Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ২.৪৬-৫০ মাঘের শেষ তারিখে

    ২.৪৬

    মাঘের শেষ তারিখে দিন পড়েছে। একই লগ্নে সুধা সুনীতির বিয়ে। রাত থাকতে থাকতে কাকপক্ষী জাগবার আগে দুই বোনকে বিছানা থেকে তোলা হল। শুরু হল অধিবাসের কাজ।

    সুধা সুনীতিকে নতুন কাপড় পরানো হল, গলায় দেওয়া হল তুলসী কাঠের মালা, কোমরে নতুন লাল ঘুনসি, কপালে চন্দন কুঙ্কুমের ফোঁটা, চোখে কাজলের টান, সারা গায়ে ঝকমকে নতুন গয়না, হাতে নতুন শাখা।

    মেয়ে সাজাবার পর নতুন পিঁড়িতে তাদের পাশাপাশি বসিয়ে শ্বেত পাথরের থালায় খাবার খেতে দেওয়া হল–খই চিড়ে মুড়কি ক্ষীর দই চিনি-বাতাসা। বিনু ঝিনুকও ওদের সঙ্গে বসে গেল। এরপর সারাদিন বিয়ের কনেরা আর কিছু খাবে না। খাবে সেই রাত্রিবেলা–বিয়ের পর।

    সুধা সুনীতিকে খেতে বসিয়ে তিরিশ চল্লিশজন এয়ো নিয়ে গান গাইতে গাইতে নদীর ঘাটে জলসই’তে গেলেন স্নেহলতা। সঙ্গে সঙ্গে সানদার (সানাইবাদক) আর ঢুলী বাজাতে বাজাতে চলল।

    জলে ঢেউ দিও না লো সখী
    ঢেউ দিও না, ঢেউ দিও না,
    আমরা জলের চাতকী।
    জলের কালোরূপ নিরখি
    জলে ঢেউ দিও না গো সখী।
    আগে সখী, পাছে গো সখী।
    মধ্যে রাধা চন্দ্রমুখী।

    স্নেহলতা যতক্ষণ না ফিরছেন, সুধা সুনীতি পাত ছেড়ে উঠবে না। এই হচ্ছে রীতি।

    কিছুক্ষণ পর স্নেহলতারা নদী থেকে নতুন কলসিতে জল ভরে ফিরে এলেন। যে কলসিটায় জল আনা হয়েছে সেটার নাম মঙ্গলকলস। পাঁচজন এয়ো একসঙ্গে কলসিটা ধরে উলু দিতে দিতে মাটিতে স্থির করে বসাল। একজন তার তলায় আগেই ধানদূর্বা দিয়েছে। বাকিরা গান ধরল।

    ওগো মঙ্গলো আসিছে দুয়ারে।
    মঙ্গলো অবনী আজ।
    মঙ্গলো জলধর, মঙ্গলো কলসে
    পাদ্য অর্ঘ্য নিয়ে এসো হরষে,
    অতিথি, ভূপতি, দেবতা, স্বদেশে,
    মঙ্গলো অবনী আজ।

    দেখতে দেখতে রোদ উঠে গেল, বেলা চড়তে লাগল। দুপুরের খানিক আগে পুরুত এল। অবনীমোহন মেয়ে সম্প্রদান করবেন। পুরুত তাকে নিয়ে বৃদ্ধিতে বসে গেল। বৃদ্ধির সময়ও মেয়েরা গান ধরল:

    ওগো বৃদ্ধির কার্যে কী কী লাগে?
    ষোল মণ চাউল লাগে গো।
    ওগো বৃদ্ধির কার্যে কী কী লাগে?
    ষোল বিড়া পান লাগে গো।
    ওগো বৃদ্ধির কার্যে কী কী লাগে?
    ষোল মণ গুয়া লাগে গো।

    বৃদ্ধির পর এয়োরা শিলে কাঁচা হলুদ বেটে সুধা সুনীতিকে মাখাল। তারপর তাদের মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে উলু দিতে দিতে স্নান করাতে লাগল। সেই সঙ্গে গান।

    তোরা আয় লো সকলে
    আমার সীতাকে স্নান করাব
    সুশীতল জলে।
    কস্তুরী মিশায়ে জল ঢেলে দাও গো
    সীতার শিরে।
    সখী, সকলে আন গো, মাজ কেটে আনো
    কুর হরিদ্রা বেটে আনো—

    সুধা সুনীতির স্নান হয়ে গেলে, ‘অধিবাসে’র তত্ত্ব নিয়ে হেমনাথ আর বিনু বেরিয়ে পড়ল। দু’ বাড়িতে তত্ত্ব যাবে। মাছ, পান, তামার পরাতে পরাতে নানা রকমের মিষ্টি। এত জিনিস হাতে করে তো নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই ভবতোষের ফিটনটা সকাল বেলাতেই আনিয়ে রেখেছিলেন হেমনাথ।

    প্রথমে বিনুরা গেল হিরণদের বাড়ি। সেখানে বেশিক্ষণ বসল না; তত্ত্ব নামিয়ে দিয়ে সোজা রামকেশবের বাড়ি চলে এল।

    এখানেও সানাই বাজছে, ঢাক বাজছে। মাঝে মাঝে শাঁখ এবং কল কল উলুর আওয়াজ আসছে।

    বিনুরা বাড়ির ভেতর আসতেই সাড়া পড়ে গেল। ঝুমা কোথায় ছিল, ছুটতে ছুটতে সামনে এসে হাজির।

    আজ দারুণ সেজেছে ঝুমা। অন্যদিন ফ্রক পরে থাকে। আজ হলুদ রঙের সিল্কের শাড়ি আর লাল টুকটুকে একটা জামা পরেছে। শাড়িটার গায়ে ছোট ছোট নীল ময়ূর। কপালে আগুনের কুঁড়ির মতো কুমকুমের একটি টিপ। টিপটাকে গোল করে ঘিরে চন্দনের বিন্দু। চোখে কাজলের টান। গালে এবং ঠোঁটে লালচে রং। আঙুলে পাথর-বসানো লম্বা আংটি, গলায় হার, হাতে সোনার চুড়ি, বাঁ হাতের সুডোল নরম কবজিটাকে ঘিরে সরু ফিতেতে বাঁধা চৌকো ঘড়ি।

    ঝুমার সাজটাজ নিয়ে ঠাট্টা করতে যাচ্ছিল বিনু। তার আগেই ঘাড়খানা বাঁকিয়ে গালে একটি হাত রেখে ঝুমাই বলে উঠল, বাবা, কী সাজটাই না সেজেছে! একেবারে বরবেশ।

    চমকে নিজের দিকে তাকাল বিনু। তার পরনে ধবধবে পাটভাঙা ধুতি, দুধরং সিল্কের পাঞ্জাবি, পায়ে নতুন পাম্প-শু। সাজসজ্জা তারও কিছু কম নয়। বিব্রত হেসে বিনু বলল, না, মানে–

    চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝুমা বলতে লাগল, যা সেজেছ, এখন কারোর সঙ্গে মালাবদল করিয়ে দিলেই হয়–

    বিনুর আড়ষ্টতা কেটে গিয়েছিল। হাসতে হাসতে বলল, আমার আপত্তি নেই। একজন যদি রাজি থাকে আজই’ বলে চোখের তারায় ইঙ্গিত করল।

    ইঙ্গিতটা বুঝেছে ঝুমা। ঝঙ্কার দিয়ে বলল, আহা-হা, আহ্লাদ কত–

    বিনু হাসতেই লাগল।

    ঝুমা আবার বলল, ওবেলা তোমাদের বাড়ি যাচ্ছি।

    বরযাত্রীদের সঙ্গে?

    হ্যাঁ, বাসর জাগব। তোমাকেও জাগতে হবে।

    নিশ্চয়ই।

    বাসরে তোমার কী হাল করি, দেখো।

    দেখব।

    একটু ভেবে ঝুমা বলল, বাসর তো সেই রাত্রিবেলায়। তখন যা হবার হবে। এখন একটু মজা করি।

    বিনু ভয়ে ভয়ে বলল, কী করবে?

    উত্তর না দিয়ে ছুটে কোথায় চলে গেল ঝুমা। পরক্ষণেই ফিরে এসে বিনু কিছু বুঝবার আগেই এক গাদা হলুদ তার নাকে-মুখে, ধুতি-পাঞ্জাবিতে মাখিয়ে দিল।

    বিনু বলতে লাগল, কী করছ! কী করছ!

    ঝুমা বলল, একদিন তো মাখতেই হবে। মাখলে কেমন লাগে আগেই দেখে নাও—

    .

    গোধুলি লগ্নে বিয়ে। বেলা থাকতে থাকতে দুই বর এসে পড়ল। বেশিক্ষণ তাদের বসতে হল না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ের আসরে নিয়ে যাওয়া হল। সানাই ঢোল কঁসি আর শাঁখের বাজনা, ঘন ঘন উলুধ্বনি–এর মধ্যে পর পর দুই মেয়েকে সম্প্রদান করলেন অবনীমোহন। সাত পাক ঘোরাবার সময় এয়োরা গান ধরল:

    আমতলায় ঝামুর ঝুমুর কলাতলায় বিয়া,
    আইল গো সুন্দরীর জামাই মুকুট
    মাথায় দিয়া।
    মুকুটের তলে তলে চন্দনের ফোটা।
    চল সখী সবাই মিলা জামাই বরি গিয়া।
    ও রাধে ঠমকে ঠমকে হাটে।
    শ্যামচাঁদের পাছে য্যামন ময়ুরে প্যাখম ধরে।
    আগে যায় গো শ্যাম রাজা।
    পাছে যায় গো রাধা,
    তারও পাছে যায় গো পুরুত
    ভৃঙ্গার হাতে লইয়া।
    এক পাক, দুই পাক, তিন পাকও যায়,
    সাত পাক দিয়া রাধা নয়ন তুইলা চায়।

    বিয়ের আসর থেকে সোজা বাসর ঘরে। পাশাপাশি দুই বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। সেখানে শুধু মেয়েদের ভিড়। ঠাট্টা, ঠিসারা, বিদ্যুৎচমকের মতো হাসাহাসি, ঠেলাঠেলি–এর মধ্যেই দুই ঘরে চাল খেলা, যো-খেলা হয়ে গেল। তারপর শুরু হল জামাই নাজেহাল করা ধাঁধা। ধাঁধার পর স্নেহলতা রঙ্গিণী মুর্তি ধরলেন। দুই বাসরে ঘুরে ঘুরে মাথায় আড়-ঘোমটা টেনে মাজা বাঁকিয়ে গাইতে লাগলেন:

    ওগো বর, এলাম তোমার বাসরে।
    একটা গান গাও না শুনি,
    গান যদি না গাও, আমার নাতনীর
    ধর পাও,
    নহিলে মিলবে না সোনার চাঁদবদনী।

    এত ভিড়ের ভেতর ছুঁচের পেছনে সুতোটির মতো বিনুর পেছনে ঝুমা লেগেই আছে। আর ঝিনুক? জল খেলা, চাল খেলা, ধাঁধা, নাচ গান, ঠাট্টা, রগড়-কিছুই যেন বুঝতে পারছিল না সে। পলকহীন কুমা আর বিনুর দিকে তাকিয়ে ছিল সে।

    এ বিয়ের আরও একটি দিক আছে। সেটা এরকম। হেমনাথ রাজ্যসুদ্ধ লোককে নেমন্তন্ন করে এসেছিলেন, বিয়ে দেখার নেমন্তন্ন। কিন্তু খাবার জন্য তাদেরই ডেকেছিলেন যারা দেশজোড়া আকালে আর মন্বন্তরে একটু ফ্যানের আশায় রাজদিয়ার রাস্তায় রাস্তায় প্রেতমুর্তির মতো ঘুরে বেড়ায়।

    সন্ধে থেকে হেমনাথ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে তদারক করে খাওয়াচ্ছিলেন।

    সকাল থেকে লারমোর এ বাড়িতে আছেন। তিনি বলছেন, এ কী করছ হেম! না খেয়ে খেয়ে ওদের পেট মরে গেছে। তার ওপর ভালমন্দ পড়লে আর দেখতে হবে না। সটান যমরাজার দরবারে গিয়ে হাজির হবে।

    হেমনাথ বলেছেন, এমনি মরবে, অমনিও মরবে। না খেয়ে মরে কী হবে, খেয়েই মরুক।

    খাওয়া দাওয়া যখন শেষ হয়ে এসেছে সেই সময় গদু চক্কোত্তি এসে হাজির। যুগলের বৌভাতে সে এসেছিল, তারপর এই দেখা গেল। চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে গদুর। বুকের হাড়গুলো গুনে নেওয়া যায়, চোখ এক ইঞ্চি ভেতরে ঢুকে গেছে।

    হেমনাথ বললেন, তোমার এ কী হাল হয়েছে চক্কোত্তি!

    গদু চক্কোত্তি বলল, আর কইয়েন না হ্যাম কত্তা, না খাইয়া খাইয়া শরীল গ্যাল। যা আকাল পড়ছে হেয়াতে (তাতে) কেউ আর খাইতে দ্যায় না। আগে মাইষে আনন্দ কইরা খাওয়াইত, অহন আমারে দেখলে মুখ ফিরাইয়া লয়। যা দুদ্দশা, তাগোই বা দুষ (দোষ) কী?

    সে তো ঠিকই। অনেক রাত হয়ে গেছে, হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে যাও।

    যুগলের বিয়ের সময় গদু চক্কোত্তি যা খেয়েছিল সুধা সুনীতির বিয়েতে তার তিনগুণ খেল। কিন্তু কে জানত, এই খাওয়াই তার শেষ খাওয়া।

    যাই হোক, খেয়ে টেয়ে চলে গেল গদু চক্কোত্তি। দিন দুই পর খবর এল, এখান থেকে মাইল তিনেক দূরের এক গ্রামে ভেদবমি করে সে মারা গেছে।

    .

    ২.৪৭

    সুধা সুনীতির বিয়ের মাসখানেক পর একদিন দুপুরবেলা ভয়ানক শ্বাসকষ্ট শুরু হল সুরমার। তক্ষুনি লারমোরকে ডেকে আনার জন্য করিমকে পাঠানো হল। কিন্তু লারমোর পৌঁছবার আগেই সব শেষ।

    এ বছর পুজোর পর থেকেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন সুরমা। চলাফেরা দূরের কথা, উঠে বসবার শক্তিটুকু পর্যন্ত তার ছিল না। অদৃশ্য রক্তচোষা দেহের সব সার যেন শুষে নিয়ে একটা বাজে সাদা কাগজের মতো সুরমাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল।

    এবাড়ির লোকেরা মনে মনে অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল, সুরমা খুব বেশিদিন বাঁচবেন না। দ্রুত আলো নিবে আসার মতো তার আয়ু ফুরিয়ে আসছিল। যা অনিবার্য, অবশ্যম্ভাবী, আজ দুপুরবেলা তাই ঘটে গেল।

    খবর পেয়ে সুধা-সুনীতি-হিরণ-আনন্দ ছুটে এল। শুধু কি ওরাই, কুমোরপাড়া-কামারপাড়া যুগীপাড়া-তিলিপাড়া, সারা রাজদিয়াই বা কেন, মৃত্যু-সংবাদ কানে যেতে চারদিকের গ্রামগঞ্জগুলো থেকে অসংখ্য মানুষ মলিন মুখে হেমনাথের বাড়ির দিকে আসতে লাগল।

    সমস্ত বাড়িখানা জুড়ে কান্না ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। সুধা সুনীতি সুরমার অসাড় বুকে মুখ গুঁজে অবোধ শিশুর মতো কাঁদছিল, তুমি আমাদের ফেলে কোথায় গেলে মা!

    সুরমার শিয়রের কাছে বসে ছিলেন স্নেহলতা আর শিবানী। সজল চোখে ভাঙা ভাঙা গলায় তারা বলছেন, আমাদের দাবি বলেই কি এতদিন পর রাজদিয়ায় এসেছিলি মা!

    একধারে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ঝিনুক। আরেক ধারে হেমনাথ এবং অবনীমোহন ঘন ঘন হাতের পিঠে চোখ মুছছিলেন। তাঁদের চোখ ফোলা ফোলা, আরক্ত, জলপূর্ণ।

    এত কান্নার মাঝখানে বিনু কিন্তু একটুও কাঁদতে পারছিল না। বুকের ভেতর পাষাণভারের মতো কী যেন চেপে আছে। চোখ ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু এক ফোঁটা জলও বেরুচ্ছে না। এত লোকজন, এত কান্না, শোকোচ্ছাস কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছিল না সে। কিছুই দেখতে বা বুঝতে পারছিল না। বিনুর সমস্ত অনুভূতি বুঝিবা অসাড় হয়ে গেছে।

    দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল।

    ওদিকে কারা যেন কুড়োল দিয়ে বাগানের বুড়ো একটা আমগাছ কেটে ছোট ছোট খন্ড করে ফেলল। তারপর পুকুরের ওপারে উঁচুমতো জায়গাটায় চিতা সাজাল।

    এদিকে স্নেহলতা সিঁদুরে-চন্দনে এবং রাশি রাশি ফুলে সুরমাকে সাজিয়ে দিলেন। তারপর কারা যেন হরিধ্বনি দিয়ে তাকে কাঁধে তুলে পুকুরপাড়ের দিকে নিয়ে গেল। হেমনাথ বিনুর একটা হাত শক্ত করে ধরে শবযাত্রীদের সঙ্গে সঙ্গে চললেন। সুধা-সুনীতি-স্নেহলতা-শিবানী-অবনীমোহন-কেউ বাড়িতে থাকল না। সবাই চলেছে আর অভিভূতের মতো বুক ফাটিয়ে কাঁদছে।

    বিনুর মনে হল, সে যেন মাটির ওপর দিয়ে হাঁটছে না; হাওয়ার ভেতরে ভারহীন হালকা শরীর নিয়ে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে।

    চিতায় তুলবার আগে সুরমাকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হল, পুরুত জোরে জোরে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছিল। শব্দগুলো কানে আসছিল ঠিকই, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিল না বিনু।

    একটু পর সুরমাকে চিতায় তোলা হল। এবার মুখাগ্নির পালা। বিনুকেই তা করতে হবে। কে যেন সাদা ধবধবে একগোছ পাটশালার মাথায় আগুন ধরিয়ে তার হাতে দিল। হেমনাথ তাকে ধরে চিতার চারধারে প্রদক্ষিণ করাতে লাগলেন। পুরুতটা মন্ত্র পড়তে পড়তে আগে আগে চলতে লাগল। বিনুর মনে হতে লাগল, তার চারপাশে সমস্ত চরাচর যেন দুলছে।

    চিতাটাকে ক’বার প্রদক্ষিণ করেছে, বিনু মনে করতে পারল না। একসময় পুরুতের কথায় মন্ত্রচালিতের মতো সুরমার মুখে পাট কাঠির আগুন ছোঁয়াল।

    শবযাত্রীরা চারদিক থেকে চিৎকার করে বলতে লাগল, বল হরি–

    হরি বোল—

    তারপরেই চিতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।

    কতক্ষণ আর? চৈত্র মাসের রাত গাঢ় হবার আগেই সুরমার রুগ্ণ শীর্ণ দেহ চিতাধূমে বিলীন হয়ে গেল।

    আগুন নিবে গেলে চিতা ধুয়ে শবযাত্রীরা পুকুরঘাটে স্নান করল। বিনুকেও স্নান করানো হল, তারপর নতুন কোরা কাপড়ের তেউনি পরানো হল তাকে, গলায় লোহার চাবি-বাঁধা ধড়া ঝুলিয়ে দেওয়া হল, হাতে দেওয়া হল একটুকরো কম্বলের আসন।

    পরদিন থেকে শুরু হল হবিষ্যি। ঘরের এক কোণে নিজের হাতে নতুন মালসায় আলো চালের একসেদ্ধ ভাত রাঁধে বিনু। কাছে বসে সজল চোখে দেখিয়ে দেন স্নেহলতা। রাতে একটু দুধ আর ফলটল খেয়ে খালি মেঝেতে এক টুকরো নতুন কাপড় পেতে শুয়ে পড়ে।

    রাজদিয়ার সব বাড়ি থেকে হবিষ্যির উপকরণ পাঠাচ্ছে–আলো চাল, কাঁচা দুধ, সর বাটা ঘি, আলু, কাঁচকলা ইত্যাদি।

    দেখতে দেখতে শ্রাদ্ধ চুকে গেল। শ্রাদ্ধের পরদিন মৎস্যমুখী। রাজদিয়ার হেন মানুষ নেই যে সুরমার শ্রাদ্ধে না এসে পেরেছে।

    বিনুদের সংসারে এই প্রথম মৃত্যু। একটি মৃত্যুই বিনুর চোখে জগতের রূপ একেবারে বদলে দিয়ে গেছে।

    এখন, এই চৈত্র মাসে হিজলগাছগুলো ফুলে ফুলে ছেয়ে যেতে শুরু করেছে। কাউগাছের ডালে ডালে গুটি ধরেছে। মান্দার আর শিমুল গাছগুলো সারা গায়ে থোকা থোকা আগুনের মতো লাল টুকটুকে ফুল ফুটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাগানের আমগাছগুলোতে গাঢ় সবুজ রঙের আম লম্বা বোঁটায় সারাদিন দোল খাচ্ছে। পরিষ্কার করে মুছে দেওয়া আয়নার মতো আকাশটা ঝকমকে। সকালে-দুপুরে বিকেলে, পুকুরের ওপারে শূন্য মাঠের ওপর কত রকমের পাখি যে উড়তে থাকে–কানিবক, পানিকাউ, টিয়া, বুলবুলি, ধবধবে গো-বক।

    যেদিকেই চোখ ফেরানো যাক, এখন শুধুই রঙের সমারোহ। লালে নীলে সবুজে অপরূপ এই বসুন্ধরা বিনুকে আজকাল আর আকুল করে না। যুগল চলে যাবার সময় ধানের খেত, শাপলা বন, জলসেঁচি শাকের ঘন জঙ্গল, উলু খড়ের বন, কেয়া ঝোঁপ, বেত ঝোঁপ, বনতুলসীর চাপ চাপ অরণ্য– জল-বাংলার সজল শ্যামল ভূখন্ডের সবটুকুর উত্তরাধিকার তার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। এই সেদিনও একা একা শূন্য মাঠে আলপথ ধরে মোহাচ্ছান্নের মতো হেঁটে যেতে তার ভাল লাগত। আকাশ জুড়ে ফিনফিনে পাতলা ডানায় ফড়িংদের ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে যেত। চনচনে সোনালি রোদ, উলটোপালটা বাতাস, গাছপালা, বনানী, নরম তৃণদল–সব যেন যাদুকরের মতো তাকে সম্মোহিত করে ফেলত।

    কিন্তু আজকাল সারা দিনই প্রায় পুবের ঘরের পৈঠেয় চুপচাপ বসে থাকে বিনু। পুকুরের ওপারে ধু ধু দক্ষিণের চক, অনেক দূরের দিগন্ত, আকাশ, বনভূমি–সব মিলিয়ে যেন এক অপরিচিত মহাদেশ। ওখানকার কোনও কিছুই সে জানে না, চেনে না। কোনওদিন ওখানে সে যেন যায় নি, যাবার আকর্ষণও বোধ করে না।

    দিনের বেলায় একটা দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে বিনুর। সুরমাকে যেখানে পোড়ানো হয়েছে তার পাশেই উঁচু বাজে-পোড়া সুপুরি গাছটার মাথায় সমস্ত দিন একটা শঙ্খচিল ডানা মুড়ে বসে থাকে, সন্ধে হলেই পাখিটা উড়ে যায়।

    শুধু দিনের বেলাতেই না, রাত্তিরেও ওই পৈঠেটিতে বসে থাকে বিনু। তার চোখের সামনে একটি দুটি করে তারা ফুটতে ফুটতে সমস্ত আকাশ ছেয়ে যায়। একসময় চাঁদও ওঠে।

    রাজদিয়ায় আসায় পর হেমনাথ তাকে নক্ষত্র চিনিয়েছিলেন। ওই তারটা অরুন্ধতী, ওইটা লুব্ধক, ওইটা শতভিষা। ছেলেবেলায় মায়ের কছে বিনু শুনেছিল, মানুষ মরে গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়। ওই সূদুর জোতিষ্কলোকের কোন তারাটি তার মা, কে জানে।

    প্রায় রোজই ঝিনুক তার পাশে এসে নিঃশব্দে বসে পড়ে। কখন যে মেয়েটা আসে, টেরও পাওয়া যায় না। হঠাৎ একসময় আধফোঁটা ঝাঁপসা গলায় সে ডেকে ওঠে, বিনুদা

    বিনু মুখ ফেরায় না। উদাস গলায় বলে, কী বলছ?

    পিসিমার জন্যে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?

    বিনু চুপ।

    ঝিনুক আবার বলল, জানো বিনুদা, মায়ের জন্যে আমারও খুব কষ্ট হয়।

    হঠাৎ বিনু ভাবে, ঝিনুকের সঙ্গে এক জায়গায় তার ভারি মিল। মেয়েটাকে বড় আপনজন মনে হয়।

    .

    ২.৪৮

    সুরমার মৃত্যুর কারণে অনেক দিন স্কুল কামাই হয়েছে। প্রায় মাসখানেক পর আজ স্কুলে গেল বিনু।

    সেটেলমেন্ট অফিসের কাছে আসতে ঝুমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আচমকা বিনুর মনে পড়ল, মায়ের মৃত্যুর পর রাজদিয়ার সব মানুষ তাদের বাড়ি গেছে। শুধু ঝুমা বাদ।

    ঝুমা বলল, তুমি খুব রোগা হয়ে গেছ বিনুদা।

    আবছা কী উত্তর দিয়ে বিনু বলল, মা স্বর্গে গেল। তুমি তো আমাদের বাড়ি একদিনও এলে না?

    দুই হাত এবং মাথা জোরে জোরে নেড়ে ঝুমা বলল, তোমাদের বাড়ি গেলেই তো কান্নাকাটি, ও সব আমার ভাল লাগে না।

    পলকে মুখোন মলিন হয়ে গেল বিনুর। মনে হল, ঝুমা বড় দূরের মানুষ।

    সুরমার মৃত্যুর মাস দুই পর সুনীতিকে নিয়ে আনন্দ কলকাতায় চলে গেল। তাদের সঙ্গে শিশিররাও গেলেন। কলকাতার অবস্থা নাকি এখন ভাল। জাপানি বোমার ভয়ে যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা সব ফিরে যেতে শুরু করেছে সেখানে।

    যাবার আগের দিন সুনীতিরা দেখা করতে এসেছিল। ঝুমাও এসেছিল ওদের সঙ্গে।

    আড়ালে ডেকে নিয়ে ঝুমা বিনুকে বলেছে, আমরা যাচ্ছি। কলকাতায় গিয়ে চিঠি দেব। তুমিও কিন্তু চিঠি লিখবে।

    আস্তে ঘাড় কাত করেছে বিনু।

    সুনীতিরা চলে যাবার পর দু’টো সপ্তাহও কাটল না। একদিন সকালবেলা হিরণ এসে হাজির।

    হেমনাথ বাড়িতেই ছিলেন। বললেন, কী ব্যাপার হিরণচন্দ্র?

    একটা কথা ছিল দাদু—

    নির্ভয়ে বলে ফেল।

    খানিক ইতস্তত করে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে হিরণ বলল, আমি কলকাতায় একটা ভাল চাকরি পাচ্ছি দাদু–

    হেমনাথের ভুরু কুঁচকে গেল, কিসের চাকরি?

    ওয়ারের। অফিসার র‍্যাঙ্কের চাকরি। নেব? হিরণের চোখ চকচক করতে লাগল।

    হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন হেমনাথ, ওয়ারের চাকরি নিবি বলেই কি তোকে লেখাপড়া শিখিয়েছিলাম? তুই চলে গেলে কলেজের কী হবে? ছি ছি, লোভটাই বড় হল!

    হিরণের মুখ কালো হয়ে গেল।

    এর পর অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকলেন হেমনাথ। বুঝলেন, হিরণকে আটকাবার চেষ্টা বৃথা। যুদ্ধের চাকরি তার অসীম শক্তি দিয়ে হিরণকে রাজদিয়া থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবেই। এক সময় গম্ভীর গলায় হেমনাথ বললেন, ইচ্ছা যখন হয়েছে, যাও। তবে এতে আমার ভীষণ আপত্তি-হেমনাথকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছে। খুবই হতাশ আর করুণ।

    দিনকয়েক পর সুধাকে নিয়ে কলকাতায় চলে গেল হিরণ।

    .

    দেখতে দেখতে আরও ক’মাস কেটে গেল।

    সুরমা নেই। সুধা সুনীতি চলে গেছে। হেমনাথের বাড়িটা এখন নিঝুম। কিছুদিন আগেও হই চই, হুল্লোড় এবং জীবনের নানা প্রাণবন্ত খেলায় এ বাড়িতে সব সময় উৎসব লেগে থাকত। এখন বাড়িটা ঘিরে অপার শূন্যতা নেমে এসেছে যেন।

    মাঝে মাঝে শিবানী আর স্নেহলতা সুরমার জন্য বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদেন। অবনীমোহন আর হেমনাথ উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন।

    এখন বর্ষা।

    মেঘ-বৃষ্টি-বাজ আর ঘন ঘন বিদ্যুৎচমক–চতুরঙ্গে আকাশ সারাদিন সেজেই আছে। ক’বছর ধরেই বিনু দেখেছে, বর্ষা নামলেই পুকুরের ওপারের মাঠ ভেসে যায়। তার মাঝখানে কৃষাণ-গ্রামগুলো দ্বীপের মতো কোনওরকমে মাথা তুলে থাকে। মাটির তলায় কোথায় যে শাপলা শালুক আর পদ্মের বীজ লুকিয়ে থাকে, কে বলবে। জল পড়লেই লাফ দিয়ে তারা বেরিয়ে আসে। সাদা সাদা শাপলা ফুলে, থালার মতো বড় বড় গোল পদ্মপাতায় আর লাল টুকটুকে শালুকে জলপূর্ণ চরাচর ছেয়ে যায়। গাঢ় সবুজ রঙের ধান আর পাটের চারাগুলো বর্ষায় জলের ওপর দিয়ে মাথা তুলে থাকে। মাঝে মাঝে এক আধটা নিঃসঙ্গ বউন্যা গাছ, কোথাও বা হিজলের সারি।

    এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। উত্তরে-দক্ষিণে-পুবে-পশ্চিমে, যেদিকেই তাকানো যাক, চোখ জুড়ে বর্ষার সেই পরিচিত জলছবি।

    সেদিন সন্ধেবেলা বিনু আর ঝিনুক পুবের ঘরে পড়তে বসেছিল। সামনে আড়াই-তলা পিলসুজে রেড়ির তেলের প্রদীপ জ্বলছে। অবনীমোহন এবং হেমনাথও এ ঘরেই ছিলেন। আজকের স্টিমারে যে খবরের কাগজখানা এসেছে, দু’জনে ভাগাভাগি করে পড়ছেন। সুরমার মৃত্যুর পর কাগজ নিয়ে আজকাল আর এ বাড়িতে আসর বসে না।

    বাইরে অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছিল। হঠাৎ ঝুমঝুম আওয়াজে বিনুরা মুখ তুলে তাকাল।

    চোখের সামনে থেকে কাগজ নামিয়ে হেমনাথ বললেন, এই বৃষ্টিতে আবার কে এল?

    ততক্ষণে বিনু দেখতে পেয়েছে। উঠোনের মাঝখানে ঝিনুকদের ফিটনটা এইমাত্র এসে থামল।

    বিনু বলল, মনে হচ্ছে, ভবতোষ মামা এসেছেন–

    সত্যি, ভবতোষই। একটু পর তিনি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

    ভবতোষের দিকে তাকিয়ে সবাই চমকে উঠল। চুল এলোমেলো, চোখ দুটো লাল টকটকে এবং ফুলে ফুলে অস্বাভাবিক বড় হয়ে গেছে। মনে হয়, যে কোনও সময় সে দু’টো ফেটে ফিকি দিয়ে রক্ত ছুটবে। চোখের কোলে গাঢ় কালির ছাপ, কণ্ঠার হাড় ফুঁড়ে বেরিয়েছে। জামার বোম নেই, বুকটাও হাট করে খোলা, কেঁচার দিকটা অনেকখানি খুলে মাটিতে লুটোচ্ছে।

    কেউ কিছু বলবার আগেই ভাঙা ভাঙা, ঝাঁপসা গলায় ভবতোষ বললেন, কাকাবাবু, আপনার বৌমা সেই লোকটার সঙ্গে পালিয়ে গেছে তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়তে লাগল।

    হেমনাথ চকিত হলেন, সে কী! বৌমা তাঁর বাপের বাড়ি ছিল না?

    হ্যাঁ। ওখান থেকেই গেছে। আচ্ছা আমি যাই–বলেই প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিটনটায় গিয়ে উঠলেন। হেমনাথ বিমূঢ়ের মতো একটুক্ষণ বসে থাকলেন। তারপর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডাকতে লাগলেন, ভব—ভব–

    ভবতোষ সাড়া দিলেন না। ঝুমঝুম আওয়াজ কানে ভেসে এল। অর্থাৎ ফিটনটা চলতে শুরু করেছে।

    কী করবেন, হেমনাথ যেন ভেবে পেলেন না। হঠাৎ তার চোখ এসে পড়ল বিনুর ওপর। দ্রুত শ্বাসটানার মতো করে বললেন, যা তো দাদা, ভব’র সঙ্গে যা। ছেলেটা আবার ঝোঁকের মাথায় এক কান্ড না করে বসে। সব সময় ওর কাছে থাকবি। যদি তেমন বুঝিস, আজ রাত্তিরে আর ফিরতে হবে না।

    বিনু ছুটে গিয়ে যখন ফিটনটা ধরল, সেটা বাগান পেরিয়ে রাস্তার ওপর চলে এসেছে।

    ভবতোষ বললেন, এই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তুমি আবার এলে কেন?

    বিনু ভয়ে ভয়ে বলল, দাদু পাঠিয়ে দিলেন।

    শব্দ করে অদ্ভুত হাসলেন ভবতোষ, কাকাবাবুর ভয়, আমি বুঝি আত্মহত্যা করব। তা বোধহয় করব না। আচ্ছা, এসেছ যখন, ওঠ–

    বিনু গাড়িতে উঠল।

    তারপর চমকপ্রদ ব্যাপারটা ঘটল। পথে যত বাড়ি পড়ল সব জায়গায় গাড়ি থামিয়ে জড়িত ভাঙা গলায় স্ত্রীর চলে যাবার কথা বলতে লাগলেন ভবতোষ। মানুষের বেদনা প্রকাশের রূপ কী বিচিত্র!

    সারা রাজদিয়ায় ঘুরে ভবতোষ যখন তার বাড়ি ফিরলেন তখন অনেক রাত। বাকি রাতটুকু কেউ আর ঘুমলো না। বিনুকে সামনে বসিয়ে সামনে স্ত্রীর কথা বলে যেতে লাগলেন ভবতোষ। সমস্ত শুনে বিনু যা বুঝল, সংক্ষেপে এইরকম।

    বিয়ের আগেই ঝিনুকের মায়ের সঙ্গে একজনের ভালবাসা ছিল। তা সত্ত্বেও তার বাপ-মা একরকম জোর করেই ভবতোষের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়েছেন। এ বিয়ে মেনে নিতে পারেন নি ঝিনুকের মা, সংসারে নিয়ত ঝগড়াঝাটি, অশান্তি লেগেই ছিল। পরিণামে একদিন তিনি বাপের বাড়ি ফিরে গেলেন। আজ সকালে খবর এসেছে, ভালবাসার সেই লোকটির সঙ্গে তিনি চলে গেছেন।

    সমস্ত রাত ভবতোষের কাছে কাটিয়ে সকালবেলা বাড়ি ফিরল বিনু। ফিরেই দেখল, একা একা বসে ঝিনুক কাঁদছে।

    থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বিনু। ঝিনুককে দেখতে দেখতে মমতায় তার মন ভরে যেতে লাগল। অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে ঝিনুকের পাশে গিয়ে বসল সে। খুব কোমল গলায় বলল, কেঁদো না ঝিনুক, কেঁদো না–

    দু’হাতে মুখ ঢেকে ঝিনুক ফেঁপাতে লাগল, আমার মা চলে গেছে।

    বিনু বলল, আমার কথা একবার ভাবো তো, আমারও মা নেই।

    মুখ থেকে হাত সরিয়ে জলভরা গভীর চোখে বিনুর দিকে তাকাল ঝিনুক।

    .

    ২.৪৯

    সুধা সুনীতি ফেরানো যাক, টার টানে সবাই

    আরও একটা বছর ঘুরে গেল। এর মধ্যে বিনু ম্যাট্রিক পাস করে রাজদিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। ঝিনুক ক্লাস নাইনে পড়ছে।

    সুরমার মৃত্যুর পর অনেক দিন এই বাড়ির ওপর দিয়ে উদাস হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। তখন বিনুর মনে হত, পৃথিবীর আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি বুঝি চিরদিনের জন্য থেমে গেছে। মনে হত, চোখের সামনের দৃশ্যময় জগতের কোথাও উজ্জ্বল রং নেই। সব দীপ্তিহীন, ধূসর হয়ে গেছে।

    ধীরে ধীরে দুঃখের তীব্রতা কমে এসেছে। শোকটা এখন আর অনুভূতিতে নেই, স্মৃতি হয়ে গেছে।

    সুধা নেই, সুনীতি নেই, সুরমা মৃত। একদিন এই বড়িটা ঘিরে সব সময় যেন উৎসব লেগে থাকত। হিরণ আসত, আনন্দ আসত, রুমা ঝুমারা আসত। জাপানি বোমার ভয়ে যারা দেশে পালিয়ে এসেছিল, তারা আসত। গান-বাজনা-নাটক এবং হুল্লোড়ে বাড়িটা গমগম করত।

    ভরা কোটালের পর প্রবল ভাটার টানে সবাই অদৃশ্য হয়ে গেছে। বাড়িটা আজকাল আশ্চর্য নিঝুম।

    যেদিকেই চোখ ফেরানো যাক, শুধুই শূন্যতা।

    সুধা সুনীতি সেই যে কলকাতায় চলে গিয়েছিল, তারপর আর রাজদিয়ায় আসে নি। মাঝে মাঝে এক আধখানা-চিঠি লিখে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখছে শুধু।

    সুধা সুনীতির কথা থাক, নতুন সংসার পেয়ে তারা বিভোর হয়ে আছে। এখান থেকে যাবার পর ঝুমাটা খুব চিঠি লিখত বিনুকে সপ্তাহে দু’টো করে। কবে থেকে চিঠি আসা কমতে কমতে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে, বিনু লক্ষ করেনি।

    সময়টা জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি। বাগামৈর আমগাছগুলো কবেই নিঃস্ব হয়ে গেছে, ডালে ডালে পাতা ছাড়া আর কিছুই নেই। কালোজাম, গোলাপজাম, রোয়াইল আর লটকা–ফলের গাছগুলোরও এক অবস্থা। শুধু আষাঢ়ে আমগাছগুলো সারা গায়ে কিছু কিছু ফল সাজিয়ে রেখেছে। তবে বেতঝোঁপের দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়, হালকা বাদামী রঙের গোল গোল থোকা থোকা বেতফলে ঝোঁপগুলো ছেয়ে আছে।

    গরম শেষ হয়ে এল। এর মধ্যেই আকাশ জুড়ে কালো কালো ভবঘুরে মেঘেরা হানা দিতে শুরু করেছে। কদিন আর? আষাঢ় মাস পড়লেই মেঘের টুকরোগুলো ঘন হয়ে, জমাট বেঁধে, চরাচর ছেয়ে ফেলবে। তারপর শুরু হবে বর্ষা। আকাশ থেকে লক্ষ কোটি বৃষ্টির ধারা সারাদিন ধরে, সারারাত ধরে শুধু নামতেই থাকবে।

    চৈত্র বৈশাখে যে মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে, নতুন বর্ষা তাদের জুড়িয়ে দেবে। তপ্ত, তৃষিত বসুন্ধরা স্নিগ্ধ সরস হতে থাকবে। চারদিকে বর্ষা তার সজল ছায়া ফেলতে শুরু করেছে।

    .

    একদিন দুপুরে অবনীমোহন কোথায় যেন গিয়েছিলেন। সন্ধেবেলা ফিরে এসে হেমনাথকে বললেন, মামাবাবু একটা কথা বলছিলাম–

    হেমনাথ আর বিনু পুবের ঘরে বসে ছিল। স্নেহলতা এইমাত্র এ ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন।

    জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন হেমনাথ, কী কথা অবনী?

    বিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবনীমোহন বললেন, আমি আসাম যাব।

    হঠাৎ আসাম! হেমনাথ অবাক।

    হেমনাথ বলতে লাগলেন, ক’দিনের মধ্যে বৃষ্টি নেমে যাবে। জমিতে হাল-লাঙল নামাতে হবে। এ সময় তুমি আসাম যেতে চাইছ?

    আজ্ঞে হ্যাঁ, মানে–

    কী?

    এ বছর আমি চাষ করব না।

    তবে জমির কী হবে?

    ভাবছি বর্গাদারদের কাছে ভাগচাষে দিয়ে দেব।

    কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর হেমানথ বললেন, আসাম থেকে ফিরছ কবে?

    কিছু ঠিক নেই।

    ওখানে যাবার কী কারণ ঘটল, বুঝতে পারছি না তো!

    আমি একটা কনট্রাক্ট পেয়েছি।

    কিসের কনট্রাক্ট?

    মিলিটারির।

    মিলিটারির?

    হ্যাঁ—

    কই, আমাকে আগে কিছু বলনি তো—

    আজই পেলাম, আগে বলব কী করে? অবনীমোহন হাসলেন।

    হেমনাথ বললেন, কনট্রাক্ট তো নিয়েছ। আসামে গিয়ে কী করতে হবে?

    মিলিটারিদের জন্যে রাস্তাঘাট আর পাহাড়ের ওপর ব্যারাক, ট্যারাক তৈরি করতে হবে।

    তোমার ওসব কাজের অভিজ্ঞতা আছে?

    বিন্দুমাত্র না।

    তা হলে?

    করতে করতেই অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে।

    হেমনাথ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকলেন।

    অবনীমোহন বলতে লাগলেন, রাজদিয়ায় আসবার আগে চাষবাদের কিছু কি জানতাম? করতে করতেই শিখে গেলাম।

    হেমনাথ এবারও কী উত্তর দেবেন, ভেবে পেলেন না।

    অবনীমোহনের দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল বিনু। বাবাকে সে চেনে। তার মধ্যে কোথায় যেন একটা চঞ্চল যাযাবরের বাস, দুটো দিনও সেটা তাকে স্থির থাকতে দেয় না, নিয়ত ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়।

    যৌবনের শুরু থেকে কত কী-ই তো করছেন অবনীমোহন। অধ্যাপনা-ব্যবসা-চাকরি–একটা ধরেছেন, আরেকটা ছেড়েছেন। নির্ভর করার মতো কিছু হাতে পেলে মানুষ সেটা ঘিরেই জীবনকে সাজিয়ে তোলে। অবনীমোহনের স্বভাব আলাদা। অনিশ্চয়তার ভেতর ছুটে বেড়ানোতেই তার যত আনন্দ।

    এই প্রৌঢ় বয়সে বসুন্ধরার এক কোণে অনেকখানি ভূমি পেয়েছেন তিনি, চারদিক শস্যে-স্বর্ণে পরিপুর্ণ। কোথায় পা পেতে বসে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন, তা নয়। রক্তের ভেতরে সেই যাবারটা তাকে চঞ্চল করে তুলেছে।

    তিন চার বছরের মতো রাজদিয়া তাকে মুগ্ধ, সম্মোহিত করে রেখেছিল। জল-বাংলার এই সরস শ্যামল জায়গাটার আর সাধ্য নেই অবনীমোহনকে ধরে রাখে। তার সম্মোহনের শক্তি ব্যর্থ হয়ে যেতে শুরু করেছে।

    দিনকয়েক পর অবনীমোহন আসাম চলে গেলেন।

    .

    অবনীমোহন চলে যাবার পর সময় যেন ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগল। যুদ্ধের প্রথম দিকে দুর্ধর্ষ জার্মান বাহিনী সমস্ত পৃথিবীকে পায়ের নিচে নামিয়ে এনেছিল। এখন তারা পিছু হটছে। দিকে দিকে শোনা যাচ্ছে মিত্রশক্তির জয়ধ্বনি।

    একদিন খরর এল, লাল ফৌজ বার্লিনে ঢুকে পড়েছে এবং জার্মানি আত্মসমর্পণ করেছে। পূর্ব গোলার্ধে এখনও আসর জমজমাট। হঠাৎ আরেক দিন খবর এল, হিরোসিমা নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা পড়েছে। এবং এই দুটি বোমাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ওপর যবনিকা টেনে দিল।

    অবনীমোহন সেই যে খবরের কাগজ আনার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, এখনও তা চলছে। তিন মাস পর পর হেমনাথ টাকা পাঠিয়ে দেন, ডাকে খবরের কাগজ চলে আসে।

    একদিন বিনু দেখল, প্রথম পাতা জুড়ে বড় বড় অক্ষরে খবর বেরিয়েছে? বিশ্বযুদ্ধের অবসান :

    মিত্রপক্ষের নিকট জাপানের আত্মসমপর্ণ ও জাপ সম্রাটের ঘোষণা।

    পটাসডাম ঘোষণার সমস্ত শর্ত স্বীকার। মিকাডো কর্তৃক পারমাণবিক বোমার ধ্বংসলীলার কথা উল্লেখ।

    প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ও মিস্টার এটলির বিবৃতি। প্রশান্ত মহাসাগরীয় মিত্রপক্ষ বাহিনীর প্রতি যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ।

    নিউইয়র্ক, ১৫ই আগষ্ট-সম্রাট হিরোহিতো অদ্য বেতারে সরাসরি জাপ জাতির উদ্দেশে এই বক্তৃতায় বলেন যে, পটাসডাম চরমপত্র গ্রহণ করা হইয়াছে। জাতির উদ্দেশে সম্রাটের সরাসরি বক্তৃতা এই প্রথম।

    একধারে ছোট হরফে আরেকটা খবর রয়েছে।

    পরাজিত জাপানের প্রতি মিত্রপক্ষের প্রথম আদেশ জারি। জেনারেল ম্যাক আর্থারের প্রতি দূত প্রেরণের নির্দেশ। সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি মিত্রবাহিনী কর্তৃক দখলের আয়োজন।

    তার তলায় আরেকটা খবর।

    জাপানি সমর সচিবের আত্মহত্যা। যুদ্ধে পরাজয়ের জের।

    লন্ডন, ১৫ই আগষ্ট–জাপানি নিউজ এজেন্সির খবরে প্রকাশ যে, জাপানের সমর সচিব কোরেচিকা আনামি গতরাত্রে তার সরকারি বাসভবনে আত্মহত্যা করেছেন।

    কোথায় গ্রেট ব্রিটেন, কোথায় আমেরিকা, কোথায় নরওয়ে, কোথায়ই বা ফ্রান্স আর রাশিয়া। মিত্রবাহিনী জেতার ফলে সে সব জায়গায় নাকি উৎসবের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধজয়ের ঢেউ অখ্যাত নগণ্য রাজদিয়াতেও এসে পড়ল।

    মিলিটরি ব্যারাকগুলো আলোর মালা দিয়ে সাজানো হয়েছে। রঙিন কাগজ দিয়ে বড় বড় তোরণ তৈরি করা হয়েছে। সেগুলো থেকে লাল-নীল কাগজের ঠোঙায় অসংখ্য লণ্ঠন ঝুলছে। আর উড়ছে পতাকা–মিত্রশক্তির সবগুলো দেশের পতাকা রাজদিয়ার আকাশে সগর্বে মাথা তুলে আছে।

    যুদ্ধজয়ের আনন্দে সারাদিনই ব্যারাকগুলোতে হুল্লোড় চলছে। নাচ গান আর অবিরাম জ্যাজ বাজনার শব্দে রাজদিয়ার স্নায়ু বুঝি ছিঁড়েই পড়বে। নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-মানিকগঞ্জ থেকে কত যুবতী মেয়ে যে আনা হয়েছে তার লেখাজোখা নেই। তা ছাড়া, মদের ঢল বয়ে যাচ্ছে। মিলিটারি ব্যারাকের একটি প্রাণীও এখন সুস্থ বা স্বাভাবিক নেই। দিবারাত্রি নেশার ঘোরে আচ্ছন্ন।

    মাসখানেক প্রমত্ত উৎসব চলল। তারপর একদিন রাজদিয়াবাসীরা দেখতে পেল, ধূসর রঙের সেই বড় স্টিমারটা এসে জেটিঘাটে ভিড়েছে। বিশাল জলপোকার মতো এই স্টিমারে করেই নিগ্রো আর আমেরিকান টমিরা রাজদিয়ায় এসেছিল। তাদের লরি-ট্রাক-কামান-বন্দুক গোলাগুলি এবং অসংখ্য সাজ সরঞ্জাম এসেছিল।

    যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। রাজদিয়াবাসীরা এবার দেখল, জিপ-ট্রাকের চাকাটাকা খুলে এবং বড় বড় লোহার পেটিতে অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই করে স্টিমারে তোলা হচ্ছে। একদল টমিও স্টিমারে উঠল।

    সকালের দিকে স্টিমারটা এসেছিল, বিকেলে চলে গেল।

    এরপর থেকে একদিন পর পর সকালবেলা স্টিমারটা রাজদিয়ায় আসতে লাগল। এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম আর একদল করে টমি নিয়ে চলে যেতে লাগল। দশ দিনের ভেতর চারদিক ফাঁকা হয়ে গেল। যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অতিকায় প্রাণীর কঙ্কালের মতো রাজদিয়া জুড়ে পড়ে থাকল কতকগুলো শূন্য ব্যারাক এবং লম্বা পিচের রাস্তা।

    যুদ্ধের মাঝামাঝি দু’তিনটে বছর রাজদিয়ার জীবন খুব চড়া তারে বাজছিল, আবার পুরনো স্তিমিত ঢিমে তালের দিনযাপনের মধ্যে ফিরে গেল সেটা।

    .

    ২.৫০

    যুদ্ধের শেষ দিকে বিস্ময়কর একটা খবর এসেছিল–সুভাষচন্দ্রের খবর।

    বিনুর মনে পড়ে, তারা রাজদিয়া আসার কিছুদিন পর সুভাষচন্দ্র কলকাতার বাড়িতে অন্তরীণ হয়ে ছিলেন। সেই অবস্থাতেই একদিন তাকে পাওয়া গেল না। সমস্ত দেশ স্তম্ভিত বিস্ময়ে শুনল, ইংরেজদের সতর্ক বিনিদ্র পাহারার মধ্যে দিয়ে তার রহস্যময় অন্তর্ধান হয়েছে। কিভাবে, কোথায়, কোন দুর্গম দেশে তিনি অদৃশ্য হয়েছেন, কেউ জানতেও পারল না। সারা দেশের কাছে সুভাষচন্দ্র এক চমকপ্রদ লিজেন্ডের নায়ক হয়ে থাকলেন।

    তার ক’বছর পর যুদ্ধের যখন শেষ অঙ্ক, শেষ দৃশ্য, সেই সময় উত্তর-পুর্ব সীমান্তের ওপার থেকে টুকরো টুকরো যেসব খবর আসতে লাগল তাতে শৃঙ্খলিত দেশের হৃৎপিন্ড বিপুল আশায় দুলতে লাগল।

    রূপকথার চাইতেও সে এক অবিশ্বাস্য ইতিহাস। কলকাতা থেকে অন্তর্হিত হয়ে প্রথমে আফগানিস্তান, সেখান থেকে বার্লিন, তারপর টোকিও গেলেন সুভাষচন্দ্র। পদানত দেশ তাঁকে যেন অস্থির উন্মাদ করে তুলেছে।

    বীর নায়ক রাসবিহারী তখন আজাদ হিন্দ সঙঘ সৃষ্টি করেছেন। সুভাষচন্দ্র তাতে প্রাণসঞ্চার করে নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। আজাদ হিন্দ সঙঘ হল আজাদ হিন্দ ফৌজ। ইতিহাসের সে এক পরম শুভক্ষণ। একই পতাকাতলে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রান্ত এসে হাত মেলাল। সুভাষচন্দ্র সেদিন থেকেই নেতাজী।

    তারপর শুরু হল শৃঙ্খলমুক্তির অভিযান। জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে ঊর্ধ্বশ্বাসে একাগ্র চিত্তে সে এক দুরূহ ব্রতপালন। দেখতে দেখতে সিঙ্গাপুরে জাতীয় পতাকা উড়ল। তারপর বর্মা পেরিয়ে ইম্ফল পেছনে ফেলে ঝড়ের গতিতে কোহিমা পর্যন্ত চলে এল আজাদ হিন্দ ফৌজ।

    ওই কোহিমা পর্যন্তই। এদিকে জাপানের তখন করুণ অবস্থা। রসদ নেই, খাদ্য নেই। ফলে সুভাষচন্দ্রের বড় সাধের দিল্লি চল’ স্বপ্ন হয়েই রইল।

    আজাদ হিন্দ ফৌজের মরণপণ অভিযান পরাভূত, বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ‘জীবন-মৃত্যু’কে যাঁরা তুচ্ছ করেছিলেন সেই ভয়লেশহীন বীর সন্তানেরা বন্দি হয়ে একে একে দিল্লির লালকেল্লায় কারারুদ্ধ হয়েছেন। ধীলন শাহনওয়াজ সায়গল–পরাধীন জাতির ইতিহাসে নামগুলো সোনার অক্ষরে লিখে রাখবার মতো।

    বিনুর মনে আছে, দিনকয়েক আগে খবরের কাগজে পড়েছিল, আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযুক্ত সেনানীদের বিচারের জন্য সামরিক ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে এবং বন্দিরা আপিল করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

    ট্রাইবুনাল গঠনের পর তিন সপ্তাহ বিচার স্থগিত ছিল। আজ লালকেল্লায় তার প্রহসন শুরু হবে। একরকম আনায়াসেই এই বিচারের রায় আগে থাকতে বলে দেওয়া যায়।

    সমস্ত দেশের প্রাণপুরুষ এই বীর সেনানায়কদের জন্য উদ্বেল হয়ে উঠেছে। আসমুদ্র হিমাচল বিশাল ভারতবর্ষের এমন কেউ নেই, মনে মনে লালকেল্লার সেই মানুষ ক’টির পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি। সামরিক ট্রাইবুনালের সমানে বীর সন্তানদের মুক্তির জন্য সওয়াল করতে ছুটে গেছেন ভুলাভাই দেশাই। দীর্ঘ দু’যুগ পর ব্যারিস্টার বেশে জহরলাল আজ ভুলাভাইর পাশে গিয়ে দাঁড়াবেন।

    কোথায় কলকাতা, কোথায় বোম্বাই, কোথায় দিল্লি সমস্ত ভারতবর্ষ আজ অস্থির, উদ্বেলিত। বিচারের আগের মুহূর্তে দেশের আত্মা যেন বজ্রকণ্ঠে দাবি জানাচ্ছে, স্বাধীনতার সৈনিকদের সসম্মানে মুক্তি চাই।

    দূর সমুদ্রকল্লোল এই রাজদিয়ায় এসেও ধাক্কা দিল। বিনুরা কলেজে স্ট্রাইক করল। দশটা প্রাইমারি স্কুল, ছেলেদের হাইস্কুল এবং মেয়েদের হাইস্কুলেও স্ট্রাইক হয়ে গেল। তারপর ছাত্রছাত্রীরা ত্রিবর্ণ পতাকা হাতে নিয়ে মিছিল বার করল। সারা শহর ঘুরতে ঘুরতে তারা স্লোগান দিতে লাগল।

    আজদ হিন্দ ফৌজের বীর সৈনিকদের–

    মুক্তি চাই, মুক্তি চাই।

    জয় হিন্দ–

    বন্দে মাতরম—

    নেতাজীকি—

    জয়।

    ভারত মাতাকি—

    জয়।

    শাহনওয়াজ-ধীলন-সায়গলকি—

    জয়।

    একে একে এল রসিদ আলি ডে, বোম্বাইতে নৌবিদ্রোহ। সারা দেশ ঝড়ের দোলায় দুলতে লাগল।

    আজাদ হিন্দ সৈনিকদের মুক্তির জন্য আন্দোলন, নৌবিদ্রোহ, রসিদ আলি ডে–বিদ্যুৎচমকের মতো দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।

    .

    এদিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে গ্রেট ব্রিটেনের শ্রমিক সরকার ঘোষণা করলেন, একটি ক্যাবিনেট মিশন এদেশে পাঠাবেন। উদ্দেশ্য, কিভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায় তার সূত্র উদ্ভাবন করা।

    উনিশ শ’ ছেচল্লিশের তেইশে মার্চ ক্যাবিনেট মিশন ভারতে এসে পৌঁছল। দলে তিনজন সদস্য লর্ড পেথিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং মিস্টার এ. ভি. আলেকজান্ডার।

    ক্যাবিনেট মিশন ভারতবর্ষে এসেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের সঙ্গে আলোচনা শুরু করল।

    লাহোর প্রস্তাবের পর মুসলিম লিগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ভারতবর্ষের দেহ ছিন্ন করে একটি সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র গড়তেই হবে। লিগ নেতাদের ভয়, দেশ, স্বাধীন হলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা থাকবে না, হিন্দু রাজ’ তাদের ধ্বংস করে দেবে।

    কিন্তু ক্যাবিনেট মিশনের সদ্যসরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন, দেশগে তাঁদের বিন্দুমাত্র সায় নেই। তখন মোটামুটি স্থির হয়, সংখ্যলঘুদের নিরাপত্তা এবং সুশাসনের জন্য ফেডারেল গমেন্ট তৈরি করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে-প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্ব। এ, বি এবং সি–দেশকে তিনটি অংশে ভাগ করে যত বেশি বিষয়ে সম্ভব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে।

    বি বিভাগে থাকবে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং ব্রিটিশ বেলুচিস্তান। এই অংশটিতে নিরঙ্কুশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা। সি’ বিভাগে থাকবে বাংলা ও আসাম। এখানেও মুসলমানরা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন হাতে পেলে মুসলমানদের সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা অদ্ভুত থাকার কথা নয়। তবে জাতীয় ঐক্যের দিকে দৃষ্টি রাখতেই হবে।

    মুসলিম লিগ শেষ পর্যন্ত এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। কংগ্রেসেরও এতে আপত্তি ছিল না। সফলকাম ক্যাবিনেট মিশন দেশে ফিরে গেল।

    ক্যাবিনেট মিশন চলে যাবার পর কদিন আর। আবার পুরনো সংশয়, ঘৃণা এবং পারস্পরিক বিদ্বেষে আকাশ বিষাক্ত হয়ে উঠল। মুসলিম লিগ সিদ্ধান্ত নিল কনস্টিটিউয়েন্ট আসেমব্লিতে যোগ দেবে না বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করবে না। জিন্না ছেচল্লিশের ষোলই আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ডাক দিলেন।

    ছেচল্লিশের ষোলই আগস্ট ইতিহাসের এক অন্ধকার দিন। সারা দেশ জুড়ে আত্মঘাতী দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। কোথায় কলকাতা, কোথায় বিহার, কোথায় নোয়াখালি-সমস্ত ভারতবর্ষ রক্তের সমুদ্র হয়ে দুলতে লাগল। কে বলবে মাত্র কদিন আগে নৌ-বিদ্রোহ ঘটে গেছে, কে বলবে রসিদ আলি ডে কিংবা আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সোনানীদের মুক্তির জন্য জাঙ্খির্মনির্বিশেষে মানুষ সেদিন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছিল।

    খবরের কাগজ খুললে এখন শুধু আগুন-হত্যা-ধর্ষণ। ভারতবর্ষ যেন এক দুঃস্বপ্নের ঘোরে বর্বর যুগের কোনও আদিম অন্ধকারে ফিরে গেছে।

    আসমুদ্র হিমাচল একখানা আগুনের চাকা যেন ঘুরে চলেছে। এই ছোট্ট রাজদিয়াতেও তার আঁচ এসে লাগল।

    মিলিটারি ব্যারাকে সাপ্লাই দেবার জন্য রজবালি শিকদার মন্তাজ মিঞার যে বাড়িটা ভাড়া নিয়ে গুদাম করেছিল, এখন সেটাই মুসলিম লিগের অফিস। তার থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলে হাইস্কুলের গা ঘেঁষে কংগ্রেসের অফিস।

    আজকাল রোজই হয় মুসলিম লিগ, না হয় কংগ্রেস রাজদিয়ায় মিটিং করছে। মিটিংয়ের পর দু’ দলই মিছিল বার করে।

    সবুজ পতাকা উড়িয়ে লিগের সমর্থকরা শ্লোগান দেয় :

    লড়কে লেঙ্গে—

    পাকিস্থান।

    কায়েদে আজম—

    জিন্দাবাদ।

    কংগ্রেসের মিটিংয়ে মোতাহার হোসেন সাহেব আবেগপূর্ণ ভাষায় বক্তৃতা দেন, আমরা হিন্দু মুসলমান যুগ যুগ ধরে পাশাপাশি বাস করছি। বাস করবও। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ দেশকে কোনও দিনই ভাগ করতে দেওয়া হবে না। এক বছর, দু’বছর, দশ হাজার বছর পরও এ দেশ একই থাকবে।

    সারা দেশ যখন অস্থির উন্মাদ, তখন মোতাহার সাহেবের কথা কার কানে ঢুকবে? দেশজোড়া উন্মত্তরা জল-বাংলার এই স্নিগ্ধ শ্যামল ভুবনেও একদিন রক্তের সমুদ্রকে টেনে নিয়ে এল।

    ঘটনাটা এইরকম।

    সেদিন হেমনাথের সঙ্গে সুজনগঞ্জের হাটে গিয়েছিল বিনু। নৌকো থেকে নেমে ওপরে উঠতেই তারা শুনতে পেল, বিষহরিতলার ওধারে বিশাল মাঠখানায় মিটিং চলছে। হাটের বেশির ভাগ লোক ওখানে ভিড় জমিয়েছে।

    কিছুটা আপন মনে হেমনাথ বললেন, আজকে আবার কিসের মিটিং?

    বিনু বলল, কী জানি–

    বেগুন ব্যাপারি গয়জদ্দি পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল, হেমনাথ ডাকলেন। গয়জদ্দি দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, কী ক’ন হামকত্তা?

    অমন দৌড়চ্ছিস কেন?

    মিটিনে যাই—

    কিসের মিটিং রে?

    ঢাকা থনে বড় মাইনষেরা আইছে, তেনারা কী হগল কইব। যাই–বলে আর দাঁড়াল না গয়জদ্দি, আবার ছুটল।

    একটু চুপ করে থেকে হেমনাথ বিনুকে বললেন, মিটিংয়ে যাবি নাকি দাদাভাই?

    চল। ঢাকার লোকেরা কী বলছে, শুনেই আসি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.