Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কিশোর গল্প – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প310 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    আমি

    আমি

    ১

    এখন আমি বড়ো হয়েছি৷ এমনকী বলা চলে, বুড়োও হয়েছি৷ কিন্তু আমি যেমনটি ছিলাম তেমনই রইলাম৷ বদলালাম না একটুও৷

    ছেলেবেলায় আমার কেবলই আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করত৷ আজও করে৷ আমার দুই দাদাই পড়াশোনা, খেলাধুলাতে আমার চেয়ে অনেকই ভালো ছিল৷ স্কুলের মাস্টারমশাইরা বলতেন, ‘কী দাদাদের কী ভাই! ছ্যাঃ ছ্যাঃ ভাবা যায় না৷’

    বাবা বলত, ‘হোন্দল, তুই কি অমানুষ হয়েই থাকবি চিরটাকাল? কোন গুণটা তোর আছে, আমাকে বলতে পারিস?’ বড়ো জ্যাঠাইমা বলত, ‘তুই ঘোষ পরিবারের একটা কুলাঙ্গার৷ তুই মরলে গুষ্টির উপকার৷’ তা আমি এমনই হতভাগা ছিলাম যে, না পারলাম ‘মানুষের মতো মানুষ’ হতে, না পারলাম, মরতে৷ তা ছাড়া এত যে গালমন্দ, ছিঃ ছিঃ করে, সেসব আমার গায়ে লাগত না৷ হাঁসের ডানায় জলের মতো গড়িয়ে যেত৷ যার বোধবুদ্ধিই নেই, তার কাছে প্রশংসা বা নিন্দামন্দ সবই সমান৷

    পড়াশোনা, খেলাধুলা আমার কিছুই ভালো লাগত না৷ পেয়ারা গাছের কাঠবিড়ালির বাচ্চাদের সঙ্গে, বাগানের নাগচম্পা গাছের উঁচু ডালে বাসা করা ডাহুকদের বাচ্চাদের সঙ্গে, বাড়ির বাইরের মধুখালির প্রকাণ্ড বিলের পাশের দলদলি আর দাম-এর মধ্যে সল্লি হাঁসদের পাড়া ডিম কখন ফুটবে তার অপেক্ষাতে আমার দিন কাটত৷

    ফিনফিনে হলদে রঙের ফড়িংরা মধুফুলের মধু চুষে যখন উড়ে যেত গোধুলিয়ার মাঠের দিকে তখন তাদের পেছন পেছন দৌড়োতে আমার ভারি ভালো লাগত৷ ভালো লাগত, হাঁসেদের ঘর খুলে তাদের শীতের সকালে তাড়িয়ে নিয়ে হরিসভার পুকুরপাড়ে গিয়ে দু-কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেক করে করে দূর থেকে উড়ে ঝাঁপ দিয়ে ঝপাং ঝপাং করে শীতের কুয়াশামাখা পুকুরের ঠান্ডা জলে তাদের আছড়ে পড়া দেখতে৷ জল ছিটকে উঠত তাদের জলে পড়াতে আর সকালের সোনারোদ সেই অগণ্য জলকণাতে পড়তেই কোনো অদৃশ্য হাত হিরের টিয়ারা বুনত শূন্যে৷ সেই হাঁসেদেরই যখন সূর্যাস্তবেলাতে বিন্নিদিদি কুলো হাতে দাঁড়িয়ে ধান ছড়াতে ছড়াতে ডাকত চই চই চই চই করে, আর তারা যখন হেলতে-দুলতে প্যাঁক প্যাঁক প্যাঁক করে আমাদের বাড়ির দিকে একে একে ফিরে আসত তখন মন ভরে যেত তাদের দেখে৷ যেকথা বললে কেউই বিশ্বাস করত না, তাই কারওকেই বলা হয়নি আজ অবধি সেকথা৷ সকালে হাঁসেদের হরিসভার পুকুরপাড়ে ছেড়ে দিয়ে খুব জোরে যখন দৌড়ে বাড়ির দিকে ফিরে যেতাম তখন আমি আসলে দৌড়োতাম না, উড়তাম৷ সত্যিই উড়তাম৷ মাটি থেকে অনেক ওপর দিয়ে উড়ে যেতাম—আমার খালি পা দুটো টী-টী পাখির পায়ের মতো দুলতে দুলতে চলত আমার শরীরের নীচে নীচে৷

    এই সবই করতাম কিন্তু পড়াশোনা করতাম না৷ আদিগন্ত নীল আকাশ, মধুখালির বিলের সবজেটে জলের বিস্তীর্ণ চাদর৷ এই সবই ছিল আমার জগৎ৷

    দাদা হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষাতে সপ্তম হল৷ কলকাতাতে গিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হল৷ মামাবাড়িতে থেকে পড়াশোনা করবে ঠিক করল৷ আমার মামারা বালিগঞ্জে থাকতেন৷ মামা খুব বড়ো উকিল ছিলেন৷ খুব ভালো অবস্থা৷ দাদা পরে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে আরও ডিগ্রি নিতে চলে গেল৷ প্রথমে গেল বার্মিংহাম-এ৷ তারপর সেখান থেকে ইউনাইটেড স্টেটস-এ৷ মাঝে একবার দেশে ফিরেছিল৷ তারপর বস্টনেই থিতু হল৷ একজন ফরাসি মেয়ে বিয়ে করে গ্রিনকার্ড হোল্ডার হয়ে আমেরিকাতেই থেকে গেল৷

    মেজদাও হায়ার সেকেন্ডারিতে স্ট্যান্ড করল৷ তবে দাদার মতো অত ভালো ছিল না সে৷ উনিশ না কুড়ি কী যেন হয়েছিল৷ তারপর মেজদাও ডাক্তারি পাশ করে আরও বড়ো চোখের ডাক্তার হতে অস্ট্রেলিয়াতে চলে গেল৷ তারপরই বাবার ব্যবসা খুবই খারাপ হয়ে গেল৷ শরীরও খারাপ৷ মায়ের কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে৷ প্রতি সপ্তাহে ডায়ালিসিস করতে সদরে যেতে হয়৷ সেখানে হাসপাতাল ও ডাক্তারের সুবিধা তেমন নেই৷ আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি৷ মায়ের চিকিৎসার সুবিধার জন্যেই আমাদের হরিনাথপুরের বাড়ি, সমস্ত ধানজমি, আমবাগান, পুকুরটুকুর সব বিক্রি করে দিয়ে বাবা কলকাতার ভবানীপুরে একটি ছোটো বাড়ি কিনে যা কিছু নগদ পেয়েছিলেন সব নিয়ে কলকাতাতে চলে এলেন৷

    বড়দা ও মেজদা আমার চেয়ে আট এবং সাত বছরের বড়ো৷ বড়দা তো আমেরিকাতে সেটল করেই গেছে, মেজদাও পড়াশোনা শেষ করে এনেছে অস্ট্রেলিয়াতে৷ হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, সেও আর দেশে ফিরবে না৷ ততদিনে অতি বাজে সেকেন্ড ডিভিশনে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে কোনোক্রমে ভূগোল নিয়ে ভরতি হয়েছি আশুতোষ কলেজে৷ বাবার রোজগার কিছু নেই৷ সঞ্চয় ভাঙিয়ে মায়ের চিকিৎসা আর সংসার খরচ চলছে৷

    অতি নিকৃষ্ট ফল করে কোনোক্রমে কলেজের গণ্ডি পেরোলাম৷ আমাকে তো ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক সোসাইটি ডেকে নিয়ে চাকরি দেবে না৷ এখন বিজ্ঞান, অ্যাকাউন্টেন্সি আর কম্পিউটারের যুগ৷ ভূগোল নিয়ে যাচ্ছেতাই ভাবে পাশ করা ছেলেকে কে চাকরি দেবে?

    ততদিনে বড়োমামা একদিন ম্যাসিভ স্ট্রোকে চলে গেলেন৷ উনি থাকতে উনিই বাবার পরামর্শদাতা ছিলেন৷ আমার ধারণা বাবাকে না জানিয়ে উনি মাকে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্যও করতেন৷ বড়োমামার ছেলে ছিল না৷ এক মেয়ে—ছবিদি৷ যে পাশের বাড়ির একটা বখাছেলেকে বিয়ে করে বড়ো দুঃখী জীবনযাপন করছিল৷ বড়োমামি তো আগেই গত হয়েছেন৷ জিতু জামাইবাবু দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন৷ কিন্তু তিনিও শ্বশুরের সম্পত্তি ভাঙিয়েই দিন চালাতেন৷ তা ছাড়া খুব মদ খেতেন, ছবিদিকে মারধরও করতেন৷

    ওই পরিস্থিতিতে আমার আত্মহত্যা করার ইচ্ছেটা আরও তীব্র হল৷ কিন্তু আমার এক বখাবন্ধু ছিল৷ জগৎ৷ আশুতোষ কলেজে পড়ত কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারেই পড়া ছেড়ে দেয়৷ যদুবাবুর বাজারের পাশের গলিতে সে একটি ছিটকাপড়ের দোকান করে আর মির্জাপুরের এক মুসলমান দর্জির কাছ থেকে জামা-প্যান্টের কাপড় কাটতে আর সেলাই করতে শিখে নেয়৷ তার দোকান এখন রমরমিয়ে চলে৷ জগৎ কলেজ ছাড়লেও আমার সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখেছিল৷ মাঝে মাঝেই পূর্ণ বা ইন্দিরা বা বিজলিতে সিনেমা দেখাত৷ মা-বাবার কাছেও আসত৷ খুব হাসাতে পারত ও সকলকে৷ অত যন্ত্রণার মধ্যে মা-র মুখে হাসি ফুটে উঠত৷ মা বলতেন, ‘জগৎ, তুমি আবার এসো বাবা৷’

    একটা নতুন কিডনির দাম অনেক টাকা৷ জমিজমা বিক্রি করার পরই বাবা যদি মায়ের জন্যে কিডনি কিনে দিতেন একটা তাহলেও হত৷ আজকে সেই সামর্থ্য কোথায়? জগৎই মা-বাবাকে বলেছিল, ‘আমি আর হোন্দল একটা করে কিডনি দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়৷’

    বাবা রাজি হননি৷ বলেছিলেন, ‘তোমার মাসিমা আর আমি আর ক-দিন বাঁচব? দু-জনেই তো সত্তর পার করে দিয়েছি৷ তোমাদের সামনে সুন্দর জীবন—দীর্ঘ জীবন—তোমাদের এই শাস্তি দিতে পারি না আমরা৷’

    এদিকে আমাদেরও আর চলে না৷ বাবার পুঁজি সব শেষ৷ এবারে মায়ের গয়না ভাঙা শুরু হল৷ আমি, এই হোন্দল এমনই অপদার্থ যে, বাবা-মায়ের জন্যে কিছুমাত্রও করতে পারি না৷ বাবা ঠিকই বলেছিলেন, দাদারা কত ভালো আর আমি একটা অমানুষ৷

    বাড়ির একতলাটা একটা গুজরাটি পরিবারকে ভাড়া দিয়েছেন বাবা৷ তাও মাস ছয়েক হল৷ তাদের কেবলই ধান্দা বাড়িটা কিনে নিয়ে আমাদের উদবাস্তু করার৷ সবসময়ে টাকার লোভ দেখাচ্ছে তারা বাবাকে৷ এমন সময়ে এক রবিবারে জগৎ এসে বলল, ‘কাল সারারাত ভেবে ভেবে একটা প্ল্যান এসেছে মাথাতে৷’

    ‘কী প্ল্যান?’

    ‘তোদের গ্যারাজটা তো ফাঁকা পড়ে আছে৷ ভাগ্যিস ভাড়াটেকে দিয়ে দেননি মেসোমশাই৷’

    ‘ওরা তো গাড়ি পাশের প্যাসেজে রাখে৷ তিনটে গাড়ি ওদের৷ পয়সার অভাব তো নেই৷ আগে একটা ছিল৷ গত ছ-মাসে আরও দুটো কিনেছে৷’

    ‘সে যাই হোক, তোদের বাড়িটার লোকেশানটা খুবই ভালো৷ এখানে ঢোকলা, চানাচুর, গজা এসবের দোকান করলে খুব চলবে৷ এ ব্যবসাতে কত প্রফিট জানিস? সত্তর পার্সেন্ট৷’

    তারপর বাবাকে বলল, ‘মেসোমশাই, বিজলি সিনেমার পাশে এক চিলতে একটা দোকানে গরম গরম চানাচুর ভাজছে একটা লোক গত পঞ্চাশ বছর হল৷ সে আজ নিজে হয়তো ভাজছে না, তার নাতিপুতি ভাজছে হয়তো৷ কিন্তু সেই দোকান থেকে সে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করেছে এবং আজও করছে৷ বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী এই কথাটা তো বাঙালি ওই লোকটাকে দেখেও শিখতে পারত৷’

    আমি বললাম, ‘বাণিজ্য তো করব, ক্যাপিটাল আসবে কোত্থেকে?’

    জগৎ বলল, ‘এই কথাটা যা বললি এর তুলনা নেই৷ সব বাঙালির এক রা৷ হোয়্যার, দেয়ার ইজ আ উইল দেয়ার ইজ আ ওয়ে৷ টাকার দরকার হলে কাবলিওয়ালার কাছ থেকে ধার করবি৷ আর কিছুটা আমি দেব৷ দেখিস তুই! একমাসে তোর দোকান দাঁড়িয়ে যাবে৷ চক্রবেড়িয়ার একটা দোকান থেকে দুটো ছোঁড়াকে ভাগিয়ে আনব৷ তাদের মোটা অ্যাডভান্স দিয়ে দিয়েছি৷ ওরাই তো কারিগর৷’

    ‘দোকানের নাম কী দিবি?’

    ‘কেন? হোন্দল কুতকুত৷ দেখবি, নামেই কেল্লাফতে হয়ে যাবে৷’

    ২

    সেদিন জগৎকে বাস স্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যখন যাই, জগৎ বলল, ‘হোন্দল, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করিস না৷ অত্যন্ত পার্সোনাল কথা৷’

    ‘কী কথা৷ বল?’

    ‘তোর দুই দাদা এত কৃতী, এত বড়োলোক৷ মাসিমার অসুখ এবং তোদের অবস্থার কথা কি তাঁরা জানেন না?’

    আমি মুখ নীচু করে বললাম, ‘জানেন৷’

    ‘তবে?’

    ‘দাদাদের অনেক খরচ৷ একজনের ফ্রেঞ্চ বউ, অন্যজনের ইংলিশ৷ তারা হরিনাথপুরের অতি সাধারণ শিক্ষিত চাষা আমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না৷ আমাকে বড়দা একবার লিখেছিল, তোকে একটা অটো কিনে দিতে পারি৷ বাবাকেও৷ কিন্তু খেটে খেতে হবে৷ মাঝে মাঝে অনুদান দিতে পারব না৷ মেজদা চলে যাওয়ার পরে আর যোগাযোগ রাখেনি মা-বাবার সঙ্গে৷ আমাকে একটি চিঠিতে লিখেছিল, তোদের কম্পিউটার নেই৷ ই-মেইল ছাড়া আজকাল কি যোগাযোগ করা সম্ভব! বরং ইন্টারন্যাশনাল রোমিং মোবাইল ফোন নিয়ে নে একটা৷’

    ‘সত্যি৷ মোবাইল তো আজকাল পানওয়ালা বিড়িওয়ালার কাছেও আছে৷ নিস না কেন একটা?’

    ‘আমাদের তো ল্যান্ড লাইনই নেই৷ কী দরকার? ওসব তোদের মতো কাজের মানুষদের দরকার৷ প্রয়োজন বাড়ালেই বাড়ে৷’

    সেই রাতেই মায়ের অবস্থা খুব খারাপ হল৷ পাড়ার হরেন ডাক্তারকে ডেকে আনলাম গিয়ে৷ বললেন, ‘এখনই নার্সিং হোমে রিমুভ করুন৷ মেডিক্লেইম করা আছে কি?’

    ‘না তো৷’

    ‘তবে হাজার পঞ্চাশেক টাকার বন্দোবস্ত করুন৷ নইলে নার্সিং হোম ভরতি করবে না৷’

    তারপর বললেন, ‘কোনো এম.এল.এ-র সঙ্গে জানাশোনা আছে? তা না হলে সরকারি হাসপাতালেও ভরতি করে নেবে না৷’

    আমার মুখে এসে গেল, ‘তাহলে কি গরিব বিনা চিকিৎসাতে মরবে এই জনদরদি রাজ্যে?’

    ‘গরিব চিরদিনই বিনা চিকিৎসাতে মরেছে৷ কংগ্রেসি আমলেও মরেছে, লাল আমলেও মরছে৷ কোনোদিন যদি গৈরিক আমল আসে তখনও মরবে৷ জনতার প্রতি দরদ এসব মুখের কথা৷ কথার কথা৷ নির্বাচনের আগের বুলি৷’

    মা রাত পৌনে দুটোর সময়ে মারা গেলেন৷ পাড়ার মোড়ের ফোন বুথ থেকে আগে জগৎকে একটা ফোন করলাম৷ অত রাতে বিরক্ত করার মতো আপনজন আমার আর কেউই ছিল না৷ তারপর সকাল বেলা বড়োমামার উপহার দেওয়া সোনার টিসট হাতঘড়িটি বিক্রি করে যে টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে বড়দা ও মেজদাকে আই.এস.ডি কল করলাম৷

    বড়োদাদা বলল, ‘মরবার আর সময় পেল না? এ সপ্তাহের শেষে আমার একটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট প্রেজেন্টেশান আছে, আমার পক্ষে পনেরো দিনের আগে দেশে যাওয়া সম্ভব নয়৷ তা ছাড়া, গিয়ে হবেটাই-বা কী? মা তো মরেই গেছে৷’

    তারপর বলল, ‘টাকাপয়সার দরকার আছে তো বল৷ কিছু ডলার পাঠাবার বন্দোবস্ত করছি৷’

    বললাম, ‘না, না, তোমার টাকা পাঠাতে হবে না৷ হয়ে যাবে৷’

    মেজদার ফোন বেজে গেল অনেকক্ষণ৷ হয় বাড়িতে কেউ নেই, দু-জনেই কাজে গেছে৷ তারপর ভয়েস মেইল-এ শোনা গেল যে ওরা হলিডেতে গেছে ইন্দোনেশিয়াতে৷ পনেরো দিন পরে ফিরবে৷ এমন করে ইংরেজি বলে ওরা যে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়া আমার পক্ষে বোঝাই সম্ভব হয় না৷

    বাড়ি ফিরে দেখলাম জগৎ এসে গেছে৷ খুব রাগ করল আমার ওপরে৷

    ‘যে হাসপাতালে ডায়ালিসিস করা হচ্ছিল সেখানে নিয়ে যাওয়া অবশ্যই উচিত ছিল৷ আমাকে জানালে আমি টাকা নিয়ে আসতাম৷’

    বাবা বললেন, ‘তুমি আর কত করবে বাবা৷ তুমি তো আমার কেউ নও৷ আমার দু-দু জন পরম মানুষ-ছেলে৷ আর ও-ই একটা অমানুষ৷ তারাই যদি কিছু না করে, না করতে পারে, তুমি কী করবে৷’

    জগৎ বলল, ‘আমি গিয়ে গুরুদোয়ারাতে ফোন করে দিচ্ছি৷ কাল সকাল নটাতে কাচের গাড়ি পাঠাবে৷’

    আমি ওকে ছবিদির নম্বরটা দিয়ে বললাম, ‘ভোর পাঁচটা নাগাদ খবরটা দিস৷ যদি আসে৷ মায়ের শাড়ি-টাড়িও তো বদলাতে হবে৷’

    জগৎ বলল, ‘আমি মাকে নিয়ে চলে আসব ছ-টার সময়ে৷ ফুল, ধূপকাঠি, মালা এসব নিয়ে৷’

    তারপর বলল, ‘এই কলকাতাটা বাংলারই রাজধানী৷ কিন্তু দেখ আমরা জন্মাই কোনো মাড়োয়ারি হাসপাতালে৷ লেখাপড়া করি গুজরাটিদের ভবানীপুরের স্কুলে বা মাড়োয়ারিদের হিন্দি হাই স্কুলে৷ অসুখ হলে যাই বেলভিউ অথবা বিড়লা হার্ট সেন্টারে৷ ছেলের অন্নপ্রাশন দিই মহারাষ্ট্র নিবাস অথবা মাইসোর হলে, মেয়ের বিয়ে দিই ত্যাগরাজা হলে অথবা পাঞ্জাব ভবনে৷ আর মরে গেলে সর্দারজিদের গুরুদোয়ারার শববাহী গাড়িতে শ্মশানে যাই৷ আমাদের জবাব নেই, সত্যি৷’

    জগৎ চলে গেলে আমি মায়ের পায়ের কাছে বসে থাকলাম মায়ের মুখের দিকে চেয়ে৷

    বাবা নিজের মনে বললেন, ‘ভালোই গেছেন৷ এই বাঁচা কি বাঁচা ছিল!’

    তারপর বললেন, ‘বড়ো ও মেজোকে কি খবর দিয়েছিলি?’

    বাবাকে মিথ্যে বললাম আমি৷ বললাম, ‘ওদের কেউই নেই৷ দু-জনেই অফিসের কাজে বাইরে গেছে৷’

    ‘আর বউমারা?’

    ‘তাঁরাও তো কাজে থাকেন৷’

    অত দুঃখেও হাসি পেল আমার৷ যাঁদের চোখে দেখেননি, ফোটো দেখেছেন শুধু, তাঁদেরও বউমা বলে আনন্দ পাচ্ছেন৷

    পাখাটা মাথার ওপরে ঘুরছিল শব্দ করে৷ একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠল৷ মুচমুচ শব্দ তুলে পথের পাতা-পুতি, কাগজের ঠোঙা ধুলোকে ঝাঁট দিয়ে নিয়ে গেল সেই হাওয়া৷ নিশুতি রাতের পথে কারা যেন টেম্পো করে ‘বলহরি হরিবোল’ ধ্বনি দিতে দিতে উল্লাস করতে করতে মৃতদেহ নিয়ে গেল কেওড়াতলার দিকে৷ আমি সেই অদেখা-অচেনা মৃতের উদ্দেশে দু-টি হাত অভ্যাসবশে জড়ো করলাম বুকের কাছে৷

    বাবা মায়ের চেয়ে আট বছরের বড়ো৷ বাবারও দিন ফুরিয়ে এসেছে৷ মা চলে যাওয়াতে তাঁর বাঁচার ইচ্ছেও আর বোধ হয় রইল না৷

    হঠাৎ বাবা বললেন, একটু কেশে নিয়ে, ‘বুঝলি হোন্দল, তোকে আমি চিরদিনই অমানুষ বলে এসেছি৷ আজকে বলছি, না, তুই-ই আমার সন্তানদের মধ্যে একমাত্র মানুষ৷’

    তারপর বললেন, ‘জগতের সঙ্গে ব্যবসাটা তুই শুরু কর৷ তারপর বিয়ে কর৷ আমি নাতি-পুতি না দেখে মরছি না, যম আমাকে যতই ডাকুক৷’

    বাবার কথাতে আমার দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল৷

    —

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবনবিবির বনে – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article জংলিমহল – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }