Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ১.৩৫ লক্ষ্মীপুজোর পর থেকে

    লক্ষ্মীপুজোর পর থেকেই রাজদিয়ায় ভাটার টান ধরেছে। যে প্রবাসী সন্তানেরা কয়েক দিনের জন্য এসে শহর সরগরম করে তুলেছিল একে একে স্টিমারে করে তারা চলে যেতে লাগল। কেউ গেল আসামে, কেউ বার্মায়, তবে অধিকাংশরই গন্তব্য কলকাতা।

    এর মধ্যে একদিন শিশিররা এলেন। সবাই এসেছেন–শিশির স্মৃতিরেখা রুমা ঝুমা আনন্দ।

    খানিক এ গল্প সে গল্পের পর শিশির বললেন, আমরা কাল চলে যাচ্ছি জ্যাঠাইমা—

    স্নেহলতা বললেন, কালই যাবি?

    হ্যাঁ।

    এক বছর পর তো এলি। কটা দিনই বা বাড়িতে থাকলি!

    কী করব! সরকারি চাকরি, যেতেই হবে। ছুটিও আর নেই। নিয়মমতো দশমী পর্যন্ত ছুটি, তার পরও এ কদিন থেকে গেলাম। আর থাকলে চাকরিটা যাবে।

    শিশিররা কথা বলছিলেন। শুনতে শুনতে হঠাৎ বিনুর চোখে পড়ল, আনন্দ সুনীতিকে কী যেন ইশারা করছে।

    একটু পর সুনীতি বেরিয়ে বাগানের দিকে গেল। তার কিছুক্ষণ পর আনন্দও বেরিয়ে পড়ল। উঠোনে খানিক ঘোরাঘুরি করে সেও বাগানের রাস্তা ধরল।

    বিনু আর বসে থাকতে পারল না। বিচিত্র এক কৌতূহল যেন তাকে ঘিরে ধরছিল। একসময় সেও উঠে পড়ল।

    আশ্বিন মাসের শেষ তারিখে ছিল লক্ষ্মীপুজো। লক্ষ্মী ভাসানের দিন থেকে কার্তিক মাস পড়েছে। আজ তেসরা কার্তিক।

    সবে কার্তিকের শুরু, এরই মধ্যে বিকেলের হাওয়ায় হিমের ছোঁয়া টের পাওয়া যায়। রোদের রংও গেছে বদলে। শিউলি ফুলের বোঁটার মতো উজ্জ্বল হলদে আভা আর তাতে নেই, বাসি হলুদের মতো তা মলিন।

    বাগানে এসে বিনু দেখতে পেল, সূর্যটা রক্তিম গোলকের মতো পশ্চিম আকাশের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে অনেকখানি নেমে গেছে। বাগানের ভেতর এখন ঘন ছায়া। মাথার ওপর ডালপালা আর পাতার দোয়া, তার ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো রোদ এসে হাওয়ায় দুলছে।

    এই তত বিকেল হল। এরই ভেতর পাখিরা ফিরে আসতে শুরু করেছে। কেউ সারাদিন আকাশে সাঁতার কেটেছে, কেউ মাঠে মাঠে শস্যকণা খুঁজেছে। ক্লান্ত পাখিরা এখন বাগানের গাছে গাছে তাদের সাধের বাসায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে, কিচিরমিচির করছে। চেঁচামেচিতে চারদিক মুখর।

    বাগানে এসে বিনু পাখিদের দিকে তাকল না, অনুজ্জ্বল মলিন রোদ লক্ষ করল না, হিমেল হাওয়ার কথা ভাবল না। সে শুধু চনমন চোখে চারদিকে খুঁজতে লাগল। এইটুকু সময়ের ভেতর আনন্দ আর সুনীতি গেল কোথায়?

    বেশিক্ষণ খোঁজাখুঁজি করতে হল না। উত্তর দিকে যে বেতবন রয়েছে তার গায়ে ঝাঁকড়া-মাথা একটা পিটক্ষীরা গাছ। গাছটার অনেকগুলো মোটা মোটা শেকড় মাটির ওপর ছড়িয়ে আছে। দুটো শেকড়ে মুখোমুখি বসে রয়েছে সুনীতি আর আনন্দ।

    জায়গাটা আড়াল মত। পা টিপে টিপে বিনু পিটক্ষীরা গাছটার কাছে চলে এল। এমনভাবে দাঁড়াল যাতে সুনীতিরা তাকে দেখতে না পায়।

    আনন্দ বলছিল, কালই আমরা চলে যাচ্ছি।

    মৃদু আধফোঁটা গলায় সুনীতি বলল, সে তো শুনলাম। আপনার জামাইবাবু তখন বললেন।

    আনন্দ বলল, তুমি কিছু বলবে না?

    দূরে দাঁড়িয়ে বিনু অবাক। আনন্দ তো বড়দিকে আপনি’ বলত, সম্ভাষণের ভাষাটা কবে থেকে বদলে গেল কে জানে।

    সুনীতি আগের স্বরেই বলল, আমি কী বলব?

    বা রে, চলে যাচ্ছি। ভালমন্দ কিছু বলবে না?

    সুনীতি উত্তর দিল না।

    একটু ভেবে আনন্দ বলল, আবার কবে দেখা হবে?

    সুনীতি বলল, তা কী করে বলি—

    তোমরা কলকাতায় যাচ্ছ কবে?

    বলতে পারছি না।

    তবু?

    পুজোর ছুটি শেষ না হলে দাদু বোধহয় যেতে দেবেন না।

    কোন পুজোর ছুটি? স্কুল-কলেজের, না অফিস-টফিসের?

    স্কুল-কলেজের।

    ঈষৎ হতাশার সুরে আনন্দ বলল, ওরে বাবা, সে তো এখনও অনেক দিন! সেই ভাইফোঁটার পর শেষ হবে।

    সুনীতি আস্তে ঘাড় কাত করল।

    ততদিন তা হলে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই?

    তাই তো মনে হচ্ছে।

    একটু নীরবতা। তারপর আনন্দ বলল, আমার খুব খারাপ লাগছে, খুব খারাপ।

    মৃদু কণ্ঠস্বরে সুনীতি বলল, আমারও খুব ভাল লাগছে না।

    তোমরা কিন্তু স্বচ্ছন্দে কালই আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যেতে পারতে।

    ও ব্যাপারে আমার কোনও হাত নেই।

    চিন্তাগ্রস্তের মতো আনন্দ বলল, তা বটে।

    সুনীতি কিছু বলল না।

    আনন্দ আবার বলল, তোমাদের কলকাতার ঠিকানা কী?

    সুনীতি ঠিকানা জানিয়ে দিল।

    আনন্দ বলল, ঠিকানা নিলাম, তোমাদের বাড়ি কিন্তু যাব।

    নিশ্চয়ই আসবেন।

    কেউ কিছু মনে করবে না তো?

    কারোর মনে করাকরিতে আপনার কিছু যাবে আসবে?

    তার মানে?

    সুনীতি লীলাভরে ঘাড় বাঁকিয়ে হাসল, মানে আসবেন, যখন খুশি আসবেন।

    আনন্দ বলল, সে তো অনেক দেরি। মাঝখানের এই দিনগুলো–

    কী?

    কেমন করে কাটবে?

    আমাকে দেখার আগে যেমন করে কাটত।

    উঁহু—

    কী?

    তা আর হয় না।

    চোখের তারায় কেমন করে যেন হাসল সুনীতি। বলল, কেন মশাই?

    আনন্দ বলল, বুঝতে পারছ না?

    না।

    সত্যি?

    হুঁ–

    তা হলে কারণটি বলি?

    বলতে হবে না।

    একটু চুপ। তারপর কী ভেবে আনন্দ বলল, ভাবছি কলকাতায় গিয়ে একটা কাজ করব।

    সুনীতি জিঞ্জাসু চোখে তাকাল, কী?

    আনন্দ বলল, তোমাকে রোজ একখানা করে চিঠি লিখব।

    সুনীতি চমকে উঠল, ও মা, না না– তারপর দু’হাত এবং মাথা একই সঙ্গে জোরে জোরে প্রবলবেগে নেড়ে বলতে লাগল, কিছুতেই না, কিছুতেই না। চিঠি টিঠি লিখবেন না।

    কেন লিখব না?

    সবাই কী ভাববে!

    যা সত্যি তাই ভাববে।

    না না, আমি ভারি লজ্জায় পড়ে যাব। কারোর মুখের দিকে তাকাতে পারব না। আর সুধাটা তো–

    সুধা কী?

    আমাকে একেবারে পাগল করে ছাড়বে।

    আনন্দ আর সুনীতির বাকি কথাগুলো আর শোেনা হল না। তার আগেই পাশ থেকে কে ডেকে উঠল, বিনুদা–

    চমকে পেছন ফিরতেই বিনু দেখতে পেল, ঝুমা। চোখাচোখি হতেই মেয়েটা হাসল, এখানে কী করছ?

    ইঙ্গিতে আনন্দ সুনীতিকে দেখিয়ে ঠোঁটের ওপর আঙুল রাখল বিনু। নিচু গলায় বলল, চুপ।

    ঝুমাটা ভারি চালাক। চট করে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে ফিসফিস গলায় বলল, লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের কথা শুনে কী হবে? চল আমরা ওদিকে যাই।

    আনন্দ সুনীতি এত তন্ময়, নিজেদের নিয়ে এতই মগ্ন যে বিনুদের অস্তিত্ব টের পেল না। বিনু শুধলল, ওদিকে কোথায় যাবে?

    এদিক ওদিক দেখে ঝুমা বলল, চল, পুকুরঘাটে গিয়ে বসি।

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঝুমার সঙ্গে যেতে হল। শান-বাঁধানো পুকুরঘাটে এসে জলে পা ডুবিয়ে পাশাপাশি বসল দু’জন।

    পুকুরের ওপারে ধানের খেত। এই তো সেদিন বিনুরা রাজদিয়া এল। পুরোপুরি একটা মাসও হয় নি। তখন ধানগাছগুলো সবে শিষ ছাড়তে শুরু করেছে। আর এখন, কার্তিকের এই শুরুতে? পাতা আর দেখা যায় না। ধানের মঞ্জরীতে মঞ্জরীতে চারদিক ছেয়ে গছে। সবুজ তুষের ভেতর এখন অবশ্য দুধ জমছে, একটু টিপলেই বেরিয়ে আসে। কদিন পর আর এই দুধ থাকবে না, ঘন হয়ে জমাট বেঁধে একেক দানা শস্য হয়ে যাবে–মানুষের বাঁচার আশ্বাস, তার সঞ্জীবনী।

    এখনও মাঠ জুড়ে সবুজের সমারোহ। যুগল বলেছে, কদিন পর অঘ্রাণ পড়লেই এ রং থাকবে না। ধান পেকে মাঠের ঝাপি সোনালি লাবণ্যে ভরে যাবে।

    পা দিয়ে জলে ঢেউ তুলতে তুলতে ঝুমা ডাকল, বিনুদা–

    দূর ধানখেতের দিকে তাকিয়ে বিনু আনন্দ আর সুনীতির কথা ভাবছিল। ঝুমার ডাকে অন্যমনস্কের মতো সাড়া দিল।

    ঝুমা বলল, আমার কিন্তু খুব মন কেমন করবে।

    কেন?

    কেন আবার, তোমার জন্যে।

    বিনু উত্তর দিল না।

    ঝুমা এবার বলল, সেদিন নৌকোয় করে আমরা ফুল তুলতে গিয়েছিলাম—

    হুঁ–

    তুমি কাউফল পাড়তে গিয়ে জলে ডুবে গিয়েছিলে—

    হুঁ–

    তারপর পুজোর সময় পাশাপাশি বসে থিয়েটার দেখলাম—

    হুঁ–

    মাঝরাত্তিরে নৌকো চড়ে যুগলের সঙ্গে সুজনগঞ্জে যাত্রা শুনতে যাওয়া—

    হুঁ–

    কলকাতায় গিয়ে এই সব খুব মনে পড়বে।

    বিনু কিছু বলল না, আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।

    ঝুমা বলল, তোমরা কলকাতায় যাবে না?

    বিনু বলল, যাব না মানে? ছুটির পর স্কুল খুললেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা। এখানে বসে থাকলে পরীক্ষা দেব কী করে?

    তা তো ঠিকই। তোমরা কবে যাচ্ছ?

    অক্টোবরের বাইশ তারিখে স্কুল খুলবে, তার আগেই যাব।

    কলকাতায় গেলে আমাদের বাড়ি আসবে তো?

    যাব।

    আমাদের বাড়ি হেলদার কাছে, বত্রিশ নম্বর রামকান্ত চাটুজ্যে লেন।

    বিনু কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বাড়ির ভেতর থেকে ডাক এল, কোথায় গেলি রে তোরা? এই বিনুদাদা–ঝুমাদিদি–শিগগির বাড়ি আয়–

    হেমনাথের গলা। বিনু বলল, চল, বাড়ি যাই। দাদু ডাকছে।

    যেতে যেতে ঝুমা বলল, আমাদের বাড়ি যাবার কথা মনে থাকে যেন। তুমি আবার বড় ভুলে। যাও।

    ভুলব না। তবে–

    কী?

    আমি তো একা একা অতদুর যেতে পারব না। বাবাকে বলব, না নিয়ে গেলে কিন্তু যাওয়া হবে না।

    ভুরু কুঁচকে বিনুর দিকে তাকাল ঝুমা। গলার স্বরে ধিক্কার মিশিয়ে বলল, কী ছেলে তুমি! ভবানীপুর থেকে দু’নম্বর দোতলা বাসে উঠবে, সোজা হেদায় এসে নামবে। একটু ভেবে বলল, ঠিক আছে, তোমাকে আগে যেতে হবে না। আমরাই আগে তোমাদের বাড়ি যাব।

    কার সঙ্গে যাবে?

    কার সঙ্গে? চোখের পাতা নাচাতে নাচাতে ঝুমা বলল, আমার মামার সঙ্গে। তখন শুনলে, সুনীতিদিকে মামা বলছিল, তোমাদের বাড়ি যাবে। মামা গেলেই আমি তার পিছু নেব।

    সেই ভাল।

    একটু চুপ করে থেকে ঝুমা বলল, আচ্ছা বিনুদা–

    কী?

    সুনীতিদির সঙ্গে মামার খুব ভাব, না?

    হুঁ–

    ঘাড় কাত করে ঝুমা এবার বলল, তোমার সঙ্গে আমারও খুব ভাব—

    বিনু উত্তর দিল না। আড় চোখে একবার ঝুমাকে দেখে নিল।

    বাড়ি ফিরবার পর ঝুমারা বেশিক্ষণ থাকল না। সন্ধে নামতে না নামতেই চলে গেল।

    যাবার সময় হেমনাথ বললেন, তোরা কাল দুপুরের স্টিমারে যাচ্ছিস তো?

    শিশির বললেন, হ্যাঁ।

    যদি পারি স্টিমারঘাটে যাব।

    আবার কষ্ট করে–

    কষ্ট আর কি—

    .

    দিন দুই আগে কোজাগরী পূর্ণিমা গেছে। তার রেশ এখনও রয়েছে। সন্ধের ঠিক পরেই আকাশের গা বেয়ে রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠে এল। চারদিকে-বাগানে, ধানখেতে, পুকুরের শান্ত স্থির টলটলে জলে জ্যোৎস্নার বান ডাকল। পাখিদের আর সাড়াশব্দ নেই, সারাদিনের ক্লান্তিমাখা দেহে তাদের ঘুম নেমে এসেছে। বিকেলবেলা থেমে থেমে ঝিঁঝিরা ডাকছিল, এখন আর মাঝখানে ছেদ নেই। একটানা তাদের কণ্ঠসাধনা চলছে।

    ঝুমারা খানিক আগে চলে গেছে। অবনীমোহন বললেন, বিনু ঝিনুক সুধা-সুনীতি, তোরা সব পড়তে বসে যা।

    দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় পাটি পেতে দু’খানা হোরিকেন জ্বেলে চারজনে পড়তে বসল। বিনুর দেখাদেখি হিংসেয় হিংসেয় আজকাল ঝিনুকও পড়তে বসে।

    বিনুর কাছাকাছি বসে ছিল ঝিনুক। কিছুক্ষণ পড়ার পর সবার কান বাঁচিয়ে ঝিনুক ডাকল, বিনুদাদা–

    পড়ার বই থেকে মুখ তুলল বিনু, কী বলছ?

    তখন তোমরা কী করছিলে?

    সেদিন লক্ষ্মীসরা আনতে যাবর সময় ঝিনুককে সঙ্গে নেয় নি, সে জন্য মায়ের হাতে মার খেতে হয়েছিল। সেই থেকে ঝিনুকের সঙ্গে বিশেষ কথা বলে না বিনু, মনে মনে মেয়েটার ওপর খুব রেগে আছে। নিস্পৃহ সুরে সে বলল, কখন?

    বিকেলবেলা। ঝিনুক বলতে লাগল, তুমি আর ঝুমা পুকুরঘাটে পা ডুবিয়ে বসে ছিলে, সেই তখন?

    বিনু চমকে উঠল, তুমি আমাদের দেখেছ?

    হ্যাঁ। ঝিনুক বলতে লাগল, প্রথমে সুনীতিদিদি গেল, তার পেছন পেছন গেল আনন্দদাদা। আনন্দদাদার পর তুমি গেলে তারপর ঝুমা। ঝুমার পিছু পিছু আমি গেলাম।

    অবাক বিস্ময়ে বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকল বিনু।

    ঝিনুক থামে নি, তখন তোমরা কী করছিলে, বল না?

    বিনু আস্তে করে বলল, গল্প করছিলাম।

    কী গল্প?

    সে অনেক রকম।

    হোক অনেক রকম, তুমি বল।

    বিনু বলল, অত আমার মনে নেই।

    ঝিনুক নাছোড়বান্দা, যা আছে তাই বল।

    একটু ভেবে নিয়ে বিনু বলল, ঝুমারা তো কাল কলকাতা চলে যাবে। আমরাও কদিন পর যাচ্ছি। ঝুমা বলছিল, কলকাতায় গেলে ওদের বাড়ি যেতে, ওরাও আমাদের বাড়ি আসবে। এই সব–

    হঠাৎ আলো নিবে গেলে যেমন হয়, ঝিনুকের মুখখানা নিমেষে সেই রকম মলিন হয়ে গেল। চোখ দুটি কেমন যেন ব্যথিত আর করুণ। কঁপা শিথিল গলায় সে বলল, তোমরা কলকাতায় চলে যাবে!

    বা রে, আমরা এখানে সারা জীবন থাকতে এসেছি নাকি?

    মুখখানা আরও বিষণ্ণ হয়ে গেল ঝিনুকেরা। নীলকান্ত মণির মতো চোখের তারাদু’টো জলে ডুবে যেতে লাগল।

    এই মেয়েটার জন্য কদিন আগে যে মার খেতে হয়েছিল তা আর মনে থাকল না বিনুর। ঝিনুকের জন্য হঠাৎ অত্যন্ত মমতা বোধ করল সে। গাঢ় গলায় বলল, তুমি কাঁদছ?

    ঝিনুকের চোখ থেকে পোখরাজের দানার মতো জলের বিন্দুগুলি টপ টপ করে ঝরতে লাগল। বিনুর দিকে সে আর তাকিয়ে থাকতে পারছিল না; আপনা থেকেই তার মাথাটা নিচের দিকে নেমে গেল।

    বিনু ভীষণ বিব্রত বোধ করছিল। সবার কান বাঁচিয়ে যতখানি সম্ভব চাপা গলায় বলতে লাগল, এই বোকা মেয়ে, কাঁদে না।

    ঝিনুকের কান্না থামল না। শব্দ করে সে অবশ্য কাঁদছে না, নীরবে পোখরাজের দানাগুলো বিরামহীন ঝরেই যাচ্ছে।

    বিনু আবার বলল, আরে বাপু, এক্ষুনিই তো আমরা চলে যাচ্ছি না আরও কিছুদিন থাকব।

    .

    পরের দিন দুপুরবেলা শিশিরদের বিদায় জানাবার জন্য হেমনাথ স্টিমারঘাটে গেলেন। তার সঙ্গে সুনীতি ঝিনুক আর বিনু।

    শিশিররা ততক্ষণে এসে গেছেন। তাঁদের সঙ্গে এসেছেন রামকেশব আর তার স্ত্রী, অর্থাৎ শিশিরের বাবা-মা।

    শিশিররা এখনও স্টিমারে ওঠেন নি, জেটিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শিশিরের মা খুব কাঁদছিলেন আর আঁচলে ঘন ঘন চোখ মুছছিলেন। রামকেশবের চোখদু’টিও ফোলা ফোলা, ঈষৎ আরক্ত। বোঝ যায়, গোপনে তিনিও কেঁদেছেন। দীর্ঘ এক বছরের জন্য ছেলে কলকাতায় চলে যাচ্ছে, বিদায়ের সময় কেউ আর স্থির থাকতে পারছেন না।

    শিশির-স্মৃতিরেখা রুমা, কারোর চোখই শুকনো নেই। সবাই ভারাক্রান্ত, বিষাদমলিন। রামকেশব এবং তার স্ত্রীর কান্না ওদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে।

    হেমনাথ বললেন, খুব তো কান্নাকাটি চলছে। স্টিমার ক’টায় ছাড়বে হুঁশ আছে?

    শিশির যেন সময় সম্বন্ধে এতক্ষণে সচেতন হলেন। বললেন, সোয়া বারটায়– বলেই পকেট থেকে চেনে-বাঁধা ঘড়ি বার করলেন, ইস, বারটা বাজে! আর মোটে পনের মিনিট সময় হাতে।

    হেমনাথ বললেন, বেশ মানুষ তোরা! মালপত্র স্টিমারে তুলতে হবে না? টিকিট কাটা হয়েছে?

    শিশির জানালেন, টিকিটটা কালই করে রাখা হয়েছে।

    কিসে যাচ্ছিস, ডেকে না কেবিনে?

    ডেকে।

    মালপত্র তুলবার ব্যবস্থা কর। ছেলেপুলে নিয়ে যাবি, হাত-পা ছড়িয়ে বসবার শোবার মতো খানিকটা জায়গা তো চাই। একটা রাতের মতো স্টিমারে থাকতে হবে।

    অতএব হিন্দুস্থানী কুলিদের ডাক পড়ল। মালপত্র মাথায় নিয়ে তারা স্টিমারের দিকে ছুটল। সবাইকে সঙ্গে করে হেমনাথও স্টিমারে এলেন। তার নির্দেশমতো চারদিকে বাক্স-ট্রাঙ্ক-টিফিন ক্যারিয়ার, এইসব নামিয়ে রেখে কুলিরা ডেকের অনেকখানি জায়গা দখল করে ফেলল। মাঝখানে পেতে দিল ঢালা বিছানা।

    হেমনাথ বললেন, সাবধানমতো যাবি, কলকাতায় গিয়েই পৌঁছ-সংবাদ দিয়ে চিঠি লিখবি।

    শিশির বললেন, লিখব।

    এর মধ্যে ছুটিছাটা পেলে বৌমাদের নিয়ে চলে আসবি।

    সরকারি চাকরি, ছুটিছাটা বড় কম। আসছে বছর পুজোর আগে আসার আর সম্ভাবনা নেই।

    বাড়ি আসার ব্যাপারে শিশির রামকেশব এবং হেমনাথের মধ্যে কথা হতে লাগল।

    এদিকে ঝুমা বিনুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাকল, বিনুদা—

    বিনু তার দিকে তাকাল।

    ঝুমা বলল, সেই কথাটা মনে আছে তো?

    কোনটা?

    কলকাতায় গিয়ে আমাদের বাড়ি যাবে, আমি তোমাদের বাড়ি যাব।

    মনে আছে। তুমি কিন্তু আমাদের বাড়ি আগে আসবে।

    কথায় কথায় খেয়াল ছিল না। হঠাৎ বিনুর চোখে পড়ল, একটু দূরে জলের কাছটায় স্টিমারের রেলিঙ ধরে সুনীতি আর আনন্দ খুব ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    একটু পর স্টিমারঘাট থেকে ঘন্টির শব্দ ভেসে এল। হিন্দুস্থানী কুলি আর খালাসিরা চিৎকার করে উঠল, যাঁরা স্টিমারে যাবেন না তারা যেন নেমে যান। কেননা গ্যাংওয়ে এক্ষুনি সরিয়ে নেওয়া হবে।

    হেমনাথ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, এবার আমরা নামব শিশির। সুনীতি কোথায় রে? বিনু, ঝিনুক–

    বিনুরা কাছেই ছিল। সুনীতি ছুটে এল। তারপর আরম্ভ হল প্রণাম পর্ব। শিশিররা একে একে হেমনাথ রামকেশব আর তার স্ত্রীকে প্রণাম করলেন। বিদায় নিয়ে আশীর্বাদ করে হেমনাথরা জেটিঘাটে নেমে এলেন। তারা নামবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গ্যাংওয়ে সরিয়ে নেওয়া হল। জেটি আর স্টিমারের মাঝখানে কাঠের পাটাতনের সংযোগটুকু ছিন্ন হয়ে গেল।

    তারপর দু’মিনিটও কাটল না, ভো বাজিয়ে স্টিমার ছেড়ে দিল। জলজানের দু’ধারে বড় বড় চাকা দু’টো নদী তোলপাড় করে বিপুল গর্জনে ঘুরে চলেছে, ফলে ঢেউ উঠছে পাহাড়প্রমাণ। আর তাতে চারদিকের নৌকোগুলো মোচার ভোলার মতো দুলে চলেছে।

    স্টিমারের যত যাত্রী সব এদিকের রেলিংএর কাছে ভিড় জমিয়েছে আর সমানে হাত নাড়ছে। তাদের ভেতর ঝুমাদের দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ঝুমা হাত নাড়ছিল না, রুমাল ওড়াচ্ছিল।

    ঝুমার জন্য মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেছে বিনুর। আস্তে আস্তে সেও হাত নাড়ছিল।

    প্রথম দিকে স্টিমারটার গতি ছিল রাজহাঁসের মতো মন্থর, ধীরে ধীরে তাতে দুর্দম বেগ এসে যেতে লাগল। একসময় কুমাদের নিয়ে অনেক দূরে একটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল স্টিমারটা।

    এতক্ষণ পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন শিশিরের মা। যখন আর স্টিমারটা দেখা গেল না, আচমকা জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন।

    শিশিরের মায়ের কান্না দেখতে দেখতে, হঠাৎ কেন কে জানে বিনুর মনে হল, তারা যখন রাজদিয়া থেকে চলে যাবে নদীতীরে দাঁড়িয়ে ঝিনুকও হয়তো এই রকম কাঁদবে।

    এক দিকে ঝুমা, আরেক দিকে ঝিনুক দুইয়ের মাঝখানে নিজেকে কেমন যেন মনে হয় বিনুর!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.