Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ৩.১১-১৫ সূর্য এখন সোজাসুজি

    ৩.১১

    সূর্য এখন সোজাসুজি মাথার ওপর উঠে এসেছে। হেমন্তের রোদ নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে ঝলকে যাচ্ছে।

    মাঝনদী দিয়ে একঘেয়ে আওয়াজ করতে করতে ছুটে চলেছে স্টিমার। দু’পাড় ধুধু। গাছপালা, গ্রাম, কিছুই স্পষ্ট নয়। মনে হয়, এপাড়ে ওপাড়ে দিগন্ত ঘেঁষে কেউ ধূসর রঙের মোটা লাইন টেনে রেখেছে। নদী জুড়ে অসংখ্য নৌকো। কোনওটায় বাদাম খাটানো, কোনওটায় পাল নেই, মাঝিরাই বৈঠা টেনে চলেছে। যে নৌকোগুলো স্টিমারের কাছাকাছি, উত্তাল ঢেউয়ে সেগুলো মোচার খোলার মতো ওঠানামা করছে।

    তখন খাওয়ার পর ঝিনুককে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিল বিনু। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে অলস দৃষ্টিতে চারপাশের দৃশ্য দেখল ঝিনুক। তারপর বলল, আমি একটু ঘুমবো। বলেই শুয়ে পড়ল।

    যখন তখন ঘুমোতে পারে না বিনু। বিশেষ করে দিবানিদ্রার অভ্যাস নেই তার।

    অনেকক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকার পর দৃষ্টিটাকে ডেকে ফিরিয়ে আনল বিনু। থোকায় থোকায় চার পাঁচ ছয় সাতজনের এক একটা পরিবার গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে। সকলের সঙ্গেই কম বেশি লটবহর। বোঁচকা বুচকি, টিনের বাক্স, এসব তো আছেই। কেউ কেউ ফলন্ত লাউগাছ, নারকেল পাতার শলা দিয়ে তৈরি ঝটা, ছোবড়াসুদ্ধ নারকেল, পাকা সুপারির ছড়া, ডাটা শাক, মাটির পাতিল অর্থাৎ পার্থিব সম্পত্তি বলতে যেটুকু পেরেছে নিয়ে এসেছে।

    স্টিমারের একটানা দোলানিতে চারপাশের মানুষজন সমানে ঢুলছে। কেউ কেউ শুয়েও পড়েছে।

    হঠাৎ চাপা কান্নার পরিচিত শব্দ কানে ভেসে আসে বিনুর। এধারে ওধারে তাকাতে হরিদাস সাহাদের দেখতে পায় সে। তাদের ডান পাশে বসেছে হরিন্দরা, তারপর রামরতনরা, তাঁদের ঠিক পরেই হরিদাস এবং তার বউ ছেলেমেয়ে।

    তারপাশা স্টিমারঘাটে, নদীর কিনারে বসে বিনুরা যখন গোয়ালন্দের স্টিমারের জন্য অসীম উৎকণ্ঠায় অপেক্ষা করছে সেই সময় হরিদাস সাহার বৌকে কাঁদতে দেখেছিল। তেমনই মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, একই রকম ক্ষীণ শব্দ করে এখনও কাঁদছে। কোন এক নয়া চিকন্দি গ্রামে যুবতী মেয়েকে খুইয়ে এসেছে তারা। মা তো, বাকি জীবনটা কেঁদে কেঁদেই তার কেটে যাবে।

    শোকাতুর মহিলার জন্য পুরনো কষ্টটা ফের নতুন করে অনুভব করতে থাকে বিনু। কিছুক্ষণ বিষণ্ণ চোখে তাকে দেখার পর নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

    বাঁ ধারে কোনাকুনি, ডেকের রেলিং পর্যন্ত, যারা বসে বা শুয়ে আছে তাদের মধ্যে একজন অনেকক্ষণ বিনুকে লক্ষ করছিল। লোকটার বয়স পঞ্চাশ বাহান্ন। রোগা, হাড় বার করা চেহারা। লম্বা শীর্ণ মুখে কয়েকদিনের কঁচাপাকা দাড়ি, পাটের ফেঁসোর মতো চুল, চোখা থুতনি, চোখ গর্তে বসা। কণ্ঠমণি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। পরনে খাটো ময়লা ধুতি আর ফতুয়া। লোকটার বাঁ পায়ে উরুর মাঝামাঝি থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত পুরনো কাপড় ছিঁড়ে পুরু করে ব্যান্ডেজ বাঁধা।

    বিনুর সঙ্গে আলাপ করার খুব ইচ্ছা লোকটার। কিন্তু তার কাছে আসবে কি আসবে না, ঠিক করতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত দ্বিধা কাটিয়ে পা টেনে টেনে উঠে এল। হাতজোড় করে বিনীতভাবে বল, পন্নাম হই বাবুমশয়।

    চমকে নদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিনু বলল, নমস্কার—

    আমার নাম অধর ভুইমালী। লোকটা বলতে লাগল, আপনার কাছে ইট্র বসুম?

    হ্যাঁ হ্যাঁ, বসুন না–

    অধর একটু দূরে বাঁ পা’টা ছড়িয়ে বেশ কষ্ট করে বসল। চাপা গলায় বলল, আপনের লগে দুই একখান কথা আছে।

    একটা অচেনা লোক আচমকা উঠে এসে কী বলতে চায় তাকে? বেশ অবাকই হল বিনু।

    অধর ভুঁইমালী বলল, আমাগো চৈদ্দ পুরুষের ভিটা আছিল তালসোনাপুরে। নাম শুনছেন নি জাগাখানের (জায়গাটার)?

    বিনু বলে, নামটা তার জানা। তবে সেখানে কখনও তার যাওয়া হয়নি।

    অধর গলা আরও নামিয়ে এবার বলল, আমাগো উইদিকে জবর খুনাখুনি হইছে। দ্যাশে আর থাকন গ্যাল না। বাড়িঘর ছাইড়া কইলকাতায় যাইতে আছি।

    এসব নতুন কিছু নয়। এই স্টিমারে যারা যাচ্ছে, কিংবা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে আরও অসংখ্য মানুষ যারা যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছে, তাদের সবারই দেশ ছাড়ার ওই একটাই কারণ।

    এদিকে কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক নেই, রাজদিয়ায় অধর সাহার কথা মনে পড়ে গেল বিনুর। যে কিনা বেঁচে থাকতেই নিজের দানসাগর শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করে রেখেছে। হয়তো দু’জনের নামের মিলের জন্যই এই মনে পড়া। অধর সাহা অবশ্য দেশেই আছে। ইন্ডিয়ায় যাবার কথা ভাবে নি।

    অধর তার বাঁ পায়ের প্রকান্ড ব্যান্ডেজ দেখিয়ে বলল, এই দ্যাখেন, সড়কি ফেইকা (ছুঁড়ে) পাও এ-ফোড় ও-ফোড় কইরা ফেলাইছিল। এইর পর ঘেটি থেইকা মাথা লামাইয়া দিত। ভিটায় পইড়া থাকতে আর ভরসা হইল না।

    বোঝা যাচ্ছে, লোকটার বক্তব্য অন্য। সেটা শুরু করার আগে ভণিতা করে নিচ্ছে। বিনু চুপ করে থাকে।

    অধর আর অযথা প্যাচাল না পেড়ে আসল কথায় চলে এল। রামরতনকে দেখিয়ে বলল, আপনের সুমখে তারপাশার হেই মিঞাসাব ওনারে কইতে আছিল, অবোস্তা ইট্টু শান্ত হইলে দ্যাশের ভিটামাটি ব্যাচন (বিক্রি করা) যাইব।

    বিনু বুঝতে পারে, নাসের আলির কথা বলছে অধর। হ্যাঁ, তার সামনেই নাসের সাহেব রামরতনকে এরকম ভরসা দিয়েছিলেন।

    বিনু উত্তর দেবার আগেই অধর ফের বলে ওঠে, আপনেরে মনে লয়, পণ্ডিত মানুষ। আবার রামরতনকে দেখিয়ে বলল, মিঞাসাব পথে উনাগো দেখাশুনার ভার আপনেরে দিয়া গ্যাছে। আপনে যে সে মানুষ না।

    দেখা যাচ্ছে, বিনুর ওপর আগাগোড়া লক্ষ্য রেখে গেছে অধর। হয়তো স্টিমারঘাটে বসে থাকার সময় থেকেই। যেহেতু নাসের আলির মতো একজন বয়স্ক, শিক্ষিত ভদ্রলোক তাকে রামরতনদের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন, অধরের চোখে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।

    আগের কথার খেই ধরে অধর বলল, আপনের কী মনে লয়, পাকিস্থানে আর কি সুদিন ফিরা আসব? কাটাকাটি খুনাখুনি কি থামব?

    বিনুও জানে না, এখানে যেভাবে ভয় আতঙ্ক আর মত্ততা ছড়িয়ে আছে, সেসব কাটিয়ে আদৌ সুস্থিতি ফিরে আসবে কিনা। এখন যা পরিস্থিতি, কবে যে সব কিছু স্বাভাবিক হবে, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস আর ঘৃণা ঘুচে যাবে, সে সম্বন্ধে পরিষ্কার কোনও ধারণা নেই তার। হয়তো অধর ভুঁইমালীর মনে উৎসাহ জাগাবার জন্য বিনু বলল, এমন অবস্থা তো চিরকাল চলতে পারে না। বলেছে ঠিকই, নিজের কানেই কথাগুলো বেখাপ্পা শোনাল তার।

    অধরের ভাঙাচোরা মুখ আলো হয়ে ওঠে। কেউ তার আশাকে জিইয়ে রাখুক, এটাই খুব সম্ভব সে চায়। বলল, ঠিকই কইছেন বাবুমশয়। ইন্ডিয়ায় গিয়াও বডারের এই পারে তাকাইয়া থাকুম। যদ্দিন শ্বাস তদ্দিন আশ। একটু থেমে বলল, বাপ ঠাউরদার জমিজেরাত হগলই তো দ্যাশে পইড়া রইল।

    বিনু জিজ্ঞেস করল, দিনকাল ভাল হলে জমি বাড়ি বেচতে আসবেন; রেজিস্ট্রির সময় দলিলপত্র কিন্তু লাগবে।

    অধর বলল, হেয়া (তা) জানি।

    রামরতনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিনু বলল, উনি ওঁদের দলিল টলিল নাসের সাহেবের কাছে রেখে যাচ্ছেন। আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাসী কারোর হাতে দিয়ে এসেছেন?

    অধর অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। এধারে ওধারে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আরও কাছে ঘন হয়ে বসল। বলল, দলিলগুলার পাকা ব্যবস্তা করছি। হারাইব না, নষ্টও হইব না।

    অধর ভুঁইমালী লেখাপড়া জানে বলে মনে হয় না। নিরক্ষরই হবে। তবে বেশ চালাক চতুর। তার বিষয়বুদ্ধিও প্রখর। বিনু আর কোনও প্রশ্ন করল না।

    অধর বলল, বাবুমশয়, গোয়ালন্দে গিয়া একলগে রেলগাড়িতে চাইপা (চেপে) কইলকাতায় যামু কিলাম–

    রামরতন, হরিন্দদের মতো এই লোকটাও কলকাতা পর্যন্ত গায়ের সঙ্গে জুড়ে থাকবে। কিন্তু কী আর করা যাবে। বিনু বলল, ঠিক আছে, যাবেন।

    এই পেরথম কইলকাতায় যাইতে আছি। শুনছি জবর শহর, কুনখানে আগা কুনখানে শ্যাষ, দিশা পাওন যায় না। আপনের লাখান (মতো) একজন বিদ্বান মানুষ লগে থাকলে ভরসা পাওন যায়। আইচ্ছা, অহন উঠি। পরে আবার আসুম।

    অধর ভুঁইমালী চলে গেল।

    বেলা হেলে গেছে। সূর্যটা গড়াতে গড়াতে পশ্চিম দিকে অনেকখানি নেমে গিয়ে থমকে আছে। রোদে এখন গলানো গিনির রং। উত্তর দিকে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে কয়েক টুকরো মেঘ। হেমন্তের মেঘ বর্ষায় না, নীলাকাশের শোভা খানিক বাড়িয়ে দেয়।

    স্টিমারের একঘেয়ে গজরানি শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। মাথা ঝিম ঝিম। নদীতে সেই একই দৃশ্য। একমাল্লাই, দু’মাল্লাই, চারমাল্লাই, বাদামহীন বা পাল-খাটানো নৌকোর মেলা। যতক্ষণ না তারা গোয়ালন্দ পৌঁছচ্ছে, এর হেরফের হবে না।

    ওধার থেকে স্টিমারের দোলানিতে টলতে টলতে রামরতন উঠে এসে বিনুর পাশে বসে পড়লেন। বললেন, শুইয়া আছিলাম, কিন্তু ঘুম আসে নাই। মাথায় বড় দুশ্চিন্তা। তাই চইলা আসলাম।

    ঝিনুক অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। চেনাজানা মানুষজনের মধ্যে হরিন্দরাও শুয়ে আছে। অধর ভূঁইমালী অবশ্য নিজে থেকে এসে আলাপ পরিচয় করে গেছে। তাও বেশ খানিকক্ষণ হল। চুপচাপ, একটানা নদী আকাশ নৌকা দেখতে দেখতে ক্লান্তি বোধ করছিল বিনু। রামরতনকে দেখে বলল, ভাল করেছেন এসে–

    রামরতন বললেন, তোমার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানি না। কোনখানে বাড়ি আছিল?

    খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিনুর ব্যাপারে সব জেনে নিলেন রামরতন। এমনকি কলকাতায় গিয়ে সে কোথায় উঠবে, তা-ও। তবে ঝিনুক সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করলেন না। অন্য সবার মতো তিনিও ধরে নিয়েছেন, ঝিনুক তার স্ত্রী।

    রামরতন বললেন, কইলকাতায় তোমার বাবা আছেন, বইনেরা আছে। তোমার চিন্তা নাই। বিনু বলল, আপনারও তো ভাইপো আছে।

    তা আছে। বিমল পোলা হিসাবে চমৎকার। আমারে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। ওর মা-বাপ মারা গেছিল অল্প বয়েসে। আমিই ওরে মানুষ করছি। সগলই ঠিক। কিন্তুক কইলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থাকে। নিজের সংসার, বউ, পোলা-মাইয়া আছে। তার উপুর আমরা এতজন গিয়া যদি তার কান্ধে চাপি, কী কইরা যে চালাইব! চিন্তাকুল মুখে রামরতন বলতে লাগলেন, দ্যাশ থিকা শ’ চাইরেক টাকা, কিছু জামাকাপড়, বাসনকোসন ছাড়া আর কিছুই লগে আনতে পারি নাই। যথাসর্বস্ব ফেলাইয়া যাইতে আছি। কী যে করুম, ভাইবা কুল পাই না।

    কী উত্তর দেবে, ঠিক করে উঠতে পারে না বিনু। এই যে স্টিমার বোঝাই মানুষ সীমান্তের ওপারে চলেছে, কিংবা আরও হাজার হাজার দেশ ছাড়ার জন্য পা বাড়িয়ে আছে, তাদের সবারই তো অবিকল এক সমস্যা।

    রামরতন একই সুরে বলতে থাকেন, আমার আর আমার স্ত্রীর তিন কাল গেছে। কিন্তুক তিন মাইয়া তো এখনও অনেক দিন বাচব। একটা বিধবা, দুইটার বিয়া দিতে পারি নাই। কী যে ওগো (ওদের) ভবিষ্যৎ, জানি না। ওগো চিন্তায় মইরাও আমি শান্তি পামু না।

    খোলা নদীতে হেমন্তের অফুরান আলো, অপর্যাপ্ত বাতাস, তবু আবহাওয়া কেমন যেন ভারী আর স্নান মনে হয় বিনুর। অস্পষ্টভাবে সে কিছু একটা উত্তর দেয়, নিজের কাছেই তা পরিষ্কার নয়।

    রামরতন বলেন, গত আষাঢ় মাসে তিয়াত্তর বৎসরে পড়ছি। শরীরে শক্তি নাই, উৎসাহ নাই। তবে এম. এ’র ডিগ্রিখান আছে। শুনছি, ইস্ট পাকিস্তান থিকা উৎখাত হইয়া যারা ওই পারে যাইতে আছে, ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট গো চাকরি বাকরির ব্যবস্থা কইরা দিতে আছে। আমি কি একটা কিছু কাজকর্ম পামু না?

    বিনুর মনে হল, তাকে সামনে বসিয়ে রামরতন যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন, নিজেকেই। প্রশ্ন করছেন। তাকে ভরসা দেবার জন্য সে বলে, নিশ্চয়ই পাবেন। পণ্ডিত মানুষ আপনি, এত বছরের পড়ানোর অভিজ্ঞতা। আপনার মতো একজনকে পাওয়া তো যে কোনও স্কুলের পক্ষে ভাগ্যের কথা।

    কিন্তু আমার এই বয়সে কি স্কুলে নিব?

    নেওয়া তো উচিত।

    সংশয়ের সুরে রামরতন বলেন, কী জানি! ভবিষ্যতের চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েন।

    একটু চুপচাপ।

    তারপর রামরতন হঠাৎ গলার স্বর উঁচুতে তুলে আবার বলে ওঠেন, যুবক বয়সে একটা মহা ভুল কইরা ফেলাইছিলাম। অখন সেই কথা ভাইবা অনুশোচনার শ্যাষ নাই–

    ঠিক কী বলতে চান রামরতন, ধরতে না পেরে তার দিকে তাকিয়ে থাকে বিনু।

    রামরতন থামেননি, এম. এ পাস করার পর সিদ্ধান্ত নিছিলাম, নেশান বিল্ডিংয়ের কামে লাগুম। গ্রামে গিয়া জ্ঞানের আলো বিতরণ করুম। আইডিয়ালিয়াজিমের দানব কান্ধে চাপছিল। স্বপ্ন দেখতাম, আমার হাত দিয়া হাজার হাজার ছাত্র বাইর হইব। তারা দ্যাশরে নানান দিক দিয়া আগাইয়া নিয়া যাইব। কত বড় বড় চাকরির অফার আইছিল কইলকাতা থিকা। তখন যদি চইলা যাইতাম, শ্যাষ জীবনে এই দুর্গতি হইত না।

    তাঁর আক্ষেপের কারণ এবার স্পষ্ট হয়ে যায়। আস্তে মাথা নাড়ে বিনু।

    রামরতন অদ্ভুত এক ঝোঁকে একটানা বলে যান, কী নেশান বিল্ড করছি একবার ভাবো। জমিজমা ভিটামাটি ছাইড়া মাথার উপুর দুই আনম্যারেড যুবতী মাইয়া আর এক বিধবা মাইয়া লইয়া চইলা যাইতে আছি। শিক্ষাব্রতী হইয়া কী লাভটা হইল? স্বার্থপর হওয়া উচিত ছিল আমার, সেলফ-সেন্টারড হওয়া উচিত ছিল, নিজের বুঝ বুইঝা নেওয়া উচিত ছিল। বৃদ্ধ বয়েসে পথের ভিখারি হইয়া গেলাম।

    রামরতনের কথা শেষ হতে না হতেই আচমকা স্টিমারের ইঞ্জিন থেকে বিকট ঘড় ঘড় আওয়াজ আসতে লাগল। দু’পাশের চাকাগুলো এখন আর আগের মতো জোরে জোরে ঘুরছে না। বিশাল জলযানের গতি কমে আসছে। সেটা মাঝনদী থেকে ক্রমশ ডান ধারে পাড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

    দোতলার ডেক জুড়ে যারা ঢুলছিল বা ঘুমিয়ে ছিল, তারা ধড়মড় করে উঠে বসে। বিনুরা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে একতলা এবং তেতলার ডেকের অনেকটা অংশ চোখে পড়ে। ওই দুই ডেকের যাত্রীদের একই অবস্থা। সবাইকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।

    নানা দিক থেকে শোরগোল ভেসে আসছিল।

    কী হইল? কী হইল?

    ইস্টিমার কিনারে যায় ক্যান? সিধা মইদ্য গাঙ দিয়া যাওনের কথা–

    কে একজন বলে ওঠে, শুনছি আইজকাইল গোয়ালন্দের দিকে অনেক কালের পুরানা ঝইরা ইস্টিমার দিতে আছে। কিছুদূর গিয়া হেইগুলান থাইমা যায়, সারাইয়া সুরাইয়া আবার কিছু সোময় চলে। এইভাবে গোয়ালন্দে পৌছায়–

    আরেক জন বলল, দ্যাশ ছাইড়া যারা যাইতে আছে তাগো উপুর মায়া দয়া নাই।

    ইস্টিমার কিনারে নিয়া যাইতে আছে ক্যান, বুঝি না—

    রামরতন আর বিনু সবার কথা শুনতে পাচ্ছিল। চিন্তাগ্রস্তের মতো রামরতন বললেন, আমাগো যা অদৃষ্ট, সহজে কিছু হওনের উপায় নাই। কী হইছে, খবর নিয়া আসতে পার?

    সবাই জেগে গেলেও ঝিনুকের ঘুম ভাঙেনি। রামরতনকে তার পাশে বসে থাকতে বলে বিনু উঠে পড়ল।

    যাত্রীদের জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাওয়া যাবে না। তারা জানেই বা কী? খুঁজে খুঁজে একতলায় গিয়ে সারেঙকে ধরল বিনু। লোকটা ভদ্র। মোটামুটি স্বীকার করে নিল, স্টিমারটা মান্ধাতার আমলের। ইঞ্জিনে গোলযোগ দেখা দিয়েছে। তবে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। মেরামত করে দু’চার ঘন্টার ভেতর ছেড়ে দেওয়া হবে। তীরের কাছে নিয়ে যাবার কারণ এইভাবে ব্যাখ্যা করলেন। কলকজার ব্যাপার ততা, সারাই করতে যদি দেরি হয়ে যায় অসুবিধা দেখা দেবে। স্টিমারে রসদ ফুরিয়ে এসেছে; পাড়ের কাছে থাকলে গ্রাম থেকে যোগাড় করে আনা যাবে।

    বিনু ফিরে এসে রামরতনকে সব জানিয়ে দেয়।

    রামরতন উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, দ্যাশ ছাইড়া যারা যাইতে আছে, শুনছি নদীতে তাগো উপর হামলা হয়।

    বিনু নিজেই যে ভুক্তভোগী, সেটা আর জানালো না।

    রামরতন আবার বললেন, স্টিমারে তেমন কিছু হইছে বইলা শুনি নাই। নদীর কিনারের কাছে অনেকক্ষণ খাড়ইয়া থাকলে কী হইব জানি না।

    অর্থাৎ পাড়ের কাছাকাছি স্টিমার কয়েক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলে, হানাদারদের চড়াও হবার সম্ভাবনা আছে। এমনই আশঙ্কা রামরতনের। দেশের যা অবস্থা তাতে বৃদ্ধের মনোবল বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। সবসময় তিনি উতলা হয়ে থাকেন।

    বিনু বলল, আমরা এত লোক রয়েছি। মনে হয়, তেমন কিছু হবে না।

    রামরতন বললেন, না হইলেই মঙ্গল।

    স্টিমার নদীর পাড় থেকে তিনশ’ সাড়ে তিনশ’ হাত দূরে থেমে গেল। দু’ধারের চাকা এখন ঘুরছে না। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড়ানি বন্ধ হয়ে গেছে।

    রামরতন এবার বললেন, আর বইসা থাকতে পারতে আছি না। যাই, কিছুক্ষণ শুইয়া থাকি গিয়া–

    বিনু রামরতনের হাত ধরে তাঁর স্ত্রী এবং মেয়েদের কাছে পৌঁছে দিয়ে এল।

    .

    ৩.১২

    সন্ধের পর খালাসিরা তিনটে ডেকে টিমটিমে আলো জ্বেলে দিয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল ইঞ্জিন মেরামতির কাজ। ঠুকঠাক, খটখট, ঘটাং ঘটাংকত রকমের যে আওয়াজ।

    তারই মধ্যে একসময় চিড়ে গুড় খেয়ে শুয়ে পড়েছিল বিনু আর ঝিনুক। সারা শরীর জুড়ে ক্লান্তি ছড়িয়ে ছিল। শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে বিনু। তারা যখন শোয়, স্টিমারের যাত্রীদের অনেকেই জেগে বসে ছিল।

    কার ডাকাডাকিতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে বিনু দেখতে পায়, সাদা থান পরা কেউ একজন কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। ডেকের নিস্তেজ আলোয় প্রথমটা চিনতে পারল না সে। জিজ্ঞেস করল, কে?

    মেয়েটি বলল, আমি বাসন্তী। বাবার শরীর খারাপ হইছে। মা আপনেরে ডাইকা নিয়া যাইতে কইল। তার গলায় গভীর উৎকণ্ঠা।

    এবার চেনা গেল। রামরতনের সেই মাঝবয়সী বিধবা মেয়ে। হাতের ভর দিয়ে দ্রুত উঠে পড়ে বিনু।

    ঝিনুক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। তিনটে ডেকের একজন যাত্রীও জেগে আছে বলে মনে হল।

    স্টিমার জল তোলপাড় করে এখন ছুটে চলেছে। বিনু যখন ঘুমোচ্ছিল সেই সময় ইঞ্জিন সারাই হয়ে কখন সেটা চলতে শুরু করেছে, টের পাওয়া যায়নি। নদী, আকাশ, দুই তীর, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। গাঢ় কুয়াশায় এবং অন্ধকারে সব ঢেকে আছে। এখন কত রাত, কে জানে।

    বিনু গিয়ে দেখল, বুক দু’হাতে খামচে ধরে ছটফট করছেন রামরতন। তার গলা থেকে ক্ষীণ, কাতর শব্দ বেরিয়ে আসছে। তাকে ঘিরে বসে আছে তার স্ত্রী এবং দুই অবিবাহিত তরুণী মেয়ে। কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কেউ হাত-পা টিপছে। সবাই ভীষণ দিশেহারা। কিভাবে শুশ্রূষা করলে রামরতনের কষ্ট লাঘব হবে, তারা ভেবে পাচ্ছিল না।

    বিনু জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ওঁর?

    রামরতনের স্ত্রী বললেন, বুঝতে পারতে আছি না। ঘুমাইয়া আছিল। খানিকক্ষণ আগে আতখা (হঠাৎ) চিৎকার কইরা আমাগো ডাইকা তুলল। কইল ভীষণ বেদনা। কয় আর ছটফট করে। আমরা ডরাইয়া গেলাম। এত রাইতে কী করুম, দিশা করতে না পাইরা বড় মাইয়ারে তোমার কাছে পাঠাইছি।

    ভাল করেছেন। কিন্তু বিকেলেও তো উনি সুস্থ ছিলেন। আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন।

    হ। তোমার লগে কথা কইয়া আইসা সন্ধ্যা তরি (পর্যন্ত) শুইয়া আছিল। হেরপর উইঠা খাইল। খাইয়া আবার শুইল। তহনও তো ভালই আছিল–

    রামরতনের পাশে বসে পড়ল বিনু। ডাকতে লাগল স্যার, স্যার—

    প্রথমটা সাড়া পাওয়া গেল না। বেশ কয়েক বার ডাকার পর চোখ আধাআধি মেললেন রামরতন।

    বিনু অনেকখানি ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল, কী কষ্ট হচ্ছে?

    রামরতন নিজের বুক থেকে হাত সরাননি। আগের চেয়েও জোরে খামচে ধরেছেন। তার নখ জামার ওপর দিয়ে চামড়ার মাংসে গেঁথে যাচ্ছে। গোঙানির মতো শব্দ করে কোনও রকমে বোঝালেন, ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।

    রামরতনের স্ত্রী বললেন, যদি ডাক্তার পাওনা যাইত–

    বিনুও ঠিক তা-ই ভাবছিল। কিন্তু যে ছিন্নমূল মানুষের দল সর্বস্ব খুইয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের জন্য স্টিমারে ডাক্তার থাকবে, সেটা নেহাতই দুরাশা। তবু একটা বৃদ্ধ মানুষ চোখের সামনে এত ক্লেশ ভোগ করবেন, আর সে চুপচাপ বসে থাকবে, তা হতে পারে না।

    বিনু উঠে পড়ল। বলল, দেখি কী করা যায়

    সারেঙ লোকটাকে ভাল লেগেছিল বিনুর। তার সঙ্গে কিন্তু এবার দেখা করা গেল না। তিনি ইঞ্জিন ঘরে রয়েছেন। দু’জন খালাসিকে অবশ্য পাওয়া গেল। যা ভাবা গিয়েছিল তাই। খালাসিরা জানায়, স্টিমারে ডাক্তার নেই।

    হতাশ বিনু ফিরে আসে। রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েরা উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিল। সে তাদের বলল, না, পাওয়া গেল না।

    বিহ্বলের মতো রামরতনের স্ত্রী বললেন, অখন তা হইলে কী করা? ওষুধ বিষুধ না পড়লে– বলতে বলতে থেমে গেলেন।

    বিনু উত্তর দিল না। রামরতনের যন্ত্রণার উৎস যে বুকে সেটা আগেই জানা গিয়েছিল, কিন্তু কারণটা অজানা। এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত, সে প্রথমটা ভেবে পাচ্ছিল না। তারপর মরিয়া হয়ে রামরতনের হাত সরিয়ে জামার ভেতর নিজের হাত ঢুকিয়ে বুকটা ডলতে থাকে। কার কাছে। সে যেন শুনেছিল, অতিরিক্ত মানসিক চাপে এবং উৎকণ্ঠায় নাকি এরকম বুকের ব্যথা হয়।

    বেশ কিছুক্ষণ ডলার পর রামরতনের ছটফটানি কমে আসে। এখন তিনি অনেকটা শান্ত। কাতরানিও বন্ধ। চোখ বুজে গেছে। বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনে হচ্ছে, কষ্টের উপশম হয়েছে।

    বুকে মালিশ করাটা ঠিক হয়েছে কিনা, সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সংশয় আছে বিনুর। রামরতনের ক্ষতি হল কিনা, বোঝা যাচ্ছে না।

    তারপাশায় ঝিনুকের জ্বর হয়েছিল। ডাক্তার পাওয়া যায়নি। তবে ওষুধের দোকানে গিয়ে বলতে যে ওষুধ দিয়েছিল তাতে কাজ হয়েছে। যাদের ওষুধের কারবার তাদের প্রচুর অভিজ্ঞতা। কোন রোগে কী ওষুধ খেতে হয়, মোটামুটি ওরা জানে। রামরতনের যন্ত্রণাটা যদি তারপাশায় হত, লক্ষণ জানিয়ে ওষুধ নিয়ে আসা যেত।

    বিনু জিজ্ঞেস করে, এরকম কষ্ট কি স্যারের আগেও হয়েছে?

    রামরতনের স্ত্রী বললেন, না।

    আমি এখন যাই। আবার যদি যন্ত্রণা হয়, আমাকে ডাকবেন।

    ডাকুম।

    বিনু নিজের জায়গায় ফিরে এসে ফের শুয়ে পড়ে।

    কুয়াশা আর অন্ধকার যেভাবে নদীর ওপর জমাট বেঁধে আছে, রাত ফুরোতে এখনও অনেক দেরি।

    .

    ৩.১৩

    বেশ কিছুক্ষণ ধরে অস্পষ্ট সোরগোল কানে আসছিল। ঘুমের ঘোরে মনে হচ্ছিল, বহু দূরের অলীক কোনও শব্দ। স্বপ্নে যেমন শোনা যায়। কিন্তু আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছে। বেড়েই চলেছে।

    ঘুমটা হঠাৎ ছিঁড়ে খুঁড়ে গেল বিনুর। রাতের আঁধার আর নেই। আকাশ যেখানে নদীর সঙ্গে দিগন্তে একাকার হয়ে আছে, রক্তবর্ণ সূর্য সেখান থেকে উঠে আসছে। কুয়াশা কেটে যাচ্ছে দ্রুত। আলোয় ভরে যাচ্ছে চরাচর।

    হাতের ভর দিয়ে উঠে বসল বিনু। যে হইচইটা ঘুমের ভেতর আবছাভাবে শুনেছিল, স্টিমারের তিনটে ডেক জুড়ে সেটা চলছে। যেদিকে তাকানো যায়, তুমুল ব্যস্ততা। সবাই তাদের পোঁটলা পুঁটলি ডালাকুলো বাক্সবিছানা গুছিয়ে নিচ্ছে।

    স্টিমার গজরাতে গজরাতে জল কেটে চলেছে। ইঞ্জিনের ধকধকানিও শোনা যাচ্ছে।

    হরিন্দর গলা কানে এল, ছুটোবাবু, বৌঠাইনরে জাগান। গোয়ালন্দ আইসা গেল। উই দ্যাখেন– পাড়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল সে।

    দূরে, নদীর কোনাকুনি স্টিমারঘাট দেখা যাচ্ছে। এত চাঞ্চল্য এবং শোরগোলের কারণ এতক্ষণে বোঝা গেল। স্টিমার থেকে নেমেই ট্রেন ধরতে হবে। তারই প্রস্তুতি চলছে।

    ঝিনুকের ঘুম ভাঙেনি। বিনু তাকে জাগিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি কল-ঘরে নিয়ে গেল। তাদের লটবহর নেই বললেই হয়। দু’টো মোটে চাদর। দুজনে মুখটুখ ধুয়ে ফিরে এসে চাদর ভাঁজ করে নিল। হরিরা শোবার জন্য সেই সুজনিটা দিয়েছিল। সেটা ফেরত দিতে গিয়ে রামরতনদের দিকে বিনুর চোখ চলে যায়। অসুস্থ মাস্টারমশাইয়ের খোঁজ নেওয়া দরকার। তা ছাড়া, ওঁদের মালপত্র গোছগাছ। করে দিতে হবে। অশক্ত, অপটু বৃদ্ধের পক্ষে সব কিছু সামলে নামানো সম্ভব নয়। তার স্ত্রীকে বিনু যেটুকু দেখেছে, মনে হয়েছে বৃদ্ধার স্বাস্থ্য খুব নড়বড়ে। বাকি রইল তিন মেয়ে। লটবহর টানাহ্যাঁচড়া করে ভিড় ঠেলে স্টিমারঘাটে নামানো, তারপর ধাক্কাধাক্কি করে ট্রেনে ওঠা–এ সব কি মেয়েদের কাজ? যা করার বিকেই করতে হবে। এই অসহায় পরিবারটার ওপর কেমন এক দায়িত্ববোধ এসে গেছে তার। তা ছাড়া, কাল রাতে বুক মালিশ করে দেবার পর রামরতন কেমন আছেন সে সম্বন্ধে যথেষ্ট উৎকণ্ঠাও রয়েছে।

    বিনু রামরতনদের কাছে চলে আসে। সকাল হলেও রামরতন এখনও শুয়ে আছেন। চোখ বোজা, খুব সম্ভব ঘুমোচ্ছেন। তার স্ত্রী এবং মেয়েরা বৃদ্ধকে ঘিরে বসে আছে। মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছে, সারা রাত ওরা ঘুমোয়নি।

    বিনু বলে, কাল রাতে আপনাদের এখান থেকে যাবার পর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই খবর নিতে পারিনি। স্যারের বুকের কষ্টটা আর হয়নি তো?

    রামরতনের বিধবা মেয়ে অর্থাৎ বাসন্তী বলল, না।

    দুর্ভাবনা কাটে বিনুর। জিজ্ঞেস করে, সেই থেকেই ঘুমোচ্ছন?

    হ।

    এবার ওঁকে জাগাতে হবে। গোয়ালন্দ এসে গেছে।

    বাসন্তী বেশ কয়েক বার ডাকার পর চোখ মেলে তাকালেন রামরতন। আস্তে আস্তে উঠে বসে শিয়রের কাছে রাখা নিকেল ফ্রেমের চশমাটা পরে নিলেন।

    বিন জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন লাগছে স্যার?

    রামরতন বললেন, কাইল রাইতের থিকা অনেক ভাল। তবে বুকের বেদনাটা পুরাপুরি যায় নাই।

    আরও কিছুক্ষণ ঘুমোতে পারলে বাকি কষ্টটুকু থাকত না। কিন্তু তার উপায় নাই। আমাদের নামার সময় হয়েছে। তাই আপনাকে জাগাতে হল।

    গোয়ালন্দ আইসা গেল নিকি?

    হ্যাঁ। স্টিমার থেকে নেমে খোঁজ করে দেখব, যদি ডাক্তার পাওয়া যায়—

    রামরতন বললেন, অখন আর দরকার নাই। একেবারে কইলকাতায় গিয়া চিকিৎসা করামু–

    বিনু বলল, আপনি বিছানা থেকে নেমে বসুন। মালপত্র গোছাতে হবে–

    হ হ, ঠিকই। আমার আর আমার স্ত্রীর বয়স হইছে। শরীরে শক্তি নাই। মাইয়ারাও এই সব পারব না। রামরতন বলতে লাগলেন, তোমার লগে দেখা না হইলে কী বিপদে যে পড়তাম!

    কিন্তু উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথা টলে গেল রামরতনের। মুখ থুবড়ে হুড়মুড় করে পড়েই যেতেন, বিনু আর বাসন্তী ধরাধরি করে বিছানা থেকে নামিয়ে ডেকের পাটাতনে তাকে বসিয়ে দিল। বোঝাই যাচ্ছে, কাল রাতের ধাক্কাটা সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে পারেননি বৃদ্ধ। সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে উঠতে তাঁর সময় লাগবে।

    বিনু জিজ্ঞেস করল, শরীরটা আবার কি খুব খারাপ লাগছে?

    মাথাটা এলিয়ে পড়েছিল রামরতনের। চোখের পাতা বুজে গেছে। ক্ষীণ স্বরে বললেন, খাড়ইতে গিয়া মাথা ঘুইরা গেল। চাইর দিক অন্ধকার।

    কিছুক্ষণ শুয়ে নেবেন স্যার?

    না না, অখন শুইলে স্টিমারঘাটায় নাইমা আইজ আর ট্রেন ধরতে পারুম না। তুমি গোছগাছ কইরা ফেলাও। বাসন্তী আমারে ধইরা থাকুক।

    শুধু বাসন্তীই নয়, রামরতনের অন্য দুই মেয়েও তাঁকে তিন দিক থেকে ধরে থাকে। বুড়ো মানুষটি ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলে নতুন বিপদ।

    বিনু হরিন্দকে ডেকে দু’জনে ক্ষিপ্র হাতে বাঁধাছাঁদা শেষ করে ফেলে। ততক্ষণে স্টিমার গোয়ালন্দের জেটিঘাটে পৌঁছে গেছে।

    তারপাশায় স্টিমারে ওঠার জন্য যেমন মরণপণ গুতোর্থতি ধাক্কাধাক্কি আর খিস্তিখেউড় চলেছিল, এখানেও গ্যাংওয়ে দিয়ে নামার জন্য সেই একই দৃশ্য। সবার ধারণা, আগে নামতে পারলে কলকাতার ট্রেনে আগে উঠতে পারবে।

    অধর ভূঁইমালী আর হরিন্দর প্রচুর লটবহর, তাছাড়া বউ ছেলেমেয়ে। তবু বিনুর ডাকে তারা সাড়া দিল। নিজেদের মালপত্রের সঙ্গে রামরতনদের বাক্স বিছানা টিছানা কাঁধে এবং মাথায় তুলে বৃদ্ধকে ধরাধরি করে স্টিমার থেকে নামিয়ে আনল।

    একটা ব্যাপারে বিনু কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত। ঝিনুকের সেই আতঙ্কগ্রস্ত ভাবটা অনেকখানিই কেটে গেছে। গোয়ালন্দে পৌঁছবার পর তার হয়তো ধারণা হয়েছে, এবার নির্বিঘ্নে কলকাতায় চলে যেতে পারবে। তা ছাড়া, আন্দাজে ওষুধ দিলেও তার জ্বর ছেড়ে গিয়েছিল, নতুন করে সেটা আর আসেনি।

    জেটিঘাটের বাইরে খানিকটা গেলে বিশাল ফাঁকা জায়গা। তার একধারে টিনের চালের সারি সারি হোটেল, নানা ধরনের দোকানপাট। একটু দূরে রেল লাইন। সেখানে কলকাতার ট্রেনের চিহ্নমাত্র নেই।

    ফাঁকা জায়গাটায় আগে থেকে অগুনতি ভিটেমাটি খোয়ানো মানুষ বসে আছে। তারপাশার স্টিমারঘাটে যেমনটা দেখা গিয়েছিল, অবিকল সেই দৃশ্য। কলকাতার ট্রেনের জন্য তারা অপেক্ষা করছে।

    বিনু শুনেছে, দিনে একটাই ট্রেন কলকাতায় যায়। এত লোক আগে থেকে জমা হয়েছে, তার ওপর তারা এসে সংখ্যাটা অনেক বাড়িয়ে দিল। আজ আদৌ ট্রেনে ওঠা যাবে কিনা, কে জানে।

    একসময় বিনুরা থিকথিকে ভিড়ের ভেতরে একটু জায়গা করে বসে পড়ে। মাটির ওপরেই দ্রুত বিছানা পেতে রামরতনকে শুইয়ে দেওয়া হল। উর্দি-পরা রেলের কিছু কর্মচারী এবং কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবলকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে।

    বিনুদের ডান পাশে রয়েছে রামরতনরা, তারপর হরিন্দ এবং অধর ভুঁইমালীর পরিবার।

    স্টিমারে রামরতনের যে উপসর্গ দেখা দিয়েছিল সেটা এখনও কাটেনি। চোখ বুজে, নিজীবের মতো তিনি শুয়ে আছেন। এই অসুস্থ বুড়ো মানুষটাকে কিভাবে ট্রেনে তোলা সম্ভব হবে, কিভাবেই বা ধকল সয়ে তিনি কলকাতায় পৌঁছতে পারবেন, কে জানে।

    অন্য যারা আগে থেকেই বসে ছিল তাদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ট্রেন কখন আসবে, এই নিয়ে তারা নানা মন্তব্য করছিল। একসঙ্গে বহু লোক কথা বললে যা হয়, সারা এলাকা জুড়ে ভনভনে গুঞ্জন চলছে।

    হেমন্তের বেলা অনেকটা চড়েছে। রোদের তেজও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তবে নদীর ওপর দিয়ে ঠাণ্ডা উত্তুরে হাওয়া ছুটে আসায় রোদের আঁচ তেমন গায়ে লাগে না। বেশ আরামদায়ক মনে হয়।

    এর আগে হেমনাথের সঙ্গে দু’চার বার গোয়ালন্দে এসেছে বিনু। এখানকার হোটেলগুলো তেমনই রয়েছে। মালিকরা কেউ ইন্ডিয়ায় চলে যায়নি। হাজারে হাজারে মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় তাদের ব্যবসা বরং ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

    পুরনো দিনের মতোই হোটেলের টাউটরা ভিড়ের ভেতর ঘোরাঘুরি করছে। খদ্দের টেনে নিয়ে যাবার কতরকম কসরত তাদের!

    এক দালাল তাদের হোটেলের অজস্র মহিমা কীর্তন করে জানায়, পাবদা মাছ, রুইত মাছ, বোয়াল মাছ, খাসির মাংস–যা চাইবেন হেয়াই (তাই) পাইবেন। প্যাটচুক্তি পাঁচ সিকা। আমাগো পাকা পাইখানাও আছে। অর্থাৎ সুখাদ্যের অতিরিক্ত ইট সিমেন্ট বাঁধানো পায়খানার আরামও পাওয়া যাবে। পেটে যত ভাত-মাছ-তরকারি আঁটে তার জন্য মূল্য মাত্র পাঁচ সিকে বা এক টাকা চার আনা।

    অন্য টাউটরাও একই সুরে বলে যায়। তাদের ব্যবস্থাও অতি উত্তম। কারোর হোটেলে পাওয়া যাবে শিলং মাছ,  বাঁচা মাছ, কারোর হোটেলে চিতলের পেটি, বড় গোলসা ট্যাংরা ও টাটকিনি মাছ। সেই সঙ্গে পাকা পায়খানার ব্যবস্থা তো আছেই।

    কেউ কেউ বলছে, টিরেনে (ট্রেনে ওঠনের আগে প্যাট ভইরা খাইয়া লন। এইর পর কবে ভাত পাইবেন ঠিক নাই।

    এই লোকগুলোর খদ্দের টানার কৌশল, কথা বলার চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হয়ে যায় বিনু। ভূ-ভারতে এমন করে কেউ লোক ভজাতে পারে কিনা, তার জানা নেই। দুশ্চিন্তার চাপ থাকা সত্ত্বেও সে বেশ মজাই পায়।

    যে মানুষগুলো ভিটেমাটি ফেলে প্রায় খালি হাতে দেশ ছাড়ছে তাদের বেশির ভাগেরই মাথাপিছু পাঁচ সিকে খরচ করে উৎকৃষ্ট আহার করার মতো শৌখিনতা নেই। যারা কিছু পয়সা নিয়ে আসতে পেরেছে তাদের কেউ কেউ অবশ্য টাউটদের সঙ্গে হোটেলে যাচ্ছে।

    অধর ভুইমালী বা হরিরা টাউটদের ফিরিয়ে দিল। হাতে যদি কিছু সম্বল থাকেও, ভালমন্দ খেয়ে উড়িয়ে দেবে না, দুর্দিনের জন্য রেখে দেবে। রামরতনের শরীরের যা হাল তাতে তার মেয়েরা বা স্ত্রী খেতে যাবেন না। বাসন্তীর অবশ্য হোটেলে খাওয়ার প্রশ্নই নেই। সে ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা, নিশ্চয়ই নিরামিষ খায়।

    পরিচিত মানুষগুলোকে ফেলে হোটেলে যাবার ইচ্ছে নেই বিনুর। তবু ঝিনুককে জিজ্ঞেস করল, ভাত খেয়ে নেবে?

    রামরতন হরিন্দদের দেখিয়ে ঝিনুক বলল, ওরা খাবে না। আমাদের খেতে যাওয়া কি উচিত হবে?

    বিনুও তা-ই ভেবেছে। বলল, তা হলে থাক। সঙ্গে যা চিড়ে মুড়ি আছে, একটা দিন ঠিক চলে যাবে। তারপর সবার যা হবে, আমাদেরও তাই হবে।

    তাদের ঠিক বাঁ পাশে রয়েছে জন ছয়েকের একটি পরিবার। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই একটা ঢ্যাঙা, রোগাটে চেহারার লোক পরিবারটির কর্তা। তার লম্বা মুখ, থ্যাবড়া থুতনি, চওড়া কপালের চামড়ায় জালি জালি কালচে দাগ, গর্তে বসা চোখ, চামড়া ঘেঁষে ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল। পরনে ফতুয়া আর খাটো ধুতি। গলায় তুলসীর মালা, হাতে রুপোর তাবিজ।

    লোকটা মাথা ঝুঁকিয়ে হাতজোড় করে বলল, পরণাম (প্রণাম)।

    বিনুকে দেখলে বড় ঘরের শিক্ষিত যুবক মনে হয়। অক্ষরপরিচয়হীন চাষাভূষো ধরনের গেঁয়ো লোকেরা তাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে কথা বলে।

    বিনু বলল, নমস্কার।

    লোকটা বলে, আমার নাম ভোবন দাস। কিছুক্ষণ আগে ইস্টিমার থিকা আপনাগো লাইমা আইতে দেখলাম। ভিটামাটি আছিল কোন গেরামে?

    ভোবন অর্থাৎ ভুবন দাস। বিনু বলল, রাজদিয়া। আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

    তাহেরগঞ্জ। ভুবন দাস নদীর ওপারে, বহুদূর দিগন্তের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে বলে, লৌহজং পার হইয়া চাল্লিশ মাইল গেলে আমাগো গেরাম। গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনেগো রাইজদার খবর কী? বড়সড় গণ্ডগোল হইছে নিকি?

    বিনু জানায়, রাজদিয়াতে তেমন কিছু ঘটেনি, তবে সেখানকার আবহাওয়া খুবই উত্তপ্ত।

    ভুবন দাস বলল, আমাগো উই দিকেও কিছু হয় নাই। জিগাইতে পারেন, তয় (তবে) দ্যাশ ছাইড়া যাইতে আছি ক্যান? তরাসে–তরাসে। গেরামের মেলা (বহু) মানুষ গ্যাছে গিয়া। কার ভরসায় থাকুম? একটু থেমে বলল, আইজ কিছু হয় নাই। কাইল যে হইব না, ক্যাঠা (কে) কইব?

    বিনু অন্যমনস্কর মতো ভাবল, এত মানুষ যে পালিয়ে যাচ্ছে তার বড় কারণ সর্বগ্রাসী ভয়। তাদের সাহস আর আত্মবিশ্বাসের ভিত ধসে পড়েছে। বলল, গ্রাম থেকে কবে এখানে এসেছেন?

    পরশু বিকালে।

    এখনও ট্রেন ধরতে পারেননি?

    ভুবন হাসল, পারলে কি বউ পোলাপান লইয়া খুলা জাগায় (জায়গায়) পইড়া থাকি? পরশু একখান টেরেন দিছিল। মাইনষের গুতাগুতিতে উঠতে পারি নাই। কাইল গাড়ি দ্যায় নাই। আইজ দিব কিনা, ভগমান জানে–

    স্টিমারের মতো ট্রেনও তা হলে অনিশ্চিত। নিয়মিত কলকাতায় যাতায়াত করছে না। কিন্তু কী আর করা যাবে? অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।

    ভুবন বলল, একখান কথা জিগাই—

    কী?

    ইণ্ডিয়ায় তো আগে কুনোকালে যাই নাই। শুনতে আছি সোনার দ্যাশ। এইপার থিকা যারা যাইতে আছে হেগো (তাদের) নিকি মেলা জমিন আর ট্যাকাপয়সা দিতে আছে?

    বিনু এ সম্বন্ধে স্পষ্ট কিছুই জানে না। তবে এপারের মানুষজনের অনেকেরই ধারণা, উদ্বাস্তু হয়ে যারা সীমান্তের ওপারে যাচ্ছে তাদের প্রচুর সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সে বলল, কে বলল আপনাকে?

    ভুবন বলল, শুনাশুন কানে আইছে।

    আমার জানা নেই। আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে বিনু।

    আশায় ভুবনের চোখ চকচকে করে। সে বলে, অ্যাতখানি বয়স তরি চাষবাস ক্ষেতি উতি ছাড়া তো কিছু বুঝি নাই। জমিন পাইলে বাইচা যামু–

    বিনু আর বসল না। ট্রেনের ব্যাপারে শত চেষ্টা করেও নিজেকে নিস্পৃহ রাখা যাচ্ছে না। খোঁজখবর নেওয়া দরকার। ঝিনুককে বলল, তুমি একটু বসো, আমি আসছি।

    ঝিনুক জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ? তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। আসলে এক মুহূর্ত বিনুকে সে কাছছাড়া করতে চায় না।

    কোথায় যাচ্ছে, জানালো বিনু। তারপর দূরে যেখানে রেলের চার পাঁচজন কর্মচারী জটলা করছে, পায়ে পায়ে সেখানে চলে আসে। জিজ্ঞেস করে, আজ কি কলকাতার ট্রেন পাওয়া যাবে?

    একজন বয়স্ক কর্মচারী, মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি, বলল, পাওয়ার তো কথা। হেরপর (তারপর) বড় সাহেবগো মর্জি।

    একটি কম বয়সের কর্মচারীর এই সব জিজ্ঞাসাবাদ পছন্দ হচ্ছিল না। তার চোখ কুঁচকে গিয়েছিল। বিরক্ত, কর্কশ গলায় বলল, যহন আইব, দেখতেই পাইবেন। ভ্যাজর ভ্যাজর না কইরা বইসা থাকেন গিয়া–

    বয়স্ক কর্মচারীটি তার যুবক সহকর্মীকে ধমকে দিলেন, দ্যাশ ছাইড়া এনারা চইলা যাইতে আছে। ভালভাবে কথা ক’ সিরাজ। বিনুর দিকে ফিরে সহানুভূতির সুরে বলে, অর কথায় মনে কিছু কইরেন না। কাইল কইলকাতার ট্রেন দ্যায় নাই, আইজ নিচ্চয় দিব। মনে লয়, দ্যাড় দুই ঘণ্টার মইদ্যে লাইনে ট্রেন আইসা যাইব।

    যুবক কর্মচারীটির কথায় মন তিক্ত হয়ে গিয়েছিল বিনুর। এর উপযুক্ত জবাব দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, সেটা করতে গেলে আগুন ধরে যাবে। মুখ বুজে তাকে মেনে নিতে হল। তবে পরিবেশ যতই অগ্নিগর্ভ হোক, পৃথিবীতে ভাল মানুষ থাকেই। বয়স্ক কর্মচারীটি অনেক বিবেচক এবং বিচক্ষণ। তার সহৃদয় ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেল সে।

    ট্রেন সম্পর্কে যা জানার ছিল, জেনে নিয়েছে বিনু। সে ফিরে আসছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল, জনতিনেক সাদা চামড়ার সাহেব এবং দুই মেম কী যেন করছে। তাদের ঘিরে মোটামুটি একটা ভিড়।

    গোয়ালন্দের স্টিমারঘাটের বাইরে ভিটেমাটি ফেলে আসা উদ্বাস্তুদের ভেতর সাহেব-মেম দেখা যাবে, ভাবতে পারেনি বিনু। তার কৌতূহল হচ্ছিল। নিজের অজান্তেই ওদের দিকে এগিয়ে গেল।

    সাহেব-মেমদের বয়স খুব বেশি নয়। তিরিশের নিচেই হবে। পুরুষদের পরনে হাঁটুঝুল হাফপ্যান্ট, শার্ট এবং মোটা কটনের জ্যাকেট। মাথায় শোলার হ্যাঁট। মেমসাহেবরা পরেছে চাপা ট্রাউজার্স, ঢোলা শার্ট, মাথায় হেলানো ফেল্ট হ্যাঁট। সবারই পায়ে পুরু সোলের মজবুত জুতো। কারোর কারোর চোখে সানগ্লাস। এরা কোন দেশের মানুষ–ব্রিটিশ, ফ্রেঞ্চ না জার্মান–বোঝা যাচ্ছে না।

    দূর থেকে চোখে পড়ে নি, কাছে এসে দেখা গেল, এই দলটার একজন হাঁটু গেড়ে মুভি ক্যামেরা চালিয়ে উদ্বাস্তুদের ছবি তুলছে। অন্য একজন তাকে সাহায্য করছে। আগে কী একটা বইতে মুভি ক্যামেরার ছবি দেখেছে বিনু, এই প্রথম স্বচক্ষে দেখল।

    অন্য একটি সাহেব এবং দুই মেম টেপ রেকর্ডার নিয়ে উদ্বাস্তুদের প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চলেছে। তাদের বাড়ি কোন গ্রামে, কেন তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, কলকাতায় গিয়ে তারা কোথায় উঠবে, কী করবে, ইত্যাদি।

    উদ্বাস্তুরা ইংরেজি জানে না। সাহেব-মেমরা বাংলা বোঝে না, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক বাংলা তাদের কাছে একেবারেই দুর্বোধ্য। তাই সাহায্য করার জন্য তিনজন শিক্ষিত বাঙালি যুবককে সঙ্গে নিয়েছে। তারা দোভাষীর কাজ করছে। সাহেব-মেমদের প্রশ্নগুলো বাংলা করে উদ্বাস্তুদের জানিয়ে দিচ্ছে, আর উদ্বাস্তুদের জবাব ইংরেজি করে সাহেব-মেমদের বলছে। কিন্তু এই যুবকেরা ইংরেজি : বলায় তেমন সড়গড় নয়। মাঝে মাঝে গোলমাল করে ফেলছে।

    নানা জনের দেশছাড়ার কারণ টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখতে রাখতে এক বিদেশি তরুণী বিনুর সামনে চলে আসে। তার দলামোচড়া ময়লা পোশাক, উষ্কখুষ্ক চুল, চোখের তলায় কালির পোঁচ, ইত্যাদি দেখতে দেখতে বিদেশিনীর মনে হয়েছে সে-ও ছিন্নমূল জনতার একজন। অন্য অনেকের মতো তারও ধারণা, বিনু শিক্ষিত যুবক। মেয়েটি ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি ইংরেজি জানেন?

    মাথা সামান্য হেলিয়ে দেয় বিনু, জানি।

    অন্তত বিনুর ব্যাপারে যে ইন্টারপ্রেটারের সাহায্য নিতে হবে না, সরাসরি কথা বলা যাবে, এতে মেয়েটি যথেষ্ট স্বস্তিবোধ করে। বলে, আপনি নিশ্চয়ই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?

    উত্তর দেবার আগে আমার কিছু বলার আছে।

    হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন—

    আপনারা এই যে ছবি তুলছেন, লোকজনের কথা রেকর্ড করছেন–এসব কী জন্যে?

    তরুণীটি জানায়, তারা ব্রিটিশার। লণ্ডনের একটা বড় ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। এই কোম্পানি পূর্ণদৈর্ঘের ছবি করা ছাড়া ডকুমেন্টারি ছবিও করে থাকে। এই শতাব্দীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে, প্রাণহানি হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের। কিন্তু ভারতবর্ষের বিভাজন তার চেয়ে এতটুকু কম ভয়াবহ নয়। পৃথিবীর এই গোলার্ধে জাতি-দাঙ্গায় কত জনের মৃত্যু হয়েছে, সীমান্তের এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে কত লক্ষ মানুষ চলে গেছে, তার হিসেব নেই। এই শতকের এমন ব্যাপক হিউম্যান ট্র্যাজেডি’র প্রামাণ্য চিত্র ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা অত্যন্ত জরুরি।

    এই ইংরেজ তরুণ-তরুণীরা মানবিক দায়িত্ববোধে বিশাল কাজে হাত দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে আসার আগে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাবে গিয়েছিল দেশভাগের ঠিক পরে পরেই। পাঞ্জাবের সম্পূর্ণ জন-বিনিময়ের ছবি তারা যতটা পেরেছে তুলে রেখেছে। এই সেঞ্চুরিতে এমন টোটাল ট্রান্সফার অফ পপুলেশন আর কোনও দেশে হয়েছে কিনা, তাদের জানা নেই।

    কোথায়, কত হাজার মাইল দূরে, ভূমণ্ডলের দূর প্রান্তে এই তরুণ-তরুণীদের বাড়ি, আর কোথায় এই খণ্ডিত উপ-মহাদেশ! ভারত-ভাগের শোচনীয় ঐতিহাসিক ঘটনাকে চিরস্থায়ী করে রাখার জন্য তারা গোয়ালন্দের স্টিমারঘাটে ছুটে এসেছে, এ যেন ভাবা যায় না। অভিভূতের মতো তাকিয়ে থাকে বিনু।

    মেয়েটি বলে, এবার তা হলে পুরনো প্রশ্নটায় ফিরে যাওয়া যাক। ইস্ট পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন?

    বিনু বলল, হ্যাঁ।

    কেন যাচ্ছেন?

    যে যুবকেরা ইন্টারপ্রেটারের কাজ করছে তাদের সামনে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ঠিক সাহস হচ্ছিল না। যদি বিনু বলে, এখানে নির্ভয়ে থাকা যাচ্ছে না, ওরা হয়তো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। দ্বিধান্বিতভাবে সে বলল, এই—ঠিক–

    একটি দোভাষী যুবক বিনুকে বলল, যা সত্য তা-ই কন। আমরা কিছু মনে করুম না।

    ছেলেটিকে ভাল লাগল বিনুর। ইতিহাস অবিকৃত থাক, প্রকৃত সত্য যেন গোপন করা না হয়, এটাই হয়তো ওরা চাইছে। বিনু প্রায় মরিয়া হয়ে বলল, ভয়ে চলে যাচ্ছি

    মেয়েটি বলল, কলকাতায় কোথায় উঠবেন?

    বিনু জানায়, তার বাবা এবং দুই দিদি সেখানে আছে। বাবার কাছেই যাবে সে।

    তা হলে বর্ডারের ওপারে আপনার একটা শেলটার অন্তত আছে। অন্যদের মতো আপনার অবস্থা ততটা দুর্ভাগ্যজনক নয়।

    তা বলতে পারেন।

    সহযোগিতার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    বিনু আর দাঁড়াল না।

    .

    ৩.১৪

    রেলের বয়স্ক কর্মচারীটি ঠিক খবরই দিয়েছিল। ঘণ্টাদেড়েকের মধ্যে লাইনে ফাঁকা ট্রেন এসে দাঁড়াল।

    স্টিমারে ওঠা বা নামার সময় যা ঘটেছিল, ট্রেনের বেলাতেও তার হেরফের কিছু হল না। একই রকম ঠেলাঠেলি, একই রকম ধুন্ধুমার কাণ্ড।

    লটবহরের ঝঞ্জাট নেই। বিনু প্রায় ঝাড়া হাত-পা। ঝিনুকও ভয় ডর অনেকখানি কাটিয়ে ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তাকে ট্রেনের কামরায় ঠেলেঠুলে একবার তুলে দিতে পারলে আর চিন্তা নেই। বিনু যেভাবে হোক, ঠিক উঠে পড়তে পারবে।

    কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রামরতনকে নিয়ে। গোয়ালন্দে নামার পর সেই যে তিনি শুয়ে পড়েছিলেন আর উঠতে পারেননি। বুকের কষ্টটা ফের প্রচণ্ড বেড়ে গেছে। ওঁদের ফেলে যাওয়াও যাচ্ছে না। যা করার খুব তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। পাঁচ সাত মিনিট দেরি হলে ট্রেনে আর জায়গা পাওয়া যাবে না।

    অধর ভুঁইমালী, হরিন্দ আর ভুবন দাসকে ডেকে সমস্যার কথা বলতে তারা একেবারে ভেলকি দেখিয়ে ছাড়ল। হরিন্দ, বিনু আর ভুবন রামরতনকে কাঁধে তুলে ভিড়ের ভেতর দিয়ে প্রথমে সামনের একটা কামরায় নিয়ে শুইয়ে দিল। তারপর সবার লটবহর তো তুললই, বাচ্চাকাচ্চা এবং মেয়েদেরও তুলে ফেলল। অধর ভুঁইমালীও কম যায় না। পায়ে পুরু ব্যাণ্ডেজ। খোঁড়াতে খোঁড়াতে বিনুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে-ও বিস্তর টানাহ্যাঁচড়া করল।

    কামরার একটা দিক বিনুরা দখল করে ফেলেছে। তারা ওঠার আগেই কিছু লোক উঠে পড়েছিল। বাকিরা পরে ঋক বেঁধে উঠতে লাগল। চোখের পলকে মেঝে, বাঙ্ক, বেঞ্চ তো বটেই, দরজার সামনের প্যাসেজ বোঝাই হয়ে গেল। বাইরে এখনও অগুনতি মানুষ। যারা কামরাগুলোতে ঢুকতে পারেনি, তাদের অনেকেই বেয়ে বেয়ে ট্রেনের ছাদে উঠে পড়েছে।

    বাইরে তুমুল হট্টগোল। কামরার ভেতর দম-আটকানো ভিড়। বুকের যন্ত্রণাটা ক্রমশ তীব্র হচ্ছে রামরতনের। জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে তিনি সমানে বলতে লাগলেন, শ্বাস নিতে পারতে আছি না। বাতাস কর, বাতাস কর’

    কামরায় ফ্যান নেই, হাত-পাখাও কেউ সঙ্গে করে আনেনি। রামরতনের মেয়েরা, তার স্ত্রী এবং ঝিনুক শাড়ির আঁচল নেড়ে নেড়ে হাওয়া করতে লাগল।

    বাইরে রেলের সেই কর্মচারীদের দেখা গেল। বয়স্ক কর্মচারীটির হাতে একটা লম্বা মুলি বাঁশের লাঠি। কামরাগুলোর ছাদের দিকে লাঠিটা বাড়িয়ে মৃদু খোঁচা দিতে দিতে এবং চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে, ছাত থেইকা নাইমা আসো। নাইলে মহা বিপদ হইয়া যাইব। নামো– নামো–

    কাবোর নামার লক্ষণ দেখা যায় না। যারা ওপরে উঠেছিল, ছাদ আঁকড়ে তারা বসে থাকে।

    কর্মচারীটি বোঝাবার চেষ্টা করে, পথে মেলা নিচা নিচা (নিচু নিচু) ব্রিজ পড়ব। মাথায় বাড়ি খাইয়া পইড়া যাইবা, লগে লগে শ্যাষ। মরণের ওষুধ কানে বাইন্ধা না। যা কই কর। নাইমা আসো

    ওপর থেকে অনেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, আবার কবে টেরেন দিব তার ঠিক নাই।

    অর্থাৎ ওরা অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে চায় না। ট্রেন যখন একটা পাওয়া গেছে, চরম বিপদের ঝুঁকি নিয়েই তারা কলকাতায় যাবে।

    কর্মচারীটি বলে, আরে বাপু, মাঝে মইদ্যে ইট্টু আধটু গণ্ডগোল হইতে আছে ঠিকই, তয় (তবে) তোমাগো লেইগা গাড়ি নিচ্চয় দেওন হইব। এক আধদিন এইখানে সবুর কর, হের পর (তারপর) কইলকাতায় যাইও। ভাল কথা কই, নিচে নামো–

    তার পরামর্শে কেউ কর্ণপাত করে না। কামরার মাথায় লোকগুলো অনড় বসে থাকে। তাদের হয়তো ধারণা, এটাই কলকাতার শেষ ট্রেন।

    ট্রেনের জানালা দিয়ে বয়স্ক কর্মচারীটির পাশাপাশি সেই কম বয়সের কর্মচারীটিকেও দেখতে পাচ্ছিল বিনু। ছোকরার চোখেমুখে চরম বিরক্তি আর বিদ্বেষ। রুক্ষ গলায় সে বলে, কাফেরগুলা যদি মরে মরুক। তুমি ক্যান চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া গলার নলী ফাইড়া ফেলাইতে আছ চাচা?

    বয়স্ক কর্মচারীটি ভীষণ রেগে যায়, অগো উপুর তর এত গুসা ক্যান? এই দ্যাশটা তর আমার য্যামন, অগোও ত্যামন আছিল। এক লগে কত কাল ধইরা কাছাকাছি থাকছি। পরস্পর ভাই-দাদা চাচা কইছি। দ্যাশ ভাগ না হইলে অরা কি যাইত? যহন জানি রেলের মাথায় বইসা গ্যালে বিপদ। হইব, সাবধান কইরা দিমু না?

    যুবকটি উত্তর দেয় না। বর্ষীয়ান সহকর্মীর কথায় সে খুব একটা খুশি হয়েছে বলে মনে হল না।

    কেউ শুনুক না-শুনুক, বয়স্ক কর্মচারীটি হুঁশিয়ারি দিতে দিতে বিনুদের কামরার পাশ দিয়ে চলে যায়।

    ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়েই আছে। কখন ছাড়বে, কে জানে।

    জানালার বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে কামরার ভেতরে তাকায় বিনু। সেই সকাল থেকে যন্ত্রণায় ছটফট করেই চলেছেন রামরতন। একটু থেমে থেমে কাতর শব্দ করে উঠছেন। তার মেয়েরা অনবরত শাড়ির আঁচল নেড়ে নেড়ে হাওয়া করে যাচ্ছে। ঝিনুকও তাই করছিল। এখন ক্লান্ত হয়ে কামরার দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে।

    সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি বিনু বা ঝিনুকের। ভীষণ খিদে পেয়েছে। তারপাশায় প্রচুর চিড়ে গুড়টুড় কিনেছিল। তার অর্ধেকটা এখনও রয়েছে। কিন্তু রামরতনের বুকের কষ্টটা বেড়ে যাওয়ায় তার স্ত্রী এবং মেয়েরা এমনই উদ্বিগ্ন যে খাওয়ার কথা তাদের খেয়াল নেই। এই অবস্থায় পাশে বসে খাওয়াও যায় না। আসলে ওরা না খেলে বিনুরাই বা খায় কী করে? রামরতনদের সঙ্গে কাল তারপাশায় দেখা। এইটুকু সময়ের মধ্যে কতভাবেই না ওঁদের সঙ্গে বিনুরা জড়িয়ে গেছে।

    তারা না খেলেও কামরার বাকি সবাই পোঁটলা পুঁটলি খুলে মুড়ি বাতাসা বা চিনির মঠ বার করে খাচ্ছে।

    রামরতনের কাতরানিটা চলছেই। তাঁর স্ত্রী ব্যাকুলভাবে বিনুকে বলল, বুড়া মানুষটারে লইয়া কী করি কও তো বাবা? কইলকাতা তরি ওনারে লইয়া যাইতে পারুম তো?

    অসহায় বৃদ্ধাকে দেখতে দেখতে বুকের ভেতরটা কেঁপে যায় বিনুর। সে বলে, খারাপ কথা, চিন্তা করবেন না মাসিমা। নিশ্চয়ই স্যারকে নিয়ে যেতে পারবেন।

    রামরতনের শিয়রের কাছে বসেছে বিনু। কাল রাতে জোরে জোরে বুক ডলে দেওয়ায় তার যন্ত্রণা কমে গিয়েছিল। কিন্তু বার বার একই পদ্ধতিতে কাজ হবে কিনা, কে জানে। বিনু ঝুঁকি নিল না। জামার ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অনেকক্ষণ পর রামরতনের গোঙনি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এল।

    বেশ কয়েক ঘন্টা পর, বিকেলের সূর্য যখন পশ্চিম দিকে নদীর ওপর ঢলে পড়েছে, সেই সময় গার্ডের হুইসিল শোনা গেল। পরক্ষণে ট্রেন চলতে শুরু করল।

    রামরতন অনেকক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কষ্টটা নিশ্চয়ই আর নেই। বিনু তাড়া দিয়ে দিয়ে তার স্ত্রী এবং মেয়েদের চিড়ে টিড়ে খাইয়েছে। ঝিনুক আর সেও খেয়েছে। রামরতনের জন্য যে উৎকণ্ঠা ছিল সেটা অনেকখানি কেটে গেছে।

    জানালার বাইরে মুখ ফিরিয়ে আকাশ নদী গাছপালা ধানখেত দেখছিল বিনু। পূর্ব বাংলায় এটাই তার জীবনের শেষ সূর্যাস্ত। পৃথিবীর এই ভূখণ্ডে আর কখনও তার ফেরা হবে না।

    এখানে কমগুলো বছর তো কাটল না। এই বাংলার খাল বিল নদী, ঘন সবুজ বৃক্ষলতা, আকাশ বাতাস, সোনালি লাবণ্যে ভরা অবারিত ফসলের খেত, ফুল, পাখি, মাছ, ঋতুক্রের মোহিনীমায়া সব তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে জড়িয়ে আছে। এসব ফেলে চলে যেতে আশ্চর্য এক বেদনা বিনুকে কাতর করে তুলছিল। সেই সঙ্গে রয়েছে সন্দেহ, অবিশ্বাস, আতঙ্কের দমবন্ধ-করা ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যাবার অগাধ স্বস্তি। মিশ্র অনুভূতির টানাপোড়েন চলছে দুই বিপরীত দিকে।

    দেখতে দেখতে সূর্য ডুবে যায়। হেমন্তের সন্ধ্যা নামে। বাতাসে দ্রুত হিম মিশতে থাকে। কুয়াশায় অন্ধকারে চারদিক ঢেকে যায়।

    বিনু জানালার পাল্লা টেনে বন্ধ করে। কামরার ভেতর টিমটিমে আলো জ্বলছে। তাতে কোনও কিছু স্পষ্ট নয়। চারপাশের মানুষগুলোকে ধোঁয়ার মূর্তির মতো মনে হচ্ছে।

    ট্রেন কিন্তু একটানা চলছে না। মাঝে মাঝে মাঠের মাঝখানে কিংবা নগণ্য কোনও স্টেশনে থামছে। দু’এক ঘন্টা নড়ন চড়ন নেই। তারপর আবার দৌড়। এভাবে থেমে থেমে চললে কাল আদৌ কলকাতায় পৌঁছনো যাবে কিনা, কে জানে।

    .

    কখন চোখে ঢুল নেমেছিল আর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, বিনুর খেয়াল নেই। হঠাৎ কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়।

    ধড়মড় করে খাড়া হয়ে বসে বিনু। ট্রেন উধ্বশ্বাসে ছুটছিল। কামরার জানালাগুলো এখন খোলা। বাইরে অনেক দূরে সূর্যোদয় হচ্ছে। সকালের প্রথম আলো এসে পড়ছে কামরার ভেতরে। সেই সঙ্গে ঢুকছে হেমন্তের শীতল বাতাস।

    কিন্তু কোনও দিকেই লক্ষ্য নেই বিনুর। হতচকিত হয়ে সে দেখতে পায়, রামরতনের তিন মেয়ে এবং স্ত্রী অঝোরে কাঁদছেন। কামরার অন্য সবার এখনও ঘুম ভাঙেনি। যারা জেগে উঠেছে, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে আছে। ঝিনুকও জেগে গিয়েছিল। তার চোখে মুখে অদ্ভুত বিহ্বলতা।

    হঠাৎ কী হতে পারে যাতে রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েরা এমন ব্যাকুলভাবে কেঁদে চলেছে!

    কয়েক পলক তাকিয়ে থাকে বিনু। এই কান্নাকাটি কিসের এক অশুভ সংকেত যেন দিয়ে যাচ্ছে। হকচকানো ভাবটা খানিক কাটিয়ে রামরতনের স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে সে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে মাসিমা?

    বৃদ্ধা কান্নাজড়ানো গলায় বললেন, সকাল হইছে দেইখা তোমার মেসোমশাইরে জাগাইতে চেষ্টা করলাম। কাইল পুরা দিন প্যাটে কিছু পড়ে নাই। ভাবলাম উঠাইয়া দু’গা চিড়ামুড়ি খাওয়ামু। না। খাইলে শরীর আরও কাহিল হইয়া পড়ব। ডাকি, ঠেলা দেই, সাড়া নাই। চোখও মেলে না। গাও (গা) ক্যামন য্যান ঠাণ্ডা। আমার মন বড় কু ডাকতে আছে–

    বিনু বলল, আমাকে ডাকেননি কেন?

    আমাগো লেইগা কম তো কর নাই। রামরতনের স্ত্রী বললেন, অঘোরে ঘুমাইতে আছিলা। তাই আর জাগাই নাই–

    বিনু উত্তর দিল না। দ্রুত রামরতনের জামার ভেতর দিয়ে বুকে হাত রাখল। বরফের মতো শীতল। হাত বার করে তার একটা হাত তুলে নাড়ি টিপে ধরল। স্পন্দন নেই। গতি খুব সম্ভব চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেছে।

    বিনুর হৃৎপিণ্ডের ভেতর হিমস্রোত বয়ে গেল। শ্বাস আটকে আসছে তার। যা ঘটেছে সেটা পরিষ্কার। তবু রামরতনের কাঁধে মাথায় উদ্ভ্রান্তের মতো ঠেলা দিতে দিতে ডাকতে লাগল, স্যার স্যার–

    রামরতন নিশ্চল শুয়ে রইলেন। বিনু জানে, পৃথিবীর কোনও শব্দই তার কানে পৌঁছবে না, তবু বার বার ডাকতে ডাকতে একসময় থেমে গেল সে। রামরতনের বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে। কয়েক ফোঁটা জল বার হয়ে এল।

    এই বৃদ্ধের সঙ্গে পরশু তারপাশার স্টিমারঘাটে প্রথম আলাপ। রক্তের কোনও সম্পর্ক নেই। তবু বুকের অতল স্তর থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে এসে গলার কাছে কী যেন আটকে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বিনুর।

    ভয়তাড়িত রামরতন দেশ ছাড়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু ভারতে আর পৌঁছনো হল না। কাল রাতে ঘুমের ঘোরে যাবতীয় দুর্ভাবনা এবং ত্রাস এই ভূমণ্ডলে ফেলে রেখে তিনি চলে গেছেন।

    কান্নাটা সাময়িক থেমে গিয়েছিল। রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েরা আগেই জেনে গিয়েছিল। তবু অসম্ভব বুঝেও ক্ষীণ একটু আশা জাগিয়ে তুলে রুদ্ধশ্বাসে বিনুর দিকে তাকিয়ে আছে।

    রামরতনের স্ত্রী ঝাঁপসা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী বুঝলা বাবা?

    দুঃসংবাদটা বিনুর পক্ষে নতুন করে জানানোনা সম্ভব নয়। বিব্রতভাবে সে বলে, এখন উনি যেমন আছেন তেমনি শুয়ে থাকুন। ডাকাডাকি করার দরকার নেই। কলকাতায় পৌঁছবার পর ডাক্তার দেখানো যাবে।

    বিনু কী বলতে চায়, না বোঝার কারণ নেই। সরটি নানা বয়সের মহিলা ফের কান্নায় ভেঙে পড়ে।

    .

    হেমন্তের সূর্য মাথার ওপর উঠে আসার অনেক আগেই ট্রেন দর্শনা পৌঁছে যায়।

    পাকিস্তানের বর্ডার পুলিশ আর কাস্টমসের লোকজনে স্টেশনটা থিকথিক করছে। ট্রেন থামতেই তারা আঁপিয়ে পড়ল। প্রতিটি কামরার জানালায় জানালায় মুখ বাড়িয়ে আমর্ড কনস্টেবল আর কাস্টমসের অফিসাররা কড়া গলায় হুকুম দিতে লাগল, মালপত্র লইয়া সগলে নাইমা আসো। সার্চ হইব–

    বর্ডারে তল্লাশির কথা আগেই শুনেছিল বিনু। পূর্ব পাকিস্তান থেকে মূল্যবান কোনও জিনিস– সোনাদানা, গয়নাগাটি, বাসনকোসন, প্রচুর নগদ টাকা–নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। সার্চ করে যদি দেখা যায় তেমন কিছু কেউ লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তক্ষুনি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।

    হুকুম জারি হবার সঙ্গে সঙ্গে বিনুদেরই শুধু নয়, সবগুলো কামরা খালি করে ভয়ার্ত উদ্বাস্তুর দল হুড়মুড় করে লটবহর নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ে।

    রামরতনের স্ত্রী বিহ্বলের মতো বিনুকে বললেন, আমাগোও তো নামতে হইব। স্বামীকে দেখিয়ে বললেন, কিন্তু এই মানুষটারে ফেলাইয়া–

    বিনু বলল, আপনাদের এখন নামতে হবে না। আমি গিয়ে ওদের বুঝিয়ে বলব। তারপরও যদি না শুনতে চায় তখন দেখা যাবে–ঝিনুককে রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েদের কাছে রেখে কামরা থেকে নেমে পড়ল বিনু।

    প্ল্যাটফর্মে প্রচণ্ড ভিড়। কামরাগুলো থেকে লোক তো নেমেছেই, বিনুর চোখে পড়ল গাড়ির ছাদ থেকেও নামছে। হুকুমনামা অগ্রাহ্য করার মতো বুকের পাটা কারোর নেই।

    বিনুর মনে হল, গোয়ালন্দে যারা ট্রেনের মাথায় চড়েছিল তাদের কেউ মারা যায়নি। খুব সম্ভব ব্রিজ দেখলে তারা টান টান হয়ে ছাদে শুয়ে পড়েছে।

    প্ল্যাটফর্মের এক মাথায় টেবল চেয়ার পেতে লম্বা লম্বা বাঁধানো খাত আর পেন নিয়ে অফিসারেরা বসে আছে। ধমকধামক, বা বন্দুকের কুঁদোর গুতো দিয়ে পুলিশের লোকেরা অনেকগুলো লাইন করে উদ্বাস্তুদের দাঁড় করিয়ে দিল। প্রতিটি লাইনের জন্য একজন করে অফিসার।

    তল্লাশি শুরু হল। লাইনের প্রথম দিকে যারা আছে তাদের আগে সার্চ হয়ে যাচ্ছে। মালপত্র ঘাঁটাঘাঁটি তো হচ্ছেই, প্রত্যেকের সারা শরীরও হাতড়ানো হচ্ছে। এমনকি মেয়েরাও রেহাই পাচ্ছে না।

    বেশির ভাগেরই লটবহরে রয়েছে শস্তা পুরনো জামাকাপড়, কাঁথাবালিশ, তামা কাসার দু’চারটে বাসন, তা ছাড়া টুকিটাকি কিছু জিনিস।

    যাদের কাছে দামী কিছুই নেই তারা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দু’একজনের কাছ থেকে দু’চারটে সোনার গয়না, জমির দলিল এবং বেশ কিছু নগদ টাকা পাওয়া গেল। তক্ষুনি সে সব কেড়ে নেওয়া হল।

    লোকগুলো অফিসারদের পা জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে, সব্বস্ব খুয়াইয়া দ্যাশ ছাড়তে আছি। ওইটুকই শ্যাষ সম্বল। দয়া করেন গরিবের উপর–

    কিন্তু শুধুমাত্র কান্নায় অফিসারদের মন গলানো সহজ নয়। পা ঝাড়া দিয়ে তারা নিজেদের ছাড়িয়ে নেয়। কিন্তু এই উদ্বাস্তুরা নাছোড়বান্দা, ওরা ফের পা জাপটে ধরে। অগত্যা অফিসাররা আর্মড পুলিশ ডাকে। তারা ঘাড় ধরে টানতে টানতে এবং অকথ্য খিস্তি দিতে দিতে ওদের দূরে আছড়ে ফেলে। কারোর হাত-পা থেঁতলে যায়, কারোর বা বাঁধানো প্ল্যাটফর্মে মাথা ঠকে রক্তারক্তি কাণ্ড।

    সাত পুরুষের ভিটেমাটি খুইয়ে চিরকালের মতো যারা পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের প্রতি কেন এই অমানুষিক নিষ্ঠুরতা? আর একটু সদয় ব্যবহার কি করা যায় না? পাশের লাইন থেকে বিনু চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু কেউ যেন ভেতর থেকে তার গলা চেপে ধরে। প্রতিবাদ করতে গেলে তার পরিণতি মারাত্মক হবে। এই পরিস্থিতিতে বোবা হয়ে থাকাই একমাত্র বুদ্ধিমানের কাজ।

    সমান্তরাল রেখায় পর পর ছটা লাইন এগিয়ে চলেছে। যাদের কাছে তেমন কিছু পাওয়া যাচ্ছে, কেড়েকুড়ে তো নেওয়া হচ্ছেই, তার ওপর চলছে হেনস্থা। তবে তল্লাশির নামে মেয়েদের, বিশেষ করে তরুণীদের নিয়ে যা চলছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। মেয়েগুলো লজ্জায় ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। কিন্তু অন্ধ আর বধির হয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

    তবে কম বয়সের যে অফিসারটির সামনে বিনু লাইন দিয়েছে সে খুবই ভদ্র এবং দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। উদ্বাস্তুদের মালপত্র একটু আধটু দেখেই ছেড়ে দিচ্ছে। মেয়েদের কোনও কিছু জিজ্ঞেস করছে না, গায়ে হাত দিয়ে সার্চের তো প্রশ্নই নেই। নরম গলায় তাদের বলছে, আপনেরা যান–

    বিনু অফিসারটির কাছাকাছি চলে এসেছিল। তার সামনে আর মাত্র চার পাঁচটি লোক। তারপর। এই দুর্ভোগ শেষ হবে।

    হঠাৎ একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। বিনুদের বাঁ পাশের লাইনে আরও অনেকের সঙ্গে ছিল একটি রোগা, ক্ষয়টে চেহারার চাষাভুষো ধরনের প্রৌঢ়, তার স্ত্রী, একটি তরুণী এবং অল্প বয়সের দু’টি ছেলে। ওই লাইনের শেষ মাথায় যে অফিসারটি বসে আছে তার বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ। লম্বা চওড়া মজবুত চেহারা, চৌকো মুখ, পাকানো গোঁফ। ভাঙা ভাঙা বাংলার সঙ্গে উর্দু মিশিয়ে কথা বলছিল। বাঙালি যে নয়, পরিষ্কার বোঝা যায়। অবশ্যই পশ্চিম পাকিস্তানের লোক।

    বিনু অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিল, এই অবাঙালি অফিসারটি সবচেয়ে বেশি উৎপাত করে চলেছে। সে ওই প্রৌঢ়টির লটবহর খুলে আতিপাতি করে তো খুঁজলই, তারপর প্রৌঢ়, তার স্ত্রী এবং কম বয়সের ছেলে দুটোর শরীর হাতড়ে তল্লাশি চালাল। সবার শেষে এল যুবতী মেয়েটির পালা। সার্চের নামে তার গায়ে যেখানে সেখানে হাত চালিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি লজ্জায় উৎকণ্ঠায় আতঙ্কে এমনই। দিশেহারা যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। এত টলছিল যে জ্ঞান হারিয়ে যে কোনও মুহূর্তে লুটিয়ে পড়বে। তার বাপ হাতজোড় করে আর্ত, করুণ স্বরে সমানে বলে যাচ্ছিল, দয়া করেন ছার (স্যার), দয়া করেন। মাইয়াটারে ছাইড়া দ্যান তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে আকুল হয়ে একটানা কেঁদে চলেছে।

    অবাঙালি অফিসারটি তার কথায় কর্ণপাত করছিল না।

    অসহ্য ক্রোধে মাথার ভেতরটা যেন ফেটে যাবে বিনুর। মনে হল, জন্তুটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিন্তু নিরুপায় কাপুরুষের মতো হাত কামড়ানো ছাড়া উপায়ই বা কী।

    বিনু পারেনি, কিন্তু তার সামনের তরুণ বাঙালি অফিসারটি বসে থাকতে পারল না। সহ্যশক্তির শেষ সীমায় সে পৌঁছে গিয়েছিল। অবাঙালি অফিসারটির সার্চের নামে নোংরা ক্রিয়াকলাপ তাকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। হঠাৎ হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাংলা, উর্দু এবং ইংরেজি মিশিয়ে চিৎকার করে ওঠে, স্টপ ইট, স্টপ ইট। ছাড়েন–ছাড়েন, ছোড়িয়ে উনকো–

    অবাঙালি অফিসারটিও ততক্ষণে উঠে পড়েছে। বাধা দেওয়ায় তার মুখচোখ যেন রাগে ফেটে পড়বে। শরীরের সব রক্ত মাথায় চড়ে গেছে। গলার শির ছিঁড়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে, কিপ ইওর ব্লাডি মাউথ শাট। নিজের চরকায় তেল দাও। সিট ডাউন–

    অবাঙালি অফিসারটি খুব সম্ভব বাঙালি তরুণটির সিনিয়র। তরুণটি কিন্তু তার রক্তবর্ণ চোখ। এবং দাবড়ানি গ্রাহ্য করে না। সে এতটাই ক্রুদ্ধ আর উত্তেজিত যে গলার স্বর আরও কয়েক পর্দা চড়িয়ে যা বলল তা এইরকম। সিনিয়র অফিসারটির ইতরামো, অসভ্যতা কোনও মতেই বরদাস্ত করা যায় না। উদ্বাস্তু যুবতীরা তাদের মতো লোকের কাছে যে ব্যবহার পাচ্ছে, ওপারে গিয়ে যখন জানাবে, তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হবে। সবসময় মনে রাখা দরকার, সীমান্তের ওধারেও মাইনোরিটি কমিউনিটির লক্ষ লক্ষ মানুষ রয়েছে। তাদের ওপর জনরোষ গিয়ে পড়লে অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে?

    তরুণ অফিসারের দু’চারজন বাঙালি সহকর্মী তার সঙ্গে গলা মিলিয়ে অবাঙালিটির আচরণের প্রতিবাদ জানাতে থাকে।

    অনেকক্ষণ তুমুল বচসার পর গজ গজ করতে করতে বসে বড়ে অবাঙালি অফিসারটি। তবে নতুন করে বাড়াবাড়ি করতে তার সাহস হয় না। সে ভেবে পায় না, কাফের মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ায় বাঙালি ছোরারা এত খেপে গেল কেন?

    অবাক চোখে তরুণটির দিকে তাকিয়ে আছে বিনু। তাকে যত দেখছে ততই শ্রদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। আফজল হোসেনকে আগেই দেখেছে সে, নাসের আলিকে দেখেছে, এখন এই যুবক অফিসারটিকে দেখল। এদের সংখ্যাটা যদি আরেকটু বেশি হত!

    লাইনের সামনে যে ক’জন ছিল, তাদের তল্লাশি হয়ে গেছে। বিনু এখন তরুণ অফিসারটির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।

    অফিসারটি জিজ্ঞেস করল, আপনের মালপত্র?

    বিনু বলল, দুখানা চাদর ছাড়া আর কিছু নেই। সে দুটো রেলের কামরায় রেখে এসেছি।

    ঠিক আছে।

    অবশ্য—

    কী?

    আমার সঙ্গে কিছু টাকা আছে।

    কত?

    টাকা বার করে দেখায় বিনু। রাস্তায় খরচখরচা বাদ দিয়ে আট শ’ পাঁচ টাকা বার আনা।

    অফিসারটি বলল, টাকাটা নিজের কাছে রাইখা দ্যান।

    টাকা রেখে বিনু দু’হাত মাথার ওপর তুলে বলল, আমাকে সার্চ করে দেখতে পারেন।

    দরকার নাই। কে সত্য কয় আর কে মিছা, মুখ দেখলে বুঝা যায়। আপনে যাইতে পারেন।

    আমার আরও কিছু বলার আছে।

    অফিসার উৎসুক চোখে তাকায়।

    গলা নামিয়ে বিনু জানায়, তার সঙ্গে কয়েকজন রয়েছে। তাদের পক্ষে কামরা থেকে নেমে এসে তল্লাশির জন্য লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি।

    অফিসারের কপাল কুঁচকে যায়, ক্যান সম্ভব হয় নাই?

    রামরতনদের সঙ্গে কোথায় তার আলাপ, কিভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটেছে, সব জানিয়ে বিনু বলে, সবাই ওঁর বডি ঘিরে বসে আছে। এই অবস্থায় তো ওঁদের নামিয়ে আনা যায় না।

    ঠিকই।

    বিনু ফের বলে, আপনি কি কষ্ট করে আমাদের কম্পার্টমেন্টে যাবেন?

    কী ভেবে অফিসারটি বলে, আইচ্ছা চলেন– অন্য এক বাঙালি অফিসারকে তার জায়গায় বসিয়ে বিনুর সঙ্গে ওদের কামরায় যায় সে।

    রামরতনকে ঘিরে বসে তার স্ত্রী এবং মেয়েরা কেঁদেই চলেছে। চিৎকার করে নয়, একটানা চাপা, করুণ সুরে। তাদের পাশে বসে আছে ঝিনুক। নীরব, বিষণ্ণ। কামরার অন্য যাত্রীরা তল্লাশির জন্য নেমে গিয়েছিল। তারা এখনও ফিরে আসেনি।

    দৃশ্যটা তরুণ অফিসারকে হয়তো বিচলিত করে তোলে। আন্দাজ করা যায়, খুব বেশিদিন চাকরিতে ঢোকেনি। এখনও নতুন। তাই ততটা কঠোর আর যান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারেনি।

    রামরতনদের ডাঁই-করা মালপত্র দেখিয়ে বিনু বলে, ওগুলো ওঁদের। সার্চ করে দেখতে পারেন।

    নানা বয়সের চার শোকাতুরা নারীকে দেখতে দেখতে অফিসারটির মনে হয়, এই পরিস্থিতিতে তল্লাশি করাটা চরম নিষ্ঠুরতা। ভারী গলায় জানায়, না, থাউক। একটু থেমে বলে, যদি আইনে আটকায় অ্যামন কিছু ওনারা নিয়াও যান, বাধা দিমু না। নিজেগো জিনিসই তো নিয়া যাইতে আছেন। বলতে বলতে কামরা থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে যায়।

    বিনুও তার সঙ্গে নেমে পড়েছিল। তরুণ অফিসারটির সহৃদয়তায় সে আপ্লুত। গম্ভীর গলায় বলল, আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব!

    অফিসারটি বলল, কৃতজ্ঞতা আবার কিসের? ওনাগো এত বড় একটা সর্বনাশ হইয়া গেছে। তার উপুর ডিসটার্ব করুম, অ্যামন অমানুষ আমি না। আইচ্ছা, চলি–

    বিনু আর এগুলো না, হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে রইল।

    .

    ৩.১৫

    তল্লাশি শেষ হতে আড়াই তিন ঘন্টা লেগে গেল। লটবহর নিয়ে যারা নেমে গিয়েছিল, প্রতিটি কামরায় তারা ফিরে এসেছে। যারা ট্রেনের মাথায় চড়ে গোয়ালন্দ থেকে রওনা হয়েছিল, তারা ফের ছাদে উঠে পড়েছে।

    কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন সীমান্ত পেরিয়ে ইন্ডিয়ায় পৌঁছে যাবে। দেশ-হারানো ছিন্নমূল মানুষগুলোর চোখমুখ থেকে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা অনেকটাই কেটে গেছে। তাদের আশা, পাকিস্তান বর্ডারে তল্লাশির পর নতুন করে আর কোনও হানাদারি হবে না। বাকি যাত্রাপথ বিঘ্নহীন এবং নিরাপদ।

    বেশির ভাগ উদ্বাস্তুই সামান্য কথাকানি, কাপড়চোপড়, পুরনো বাসনকোসন ছাড়া পার্থিব অন্য কিছুই সঙ্গে আনতে পারেনি। যারা লুকিয়ে চুরিয়ে একটু আধটু সোনার গয়না বা জমির দলিল পরচা নিয়ে এসেছিল, সেগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানি অফিসারদের চোখে ধুলো ছিটিয়ে শেষরক্ষা করা যায়নি। এরা হতাশ হয়ে পড়লেও বড় রকমের একটা সান্ত্বনা তাদের আছে। সেই সঙ্গে স্বস্তিও। শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ায় তারা পৌঁছতে পারবে।

    বিনুদের কামরাটাও আগের মতোই ভিড়ে বোঝাই হয়ে গেছে। একটা সর্ষের দানা ফেলার মতো ফাঁকও নেই।

    ওদিকে রামরতনের স্ত্রী আর মেয়েদের কান্নার বিরাম নেই। সবার চোখ টকটকে লাল, যেন রক্তজবা। চোখের জল গাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অবিরল ঝরে যাচ্ছে।

    কামরার মানুষগুলোর বহুদিনের পুঞ্জীভূত আতঙ্ক প্রায় কেটে গেলেও তারা খুবই ম্রিয়মাণ। রামরতনের মৃত্যু এবং তার পরিজনদের কান্না পরিবেশটাকে আচ্ছন্ন তুলেছে। কেউ একটা কথাও বলছে না। কামরাটা আশ্চর্য রকমের চুপচাপ, বিহ্বল, গাঢ় বিষাদে ডুবে আছে।

    একসময় ট্রেন চলতে শুরু করল।

    বেশিক্ষণ লাগল না। পাকিস্তানের সীমানা পার হয়ে গাড়ি ইন্ডিয়ায় ঢুকে পড়ে। পূর্ব বাংলার সঙ্গে চিরকালের মতো সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল বিনুর। একধারে রামরতনের মৃতদেহ, তাকে ঘিরে শোককাতর চার মহিলা। সব মিলিয়ে বুকের ভেতর দুরন্ত ঘূর্ণির মতো কী যেন পাক খেতে লাগল তার।

    ট্রেন ইন্ডিয়ায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বিনুদের কম্পার্টমেন্টটা বাদ দিয়ে অন্য সব কামরা এবং ছাদের ওপর থেকে দেড় দু’হাজারের মতো মানুষ চিৎকার করে কী বলতে লাগল। ট্রেনের আওয়াজ ছাপিয়ে তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। তবে আন্দাজ করা যাচ্ছে, ইন্ডিয়ায় পৌঁছতে পেরে তারা ভীষণ উত্তেজিত। হইচই সেই কারণে।

    বিনু ঝিনুকের দিকে একবার তাকাল। এখন পর্যন্ত তাকে মোটামুটি সুস্থ এবং স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। কলকাতায় পৌঁছবার পর কী হবে, কে জানে। কিন্তু ঝিনুকের চিন্তা ছাপিয়ে রামরতনদের সমস্যা তাকে ক্রমশ অস্থির করে তুলতে থাকে।

    কলকাতায় সপরিবারে রামরতনের যাওয়ার খবর তার ভাইপো বিমল পেয়েছে কিনা, নাসের আলি বা স্বয়ং রামরতন কেউ বলতে পারেননি। যদি না পেয়ে থাকে? শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে যদি দেখা যায় বিমল ওঁদের নিতে আসেনি, তখন কী করবে বিনু? একটা মৃতদেহ, একজন বৃদ্ধা, একজন মাঝবয়সী বিধবা আর দুটি তরুণীকে বিশাল জনারণ্যে ফেলে রেখে সে কি চলে যাবে?

    অবনীমোহন সুধা এবং সুনীতিকে সে অনেক আগেই চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল, কলকাতায় যাচ্ছে। হেমনাথও লিখেছেন। ওরা যদি তাদের চিঠি না পেয়ে থাকে, স্টেশনে আসার প্রশ্নই নেই। তবু বিনুর খুব একটা অসুবিধা হবে না। ওদের সবার ঠিকানা তার জানা। আর কলকাতা শহরটা তার একেবারে অচেনাও নয়। খুঁজে খুঁজে কারোর না কারোর বাড়ি পৌঁছে যেতে পারবে। রামরতন যদি বেঁচে থাকতেন, ওঁদের সবাইকে নিয়ে অবনীমোহন বা দিদিদের কারোর বাড়িতে চলে যাওয়া যেত। কেউ আপত্তি করত না। ট্রেনের ধকল কাটাবার পর ধীরে সুস্থে বিমলের কাছে রামরতনদের পাঠিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু মৃতদেহ নিয়ে তো কারোর বাড়ি যাওয়া যায় না।

    পাশ থেকে অধর ভুঁইমালীর ফিসফিসানি কানে এল, বাবুমশয়—

    চমকে বাঁ পাশে তাকাতেই বিনুর চোখে পড়ল, অধর তার পুরু ফেট্টি বাঁধা পা তেরছা করে একটা রংচটা তোবড়ানো টিনের বাক্সের ওপর রেখে তার দিকে শরীরটা কাত করে দিয়েছে। চোখাচোখি হতে সে বলল, মাস্টারমশয় আতখা (হঠাৎ) মইরা গেল। ইন্ডিয়ায় আইল তেনার মরা শরীল। পথের আলাপ, তভু জবর কষ্ট হইতে আছে। একটু থেমে বলল, কিন্তু ক এইর মইদ্যে একখান কাণ্ড ঘটছে।

    বিনু জিজ্ঞেস করল, কী কাণ্ড?

    অধর বলল, উই শালারা তো আমারে চিনে না। অরা যায় ডাইলে ডাইলে, আমি যাই পাতায় পাতায়। দুই হাতের বুড়ো আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে বলতে লাগল, দিছি উই শালোগো এই আইঠা (বিচে) কলা চুষাইয়া।

    উই শালাগো– বলতে কোন শালাদের বুড়ো আঙুল বা বিচে কলা চুষিয়েছে অধর ভুঁইমালী, বুঝতে পারল না বিনু। জানতে চাইল, কাদের কথা বলছ?

    বিনুর কানে মুখটা প্রায় গুঁজে দিয়ে অধর বলল, উই পাকিস্থানী পুলিশ আর অগো (ওদের) অপসারগো।

    ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। বিনুর চোখমুখ দেখে সেটা আঁচ করে নিয়ে অধর বলল, বোঝতে নি পারলেন বাবুমশয়?

    না।

    আমি আগেই শুনছিলাম, বারে (বর্ডারে) আইলে পাকিস্থানী পুলিশেরা মালপত্তর ঘাইটা দুইটা (ঘেঁটে) তল্লাশি তো করেই, মাইয়া মরদ কেওরে (কাউকে) বাদ দ্যায় না। শরীলে-হাত হান্দাইয়া বিচরায় (হাত ঢুকিয়ে খোঁজে)।

    অধর ভুইমালী যা বলল, খানিক আগে দর্শনায় স্বচক্ষে তা দেখে এসেছে বিনু। নারীপুরুষ কেউ রেহাই পায়নি।

    অধর বলতে লাগল, পুঙ্গির পুতেগো চৌখে ধূলা দিয়া আমি সাত ভরি সোনার গয়না আর জমিজমা বাড়িঘরের বেবাক দলিল লইয়া আইছি।

    বলে কি লোকটা? খানিকক্ষণ হাঁ হয়ে থাকে বিনু। তারপর জিজ্ঞেস করে, তোমার জিনিসপত্র খুঁজে দেখে নি?

    দ্যাখে আবার নাই? পিন্দনের (পরনের) কাপড়ের ভিতরে তরি হাত হান্দাইয়া খাবলাইয়া দেখছে। তভু উদ্দিশ পায় নাই।

    দলিল টলিল রেখেছিলে কোথায়?

    ইণ্ডিয়ায় ঢুইকা গ্যাছি। অহন আর ডরের কিছু নাই। পাকিস্থানের পুলিশ এইখানে আইসা আর তেড়িমড়ি করতে পারব না। বডারের এই পারে আইলে ইন্ডিয়া অগো ঘেটি থিকা মাথা নামাইয়া দিব। হ। পায়ের মোটা ফেট্টিটা দেখিয়ে বলল, আসল মালগুলা রাখছি এইর ভিতরে। ল্যাংড়াইয়া ল্যাংড়াইয়া হাটছি বইলা হুমুন্দির পুতেরা ট্যারই পায় নাই।

    বিনুর তাক লেগে গেল। এই অক্ষরপরিচয়হীন পেঁয়ো লোকটা কী ধুরন্ধর, কতখানি কূট বুদ্ধি সে ধরে এবং কী বিপুল তার অভিনয় প্রতিভা, ভাবা যায় না। সেই তারপাশা স্টিমারঘাট থেকে যে প্রক্রিয়ায় নিখুঁতভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সে মারাত্মক ধরনের নিষ্ঠুর আর সজাগ পাকিস্তানি অফিসার আর পুলিশবাহিনীকে ধোঁকা দিয়েছে, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না বিনুর। নিচ্ছিদ্র পাহারদারি করেও সোনাদানা দলিলপত্র নিয়ে সীমান্তের এপারে তার চলে আসা পাকিস্তানিরা আটকাতে পারেনি। যন্ত্রণায় ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, এমন মুখভঙ্গি করে প্রায় দুটো দিন কাটিয়ে দিয়েছে সে। বিনু ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, তার পায়ের ব্যাণ্ডেজের ভাঁজে ভাঁজে কী লুকনো আছে। হঠাৎ ত্রৈলোক্য সেনের কথা মনে পড়ল। তিনিও হুবহু এই প্রক্রিয়ায় যুদ্ধের আমলে বর্মা থেকে অনেক টাকা নিয়ে এসেছিলেন।

    বিনু বলল, তা হলে তোমার পায়ে চোট টোট কিছুই লাগে নি!

    অধর বলল, না বাবুমশয়, না। একখান খোঁচা (খোঁচা) তরি না। আসল কথাখান কী জানেন?

    কী?

    দিনকাল আর আগের লাখান নাই। দাঙ্গা হইল, দ্যাশভাগ হইল, লাখ লাখ মানুষ ইণ্ডিয়ায় চইলা যাইতে আছে। অহন যদিন বুদ্ধি খাটাইয়া না চলেন, টিকতে পারবেন না। শ্যাষ হইয়া যাইবেন।

    অধর ভুঁইমালীর মুখ দিয়ে যেন দৈববাণী বেরুচ্ছে। সার সত্যিটা সে বুঝে নিয়েছে। এই দুঃসময়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে কৌশল দরকার। বিনু নিশ্চিত, লোকটা যে ধরনের চতুর এবং ফন্দিবাজ, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেলেও সে শেষ হয়ে যাবে না। নিজের বউ ছেলে মেয়ের জন্য ইন্ডিয়ায় কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে ফেলবে।

    অধর গলা আরও নামিয়ে দিল, বিশ্বাস কইরা আপনেরে কথাগুলান কইলাম বাবুমশয়। দেইখেন কেউ কেউ) য্যান ট্যার না পায়।

    না না, আমি কাউকে জানাব না। তা ছাড়া, কলকাতায় পৌঁছবার পর আমরা কে কোথায় চলে যাব, হয়তো আর দেখাই হবে না।

    একসময় ট্রেন বেনাপোল পৌঁছে যায়।

    বর্ডারের ওধারের মতো এখানেও প্রচুর ইন্ডিয়ান পুলিশ এবং অফিসার রয়েছেন। আর আছে অনেকগুলো সরকারি আর বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের লোকজনেরা।

    এখানে অবশ্য ট্রেনটাকে বেশিক্ষণ আটকানো হল না। সরকারি তরফ থেকে তো বটেই, স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলোর লোজনেরাও উদ্বাস্তুদের শুকনো খাবার অর্থাৎ চিড়ে গুড় দরবেশ, ইত্যাদি খেতে দিল। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত মানুষগুলো গোগ্রাসে খেতে লাগল।

    এরই মধ্যে অফিসাররা উদ্বাস্তুদের কে কোত্থেকে এসেছে, তাদের নাম, পরিবারে কতজন মানুষ, ইন্ডিয়ায় তাদের আত্মীয়স্বজন কেউ আছে কিনা, থাকলে সেখানে আশ্রয় পাওয়ার কতখানি সম্ভাবনা, ইত্যাদি টুকে নিয়ে প্রত্যেককে বর্ডার স্লিপ লিখে দিতে লাগলেন। ইন্ডিয়ার সরকারি নথিপত্রে শরণার্থী হিসেবে তাদের নামগুলো পাকা জায়গা পেয়ে গেল।

    গোয়ালন্দের মতো বেনাপোলেও একদল সিনেমার লোক মুভি ক্যামেরা নিয়ে উদ্বাস্তুদের ছবি তুলছিল। সবার বয়স তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। দলের কেউ কেউ ওপার থেকে আসা মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলে দেশছাড়ার কারণ রেকর্ড করে নিচ্ছে। গোয়ালন্দে সেভাবে মুখ খোলে। নি উদ্বাস্তুরা। কিন্তু এপারে এসে নির্ভয়ে জানিয়ে দিচ্ছে, পাকিস্তানে কী আতঙ্কের ভেতর তাদের দিন কেটেছে এবং ইন্ডিয়ায় না এসে কেন তাদের উপায় ছিল না, ইত্যাদি।

    বিনু লক্ষ করল, সিনেমার এই কলাকুশলীরা গোয়ালন্দের সেই দলটার মতো সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে আসেনি। তারা এই উপমহাদেশেরই লোক। ওদের চেহারা দেখে, কথা শুনে মনে হয়, নিঃসন্দেহে বাঙালি। বিশ শতকের মাঝামাঝি লক্ষ লক্ষ মানুষের দেশত্যাগের মর্মান্তিক ইতিহাস তারা ছবিতে ধরে রাখছে।

    অনেককে বর্ডার স্লিপ দেবার পর একজন অফিসার বিনুকে ডাকলেন। বাঁধা নিয়মে তার নাম টাম জেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সঙ্গে আর কেউ আছে?

    বিনু ঝিনুকের কথা বলল।

    আপনার স্ত্রী? অফিসার জানতে চাইলেন।

    বিব্রত বোধ করে বিনু। একটু ভেবে বলে, না। আমার আত্মীয়। দাঙ্গায় ওর মা-বাবা মারা গেছেন।

    ঝিনুক সম্পর্কে আর কোনও প্রশ্ন না করে অফিসার বললেন, কলকাতায় আপনাদের কেউ আছেন?

    আছেন। আমার দুই দিদি আর বাবা।

    তা হলে আপনাদের রিলিফ কাম্পে ওঠার দরকার নেই।

    রিলিফ ক্যাম্প?

    অফিসার বিশদভাবে বুঝিয়ে দিলেন। যারা সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের ওপার থেকে পশ্চিম বাংলায় চলে আসছে, তাদের আশ্রয় দেবার মতো আত্মীয়পরিজন যদি এখানে না থাকে, এই ধরনের মানুষজনকে কলকাতার আশেপাশে বা বিভিন্ন জেলায় ত্রাণ-শিবিরে পাঠানো হচ্ছে। যতদিন না সরকার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে, বা এরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে, শিবিরেই তাদের থাকতে হবে। সরকারই এদের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবে।

    অফিসার বললেন, আপনার তো সে সমস্যা নেই। বাবা আর দিদিরা যখন আছেন, তাদের কারোর কাছে উঠতে পারবেন। ক্যাম্পে যাবার দরকার হবে না।

    আস্তে মাথা নাড়ে বিনু, না।

    এই বর্ডার স্লিপ দু’টো রাখুন– বিনু আর ঝিনুকের নাম লিখে দু’টো ছাপানো কাগজ দিলেন অফিসার।

    বিনু বলল, আমরা তো রিলিফ ক্যাম্পে উঠছি না। এ দুটো দিয়ে কী হবে?

    আপনারা যে জেনুইন রিফিউজি, বর্ডারের ওপার থেকে ইন্ডিয়ায় এসেছেন, এই স্লিপ তার ডকুমেন্ট। একটা খবর কি আপনি জানেন?

    কী?

    সরকারি চাকরিবাকরির ব্যাপারে রিফিউজিদের অনেক প্রেফারেন্স দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে সারভিস করতে চাইলে এ দু’টো কাজে লাগবে। যত্ন করে রাখবেন।

    সীমান্তের ওধারে একজন সহৃদয় তরুণ বাঙালি অফিসারকে দেখে এসেছে বিনু। এ পারেও তেমন একজনকে পাওয়া গেল। সহানুভূতিশীল, শুভাকাঙ্ক্ষী। তবে এধারের অফিসারটি ওপারের অফিসারের মতো যুবক নন। মধ্যবয়সী।

    বিনুর সঙ্গে কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। অফিসারটি অন্য একজন উদ্বাস্তুকে ডাকতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ রামরতনদের কথা মনে পড়ে গেল তার। ব্যস্তভাবে বলল, স্যার, একটা ফ্যামিলি আমাদের সঙ্গে এসেছে। তাদের নাম গভর্নমেন্ট রেকর্ডে থাকা দরকার।

    নিশ্চয়ই। তারা কোথায়?

    ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে রয়েছে।

    ওদের তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দিন।

    ওরা আসতে পারবে না।

    কেন?

    রামরতনদের তারপাশা স্টিমারঘাটে পরিচয় হবার পর একসঙ্গে গোয়ালন্দে আসা, তারপর ট্রেনে তার মৃত্যু, সংক্ষেপে সব জানিয়ে দিয়ে বিনু বলল, ওঁর স্ত্রী আর মেয়েরা ডেডবডি আগলে কান্নাকাটি করছে। কী করে নেমে আসবে?

    অফিসার কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকেন। তারপর বিষণ্ণ গলায় বলেন, না না, ওঁদের আসার দরকার নেই। আমি আপনার সঙ্গে একজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সে ওঁদের নাম টাম রেকর্ড করে বর্ডার স্লিপ দিয়ে আসবে। কিন্তু–

    কী?

    ডেডবডিটা নিয়ে তো ভীষণ সমস্যা হল।

    হ্যাঁ। শিয়ালদায় গিয়ে যদি দেখি রামরতনবাবুর ভাইপো আসেননি, খুব বিপদে পড়ে যাব। ওঁদের ফেলেও চলে যেতে পারব না, অথচ কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। স্যার, আপনি কি আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন?

    একটু চিন্তা করে অফিসার বললেন, ডেডবডি বেশিক্ষণ ফেলে রাখা যাবে না। পচন শুরু হয়ে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, বার্নিং ঘাটে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু এখানে সেরকম কোনও ব্যবস্থা নেই। শিয়ালদায় আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন অফিসারকে চিঠি লিখে দিচ্ছি। যদি রামরতনবাবুর ভাইপো না আসেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন। ওঁর হেল্প নিশ্চয়ই পাবেন। দ্রুত চিঠি লিখে একটা খামে পুরে বিনুকে দিতে দিতে বললেন, খুব ভালমানুষ। ভেরি মাচ সিমপ্যাথেটিক টু দা রিফিউজিস। অনেক সময় নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়েও সাহায্য করেন।

    খামের ওপর অফিসারের নাম লেখা আছে। অলোকপ্রসাদ সেন। বিনু জিজ্ঞেস করল, অলোকপ্রসাদবাবুকে যদি কোনও কারণে না পাওয়া যায়?

    জোর দিয়ে অফিসারটি বললেন, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আপনাদের ট্রেনটা যে যাচ্ছে, ওঁকে সে খবর পাঠানো হয়েছে। রিফিউজিদের রিসিভ করার জন্যে উনি শিয়ালদায় থাকবেন। তবে ধরুন হঠাৎ শরীর খারাপ হল, কি অন্য কোনও জরুরি কাজে অথরিটি ডেকে পাঠালেন, তা হলে ওঁর অ্যাসিস্টান্ট শুকদেব মালাকারের সঙ্গে দেখা করে আলোকপ্রসাদবাবুর চিঠিটা দেবেন, আমার কথাও বলবেন। আশা করি, কাজ হবে। অফিসার তার এক সহকারীকে বিনুর সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন। সে রামরতনের স্ত্রী এবং মেয়েদের নাম টাম লিখে, বর্ডার স্লিপ দিয়ে চলে গেল। আরও কিছুক্ষণ বাদে ট্রেন চলতে শুরু করল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.