Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ২.১৬-২০ কাল হেমনাথ বলে গিয়েছিলেন

    ২.১৬

    কাল হেমনাথ বলে গিয়েছিলেন, বেলা থাকতে থাকতে যেন যুগলরা বাড়ি চলে যায়। কিন্তু পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেল।

    শাঁখ বাজিয়ে, উলু দিয়ে বর কনেকে ঘরে নিয়ে তুললেন স্নেহলতা। সেই ঘরখানায়, যেটা যুগলের জন্য নতুন ভোলা হয়েছিল।

    ঘরের ভেতর ঢুকে বিনু অবাক হয়ে গেল। কাল বিকেল থেকে আজকের রাত, একটা দিনের কিছু বেশি সময় সে বাড়িতে ছিল না। এর ভেতর যুগলের ঘরখানা কি চমৎকার করেই না সাজিয়ে দিয়েছেন স্নেহলতা!

    আজ কালরাত্রি। জামাই-মেয়ে এক ঘরে রাত কাটাবে না। বরণ টরণ এবং অন্য সব রীতি পালনের পর পাখিকে নিয়ে ভেতর-বাড়িতে চলে গেলেন স্নেহলতা। রাত্তিরটা সেখানেই কাটাবে পাখি, আর যুগল একা এ ঘরে থাকবে।

    আত্মীয় কুটুম্ব, নাইওরি-ঝিওরি, সবাই নতুন বউর সঙ্গে ভেতর-বাড়ি চলে গেছে। নতুন ঘরে এখন শুধু যুগল আর বিনু।

    যুগল ডাকল, ছুটোবাবু–

    কী?

    ঠাউরমা’র বিচারটা দেখলেন?

    কিসের বিচার?

    আপনেই ক’ন, বিয়ার পর বউ বিহনে রাইত কাটান যায়?

    বিনু ফস করে বলে ফেলল, একটা তো মোটে রাত। কাল থেকেই তো।

    ক্ষোভ এবং অভিমানের গলায় যুগল বলল, একটা রাইতও অহন একা একা ভালা লাগে না। একা না বোকা। আপনে অবিয়াত পোলা, আপনে এইর মম্ম বুঝবেন না।

    বিনু বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকল।

    .

    রাত পোহালেই বউ-ভাত।

    রাজদিয়ার হেন মানুষ নেই যাকে নেমন্তন্ন করেননি হেমনাথ। যুগীপাড়া-কুমোরপাড়া-তেলিপাড়া বামুনপাড়াকায়েতপাড়া, সমস্ত জায়গায় ঘুরে ঘুরে সবাইকে বলে এসেছেন। হেমনাথ বলেছেন পুরুষদের, স্নেহলতা বলে এসেছেন মেয়েদের। হেমনাথের সঙ্গে বিনুও ঘুরে ঘুরে নেমন্তন্ন করতে গেছে।

    শুধু কি রাজদিয়ার বাসিন্দাদের, এই জল-বাংলায় যত চেনাজানা মানুষ আছে সবাইকে নেমন্তন্ন করে এসেছেন হেমনাথ। বহুকাল বাড়িতে কোনও উৎসব হয় নি, যুগলের বিয়েটা উপলক্ষ করে হেমনাথ আর স্নেহলতা প্রাণভরে সাধ মিটিয়ে নিচ্ছেন।

    আজ সকাল থেকেই এ বাড়িতে মেলা বসে গেছে। কেতুগঞ্জ থেকে বাড়ির মেয়েদের নিয়ে এসেছে মজিদ মিঞা। সুজনগঞ্জ থেকে এসেছে নিত্য দাস, চন্দ্র ভূঁইমালী। কমলাঘাট থেকে এসেছে রমজান সাহেব, মালখানগর থেকে বৈকুণ্ঠ কুণ্ডু। তা ছাড়া এই রাজদিয়ার লারমোর, রামকেশব, হেডমাস্টার মোতাহার সাহেব–এঁরা তো আছেনই।

    সন্ধের পর ডে-লাইট আর হ্যাঁজাকের আলোয় বাড়িটা যেন দিনের মতো হয়ে উঠল। তখন থেকে দলে দলে অন্য নিমন্ত্রিতেরা আসতে লাগল।

    পুবের ভিটির বড় ঘরখানা সাজিয়ে গুছিয়ে সিংহাসনের মতো কারুকাজ-করা প্রকাণ্ড একটা চেয়ারে পাখিকে বসানো হয়েছে। সারা বিকেল ধরে সুধা সুনীতি তাকে সাজিয়েছে। স্নেহলতা লোহার সিন্দুক খুলে গয়নার বাক্স বার করে দিয়েছিলেন।

    পাখির পরনে লাল টুকটুকে বেনারসী। মাথায় সোনার মুকুট, কপালের কাছে গোল টিকলি, ওপর হাতে আড়াই-পেঁচি অনন্ত, নিচের দিকে গোছ গোছ চুড়ি, গলায় সীতাহার। দু’হাতে কম করে ছ’টা আংটি, কোমরে সোনার বিছে, পায়ে তোড়া।

    সব মিলিয়ে পাখিকে রাজেন্দ্রাণীর মতো দেখাচ্ছিল।

    পুবের ঘরেই সব চাইতে বেশি ভিড়। বিনু আর ঝিনুকও ওই ঘরেই আছে। স্নেহলতা-সুধা সুনীতি-সুরমা পাখিকে ঘিরে বসে আছেন।

    একেকটা দল আসছে, পাখির হাতে উপহার তুলে দিচ্ছে। পাখির হাত ঘুরে সেগুলো যাচ্ছে সুধা সুনীতির কাছে। সুধারা সেগুলো একধারে সাজিয়ে নম্বর দিয়ে খাতায় লিখে রাখছে।

    স্নেহলতা উপহারদাতাদের শুধোন, বউ কেমন দেখলে?

    উত্তর আসে, সোন্দর। কিবা রং, কিবা চৌখ, কিবা হাত-পায়ের গড়ন–

    আমার বাড়িতে মানাবে, কি বল?

    নিয্যস–

    উৎসবের ঘোর বুঝি ছোট্ট ঝিনুকের মনেও লেগেছে। ফিসফিস গলায় সে ডাকে, বিনুদাদা–

    মুখ ফিরিয়ে বিনু বলে, কী?

    বিয়ে করতে বেশ লাগে, না?

    অন্যমনস্কের মতো বিনু জবাব দেয় হুঁ—

    .

    উত্তরের ঘর, দক্ষিণের ঘর, পুবের ঘর, পশ্চিমের ঘর–সব জায়গায় নিমন্ত্রিতদের জন্য আসন পড়েছে। রাত একটু বাড়লে খাবার ডাক পড়ল।

    নিমন্ত্রিতরা সবে বসতে শুরু করেছে, সেই সময় গোলগাল ঘটের মতো চেহারার একটি লোক এসে উঠোনে দাঁড়াল। ফর্সা টুকটুকে রং তার। পরনে হাঁটু পর্যন্ত খাটো ধুতি আর ফতুয়া। কাঁধে পাট-করা ময়লা চাদর, খালি পা।

    উঠোনে পা দিয়েই সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, অতিথ আইলাম হ্যামকত্তা–

    হেমনাথ আর লারমোর কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। উদ্দেশ্য, নিমন্ত্রিতদের খাওয়াদাওয়া তদারক করা। তাদের পাশে বিনু। হেমনাথ প্রায় ছুটেই লোকটার কাছে চলে গেলেন। বললেন, এস এস চক্কোত্তি, তোমার কথাই আজ সকাল থেকে মনে পড়ছিল। আমার বাড়িতে একটা শুভ কাজ হচ্ছে, অথচ তোমারই পাত্তা নেই।

    লোকটা এক গাল হাসল, আপনে নিশ্চিন্ত থাকেন হামকত্তা। কুনো বাড়িতে কিয়াকম্ম হইলে আমি ঠিক ট্যার পইয়া যাই। আমারে ফাঁকি দ্যাওন সহজ না।

    লারমোর ওধার থেকে বলে উঠলেন, তা ঠিক। বিশ মাইল দূর থেকে তুমি লুচিভাজার গন্ধ পাও।

    লোকটা হাসতেই লাগল, তা যা কইছেন লালমোহন সায়েব।

    এদিকে লোকটাকে দেখে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেছে। সবাই উৎসুক, চকচকে চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলাবলি করছে, গদু চক্কোত্তি আসছে, গদু চক্কোত্তি আসছে। আইজ আসর জমব ভালা।

    লোকটার নাম জানা গেল–গদু চক্কোত্তি। এমন অদ্ভুত নাম আগে আর কখনও শোনেনি বিনু। তা ছাড়া, নিমন্ত্রিতদের তালিকায় গদু চক্কোত্তি ছিল না। যাদের যাদের নেমন্তন্ন করা হয়েছে তাদের বাড়িতে হেমনাথের সঙ্গে গিয়েছিল বিনু, গদু চক্কোত্তির বাড়ি সে যায় নি।

    সে যাই হোক, দেখা যাচ্ছে, সবাই গদু চক্কোত্তিকে চেনে এবং সে আসতে সকলেই ভারি খুশি।

    লারমোরের পাশ থেকে বিনু হঠাৎ বলে উঠল, লোকটা কে লালমোহন দাদু?

    লারমোর বললেন, গদু চক্কোত্তি—

    নামটা তুমি বলবার আগেই শুনেছি। কিন্তু—

    বিনুর মনের কথাটা চট করে বুঝে নিলেন লারমোর। তারপর বললেন, নাম শুনলেই চলবে না, কেমন? কোথায় থাকে, কী তার পরিচয়, এ সবও জানতে হবে, তাই না? ওর বাড়ি হচ্ছে কাজির পাগলা বলে একটা গ্রামে। এখান থেকে মাইল দশেক পুবে। আর পরিচয়? সেটা একটু পরেই টের পাবি দাদাভাই। আমি আর মুখে কতটুকু বলতে পারব।

    বিনুর খুঁতখুঁতুনি তবু গেল না। সে বলল, কিন্তু—

    আবার কী?

    আমার যদূর মনে আছে একে নেমন্তন্ন করা হয়নি।

    ওকে নেমন্তন্ন করতে হয় না।

    বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকল বিনু। বিনা নেমন্তন্নে কেউ এভাবে চলে আসতে পারে, তার কাছে এটা নিতান্তই অভাবনীয়।

    লারমোর এবার যা বুঝিয়ে বললেন, সংক্ষেপে এইরকম। এই জল-বাংলায় যত গ্রাম-গঞ্জ আছে। সব জায়গায় গদু চক্কোত্তির অবাধ গতিবিধি। এ দেশের সবাই তাকে চেনে। বিয়ে-অন্নপ্রাশন-পৈতা–যেখানে উৎসবের ব্যাপার থাকে, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার থাকে, গন্ধ শুকে শুকে গদু চক্কোত্তি ঠিক হাজির হবেই। এই জলের দেশে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে সে অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। ভালমন্দ খাওয়া ছাড়া তার আর কোনও কাজ নেই। তার কাছে বেঁচে থাকার একটিই মাত্র উদ্দেশ্য, তা হল খাওয়া। এক ভোজবাড়ি থেকে আরেক ভোজবাড়ি সারা জীবন এইভাবে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। গদু চক্কোত্তি। এই প্রাচুর্যের দেশে সে রবাহূত হয়ে এলেও কেউ অসন্তুষ্ট হয় না, বরং যথেষ্ট সমাদর করেই তাকে গ্রহণ করা হয়।

    যত শুনছিল ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিল বিনু।

    এদিকে হেমনাথ গদু চক্কোত্তিকে বলছিলেন, কি চক্কোত্তি, এখনই খেতে বসবে, না নতুন বউ দেখে, পরে–

    তাঁর কথা শেষ হবার আগেই গদু চক্কেত্তি বলে উঠল, পাত যহন পইড়াই গ্যাছে তহন বইসাই পড়ি। পরে বউ দেখুম।

    এখানেই হাত-পা ধোয়ার জল আনিয়ে দিলেন হেমনাথ। হাত-মুখ ধুয়ে একটা আসনে বসতে বসতে নিমন্ত্রিতদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল গদু চক্কোত্তি। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, একজনেরও খাওইয়ার লাখান চেহারা না। এগো তো সব বগের আধার (এরা বকের মতো সামান্য খায়) এগো লগে খাইতে বইসা সুখ নাই, নিজেরই লজ্জা। পাল্লাদার না হইলে আসর জমে না। বলতে বলতে কী মনে পড়তে চোখমুখ আলো হয়ে উঠল তার, ভালা কথা, আপনেগো এইহানে বুধাই পালের ভাই হাচাই পাল তো মন্দ খাওইয়া না। হেরে (তাকে) খবর দ্যান হ্যামকত্তা

    হাচাই পালের নেমন্তন্ন হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সে এখনও আসেনি। তক্ষুনি লোক পাঠিয়ে কুমোরপাড়া থেকে তাকে ধরে আনা হল। সব শুনে হাতজোড় করে হাচাই পাল বলল, আমি কি চক্কোত্তি ঠাউরের লগে পাল্লা দিতে পারুম?

    গদু চক্কোত্তি হাচাই পালের এই বিনয়ে খুবই সস্তুষ্ট। মুরুব্বিয়ানার সুরে বলল, তুমি ক্যান, এই ঢাকার জিলায় কুনো সুমুন্দি নাই আমার লগে পাল্লা দ্যায়। তয় কিনা, একজন ভাল খাওইয়া কাছে বইলে খাইতে আইট হয়।

    অগত্যা হাচাই পালকে তার মুখোমুখি বসতে হল।

    হেমনাথ চেঁচিয়ে উঠলেন, ও রে লুচি দে, লুচি দে–

    গদু চক্কোত্তি খায় আর গল্প করে। কোথায় কোন রাজবাড়িতে দশ সের দই খেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল, কোথায় শুধু তিন কড়াই মুগের ডাল খেয়েছিল, কোথায় বড় বড় খাইয়েরা পাল্লা দিতে এসে তার কাছে হেরে ভূত হয়ে গেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি অসংখ্য দিগ্বিজয়ের কাহিনী বলে যেতে লাগল।

    গদু চক্কোত্তির খাওয়া সত্যিই দর্শনীয়। নিমন্ত্রিতরা খাবে কি, হাঁ করে তাকিয়ে আছে। শুধু কি তাই, বাড়ির ভেতর থেকে মেয়েরা পর্যন্ত বেরিয়ে এসে তার খাওয়া দেখছে। এর মধ্যেই বিনু টের পেয়ে গেছে, খাইয়ে হিসেবে এ অঞ্চলে গদু চক্কোত্তির বিপুল খ্যাতি, অসীম প্রতিষ্ঠা।

    হাচাই পাল মোটামুটি ভালই পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে। গদু চক্কোত্তি শুধু বেগুনভাজা দিয়ে কুড়িখানা লুচি খেল, হাচাই পালও তাই খেল। ফুলকপির তরকারি দিয়ে গদু চক্কোত্তি খেল চল্লিশখানা লুচি, হাচাই পালও চল্লিশখানাই খেল। তবে লক্ষ করা গেল, তার চোখমুখ যেন কেমন কেমন। পেটটা সামনের দিকে অনেকখানি এগিয়ে গেছে, পিঠটা পেছনে হেলে যাচ্ছে।

    কপির পর এল মাছ। পঞ্চাশ টুকরো মাছ আর বত্রিশখানা লুচি অদৃশ্য করে দেবার পর হাচাই পালের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। পেছন দিকে আরও হেলে পড়েছে সে। হঠাৎ দুই হাতজোড় করে সে লম্বা হয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল, আমারে ক্ষমা করেন চক্কোত্তি কত্তা, আপনের লগে পাল্লা দ্যাওন আমার কাম না। হুকুম করেন, আমি যাই। বলে দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি চলে গেল।

    হাচাই পাল চলে গেলে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল গদু চক্কোত্তি। তারপর বিমর্ষ মুখে বলল, এই হগল মানুষ ক্যান যে আসরে আইসা বসে! খাওনটাই মাটি। বলে আবার খেতে শুরু করল।

    একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিল বিনু। গদু চক্কোত্তির কোমরের কষিটা বুকের কাছে বাঁধা। খাচ্ছিল আর খানিকটা পর পরই হ্যাঁচকা টানে সেটা নিচের দিকে নামাচ্ছিল সে।

    অবাক বিস্ময়ে বিনু লরামমিরকে জিজ্ঞেস করল, ওইটুকু ওইটুকু করে কাপড়টা নামাচ্ছে কেন লালমোহনদাদু?

    লারমোর হাসতে হাসতে সকৌতুকে বললেন, পেটের যেটুকু যেটুকু ফিল-আপ হচ্ছে, কাপড়টা সেইটুকু সেইটুকু নামাচ্ছে। তারপর নাইকুণ্ডল থেকে যখন এক ইঞ্চি ওই কষি নামাবে তখন খাওয়া শেষ।

    নাভির তলায় কাপড় নামাতে পরিবেশনকারীদের যে কতবার ছোটাছুটি করতে হল তার আর হিসেব নেই।

    খাওয়া দাওয়ার পর ব্ল্যাক থেকে একটা দোয়ানি বার করে পাখিকে আশীর্বাদ করল গদু চক্কোত্তি। তারপর হেমনাথকে বলল, অহন যাই হ্যামকত্তা।

    হেমনাথ বললেন, এত রাতে কোথায় যাবে?

    নবীগুঞ্জের গয়নার নাও ধরুম।

    কাল সকালে গেলে হয় না?

    উঁহু। কাইল সকালে উইখানে এক বাড়িতে পৈতা আছে। আইজই আমারে রওনা দিতে হইব।

    তা হলে তো তোমাকে ছেড়ে দিতেই হয়।

    গদু চক্কোত্তি চলে গেল। যাবার আগে বিনুর মনে বিচিত্র বিস্ময়ের রেশ রেখে গেল।

    .

    ২.১৭

    বৌভাতের দিন পাখিদের বাড়ির সবাই এসেছিল। তাদের নিয়ে এসেছিল গোপাল দাস আর ধনঞ্জয়। গোপাল দাস সেদিন কিছুতেই খায়নি। যতদিন না মেয়ের ছেলেপুলে হচ্ছে ততদিন তার শ্বশুরবাড়ির জলটুকুও ছোঁবে না।

    বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হলে গোপাল দাসরা চলে গিয়েছিল। যাবার আগে মেয়ে-জামাইকে দ্বিরাগমনে নেমন্তন্ন করে গেছে।

    পাখিরা টুনিদের বাড়ি দ্বিরাগমনে যাবে না, যাবে ভাটির দেশে গোপল দাসের বাড়ি।

    গোপাল দাসদের নিয়ম অনুযায়ী বৌভাতের আড়াই দিন পর দ্বিরাগমনে যাবার কথা। যুগলদের রওনা হতে হতে পাঁচদিন কেটে গেল। এখন শুকনোর সময়। বাড়ি থেকে লারমোরের ফিটনে নদীর ঘাটে এসে কেরায়া নৌকোয় উঠল পাখিরা। তাদের বিদায় দেবার জন্য বাড়ির সবাই সঙ্গে এসেছিল।

    নৌকো ছাড়ার মুখে স্নেহলতা বললেন, সাত দিনের মধ্যে ফিরে আসবি যুগল।

    যুগল মাথা নাড়ল, আইচ্ছা—

    বেশিদিন কিন্তু শ্বশুরবাড়ি থাকতে নেই, বুঝলি?

    ঘাড় কাত করে যুগল জানাল, বুঝেছে।

    স্নেহলতা আবার বললেন, বেশিদিন থাকলে নিন্দে হয়।

    .

    সেই যে যুগল দ্বিরাগমনে গিয়েছিল তারপর আর কোনও খবর নেই। সাত দিনের ভেতর ফিরে আসার কথা। সাত দিনের জায়গায় পনের দিন গেল, পনের দিনের পর মাসও যায় যায়। না ফিরল যুগল, না এল পাখি।

    সবাই অস্থির, চিন্তিত। হেমনাথ ঠিক করলেন, ভাটির দেশে গোপাল দাসের বাড়িতে লোক পাঠাবেন। তোক আর পাঠাতে হল না, তার আগেই যুগলের চিঠি এল। নিজে তো আর লেখাপড়া জানে না, অন্য কাউকে দিয়ে লিখে পাঠিয়েছে।

    শ্রীচরণকমলেষু,

    প্রণাম অন্তে জানিবেন, আমরা মঙ্গলমতো পৌঁছিয়াছি। পত্র দিতে দেরি হইল বলিয়া মনে কিছু করিবেন না।

    যাহা হউক, বর্তমান জানিবেন আমাদিগের আর রাজদিয়া ফিরত যাওয়া হইবে না। শ্বশুরমহাশয়ের পুত্ৰাদি নাই। তাহার ইচ্ছা আমি এইখানেই বসবাস করি।

    এইখানে আমার থাকিবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কী করিব? শ্বশুরমহাশয়ের অনেকগুলি পুকুর। ইদানীং কয়েকটি বিলও তিনি ইজারা লইয়াছেন। বিল এবং পুকুরে প্রচুর মাছ। কই, বোয়াল, চিতল, মাগুর, কাজলি, বাতাসী, কালিবাউস, রুই, কাতল, ফলি, পাবদা ইত্যাদি। এত মাছ ফেলিয়া আমার রাজদিয়া ফিরিয়া যাইতে মন চায় না।

    ঠাকুমা আপনি এবং বাটিস্থ সকলে আবার প্রণাম নিবেন। ছোটবাবুকে বলিবেন আমার জন্য যেন মন খারাপ না করে।

    আগতে আপনাদের কুশল দানে সুখী করিবেন। ইতি–

    আপনার সেবক-যুগল।

    চিঠি পড়ে কিছুক্ষণ বিষণ্ণ মুখে বসে রইলেন হেমনাথ। স্নেহলতা কাঁদলেন। সত্যিই ছেলেটার ওপর বড় মায়া পড়ে গিয়েছিল তাদের।

    যুগল না ফেরাতে সব চাইতে যার বেশি মন খারাপ হয়েছে সে বিনু। বুকের ভেতরটা সবসময় তার ভারী হয়ে থাকে।

    যুগল তাকে হাতে ধরে জলে নামিয়েছে, সাঁতার শিখিয়েছে। নৌকো বাওয়ার, মাছমারার কৌশল আয়ত্ত করিয়েছে। হেমন্তের স্থির নিস্তরঙ্গ জলে অলস কচ্ছপ এবং শীতের শূন্য মাঠে সুন্দি কাউঠ্যা’র আস্তানা চিনিয়েছে। এই জলের দেশের প্রতিটি বৃক্ষলতা, প্রতিটি পশুপাখি, প্রতিটি তৃণের নাম সে মুখস্ত করিয়েছে। এখানকার বিশাল নদী, বিরাট আকাশ আর সীমাহীন মাঠের মাঝখানে এক অপার অথৈ বিস্ময়ের ভেতর বার বার তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বিনুর চোখে নতুন রং ধরিয়ে দিয়েছে। একা একা মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতে, জলের ভেতর মাছের খেলা দেখতে কিংবা গাছের ডালে মোহনচূড়া পাখিটার নাচানাচি লক্ষ করতে করতে যে আজকাল ভাল লাগে, সে ওই যুগলের জন্য। এই অসীম বিশ্বের বাধাবন্ধহীন ফসলের খেতে, আঁকাবাঁকা আলপথে, স্কুপের মতো সাজানো আকাশের মেঘগুলিতে কিংবা স্থির জলে নলঘাসের প্রতিবিম্বের মধ্যে যে এত আনন্দ ছড়ানো ছিল, এ খবর যুগলের আগে আর কেউ তাকে দেয়নি।

    আপন অভিজ্ঞতার সবটুকু সার বিনুর হাতে তুলে দিয়ে চলে গেছে যুগল। তার জন্য ভোলা সেই নতুন ঘরখানা তালা দিয়ে রেখেছেন স্নেহলতা। প্রায় রোজই তার কথা হয়। অনেক দিনের অনেক স্মৃতির কথা বলতে বলতে চোখ ঝাঁপসা হয়ে যায় স্নেহলতার। শুনতে শুনতে বিনুর মনে বিষাদ ঘন হতে থাকে।

    .

    ২.১৮

    যুগল নেই। আজকাল বিনুর ছোটাছুটি ঘোরাঘুরি অনেক কমে গেছে। কাজ বলতে এখন শুধু পড়াশুনো, স্কুলে যাওয়া, ঝিনুকের সঙ্গে ঝগড়া, আর দু’চারদিন পর পর পোস্ট অফিসে গিয়ে সুনীতির চিঠির খোঁজ করা। আনন্দর চিঠি এলে বইয়ের ভেতর লুকিয়ে বাড়ি এসে সুনীতিকে দেয় বিনু, তার জন্য দু’আনা করে পয়সা পায়।

    নিবারণ পিওন বলে, দাদুভাই, তুমি আইসা চিঠি নিয়া যাও। আমি গ্যালে একবেলা দুই মুঠা ভালোমন্দ খাইতে পাইতাম।

    বিনু বলে, চিঠির সঙ্গে কী, আপনি এমনি গিয়ে খেয়ে আসবেন। আর এই চিঠির কথা কাউকে বলবেন না।

    হেসে হেসে, নিবারণ বলে, হেয়া আমি জানি, ব্যাপারখান বড় গুপন (গোপন)।

    বিনু হাসে, কিছু বলে না। সুনীতির চিঠির ব্যাপারটা নিয়ে নিবারণের সঙ্গে অলিখিত একটা চুক্তি হয়ে গেছে তার।

    মাঘের শেষাশেষি যুগল দ্বিরাগমনে গিয়েছিল। তারপর একে একে ফায়ূন এল, চৈত্র এল। হেমনাথের বাগানে মান্দার গাছগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল, শিমুলগাছের মাথায় থোকা থোকা। আগুন জ্বলতে লাগল। জামরুল আর কালোজাম, রোয়াইল আর কাউগাছগুলো ফলের ভারে নুয়ে। পড়ল। আমের গাছগুলোতে বোল এসেছিল মাঘের গোড়ায়, এখন গুটি ধরেছে। লক্ষ লক্ষ ফড়িং ফিনফিনে পাতলা ডানায় বাগানময় উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর উড়ছে পাখি–শালিক, চড়ুই, বুনন টিয়া, বুলবুলি। দক্ষিণ দিক থেকে আজকাল ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ হাওয়া বইতে থাকে।

    এই ফুল-ফল-হাওয়া, এই পাখি পতঙ্গ, যুগল ছাড়া সব অর্থহীন, সবই বৃথা। অন্তত বিনুর তাই মনে হয়।

    যুগল চলে যাবার পর কিছুদিন সময় যেন থমকে ছিল। তারপর আবার চিরাচরিত পুরনো নিয়মে চলতে শুরু করেছে। নবু গাজির ছেলের সঙ্গে মজিদ মিঞার মেয়ের বিয়েও হয়ে গেছে এর মধ্যে। বিনুরা কেতুগঞ্জে গিয়ে সারাদিন থেকে নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছে। স্নেহলতা-শিবানী সুরমা-হেমনাথ, প্রত্যেকেই যে যার নিজের কাজের চাকায় বাঁধা। এরই ভেতর একদিন সময় করে বুধাই পালের। মেয়ের মাঘমন্ডলের ব্রত সাঙ্গ করিয়ে এসেছেন স্নেহলতা। হেমনাথের মতো তারও দায়দায়িত্ব কি এক-আধটা? পারিবারিক দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব, সবই পালন করতে হয়। সুধা সুনীতি নিয়মিত কলেজ করে যাচ্ছে।

    তবে সব চাইতে পরিবর্তন হয়েছে অবনীমোহনের। জমি পেয়ে একেবারে মেতে উঠেছেন তিনি। ধান উঠে যাবার পর পৌষ মাসে রবিশস্যের বীজ ছড়িয়েছিলেন–মুগ তিল মটর খেসারি। চৈত্রের গোড়ায় রবিফসল উঠে গেছে। চৈত্রের শেষাশেষি হাল-লাঙল নিয়ে আবার মাঠে নেমে পড়েছেন। এ জন্য আটটা কামলা রেখেছেন অবনীমোহন, বলদ কিনেছেন ষোলটা। জমি চৌরস করে রাখবেন এখন, তারপর নতুন বর্ষার জল পড়লেই আউশ বুনবেন।

    হেমনাথ ঠাট্টা করেন, তুমি দেখি দুদিনেই আমাদের চাইতেও বড় চাষী হয়ে উঠলে অবনী।

    অবনীমোহন কিছু বলেন না, শুধু হাসেন।

    সুরমা শুধু বলেন, দেখ, ক’দিন উৎসাহ থাকে।

    চৈত্রের পর এল নিদারুণ খরার দিন। মাঠ ফেটে এখন চৌচির। আলের ধারের জলসেঁচি শাকগুলো পুড়ে পুড়ে হলুদ হয়ে যেতে লাগল। মেঘশূন্য আকাশ সারাদিন গলা কাসার রং ধরে থাকে। অনেক, অনেক দূরে আকাশ যেখানে ধনুরেখায় দিগন্তে নেমেছে সেইখানে আগুনের হলকা কাঁপতে থাকে। কার সাধ্য সেদিকে তাকায়।

    সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে সন্ধেবেলা ফেরেন অবনীমোহন। ফিরেই দু’দিনের বাসি খবরের কাগজ নিয়ে বসেন।

    .

    পুজোর পর সেই যে কলকাতায় গিয়েছিলেন অবীমোহন তখনই তার নামে রাজদিয়ায় খবরের কাগজ পাঠাবার ব্যবস্থা করে এসেছিলেন। টাটকা টাটকা খবর আর কেমন করে পাওয়া যাবে? কলকাতায় যে কাগজ আজ বার হয় ট্রেনে স্টিমারে রাজদিয়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে তার দুদিন লেগে যায়। কী আর করা যাবে, এই গ্রামদেশে দু’দিনের বাসি খবর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় অবনীমোহনকে।

    আজকাল কাগজভর্তি শুধু যুদ্ধের খবর। ক’মাস আগেও রাজদিয়ার মানুষের যুদ্ধ সম্বন্ধে মাথাব্যথা ছিল না। কোথায় জার্মানি, কোথায় ফ্রান্স, কোথায় গ্রিস, কোথায় ইংল্যান্ড, কোথায় বা বলকান কান্ট্রি ভূগোলের কোন প্রান্তে এই দেশগুলো ছড়িয়ে আছে তার খোঁজ রাখার প্রয়োজন বোধ করত না তারা। কিন্তু ইদানীং রাজদিয়ার গায়ে যুদ্ধের আঁচ লাগতে শুরু করেছে।

    সন্ধে হলে নিকারীপাড়ার আইনুদ্দি, সর্দারপাড়ার ইচু মণ্ডল, কুমোরপাড়ার হাচাই পাল, বুধাই পাল, যুগীপাড়ার গোঁসাইদাস–এমনি অনেকে এসে হাজির হয়। এ ছাড়া হেমনাথ-সুধা-সুনীতি-বিনুরা তো আছেই।

    সবাই এসে জড়ো হলে অবনীমোহন হেরিকেনের আলো উসকে দিয়ে কাগজ পড়তে শুরু করেন।

    পুজোর পর বাড়ির এবং ব্যবসাপত্তরের ব্যবস্থা করতে কলকাতায় গিয়েছিলেন অবনীমোহন। ফিরে আসার পর থেকেই খবরের কাগজ পড়ার আসর বসছে। প্রথম দিকে ইচু মন্ডলরা আসত না, তখন বাড়ির লোকেদের পড়ে পড়ে শোনাতেন অবনীমোহন। পরে খবর পেয়ে ইচু মন্ডলরা আসতে শুরু করেছে। আজকাল তারা নিয়মিত আসে।

    অবনীমোহন কোনও দিন পড়েন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের আওতার ভিতর চলিয়া আসিতেছে। তাহাদের প্রেরিত সমবোপকরণ যাহাতে ব্রিটেনে পৌঁছাইতে না পারে সে জন্য জার্মান বিমান ও ইউ বোটগুলি আটলান্টিকে হানা দিয়ে ফিরিতেছে।

    দূর প্রাচ্যে ঘোরালো অবস্থা। ব্রিটেন সেখানে ব্যাপক সামরিক ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেছে।

    সিঙ্গাপুরের খবরে প্রকাশ, হাজার হাজার অস্ট্রেলিয়ান সৈন্য সিঙ্গাপুরে পৌঁছিয়াছে এবং মালয়ের বিভিন্ন স্থানে যাত্রা করিয়াছে।

    কোনও দিন পড়েন, বাংলা সরকারের ইস্তাহার, বিমান আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হউন। কলিকাতা শহরে হাজার হাজার আগুনে বোমা পড়িতে পারে, তবে আগুনে বোমা দেখিয়া ভয় পাইবেন না।

    সিঙ্গাপুরের খবর : হাইনান ও টঙ্কিনে জাপানিরা দশ ডিভিশন সৈন্য সন্নিবেশ করিতেছে। ইন্দোচিনের দরিয়ায় জাপানের নৌবাহিনী টহল দিতেছে।

    কোনও দিন পড়েন, জাপ পররাষ্ট্র সচিব মাৎসুওকা বার্লিন যাইবার পথে মস্কোতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করিয়াছেন।

    কোনও দিন পড়েন, জার্মানি কর্তৃক যুগোশ্লাভিয়া ও গ্রিস আক্রমণ। যুগোশ্লাভিয়াকে হাত করিয়া গ্রিসের উপর আক্রমণ চালাইবার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় নাৎসীরা যুগোশ্লাভিয়া আক্রমণ করে। বেলগ্রেডে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ–

    জাপ-সোভিয়েট অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত।

    জার্মানির দুর্ধর্ষ সামরিক বিমান য়ুঙ্কারের আবির্ভাব।

    কোনও দিন অবনীমোহন পড়েন, চিন-জাপান যুদ্ধের নূতন অধ্যায়। মহাচিনে চুংকিঙ সরকারের সহিত কমিউনিস্টদের মিটমাট হইয়াছে। চিয়াং কাইশেক কমিউনিস্ট চতুর্থ বাহিনী ভাঙিয়া দিবার পর উত্তর-পশ্চিম চিনে কমিউনিস্ট অষ্টম বাহিনী চুংকিঙের সহিত সহযোগিতা করিতেছিল না। ফলে তাহারা জাপ আক্রমণ ঠেকাইতে পারিতেছিল না। এই অবস্থায় চুংকিঙ সরকার কমিউনিস্টদের নিকট আবেদন জানান। ইহার পর কমিউনিস্টরা তাহাদের সহিত যোগদানের সিদ্ধান্ত করে। এখন তাহারা মিলিতভাবে আক্রমণ করায় জাপানিরা মুশকিলে পড়িয়াছে।

    শেনসি, সানসি ও হোনানে পাল্টা আক্রমণ চলিতেছে।

    কোনও দিন পড়েন, জার্মানির বিরুদ্ধে আমেরিকার আচারণ ক্রমেই উগ্রতর হইয়া উঠিতেছে। মার্কিন সরকার আমেরিকায় জার্মান দূতাবাস, তাদের পাঠাগার, টুরিস্ট ব্যুরো, ট্রান্স ওসেন নিউজ এজেন্সি বন্ধ করিয়া দিয়াছেন।

    কোনও দিন পড়েন, রুশ-জার্মান যুদ্ধের শুরু।

    লেনিনগ্রাদ, সেবাস্টিপুল, ওদিকে হেলিসিঙ্কি, ওয়ারশ, ডানজিগে জার্মান বোমাবর্ষণ।

    কৃষ্ণসাগর হইতে শ্বেতসাগর পর্যন্ত যুদ্ধের বিস্তৃতি।

    জার্মানদের বর্তমানে চারটি প্রধান লক্ষ্য–মুরমানস্ক, লেনিনগ্রাদ, মস্কো ও কিয়েফ।

    কোনও দিন পড়েন, চিন-জাপান যুদ্ধ চার বছর পার হইয়া পাঁচ বছরে পড়িল।

    রুশ-জার্মান যুদ্ধ শুরু হইবার পর আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি বিস্তারের দিকে মনোযোগ।

    খবরের কাগজের পাতা জুড়ে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ, উত্তেজনা আর আতঙ্ক। শ্বাস টানলে বাতাসে বারুদের গন্ধ পাওয়া যায়। দেশ-দেশান্তর জুড়ে সেই আগুনের চাকা যেন আরও, আরও বড় হয়ে ঘুরতে শুরু করেছে।

    রোজই খবরের কাগজ পড়া হয়ে গেলে যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা আরম্ভ হয়।

    ইচু মন্ডল বলে, জারমান-জুরমান, মাৎসুকা, লেনিনগারদ–নামগুলান জবর খটমইটা।

    অবনীমোহন হাসেন, হ্যাঁ।

    জাগাগুলি (জায়গাগুলো) কুনখানে জামাই?

    ওর ভেতর শুধু জায়গার নামই নেই, মানুষের নামও আছে। জায়গাগুলো এখান থেকে অনেক, অনেক দূরে।

    ইচু মন্ডল মাথা নাড়ে, হেয়া বুঝছি। আমাগো দ্যাশে অ্যামন খটর মটর নাম নাই।

    বুড়ো রসিক শীল বলে, আইচ্ছা জামাই–

    ইতিমধ্যে রাজদিয়া এবং চারদিকের গ্রাম-গঞ্জ-জনপদে জামাই’ নামে পরিচিত হয়েছেন অবনীমোহন। হেমনাথের ভাগনী-জামাই, সেই সুবাদে এ অঞ্চলের জামাই হয়ে গেছেন। ওই নামেই সবাই তাকে ডাকে।

    অবনমোহন বলেন, কী বলছেন?

    খবরের কাগজ শুইনা তো মনে লাগে, চাইর দিকে বেড়া আগুন লাগছে। আপনের কী মনে লয় (হয়)?

    কী ব্যাপারে?

    যুজ্যু (যুদ্ধ) কি আমাগো এই রাইজদাতেও আইসা পড়ব?

    কেমন করে বলি!

    ওধার থকে হাচাই পাল বলে ওঠে, এইখানে যুজ্য লাগব কিনা ক্যাঠা কইব। তয়—

    অবনীমোহন শুধোন, তবে কী?

    বাজারে আগুন লাইগা গ্যাছে।

    বুধাই পাল বলে হে যা কইছ ঠাউরভাই, আগুনই লাগছে। আমাগো লাখান গরিব মাইনষে আর বাচব না। বাইগনের (বেগুনের) স্যার (সের) আছিল এক পহা দ্যাড় পহা, হেই বাইগন অহন তিন পহা চাইর পহায় বিকাইতে আছে।

    ইসমাইল চৌকিদার বলে, মলন্দি মাছ আর বজুরি মাছের ভাগা আছিল দুই পহা কইরা। তার দাম উঠছে ছয় পহা। এক গ্যালাস মাঠা চাইর পহা। পটল যে পটল, মূলা যে মূলা, ঝিঙ্গা যে ঝিঙ্গা, বাঙ্গী যে বাঙ্গী-কুন জিনিসখানে হাতে দিতে পারবা! হগল আগুন।

    ইচু মন্ডল বলে, মাছ-বাগুন-মূলা-পটল এক কিনারে থুইয়া দাও। যেই দব্য না হইলে পরাণ  বাঁচে না তার খবর রাখ?

    সমস্বরে অন্য সবাই শুধোয়, কোন দব্য?

    ইচু মন্ডল বলে, চাউল রে ভাই, চাউল। চাউলেই ঘাউল করছে। গ্যাল হাটে চাউলের দর কত উঠছে জানো?

    কত? কত?

    আঠার ট্যাকা মণ।

    অনেকগুলো ভীতিবিহ্বল কণ্ঠস্বর শোনা যায়, কও কী মন্ডলের পুত!

    ইচু মন্ডল মাথা নাড়ে, ঠিকই কই রে দাদারা, ঠিকই কই।

    বুধাই পাল বলে, গ্যাল হাটে চাউল কিনি নাই। তার আগের হাটে কিনছিলাম। তহন দর আছিল বার ট্যাকা মণ। সাত দিনের ভিতরে ছয় ট্যাকা চইড়া গেল!

    ইচু মন্ডল বলে, দরের অহনই দেখছ কী! ব্যাপারিরা কইতে আছিল, পরের হাটে আরও চড়ব।

    সাচা (সত্যি?

    সাচা—

    তাইলে উপায়! আরও দর চেতলে (বাড়লে) খামু কী? পোলা-মাইয়ারে খাওয়ামু কী?

    খাইতে আর হইব না, শুকাইয়া মরতে হইব।

    কী যুজ্যু যে লাগল!

    .

    এ ক’মাসে খবরের কাগজের পাতা জুড়ে যুদ্ধের খবরই বেশি। তার ফাঁকে ফাঁকে অন্য খবরও চোখে পড়েছে অবনীমোহনের। সেগুলোও পড়ে পড়ে শুনিয়েছেন তিনি।

    সত্যাগ্রহ করিয়া মৌলানা আজাদের আঠার মাস সশ্রম কারাদন্ড লাভ।

    সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান। কিছুদিন যাবৎ সুভাষচন্দ্র মৌনাবলম্ব করেন এবং নিজের ঘরে গীতা, চন্ডী ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ পাঠ করিতে থাকেন। হঠাৎ দেখা যায় তিনি অন্তর্ধান করিয়াছেন। যেদিন তাহার গৃহত্যাগের সংবাদ প্রকাশ পায় সেদিন ভারতরক্ষা আইনের বলে তাহার বিচারের দিন ছিল। সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধানের ফলে সারা ভারতবর্ষে নিদারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে।

    নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের অগ্নিমূল্য। দাম বাড়িয়া যাওয়ায় অসন্তোষে নানা স্থানে ধর্মঘট।

    এসব ছাড়া মুসলিম লিগের খবর, কংগ্রেসের খবর, নেহরু-জিন্না-গান্ধিজি এবং হক সাহেবের খবর তো ছিলই। আর ছিল জিন্নাসাহেবের দেশ ভাগাভাগি করে নেবার পরিকল্পনা এবং দাবি।

    সুভাষচন্দ্র-পাকিস্তান-গান্ধি-জিন্না, এসব নিয়েও হেমনাথের ঘরের দাওয়ায় হেরিকেনের অনুজ্জ্বল আলোয় বসে শ্রোতাদের কম আলোচনা হয়নি, দেশের রাজনৈতিক আর রাষ্ট্রীয় সমস্যা নিয়ে তারা কম মাথা ঘামায় নি।

    ইচু মন্ডল বলেছে, আইচ্ছা জামাই—

    বলুন– জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছেন অবনীমোহন।

    সুভাষবাবু গেল কই?

    কী করে বলি।

    সুভাষবাবু খুব বড় মনিষ্য (মানুষ)।

    নিশ্চয়ই।

    এংরাজগো চৌখেরে ফাঁকি দিয়া যাওন সোজা না।

    তা তো ঠিকই।

    ওধার থেকে উদ্বেগের গলায় ইসমাইল চৌকিদার শুধিয়েছে, সুভাষবাবুরে এংরাজরা আর ধরতে পারব?

    অবনীমোহন বলেছেন, কিছুই বলতে পারছি না।

    ইচু মণ্ডল বকের পাখার মতো সাদা ধবধবে দাড়ি নেড়ে বলেছে, সুভাষবাবুরে আমি দেখছি।

    ইসমাইল চৌকিদার, রজবালি সিকদার, বুধাই পালেরা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করেছে, কই দেখলা চাচা, কই দেখলা?

    বরিশালে, তেনি উইখানে আইছিল। কী সোন্দর দেখতে, য্যান রাজপুত্তুর।

    কথায় কথায় দেশভাগের কথাও এসে পড়েছে। পাকিস্তানের কথা এসেছে।

    এ প্রসঙ্গে বুধাই পাল বলেছে, অ গো হ্যামকত্তা, অ গো জামাইকত্তা—

    হেমনাথ অবনীমোহন দু’জনেই তার দিকে তাকিয়েছেন।

    বুধাই পাল একবার বলেছে, মাইনষের মুখে শুনি, খবরের কাগজেও লেখছে, দ্যাশখান নিকি ভাগাভাগির কথা হইতে আছে। একখান ভাগ হিন্দুর, একখান মুসলমানের।

    হেমনাথ আস্তে আস্তে করে মাথা নাড়েন।

    দ্যাশ আবার ক্যামনে ভাগ হয়?

    কী জানি—

    এই সময় ইচু মন্ডল হঠাৎ বলে উঠেছে, দ্যাশভাগের কথায় একখান কথা মনে পড়ল। সম্বাদখান তোমাগো শুনাই।

    কও, কও–সবাই উৎসাহিত হয়ে উঠেছে।

    বুঝলা নি ভাইস্তারা (ভাইপোরা), হেই–হেইবার–গলার স্বরে দীর্ঘ টান দিয়ে একটু থেমেছে ইচু মন্ডল। হয়তো মনে মনে বক্তব্যটাকে গুছিয়ে নিচ্ছিল সে।

    শ্রোতাদের তর আর সইছিল না। ভাববার মতো সময়টুকু দিতেও রাজি নয়। সকলে সমস্বরে তাড়া দিয়ে উঠেছে, কুন বার চাচা, কুন বার?

    ইচু মন্ডল পাকা ভুরুদু’টো কুঁচকে বলেছে, হেই যেইবার জোড়া বান ডাকল। কী তুফান বড় নদীতে! এই রাইজদা জলের তলে পরায় (প্রায়) সাত দিন ডুইবা আছিল। ঝড়ে আমার বাড়ির মধুটুকরি আমের গাছটা মাটিতে শুইয়া পড়ল, দুইখান ঘরের চাল উইড়া গিয়া পড়ল নয় মাইল তফাতে। হেইবারের দুই বছর আগে কি পরে, মনে নাই–

    সময় সম্পর্কে এখানকার মানুষের ধারণা অদ্ভুত। সাল-তারিখের হিসেব নিয়ে তাদের দুর্ভাবনা নেই, তার ধারও তারা পারে না। ভয়াবহ কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা ওইরকম কোনও ঘটনার স্মৃতি দিয়ে তারা সময়ের হিসেব করে।

    ইচু মন্ডল থামেনি, হেইবার, বুঝলা ভাইস্তারা, এংরাজরা ঠিক করছিল বাংলা দ্যাশখানেরে দুই টুকরা করব–

    পারছিল?

    হে কি পারে! বড় বড় বাবুরা আর বড় বড় মোছাবরা দ্যাশখান উথালপাথাল কইরা ছাড়ল। শ্যাষম্যাষ এংরাজরা ডরাইয়া গেল, দ্যশ আর টুকরা টাকরি করতে সাহস পাইল না।

    রোজই এই খবরের কাগজ পড়ার সময় কিছুক্ষণ অবনীমোহনদের কাছ এসে বসে বিনু। কী একটা বইতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কথা পড়েছিল সে। বিনু বুঝতে পেরেছে, সেই কথাই বলছে ইচু মন্ডল।

    বুধাই পাল, হাচাই পাল এবং ইসমাইল চৌকিদারও বয়সে বেশ প্রবীণ। অবশ্য ইচু মন্ডলের চাইতে ঢের ছোট। ইচুর কথায় তাদেরও যেন মনে পড়ে গেছে। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে তারা বলেছে, আমাগো ছুটোকালে এইরকম একখান কথা শুনছিলাম য্যান।

    ইচু মন্ডল আবার কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার নজর এসে পড়েছে হেমনাথের ওপর। হেমনাথ চুপচাপ ওদের কথা শুনছিলেন। ইচু মন্ডল তাঁকেই সাক্ষী মেনে এবার বলেছে, এই যে হ্যামকত্তা, আপনেই তো এই রাইজদা তুলফাড় কইরা ফালাইছিলেন। মনে পড়ে, বাড়ি বাড়ি ঘুইরা বুঝাইছিলেন, হিন্দুই হউক আর মুসলমানই হউক, হগল বাঙ্গালীই এক।

    হেমনাথ উত্তর দেন নি, অল্প হেসে ঘাড় হেলিয়ে দিয়েছেন।

    ইচু মন্ডল আবার বলেছে, এংরাজ পারে নাই, ওনারা পারব! যত তামশার কথা!

    বয়স যাদের কম তারা শুধিয়েছে, এই হগল কত কাল আগের কথা চাচা?

    ইচু মন্ডল বলেছে, তা বিশ পঞ্চাশ বচ্ছর আগের হইব। বলতে বলতে হেমনাথের দিকে ফিরেছে, না হ্যামকত্তা?

    হেমনাথ কৌতুক বোধ করেছেন। বলেছেন, তুমি তো সবই জানো।

    কমবয়সীরা জিজ্ঞেস করেছে, তখন তোমার কত ব’স (বয়স) চাচা?

    ইচু মন্ডল বলেছে, হে হইব দ্যাড় কুড়ি। ছ্যামরারা, তহন আমার জুয়ান ব’স (বয়স), ঘরে তিন বিবি–

    শুনতে শুনতে সবাই হেসে উঠেছে।

    .

    ২.১৯

    এই জল-বাংলায় ঋতু বলতে চারটি-শীত গ্রীষ্ম বর্ষা এবং শরৎ। বাকি ঋতুগুলি কখন যায় কখন আসে, বিশেষ টেরও পাওয়া যায় না। তারা আসে চুপিচুপি, যায় আরও নিঃশব্দে।

    চার ঋতু বাদ দিয়ে থাকে হেমন্ত আর বসন্ত। মাঠভর্তি জলে যখন টান ধরে, উত্তরে বাতাসে যখন চামড়া ফাটতে থাকে, সকালের দিকে ঠান্ডায় গায়ে কাঁটা দেয়, কুয়াশায় হিমে সন্ধেটা যখন ঝাঁপসা, সেই সময়টা হেমন্ত। ভাল করে হেমন্তকে বুঝবার আগেই শীত নেমে যায়। শীতের পর মান্দার আর শিমুল গাছে থোকা থোকা রক্তবর্ণ ফুলের নিশান উড়িয়ে বসন্ত আসে, কিন্তু তার আয়ু আর কতটুকু! দেখতে দেখতে মাঠ ঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে যেতে থাকে। ফাটলের ভেতর থেকে বিষাক্ত নিঃশ্বাসের মতো পৃথিবীর অন্তঃপুরের যত উত্তাপ বেরিয়ে আসে। আকাশ যেখানে ধনুরেখায় দিগন্তে বিলীন, সেখানে যখন আগুনের হলকার মতো রোদ কাঁপতে থাকে তখন টের পাওয়া যায় খরা এসে গেল।

    হেমন্ত আর বসন্ত ছাড়া বাকি চার ঋতুর চেহারা এখানে স্পষ্ট। এসেই তাদের পালাই পালাই নেই। একবার এলে যেতেই চায় না, রীতিমতো আসর জাঁকিয়ে বসে, আকাশে বাতাসে আপন স্বভাবটি মুদ্রিত করে তবে যাবার নাম করে।

    এখন আষাঢ়। জষ্ঠির মাঝামাঝি খালবিল ছাপিয়ে নতুন বর্ষার জল আসতে শুরু করেছিল। পশ্চিমা বাতাসের টানে আকাশ জুড়ে তখন থেকেই কালো কালো ভবঘুরে মেঘেদের আনাগোনা। জষ্ঠি মাসে যে মেঘগুলো ছিল অস্থির, উড়-উড়, নিয়ত চঞ্চল, তারাই একাকার হয়ে জমাট বেঁধে আকাশময় বিরাট এক চাদোয়ার মতো মাথার ওপর অনড় হয়ে আছে।

    সারাদিন বৃষ্টি পড়ছেই। কখনও ঝিপ ঝিপ, কখনও ঝর ঝর। ভরা বর্ষার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বিনুর মনে হয়, যুগযুগান্ত ধরে কাল কালান্তর পার হয়ে এ বৃষ্টি পড়ছেই, পড়েই যাচ্ছে।

    হেমনাথের পুকুরটা বর্ষার প্রথম দিকেই ভেসে গিয়েছিল। মাঠ-ঘাট-খেত সব এখন জলের তলায়। নতুন বর্ষার জল পড়তেই বীজ বোনা হয়েছিল। ধানগাছ এখন জলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফনফনিয়ে বেড়ে উঠছে।

    কচুবনে দিন রাত ব্যাঙ ডাকছে, ঝিঁঝিদের রাজ্যেও একটানা জলসার আসর বসেছে। আকাশ পাতাল জুড়ে তাদের মিলিত সুর সব কিছুকে করুণ, বিষণ্ণ, উদাস করে তুলেছে। এ ছাড়া যেন পৃথিবীতে আর কোনও শব্দ নেই।

    এই জল-বাংলায় এত যে পাখি-জলপিপি, কবুতর, মোহনচূড়া, বখারি, শালিক, সিদ্ধিগুরু, বুনো টিয়া–বর্ষা নামবার পর থেকে তাদের আর দেখা নেই। কোথায়, কোন ঠিকানায় তারা দেশান্তরী হয়েছে, কে জানে।

    সমস্ত চরাচর বৃষ্টির অবিরাম দীর্ঘ ধারাগুলির ওধারে ঝাঁপসা হয়ে আছে। কদাচিৎ পুকুরের ওপারে ধানখেতের ভেতরে এক আধটা নৌকো চোখে পড়ে। দেখেও যেন বিশ্বাস হতে চায় না। মনে হয়, অনেকদিন আগের দেখা কোনও আবছা স্মৃতির ভেতরে নৌকোগুলো দোল খাচ্ছে।

    বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একদিন হেমনাথ আর অবনীমোহনের সঙ্গে সুজনগঞ্জের হাটে গেল বিনু। অনেক দিন পর এবার সুজনগঞ্জে এল সে। স্কুল চলছে, এখন হাটে আসবার সময় কোথায় তার।

    এত জল, এত বাদলা, তবু সুজনগঞ্জের হাটে ভিড় একই রকম আছে। শিয়রের দিককার নদীটা নৌকোয় নৌকোয় তেমনই ঢাকা। কয়েক মাইলের ভেতরে এই একটাই তো হাট। বিকিকিনির জন্য, ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য, প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিসটুকুর জন্যও হাটের মুখ চেয়ে বসে থাকতে হয়। মানুষ না এসে কী করবে?

    জল-বাংলায় বেশ কিছুদিন কেটে গেল বিনুদের। দাদুর সঙ্গে খুব বেশি না হলেও সুজনগঞ্জের হাটে খুব কমও আসেনি সে। আর অবনীমোহন তো প্রতি হাটেই আসছেন। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে সুজনগঞ্জের সব ব্যাপারি-পাইকার-আড়তদার-দোকানদারের সঙ্গে তার আলাপ হয়ে গেছে।

    হেমনাথের বাড়ি উঁচু মন্ডলরা সন্ধেবেলা এসে যা বলাবলি করে, দেখা গেল তা সত্যি। মাছের বাজারে, আনাজপাতির বাজারে, ডাল-মশলার বাজারে–যেখানেই যাচ্ছে সেখানেই এক কথা।

    জিনিসপাতি আগুন হইয়া উঠছে। কী যে করুম—

    দর বাড়লে তোমাদের তো ভালই। লাভ বেশি।

    লাভ বেশি ঠিকই, কিন্তুক আমাগোও তো চড়া দরে চাউল ডাইল কিনতে হয়। বেশি ভালা কইরা সুফল কী? আগে দশ ট্যাকা বার টাকার মাল বিকাইতে পারলে হপ্তার খরচ উইঠা যাইত, পোলা-মাইয়ারে দুধে-ভাতে রাখতে পারতাম। আইজকাইল বিশ পঞ্চাশ ট্যাকা বেইচাও ব্যাড় (বেড়) পাই না। দিনকাল কী যে পড়ল!

    হাটে এলেই হেমনাথ চারদিক টহল দিয়ে বেড়ান। এখানে একটু বসেন, ওখানে দু’দন্ড দাঁড়িয়ে গল্প করেন। হেমনাথের সঙ্গে থেকে থেকে তার এই স্বভাবটি পেয়ে গেছেন অবনীমোহন। হাটের সব মানুষের সঙ্গে দু’একটা কথা বলতে না পারলে তার ভালই লাগে না।

    ঘুরতে ঘুরতে বিনুরা একসময় নিত্য দাসের ধানের আড়তে এসে পড়ল। খুব খাতির টাতির করে নিত্য দাস তাদের বসাল।

    হেমনাথ বললেন, তারপর খবর কী নিত্য?

    নিত্য দাস শুধলো, কুন খবর জানতে চান বড়কত্তা?

    কোন খবর আর, ধান চালের–

    ধান চাউলের খবর জবর মোন্দ—

    কেমন?

    চাউলের দর বিশ ট্যাকায় উঠছে।

    গেল হাটে না আঠার ছিল?

    হ। নিত্য দাস মাথা নাড়ে, অহন রোজ দর চেততে (চড়তে) আছে। বলতে বলতে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে, একখান বড় খারাপ সম্বাদ শুনলাম বড়কত্তা–

    কপাল কুঁচকে হেমনাথ জিজ্ঞেস করেন, কী সংবাদ?

    ধান চাউল নিকি আর পাওয়া যাইব না।

    কে বললে?

    পরস্পর কানে আইতে আছে।

    হেমনাথ চিন্তিত মুখে বললেন, ঠিক শুনেছিস?

    নিত্য দাস বলল, হ, বড়কত্তা।

    এ দেশ ধান চালের দেশ। এত ধান চাল যাবে কোথায়?

    যুজ্যে নিকি লাগব।

    একটু নীরবতা। তারপর নিত্য দাসই আবার শুরু করল, বড়কত্তা একখান কথা জিগাই।

    কী?

    আপনের হগল ধান বেইচা দিছেন?

    না।

    সব ধান অহন ছাইড়েন না, ‘রাখি’ করেন। পরে কামে দিব।

    দেখি।

    নিত্য দাসের আড়ত থেকে বেরিয়ে বিনুরা বিষহরি তলায় চলে এল। বর্ষা কালে বিষহরি তলার ওধারে পুকুরপাড়ের ফাঁকা জমিতে রোগী দেখতে বসেন না লারমোর। মন্দিরের একধারে একটা বারান্দায় চেয়ার-টেবিল-ওষুধের বাক্স সাজিয়ে বসেন। আজও বসেছিলেন।

    বিনুরা এসে তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। রোগী দেখতে দেখতে কথা বলতে লাগলেন লারমোর।

    অবনীমোহন বললেন, জিনিসপত্রের দর ভয়ানক চড়ছে লালমোহন মামা।

    অন্যমনস্কের মতো লারমোর বলেন, চড়ছে নাকি?

    বা রে, আপনি জানেন না!

    জানবার সময় কোথায়? লারমোর বলতে থাকেন, সারাদিন রুগী নিয়েই থাকি। অন্য দিকে তাকাবার ফুরসতই পাই না। অবশ্য–

    অবনীমোহন বলেন, কী?

    রোগীরা দর চড়ার কথা বলে বটে।

    অবনীমোহন এবার চুপ করে রইলেন।

    লারমোর আবার বললেন, দর যদি চড়েই, তুমি আমি কী করতে পারি বল? ভেবে কিছু লাভ নেই।

    কথাটা ঠিক। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন অবনীমোহন।

    লারমোর বলতে লাগলেন, ঘরে কছু চাল আছে। দর চড়লে জিনিসপত্তর যদি কিনতে না পারি একবেলা ফেনা ভাত করে খাব। দিনে একবার খেতে পেলেই আমার চলে যাবে।

    যে মানুষের ঘর-সংসার নেই, ছেলেমেয়ে নেই, বহুজনের হিতে যিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন তার সঙ্গে দর টর নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়া বৃথা। তা বুঝে অবনীমোহন অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। এবারকার বর্ষা, লারমোরের রোগী, ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলল।

    কথায় কথায় একসময় বৃষ্টি ধরে এল। পুব দিকের ঘন মেঘে ফাটল ধরিয়ে চিকচিকে একটু আভা ফুটে বেরুল।

    হেমনাথ বললেন, বৃষ্টি থেমেছে। এই ফাঁকে কেনাকাটা সেরে নিলে ভাল হত না?

    হ্যাঁ হ্যাঁ– ব্যস্তভাবে অবনীমোহন উঠতে যাবেন, সেই সময় দুরের ফাঁকা মাঠটায় একজোড়া ঢাক, বেজে উঠল।

    চমকে বিনু সেদিকে চোখ ফেরাতেই দেখতে পেল সেই ঢেঁড়াদার লোকটা নাম–যার হরিন্দ– একটা উঁচু প্যাকিং বাক্সের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে মা কালীর অসুরের মতো কুচকুচে কালো দুই ঢাকী, কাগা আর বগা, মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে প্রচন্ডভাবে ঢাক পিটিয়ে চলেছে।

    বিনুর মনে পড়ে গেল, যুগলের সঙ্গে প্রথম যেদিন সে সুজনগঞ্জের হাটে আসে সেদিনও কাগা বগা আর হরিন্দকে ঢেড়া দিতে দেখেছিল। অনেক-অনেকদিন পর হরিন্দ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গকে আবার সুজনগঞ্জে দেখা গেল।

    ঢাকের আওয়াজ পেয়ে তামাক-হাটা, আনাজ-হাটা, নৌকো-হাটা ভেঙে দিগ্বিদিক থেকে মানুষ ছুটে আসতে লাগল। মুহূর্তে হরিন্দদের গোল করে ঘিরে ভিড় জমে গেল।

    হেমনাথ বললেন, হরিরা এসেছে দেখছি। অবনীমোহন বললেন, হ্যাঁ। কিসের কেঁড়া দিতে এল, কে জানে।

    অবনীমোহন কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। উৎসুক সুরে বললেন,চলুন মামাবাবু, একটু দেখে আসি।

    তার মনের কথাটা বুঝিবা পড়তে পারলেন হেমনাথ। বললেন, চল।

    কাছাকাছি আসতে বিন্দুরা দেখতে পেল, মাথাটা একদিকে হেলিয়ে লোক জন দেখছে হরিন্দ। যখন বুঝতে পারল, সারা হাট তার চারধারে ভেঙে পড়েছে সেই সময় হাতের ইঙ্গিতে কাগা বগাকে থামিয়ে দিল।

    ভিড়ের ভেতর থেকে হাটুরে মানুষগুলো প্রশ্ন ছুঁড়তে লাগল, এতকাল পর কী মনে কইরা গো ঢ্যাড়াওলা?

    হরিন্দর বলল, সম্বাদ আছে।

    হরিন্দর আসা মানেই রসের বান ডেকে যাওয়া। পাখি যেমন নানা দেশ থেকে ঠোঁটে ঠোঁট শস্যকণা কুড়িয়ে আনে, হরিন্দও তেমনি মজার মজার চমকদার খবর নিয়ে আসে। এই জলা-বাংলার জীবন যেখানে মৃদু, নিঃশব্দ, তিরতিরে স্রোতের মতো বেগবর্ণহীন, হরিন্দ সেখানে আনন্দের দূত। ঝুলি বোঝাই করে সে আনন্দ নিয়ে আসে। হরিন্দ এলেই তাই হাটে সাড়া পড়ে যায়।

    হাটুরে লোকেরা উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী সম্বাদ, কী সম্বাদ?

    হরিন্দ বলল, শুনলেই বুঝবা, ধৈয্য ধর।

    লোকগুলোর ধৈর্য মানে না। অধীর গলায় তারা বলতে লাগল, রসের সম্বাদ তো, অ ঢ্যাড়াওলা?

    উত্তর না দিয়ে হরিন্দ এবার ঢাকী দু’টোর দিকে তাকাল, বাজা ব্যাটারা, ঘুইরা ফিরা বাজা–

    একধারে বসে কাগা বগা বিড়ি টানছিল তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ঢাকে কাঠি দিয়ে চারদিক সরগরম করে তুলল।

    এটা হরিন্দর পুরনো কৌশল। এর সঙ্গে বিনুর আগেই পরিচয় হয়েছে। লোকের কৌতূহল উসকে দেবার জন্য মাঝে মাঝে কথা বন্ধ করে কাগা বগাকে দিয়ে ঢাক বাজাতে থাকে।

    কিছুক্ষণ বাজাবার পর হরিন্দ কাগা বগাকে থামাল। তারপর গলা উঁচুতে তুলে বলল, হাটেরা (হাটুরে) ভাইরা, তোমরা অহন যাইও না। দুইজন মাইন্যগণ্য মনিষ্য আইজ এইখানে আইব।

    সমস্ত ভিড়টা চেঁচিয়ে উঠল, তোরা কারা?

    এছ.ডি.ও সাব আর জিলা ম্যাজিস্টর সাব। মটর লঞ্চে কইরা তেনারা আইব।

    ভিড়ের ভেতর এবার গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল, এছ.ডি.ও সাব, ম্যাজিস্টর সাব এইখানে ক্যান? অ ঢ্যাড়াওলা ভাই, তুমি কিছু বিত্তান্ত জানো?

    হরিন্দ বল, জানি। তয়–

    তয় কী?

    কমু না।

    ক্যান কইবা না? ক্যান?

    নিষেধ আছে। যা কওনের তেনারা আইসা কইব। ইট্টু সবুর কর।

    ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং এস.ডি.ও’র মতো মানুষ যে সুজনগঞ্জের হাটে আসতে পারেন, এ এক অভাবনীয় ঘটনা। কেন তারা আসছেন, উদ্দেশ্যটা কী, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কাজেই হাটুরে মানুষগুলোর ভেতর গবেষণা শুরু হয়ে গেল।

    মাছ ব্যাপারি গয়জদ্দি বলল, আমার মনে লয়, ধান চাউলের দর-দাম বাড়তে আছে, ম্যাজিস্টর সাবরা এইর এট্টা পিতিকার করব। হেই লেইগা আইতে আছে।

    বেগুন ব্যাপারি নোয়জ মিঞা বলল, আমার কিন্তুক অন্য কথা মনে লয়।

    মরিচ ব্যাপারি বিনোদ পাল শুধলো, কী মনে লয় নোয়াজ ভাই?

    আমাগো হাটেরা মানুষগো পিছামোড়া বাইন্ধা লইয়া যাইব।

    শুদাশুদি বাইন্ধা নিব ক্যান? আমাগো অপরাধখান কী?

    গরিব মাইনষের অপরাধ লাগে না, বাইন্ধা নিলেই হইল।

    ওধার থেকে গো-হাটার কাদের মিঞা হালকা গলায় রঙ্গ করে, আমার কী মনে লয় জানস? ম্যাজিস্টর সাবের পোলার লগে এছ.ডি.ও সাবের মাইয়ার শাদি হইব। হেই লেইগা আমাগো দাওয়াত করতে আইতে আছে।

    সবাই হেসে উঠল।

    হালকা এবং গম্ভীর, যত আলোচনাই চলুক, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের আসার উদ্দেশ্যটা বোঝা যাচ্ছে না। তাই হাটুরে মানুষগুলো ভীত, চিন্তিত, সন্ত্রস্ত হয়ে রইল। সন্দেহে সংশয়ে দুলতে লাগল।

    বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, সত্যি সত্যি একটু পর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা এসে পড়লেন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব খাস ইংরেজ, লাল টকটকে চেহারা। ছ’ফুটের বেশি লম্বা, প্রকান্ড বুকের পাটা, মাথায় হ্যাঁট। এস.ডি.ও সাহেব কিন্তু বিশুদ্ধ বঙ্গসন্তান। কিন্তু গায়ের রংটি বাদ দিলে কে বলবে তিনি বাঙালি! হ্যাঁট-কোট-প্যান্ট এবং চালচলন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের চাইতে তিন কাঠি ওপরে।

    ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবদের আগমনটি সত্যিই দর্শনীয়। সামনে এক অক্ষৌহিণী বন্দুকধারী পুলিশ, পেছনে আরেক অক্ষৌহিণী। দু’টো লম্বা লোক ম্যজিস্ট্রেট এবং এস.ডি.ও সাহেবের মাথায় ছাতা ধরে আছে।

    তারা এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোত্থেকে দুটো বড় বড় কারুকাজ-করা ভারি চেয়ার এসে পড়ল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবরা বসলেন। চারদিকের জনতা দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল।

    চেয়ারে বসেই এস.ডি.ও সাহেব ইশারায় হরিন্দকে কাছে ডাকলেন, তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু গলায় কী ফিসফিস করলেন। তারপরেই হরিন্দ লাফ দিয়ে ঢাকী দু’টোর কাছে গিয়ে হাওয়ায় হাত ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, বাজা ব্যাটারা, বাজা–

    কিছুক্ষণ বাজনার পর কাগা বগাকে থামিয়ে হরিন্দ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, হাটৈরা ভাইরা, এইবার এছ.ডি.ও ছাব আপনেগো কিছু কইবেন– বলে একধারে সরে গেল।

    এস.ডি.ও সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।

    কোথাও এতটুকু আওয়াজ নেই। বাতাস বুঝি থেমে গেছে। গাছের একটা পাতা খসলেও এখন তার শব্দ শোনা যাবে।

    গলায় খাকারি দিয়ে এস.ডি.ও সাহেব হঠাৎ শুরু করলেন, বন্ধুগণ, আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন যুদ্ধ লেগেছে—

    কেউ উত্তর দিল না। গলা লম্বা করে জনতা উদ্গ্রীব দাঁড়িয়ে আছে, তাদের চোখের পলক পড়ছে না।

    এস.ডি.ও সাহেব চারদিকের সারি সারি মানুষগুলের মুখের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর বলতে লাগলেন, যুদ্ধ আমাদের এই পূর্ব বাংলাতেও চলে আসতে পারে। তাই বলছিলাম, ঘর-সংসার এবং দেশ রক্ষা করবার জন্যে আপনারা দলে দলে সেনাদলে নাম লেখান।

    জনতার ভেতর গুঞ্জন উঠল, যুজ্যে যাইতে কয়। হায় আল্লা, উই কারবারে আমি নাই।

    আরেকজন কে বলল, যুজ্যে গিয়া মরি আর কি।

    অন্য একটি গলা শোনা গেল, লও যাই, মানে মানে অহন সইরা পড়ি।

    একটু থেমে এস.ডি.ও সাহেব খুব সম্ভব জনতার প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছিলেন। আবার তিনি শুরু করলেন, দেশের জন্যে, মাতৃভূমির জন্যে, নিজের ভাইবোন সন্তানদের জন্যে আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে, শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। নইলে সব কিছু ছারখার হয়ে যাবে। একটু ভেবে, আজই আপনাদের যুদ্ধে নাম লেখাতে হবে না, বাড়ি গিয়ে সবাই ভাবুন। আসছে হাটে আবার আমরা আসব। তার পরের হাটেও আসব। এখন থেকে প্রতি হাটেই আমরা আসব। আপনারা এর ভেতর ভেবেচিন্তে নিন। মনে রাখবেন, সেনাদলে এমনি এমনি নাম লেখাতে বলছি না। ভালই মাইনে পাবেন, পোশাক পাবেন, ভাল খেতে পাবেন। আমার কথা শেষ হল, এবার ম্যজিস্ট্রেট সাহেব আপনাদের কিছু বলবেন। বলে বসে পড়লেন তিনি।

    ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবার উঠে দাঁড়ালেন। বাংলাটা তিনি ভালই বোঝেন, কিন্তু তেমন বলতে পারেন না। ভাঙা ভাঙা যা বললেন তা এইরকম।

    বন্ধুগণ, আপনারা যুদ্ধে আসিলে টাকা পাইবে, অনেক সুখ হইবে। গভর্নমেন্টের খুব আনন্দ হইবে। ইত্যাদি ইত্যাদি–

    খাস ইংরেজের আড়ষ্ট জিভে জায়গা পেয়ে গর্বে বাংলা ভাষার বুক যেন দশ হাত ফুলে উঠল। একটু পর ম্যজিস্ট্রেট সাহেবরা চলে গেলেন।

    হাটুরে মানুষগুলো সেনাদলে নাম লেখাবার ব্যাপার নিয়ে সন্ত্রস্ত আলোচনা করতে করতে তামাক হাটা, মরিচ-হাটা, গো-হাটার দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

    বিনুরা তখনও দাঁড়িয়ে ছিল।

    উদ্বেগের গলায় হেমনাথ বললেন, যুদ্ধে রিক্রুটমেন্টের জন্যে ম্যাজিস্ট্রেট, এস.ডি.ও পর্যন্ত ছুটে এসেছে। অবস্থা খুব ভাল না অবনীমোহন।

    .

    ২.২০

    জষ্ঠির শেষাশেষি সেই যে বৃষ্টি নেমেছিল, এখনও তার থামবার নাম নেই। মনে হয়, দু’এক দিন নয়, দু’চার মাসও নয়, অনাদি অনন্তকাল ধরে ঝরছেই। ঘন কালো মেঘে আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে

    আছে। বৃষ্টির লক্ষ কোটি ধূসর ধারায় চরাচর ঝাঁপসা, বর্ণহীন, বিস্বাদ।

    ঘরের জানালায় বসে আকাশ দেখতে দেখতে বিনুর মনে হয়, কোনওদিন আর বেরুতে পারবে না, আর কখনও রৌদ্রোজ্জ্বল ঝকমকে দিনের মুখ দেখতে পাবে না। এই ঘরটুকুর মধ্যেই চিরকাল বন্দি হয়ে থাকতে হবে। অথচ ঘরে থেকে থেকে তার প্রাণ অস্থির হয়ে উঠেছে।

    জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিনুর মনে হয়, জলের গন্ধ, ভেজা মাটির গন্ধ, গাছপালার গন্ধ চুঁইয়ে চুঁইয়ে তার বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে এবং সেখানে বিচিত্র এক বিষাদ গাঢ় করে তুলছে। খুব খারাপ লাগে বিনুর, খুব খারাপ লাগে।

    তাকে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ঝিনুক কখনও কখনও কাছে এসে দাঁড়ায়। অন্যমনস্কের মতো বিনু বলে, বৃষ্টি বোধহয় আর থামবে না।

    ঝিনুক বলে, থামবে না, তোমায় বলেছে।

    আবার রোদ উঠবে?

    উঠবে।

    কবে?

    বর্ষা গেলেই।

    যেদিন সকালের দিকে জোর বৃষ্টি নামে সেদিন আর স্কুলে যেতে পারে না বিনু। অল্প বৃষ্টি থাকলে অবশ্য ছাতা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

    এই বর্ষার সময়টা প্রায়ই স্কুল কামাই হচ্ছে। সারাদিন বাড়িতে আটকে থেকে পরিচিত মানুষগুলোকে বার বার, হাজার বার দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ে বিনু। সন্ধের সময় ইচু মন্ডলরা জলে ভিজে ভিজে যখন যুদ্ধের খবর শুনতে আসে, সেই সময়টা মোটামুটি উন্মাদনার মধ্যে কেটে যায়।

    রোজই খবরকাগজ নতুন নতুন উত্তেজনা নিয়ে আসে। যুদ্ধের তান্ডব ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত তার অশুভ ভয়াবহ ছায়া পড়ছে। বর্ষার অনড় মেঘের মতো দুই গোলার্ধকে কী এক অভিশাপ যেন ঢেকে ফেলেছে।

    যুদ্ধের খবরের মধ্যে একদিন অবনীমোহন পড়ে শোনালেন, রবীন্দ্রনাথ খুব অসুস্থ। তারপর আরেক দিন পড়লেন তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

    দিনের পর দিন যেতে লাগল।

    .

    সেদিন অল্প অল্প বৃষ্টির ভেতর স্কুলে গেল বিনু। দু’টো ক্লাস হবার পর হঠাৎ থার্ড পিরিয়ডে হেড মাস্টার মোতাহর সাহেব এলেন। অবোধ বালকের মতো তিনি কাঁদছেন। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন রবীন্দ্রনাথ আর নেই। আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি কী ছিলেন, কত বিরাট, কত বিপুল, আজ বুঝতে পারবে না। বড় হয়ে তাকে বুঝতে চেষ্ট করো। যাও, আস্তে আস্তে বাড়ি চলে যাও।

    বাড়ি ফিরে বিনু দেখতে পেল, সমস্ত বাড়িটা যেন শোকাচ্ছন্ন, নিস্তব্ধ। পুবের ঘরের ঢাকা বারান্দায় অবনীমোহন আর হেমনাথ বসে ছিলেন। খুব চাপা গলায় ফিসফিস করে কী বলাবলি করছিলেন।

    কাছে যেতে হেমনাথের গলা বিনুর কানে এল, পৃথিবী জোড়া অন্ধকারে ওই একটুখানি আলো ছিল, তাও নিবে গেল।

    বিনু বুঝতে পারল, রবীন্দ্রনাথের কথাই হচ্ছে।

    রবীন্দ্রনাথ কত বড়, কত বিশাল, কত মহৎ–বিনুর জানা নেই। তবু পাষাণভারের মতো কী যেন তার বুকের ভেতর নিশ্চল হয়ে রইল। শ্বাসটা আটকে আসতে লাগল যেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.