Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কিশোর গল্প – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প310 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    জেঠুমণি অ্যান্ড কোম্পানি

    জেঠুমণি অ্যান্ড কোম্পানি

    কিছুক্ষণ আগে এক পশলা জোর বৃষ্টি হয়ে গেছিল৷ বসন্তের জঙ্গল-পাহাড়ের গায়ে যত ধুলো জমেছিল, সমস্ত পরিষ্কার করে নিয়েছিল সেই বৃষ্টি৷ এখন গোধূলির নরম হলদেটে আলোয় চারদিক হেসে উঠেছে৷ সন্ধে হওয়ার দেরি নেই৷ ঋজুদা কাঠকামচারির বাংলোর সামনে ইঞ্জিচেয়ারে বসে পায়ের ওপরে পা রেখে ভুড়ুক-ভুড়ুক করে পাইপ খাচ্ছিল৷ আর আমি বসে ছিলাম একটা গাছের গুঁড়িতে! বসে-বসে বৃষ্টির পরে রাইফেলটা এবং বন্দুকটা ভালো করে ক্লিনিংরড দিয়ে এবং পুলথ্রু টেনে-টেনে পরিষ্কার করছিলাম৷ ঋজুদা বলল, ‘‘আজকে একটু তেলও লাগাস৷ যা ভেজান ভিজেছে বৃষ্টিতে বন্দুক-রাইফেলগুলো৷’’ আসলে, কাঠকামচারির মানুষখেকো বাঘটাকে ঋজুদা কিছুতেই কব্জা করতে পারছে না৷ আমরা দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়ার পরই আজকেও বেরিয়ে গেছিলাম৷ চার-পাঁচ মাইল হাঁটাহাঁটি হল৷ কোথাও বাঘের পায়ের দাগ পাওয়া গেল না৷

    অবশ্য বলা যায় না; এই বৃষ্টিতে যেভাবে মাটি নরম করে ভিজল, এর উপর বাঘের দাগ পড়লে কাল আমাদের দেখতে এবং খুঁজতে খুব সুবিধা হবে৷ রাইফেল পরিষ্কার করতে-করতে ঋজুদাকে বললাম, ‘‘তুমি তো রোজই বলো জেঠুমণির গল্প বলবে৷ আজকে বলো না বাবা এখন তো আর কিছু করবার নেই৷’’

    ঋজুদা ঠাট্টার গলায় বলল, ‘‘বলছিস? চল রাতে মহুয়াগাছের মাচায় বসব৷’’

    আমি বললাম, ‘‘তুমি আমার কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছ৷ মাচায় তো বসবে রাতে৷ এখন কী? বলো না, তোমার জেঠুমণির গল্পটা বলো৷’’

    ঋজুদা হঠাৎ পায়ের উপর থেকে পা-টা নামিয়ে সড়াত করে সোজা চাবুকের মতো বসে, ইজিচেয়ারের দু’পাশে দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে ঘোড়সওয়ার হয়ে বলল, ‘‘আচ্ছা তবে শোন বহুদিন থেকে বলছি তোকে বলব, বলব৷ তবে জেঠুমণির গল্প কি আর শেষ করা যায়? বলতে আরম্ভ করলে দু’বছর লেগে যাবে৷’’

    আমি হাসলাম৷ বললাম ‘‘দু’বছর না, তুমি দু’ঘণ্টাই বলো না৷’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘ঠিক আছে, আমি কিন্তু বলেই চলব৷ তোর যখন ইচ্ছে হবে, তুই বলবি, থামো৷ কিংবা কাড়ুয়ার যখন রাতের খিচুড়ি রান্না শেষ হবে, তখনই শুধু গল্প বন্ধ হবে৷ নইলে আমি গল্প কিন্তু বলেই চলছি৷’’

    আমি বললাম, ‘‘খুব ভালো, খুব ভালো, বলো৷’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘জেঠুমণির মতো গণতান্ত্রিক শিকারি আমি জীবনে দেখিনি৷’’

    আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘‘গণতান্ত্রিক শিকারি মানে?’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘সেই তো মজা৷’’ তারপর আরও একটু ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘‘ধর জেঠুমণির সঙ্গে আমরা শিকারে গেছি৷ জিপে করে যাচ্ছি৷ শিকারের জায়গায় তখনও পৌঁছোইনি৷ জিপে কম করে এক ডজন অস্ত্রধারী লোক বসে আছে৷ প্রত্যেকের হাতে বন্দুক-রাইফেল৷ এমন এক সময় হতভাগা হরিণ কোত্থেকে বেরিয়ে পড়ে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল৷ জেঠুমণির এক বন্ধু বললেন, দাঁড়া-দাঁড়া, আমি মারি৷ জেঠুমণি বললেন, এইসব বুর্জোয়া মনোবৃত্তি চলবে না৷ শিকারে এসেছ একসঙ্গে৷ প্রত্যেকের বন্দুক-রাইফেল থেকে একসঙ্গেই গুলি বেরোবে৷ এবং জানোয়ার যদি চেহারা দেখায়, তবে সে তার চেহারা দেখিয়ে পালিয়ে যাবে, সেটি হচ্ছে না৷ সে চেহারা যদি একবার দেখায় সঙ্গে-সঙ্গে তাকে পপাতধরণীতলে হতেই হবে৷ ওসব ব্যক্তিগত বাহাদুরি চলবে না যে, আমার গুলি লেগেছে, তোমার গুলি লাগেনি৷ কিংবা আমি গলায় গুলি মেরেছিলাম, আমি ফুসফুসে মেরেছিলাম, কী আমার গুলি কপালে লেগেছে৷ জানোয়ার দেখেছ কি একসঙ্গে সব রাইফেল-বন্দুক দমাদ্দম করে দেগে দাও৷ ধপ করে জানোয়ার পড়ে যাবে৷’’

    আমি শুনে তো হো-হো করে হেসে উঠলাম৷ বললাম, ‘‘এ আবার শিকার কী? এ তো দল বেঁধে মারামারি৷ তোমরা তো দল বেঁধে একসঙ্গে খুন করতে বলো৷’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘এসব কথা তুই আমাকে বলে পার পেয়ে গেলি৷ জেঠুমণিকে বললে মার খেয়ে তোর অবস্থা কাহিল হয়ে যেত৷ তবে জেঠুমণির যুক্তি অকাট্য ছিল৷ জেঠুমণি বলতেন, দ্যাখ, শিকারে কি আর রোজ-রোজ আসা হয়? এত টাকা-পয়সা খরচ করে কলকাতা থেকে পোঁটলা বেঁধে জোগাড়যন্ত্র করে, যদি বছরে দু-তিনবার করে আসি, তখন অত সব বাছবিচার আমার করা সম্ভব নয়৷ আমরা তো প্রফেশন্যাল শিকারি নই, যে সারাদিন এই-ই করে বেড়াচ্ছি৷ সকাল নেই, রাত্তির নেই, কাজ নেই, কর্ম নেই, খালি জানোয়ারের পিছন-পিছন ঘুরে বেড়ানো৷ ওসব শিকার আমাদের পোষায় না৷ আমরা হচ্ছি শহুরে শিকারি৷ জানোয়ার দেখেছ, কি মেরেছ৷ কোনো বাছাবাছি নেই৷’’

    আমি বললাম, ‘‘তুমি যখন জেঠুমণির সঙ্গে শিকারে গেছিলে, তুমি তখন কত বড় ছিলে?’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘কত বড় আর? তখন স্কুলে পড়ি৷ জেঠুমণির কাছেই তো শিকারের হাতেখড়ি৷ তখন আমার হাতে থাকত একটা টোয়েন্টি বোরের টলি শটগান, ডাবল ব্যারেল৷ এবং আমার ওপর আদেশ ছিল যে, জেঠুমণি, কাকামণি এবং তাঁদের বন্ধুবান্ধবেরা গুলি করার পরেও যদি কোনো গুলিখোর জানোয়ার পরম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে দৌড়ে উঠে পালাতে যায়, তখন সেই অকৃতজ্ঞ পলায়মান জানোয়ারকেই শুধু আমার গুলি করার অধিকার আছে৷ জ্যান্ত জানোয়ার বা অনাহত জানোয়ারকে গুলি করার আমার কোনো অধিকার ছিল না৷ তার ফলে প্রায়ই তখন নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হত৷’’

    আমি বললাম, ‘‘কী রকম?’’

    ‘‘একবার জেঠুমণির বোনের বাড়ি গেছি৷ আসামের গোয়ালপাড়া জেলার ছোট্ট একটা গ্রাম, তার নাম তামাহাট, সেখান থেকে আমরা যাব ‘যমদুয়ার’ বলে গভীর জঙ্গলে৷ যমদুয়ার নামটা শুনেই বুঝতে পারছিস, জায়গাটা কীরকম হবে৷ একপাশে ভুটান পাহাড়, একপাশে পশ্চিমবঙ্গ, আরেক দিকে আসাম৷ আসাম আর পশ্চিমবঙ্গের সীমানা বেয়ে বয়ে চলেছে সংকোশ নদী৷ কী সুন্দর যে দেখতে সে-নদী৷ বড়-বড় পাথর ভরা শীতকালে সে-নদীর জল এত স্বচ্ছ থাকে, যে নীচে রঙিন নুড়িগুলোকে চমৎকার দেখা যায়৷ আর তার মধ্যে উড়ে এসে বসে নানারকম হাঁস দূর-দূর দেশ থেকে৷ যমদুয়ার তামাহাট থেকে অনেক দূর৷ তামাহাট থেকে তো রওনা হওয়া গেল৷ বলা বাহুল্য, জেঠু যেহেতু গণতান্ত্রিক শিকারি ছিলেন, উনি স্বার্থপরতায় বিশ্বাস করতেন না৷

    উনি শিকারে যাচ্ছেন শুনে, সঙ্গে এত লোক ‘আম্মো যাব’ ‘আম্মো যাব’ করে লাইন লাগাল যে শেষকালে আর গাড়ি-টাড়িতে হল না, একটা ট্রাকই ভাড়া করতে হল৷ ট্রাকের উপরে আমরা সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম৷ বুঝতেই পারছিস, অত লোক জঙ্গলে গিয়ে বে-নোটিস থাকা হবে৷ সঙ্গে খাবার-দাবার ও শোবার বিছানাপত্র৷ সব কিছুরই বন্দোবস্ত রয়েছে৷ বিরাট-বিরাট পেট-মোটা হোল্ড-অল আর খাবার-দাবারের কথা কী আর বলব৷ দু’বস্তা মুড়ি, দু’বস্তা চিঁড়ে, একটা ঝোলাগুড়ের হাঁড়ি, পাটালি গুড়ের বান্ডিল থাক-থাক ন্যাকড়া দিয়ে বাঁধা৷ এক ঝুড়ি পান, এক হাঁড়ি তাজা সুপারি, যার গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসে৷ কিন্তু সেই মজা সুপারি দিয়ে পান না খেলে জেঠুমণির ভালোই লাগত না আসামে গেলে৷ সুতরাং সুপুরি সঙ্গে যেতই৷ দু’ঝুড়ি কমলালেবু এবং দুটো আস্ত পাঁঠা৷ জঙ্গলে যদি শিকার না পাওয়া যায়, তবে মাংস খাওয়া হবে কী করে? কাজেই পাঁঠাও রয়েছে৷

    আরও ছিল এক ঝুড়ি মুরগি, এক ঝুড়ি ডিম, শাক-সবজি তো রয়েইছে৷ আর তার মধ্যে শিকারিরা সব৷ ঝুড়ি-ঝুড়ি৷ কী তাদের বাহার পোশাক-আশাক! বিচিত্র ভাষা, বিচিত্র বয়েস; কেউ ধুতি পরে, কেউ পুরো সাহেব৷ আমাদের কাসেম আলি মিঞা মোটা গদগদে, নতুন আলুর মতো লালচে গায়ের রং৷ জেঠুমণির পেট ছিল আবু সাত্তার৷ সে ছিপছিপে৷ সাত্তার সাংঘাতিক লোক ছিল৷ কত বাঘ আর লেপার্ড যে মেরেছিল, তার ইয়ত্তা নেই৷ পরে ছ’জন আত্মীয়কে একদিন গুলি করে মেরে ফাঁসিতে গেছিল৷ সেই সাত্তারের গল্প পরে বলব৷ সঙ্গে কাকুমণি৷ জেঠু তো আছেনই৷ আমিও রয়েছি বলা বাহুল্য৷

    সন্ধের একটু পরেই ট্রাকটা তো ছাড়ল৷ ধূলি-ধূসর রাস্তা পেরিয়ে তামাহাটের পরে দোকান-বাজার পেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় পৌঁছেছে৷ শীতকাল৷ হঠাৎ রাস্তার পাশেই চষাখেতে এক বিরাট বড় চিতাবাঘ৷ কুকুরের মতো রাস্তার পাশে বসে আছে৷ সে বাঘের কী চেহারা! মানে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো বড়৷ এত্ত বড় চিতাবাঘ৷ আমি তখন বুঝলি স্কুলে পড়ি, এন সি সি ওয়েস্ট বেঙ্গলকে রিপ্রেজেন্ট করি, ন্যাশনাল রাইফেল শুটিং কম্পিটিশনে৷ জেঠুমণির বন্দুকটা আমার হাতে৷ সেই টোয়েন্টি-বোর টলি শট গান৷ বন্দুকটা আমি তাক করে রেখেছি বাঘের কানে৷ স্কেরিকাল বল পোরা আছে৷ ডাবল চোকড ব্যারেলে৷ গুলি করলে বাঘ ওখানে উল্টে পড়ে যাবে৷ কিন্তু আমার গুরুজনেরা তো কেউ তখনও গুলি করেননি৷ আমার অর্ডার নেই গুলি করবার৷

    কয়েকদিন আগে জেঠুমণি অস্ট্রিয়া থেকে দুটো রাইফেল আনিয়েছিলেন৷ একটা ছিল পয়েন্ট থ্রি সিক্স-সিক্স বোরের, আরেকটা ছিল পয়েন্ট থ্রি সেভেন ফাইভ বোরের৷ দুটোই ম্যানলিকার সোনার৷ জেঠুমণির হাতে পয়েন্ট থ্রি সিক্স-সিক্স বোরের রাইফেল আর কাকুমণির পয়েন্ট থ্রি সেভেন ফাইভ৷ দুটোই একেবারে আনকোরা নতুন৷ কুঁদো দিয়ে নতুন-নতুন গন্ধ বেরোচ্ছে৷ চমৎকার ব্লুয়িং করা ব্যারেল৷

    বাঘ দেখে যখন ড্রাইভার ট্রাকটাকে দাঁড় করাল, তখন জেঠুমণি একটা হোল্ড-অলের ওপর বসে বাঁ হাতের চেটোয় পান রেখে ডান হাত দিয়ে তাতে সযত্নে চুন লাগাচ্ছিলেন, তিনি বাঘটাকে দেখেননি৷ এবং চারপাশে শাগরেদরা এমন ভিড় করে বসে ছিল যে, তাঁর পক্ষে ওই ট্রাকের মধ্যিখানে বসে দু’পাশের কিছুই দেখা সম্ভব ছিল না৷ কিন্তু কাকুমণি বাঘটাকে দেখেছিলেন৷

    বাঘটাকে দেখামাত্রই আমি দেখলাম, কাকুমণি বাঘটার দিকে রাইফেলের নল তাক করলেন৷ এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা উঁ-উঁ-উঁ আওয়াজ শুনলাম৷ কী ব্যাপার কিছু বুঝতে না পেরে আমি তখন বাঘ ছেড়ে কাকুমণির দিকে তাকালাম৷ তাকিয়ে দেখি, কাকুমণি চোখ-মুখ লাল করে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই সদ্য-আনা অস্ট্রিয়ান রাইফেলের ট্রিগারটি ভেঙে ফেলার উপক্রম করছেন৷ দোষটা অবশ্য ট্রিগারের নয়৷ কারণ সেই বাঘ দেখে প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাকুমণি তাড়াতাড়িতে রাইফেলের সেফটি ক্যাচই সরাননি৷ ভুলে গিয়েছিলেন৷ কাজেই সেফটি ক্যাচ আনসেফ না করে ট্রিগার বেচারিকে টানাটানি করে ট্রিগারের অসম্মান করা ছাড়া কিছুই করা হচ্ছিল না৷ আর সেই রাইফেলও অস্ট্রিয়ার তৈরি রাইফেল৷ প্রাণ যায় কী জান যায়৷ ভেঙে না-ফেলা অবধি সে ট্রিগারও দমবার পাত্র নয়৷

    কাকুমণি ক্রমান্বয়ে উঁ-উঁ করে ট্রিগারটাকে টেনে যাচ্ছেন সজোরে৷ বাঘটা এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে ট্রাক-ভর্তি সার্কাস-করনেওয়ালা লোকেদের দিকে তাকিয়েই রইল৷ কিন্তু সে এক মুহূর্তে৷ বাঘ বাবাজির সেই সার্কাস কোম্পানির ব্যাপার-স্যাপার দেখে মোটেই ভালো না ঠেকায়, লেজ তুলে পোঁ-পোঁ দৌড় লাগালেন৷

    বাঘ দৌড়ে যাচ্ছে৷ পাঁচ-ব্যাটারি আমেরিকান টর্চের আলো তার পিঠের উপর পিছলে-পিছলে যাচ্ছে৷ এমন সময় জেঠুমণির শাগরেদরা জেঠুমণিকে বললেন, দাদা বাঘ, দাদা বাঘ৷ কাসেম আলি পান খাচ্ছিলেন৷ বললেন, মেলা বাঘ৷ জেঠুমণি তখন সেই সদ্য চুনলেপিত পান এক শাকরেদের গালে সেঁটে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷

    দাঁড়িয়ে যখন দেখলেন যে সেই বে-আক্কেলে বাঘ পালিয়ে যাচ্ছে, তিনি তাঁর রাইফেল থেকে গদাম করে একরাউন্ড গুলি ছুড়লেন৷ স্বাভাবিক কারণে অত তাড়াতাড়ি এবং পান সাজতে-সাজতে গুলি করায় সেই গুলির আর বাঘের সঙ্গে যোগাযোগ হল না মোটেই৷ বাঘের লেজের হাত দশেক পিছনে চষাখেতে রাইফেলের গুলি পড়তেই একতাল ধুলো উড়ে গেল পাউডারের মতো৷ আর বাঘটা সড়াত করে আর-এক লাফে গিয়ে বাঁশঝাড়ের মধ্যে ঢুকে গেল৷ তখন হৈ-হৈ-রৈ রৈ-কাণ্ড করে জেঠুমণি অ্যান্ড কোম্পানি ট্রাক থেকে নেমে পড়লেন৷ দু’জন লোক একটা একস্ট্রা ব্যাটারি কাঁধে নিয়ে চলল৷ তার সঙ্গে স্পটলাইট ফিট করা৷ সামনে জেঠুমণি, পিছনে কাকুমণি, তার পিছনে শাগরেদরা এবং সব শেষে আমি৷

    যখন আমরা গিয়ে বাঘ যে বাঁশঝাড়ে ঢুকেছিল, তার কাছে পৌঁছোলাম, তখন বাঘ নিশ্চয়ই সেখান থেকে মাইল ছয়েক দূরে কোনো নিরাপদ জায়গায় প্রচণ্ড হাসি হাসছে, আর তার বন্ধু-বান্ধব, বাচ্চাদের গল্প করছে যে, যা সার্কাস দেখলাম না, এরকম সার্কাস কলকাতাতেও দেখা যায় না৷’’

    * * *

    আমার হাসি থামলে ঋজুদা বলল, ‘‘জেঠুমণির প্রথম-প্রথম শিকারের গল্প শুনলে তুই হাঁ হয়ে যাবি৷ সাংঘাতিক-সাংঘাতিক সে-সব গল্প৷’’

    আমি বললাম, ‘‘বলো না, সে-সব গল্প শোনবার জন্যেই তো হাঁ করে আছি৷’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘তাহলে শোন৷ ওই যে জায়গাটার কথা বলছিলাম, আসামের গোয়ালপাড়ায় তামাহাট গ্রাম; সেই গ্রামেই রতুজেঠু বলে জেঠুমণির চেয়েও বয়সে বড় এক ভদ্রলোক ছিলেন৷ তাঁর পাশের বাড়ি ছিল জেঠুমণির ভগ্নীপতির বাড়ি৷ জেঠুমণির সঙ্গে তাঁর খুব হৃদ্যতা ছিল৷ সেই রতুজেঠু ওই অঞ্চলের খুব নামকরা শিকারি ছিলেন৷ তখন তো আর আজকালকার মতো বাঘ-ভাল্লুকের দুর্ভিক্ষ হয়নি৷ আকছার জন্তু-জানোয়ার দেখা যেত তখন জঙ্গলে বেরোলেই৷ চিতাবাঘ-টিতাবাঘ তখন এতই ছিল যে, চ্যাগাড়ের বেড়া পেরিয়ে মুরগি নিয়ে যেত, পাঁঠা নিয়ে যেত, কুকুর নিয়ে যেত৷ সন্ধেবেলা বেরোলেই বিপদ ছিল৷ সেই রতুজেঠুর ছোট্ট একটা বেবি-অস্ট্রিন গাড়ি ছিল৷ একদিন জেঠুমণি, রতুজেঠু এবং তাঁদের দু-তিনজন বন্ধু মিলে ঠিক করলেন, ছোট-ছোট শিকার তো অনেক হল, এবারে বড় শিকারে যেতে হবে৷ যাকে বলে রিয়্যাল বিগ গেম৷ কিন্তু কোথায়? না, রাইমানার জঙ্গলে৷

    দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর সকলে মিলে বেরিয়ে পড়লেন বেবি-অস্টিন গাড়ি চড়ে৷ সঙ্গে প্রচুর খাবার-দাবার৷ কখন খিদে পেয়ে যায়, কে বলতে পারে? জেঠুমণির এই একটা পলিসি ছিল যে, কখনও কোনো রিস্ক নেবে না৷ বিশেষ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে৷ যদি জঙ্গলে টায়ার ফেটে যায়, যদি রাত্তিরে ফেরা না যায়? যদি জঙ্গলে থেকেই যেতেই হয়, তাহলে খাবার-দাবার যেন কখনই কম না পড়ে৷

    পাঁচজন শিকারি, সঙ্গে পাউন্ড দশেক পাঁউরুটি, তাল-তাল মাখন, জ্যামের শিশি, ডিমসিদ্ধর হাঁড়ি, কমলালেবুর ঝুড়ি ইত্যাদি নিয়ে তাঁরা রওনা হলেন৷ সন্ধের মুখোমুখি সেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে এসে তাঁরা পৌঁছলেন৷ সারা রাস্তাই জঙ্গল আর জঙ্গল৷ রাইমানার জঙ্গল! রাইমানা, কচুগাঁও! তখনকার দিনে সে-সব ভয়াবহ জঙ্গল ছিল৷ সে জঙ্গলে ছিল না, এমন জানোয়ার নেই৷ বুনো মোষ, শম্বর, সব রকম হরিণ, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, বড় বাঘ৷ সে ভয়াবহ ব্যাপার৷ হাতি ও গন্ডারও৷

    ‘‘গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে রেখে ওঁরা দু’দলে ভাগ হয়ে গেলেন৷ এক দলে জেঠুমণি, রতুজেঠু আর তাঁদের শাগরেদ বৈদ্যকাকু৷ আরেক দলে জেঠুমণির কলকাতা থেকে আসা এক বন্ধু, তাঁর নাম অজিত সিং এবং অন্য একজন৷ অজিতকাকুর লম্বা-চওড়া চেহারা, সুপুরুষ, খুব ভালো রাইফেলে হাত, এবং তাঁরই তখন একমাত্র রাইফেল ছিল৷ জেঠুমণির একটা চেকোস্লোভাকিয়ান বন্দুক৷ রতুজেঠুর একনলা একটি বন্দুক৷ একনলেই তিনি জানোয়ার মেরে ভিড় করে দিয়েছিলেন৷ দু’নল থাকলে যে কী হত, সে ভগবানই জানেন৷

    ঘড়ি দেখে ঠিক হল যে, দু’দল দু’দিকে চলে যাবে৷ ঠিক রাত্রি দশটা যখন বাজবে, তখনই গাড়ির কাছে রাঁদেভু পয়েন্টে দু’দল একসঙ্গে মিলিত হয়ে তারপর মানে-মানে ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে আসবে৷

    গুড-হান্টিং, গুড-লাক, উইশ অল দি বেস্ট ইত্যাদি বলে মলে হ্যান্ডশেক-টেক করে দু’দল তো দু’পাশে চলে গেলেন৷ হাঁটছেন তো হাঁটছেনই৷ সঙ্গে টর্চ বড়-বড়৷ আর জেঠুমণির মাথাতে লাগানো ক্ল্যামপের সঙ্গে টর্চ কপালের এক পাশ থেকে তার ঝুলে পকেটের ব্যাটারির বাক্সে ঢুকে গেছে৷ তখনকার দিনে একরকম হান্টিং-টর্চ পাওয়া যেত৷ হয়তো এখনও পাওয়া যায়, জানি না৷ আমি এই টর্চগুলো মোটেই পছন্দ করি না৷ কারণ ওই টর্চ মাথায় বেঁধে হাঁটতে-হাঁটতে অ্যালাইনমেন্ট নষ্ট হয়ে যায়, ফলে হঠাৎ কোনো জন্তু সামনে পড়লে রাইফেল কি বন্দুক তুলে মারতে গিয়ে দেখা যায় যে রাইফেল রয়েছে একদিকে আর আলোটা সরে গেছে অন্যদিকে৷ যাই হোক জেঠুমণির বন্ধু অজিত সিংয়ের কপালে সেই আলোই ছিল৷

    প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে প্রচুর খিদে পেয়ে গেছে৷ জানোয়ারগুলো সব হতভাগা৷ একটা যে সামনে এসে ওঁদের এত কষ্টের মূল্য দেবে, সে-সব কোনো জ্ঞান-গম্যিই তাদের নেই৷

    তা জেঠুমণি বললেন, এসব লাজুক আনস্পোর্টিং জানোয়ারের জঙ্গলে আসাই ঠিক নয়৷ বসো, খিদে পেয়ে গেছে৷ একটু খাওয়া-দাওয়া করা যাক৷ শরীরকে খামোখা কষ্ট দিয়ে লাভ নেই৷

    একটা বড় গাছের নীচে সাপ-টাপ, বিছে-টিছে নেই, সে সম্বন্ধে শিওর হয়ে ওঁরা বসেছেন৷ বৈদ্যকাকু পিঠের রুকস্যাক থেকে খবরের কাগজ বের করে মাটিতে পেতে তার উপরে পাঁউরুটি মেলে খচাখচ মোটা-মোটা করে বড়-বড় সাইজের পাঁউরুটি কাটছেন এবং কাটা হয়ে গেলে দরাজ হাতে তার একপিঠে মাখন, অন্য পিঠে জেলি লাগিয়ে, তার সঙ্গে গোটা ছয়েক করে ডিমসিদ্ধ জেঠুমণি-রতুজেঠু সবাইকে এগিয়ে দিয়ে নিজেও খেতে আরম্ভ করেছেন৷

    এমন সময় হঠাৎ দূরে অন্ধকারের মধ্যে বনজঙ্গলের আড়ালে একটা চোখ দেখা গেল৷ লাল একটা চোখ জ্বলজ্বল করছে৷

    জেঠুমণি তখন নতুন শিকারি৷ বিগ গেম এবং নাইট শুটিং সম্বন্ধে ধারণা তাঁর অত্যন্ত কম৷ পাখি-টাখি মেরেছেন৷ হরিণও দু-একটা মেরেছেন৷ খরগোশ মেরেছেন সম্পূর্ণ নিজ প্রচেষ্টায় এবং একক অভিযানে৷ বিগ গেম শিকারের যদিও সঙ্গে গুরু রয়েছেন রতুজেঠু৷

    জেঠুমণি ডিমসিদ্ধ খেতে খেতে হঠাৎ এ দৃশ্য দেখে কোঁত করে ডিমটা গিলে ফেলে রতুজেঠুকে ফিসফিস করে বললেন—রতুদাদা ওটা কী?

    রতুজেঠু ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে খাচ্ছিলেন৷ চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে ভালো করে নজর করে দেখলেন৷ দেখে অনেকক্ষণ পরে বললেন, বাঘ৷

    সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ হয়ে গেল৷ জেঠুমণি বন্দুক হাতে তুলে নিলেন৷ রতুজেঠুও৷

    বৈদ্যকাকুর সঙ্গে বন্দুক-টন্দুক কিছু নেই৷ পরনে মালকোঁচা-মারা ধুতি, গায়ে একটা নীলরঙা টুইলের শার্ট৷ কোমরে ভোজালি৷ তিনিও সঙ্গে-সঙ্গে ভোজালি বের করে ফেললেন খাপ থেকে৷ তিনজনে একাগ্র দৃষ্টিতে সেই বাঘের একটি চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন সমস্ত মনোযোগ সহকারে৷ অনেকক্ষণ কেটে যাবার পর জেঠুমণি ভয়ে ভয়ে রতুজেঠুকে শুধালেন, আচ্ছা রতুদাদা, বাঘ যদি তো একটা চোখ কেন?

    রতুজেঠু বললেন, কথা বলো না৷ আরেকটা চোখ গাছের আড়ালে আছে৷ আরও মিনিট তিন-চার কেটে গেল৷ বাঘ নড়েও না চড়েও না৷ হুম করে না, হাম করে না৷ কতদূরে আছে, তাও বোঝার উপায় নেই৷ কিন্তু চোখটা তার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তো জ্বলছেই৷ গাছ-গাছালির গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে চোখটা অনেক দূর থেকে দেখা যাচ্ছে৷

    তখন আবার সাহস সঞ্চয় করে জেঠুমণি রতুজেঠুকে বললেন, আচ্ছা যদি গাছের আড়ালেই থাকবে, তাহলে এতক্ষণ কি গাছের আড়ালেই আছে? নড়াচড়া করে না কেন? বাঘের কি প্যারালিসিস হল? মনে-মনে ভাবলেন হতেও পারে৷ একসঙ্গে এতজন শিকারি দেখেছে তো! ভয়ে কী না হয়৷

    তখন রতুজেঠু ডানহাতের পাতার পাঁচটি আঙুল জেঠুমণির নাকের সামনে তুলে ধরে বললেন, বুঝছো হে, কানা বাঘ৷

    তখন জেঠুমণি বুঝতে পারলেন৷

    বললেন, ও তাই বলুন৷ একচোখা বাঘ? একটা চোখ কানা?

    রতুজেঠু বললেন, তাহলে আর বলছি কী? এক্সপিরিয়েন্স৷ এক্সপিরিয়েন্স ছাড়া এসব বনে-জঙ্গলে আসা মুশকিল৷ আমি না থাকলে তোমরা তো ভূত-টুত ভাবতে ওই একটা চোখকে৷

    জেঠুমণি বললেন, তা ঠিকই বলেছেন৷ আলোয়া-টালেয়া ভাবতাম! কিন্তু কী হবে? আমরা তো শিকার করতেই এসেছি৷ আজ আমরা কানা বাঘই মারব!

    বৈদ্যকাকু বললেন, সেকথা ছাড়ান দ্যান, বাঘ আমাদের মারে কি মারে না, তাই আগে দ্যাখেন!

    তখন রতুজেঠু বললেন, বৈদ্য এসব অলুক্ষুণে কথা সন্ধেবেলায় বলবিনি!

    বৈদ্যকাকু চুপ করে গেলেন৷ এবং কিছুই করার নেই দেখে খপাখপ রুটি খেতে লাগলেন৷ সাহসী লোক ছিলেন৷ নইলে বাঘের মুখে বসে কেউ রুটি-মাখন খায়! এমন সময় রতুজেঠু ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসলেন৷ নিলিং পজিশনে৷ বসে, অত্যন্ত সমারোহের সঙ্গে তাঁর একনলা বন্দুকটি কাঁধে ঠেকালেন৷

    বৈদ্যকাকু বললেন, সে কী, আপনি সত্য-সত্যই বাঘ মারতাছেন দেখি?

    রতুজেঠু বললেন, সেইরকমই তো কথা ছিল৷ বাঘ মারার জন্যেই তো এত কাণ্ড করে পেট্রল পুড়িয়ে আসা৷ তুমি না বিগ গেম করবে?

    বৈদ্যকাকু সেকথা শুনে আর কিছু বললেন না৷

    রতুজেঠু অনেকক্ষণ ধরে নিশানা করে গুড়ম করে গুলি করলেন৷ গুলি হওয়ার পরেই, খেলাটা আরম্ভ হল৷

    সেই এক-চোখা স্থিতপ্রজ্ঞ বাঘ গুলি খেয়েই হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠল৷ তারপর সেই চোখটা আস্তে-আস্তে এঁকে-বেঁকে জেঠুমণিদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷

    বৈদ্যকাকু ওয়াটার বটল থেকে অনেকখানি জল খেয়ে ফেললেন৷ বললেন—খাইছে৷ বাঘের গায়ে সত্যই গুলি লাইগ্যা গেছে গিয়া৷ আমি গাছে উঠলুম৷ বলে, বিনাবাক্যব্যয়ে সাধের পাঁউরুটি, সাধের জেলি ফেলে রেখে সামনেই যে গাছ পেলেন, তার মগডালে গিয়ে চড়লেন৷ রতুজেঠু তখন বন্দুকটা আনলোড করে আরেকটা গুলি পুরলেন৷ এবার অ্যালফাম্যাক্সের বল৷ এ গুলি বাঘের গায়ে লাগলে বাঘের পঞ্চত্বপ্রাপ্ত অবশ্যম্ভাবী৷ কিন্তু বাঘ মুখে শব্দটি না করে ধীরে-ধীরে আস্তে-আস্তে এঁকেবেঁকে গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে ওঁদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷ মনে হল, সে বাঘ শুধু কানাই নয়, বোবাও৷

    রতুজেঠু আর কালবিলম্ব না করে আবারও নিশানা নিয়ে গুড়ুম করে গুলি করলেন৷ এইবার সাংঘাতিক কাণ্ড হল৷

    সেই বাঘ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে লাফাতে লাফাতে জেঠুমণিদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷ এবার বাঘের পায়ের মচ মচ শব্দ শোনা গেল৷ এ-দেশীয় বাঘমশাইরা বুট জুতো পরেন কিনা, জেঠুমণির জানা ছিল না৷ কিন্তু বাঘের পায়ে বুট জুতোর আওয়াজ শুনে জেঠুমণি ডবল ঘাবড়ে গেলেন৷

    এদিকে বাঘ এসে যায় আর কী! শুকনো পাতার উপরে, পাথরের উপরে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ এমন সময় জেঠুমণি দাঁড়িয়ে উঠলেন৷ দাঁড়িয়ে উঠে বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে হেডলাইটটা সোজা করে নিয়ে আগন্তুক বাঘের দিকে নিশানা নিয়েই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, বাঘ! বাঘ! তুমি যদি মানুষ হও তো প্লিজ সরে যাও৷

    সঙ্গে-সঙ্গে বাঘ বলল, মনাদা!

    সঙ্গে-সঙ্গে রতুজেঠু গোঁ-গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন৷ এবং জেঠুমণি বন্দুক নামিয়ে নিলেন৷

    অজিতকাকু ও তাঁর দুই শাগরেদ রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হলেন৷

    পরে যা শোনা গেল, তাতে জানা গেল, অজিতকাকুরাও অনেক হেঁটে-হেঁটে এই অকৃতজ্ঞ জানোয়ারে ভরা জঙ্গল সম্বন্ধে অত্যন্ত হতাশ হয়ে একটা গাছের গোড়ায় পাথরের উপর বসে খাওয়া-দাওয়া করছিলেন৷ অজিতকাকুর কপালে ক্লাম্পে টর্চ লাইট বাঁধা ছিল৷ সেই টর্চ লাইটের আলো অনেক দূর থেকে গাছের গুঁড়ির ঝোপ-ঝাড় ভেদ করে জেঠুমণিদের চোখে, বাঘের চোখ বলে মনে হয়েছিল৷ অবশ্য অ্যামেচার শিকারি জেঠুমণি বলেই ছিলেন বাঘের একটা চোখ কেন? কিন্তু বিগ-গেম-এর এক্সপিরিয়েন্সসম্পন্ন রতুজেঠু যখন বললেন, বাঘটা কানা বাঘ, তখন জেঠুমণির কোনো সংশয় ছিল না৷ অজিতকাকুরা তখন নিবিষ্টমনে রুটি-মাখন খাচ্ছেন, সেই সময় রতুজেঠু প্রথম গুলি করলেন কানা বাঘটাকে৷ এবং ‘কানা বাঘের’ পূর্বপুরুষের পুণ্যবলে রতুজেঠুর গুলি অজিতকাকুর শরীরের অনেক দূর দিয়ে চলে গেল৷

    অজিতকাকুরা গুলির শব্দ শুনে ভাবলেন যে, অন্য দল নিশ্চয়ই কোনো শিকার পেয়েছে৷ এবং অন্য দল শিকার পেয়েছে এবং এই দল পায়নি এই ভাবনা ভাবার সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন এবং হীনম্মন্যতাবোধে ভুগতে থাকলেন৷ কিছুক্ষণ পর আরও একটা গুলি হতে, অজিতকাকুর মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না যে, অন্য দলের সামনে নিশ্চয়ই কোনো বড় জানোয়ার, হাতি-টাতি কি বুনো মোষ পড়েছে, শুধুমাত্র বন্দুকের পক্ষে সে জানোয়ারকে সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ সুতরাং বন্ধুদের জন্যে অজিতকাকু ভাবিত হলেন৷ যেহেতু তাঁর হাতে রাইফেল আছে এবং রাইফেল বন্দুকের চেয়ে অনেক জোরদার হাতিয়ার, সুতরাং অজিতকাকু শাগরেদদের নিয়ে দৌড়ে গুলির শব্দের দিকে আসতে লাগলেন৷ তখন রতুজেঠু ভাবলেন যে, গুলি খেয়ে বাঘ আক্রমণ করেছে৷’’

    আমি বললাম, ‘‘তারপর কী হল?’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘তারপর বৈদ্যকাকু সড়াত করে গাছ থেকে নেমে এসে ওয়াটার বটলের জল থেবড়ে-থেবড়ে রতুজেঠুর মাথায় কপালে দেওয়ার অনেকক্ষণ পরে রতুজেঠুর জ্ঞান ফিরল৷ সে যাত্রায় আর শিকার-টিকার হল না৷’’

    আমি বললাম, ‘‘থামলে কেন ঋজুদা?’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘একদিনে সব শুনিস না, মুশকিলে পড়বি৷ অন্য দিন বলব৷’’

    আমি বললাম, ‘‘তুমি ভীষণ খারাপ, কথা দিয়ে কথা রাখো না৷’’

    ঋজুদা বলল, ‘‘গাঁট্টা খাবি৷ যা কফি করে নিয়ে আয় আমার জন্যে৷’’

    —

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবনবিবির বনে – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article জংলিমহল – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }