Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কিশোর গল্প – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প310 Mins Read0

    ডিমেংকারি

    আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা বলতে বসেছি৷ হাজারিবাগে গোপালদের ছবির মতো বাড়িতে উঠেছি গিয়ে গোপালের সঙ্গে৷ গোপালের ভালো নাম মিহির সেন৷ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং শিকারি৷ পনেরো দিন থাকব৷ একশো টাকা ক্যাপিটাল৷ এ-বেলা এবং ও-বেলা চমনলাল খিচুড়ি রাঁধে৷ মুরগি, তিতির, খরগোশ শিকার হলে আমিষ৷ নইলে নিরামিষ৷ এখন শীত৷ শীত মানে, হাজারিবাগি শীত৷ সন্ধে হতে-না-হতেই দু’কান পাকড়ে থাপ্পড় মারে৷

    আমাদের গাড়িও নেই, জিপও নেই৷ জোগাড় করার ক্ষমতা বা প্রতিপত্তিও নেই৷ পায়ে হেঁটে এদিক-ওদিক ঘুরি বন্দুক-কাঁধে৷ অথবা সাইকেল-রিকশা করে সীমারিয়ার রাস্তাতে বানাদাগ অবধি গিয়ে, সাইকেল-রিকশা ছেড়ে দিয়ে বন্দুক এবং ঝোলাঝুলি কাঁধে হণ্টন মারি কোসমার উদ্দেশে৷ নাগেশ্বরোয়ার ঘর তেঁতুলগাছতলায়৷ নয়া তালাও-এর কাছে৷ সেই ঘরের লাগোয়া নাজিমসাহেবের তিন দিক বন্ধ আর একদিক একেবারে উদোম খোলা মাটির ঘরটি৷ জাংগল-কটেজ৷ সেই ঘরই আমাদের আস্তানা৷ রাতে, উদোম দিকটার সামনে আগুন জ্বেলে, আলুকা ভাত্তা, ঘি এবং খিচুড়ি খেয়ে ঘরের মাটির মেঝে খোঁড়া ধিকিধিকি জ্বলা উনুনের পাশে প্রথম প্রহরে কাদা ঘুম ঘুমিয়ে উঠে একেবারে সূর্যোদয় অবধি পালসা শিকার করি৷ পায়ে হেঁটে—টর্চ নিয়ে৷ দু’দিন আগে খুব বড় একটা হুণ্ডার মেরেছিলাম আমি৷ আর গোপাল মেরেছিল একটা বড়কা দাঁতাল শুয়োর৷ শ্রীসত্যচরণ চ্যাটার্জি, মানে সুব্রতর বাবা তখন হাজারিবাগের পুলিশ সুপার৷ এস-পির অফিসিয়াল কোয়ার্টারে থাকতেন তিনি তখন৷ গোপালই একদিন বলল, জিপ না হলে বড় শিকার কিছুই হবার নয়৷ রোজ-রোজ কি সাইকেল-রিকশা করে সীতাগড়াতে গিয়ে মানুষখেকো বাঘের রাহান সাহান-এর খোঁজ করে আবার ফিরে আসা যায় শহরে? এভাবে অসম্ভব৷ তার চেয়ে এক কাজ করো, তুমি বাংলায় একটা জম্পেশ করে চিঠি লেখো এস-পি সাহেবের ছেলেকে৷ লেখো যে, তার শিকারের উৎসাহের কথা শুনছি আমরা বহুদিন ধরে তাই আলাপ করার বড়ই ইচ্ছে, তাছাড়া সীতাগড়া পাহাড়ে একটি মানুষখেকো বাঘ অপারেট করছে৷ আমরা তাকে মারবার চেষ্টাও করেছি৷ যদি সে আমার সঙ্গে যোগ দিতে চায়, তো দিতে পারে৷ আমাদের একটুও আপত্তি নেই৷ এমন করে চিঠিটা লেখো, যাতে এক চিঠিতেই পার্টি কাত হয়৷ রিয়েল স্পোর্টসম্যান-স্পোর্টসম্যান গন্ধ বেরোয় যেন চিঠি থেকে৷ আসল কেসটা ধরে না ফেলে৷

    এক বিকালে পূর্বাচল-এর পশ্চিমের বারান্দায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে অনেক পাঁয়তারা করে একখানি চিঠি লিখে ফেললাম৷ মালির হাত দিয়ে সে চিঠি গোপাল পাঠিয়ে দিল এস-পি সাহেবের বাংলোয়৷ জিপ-টিপ আর কোনো সমস্যাই নয়৷ যতক্ষণ না মালি উত্তর নিয়ে ফেরে, ততক্ষণ টেন্স হয়ে, ভুরু কুঁচকে অস্তগামী সূর্যের দিকে চেয়ে একটার পর একটা সিগারেট খেতে লাগল গোপাল৷

    সূর্যও ডুবল, আর করম মালি ফিরে এল সাইকেলে কিরকির আওয়াজ তুলে৷ এবং প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা গাড়ি বাংলোর গেটে ঢুকল৷ গাড়ি পার্ক করিয়ে লেংথ-উইদাউট-ব্রেথ, কিন্তু প্রচণ্ড রাশভারী কুড়ি বছরের তেজি শৌখিন-গোঁফের সুব্রত চাটুজ্যে নামলো গাড়ি থেকে৷ গোপাল ফুলহাতা সোয়েটারের ওপরে একটা জাপানি কিমোনো পরে বসে ছিল৷ নীচে খাকি ফ্ল্যানেলের ট্রাউজার৷ তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই বলল, ‘‘নমস্কার৷’’

    সুব্রতর সঙ্গে আমাদের আলাপ বিলক্ষণই হল৷ কিন্তু তাৎক্ষণিক সুবিধে বিশেষ হল না৷ ও বলল যে, বাবার সঙ্গে ঝুমরিতলাইয়াতে যাচ্ছে, দিন সাতেক পরে ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে৷ কিন্তু আরো দিন সাতেক আমরা থাকতে পারব কি না তারই ঠিক নেই৷

    যাই হোক, সুব্রত তার ফিনফিনে তালঢ্যাঙা ফর্সা চেহারার সঙ্গে একেবারেই বেমানান৷ কালো, ঢাউস মার্কারি-ফোর্ড গাড়িখানা চালিয়ে যখন চলে গেল, তখন গোপাল কিমোনোর দু’হাতার মধ্যে হাত ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘‘এ পার্টি বহুতই চালু আছে৷ জিপ তো পাওয়া যাবেই না, মধ্যে দিয়ে আমাদের সীতাগড়ের বাঘটাও বোধহয় বেহাত হয়ে যাবে৷’’

    ‘‘বেহাত হবে মানে? বাঘটা কি তোমার হাতের পাঁচ? আজ অবধি লেজটি পর্যন্ত দেখাল না আমাদের! খালি থাবার ছাপ দেখিয়েই ঘুরিয়ে মারছে, চোখ-বাঁধা বলদের মতো৷’’

    ‘‘উহারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে! একেই বলে যোগাযোগ! তবে আমাদের হাত থেকে ফসকেই গেল৷’’

    কিমোনো থেকে বাঁ হাত হঠাৎ বের করে বাঁ গালে চটাস করে একটা মশা মেরে ও বলল, ‘‘তোমার মাথার গ্রে-ম্যাটার বিলক্ষণ কম আছে৷ হাজারিবাগ জেলার এস-পি সাহেবের ছেলে যদি কোনো হাজারিবাগি বাঘকে মারতে চায়, তাহলে সে সুধন্য বাঘ কি অন্য কারো কাছেই গুলিখোর হবে? মরণে মহান হলে, কাগজে ছবি ছাপা হবে তার শিকারির সঙ্গে৷ এমন সুযোগ কোনো বোকা মানুষই ছাড়ত না, আর এমন চালাক বাঘ ছাড়বে? না, সাংঘাতিক স্ট্র্যাটেজিক ভুল হয়ে গেল৷ বুঝেছ?’’

    সেই মানুষখেকো বাঘটাকে পরে সুব্রত মেরেছিল সীতাগড়া পাহাড়ের নীচে৷ টুটিলাওয়ার জমিদার ইজাহারুল হকও সঙ্গে ছিল৷ ইজাহার আর আজকে বেঁচে নেই৷ সুব্রত এখন গোমিয়ার ইন্ডিয়ান এক্সপ্লোসিভস-এর ভারী অফিসার৷ কয়েক বছর আগে কোথা থেকে এসে একটা গুলিখেকো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার গোমিয়ার এক্সপ্লোসিভস ফ্যাক্টারির উঁচু পাঁচিল টপকে ভিতরের পুটুস আর ঝাঁটি জঙ্গল ভরা এলাকায় ঢুকে পড়েছিল৷ গত জন্মে বোধহয় ও সুব্রতর কাছে ঘুষ খেয়েছিল, তাই এ জন্মে কৃতজ্ঞতায় সুব্রতর রাইফেলের মিষ্টি গুলি না খেয়ে মরবে না মনস্থ করে আত্মহত্যা করতে এসেছিল সুব্রতর সৎসঙ্গে৷ নাজিমসাহেবকে হাজারিবাগ থেকে ডাকিয়ে নিয়ে সেই মহান বাঘকে ঋণমুক্ত করেছিল সুব্রত এবং তার আত্মাকে বিষুনপুরের মোড়ে নিয়ে গিয়ে বাসে চড়িয়ে দিয়ে, গয়ায় পাঠিয়েছিল স্বপিণ্ডদানের জন্যে৷

    ভূতো-পার্টি ঠিক সেই সময় এসে লাফিয়ে নামল সাইকেল-রিকশা থেকে৷ এই এক ছেলে৷ একরত্তি, কিন্তু ভয়-ডর, শীত-গ্রীষ্ম, আরাম-বিরাম বলতে কিছুমাত্র নেই৷ দারুণ গাড়ি চালায় আর যে-কোনো গাড়ি বা জিপ ওর সঙ্গে কথা বলে৷ সবসময় গোপালের চামচেগিরি করছে এক-ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে৷ ওকে পাঠানো হয়েছিল কোনো গাড়ি-টাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় কিনা, তারই খোঁজে৷ এই শীতে নিম্নাঙ্গে শুধুমাত্র জিনস৷ ঊর্ধ্বাঙ্গে সোয়েটারহীন মালটিকালারড প্যারালাল স্ট্রাইপস-এর গেঞ্জি৷ শ্রীচরণে এক জোড়া হাফ ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াইয়ান চপ্পল৷ ঝাঁকি মেরে-মেরে, হাঁটতে-হাঁটতে ভূতো এসে সিরিয়াস মুখে বলল, ‘‘হবে৷’’

    আমি শুধোলাম, ‘‘কী হবে?’’

    ‘‘গাড়ির বন্দোবস্ত৷ দেখে এলাম মসজিদের পেছনে থাকে-থাকে সাজানো ইটের উপর বসে আছে নাইনটিন থার্টি-টুর হুড-খোলা টি-মডেল ফোর্ড৷ হাঁস যেমন করে বসে ডিমে তা দেয়, তেমন করেই ইটে তা দিচ্ছে৷ তিরিশ টাকা ভাড়া এক রাতের৷ কাডুয়া-তেলেও চলে, সুরগুজার তেলেও চলে, আবার পেট্রলেও চলে৷ তবে তেলের কোয়ালিটি যত ভালো হবে, ততই ভালো হবে পিক-আপ৷ বুক করতে হলে ক্লিয়ার ফর্টি-এইট আওয়ার্সের নোটিস দিতে হবে মালিক-কাম-ড্রাইভারকে, কারণ, ইট-ফিট সরিয়ে এঞ্জিনের মধ্যে বাসা-বাঁধা নেংটি ইঁদুরদের তাড়িয়ে সব ঠিকঠাক করতে টাইম লাগবে তো!’’

    গোপাল অনেকক্ষণ ভূতোর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভেবে, হঠাৎই ধমক দিয়ে বলল, ‘‘মগের মুলুক পেয়েছ? তিরিশ টাকা কম টাকা হল নাকি? কম-টম করে কি না, কাল গিয়ে একটু হিগলিং করে দেখে এসো৷ তিরিশ টাকা যেন তোমার গায়েই লাগছে না?’’

    ভূতো তীব্র আপত্তি করে জানাল যে, হিগলিং-ফিগলিং-এর মধ্যে সে আর নেই৷ পরশু রাতে ছাড়োয়া ড্যামের কাছে একগাদি শুয়োর মেরে এনে আমরা ভূতোকে পাঠিয়েছিলাম সর্দারজির হোটেলে৷ ভূতো প্রায় মাঝরাতে জনা পাঁচেক তাগড়া সর্দারজিকে নিয়ে গিয়ে ছারোয়া ড্যামের জঙ্গলের মধ্যে টর্চ ফেলে মরা শুয়োর দেখাচ্ছিল, আর হিগলিং করছিল৷ একজন দৈত্যপ্রমাণ সর্দারজি ওকে কিছুতেই কায়দা করতে না পেরে, শেষে বগলচাপা করে রেখে দিয়েছিল অনেকক্ষণ৷ অত্যন্ত বেকায়দায়৷ এখনও সর্দারজির গায়ের প্যাঁজ-রসুনের গন্ধ যায়নি ওর নাক থেকে৷ হিগলিং-এর নাম শুনেই ভূতো পেছিয়ে গেল৷ তবে, তিরিশ টাকা তখনকার দিনে অনেক এবং আমাদের তো ঐ অবস্থা৷ সুতরাং ভাড়া-গাড়িও জুটল না৷ গোপালের সঙ্গে পরামর্শ করে শেষ চেষ্টা করাই সাব্যস্ত হল৷ পেট্রল-পাম্প থেকে ডালটনগঞ্জে একটা ফোন বুক করে দিয়ে ধুকপুক বুক নিয়ে আমরা বসে রইলাম মবিলের আঠাতে চ্যাটচেটে টেবিলের উপর৷ আশ্চর্য! সেদিন দশ মিনিটের মধ্যেই লাইন মিলে গেল৷ ডালটনগঞ্জের মোহন বিশ্বাস বলল, ‘‘দু’দিনের জন্যে, নো-প্রবলেম৷ বে-ফিক্কর থাকুন৷ কাল দুপুরের মধ্যেই জিপ যাবে হাজারিবাগের বাড়িতে৷’’

    আমাদের আর পায় কে! পাম্প থেকে সোজা একেবারে নাজিম মিঞার বাড়িতে৷ ইদে জবাই হবার অপেক্ষায় পেতলের চেনে বাঁধা মসৃণ, সফেদ খাসি উজ্জ্বল চোখে রোদ পোয়াচ্ছিল নাজিমসাহেবের বাড়ির বারান্দায়, নাজিমসাহেবও স্বয়ং৷ খবরটা পেয়েই তো উনি লাফিয়ে উঠলেন৷ ‘‘জিপ পাওয়া যাচ্ছে? কিন্তু কোন দিকে যাওয়া যায়? আর কে-কে যাবে?’’ বলেই বললেন, ‘‘এক্কেবারে হল্লা-গুল্লা নয়৷ গোপালবাবু, ‘ভুচু’, আমি আর আপনি৷’’

    নাজিমসাহেব ভূতোকে প্রথম দিন থেকেই ‘ভুচু’ বলে ডাকতেন৷ কেন, তা উনিই জানেন, আর ভূতোই জানে৷ রহস্যটা এ পর্যন্ত আমাদের কাছে অজ্ঞাতেই রয়ে গেছে৷ ভূতো নাজিমসাহেবকে ধমকে বলল, ‘‘সে না হয় হল, কিন্তু যাবেন কোন দিকে?’’

    আমরা নাজিমসাহেবকে খুবই সমীহ করতাম৷ কিন্তু হাজারিবাগে নবাগত, গোপালেরই অতিথি ভূতো (ওরফে ভুচু) প্রথম দিন থেকেই যে নাজিমসাহেবকে এমন ডেঁটে কথা বলত কোন সাহসে, তা সত্যিই আমাদের বুদ্ধির বাইরে ছিল৷ পরে অবশ্য বিস্তারিত জানা গেছিল সে রহস্য৷ সে-কথা, অন্যখানে বলা যাবে’খন৷

    নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘তাই-ই তো ভাবছি৷ কোথায় যাওয়া যায়?’’

    ‘‘টুটিলাওয়া হয়ে ওল্ড চাতরা রোড ধরে চাতরা যাবেন?’’ আমি বললাম৷

    গোপাল বলল, ‘‘কাটকামচারী চলুন না, নাজিমসাব?’’

    ফচকে ‘ভুচু’ বলল, ‘‘দানুয়া-ভুলুয়ার জঙ্গলে?’’

    নাজিমসাহেব ইদের খাসির মতোই অনেকক্ষণ ধ্যানমগ্ন থাকার পর ধ্যান ভেঙে বললেন, ‘‘নেহি৷ উসব ছোড়িয়ে৷ কাল চলেঙ্গে হান্টারগঞ্জ৷ মশহুর জাগা৷ হান্টার লোঁগোকা বেহেস্ত৷’’

    আমরা সবিস্ময়ে, সহর্ষে, সমস্বরে বললাম, ‘‘হান্টারগঞ্জ! ওয়া! ওয়াহ৷’’

    পরদিন বেলা বারোটা নাগাদ ডালটনগঞ্জ থেকে চাঁদোয়া-টোডি, বাঘড়ার মোড়, সীমারীয়া, টুটিলাওয়া হয়ে মোহনের জিপ সত্যিই হাজারিবাগে এসে পৌঁছল৷ ড্রাইভারের নাম সাকির মিঞা৷ এই প্রচণ্ড শীতে এতখানি জঙ্গলের পথ আসতে ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল বেচারা৷ তার শরীরটা বেঁকে গিয়ে গাড়ির শক-অ্যাবসরবারের মতো দেখচ্ছিল৷ সেও আজ বেঁচে নেই৷ বিকেল পাঁচটা নাগাদ নাজিমসাহেব এসে পৌঁছলেন দুই হ্যান্ডেল থেকে লাল-নীল প্লাস্টিকের ফিতে ঝোলানো তাঁর ঝিং চ্যাক সাইকেলে, রিং-টিং বেল বাজিয়ে৷ আমরা বন্দুক মুছে, তেল দিয়ে, ফিনসে মুছে গুলি-টুলি ঠিকঠাক করে, ওভারকোট, টুপি, মাফলার, ওয়াটার বটল সব এক জায়গায় জমিয়ে রেডি হয়েই বসে ছিলাম৷

    নাজিমসাহেব এসেই গোপালকে বললেন, ‘‘চমনকো বুলাইয়ে৷’’

    চমন এসে দাঁড়াল গোপালের ডাকে৷ আমাদের চমনলাল সত্যিই গ্রেট লোক ছিল৷ কারো কথা শোনার সময় চমনের কান দুটো গ্লাইডারের ব্লেডের মতো নড়াচড়া করত৷ ওর আর যে গুণটি ছিল, তা কোনো মডার্ন সাবমেরিনের হাইড্রো-সোলার সিস্টেমেরও নেই৷ ইচ্ছাশ্রুতির মানুষ ছিল সে৷ যে কথা সে শুনতে চাইত না, সে কথা শুনতেই পেত না৷

    নাজিমসাহেব চমনকে বললেন, চিতলের কাটলেট হবে৷ শুধু খিচুড়িটা রেঁধে রাখলেই চলবে চমনের৷ কিন্তু মশলা-টশলা বেটে ঠিকঠাক করে রাখতে হবে মাংসের জন্য৷ বাকি রান্না নাজিমসাহেব ফিরে এসে স্বয়ং ফটাফট করে ফেলবেন৷ নাজিমসাহেবের রান্নার হাতের জবাব ছিল না৷

    ভূতো কিছুক্ষণ বোকার মতো চেয়ে থেকে বলল, ‘‘হান্টারগঞ্জের বাজারে বুঝি চিতল মাছ পাওয়া যায়? হাজারিবাগে তো পাওয়া যায় না?’’

    নাজিমসাহেব খিকখিক করে হেসে উঠলেন৷ পানের পিক আর কালা-পিলাপাত্তি জর্দা ছিটকে এল দাঁতের ফাঁক দিয়ে৷ ঠাট্টার গলায় বললেন, ‘‘আরে ভুচু, ঈ চিতল তুমহারা কুলকাত্তাকে চিতল নেহি হ্যায়৷’’

    ভূতোকে বললাম, ‘‘চিতল মানে স্পটেড-ডিয়ার৷’’

    আমাদের গোপালও দারুণ ভালো কুক৷ হাজারিবাগের বাড়ির নিরবচ্ছিন্ন নিরিবিলিতে ইংরিজি, মোগলাই, বাঙালি, চাইনিজ এবং নানারকম পদ নিয়েই এক্সপেরিমেন্ট চালাত ও৷ চমনলাল আর আমাকে দিয়ে সে-সব এক্সপেরিমেন্টাল অখাদ্য খাওয়াত৷ খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে ও নিজে কোনোদিনই ছিল না৷ ও খালি শুঁকত৷ চিরদিনই নিখাকিবাবা৷ তবে গোপালের রান্নার হাত এখন যে-রকম, তাতে অনেক বড়-বড় হোটেলের শেফও লজ্জা পাবে৷ ড্রাইভার সাকির মিঞাকে উদ্দেশ করে নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘অব চলা যায় ড্রাইভার সাহাব৷’’

    সাকির মিঞা বলল, ‘‘জি জনাব৷’’

    আমি আর গোপাল সামনে বসলাম৷ পেছনে ভূতো আর নাজিমসাহেব৷ একমাত্র ভূতোরই গায়ে কোনো গরম জামা নেই৷ কারোই কোনো কথা শোনে না ও৷ নাজিমসাহেব বলতেই ও বলল, ‘‘কলকাতায় তো শীত পাওয়া যায় না৷ এখানে পাচ্ছি, বিনা-পয়সায় তাই খেয়ে নিচ্ছি খালি গায়ে৷ শীতটা ভালো৷ কিন্তু আপনাদের মশাগুলো খারাপ৷’’

    জিপ ছেড়ে দিল৷ মুখ বাড়িয়ে গোপাল চমনকে বলল যে, আমরা খুব বেশি দেরি করলে রাত এগারোটা করব৷ খিচুড়ি যেন রেঁধে রাখে৷

    পদ্মার রাজার বাড়ির দিকে জিপ ছুটল৷ রাস্তাটা খুবই খারাপ হয়ে রয়েছে৷ বড়-বড় গর্ত৷ পথের দু’পাশের কাঁচা রাস্তাতে আরও বড়-বড় গাড্ডা৷ কিন্তু সাকির মিঞা আড়াই-পাক ফসল আর্মি-জিপের স্টিয়ারিংটা শক্ত করে ধরে সটান সামনে চেয়ে বসে রইল তো রইলই৷ ঐ ঠান্ডার হাত-নাড়ানাড়ির ঝামেলার মধ্যে সে একেবারেই যেতে চায় না বলেই মনে হল৷

    ওকে একটু লক্ষ করার পর নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘ক্যা, মিঞাসাব? নিম্মন গীতিয়া না গায়েব; না, সরকারনে পাকড়ায়েব?’’

    সাকির মিঞা গুঁ এবং গাঁর মাঝামাঝি একটা চাপা সংক্ষিপ্ত আওয়াজ করল৷ স্টিয়ারিং ঐভাবেই ধরে থেকে৷ কী যে বলতে চাইল, তার কিছুমাত্রও বুঝলাম না আমরা৷

    ভূতো শুধোল, ‘‘ব্যাপারটা কী?’’

    ‘‘ব্যাপার বুঝে আর কাজ নেই৷ যার বোঝার সে ঠিকই বুঝেছে৷ শরীরের সমস্ত যন্ত্রপাতির ঠিকানাই বদলে যাচ্ছে৷ আর জনাব বে-ফিক্কর৷ শেষমেশ ভুচুকেই চালাতে হবে জিপ৷ এভাবে যাওয়া…’’

    ‘‘কেন? এখন কুলকাত্তার ড্রাইভারকে তলব কেন? আপনার হাজারিবাগের সবই তো একেবারে উঁদো৷ সুইজারল্যান্ডের চেয়েও ভাল জায়গা!’’

    ভূতো চিবিয়ে দিল নাজিমসাহেবকে৷

    গোপাল বলল, ‘‘বরহিতে তেল দেখে নিতে হবে ভূতো৷ ভুলো না৷’’

    ন্যাশানাল পার্কের পাশে পৌঁছবার আগেই ভূতোকে এসে স্টিয়ারিং-এ বসতে হল৷ আমাদের হাড়গোড় নইলে সত্যিই আর আস্ত থাকবে না৷ সাকির মিঞা৷ শেয়াল রং চাদরে তার শরীর এবং সম্মান আপাদমস্তক ঢেকে ফেলে পেছনের সিটে নির্বিকারে ঘুমাতে লাগল৷

    ভূতো জিপ চালাচ্ছে৷ তবুও, মাঝে-মাঝেই, নাজিমসাহেবের বিরক্তিসূচক আঃ, উঃ, ক্যা হো রহা হ্যায়? ইত্যাদি আওয়াজ আসতে লাগল পেছন থেকে৷ গোপাল বলল, ‘‘ক্যা হুয়া নাজিমসাব?’’

    ‘‘হোগা ঔর ক্যা? ড্রাইভারদাদা তো আমাকে ইজিচেয়ার করেছেন৷ ইজিচেয়ারে ঘুমুতে-ঘুমুতে চলেছেন৷ পুরো শরীরের ভার আমারই গায়ে৷’’

    মিনিট দশেক পর হঠাৎ ‘কেঁয়াও’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন নাজিমসাহেব৷

    ভূতোও সেটাকে ভূতুড়ে আওয়াজ মনে করে আচমকাই ব্রেক-শুতে মারল ডান পায়ে এক জোর লাথি৷ মারতেই, এক্কেবারে কেলো! ঘুমন্ত, আত্মবিস্মৃত সাকির মিঞা সিট থেকে এক ঝটকায় নাজিমসাহেবের কোলে৷ এবং নাজিমসাহেব তাকে দু’ ঊরুর উপরে নিয়ে ঘুঘুরসই করতে-করতে জিপের মেঝেতে৷ ইনসট্যানটেনাসলি, আমাদের মাথা ঠুকে গেল উইন্ডস্ক্রিনে৷ কিন্তু এততেও যতি হল না৷ মনে হল, আমার ঘাড়েরই উপর দু’টি মামদো-ভূতে গামদা-গামদি করছে৷ তার উপর হঠাৎ কাঁচা ডিমের ফাটা গন্ধ আর তার সঙ্গে উঁ-উ-উ, আঁ-আঁ, ইঁ-ইঁ ইঁ, ঈঁ-ঈঁ-ঈঁ, গিস-গিস, টিস-টিস—নানারকম সব উদ্ভট আওয়াজ৷

    ভূতো একপলকে ব্যাপারটা দেখে নিয়েই স্টিয়ারিং ছেড়ে লাফিয়ে নেমে পড়ে বাঁ দিকের গাছতলায় দাঁড়িয়ে পেটে হাত দিয়ে কোমর বেঁকিয়ে-বেঁকিয়ে হাসতে লাগল৷ সে হাসি আর থামে না৷ ব্যাপার সুবিধের নয় বুঝে আমরাও ঘাবড়ে গিয়ে নেমে পড়তেই দেখি, একেবারে ডুনুন-ডুনুন কাণ্ড! আনডাউটেডলি আন্ডা-হল্ট৷

    গোপাল সাকির মিঞাকে ধমকে বলল, ‘‘আন্ডা কাঁহাসে লে আয়া আপ’? সাকির মিঞা এবং নাজিমসাব দু’জনের কারো’ই কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না৷ জিপের সিটের নীচে রাখা এক ঝুড়ি ডিমের মধ্যে বডি থ্রো দিয়েছিলেন দু’জনে জাপটা-জাপটি করতে-করতে৷

    সাকির মিঞা যা বলল, তাতে বোঝা গেল যে চিপাদোহরের ডেরায় রোড-আইল্যান্ড আর লেগ-হর্ন মুরগির অনেক ডিম হওয়াতে মোহনের মেজকাকা ঝুড়ি ভর্তি ডিম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শালপাতা দিয়ে প্যাক করে এই জিপে করেই৷ সাকির মিঞা ডিমের ঝুড়িটা নামাতে একেবারেই ভুলে গেছল ডালটনগঞ্জে৷

    ভুতো একবার বাঁ পা ছুড়ে, ডান হাত তুলে, আর একবার ডান পা ছুড়ে, বাঁ হাত তুলে, ‘ও, বাব্বা রে! ও মাম্মা রে! কী গন্ধ রে!’ বলে তখনও লাফাচ্ছিল৷

    সত্যিই, কাঁচা ডিমে ভারী বদ গন্ধ! তাও আবার এক ঝুড়ি বিলিতি মুরগির ডিমের একগাদা বিজাতীয় গন্ধ৷ ওয়াটার বটল দুটোর সব জলই শেষ হয়ে গেল ওদের দুজনকে ডিম-ফুটিয়ে বের করতে৷ ভূতো নিজের হিপ-পকেট থেকে ধূপকাঠির প্যাকেট বের করে চারগাছি ধূপকাঠি জ্বেলে জিপের ড্যাশবোর্ডে গুঁজে দিয়ে নাজিমসাহেবকে বলল, ‘‘ক্যা আন্ডাবাবা? চলনা হ্যায় তো হান্টারগঞ্জ? হান্টারলোঁগোকা বেহেস্তমে?’’

    ‘‘হাঁ-হাঁ৷ চলো ভুচু৷ জরুর যানা!’’ গলায় কাঁচা-ডিমের কুসুমের সঙ্গে কুসুম-কুসুম উৎসাহ মাখিয়ে নাজিমসাহেব বললেন৷

    সাকির মিঞার বাতচিত বিলকুল বন্ধ৷ কারণ, ডিম-ফাটাফাটি যা হবার তা-তো হয়েছিলই, তার উপরে নাজিমসাহেবের বন্দুকটার বত্রিশ ইঞ্চি লম্বা ব্যারেল একেবারে গদার মতো গিয়ে গদ্দাম করে তার চাঁদিতে পড়ায় তার মাথা ফাটাফাটিরও উপক্রম হয়েছিল৷

    আমার মন বলছিল যে, পুরো ব্যাপারটাই ভূতোর প্রি-প্ল্যান৷ যখন পেছনে বসেছিল ও, তখনই নিশ্চয়ই ডিম-আবিষ্কার করেছিল৷

    বরহিতে পৌঁছে তেল নেওয়া হল৷ চার গ্যালন মতো তেল খেল৷ সাকির মিঞা নেমে ড্রাইভিং সিট তুলে একটা বাঁশের টুকরো পেট্রল ট্যাঙ্কের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েই, তুলে তার গন্ধ শুঁকে বলল, ‘‘হ্যাঁ! পুরা ফুল৷’’

    সাকির মিঞা এবং নাজিমসাহেব দুজনেই পানের দোকানে গিয়ে কষে কালা-পিলাপাত্তি জর্দা দিয়ে পান খেলেন, গন্ধ তাড়াতে৷ ভূতো বলল, ‘‘গোপালদা, এই ফাটা ডিমের ঝুড়ি ধাবার সর্দারজিকে দান করে দিন, নইলে বিপদ হবে৷ ডিমের মতো অযাত্রা আর নেই৷ তার উপর আবার শিকারে!’’

    আমি বললাম, ‘‘সব ডিম তো ভাঙেনি৷ রোড-আইল্যান্ড আর লেগ-হর্নের ডিম৷ তা ছাড়া, পরের ডিম৷ দিয়ে দেবে?’’

    ভূতো চটে বলল, ‘‘নিজের ডিম হলেও দেওয়া উচিত৷ ডিম ফটাফট ফাটবে এখানে, আর ওমলেট ফুলবে ডালটনগঞ্জের তাওয়ায়, তা-তো হয় না৷ না দিতে চান তো সবগুলো ডিম গুলে একটা বারকোশের সাইজের ওমলেট বানাতে বলে নামিয়ে দিন ড্রাইভারকে সর্দারজির ধাবায়৷ খাকগে সে বসে-বসে৷’’

    গোপাল বলল, ‘‘মাথা গরম করে না ভূতো৷ দেখছ না, পরের ডিম৷’’

    ভূতো গোপালের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি হেনে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট করল৷

    বরহি থেকে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে দোভিতে এলাম আমরা৷ দোভি থেকে ডানদিকে গেলেই বুদ্ধগয়া হয়ে গয়া আর বাঁ দিকে গেলে চাতরা৷ ওই রাস্তাতেই কয়েক মাইল গিয়ে ডানদিকের পাহাড়ের উপরে চলে গেছে একটি রাস্তা—হান্টারগঞ্জে৷ গয়ার অন্তঃসলিলা ফ;র শাখানদী ইলাজান বয়ে গেছে সেখানে এঁকে-বেঁকে৷ ভারী সুন্দর নদী৷ দোভিতে এসে বাঁ দিকে মোড় নেব আমরা৷ শীতটা বাড়ছে রাত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে৷ ওখানে চা খেয়ে গা গরম করে নিলাম৷ ওঁরা দুজনে আবারও জর্দা-পান খেলেন৷

    ‘‘ওয়াটার-বটলগুলোতে এখানে জল ভরে নেওয়া যাক ভূতো৷ সব জল তো ডিম ধুতেই গেল৷’’ আমি বললাম৷

    নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘ছোড়িয়ে তো৷ ঝুটমুট দের হো রহা হ্যায়৷ ঔর দের করনেসে শিকার-উকার কুছ নেহি মিলেগা৷ ঝুটা পরিসানি হোগা৷’’ ভূতো জিপ স্টার্ট করে বলল, ‘‘আপনারা কি কিন্ডারগার্টেনের ছাত্র-ছাত্রী নাকি? যেখানেই যান, জলের বোতল গলায় ঝুলিয়ে…’’

    গোপাল চটে উঠে বলল, ‘‘সবটাতে ইয়ার্কি করো না৷ বন-পাহাড়ে ঘুরে-ঘুরেই এই অভ্যেস হয়েছে৷ কিছু খারাপ অভ্যেস নয়৷ জলই হচ্ছে প্রাণ৷ জঙ্গলে গেলে জল সবসময়ই নেওয়া উচিত৷’’

    ভূতো বলল, ‘‘যত্ত সব বাতিক আপনাদের৷ রাতে এই ঠান্ডাতে কেউ আবার ঘড়া-ঘড়া জল খায় নাকি? এমনিতেই তো শীতের দিনে ঘাম হয় না বলে বাথরুম করতে-করতে হয়রান অবস্থা৷ তার উপর…৷ আমরা কি ফায়ার ব্রিগেডের লোক?’’

    ভূতোর সঙ্গে কথায় পারা ভার৷ নাজিমসাহেব, যাঁর ভয়ে আমি আর গোপাল কেঁচো, তিনিই পারেন না; তো আমরা কোন ছার৷

    এবার চাতরার রাস্তা ছেড়ে আস্তে-আস্তে পাহাড়ে উঠছি৷ এইসব অঞ্চল, হান্টারগঞ্জ-পরতাপপুর-জৌরী খুবই নামী শিকারের জায়গা ছিল একসময়৷ যখনকার কথা বলছি, তখনও ছিল—মানে বছর পঁচিশ-তিরিশেক আগে৷ বেশ ভালো জঙ্গল দু’দিকে৷ হান্টারগঞ্জে নাজিমসাহেবের চেলা আছে একজন৷ সেখানে গিয়ে পৌঁছলে নাকি আর ভাবতেই হবে না৷ ওর সঙ্গে মাইলটাক হেঁটে গেলেই নিশ্চয়ই শিকার৷ গুলি ভরো আর মারো, মারো আর ভরো, খচাখচ—গোলি অন্দর; জান-বাহার৷

    পাহাড়ের উপরের মালভূমিতে এবং ঢালে-ঢালে ফসল লেগে আছে সব৷

    কুলথি, সুরগুজা, মকাই, জিনোর, অড়হর, মটরছিম্মি৷ খেতে-খেতে এখন শম্বর, চিতল হরিণদের ফিস্টি৷ আলু, কচু ইত্যাদির লোভে আসে শুয়োরের ধাড়ি-কচির দল৷ শজারু আর ভাল্লুক৷ আর তাদের পিছন পিছন চুপিসারে, আড়ে-আড়ে আসে বড় বাঘ ও চিতা৷

    ভূতো কিন্তু দারুণ জিপ চালাচ্ছে৷ পাহাড়ি রাস্তা৷ খুব কম ব্রেক ব্যবহার করে শুধু গিয়ারেই এত ভালো গাড়ি চালায় ভূতো যে, শেখবার আছে ওর কাছে৷ গাড়ি তো চালায় অনেকেই, কিন্তু ঠিকমতো গাড়ি চালাতে খুব কম লোকই জানে৷ নাজিমসাহেব আমাদের সবসময় বলতেন যে, একজন মানুষের সঙ্গে অন্যজনের তফাত হব—ব্যস-স এটুকুতেই৷ বলতেন, যা-কিছুই করো না কেন, জীবনে এমন করে কিছু করার চেষ্টা করবে, যেন তোমার চেয়ে ভালো করে আর কেউই সেই কাজটা না করতে পারে৷ যখন যা করবে, তাতেই সেরা হবার সাধনা করবে৷ বলতেন, এই জেদটুকু থাকলে তবেই না মানুষ মানুষ হয়৷ মানুষের শরীর তো সব মানুষেরই আছে৷ কিন্তু তা বলে সবাই-ই কি মানুষ?

    আমরা এখন পাহাড়ের অনেক উপরে উঠে এসেছি! লাল সুরকি-রঙা মাটির কাঁচা পথ৷ ধারে পাহাড়-জঙ্গল৷ ধুলো উড়ছে না বেশি৷ ধুলোরাও যেন শীতের রাতে শিশিরের কাঁথা মুড়ে কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে আছে৷ বাঁকের মুখে হঠাৎ একটা পাটকিলে-রঙা ধেড়ে খরগোশ দেখা গেল৷ পথের একেবারে উপরেই৷ নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘মানহুস৷’’

    অর্থাৎ মহা-অপয়া৷ বড় শিকারে বেরিয়ে খরগোশ মারা বারণ ছিল৷ জঙ্গলের ঢুকে প্রথমেই খরগোশ দেখলে সেদিন শিকার পাওয়া যাবে না বলেই বিশ্বাস করতেন এই অঞ্চলের শিকারিরা৷ এ ব্যাপারে এক-এক জায়গায় এক-একরকম কুসংস্কার৷ শিকারিদের মতো কুসংস্কার বোধহয় গ্রামের মেয়েদেরও নেই৷

    ভূতো বলল, ‘‘দুসসস্…’’

    খরগোশটা টুইস্ট নাচতে-নাচতে চলল কিছুক্ষণ জিপের সামনে সামনে৷ তারপর হঠাৎই তড়াক করে বাঁয়ে লাফিয়ে গেল৷ খাদে পড়ল কি কাঁটাঝোপে বিঁধল, বোঝা গেল না৷ খরগোশটার দিক থেকে চোখ ফেরাতেই দেখি এক প্রকাণ্ড চিতা, শীতের চকচকে জেল্লাদার চামড়াখানা গায়ে ফেলে দিব্যি গোঁফে চুমকুড়ি দিতে-দিতে একেবারে বড় রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে কোমর আর লেজ দুলিয়ে লটর-পটর করতে-করতে রোদে বেরিয়ে এদিকেই আসছে৷

    ভুতো এর আগে কখনও বাঘ দেখেনি জঙ্গলে; চিতাও নয়৷ জঙ্গল বলতেও দেখেছে মামাবাড়ির আমবাগান৷ হাজারিবাগেও এই প্রথম আসা ওর৷ শিকার বা বনজঙ্গল সম্বন্ধে ওর অভিজ্ঞতা তখন কিছুই ছিল না বলেই উচ্ছ্বাস এবং উদ্দীপনা খুবই বেশি ছিল৷ ক্যালকেশিয়ান ভূতোকে মানা করার আগেই সে দু’হাতে হর্ন টিপে ধরে হর্নের সঙ্গে গলা মিলিয়ে, ‘ওরে বাবাগো! বাঘে খেলেগো!’ বলে চিৎকার করে উঠল৷ কত পার্সেন্ট ভয়ে, আর কত পার্সেন্ট পেজোমিতে, তা ওই-ই জানে৷

    বাঘই বেশি ভয় পেয়েছিল, না ভূতো, তাও ঠিক বোঝা গেল না৷ কিন্তু আচমকা হর্ন বাজার সঙ্গে সঙ্গেই বাঘ ঘাবড়ে গিয়ে ‘ঘাবুড়’ বলে এক হাঁক ছেড়ে লাফ মেরে জঙ্গলের মধ্যে হাওয়া হয়ে গেল৷

    বাঘকে বেকায়দায় ফেলার জন্যে আমরা কায়দা করে হড়হড়িয়ে নামতে যাচ্ছিলাম৷ জিপে বসে তাকে কব্জা করা মুশকিল ছিল৷ নাজিমসাহেবও তাঁর চামড়ার কেস থেকে বন্দুকটা অর্ধেক বের করে ফেলেছিলেন, কিন্তু চিতামহারাজের হাওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কোঁ-কোঁওও-কোঁ-চোঁ-চোঁ-চোঁওও—একটা বদখত আওয়াজ করে উঠল জিপটা৷

    ভূতো স্টিয়ারিং-এ বসেই বাঘের কথা সম্পূর্ণ ভুলে বেদম হাসতে লাগল৷

    সাকির মিঞা রেগে বলল, ‘‘কেয়া লড়প্পনবাজি করা রহা হ্যায় আপ?’’

    ‘‘লড়প্পন তো হ্যায়৷’’ বলেই নাজিমসাহেব ড্রাইভারকে বললেন, ‘‘আপ উতারকে জারা দেখিয়ে না জনাব ক্যা হুয়া!’

    সাকির মিঞা নামার আগেই ভূতো বলল, ‘‘ট্যাঙ্কে তেল শেষ গোপালদা৷ জিপ আর যাবে না৷ চিতলকা কাটলিস? ক্যা আড্ডাবাবা?’’

    ‘‘যাঃ৷ তা কী করে হয়?’’ গোপাল অবিশ্বাসের গলায় বলল৷

    ‘‘অনেক কিছুই হয়৷ হবার হলে৷’’

    নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘এই ভুচু, মজাক মত করনা৷ ইয়ে মজাককা বাত নেহি৷ ওয়াক্ত ভি নেহি!’’

    ‘‘মজাক-উজাক নেহি৷ পেট্রলকা ট্যাঙ্কিমে পেত্নি ঘুষ গ্যয়া৷’’ ভূতো নাকি সুরে বলল৷

    বিরক্ত মুখে নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘পেত্নি, কা চিজ?’’

    ‘‘কা চিজ? বাঙালি, জানানা ভূত৷ যিসকা পাকড়তা ওহি জানতা কা চিজ৷ অব বোলিয়ে নাজিম মিঞা ক্যা কিয়া যায়?’’

    আমরা সকলেই নামলাম৷ ড্রাইভিং-সিট তুলে আবার সাকির মিঞা বাঁশ বাগিয়ে তেল মাপল৷ আশ্চর্য! সত্যিই একটুও তেল নেই৷

    ভূতো বলল, ‘‘আপকা ট্যাঙ্কিমে জরুর ছ্যাঁদা হো গ্যয়া৷’’

    সাকির মিঞা নট-নড়ন-চড়ন, নট-কিছু, স্থিরনেত্র হয়ে তাকিয়ে রইল৷

    নাজিমসাহেব যে-কোনো বিপদেই মাথা ঠান্ডা রাখেন৷ আর বাক্যব্যয় না করে, জিপ থেকে ধীরে-সুস্থে নেমে; ভাঙা কাঠকুটো জোগাড় করে জিপের একটু দূরেই দেশলাই জ্বেলে আগুন করলেন৷ আমরাও নেমে কাঠকুটো জোগাড় করে এনে তার পাশে জমা করে রাখতে লাগলাম৷ হয়তো সারারাতই এখানে পড়ে থাকতে হবে৷ কে জানে?

    আগুনের সামনে সকলে গোল হয়ে বসতেই নাজিমসাহেব পেটে হাত দিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘না-দানা, না-পানি৷ ক্যা হায়রানি! ঔর বহতই খাতরা৷ পাকড়া গিয়া তো কা হোগা? পইলে ডান্ডা, পিছে বাত৷ হান্টারগঞ্জকা শুটিং পারমিট লেকে হামলোগ থোড়ি আয়া! ইয়া আল্লা৷ ক্যা বদনসিবি!’’

    গোপাল উঠে ওয়াটার-বটল দুটো নেড়ে-চেড়ে দেখল৷

    নাঃ, এক ফোঁটা জলও নেই সঙ্গে৷ শিকারে বেরোলেই নাজিমসাহেবের সঙ্গে আমেরিকান আর্মির ডিসপোজালের একটা রুকস্যাকও থাকতই থাকত৷ ছোট, কিন্তু তার মধ্যে থেকে রাত-বিরেতে জায়গায়-অজায়গায় কতবার বাখরখানি রোটি, শান্ডিলা লাড্ডু, গরমে বা বর্ষায় পাটনাই ল্যাংড়া বা দশেরি আম, তিতির-বটেরের কাবাব ইত্যাদি অবিশ্বাস্যভাবে বেরিয়ে পড়ত৷ আমরা বলতাম প্যান্ডোরা’জ বকস৷ কিন্তু ঠিক আজকেই সেই রুকস্যাকটি সঙ্গে নেই৷ ঘড়িতে এখন রাত ন’টা৷ হান্টারগঞ্জ-পরতাপপুর থেকে একটা বাস নাকি ছাড়ে ভোর চারটেতে—যায় দোভি হয়ে অন্য জায়গায়৷ সেই বাসেই পাহাড় থেকে নেমে দোভিতে পেট্রল কিনে আমাদের ফিরে আসতে হবে৷ নাজিমসাহেব জানালেন৷

    মন-মেজাজ খারাপ হয়ে গেল৷ একে শিকার পণ্ড, তায় এই বিপদ!

    ঠিক হল, গোপাল এবং সাকিব মিঞা বাসে করে কাল ভোরেই গিয়ে তেল, আমাদের জন্যে খাবার এবং পেট্রল ট্যাঙ্কের জন্যে সাবান নিয়ে আসবে৷ কোনোরকমে ট্যাঙ্কের ছ্যাঁদা সাবান দিয়ে বন্ধ করে দোভি বা চাতরা পর্যন্ত চলে গেলেই ট্যাঙ্ক ঝালাইয়ের ব্যবস্থা একটা হবেই৷

    কাল ভোরের তো এখনও অনেকই দেরি৷ এখন তো সময় আর এগোচ্ছে না৷ দশটা, এগারোটা৷ ফুটফাট করে কাঠ পুড়ছে৷ যতরকম গল্প জানা ছিল, আমাদের সব গল্প জমা করেও সময় জ্বলছে না৷ পেটের মধ্যে ধেড়ে ধেড়ে পাটকিলে খরগোশ কনটিন্যুয়াসলি লাফাচ্ছে৷ হায় চমনলাল! আহা! তোমার খিচুড়ির জবাব নেই৷

    আমি আর গোপাল নাজিমসাহেবের পাশে আগুনের সামনে বসে আছি৷ পাশেই বন্দুক রাখা আছে৷ গুলিভরা৷ এ জঙ্গলে খুব ভাল্লুক৷ নাজিমসাহেব বলছিলেন৷ চিতাবাঘের দেখা তো পাওয়াই গেল একটু আগেই৷ বড় বাঘও আছে৷ তবে মানুষখেকো না হলে বাঘকে নিয়ে ঝামেলা নেই৷ ভাল্লুকগুলোই গায়ে-পড়ে ঝামেলা বাধায়, নাক-চোখ খুবলে নেয়, ভারী যাচ্ছেতাই৷ কিন্তু খালি হাতে থাকলে তবেই ভয়৷ গায়ে-পড়া স্বভাবের জন্তুজানোয়ারই তো আমাদের পছন্দ৷ বন্দুক তুলব আর চিতপটাং৷ ভূতো আর সাকির মিঞা জিপের মধ্যেই ঘুমোচ্ছে৷ এই ঠান্ডায় কী করে যে ঘুমোচ্ছে খালি গায়ে, তা ভূতোই জানে! ওর নাক-ডাকার ফঁএর-ফঁর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে৷ গোপাল আর আমিও আগুনের পাশে বসে-বসেই ঢুলছিলাম৷ ঘুমোন না কেবল নাজিমসাহেব৷ আমরা তাঁর কাছে সহোদর-প্রতিম বলে, বিপদ ঘটলেই সেলফ-অ্যাপয়েন্টেড লোকাল-গার্জেন হয়ে যান তিনি সব জায়গাতেই৷

    হঠাৎ ‘ভ্যাঁ-পোঁ’ বাসের হর্নে আমরা চমকে উঠলাম৷ চমকে উঠে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সত্যিই ভোর হয়ে এসেছে৷ এই রাত কী করে ভোর হবে তাই ভাবছিলাম, কিন্তু ভাবনা শেষ হবার আগেই ভোর হয়ে গেল৷ সব সব রাতই শেষ হয় একসময়, সুখের রাত; দুখের রাত৷ চারটে বেজে গেছে৷ বাস এসে গেছে পরতাপপুর থেকে৷ কুল্লে জনা-পাঁচেক যাত্রী তাতে আপাদমস্তক কম্বলে ঢেকে পা-মুড়ে বসে আছে৷ অতিকষ্টে ঠেলেঠুলে জিপটাকে আমরা সাইড করে দিলাম৷ বাসটা পাস করলে গোপাল সাকির মিঞাকে সঙ্গে নিয়ে বাসে উঠে চলে গেল৷ বলল, ‘‘সকাল আটটা-ন’টার মধ্যেই ফিরে আসছি পেট্রল এবং খাবার-দাবার নিয়ে৷ তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো৷’’

    বাস চলে গেল৷ শীতের রাতে জেগে থাকলে ভোরের দিকে ভীষণ ঘুম পায়৷ শীতও তখন প্রচণ্ড জ্বালায়৷ গোপালের অভয়বাণী শুনে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম দু’হাঁটুর মধ্যে মাথা রেখে, টুপিটা ঘাড় অবধি দিয়ে৷ ওভারকোটের কলারের উপর নামিয়ে৷ একসময় প্রথম-সকালের মুরগি-ময়ূর ডেকে উঠল কঁকর-ক, কেঁয়া-কেঁয়া করে৷ শিকার-টিকারের ইচ্ছা বা উপায় তখন ছিল না৷ ভূতো জিপ থেকে নেমে দু’বার আড়মোড়া ভেঙে নিয়ে হাত-পা ছুড়ে নাজিমসাহেবকে বলল, ‘‘গুড মর্নিং নাজিমসাহেব৷ ব্রেকফাস্টমে কেয়া খাইয়েগা? ফরমাইয়ে!’’

    নাজিমসাহেব ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ভুচু, ভুচু…ভুচু, উ-উ…’’

    মানে, ভুচু সাবধান৷

    বেশ রোদ উঠে গেছে৷ চারধারের জঙ্গল জেগে উঠেছে৷ রাতে খালি রাত-চরা পাখিদের ডাক আর শম্বর-চিতলের শব্দ ছিল৷ এখন কত পাখি, প্রজাপতি, পোকা-মাকড়৷ শীতের রোদ-পড়া চকচকে সকালের জঙ্গল গমগম করছে প্রাণের শব্দে চারপাশে৷ হঠাৎ একটি দেহাতি ছেলেকে আসতে দেখা গেল পাহাড়তলি থেকে৷ লোহার নাল-লাগানো নাগরা জুতো পায়ে চটাং-ফটাং শব্দ করতে করতে পাথর-ভরা পথে৷ সে আসছিল৷ তার কাঁধে একটা মস্ত লাঠি৷ লাঠির ডগায় একটা কাপড়ের পুঁটলি৷

    আমি বললাম, ‘‘পুঁটলিতে খাবার-টাবার থাকতেও পারে৷ কী নাজিমসাহেব? বাজিয়ে দেখুন না একটু৷ অবস্থা যে কাহিল!’’

    নাজিমসাহেব ডাকলেন, ‘‘আরে ও বাব্বুয়া! ইন্নে আ বাবা; ইন্নে আ…’’ বাবুয়া কাছে এসে হাঁ করে দাঁড়াল৷

    ‘‘তেরা গাঁঠরিমে ক্যা বা?’’

    ছেলেটি হাসল৷ ভূতো বলল, ‘‘ছাতু-ফাতু হবে৷ এখন আবার বাদ-বিচার৷ একে মায়ে রাঁধে না, তপ্ত আর পান্তা! ম্যানেজ করুন না পুঁটলিটা কোনোক্রমে৷ কোঈ কাম কা নেহি আপ৷’’

    নাজিমসাহেব পটিয়ে-পাটিয়ে ওকে দিয়ে পুঁটলিটা নামিয়ে খুব যত্ন করে নাকের কাছে এনে শুঁকলেন৷ কী বুঝলেন, উনিই জানেন৷

    ভূতো বলল, ‘‘গন্ধগোকুল! ছাতু-ফাতু হলে আমি খাব না৷ আমার কাতুকুতু লাগে ছাতু খেলে৷ মানে, ছাতু মাখতে গেলেই!’’

    তারপর পুঁটলিটা খুললেন নাজিমসাহেব, নিজ হাতে ধৈর্যের সঙ্গে৷

    চোখ গোল করে চেয়ে রইলাম ভূতো আর আমি৷ পুঁটলি খোলা হতেই দেখা গেল, দু’জোড়া নতুন নাল-বসানো প্রমাণ সাইজের নাগরা জুতো তাতে৷ ভূতো বলল, ‘‘ও লালাদা! গোল্ড-রাসে চার্লি চ্যাপলিন জুতো খেয়েছিলেন, তাই না? তবে, সে সুস্বাদু সেদ্ধ জুতো৷ এ জুতো খেলে সাক্ষাৎ বদহজম৷ খাওয়া উচিত হবে না৷ কী বলেন?’’

    নাজিমসাহেবের মুখটা কালো হয়ে গেছিল৷ ছেলেটি নীরবে হেসে আবার পুঁটলি উঠিয়ে চলে গেল৷

    ভূতো ছেলেটির দিকে চেয়ে বাংলায় বলল, ‘‘খুব ঠকালি, না? আচ্ছা! এখন যা! তোকে কলকাতায় গিয়ে যখন ধর্মতলার মোড়ে দাঁড় করিয়ে দেব তখন বুঝবি, কত প্যাডিতে কত রাইস৷ তিনদিন ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও রাস্তা পেরোতে পারবি না ট্রাফিকের ভিড়ে৷ টিট-ফর-ট্যাট করে দেব!’’

    পেছন দিকে অনেক দূর থেকে মাদলের ধুতুর-ধুতুর ধিতাং-ধিতাক ধুতরু-ধাতুর আওয়াজ আসতে লাগল৷ আমাদের পেছনেই পাহাড়ের পায়ে-পায়ে ইলাজান নদী ঘুরে গেছে৷ গাছপালার ফাঁকে-ফাঁকে দেখা যাচ্ছে নদী ছবির মতো৷ ভূতো বলল, ‘‘চলুন, ঐ দিকেই ঘুরে আসি৷ মাদল বাজছে যখন, তখন কোনো ব্যাপার আছে৷ লোকজন থাকলে খাবার পাওয়া যেতে পারে৷ চলিয়ে নাজিমসাহেব৷’’

    নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘আমি বুড়হা-পুরানা আদমি৷ আমি কোথাওই যাব না৷ বন্দুকগুলোও পাহারা দিতে হবে৷’’ বলেই আমাকে বললেন, ‘‘আপভি মত যাইয়েগা৷ কোতোয়ালিমে ভর দেনেসে বাতচিত করনেকা লিয়ে ভি তো কই দোস্ত চাহিয়ে!’’

    তবু নিজের বন্দুকটা হাতে নিয়ে আমি ভূতোর সঙ্গে ওকে একটু এগিয়ে দিতে গেলাম৷ নাজিমসাহেব ভাল্লুক সম্বন্ধে বারবার সাবধান করে দিলেন ওকে৷ বললেন, ‘‘নোচ লেগা৷ বড়ী খতরনাগ হ্যায়৷ ইয়ে—জঙ্গল তুমহারা মাম্মবোড়িকা আমকা-বাগিচা মত শোচনা৷’’

    নদীতে পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে জল খেলাম৷ দাঁত জমে গেল৷ এখনও ভীষণ ঠান্ডা৷ ফ্রিজ খুললে যেমন ধোঁয়া বেরোয়, তেমন ধোঁয়া বেরুচ্ছে জল থেকে৷ ভুতো বলল, ‘‘ওই দেখুন, নদীর ওপারে যেন কার বিয়ে হচ্ছে৷ শ্রাদ্ধ হলেই বা কী এল গেল৷ গেলেই খেতে দেবে৷ চলুন-চলুন! ধিতাং-ধিতাং বোলে, মাদলে তাল তোলে—’’

    বলেই গান জুড়ে দিল ভূতো বেসুরে কোমর দুলিয়ে৷

    আমি বললাম, ‘‘নেমন্তন্ন ছাড়াই যাবে? মান-সম্মান নেই?’’

    ‘‘আর মান-সম্মান! পড়েছি আপনাদের খপ্পরে৷ আপনি বাঁচলে চাচার নাম৷’’ বলেই, চপাং-চপাং করে হাওয়াইন চপ্পল পরে জিনস ভিজিয়ে নদীর মধ্যে দিয়ে ওপারের দিকে যেতে লাগল ভূতো৷ ওয়াটার-বটলে ভর্তি করে নাজিমসাহেবের জন্যে খাবার জল নিয়ে ফিরে এলাম আমি নদী থেকে৷ এখন এগারোটা বাজে৷ কাল দুপুরেই শেষ খেয়েছিলাম আমরা৷ ব্যস-স! বিকালে হাজারিবাগে চা৷ রাতে দোভিতেও শুধু চা৷ গরমাগরম রোদ এসে পড়েছিল ঘাড়ে৷ আরাম লাগছিল খুব৷ জল খেয়ে আমি আর নাজিমসাহেব চওড়া চ্যাটালো পাথরের উপর শুয়ে পড়লাম৷

    অনেকক্ষণ পর ভূতোর ডাকে চোখ খুলল! ভূতো বলল, ‘‘নাপিতের বাড়ি বিয়ে ছিল৷ খুবই খাতির-যত্ন করল৷ মাছ, দই আর লাড্ডু খেয়েছি ঢালোয়া৷ মাডুয়ার রুটি দিয়ে৷’’ বলেই হেকুত শব্দ করে একটা ঢেকুর তুলল৷

    ঢেকুরের শব্দ যে এত মিষ্টি, আগে কখনও তা খেয়াল করিনি৷ ঘড়িতে এখন দুটো বাজে৷ শীতের বন-বনে রোদ ঝকঝক করছে৷ এতক্ষণ কী করছে গোপালরা দোভিতে? ভারী রাগ হতে লাগল আমাদের৷ দুটো থেকে তিনটে, তিনটে থেকে চারটে৷ আরো রাত ঘনিয়ে আসতে লাগল৷ সারাটা দিন পরের খোলা জিপ, পরের ডিম, পরের বন্দুক ছেড়ে যেতেও পারিনি কোথাও৷ আর নিশ্চিন্ত করে যারা গেল তারা কখন যে দয়া করে এসে পড়ে তাও তো অজানা৷ খিদের কথা ছেড়েই দিলাম, কখন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক এসে ক্যাঁক করে ধরে, সেই ভয়ে সবসময় টেন্স হয়ে বসে আছি৷ একটু রিল্যাক্স করতে পারলাম না এই সুন্দর পরিবেশেও৷ শিকারের কথা তো ভাবছিই না৷

    ময়ূর-মুরগি ডাকতে লাগল৷ তারপর দেখতে-দেখতে অন্ধকারও ডাকতে ডাকতে এসে হাজির হল৷ নাজিমসাহেব সূর্য ডোবার আগে ওরই মধ্যে একবার নামাজ পড়ে নিলেন৷ প্রার্থনাতে কী কী বললেন, তা আর বুঝতে বাকি রইল না৷ আমাদের দুজনের অবস্থাই বেশ কাহিল৷ ভূতো কেবল এখনও লাফিয়ে বেড়াচ্ছে একা৷

    নাজিমসাহেব কালকের আগুনের জায়গাতেই বাসিবিয়ের আসনের মতো যত্ন করে আগুন জ্বালালেন নতুন করে৷ কে জানে, এই আগুনই চিতার আগুন হবে কিনা! আগুনের কাঁপা-কাঁপা লাল আলোয় আমরা তিনজনে তিনজনের মুখ দেখতে লাগলাম৷ এমন সময় হঠাৎ বাসের এঞ্জিনের আওয়াজ এবং ভ্যাঁ-পোঁ হর্ন শোনা গেল৷ আমরা চমকে উঠলাম অবিশ্বাস্যে৷

    নাজিমসাহেব বললেন, ‘‘গোপালবাবু যদি এই বাসেও না আসেন?’’

    ভূতো বলল, ‘‘যদি না আসেন? তাহলে কোর্ট-মার্শাল করা হবে৷ ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়াতে হবে৷’’

    কিন্তু ওরা নামল শেষ পর্যন্ত ওই বাস থেকেই৷ গোপালের হাতে একটা মাটির হাঁড়ি, সাকির মিঞার হাতে শালপাতার ঠোঙায় অনেকগুলো রুটি৷ বাসের কনডাকটর তেলের জেরিক্যানটাকে একজন প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে ধরাধরি করে নামিয়ে দিয়ে বাসের গায়ে দুটো জব্বর চাঁটি মেরে বলল, ‘‘হ্যাঁ উস্তাদ! টিকিয়া উড়ান৷’’

    গোপাল বলল, ‘‘নাও, শিগগিরি খেয়ে নাও দেখি! কী কাণ্ড! তোমাদের জন্যে ভোরে গিয়েই খাবার কিনেছিলাম৷ তখন কি জানি যে পেট্রল নিয়ে কোনো ট্রাকই এদিকে আসতে চাইবে না৷ সাইকেল-রিকশাতে খুচুর-খুচুর করে এত মাইল এসে বসে আছি পাহাড়ের নীচে সারাদিন হা-পিত্যেশে! এই বাসও তো পেট্রল বইতে চাইছিল না৷ নেহাতই যাবার সময় ওরা তোমাদের দেখে গেছে পথে বসে আছ, তাই দয়া করল৷ যাকগে, কথা পরে শুনবে, খেয়ে নাও আগে৷ খাও,—খাও৷’’

    কথা শোনার মতো সময় বা অবস্থা আমাদেরও একেবারেই ছিল না৷ তাড়াতাড়ি রুটি ছিঁড়ে, ডিমের হাঁড়িতে হড়হড়িয়ে হাত ঢোকাতে যাব হঠাৎ পাশ থেকে শুনি আঁ-আঁ-আঁক৷ শুকনো রুটি আর ডিম আটকে গেছে নাজিমসাহেবের গলায়৷ দুপুর বেলায় দাঁড়কাকের মতো হাঁ করে রয়েছেন তিনি৷

    গোপাল ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘‘দেখেছ! কী খারাপ! ধাবাওয়ালাটা! নতুন মাটির হাঁড়িতে করে ডিমের কারি দিয়ে দিয়েছে৷ তাও সেই সক্কালবেলায়৷ ঝোল সব তো খেয়ে নিয়েছে হাঁড়িই৷ ঈসস-স-স-ঈসস-স…’’ আমার খাওয়া মাথায় উঠল৷ চেঁচিয়ে বললাম, ‘‘অ্যাই ভূতো! নাজিমসাহেবকে জল দাও৷ শিগগিরি জল৷ মারা যাবেন যে! ওয়াটার-বটল৷’’

    জল কোথায়? জল নেই৷ ননশালান্টলি ভূতো বলল, ‘‘একটু আগেই তো আমি জঙ্গলে গেছিলাম৷ অন্ধকারের মধ্যে নদীতে গিয়ে তো আর পশ্চাৎদেশে ভাল্লুকের খামচানি…৷ মাড়ুয়ার রুটি—পেটের মধ্যে সাংঘাতিক গ্যাঞ্জাম৷ হান্টিং করতে নিয়ে এসেছে নাজিম বুড়ো হান্টারগঞ্জে! আর জায়গা পেলে না৷ মরুক গে যাক বুড়ো গলায় ডিম বিঁধে৷’’

    গোপাল, নাজিমসাহেবের হাঁ-করা মুখের এবং জিপের হেডলাইটের মতো ড্যাবড্যাবে জ্বলজ্বলে চোখ-জোড়ার দিকে চেয়ে আতঙ্কিত গলায় বলল, ‘‘ডিমই এ যাত্রা ডোবাল আমাদের৷ কেলেঙ্কারি!’’

    ভূতো ওরই মধ্যে ফিচিক করে হেসে উঠে বলল, ‘‘ঈসস্ স্ স্, ইক্কেরে ইনফিনিচুড ডিমেংকারি!’’

    —

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবনবিবির বনে – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article জংলিমহল – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.