Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ২.২৬-৩০ সেটেলমেন্ট অফিস

    ২.২৬

    কয়েকদিনের ভেতরেই দেখা গেল সেটেলমেন্ট অফিসের পেছন দিকে যে বিশাল ফাঁকা মাঠখানা পড়ে ছিল, তারকাটা দিয়ে সেটা ঘিরে ফেলা হয়েছে, এবং তার মধ্যে মিলিটারির জন্য সারি সারি অসংখ্য তবু উঠেছে।

    শুধু তাই নয়, বরফকল এবং মাছের আড়তগুলোর ওধারে একেবারে নদীর ধার ঘেঁষে মাইলের পর মাইল নিচু জমি পড়ে ছিল। বর্ষায় জায়গাটা জলে ডুবে যায়, অন্য সময় কাদায় থক থক করে। তার ওপর জলসেঁচি আর বিশল্যকরণীর বন উদ্দাম হয়ে বাড়তে থাকে। কাদাখোঁচা আর পাতিবকের দল নরম মাটিতে হাঁটু পর্যন্ত ডুবিয়ে জলসেঁচির বনে সারাদিন কী যে খুঁজে বেড়ায়!

    মিলিটারির নজর পড়ল জায়গাটার ওপর। কোত্থেকে ঠিকাদাররা এসে গেল। চারধারের গ্রাম গঞ্জ থেকে, নদীর ধু ধু চর থেকে, মোটা মজুরির লোভ দেখিয়ে হাজার দুই তিন লোক জুটিয়ে ফেলল তারা। কানের কাছে কাঁচা পয়সার ঝনঝনানি চলতে থাকলে কতক্ষণ কে আর ঘরে বসে থাকতে পারে।

    মজুরদের প্রায় সকলেই ভূমিহীন কৃষাণ। অন্যের জমিতে ধান কেটে, হাল দিয়ে এবং আরও হাজারটা উঞ্ছবৃত্তিতে তাদের দিন কাটত। বছরের বেশির ভাগ সময়ই তাদের জীবনে দুর্ভিক্ষ লেগে আছে।

    ঠিকাদাররা প্রথমে তাদের মাটি ভরাটের কাজে লাগাল। নিচু জমিটাকে রাস্তার সমান উঁচু করতে হবে।

    সারাদিন কাজ তো চলেই, রাত্তিরেও নিশ্বাস ফেলবার সময় নেই। আলো জ্বালিয়ে মাটি ফেলা হচ্ছে তা হচ্ছেই।

    স্কুলে যাবার পথে সময় হয় না। তবে টিফিনে কি ছুটির পর শ্যামলকে সঙ্গে নিয়ে বিনু ওখানে চলে যায়। দু তিন মাইল জায়গা জুড়ে হাজার কয়েক লোক ঝোড়া বোঝাই করে এনে মাটি ফেলছে। মজুরদের ব্যস্ততা, ঠিকাদারের লোকদের ধমক, খিস্তি খেউড়, চিৎকার, হই হই–সব মিলিয়ে বিরাট ব্যাপার।

    বিনু বলে, ওখানে কী হবে বলতে পার?

    শ্যামল বলে, কী জানি—

    ঠিকাদারের লোকেরা, যারা মজুর খাটায়, জিজ্ঞেস করলে বলে, দেখ না, কী হয়। বলেই ব্যস্তভাবে চলে যায়।

    একদিন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সেই লোকগুলোকে দেখতে পেল বিনু তাহের, বছির, বুড়ো খলিল। ওরা সবাই চরের মুসলমান। প্রতি বছর ধানকাটার সময় চুক্তিতে কাজ করতে আসে। এবারও অঘ্রাণ মাসে এসে তারা বিনুদের ধান কেটে গেছে।

    বছরে মাস দুয়েকের মতো বছিররা রাজদিয়ায় এসে থাকে। আসে অঘ্রাণের মাঝামাঝি, মাঘ পড়তে না পড়তে চলে যায়। কোনও কোনও বার অবশ্য দেরিও হয়, যেতে যেতে মাঘের শেষ কিংবা ফাল্গুনের শুরু।

    ধানকাটার মরশুম বাদ দিলে বছরের অন্য সময় বছিরদের রাজদিয়ায় দেখা যায় না। এবারটা কিন্তু ব্যাতিক্রম। এই তো সেদিন ধান কেটে গেল ওরা। এর মধ্যেই আবার মাটি ভরাটের কাজে ফিরে এসেছে।

    বিনুকে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে হল না। মাটি ফেলতে ফেলতে বছিররাই তাকে দেখে ফেলল। দেখামাত্র বছির আর তাহের লম্বা লম্বা পা ফেলে কাছে এল। খুশি গলায় বলল, বাবুগো পোলা না?

    বিনু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

    বিনুর হাতে বই খাতা-টাতা ছিল। বছির বলল, ইচকুল(স্কুল) থিকা আসলেন বুঝিন?

    হ্যাঁ। একটু আগে ছুটি হল।

    হ্যামকত্তায় ভাল আছে?

    হ্যাঁ।

    জামাইকত্তায়?

    হ্যাঁ।

    বাড়ির আর হগলে?

    সবাই ভাল। তোমরা?

    খোদা য্যামন রাখছে।

    একটু নীরবতা। তারপর বিনু শুধলো, এখানে কদ্দিন কাজ করছ?

    বছির হিসেব করে বলল, দশ দিন। একটু চুপ করে থেকে উজ্জ্বল, উৎফুল্ল মুখে আবার বলল, বাহারের কাম ছুটোবাবু।

    বিনু উৎসুক সুরে জানতে চাইল, কিরকম?

    রোজ নয় সিকা কইরা মজুরি। তাইলে হিসাব কইরা দ্যাখেন, দশ দিনে কত টাকা পাইছি। বাপের জম্মে অ্যাত টাকার মুখ আর দেখি নাই। বলে তাহেরের দিকে তাকাল বছির, না কি কও তাহের ভাই?

    দেখা গেল তাহেরের এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই। জোরে জোরে মাথা নেড়ে সে বলল, সাচা কথা।

    বছির বলতে লাগল, হেই ইনামগুঞ্জ, নিশিন্দার চর, চরবেউলা, গিরিগুঞ্জ, কেতুগুঞ্জ, ডাকাইতা পাড়া-যেইখানে যত কিষান আছে, হগলে মাটি কাটার কামে আসছে। আসব না ক্যান? অ্যাত মজুরি, অ্যাত টাকা পাইব কই? শুনতে আছি–

    কী?

    সুজনগুঞ্জেও নিকি মাটি কাটার কাম শুরু হইব।

    কে বললে?

    পরস্পর কানে আইল।

    ওখানে মাটিকাটা কেন?

    সৈন্যগো পেয়োজন (প্রয়োজন)।

    ওখানেও সৈন্য যাবে! বিনু অবাক।

    বছির বলল, হেই তো শুনতে আছি।

    বিনু চুপ করে থাকল।

    বছির উৎসাহের গলায় বলতে লাগল, এইরকম কাম যদিন মিলে, কিষানরা আর চাষবাস করব না। জমিন ফেলাইয়া হগলে যুজ্যের কামে লৌড়াইব।

    তাহের বলল, ভাগ্যে যুজ্যু বাধছিল! দুইখান পহা নাড়াচাড়া করতে পারি, পোলামাইয়ারে দুই বেলা প্যাটভরা ভাত দিতে পারি। হায় রে আল্লা, জম্ম ইস্তক কী দিনই না গ্যাছে!

    বছির বলল, মাইনষে কয়, যুজ নিকি মোন্দ, আমরা কই যুজ্যু ভালা। যুজুর কালানে (কল্যাণে) বউ-পোলার মুখে হাসন ফুটছে।

    আর কিছুক্ষণ হয়তো গল্প টল্প করত বছিররা, তা আর হল না। ঠিকাদারের একটা লোক শকুনের চোখ নিয়ে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সে প্রায় তাড়া করে এল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে লোকটা অশ্লীল খিস্তি দিল প্রথমে। তারপর বলল, সুমুন্দির পুতেরা, গপ (গল্প) মারনের জাগা পাও না! দুই ঝোড়া মাটি ফেলাইয়া নয় সিকা পহা গইনা লইতে বড় সুখ! আইজ শালা তোগো মজুরি যদি না কাটি তো আমার নাম ফিরাইয়া রাখিস।

    বছির আর তাহেরের মুখ ম্লান হয়ে গেল। বিষণ্ণ সুরে তারা বলল, যাই ছুটোবাবু, অহন আর খাড়নের সোময় নাই।

    বিনু বলল, একদিন এস আমাদের বাড়ি।

    যামু।

    দেখতে দেখতে নদীপাড়ের নিচু জমি উঁচু হল। তার ওপর সারি সারি ব্যারাক উঠল মিলিটারিদের জন্য।

    শুধু কি তাই, রাজদিয়ায় আগে বিজলি আলো ছিল না। মিলিটারির কল্যাণে, যুদ্ধের কল্যাণে রাতারাতি তা এসে গেল। অবশ্য বিজলি আলোটা সাধারণ মানুষের জন্য নয়, শুধু মিলিটারির জন্য। রাজদিয়ার একমাত্র বড় রাস্তাটাকে দ্বিগুণ চওড়া করে পিচ ঢেলে চেহারা একেবারে বদলে দেওয়া হল। নতুন নতুন আরও অনেকগুলো কংক্রিটের রাস্তাও তৈরি হল। সব চাইতে মজার ব্যাপার যেটা তা হল এইরকম। এখানকার যত তালগাছ, সেগুলোর মাথা কেটে আলকাতরা দিয়ে কালো রং করে দেওয়া হল, সেগুলোকে এখন অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট কামানের মতো দেখায়। অনেকগুলো নকল কামানকে নদীর ধারে ধারে আবার হেলিয়ে রাখা হয়েছে।

    এখন সারাদিন সারারাত রাজদিয়া জুড়ে কাজ চলছে। অগুনতি ঠিকাদার আর হাজার হাজার মজুর শুধু খেটেই যাচ্ছে। রোড রোলার এবং নানারকম যন্ত্রের শব্দে জায়গাটা আজকাল সরগরম।

    রাজদিয়ার গায়ে যেন ময়দানবের ছোঁয়া লেগেছে। এতকাল জায়গাটা যেন ঘুমিয়ে ছিল। শতাব্দীর অতল নিদ্রা থেকে সে আচমকা জেগে উঠেছে।

    কদিন আগেও এখানকার জীবন ছিল স্তিমিত, বেগবর্ণহীন, নিস্তরঙ্গ। তিরতিরে স্রোতের মতো যুগ-যুগান্তরের ওপর দিয়ে নিঃশব্দে, চুপিসারে অতি সঙ্গোপনে সময়ের ধারা বয়ে যেত। রাজদিয়ার সেই শান্ত, অচঞ্চল জীবনযাত্রায় হঠাৎ যেন জলোচ্ছ্বাসের বেগ এসেছে।

    আগে আগে সারাদিনে গোয়ালন্দের একখানা স্টিমার আসত। আজকাল যাত্রীবাহী স্টিমার তো আছেই। তা ছাড়া, সপ্তাহে একবার করে মিলিটারিদের সেই স্টিমারটা সৈন্যসামন্ত, লরি-ট্রাক-জিপ এবং অসংখ্য সরঞ্জাম নিয়ে আসছে। মিলিটারিদের স্টিমারটা এলে জেটিঘাট থেকে নতুন ব্যারাকগুলো পর্যন্ত রাস্তাটা দিয়ে তোক চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। কাছাকাছি কারোকে এগোতে পর্যন্ত দেওয়া হয় না। সাধারণ পুলিশ টুলিশ নয়, কয়েক শ’ মিলিটারি পুলিশ জায়গাটাকে ঘিরে ফেলে। তারপর কী সব জিনিসপত্র ঢাকাটুকি দিয়ে সবার অলক্ষ্যে ব্যারাকের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।

    আড়ালে রাজদিয়ার বাসিন্দারা ফিসফিস করে, শালারা কী আনছে কও দেখি?

    ক্যামনে কই?

    আমার মনে লয়, কামান আর গোলাগুলি।

    হইতে পারে। ঢাইকা ঢুইকা আনে ক্যান?

    কী জানি। যুজ্যে বুঝি গুপন (গোপন) রাখা নিয়ম।

    বিনু লক্ষ করেছে, প্রথম দিন স্টিমারটা এসেছিল দুপুরবেলায়। আজকাল বেশির ভাগ আসে রাতের দিকে। রাত্রিবেলা কখন আসে, টের পাওয়া যায় না। সমস্ত রাত ওখানে থেকে কী করে, কে বলবে। তবে সকাল হলেই রাজদিয়াবাসীরা দেখতে পায়, স্টিমারটা জেটিঘাট ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

    আগে ফিটন আর কদাচিৎ দু’একখানা সাইকেল ছাড়া এখানে অন্য কোনও রকম গাড়িটাড়ি ছিল না। ইদানীং দিনরাত রাজদিয়ার হৃৎপিন্ড কাঁপিয়ে মিলিটারি ট্রাক-জিপ ছুটতে থাকে। শোনা যাচ্ছে, এখানে নাকি একটা এরোড্রোমও তৈরি হবে।

    মিলিটারি ব্যারাক, রাস্তাঘাট, বিজলি আলো–এত কিছু হয়েছে রাজদিয়াতে, তবু যেন কাজের শেষ নেই। ব্যারাকের উলটো দিকের ফাঁকা জায়গাগুলোতে কাঁচা বাঁশের চালা তুলে ঠিকাদার আর মজুরদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে।

    আগে রাজদিয়াতে চায়ের দোকান একটাও ছিল না। দোকান দূরের কথা, চা খাওয়ার রেওয়াজই ছিল না। রাজদিয়ার মোট সাতটি বাড়িতে চা ঢুকত। আজকাল মজুরদের অস্থায়ী আস্তানাগুলোর গায়ে কম করে কুড়িটা চায়ের দোকান বসেছে।

    .

    ২.২৭

    এক ছুটির দিনের সকালে পুবের ঘরের দাওয়ায় বসে হেমনাথরা আসর জমিয়েছেন। স্কুল কলেজ বন্ধ। রান্নাবান্নার তাড়া ছিল না। সকাল থেকেই দিনটার গায়ে যেন আলস্য মাখানো। স্নেহলতারা। পর্যন্ত রান্নাঘর ছেড়ে গল্প করতে বসেছেন।

    কথা হচ্ছিল এই রাজদিয়া নিয়ে। খুব চিন্তিত মুখে হেমনাথ বললেন, কী জায়গা ছিল আর এখন কী দাঁড়িয়েছে।

    অবনীমোহন বললেন, আমরা এসেও যা দেখেছি তা আর নেই। রাতারাতি সব বদলে গেল।

    তা বদলাক। রাস্তাঘাট হয়েছে। ইলেকট্রিক আলো এসেছে। এখন অবশ্য মিলিটারির জন্যে, দুদিন পর আমাদের ঘরেও আসবে। কিন্তু–

    কী?

    একটা বড় সাঙ্ঘাতিক খবর শুনলাম অবনীমোহন–

    কী খবর মামাবাবু?

    মিলিটারিরা মদদ খেয়ে রামকেশবদের পাড়ায় খুব হামলা করেছে। সেদিন নাকি অতুল নাহাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল।

    আমিও শুনেছি।

    সন্ধেবেলা মেয়েদের নিয়ে রাস্তায় বেরুনো এখন নিরাপদ নয়। পরশু দিন রাত্তিরে দুটো মাতাল টমি রুদ্রবাড়ির আরতিকে তাড়া করেছিল। ভাগ্য ভাল, সেইসময় মিলিটারি পুলিশের একটা জিপ এসে পড়ে। তাতে মেয়েটি বেঁচে যায়। বেশ শান্তিতে ছিলাম আমরা। কী উৎপাত শুরু হল বল দেখি—

    সুরমা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। শিউরে উঠে বললেন, সুধা সুনীতির কলেজও তো ওদিকে। আমি ওদের আর পাঠাব না। কোন দিন কী বিপদ হয়ে যাবে–

    হেমনাথ কী বলতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় বাইরের উঠোন থেকে একটা গলা ভেসে এল, হ্যামকত্তা–

    হেমনাথ সেদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, কে রে?

    আমি নিত্য–নিত্য দাস—

    আয়-আয়–

    একটু পর নিত্য দাস পুবের ঘরের দাওয়ার এসে উঠল। সুজনগঞ্জের হাটে আগেই তাকে দেখেছে বিনু। গলায় তিনকন্ঠি তুলসীর মালা, মুখে বসন্তর কালো কালো দাগ। পরনে খাটো ধুতি আর ফতুয়া। দেখতে দেখতে এ চেহারা মুখস্থ হয়ে গেছে বিনুর।

    নিত্য দাস দাওয়ার এক ধারে মাটির ওপরেই বসে পড়ল।

    হেমনাথ বললেন, তোদের খবরটবর কী?

    নিত্য দাস বলল, আপনেগো আশীৰ্বাদে ভালাই।

    বাড়ির সবাই কেমন আছে?

    ভালা।

    একটু ভেবে হেমনাথ এবার বললেন, তারপর এত সকালে কী মনে করে রে?

    নিত্য দাস বলল, একখান কামে আইতে হইল। ভাবলাম, রাইজদায় যহন আইলাম, হ্যামকত্তা আর বৌঠাইনের চরণ দশন কইরা যাই।

    হেমনাথ হাসতে হাসতে বললেন, তুই কাজের মানুষ। শুধু শুধু যে আসিস নি, বুঝতে পেরেছি। তা কাজটা কী?

    এছ.ডি.ও সাহেবের বাংলায় একবার যাইতে হইব।

    কেন রে?

    ক্রাচিন (কেরোসিন), চিনি আর কাপড় কনটোল হইয়া যাইতে আছে।

    হেমনাথ বিস্ময়ের গলায় বললেন, কনট্রোল!

    হ–আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল নিত্য দাস, তিনটা জিনিস বাইরে আর মিলব না। গরমেন্ট লাইছেন (লাইসেন্স) দিয়া কনটোলের দোকান খুলব। গরমেন্ট মাথাপিছু একটা হিসাব ঠিক কইরা দিব, তার বেশি চিনি টিনি পাওয়া যাইব না। এছ.ডি.ও সাহেবেরে ত্যাল দিয়া দেখি একখান লাইছেন পাই কিনা–

    কনট্রোল যে হবে, এ খবর তুই কোথায় পেলি?

    কয়দিন আগে ঢাকায় গেছিলাম। সেইখানেই শুইনা আইছি।

    কবে নাগাদ কনট্রোল হবে, কিছু জানিস?

    দিন তারিখ জানি না, তবে খুব তরাতরিই হইব।

    হেমনাথ এবার আর কিছু বললেন না। তার কপালে দুশ্চিন্তার রেখাগুলি গভীরভাবে ফুটে উঠতে লাগল।

    নিত্য দাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চাপা গলায় বলল, এছ.ডি.ও সাহেবের কাছে তো যাইতে আছি। শুনছি তেনার জবর খাঁই।

    চমকে হেমনাথ শুধোলেন, কিসের খাঁই?

    ঘুষের। পরস্পর শুনলাম, বিনা ঘুষে লাইছেন বাইর করন যাইব না। হেহ লেইগা–

    কী?

    পাঁচ শ’ ট্যাকা আনছি। পাঁচ শ’তে হইব না হ্যামকত্তা?

    কী করে বলি? আমি তো আর এস.ডি.ও সাহেবের অন্তর্যামী না।

    আপনে কত কী দেখছেন, শুনছেন। কত কী জানেন। এট্টা আন্দাজ যদিন দিতেন–

    সে কথার উত্তর না দিয়ে হেমনাথ বললেন, কী এমন লাভের কারবার যাতে পাঁচ শ’ টাকা ঘুষ দিতে চাইছিস?

    রহস্যময় হেসে নিত্য দাস বলল, লাভ আছে বড়কত্তা, লাভ আছে। যদিন না হইব এই সকালবেলা সুজনগুঞ্জ থিকা লৌড়াইয়া আসুম ক্যান? এছ.ডি.ও’র বাংলায় গিয়া দেখুম আমার আগে আরও কয়জন বইসা আছে। একটু থেমে আবার বলল, আমাগো এইদিকে অহনও কনটোল। হয় নাই, কিন্তুক ইনামগুঞ্জে, রসুলপুরে হইয়া গ্যাছে। কনটোলের দোকান দিয়া একেক জন লাল হয়ে গ্যাল।

    লাল কী করে হবে, বুঝতে পারছি না।

    তার পথ আছে বড়কত্তা। আপনি তো আর ব্যবসায়ী না। হইলে বুঝতে পারতেন।

    হেমনাথ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকেন।

    নিত্য দাস আবার বলল, শুদা কাপড়-চিনি-ক্রাচিনের লাইছেন নিতেই আসি নাই বড়কত্তা। আরও একখান কামেও আইছি–

    কী কাজ?

    উই যেইখানে মিলিটারিগো থাকনের বাড়িঘর উঠছে, তার উলটা দিকে মদের দোকান খোলনের লাইছেন দিব গরমেন্ট

    হেমনাথ চমকে উঠলেন, রাজদিয়াতে মদের দোকান ভোলা হবে।

    হ।

    তুই তার লাইসেন্স নিবি নাকি?

    হেই রকমই ইচ্ছা—

    হেমনাথ এবার প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, না, কিছুতেই না।

    হেমনাথ ধীর, স্থির, অচঞ্চল মানুষ। কোনও ব্যাপারে তাকে অসহিষ্ণু বা বিচলিত হতে দেখা যায় না। হঠাৎ তাকে এরকম চেঁচিয়ে উঠতে দেখে সবাই অবাক, কিছুটা বা চিন্তিত।

    নিত্য দাস ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কাঁপা গলায় বলল, আইজ্ঞা—

    হেমনাথ বলতে লাগলেন, তুই না ধর্মকর্ম করিস! নারায়ণ সেবা না করে জল খাস না! তোর এত অধঃপতন হয়েছে! মদের দোকান খুলে এখানকার মানুষের সর্বনাশ করতে চাইছিস!

    কিন্তুক—

    কী?

    এয়া তো ব্যবসা, ধম্মের লগে এয়ার সম্পক্ক কী?

    সম্পর্ক নেই? থাকলেও আমি বুঝতে পারতে আছি না। হে ছাড়া–

    আবার কী?

    আমি যদিন মদের দোকানের লাইছেন না লই, আর কেউ নিয়া নিব—

    যে খুশি নিক, তুই নিতে পারবি না, এই বলে দিলাম—

    নিত্য দাস উত্তর নিল না। শীতল চোখে হেমনাথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ নামাল। একটু পর চলে গেল সে।

    .

    নিত্য দাস যা বলেছিল, তা-ই। দেখতে দেখতে খোলাবাজার থেকে চিনি কাপড় এবং কেরোসিন উধাও হয়ে গেল। সুজনগঞ্জের দোকানদারদের কাছে ধরনা দিলে জোরে জোরে দু’হাত নেড়ে তারা। শুধু বলে, নাই, নাই–

    চিনি না হলে তবু চলে। কিন্তু কেরোসিন আর কাপড় ছাড়া সংসার অচল। রাজদিয়া, কেতুগঞ্জ, ইসলামপুর, ডাকাইতা পাড়া-সারা তল্লাটের লোক কাপড় কেরোসিনের জন্য দিগ্বিদিকে ছোটোছুটি করতে লাগল।

    এই ডামাডোলের ভেতর একদিন দেখা গেল, রাজদিয়াতে কাপড়-কেরোসিন-চিনির জন্য তিনটে কনট্রোলের দোকান বসেছে। একটা কেতুগঞ্জের রায়েবালি শিকদারের, একটা ইসলামপুরের অখিল সাহার, আর তৃতীয়টি নিত্য দাসের।

    একজন যাতে বার বার কেরোসিন না নিতে পারে সেজন্য পরিবার পিছু রেশন কার্ডও হল। রেশন কার্ড দেখালে তবেই ওই দুর্লভ বস্তুগুলো পাওয়া যায়।

    আরও কিছুদিন পর রাজদিয়াবাসীরা দেখল, মিলিটারি ব্যারাকের উলটো দিকে একটা মদের দোকান খোলা হয়েছে। দোকানটার মালিক আর কেউ না, স্বয়ং নিত্য দাস।

    নিত্য দাস মদের দোকান খুলেছে, এই খবরটা এল দুপুরবেলা। শুনে তক্ষুনি হেমনাথ ছুটলেন। স্নেহলতা বারণ করলেন, এখন বেরুতে হবে না।

    অবাক বিস্ময়ে হেমনাথ বললেন, বেরুব না, বল কী!

    বেরিয়ে কী হবে? তার চাইতে দু’দন্ড বিশ্রাম কর।

    তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হল স্নেহ! মদের দোকান দিয়ে হারামজাদা সারা রাজদিয়াকে জাহান্নামে পাঠাবে, আর ঘরে বসে আমি বিশ্রাম করব!

    ভয়ে ভয়ে স্নেহলতা বললেন, ওখানে গিয়ে তুমি কী করবে?

    শান্ত অথচ কঠিন গলায় হেমনাথ বললেন, যাতে এখানকার সর্বনাশ না করতে পারে গোড়াতেই তার ব্যবস্থা করব।

    কিন্তু—

    কী?

    এটা ওর ব্যবসা—

    যে ব্যবসা মানুষের ক্ষতি করে তা চালাতে দেওয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারে আমার কর্তব্য আছে।

    হেমনাথকে আটকানো গেল না, দুপুরের সূর্য মাথায় নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।

    বেশ কিছুক্ষণ পর হেমনাথ ফিরে এলেন। এখন আর তার দিকে তাকনো যাচ্ছে না। সমস্ত রক্ত বুঝি মুখে গিয়ে জমা হয়েছে। চোখ দুটো যেন ফেটেই পড়বে।

    উদ্বিগ্ন মুখে স্নেহলতা শুধালেন, কী হয়েছে?

    হেমনাথ উত্তর দিলেন না।

    স্নেহলতা কাছে এগিয়ে এসে আগের স্বরেই আবার জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, বলছ না কেন?

    হেমনাথ এবার বললেন, নিত্য আমাকে অপমান করেছে। অসহ্য আবেগে তার ঠোঁট এবং কণ্ঠস্বর কাঁপতে লাগল।

    অপমান!

    তা ছাড়া কী? হেমনাথকে অত্যন্ত উত্তেজিত দেখাল, আমি নিত্যকে বললাম দোকান বন্ধ করে দে। কিছুতেই সে শুনল না।

    বিনু-ঝিনুক-অবনীমোহন-সুরমা, হেমনাথকে ফিরতে দেখে সবাই ছুটে এসেছিল। কেউ কিছু বলল না। স্নেহলতাও এবার চুপ করে রইলেন।

    হেমনাথ আবার বললেন, সারা জীবন মানুষের হিত ছাড়া অহিত চিন্তা করি নি। যাকে যা বলতাম সে তা-ই শুনত, সেইমতো চলত। কিন্তু এই শেষ বয়েসে নিত্য দাস আমার কথাটা রাখল না, আমাকে অমান্য করল। দুঃখে অভিমানে তাঁর গলা বুজে এল।

    আবছা গলায় স্নেহলতা বললেন, তখনই তো তোমাকে বললাম, যেও না

    উত্তর না দিয়ে হেমনাথ ঘরের ভেতর চলে গেলেন। তারপর দুই হাঁটুর ওপর মুখ রেখে আচ্ছন্নের মতো বসে থাকলেন।

    বিনু দাঁড়িয়ে ছিল। আস্তে আস্তে একসময় এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে হেমনাথ যেন একবারে ভেঙেচুরে গেছেন। তাকে ক্লান্ত, পরাভূত, মলিন দেখাচ্ছে।

    দাদুর অবস্থা খানিকটা অনুমান করতে পারছিল বিনু। রাজদিয়াকে ঘিরে বিশ পঁচিশ মাইলের মধ্যে যত গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ, সব কিছুর ওপর ঈশ্বরের মতো ব্যাপ্ত হয়ে আছেন হেমনাথ। তিনি আঙুল তুলে সামান্য একটু ইঙ্গিত করলে চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে। সবাই তাকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে।

    যে মানুষ এতকাল শুধু সম্মানই কুড়িয়েছেন, যাঁর প্রতিষ্ঠা ছিল সম্রাটের মতো, জল-বাংলার এই জায়গাটুকু জুড়ে সহস্র হৃদয়ে যার সিংহাসন পাতা, জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে সেই হেমনাথ আজ প্রচন্ড আঘাত পেয়েছেন। নিত্য দাস অবাধ্য হবে, হেমনাথের পক্ষে, তা ছিল অকল্পনীয়। এই একটি আঘাত তাকে একেবারে চুরমার করে দিয়েছে।

    অবনীমোহনরা এখনও বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। স্নেহলতা হঠাৎ ফিসফিস গলায় বললেন, কী লক্ষ্মীছাড়া যুদ্ধ যে বাধল! মানুষকে একেবারে বদলে দিচ্ছে। ওই নিত্য দাস আগে আগে এ বাড়িতে পড়ে থাকত। একটা পয়সা ছিল না তার। তোমার মামাবাবু টাকা দিয়ে ব্যবসায় বসিয়ে দিলে। সেই থেকে তার উন্নতি। এখন তার আড়তে সবসময় দু’তিন শ’ মণ ধান মজুত থাকে, যখন তখন দশ বিশ হাজার টাকা বার করে দিতে পারে। যার জন্যে এত, তার কথাটাই রাখল না নিত্য দাস!

    অবনীমোহন কিছু বললেন না, বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে থাকলেন।

    .

    ২.২৮

    দিনকয়েক পর সন্ধের সময় যথারীতি খবরের কাগজ পড়ার আসর বসেছে। ইচু মণ্ডল, হাচাই পালরা অন্ধকার নামতে না নামতেই এসে হাজিরা দিয়েছে।

    অবনীমোহন পড়ছিলেন, রেঙ্গুনের পতন। মাত্র কয়েকদিন আগে সিঙ্গাপুর অধিকার করিবার পর জাপবাহিনী আজ রেঙ্গুন দখল করিয়াছে। মিত্র সৈন্যরা সাফল্যের সহিত পশ্চাদপসরণ করিতেছে।

    জাপানী আক্রমণের আতঙ্কে কলিকাতা সন্ত্রস্ত। মহানগরী ত্যাগ করিয়া বহু লোকের নানা দিকে পলায়ন–

    হঠাৎ পড়া থামিয়ে অবনীমোহন বললেন, কলকাতায় ইকুয়েশন শুরু হয়ে গেল মামাবাবু–

    এর ভেতর সেদিনের সেই আঘাতটা অনেকখানি সামলে নিয়েছেন হেমনাথ। বললেন, তাই তো দেখছি। আমার মনে হয়, রাজদিয়ার লোক যারা কলকাতায় থাকে, তারাও চলে আসবে।

    হেমনাথ যা অনুমান করেছেন তা-ই। দু’একদিনের ভেতর দেখা গেল স্টিমার বোঝাই হয়ে। রাজদিয়ার প্রবাসী সন্তানেরা জাপানি বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে চলে আসছে। দেখতে দেখতে নাহাপাড়া, গুহপাড়া, দত্তপাড়া, আদালতপাড়া, কলেজপাড়ার ফাঁকা বাড়িগুলো ভরে গেল।

    কলকাতা থেকে যারা এসেছে তাদের মুখে চমকপ্রদ সব খবর পাওয়া যাচ্ছে। জলোচ্ছ্বাসের দিশেহারা ঢলের মতো কলকাতার লোকেরা নাকি যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। রেলওয়ে বুকিং অফিসগুলোতে দু’মাইল লম্বা কিউ’ পড়েছে, কিন্তু টিকিট মিলছে না। ন্যায্য দামের সঙ্গে দ্বিগুণ তিনগুণ ঘুষ দিয়েও না। হাওড়া আর শিয়ালদা স্টেশনে ঢুকবার উপায় নেই। একেক ট্রেনে দশটা ট্রেনের যাত্রী উঠছে। বেঞ্চির তলায় পা রাখবার জায়গা নেই। সেখানেও মানুষ। ল্যাট্রিন, পা-দানি, এমনকি ছাদের ওপর উঠেও মানুষ পালাচ্ছে। ছাদে যারা ওঠে তাদের মধ্যে কত লোক যে ওভারব্রিজে ধাক্কা খেয়ে মরছে, হিসেব নেই।

    মারোয়াড়ী, হিন্দুস্থানী, গুজরাটিরা জলের দরে বাড়ি বেচে দিচ্ছে। রেলের আশায় তারা কলকাতায় বসে থাকছে না। স্রেফ পা দু’খানার ওপর ভরসা করে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে পাড়ি জমাচ্ছে। বাঙ্গলিরা বেশির ভাগ যাচ্ছে গ্রামের দিকে। যাদের অনেক পয়সা তারা মধুপুর, গিরিডি, যশিডিতে গিয়ে টপাটপ বাড়ি কিনছে। প্রাণের মায়া বড় কঠিন মায়া।

    ত্রৈলোক্য সেনরা আসার পর বর্মার খবর শুনবার জন্য রাজদিয়াবাসীরা তার কাছে ছুটত। বর্মা সম্বন্ধে উৎসাহ মলিন হয়ে গেছে। এখন কলকাতার খবর শুনতে এখানকার লোকজন নাহাপাড়া, আদালতপাড়া, দত্তপাড়ায় ছুটছে।

    সব শুনে অবনীমোহন সুরমাকে বললেন, এখানে জমিজমা কিনে বুদ্ধিমানের কাজই করেছিলাম, কি বল?

    সুরমা বলেন, ভাগ্যিস কিনেছিলে! নইলে এ সময়ে কোথায় যে যেতাম!

    ঝিনুকও কলকাতা থেকে লোক পালানোর খবর শুনেছিল। এ সব কথা যখন হত, অসীম আগ্রহে। সে গিলতে থাকত।

    একদিন সবার আড়ালে ঝিনুক বলল, আচ্ছা বিনুদা—

    বিনু বলল, কী?

    কলকাতা থেকে লোক তো পালাচ্ছে–

    হ্যাঁ।

    তা হলে ঝুমারাও এখানে চলে আসবে?

    ঝুমাদের কথা অনেকদিন ভাবে নি বিনু। ঝিনুকের কথায় হঠাৎ চকিত হয়ে উঠল। তাই তো, কলকাতা থেকে সবাই চলে আসছে। ঝুমারা তো এখনও এল না!

    .

    ২.২৯

    কলকাতা থেকে তোক পালাবার হিড়িক শুরু হয়েছে। ফলে শুধু রাজদিয়াই নয়, আশেপাশে গ্রাম গঞ্জ জনপদ দ্রুত ভরে উঠছে। চারধারের গ্রামগুলোই কি শুধু? সারা জল-বাংলাই হয়তো মানুষে মানুষে ছেয়ে যাচ্ছে।

    এতদিন রাজদিয়ার বাড়ি বাড়ি ঘুরে খবর আনছিলেন হেমনাথ। ইদানীং কিছুদিন ধরে আশেপাশের গ্রামগুলোতে যাচ্ছেন। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে যান। ফিরতে ফিরতে বিকেল কিংবা সন্ধে। ফিরে কোনও দিন বলেন, আজ দেবীপুরে গিয়েছিলাম। শুধু কলকাতারই লোক। কোনও দিন বলেন আজ গিয়েছিলাম বাজিতপুরে, সেখানেও এক অবস্থা। কোনও দিন বলেন, ভাগ্যিস যুদ্ধটা বেধেছিল আর জাপানি ব্যাটারা বার্মায় বোমা ফেলেছিল, তাই না ঘরের ছেলেরা ঘরে ফিরে এসেছে। যারা কখনও এখানে আসত না, এখানকার পাট চুকিয়ে কলকাতাবাসী হয়েছিল, যুদ্ধের কল্যাণে দেশের বাড়ির জন্যে তাদের প্রাণ কেঁদে উঠেছে।

    জিনিসপত্রের দাম আগে থেকেই বাড়ছিল, কলকাতায় ইকুয়েশন শুরু হবার পর হু হু করে আরও চড়ছে। এখন সব জিনিসেরই সকালে এক দর, দুপুরে এক দর, সন্ধেয় আরেক দর। দরটা এখন কিভাবে কতগুণ চড়বে, আগে তার হদিসই পাওয়া যায় না। বাজার এখন বড় অস্থির।

    তবু যত দামই বাড়ক, কলকাতার তুলনায় অনেক কম।

    আজকাল হাটে গেলে মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়। কলকাতার বাবুরা হঠাৎ এই শস্তাগন্ডার দেশে এসে একেবারে অবাক হয়ে গেছেন। যে জিনিস দেখেন তাই কিনে ফেলেন, দরদস্তুর কিছুই করেন না। যা দাম চাওয়া যায়, ঝনাৎ করে ফেলে দেন। আর কথায় কথায় বলেন, আম চিপ—

    সেদিন অবনীমোহন আর হেমনাথের সঙ্গে সুজনগঞ্জের হাটে গিয়েছিল বিনু। সেখানে চমকপ্রদ একটা ব্যাপার ঘটল।

    একজন মুসলমান ব্যাপারি ক’টা গাছপাকা পেঁপে নিয়ে বসে ছিল। সব চাইতে বড় ফল দু’টো বেছে অবনীমোহন বললেন, দাম কত?

    ব্যাপারি বলল, একখান আধুলি লাগব বাবু।

    জল-বাংলায় আসার পর প্রথম প্রথম দরদাম করতেন না অবনীমোহন। আজকাল এখানকার হালচাল বুঝে গেছেন। যে জিনিসের দাম চার পয়সা, ব্যাপারি হাঁকে দু’আনা। কজেই দর টর না করলে কি চলে!

    অবনীমোহন বললেন, বল কি, ওই দুটো পেঁপের দাম আট আনা!

    হ বাবু। সিকি আধলাও কমাইতে পারুম না।

    ন্যায্য দাম বল, নিয়ে যাই।

    চাউলের মণ বাইশ ট্যাকা, বাইগনের স্যার ছয় পহা, ঝিঙ্গার তিন পহা। দুইটা বড় পাউপার (পেঁপে) দাম আষ্ট আনা চাইয়া অলেহ্য (অন্যায়) কাম করি নাই।

    শোন ব্যাপারি, তোমার কথাও থাক, আমার কথাও থাক, ছ’আনা দিচ্ছি। দিয়ে দাও।

    ব্যাপারি এবার উত্তর দিল না। মুখ ঘুরিয়ে পাশের মরিচ-ব্যাপারির সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল।

    অবনীমোহন বললেন, কী হল, আমার কথাটা শুনতে পেলে না?

    মুখ না ফিরিয়ে ব্যাপারি বলল, শুনছি।

    আমি যা বললাম সেই দামে দেবে কি দেবে না, কিছু বললে না তো?

    একটু চুপ করে থেকে ব্যাপারি বলল, আপনের কাম না বাবু—

    অবনীমোহন অবাক, কী আমার কাজ নয়?

    আমার পাউপা কিনন (কেনা)। আপনের কাছে তো আষ্ট গন্ডা পয়সা চাইছি। ড্যাঞ্চি বাবুরা (ড্যাম চিপ বাবুরা) আইলে এক ট্যাকা দিয়া লইয়া যাইব।

    সত্যিই তাই। তাদের কথাবার্তার মধ্যে কলকাতার এক বাবু এসে ছোঁ মেরে পেঁপে দুটো কিনে নিল। দাম বাবদ একটি টাকা আদায় করে গেজেতে পুরতে পুরতে সগর্বে হাসল ব্যাপারি, দেখলেন

    এ নিয়ে তর্কাতর্কি ঝগড়াঝাটি বানো যেত। অবনীমোহন কিছুই করলেন না। মুখ লাল করে মাছহাটার দিকে চলে এলেন।

    সুজনগঞ্জে এসেই হেমনাথ ধানের আড়তগুলোর দিকে চলে গিয়েছিলেন। অবনীমোহন আর বিনু গিয়েছিল বাড়ির জন্য সওদা করতে।

    মাছের বাজারে এসে প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা হল।

    এক চেনাজানা মাছ-ব্যাপারি, নাম তার গয়জদ্দি নিকারি, এক কোণে দোকান সাজিয়ে বসেছিল। সুজনগঞ্জে প্রথম যেদিন এসেছিলেন, সেদিন থেকেই গয়জদ্দির কাছে মাছ কিনছেন অবনীমোহন। গয়জদ্দি তার বাঁধা ব্যাপারি।

    গয়জদ্দি আজ ভাল ভাল, লোভনীয় মাছ এনেছে। তার সামনে দুটো বড় বড় বেতের চাঙাড়ি। চাঙাড়ির ঢাকনার ওপর পেট-লাল গরমা, কালবোস, কাজলি এবং কুলীন জাতের চকচকে পাবদা মাছ সাজানো।

    এই জলের দেশে যেখানে অঢেল মাছ, সেখানেও এরকম পাবদা দুর্লভ। মাছগুলোর লালচে রুপোলি শরীর এত চকচকে যে মনে হয় পালিশ করা।

    অবনীমোহন বললেন, ককুড়ি পাবদা আছে গয়জদ্দি?

    গয়জদ্দি বলল, তিন কুড়ি।

    দাম কত নেবে?

    পাবদাগুলা আপনেরে দিমু না জামাইকত্তা—

    কেন?

    গয়জদ্দি বলল, উইগুলার অন্য গাহেক (খদ্দের) আছে।

    হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তে কৌতুকের গলায় অবনীমোহন বললেন, ড্যাঞ্চিবাবুরা নাকি?

    গয়জদ্দি একগাল হাসল, হ। ড্যাঞ্চিবাবুরা একেবারেই মূলায় (দরদাম করে) না। যা কই হেই দিয়া যায়। এই সুযুগে দুইখান পহা কইরা লই।

    অবনীমোহন বললেন, পাবদা না দাও, কালবোসটা দাও।

    কালিভাউসটাও ড্যাঞ্চিবাবুগো লেইগা রাখছি।

    অগত্যা ডুলা বোঝাই করে কাজলি মাছই কিনলেন অবনীমোহন।

    এখন সুজনগঞ্জের হাটে ‘ড্যাঞ্চি’ বাবুদেরই জয়জয়কার।

    .

    ২.৩০

    বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে যারা পালিয়ে এসেছে তাদের ছেলেমেয়েরা রাজদিয়ার স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে লাগল।

    বিনুর ক্লাসেও দশ-বারটা ছেলে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে সব চাইতে চমকদার হল গোঁসাই বাড়ির অশোক। প্রথম দিন স্কুলে এসেই সে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। বিনু আর শ্যামল তো রীতিমতো তার ভক্তই হয়ে দাঁড়িয়েছে। হবার মতো যথেষ্ট কারণও রয়েছে।

    অশোক স্কুলে আসে সাইকেলে করে। ঝকঝকে নতুন সাইকেল তার। স্কুলের সামনের মাঠটায় বোঁ করে একটা পাক দিয়ে সাইকেলটা যখন সে থামায় সেই বিস্ময়কর দৃশ্যের দিকে অন্য ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এত সুন্দর সাইকেল সারা রাজদিয়াতে আর কারোর নেই।

    সাইকেলের নানারকম খেলাও জানে অশোক। একটু আগে স্কুলে এসে সে সবও দেখায় সে। হ্যান্ডেল না ধরে অশোক সাইকেল চালাতে পারে। চলন্ত অবস্থায় সিটে বসে জামাকাপড় পরতে পারে।

    বিনু আর শ্যামলের চাইতে অশোক বেশ বড়। অন্তত দু’তিন বছরের তো বটেই। ফেরতা দিয়ে কাপড় পরে সে, লম্বা জুলপি রাখে। ঘাড়ের ওপর জামার কলারটা সবসময় খাড়া হয়ে থাকে। বুকের কাছে একটা মোটে বোতাম আটকানো, বাকি দু’টো খোলা। ফলে ভেতরের গেঞ্জি দেখা যায়। ছোকরার ঠোঁটের ওপর সরু শৌখিন গোঁফ। যখন কায়দা করে হাঁটে, পায়ের চটি দু’ফুট আগে আগে চলে। কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে চমৎকার শিস দিতে পারে সে।

    একেক দিন একেক রকম করে চুল আঁচড়ে আসে অশোক। একদিন হয়তো ব্যাকব্রাশ করে এল, একদিন এল অ্যালবার্ট কেটে, কিংবা চুলে ঢেউ খেলিয়ে।

    কোনও দিন এসে অশোক বলে, কার মতো চুল আঁচড়েছি বল তো?

    সারা ক্লাস চারদিক থেকে সাগ্রহে, সমস্বরে শুধোয়, কার মতো?

    রবীন বিশ্বাসের।

    বিনু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, রবীন বিশ্বাস কে ভাই?

    রবীন বিশ্বাসের কথা জানে না, এমন ছেলে হয়তো এই প্রথম দেখল অশোক। অবাক বিস্ময়ে সে বিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে। বলে, রবীন বিশ্বাসকে চেনো না!

    রবীন বিশ্বাসকে না চেনার লজ্জায় মাথা আপনা থেকেই নুয়ে পড়ে বিনুর।

    অশোক আবার বলে, স্টাইল যদি শিখতে হয় রবীন বিশ্বাসের সিনেমা দেখতেই হবে।

    বিনু এতক্ষণে বুঝতে পারে, রবীন বিশ্বাস একজন ফিল্মস্টার।

    কোনও দিন এসে অশোক বলে, আজ ছবি মজুমদারের স্টাইলে চুল আঁচড়েছি।

    কোনও দিন বলে, আজ জহর ব্যানার্জির মতো আঁচড়েছি।

    জামাও অশোক একরকম পরে না। বেশির ভাগ দিনই কলারওলা অথবা হাতাহীন পাঞ্জাবি পরে আসে। বলে, কী একটা বইয়ে মনে পড়ছে না, অমলেশ বড়ুয়া এইরকম জামা পরেছিল।

    ছোটদি আর বড়দির মুখে অমলেশ বড়ুয়ার নাম শুনেছে বিনু। কাজেই তার সম্বন্ধে আর জিজ্ঞেস করে না।

    কিন্তু এ সব অতি সামান্য ব্যাপার। ছেলেদের নিশ্বাস বন্ধ করে দেবার মতো আরও অনেক কিছু জানে অশোক। হেন সিনেমা নেই যা সে দেখেনি। শুধু সিনেমা দেখাই নাকি, ছায়ালোকের তাবৎ কিন্নর-কিন্নরীকেও সে চেনে। অশোক বলে, স্টার চিত্রতারকা। কলকাতায় থাকতে সে নাকি তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। সে লীলারানীকে দেখেছে, কনকবালাকে দেখেছে, ছবি মজুমদারকে দেখেছে। জহর ব্যানার্জি, অমলেশ বড়ুয়া, মহীন্দ্র গাঙ্গুলি, কাকে না চেনে সে? কাকে না দেখেছে?

    ক্লাসে, ক্লাসের বাইরে সারক্ষণ সিনেমার নানা গল্প করে যায় অশোক। ফাঁকে ফাঁকে গান। কত গানই না সে জানে।

    এসো যৌবন,
    এসো যৌবনমত্তা ওগো।
    মধুমাস এলো কি–
    সাগরের কল্লোল শুনি তব বক্ষে
    বিজলির ঝিলিমিলি আনিয়াছ চক্ষে।

    কিংবা

    তাহারে যে জড়াতে চায় দুটি বাহুলতা–
    কে শুনেছে মোর কামনার নীরব ব্যাকুলতা।

    কিংবা

    আমার ভুবনে এল বসন্ত তোমারই তরে।
    আঁখি দুটি তব রাখ, রাখ মোর আঁখির পরে।

    ছায়ালোকের অজস্র জ্ঞানে বোঝাই হয়ে যে এসেছে তার ভক্ত না হওয়াটাই তো আশ্চর্যের।

    ক্লাসের সব ছেলেই অশোকের ভক্ত, তবু তাদের মধ্যে বিনু আর শ্যামলের তুলনা হয় না। অশোকের দিকে সর্বক্ষণ তারা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। অশোক যা বলে অভিভূতের মতো শুনে যায়। একই কথা বার বার শুনেও ক্লান্তি নেই। অশোককে একবার পেলে তার সঙ্গ ছাড়তে চায় না। গুড়ের গায়ে মাছির মতো বিনু আর শ্যামল তার গায়ে লেগেই আছে।

    এমন ভক্ত পেলে কে না খুশি হয়! অশোকও সবার ভেতর থেকে বিনুদের বেছে বার করেছে। তাদের সঙ্গেই সে বেশি মেশে, বেশি গল্প করে, বেশি ঘোরে। মোট কথা, তাদের ওপরেই অশোকের বেশি অনুগ্রহ।

    আগে জামাকাপড় পোশাকটোশাকের দিকে নজর থাকত না বিনুর। ছেঁড়া হোক, ময়লা হোক একটা কিছু পরতে পেলেই হত। জুতো পায়ে দেবার বিশেষ বালাই ছিল না। এ সব ব্যপারে একেবারেই উদাসীন ছিল।

    অশোক আসার পর সাজটাজের দিকে মন গেছে বিনুর। আজকাল আর ময়লা জামাপ্যান্ট পরতে চায় না। পোশাকটি ধবধবে হওয়া চাই, তাতে কড়া ইস্তিরি থাকা চাই। জুতোটা চকচকে ঝকমকে না হলে আজকাল আর চলে না।

    প্রায় কান্নাকাটি করেই একটা ধুতি কিনেছে বিনু। কলারও হাতাহীন পাঞ্জাবি বানিয়েছে। অশোকের মতো কায়দা করে ফেরত দিয়ে আজকাল ধুতি পরে সে। বাড়িতে অবশ্য করে না, রাস্তায় বেরুলেই জামার কলার উলটে দেয়। চটিটা সামনের দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে হাঁটে।

    এ তো গেল পোশাকের কথা। তা ছাড়া, অশোককে আরও নানা দিক থেকে নকল করছে বিন্দু। তার মতো স্টাইল করে চুল আঁচড়ায়, সরু করে শিস দেওয়া প্র্যাকটিশ করে। আর গান তো আছেই। দিনরাত গুন গুন করেই যাচ্ছে সে :

    শত জনমের কামনা বাহিয়া।
    রূপ ধরে আজ এসেছ কি প্রিয়া?
    যত ভালবাসা তত যদি আশা—

    বিনুর হঠাৎ পরিবর্তনটা সুধা সুনীতির চোখেও পড়েছে। এত দ্রুত বদলে গেলে না পড়ে উপায় কী। সুনীতি গালে হাত দিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, ও বাবা, দিন দিন ছেলে কেমন স্টাইল শিখছে দেখ না!

    সুধা ঝঙ্কার দিয়ে বলে, ছোঁড়া একেবারে ঝুনো হয়ে উঠেছে। ওই গোঁসাইবাড়ির অশোকটা আসার পরই পাকামো শুরু হয়েছে। হা রে বিনু, লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি টিড়ি খাচ্ছিস নাকি?

    সুধার কথা শেষ হবার আগেই লঙ্কাকান্ড বেধে যায়। বিনু তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝিনুক অবশ্য অন্য কথা বলে, তুমি অমন গুন গুন কর কেন বিনুদা? গলা ছেড়ে গাইতে পার না? কী সুন্দর গলা তোমার!

    যত জ্ঞানের জাহাজ হয়েই আসুক, তার তো শেষ আছে। একদিন সিনেমার গান আর গল্পের ঝুলি ফুরিয়ে গেল অশোকের। ফুরোবার পর আবার নতুন করে সেগুলো শোনাল সে। তারপর আবার, এবং আরও অনেক বার।

    শুনতে শুনতে সব গান মুখস্থ হয়ে গেছে বিনুর। যত রোমাঞ্চকর আর যত চমকপ্রদই হোক না, একই গল্প কত বার শুনতে ভাল লাগে! আজকাল যখন অশোক চিত্রতারকার গল্প নিয়ে বসে, বিনু বা শ্যামল ততটা আগ্রহ নিয়ে শোনে না।

    ভক্তদের বিস্ময় আর মুগ্ধতা যে কমে আসছে তা লক্ষ করে একদিন অশোক বলল, চল, মিলিটারিদের ব্যারাক থেকে ঘুরে আসি।

    মিলিটারির কথায় ভয় পেয়ে গেল বিনু। বলল, না না, ওখানে গিয়ে দরকার নেই। নদীর পাড়ে ব্যারাকগুলো যখন তৈরি হচ্ছিল তখন খুব যেত বিনু। নিগ্রো আর আমেরিকান টমিরা ওখানে আসার পর আর যায় না।

    অশোক বলল, যাবে না কেন?

    ওরা যদি ধরে রেখে দেয়?

    ভীতু কোথাকার! আমরা কলকাতায় কত মিলিটারির সঙ্গে মিশেছি। কই আমাদের তো ধরত।

    বিনু বলল, কলকাতায় এখন বুঝি খুব মিলিটারি!

    অশোক মাথা নাড়ল, মিলিটারি ছাড়া কলকাতায় এখন আর কিছু নেই। রাস্তায় রাস্তায় মিলিটারি ট্রাক আর জিপ। লালমুখো আমেরিকান টমি আর নিগ্রো সোলজার। লেকের দিকে কখনও গেছ?

    অনেক বার।

    সেখানে এখন মিলিটারিদের ছাউনি পড়েছে। ওদিকে যেতে কেউ সাহস পায় না। কিন্তু বন্ধুদের নিয়ে আমি ঠিক চলে যেতাম–বলে সগর্বে তাকাল অশোক।

    বিনু আর শ্যামল অবাক হয়ে গেল।

    অশোক আবার বলল, শুধু যেতামই না, ওদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে চকোলেট, টফি, ড্রাই ফুড, টিনের মাছকত কী আদায় করতাম।

    বিনুরা সবিস্ময়ে ফিসফিসিয়ে বলল, তাই নাকি!

    অশোক বলল, এই হুঁ হুঁ–তারপর হঠাৎ কী মনে পড়তে তাড়াতাড়ি আবার বলে উঠল, ধরে রাখার কথা বললে না তখন

    হ্যাঁ।

    ধরে তোমাকে ঠিকই রাখবে। যদি—

    যদি কী?

    তুমি মেয়ে হতে।

    মেয়ে হলে ধরে রাখবে কেন?

    ঠোঁট টিপে চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ বিনুকে দেখল অশোক। তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে কী বলল।

    সঙ্গে সঙ্গে মুখ লাল হয়ে উঠল বিনুর, কান ঝা ঝা করতে লাগল।

    হাসতে হাসতে অশোক বলল, তুমি একটা ভোদা। তোমাকে মানুষ করতে অনেক সময় লাগবে। বলে একরকম টানতে টানতে মিলিটারি ব্যারাকের দিকে নিয়ে গেল।

    .

    ব্যারাকের সীমানা তারকাঁটা দিয়ে ঘেরা। কয়েক মাইল জুড়ে এই সীমানা। অবশ্য মাঝে মাঝে কাঠের গেট রয়েছে। সেখানে মিলিটারি পুলিশ রাইফেল কাঁধে পাহারা দিচ্ছে।

    বিনুরা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছল, প্রথম গেটটা থেকে কিছু দূরে তারকাটার ওপর একটা করে পা রেখে পাঁচ ছটা লালমুখো টমি দাঁড়িয়ে আছে। সীমানার বাইরে একদল আধ-ন্যাংটো, কালো ক্ষুধার্ত মানুষ জড়ো হয়েছে। তাদের লুব্ধ, করুণ চোখ টমিগুলোর দিকে। মনে হয়, ওরা প্রায়ই এখানে আসে। টমিগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচয় আছে।

    অশোক বিনুদের নিয়ে বাইরে জনতার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর বলল, এখানে দেখছি অনেক খদ্দের। এই কালো কালো জানোয়ারগুলো এসে জুটেছে। কলকাতায় আমরা দু চারজন মোটে যেতাম। বলেই টমিদের দিকে ফিরে বলল, হ্যালো জো—

    টমিরা ভুরু বাঁকিয়ে তাকাল, কিছু বলল না।

    অশোক আবার বলল, ইউ আর ভেরি কাইন্ড। প্লিজ গিভ আস চকোলেট, টফি। হ্যালো জো–

    টমিরা নিজেদের ভেতর কী বলাবলি করল না। তারপর পকেট থেকে মুঠো মুঠো চকোলেট আর টফি বার করে ছুঁড়তে লাগল। নিমেষে বাইরে জনতার ভেতর চিৎকার চেঁচামেচি মারামারি কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেল। অশোকও তার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিনু আর শ্যামল অবশ্য দাঁড়িয়ে রইল।

    একটা টমি উৎসাহ দেবার ভঙ্গিতে চেঁচাতে লাগল, গো অন ফাইটিং, ইউ ডগস, স্ন্যাচ ম্যাচ বাইট দ্যাট সোয়াইন–পুশু দ্যাট বাস্টার্ড–

    আরেকটা টমি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল, ব্লডি ইন্ডিয়ানস–বেগারস, সন্স অফ বিচ–

    বাকি টমিগুলো কিছুই বলল না, ক্যামেরা বার করে টকাটক ছবি তুলতে লাগল।

    কাড়াকাড়ি করে অনেকগুলো চকোলেট কুড়িয়েছে অশোক। সেগুলো নিয়ে বিনুদের কাছে এসে বলল, আচ্ছা ছেলে তো তোমরা, চুপচাপ হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে রইলে! তোমরা কুড়োলে আরও কত চকোলেট পাওয়া যেত।

    বিনু হঠাৎ বলে ফেলল, টমিরা কী বলছিল জানো?

    কী?

    ব্লাডি বেগারস, ডগস, সোয়াইনস–এমনি আরও কত কি। এ সব শুনবার পরও ওদের জিনিস কুড়োতে যাব!

    অশোক গ্রাহ্য করল না। গা থেকে গালাগালগুলো ঝেড়ে ফেলে বলল, বলুক গে। গায়ে তো। আর ফোস্কা পড়ছে না। ওদের চকোলেট খেয়ে দেখ, জীবনে এমন জিনিস আর কখনও খাও নি। খাস আমেরিকায় তৈরি। শুধু টমিদের জন্যে জাহাজে করে আসে। বলে একটা বড় চকোলেট এগিয়ে। দিল।

    বিনু কিন্তু নিল না।

    মিলিটারি ব্যারাকে সেই একদিনই গেল না বিনুরা। অশোক প্রায় রোজই তাদের ধরে নিয়ে যেতে লাগল।

    টমিরা তারকাঁটার বেড়ার ওধারে দাঁড়িয়ে রোজ শুধু চকোলেট ছোড়ে না, এক-আধদিন বিস্কুটের টিন, ড্রাই ফুড়ের টিনও ছোড়ে। মাঝে মাঝে মুঠো মুঠো রেজগিও ছুঁড়ে দেয়। পয়সা যেদিন ছড়ায়, মারামারিটা সেদিন সাঙ্ঘাতিক রকমের ঘটে যায়।

    প্রথম প্রথম বিনু ওদের কোনও জিনিসই ছুঁত না। অশোকের দেখাদেখি কবে থেকে যে সে কাড়াকাড়ি করতে শুরু করেছে, নিজেই জানে না।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.