Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কিশোর গল্প – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প310 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ম্যাথস

    ম্যাথস

    বাঁদরের তৈলাক্ত বাঁশে চড়ার অংকই হোক, কি চৌবাচ্চার জল ফুরানোর হিসেবের অংকই হোক, কোনো অংকই আমার ঠিক হত না৷ এমনকি, সামান্য যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগেও ভুল হত৷

    অক্ষয়-স্যার আমাদের স্কুলের মাস্টারমশাই তো ছিলেনই, ম্যাথস-এ কাঁচা বলে বাবা ওঁকে বাড়িতেও পড়াতে বলেছিলেন আমাকে৷ টকটকে ফর্সা রং ছিল ওঁর৷ খোঁচা-খোঁচা কালো গোঁফ৷ ধুতি আর পাঞ্জাবি পরতেন৷ গায়ে একটি এন্ডির চাদর থাকত৷ পায়ে পাম্প শু৷

    টেবিলের উলটো দিকের চেয়ারে বসে আমার খাতার উপর ঝুঁকে পড়ে অংকের ফল দেখতে-দেখতে ওঁর মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠত৷ ভুরু কুঁচকে যেত৷ বলতেন, ‘ই-ইটা কী?’

    কখনও বা গম্ভীর গলায় বলতেন, যেন টেবিল-চেয়ারকেই বলছেন, ‘আর কতবার বলতে হবে তোমাকে যে, সংখ্যাকে না বদলে তা কেটে পাশে পরিষ্কার করে লিখবে?’

    আমি মুখ নীচু করে থাকতাম৷ ভীষণ কষ্ট হত বুকের মধ্যে!

    অক্ষয়-স্যার যখন আমাকে বকতেন, মারতেনও কখনও, তখন আমার অত কষ্ট হত না৷ কিন্তু ওঁর মুখে যখনই বিচ্ছিরি বিরক্তির ভাব ফুটে উঠত, সেই মুখে আমি স্পষ্টই পড়তে পারতাম, আমি একটি গাধা৷ এবং উনি আমাকে নিয়ে রীতিমতোই নাজেহাল৷ অথচ ট্যুইশানিরও দরকার নিশ্চয়ই ছিল তখন ওঁর৷ তাই বলতেও পারতেন না বাবাকে যে, আমাকে আর পড়াবেন না৷

    ওঁর একমাত্র ছেলে গোপেনদা ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন৷ ওঁর জন্যে অক্ষয়-স্যারের গর্বের অন্ত ছিল না৷

    উনি চলে গেলে অনেকক্ষণ একা ঘরে আমি বসে থাকতাম৷ নিজের উপর বড়ই রাগ হত৷ অথচ কী করব? অংক আমার একেবারেই ভালো লাগত না৷ কবিতা লিখতে, ছবি আঁকতে, গান গাইতে ভালো লাগত৷ কিন্তু ওইসব তো গুণের মধ্যে পড়ত না৷ যে-গুণ ভাঙিয়ে টাকা রোজগার না-করা যায়, তা কি আর গুণের মধ্যে পড়ে?

    বাবা অফিস থেকে ফিরলেই শব্দ পেতাম৷ গ্যারাজ ছিল একতলাতেই, আমার পড়ার ঘরের পাশেই৷ অফিস থেকে ফিরেই বাবা একবার আমার ঘরে ঢুকতেনই৷ বলতেন, খোকন, কেমন হচ্ছে পড়াশোনা? পরীক্ষা তো এসে গেল৷ কোনওদিন বলতেন, আমি তো জানিই, তুই স্কলারশিপ পাবিই৷ তবে স্ট্যান্ড করলে আরও খুশি হব৷

    বাবাকে আমি ভালোবাসতাম খুবই৷ কিন্তু আমার সম্বন্ধে বাবার এমন উঁচু ধারণায় কুঁকড়ে যেতাম৷ আপত্তিও করতে পারতাম না৷ বলতে পারতাম না যে, আমি হয়তো ফার্স্ট ডিভিশনই পাব না৷

    নিজের ছুড়ে-দেওয়া কথাতে নিজেই খুশি হয়ে, দোতলায় উঠে যেতেন বাবা আমাদের ফক্স-টেরিয়ার কুকুর ‘ম্যাডা’কে আদর করতে করতে৷ বাবার গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ পর্যন্ত চিনত ম্যাডা৷ গাড়ি যখন রাস্তায় এবং আর কেউই যখন বুঝতে পর্যন্ত পারত না, ম্যাডা তখন উত্তেজিত গলায় ডাকতে-ডাকতে দোতলা থেকে তার পায়ের নখে খচর-খচর আওয়াজ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে তড়িৎগতিতে নেমে এসে গ্যারেজের সামনে ছুটোছুটি করত৷

    বিহারের মধুবনী জেলার এক রং-রুট ড্রাইভার সুরজনারায়ণ ঝা, অতি-উত্তেজিত ম্যাডার একটা পায়ের উপর চাকা তুলে দিয়ে সামনের বাঁ পাটাকে একবার প্রায় ভেঙেই দিয়েছিল একদিন৷

    বাবা উপরে চলে যাওয়ার পর আরও খারাপ লাগত৷ অক্ষয়-স্যার পড়ালে গোরু-গাধাও নাকি ফার্স্ট ডিভিশন পায়৷ আমি অন্য সব বিষয়ে খুব ভালো না হলেও, অংকের মতো অতটা খারাপ ছিলাম না৷ তাই অংকের দায়িত্ব অক্ষয়-স্যারের হাতে তুলে দিয়ে বাবা নিশ্চিন্ত হয়ে যা খুশি তাই ভাবছিলেন৷

    বন্ধুদের কাছেও শুনতাম যে, তাদের সকলের বাবাও নাকি ওইরকমই বলতেন৷ প্রত্যেকের মায়েরাই বলতেন, ‘তোর বাবা কোনোদিন ক্লাসে সেকেন্ড হয়নি৷ আর তুই?’

    আমার বন্ধু প্রণব একদিন দুঃখ করে বলেছিল, ভেবে দ্যাখ, সক্কলের বাবাই যদি ক্লাসে ফার্স্ট হতেন, তাহলে ওঁদের সময়ে ক্লাসে সেকেন্ড হতেন কে বল তো?

    প্রীতি বলেছিল, আর ফেলই বা করতেন কারা? আমি তো ভেবেই পাই না৷

    ২

    অক্ষয়-স্যার সপ্তাহে তিনদিন আসতেন৷ তাঁর বিরক্তি আর আমার হতাশা ও অপরাধবোধ ক্রমশ বেড়েই চলেছিল৷

    একদিন এক টিপ নস্যি নিয়েই উনি আমাকে বললেন, খারাপ-ভালোর অনেকরকম হয়, বুঝেছ? তোমার মতো ছেলে আমি আর দেখিনি৷ তোমার বাবা মিছেই তোমার পেছনে পয়সা খরচ করছেন৷ আমি এবার তোমার বাবাকে বলব৷ তোমার মতো দু-চারটি ছাত্র পেলেই আমার এতদিনের সুনাম ডুববে৷ এত সোজা অংক, তাও তুমি…

    আমি মাথা নীচু করেই ছিলাম৷ অনেক ছেলে, বাবা-মায়ের কাছে রিপোর্ট লুকোয়, পাছে তাঁরা মারেন, বকেন৷ আমি কখনওই লুকোইনি৷ অক্ষয়-স্যার আমার কথা বাবাকে বলে দিলেও বাবা আমাকে কিছু বলতেন না, কিন্তু বড় দুঃখ পেতেন নিশ্চয়ই৷ বাবাকে ভালোবাসতাম বলে বাবা দুঃখ পান, তাও চাইতাম না৷ অথচ আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠার অংক বা চৌবাচ্চার জল ফুরনোর অংক কিছুতেই করতে পারতাম না৷ সেই সময় কোনো রবীন্দ্রসংগীতের কলি কানের পাশে ঘুরঘুর করত৷ চোখের সামনে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’-এর রাজা দোবরুপান্না বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’র হোসেন মিঞার মুখ ভেসে উঠত৷ অ্যালজেব্রাও একদম ভালো লাগত না৷ জিওমেট্রি একটু ভালো লাগত৷ মনে হত ছবি আঁকছি৷ কিন্তু থিওরি এলেই মাথা একেবারে গোলমাল হয়ে যেত৷ আমি পরীক্ষায় ভালো ফল না করলে যে বাবা দুঃখ পাবেন—এই কথাটা ভেবেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসত৷ বাবার দুঃখ পাবার ভয়ে নিজে আগেভাগে এত দুঃখ পেতাম যে, তা বলবার নয়৷ বাবার মস্ত কারখানার ভার তাঁর একমাত্র ছেলে নেবে এই-ই ছিল বাবার ইচ্ছে৷

    ভালো ছাত্র ছিলাম না বলেই স্কুলের কোনো মাস্টারমশাই ভালো চোখে দেখতেন না আমাকে৷ যদিও ব্যবহার এবং স্বভাব পড়াশোনার তুলনায় একটু ভালো ছিল বলে কেউ খারাপ বলতেন এমনও নয়৷ আমি জানতাম যে, শিশির অথবা অনিমেষ, সকলেই ছাত্র হিসেবে আমার চেয়ে অনেকই ভালো ছিল৷ কাটু, বান্টা, এরা সব পড়াশোনাতে শিশিরদের মতো ভালো না হলেও খেলাধুলার জন্যে আলাদা একধরনের সম্মান পেত স্যারদের কাছ থেকে৷ পুরো স্কুলে ছেলেরাও তাদের হিরো-জ্ঞানে দেখত৷ কাটুর তো তখন এতই কদর ফুটবলে যে, চার ফুট দশ ইঞ্চি হাইটের ম্যাচ হলেই এক বিকেলে চার-পাঁচ জায়গায় ওকে ভাড়া করে নিয়ে যেত বিভিন্ন ক্লাব৷ ওর নিন্দুকেরা বলত, ও নাকি এক কাপ চা ও একটা বিস্কুট পেলেই ভাড়ায় খেলে দেয়৷ কাটু বিকেলের প্রথম খেলাতে নেমেই গোটা ছয়েক গোল দিয়ে তাদের এগিয়ে রেখে অন্য ম্যাচে গিয়ে পটাপট গোল দিয়ে আবার প্রথম ম্যাচের জায়গায় গিয়ে দেখত, প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকাররা গোল শোধ করে দিয়েছে কি না৷ যদি ছ’টার বেশি গোল তারাও দিত, তবে কাটু তক্ষুনি গোটা দুই-তিন গোল দিয়ে সেই ম্যাচের ইতি টানত৷

    প্রাইজ ডিসট্রিবিউশনের দিন শিশির এত বই পেত প্রাইজ হিসেবে, যে, একা বয়েই নিয়ে যেতে পারত না৷ তিন-চারজনের সাহায্য লাগত৷ স্পোর্টস-এর প্রাইজের দিনও অন্যান্য ছেলেরা কত মেডেল, কাপ সব পেত৷

    জীবনে কী পড়াশোনাতে, কী স্পোর্টসে, কোনোদিন একটিও প্রাইজ পাইনি৷ রেজাল্ট বেরোবার দিন, প্রাইজের দিন, বড় মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরতাম৷ এই ভেবে সান্ত্বনা দিতাম নিজেকে যে, আমরাই তো দলে ভারী৷ যারা প্রাইজ পেল, তারা আর ক’জন? তবুও বড় ছোট, সাধারণ, ভিড়ের মধ্যের একজন বলে মনে হত নিজেকে৷ কোনো কোনোওবার প্রাইজ ডিসট্রিবিউশনের অনুষ্ঠানে গান গাইতে বলা হত আমাকে৷ সে-গান আমার মা’ই শিখিয়ে দিতেন৷ গানও কিছু আহামরি গাইতাম না৷ অমন গান সকলেই গাইতে পারত৷

    কেবলই ভাবতাম, আমি খারাপ৷ আমি কোনো কিছুতেই ভালো নই৷ ফার্স্ট বয়দের মতো লাস্ট বয়দেরও একটা আলাদা পরিচয় থাকে, বৈশিষ্ট্য থাকে৷ আমার তাও ছিল না৷ যে বয়সে প্রত্যেকেই ইমপর্ট্যান্ট হতে চায়, সেই বয়সে তখন আন-ইমপর্ট্যান্ট হয়ে থেকে মরমে মরে যেতাম৷

    আমাদের ক্লাসের লাস্ট বয় গজু৷ বয়সে সে আমার চেয়ে অন্তত চার-পাঁচ বছরের বড় ছিল৷ একই ক্লাসে ছিল পাঁচ বছর৷ গতবার ফাইনাল পরীক্ষায় বাংলা পরীক্ষার দিনে আমার পাশেই সিট পড়েছিল গজুর৷ ও ঘাড় নীচু করে আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে গরম নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, বিপ্রকর্ষ কী রে?

    গার্ড ছিলেন নরু-স্যার৷ দুষ্টু ছেলেরা তাঁকে ডাকত ‘ঘাড়-ছোট নরু-স্যার’ বলে৷ গজুর কথাতেই আমার দিকে তাকিয়েছিলেন উনি৷ ওঁর অভ্যাস ছিল ক্লাসের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি পায়চারি করে বেড়ানো৷ ক্লাসে পড়াবার সময়ও অমনই করতেন৷ গার্ড দেবার সময়ও তাই করছিলেন৷ উনি যেই দূরে চলে গেলেন, গজু ফিসফিস করে বলল, তোর পেট যদি আজ ছুরি দিয়ে না ফাঁসাই, তো আমার নাম গজশোভা রায় নয়৷

    সেকথা শুনেই আমার পিলে চমকে গেল৷ গলা শুকিয়ে এল৷ কানাঘুষোয় আমি শুনেছিলাম যে, গিরিশ পার্কের পাশে ও একটি মরচে-পড়া ছুরি দিয়ে একটি ছেলেকে খুন করেছিল৷ মরচে-পড়া ছিল বলে ছেলেটাকে বাঁচাতে পারেনি ওর মা-বাবা অনেক চেষ্টা করেও৷ কিন্তু গজুর বাবা ছিলেন পুলিশের দারোগা৷ তাই কিছুই হয়নি ওর৷

    ঘাড়-ছোট নরু-স্যার কথাটা শুনে ফেললেন৷ ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, গজু, কেন ছেলেমানুষকে ভয় দেখাচ্ছ? বিপ্রকর্ষর মানে জানতে চাও তো আমিই বলে দিচ্ছি৷ কিন্তু এই একটি প্রশ্নের উত্তর ঠিক লিখলেই কি তুমি পাশ করে যাবে এবারে?

    গজু নরু-স্যারকে ধমকে বলল, স্যার আমি অলরেডি চটে আছি৷ আমাকে আর চটালে কার পেট যে ফাঁসবে তার ঠিক নেই৷

    ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ একটু নস্যি নেবে? বলেই ঘাড়-ছোট নরু-স্যার গজুর কাছে গিয়ে ওকে নস্যি অফার করলেন৷ গজু রেগুলার নস্যি নিত৷ স্যারের ডিবে থেকে একটিপ নস্যি নিয়ে কিছুটা আমার নাকে উড়িয়ে একটি নোংরা রুমাল বার করে নাক ঝাড়ল৷

    সেই মুহূর্তে ভালো ছাত্র শিশির সম্পর্কে যেরকম সম্ভ্রম ছিল আমার মনে, খুনি এবং ওঁচা ছাত্র গজু সম্পর্কেও, তার দুর্দান্ত প্রতাপ দেখে, ঠিক সেরকম নয়, তবে অন্য একরকম সম্ভ্রম জাগল৷ সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, জীবনে বিশেষ কেউ হতে হলে খুবই ভালো হতে হবে৷ এখানে মাঝামাঝিদের কোনো পরিচয় নেই, দামও নেই৷ খুব ভালো যদি না হওয়া যায়, তা হলে খুব খারাপ, গজুর মতো হওয়াও বোধহয় ভালো৷ কিছু না হয়ে থাকার চেয়ে তবু কিছু একটা হাওয়া হল৷ আমাদের বন্ধু রাজেন যেমন ‘কিছু’ হল সেদিন রাস্টিকেটেড হয়ে৷ বাবার আলমারি ভেঙে টাকা নিয়ে সে বোম্বে যেতে চেয়েছিল সিনেমায় নামবে বলে৷ খড়্গপুরেই পুলিশ পাকড়াও করে নিয়ে আসে তাকে৷ বোম্বেও যাওয়া হল না, রাস্টিকেটেডও হল৷

    ৩

    যেদিন স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরোল, সেদিন বাথরুমে গিয়ে খুব কাঁদলাম৷ আমার চেয়ে বেশি কাঁদলেন মা৷ এবং মা’কে অপদার্থ ছেলের জন্য কাঁদতে দেখে আমার বুক ফেটে যেতে লাগল৷

    সন্ধের পর অক্ষয়-স্যার এলেন৷ আমি পড়ার ঘরেই ছিলাম৷ ট্যাবুলেটরের কাছ থেকে উনি মার্কস জেনে এসেছিলেন৷ যেহেতু অংকই পড়াতেন, অংকের মার্কসই শুধু জেনেছিলেন৷ ওঁর মুখে আমার প্রতি সেই ঘৃণা, বিতৃষ্ণা আর অধৈর্য চিরদিনই ছিল৷ সেইসব আবারও তীব্র ঝলকে ফুটে উঠল৷ পথের ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে যেমন নাকে রুমাল চাপা দেন, তেমন করে আমার খারাপত্বর গন্ধও যেন ওঁর নাকে লেগে ওঁকে ভীষণ পীড়িত করছিল৷ নস্যি-মাখা রুমাল দিয়ে নাক চাপা দিলেন উনি৷

    মুখটি নীচু করেই রইলাম আমি৷ এ-মুখ কাউকেই দেখানোর নয়৷

    অক্ষয়-স্যার বললেন, তুমি আমার লজ্জা৷ তোমার মতো গোটা-দুই ছেলে যদি আমার লিস্টে থাকে, তবে আমার প্রাইভেট টিউটর হিসেবে যে সুনাম, তা একেবারেই উবে যাবে৷ তোমার বাবাকে বোলো, অন্য টিউটরের খোঁজ করতে৷ তুমি পঁয়তাল্লিশ পেয়েছ৷ বুঝেছ? ইয়ে! পঁয়তাল্লিশ! আর অ্যাডিশনাল ম্যাথস-এ পেয়েছ পঁচিশ৷ ছোঃ ছোঃ৷ অ্যাডিশনাল ম্যাথস! শখ কত্ত৷ কী স্পর্ধা! আর শোনো, ফার্স্ট ডিভিশনও জোটেনি কপালে৷ দশ নম্বর কম আছে৷

    আমি মুখ নীচু করেই রইলাম৷

    অক্ষয়-স্যার হঠাৎ একটিপ নস্যি নিয়ে উঠে পড়েই বললেন, তোমার বাবাকে কোন মুখে ফেস করব? উনি আসার আগেই আমি উঠছি৷ বাবাকে বোলো, তোমার ব্রিলিয়ান্ট মার্কসের কথা৷ ছিঃ, ছিঃ! কী বাবার কী ছেলে! লজ্জা, লজ্জা! তুমি আমার ছেলে হলে…

    হলে যে কী করতেন, সেটা না বলেই এগোলেন৷ গোপেনদা যে আমার চেয়ে কত ভালো তা আমি জানতামই৷ ও-কথা ওঁর বলার দরকার ছিল না৷ চলে যেতে গিয়েই ফিরে দাঁড়িয়ে আবার বললেন, তোমার বাবা আমাকে যদি কিছু বলেন, তা হলে আমি কিন্তু ওঁকে ভালো করেই শুনিয়ে দেব, গাধা পিটিয়ে ঘোড়া নিশ্চয়ই করা যায়, কিন্তু তু-তু-তুমি তো…৷

    চলে গেলেন উনি৷

    টেবিল-লাইটটা জ্বলছিল৷ আমি টেবিলের উপরেই দু-হাতের মধ্যে মাথা পেতে শুয়ে ছিলাম৷ একটু পরই হঠাৎ ম্যাডার ঘনঘন চিৎকারে চমকে উঠলাম৷ শুনতে পেলাম বাবার গাড়িটা গ্যারাজে ঢুকল৷ ড্রাইভার বাহাদুর জিজ্ঞেস করল বাবাকে, কাল সকালে কখন আসবে? তারপর চাবি দিয়ে ‘সেলাম সাহাব’, বলে চলে গেল৷

    ম্যাডা লাফাতে-লাফাতে বাবার পায়ে-পায়ে আমার ঘরে এসে ঢুকল৷ আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল৷ বাবা আমার মুখের দিকে চেয়েই বুঝলেন৷ বললেন, কী খোকন? মনটা খারাপ মনে হচ্ছে৷ হলটা কী?

    আজ যে স্কুল ফাইনালের রেজাল্ট বেরোবে তা বাবা জানতেন৷ কিন্তু আমি যে স্কলারশিপ পাবই তা যেন উনি ধরেই নিয়েছিলেন৷ সামান্য অবাক হয়ে বললেন, ‘‘কী? ভালো হয়েছে ফল?’’

    বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কোনোরকমে আমি বললাম, সেকেন্ড ডিভিশান৷

    বলতে চাইলাম, কিন্তু বলতে পারলাম না যে অংক আমার কোনোদিন ভালো লাগেনি বাবা৷ তুমি মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করলে অক্ষয়-স্যারকে রেখে৷

    ও! বাবা বললেন৷

    তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকেই বলেন, ‘‘ম্যাথস কীরকম হল?’’

    ম্যাথস-এ পঁয়তাল্লিশ৷ আর অ্যাডিশন্যাল ম্যাথস-এ পঁচিশ৷ বলেই আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম৷ বাবা আমার কাছে এসে পিঠে হাত রাখলেন৷

    একটুক্ষণ পর গলা তুলে জগুকে ডাকলেন৷

    জগু গেট ছেড়ে ভেতরে আসতেই বাবা বললেন, মাকে বল, আমি নিউ মার্কেটে যাচ্ছি৷ মাটন আনব আর গলদা চিংড়ি৷ পোলাও রাঁধতে বল৷ তোরা কী রে? খোকন আজ পাশ করেছে পরীক্ষায়, তোরা জানিস না? এই নে জগু, তুই একশো টাকা রাখ, আজ খুশির দিন৷

    বলেই বললেন, চল খোকন৷ জগু তুই ম্যাডাকে ধর৷ নইলে ঝামেলা করবে৷

    বাবা নিজেই গাড়ি বের করলেন গ্যারাজ থেকে৷ সামনের বাঁদিকের দরজা খুলে দিলেন৷ ওই সিটে মা বসেন৷ আমি বসে পড়েই দরজা বন্ধ করে দিলাম৷

    জগুদা গেট খুলে দিল৷ বাবা গাড়ি চালিয়ে চললেন, নিউ মার্কেটের দিকে৷ বললেন, ‘‘এই রে! চিংড়ি মাছ তো তোর মা ভালোবাসেন৷ তুই তো ভালোবাসিস ভেটকি মাছের ফ্রাই৷ চল, দেখি৷ পেয়ে যাব ঠিকই৷ এখন ফ্রাই পিস করে কাটার লোক পাব কিনা সেই হচ্ছে কথা!’’

    আমি চুপ করে ছিলাম৷ আমার ভীষণ জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল৷ কিন্তু চলন্ত গাড়ির মধ্যে কাঁদলে লোকে কী ভাববে?

    পার্ক স্ট্রিটে পড়েই বাবা বললেন, তোর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত আমার৷ উচিত কেন, চাইছিই ক্ষমা৷ বুঝলি খোকন!

    কী বলছ বাবা? আমি হতভম্ব হয়ে বললাম৷

    হ্যাঁ, তোর ইনক্লিনেশান ছিল আসলে আর্টসেরই দিকে৷ প্রথম থেকেই লিটারেচারে তুই তো ভালোই৷ আসলে লিটারেচার হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের সাবজেক্ট৷ আমরা তো হলাম গিয়ে মিস্তিরি৷ সে এঞ্জিনিয়ারই বল, আর অ্যাকাউন্ট্যান্টই বল৷ জজ বল, ব্যারিস্টার বল, ডাক্তার বল—যিনি সাহিত্য না পড়েছেন বা পড়েন, বা সাহিত্যের খোঁজ না রাখেন, তিনি আসলেই অশিক্ষিতই৷ সাহিত্যই হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের মনের সবচেয়ে বড় এক্সপ্রেশান৷

    একটু থেমে বললেন, এত বড় ফ্যাক্টরিটা করেছিলাম৷ তুই ছাড়া আমার তো কেউই নেই৷ একমাত্র সম্বল তুইই৷ আজকাল কত সব কথা শুনছি৷ বিদেশে গিয়ে কমপিউটার ব্যবহার হচ্ছে সব ব্যাপারেই৷ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি প্রতিদিন কোথায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষকে, মানে মেটিরিয়াল ওয়ার্ল্ডে৷ ভেবেছিলাম, সায়েন্স নিয়ে পড়লে তোর পক্ষে…৷ যাক গে, মাই লাইফ ইজ মাই লাইফ, অ্যান্ড ইওর লাইফ ইজ ইওরস৷ তুই যা হতে চাস খোকন, তাই-ই হয়ে ওঠ জীবনে৷ আমি তোকে আর ভুল পথে চালাব না৷ আই অ্যাম সরি৷ রিয়েলি আই অ্যাম৷

    নিউ মার্কেটের সামনেটা তখন ফাঁকা৷ আলো প্রায় সব নিবে গেছে৷ ফুলের দোকানগুলো খোলা আছে শুধু৷ তাও বাইরে ঝাঁপ নামানো৷ গ্লোব সিনেমার সামনে একটা বিরাট হোর্ডিং৷ সিনেমার বিজ্ঞাপন৷ ছবির নাম ‘আই উইল ক্রাই টুমরো’৷

    বাবা একটু পরেই মুটের মাথায় বাজার নিয়ে ফিরে এলেন৷ আমি তাড়াতাড়ি নেমে বাবার হাত থেকে চাবি নিয়ে গাড়ির বুটটা খুললাম৷ মাল সব রেখে বাবা মুটেকে পাঁচ টাকা দিলেন৷ মানুষটি বলল, ফুটা নেহি সাহাব৷

    বাবা বললেন, আমার ছেলে আজ পরীক্ষায় পাশ করেছে৷ কলেজে যাবে৷ তোমাকে বকশিশ দিলাম৷

    মানুষটি একটু অবাক হয়ে মাথায় হাত ঠেকাল৷

    গাড়িটা ময়দানের দিকে নিয়ে চললেন বাবা৷ ময়দানে পৌঁছে বললেন, পোলাও হতে হতে আমরা পৌঁছে যাব কী বল? তোর মা আছেন, নগেন আছে, জগু আছে, রাঁধতে কত সময় লাগবে? চল, একটু পায়চারি করি৷

    বাবা গাড়িটার পাশেই সামনে-পিছনে হাঁটবেন বলে মনে হল৷ একটু হেঁটে বললেন, নাঃ, চল তোর মা ভাববেন৷ যেতে যেতেই তোকে গল্প বলব৷ একটু চুপ করে থেকে বললেন, তুই মেন্ডহেলসনের নাম শুনেছিস?

    না তো!

    সে কী রে? একটি বই আছে ওঁর জীবনী নিয়ে লেখা, নাম ‘বিয়ন্ড ডিজায়ার’৷ পিয়ের ল্যা মূর-এর লেখা৷ তোকে কিনে দেব৷ পড়িস৷ সেদিন তুই মোৎজার্ট-এর রেকর্ড নিয়ে এসেছিলি সম্বিৎদার বাড়ি থেকে৷ বিটোভেন শুনিস প্রায়ই, আর মেন্ডহেলসনের নামই শুনিসনি?

    শুনিনি৷ আমি বললাম নির্লজ্জের মতো৷ পরীক্ষাতে এত বাজে রেজাল্ট করার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েই৷

    ফেলিক্স৷ নাম ছিল তাঁর ফেলিক্স মেন্ডহেলসন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের ইউনাইটেড জার্মানির সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার ছিলেন ওঁর বাবা৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বড়লোকদের মধ্যে একজন৷ ফেলিক্সের বাবার নাম কিন্তু ভুলে গেছি৷ ফেলিক্সও ছিলেন তোরই মতো, তাঁর বাবার একমাত্র সন্তান৷ ফেলিক্স খুব আর্টিস্টিক ছিলেন৷ দারুণ পিয়ানো বাজাতেন৷ ওঁর ইচ্ছে ছিল যে, উনি কম্পোজার হবেন৷ পিয়ানোতে নতুন নতুন সুর সৃষ্টি করবেন৷

    সে ব্যবসা দেখবে না, এই কথা শুনে বাবার মাথায় তো আকাশই ভেঙে পড়ল৷ ছেলেও নাছোড়বান্দা৷ মায়ের কিন্তু খুবই ইচ্ছে ছিল যে, ছেলে কম্পোজার হোক৷ আসলে মায়েরা সন্তানদের যতখানি বোঝেন, বাবারা কখনো ততখানি বোঝেন না৷ তোর মা’রও কিন্তু উচিত ছিল, তোর আসল ভালোলাগা কোনদিকে, তা আমাকে জানানো৷ জানালে, তোর মন আজ খারাপ হত না৷ জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষাতে ফল খারাপ করতিস না৷

    যাই হোক, ফেলিক্সের মায়ের ইচ্ছে যেরকমই হোক, তাঁর বাবার বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য৷ শেষে বাবা তো ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করার ভয়ও দেখালেন৷ বললেন, তোমাকে সম্পত্তির এক কণাও দেব না, যদি আমার ব্যবসাতে না আসো৷ সাবধান৷

    পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে এসে ট্রাফিক লাইটে গাড়িটা দাঁড়াতে বাবা বললেন, ফেলিক্স কিন্তু শুনলেন না৷ যে একবার গান-বাজনার জগতের স্বাদ পেয়েছে, সাহিত্যের রসের আস্বাদ পেয়েছে, তার কাছে টাকাপয়সা কী? চলে গেলেন সব ছেড়ে৷ যা হতে চেয়েছিলেন, তাইই হতে৷ রাজার চেয়েও বড়লোক বাবার ছেলে, অতি অল্পবয়সেই যক্ষ্মা হয়ে মারা গেলেন, একটি আন-হিটেড ঘরে৷ ইউরোপের সব জায়গাতে তো হিটিং ছিল না তখন ঘরে ঘরে৷ যক্ষ্মারও চিকিৎসক ছিল না বিশেষ৷ কিন্তু ওই বয়সেই ফেলিক্স যা করে গেলেন, টাকা রোজগার করে নয়, ক্ষমতা একীভূত করে নয়, কিছু করার মতো করে৷

    আজ পৃথিবীর মানুষ কিন্তু ফেলিক্স মেন্ডহেলসনের বাবাকে বেমালুম ভুলে গেছে, আর যদি-বা মনেও রেখেছে, তাও ফেলিক্সের বাবা হিসেবেই৷ প্রচণ্ড পয়সাওয়ালা মস্ত ব্যবসাদার, দারুণ ক্ষমতাবান তো কত মানুষই আসে যায় পৃথিবীতে৷ কিন্তু তাদের মনে রাখে কে? যদি বা কেউ রাখেও, ভালোবাসে, মনে রাখে, তাদের মধ্যে খুব কম মানুষকেই, মনে রাখে ঘৃণায়৷ ‘‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’’, বুঝলি না!

    আমি যে কোনও কিছুতেই তত ভালো নই বাবা! আমি যে মাঝামাঝি, মিডিওকার৷

    অসহায়ের মতো বললাম আমি৷

    বাবা আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন৷ বললেন, ‘‘স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাই তো জীবনের একমাত্র পরীক্ষা নয়, খোকন৷ যতদিন মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়, ততদিন, প্রত্যেকদিনই তাকে অনবরত পরীক্ষায় বসতে হয়৷ যতই দিন যাবে, ততই এই কথা বুঝতে পারবি৷ স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় যারা ফার্স্ট হয় এবং লাস্টও, তাদের মধ্যে বেশির ভাগকেই কিন্তু জীবনের মঞ্চে খুঁজে পাওয়া যায় না৷ জীবনের বড়-বড় পরীক্ষাতেও ওপরে উঠে আসে এই মাঝামাঝিদের ভিড়ের ভেতর থেকেই, কেউ-কেউ৷ যারা ননডেসক্রিপ্ট৷ ‘জনতা’ বলি আমরা যাদের৷’’ বলেই বললেন, ‘‘চল, ফিরি এবার৷’’

    বাবা গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট করবার পর আমি বললাম, ‘‘আমি যে এত খারাপ করলাম, তুমি দুঃখ পাওনি? মা খুব কেঁদেছে৷’’

    বাবা হেসে বললেন, ‘‘তোর মা একটুতেই কাঁদেন৷ কাঁদলে চোখের মণি উজ্জ্বল হয় কিনা! তাই তোর মা কথায়-কথায় কাঁদেন৷ যাঁরা সুন্দর মানুষ তাঁরাও ওরকম অনেক কিছু করেন আরও সুন্দর হওয়ার জন্যে৷’’

    আমার কথার উত্তর দিলে না তুমি বাবা?

    আমি? না না, দুঃখ পাইনি৷ তবে অবাক হয়েছি৷ রেগে গেছি৷ সেটা তোর ওপরে নয়৷ আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপরে৷ তোর মাস্টারমশাই অক্ষয়বাবুর ওপরে৷ আমার নিজেরও ওপরে৷ আমার উচিত ছিল, তোকে একটা ভালো ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া৷ আমার পক্ষে মোটেই তা অসুবিধের ছিল না৷ কিন্তু আমি চেয়েছিলাম যে আমার দেশের লক্ষ-লক্ষ ছেলেমেয়ে যে শিক্ষার সুযোগ পায়, আমার ছেলেই বা তাদের থেকে বেশি সুযোগ পাবে কেন? তা ছাড়া বাংলা তো আমাদের মাতৃভাষাই৷ বেশির ভাগ ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলেই বাঙালিদের সংস্কৃতি, সাহিত্য, গানবাজনা পরোক্ষে নষ্ট করে দেওয়া হয়৷ তুইও তেমন হয়ে উঠিস, তা আমি চাইনি…চেয়েছিলাম বাঙালি হবি৷

    আমি আসলে বাজে ছেলে৷ আমার কিছুই হবে না৷ স্কুল ফাইনালেই যে খারাপ করল, তার কাছে তো জীবনের সব দরজাই বন্ধ৷ এই পরীক্ষাই তো প্রবেশিকা৷

    হাঃ হাঃ করে হাসলেন বাবা৷ বললেন, তোর নিজের কাছেও কি বন্ধ? আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটা তোতাপাখির শিক্ষা৷ এখানের অধিকাংশ পণ্ডিতদেরই শিক্ষার গুমোর আছে, দম্ভ আছে, প্রকৃত শিক্ষা নেই৷ তা ছাড়া শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে গেছে টাকা রোজগার৷ টাকা যাতে রোজগার করতে পারে, যেসব লাইনে বেশি টাকা আছে, সেইসব লাইনেই ভিড়৷ আমি চাই না তুই তেমন শিক্ষিত হোস, চাই না যে তুই টাকার অংকের সঙ্গে মনের জীবনযাত্রার সঙ্গে, শিক্ষাকে গুলিয়ে ফেলিস৷ সত্যিই আমি চাই না৷ আমাদের দেশে টাকাওয়ালারা কোনোদিন সম্মান পায়নি৷ পাওয়া উচিতও ছিল না৷ আজ যে পাচ্ছে, তা এই ফালতু শিক্ষার ভুল-চাহিদার দোষেই৷ সরস্বতীর সাঁকো বেয়ে লক্ষ্মীর দরজায় পৌঁছতে চাইছে প্রত্যেকেই৷ আর লক্ষ্মী যেখানে থাকেন, সরস্বতী সেখান থেকে অভিমানে সরে আসেন৷ আমি কিছু মনে করিনি রে, খোকন৷ তুই আমার ভারি ভালো ছেলে৷ জীবনে ভালো হোস৷ মানুষ হোস, সত্যিকারের শিক্ষিত হোস, ডিগ্রি অনেক নাই-ই বা পেলি৷ আমি তো আর চিরদিন বাঁচব না৷ তোকে এই আশীর্বাদই করে গেলাম৷ তা ছাড়া আমি নিজে তো কখনও তেমন মেধাবী ছিলাম না৷ তোর কাছ থেকে আমার প্রত্যাশাটা অন্যায়৷ এক জেনারেশানে হয় না৷ মেধাবী যারা, তাদের মা-বাবা ঠার্কুদা-দাদু তাঁরাও বোধহয় মেধাবীই হন৷

    ৪

    কলকাতায় এসেছিলাম পুজোর সময়৷ পরশু দিল্লি ফিরে যাব৷ আমার একমাত্র ছেলে খোকা এবার দিল্লি বোর্ডের পরীক্ষা দিল৷ আমি তো ভালো ছাত্র ছিলাম না৷ খোকাও পড়াশোনাতে মাঝামাঝিই হয়েছে৷ ও অভিনেতা হতে চায়৷ গ্রুপ থিয়েটারের দলে ঢুকেছে৷ টিভি-ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করবার ইচ্ছে আছে৷ আস্ত পাগল৷

    অনেকগুলো বছর চলে গেছে৷ সত্যি অনেকই বছর৷ আজ মা নেই, বাবাও নেই৷ দক্ষিণ কলকাতার বাড়িও রামকৃষ্ণ মিশনে দিয়ে দিয়েছি আমি৷ দিল্লিতে থাকি এখন৷ আজ কুড়ি বছর হয়ে গেল৷ আমার স্টুডিও করেছি ভাড়া বাড়িতে, দিল্লির বাঙালিপাড়া চিত্তরঞ্জন পার্কে৷ ছবি আঁকি, মূর্তি গড়ি৷ প্রদর্শনী এবং এমনিতে কিছু-কিছ বিক্রি হয়৷ বড়লোক হতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু বাঙালিরা আমাকে চেনেন৷ দিল্লির বাঙালিরা তো বটেই, ভারতবর্ষ এবং বিদেশের বাঙালিরাও৷ তাতে আমার কোনো গর্ব নেই৷ আনন্দ আছে৷ পয়সার লোভে সকলেই যা করে চারপাশে, যা চায়, তাদের অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে নিজস্বতাকে এখনও খুইয়ে বসিনি যে, এইটেই আনন্দের৷ বাবার শিক্ষার অমর্যাদা করিনি আমি৷ আজকের দিনে এটা সম্ভব হত না, যদি-না শ্রাবণী আমাকে সাপোর্ট করত৷ স্ত্রীদের উপরে স্বামীদের জীবন, জীবনের গন্তব্য অনেকখানিই নির্ভর করে৷ বাড়িটার দাম পেয়েছিলাম পাঁচ লাখ৷ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব অনেকেই বলেছিল, যে নিজের সংসার চলে না, অত দাতাগিরিতে কাজ নেই৷ শ্রাবণী কিন্তু বলেছিল, মা-বাবাই যখন নেই, তখন যা আমাদের স্বোপার্জিত নয়, তা দিয়ে সহজ সুখ চাই না আমি৷ বড়লোকের ছেলে হলে খোকাও মানুষ হবে না৷ অত্যন্ত কষ্টকর হলেও বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান, বাংলায় যা কিছু ভালো তার সঙ্গে যোগাযোগ প্রবাসে বসে আমরা এখনও রেখে চলি৷ এই মাঝামাঝি মিডিওকার মধ্যবিত্ত বাঙালিরাই এখনও বাঙালির যা-কিছু ভালো তা প্রাণান্তকর কষ্টেই ধরে রেখেছেন বলে মনে হয় আমার৷ বিত্তবান বাঙালিদের অধিকাংশই বাঙালিত্বকে অসম্মান করেন, ছোট চোখে দ্যাখেন৷

    কলকাতায় এসে এবার উঠেছি আমার শ্যালকের বাড়িতে৷ খোকা আর শ্রাবণী কলকাতার পুজো দেখতে চেয়েছিল, তাই৷ ভাইফোঁটার পরই ফিরে যাব আবার দিল্লিতে৷

    আমাদের স্কুলের উলটো দিকের পার্কে ছেলেবেলায় কত ফুটবল-ক্রিকেট খেলেছি৷ বন্ধুদের সঙ্গে কত গল্প মজা৷ আজ তাই প্রথম বিকেলে একটা মিনিবাস ধরে এসেছি এখানে৷ একজন কিশোরের চোখে এই পার্কটিকেই কত বড় বলে মনে হত৷ ছোট-ছোট পায়ে এটি পার হতে হতে মনে করতাম, তেপান্তরের মাঠই পেরোলাম বুঝি! আজ পার্কে ঢুকেই মনে হল, পার্কটি খুবই ছোট৷ গাছগুলি উধাও হয়ে গেছে৷ ভিড়, বড় ভিড়৷ ধুলো৷ ছেলেবেলার সেই চোখ দুটিও তো হারিয়ে গেছে৷

    মন যদিও খারাপ হয়ে গেল, তবু ভাবলাম, কয়েকটি পাক হেঁটেই যাই পার্কের চারপাশের পিচ-বাঁধানো রাস্তায়৷

    আধ পাক যেতেই মনে হল যেন একটা বেঞ্চে লাঠি-হাতে অক্ষয়-স্যার বসে আছেন৷ ঠিক দেখলাম কি? তাঁর সামনে দিয়েই চলে গেলাম৷ ঠিকই চিনেছি৷ অক্ষয়-স্যারই৷ গোঁফচুল সব পেকে সাদা হয়ে গেছে৷ মাথায় বাঁদুরে-টুপি, হাতে লাঠি৷ মুখে পৃথিবীর সব বিতৃষ্ণা, কষ্ট৷ খারাপ ছাত্র পড়ানোর কষ্ট নয়, বার্ধক্যের জরার কষ্ট৷ গায়ে একটি নস্যি-রঙা ছেঁড়া আলোয়ান৷ আমাকে চিনতেও পারলেন না৷ না পারারই কথা৷ আমার মতো কত খারাপ ছাত্রকেই তো তিনি পড়িয়েছেন৷ খুব ভালো আর খুব খারাপ ছাত্রদেরই স্যারেরা শুধু মনে রাখেন৷ মাঝামাঝিরা হারিয়েই যায় তাঁদের স্মৃতিতে৷ ‘বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসে বিদ্যামঠতলে, চলে যায়, তারা কলরবে, কৈশোরের কিশলয়, পর্ণে পরিণত হয়, যৌবনের শ্যামল গৌরবে৷’ কালিদাস রায়ের বিখ্যাত কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল অক্ষয়-স্যারের চোখের ঝাপসা দৃষ্টি দেখে৷ ওঁকে পেরিয়ে এসেই নতুন করে মনে পড়ল যে, অক্ষয়-স্যারের মতো এতখানি অপমান আমাকে জীবনে আর কেউই করেননি৷ তাঁর প্রতি আমার বিদ্বেষ ছিল না৷ কিন্তু বুঝলাম গভীর এক উদাসীনতা জন্মে গেছে এক ধরনের৷ বহু বছরের দূরত্ব তা গাঢ় করেছে আরও৷

    আরও এক পাক ঘুরে আসার পর ওঁর সামনে দাঁড়ালাম আমি৷ অক্ষয়-স্যারের মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটল না৷ প্রণাম করে বললাম, কেমন আছেন স্যার?

    ভালো নয়, ভালো নয়৷ কিন্তু চিনতে পারলাম না তো তোমাকে? কে?

    আমি সিদ্ধার্থ স্যার৷ দক্ষিণ কলকাতায় থাকতাম৷ অংক…৷

    ও বুঝেছি, বুঝেছি৷ তা কী করছ এখন তুমি সিদ্ধার্থ?

    ছবি আঁকি স্যার৷ মূর্তি গড়ি৷

    পেট চলে তাতে? আর্টিস্টরা তো না খেয়েই থাকে শুনি৷

    কোনোক্রমে চলে যায় স্যার৷

    তা ভালোই করেছ৷ অংক তোমার লাইন ছিল না৷ অংকে মাথা লাগে৷ অংক…

    জানি৷ একটু চুপ করে থেকে বললাম, গোপেনদা কী করছেন স্যার?

    মানে, আমার ছেলে গোপেনের কথা বলছ?

    হ্যাঁ৷

    ও? অক্ষয়-স্যারের ম্লান, করুণ, কাতর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ বললেন, গোপেন তো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল৷ জানো তো? ম্যাথমেটিক্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল৷ তারপর চলে গেল নতুন করে ফিজিক্সের লাইনে৷ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স৷ এখন আমেরিকার হিউস্টনে আছে৷ আরে, নেভাদার মরুভূমিতে যে বোমা ফাটাল সেদিন আমেরিকা, সে তো তার একারই হাতে গড়া!

    এমন করে বললেন, অক্ষয়-স্যার, যেন উড়নতুবড়ি বানানোর কথাই বলছেন৷ গোপেনদা যেন একা হাতে মশলা আর লোহাচুর ভরে উড়নতুবড়িই বানিয়েছেন একটা৷ আলোর ছটার জন্যে নয়, পৃথিবীর যা-কিছু ভালো, সব ফুল, পাখি, প্রজাপতি, অরণ্য, মানুষ সব-কিছুকেই ধ্বংস করার জন্যে৷

    দারুণ আছে৷ বুঝলে হে৷ বিরাট বাড়ি৷ ক্যাডিলাক লিমুজিন গাড়ি৷ আমেরিকান মেয়ে বিয়ে করেছে৷ কী ফুটফুটে মেমসাহেব! নাতি-নাতনিরাও সব ফুটফুটে৷ পাক্কা সাহেব৷ বাংলা বলতেই পারে না৷

    গর্ব ঝরল অক্ষয়-স্যারের কথায় বসনতুবড়ির ঝরনার মতো৷

    আপনি যাননি? ওঁরা আসেন না?

    কী যে বলো! আমার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের বাড়িতে ইন্ডিয়ান বাথরুম৷ পায়রার খোপের মতো দু’খানা ঘর৷ জঞ্জালে ভরা৷ ওখানে ওরা থাকবে কী করে? তুমি যেমন অংকে গবেট ছিলে, ও ছিল তেমনই সত্যিই ব্রিলিয়ান্ট৷ জানো তো স্কুল-ফাইনালে স্টার পেয়েছিল৷ অংক, সংস্কৃত আর ভূগোলে লেটার পেয়েছিল৷ ইতিহাসেও৷

    আপনি এখনও কি পড়ান স্যার? আর মাসিমা মানে, গোপেনদার মা কেমন আছেন?

    ‘‘উনি গত হয়েছেন পাঁচ বছর হল৷’’

    একমাত্র ছেলের প্রশংসাতে উজ্জ্বল মুখ হঠাৎই নিভে গেল অক্ষয়-স্যারের৷ বললেন, ‘‘বড় কষ্ট পেয়ে, বিনা শুশ্রূষাতে, বিনা চিকিৎসাতেই প্রায় চলে গেলেন৷ আমিও তো পা বাড়িয়েই আছি, বুঝলে৷ টিকিট কাটা হয়ে গেছে৷ শুধু বার্থটাই রিজার্ভেশন হয়নি৷ বাত, হাঁপানি, দুটো হার্ট অ্যাটাক! আছি কোনোরকমে৷ একে থাকা বলে না৷’’

    তা হলে এখন আর ট্যুইশানি করেন না? স্কুল থেকে তো নিশ্চয়ই বহু বছর রিটায়ার করেছেন?

    ‘‘পঁচিশ বছর৷ ট্যুইশানি, তা করি, নিশ্চয়ই করি৷ নইলে চালাচ্ছি কী করে? কেন তোমার ছেলেও বুঝি তোমারই মতো অংকে কাঁচা?’’

    আমি হাসলাম৷ কষ্ট হল অক্ষয়-স্যারের জন্যে৷

    উনি বললেন, এখন থাকো কোথায়? ওই বাড়িতে তো অন্যরা থাকেন৷ ওই পাড়াতে আমার একটি ট্যুইশানি ছিল৷ তাই জানি৷ তুমিই বলো, সকালে অথবা দুপুরে আমি নিশ্চয়ই গিয়ে পড়াব যত্ন করে৷ রাতে আর কোথাও যাই না৷ ছেলের চেয়েও যেমন নাতি আদরের, ছাত্রের চেয়ে ছাত্রের ছেলেও তেমনই!

    তা এই বয়সেও এত কষ্ট করেন কেন, গোপেনদা এত বড় এবং বড়লোক হয়েছেন৷ আপনাকে প্রতি মাসে টাকা পাঠান তো নিশ্চয়ই৷ এসব তো ছেড়ে দিলেই পারেন৷ এই শরীরে৷ আর কতদিন কষ্ট করবেন?

    একটু চুপ করে থেকে অক্ষয়-স্যার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, অভাব আমার কিছুই নেই৷ তবে একেবারে বসে গেলে শরীরটা আর চলবে না৷ তাই-ই চালিয়ে যাচ্ছি টুকটুক করে৷

    আচ্ছা চলি স্যার৷

    তোমার ছেলে? পড়বে না সে আমার কাছে?

    অংক ও পড়বে না স্যার৷ অভিনয় করবে বলছে৷

    অক্ষয়-স্যারের মুখটি, আমার অংক দেখে যেমন বিকৃত হয়ে যেত তিরিশ বছর আগে, তেমনই বিকৃত হয়ে গেল৷ বললেন, লাইক ফাদার লাইক সান৷ ও তো তোমারই মতো গাধা হয়েছে তা হলে৷ অংকে গবেট?

    হেসে বললাম, তাই৷

    সন্ধে হয়ে এল৷ আলো জ্বলে উঠেছে৷ পার্ক থেকে বেরিয়ে আসছি, এমন সময়ে আমার স্কুলের বন্ধু রাজেনের সঙ্গে দেখা৷ চিনতেই পারিনি৷ বুড়ো হয়ে গেছে৷ সিনেমায় নামবে বলে বাবার আলমারি ভেঙে টাকা নিয়ে এই রাজেনই বোম্বে যাচ্ছিল৷ পুলিশ ধরে আনার পর স্কুল থেকে রাস্টিকেট করে দিয়েছিল ওকে৷ ওর নাম ধরে ডাকতেই, আমার নাম বলতেই, বুকে জড়িয়ে ধরল রাজেন৷ বলল, কী রে সিদু? কীরকম বুড়ো মেরে গেছিস তুই৷

    আর তুই কি কচি আছিস নাকি? টেকো-বুড়ো৷ আমি বললাম৷

    হেসে ও বলল, চল, চল, আমার দোকানে৷ বিকেলে একটু হাঁটতে বলেছেন ডাক্তার৷ দোকানে বসে-বসে ডায়াবিটিসে ধরেছে বুঝলি৷ চল, চল, দোকানের পর আমার বাড়িতে৷ সীমা কত্ত খুশি হবে৷ বাড়ির একতলাতেই তো দোকান৷

    কীসের দোকান?

    আবার কীসের? স্টেশনারি দোকান দিয়েছি বাড়ির একতলাতে৷ আমি আর কী করব? সংসার তো চালাতে হবে৷

    মেসোমশাই কেমন আছেন?

    বাবা নেই৷ অনেক চেষ্টা করলাম রে৷ সব সঞ্চয়, মায়ের, এমনকী সীমারও সব গয়না, আমার স্কুটারটা পর্যন্ত বিক্রি করেও তবু বাঁচাতে পারলাম না৷

    কী হয়েছিল?

    ক্যান্সার৷

    মাসিমা কেমন আছেন?

    বুড়ো হয়ে গেছেন৷ কিন্তু ভালোই আছেন৷ চল, চল, তোকে দেখে কত্ত খুশি হবেন৷ তুই বিজয়ার পর মায়ের হাতের কুচোনিমকি আর নারকোলের নাড়ু খেতে ভালোবাসতিস৷ চল, এখনও কিছু আছে৷ আজকাল বিজয়া-টিজয়া তো উঠেই গেছে৷ আমেরিকান হয়ে গেছি আমরা৷ কী বলব তোকে, এই শ্রীমান রাজেন দাসের একমাত্র ছেলেও ইংরেজি গান আর ইংরেজি বই ছাড়া পড়ে না৷ ইংরেজি নাচ নাচে৷

    কী করছে ও?

    চোরের ছেলে আর কী করবে? ডাকাত-টাকাত হবে হয়তো৷ এখন কবিতা লিখছে৷ বাবা তো লক্ষপতি৷ লিটল-ম্যাগ আন্দোলনে শামিল হয়েছে ছেলে৷

    আরে হোক হোক৷ ওর জীবন ওর৷ বাধা দিস না৷ আমি বললাম৷

    দোকানেই আগে নিয়ে গেল রাজেন৷ খুব মজা লাগল দেখে যে, বোম্বের বৈজয়ন্তীমালার বিরাট একটি ছবি টাঙানো আছে দোকানের দেওয়ালে৷ তাতে চন্দন-টন্দনের ফোঁটা দেওয়া৷

    বললাম, এ কী রে? যাকে বিয়ে করবি বলে পালিয়েছিলি!

    রাজেন হেসে বলল, কী বলিস তুই? যার জন্যে পুলিশের ঠ্যাঙানি খেয়ে বুকের হাড় ভাঙল, চোর বদনাম হল, তাকে কি ফেলে দিতে পারি? বাবা-মাকে যেমন ফেলে দেওয়া যায় না, একেও তেমনই৷

    বলে, নিজেই হো-হো করে হেসে উঠল৷

    রাজেনের মা খুবই খুশি হলেন৷ রাজেনের বউ সীমা বলল, ‘‘আপনাকে আজ না খেয়ে যেতেই দেব না৷ যা রান্না হয়েছে গরিবের বাড়ি, তাই খেয়ে যেতে হবে৷ এত বড় আর্টিস্ট আমাদের বাড়ি এসেছেন৷ আপনাকে কখনও চোখে না দেখলেও আমার স্বামীর বন্ধু বলেই কত্ত মানুষের কাছে গর্ব করি৷ আপনার গর্বে আপনার বন্ধুর তো মাটিতে পাই পড়ে না৷’’

    বলেই বললে, ‘‘দোকানঘরের দেওয়ালগুলো দেখে এসেছেন তো?’’

    হেসে বললাম, দেখিনি আবার!

    সীমা হেসে গড়িয়ে বলল, ফোটোর সতিনকে নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই, আমিও ফুলটুল দিই মাঝেমধ্যে৷

    অক্ষয়-স্যারের সঙ্গে দেখা হল রে, বুঝলি রাজেন৷ আমি বললাম রাজেনকে৷

    তাই? আমার সঙ্গে তো রোজই হয়৷ দোকানেও বলে রেখেছি যে, রোজকার পাঁউরুটি যেন বিনে পয়সায় দিয়ে দেয় ওঁকে৷ গুরু-ঋণ বলে কথা! রাস্টিকেটেড ছাত্রই হই আর যাইই হই! কী কানমলাই না দিতেন! মনে আছে? ও তুই তো আমার চেয়ে অনেক ভালো ছিলি অংকে৷ বাঁ কানটা চিরদিনের মতো হাফ-কালা হয়ে গেছে রে৷ একেবারে রগে রগে ঘষাঘষি করতেন অক্ষয়-স্যার৷

    গোপেনদা কিন্তু দারুণ ভালো ছিল৷ স্যারের কাছে শুনলাম যে, বিরাট নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট হয়েছেন আমেরিকায়…আমি বললাম৷

    তা তো হয়েছেন! কিন্তু মা মারা গেলেন বিনা চিকিৎসায়৷ বিনা ওষুধে৷ অংকে দারুণ খারাপ ছেলে পাঁউরুটি দান করে বুড়ো বাবাকে তার বাঁচিয়ে রেখেছে৷ অমন ভালোর দাম কী বলতে পারিস? একটা টাকাও পাঠায়নি বিদেশ যাওয়ার পর থেকে৷ একবারও আসেনি৷

    অক্ষয়-স্যারের ট্যুইশানি তো আছে এখনও কয়েকটা?

    ছাড় তো! ট্যুইশানি৷ এখনকার দিনে কি আর তৈলাক্ত বাঁশে বাঁদরের ওঠার অংক করতে হয়? না শুভংকরী মুখস্থ করতে হয়, কে পড়বে ওঁর কাছে৷ এখন অংককে অংক বলে না৷ বলে ‘ম্যাথস’৷ সীমাকেই জিজ্ঞেস কর না৷ স্যার পটকে যখনই যান, তখন শুশ্রূষা করে সীমাই, ফ্লাস্কে করে পথ্য নিয়ে গিয়ে৷ যত ঝামেলা এই রাস্টিকেটেড ছাত্ররই৷ সত্যি! যাকগে, আমি যেমন ছাত্র ছিলাম আমার ছেলেমেয়ে তার তুলনায় অনেকই ভালো৷ এইই স্যাটিসফ্যাকশান!

    মাসিমার হাতে বানানো কুচোনিমকি, আর নারকোল নাড়ু, সীমার রান্না লুচি-বেগুনভাজা, কুমড়োর ছেঁচকি আর ডিমের ঝোল খেয়ে যখন প্রায় দশটা নাগাদ রাজেনের সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে এলাম, তখন ভারী ভালো লাগছিল৷ অংকে আমরা কেউই যে ভালো ছিলাম না, এটা মনে করে সত্যিই আনন্দ হচ্ছিল৷

    রাজেনকে বললাম, সীমাকেও বলে এসেছি, আগামী শীতে সব্বাইকে নিয়ে দিল্লি আয়৷ মাসিমাকেও নিয়ে আসিস৷ একটু অসুবিধে হলেও তোদের আনন্দ হবে খুব৷

    রাজেন বলল, খুব চেষ্টা করব৷ কী বলব তোকে, বিয়ের পর সীমাকে একবার দিঘা ছাড়া আর কোথাওই নিয়ে যেতে পারিনি৷ কত্ত যে ঝামেলা৷ আর রোজগার তো লবডঙ্কা!

    বললাম, ‘‘থ্রি-টায়ারে করে চলে আয়৷ স্টেশনে তোদের রিসিভ করার পর থেকে সব দায়িত্ব আমার৷’’

    বাস এসে গেল৷ বললাম, চলি রে৷

    শীত কিছুই পড়েনি৷ তবে কলকাতার মানুষেরা তো ক্যালেন্ডার দেখে গরম জামা পরেন৷ তা ছাড়া ধোঁয়াশা আর ডিজেলের ধোঁয়ার কলকাতাকে এখন মনে হচ্ছে শীতের লন্ডন৷ দু-বছর আগে এগজিবিশন নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে৷ তাই জানি৷

    পরের স্টপে ঠিক অক্ষয়-স্যারের মতো এক ভদ্রলোক উঠলেন৷ মাথায় বাঁদুরে টুপি৷ হাতে লাঠি৷ তবে বয়স অত হয়নি৷ বাস হঠাৎ ছেড়ে দিতেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন৷ উঠে দাঁড়িয়ে ওঁকে আমার সিটে বসালাম৷

    উনি মুখে কিছু বললেন না৷ কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালেন৷

    তোতাপাখির ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ আমার দেশের ঐতিহ্য নয়৷ আমরা চোখ দিয়েই অনেক জরুরি কথা অনেক বেশি গভীরভাবে চিরদিনই বলে এসেছি৷ ওই বৃদ্ধও তাই করলেন৷

    আমি বেঁটে লোক৷ মিনিবাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না৷ কলকাতার পাবলিক বাসে দিল্লির পাবলিক বাসের চেয়ে অনেক কম ভিড়৷ দিল্লি হচ্ছে বড়লোক চাকুরে আর ব্যবসাদারদের সুখের জায়গা৷ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের বিস্তরই অসুবিধে সেখানে৷ ভাবছিলাম, বাড়িটা দান করে দেওয়া বোধহয় ঠিক হয়নি৷ কলকাতাতে থাকলেই হত৷ বাঙালি মধ্যবিত্তের পক্ষে এখনও কলকাতার মতো নিরাপদ ও সুখের জায়গা আর নেই৷

    কন্ডাকটারকে একজন যাত্রী বললেন, এটা কী হল দাদা? অংকটা কীরকম হল? দিলুম পাঁচ টাকার নোট, যাব শ্যালদা, আর ফেরত দিলেন এই? অংকের জ্ঞানটা একটু ভালো করুন৷

    অক্ষয়-স্যারের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার৷ নস্যি নিয়ে, অংক কষিয়ে, ছাত্রদের কান মলে, গালাগালি করে, প্রত্যেককে অংক-বিশারদ করতেই কাটিয়ে দিলেন সারাটা জীবন মানুষটি৷

    কিন্তু নিজের জীবনের অংকটাই, একটা মাত্র অংক, অতি সাদামাটা অংক, তাও মিলল না৷

    —

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবনবিবির বনে – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article জংলিমহল – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }