরেন মুখার্জীর সেটা জানা ছিল ঐ তল্লাটে থানা-অফিসার হিসাবে। ঐ থানায় বীরেন মুখার্জী বছর দুই হল এসেছেন।

    ব্যক্তিগতভাবে শিবতোষ মল্লিকের সঙ্গে বীরেন মুখার্জীর বেশ আলাপও আছে। আজ তাঁর একমাত্র ছেলের বৌভাত উৎসবে নিমন্ত্রিতও হয়েছিলেন, এসেওছিলেন। কিন্তু বেশীক্ষণ থাকতে পারেননি। রাত দশটা নাগাদ চলে গিয়েছিলেন।

    নির্বাণীতোষ নিজেই তাঁকে অভ্যর্থনা করে দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়েছিল।

    ঘরের মধ্যে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন মুহূর্তের জন্য যেন বীরেন মুখার্জী। এই সুন্দর স্নিগ্ধ পরিবেশে এমন একটি উৎসবের রাত, তারই মধ্যে নিষ্ঠুর মৃত্যু রক্তক্ষরণ করেছে।

    পুলিস অফিসার হিসাবে বহুবার তাঁকে এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, কিন্তু আজ যেন ঐ ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে হঠাৎ কেমন বিব্রত বোধ করেন।

    শিখেন্দুর মুখের দিকে তাকালেন বীরেন মুখার্জী, শিখেন্দু বাথরুমের খোলা দরজার দিকে

    তাকাল।

    বীরেন মুখার্জী এগিয়ে গেলেন বাথরুমের দিকে, একটা জল পড়ার শব্দ শোনা গেল।

    নিবার্ণীতোষের মৃতদেহটা ঠিক তেমনি ভাবেই পড়েছিল। উপুর হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা, মুখটা বাঁদিকে কাত করা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মৃতদেহটার দিকে বীরেন মুখার্জী।

    ছোরা প্রায় আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে বাঁ দিকের পৃষ্ঠদেশে ঠিক স্ক্যাল্লার বর্ডার ঘেঁষে। ছোরাটার বাঁটটা কাঠের।

    পকেট থেকে রুমাল বের করে ছোরার বাঁটটা ধরে শক্ত করে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছোরাটা বের করে আনলেন বীরেন মুখার্জী।

    ধারাল ছোরার ফলাটা তীক্ষ্ণ।

    ছোরাটা টেনে বের করতে গিয়েই বুঝলেন বীরেন মুখার্জী, কত জোরে ছোরাটা বেচারীর পৃষ্টদেশে বেঁধানো হয়েছিল যার ফলে ফলাটার সবটাই প্রায় ঢুকে গিয়েছিল দেহের মধ্যে, হয়ত আঘাতের প্রচণ্ডতার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুও হয়েছে।

    কিন্তু যে-ই ছোরাটা মেরে থাকুক, তার হাতের কক্তির জোর নিশ্চয়ই আছে। ছোরাটা খুব ছোট নয়—একেবারে ফলাটা ছ-ইঞ্চি মত হবে, বাঁটটা চার ইঞ্চির মত। সর্বমোট বারো ইঞ্চি মত লম্বা। তীক্ষ্ণ ধার, ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা, ফলাটা ঝক্ঝক্ করছে।

    বেসিনের ঠিক সামনাসামনিই হাত দেড়েক ব্যবধানে মৃতদেহটা পড়ে আছে। বেসিনের দিকে তাকালেন বীরেন মুখার্জী।

    বেসিনের কলটা খোলা, জল পড়ে যাচ্ছে। বেসিনের মধ্যে শূন্য একটা কাঁচের গ্লাস, গ্লাসটা তুলে পাশে রাখলেন বীরেন মুখার্জী। বীরেন মুখার্জী কলের প্যাঁচটা ঘুরিয়ে কলটা বন্ধ করে দিলেন।

    বড় সাইজের বাথরুম। বাথরুমের দেওয়ালে চারপাশে একমানুষ সমান উঁচু ইটালীয়ান টাইলস্ বসানো, মেঝেটা মোজাইক করা, বেসিনের সামনে একটা আশী লাগানো দেওয়ালে। তারই নীচে একটা শেফে নানাবিধ পুরুষের প্রসাধন দ্রব্য ও সেভিং সেট সাজানো।

    দুটি দরজা বাথরুমের। একটা ঘরের সঙ্গে, অন্যটা বোধ হয় মেথরদের যাতায়াতের জন্য। দরজাটা লক করা ছিল ভিতর থেকে। খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন বীরেন মুখার্জী একবার। তাঁর অনুমান মিথ্যে নয়, দরজার বাইরেই সরু বারান্দা এবং ঘোরানো লোহার সিঁড়ি।

    নীচে তাকালেন বীরেন মুখার্জী, বাড়ির পশ্চাৎ দিক সেটা, উৎসবের জন্য সেখানেও প্যাণ্ডেল করা হয়েছিল। নীচের প্যাণ্ডেলে তখনও আলো জ্বলছে।

    আবার বাথরুমের মধ্যে এসে ঢুকলেন বীরেন মুখার্জী। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। হঠাৎ ঐ সময় তাঁর নজরে পড়ল ছোট একটা সেলোফেন কাগজের টুকরোর মত বেসিনের নীচেই পড়ে আছে।

    কৌতূহলী হয়ে ঝুঁকে পড়ে কাগজটা তুলতেই দেখলেন, দুটো কোড়োপাইরিনের বড়ির একটা ছেড়া স্ট্রীপ। স্ট্রীপটা পকেটে রেখে দিলেন বীরেন মুখার্জী।

    বীরেন মুখার্জী বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা যা বোঝা যাচ্ছে নিষ্ঠুর একটা হত্যাই। আততায়ী যে-ই হোক, আজ রাত্রে বাড়িতে উৎসব ছিল, বহু লোকের সমাগম ঘটেছিল, যাওয়া আসার দ্বারও অবারিত ছিল—আততায়ীর পক্ষে কোনই অসুবিধা হয়নি। হয়ত কোন এক ফাঁকে সুযোগ মত ঐ বাথরুমের মধ্যে এসে আত্মগোপন করে থাকতে পারে, তারপর যেই নির্বাণীতোষ বাথরুমে ঢুকেছে, তাকে পিছন থেকে ছোরা মেরে খতম করে আবার এক ফাঁকে ভিড়ের মধ্যে অনায়াসেই সরে পড়েছে।

    কাজেই আততায়ীকে খুঁজে বের করা তত সহজ হবে না। তাহলে ও কানুন অনুযায়ী একটা অনুসন্ধান ও এ-বাড়ির সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই হবে।

    তবে এটা ঠিক হত্যাকারী যে-ই হোক, এ-বাড়ি সম্পর্কে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। সে জানত এ-বাড়ির সব কিছু। শুধু তাই নয়, আরও একটা কথা মনে হয় বীরেন মুখার্জীর, সম্ভবতঃ আততায়ী বা হত্যাকারী হয়ত এ-বাড়ির বিশেষ একজন পরিচিত জনই। অনুসন্ধান সেদিক দিয়েও শুরু করা যেতে পারে।

    বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেন বীরেন মুখার্জী। শিখেন্দু তখনও ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। শিখেন্দু বীরেন মুখার্জীর দিকে তাকাল।

    শিখেন্দুবাবু? বলুন!

    এ-বাড়ির সঙ্গে যখন বিশেষ আপনার পরিচয় অনেক দিন থেকেই আছে এবং আপনি যখন নির্বাণীতোষবাবুর ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন, ঘটনার সময়ও এখানে উপস্থিত ছিলেন—আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

    কি জানতে চান বলুন।

    যতদূর জানি শিবতোষবাবুর তো ঐ একমাত্রই ছেলে?

    লোকে অবিশ্যি তাই জানে, তবে ব্যাপারটা ঠিক তা নয় কিন্তু—

    কি রকম? আর কোন ছেলে আছে নাকি শিবতোষবাবুর?

    শিবতোষবাবুর দুই বিয়ে। অবিশ্যি অনেকেই তা জানে না এবং যারা জানত তারাও হয়ত ভুলে গিয়েছে আজ।

    সত্যি নাকি!

    হ্যাঁ–তাঁর প্রথমা স্ত্রী অবিশ্যি বহুদিন আগেই গত হয়েছেন, এবং শুনেছি, তাঁর মৃত্যুর বছরখানেক পরেই নির্বাণীর মাকে কাকাবাবু দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন।

    প্রথমা স্ত্রী তাহলে নেই?

    না। শুনেছি কাকাবাবুর এক সহপাঠীর বোন সান্ত্বনাদেবীকে লুকিয়ে বাবা রায়বাহাদুরকে জানিয়ে বিবাহ করেছিলেন।

    কার কাছে শুনেছেন কথাটা?

    নির্বাণীই একদিন কথায় কথায় বলেছিল।

    হুঁ, তারপর?

    তারা ছিল অত্যন্ত গরীব মধ্যবিত্ত ছাপোষা গৃহস্থ, কিন্তু সান্ত্বনাদেবী নাকি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন। সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই–

    বুঝেছি–

    তাঁর একটি ছেলে হয়—

    তাই নাকি!

    হ্যাঁ।

    তা সে ছেলেটি জীবিত আছে?

    আছে—তবে—

    তবে?

    সে লেখাপড়া কিছুই করেনি—

    কি নাম তার?

    আশুতোষ। শুনেছি কাকাবাবু তাকে পড়াবার, মানুষ করবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে কাকাবাবুর কোন সাহায্যই গ্রহণ করেনি। কাকাবাবুর কাছে আসেওনি কখনও। বরাবর সে তার মামাদের কাছেই থাকত।

    কি করে আশুতোষ?

    শুনেছি জগদ্দলের জুট মিলে কাজ করে এবং সেখানেই মিলের একটা কোয়াটারে থাকে বর্তমানে।

    তা আশুবাবুর—তার বাপ শিবতোষবাবুর ওপরে এত বিরাগের কারণই বা কি?

    বলতে পারব না।

    এ উৎসবে নিশ্চয়ই সে আসেনি?

    না।

    তাকে দেখেছেন কখনও আপনি?

    না।

    আপনার বন্ধু নির্বাণীতোষবাবু কখনও দেখেছিলেন তাকে?

    সম্ভবতঃ না।

    আশুবাবুর প্রতি তার মনোভাব কেমন ছিল জানেন কিছু?

    নির্বাণীর মত ছেলে হয় না মিঃ মুখার্জী! যেমন নিরহঙ্কার, তেমনি সরল, তেমনি মিশুঁকে প্রকৃতির মানুষ ছিল সে।

    তার মানে, বলতে চান কারুর সঙ্গে কোন শত্রুতারও সম্ভাবনা ছিল না।

    না। ঝগড়াঝাঁটি সে কারুর সঙ্গে করেনি। করতে কখনও দেখিনি। তাই তো বুঝে উঠতে পারছি না এখনও মিঃ মুখার্জী, তার মত মানুষের এমন কে শত্রু থাকতে পারে যে তাকে এমন করে খুন করে গেল!

    আচ্ছা এ-বাড়ির চাকরবাকররা নিশ্চয়ই সন্দেহের বাইরে?

    গোকুল আর রাজেন–না, ওদের দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। তাছাড়া এ বাড়িতে অনেক বছরই ওরা আছে।

    তাঁর বন্ধু-বান্ধব তত ছিল?

    তা ছিল।

    তাদের মধ্যে বেশী ঘনিষ্ঠতা কার কার সঙ্গে ছিল নির্বাণীতোষবাবুর বলতে পারেন?

    সকলের সঙ্গেই ও মিশত, সকলেই ওকে লাইক করত। তবে ঘনিষ্ঠতার কথা যদি বলেন, সঞ্জীব, পরেশ আর নির্মলকান্তির সঙ্গে একটু বেশীই ঘনিষ্ঠতা ছিল বোধ হয়। তারা সবাই আমাদের ক্লাসফ্রেণ্ড। তবে ওদের মধ্যে নির্মল আমাদের সিনিয়র ছিল, এখনও ফাইন্যাল এম.বি. পাস করতে পারেনি। শিখেন্দু বললে।

    আর সঞ্জীব ও পরেশবাবু?

    তারাও পাস করতে পারেনি।

    তারা আজ আসেনি উৎসবে?

    সঞ্জীব ও পরেশ এসেছিল, নির্মলকান্তি আসেনি বোধ হয়। কারণ তাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।

    কেন? আসেননি কেন নির্মলবাবু?

    তা বলতে পারব না।

    ঠিক আছে, নীচে চলুন। দীপিকাদেবীকে আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

    জ্ঞান হওয়া অবধি সে তো কোন কথাই বলছে না।

    কিছুই বলেননি?

    না। কোন প্রশ্ন করলে কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

    স্বাভাবিক, খুব শক্ পেয়েছেন তো!

    বুঝতেই পারছেন একসঙ্গে পড়েছে, দীর্ঘদিনের জানা-শোনা, ঘনিষ্ঠতা—

    দীপিকাদেবীও ডাক্তার নাকি?

    হ্যাঁ—আমাদের সঙ্গেই পাস করেছে।

    চলুন দেখা যাক।

    দুজনে নীচে নেমে এল।

    স্বাতীর ঘরে একটা চেয়ারের উপরে দীপিকা বসেছিল। পরনে তার এখনও সেই দামী বেনারসী শাড়ি আকাশ-নীল রংয়ের, মাগার সিঁথিতে সিঁদুর, সামনের কিছু বিশৃঙ্খল চুল চন্দন-চৰ্চিত কপালের উপরে এসে পড়েছে, গা-ভর্তি গহনা।

    মাথার উপরে পাখাটা বনবন করে ঘুরছে, দাঁড়িয়ে স্বাতী। তার একটা হাত দীপিকার পিঠের উপর ন্যস্ত।

    ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে স্বাতী চোখ তুলে তাকাল।

    দীপিকা কিন্তু তাকাল না।

    স্বাতী!

    আসুন শিখেন্দুদা, স্বাতী বললে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরাত নিঝুম – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    Next Article অবগুণ্ঠিতা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    Related Articles

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.