Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কিরীটী অমনিবাস ১১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত এক পাতা গল্প468 Mins Read0

    ৩৬-৪২. থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন

    থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন ঘরে এসে প্রবেশ করতেই মিঃ বসাক তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, এঁদের গ্রেপ্তারের ব্যবস্থা করুন মিঃ সেন, এঁরাই বিনয়েন্দ্র রায় ও রামচরণের যুগ্ম হত্যাকারী।

    রামানন্দ সেন বারেকের জন্য তাঁর সম্মুখে তখনো প্রস্তরমূর্তিবং দণ্ডায়মান পুরন্দর চৌধুরী ও সুন্দরলালের দিকে তাকিয়ে বললেন, এঁদের মধ্যে একজনকে তো চিনতে পারছি মিঃ বসাক কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটিকে তো ঠিক এখনও চিনতে পারছি না। দ্বিতীয় ঐ মহাশয় ব্যক্তিটি কে?

    মৃদু হাসলেন মিঃ বসাক রামানন্দ সেনের কথায়। তারপর স্মিতকৌতুকভরা কণ্ঠে বললেন, ভদ্রমহাশয় ব্যক্তি অর্থাৎ পুরুষ উনি নন, উনি ভদ্রমহিলা,মিঃ সেন।

    পুরুষ নন, মহিলা! বিস্মিত কণ্ঠ হতে উচ্চারিত হয় কথাটা রামানন্দ সেনের। এবং শুধু রামানন্দ সেনই নন। ঘরের মধ্যে ঐ সময় উপস্থিত সুজাতা মিঃ বসাকের কথায় কম বিস্মিত হয় না।

    সে বলে ওঠে, কি বলছেন প্রশান্তবাবু!

    ঠিকই বলেছি আমি মিস রয়। ওষ্ঠের উপরে চিকন ঐ গোঁফটি আসল নয়, মেকী, মাথার শিরস্ত্রাণ ঐ রেশমী পাগড়ি ওটিও আংশিক ছদ্মবেশ মাত্র। ওর নীচে রয়েছে বেণীবদ্ধ কেশ। চশমার কালো কাঁচের অন্তরালে রয়েছে নারীর দুটি চক্ষু।

    কথাগুলো বলতে বলতেই ঘুরে দাঁড়ালেন মিঃ বসাক সুন্দরলালের দিকে এবং বললেন, উনি শ্রীমতী লতাদেবী।

    আবার রামানন্দ সেন ও সুজাতা দুজনেই যুগপৎ চমকে মিঃ বসাকের দিকে তাকান।

    কী বললেন? লতাদেবী!

    কিন্তু যাকে সম্বোধন করে কথাগুলো মিঃ বসাক ক্ষণপূর্বে বললেন তিনি কিন্তু নির্বাক। পাষাণপুত্তলিকাবৎ নিশ্চল।

    মিঃ বসাক পুনরায় বলে উঠলেন, এত তাড়াতাড়ি অবিশ্যি প্রথম দিনের দর্শনেই আপনার চেহারায়, কণ্ঠস্বরে ও হাতের আঙুলে আমার সন্দেহ হলেও আপনি যে সত্যি সত্যিই পুরুষ নন নারী এই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারতাম না। যদি না আজই দ্বিপ্রহরের কিরীটীর সংকেত আপনার প্রতি আমাকে বিশেষভাবেই সজাগ করে দিত। তা সত্ত্বেও আমি বলব মিস সিং, আপনার ছদ্মবেশধারণ অপূর্ব নিখুঁত হয়েছিল।

    একেবারে সামনাসামনি ও খোলাখুলিভাবে চ্যালেঞ্জড্‌ হলেও ছদ্মবেশী লতাদেবী পাষাণপুত্তলিকার মতই এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু অকস্মাৎ যেন পরমুহূর্তেই পাথরের মত দণ্ডায়মান লতাদেবীকে তাঁর প্যান্টের পকেটে ডান হাতটা প্রবেশ করতে উদ্যত দেখেই চকিতে পিস্তল সমেত নিজের হাতটা উদ্যত করে মিঃ বসাক কঠিন কঠে বলে উঠলেন, No–No-সে চান্স আপনাকে আমি দেব না মিস সিং, প্যান্টের পকেট থেকে হাত সরান। সরান—Yes-হ্যাঁ, এতদিন ধরে এমন নৃশংস খেলা খেললেন, তারপরেও শেষটায় আপনারাই জিতে আমাদের মাত করে দিয়ে যাবেন, তাই কি হয়! বলতে বলতে মিঃ রামানন্দ সেনের দিকে তাকিয়ে মিঃ বসাক এবারে বললেন, মিঃ সেন, শ্রীমতী সিংয়ের বডিটা সার্চ করুন। চৌধুরী সাহেবকেও বাদ দেবেন না যেন।

    দ্বিধামাত্র না করে রামানন্দ সেন ইন্সপেক্টারের নির্দেশমত এগিয়ে গেলেন, এবং লতা সিংয়ের বডি সার্চ করতেই তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে বের হয়ে এল একটি মোটা কলমের মত বস্তু এবং শুধু তাই নয়, ছোট অটোমেটিক পিস্তলও একটি পাওয়া গেল।

    আর পুরন্দর চৌধুরীর বডি সার্চ করে পাওয়া গেল একটি চমৎকারভাবে কাপড়ে মোড়া এক হাত পরিমাণ কালো প্লাস্টিকের তৈরী রড ও একটি অটোমেটিক পিস্তল।

    প্লাস্টিকের রডটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখছিলেন রামানন্দ। হঠাৎ সেদিকে নজর পড়ায় মিঃ বসাক বলে উঠলেন, সাবধান মিঃ সেন, ওটা যা ভাবছেন বোধ হয় তা নয়, নিছক একটি প্লাস্টিকের তৈরী রড নয়। আর আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তো খুব সম্ভবত ওটা একটা প্ৰেয়িং অ্যাপারেটা। এবং ওর ভিতরে আছে তীব্র কালকূট,মেক ভেন।

    কী বলছেন আপনি মিঃ বসাক!

    ঠিকই বলছি বোধ হয়। দিন তো বস্তুটি আমার হাতে।

    এগিয়ে দিলেন রামানন্দ সেন বস্তুটি ইন্সপেক্টারের হাতে। বসাক প্লাস্টিকের রডটি একটু পরীক্ষা করতেই দেখতে পেলেন, তার একদিকে রয়েছে কলমের ক্যাপের মত একটি ক্যাপ। এবং সেই ক্যাপটি খুলতেই দেখা গেল তার মাথার দিকটা যেমন সরু হয়ে আসে তেমনি তারও মাথার দিকটা ক্রমশ সরু হয়ে এসেছে। এবং সেই সরু অগ্রভাগে বিন্দু পরিমাণ একটি ছিদ্র। আরও ভাল করে পরীক্ষা করতে দেখা গেল রডটির অন্যদিকে একটি ক্ষুদ্র স্প্রিংও আছে। সেই স্পিংটা টিপতেই পিচকারীর মত কি খানিকটা গাঢ় তরল পদার্থ ছিটকে বের হয়ে এল।

    প্রশান্ত বসাক এবারে বললেন, হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। দেখলেন তে। এখন বোধ হয় বুঝতে পারছেন এই বিশেষ যন্ত্রটির সাহায্যেই হতভাগ্য বিনয়েন্দ্রবাবুকে সেই রাত্রে এবং পরশু রাত্রে হতভাগ্য রামচরণকে হত্যা করা হয়।

    উঃ, কি সাংঘাতিক! রামানন্দ সেন বলেন আত্মগতভাবে।

    হ্যাঁ, সাংঘাতিকই বটে। এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপারও বটে। প্রশান্ত বসাক আবার বললেন। তারপর একটু থেমে আবার শুরু করলেন, যে বিজ্ঞান মানুষের সমাজজীবনে এনেছে প্রভূত কল্যাণ, যে বিজ্ঞানবুদ্ধি ও আবিষ্কার যুগে যুগে সমাজ-জীবনের পথকে নব নব সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, সেই বিজ্ঞান-প্রতিভাই বিকৃত পথ ধরেই এনেছে অমঙ্গল—সর্বনাশা ধ্বংস। লতাদেবী ও মিঃ চৌধুরী দুজনেই অপূর্ব বৈজ্ঞানিক প্রতিভা নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু বিকৃত বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে ওঁদের উভয়ের মিলিত প্রতিভা মঙ্গল ও সুন্দরের পথকে খুঁজে পেলেন না। ফলে ওঁরা নিজেরাও ব্যর্থ হলেন, ওঁদের প্রতিভাও ব্যর্থ হল।

    .

    ওদিকে রাত প্রায় ভোর হয়ে এসেছিল।

    ঘরের জানলাপথে প্রথম আলোর আবছা আভাস এসে উঁকি দেয়।

    লতা ও পুরন্দর চৌধুরীকে আপাততঃ আলাদা আলাদা করে দুজনকেই পুলিসের হেপাজতে রেখে সকলে নীচের ঘরে নেমে এলেন।

    সংবাদ পেয়ে রজতও এসে ওঁদের সঙ্গে যোগ দিল।

    প্রশান্ত বসাকের নির্দেশমত ড্রাইভার করালীকেও পূর্বাহ্নেই অ্যারেস্ট করা হয়েছিল।

    সুজাতা, রজত ও রামানন্দ সেন সকলেই উদগ্রীব সমগ্র রহস্যটা জানবার জন্য। কী ভাবে বিনয়েন্দ্র ও রামচরণ নিহত হল, আর কেনই বা হল।

    মিঃ বসাক বলতে লাগলেন তখন সেই কাহিনী।

    .

    ৩৭.

    কিরীটী আমাকে সব শুনে বলেছিল এই হত্যা-রহস্যের মধ্যে কোন একটি নারী আছে। কিরীটীর কথা শুনে সমগ্র ঘটনা পুনর্বার আমি আদ্যপান্ত মনে মনে বিশ্লেষণ করি। এবং তখনই আমার মনে পড়ে বিনয়েন্দ্র নিহত হবার কিছুদিন পুর্বেই এই নীলকুঠিতে এক রহস্যময়ী নারীর আবির্ভাব ঘটেছিল। এবং যে নারী অকস্মাৎ যেমন এখানে এসে একদিন উদয় হয়েছিল তেমনি অকস্মাৎ আবার একদিন দৃষ্টির অন্তরালে আত্মগোপন পরে। রামচরণের মুখেই আমি জানতে পারি যে, তার নাম লতা। বলাই বাহুল্য, আমার মন তখন সেই অন্তরালবর্তিনী লতার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। এখন অবিশি স্পষ্টই বুঝতে পারছি, সুন্দরলালের ছদ্মবেশের অন্তরালেই ছিল সেই লতা এবং সেই সঙ্গে এও বুঝতে পারছি, ওই লতা বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরী উভয়েরই যথেষ্ট পরিচিত ছিল; যেহেতু প্রথমতঃ ল্যাবরেটারী অ্যাসিস্টেন্টরূপে সমস্ত প্রার্থীর মধ্যে লতাকেই যখন বিনয়েন্দ্র মনোনীত করেছিলেন তখন তার প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব প্রমাণ হয়েছে ও সেই সঙ্গে প্রমাণ হয়েছে লতা তাঁর মনের অনেকখানিই অধিকার করেছিল। তার আরো প্রমাণলতানামটি আমি বিনয়েন্দ্ররনোটবুকেরবহু পাতাতেই পেয়েছি। এখন কথা হচ্ছে লতা বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরী এই ট্রায়োর পরিচয় পরস্পরের সঙ্গে কতদিন ধরে। গোলমালটা অবিশ্যি গড়ে উঠেছে দুটি পুরুষ বন্ধুর মধ্যে এ মধ্যবর্তিনী নারীকেই কেন্দ্র করে। কিন্তু হত্যার কারণটা কি একমাত্র তাই, না আরো কিছু? এই তথ্যটি অবিশ্যি এখন আমাকে আবিষ্কার করতে হবে। তবে বিনয়েন্দ্র রামচরণকে হত্যা করা হয়েছিল কি ভাবে সেটা এখন আমি স্পষ্টই অনুমান করতে পারছি। এবং সে অনুমানের পরেই আমার মনে হচ্ছে সে রাত্রে যখন বিয়ে তাঁর গবেষণাগারে নিজের কাজে ব্যস্ত তখন হয়তো লতা এসে দরজায় টোকা দেয়। দরজা খুলে লতাকে দেখতে পেয়ে অত রাত্রে নিশ্চয়ই প্রথমটায় বিনয়েন্দ্র বিস্মিত হন। এবং খুব সম্ভব লতার সঙ্গে যখন বিনয়েন্দ্র কথা বলছেন সেই সময় তাঁর অলক্ষ্যে এক ফাঁকে ঘরে প্রবেশ করে পশ্চাৎ দিক হতে এসে অতর্কিতে কোন কিছু ভারী বস্তুর সাহায্যে পুরন্দর চৌধুরী বিনয়েন্দ্রকে তাঁর ঘাড়ে আঘাত করেন। যার ফলে বিনয়েন্দ্র পড়ে যান ও পড়ে যাবার সময় ধাক্কা লেগে বা কোন কারণে টেবিল থেকে আরও দু-একটা কাঁচের যন্ত্রপাতির সঙ্গে বোধ হয় ঘড়িটা মাটিতে ছিটকে পড়ে ভেঙে যায়। কিন্তু এর মধ্যেও কথা আছে, ঐ ভাবে মাথায় বা ঘাড়ে অতর্কিতে একটা আঘাত হেনেইতো হতঅগ্য বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করা যেত। তবে কেন আবার ভয়ঙ্কর মৃত্যুগরল সর্পবিষ প্রয়োগ করা হল তার শরীরে? আর একাকী পুরন্দর চৌধুরীই তো তার বন্ধুকে হত্যা করতে পারত; তবে লতার সহযোগিতার প্রয়োজন হল কেন? মনে হয় আমার, প্রথমতঃ তার কারণ ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপ দেবার জন্যই ঐ ভাবে পিছন থেকে অতর্কিতে বিনয়েন্দ্রকে আঘাত হেনে প্রথমে কাবু করা হয়েছিল এবং এমন ভাবে সেই ভারী বস্তুটি কাপড় মুড়ে নেওয়া হয়েছিল যাতে করে সেই ভারী বস্তুটির আঘাতটা তার কাজ করবে, কিন্তু চিহ্ন রাখবে না দেহে। দ্বিতীয়তঃ, আঘাত হেনে অজ্ঞান করে দিতে পারলে পরে বিষ প্রয়োগকরবার সুবিধা হবে। এবং লতারসহযোগিতার প্রয়োজনও হয়েছিল; আমার মনে হয়, এই জন্যই অন্যথায় এত রাত্রে বিনয়েন্দ্রর গবেষণা-ঘরে পুরন্দর চৌধুরীর প্রবেশ সম্ভবপর ছিল না একা একা। এবং কোনমতে পুরন্দর চৌধুরী একা প্রবেশ করলেও হঠাৎ অমন করে পশ্চাৎ দিক থেকে আঘাত করবার সুযোগও পেত না, যেটা সহজ হয়ে গিয়েছিল উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় ও সহযোগিতায়। এবং লতাকে প্রথমে ঘরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে বিনয়েন্দ্রকে কথাবার্তার মধ্যে অন্যমনস্ক রেখে সেই ফাঁকে একসময় পশ্চাৎ দিক হতে গিয়ে পরম নিশ্চিন্তে বিনয়েন্দ্রকে আঘাত করা পুরন্দর চৌধুরীর পক্ষে ঢের বেশী সহজসাধ্য ছিল। যা হোক, আমার অনুমান ঐ ভাবেই বিয়েকে অজ্ঞান করে পরে সাক্ষাৎ মারণ-অস্ত্র ঐ বিশেষ অ্যাপারেটাটির সাহায্যেই মুখের মধ্যে সর্প-বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। ঐ বস্তুটি জোর করে মুখে প্রবেশ করাবার চিহ্নও ছিল ওষ্ঠে, যা থেকে মৃতদেহ পরীক্ষা করেই মনে আমার সন্দেহ জাগায়। এবং পরে সমগ্র ব্যাপারটাকে হত্যা নয়, আত্মহত্যা এই রূপ দিয়ে হত্যাকারী আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে। তারপর পরে মৃতদেহের পাশে একটা বিকারে কিছু সৰ্প-বিষ রেখে দেয় আত্মহত্যার প্রমাণস্বরূপ।

    কিন্তু কথা হচ্ছে ঐ ভাবে বিশেষ অ্যাপারেটাসের সাহায্যে দেহের মধ্যে বিষ প্রয়োগ না করে সাধারণভাবেও তো গলায় বিষ ঢেলে কাজ শেষ করা যেতে পারত। তার জবাবে আমার মনে হয়, অজ্ঞান অবস্থায় বিষ গলায় ঢেলে দিলেও যদি তার খুব বেশি অংশ পেটের মধ্যে না যায় তো কাজ হবে না, অথচ অজ্ঞান অবস্থায় খুব বেশি বিষও ভিতরে প্রবেশ করানো কষ্টসাধ্য হবে। এবং সম্ভবতঃ সেইটাই ছিল কারণ। দ্বিতীয় কারণ, এমন অভিনব একটা পথ নেওয়া হয়েছিল যাতে করে কারো মনে কোনরূপ সন্দেহই না জাগে। এখন কথা হচ্ছে, বিশেষ করে সর্প-বিষই কেন হত্যাকারী বেছে নিয়েছিল বিয়েকে হত্যা করবার যন্ত্রস্বরূপ? তার উত্তরে বলব, বিনয়েন্দ্র সর্প-বিষের নেশায় অভ্যস্ত ছিল। যাতে তার দেহে বিষ পেলেও পুরন্দরের কাহিনী শুনে লোকে মনে করত, হয় বিনয়েন্দ্র আত্মহত্যা করেছে না হয় বেশি খেয়ে সর্প-বিষে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। আর যে বিষে সে অভ্যস্ত ছিল সে বিষ দিয়ে হত্যা করতে হয়েছিল বলেই বেশি পরিমাণ বিষের প্রয়োজন হয়েছিল।

    কিন্তু যা বলছিলাম, পুরন্দর চৌধুরী ও লতা দুই বিজ্ঞানীর মিলিত হত্যা-প্রচেষ্টা অভিনব সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের সকলের দৃষ্টির বাইরে ত্রিকালদশী একজন, যিনি সর্বদা দুটি চক্ষু মেলে সদা জাগ্রত, সদা সচেতন, যাঁর বিচার ও দণ্ড বড় সূক্ষ, তাঁকে যে আজ পর্যন্ত কেউ এড়াতে পারেনিদগবী মানুষ তা ভুলে যায়। আজ পর্যন্ত কোন পাপ, কোন দুষ্কৃতিই যে চিরদিনের জন্য ঢাকা থাকে না আমরা তা বুঝতে চাই না বলেই না পদে পদে আমরা পর্যদুস্ত, লাঞ্ছিত, অপমানিত হই।

    .

    ৩৮.

    পুরন্দর চৌধুরী, লতা ও করালীকে রামানন্দ সেনই পুলিস-ভ্যানে করে নিয়ে গেলেন যাবার সময়।

    অভিশপ্ত নীলকুঠি!

    সন্ধ্যার দিকে ঐ নীলকুঠির ঘরে ঘরে ও সদর দরজায় তালা পড়ে গেল।

    রজত কলকাতায় চলে গেল।

    আর সুজাতা গেল তার দূর সম্পর্কীয় এক মাসীর বাড়িতে বরাহনগর। ছুটির এখনো দশটা দিন বাকি আছে, সুজাতা সে দশটা দিন মাসীর ওখানেই থাকবে স্থির করল।

    দিন পাঁচেক বাদে বিকেলের দিকে প্রশান্ত বসাক কী একটা কাজে দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলেন, ফেরবার পথে কি মনে করে সুজাতার মাসীর বাড়ির দরজায় এসে গাড়িটা থামালেন।

    সুজাতা বাসাতেই ছিল, সংবাদ পেয়ে বাইরে এল।

    আপনি!

    হ্যাঁ, হঠাৎ এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম যাবার পথে আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।

    বসুন। দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? সুজাতা বলে।

    খালি একটা চেয়ারে বসতে বসতে প্রশান্ত বসাক বললেন, লক্ষ্ণৌ ফিরে যাচ্ছেন কবে?

    আরও দিন দশেকের ছুটি নিয়েছি।

    তাহলে এখন এখানেই থাকবেন বলুন?

    তাই তো ভাবছি।

    এবং শুধু ঐ দিনই নয় তার পরের সপ্তাহে আরও চার-পাঁচবার দুজনে দেখা হল।

    হঠাৎ তার পর থেকে ঘন ঘন কাজ পড়ে যায় যেন ঐ দিকে প্রশান্ত বসাকের এবং ফেরবার পথেই দেখাটা করেন তিনি সুজাতার সঙ্গে। কারণ সুজাতার কথা তাঁর মনে পড়ে প্রত্যেকবারেই।

    অবশ্য সেটা খুবই স্বাভাবিক।

    সেদিন দ্বিপ্রহরে রামানন্দ সেনের সঙ্গে হেডকোয়ার্টারের নিজস্ব অফিসরুমে বসে প্রশান্ত বসাক নীলকুঠির হত্যাব্যাপার নিয়েই আবার আলোচনা করছিলেন।

    পুরন্দর চৌধুরী বা লতা এখনও তাদের কোন জবানবন্দি দেয়নি।

    তদন্ত চলছে, পুরোপুরি সেটাও এখনও তৈরী করা যায়নি।

    রামানন্দ সেন বলছিলেন, কিন্তু আপনি ওদের সন্দেহ করলেন কি করে ইন্সপেক্টার?

    ব্যাপারটা যে আত্মহত্যা নয়, হত্যা-নিষ্ঠুর হত্যা, সে আমি অকুস্থানে অর্থাৎ ল্যাবরেটারী ঘরে প্রবেশ করে, মৃতদেহটা পরীক্ষা করে ও অন্যান্য সব কিছু দেখেই বুঝেছিলাম মিঃ সেন, আর তাতেই সন্দেহটা আমার ওদের উপরে ঘনীভূত হয়।

    কি রকম?

    প্রথমতঃ মৃতদেহের position, সে সম্পর্কে পূর্বেই আমি আলোচনা করেছি আপনাদের সঙ্গে। দ্বিতীয়তঃ, মৃতদেহ ও তার ময়নাতদন্তের রিপোের্টও তাই প্রমাণ করেছে। তৃতীয়তঃ, বিনয়েন্দ্রর নিত্যব্যবহার্য অপহৃত রবারের চপ্পলজোড়া। সেটা কোথায় গেল? আপনাদের বলিনি সেটা রক্তমাখা অবস্থায় পাওয়া যায় নীলকুঠির বাঁ পাশের পোড়ো বাড়ির মধ্যে। খুব সম্ভব অতর্কিতে ঘাড়ে আঘাত পেয়ে বিনয়েন্দ্র যখন মেঝেতে পড়ে যান তখন টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কাঁচের অ্যাপারেটাও মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়; যে ভাঙা কাঁচের টুকরোয় হত্যাকারী বা তার সঙ্গীর সম্ভবত পা কেটে যায়। রক্ত পড়তে থাকে। তখন তারা ঘরের সিঙ্কের ট্যাপে পা ঘোয় ও পরে ঐ চপ্পলজোড়া পায়ে দিয়েই হয়তো ঘর থেকে বের হয়ে যায় যাতে করে রক্তমাখা পায়ের ছাপ মেঝেতে না পড়ে। আপনি জানেন না মিঃ সেন, ওদের যেদিন অ্যারেস্ট করা হয় সেই দিনই হাজতে পুরন্দর চৌধুরী ও লতার পা পরীক্ষা করে দেখা যায় লতাদেবীর পায়েই ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ছিল। এবং তারই পায়ের পাতায় ক্ষত ছিল। পা খোবার পর উত্তেজনার মধ্যে ওরা ঘরের সিঙ্কের ট্যাপটা বন্ধ করে রেখে যেতে ভুলে যায়—যেটা খুব স্বাভাবিক, আর তাইতেই সেই ট্যাপটা আমরা খোলা অবস্থায় দেখি। নীলকুঠিতে ওদের প্রবেশে অত রাত্রে সাহায্য করেছিল করালী, এবং ওরা দুজনে যখন করালীর সাহায্যে নীলকুঠিতে প্রবেশকরে বা বের হয়ে যায় তখন হয়তো রামচরণের নজরে ওরা পড়েছিল বলেই তাকে প্রাণ দিতে হল পরে হত্যাকারীর হাতে। দ্বিতীয় রাত্রে আমার সঙ্গে যখন ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে বসে এক কাল্পনিক কাহিনী বলে নিজেকে সন্দেহমুক্ত করবার জন্য ও নিজের alibi সৃষ্টির চেষ্টায় আমাকে বোকা বোঝাবার চেষ্টায় রত ছিল, সম্ভবতঃপূর্বেই পুরন্দর রামচরণকে হত্যা করে কাজ শেষ করে এসেছিল। এবং কেমন করে সে রাত্রে সেটা সম্ভব হয়েছিল নীলকুঠির উপরের ও নীচের তলাকার নকশা দেখলেই আপনি তা বুঝতে পারবেন। রাত্রে সকলের শয়নের কিছুক্ষণ পরেই পুরন্দর চৌধুরী ঘর থেকে বের হয়ে যান এবং বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে যান। করালীর সাহায্যে রামচরণকে হত্যা করে দোতলায় ওঠবার ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে আবার। তারপর আমার দৃষ্টি তার প্রতি আকর্ষণ করবার জন্য শব্দ করে ল্যাবরেটারী ঘরের দিকে যায়। কারণ সে জানত আমি সম্ভবত জেগেই থাকব। এবং পূর্বেও ছায়াকুহেলীর দুঃস্বপ্ন গড়ে তোলবার জন্য। ঐ সিঁড়ি দিয়েই সে উপরে উঠে যেত; কারণ অন্য সিঁড়ির দরজাটা রাত্রে বন্ধ থাকত। শেষ, রাত্রে যেদিন করালীকে দেখে সুজাতাদেবী ভয় পেয়েছিলেন সে রাত্রেও ওই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়েই উপরে উঠে পালাবার সময়ও সেই পথেই পালায়। এবারে আসা যাক ওদের আমি। সন্দেহ করলাম কি করে। পুরন্দর চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রথম প্রমাণ, সেই চিঠি। যা বিনয়েন্দ্রর নামে রজতবাবু ও সুজাতাদেবীকে ও তার নামেও লেখা হয়েছিল। চিঠিটা যে পুরন্দরেরই নিজের হাতে লেখা সেটা তার কৌশলে জবানবন্দির কাগজে নাম দস্তখত করে নেওয়ার ছলে সংগ্রহ করে দুটো লেখা মিলিয়ে দেখতেই ধরা পড়ে যায় আমার কাছে। কিন্তু কথা। হচ্ছে, ওভাবে risk সে নিতে গেল কেন? বোধ হয় তার মধ্যেও ছিল তার আত্ম-অহমিকা বা সুনিশ্চিয়তা নিজরে উপরে। দ্বিতীয় প্রমাণ, পুরন্দর চৌধুরীর জবানবন্দি, যা আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। খবর নিয়ে আমি জেনেছিলাম, গত পনেরদিন ধরেই পুরন্দর চৌধুরী কলকাতার এক হোটেলে ছিল। হোটেলটির নাম হোটেল স্যাভয়। সেখানকার এক বয়ের মুখেই সংবাদটা আমি পাই। তৃতীয় প্রমাণ, লতাকে আমার লোক অনুসরণ করে জানতে পারে সেও হোটেল স্যাভয়ে উঠেছিল পুরন্দরের সঙ্গে পুরুষের বেশে, কিন্তু সে যে পুরুষ নয় নারী, সেও এ হোটেলের বয়ই অতর্কিতে একদিন জানতে পারে। তারপরে বাকিটা আমি অনুমান করে নিয়েছিলাম ও কিরীটী আমার দৃষ্টিকে সজাগ করে দিয়েছিল।

    হঠাৎ ঐ সময় টেবিলের উপরে টেলিফোনটা বেজে উঠল ক্রিং ক্রিং শব্দে।

    রিসিভারটা তুলে নিলেন বসাক, হ্যালো—

    আপনাকে একবার আসতে হবে স্যার।

    কেন, ব্যাপার কী?

    লতাদেবী সুইসাইড করবার চেষ্টা করছিলেন।

    বল কি হে!

    হ্যাঁ, এখনও অবস্থা খারাপ। তিনি আপনাকে যেন কি বলতে চান।

    .

    ৩৯.

    আর দেরি করলেন না প্রশান্ত বসাক। পুলিস হাসপাতালে ছুটলেন। একটা কেবিনের মধ্যে লতাদেবী শুয়েছিলেন। জানা গেল, গোটা দুই সিঙ্গাপুরী মুক্তা তাঁর কাছে ছিল; সেই খেয়েই তিনি আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করেছেন। অবস্থা ভাল নয়।

    মিঃ বসাককে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে মৃদু কণ্ঠে লতাদেবী বললেন মিঃ বসাক!

    কাছে এসে বসলেন মিঃ বসাক।

    আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। তবে জানবেন শেষ মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলছি না।

    বলুন।

    মিঃ বসাকের চোখের ভঙ্গিতে রামানন্দ সেন আগেই কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলেন।

    লতাদেবীর শেষ জবানবন্দি রামানন্দ সেন লিখে নিতে লাগলেন।

    .

    এবং বলাই বাহুল্য বাঁচানো গেল না লতাকে।

    পরের দিন ভোরের দিকেই তাঁর মৃত্যু হল বিষের ক্রিয়ায়। এবং মৃত্যুর পূর্বে যে কাহিনী তিনি বিবৃত করে গেলেন, সেটা জানতে না পারলে নীলকুঠির হত্যারহস্যের যবনিকা তুলতে আরও কতদিন যে লাগত কে জানে!

    শুধু তাই নয়, কখনও যেত কিনা তাই বা কে বলতে পারে।

    মৃত্যুপথযাত্রিণী লতা সংক্ষেপে এক মর্মান্তিক কাহিনী বলে গেল তার শেষ সময়ে। দুটি পুরুষের প্রবল প্রেমের আকর্ষণের মধ্যে পড়ে শেষ পর্যন্ত কাউকে সে পেলে না, কাউকেই সুখী করতে পারল তো নাই, উপরন্তু তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করল সে হত্যাকারীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এবং অন্যজনকেও বিদায় দিতে হল মর্মান্তিক এক পরিস্থিতির মধ্যে। এবং সবচাইতে করুণ হচ্ছে দুজনকেই সে ভালবেসেছিল; তবে একজনের ভালবাসা সম্পর্কে সে সর্বদা সচেতন থাকলেও অন্যজনকেও যে ভালবাসত এবং ঘটনাচক্রে তারই মৃত্যুর কারণ হয়েছিল—শেষ মুহূর্তে সেটা সে বুঝতে পারল ব্যথা ও অনুশোচনার মধ্য দিয়ে।

    কিন্তু তখন যা হবার হয়ে গিয়েছে।

    .

    আরও পাঁচদিন পর—

    বিনয়েন্দ্র ও রামচরণের হত্যা-রহস্যের যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রশান্ত বসাক পুলিসের কর্তৃপক্ষকে দাখিল করেছিলেন, সেটা একটি কল্পিত উপন্যাসের কাহিনীর চেয়ে কম বিস্ময়কর ও চমকপ্রদ নয়। একটি নারীকে ঘিরে দুটি পুরুষের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের আজন্মপোষিত হিংসা যে কি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে এবং হাসিমুখে বন্ধুত্বের ভান করে কী ভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বৎসরের পর বৎসর দুই বন্ধু একের প্রতি অন্যে সেই হিংসার গরল বিন্দু বিন্দু করে সঞ্চয় করে তুলতে পারে ও শুধুমাত্র সময় ও সুযোগে সেই প্রতিহিংসার গরল-মাখানো নখরে চরম আঘাত হানবার জন্য লতার স্বেচ্ছাকৃত জবানবন্দি পেলে হয়তো সম্যক বোঝাই যেত না কোনদিন। এবং বিনয়েন্দ্রও রামচরণের হত্যা-রহস্যের উপরেও কোনদিন আলোকসম্পাত হত কিনা তাই বা কে বলতে পারে।

    .

    ৪০.

    বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরীর পরস্পরের আলাপ হয় কলেজের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে! দুজনেই ছিল প্রখর তীক্ষ্ণধী ছাত্র। চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীতে যখন তারা উঠল তারই মাসখানেক বাদে পাঞ্জাব থেকে লতা সিং পড়তে এল কলকাতায়।

    সতার বাপ ছিল পাঞ্জাবী আর মা ছিল লুধিয়ানা-প্রবাসী এক বাঙালী মেয়ে। লতা তার জন্ম-স্বত্ব হিসাবে পাঞ্জাবী পিতার দেহসৌষ্ঠব ও বাঙালী মায়ের রূপমাধুর্য পেয়েছিল।

    লুধিয়ানার কলেজেই পড়তে পড়তে হঠাৎ পিতার মৃত্যু হওয়ায় লতার মা তাকে নিয়ে তাঁর পিতার কাছে কলকাতায় চলে আসেন; কারণ লতার মাতামহ তখন দীর্ঘকাল পরে আবার তাঁর নিজের মাতামহর বাড়ি ও সম্পত্তি পেয়ে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করেছেন।

    লতা, পুরন্দর ও বিনয়েন্দ্র যে কলেজে পড়তেন সেই কলেজেই সেই শ্রেণীতে এসে ভর্তি হল।

    বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরীর সহপাঠিনী লতা। এবং ক্রমে লতার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় বিনয়েন্দ্র ও পুরন্দর চৌধুরীর। দুর্ভাগ্যক্রমে উভয়েই ভালবাসলেন লতা সিংকে। আর সেই হল যত গোলযোগের সূত্রপাত। কিন্তু পরস্পরের ব্যবহার বা কথাবার্তায় কেউ করো কাছে সে-কথা স্বীকার করলে না বা প্রকাশ পেল না। ইতিমধ্যে নানা দুর্বিপাকে পড়ে পুরন্দর চৌধুরীকে পড়াশুনায় ইস্তাফা দিয়ে জীবিকা অর্জনের জন্য চেষ্ঠা শুরু করতে হল।

    পুরন্দর চৌধুরী ও বিনয়েন্দ্র দুজনেই লতাকে ভালবাসলেও লতার কিন্তু মনে মনে দুর্বলতা ছিল পুরন্দর চৌধুরীর উপরেই একটু বেশী। সে কথাটা জানতে বা বুঝতে পেরেই হয়তো বিনয়েন্দ্র সরে দাঁড়িয়েছিলেন পুরন্দর চৌধুরীর রাস্তা থেকে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু সরে দাঁড়ালেও প্রেমের ব্যাপারে এত বড় পরাজয়টা বিনয়েন্দ্র কোনদিনই ভুলতে তো পারেনইনি, এমন কি লতাকেও বোধ হয় ভুলতে পারেননি। এবং সেই কারণেই পুরন্দরকে ক্ষমা করতে পারেননি। চিরদিন মনে মনে পুরন্দর চৌধুরীর প্রতি একটা ঘৃণা পোষণ করে এসেছেন।

    যা হোক, পুরন্দর পড়াশুনা ছেড়ে দিলেন এবং বিনয়েন্দ্র ও লতা যথাসময়ে পাস করে স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান বিভাগে নাম লেখালেন। সেখানে থেকে পাস করে বিনয়েন্দ্র নিলেন অধ্যাপনার কাজ, আর লতা বাংলার বাইরে একটা কেমিক্যাল ফার্মে চাকরি নিয়ে চলে গেল।

    পুরন্দর চলে গেলেন সিঙ্গাপুরে। সেখানে গিয়ে লিং সিংয়ের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লেন। পুরন্দর বর্ণিত সিঙ্গাপুর-কাহিনী প্রায় সবটাই সত্য কেবল সত্য নয় তাঁর স্ত্রী ও পুত্রের অকস্মিক সর্পদংশনে মৃত্যুর কথাটা। তাদের তিনি নিজ হাতে বিষ দিয়ে হত্যা করে সেই বাড়িতেই কবর দিয়েছিলেন। এবং পরে অবিশ্যি ওই সংবাদ তারযোগে সিঙ্গাপুর স্পেশাল পুলিসই মাত্র কয়েকদিন আগে আমাকে জানায়। সেই নৃশংস হত্যার পর থেকে পুরন্দর অন্য নামে আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছিল এতকাল।

    তাই বলছিলাম পুরন্দর চৌধুরী শুধু নৃশংসই নয়, মহাপাষণ্ড।

    এদিকে বিনয়েন্দ্র অনাদি চক্রবর্তীর বিষয়-সম্পত্তি পেয়ে নতুন করে আবার জীবন শুরু করলেন। এবং ক্রমে পুরন্দর ও বিনয়েন্দ্রের পরস্পরের প্রতি পোষিত যে হিংসাটা দীর্ঘদিনের অদর্শনে বোধ হয় একটু ঝিমিয়ে এসেছিল, সেটা ঠিক সেই সময়েই অকস্মাৎ একদিন জ্বলে উঠল পুরন্দর কলকাতায় এসে বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখা করায় এবং সেখানে তাকে দেখে নতুন করে আবার সেটা জেগে উঠল দীর্ঘকাল পরে। যার ফলে যাবার পূর্বে পুরন্দর বিনয়েন্দ্রকে সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় হাতেখড়ি দিয়ে গেলেন।

    সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশা ধরানোর ব্যাপারটা পূর্বাহেই অবিশ্যি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য পুরন্দর চৌধুরী মিঃ বসাকের নিকট তাঁর বিবৃতিকালে স্বীকার করেছিলেন।

    ঐ সময় তার সঙ্গেও নিশ্চয়ই পুরন্দরের কোন কথাবার্তা হয়েছিল, যাতে করে ঐ সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় কবলিত করে তাকে দীর্ঘ দিন ধরে দোহন করে করে বিয়েকে একেবারে ঝাঁঝরা করে ফেলা ও লতাকে পাওয়া যায়। এক ঢিলে দুই পাখি বধ করা।

    বলাই বাহুল্য, ইতিপূর্বে একসময় তার চাকরি গিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। আর ঠিক সেই সময় দৈবক্রমেই যেন একজন ল্যাবটারী অ্যাসিস্টেস্টের প্রয়োজন হওয়ায় কাগজে বিজ্ঞাপন দেয় বিনয়েন্দ্র। সেই বিজ্ঞাপন দেখে লতা আবেদন পাঠায়। আবেদনকারীদের মধ্যে হঠাৎ লতার আবেদনপত্র দেখে প্রথমটায় বিনয়েন্দ্রর কি রকম সন্দেহ হয়। তিনি তাকে একটা চিঠি দেন দেখা করবার জন্য লতা পত্রের জবাব দেয়, এবারে আর লতাকে চিনতে বিনয়েন্দ্রর কষ্ট হয় না। আবার লতাকে তিনি চিঠি দেন সাক্ষাতের জন্য। লতা সাক্ষাৎ করতে এল এবং বলাই বাহুল্য দীর্ঘদিন পর লতার প্রতি যে সুপ্ত প্রেম এতকাল বিনয়েন্দ্রর অবচেতন মনে ধিকি ধিকি জ্বলছিল তা লেলিহ হয়ে উঠল দ্বিগুণ তেজে। লতা কাজে বহাল হল। লতা অবিশ্যি তখনও অবিবাহিতা।

    লতাকে বিনয়েন্দ্ররনীলকুঠিতে অকস্মিকভাবে আবিষ্কার করবার পরই পুরন্দরেরমনেলতাকে ঘিরে আবার বাসনার আগুন দ্বিগুণভাবে জ্বলে ওঠে। তাছাড়া বেলাকে বিবাহ করলেও তার প্রতি কোনদিনই সত্যিকারের ভালবাসা জন্মায়নি তার। এবং লতাকে দ্বিতীয়বার আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই লতার প্রতি তার পুরাতন দিনের আকর্ষণ আবার নতুন করে জেগে উঠল। বেলাকে ও তার পুত্রকে হত্যা করে লতাকে বিবাহ করবার পথ পরিষ্কার করে নিয়েছিল পুরন্দর। বেলার মৃতদেহ কোনদিন দৈবক্রমে যদি আবিষ্কৃত হয় তখন যাতে সহজেই হত্যার দায় থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে, ঐ কাল্পনিক কাহিনী পূর্বাহেই বলবার অন্যতম আর একটি কারণ ছিল বোধ হয় তাই আমার কাছে।

    পরে সিঙ্গাপুরে ফিরে গিয়ে বেলাকে হত্যা করে সেই যে পুরন্দর আবার কলকাতায় এল আর ফিরে গেল না সেখানে। নীলকুঠির পাশেই সেই ভাঙা বাড়িতে গোপন আশ্রয় নিল ও; প্রতি রাত্রে উভয়ের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হতে লাগল এবং সেই সঙ্গে চলতে লাগল বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবার পরিকল্পনা। সেই ভাঙা বাড়িতে তাদের গতিবিধির উপর যাতে কারও নজর না পড়ে সেজন্য দ্বিতীয় আর একজনকে সেখানে নিয়ে আসা হল মিশিরজীর পরিচয়ে। অর্থাৎ এবারে পাকাপোক্তভাবেই শুরু হল ওদের অভিযান। শুধু যে পুরন্দর চৌধুরীই দুঃসাহসীই ছিল তাই নয়, লতাও ছিল। পাঞ্জাবী বাপের রক্ত ছিল তার শরীরে, তাই তার পক্ষে সে রাত্রে কার্ণিশ বেয়ে পুরন্দরের পিছু পিছু সুজাতার শয়নকক্ষে প্রবেশ করাটা এমন কষ্টসাধ্য হয়নি কিছু। সে যাক, যা বলছিলাম।

    ৪১.

    সে যাক, যা বলছিলাম, প্রশান্ত বসাক বলতে লাগলেন। পূর্ব পরিকল্পনা মতই সব ঠিক হয়ে গেলে ড্রাইভার করালীকে ওখানে প্রহরায় রেখে লতা অকস্মাৎ একদিন অন্তৰ্হিতা হল। এবং নীলকুঠি থেকে অন্তৰ্হিতা হয়ে সে প্রবেশ করল গিয়ে ভাঙা বাড়িতে।

    হত্যার দিন রাত্রে করালীর সাহায্যে সদর খুলিয়ে লতা এল বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখা করতে। সবে হয়তো তখন বিনয়েন্দ্র সিঙ্গাপুরী মুক্তার নেশায় রঙিন হয়ে উঠেছে। লতা এসেই দরজায় নক করে এবং বিনয়েন্দ্র অকস্মাৎ ঐ রাত্রে গবেষণা-ঘরের দরজা খুলে লতাকে সামনে দেখে বিহ্বল হয়ে যান। আনন্দিতও যে হয়েছিলেন সেটা বলাই বাহুল্য। এবং তারপর ঘরের দরজা খোলাই ছিল। পরে একসময় বিনয়েন্দ্রর অজ্ঞাতে পুরন্দর ল্যাবরেটারী ঘরে প্রবেশ করে। লতার সঙ্গে গল্পে মশগুল বিনয়েন্দ্র, এমন সময় পশ্চাৎদিক থেকে পুরন্দর এসে বিনয়েন্দ্রর ঘাড়ে আঘাত করে। বিনয়েন্দ্র অতর্কিত আঘাতে টুল থেকে পড়ে যান মাটিতে এবং পড়বার সময় তাঁর হাতে লেগে টেবিলের উপর থেকে ঘড়িটা ও দু-একটা কাঁচের যন্ত্রপাতিও সম্ভবত মেঝেতে পড়ে গিয়ে ভেঙে যায়। একটা কাঁচের পাত্রে খানিকটা অ্যাসিড ছিল, সেটা মেঝেতে পড়ে যায়। ঘাড়ে আঘাত করে বিয়েকে অজ্ঞান করে পুরন্দর বিচিত্র ওই স্পেয়িং অ্যাপারেটাসটার সাহায্যে বিনয়েন্দ্রর গলারমধ্যে আরো সর্পবিষ ঢেলে দেয়। তারপর ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপ দেবার জন্য মেঝের ভাঙা কাঁচের টুকরো ও অ্যাসিড সরিয়ে ও মুছে নিতে গিয়ে অতর্কিতে লতার পা কেটে যায়। তখন সে রক্ত ধুয়ে ফেলতে ও ঘরের মেঝের সব চিছু মুছে নিতে ঘরের ওয়াশিং সিঙ্কের ট্যাপ খুলে ন্যাকড়া বা রুমাল জলে ভিজিয়ে সব ধুয়ে মুছে ফেলে। কিন্তু মেঝে থেকে অ্যাসিডের দাগ একেবারে যায় না এবং চলে যাবার সময় পুরন্দর ট্যাপটা বন্ধ করে রেখে যেতে ভুলে যায়। কাঁচের ভাঙা টুকরোয় পা কেটে যাওয়ায় লতা বিনয়েন্দ্রর রবারের চপ্পল-জোড়া পায়ে দিয়ে নিয়েছিল, কারণ সে এসেছিল খালি পায়ে। যে চপ্পল আমি পাশের বাড়ির মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। শুধুমাত্র বিনয়েন্দ্রর হত্যাব্যাপারটাকে আত্মহত্যার রূপই যে দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল তা নয়, ঐ হত্যা প্রচেষ্টার পূর্বে সঙ্গে সঙ্গে একটা ভৌতিক ব্যাপারও গড়ে তোলা হয়েছিল। মধ্যে মধ্যে কিছুদিন হতেই করালীর প্রচেষ্টায়, বলাবাহুল্য আমার একটা কথা বলতে ভুল হয়ে গিয়েছে। বিনয়েন্দ্রর মৃতদেহের পাশে গ্লাস-বিকারের মধ্যে যে তরল পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যেও পরীক্ষা করে সর্প-বিষ পাওয়া যায়। তাতে করে অবিশ্যি বিনয়েন্দ্রের দেহে সর্প-বিষ পাওয়ার ব্যপারটা যে আদৌ আত্মহত্যা নয় এবং হত্যাই সেটা আমার আরও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস হয়। কারণ বিনয়েন্দ্র যে সর্প-বিষ নিয়ে গবেষণা করছিল তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই তার বিকারে সর্প-বিষ পাওয়া ও মৃত্যুর কারণ সর্প-বিষ হওয়ার সন্দেহটা বৃদ্ধি করেছিল। এই গেল বিনয়েন্দ্রর হত্যার ব্যাপার! দ্বিতীয়, রামচরণকেও হত্যা করে পুরন্দর চৌধুরীই পররাত্রে। এবং হত্যা করবার পর সে ল্যাবরেটারীতে যায় নিজের একটা alibi তৈরী করবার জন্য। আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য। সে ভালভাবেই জানত যে রাত্রে আমি সজাগ থাকব ও সহজেই সে আমার দৃষ্টিতে পড়বে এবং তখন তার সেই কাহিনী বলে আমাকে সে তার ব্যাপারে সন্দেহ থেকে নিজেকে মুক্ত করে রাখবে পূর্বেই বলেছি সে-কথা। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে কিরীটীর সঙ্গে আলোচনার পর তাঁর উপরেই আমার সন্দেহটা জাগতে পারে এবং আমি সেইভাবেই পরে তদন্ত চালাতে পারি। কিরীটীই পুরন্দরের উপরে আমার মনে প্রথমে সন্দেহ জাগ্রত করে ও চিঠিগুলোর উপরে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করায়। পরে অবিশ্যি আলাদা আলাদা কাগজে জবানবন্দি লিখে তার উপরে প্রত্যেকের নাম দস্তখত করতে আমি সকলকে বাধ্য করি। এবং প্রত্যেকের আলাদা হাতের লেখা ও তার সঙ্গে সুজাতা, রজত ও পুরন্দর চৌধুরীর কাছে প্রাপ্ত বিনয়েন্দ্রর নামে লেখা চিঠির লেখা মেলাতেই দেখা গেল, একমাত্র পুরন্দর চৌধুরীর হাতের লেখার সঙ্গেই বেশ যেন কিছুটা মিল আছে। পরে অবিশ্যি হাতের লেখার বিশেষজ্ঞও সেই মতই দিয়েছেন। যা হোক, তারপর পুরন্দর চৌধুরীর প্রতিই সন্দেহটা আরো যেন আমার ঘণীভূত হয়। এবং এখানে আর একটা কথা বলা প্রয়োজন, ঐ তিনখানা চিঠি যে আদৌ বিনয়েন্দ্রর লেখা নয় সেটার প্রমাণ পূর্বেই আমি পেয়েছিলাম বিনয়েন্দ্রর ল্যাবরেটারী ঘরের মধ্যে ড্রয়ারে প্রাপ্ত তার নোট-বইয়ের মধ্যেকার বাংলা লেখা দেখে এবং সেই লেখার সঙ্গে চিঠির লেখা মেলাতেই। বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করা হয়েছিল। এবং তাঁর হত্যার সংবাদও তাঁর সম্পত্তির ওয়ারিশন হিসাবে রজত ও সুজাতা পেতই একদিন না একদিন। তবে তাদের ওভাবে অত তাড়াতাড়ি হত্যা-মঞ্চে টেনে আনা হল কেন বিনয়েন্দ্রর নামে চিঠি দিয়ে? তারও কারণ ছিল বৈকি। এবং সেটা বুঝতে হলে আমাদের আসতে হবে পুরন্দর চৌধুরীর সত্যিকারের পরিচয়ে। কে ওই পুরন্দর চৌধুরী।

    আমরা জানি অনাদি চক্রবর্তী তাঁর পিতার একমাত্র সন্তানই ছিলেন। কিন্তু আসলে তা নয়। তাঁর একটি ভগ্নীও ছিল। নাম প্রেমলতা।

    প্রেমলতার তেরো বছর বয়সের সময় বিবাহ হয় এবুং মোল বৎসর বয়সে সে যখন বিধবা হয়ে ফিরে এল পিতৃগৃহে তখন তার কোলে একমাত্র শিশুপুত্র, বয়স তার মাত্র দুই। প্রেমলতা অনাদি চক্রবর্তীর থেকে আঠারো বছরের ছোট ছিল। মধ্যে আরো দুটি সন্তান অনাদির মার হয়, কিন্তু তারা আঁতুড় ঘরেই মারা যায়। প্রেমলতা বিনয়েন্দ্রর মার থেকে বয়সে বছর চারেকের বড় ছিল। বিধবা হয়ে পিতৃগৃহে ফিরে আসবার বছর খানেকের মধ্যে সহসা এক রাত্রে প্রেমলতা তার শিশুপুত্রসহ গৃহত্যাগিনী হয়। এবং কুলত্যাগ করে যাওয়ার জন্যই অনাদি চক্রবর্তী তার নামটা পর্যন্ত চক্রবর্তী বংশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলেন। কিন্তু জোর করে মুছে ফেললেই আর সব-কিছু মুছে ফেলা যায় না।

    যা হোক, গৃহত্যাগিনী প্রেমলতার পরবর্তী ইতিহাস খুঁজে না পাওয়া গেলেও তাঁর শিশু পুত্রটির ইতিহাস খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এক অনাথ আশ্রমে সেই শিশু মানুষ হল বটে, তবে কুলত্যাগিনী মায়ের পাপ য়ে তার রক্তে ছিল! সেই পাপের টানেই সেই শিশু যতই বড় হতে লাগল তার মাথার মধ্যে শয়তানী বুদ্ধিটাও তত পরিপক্ক হতে লাগল।

    সেই শিশুঁকেই পরবর্তীকালে আমরা দেখছি পুরন্দর চৌধুরী রূপে। পুরন্দর চৌধুরী তাঁর যে জীবনের ইতিবৃত্ত দিয়েছিল তা সর্বৈব মিথ্যা, কাল্পনিক। নিজের সত্যিকারের পরিচয়টা পুরন্দর চৌধুরী জানত, কিন্তু তা সত্বেও কোনদিন সাহস করে গিয়ে তার মামা অনাদি চক্রবর্তীর সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কারণ, সে জানত অনাদি চক্রবর্তী কোনদিনই তাকে ক্ষমার চোখে দেখবেনই না, এমন কি সামনে গেলে দূর করেই হয়ত তাড়িয়ে দেবেন।

    তাই কলেজ অধ্যয়নকালে সহপাঠী বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে যখন তার পরিচয় হয় তখন থেকেই। বিনয়েন্দ্রর প্রতি একটা হিংসা পোষণ করতে শুরু করে পুরন্দর এবং সে হিংসায় নতুন করে ইন্ধন পড়ে লতা সিংয়ের প্রেমের প্রতিদ্বন্দিতায়।

    পুরন্দর চৌধুরী অনাদি চক্রবর্তীর সঙ্গে বিনয়েন্দ্রর কোন সম্পর্ক নেই জেনে প্রথমে যেটুকু নিশ্চিন্ত হয়েছিল, পরে অনাদি চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর যখন সে জানতে পারল বিনয়েন্দ্রকেই অনাদি তার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন তখন থেকেই সে নিশ্চিন্ত ভাবটা তো গেলই, ঐসঙ্গে বিনয়েন্দ্রর প্রতি আক্রোশটা আবার নতুন করে দ্বিগুণ হয়েজেগে ওঠে। এবং প্রকৃতপক্ষে তখন থেকেই মনে মনে বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবার পরিকল্পনা করতে থাকে পুরন্দর। কিন্তু এ সময় কিছু দিনের জন্য ভাগ্যচক্রে তাকে সিঙ্গাপুরে ভাগ্যান্বেষণে যেতে হওয়ায় ব্যাপারটা চাপা পড়ে থাকে মাত্র। তবে ভোলেনি সে কথাটা। বিনয়েন্দ্রকে কোন মতে পৃথিবী থেকে সরাতে পারলে সে-ই হবে অনাদি চক্রবর্তীর সম্পত্তির অন্যতম ওয়ারিশন তাও সে ভুলতে পারেনি কোনদিন। আর তাই সে কিছুতেই নীলকুঠির মায়া ত্যাগ করতে পারেনি। নীলকুঠিতে পুরন্দর ছায়াকুহেলীর সৃষ্টি করে। তার ইচ্ছা ছিল, ঐ ভাবে একটা ভৌতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে পরে কোন এক সময় সুযোগ মত বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করবে। সেই মতলবই ধীরে ধীরে পুরন্দর তার পরিকল্পনা মত এগুচ্ছিল।

    এদিকে একদা যৌবনের বাঞ্ছিতা লতাকে পৌঢ়ত্বের সীমানায় এসে হঠাৎ আবার নতুন করে কাছে পেয়ে বিনয়েন্দ্র পাগল হয়ে উঠল। এবং অন্যদিকে আকস্মিকভাবে আবার একদিন। রাত্রে বহুকাল পরে পুরন্দরকে দেখে লতা বুঝতে পারল যৌবনের সে-ভালবাসাকে আজও সে ভুলতে পারেনি। এবং সেই ভালবাসার টানেই পুরন্দরের পরামর্শে তার দুষ্কৃতির সঙ্গে হাতে হাত মেলাল লতা। পরে অবিশ্যি ধরা পড়ে, মুক্তির আর কোন উপায়ই নেই দেখে অনন্যোপায় লতা আত্মহত্যা করে তার ভুলের ও সেই সঙ্গে প্রেমের প্রায়শ্চিত্ত করল।

    কিন্তু বলছিলাম পুরন্দর চৌধুরীর কথা। কেন সে সুজাতা ও রজতকে বিনয়েন্দ্রর নামে চিঠি দিয়ে অত তাড়াতাড়ি নীলকুঠিতে ডেকে এনেছিল?

    কারণ, বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করলেই সে সমস্ত সম্পত্তি পাবে না। রজত ও সুজাতা হবে। তার অংশীদার। কিন্তু তাদের সরাতে পারলে তার পথ হবে সম্পূর্ণ নিষ্কণ্টক। তাই সে ওদের হাতের সামনে ডেকে এনেছিল সুযোগ ও সুবিধা মত হত্যা করবার জন্যই।

    বিনয়েন্দ্রকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সে তার সম্পত্তি লাভের প্রথম সোপান তৈরী করেছিল; এখন রজত ও সুজাতাকে হত্যা করতে পারলেই সব ঝামেলাই মিটে যায়। নিরঙ্কুশভাবেই সে ও লতা বিনয়েন্দ্রর সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে।

    কিন্তু ইতিমধ্যেই নিরপরাধিনী স্ত্রী ও তার শিশু পুত্রকে ও বিনয়েন্দ্রকে হত্যা করে যে পাপের বোঝা পূর্ণ হয়ে উঠেছিল তারই অমোঘ দণ্ড যে মাথার উপরে নেমে আসতে পারে, পুরন্দর চৌধুরী বোধ হয় স্বপ্নেও তা ভাবেনি।

    সাজানো খুঁটি যে কেঁচে যেতে পারে শেষ মুহূর্তেও তা বোধহয় ধারণাও করেনি পুরন্দর। এমনিই হয়। এবং একেই বলে ভগবানের মার। যাঁর সুক্ষ্ম বিচারে কোন ত্রুটি, কোন ভুল থাকে না। যাঁর নির্মম দণ্ড বজ্রের মতই অকস্মাৎ অপরাধী পাপীর মাথার উপরে নেমে আসে।

    নইলে তারই দেওয়া সিঙ্গাপুরী মুক্তা-বিষ খেয়ে লতাকেই বা শেষ মুহূর্তে আত্মহত্যা করে তার মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে কেন? আর হতভাগ্য পুরন্দর চৌধুরীকেই বা অন্ধকার কারাকক্ষের মধ্যে ফাঁসির প্রতীক্ষ্ণয় দণ্ড পল প্রহর দিন গণনা করতে হবে কেন?

    .

    ৪২.

    এ গল্পের শেষ এখানেই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হল না। রজতকে নিজের সম্পত্তির দাবী লিখে দিয়ে পরের দিন যখন সুজাতা আবার লক্ষ্ণৌ ফিরে যাবার জন্য ট্রেনে উঠে বসেছে এবং কামরার খোলা জানলা পথে তাকিয়ে ছিল, এমন সময় পরিচিত একটি কণ্ঠস্বরে চমকে সুজাতা ফিরে তাকাল।

    সুজাতা!

    তুমি এসেছ!

    হ্যাঁ, একটা কথা বলতে এলাম।

    কী?

    এখন যাচ্ছ যাও, এক মাসের মধ্যেই আমিও ছুটি নিয়ে লক্ষ্ণৌ যাচ্ছি।

    সত্যি?

    হ্যাঁ।

    কিন্তু কেন?

    তোমাকে নিয়ে আসতে।

    ঢং ঢং করে ট্রেন ছাড়বার শেষ ঘণ্টা পড়ল। গার্ডের হুঁইসেল শোনা গেল।

    কি, তুমি যে কিছু বলছ না? প্রশান্ত প্রশ্ন করে।

    কী বলব?

    কেন, বলবার কিছু নেই?

    ট্রেনটা ধীরে ধীরে চলতে শুরু করেছে তখন। সুজাতার চোখের কোল দুটো অকারণেই ছল ছল করে আসে। সে কেবল মৃদু কণ্ঠে বলে, না।

    –: সমাপ্ত :–

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরাত নিঝুম – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
    Next Article অবগুণ্ঠিতা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    Related Articles

    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    কিরীটী অমনিবাস ১ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025

    কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

    September 8, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.