Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ২.৩৬-৪০ চিনি কেরোসিন আর কাপড়

    ২.৩৬

    কনট্রোল হবার আগেই চিনি কেরোসিন আর কাপড় বাজার থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। তারপর এই রাজদিয়ায় তিনখানা কনট্রোলের দোকান বসল। একটা নিত্য দাসের, একটা অখিল সাহার আর তৃতীয়টি রায়েবালি শিকদারের।

    প্রথম প্রথম রেশন কার্ড দেখিয়ে জিনিস তিনটে পাওয়া যাচ্ছিল। তারপর কনট্রোলের দোকান থেকে সেগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল।

    মিলিটারি ব্যারাকগুলি বাদ দিলে রাজদিয়ার ঘরে ঘরে আজকাল আর হেরিকেন জ্বলে না। গন্ধক শলা কি রেডির তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে সবাই রাতের কাজ সারে। চারদিকের গ্রামগুলোর অবস্থা আরও করুণ। সেখানকার মানুষেরা বিকেল থাকতে খেয়েদেয়ে (যে খাবার জোটাতে পারে) ঘরে খিল লাগিয়ে দেয়। ফলে সন্ধে নামতে না-নামতেই গ্রামগুলো নিশুতিপুর। সারা পূর্ব বাংলা জুড়ে পাতালের অন্তহীন, গাঢ় অন্ধকার যেন অনড় হয়ে আছে।

    .

    বিনুদের রেশন কার্ড পড়েছে নিত্য দাসের দোকানে। চিনি আর কেরোসিন আনতে বিনুকে সেখানে যেতে হয়। যখনই যায়, তার চোখে পড়ে, দোকানটার সামনে উলটো চন্ডীর মেলা লেগে আছে। শুধু নিত্য দাসের দোকানেই না, অখিল সাহা আর রায়েবালি শিকদারের দোকান দুটোরও একই হাল।

    বাইরে রেশন কার্ড আর বোতল হাতে ঝুলিয়ে জনতা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকে। ভেতরে দেখা যায়, নিত্য দাস একটা তক্তপোশে বসে আছে। তার সামনে ক্যাশবাক্স, রসিদ বই। ডান ধারে। বড় বড় কেরোসিনের ড্রামগুলো শূন্য, চিনির বস্তাগুলো ফাঁকা। পেছনে কাপড় রাখার জন্য যে সারি সারি কাঁচের আলমারি বসানো আছে সেগুলোতে কিছুই নেই।

    বাইরে জনতা করুণ গলায় গোঙানির মতো আওয়াজ করে ডাকে, অ দাস মশয়, অ দাস মশয়–

    একশ’বার ডাকলে তক্তপোষের ওপর থেকে একবার মোটে সাড়া দেয় নিত্য দাস, কী কও–

    ইটু ক্রাচিন দ্যান। আন্ধারে থাইকা থাইকা আর পারি না। হেই দিন রাইতে ঘরে সাপ ঢুকছিল।

    ক্রাচিন নাই।

    ইট্ট ব্যবোস্তা করেন দাস মশয়—

    ব্যবস্থা কি আমার হাতে? উই দেখ না ক্রাচিন ডেরামগুলান শূইন্য (শূন্য)।

    দয়া করেন দাস মশয়—

    দয়ার কী আছে! তোমরা ট্যাকা দিয়া মাল কিনবা, কিন্তু ব্যাপারখান কী জানো?

    কী?

    ছাপ্লাই নাই। উই দেখ চিনির ছালাগুলা (বস্তাগুলো) শূইন্য পইড়া রইছে।

    মিঠার লেইগা পোলাপানগুলো কাইন্দা মরে। কনটোলে চিনি পাইলে কিনতে পারি। কিন্তুক বাইরে গুড়ের দর একেবারে আগুন। কাছে আউগান (এগুলো যায় না।

    ক্যান যে তোমরা এত ঘ্যান ঘ্যান কর! কইতে আছি চিনি নাই, নিজের চৌখে হগলে দেখতেও আছ। তবু বিশ্বাস যাও না।

    চিনি না দ্যান, কাপড় দ্যান–

    কাপড়েরও ছাপ্লাই নাই। আঙুল দিয়ে সারি সারি ফাঁকা আলমারিগুলো দেখিয়ে দেয় নিত্য দাস।

    জনতা বলে, চিনি ক্রাচিন না দ্যান তো না দিলেন। কিন্তুক একখান শাড়ি না দিলে চলব না দাস মশয়। কাপড় বিহনে ঘরের বউমাইয়া বাইর হইতে পারে না। গামছায় কি শরম ঢাকে! তারা কয় গলায় দড়ি দিব।

    অসীম ধৈর্য নিত্য দাসের। সবার কথা, সবার মিনতি, সবার আবেদন কান পেতে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনে যায়। তারপর বলে, কাপড় কই পাই? ছাপ্লাই না থাকলে আমি কী করতে পারি? আমার তো আর ধুতি-শাড়ির মেচিন নাই যে বানাইয়া দিমু।

    আপনের কুনো কথা শুনুম না। কাপড় না পাইলে এইখানে ‘হত্যা’ (হত্যে) দিয়া পইড়া থাকুম।

    হত্যা দিলে কি কাপড় মিলব! হের থিকা এক কাম কর–

    কী?

    গরমেণ্টেরে (গভর্নমেন্টকে) গিয়া ধর।

    গরমেন বুঝি না, আপনেই আমাগো হগল।  বাঁচান দাস মশয়, ঘরের বউ-ঝি’র ইজ্জত  বাঁচান।

    এই সব আবেদন-নিবেদন কাকুতি-মিনক্সি মধ্যে হঠাৎ বিনুকে দেখতে পেলেই হাতের ইশারা করে নিত্য দাস। ভিড় ঠেলে ঠেলে বিনু দোকানের ভেতর চলে আসে।

    নিত্য দাস তার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে, কি ছুটোবাবু, ক্রাচিন নিতে আসছ?

    বিনু মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

    যাও গা, রাইতে পাঠাইয়া দিমু।

    কিন্তু—

    কী?

    আপনার দোকানে তো কেরোসিন নেই।

    থাউক না থাউক, হে তোমার দেখতে হইব না। তুমি ক্রাচিন পাইলেই তো হইল। নিত্য দাস বলতে থাকে, রাইতে যে ক্রাচিন পাঠামু হেই কথাখান গুপন (গোপন) রাইখো। একবার জানতে পারলে উই শকুনের গুষ্টি আমারে ছিড়া খাইব। বলে সামনের জনতাকে দেখিয়ে দেয়।

    বিনু যেদিনই কেরোসিন আনতে যায়, সেই একই কথা বলে তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় নিত্য দাস। তারপর রাত্রিবেলা তার লোক ঢাকাটুকি দিয়ে কেরোসিনের টিন নিয়ে আসে।

    এইভাবেই চলছিল।

    নিত্য দাসের যে গোমস্তা কেরোসিন দিয়ে যায় তার নাম সুচাঁদ। হঠাৎ একদিন সে হেমনাথের সামনে পড়ে গেল।

    হেমনাথ বললেন, তুই নিত্য দাসের দোকানে কাজ করিস না?

    সুচাঁদ বলল, আইজ্ঞা।

    এই রাত্রিবেলা আমার বাড়ি কী মনে করে?

    আইজ্ঞা ক্রাচিন।

    কেরোসিন?

    হ–সতর্ক চোখে চারদিক দেখে নিয়ে কাপড়ের আড়াল থেকে মাকারি একটা টিন বার করল সুচাঁদ।

    হেমনাথ বিমুঢ়ের মতো বললেন, কী ব্যাপার? এইভাবে চোরের মতো কেরোসিন নিয়ে এসেছিস! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

    তার বাড়িতে এভাবে গোপনে যে কেরোসিন পাঠানো হচ্ছে, হেমনাথ জানতেন না। তার বিমুঢ় হবারই কথা।

    বিনু কাছেই ছিল। সে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলল।

    শুনে চিৎকার করে উঠলেন হেমনাথ, হারামজাদার এত বড় সাহস, কেরোসিন ঘুষ দিয়ে আমাকে খুশি করতে চায়! সুচাঁদকে বললেন, বেররা আমার বাড়ি থেকে।

    সুচাঁদ ভয় পেয়ে গিয়েছিল, আইজ্ঞা–

    উত্তেজিত সুরে হেমনাথ আবার বললেন, এখনও দাঁড়িয়ে আছিস! কেরোসিন টিন নিয়ে এক্ষুনি চলে যা–

    সুচাঁদ পালিয়ে গেল।

    চেঁচামেচি শুনে স্নেহলতারা বেরিয়ে এসেছিলেন।

    স্নেহলতা বললেন, কী হল, অত হইচই কেন?

    উত্তেজনা যেন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছুল হেমানাথের, ওই নিত্য দাসের স্পর্ধা দেখেছ।

    কেন, কী করেছে সে?

    কী করে নি? রেশনের চিনি-কেরোসিন-কাপড় ব্ল্যাকে দশ গুণ দামে বিক্রি করছে। রাজদিয়া কেতুগঞ্জ-রসুলপুল, চারদিকের গ্রামগুলোর কোনও লোক ন্যায্য দামে এক দানা চিনি পাচ্ছে না, এক ফোঁটা কেরোসিন পাচ্ছে না, কাপড়ের একটা সুতো পাচ্ছে না। আর রাত্রিবেলা লোক দিয়ে আমাকে ঘুষ পাঠানো হচ্ছে! ওকে আমি পুলিশে দেব, জেলে পাঠাব।

    স্নেহলতা শুধোলেন, সুচাঁদ কি কেরোসিন এনেছিল?

    হেমনাথ বললেন, এনেছিল। আমি তাড়িয়ে দিয়েছি।

    তাড়িয়ে তো দিলে, হেরিকেন জ্বলবে কেমন করে?

    জ্বলবে না। গন্ধকশলা আর রেড়ির তেল দিয়ে কাজ চালাও। তা যদি না পার, অন্ধকারে থাকবে। সারা দেশে আলো নেই, আর তুমি নিজের ঘরে দেয়ালি জ্বালবে–এ হতে পারে না স্নেহ।

    বিনু অভিভূতের মতো হেমনাথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

    .

    ২.৩৭

    সিগারেট খাওয়ার জন্য মজিদ মিঞার হাতে সেই যে মার খেয়েছিল, তার পর থেকে শ্যামল আর অশোকের সঙ্গে মেশে না বিনু। হেমনাথ-অবনীমোহন-সুরমা-স্নেহলতা, সবাই ওদের সঙ্গে মেলামেশা করতে বারণ করে দিয়েছেন। নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে, স্কুল ছুটির পর পারতপক্ষে ওদের সঙ্গে বেড়ায় না বিনু। বেশির ভাগ দিন সোজা বাড়ি চলে আসে।

    আজও ফিরছিল সে।

    পশ্চিম আকাশের ঢাল পাড় বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি নেমে গেছে। রোদের রং এখন বাসি হলুদের মতো। বিকেলের নিবু নিবু অনুজ্জ্বল আলো গায়ে মেখে ঝাকে ঝাকে বালিহাঁস আর পানিকাউ উড়ছিল। উত্তর আকাশে তুলোর স্কুপের মতো সাদা সাদা ভবঘুরে মেঘ।

    বরফ কল, মাছের আড়ত পেরিয়ে স্টিমারঘাটের কাছে আসতেই কে যেন ডাকল, বিনুদা বিনুদা–

    চমকে ঘুরে দাঁড়াতেই বিনু দেখতে পেল, জেটির কাছে ঝুমা।

    চোখাচোখি হতেই ঝুমা হাতছানি দিল।

    প্রথমটা বিশ্বাসই করতে পারল না বিনু। এই বিকেলবেলায় নদীর দিক থেকে যখন এলোমেলো হাওয়া দিয়েছে, সূর্যটা ডুবুডুবু, রোদের রং বাসি হলুদের মতো, যখন পশ্চিমের ভাসমান মেঘ ফুলে ফুলে পাহাড়ের মতো হয়ে আছে, সেই সময় স্টিমারঘাটের কাছে কুমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল! অবাক বিনু দাঁড়িয়েই থাকল।

    ঝুমা আবার ডাকল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন? এস দু’চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল বিনু।

    স্তূপাকার মালপত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা। ট্রাঙ্ক, সুটকেস, বেতের বাস্কেট, কুঁজো, চার পাঁচটা হোল্ডঅল, টিফিন-কেরিয়ারকত যে জিনিস, লেখাজোখা নেই। ঝুমারা ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

    পলকহীন তাকিয়েই ছিল বিনু। চোখ কুঁচকে ঝুমা বলল, একেরারে বোবা হয়ে গেলে যে! আমাকে যেন চিনতেই পারছ না–

    হঠাৎ দেখলে সত্যিই চেনা যায় না। মাথায় অনেকখানি লম্বা হয়ে গেছে ঝুমা। দু’বছর আগে ছিল বালিকা, বড় বড় পা ফেলে কখন সে কৈশোরকে ধরে ফেলেছে, কে বলবে। গায়ের চামড়া টানটান, মসৃণ, তাতে চকচকে আভা ফুটেছে। প্রচুর স্বাস্থ্য মেয়েটার, গায়ের আঁটোসাঁটো জামাটায় ধরতে চায় না।

    চোখ এমনিতেই বড়, তার মাঝখানে কালো কুচকুচে মণিদু’টো নিয়ত অস্থির, নিয়ত ছটফটে।

    বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না বিনু। অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে বিব্রতভাবে বলল, না, মানে–

    মানে আবার কী?

    অনেকদিন পর তোমাকে দেখলাম কিনা। একটু সামলে নিয়ে বিনু আবার বলল, তুমি একলা এখানে, এই স্টিমারঘাটে?

    ঝুমা বলল, আজই আমরা কলকাতা থেকে এলাম যে—

    কখন এসেছ?

    এক্ষুনি এলাম। দেখছ না স্টিমারটা–

    বিনু তাকিয়ে দেখল, জেটিঘাটের ওপারে রাজহাঁসের মতো সেই স্টিমারটা দাঁড়িয়ে আছে। সেটার মাস্তুলে খয়েরি রঙের শঙ্খচিল। হঠাৎ বিনুর মনে পড়ল, ও বেলা স্কুলে আসার সময় স্টিমারটা চোখে পড়ে নি। সে বলল, স্টিমার তো সকালবেলা আসার কথা–

    ঝুমা বলল, হ্যাঁ, বড্ড দেরি করে এসেছে। পাক্কা দশ ঘন্টা লেট–

    এবার বিনু ভাল করে লক্ষ করল, ঝুমার চুল রুক্ষ, উষ্কখুষ্ক। প্রায় দু’দিন স্টিমার এবং ট্রেনে কাটিয়ে আসার ফলে মুখচোখ মলিন। তারপর একটা কথা খেয়াল হতে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তোমাকেই শুধু দেখছি, আর সবাই কোথায়?

    জেটিঘাটের ভেতর। কুলিদের দিয়ে মালপত্তর এনে এনে রাখছে। আমি এখানে পাহারা দিচ্ছি। দাদু আর বাবা গেছেন একটা ঘোড়ার গাড়ি যোগাড় করতে। ওঁরা এলেই আমরা বাড়ি যাব। বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল ঝুমার, আচ্ছা বিনুদা–

    কী বলছ?

    তোমরা তো সেই থেকেই দেশে আছ, আর কলকাতায় যাও নি–তাই না?

    হ্যাঁ। তোমায় কে বললে?

    বা রে, কলকাতায় গেলে তুমি বুঝি আমাদের বাড়ি যেতে না? তা ছাড়া–

    কী?

    চোখের তারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝুমা এবার বলল, তোমরা যে দেশে আছ, সে খবর আমরা পেয়েছি।

    কেমন করে?

    হাঁদা গঙ্গারাম, কিছুই জানো না! সুনীতিদি প্রত্যেক সপ্তাহে আমার মামাকে দু’খানা করে চিঠি লেখে। তাতেই জানতে পেরেছি।

    বিনু মনে মনে ভাবল, সত্যিই সে হাঁদা। সুনীতির সব চিঠিই তো সে নিজের হাতে ডাকবাক্সে দিয়ে আসত, অথচ এমন সোজা জিনিসটা তার মাথায় ঢুকল না!

    ঝুমা এবার গলা নামিয়ে ফিসফিস করল, তোমার দিদি আর আমার মামার ভেতর ব্যাপার আছে, না বিনুদা– বলে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে কেমন করে যেন হাসতে লাগল।

    ঝুমার ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে বিনু। তার মুখ লাল হয়ে উঠল। দু’বছর আগে মেয়েটা ছিল দুর্দান্ত, ডানপিটে। ভয় টয় বলে তার কিছুই ছিল না। টের পাওয়া যাচ্ছে, সেই ঝুমা এবার অন্য দিক থেকে পেকে টুসটুসে হয়ে এসেছে।

    একটু নীরবতা।

    তারপর ঝুমাই আবার ডাকল বিনুদা–

    কী বলছ?

    সেই হিংসুটি মেয়েটা এখন কোথায় গো?

    কার কথা বলছ?

    ঝিনুক-ঝিনুক—

    বিনু বলল, ঝিনুক আমাদের বাড়িতেই আছে।

    ঝুমা ঘাড় বাঁকিয়ে শুধলো, সেই তখন থেকে?

    হ্যাঁ। গভীর সহানুভূতির গলায় বিনু বলতে লাগল, কোথায় আর যাবে বল। ওর মা তো এখানে নেই–

    ঝিনুকের মা এখনও আসে নি?

    না।

    আর আসবে না মনে হয়।

    তাই শুনেছি।

    একটু কী ভেবে ঝুমা এবার জিজ্ঞেস করল, ঝিনুক এখন কত বড় হয়েছে বিনুদা? কুমার কথায় চকিত হল বিনু। সত্যিই বড় হয়ে উঠেছে ঝিনুক, প্রায় ঝুমার মতোই কিশোরী। দু’বছর হতে চলল, একই বাড়িতে সাতাশের বন্দে’র ছ’খানা ঘর, ঢালা উঠোন, স্নিগ্ধ ছায়াছন্ন বাগান, টলটলে পুকুর, পাখিদের অশ্রান্ত কিচির মিচির আর গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত দিয়ে ঘেরা ছোট্ট মনোরম একটি ভুবনের মাঝখানে তারা পাশাপাশি আছে। অথচ তিল তিল করে কখন যে ঝিনুক বড় হয়ে উঠেছে, লক্ষই করে নি বিনু। আজ ঝুমার কথায় মনে পড়ে গেল।

    ঝিনুক যেন শ্বাসবায়ুর মতো। সে কাছেই আছে, কিন্তু তার কথা মনেই থাকে না।

    বিনু বলল, তোমার মতোই বড় হয়েছে।

    তা হলে তো–বলে চোখ কুঁচকে ঠোঁট কামড়াতে লাগল ঝুমা।

    তা হলে কী?

    ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে ঝুমা বলল, দু’জনে বেশ চালাচ্ছ– কথায় কথায় ভুরু নাচানো মেয়েটার স্বভাব।

    কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল বিনুর। আবছা গলায় সে বলল, কী যা-তা বলছ!

    ঝুমা আবার কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় জেটিঘাটের ভেতর থেকে চার পাঁচটা কুলির মাথায় বড় বড় স্টিলের ট্রাঙ্ক চাপিয়ে স্মৃতিরেখা বেরিয়ে এলেন। তার পেছনে রুমা আর আনন্দ।

    আনন্দও তবে এসেছে!

    কাছাকাছি এসে কুলিরা ট্রাঙ্কগুলো নামাল। স্মৃতিরেখা বিনুকে দেখতে পেয়েছিলেন। একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, বিনু না?

    বিনু বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

    চিনতেই পারা যায় না। কত বড় হয়ে গেছে!

    লজ্জায় চোখ নামাল বিনু। স্মৃতিরেখা বললেন, তুমি এখানে কোত্থেকে এলে?

    বিনু বলল, স্কুল থেকে। বাড়ি ফিরছিলাম, ঝুমা ডাকল।

    একটু চুপ করে থেকে স্মৃতিরেখা এবার বললেন, বোমার ভয়ে পালিয়ে এলাম। কলকাতায় যে কোনওদিন এখন বোমা পড়তে পারে।

    চোখ মাটির দিকে রেখেই বিনু বলল, কলকাতা থেকে অনেক লোক রাজদিয়া চলে এসেছে।

    তাই নাকি?

    আজ্ঞে হ্যাঁ।

    স্মৃতিরেখা বললেন, কলকাতা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। যে যেদিকে পারছে, প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সে যাক গে। হ্যাঁ বিনু–

    মুখ তুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল বিনু।

    স্মৃতিরেখা বললেন, শুনেছি, তোমরা নাকি সেই থেকেই রাজদিয়ায় আছ—

    আজ্ঞে হ্যাঁ।

    জমিজমাও কিনেছ?

    আজ্ঞে হ্যাঁ।

    কতটা?

    তিরিশ কানির মতো।

    তোমার বাবা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছেন।

    একটু চুপ।

    তারপর স্মৃতিরেখা আবার বললেন, বাড়ির সবাই ভাল তো?

    বিনু মাথা নাড়ল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

    এরপর এলোমেলো, অসংলগ্ন নানারকম কথা হতে লাগল। যুদ্ধের কথা, জাপানি বোমার কথা, রাজদিয়ার কথা, কলকাতা থেকে আসার সময় ট্রেনে-স্টিমারে অসম্ভব ভিড়ের মধ্যে প্রচন্ড কষ্টের কথা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

    একসময় শিশির আর রামকেশব ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে ফিরে এলেন। দেখেই বিনু চিনতে পারল, গাড়িটা ঝিনুকদের। শিশিররা তা হলে ঝিনুকদের ফিটন চেয়ে আনতে গিয়েছিলেন।

    কুলিগুলো একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। রামকেশব তাড়া লাগালেন, মাল তুলে ফেল–

    বাক্সপ্যাঁটরা ভোলা হলে কুলিরা ভাড়া নিয়ে চলে গেল। রামকেশব বললেন, সবাই গাড়িতে ওঠ।

    স্মৃতিরেখা বিনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাদের বাড়ি যাবে নাকি? চল না—

    ঝুমাও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, চল, চল–আগ্রহে তার চোখ চকচক করতে লাগল।

    যাবার খুব যে একটা অনিচ্ছা ছিল তা নয়। হয়তো যেতও বিনু, কিন্তু পরক্ষণে সেই নিষেধাজ্ঞার কথা মনে পড়ে গেল। আজকাল স্কুল ছুটির পর আর এক মুহূর্তও বাইরে থাকার উপায় নেই। মজিদ মিঞা তার কি সর্বনাশটাই না করেছে! অবশ্য অশোকরা মাঝে মাঝে তাকে ধরে ওদের সঙ্গে নিয়ে যায়। একটু ভেবে বিনু বলল, এই মাত্র আপনারা এলেন। আজ বিশ্রাম টিশ্রাম করুন। আমি পরে যাব।

    স্মৃতিরেখা বললেন, সেই ভাল। ট্রেনে স্টিমারে দু’দিন যা ধকল গেছে। এখন চান করে একটু শুতে পেলে বাঁচি। তোমাকে নিয়ে গিয়ে ভাল করে কথাই বলতে পারব না। পরে আসবে কিন্তু

    আসব।

    ঝুমা বলল, কালই এস—

    বিনু হাসল।

    স্মৃতিরেখা আর কিছু না বলে ফিটনে উঠলেন। তার পিছু পিছু শিশির রুমা আর রামকেশবও উঠলেন।

    উঠতে উঠতে রামকেশব বিনুকে বললেন, হেমদাদা আর বৌ-ঠাকরুনকে বলিস, কলকাতা থেকে শিশিররা আজ এসেছে।

    বিনু ঘাড় হেলিয়ে দিল, বলব।

    আনন্দ আর ঝুমা এখনও নিচে দাঁড়িয়ে। সবার কান বাঁচিয়ে নিচু চাপা গলায় আনন্দ বলল, বাড়িতে আমার কথাও বলে।

    ঝুমাটা কাছেই আছে, তাকে ফাঁকি দেওয়া যায় নি। চোখ কুঁচকে ঠোঁট ছুঁচলো করে সে বলল, কার কাছে বলবে মামা? সুনীতিদির কাছে?

    তুই ভীষণ ফাজিল হয়েছিস। আলতো করে ঝুমার মাথায় চাটি কষিয়ে দিল আনন্দ।

    নাকের ভেতর থেকে কপট কান্নার শব্দ করতে লাগল ঝুমা, উঁ-উঁ-উঁ–

    আর বাঁদরামো করতে হবে না। গাড়িতে ওঠ– দু’জনে ফিটনে উঠে দরজা বন্ধ করল।

    সঙ্গে সঙ্গে রামকেশব চেঁচিয়ে বললেন, গাড়ি চালা রে রসুল-ঝিনুকদের কোচোয়ানটার নাম রসুল।

    ফিটন চলতে শুরু করল। জানালার বাইরে মুখ বার করে হাত নাড়তে লাগল ঝুমা। যতক্ষণ দেখা যায়, নদীর পাড়ে স্টিমারঘাটে দাঁড়িয়ে থাকল বিনু।

    .

    বাড়ি ফিরতে ফিরতে আজ সন্ধে হয়ে এল। পুকুরের ওপারে ধানের খেত এর মধ্যে ঝাঁপসা হয়ে গেছে। আকাশ যেখানে পিঠ বাঁকিয়ে দিগন্তে নেমেছে, সেই জায়গাটা নিরাকার, অস্পষ্ট। বাগানের এ কোণে ও কোণে থোকা থোকা অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। সোনাল আর পিঠক্ষীরা ঝোঁপের জ্ঞের জোনাকিদের নাচানাচি শুরু হয়ে গেছে।

    স্টিমারঘাটে যে সূর্যটা ছিল ডুবু ডুবু, এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। আকাশ জুড়ে যুঁই ফুলের মতো অগণিত তারা ফুটতে শুরু করেছে।

    উঠোনে পা দিতেই সুরমা ছুটে এলেন, তোর তো লজ্জা নেই বিনু। সেদিন যে মজিদ মিঞা অত করে মারল, এর মধ্যেই ভুলে গেলি!

    স্নেহলতা সুধা সুনীতি শিবানী ঝিনুক, সবাই একধারে দাঁড়িয়ে আছে। খুব সম্ভব তার ফেরার জন্য ওরা উঠোনে অপেক্ষা করছিল। অবনীমোহন আর হেমনাথকে অবশ্য দেখা গেল না।

    স্নেহলতা বললেন, গায়ের ব্যথাও মরল, আবার যে কে সে-ই হয়ে দাঁড়ালি!

    বিনু তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তোমরা যা ভাবছ তা নয় দিদা—

    সুধা এই সময় গলা কাঁপিয়ে কাঁপয়ে ভেংচি কাটার মতো মুখ করে বলল, তোমরা যা ভাবছ তা নয় দিদা! নিশ্চয়ই তা-ই। আবার ওই বাঁদরগুলোর সঙ্গে মিলিটারি ব্যারাকে গিয়ে ভিখিরিদের মতো চকলেট চাইছিলি, সিগারেট খাচ্ছিলি। দাঁড়া আজই মজিদ মামাকে খবর পাঠাচ্ছি। চ্যালা কাঠ দিয়ে যাতে–

    সুধার কথা শেষ হল না, তার আগেই বিনু ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিমেষে দেখা গেল সুধার চুলের গোছা বিনুর মুঠোয়। সুধাও ছাড়ে নি, দু’হাতের দশটা নখ বিনুর গালে বসিয়ে দিয়ে ধরে আছে।

    চেঁচামেচি এবং টানাটানি করে স্নেহলতারা দু’জনকে ছাড়িয়ে দিলেন।

    যে সুনীতি চিরদিনই ধীর স্থির শান্ত, হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল তার। ছুটে এসে বিনুর গালে এক চড় কষিয়ে দিল। চোখ পাকিয়ে বলল, অন্যায়ও করবে, আবার লোকের গায়ে হাতও তুলবে! দিন দিন তোমার আস্পর্ধা বেড়েই চলেছে! খুনী কোথাকার–

    দুর্বিনীত ঘাড় বাঁকিয়ে বিনু বলল, আমি অন্যায় করি নি। চড় খেয়ে তার চোখ টসটস করছে। মনে হচ্ছে সে দুটো বুঝি ফেটেই যাবে।

    সুরমা বললেন, অন্যায় করিস নি তো এতক্ষণ ছিলি কোথায়? তোকে না বলে দেওয়া হয়েছে স্কুল ছুটির পর এক মিনিটও বাইরে থাকবি না। আবার সন্ধে করে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে।

    বিনু বলল, স্কুল ছুটির পর আমি তো আসছিলামই। স্টিমারঘাটের কাছে ঝুমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

    কোন ঝুমা?

    ওই যে রামকেশবদাদুর নাতনি—

    স্নেহলতা বললেন, ওরা এসেছে নাকি?

    বিনু বলতে লাগল, হ্যাঁ, আজই বিকেলবেলা এসেছে। স্টিমারঘাটে নেমেই আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা আটকাল। কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।

    সুধাটা চিরকালের ঘরশত্রু। সে হঠাৎ বলল, গোয়ালন্দের স্টিমার তো আসে সকালে। বিকেলবেলা এসেছে কিরকম?

    দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে মেচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল বিনু, বিশ্বাস না হয়, কুমাদের বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয় না রাক্ষুসী।

    আবার একটা কুরুক্ষেত্র বেধে যাবার উপক্রম হচ্ছিল। তাড়াতাড়ি দু’জনকে থামিয়ে স্নেহলতা বললেন, ঝুমাদের জন্যে দেরি হয়েছে, সে কথা বলবি তো। কী বোকা ছেলে তুই! শুধু শুধু মার খেলি!

    অভিমানের গলায় বিনু বলল, তোমরা আমাকে বলতে দিলে কোথায়?

    বিনুর একখানা হাত ধরে স্নেহের সুরে স্নেহলতা বললেন, চল, হাত মুখ ধুয়ে খাবি। সেই কখন চাট্টি খেয়ে স্কুলে গিয়েছিলি।

    .

    খেয়েটেয়ে বিনু পড়তে বসল। বেশ রাত হয়ে গেছে। ধানখেত, পুকুর, সুদূর বনানী, গাছপালা সব কিছুই এখন গাঢ় অন্ধকারে অবলুপ্ত।

    সুধা সুনীতি আর ঝিনুক আগেই পড়তে বসেছিল।

    এ বাড়িতে আজকাল আর কেরোসিন ঢোকে না। হেমনাথের বারণ। সারা দেশ যখন অন্ধকারে ডুবে আছে তখন নিজের ঘরে তিনি দেওয়ালি জ্বালাতে চান না। তা ছাড়া, নিত্য দাসের ওপর তিনি এতই অসন্তুষ্ট যে তার দোকানের একটা কুটোও বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না।

    কেরোসিন আসে না। এ বাড়িতে আজকাল রেড়ির তেল জ্বলে।

    এই মুহূর্তে পুবের ঘরের এক কোণে দু’টো আড়াই-তলা কাঠের পিলসুজে প্রদীপ জ্বলছে। রেড়ির তেলের নিরুত্তেজ আলোয় চারধার স্নিগ্ধ। বিনুরা তিন ভাই বোন আর ঝিনুক সুর করে পড়ে যাচ্ছিল।

    বিনুর ডান পাশে বসেছে সুনীতি। তারপর সুধা এবং ঝিনুক।

    পড়তে পড়তে মুখ তুলে সুনীতি একবার বিনুকে দেখে নিল। তারপর আবার বাইরের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ পর আবার বিনুকে দেখল, তারপর চোখ নামিয়ে বই নাড়াচাড়া করতে লাগল।

    অনেকক্ষণ ইতস্তত করার পর খুব আস্তে, গলার ভেতর থেকে সুনীতি ডাকল, বিনু—

    বিনু শুনেও শুনল না, গলা চড়িয়ে পড়তে লাগল।

    ফের ডাকল সুনীতি।

    এবার বিরক্ত, অপ্রসন্ন চোখে তাকাল বিনু।

    সুনীতি বলল, খুব পড়া দেখাচ্ছিস, না? বলে হাসল।

    বিনু কিছু বলল না, চোখ কুঁচকেই থাকল।

    সুনীতি এবার কোমল গলায় বলল, গালে খুব লেগেছিল, না রে?

    মুখ বাঁকিয়ে বিনু বলল, না, লাগবে না!

    সত্যি, আর মারব না। হঠাৎ এমন রাগ হয়ে গিয়েছিল। বিনুর মাথায় হাত বুলোত লাগল সুনীতি।

    এক ঝটকায় সুনীতির হাতটা সবিয়ে দিল বিনু, মারবার সময় মনে ছিল না? এখন আদর ফলানো হচ্ছে!

    সুনীতি আবার বিনুর মাথায় হাত রাখল। খোশামোদের গলায় বলল, জীবনে আর কক্ষনো তোর গায়ে হাত তুলব না। মা কালীর দিব্যি। আর

    আর কী?

    তোকে একটা জিনিস দেব।

    কী জিনিস?

    দু’টো টাকা।

    বিনু এবার নরম হল। একটু ভেবে বলল, কখন দেবে?

    আজকেই।

    ঠিক?

    ঠিক।

    একটু চুপ করে থেকে সুনীতি গলার স্বর আরও নামিয়ে দিল, অ্যাই—

    কী বলছ?

    ঝুমারা কে কে এসেছে রে?

    ঝুমা রুমাদি শিশিরমামা মামী আর—

    নিশ্বাস বন্ধ করে পলকহীন তাকিয়ে ছিল সুনীতি। চাপা গলায় ফিসফিস করে বলব, আর কে?

    বিনুর চোখ চিকচিক করতে লাগল। সে বলল, যার কথা শুনবার জন্যে দম বন্ধ করে আছ– সে। আনন্দদাও এসেছে।

    আহা, দম বন্ধ করে থাকবার আর লোক পেলাম না! বলেই বইয়ের ওপর ঝুঁকে মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগল সুনীতি।

    বিনু বলল, আমার টাকা দাও—

    দেব’খন।

    ও, কাজের বেলায় আঁটিসুটি, কাজ ফুরালে দাঁত কপাটি। টাকা না দিলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।

    কিছুক্ষণ পড়াশোনার পর বিনু হঠাৎ শুনতে পেল, নিচু গলায় সুধা সুনীতিকে বলছে, তোর মনস্কামনা পূর্ণ হল তো দিদি–

    সুনীতি বলল, কিসের আবার মনস্কামনা?

    উত্তর না দিয়ে সুধা রগড়ের গলায় বলল, আনন্দদার খবর জানবার জন্যে নগদ দুটো টাকা খরচ করতে হবে দিদিভাই।

    সুনীতি ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, আহা-হা—

    একসময় খাবার ডাক পড়ল।

    বইটই গুছিয়ে প্রথমে সুধা সুনীতি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

    পুবের ঘর আর রান্নাঘরের মাঝখানে উঠোন। সুধা সুনীতির পর বিনু ঝিনুক খেতে গেল। অন্ধকারে যেতে যেতে ঝিনুক বলল, তোমার তো এখন ভারি মজা, না বিনুদা?

    বিনু বলল, কেন?

    ঝুমা এসেছে।

    বিনু কিছু বলল না। উঠোন পেরুতে পেরুতে ঝিনুকের কথাগুলো বুঝবার চেষ্টা করতে লাগল শুধু।

    .

    ২.৩৮

    দিন দুই পর ছিল রবিবার। দুপুরবেলা বিনুরা সবে খেয়েদেয়ে উঠেছে, সেই সময় ঝুমা আর আনন্দ এসে হাজির।

    সঙ্গে সঙ্গে বাড়িময় সাড়া পড়ে গেল। সুরমা-শিবানী-হেমনাথ-অবনীমোহন, সবাই ছুটে এলেন।

    আনন্দ বলল, কলকাতা থেকে আমরা বেস্পতিবার এসেছি। বলে হাসল, তার হাসিটা কেমন যেন লজ্জার রঙে ছোপানো।

    সুরমা বললেন, বিনুর কাছে সেদিনই আমরা খবর পেয়ে গেছি।

    বিনুর সঙ্গে স্টিমারঘাটে আমাদের দেখা হয়েছিল।

    স্নেহতলা বললেন, উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা নয়। চল, ঘরে চল–ঝুমাদের হাত ধরে তিনি এনে বসালেন। অন্য সবাই তাদের সঙ্গে সঙ্গে এল।

    ঘরে এসে আনন্দ বলল, জাপানি বোমার ভয়ে কালকাতা থেকে তোক পালাবার হিড়িক পড়েছে। চারদিক এখন ফাঁকা। আমার বাবা মা ভাইবোনেরা মধুপুরে চলে গেছে

    সুরমা শুধোলেন, মধুপুরে কে আছে?

    কেউ নেই। আমাদের একটা বাড়ি আছে, একজন মালী দেখাশোনা করে।

    কলকাতায় একখানা বাড়ি আছে না তোমাদের?

    আজ্ঞে হ্যাঁ।

    আগের বার সুযোগ হয়নি। এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কথা জেনে নিলেন সুরমা। আনন্দর বাবা অ্যাডভোকেট, দুই দাদা বড় সরকারি চাকুরে। ছোট ভাইটা বি.এ পড়ছে। বড় বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে। হোট যে বোনটা রয়েছে সে ছাত্রী। বাকি রইল আনন্দ নিজে। আগেই এম. এ আর লটা পাশ করেছিল। কিছুদিন হল, বাবার সঙ্গে কোর্টে যেতে শুরু করেছে। আশা, বাবা বেঁচে থাকতে থাকতেই সে দাঁড়িয়ে যাবে। অ্যাডভোকেট হিসেবে বাবার বিপুল প্রতিষ্ঠা। তার প্রতিষ্ঠা এবং খ্যাতি আনন্দকে অনেকখানি এগিয়ে দেবেই। দু’চার বছর বাবার সঙ্গে বেরুতে পারলে সাফল্যের চাবিকাঠিটার সন্ধান নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তবে যুদ্ধটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওটা না থামলে কিছুই হবে না।

    সুরমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল আনন্দ, জাপানি বোমার ভয়ে আমাদের বাড়ির সবাই গেল মধুপুর। দিদি-জামাইবাবু আমাকে কিছুতেই ছাড়লেন না, টানতে টানতে রাজদিয়ায় নিয়ে এলেন।

    কৌতুকের গলায় হেমনাথ হঠাৎ বলে উঠলেন, রাজদিয়ায় আসতে তোমার বুঝি একটুও ইচ্ছা ছিল না? বলে চোখের মণি দুটো কোণে এনে আড়ে আড়ে সুনীতির দিকে তাকালেন।

    বিনু লক্ষ করেছে, এতক্ষণ একদৃষ্টে আনন্দের দিকে তাকিয়ে ছিল সুনীতি। তার চোখমুখে ঢেউয়ের মতো কী খেলে যাচ্ছিল। হেমনাথ তাকাতেই দ্রুত মুখ নামিয়ে নখ খুঁটতে লাগল।

    এদিকে আনন্দ থতমত খেয়ে গিয়েছিল, নামানে, দু’বছর আগে যখন এসেছিলাম, রাজদিয়া আমার খুব ভাল লেগেছিল। তাই

    বাধা দিয়ে হেমনাথ বলতে লাগলেন, তুমি আর যাই হও, উৎকৃষ্ট উকিল হতে পারবে না–  বলে ঠোঁট টিপে টিপে হাসতে লাগলেন, নিজের কেসটা পর্যন্ত ভাল করে সাজাতে পার না। অপলক তাকিয়ে থেকে কী যেন বুঝতে চেষ্টা করল আনন্দ, তারপর হেমনাথের সঙ্গে সুর মিলিয়ে হেসে উঠল।

    একটু ভেবে হেমনাথ বললেন, এবার বন্দুক টলুক এনেছ তো? তোমার যা শিকারের নেশা!

    আজ্ঞে হ্যাঁ। পুরো এক বাক্স কার্তুজও এনেছি।

    স্নেহলতা বললেন, রাজদিয়ার জন্তু-জানোয়ার আর পাখিদের দেখছি বড়ই দুর্দিন।

    প্রগলভতার ঈশ্বর আজ বুঝি হেমনাথের কাঁধে ভর করে বসেছে। চোখের তারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রগড়ের সুরে আনন্দকে বললেন, তুমি কী ধরনের শিকারি তা আমার জানা আছে। নিশানার এক। শ’ হাত দূর দিয়ে গুলি চলে যায়। অবশ্য–

    আনন্দ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

    হেমনাথ বলতে লাগলেন, এক জায়গায় তীর ঠিক বিধিয়েছ। সেখানে নিশানা ভুল হয় নি’ বলে চোরা চোখে সুনীতিকে বিদ্ধ করলেন।

    সুনীতি সেই যে মুখ নামিয়েছিল, আর তোলে নি। সমানে নখ খুঁটেই চলেছে।

    হকচকিয়ে আনন্দ কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় বিনুর মনে হল কাঁধের কাছে কেউ মৃদু টোকা দিচ্ছে। মুখ ফেরাতেই সে দেখতে পেল–ঝুমা।

    চোখে চোখ পড়তেই ঝুমা বলল, চল—

    কোথায়?

    তোমাদের বাগানে বেড়াই গে। এখানে বসে বসে বড়দের কথা শুনে কী হবে? তার চাইতে আমরা গল্প করব।

    একটু চুপ করে থেকে বিনু বলল, চল—

    দু’জনে ঘর থেকে বেরিয়ে বাগানে চলে এল।

    হেমনাথের বাড়ির নকশা করা টিনের চালগুলোতে রোদ ঝলকে যাচ্ছে। পুকুরে, দূর ধানখেতে, গাছপালার মাথায় কিংবা আকাশ জুড়ে যেদিকেই চোখ ফেরানো যাক, রোদের ছড়াছড়ি। কিন্তু বাগানের ভেতরটা বড় ছায়াচ্ছন্ন, নিঝুম, মায়ের কোলের মতো ঠান্ডা। এখানে এলেই যেন ঘুমে চোখ জুড়ে যায়।

    মৌটুসকি আর হলদিবনা পাখিগুলো ঘন জামরুল পাতার ভেতর বসে খুনসুটি করছিল। চোখ উদানে ঝোঁপের জঙ্গলে ঝাঁকে ঝাঁকে সোনাপোকা উড়ছে। বড় বড় ঘাসের মাথায় সবুজ রঙের গঙ্গাফড়িং ঢ্যাঙা পায়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। কতকগুলো বহুরূপী গিরগিটি অকারণেই ছোটাছুটি করছে। আর শোনা যাচ্ছিল ঝিঁঝির ডাক। কোন পাতাল থেকে তাদের বিলাপ উঠে আসছে, কে বলবে।

    মুত্রাঝোপের পাশে, কাঁটাবেতের বনের ধারে কিংবা আম-জাম-বাতাবি লেবু গাছের তলায় তলায় বিনুরা কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল। কিন্তু একটা জায়গাও মনঃপূত হল না।

    শেষ পর্যন্ত ঝুমা বলল, চল, পুকুরঘাটে গিয়ে বসি—

    বিনু তক্ষুনি সায় দিল, চল–

    পুকুরঘাটটা নারকেল গুঁড়ি দিয়ে বাঁধানো। বসতে গিয়েই ঝুমার চোখে পড়ল, ডান ধারে সরু পিঠক্ষীরা গাছটার গায়ে একটা ছোেট একমাল্লাই নৌকো বাঁধা রয়েছে।

    ঝুমা তাড়াতাড়ি মত বদলে ফেলল, এখানে বসব না।

    তা হলে কোথায় বসবে?

    নৌকোয় চড়ব।

    নৌকোর নামে বিনুও উৎসাহিত হয়ে উঠল, সেই ভাল। এস—

    দু’জন পিঠক্ষীরা গাছটার দিকে এগিয়ে গেল।

    প্রথম ঝুমাকে নৌকোয় তুলল বিনু, তারপর নিজে উঠে বাঁধন খুলে বৈঠা হাতে গলুইর কাছে বসল।

    ঝুমা বলল, সেবার তুমি আর আমি নৌকোয় করে অথৈ জলে চলে গিয়েছিলাম, মনে আছে। বিনুদা?

    হু–বলেই বৈঠার খোঁচায় নৌকোটাকে মাঝ-পুকুরে নিয়ে এল বিনু।

    সেবার কিন্তু আমরা নৌকো বাইতে জানতাম না। কী কষ্টে যে পুকুর পার হয়ে ওই ধানখেতের দিকে গিয়েছিলাম!

    এবার আর কষ্ট হবে না। আমি নৌকো বাওয়া শিখে গেছি।

    সেবারের মতো এবারও চারদিকে শুধু জল। পুকুরের ওপারে ধানখেত, মাঠ–সব একাকার। মাঠের মাঝখানে হিজল আর বন্যা গাছগুলোর বুক পর্যন্ত ডুবে গেছে। হিজলের যে ডালগুলো জলের ওপরে, ফুলে ফুলে সেগুলো ছাওয়া। আর বউন্যা গাছের ডাল থেকে শক্ত শক্ত অসংখ্য গোলাকার ফল ঝুলছে। ধানখেত বাদ দিলে যে মাঠ, সেখানে শুধু শাপলা শালুক আর পদ্মবন।

    পুকুর ধানখেত পার হয়ে একসময় শাপলাবনে এসে পড়ল বিনুরা।

    হঠাৎ কী একটা কথা মনে পড়তে ঝুমা বলে উঠল, তোমাকে তো নিয়ে এলাম। সেবারের মতো আবার কান্ড করে বসবে না?

    কিসের কান্ড?

    কাউফল পাড়তে গিয়ে জলে ডুবে গিয়েছিলে, মনে পড়ে? বিনু বলল, এখন আর ডুবব না, সাঁতার শিখে গেছি।

    চোখের তারা স্থির করে ঝুমা বলল, বাব্বা, তুমি দেখছি অনেক কিছু শিখে গেছ! নৌকো বাইতে শিখেছ, সাঁতার কাটতে শিখেছ–

    বা রে, আমি বড় হয়েছি না।

    বড় হয়েছ! বলে নৌকোর মাঝখান থেকে অনেক কাছে চলে এল ঝুমা। তারপর মাথা ঘুরিয়ে এদিক থেকে ওদিকে, মিটমিটি দুষ্টুমির চোখে বিনুকে দেখতে লাগল।

    বিব্রত মুখে বিনু বলল, কী দেখছ?

    সত্যিই তো বড় হয়ে গেছ। ঠোঁটের ওপর গোঁফ উঠছে—

    বিনু লজ্জা পেয়ে চোখ নামাল।

    ঝুমা আবার বলল, বড় তো হয়েছ, সিগারেট খাও?

    সিগারেট খাওয়ার সঙ্গে যে স্মৃতিটা জড়ানো তা খুব মনোরম নয়। বিনু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে জানালো, সে সিগারেট খায় না।

    ঈষৎ ধিক্কারের গলায় ঝুমা বলল, সিগারেট খাও না, তা হলে কী বড় হয়েছ।

    বিনু চুপ।

    কিছুক্ষণ পর ঝুমা শুধলো, সেই কাউগাছটা এখনও আছে বিনুদা?

    বিনু বলল, আছে।

    চল, কাউ পাড়ি গে—

    কাউ এখনও পাকে নি। কাঁচা কাউ পেড়ে কী হবে?

    তা হলে থাক। শাপলাই তুলি।

    নৌকোর ধারে গিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে কাঁচের মতো টলটলে জল থেকে শাপলা তুলতে তুলতে ঝুমা বলল, আচ্ছা বিনুদা–

    বিনু তক্ষুনি সাড়া দিল, কী বলছ?

    মনে পড়ে, সেবার রাত্রিবেলা লুকিয়ে লুকিয়ে যাত্রা শুনতে গিয়েছিলাম–

    হুঁ।

    ঝিনুকটার কী হিংসে! আগে থেকে নৌকোয় উঠে বসে ছিল–

    হুঁ।

    আমরা কলকাতায় চলে যাবার পর তুমি আর যাত্রা দেখেছ?

    না।

    কেন?

    কে দেখাবে বল?

    কেন, যুগল?

    যুগল তো এখানে নেই।

    কোথায় গেছে?

    বিয়ের পর ভাটির দেশে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে।

    ও মা, তাই নাকি! আর ফিরবে না?

    না।

    অনেকক্ষণ চুপচাপ।

    তারপর ঝুমাই আবার শুরু করল, জানো বিনুদা–

    কী?

    কলকাতায় যাবার পর তোমার কথা খালি মনে পড়ত।

    আমারও।

    ছাই। ঠোঁট উলটে দিল ঝুমা।

    বিনু বলল, বিশ্বাস কর, সত্যি মনে পড়ত।

    রোজ ভাবতাম, আমাদের বাড়ি আসবে।

    কী করে যাব বল। আমরা তো রাজদিয়ায় থেকে গেলাম। কলকাতায় যাওয়া হল না।

    ঝুমা বলল, যাওয়া না হয় না-ই হয়েছিল, চিঠি লিখলেও তো পারতে।

    বিমূঢ়র মতো বিনু বলল, চিঠি লিখব!

    হ্যাঁ। জানো না ‘লাভার’রা চিঠি লেখে। তোমার দিদি আর আমার মামা ঝুড়ি ঝুড়ি চিঠি লিখত।

    লাভার শব্দটার মানে বিনুর অজানা নয়। তবু সে জিজেস করল, লাভার কী?

    আহা-হা। তুমি একটি গর্দভচন্দ্র শিকদার লাজুক হেসে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে ঝুমা বলল, যাদের মধ্যে ভাব থাকে তাদের লাভার বলে।

    ফস করে বিনু বলে ফেলল, আমি কি তোমার–শেষ শব্দটা গলায় ভেতর থেকে কিছুতেই বার করে আনতে পারল না সে।

    ঘাড় বাঁকিয়ে কেমন করে যেন হাসল ঝুমা, তুমি আমার কী?

    বিনু কিছু বলতে পারল না, ঝুমার দিকে তাকিয়েও থাকতে পারল না। মুখ নামিয়ে এলোমেলো নৌকো বাইতে লাগল।

    এরপর কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ। শাপলা আর বড় বড় পদ্মপাতা তুলে তুলে নৌকো বোঝাই করে ফেলতে লাগল ঝুমা, আর বিনু লক্ষ্যহীনের মতো কখনও উত্তরে কখনও দক্ষিণে নৌকোটা ছুটিয়ে বেড়াতে লাগল।

    একসময় ঝুমা ডাকল, বিনুদা–

    কী বলছ? এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল বিনু।

    কলকাতা থেকে আসবার আগের দিন একটা ইংরেজি সিনেমা দেখেছিলাম—

    কী সিনেমা?

    ফাইটের। খুব লড়াই ছিল। আর–

    আর কী?

    ঠোঁট টিপে টিপে চোখের তারায় হাসতে লাগল ঝুমা, এখন বলব না।

    বিনু শুধলো, কখন বলবে?

    একদিনে সব শুনতে চাও নাকি? কাল স্কুল ছুটির পর আমাদের বাড়ি যেও। তখন বলব।

    সেবার ঝুমা ছিল দুরন্ত, দুর্দান্ত, দুঃসাহসী। দু’বছর পর কলকাতা থেকে অসীম রহস্যময়ী হয়ে ফিরে এসেছে মেয়েটা।

    একটু ভেবে বিনু বলল, স্কুল ছুটির পর দেরি করে বাড়ি ফিরলে মা বকে—

    ঝুমা বলল, আমি মাসিমাকে বলব’খন।

    আচ্ছা।

    নৌকোয় ওঠার পর থেকে কত কথা যে বলেছে ঝুমা! অনেক সময় এক কথার সঙ্গে আরেক কথার মিল ছিল না। তবু এই অসংখ্য অসংলগ্ন কথা, ঝুমার হাসি, চোখের তারায় অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত সব মিলেমিশে বিনুকে হাতছানি দিয়ে দিয়ে এক অচেনা রহস্যের দিকে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

    আদিগন্ত এই মাঠের ভেতর শুধু জল আর জল। মাঝে মাঝে ধানখেত, নলখাগড়ার ঝোঁপ, মুত্রার। জঙ্গল, শাপলাবন, শালুকবন, পদ্মবন, কদাচিৎ দু’চারটি বউন্যা কি হিজল গাছ ছাড়া কেউ নেই, কিছু নেই। এই নির্জন জলমগ্ন চরাচরে নিঝুম দুপুরবেলায় ঝুমাকে বড় ভাল লাগছে। আবার কেমন যেন ভয়ও করছে বিনুর। বুকের ভেতর ঘোট ঘোট ঢেউয়ের মতো কী যেন বয়ে যাচ্ছে তার।

    রোদের রং যখন গাঁদাফুলের মতো হলুদ হয়ে এল সেই সময় ঝুমা বলল, অনেকক্ষণ এসেছি। এবার ফিরব না?

    বিনু বলল, হ্যাঁ।

    পুকুরঘাটে ফিরে এসে বিনু অবাক। জলে পা ডুবিয়ে নারকেল গুঁড়ির সিঁড়িতে একা বসে আছে ঝিনুক।

    সেই পিঠক্ষীরা গাছটার গায়ে নৌকো বাঁধতেই প্রথমে লাফ দিয়ে পাড়ে নামল ঝুমা, তারপর বিনু। নেমেই বিনু ঝিনুককে শুধলো, এখানে বসে আছ যে?

    আধফোঁটা গলায় ঝিনুক বলল, এমনি।

    কখন থেকে বসে আছ?

    অনেকক্ষণ। তোমরা যখন নৌকোয় করে ধানখেতের ভেতর ঢুকলে সেই তখন থেকে—

    বিনুর একবার ইচ্ছে হল, জিজ্ঞেস করে, তাদের পিছু পিছু কি ঘর থেকে পুকুরঘাট পর্যন্ত চলে এসেছিল ঝিনুক? কী ভেবে করল না। বিনুর মন ছায়াচ্ছন্ন হয়ে রইল।

    বাড়িতে এসে বেশিক্ষণ থাকতে পারল না ঝুমা। একটু পর তাকে নিয়ে আনন্দ চলে গেল।

    যাবার আগে অবশ্য ঝুমা সুরমাকে বলে গেছে, স্কুল ছুটির পর বিনুদা কিন্তু মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ি যাবে মাসিমা। আপনি বকতে পারবেন না।

    সরল মনে সুরমা বলেছেন, তোমাদের বাড়ি গেলে বকব কেন? নিশ্চয়ই যাবে।

    বিনু লক্ষ করেছে, সেইসময় একবার তার দিকে, আরেক বার ঝুমার দিকে তাকাচ্ছিল ঝিনুক। কী যেন খুঁজবার চেষ্টা করছিল সে।

    .

    ২.৩৯

    পরের দিন স্কুল ছুটির পর ঝুমাদের বাড়ি গেল বিনু।

    তাকে দেখেই চোখের কোণে হেসে ফেলল ঝুমা, একেবারে গুড বয়। আজ আসতে বলেছি, আজই এসেছে–

    খানিকক্ষণ এ গল্প সে গল্পের পর ঝুমাকে একলা পেয়ে বিনু বলল, এবার সিনেমার কথাটা বল।

    ও বাবা, ছেলের আর তর সয় না।

    কিছুতেই সিনেমার কথাটা সেদিন বলল না ঝুমা।

    সেদিন কেন, আরও দিনকয়েক বিনুকে ঘোরাল ঝুমা। তারপর একদিন বিকেলবেলা বিনু ওদের • বাড়ি যেতেই তাকে ছাদে নিয়ে গেল। কার্নিসের ধারে নিরালা একটু কোণ দেখে এসে দাঁড়াল।

    দূরে স্টিমারঘাট আর বরফ কলের চুড়োটা চোখে পড়ছে। ডান ধারে ঝাউবনের ওপারে সারি সারি মিলিটারি ব্যারাক। ব্যারাকের ওধারে বিকেলের রোদ গায়ে মেখে নদীর ঢেউগুলো টলমল করছে। মোচার খোলার মতো কেরায়া আর ভাউলে নৌকাগুলো দূলছে। ছেঁড়া রঙিন পাপড়ির মতো আকাশে ঝক ঝাক পাখি উড়ছে।

    বিনু বলল, এখন বল—

    ভুরু দুটো বাঁকিয়ে চুরিয়ে ঝুমা বলল, শুনবার জন্যে ঘুম হচ্ছিল না বুঝি?

    এবার প্রথম দু’একদিন মুখচোরার মতো ছিল বিনু, এখন সাহস বেড়ে গেছে। সে বলল, হচ্ছিলই না তো–

    একটু চুপ করে থেকে ঝুমা বলল, সিনেমাটায় কী ছিল জানোবলেই দু’হাতে মুখ ঢেকে খিল খিল করে হেসে উঠল।

    হাসছ কেন? বল–

    অনেকক্ষণ হাসার পর স্থির হল ঝুমা। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ফিসফিস গলায় বলতে লাগল, সিনেমায় একটা সাহেব একটা মেমসাহেবকে খুব কিস খাচ্ছিল–

    নাক মুখ আঁ আঁ করে উঠল বিনুর। অবিশ্বাসের গলায় সে বলল, যাঃ—

    সত্যি বিনুদা। মা কালীর দিব্যি।

    খানিক চিন্তা করে বিনু বলল, সাহেবটার কত বয়েস?

    সাতাশ আটাশ—

    আর মেমটার?

    বাইশ তেইশ!

    এত বড় ছেলেমেয়ে কখনো কিস খায়!

    মুখ ফিরিয়ে ঝুমা বলল, তুমি একটা হাঁদারাম। কিছু জানো না। লাভার হলেই কিস খায়। এই যে আমার দিদি–

    বিনু শুধলো, তোমার দিদি কী?

    কলকাতায় দিদির এক লাভার আছে–অনিমেষদা। আমাদের বাড়ি এলেই দু’জনে ছাদে চলে যেত। তারপর খুব কিস খেত।

    সমস্ত শরীর কেমন যেন জ্বরের মতো লাগছিল। ঝাঁপসা কাঁপা গলায় বিনু বলল, সত্যি?

    সত্যি।

    তারপর কী হয়ে গেল, কে বলবে। সময় যেন কিছুক্ষণ গতি হারিয়ে এই নির্জন ছাদে স্তব্ধ হয়ে রইল। বিনুর যখন জ্ঞান ফিরল, দেখতে গেল, তার বুকের ভেতর ঝুমা চোখ বুজে আছে। চকিত বিনু এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে উধ্বশ্বাসে সিঁড়িঘরের দিকে ছুটল। তর তর করে নিচে নেমে রাজদিয়ার রাস্তা দিয়ে আচ্ছন্নের মতো দৌড়তে লাগল। তার চারধারে চরাচর যেন দুলতে শুরু করেছে।

    বিনু জানে না, একটু আগে ঝুমা তার হাত ধরে কৈশোর থেকে যৌবনের সিংদরজায় পৌঁছে দিয়েছে।

    .

    স্কুলের ছুটি হলে আজকাল আর কোনও দিকে তাকায় না বিনু। সম্মোহিতের মতো নেশাগ্রস্তের মতো ঝুমাদের বাড়ি চলে যায়। এই সময়টার জন্য সারাদিন অস্থির, উন্মুখ হয়ে থাকে সে।

    অশোকের কাছে জীবনের রহস্যময় একটা কথা কিছু কিছু শুনেছিল বিনু। কিন্তু সে সব ভাসা ভাসা, মৌখিক। ঝুমা যেন এক টানে চারদিকের সব পর্দা ছিঁড়ে সেই রহস্যটাকে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

    এই ভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন স্কুল ছুটির পর ঝুমাদের বাড়ি এসে বিনু অবাক, ঝিনুক বসে আছে।

    বিনু শুধলো, তুমি!

    ঝিনুক বলল, সুধাদিদি সুনীতিদিদির ছুটি হতে আজ অনেক দেরি হবে। কতক্ষণ আর স্কুলে বসে থাকব? তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।

    স্কুল ছুটির পর ঝিনুক তার ক্লাসে বসে থাকে। কলেজ থেকে ফেরার পথে সুধা সুনীতি তাকে বাড়ি নিয়ে যায়। দু’বছর এই নিয়মেই কেটেছে। আগেও তো সুধা সুনীতি কত দেরি করে তাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। এতকাল পর হঠাৎ বিনুর সঙ্গে বাড়ি ফেরার কেন যে দরকার হল ঝিনুকের, কে বলবে।

    আজ আর ঝুমার সঙ্গে ভাল করে কথাই বলতে পারল না বিনু। একটু পর ঝিনুককে নিয়ে বাড়ি চলে গেল।

    আশ্চর্য! পরের দিনও ছুটির পর দেখা গেল ঝুমাদের বাড়ি এসে বসে আছে ঝিনুক। তারপরের দিনও সেই ব্যাপার।

    দু’চারদিন দেখে ঝিনুকের চাতুরি ধরে ফেলল বিনু। এখন আর ছুটির পর ঝুমাদের বাড়ি যায় সে। স্কুল কামাই করে দুপুরবেলা ঝুমাদের বাড়ি যেতে লাগল।

    ঝিনুকের সাধ্য কি ঝুমার কাছ থেকে বিনুকে ফেরায়।

    .

    ২.৪০

    কিছুদিন ধরেই খবরের কাগজে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল, ঝড় আসছে।

    পরাধীন দেশের আত্মা অপমানে অত্যাচারে টগবগ করে ফুটছিল। টের পাওয়া যাচ্ছিল, যে কোনও দিন বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।

    কিছুদিন আগে ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। তারপর কয়েকটা মাস সমস্ত ভারতবর্ষ যেন রূদ্ধশ্বাসে অনিবার্য কোনও পরিণামের প্রতীক্ষা করছিল।

    শেষ পর্যন্ত সেই দিনটি এসে গেল। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কাছে গান্ধীজি আগেই কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের কথা বলেছিলেন। ওয়ার্কিং কমিটি সেটা একটা প্রস্তাবে রূপ দেয়।

    আটই আগস্ট বোম্বাইতে ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতিতে বিপুল ভোটাধিক্যে গৃহীত হল।

    এই সময় বক্তৃতা প্রসঙ্গে গান্ধীজি বলেছেন, এই আন্দোলনে আমি আপনাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করছি। অধিনায়ক হিসেবে নয়, আপনাদের সকলের ভৃত্য হিসেবে। তারপরেরই সমস্ত জাতির উদ্দেশ্যে ডাক দিলেন, ব্রিটিশ ভারত ছাড়–কুইট ইন্ডিয়া–

    সারা দেশে যেখানে যত বিক্ষোভ, যত বেদনা, যত অসম্মান পুঞ্জীভূত হয়ে ছিল, সব এক নিমেষে দৃপ্ত অগ্নিশিখা হয়ে উঠল যেন। আর সেই ঊর্ধ্বমুখ শিখার শীর্ষে দুটি অক্ষর জ্বলতে লাগল, কুইট ইন্ডিয়া–

    কুইট ইন্ডিয়া– শৃঙ্খলিত দেশ এই মন্ত্রটির জন্য যুগ যুগ তপস্যা করেছে। কোটি কোটি মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চকিত হয়ে উঠল।

    কিন্তু তারপরেই নিদারুণ খবর এল। রাষ্ট্রীয় সমিতির বোম্বাই অধিবেশনের পর গান্ধীজি, রাষ্ট্রপতি আজাদ, প্যাটেল, জওহরলাল, সরোজিনী নাইডু, ডক্টর প্রফুল্ল ঘোষ, আসফ আলি, কৃপালনি, সীতারামাইয়া এবং সৈয়দ মামুদ সহ ওয়ার্কিং কমিটির সব সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

    বিড়লা ভবনে কস্তুরবা, গান্ধীজির একান্ত সচিব প্যারেলাল, ডাক্তার সুশীলা নায়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাটনায় গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজেন্দ্রপ্রসাদ। এলাহাবাদে ট্যান্ডন এবং কাটজু।

    সারা দেশ জুড়ে শুধু ধরপাকড়ের খবর। নেতাদের কেউ বাইরে নেই, সবাই কারাপ্রাচীরের অন্তরালে।

    নেতৃহীন অনাথ দেশ এ অসম্মান নীরবে মেনে নিল না। যুগ-যুগান্তর ধরে বুকের ভেতর যে স্থূপীকৃত বিক্ষোভ বারুদ হয়ে ছিল, দিকে দিকে তার বিস্ফোরণ শুরু হল। কোথায় মহারাষ্ট্র, কোথায় বিহার, কোথায় পাঞ্জাব-দিগদিগন্ত থেকে কত খবর যে আসতে লাগল। এখানে টেলিগ্রাফের তার কেটে দিয়েছে, ওখানে মাইলের পর মাইল রেললাইন উপড়ে ফেলেছে, সেখানে থানা আক্রমণ, ডাকঘরে। আগুন। ওদিকে বিদেশি শাসকও হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকল না। রক্তচক্ষু মেলে তারা দিগ্বিদিকে ছুটতে লাগল। পরাধীন দেশের জাগ্রত বিবেককে স্তব্ধ করে না দেওয়া পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই।

    শুরু হয়ে গেল সন্ত্রাসের রাজত্ব। গুলি, কাঁদানে গ্যাস, গ্রেপ্তার। বেয়নেটের ধারাল ফলায় কত মানুষের বুক ফালাফালা হয়ে গেল, রাইফেলের নল থেকে বুলেট ছুটে গিয়ে কত মানুষের পাঁজর। বিদীর্ণ করে দিল। জেলখানাগুলো ভরে উপচে পড়তে লাগল।

    সৌরাষ্ট্র থেকে আসাম, হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী–সমস্ত দেশ উত্তাল, ছোট বড় অসংখ্য ঢেউয়ে তরঙ্গিত। কোটি কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণের মতো একটি মাত্র শব্দ শোনা যায়, কুইট ইন্ডিয়া–

    ভারত ছাড়–

    সারা দেশ যখন দুলছে, রাজদিয়া কি স্থির থাকতে পারে? দূরের ঢেউ এই ছোট রাজদিয়াতে এসেও ভেঙে পড়ল।

    বিনুদের স্কুলের হেডমাস্টার মোতাহার হোসেন সাহেব, কংগ্রেসের স্থানীয় সেক্রেটারি, সেদিন একটা মিছিল বার করলেন। পতিতপাবন, খলিল থেকে শুরু করে কে নেই তাতে? কলেজের ছেলেরা এসেও যোগ দিল। শুধু কি স্কুল কলেজের ছেলেরা, রাজদিয়াবাসীদের অনেকেই মিছিলে এসেছে। সারা শহর বেরিয়ে পড়েছে। বিনু কি চুপ করে ঘরে বসে থাকতে পারে? সেও ছুটে এসেছে। প্রায় সবার হাতেই একটা করে ত্রিবর্ণ পতাকা।

    সমস্ত দেশ জুড়ে যে বর্বরতা চলছে তার প্রতিবাদ করতে হবে। শোভাযাত্রা শহরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। সেই সঙ্গে অসংখ্য কণ্ঠে শোনা যেতে লাগল:

    বন্দে মাতরম্—

    বন্দে মাতরম—

    ভারত মাতাকি—

    জয়—

    ব্রিটিশ—

    ভারত ছাড়–

    ঘুরতে ঘুরতে থানার কাছে অসতেই হঠাৎ পুলিশ লাঠি চার্জ শুরু করে দিল। একটা লাঠি পড়ল বিনুর হাঁটুতে। লুটিয়ে পড়তে পড়তে বিনু দেখতে পেল, মোতাহার হোসেন সাহেবের মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। শুধু কি মোতাহার সাহেবই, কত ছেলের যে হাত-পা ভেঙেছে, হিসেব নেই। শোভাযাত্রা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। অনেকে পালাচ্ছে। থেকে থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে আসছে।

    দেখতে দেখতে একসময় বেহুঁশ হয়ে পড়ল বিনু। জ্ঞান ফিরলে দেখল, সদর হাসপাতালে শুয়ে আছে, পায়ে মস্ত ব্যান্ডেজ। তার পাশের বেডে মোতাহার সাহেব। চারদিকের সারি সারি বেডগুলোতে আরও অনেক ছেলে। বেড বেশি নেই বলে অনেককে মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে।

    হাসপাতালে সাত দিন থাকতে হল। এর ভেতর হেমনাথ আর ঝিনুক রোজই আসে।

    ঝিনুক ছলছল করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, তোমার খুব লেগেছে, না বিনুদা?

    বিনু হাসে, না, তেমন কিছু নয়।

    সুরমা, অবনীমোহন, সুধা সুনীতি একদিন পর পর এসে দেখে যায়। ঝুমাও এল একদিন। ঠোঁট টিপে বলল, আচ্ছা বীরপুরুষ।

    হাসপাতালে থাকার সময় বিনু লক্ষ করেছে, দিনরাত পুলিশ সারা হাসপাতালটা ঘিরে রেখেছে। সাত দিন পর পুলিশের পাহারাতেই কোর্টে যেতে হল। তাদের বিরুদ্ধে থানা আক্রমণের অভিযোগ আনা হয়েছে।

    বিচারে পনের দিনের জেল হয়ে গেল বিনুর, মোতাহার সাহেবের হল দু’মাস। অন্য ছেলেদেরও দশ থেকে পনের দিনের সাজা হল।

    মুক্তির দিন জেল গেটে সে কী দৃশ্য! সারা রাজদিয়া যেন ভেঙে পড়েছে সেখানে। বিনুরা বেরিয়ে আসতেই কারা যেন গলায় ফুলের মালা দিয়ে তাকে কাঁধে তুলে ফেলল। কাঁধে চড়েই বাড়ি ফিরল সে।

    জেল-খাটা, পা-ভাঙার জন্য অবনীমোহন বা সুরমা সুখী নন। তারা বলতে লাগলেন, হই চই করে কতগুলো দিন নষ্ট করল। এ বছর কিছুতেই ও পাশ করতে পারবে না। একটা বছর মাটি হবে।

    হেমনাথ বিনুর পক্ষ নিয়ে বললেন, হোক নষ্ট, পড়াশোনার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে, কিন্তু এমন দিন আর কখনও আসবে না। সেদিন নিজে থেকে প্রশেসনে না গেলে আমিই ওকে দিয়ে আসতাম।

    ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন উত্তেজনা কেটে যেতে বেশ সময় লাগল। তারপর স্কুল, পড়াশোনা, ছুটির পর ঝুমাদের বাড়ি যাওয়া, ঝিনুকের সঙ্গে লুকোচুরি দিয়ে ঘেরা সেই পুরনো অভ্যস্ত জীবনের ভেতর আবার ফিরে গেল বিনু।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.