Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ২.২১-২৫ গত বছর পুজোর ছুটির পর

    ২.২১

    গত বছর পুজোর ছুটির পর সেই যে হিরণ ঢাকায় গিয়েছিল, সেই থেকে তার আর খোঁজখবর ছিল না।

    হিরণ যাবার পর তাকে নিয়ে এ বাড়িতে আলোচনা কম হয়নি।

    একদিন হেমনাথ বলেছিলেন, বাঁদরটা ওইরকম। কাছে থাকলে দিনরাত মাখামাখি, যেই চোখের আড়াল হল অমনি সব ভুলে গেল।

    সেদিনই সন্ধেবেলায় সুধা-সুনীতি-বিনু, তিন-ভাই-বোন পড়তে বসেছিল। চারদিক দেখে নিয়ে নিচু গলায় সুনীতি সুধাকে বলেছিল, দাদু হিরণচন্দর সম্বন্ধে তখন কী বলছিল শুনেছিস তো? এমন মানুষকে মন দিলি ভাই, একবার খোঁজও নেয় না।

    সুধা ঠোঁট উলটে দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিল, খোঁজ নেয় না বলে তো আমি একেবারে মরে গেছি।

    গেছিসই তো—

    তোকে বলেছি?

    না বললে কি। তোর মুখ দেখে বুঝতে পারি না, ভেবেছিস?

    ও বাবা– সুধা গালে হাত রেখে বলেছিল, কবে থেকে অন্তর্যামী হলি রে দিদি!

    সুনীতি বলেছিল, যেদিন হিরণচন্দরের সঙ্গে তোর আলাপ হয়েছে সেদিন থেকে একটু চুপ। তারপর সুনীতিই আবার শুরু করেছিল, ওই ভদ্রলোকটি কিন্তু বেশ। কলকাতা থেকে ঠিক চিঠিপত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

    সুধা মুখ টিপে হেসেছিল, তোর কথাই আলাদা। মনের মতো মনের মানুষ পেয়েছিস।

    তোরটা বুঝি মনের মতো নয়?

    বিচ্ছিরি।

    আয় তা হলে বদলা বদলি করে নিই।

    বদলা বদলির দরকার নেই। দুটোকেই তুই নিয়ে নে—

    মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সুনীতির। ঝঙ্কার দিয়ে বলেছিল, তুই ভারি অসভ্য হয়ে উঠেছিস সুধা।

    সুধা উত্তর দেয়নি, হেসে সে গড়িয়ে পড়েছিল।

    .

    বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ দুপুরবেলা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঢাকা থেকে আজ হিরণ এসে হাজির। পুবের ঘরে সুধা-সুনীতি-বিনু আর হেমনাথ বসে ছিলেন। হিরণকে দেখে হেমনাথ প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, আরে কালাচাঁদ যে, আয় আয়

    হিরণ ছাতা নিয়ে এসেছিল। ছাতাটা মুড়ে বাইরে রেখে ভেতরে এসে বসল।

    হেমনাথ আবার বললেন, কী ব্যাপার, এতদিন খবর নেই বার্তা নেই, একবার আসিসও নি। ঢাকায় বসে কী করছিলি?

    হিরণ খুব গম্ভীর গলায় বলল, সরস্বতীর আরাধনা।

    হেমনাথ ভ্রকুটি হানলেন, তার মানে?

    তার মানে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। মাসে মাসে আমার পেছনে কতগুলো করে টাকা ঢালছ, খেয়াল আছে?

    হেমনাথ কিছু না বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকলেন।

    হিরণ বলল, অন্তত একটা ফার্স্ট ক্লাস যদি না পাই, তুমি আমাকে আস্ত রাখবে?

    হেমনাথ হেসে ফেললেন, তা রাখব না। শুধু কি তাই, এখানকার কলেজে চাকরিও দেব না।

    তা হলেই বুঝে দেখ, ঢাকা থেকে হুট হুট ছুটে আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

    না-ই বা এলি, মাঝে মাঝে চিঠি লিখলেও পারিস তো।

    চিঠি লেখা আমার কোষ্ঠীতে নেই, তা তো তুমি জানোই।

    তোর কোষ্ঠীতে নেই। এদিকে আরেক জনের দিকে যে তাকানো যায় না। মুখে সব সময় মেঘ জমে আছে।

    কার?

    আঙুল বাড়িয়ে সুধাকে দেখিয়ে দিলেন হেমনাথ। হিরণ-সুধা বা সুনীতি-আনন্দর মধ্যে যে হৃদয়রাগের খেলা চলছে এ বাড়িতে তা বিশেষ গোপন নেই। এ ব্যাপারে হেমনাথদের কিছু প্রশ্রয়ও আছে। তাদের স্নেহের ছায়ায় চারটি উন্মুখ তরুণ মনে উৎসব শুরু হয়ে গেছে যেন।

    হাত-পা নেড়ে একেবারে চেঁচামেচি জুড়ে দিল সুধা, আহা-হা, আহা-হা—

    এই সময়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন হেমনাথ। রসালো সুর টেনে টেনে বললেন, আহা আহা করিস লো সই। বলেই হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গান ধরলেন:

    নয়ন-নীরে কি নেভে মনের অনল,
    সাগরে প্রবেশি যদি না হয় শীতল।
    তৃষার চাতকী মরে, অন্য বারি নাহি হেরে,
    ধারাজল বিনে তার সকলই বিফল।
    যবে তারে হেরে সখি, হরিষে বরিষে আঁখি,
    সেই নীরে নিভে সখি অনল প্রবল।

    সুধা লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। আরক্ত মুখে বলল, এরকম করলে আমি কিন্তু চলে যাব দাদু–

    হাত ধরে সুধাকে তক্তপোষে বসিয়ে দিতে দিতে হেমনাথ বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, এই গান থামিয়ে দিলাম। তোরা গল্পটল্প কর। আমাকে বেরুতে হবে। হিরণ, তুই এখানে খেয়ে যাবি। হোম ডিপার্টমেন্টে বলে যাচ্ছি।

    হিরণ ঘাড় হেলিয়ে জানালো, খেয়েই যাবে।

    বেরিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কী মনে পড়ায় দাঁড়িয়ে পড়লেন হেমনাথ। হিরণের চোখে চোখ রেখে বললেন, হ্যাঁ রে–

    কী বলছ?

    পুজো তো এসে গেল।

    হ্যাঁ।

    গেল বারের মতো এবারও নাটক টাটক করবি তো?

    হিরণ বলল, এবার পুজোর ছুটিতে আমি আসছি। ঢাকাতেই থাকব।

    একটু অবাক হলেন হেমনাথ, কেন রে?

    ছুটির পর কতটুকু আর সময় পাওয়া যাবে। তারপরই পরীক্ষা–

    তাই তো, আমার খেয়াল ছিল না। না না, ছুটিতে তোর আসার দরকার নেই। পরীক্ষা আগে, জীবনে ফুর্তি করার ঢের সময় পাওয়া যাবে। আচ্ছা এখন যাই।

    হেমনাথ বেরিয়ে যাবার পর মুখ নিচু করে নিঃশব্দে নখ দিয়ে তক্তপোষে আঁকিবুকি কাটতে লাগল সুধা। হিরণের সঙ্গে কথা টথা যা বলবার, সুনীতিই বলল। তার এতদিন ডুব দিয়ে থাকা নিয়ে ঠাট্টা করল, প্রাণ খুলে হাসির ফোয়ারা ছোটাল। তারপর একসময় কাজের ছল করে উঠে গেল।

    এখন ঘরের ভেতর ওরা তিনজন। সুধা হিরণ আর বিনু। বিনু জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। আকাশ জুড়ে শুধু মেঘ, চরাচর আচ্ছন্ন করে ধূসর রেখায় বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে। ধানখেতের দিক থেকে হঠাৎ হঠাৎ দমকা বাতাস ছুটে আসে, বাগানের সুপুরি গাছগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ে। জামরুল আর কালোজাম গাছ দুটো পরস্পরের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস গলায় কী পরামর্শ করতে থাকে।

    অনেকক্ষণ নীরবতার পর হিরণই প্রথম কথা বলল, কেমন আছ সুধা?

    সুধা উত্তর দিল না।

    হিরণ আবার বলল, খুব রাগ করে রয়েছ, না?

    এবার সুধা ভারী গলায় উত্তর দিল, না। খুশিতে–

    খুশিতে কী?

    ডগমগ হয়ে আছি।

    সত্যি খুব অন্যায় হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে এক-আধবার রাজদিয়াতে আসা উচিত ছিল। কিন্তু এমন অভ্যেস আমার–

    খুব খারাপ অভ্যেস’ এতক্ষণ সুধার গলা ভারী ছিল, এবার কাঁপতে লাগল, মরে গেছি কি বেঁচে আছি, খোঁজ নেওয়ার দরকার মনে করেন না? ওদিকে জানেন–

    কী?

    আনন্দদা সপ্তায় দুটো করে চিঠি লেখে দিদিকে—

    আনন্দবাবু লেখে দু’টো করে। ঢাকায় গিয়ে এবার থেকে আমি চারটে করে লিখব–

    ইয়ার্কি হচ্ছে?

    না না– হিরণ কিন্তু ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তুমি দেখে নিও–

    সুধা ভয় পেয়ে গেল যেন, দোহাই আপনার, অত চিঠি লিখবেন না। দিদি তা হলে আমাকে খেপিয়ে মারবে। মাঝে মাঝে এক-আধটা লিখলেই আমি খুশি–

    কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল হিরণ, হঠাৎ কিছু ভেবে গলা নামিয়ে বলল, এই সুধা–

    কী বলছেন?

    আমরা তো খুব প্রাণের কথা চালিয়ে যাচ্ছি। ওদিকে—

    ওদিকে কী?

    ঘরের ভেতর বিনু রয়েছে না?

    এক পলক বিনুকে দেখে নিয়ে সুধা বলল, ওটা একটা হাবা গঙ্গারাম। জানালার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টিই দেখছে, আমাদের কথা কানেও যাচ্ছে না। ভারি অন্যমনস্ক ছেলে

    হাবা গঙ্গারামটির চোখ অবশ্যই জানালার বাইরে ছিল, কিন্তু ধ্যানজ্ঞান ছিল ঘরের ভেতরে। কান খাড়া করে হিরণদের প্রতিটি কথা শুনে যাচ্ছিল বিনু।

    সুধা বলা সত্ত্বেও সন্দেহ গেল না হিরণের। সংশয়ের গলায় বলল, যদি শুনে থাকে

    সুধা বলল, কিচ্ছু শোনেনি, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। কিরকম অন্যমনস্ক দেখবেন? বলেই ডাকল, অ্যাই বিনু–

    বিনু প্রথমটা সাড়া দিল না। বৃষ্টির লম্বা লম্বা ধূসর রেখাগুলি এবং তাদের একটানা ঝমঝম শব্দ ছাড়া জগতের আর কোনও দিকে তার বিন্দুমাত্র মনোযোগ আছে বলে মনে হল না।

    সুধা আবার ডাকল। বারকয়েক ডাকাডাকির পর চমকে ওঠার ভঙ্গি করে বিনু ঘুরে দাঁড়াল, কী বলছিস?

    কী করছিস, জিজ্ঞেস করছিলাম—

    বৃষ্টি দেখছি।

    আমি তোকে ক’বার ডেকেছি বল তো?

    এই তো একবার।

    আমরা কী বলছিলাম, শুনেছিস?

    না তো—

    ঠিক আছে, তুই বৃষ্টি দ্যাখ—

    বিনু আবার জানালার বাইরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকাল।

    আর সুধা হিরণকে বলল, দেখলেন তো?

    হাতেনাতে এত বড় প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও বিনু সম্পর্কে সতর্ক হয়ে রইল হিরণ। যতখানি সম্ভব গলাটা অতলে নামিয়ে সে ফিসফিস করতে লাগল। সঙ্গগুণেই কিনা কে জানে, সুধাও গলা নামাল।

    আর জল-বাংলার ক্লান্তিহীন বর্ষণ দেখতে দেখতে উৎকর্ণ বিনু ঘরের ভেতর দুটি অন্তরঙ্গ গাঢ় গলার ফিসফিসানি শুনতে লাগল।

    .

    ২.২২

    দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল।

    এই সেদিনও আকাশ জুড়ে কালোলা মেঘ অনড় হয়ে ছিল। এখনও মেঘ আছে, তবে রং গেছে বদলে।

    সারা বর্ষার জলে ধুয়ে আকাশখানি এখন আশ্চর্য নীল। এত চকচকে, এত ঝকমকে যে মনে হয় এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত পর্যন্ত একখানা নীল আয়না কেউ টাঙিয়ে রেখেছে। তার গায়ে থোকা থোকা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।

    আশ্বিন মাস পড়তেই খাল-বিল আর নদীপাড়ের কাশবন সাদা হয়ে গেছে। হিজল গাছগুলোর পাতা দেখা যায় না, শুধু ফুল আর ফুল।

    বর্ষার সময়টা এই জল-বাংলা থেকে সব পাখি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। দিন-রাত একটানা বৃষ্টির ভেতর তারা বেরোয় কী করে? আশ্বিনের শুরুতে যেই বৃষ্টি থামল, মেঘ কেটে ঝলমলে সোনালি রোদ দেখা দিল, অমনি নিরুদ্দেশ পাখির ঝাঁক রাজদিয়ার আকাশে ফিরে আসতে লাগল। দিবানিশি তাদের কিচিরমিচিরে চারদিক এখন মুখর। আর এসেছে পতঙ্গেরা-ফড়িং, প্রজাপতি, নানরকম পোকা।

    পুকুর, ধানখেত, দূরের মাঠ, মাঠের মাঝখানে ছোট ছোট কৃষাণ গ্রাম–বর্ষায় সব ভেসে গিয়েছিল। মাঠের জল, ধানখেতের জল, খালবিলের জল, সব জায়গায় জল এখন স্থির। কৃষাণ গ্রামগুলোকে আজকাল দ্বীপের মতো দেখায়। দূরে দূরে মাঠের মাঝখানে ভেসাল জাল পাতা। ভেসালের বাঁশে শঙ্খচিল কি কানি বক ধ্যানস্থ হয়ে বসে থাকে। নিস্তরঙ্গ জলে ধানগাছের ছায়া, মুত্রার ছায়া, নলঘাস এবং ধঞ্চের ছায়া সারাদিন স্থির হয়ে থাকে। শুধু উড়ন্ত পাখিদের ছায়া দুলতে দুলতে ধু ধু দিগন্তের দিকে চলে যায়।

    ক’টা মাস একটানা বর্ষায় স্যাঁতসেঁতে, সিক্ত থাকার পর রোদে-বাতাসে-আলোয় এবং উত্তাপে জল-বাংলা আবার যেন সজীব, প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।

    হেমনাথ আর অবনীমোহন এবার জমিতে আউশ ধান দিয়েছিলেন, পাটও রুয়েছিলেন। শ্রাবণের শেষাশেষি আউশ উঠে গেছে। বর্ষায় পাট জাগ দিয়ে রাখা হয়েছিল। কামলারা এখন বার-বাড়ির বাগানে বসে পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছে।

    জমিজমা নিয়ে একেবারে মেতে উঠেছেন অবনীমোহন। দিনরাত ধান-পাট, কামলাকৃষাণ, এসব নিয়েই আছেন। কে বলবে, মাত্র ক’মাস আগে জমি কিনেছেন! দেখেশুনে তো মনে হয়, চাষবাসই তাঁর জীবনের সারাৎসার, নিরবধি কাল ধরে এই কাজই করে যাচ্ছেন।

    খরার দিনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জমি চৌরস করিয়েছেন অবনীমোহন। বর্ষায় নতুন জল এলে বীজ বুনিয়েছেন। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আউশ ধান আর পাট কাটিয়েছেন। এখন যে পচা পাট থেকে আঁশ ছাড়ানো হচ্ছে, তাও সারাদিন সামনে বসে থাকেন। চাষবাসের জীবন তাকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন। করে রেখেছে।

    ধান-পাট ছাড়া আর কিছুই আজকাল ভাবতে পারেন না অবনীমোহন। অন্য কোনও দিকে মনেযোগ দেবার মতো যথেষ্ট সময়ও তার নেই।

    হেমনাথ কিন্তু তার নিজস্ব নিয়মেই চলছেন। বাড়ি থেকে একবার বেরুতে না পারলে তার ঘুমই হয় না। এই রাজদিয়া কিংবা আশেপাশের গ্রামগঞ্জগুলোর খোঁজ নেওয়া চাই-ই। জষ্টির পর থেকে এত যে বর্ষা, এত যে জল, তবু তাকে কেউ বাড়িতে আটকে রাখতে পারেনি, ছাতাটি মাথায় দিয়ে ঠিক বেরিয়ে পড়েছেন।

    আশ্বিন মাস পড়বার পর একদিন দুপুরবেলা কোত্থেকে বাড়ি ফিরে হেমনাথ বললেন, পুজোর ছুটি পড়ে গেছে। আজকের স্টিমারে কলকাতা থেকে রাজেন গুহর ছেলে-বৌ এল।

    স্নেহলতা বললেন, কে, অশোক?

    হ্যাঁ।

    গুহবাড়ির ছেলে তো এল। অন্য বাড়ির কেউ আসেনি?

    এখনও আসেনি। দু’একদিনের ভেতর এসে পড়বে।

    পুজোর ছুটি পড়তেই গৃহকোণলোভী প্রবাসী সন্তানেরা ফিরে আসতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে রাজদিয়া ভরে যাবে। এখানকার মৃদু, স্তিমিত, বেগবর্ণহীন জীবন সরগরম হয়ে উঠবে।

    একেক দিন একেক জনের খবর নিয়ে আসেন হেমনাথ। কোনওদিন এসে বলেন, আজ মল্লিকবাড়ির সবরাজরা এল। কোনওদিন বলেন, আজ নাহাবাড়ির প্রাণকান্তরা এল। কোনওদিন বলেন, আজ রুদ্রবাড়ির মহিমরা এল।

    হেমনাথ যখন খবর নিয়ে আসেন, সুধা-সুনীতি-বিরা অসীম আগ্রহে কাছে এসে দাঁড়ায়।

    একেক দিন একেক জনের কথা বলেন হেমনাথ, কিন্তু ঝুমাদের সম্বন্ধে কিছুই বলেন না।

    এই নিয়ে সুধা সুনীতি চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে। সুধা বলে, কিরে দিদি—

    সুনীতি বলে, কী?

    দাদু শিশির মামাদের কথা একবারও তো বলছেন না।

    ওঁরা আসেননি, তাই বলছেন না।

    ওঁরা এলে—

    এলে কী?

    আনন্দদাও আসবে।

    তার কি কিছু ঠিক আছে?

    চোখ ঘুরিয়ে সুধা বলে, আসবে রে, আসবে। তুই এখানে পড়ে আছিস, চিঠিতে কত আর মনের কথা লেখা যায়! বিধুমুখ দেখতে না পেলে

    তার পিঠে দুম করে এক কিল বসিয়ে সুনীতি বলে, খুব ফাজলামি শিখেছিস! পিঠ বাঁকিয়ে খানিকক্ষণ উ-উ-উ” করে সুধা। তারপর ঘন গলায় বলে, আনন্দদা এলে বেশ হয়, না?

    সুনীতি বলে, জানি না, যা–

    পুজোর সপ্তাখানেক আগে একদিন বিকেলবেলা বাড়ি ফিরে হেমনাথ চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন, কই গো, কোথায় গেলে সব

    সবাই ছুটে এল। স্নেহলতা বললেন, কী হয়েছে, অত চিৎকার করছ কেন?

    হেমনাথ বললেন, খুব খারাপ খবর।

    উদ্বিগ্ন মুখে স্নেহলতা শুধোলেন, কী?

    আজ রামকেশবের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও কী বললেন জানো?

    কী?

    শিশিররা এবার পুজোর দেশে আসছে না।

    কেন?

    শিশিরের বড় মেয়ে রুমার খুব অসুখ। ডাক্তার নড়াচড়া করতে বারণ করেছে। তাই—

    স্নেহলতা বললেন, কী অসুখ?

    হেমনাথ বললেন, টাইফয়েডের মতো–

    সত্যিই খুব খারাপ খবর। হিরণটা পরীক্ষার জন্য আসতে পারবে না, শিশিররা আসবে না। এবারকার পুজোয় তেমন আনন্দ হবে না।

    একধারে সুধা সুনীতি দাঁড়িয়ে ছিল। সুধা চাপা গলায় বলল, এই দিদি, তোর মুখটা অমন কালো হয়ে গেল কেন রে?

    শিশিররা আসবে না শুনে সুনীতির মুখখানা সত্যিই ভারি করুণ হয়ে গিয়েছিল। সুধার কথায় হাসবার চেষ্টা করল সে, কোথায় কালো হয়েছে?

    সুধা বলল, আমাকে তুই ফাঁকি দিতে চাস দিদি?

    সুনীতি উত্তর দিল না।

    একটু চুপ করে থেকে ভারী গলায় সুধা বলল, একজন ঢাকা থেকে রাজদিয়া আসতে পারবে না, আরেক জন কলকাতায় পড়ে থাকবে। না আসুক গে–

    সেদিনই রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঝুমার কথা ভাবছিল বিনু। আগের বছর পুজোর সময় তার সঙ্গে নৌকোয় করে ভাসতে ভাসতে মাঠের মাঝখানে চলে গিয়েছিল। সেখানে কাউ ফল পাড়তে গিয়ে পড়েছিল অথৈ জলে। ডুবেই যেত, ঝুমাই সেদিন তাকে নৌকোয় টেনে তুলেছিল।

    শুধু কি তাই, ঝুমার পাশে বসে থিয়েটার দেখেছে। ঝাঁপসা রহস্যময় জ্যোৎস্নায় যুগলের নৌকোয় উঠে সুজনগঞ্জে যাত্রা শুনতে গেছে। নিশিন্দার চরে গেছে চড়ুইভাতি করতে। দুঃসাহসী মেয়েটার অসংখ্য স্মৃতি নানা দিক থেকে বিনুর চারপাশে ভিড় করে আসতে লাগল।

    হঠাৎ ঝিনুক ডাকল, বিনুদা—

    বিনু চমকে উঠল, কী বলছ?

    ঝুমারা এবার আসবে না।

    হুঁ।

    এবার থিয়েটারের সময় তোমার জন্যে আমি জায়গা রাখব।

    অন্যমনস্কের মতো বিনু বলল, হুঁ–

    ঝিনুক আবার বলল, সুজনগঞ্জের হাটে রাত্রিবেলা নৌকোয় করে যাত্রা শুনতে যাব।

    হুঁ—

    .

    হিরণ আসেনি, শিশিররা আসেন নি। তবু পুজোর সমারোহ কম হল না। অন্যবারের মতো এবারও ধুনুচি-নাচের, ঢাকের বাজনার প্রতিযোগিতা হল, নাটক হল, যাত্রা হল, ভাসান গান হল, জারি সারিকাঁচ নাচের আসর বসল, একদিন ধুমধাম করে বাইচ খেলাও হয়ে গেল।

    নিয়মমতো সবই হল, কিন্তু মানুষের মন এবার বড় অস্থির, বড় চঞ্চল। পুজোমন্ডপে, জারি সারি-ভাসান গান কি যাত্রার আসরে–সর্বত্রই এক কথা, এক আলোচনা।

    যুজ্যু লাগছে, কী যে হইব!

    এইবার আর রক্ষা নাই।

    জিনিসপত্তরের দাম যা চড়তে আছে হেইতে আর বাচতে হইব না।

    জিনিসপত্তর আর পাইবা নিকি, বাজার থিকা চাউল ডাইল হগল উধাও হইয়া যাইতে আছে। ট্যাকা যার আছে হেও না খাইয়া মরব, যার নাই হে তো মরবই।

    কলকাতা-প্রবাসী কেউ কাছাকাছি থাকলে আলোচনাটা আরও জমে ওঠে। কালকাতার মানুষ অনেক বেশি জানে-শোনে, অনেক বেশি খবর রাখে। তারা যুদ্ধ সম্বন্ধে এমন এমন সব কথা বলে যাতে ভয়ে, আতঙ্কে রাজদিয়াবাসীদের বুকের ভেতর শ্বাস আটকে যায়।

    মোট কথা, সবাই আশঙ্কা করে আছে, কিছু একটা ঘটবে। নিদারুণ, বিপজ্জনক, অনিবার্য কিছু। সারা দেশ, সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ড জুড়ে তারই আয়োজন চলছে। রাজদিয়াবাসীরা ভাবে, যুদ্ধ যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে, এই রাজদিয়ারও নিস্তার নেই।

    দুর্গাপুজোর পর লক্ষ্মীপুজো। তারপর রাজদিয়া আবার ফাঁকা হয়ে গেল। একে একে কলকাতার চাকুরেরা ফিরে যেতে লাগল। ক্ষণিকের জন্য রাজদিয়া উৎসবে, উচ্ছাসে মুখর হয়ে উঠেছিল, তার পর আবার স্তিমিত, নিরুচ্ছ্বাস, বর্ণহীন দিন নেমে আসতে লাগল।

    লক্ষ্মীপুজোর পর কালীপুজো।

    কালীপুজোর রাত্তিরে একটা মজার ঘটনা ঘটল। মজার এবং বিস্ময়েরও।

    রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে বিনু আর ঝিনুক হেমনাথের ঘরে শুতে আসছিল। স্নেহলতা ঝিনুককে ডাকলেন।

    ঝিনুক দাঁড়িয়ে পড়ল, কী বলছ?

    স্নেহলতা তার কথার উত্তর না দিয়ে বিনুকে বললেন, তুই শুতে চলে যা দাদাভাই—

    বিনু বলল, ঝিনুক যাবে না?

    না।

    ঝিনুক এইসময় চেঁচিয়ে উঠল, বা রে, আমার বুঝি ঘুম পায় না!

    স্নেহলতা বললেন, ঘুম পেয়েছে তো আমার বিছানায় শুয়ে থাক গে—

    ঝিনুক অবাক, তোমার বিছানায় শোব কেন?

    আজ থেকে আমার কাছেই শুবি।

    না না, দাদুর কাছে যোব, বিনুদাদার কাছে শোব–ঝিনুক হাত-পা ছুঁড়তে লাগল।

    বড় বড় চোখ পাকিয়ে স্নেহলতা বললেন, যা বলছি তাই কর। যাও আমার বিছানায়।

    স্নেহলতার এ চেহারা আগে আর কখনও দেখে নি ঝিনুক, এমন কণ্ঠস্বর শোনেনি। নিমেষে তার হাত-পা ছোঁড়া বন্ধ হল, কিন্তু জেদটা একেবারে গেল না। ঘাড় বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল সে, আর সমানে বলতে লাগল, কেন ওদের কাছে পোব না, কেন?

    খুব শান্ত গলায় স্নেহলতা এবার বললেন, তুমি এখন বড় হয়ে গেছ, তাই—

    ঝিনুক বিহুলের মতো প্রতিধ্বনি করল, বড় হয়ে গেছি! বলে নিজের দিকে তাকাল, তাকিয়েই রইল।

    স্নেহলতা বললেন, হ্যাঁ।

    ঝিনুক কী বুঝল, কে জানে। আর কিছুই বলল না।

    আর বিমূঢ় বিনু অবাক চোখে ঝিনুককে দেখতে লাগল। গেল বার পুজোর সময় তারা রাজদিয়া এসেছে। এবার আরেক পুজো গেল। এক বছরের ভেতর কখন, কোন ফাঁকে মেয়েটা বড় হয়ে। গেছে, সে ভেবেই পেল না।

    খানিক তাকিয়ে থেকে একসময় একাই হেমনাথের ঘরে চলে গেল বিনু।

    .

    ২.২৩

    পুজোর ছুটির পর স্কুল খুলল। মাঝখানে মোটে দেড়টি মাস, তারপরেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা।

    সারা রাজদিয়া জুড়ে এখন পড়ার মরশুম চলছে। আজকাল যে বাড়িতেই যাওয়া যাক, সকাল সন্ধে কচি কচি গলায় একটানা বিচিত্র সুর কানে আসে, থ্রি সাইডস অফ এ ট্রাঙ্গেল’ অথবা জলস্পর্শ করবো না আর চিতোর রানার পণ, বঁদির কেল্লা মাটির পরে থাকবে যতক্ষণ। ইত্যাদি ইত্যাদি। জিরান্ড, ভার্বেল নাউন, বহুব্রীহি সমাস, জ্যামিতির কঠিন কঠিন উপপাদ্য, অ্যালজেব্রার ফরমুলাগুলো রাজদিয়া জুড়ে রাজত্ব করে চলেছে।

    একদিন সন্ধেবেলা দক্ষিণের ঘরে বিনুরা পড়তে বসেছে। বাইরের বারান্দায় অবনীমোহন, হেমনাথ খবরের কাগজ নিয়ে আসর জমিয়েছেন। ইচু মন্ডল, ইসমাইল চৌকিদার, কুমোরপাড়ার হাচাই পাল, বুধাই পাল–এমনি অনেকে ঘন হয়ে বসে নিঃশ্বাস বন্ধ করে যুদ্ধের খবর শুনছে।

    হঠাৎ বাগানের দিক থেকে রাজদিয়া স্কুলের অ্যাসিস্টান্ট হেডমাস্টার আশু দত্তর গলা ভেসে এল, হেমদাদা আছেন?

    পড়তে বসেই দুলুনি শুরু হয়ে গিয়েছিল বিনুর, চোখ বুজে আসছিল। বার বার বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ছিল সে।

    আশু দত্তর গলা কানে আসতেই ঝিমুনি ছুটে গেল। খাড়া হয়ে বসে শেষ পর্দায় গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বিনু পড়তে লাগল, আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকায় পিগমি নামক জাতি বাস করে। ইহারা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র মানব, মাত্র চার ফুট দীর্ঘ। এই অঞ্চলের তীব্র সূর্যতাপের জন্য–

    চোখ বইয়ের পাতায় আছে ঠিকই, কিন্তু কান রয়েছে বাইরে। ওদিকে হেমনাথ বারান্দা থেকে সাড়া দিয়েছেন, আছি। কে, আশু?

    হ্যাঁ।

    আয়, আয়–

    আশু দত্ত এলে একটা জলচৌকিতে তাকে বসানো হল। হেমনাথ বললেন, কী ব্যাপার আশু, হঠাৎ রাত্রিবেলা কী মনে করে?

    আশু দত্ত বললেন, একটু খোঁজখবর নিতে এলাম।

    কিসের?

    আপনার না, আমার ছাত্রের।

    মানে বিনুর?

    আজ্ঞে হ্যাঁ।

    জিজ্ঞাসু সুরে হেমনাথ বললেন, বিনু তো ভালই আছে। ওই যে পড়ছে। কিন্তু–

    আশু দত্ত হেসে বললেন, ভাবনার কিছু নেই। আমি পড়াশোনারই খোঁজ নিতে এসেছি। বুঝতেই তো পারছেন, অ্যানুয়াল পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই। ছেলেগুলো পড়ছে কি ঘুমাচ্ছে, দেখতে হবে না?

    হেমনাথ হেসে ফেললেন, তা তো ঠিকই। বিনুকে ডাকব?

    ডাকতে হবে না, আমিই ঘরে যাচ্ছি।

    যা—

    আশু দত্ত ঘরের ভেতর এলেন। গলার স্বর আরেক পর্দা চড়িয়ে দিল বিনু।

    আশু দত্ত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পড়া শুনলেন। তারপর ডাকলেন, বিনয়—

    স্কুলে বিনয় নামটাই চালু। বিনু বই থেকে মুখ তুলে বলল, আজ্ঞে—

    পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?

    রাজদিয়া ঘোট জায়গা। এখানে সবাই সবাইকে চেনে। সুধা সুনীতির সঙ্গে আগেই আশু দত্তর পরিচয় হয়েছিল।

    সুধাটা চিরকালই বিভীষণ। সে বলল, কোথায় পড়া, এই তো একটু আগে ঢুলছিল।

    কটমট করে সুধাকে একবার দেখে নিয়ে মিনমিনে গলায় বিনু বলল, ঢুলছিলাম না স্যার।

    আশু দত্ত বললেন, মন দিয়ে পড়। ইংরেজি র‍্যাপিড রিডার আর গ্রামার কিন্তু তোমার ঠিকমতো তৈরি হয়নি। ওগুলো দেখে রাখবে।

    রাখব স্যার।

    মুখে বললে হবে না, কাজে দেখাতে হবে। পড়ায় ফাঁকি দিচ্ছ কিনা, সেটা দেখতে আমি আবার আসব।

    কবে আসবেন?

    তা কি বলে আসব? যে কোনও দিন আসতে পারি।

    আশু দত্ত ঘরের বাইরে যেতে হেমনাথ বললেন, বোস, চা খাবি?

    আশু দত্ত অবাক, আপনার বাড়িতে চা ঢুকেছে নাকি!

    হেমনাথ হাসলেন, জামাইয়ের চায়ের অভ্যাস। চা না ঢুকিয়ে কী করি বল।

    তা হলে খেয়েই যাই।

    একটু পরে চা এল। খেয়েই উঠে পড়লেন আশু দত্ত।

    হেমনাথ বললেন, এক্ষুনি যাবি? আরেকটু বোস না। খবরের কাগজ এসেছে, গরম গরম অনেক যুদ্ধের খবর আছে, শুনে যা।

    আমার বসবার সময় নেই হেমদাদা।

    কেন, তোমার কী এমন রাজকাজ?

    আর বলবেন না। লাহিড়ীবাড়ি যেতে হবে, মুন্সিবাড়ি যেতে হবে, রুদ্রদের বাড়ি যেতে হবে।

    কেন?

    ওদের বাড়ির ছেলেরা পড়ায় বড্ড ফাঁকি দেয়। এখন থেকে যদি পেছনে না লেগে থাকি ম্যাট্রিকে স্কুলের রেজাল্ট ভাল হবে কী করে? আমি চাই রাজদিয়ার প্রত্যেকটি ছেলে লেখাপড়ায় ভাল হোক, মানুষ হোক। একটু থেমে আশু দত্ত আবার বললেন, যুদ্ধের খবর শুনবার জন্যে বসতে বলছেন? শুনে কী করব? যুদ্ধ তো আর আমি ঠেকাতে পারব না। যা হবার তাই হবে।

    হেমনাথ মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। ছেলেদের চিন্তায় আশুটা পাগল। কে পড়ছে না, কার কী অসুবিধা হচ্ছে–এসব দেখে না বেড়ালে ওর ঘুমই হয় না।

    অসীম শ্রদ্ধায় অবনীমোহন উচ্চারণ করলেন, সত্যি, এরকম শিক্ষক আগে আর কখনও দেখিনি।

    .

    ২.২৪

    অ্যানুয়াল পরীক্ষার সময় ক’দিন খুব হইচই। জাপানিরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পার্ল হারবারে, সিঙ্গাপুরে, ম্যানিলায় বোমা ফেলেছে। প্রিন্স অফ ওয়েলস’ আর রিপালস’ নামে দুটো বড় বড় জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে।

    ভয়, উত্তেজনা, উদ্বেগ এবং রকমারি গুজবের মধ্যে বিনুদের পরীক্ষা হয়েও গেল।

    পরীক্ষার কিছুদিন পর খবরের কাগজ আরও মারাত্মক সংবাদ বয়ে আনল। জাপানিরা ঘরের কাছে বর্মায় নাকি এবার বোমা ফেলেছে। শুধু তাই না, বর্মা থেকে দলে দলে তোক পায়ে হেঁটে দুর্গম পাহাড় পর্বত বনজঙ্গল পেরিয়ে ভারতবর্ষের দিকে চলে আসছে।

    একদিন হেমনাথ বললেন, ত্রৈলোক্য সেনের নাম শুনেছ তো?

    স্নেহলতা বললেন, যে রেঙ্গুনে থাকত?

    হ্যাঁ। সে আজ রাজদিয়ায় ফিরে এসেছে।

    স্নেহলতা বললেন, ত্রৈলোক্য সেন এসেছে!

    হেমনাথ বললেন, একা আসবে কি, ছেলেপুলে নাতি-নাতিকুড় সবাইকে নিয়ে এসেছে। তাদের কোথায় রেখে আসবে?

    হঠাৎ চলে এল?

    বা রে, তুমি কি কিছুই খোঁজ রাখো না!

    হেমনাথ বলতে লাগলেন, বর্মায় জাপানিরা বোমা ফেলেছে। অনেক লোক মরেছে। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সব ধ্বংসস্তূপ। বোমা পড়তেই রেঙ্গুন শহর থেকে লোক পালাতে শুরু করেছিল। রেঙ্গুন এখন একেবারে ফাঁকা।

    কোথায় বর্মা, কোথায় জাপান, কোথায় শ্বেতসাগর, কোথায় ডানজিগ-সেবাস্টিপুল-মস্কো, কোথায় বলকান-যুগোশ্লাভিয়া-পোল্যান্ড-ভূগোলের কোন প্রান্তে এই জায়গাগুলো পড়ে আছে, দুই গোলার্ধের কোথায় কোথায় বোমা পড়ছে, কত লোক মরছে, মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য কারা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, এ সব কোনও খবরই রাখেন না স্নেহলতা। এই রাজদিয়া, হাচাই পালের মেয়ের মাঘমন্ডলের ব্রত, নাটাইচন্ডীর ব্রত, নীলপুজো, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো, বাস্তুপুজো, কারোর বিয়ে হলে জল সইতে যাওয়া, বাসর জাগা–এ সবের মধ্যেই তার ভূমন্ডল, তাঁর জগৎ। এতকাল এর বাইরে কোনও কিছু সম্বন্ধেই তাঁর দুর্ভাবনা ছিল না।

    এস্ত সুরে স্নেহলতা বললেন, তাই নাকি, এত কান্ড হয়েছে!

    হ্যাঁ। ওইরকম অবস্থায় মানুষ কখনও বর্মায় পড়ে থাকতে পারে?

    তা তো ঠিকই।

    হেমনাথ বললেন, ত্রৈলোক্যদের যা দুর্গতি হয়েছে কী বলব! জাহাজ নেই, নৌকো নেই–

    তবে এল কী করে? হেঁটে। বর্মা তো শুনেছি অনেক দূর।

    হ্যাঁ। ছেলেপুলে নাতি-নাতনীর হাত ধরে পাহাড়-পর্বত-বন-জঙ্গল পেরিয়ে প্রথমে আসামে এসেছিল। সেখান থেকে রাজদিয়া।

    একটু ভেবে স্নেহলতা বললেন, হেঁটে তো এসেছে। জিনিসপত্র কিছু আনতে পেরেছে কি?

    হেমনাথ জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, কিছু না, কিচ্ছু না। নিজেদের হাত-পা আর পরনের। জামাকাপড় ছাড়া কুটোটুকুও আনতে পারে নি।

    আহা রে, কী কষ্ট!

    একটু চুপ।

    তারপর স্নেহলতা আবার বললেন, অনেক কাল পরে ত্রৈলোক্য সেনরা রাজদিয়া এল, তাই না?

    হেমনাথ বললেন, হ্যাঁ। তা বছর তিরিশেক হবে।

    বর্মায় ওরা তো বেশ ভালই ছিল।

    ভাল বলে ভাল। বিরাট অবস্থা করে ফেলেছিল ত্রৈলোক্য। এক রেঙ্গুনেই তিনখানা বাড়ি, প্রোমে ছিল একখানা। তা ছাড়া জমিজমা, নারকেল বাগান। নগদ টাকাপয়সাও প্রচুর।

    দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্নেহলতা বললেন, কিছুই আনতে পারল না। সর্বস্ব বিদেশেই পড়ে রইল।

    হেমনাথ বললেন, বাড়িঘর যাক। নিজের নিজের প্রাণটুকু নিয়ে যে আসতে পেরেছে, এই ঢের।

    হঠাৎ কী মনে পড়তে স্নেহলতা তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ভাল কথা–

    কী?

    অনেক কাল ওরা ছিল না। রাজদিয়ায় ওদের বাড়ি তো জঙ্গলে ঢেকে গেছে। তা উঠল কোথায়? আমাদের বাড়ি নিয়ে এলেই পারতে। যদ্দিন না কিছু একটা ব্যবস্থা হয় এখানেই থাকত।

    হেমনাথ বললেন, ভাল জায়গাতেই উঠেছে। সে জন্যে চিন্তা নেই। স্টিমারঘাট থেকে রামকেশব ত্রৈলোক্যদের নিজের বাড়ি নিয়ে তুলেছে।

    আপাতত ওখানেই থাকছে তা হলে?

    হ্যাঁ।

    কাল একবার যাব।

    হ্যাঁ, যাওয়া দরকার।

    ম্যাপ বইতে বর্মার মানচিত্র দেখেছে বিনু। ভারতবর্ষের ঠিক গায়েই ব্রহ্মদেশ। আরাকান ইরাবতী পেগু মান্দালয়–সে দেশের নদ-নদী শহর-বন্দরের নাম ভূগোল বইয়ের কল্যাণে তার মুখস্থ। ম্যাপে যত কাছে মনে হয়, ব্ৰহ্মদেশ আসলে তত কাছে নয়–সে কথা বিনু জানে। ভারতবর্ষ, বিশেষ করে এই রাজদিয়া থেকে বর্মা শত শত মাইল দূরে।

    রাজদিয়া নামে জল-বাংলার এক অখ্যাত নগণ্য মফস্বল শহরের লোক বর্মায় গিয়ে দীর্ঘ তিরিশ বছর ছিল, জাপানি বোমার ভয়ে এত কাল পর সপরিবারে পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে আবার জন্মভূমিতে ফিরে এসেছে–সমস্ত ব্যাপারটাই যেন অবিশ্বাস্য। একধারে দাঁড়িয়ে ত্রৈলোক্য সেনদের কথা শুনতে শুনতে বিস্ময়ে চোখে আর পলক পড়ছিল না বিনুর। বুকের ভেতর শ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল, তোমার সঙ্গে আমিও যাব দিদা- ত্রৈলোক্য সেনদের দেখবার জন্য মনে মনে সে অস্থির, উন্মুখ হয়ে উঠেছে।

    বিনু যেতে চেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুকও সুর ধরল, আমিও যাব ঠামু–

    দেখা গেল সুধা সুনীতি, এমন কি সুরমা-শিবানী-অবনীমোহনেরও এ ব্যাপারে বেশ আগ্রহ। বর্মা ফেরত মানুষগুলোকে দেখার জন্য সকলে যেন পা বাড়িয়ে আছে।

    স্নেহলতা বললেন, সবাই যাবে। বলেই হেমনাথের দিকে ফিরলেন, ওদের জিজ্ঞেস করেছ?

    হেমনাথ বললেন, কী?

    টাকাপয়সা কি অন্য কিছুর দরকার আছে কিনা?

    না। সবে এসেছে। তা ছাড়া, রামকেশব নিজের বাড়ি নিয়ে গেছে। এক্ষুনি জিজ্ঞেস করাটা খারাপ দেখায়।

    একটু চুপ করে থেকে স্নেহলতা বললেন, আমি কিন্তু কাল ত্রৈলোক্য ঠাকুরপোকে জিজ্ঞেস করব।

    চিন্তিত মুখে হেমনাথ বললেন, কোবরা। তবে রামকেশবের সামনে না।

    তা তোমাকে বলে দিতে হবে না। আমার ঘটে সেটুকু বুদ্ধি আছে। স্নেহলতা হাসলেন।

    আছে নাকি? হেমনাথও হাসলেন।

    বাকি দিনটা ত্রৈলোক্য সেনদের নিয়ে আলোচনাতেই কাটল।

    ত্রৈলোক্য সেনের বাবা ছিলেন নামকরা কবিরাজ, লোকে বলত স্বয়ং ধন্বন্তরি। অম্বিকা কবিরাজ ছুঁলেই নাকি রোগ অর্ধেক সেরে যেত। কবিরাজি তাঁদের কৌলিক ব্যবসা, বংশ পরম্পরায় চলে আসছিল। বিপুল পশার ছিল অম্বিকা কবিরাজের। ঢাকা-বরিশাল-ময়মনসিংহ, দেশ বিদেশ থেকে তার ডাক আসত। প্রচুর পয়সাও করেছিলেন। লোকে সম্মান করত, ভক্তি করত।

    জল-বাংলার দুর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র শিখতে অম্বিকা সেনের কাছে ছাত্ররা আসত। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও নিজের ছেলেকে কুলবিদ্যা ধরাতে পারেন নি অম্বিকা সেন। বংশগত ব্যবসা না করুক, ছেলে অন্তত লেখাপড়া শিখে মানুষ হোক, এই আশায় ত্রৈলোক্যকে ইংরেজি স্কুলে পাঠিয়েছিলেন অম্বিকা কবিরাজ। তখন ইংরেজর খুব রবরবা, তার তোপের মুখে ভারতবর্ষের যত প্রাচীন বিদ্যা উড়ে যাচ্ছে। এক-আধ পাতা এ বি সি’ শিখলেও করে খেতে পারবে।

    কিন্তু দু’চার বছরের বেশি ইংরেজি স্কুলে যাতায়াত করেন নি ত্রৈলোক্য সেন। আসলে লেখাপড়ায় মনই ছিল না। যৌবনের শুরুতেই বেছে বেছে খারাপ সঙ্গী যোগাড় করেছিলেন। কুসঙ্গে পড়ে নেশা-টেশা ধরেছিলেন, মাঝে মাঝে বাইরে রাত কাটিয়ে আসতেন। অনেক বার যুগীপাড়া, তেলীপাড়া থেকে মার খেয়ে এসেছেন।

    ছেলের চরিত্র শোধরাবার জন্য কম বয়সেই বিয়ে দিয়েছিলেন অম্বিকা সেন। সে আমলে মেয়েদের ছোটবেলাতেই বিয়ে হত। ঘরে যাতে ছেলের মন বসে, তাই খুঁজে খুঁজে যুবতী পুত্রবধূ এনেছিলেন। তাতে কাজও হয়েছিল। ত্রৈলোক্য সেন আর বাড়ি থেকে বেরুতেন না।

    ছেলেকে তরুণী মেয়ে ঘুষ দিয়ে নিজের ইচ্ছামতো হয়তো চালাতে পারতেন, কিন্তু তার আগেই অম্বিকা সেন মারা গেলেন। বাবার মৃত্যুর পর তার যা কিছু সঞ্চয় ভেঙে ভেঙে খেলেন ত্রৈলোক্য। সেন। তারপর একে একে দেড়শ’ কানি ধানজমি বেচলেন। পৈতৃক বাড়িখানা ছাড়া যখন আর কিছু নেই, সেই সময় একদিন ছেলেপুলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে সুদূর বর্মায় পাড়ি দিলেন ত্রৈলোক্য। এত রাজ্য থাকতে কেন যে মগের মুল্লুকে গেলেন, তিনিই জানেন।

    সে কি আজকের কথা! তিরিশ বছর আগে, তখন প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয় নি, ত্রৈলোক্য সেন বর্মা গিয়েছিলেন। সেখান থেকে হেমনাথকে একখানা মোটে চিঠি লিখেছেন। তারপর এতকাল রাজদিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জাপানি বোমার ভয়ে দেশে ফিরে আসতে হল তাঁকে।

    ভাগ্যের সন্ধানে বর্মায় গিয়েছিলেন ত্রৈলোক্য সেন। ভাগ্য তাকে ছলনা করে নি, দশ হাতে ঢেলে দিয়েছিল। কাঠের ব্যবসা করে অজস্র পয়সা করেছিলেন, বাড়িঘর করেছিলেন। কিন্তু জীবন এমন ব্যঙ্গরসিক যে সব ফেলে চলে আসতে হয়েছে।

    .

    পরদিন বিকেলবেলা বিনুরা রামকেশবের বাড়ি গেল।

    ত্রৈলোক্য সেনরা যে জাপানি বোমার ভয়ে চলে এসেছে, সে খবর জানতে কারো বুঝি বাকি নেই। সারা রাজদিয়া যেন রামকেশবের বাড়িতে ভেঙে পড়েছে। রাজদিয়া কেন, আশেপাশের গ্রাম গঞ্জ থেকেও অনেকে এসেছে। সবার চোখে মুখে আগ্রহ, বিস্ময়, ভয় এবং আতঙ্ক।

    বিনুরা যেতেই সাড়া পড়ে গেল। চারপাশের ভিড়টা বলাবলি করতে লাগল, হ্যামকত্তার বাড়ি থিকা আইছে।

    ভিতরে যাইতে দাও।

    খবর পেয়ে রামকেশব ছুটে এলেন। সম্ভ্রমের সুরে বললেন, আসুন, আসুন বৌ-ঠাকরুন। কাল হেমদাদা এসেছিলেন, তার মুখে নিশ্চয়ই ত্রৈলোক্যদাদার খবর পেয়েছেন–

    স্নেহলতা বললেন, হ্যাঁ। সেই জন্যেই তো ছুটে এলাম।

    তা জানি। নইলে—

    জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকলেন স্নেহলতা।

    রামকেশব আবার বললেন, ত্রৈলোক্যদাদা এসেছেন বলে গরিবের বাড়ি আপনার পায়ের ধুলো পড়ল।

    চোখ কুঁচকে, মাথা নেড়ে নেড়ে, কপট রাগের গলায় স্নেহলতা বললেন, আমি বুঝি আসি না?

    কই আর আসেন। কদিন পর এলেন, চট করে বলে দিতে পারবেন?

    রণে ভঙ্গ দিলেন স্নেহলতা। হাসতে হাসতে বললেন, হিসেব-নিকেষ ভবিষ্যতের জন্যে থাক। এখন সেন ঠাকুরপোর কাছে নিয়ে চলুন।

    কৌতুকের গলায় রামকেশব বললেন, অমন মোহন হাসি হাসলে চলবে না। কোমর বেঁধে ঝগড়া করব। তবে ছাড়ব।

    আচ্ছা, আমি তার জন্যে তৈরি।

    দেখা যাবে।

    রামকেশব তাদের নিয়ে দোতলার একটা ঘরে এলেন। এ ঘরে সব চাইতে বেশি ভিড়। একটি লম্বামতো সুপুরুষ বৃদ্ধকে ঘিরে রাজদিয়াবাসী অনেক লোকজন বসে আছে।

    বৃদ্ধ কিছু বলছিলেন। আর চারধারের জনতা উদগ্রীব হয়ে শুনেছিল। শ্বাস টানতে পর্যন্ত তারা ভুলে গেছে।

    ঢুকেই রামকেশব ডাকলেন, সেনদাদা–

    বোঝা গেল উনিই ত্রৈলোক্য সেন। রামকেশব বললেন, আপনার আরও শ্রোতা এসেছে। বলে স্নেহলতাকে দেখিয়ে দিলেন, এঁকে চিনতে পারছেন?

    একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ত্রৈলোক্য। ধীরে ধীরে বললেন, চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না।

    রামকেশব বললেন, আমাদের বৌ-ঠাকরুন। হেমদাদা–

    চোখের তারায় আলো নেচে গেল ত্রৈলোক্যের, আর বলতে হবে না। ওঃ, কতকাল পর আপনাকে দেখলাম। চিনবার কি উপায় আছে! চুলটুল সব পাকিয়ে ফেলেছেন।

    চুল পাকবে না? আয়নায় নিজের চেহারাখানা দেখেছেন? আপনিও কিন্তু আর নবীন যুবকটি নেই।

    তা যা বলেছেন। বলতে বলতে উঠে এসে স্নেহলতাকে প্রণাম করলেন ত্রৈলোক্য।

    বিব্রতভাবে পিছোতে পিছোতে স্নেহলতা বললেন, থাক থাক, আবার প্রণাম কেন?

    ত্রৈলোক্য বললেন, আপনি আমাদের প্রণামের পাত্রী, তাই—

    রামকেশব এরপর একে একে অবনীমোহন সুরমা সুধা সুনীতিদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন।

    পরিচয়-পর্ব চুকলে ত্রৈলোক্য বললেন, বেশ বেশ। বসুন বৌ-ঠাকরুন, বোসো বাবা অবনী। সুরমা তোমরাও বোসো।

    সবাই বসবার পর স্নেহলতা বললেন, আপনাকে তো দেখছি। আমার বোন, ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনীরা কোথায়?

    বড় নাতি ছাড়া আর সবাই আমাদের বাড়ি দেখতে গেছে।

    আপনাদের বাড়ি কি আর বাসের যোগ্য আছে?

    কী করে থাকবে বলুন। তকাল আমরা দেশছাড়া। বাড়িঘর এখন জঙ্গলে বোঝাই। সাপখোপের আস্তানা হয়ে উঠেছে। আজ থেকে কামলা লাগল। বাড়ি সারিয়ে সুরিয়ে যেতে হবে তো। রামকেশবের ওপর কদ্দিন আর জুলুম করব! বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়তে গলা চড়িয়ে ডাকতে লাগলেন, শ্যামল কোথায় রে, শ্যামল–

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজায় যে ছেলেটি এসে দাঁড়াল তার বয়স চোদ্দ পনেরর মতো, বিনুর প্রায় সমবয়সী, কি বছর খানেকের বড়।

    কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, লম্বাটে মুখ, ভাসা ভাসা বড় চোখ, গায়ের রংখানি উজ্জ্বল শ্যাম। সব মিলিয়ে চেহারাটি ভারি মিষ্টি, তাকালেই চোখ স্নিগ্ধ হয়ে যায়। ছেলেটির শ্যামল নাম সার্থক। নামের সঙ্গে চেহারার এমন মিল কদাচিৎ দেখা যায়।

    ত্রৈলোক ডাকলেন, আয়—

    ছেলেটি ভেতরে এল। ত্রৈলোক্য বললেন, এই আমার বড় নাতি।

    স্নেহলতাদের দেখিয়ে শ্যামলকে বললেন, ইনি ঠাকুমা। উনি হলেন পিসিমা, উনি পিসেমশায়, ওরা দিদি। যাও প্রণাম কর।

    ঢিপ ঢিপ করে স্নেহলতা-সুরমা-অবনীমোহন-সুধা-সুনীতির পায়ে কপাল ঠেকিয়ে বিনুর পাশে গিয়ে বসল শ্যামল।

    এদিকে ঘরে অন্য লোকজন যারা আগে থেকে বসে ছিল, অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। কিছু অবশ্য বলছে না। তবে মুখ টুখ দেখে তা টের পাওয়া যায়।

    স্নেহলতা লক্ষ করছিলেন। বললেন, আমরা আসবার আগে কী কথা হচ্ছিল সেন ঠাকুরপো?

    এই বর্মার কথা বলছিলাম সবাইকে। রামকেশব বিনুদের পৌঁছে দিয়ে চলে যান নি, একধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, সেনদাদা, কাল থেকে কতবার যে বর্মার কথা বলছে, লেখাজোখা নেই। সারাদিন লোক আসছে, সারাদিন বকবকানি চলছে। বকতে বকতে মুখে ফেনা উঠবার যোগাড়।

    ত্রৈলোক্য হাসলেন, কী আর করা যাবে। লোকে এত আগ্রহ নিয়ে আসছেন। না শুনিয়ে পারি কখনও?

    স্নেহলতা বললেন, আমরাও কিন্তু বর্মার গল্প শুনতে এসেছি।

    ত্রৈলোক্য বললেন, নিশ্চয়। বলে ভিড়টার দিকে তাকালেন, বৌ-ঠাকরুন এসেছে। তাহলে গোড়া থেকে আবার শুরু করা যাক।

    দেখা গেল, এ ব্যাপারে কারোর আপত্তি নেই। সবাই মাথা নেড়ে বলল, হ হ, হেই ভালা। আরেক বার শুনা যাইব।

    ত্রৈলোক্য আরম্ভ করলেন। বেশ সুখেই ছিলেন তারা বর্মায়। হঠাৎ কেন যে যুদ্ধ লাগল! আর লাগবিই যদি, পৃথিবীতে ঢের জায়গা পড়ে ছিল। সেসব ছেড়ে জাপানি ব্যাটারা এসে বর্মার ওপর বোমা ফেলল। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না, পলক পড়তে না পড়তে বহুকাল ধরে তিল তিল সাধনায় গড়ে ওঠা মনোরম জনপদ কিভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বাড়িগুলো তাসের ঘরের মতো কাত হয়ে পড়ল। রাস্তায় রাস্তায় প্রকাণ্ড গর্ত। আহত মানুষের চিৎকার, মানুষের স্তূপাকার মৃতদেহ, ঘন ঘন সাইরেনের শব্দ, ঝক ঝক জাপানি প্লেনের আক্রমণ–সব মিলিয়ে বর্মা যেন নরকের আরেক নাম।

    ত্রৈলোক্য বলতে লাগলেন, বোমা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে রেঙ্গুন টেঙ্গুন থেকে পালোনোর হিড়িক লেগে গেল। কিন্তু যাবে কোথায়? বার্মিজরা গ্রামের দিকে পালাল। আর ইন্ডিয়ানরা ভারতবর্ষের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু আসতে চাইলেই তো আসা যায় না। দশ দিন আরও দিন পর একটা করে কলকাতার জাহাজ। দামের তিন গুণ দিয়েও তার টিকিট পাওয়া যায় না। সেই জাহাজ আসাও একদিন বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে রেঙ্গুনে বসে থাকা মানে নির্ঘাত মৃত্যু। অগত্যা বহু মানুষ হাঁটা পথ ধরল, আমরাও পা দু’খানার ওপর ভরসা করে রওনা হলাম।

    স্নেহলতা বললেন, তারপর?

    সে যে কী কষ্ট, বলে বোঝাতে পারব না বৌ-ঠাকরুন। পাহাড় পর্বত বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনের পর দিন হাঁটছি তো হাঁটছিই। হাঁটতে হাঁটতে পা ফুলে গেল। কত লোক যে রাস্তায় পড়ে মরেছে, তার হিসেব নেই। খাদ্য নেই, জল নেই। খিদের জ্বালায় পেট পুড়ে গেছে, তেষ্টায় ছাতি ফেটে গেছে। কোথাও ঝরনা দেখে হয়তো ছুটে গেছি। কাছে যেতেই চোখে পড়েছে, দা হাতে মগেরা দাঁড়িয়ে আছে। দশ টাকা করে দিলে এক বালতি জল পাওয়া যাবে। ভয়ে ভয়ে ফিরে এসেছি। কোথাও বনের ভেতর কলা ফলে আছে। সেখানেও দা হাতে মগ। হাঁটতে হাঁটতে বাচ্চাগুলোর জ্বর হয়ে গেল। তাদের কাঁধে তুলে চলতে লাগলাম।

    স্নেহলতা বললেন, আহা রে–

    বর্মা থেকে রাজদিয়া পর্যন্ত পথের ভয়াবহ নিদারুণ বর্ণনা দিয়ে যেতে লাগলেন ত্রৈলোক্য, রাস্তায় কতবার যে ডাকাতের হাতে পড়েছি তার হিসেব নেই। শুধু আমরাই তো নই, বর্মা থেকে আরও অনেক মানুষ আসছিল। ডাকাতরা যদি টের পেয়েছে, কারোর সঙ্গে টাকা পয়সা সোনাদানা আছে, গলার কাছে রামদা ধরে সব কেড়ে কুড়ে নিয়েছে। দিতে না চাইলে স্রেফ কেটে ফেলেছে। এভাবে যে কত লোক প্রাণ দিয়েছে তার হিসেব নেই বৌ-ঠাকরুন।

    মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছিল বিনু। হঠাৎ পাশ থেকে কে ডাকল, এই

    চমকে সেদিকে তাকাল বিনু। দেখল সেই ছেলেটা, যার নাম শ্যামল। চোখাচোখি হতেই শ্যামল হাসল। বলল, তোমার নাম কি ভাই?

    বিনু স্কুলের ভাল নামটাই বলল, বিনয়কুমার বসু–

    শ্যামল বেশ সহজ সাবলীল ছেলে, সঙ্কোচ টঙ্কোচ তার নেই বললেই হয়। হাসতে হাসতে বলল, ও তো ভাল নাম। মস্ত বড়। ডাক-নাম নেই তোমার?

    আছে। বিনু–

    সুন্দর নাম তো।

    বিনু বলল, তোমার নামটাও সুন্দর।

    শ্যামল বলল, তাই নাকি?

    হ্যাঁ।

    সবার সঙ্গে দাদু আলাপ করিয়ে দিয়েছেন, শুধু তোমার সঙ্গেই বাদ।

    কথাটা ঠিক। বিনু বলল, হয়তো খেয়াল করেননি।

    শ্যামল বলল, সে যাক গে। তোমার সঙ্গে আমি কিন্তু সেধে আলাপ করলাম। রাগ করলে না তো?

    বা রে, রাগ করব কেন?

    তুমি কোন ক্লাসে পড় ভাই?

    এবারে নাইনে উঠেছি।

    শ্যামল উৎসাহিত হয়ে উঠল, রেঙ্গুনে আমি ক্লাস এইটে পড়তাম। এ বছর নাইনে উঠবার কথা ছিল। ভালই হল, নাইনে ভর্তি হব, তোমার সঙ্গে পড়ব। একটু থেমে বিমর্ষ সুরে আবার বলল, কিন্তু বিনু–

    কী?

    আমাকে কি এখানে ক্লাস নাইনে নেবে?

    কেন নেবে না?

    আমার যে ভাই ওখানে অ্যানুয়াল পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আনতে পারিনি। আনব কী করে বল? জাপানিদের বোমা পড়ল। সব ফেলে পালিয়ে আসতে হল

    বিনু বলল, এখানে ভর্তি হতে হলে একটা অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে। আমিও কলকাতা থেকে এসে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম।

    চিন্তিত মুখে শ্যামল শুধলো, খুবই কঠিন পরীক্ষা নেয়?

    নিজের ফাঁড়া তো কেটে গেছে। মুরুব্বিয়ানা চালে বলল, তেমন কঠিন আর কি—

    শ্যামল বলল, বড্ড ভয় করছে।

    বিনু শ্যামলের সঙ্গে কথা বলছিল ঠিকই। কিন্তু তার কান দুটো ছিল ত্রৈলোক্য সেনদের দিকে। জাপানি বোমার ভয়ে দুর্গম পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে পালিয়ে আসার দীর্ঘ রোমাঞ্চকর বিবরণ শোনার মতো উন্মাদনা আর কী থাকতে পারে? প্রবল আকর্ষণে ত্রৈলোক্য বিনুকে তার দিকে টানছিলেন।

    বিনু যে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে, শ্যামল তা লক্ষ করছিল। বলল, দাদুর কথা বুঝি ভাল লাগছে?

    বিনু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

    দাদু আর কতটুকু বলছে। আমি তোমাকে পরে সব বলব। জাপানিরা প্রথম দিন এসে কেমন। করে বোমা ফেলল, ইংরেজ সৈন্যরা তখন কী করছিল, আমরা কী করছিলাম, রেঙ্গুনের লোকেরা কী করছিল, আমরা কেমন করে এলাম–সব বলব। কত শুনতে পার তখন দেখা যাবে। শোনাতে শোনাতে কান একেবারে ঝালাপালা করে ছাড়ব। এখন আমার সঙ্গে গল্প কর দেখি।

    কী আর করা, ত্রৈলোক্য সেনের গল্পের আশা ছাড়তে হল বিনুকে। চোখ কান মেলে শ্যামলের দিকে তাকাল সে।

    শ্যামল বলল, তখন কলকাতার কথা কী বলছিলে?

    বিনু বলল, আমরা কলকাতায় থাকতাম।

    কবে এসেছ?

    বছর দেড়েকের কাছাকাছি।

    রাজদিয়াতে তোমরা কোথায় থাকো?

    কোথায় থাকে, বিনু বলল।

    তোমাদের বাড়ি একদিন যাব।

    নিশ্চয়ই যাবে।

    তোমাকেও আসতে হবে। তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে।

    আসব। তোমাকেও আমার ভাল লেগেছে।

    দু’জনের মধ্যে টুকরো টুকরো, এলোমেলো, অসংলগ্ন গল্প চলতে লাগল। কথা বলতে বলতে বিনুর হঠাৎ মনে পড়ল, ঝুমার সঙ্গে এখানেই তার আলাপ হয়েছিল। সেই দুঃসাহসী, ভয়লেশহীন মেয়েটা! কতকাল তার সঙ্গে দেখা হয় না। ঝুমার কথা ভাবতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল বিনুর।

    ওধারে একসময় ত্রৈলোক্য সেনের বিচিত্র ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কাহিনী শেষ হল।

    স্নেহলতা ছাড়া একে একে অন্য শ্রোতার দলে চলে যেতে লাগল।

    সবাই চলে গেলে ঘর যখন ফাঁকা, স্নেহলতা শুধোলেন, একটা কথা সেন ঠাকুরপো—

    ত্রৈলোক্য সেন উৎসুক চোখে তাকালেন, কী?

    মগের মুল্লুকে সবই তো ফেলে টেলে এসেছেন। কিছুই আনতে পারেন নি।

    হ্যাঁ।

    টাকাপয়সার দরকার থাকলে কিন্তু বলবেন। একটুও লজ্জা করবেন না।

    আপনাদের কাছে লজ্জার কিছু আছে নাকি। তবে–

    কী?

    টাকাপয়সার এখন দরকার নেই বৌ-ঠাকরুন।

    কিছুই আনতে পারেন নি অথচ পয়সাকড়ির প্রয়োজন নেই, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না স্নেহলতা। বিমূঢ়ের মতো তিনি তাকিয়ে থাকলেন।

    স্নেহলতার মনোভাব খানিক যেন অনুমান করতে পারলেন ত্রৈলোক্য। হাসতে হাসতে বললেন, তা হলে আপনাকে একটা কথা বলি–

    কী?

    হাজার বিশেক টাকা আমি আনতে পেরেছি।

    কিভাবে? বিস্ময়ে আর উত্তেজনায় গলা কাঁপতে লাগল স্নেহলতার, ডাকাতরা ধরে নি?

    আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে ত্রৈলোক্য সেন বললেন, সে একটা চালাকি করেছিলাম বৌ-ঠাকরুন। পা যেন ভেঙে গেছে, তা দেখাবার জন্যে হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করে নিয়েছিলাম। ব্যান্ডেজের ভঁজে ভাঁজে একশ’ টাকার নোট রেখেছি। লোকের চোখে ধুলো ছিটোবার জন্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতাম। কিরকম ফন্দি খাঁটিয়েছিলাম বলুন তো? চোখেমুখে গর্বের ভাব ফুটিয়ে ত্রৈলোক্য তাকালেন।

    গালে হাত দিয়ে মাথাটি হেলিয়ে দিলেন স্নেহলতা, বাব্বা, আপনার মাথায় এতও এসেছিল?

    ত্রৈলোক্য হাসতে লাগলেন, হাজার হোক ওরা মগ ডাকাত। আর আমি–

    আপনি কী?

    ঢাকাইয়া পোলা। শব্দ দু’টো পূর্ব বাংলার টান দিয়ে উচ্চারণ করলেন ত্রৈলোক্য।

    স্নেহলতা এবার হেসে ফেললেন।

    কথায় কথায় বেলা ফুরিয়ে এল। শীতের অবেলায় রোদের রং যখন বাসি হলুদের মতো সেই সময় ত্রৈলোক্য সেনের স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বৌ, অন্য নাতি-নাতনীরা নিজেদের বাড়ি দেখে ফিরে এল।

    অগত্যা আরও কিছুক্ষণ বসে যেতে হল বিনুদের। স্নেহলতা ত্রৈলোক্য সেনের স্ত্রী এবং ছেলের বৌদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললেন।

    দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল। নদীর দিক থেকে ঠান্ডা বাতাস ছুটে আসতে লাগল। হিমে কুয়াশায় চারদিক ঝাঁপসা, অস্পষ্ট। কাছাকাছি ঝোঁপঝাড়গুলোর ভেতর থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। আলোর ছুঁচের মতো অন্ধকারকে বিধে বিঁধে জোনাকিরা একবার জ্বলছে, একবার নিবছে। সারা রাতের জন্য এই জ্বলা এবং নেবার খেলা চলবে।

    বাইরের দিকে তাকিয়ে চঞ্চল হলেন স্নেহলতা, এবার আমরা যাই বোন।

    ত্রৈলোক্য সেনের স্ত্রী বললেন, এখনই যাবেন দিদি?

    হ্যাঁ। রাতের রান্না পড়ে আছে। গিয়ে বসাতে হবে। তোমরা যেও–

    বুঝতেই তো পারছেন দিদি, এখন যাওয়ার খুব অসুবিধে। নিজের বাড়িঘরে থিতু হয়ে বসি, তারপর যাব।

    বাড়ি যেতে কদ্দিন লাগবে?

    আজই সবে কামলা লাগল। সাত আট দিনের আগে সারাই টারাই হবে বলে তো মনে হয়।

    বাড়ি গিয়ে বসবার পরই তা হলে যেও।

    যাব। আপনারও আসবেন।

    আসব। বলতে বলতে উঠে পড়লেন স্নেহলতা।

    .

    ২.২৫

    দিনকয়েক পর শ্যামল বিনুদের ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেল। এখন রোজই তার সঙ্গে দেখা হয়। দিনের অনেকখানি সময় এক সঙ্গে কাটে দু’জনের।

    কলকাতা থেকে আসার পর এখানে বিশেষ বন্ধু টন্ধু পায় নি বিনু। ক্লাসের ছেলেরা অবশ্য ছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে তেমন মিশত না।

    বন্ধুর জন্য বিনুর প্রাণের যে জায়গাটা ফাঁকা পড়ে ছিল, শ্যামল এসে তা ভরিয়ে তুলল।

    টিফিনের সময় কিংবা স্কুল ছুটির পর বিনুরা নদীর পাড়ে গিয়ে বসে। কখনও হাঁটতে হাঁটতে বরফ কল, স্টিমারঘাটের দিকে চলে যায়।

    এর মধ্যে বর্মার অনেক গল্প করেছে শ্যামল। রেঙ্গুন শহর, শোয়েডাগন প্যাগোডা, রয়াল লেক, বর্মিদের জল-উৎসব, সাগরের জলে ভরপুর নীলকণ্ঠ ইরাবতী–এমনি অজস্র গল্প।

    একদিন গল্প করতে করতে শ্যামল বলল, জানো বিনু, দু’জনের জন্যে আমার ভারি কষ্ট হয়।

    তারা কে?

    সুব্রত আর মা-পোয়ে। সুব্রত ছিল আমার প্রাণের বন্ধু, রেঙ্গুনে আমরা এক রাস্তাতেই থাকতাম। বোমা পড়বার পর সবাই যখন পালাচ্ছে, সুব্রতরা জাহাজের টিকিট পেয়ে গেল। ওরা কলকাতায় এসেছিল, তারপর কোথায় গেছে, কে জানে। জীবনে আর হয়তো কোনও দিন ওর সঙ্গে দেখা। হবে না। বলতে বলতে কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে ওঠে শ্যামলের। চোখমুখ বিষণ্ণ দেখায়।

    বিনু শুধোয়, মা-পোয়ে কে?

    একটা বার্মিজ মেয়ে। ওরা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত। ওর বাবা আমার বাবার বন্ধু। আমাদের বাড়ি ওরা সবসময় আসত, আমরাও ওদের বাড়ি যেতাম। বোমা পড়বার পর মা-পোয়েরা মান্দালয়ের দিকে গেল, আমরা এলাম এই রাজদিয়াতে।

    বিনু এবার কিছু বলল না।

    একটু চুপ করে থেকে শ্যামল বলল, মা-পোয়ের মা আর বাবা আমাকে খুব ভালবাসতেন। ওঁদের খুব ইচ্ছে ছিল, বড় হলে মা-পোয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন। আমার মা-বাবারও ইচ্ছে ছিল।

    একটা কথা মনে হতে বিনু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মা-পোয়েরা বার্মিজ না?

    হ্যাঁ।

    বার্মিজদের সঙ্গে বাঙালির বিয়ে হয়?

    অনেক হয়েছে। বর্মায় গিয়ে দেখে এস না–

    এরপর আর কেউ কিছু বলল না। শ্যামল উদাস চোখে অনেক দূরে নদীর ওপারে ধু ধু বনানীরেখার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।

    একদিন স্কুল ছুটির পর বিনুরা অলস পায়ে নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ তাদের চোখে পড়ল, স্টিমারঘাটে নতুন একটা স্টিমার এসে লেগেছে। গোয়ালন্দ থেকে রোজ সকালে যে সাদা ধবধবে স্টিমার যাত্রী নিয়ে আসে এটা সেইটা নয়। এর রং ধূসর, আকারেও অনেক বড়।

    বিনুরা দেখল, অনেক লোক স্টিমারঘাটের দিকে ছুটছে। দেখাদেখি ওরাও ছুটল এবং মুহূর্তে সেখানে পৌঁছেও গেল।

    স্টিমারঘাটের জেটিটাকে ঘিরে মেলা বসে গেছে যেন। রাজদিয়ার যত দোকানদার-আড়তদার মাছ ব্যাপারি, সবাই ছুটে এসেছে।

    স্টিমার, এমনকি জেটির ওপরেও কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। অগুনতি পুলিশ চারদিক ঘিরে রেখেছে। এগুতে চাইলেই লাঠি তুলে তাড়া করে আসছে।

    ভিড়ের ফাঁক দিয়ে একসময় বিনুরা দেখে ফেলল, স্টিমার থেকে বিশাল ফৌজ নামছে।

    চারপাশের ভিড়টা চাপা ভীতু সুরে বলাবলি করতে লাগল, সৈন্য আইছে। রাইজদাতেও তাইলে যুজ্ঞা আইসা গেল!

    হায় আল্লা, কী হইব!

    হা ভগমান, কপালে কী লেখছিলা!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.