Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ৩.৩৬-৪০ খাওয়াদাওয়ার পালা

    ৩.৩৬

    রান্নাবান্না শেষ হতে বেলা হেলে গেল। এবার খাওয়াদাওয়ার পালা।

    সামনের বিশাল চত্বরটায় মুকুন্দপুরের পুরুষ আর বাচ্চাদের কাতার দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হল। মাটিতে বসে কলাপাতায় খাওয়ার ব্যবস্থা। একমাত্র বিনুর জন্যই পাখি কালকের সেই ফুলতোলা। আসনটা এনে দিয়েছে।

    মেয়েরা নিপুণ হাতে পরিবেশন করছে। পুরুষদের খাওয়া শেষ হলে তারা খাবে।

    পদ খুব বেশি নয়। মসুর ডাল, নানারকম আনাজ দিয়ে পাঁচমেশালি একটা তরকারি, কাতলা মাছের ঝোল এবং বোয়াল মাছের পাতুরি।

    হই হই করে সবাই খাচ্ছে। সেই সঙ্গে নানা গল্প। ঠাট্টা। মজার মজার কথায় ভোজসভার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত হাসির লহর উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। আর শতমুখে শুধু বিনুর নাম। হেমকর্তার নাতি হেমকর্তার মনই পেয়েছে। পাঁচ শ’ হাত চওড়া একটা মন।

    মাত্র এক শ’টা টাকা খরচ হয়েছে বিনুর। আর তাতেই মুকুন্দপুরবাসীদের মুখে প্রাণখোলা হাসি ফোঁটাতে পেরেছে। অম্লান, অফুরান হাসি।

    চারপাশের হাস্যোজ্জ্বল মুখগুলো দেখতে দেখতে বিচিত্র আবেগে বুকের ভেতরটা তোলপাড় হতে থাকে বিনুর।

    পুরুষদের পর মেয়েরা। তাদের খাওয়া যখন শেষ হল, সূর্য পশ্চিম আকাশে অনেকখানি ঢলে পড়েছে। হেমন্তের মরা রোদ দ্রুত জুড়িয়ে যাচ্ছে।

    হঠাৎ ঝিনুককে মনে পড়ল বিনুর। কাল এখানে আসার পর রাজদিয়া অঞ্চলের পরিচিত মানুষজনকে কাছে পেয়ে আবেগে, আনন্দে ভেসে গিয়েছিল। ঝিনুকের কথা ভাবতেই সীমাহীন ব্যাকুলতা বোধ করে সে। মনে মনে ঠিক করে ফেলে, আজই কলকাতায় ফিরে যাবে। যুগলকে তা জানাতেই সে হুলস্থুল বাধিয়ে দেয়, এই কথা তো আছিল না ছুটোবাবু। আইজের (আজকের) দিন থাইকা কাইল যাইবেন। কিছুতেই আইজ আপনেরে ছাড়ুম না।

    মুকুন্দপুরের অন্য বাসিন্দারা যুগলের সঙ্গে সুর মেলায়। আজ কোনওভাবেই বিনুকে যেতে দেবে না।

    কাল সুধাদের বাড়িতে একরকম জেদই ধরেছিল যুগল। বিনুকে মুকুন্দপুরে নিয়ে সাত আটদিন নিজেদের কাছে রাখবে। বিনু অতদিন থাকবে না। শেষ পর্যন্ত হিরণ রফা করে দিয়েছিল, আজকের দিনটা থেকে কাল চলে যাবে বিনু। কিন্তু আজই সে ফিরে যেতে চাইছে।

    যুগল অবুঝ, একগুয়ে বালকের মতো হাত-পা ছুঁড়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে থাকে, কত বচ্ছর পর আপনেরে কাছে পাইছি। আইসাই চইলা যাইবেন, হেয়া হইব না, হইব না, হইব না।

    কেন বিনু আজই ফিরে যাবে, যুগলকে তা বলা যায় না। সেই ছেলেবেলা থেকে সে দেখে আসছে, ঝিনুক চিরদুঃখী। মা-বাবার তিক্ত সম্পর্ক তাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। যেন এক নিপ্রাণ প্রতিমা। সারাক্ষণই প্রায় চুপচাপ।

    অন্য সবার সামনে যেমনই হোক, যত নিঝুম বা জড়সড়, হেমনাথ স্নেহলতা আর বিনুর কাছে সে একেবারেই অন্য মানুষ। তার মধ্যে যে একটা গোপন জলপ্রপাত আছে, এই তিনজনই শুধু সেটা বার করে আনতে পারত। তাদের সঙ্গে ওর যত হাসি, কল কল করে যত কথা, তাদের কাছে তার যত আবদার। বড় হবার পর থেকে মেয়েটাকে অপার মায়ায়, অফুরান সহানুভূতিতে ঘিরে রেখেছে বিনু। আর বিনুকে, একমাত্র বিনুকেই শত হাতে আঁকড়ে ধরেছে ঝিনুক।

    সবই ঠিক ছিল। মসৃণ নিয়মে প্রিয় নারীটিকে আরও নিবিড় করে পেয়ে যেত বিনু। ঝিনুকের যাবতীয় ক্লেশেরও হয়তো অবসান ঘটত। কিন্তু এই সেদিন ঢাকা থেকে যখন তাকে উদ্ধার করে আনা হল, ঝিনুক যেন এক ভগ্নস্তূপ। শারীরিক সর্বনাশ যতটুকু হয়েছে তার সহস্র গুণ ক্ষতি হয়েছে মনের দিক থেকে। ঝিনুক তখন প্রায়-উন্মাদ। বিধ্বস্ত। তাকে কত যত্নে কত শুশ্রূষায় যে খানিকটা স্বাভাবিক করে তোলা হয়েছে, বিনুর চাইতে কে আর তা বেশি জানে!

    তারপর তো কলকাতায় পাড়ি। কিন্তু সুনীতিদের বাড়ি এসে মেয়েটাকে কী লাঞ্ছনাই না ভোগ করতে হয়েছে! সুধারা অবশ্য গভীর মমতায় তাকে কাছে টেনে নিয়েছে। হাসিখুশি, স্বাভাবিক, শঙ্কাহীন। ঝিনুককে ওদের কাছে রেখে মুকুন্দপুরে এসেছে বিনু। সুধাদের দিক থেকে দুর্ভাবনা নেই। কিন্তু এই যে প্রায় দেড়টা দিন সে ঝিনুকের কাছে নেই, এর ভেতর রাজদিয়া এলাকার কেউ যদি সুধাদের বাড়ি গিয়ে থাকে? সুধারা তো জানে না, কার কোন কথায়, সামান্য কোন ইঙ্গিতে ফের কুঁকড়ে যাবে ঝিনুক, শক্ত খোলার ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নেবে, ফিরে যাবে ঢাকার সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের দিনগুলোতে। তাকে পুরোপুরি সুস্থ এবং স্বাভাবিক করে তোলার এত যত্ন, এত প্রয়াস, সব ব্যর্থ হয়ে যাবে। না, ঝিনুকের কাছ থেকে বেশিক্ষণ দূরে থাকা ঠিক নয়।

    যুগল তো বটেই, মুকুন্দপুরের বাসিন্দারা প্রচুর কাকুতি মিনতি করল, হাতে পায়ে ধরল, কিন্তু বিনুকে কিছুতেই আটকানো গেল না।

    হরনাথ বলল, দিন তো ফুরাইয়াই আসছে। আর একখান রাইত থাইকা গ্যালে আমরা বড় আনন্দ পাইতাম।

    বিনু বলল, কলকাতায় আমার খুব দরকারী কাজ আছে। না গেলেই নয়। মিথ্যেই বলেছে সে। না বলে উপায়ই বা কী। চলে যাবার একটা ওজর তো চাই।

    যুগল আর একটা কথাও বলল না। একেবারে গুম মেরে গেছে। ছোটবাবুর ওপর তার বড় অভিমান। আরেকটা রাত থেকে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হত না, আকাশ মাথার ওপর খান খান হয়ে ভেঙে পড়ত না। কলকাতায় কী এমন দরকার যে আজকের রাতটা থেকে যেতে পারবে না?

    বিনু আর দেরি করল না। পাখি তার বাসি জামাকাপড় ধুয়ে, শুকিয়ে পাট করে রেখেছিল। সেগুলো কাপড়ের ব্যাগে পুরে বেরিয়ে পড়ল।

    শেষ পর্যন্ত অভিমান করে থাকা গেল না। থমথমে মুখে যুগল বলল, যাইবেনই যহন, চলেন আপনেরে কইলকাতায় পৌঁছাইয়া দিয়া আসি।

    বিনু যুগলের কাঁধে একখানা হাত রেখে হেসে হেসে খুব নরম গলায় বলল, রাগ করো না। সত্যিই আমার জরুরি কাজ আছে। নইলে থেকে যেতাম।

    আর কি মুকুন্দপুরে আপনেরে আনা যাইব?

    কী বলছ তুমি! দেশের এত মানুষ এখানে রয়েছে। আরও অনেকে আসবে। না এসে কি পারি?

    যুগল একটুতেই খুশি হয়ে যায়। তার মুখ আলো হয়ে ওঠে। না আসলে আমরা বেবাকে গিয়া কইলকাতা থিকা আপনেরে ধইরা আনুম।

    কথা বলতে বলতে বিরাট চত্বর পেরিয়ে, নতুন বসতির অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায় সবাই। এখান থেকে আগরপাড়া পর্যন্ত ধানখেত, খাল ইত্যাদি।

    মুকুন্দপুরের লোকজন বিনুদের পেছন পেছন চলে এসেছিল। বিনু বলল, আপনারা আর কষ্ট করে আসবেন না। ফিরে যান।

    সবাই দাঁড়িয়ে পড়ে। সারি সারি ম্লান মুখ। তারা বলে, আপনের আশায় আমরা পথ চাইয়া থাকুম কিলাম–

    ওদের দেখতে দেখতে বিনুর বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে ওঠে, বলেছি তো আসব। নিশ্চয়ই আসব।

    দু’জনে ধানখেতে নেমে পড়ে। আলের ওপর দিয়ে ওপর দিয়ে খানিকটা গেলে মেঠো পথ পাওয়া যাবে।

    চলতে চলতে বিনু বলল, তোমাকে ছোটদির বাড়ি পর্যন্ত যেতে হবে না। আগরপাড়ায় গিয়ে কলকাতার ট্রেনে তুলে দিলেই চলবে।

    যুগল বলল, শিয়ালদায় লাইমা টালিগুঞ্জে যাইতে পারবেন তো? তাকে বেশ চিন্তিত দেখায়।

    বিনু বলল, কেন পারব না? শিয়ালদা থেকে ধর্মতলা। সেখান থেকে বাস পালটে কি ট্রামে টালিগঞ্জ।

    ঠিকই বলেছে বিনু। তবু যেন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারে না যুগল, কুন কুন নম্বরের বাস ধরবেন কন দেখি–

    বিনু বলল। যুগলের ভাবভঙ্গি স্নেহপ্রবণ অভিভাবকের মতো। বিনুর খুব হাসি পাচ্ছিল।

    .

    আগরপাড়া স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। অনেক আগেই কুয়াশা আর হিম পড়তে শুরু করেছে ঘন হয়ে। নেমে এসেছে আঁধারও।

    টিকিট কেটে এনে প্ল্যাটফর্মের একধারে দাঁড়াল বিনু। পাশে যুগল।

    এই সময়টা কলকাতার দিকের প্যাসেঞ্জার কম থাকে। প্ল্যাটফর্মটা প্রায় ফাঁকা। দূরে দূরে মিটমিটে আলো জ্বলছে। কুয়াশা এবং অন্ধকার সেগুলোর টুটি টিপে ধরে আছে।

    টুকরো টুকরো নানা কথা বলতে বলতে যুগল হঠাৎ দ্বিধার সুরে জিজ্ঞেস করে, ছুটোবাবু, যদিন গুসা না করেন, একখান কথা জিগামু?

    হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

    ঝিনুক বইনের দুঃখুর কথা শুনাশুন আমাগো কানে আইছে।

    সুধাদের বাড়িতে দু’বার যুগলের সঙ্গে দেখা হয়েছে। মুকুন্দপুরেও এতটা সময় একসঙ্গে কাটিয়ে এল। কত গল্প হয়েছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও যুগল বুঝতে দেয় নি, ঝিনুকের লাঞ্ছনার কাহিনী সে জেনে গেছে। কিন্তু হঠাৎ এই প্রসঙ্গটা তুলল কেন? তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বিনু।

    যুগল বিমর্ষ সুরে বলল, যহন ঝিনুক বইনের কথাখান শুনলাম, বুক আমার ফাইটা গেছিল।

    যুগলের কষ্টটা যে যথেষ্ট আন্তরিক তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বিনু উত্তর দিল না।

    যুগল এবার জিজ্ঞেস করে, ঝিনুক বইনেরে লইয়া এক রাইত এক দিন সুনীতিদিদির বাড়িত আছিলেন। ওনার শাউড়ি যা একখান মানুষ! ঝট করে নাই?

    বিনু চমকে উঠল। হেমনলিনী ঝিনুকের সঙ্গে যে ভাল ব্যবহার করতে পারেন না, সেটা আন্দাজ করে নিয়েছে যুগল। আত্মীস্বজনদের সম্বন্ধে অপ্রিয় আলোচনা করতে রুচিতে বাধে বিনুর। ভীষণ অস্বস্তি হয়। সে চুপ করে রইল।

    কী ভেবে যুগল ফের বলে, সুধাদিদি আর ছুটো জামাইবাবু, দুইজনেই ভালা মানুষ। কিন্তুক কয়দিন পর ছুটো জামাইবাবুর ঠাউরদা আর জেঠিমা ফিরা আসব। হেয়া ছাড়া আপনের বাবায়ও তীর্থধম্ম সাইরা ফেরবেন। তেনারা পুরানা কালের মানুষ। ঝিনুক বইনেরে কি মাইনা নিবেন?

    যে তিনজনের কথা যুগল বলল তাদের সম্বন্ধে যথেষ্ট দুশ্চিন্তা রয়েছে বিনুর। রয়েছে গভীর শঙ্কা। লাঞ্ছিত ঝিনুককে তারা যদি সসম্মানে কাছে টেনে না নেন? হেমনলিনী যা করেছেন, হুবহু সেইভাবেই নোংরা আবর্জনার মতো তাকে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলেন?

    বিনু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। যুগল ফের বলে, ছুটোবাবু, ছুটো মুখে একখান কথা কই। ঝিনুক বইনেরে লইয়া যদিন বিপদে পড়েন, সিধা মুকুন্দপুরে চইলা আসবেন। আমরা সোম্মান দিয়া তেনারে মাথায় কইরা রাখুম।

    বিহ্বল বিনু যুগলের দিকে তাকিয়েই থাকে। অক্ষরপরিচয়হীন এই যুবকটি সর্বস্ব খুইয়ে সীমান্তের এপারে চলে এসেছে। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য প্রতি মুহূর্তে তার নিদারুণ যুদ্ধ। অপরিসীম ক্লেশ। তার মধ্যেই অন্যের কথা চিন্তা করে সে, অপরের দুঃখে কাতর হয়। লাঞ্ছিত ঝিনুকের জন্য সে যে এতটা ভেবে রেখেছে, কে জানত! যুগলের উদারতা, যুগলের সমবেদনার লেশমাত্রও যদি নিজের পরিজনদের মধ্যে থাকত!

    কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে যায় বিনুর। যুগলের একটা হাত ধরে ভারী গলায় বলে, তোমার কথা আমার মনে থাকবে। পরক্ষণে অন্য একটা চিন্তা তাকে ভীষণ দমিয়ে দেয়, কিন্তু

    কী হইল ছুটোবাবু?

    তোমরা না হয় মাথায় করে রাখলে। কিন্তু মুকুন্দপুরের অন্য সবাই?

    এই কথা! যুগল হাসে, মুকুন্দপুরের তিন ফেমিলির বস্যের মাইয়া পাকিস্থানে টাইনা লইয়া গ্যাছে। পাঁচ সাতটা মাইয়া আছে, এইপারে আসনের আগে তাগো মান-ইজ্জৎ নষ্ট হইছে। হগলেরই তো একই দুঃখু। একই কষ্টে বুক টাটায়। ঝিনুক বইনেরে ক্যাঠা কী কইব! চিত হইয়া ছাপ (থুতু) ফেলাইলে নিজের বুকেই তো আইসা পড়ে। আপনে ভাইবেন না ছুটোবাবু–

    একসময় দিগদিগন্ত কাঁপিয়ে কলকাতার ট্রেন এসে পড়ে।

    .

    সুধাদের বাড়ি বিনু যখন পৌঁছল, আটটাও বাজে নি। সদর দরজায় কড়া নাড়তে উমা নেমে এসে খুলে দিয়েছিল। দোতলায় এসে বিনু দেখল, সুধা ঝিনুক আর হিরণ ভেতরে শোবার ঘরে বসে গল্প করতে করতে রেডিও সিলোনের গান শুনছিল। বিখ্যাত সব গান। নামকরা সব শিল্পী। নুরজাহান, রাজকুমারী, রফি, হেমন্তকুমার, জগমোহন, গীতা রায়, লতা মঙ্গেশকর, মুকেশ, তালাত মামুদ, এমনি অনেকে।

    বিনুকে দেখে প্রথমটা সবাই অবাক। তারপর হইহই করে উঠল।

    সুধা বলল, কি রে, তোর না কালকে আসার কথা ছিল।

    কাঁধের ব্যাগটা মেঝেতে নামিয়ে একটা বেতের মোড়ায় বসতে বসতে বিনু বলল, চলে এলাম—

    রেডিও বন্ধ করে হিরণ জিজ্ঞেস করল, যুগলরা তোমাকে আসতে দিল?

    একেবারেই না। শুধু যুগল নাকি, সারা মুকুন্দপুরের লোকজন ঘিরে ধরেছিল। কিছুতেই আসতে দেবে না।

    হঠাৎ ঝিনুক বলে ওঠে, যুগলদা তোমাকে এত ভালবাসে। তোমার ওপর কী টান! দু’চারটে দিন ওদের কাছে থেকে আসা উচিত ছিল।

    বিনু পূর্ণ দৃষ্টিতে ঝিনুকের দিকে তাকায়। এই কি সেই ঝিনুক, রাজদিয়া থেকে আসার পর তাকে এক দণ্ড না দেখলে যে কেঁদে কেটে পৃথিবী ভাসিয়ে ফেলত! সে-ই কিনা তাকে যুগলদের কাছে শুধু। আজকের দিনটাই না, আরও কটা দিন কাটিয়ে আসার কথা বলছে! শুনেও বিশ্বাস হতে চায় না।

    ঘরে ঢুকে ঝিনুককে যখন রেডিও সিলোন শুনতে দেখেছিল তখনই বিনু বুঝেছে, বেশ আনন্দেই আছে মেয়েটা। মুকুন্দপুরে যে সংশয়টা তার মস্তিষ্কে হুল ফোঁটাচ্ছিল, দেখা যাচ্ছে, সেটার কোনও কারণ নেই। এর ভেতর নিশ্চয়ই সুধাদের বাড়িতে এমন কিছু ঘটে নি বা বাইরের কেউ এসে এমন কিছু বলে নি যাতে ঝিনুক ফের কুঁকড়ে যায়, ফিরে আসে তার সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি।

    ঝিনুককে দেখে খুব ভাল লাগছিল বিনুর। বলল, এমনিই চলে এলাম। আসল হেতুটা তো আর জানানো যায় না।

    গভীর আগ্রহে হিরণ জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলে জায়গাটা?

    বিনু সবিস্তার সব জানালো।

    হিরণ বলে, খুঁজে খুঁজে অমন একটা জায়গা বার করেছে। জঙ্গল কেটে কলোনি বসিয়েছে। সাপখোপ আর জমিদারের গুণ্ডাবাহিনীর সঙ্গে ফাইট করে নিজেদের এস্টাব্লিশ করতে চেষ্টা করছে। সবই আমাকে জানিয়েছে যুগল। কিন্তু তুমি যা ডেসক্রিপশন দিলে, এতটা ভাবতে পারি নি। ইস্ট পাকিস্তান থেকে এসে যারা রিফিউজি ক্যাম্পে আর রেল স্টেশনে ধুকে ধুকে মরছে তাদের যদি যুগলদের মতো সাহস, মনের জোর আর অ্যাডভেঞ্চারাস স্পিরিট থাকত!

    মাথা নেড়ে সায় দেয় বিনু।

    হিরণ বলতে লাগল, যুগল অনেক বার যেতে বলেছে। নানা কারণে যাওয়া হয় নি। এবার একদিন যেতে হবে।

    নিশ্চয়ই যাবেন। গেলে ওরা কী খুশি যে হবে।

    শুনতে শুনতে সুধা এবং ঝিনুকের ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। ঝিনুক জিজ্ঞেস করল,

    কিভাবে মুকুন্দপুরে যেতে হয়?

    বিনু মজার গলায় বলল, তুমি ওখানে যাবে নাকি?

    প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে ঝিনুক বলল, যুগলদা বলেছিল, আমাদের রাজদিয়ার অনেক মানুষ ওখানে গিয়ে ঘরবাড়ি তুলেছে। কারা কারা গেছে?

    সকলের নাম বলল বিনু। আরও জানালো শুধু রাজদিয়ারই না, গিরিগঞ্জ সিরাজদীঘা দেলভোগ রসুনিয়া, এমনি নানা জায়গার লোজন ওখানে আছে। সবই পরিচিত মুখ। মুকুন্দপুরে গেলে মনে হবে আরেক রাজদিয়া। যুগলরা পূর্ব বাংলার সেই জনপদটিকে অসীম মায়ায় সীমান্তের এপারে জঙ্গ ল নিমূল করে নতুন করে সৃষ্টি করছে।

    ঝিনুক উত্তর দিল না। ভেতরে ভেতরে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছে সে।

    মুখচোখের সামান্য পরিবর্তন লক্ষ করে ঝিনুকের মনোভাবটা আঁচ করে নেয় বিনু। রাজদিয়াবাসী যারা মুকুন্দপুরে এসে উঠেছে তারা কি আর রায়টের সময় তার লাঞ্ছনার খবরটা পায় নি? ওদের কাছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা, সেই সংশয় তাকে হয়তো বিচলিত করে তুলেছে। বিনু আর কোনও প্রশ্ন করল না।

    .

    রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিনুকে একলা পেয়ে ঝিনুক নতচোখে কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করে, যুগলদের ওখানে সবাই কি আমার কথা জানে?

    ঝিনুকের মাথায় কোন চিন্তাটা অবিরল ঘুরপাক খাচ্ছে, বুঝতে পারছিল বিনু। সে মনস্থির করে ফেলে। বলে, হা, জানে। কিন্তু ওখানে গেলে তোমার কোনও ভয় নেই।

    বিমূঢ়ের মতো ঝিনুক বলে, মানে?

    বিনু বুঝিয়ে দেয়, মুকুন্দপুরে তার মতো ধর্ষিত মেয়ে আরও অনেকে আছে। এমনকি পাকিস্তানে বেশ ক’টি যুবতী মেয়েকে জল্লাদেরা কেড়ে নিয়ে যাবার পর তাদের শোকাতুর মা-বাবারা ওখানে এসে উঠেছে।

    যে মেয়েরা পাকিস্তানে সম্রম খুইয়ে, অশেষ নির্যাতন ভোগ করে মুকুন্দপুরে এসেছে, কেউ তাদের ঘেন্না করে না। গায়ে থুতু দেয় না। অছুতের মতো দূরে সরিয়ে রাখে না। এইরকম মেয়ে তো একটা দুটো নয়। কে কাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেবে? বরং মুকুন্দপুরবাসীরা নিবিড় সহানুভূতিতে, গভীর মমতায় নিজেদের কাছে এদের টেনে নিয়েছে। পাছে ওরা কষ্ট পায়, পুরনো দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ফের ওদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে, তাই চরম ইত্যানির কথা কেউ মুখেও আনে না।

    শুনতে শুনতে মুখ আলোয় ভরে যায় ঝিনুকের। বলে, ওরা তো খুব ভাল

    হ্যাঁ। এবার যেতে আপত্তি নেই তো?

    না।

    .

    ৩.৩৭

    মুকুন্দপুর থেকে ফেরার পর দুদিন কেটে গেল। এর মধ্যে একটা বড় কাজ সেরে ফেলেছে বিনু। শওকত আলিদের খান মঞ্জিল’-এর সঙ্গে তাদের রাজদিয়ার বাড়ি এক্সচেঞ্জ করার কথাবার্তা আগেই মোটামুটি পাকা করে ফেলেছিল হিরণ। কিন্তু সুধা ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছিল, কিছুতেই ও বাড়িতে যাবে না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে রাজি করিয়েছে বিনু। তবে আরও একটা মস্ত বাধা আছে। হিরণের জেঠিমা। তাঁকে রাজি করানোর দায়িত্ব বিনুর নয়, হিরণের। সুধারও।

    .

    এখন বিকেল।

    হিমঋতু লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। আজকাল দুপুরের পর সূর্য পশ্চিম দিকে একটু ঢলে পড়লেই উত্তুরে হাওয়া দ্রুত জুড়িয়ে যায়। রোদের রং ক্রমশ মলিন হতে থাকে।

    বাড়িতে এখন বিনু আর উমা ছাড়া অন্য কেউ নেই। হিরণের ছুটি ফুরিয়ে গেছে। সে অফিসে। সন্ধের আগে ফিরবে না। সুধা ঝিনুককে নিয়ে দুপুরে ভবানীপুরে গেছে। কী সব কেনাকাটা করবে। তারপর ওদিক সেদিক বেড়িয়ে তাদেরও ফিরে আসতে আসতে সন্ধে পেরিয়ে যাবে।

    বিনু কাল একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখে হিরণকে দিয়েছিল। দরখাস্তের খসড়াটা করে দিয়েছে হিরণ। সে তাদের ফুড ডিপার্টমেন্টে ওটা কালই জমা করেছে। আজ অফিসে বেরুবার সময় আরও তিনটে দরখাস্ত লিখে রাখতে বলে গেছে। একটা দেওয়া হবে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে, একটা পি ডরু ডি’তে, আর একটা এক্সাইজে। কোথায় চাকরি হবে তা তো বলা যায় না। চেষ্টা করতেই হবে। পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে এসেছে বিনু। বর্ডার স্লিপও পেয়েছে। চাকরি বাকরি একটা কিছু জুটেও যাবে। সমস্যা অবশ্য আছে। তার ডিগ্রি টিগ্রিগুলো খোয়া গেছে। নিত্য দাসও এর ভেতর আসে নি। সে না এলে হেমনাথকে খবর পাঠিয়ে ডিগ্রিগুলোর ব্যবস্থা করা যাবে না। তবে অ্যাপ্লিকেশন দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তো ইন্টারভিউর জন্য ডাক আসবে না। আশা করা যায়, তার মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হিরণ সেইরকম আশার কথা শুনিয়েছে। তারপর দেখা যাক।

    বাইরের ঘরের এক কোনায় টেবল চেয়ার রয়েছে। সেখানে বসে হিরণের কথামতো অ্যাপ্লিকেশনগুলো লিখছিল বিনু। ভেতরের কোনও একটা ঘরে খুটখাট করে কী যেন করছে উমা।

    নিচে থেকে কড়া নাড়ার আওয়াজ ভেসে এল। লিখতে লিখতেই বিনু উমাকে বলল, দেখ তো উমা, কে এসেছে এখন হিরণদের কারও ফেরার কথা নয়। তা হলে কে আসতে পারে?

    যাই মামাবাবু–

    উমা ব্যস্তভাবে একতলায় চলে গেল। একটু পরে কলকল করতে করতে তার সঙ্গে যে উঠে এল, এই মুহূর্তে কেন, আট দশ দিনের ভেতর তার কথা একবারও ভাবে নি বিনু। দরজার বাইরে ঝুমা। তার পেছনে আনন্দ।

    ঝুমাকে দেখামাত্র সারা শরীরে পুরনো সেই শিহরন খেলে যায় বিনুর। টেবল থেকে ত্বরিত পায়ে উঠে সে এগিয়ে আসে, আসুন আনন্দদা, এস ঝুমা–

    দু’জনে ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ে। বিনুও ওদের মুখোমুখি বসে।

    আনন্দ বলে, বাড়ি এত নিঝুম কেন? হিরণ নিশ্চয়ই অফিসে? সুধা আর ঝিনুক কোথায়? ওদের ডাকো–

    আমিই ডেকে আনছি–

    ঝুমা উঠতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিনু বলে, ওরা বাড়ি নেই। কোথায় গেছে, কখন ফিরবে, তাও জানিয়ে দিল।

    বলতে বলতে বিনু লক্ষ করল, ঝুমার চোখে ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। দুই ঠোঁটে রহস্যময় সংকেতের মতো চিকন একটু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। মনে হল, ঝিনুকরা না থাকায় সে খুশিই হয়েছে।

    সেদিন কলেজ থেকে সোজা আনন্দদের বাড়ি চলে গিয়েছিল ঝুমা। পরনে সিল্কের শাক্টিাড়ি থাকলেও তেমন একটা সাজে নি। আজ কিন্তু তার শতগুণ সেজে এসেছে। পাঁচ হাত দূরে বসে আছে এক পরমাশ্চর্য স্বপ্নের পরী। নাকি এক কুহকময়ী নারী? ঝুমার শাড়িটাড়ি থেকে সেন্টের তীব্র মিষ্টি গন্ধ উঠে এসে বিনুর স্নায়ুগুলোকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল।

    বিনু বলল, আপনারা এলেন, বড়দিকে আনলেন না কেন?

    আনন্দ বিব্রত বোধ করে, জানোই তো, ওর এখানে আসার অসুবিধা আছে। তাই–

    ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। হেমনলিনী চান না, ঝিনুক যতদিন সুধাদের কাছে আছে, তাদের বাড়ির মেয়েরা এখানে আসুক। বিনুর মনটা খারাপ হয়ে যায়।

    আনন্দ এবার বলল, তোমার জন্যে আজ অফিস ছুটি নিয়েছি।

    বিনু অবাক হল, কেন বলুন তো?

    বলতেই তো এসেছি। একটু ধৈর্য ধর। আনন্দ বলতে লাগল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা দরকারে ঝুমাদের ওখানে গিয়েছিলাম। ওর কলেজ আজ ছুটি। আমাকে ছাড়ল না। জোর করে সঙ্গে চলে এল।

    বিনু উত্তর দিল না। কী কারণে হঠাৎ আনন্দ এসেছে সেটা জানার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে থাকে।

    ঝুমা ভীষণ চঞ্চল, ছটফটে। এক জায়গায় চুপচাপ স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসা তার ধাতে নেই। হুট করে উঠে পড়ল সে। তোমরা গল্প কর। এ বাড়িতে অনেক দিন আগে সুনীতি মামীর সঙ্গে একবার মাত্র এসেছিলাম। সব মনেও নেই। ঘুরে ঘুরে একটু দেখি। চা খাবে তো?

    ঝুমার স্বভাবে অবাধ জলস্রোতের মতো কিছু আছে। সঙ্কোচ, জড়তা বা বাধোবাধো ভাবের লেশমাত্র নেই। যেখানেই যাক, মনে হয়, অনেকদিন ধরে রয়েছে। এ বাড়িতে সুধারা যখন নেই, আনন্দদের আপ্যায়নের দায়িত্ব যেন তারই।

    আনন্দ বলল, নিশ্চয়ই খাব। কিন্তু—

    ঝুমা বিনুকে জিজ্ঞেস করল, হিরণমামাদের কাজের মেয়েটার নাম যেন কী?

    বিনু বলল উমা—

    উমাকে চা করতে বলছি’ ঝুমা টুক করে বাইরে বেরিয়ে গেল।

    আনন্দ এবার বলল, যেভাবে আমাদের বাড়ি থেকে তোমাদের চলে আসতে হয়েছে, সে জন্যে আমার লজ্জার শেষ নেই। তোমার বড়দি দুদিন খুব কেঁদেছে। আমারও কী খারাপ যে লেগেছে, বলে বোঝাতে পারব না।

    আনন্দর দুঃখ বা অনুতাপ যে যথেষ্ট আন্তরিক, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না বিনুর। প্রসঙ্গটা অপ্রিয়, অস্বস্তিকর। সেটা এড়ানোর জন্য বলল, ওসব কথা থাক আনন্দদা

    আনন্দ আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, সেই ভাল। এখানে কেমন আছে ঝিনুক?

    আগের থেকে অনেক নর্মাল। বেশ হাসিখুশি। পুরনো শকটা প্রায় কাটিয়ে উঠেছে।

    পাংশু মুখে খানিকক্ষণ বসে থাকে আনন্দ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমরা পারি নি। হিরণ আর সুধা যে মেয়েটার মুখে হাসি ফোঁটাতে পেরেছে, শুনে খুব ভাল লাগছে।

    বিনু উত্তর দিল না।

    আনন্দ জিজ্ঞেস করে, শেষ পর্যন্ত কী ঠিক করলে?

    বুঝতে না পেরে বিনু বলে, কী ব্যাপারে?

    রাজদিয়া থেকে বি.এ পাস করে এসেছ। পড়াশোনাটা চালিয়ে গেলে ইউনিভার্সিটিতে এখনই ভর্তি হতে হয়। আর যদি চাকরি টাকরি কর–

    এই কথাটা হিরণও তাকে বলেছে। সে জানালো, চাকরির কথাই ভাবছি আনন্দদা। শুনেছি রিফিউজিদের এ ব্যাপারে গভর্নমেন্ট থেকে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। সেটা নেওয়া উচিত। হিরণদাও তাই বলছিল।

    চেষ্টা টেষ্টা করছ?

    হিরণদাদের অফিসে অ্যাপ্লাই করেছি। হিরণদা নিজে অ্যাপ্লিকেশনটা নিয়ে গিয়ে জমা দিয়েছে। অন্য অন্য অফিসে পাঠাবার জন্য আরও তিনটে দরখাস্ত লিখতে বসেছিলাম, আপনি আর ঝুমা এসে গেলেন।

    হিরণ কী বলছে, ওদের ওখানে হয়ে যাবে?

    সবে তো দরখাস্ত জমা পড়েছে। যাতে কাজটা হয়, হিরণদা সেজন্যে লেগে আছে। আমার ইচ্ছে, চাকরি পেলে প্রাইভেটে এম.এটা দিয়ে দেব।

    গুড আইডিয়া।

    একটু চুপ।

    তারপর আনন্দ বলে, আমি একটা চাকরির খবর নিয়ে এসেছি। যদি রাজি হও, এখনই হয়ে যেতে পারে।

    অফিস ছুটি নিয়ে এ বাড়িতে আনন্দর আসার উদ্দেশ্যটা এতক্ষণে জানা গেল। বিনুর সর্বাঙ্গে তড়িৎপ্রবাহ বয়ে যায়। হিরণের অফিসে সবে দরখাস্ত জমা পড়েছে। কবে সেখান থেকে ডাক আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আনন্দর কাজটা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। উৎসুক সুরে বিনু জিজ্ঞেস করল, কী ধরনের চাকরি?

    আনন্দ বিশদভাবে জানায়। তার বাবা যখন হাইকোর্টে প্রাকটিস করতেন, একজন বড় বিজনেসম্যান ছিলেন তার ক্লায়েন্ট। কয়েকটা ইণ্ডাস্ট্রি তাঁর ছিল। ভদ্রলোক অত্যন্ত, বুদ্ধিমান এবং দূরদশী। দেশ চিরকাল পরাধীন থাকবে না, ইংরেজকে সুদূর ভারতবর্ষের কলোনি থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পালাতে হবে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য পৃথিবীর এই ভূখণ্ডে চিরদিনের মতো অস্তাচলে যাবে বহুকাল আগেই তিনি তার আঁচ পেয়েছিলেন। তখন থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, সশস্ত্রই হোক বা অহিংস, গোপনে গোপনে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইংরেজদের সংকট যখন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে, সাহায্যের মাত্রাটা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, দেশের রাজ্যপাট একদিন এদের হাতেই আসবে। ব্যবসা বাণিজ্য কলকারখানা চালাতে গেলে নতুন শাসকদের অনুগ্রহ দরকার। অর্জুনের সেই মাছের চোখের মতো লক্ষ্যটা এরকম হলেও, দেশপ্রেম বা আদর্শবাদ তাঁর একেবারেই যে ছিল না তা নয়।

    এই বিজনেসম্যান ভদ্রলোক, জগদীশ গুহঠাকুরতা, স্থির করেছেন, একখানা বাংলা দৈনিক কাগজ বার করবেন। অনেক দূর এগিয়েও গেছেন। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে তাঁদের একটা বড় তেতলা বাড়ি আছে। সেখানে অফিস খোলা হয়েছে। প্রেস, লাইনো মেশিন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনা হয়ে গেছে। সাংবাদিক থেকে শুরু করে নানা ডিপার্টমেন্টে কিছু কিছু লোকও নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির আরও নেওয়া হবে।

    খবরটা কানে আসামাত্র বালিগঞ্জে জগদীশবাবুর বাড়ি ছুটেছিল আনন্দ। বাবার জুনিয়র হিসেবে একসময় কিছুদিন হাইকোর্টে আনাগোনা করেছিল সে। তখন থেকেই জগদীশের সঙ্গে আলাপ। মাঝে মাঝে ভদ্রলোক তাদের বাড়িতে আসতেন। এখনও আসেন। আনন্দরাও বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, এমনি নানা অনুষ্ঠানে ওঁদের বাড়ি যেত। এখনও যায়। ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কের মতো দাঁড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। আনন্দর বাবার মৃত্যু হয়েছে, হাইকোর্টে যাওয়া কবেই

    ছেড়ে দিয়েছে সে, তবু জগদীশ গুহঠাকুরতার সঙ্গে যোগাযোগটা থেকেই গেছে।

    বিনুর কথা জানানো মাত্র জগদীশ তাকে আজকালের মধ্যে নিয়ে যেতে বলেছেন। আনন্দ জিজ্ঞেস করল, কবে যাবে বল–

    বিনু বলল, খবরের কাগজের কাজ তো আমি কিছুই জানি না। এ সম্পর্কে আমার কোনও, ধারণাই নেই।

    আনন্দ হাসল, ধর হিরণদের ফুড ডিপার্টমেন্টে কি অন্য কোনও অফিসে তোমার চাকরি হল। সে সব জায়গার কাজকর্ম সম্বন্ধে তোমার ধারণা আছে?

    ত নেই।

    কাজ করতে করতেই সবাই শিখে নেয়। সুযোগটা যখন এসে গেছে, ছেড়ো না। পরে ভাল চাকরি পেলে এটা ছাড়তে কতক্ষণ?

    একটু চিন্তা করে বিনু বলল, ঠিক আছে। কবে যেতে বলছেন?

    আজ যেতে পারবে?

    বাড়িতে কেউ নেই। ছোটদিদের না জানিয়ে বেরুনো ঠিক হবে না।

    তা হলে কালই যাওয়া যাবে।

    বিনু আস্তে ঘাড় হেলাল।

    আনন্দ বলল, জগদীশবাবু সন্ধেবেলা ওঁদের খবরের কাগজের অফিসে আসেন। তুমি বিকেলে আমাদের বাড়ি চলে এস। আমি আমার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাড়ি থেকে তোমাকে নিয়ে জগদীশবাবুর কাছে চলে যাব।

    মুখটা পলকের জন্য থমথমে হয়ে গেল বিনুর। ধীরে ধীরে বলল, আপনার অফিসের ঠিকানাটা দিন। আমি বরং সেখানে চলে যাব। আপনি ওখান থেকে আমাকে নিয়ে যাবেন।

    বিনু কেন তাদের বাড়ি যেতে চাইছে না, তার দ্বিধা এবং ক্ষোভটা কী কারণে, সবই বুঝতে পারছে আনন্দ। এ নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন করল না। বলল, বেশ। অফিসের ঠিকানাটা লিখে নাও–

    কোণের টেবল থেকে কাগজ কলম এনে লিখে নিল বিনু।

    উমা একটা ট্রে’তে চা এবং প্রচুর মিষ্টি টিষ্টি দিয়ে গেল। আনন্দর সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্কটা তার খুব ভাল করেই জানা আছে। সুধারা নেই। তাদের ঘনিষ্ঠ পরিজনদের আদরযত্নে বিন্দুমাত্র ত্রুটি হতে দেয় না সে। তা ছাড়া, ঝুমাও নিশ্চয়ই তাকে চায়ের কথা বলেছে।

    বিনু শুধু চায়ের কাপটাই তুলে নিয়েছে। দু’এক চুমুক দেবার পর বলল, আমার একটা কৌতূহল হচ্ছে আনন্দদা–

    কী কৌতূহল?

    জগদীশবাবু তো বললেন কী সব বিজনেস করেন, কলকারখানাও বসিয়েছেন। তিনি হঠাৎ খবরের কাগজ বার করতে চলেছেন কেন?

    আনন্দ হাসল, স্বাধীনতার পর খবরের কাগজও তো বিগ বিজনেস হয়ে উঠছে। তবে এর পেছনে ওঁর অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কিনা, আমার জানা নেই। একটু থেমে ফের বলে, জলে ফেলার জন্যে কেউ লাখ লাখ টাকা ঢালে না।

    কথা বলতে বলতে হঠাৎ বিনুর চোখে পড়ল, দরজার বাইরে দেওয়াল ঘেঁষে নিজেকে যতটা সম্ভব আড়ালে রেখে হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে ঝুমা। আনন্দ যেখানে বসেছে সেখান থেকে ঝুমাকে দেখা যায় না।

    রাজদিয়ায় পুজোর ছুটিতে গিয়ে সেই যে ঝুমা বিনুর নাকে একটা অদৃশ্য বড়শি আটকে দিয়েছিল সেটা এখনও বিধেই আছে। কী যে দুরন্ত, অদম্য আকর্ষণ এই তরুণীর! রক্তস্রোতে চমক খেলে যেতে লাগল বিনুর। যাদুকরীর মতো ক্রমাগত ইঙ্গিতে টেনেই চলেছে সে।

    নিজের অজান্তেই যেন উঠে দাঁড়ায় বিনু। আনন্দদা, আপনি চাটা খান। আমি একটু ভেতর থেকে আসছি–

    বাইরে আসতেই ঝুমা বিনুকে পেছন দিকের একটা চওড়া ব্যালকনিতে নিয়ে গেল। এখান থেকে ট্রাম রাস্তার দিকের অনেকখানি অংশ দেখা যায়।

    বেলা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বিবর্ণ, নিস্তেজ সূর্য পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথায় এখনও আলগাভাবে আটকে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওটা টুপ করে গাছপালার আড়ালে খসে পড়বে।

    বাতাসে হিম আর কুয়াশা মিশে যাচ্ছে। যেদিকে, যতদূর চোখ যায়, সন্ধে নামার তোড়জোড় চলছে।

    বিনুর গা ঘেঁষে ব্যালকনির রেলিংয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা। তার গা থেকে সেন্টের সেই উগ্র গন্ধটা বিনুর নাকের ভেতর দিয়ে হাড়মজ্জায় ঢুকে যাচ্ছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে তার।

    ঝুমা বলল, মামা আনতে চাইছিল না। তবু আমি জোর করে চলে এসেছি। কেন জানো?

    ঝুমার উত্তরটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছে বিনু। তবু জিজ্ঞেস করল, কেন?

    হাঁদারাম, বুঝতে পার না? তোমার জন্যে।

    গায়ে কাঁটা দিল বিনুর। এই মেয়েটা যখন সদ্য কিশোরী, একটি চুম্বনে নরনারীর সম্পর্কের অপার রহস্যময় পৃথিবীর দরজা তার সামনে খুলে দিয়েছিল। কোন গহন অভিসন্ধি নিয়ে সে আজ এখানে হাজির হয়েছে, কে জানে।

    ঝুমা এবার বলল, ঝিনুক আর সুধা মাসি নেই। ভালই হয়েছে। তোমাকে একলা পাওয়া গেছে। ঝিনুক থাকলে তোমার সঙ্গে কথাই বলা যেত না।

    বিনু উত্তর দিল না।

    ঝুমা বলতে লাগল, রোজই আশা করে থাকি, আমাদের বাড়ি আসবে। কিন্তু একদিনও এলে না।

    বিনু ঝুমার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। বলে, এখানে এসে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, এত জায়গায় ছোটাছুটি করতে হচ্ছে যে অন্য কোনও দিকে মন দেবার সময় পাচ্ছি না। সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে না-যাবার কারণটা খাড়া করল সে, তা ছাড়া–

    কী?

    সেদিনই তো বলেছি, কলকাতায় যখন এসেছি, কোথাও না কোথাও তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

    সে তো ঝিনুক তোমার পাশে বসে ছিল বলে। একটা সত্যি কথা বলবে?

    কী?

    ঝুমা সোজা বিনুর দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। পলকহীন। তার দু’চোখে সম্মোহনের মতো কী যেন ঘন হয়ে আসে। বলে, আমার সঙ্গে দেখা করতে তোমার ইচ্ছা হয় না?

    বিনু চুপ করে থাকে।

    ঝুমা চোখ সরায় নি। বিনুর মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, করে। বলতে লজ্জা হচ্ছে, তাই না? তার গলার স্বর চাপা শোনায়।

    বিনু এবারও নীরব।

    ঝুমা আরেকটু নিবিড় হয়ে আসে। বলে, ঝিনুককে তুমি খুব ভয় পাও। ওর জন্যে আমাদের বাড়ি যাও না। কি, ঠিক বলছি?

    বিনু চোখ নামিয়ে নেয়। ঝুমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না সে।

    ঝুমা হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে, ঝিনুককে তুমি কলকাতায় নিয়ে এলে কেন?

    বিনু হতচকিত। এমন একটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। একটু চুপ করে থেকে, আস্তে আস্তে বলল, তুমি জানো না, ওর কত বড় ক্ষতি হয়েছে। পুরোপুরি অ্যাবনর্মাল হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানে একেবারেই থাকতে চাইছিল না। সারাক্ষণ কান্না আর কান্না। দেশে থাকলে ও মরে যেত। চোখের সামনে একটা মেয়ে ভয়ে আতঙ্কে কেঁদে কেঁদে মারা যাবে, সহ্য করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ থেমে, গম্ভীর গলায় বলে, মেয়েটা বড় দুঃখী।

    ঝুমার মুখচোখ কোমল হয়ে এল। সামান্য অনুতপ্ত কি? ভারী গলায় বলল, জানি ঝিনুক খুব দুঃখী। ওর জন্যে আমারও যথেষ্ট সিমপ্যাথি আছে। কিন্তু–

    কী?

    অন্য সমস্যাগুলো তুমি বোধ হয় আগে ভেবে দেখ নি?

    কোন কোন সমস্যার কথা বলছ?

    ঝুমা বুঝিয়ে দিল। একটি ধর্ষিত মেয়ের পক্ষে এই সমাজে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। মানুষ এখনও হাজারটা সংস্কারের কুয়োয় আটকে আছে। তার মনের প্রসার কবে ঘটবে, আদৌ ঘটবে কিনা, কেউ জানে না। উদারতা, মহত্ত্ব, এই সব দামী দামী শব্দ বইয়ের পাতাতেই শুধু সাজানো থাকে।

    ঝুমা বলতে লাগল, আমার মামাবাড়িতে তো ঝিনুককে নিয়ে গিয়েছিলে। থাকতে পারলে? আমার দিদা কী নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছে, সব শুনেছি। সুধামাসিরা শেলটার দিয়েছে, কিন্তু সে আর ক’দিন? হিরণ মেশোর দাদু আর জেঠিমা শিগগির পাটনা থেকে চলে আসবেন। তোমার বাবারও ফিরে আসার সময় হয়েছে। আমার মনে হয় না, ঝিনুকের মতো একটা মেয়েকে ওঁরা কেউ মর্যাদা দিয়ে বাড়িতে থাকতে দেবেন।

    এগুলো নতুন কথা নয়। বিনু নিজেও সহস্র বার ভেবেছে। যেটা তাকে অবাক করল, ঝিনুককে নিয়ে সে কোন সংকটে পড়েছে, এবং ভবিষ্যতে তার সমস্যা আরও কতটা ঘোরালো হয়ে উঠবে, সে সম্বন্ধে কুমার ধারণা আছে। তার চিন্তাশক্তি খুবই স্বচ্ছ। মেয়েটাকে যতটা চটুল মনে হোক, আদপে সে কিন্তু তা নয়।

    বিনু বলল, পাকিস্তানে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে ওকে না এনে উপায় ছিল না। দাদু আর দিদারাও নিয়ে আসতে বলল। তখন অন্য কিছু ভাবার মতো সময় বা মানসিক অবস্থা কারোর ছিল না।

    ঝুমা বলল, সবই বুঝলাম। কিন্তু ঝিনুককে কেউ যখন নিজেদের কাছে থাকতে দেবে না, ওই মেয়েকে নিয়ে কী করবে তুমি? কোথায় যাবে? তা ছাড়া–

    এই সব চিন্তা কদিন আগেও অবিরল বিনুকে অস্থির করে রেখেছিল। সুধাদের কাছে এসে কিংবা মুকুন্দপুরে গিয়ে রাজদিয়া এলাকার পরিচিত মানুষজনের মধ্যে একটা দিন একটা রাত কাটিয়ে, তাদের আন্তরিকতায় সে এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে ঝিনুককে নিয়ে সংকটের কথা ভাবে নি। কয়েক দিনের জন্য দুশ্চিন্তাটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। ঝুমা মনে করিয়ে দিতে মস্তিষ্কের কোনও গোপন কুঠুরি থেকে দঙ্গল বেঁধে সমস্যাগুলো বেরিয়ে এল।

    বুকের ভেতর কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে। ঝুমা তার পুরনো দুর্ভাবনা এবং ত্রাস ফিরিয়ে এনেছে। মলিন মুখে সে জিজ্ঞেস করে, তা ছাড়া কী?

    সারাক্ষণ তুমি ঝিনুককে আগলে আগলে রাখতে পারবে না। মামা তোমার জন্যে চাকরির ব্যবস্থা করেছে। খবরের কাগজেই হোক, বা অন্য কোথাও, কাজ তোমাকে করতেই হবে। অফিসে তো আর ঝিনুককে নিয়ে যেতে পারবে না। তখন সে কোথায় থাকবে?

    ঝুমা যা বলল তার এক বর্ণও মিথ্যে নয়। বিনু যেন চোখের সামনে দেখতে পেল, এই সমস্যাগুলো ক্রমশ বিশাল আকার নিয়ে বেড়াজালের মতো তাকে ঘিরে ফেলছে। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জানি না, জানি না–

    অনেকক্ষণ চুপচাপ।

    হেমন্তের বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মিহি কুয়াশা নামছে, সেই সঙ্গে হিমও। চারদিক ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, মহানগর যেন সারা গায়ে উলঙ্গবাহার শাড়ি জড়াতে শুরু করেছে।

    অনেকক্ষণ চুপচাপ।

    তারপর একেবারে অন্য কথায় চলে গেল ঝুমা। গাঢ় গলায় বলল, আমার একটা কথা রাখবে?

    অন্যমনস্কর মতো বিনু জিজ্ঞেস করে, কী?

    আমাদের বাড়ি তোমাকে যেতে হবে না।

    তাদের বাড়িতে যাবার জন্য সেদিনও কত জোরাজুরি করেছে ঝুমা। কত অভিমান। হঠাৎ মতটা পালটে গেল কোন যাদুমন্ত্রে? বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সে।

    ঝুমা থামে নি, আমাদের বাড়ি গেলে সবাই ঝিনুকের কথা জিজ্ঞেস করবে। তোমার ভীষণ অস্বস্তি হবে। তার চেয়ে এক কাজ করো–

    কী?

    আমার কলেজের নামটা মনে আছে তো?

    আছে। স্কটিশ চার্চ। কেন?

    তুমি ওখানেই চলে যেও। আমার হিস্ট্রি অনার্স, ফার্স্ট ইয়ার। ভাল নাম শতরূপা। হিস্ট্রি ক্লাসে খোঁজ করলেই আমাকে পেয়ে যাবে।

    ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। গোপনে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে ঝুমা। সেই পুরনো শিহরনটা নতুন করে বিনুর রক্তস্রোতে চমক দিয়ে যায়।

    ঝুমা ব্যগ্র সুরে বলতেই থাকে, যাবে তো বিনুদা? আমি কিন্তু তোমার আশায় অপেক্ষা করে থাকব। কেউ কিছু জানতেও পারবে না।

    হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন হঠাৎ সহস্র গুণ বেড়ে যায় বিনুর। ঝুমা যে সংকেতটা দিয়েছে তাতে মাথা ঝিম ঝিম করছে। তার শরীর থেকে সেই তীব্র সুঘ্রাণ, তার কথা বলার ভঙ্গি, তার তাকানো বিনুর স্নায়ুগুলোকে ফের বিবশ করে ফেলে।

    বিনু কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চোখে পড়ল, সামনের রাস্তা দিয়ে সুধা আর ঝিনুক আসছে। তাদের দু’জনের হাতেই মোটাসোটা সুদৃশ্য কাপড়ের ব্যাগ। বোঝা যায়, প্রচুর কেনাকাটা করেছে।

    বিনু লহমায় ঘোরের ভেতর থেকে উঠে আসে। ভীষণ ব্যস্তভাবে বলে, চল চল, ওরা এসে গেছে– সে আর দাঁড়ায় না। স্তভাবে ব্যালকনি থেকে বাড়ির ভেতর দিকে চলে যায়। কুমার সঙ্গে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ঝিনুক তুলকালাম বাধিয়ে দেবে।

    ঝুমা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। মুখটা ক্রমশ শক্ত হয়ে ওঠে। চোখে ক্ষণিকের জন্য ঝিলিক খেলে যায়। তারপর ধীরে ধীরে সেও ভেতরে চলে আসে।

    .

    উমা ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বিনু ব্যালকনি থেকে সোজা বাইরের ঘরে চলে আসে। সুধারা দুটো কাগজ রাখে। একটা বাংলা, একটা ইংরেজি। যুগান্তর’ এবং হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড। সঙ্গী টঙ্গী নেই। অগত্যা একা একা বাইরের ঘরে বসে আনন্দ মর্নিং এডিশনের কাগজগুলো এই সন্ধেবেলাতেও উলটে পালটে দেখছিল। বিনুকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, কোথায় ছিলে?

    একটা সোফায় বসতে বসতে বিনু বলল, ওধারের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ঝুমার সঙ্গে কথা বলছিলাম।

    ঝুমা এসে অন্য একটা সোফায় বসে। বলে, আমাদের কলেজের গল্প করছিলাম মামা। কোন প্রফেসর কিরকম পড়ান, কে দারুণ ফাঁকিবাজ, কোন স্টুডেন্ট ক্লাস পালিয়ে চৌরঙ্গিতে ইংলিশ পিকচার দেখতে যায়, কে মেয়েদের জ্বালাতন করে, এই সব।

    বিনু হাঁ হয়ে যায়। কেউ যে বানিয়ে বানিয়ে এত মসৃণভাবে ডাহা মিথ্যে বলতে পারে, কে জানত! ঝুমার মুখ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। মনে হয়, যুধিষ্ঠিরের পর এমন সত্যবাদী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি জন্মায় নি।

    আনন্দ এ নিয়ে আর কিছু জানতে চাইল না। নিচের দরজা খোলা ছিল। একটু পরেই সুধা আর ঝিনুক বাইরের ঘরে এসে ঢুকল। আনন্দদের দেখে সুধা খুব খুশি। বলল, ঝুমা, আনন্দদা, আপনারা কখন এসেছেন? হাতের ব্যাগ মেঝেতে নামিয়ে সে বসে পড়ল।

    আনন্দ বলল, প্রায় ঘন্টা দেড়েক।

    ইস। আসবেন, আগে জানান নি কেন? ঝিনুককে গিয়ে ভবানীপুরে গিয়েছিলাম। আজ না হয় না-ই যেতাম।

    ভবানীপুরের খবরটা বিনুর কাছে পেয়েছি। হঠাৎ একটা দরকারে আসতে হল। জানাবার সময় পাই নি।

    দরকারের কথা পরে হবে। চা খেয়েছেন?

    শশব্যস্তে সুধা উঠতে যাচ্ছিল। বড় ভগ্নিপতি এবং তার ভাগনীকে আপ্যায়ন করাটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে আনন্দ বলল, চা মিষ্টি, সব খাওয়া হয়েছে। তুমি ছিলে না। হোস্টের ভূমিকাটা সুন্দরভাবে পালন করেছে ঝুমা। উমাকে দিয়ে চা করিয়ে খাইয়েছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ঝিনুক এখনও দাঁড়িয়ে আছে।

    আনন্দ ঝিনুককে বলল, বসো–

    একটু দূরে দু’টো মোড়া খালি পড়ে আছে। তার একটায় নিঃশব্দে বসল ঝিনুক।

    বাইরের ঘরে ঢোকার পর থেকেই ঝিনুকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বিনু। পলকের জন্য নজর সরায় নি।

    ঝিনুকের মুখে পর পর কত কিছুই যে ফুটে উঠছে। এই হয়তো ভয়, পরক্ষণে সংশয়, তারপরেই উত্তেজনা বা বিতৃষ্ণা। এই সে তাকাচ্ছে বিনুর দিকে। পরমুহূর্তে তার চোখ চলে যাচ্ছে ঝুমার মুখের। ওপর। একবার বিনু। একবার ঝুমা। দু’জনকে দেখতে দেখতে সূক্ষ্মভাবে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করছে।

    আনন্দ সুধা আর ঝুমা এলোমেলো গল্প করে যাচ্ছিল। বিনুকে কিছু বললে খুব সংক্ষেপে সে। উত্তর দিচ্ছে। ঝিনুক প্রায় চুপচাপ। তার চোখ অনবরত দুটি মুখের ওপর পাক খাচ্ছে। আনন্দরা তাকে আড্ডার মধ্যে টেনে আনতে কম চেষ্টা করছে না। ঝিনুক শুধু অন্যমনস্কর মতো হুঁ হাঁ করে যাচ্ছে।

    কিছুক্ষণের মধ্যে হিরণ অফিস থেকে ফিরে এল। আজ্ঞা নতুন করে জমে ওঠে। ফের চা আসে, ফের খাবার।

    রাত একটু বাড়লে ঝুমা বলল, মামা, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কাল সাড়ে দশটা থেকে আমার ক্লাস–

    আনন্দ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, হ্যাঁ হ্যাঁ, এখুনি বেরুব। হিরণ এবং সুধাকে বলল, বিনুর একটা চাকরির ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম। ওকে সব জানিয়েছি। তোমরাও শোন।

    সবিস্তার সব বলল আনন্দ। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দিল না। তারপর জিজ্ঞেস করল, বিনু রাজি আছে। তোমরা কী বল?

    সুধা বলল, খবরের কাগজের চাকরি। বিনু তো এ ধরনের কাজ আগে করে নি। পারবে কি?

    আনন্দ বলল, বিনুও সেই কথাই বলছিল। এত লোক পারছে, ও-ই বা পারবে না কেন? কাজ। করতে করতে শিখে নেবে। একটু ভেবে বলল, জার্নালিস্টই যে হতে হবে, তার কোনও মানে নেই। নিউজ পেপারে কত ডিপার্টমেন্ট আছে। যেখানে সুটেবল মনে হবে সেখানেই জগদীশবাবু ওঁকে প্লেস করে দেবেন।

    সুধা বলল, গভর্নমেন্ট সারভিস হলে ভাল হত।

    আনন্দ বলল, শুনলাম হিরণ ওদের ডিপার্টমেন্টে চেষ্টা করছে। সেটা–

    তাকে থামিয়ে দিয়ে হিরণ বলল, সরকারি চাকরি তো বললেই হয়ে যায় না। যদ্দিন না হচ্ছে, বসে থাকবে কেন? যেটা হাতে এসেছে, নিয়ে নেওয়াই ভাল।

    সুধা আর আপত্তি করে না।

    আনন্দ উঠে পড়তে পড়তে বলে, বিনু, কাল ঠিক সময়ে আমার অফিসে চলে যেও।

    বিনু মাথা নাড়ে, আচ্ছা—

    .

    রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিনুকে একা পেয়ে চাপা গলায় ঝিনুক বলে, ঝুমা এসেছিল কেন?

    বিনু বলল, এতক্ষণ ছিল। ওকে জিজ্ঞেস করলেই পারতে।

    তোমাকে করছি। তুমি উত্তর দাও।

    ওর মামা ওকে নিয়ে এসেছে, তাই এসেছে। এখানে আমার কিছু করার নেই।

    কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ঝিনুক। নিষ্পলকে। তারপর বলে, বাড়িতে কেউ নেই, দু’জনে খুব মজা করলে, তাই না?

    বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে বিনুর। ঝিনুকের কথায় কোন সংকেত রয়েছে, নিমেষে টের পেয়ে যায় সে। এর মধ্যেই বুঝে গেছে, এই মেয়েটিকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে অনেকখানি কৌশল। প্রয়োজন। দরকার কিছুটা কপটতার। গম্ভীর মুখ করে বিনু বলে, বাড়িতে উমা আর আনন্দদা ছিল। মজা করবার সময় পাওয়া যায় নি। চাকরির খবর নিয়ে আনন্দদা এসেছিল। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তোমরা এসে গেলে।

    সারাক্ষণ চাকরির কথাই বলছিলে? ঝিনুক বলতে লাগল, একবারও আলাদা করে ঝুমা তোমার সঙ্গে গল্প করে নি?

    সুনীতিদের বাড়িতে প্রায় এমনটাই ঘটেছিল। ঝিনুক তখন একতলায়। দোতলায় ছিল বিনু সুনীতি মাধুরী আর ঝুমা। ঝিনুক ধরেই নিয়েছিল, ঝুমা সুযোগ করে নিয়ে তাকে কাছে পেতে চেষ্টা করেছে। ঝুমা সম্পর্কে সন্দেহটা কোনও দিনই বুঝিবা ঘুচবে না ঝিনুকের।

    বিনু বলল, আনন্দদাকে তো এখন পাচ্ছ না। উমা আছে। তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখ। বলেই এস্ত হয়ে ওঠে। ঝোঁকের মাথায় বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হল। পরক্ষণে ভাবে, কাজের মেয়ের কাছে এমন একটা ব্যাপারে কি খোঁজ নিতে যাবে ঝিনুক? কিন্তু সন্দেহের কীট যার মাথায় অবিরত বিষ ঢালছে তার পক্ষে কোনও কিছুই কি অসম্ভব?

    আপাতত কটা দিন সহজভাবে শ্বাস নিতে পারবে না বিনু।

    .

    ৩.৩৮

    ডালহৌসি স্কোয়ারে আনন্দদের অফিস। সেখানে কিভাবে, কোন রুটের ট্রাম বা বাস ধরে যেতে হবে, জলের মতো বুঝিয়ে দিয়েছিল সে।

    সুধাদের বাড়ি থেকে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে ট্রামই ধরল বিনু। চল্লিশ মিনিটের ভেতর ডালহৌসি পৌঁছে গেল। যেদিকেই তাকানো যাক, একটা প্রকাণ্ড দীঘি ঘিরে বিশাল বিশাল সব বিল্ডিং।

    আনন্দদের অফিসটা ক্লাইভ স্ট্রিটে। মস্ত ঘড়িওলা জি.পি.ও’র পাশ দিয়ে উত্তর দিকে মিনিট তিনেক হাঁটলেই বাঁ ধারের ফুটপাতে ক্রফোর্ড ম্যানসন। আনন্দ বলে দিয়েছিল, এই বাড়ির তেতলায় সে বসে।

    রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে করে ক্রফোর্ড ম্যানসন’-এ চলে এল বিনু। ব্রিটিশ আমলের বিরাট বাড়ি। গেটে উদি-পরা শিখ দারোয়ান। ছফিটের ওপর হাইট। মাথায় পাগড়ি। জবরদস্ত চেহারা। ভয়ে ভয়ে তার পাশ দিয়ে বিল্ডিংয়ে ঢুকলেই রিসেপশন। কাঁচের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা সাজানো গোছানো, এয়ার কণ্ডিশনড চেম্বারে একটি ঝকঝকে অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান তরুণীকে দেখা গেল। তাকে এড়িয়ে ভেতরে যাবার উপায় নেই। কী করবে, বুঝে উঠতে পারছিল না বিনু। রাজদিয়ায় যার জীবনের বেশির ভাগটাই কেটে গেছে তার পক্ষে এই ধরনের অফিসের কায়দা কানুন জানার কথা নয়।

    রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বিনুকে দেখতে পেয়েছিল। হাতের ইশারায় চেম্বারে ডেকে বলল, ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?

    সারা শরীরে অঢেল, উগ্র যৌবন। নখে ঠোঁটে গালে চড়া রং। বাদামি চুল কাধ পর্যন্ত ছাঁটা। পরনে টাইট স্কার্ট আর চাপা শার্ট। তার গা থেকে পারফিউমের ঝাঁঝাল গন্ধ উঠে আসছিল।

    মেয়েটা সাত আট ফুট দূরে বসে আছে। বিনু আর তার মাঝখানে ওভাল শেপের গ্লাস-টপ টেবল, তিন চারটে টেলিফোন, পেন হোল্ডারে নানারকম কলম, টেবল ক্যালেণ্ডার, ভিজিটরস স্লিপের ক’টা প্যাড, ইত্যাদি।

    এ ধরনের মেয়ের এত কাছাকাছি আসা তো দূরের কথা, আগে কখনও চোখে দেখে নি বিনু। হেমন্তের এই শীতল বেলাশেষে ঘামতে লাগল সে। নাকমুখ ঝা ঝাঁ করছে।

    ঢোক গিলে পেঁয়ো উচ্চারণে, ইংরেজিতেই বিনু তার আসার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দিল।

    রিসেপশনের একধারে অনেকগুলো সোফা আর সেন্টার টেবল রয়েছে। আছে ক’টা রঙিন ইংরেজি ম্যাগাজিন। মেয়েটি সোফাগুলো দেখিয়ে বলল, প্লিজ সিট দেয়ার একটা ফোন তুলে কার সঙ্গে যেন কথা বলে সেটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বিনুর দিকে তাকাল, একটু অপেক্ষা করুন–

    মিনিট পাঁচেকও বসতে হল না। আনন্দ এসে হাজির। মেয়েটা তা হলে আনন্দকেই ফোনে তার আসার খবরটা দিচ্ছিল।

    সোফার কোণে সিটিয়ে বসে ছিল বিনু। এক পলক তাকে দেখল আনন্দ। পরক্ষণে তার চোখ চলে গেল রিসেপশনিস্ট মেয়েটির দিকে। বিনুর আড়ষ্টতার কারণটা আঁচ করে নিল সে। বলল, চল, বেরুনো যাক।

    আনন্দকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বিনু। বলল, আপনার ছুটি পাঁচটায়। এখন সবে চারটে পাঁচ। এক্ষুনি বেরুবেন?

    নো প্রবলেম। আমার ডিপার্টমেন্টের আমিই টপ ম্যান। কখন বেরুব না-বেরুব, সে জন্যে কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। তা ছাড়া, জগদীশবাবুর সঙ্গে আজ সকালে আমার কথা হয়েছে। তোমাকে সোয়া পাঁচটা নাগাদ নিয়ে যেতে বলেছেন। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে যেতেও তো খানিকটা সময় লাগবে।

    বিনু কিছু বলল না।

    অফিসের বাইরে এসে আনন্দর একটু মজা করতে ইচ্ছা হল, লিজার সামনে অমন কাঠ হয়ে বসে ছিলে কেন?

    জানা গেল রিসেপশনিস্ট মেয়েটির নাম লিজা। মুখ লাল হয়ে ওঠে বিনুর। বলে, না, মানে–

    কলকাতায় এসেছ। এরকম কত মেয়ের সঙ্গে আলাপ হবে। ট্রাই টু বি স্মার্ট। গা থেকে রাজদিয়ার গন্ধটা যত তাড়াতাড়ি পার, ঝেড়ে ফেল। নইলে এখানে টিকতে পারবে না।

    আচ্ছা আনন্দদা—

    বল—

    আপনাদের অফিসে বুঝি সোজাসুজি ভেতরে যাওয়া যায় না?

    আনন্দ আন্দাজ করে নিল, বিনুর মাথায় লিজা এখনও ভর করে আছে। বলল, ব্রিটিশ কোম্পানির অফিস তো। তাদের কিছু কায়দাকানুন আছে। রিসেপশানিস্টের গ্লু দিয়েই ভেতরে যেতে হয়। আচ্ছা–

    বিনু উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়।

    আনন্দর চোখ থেকে কৌতুক উপচে পড়ছিল। বিনুকে আরেকটু খোঁচাতে চাইছিল সে। বলল, লিজার সামনে কয়েক মিনিট তো বসে ছিলে। রিয়ালি বিউটিফুল, সাঙ্ঘাতিক ফিগার। কি, ঠিক বলছি?

    আরেক বার মুখটা আরক্ত হল বিনুর। তবে সে লিজার ধার কাছ দিয়েও গেল না। বলল, ইণ্ডিয়া তো স্বাধীন হয়ে গেছে। এখনও এদেশে ব্রিটিশ কোম্পানি আছে?

    প্রচুর। তবে বেশিদিন থাকবে না। পাঁচ সাত বছরের ভেতর ইণ্ডিয়ানদের হাতে কারবার টারবার বেচে দিয়ে দেশে ফিরে যাবে।

    ফুটপাত ধরে ওরা খানিকটা এগিয়ে এসেছিল।

    আনন্দ এবার জিজ্ঞেস করল, কিভাবে যাবে বল?

    বুঝতে না পেরে বিনু বলল, কিভাবে বলতে?

    ট্যাক্সি নিলে মিনিট পনের কুড়ির ভেতর পৌঁছে যাব। তবে ওখানে গিয়ে জগদীশবাবুর জন্যে ওয়েট করতে হবে। আমার ইচ্ছে হেঁটেই যাই। তা হলে এই অফিস পাড়াটা মোটামুটি তোমাকে চিনিয়ে দিতে পারব। তাই একটু আগে আগে অফিস থেকে বেরুলাম।

    সোয়া পাঁচটার মধ্যে পৌঁছতে পারব তো?

    নিশ্চয়ই। ওখানে যাওয়াটাই তো আসল ব্যাপার।

    বিনু বলল, হেঁটেই চলুন। কলকাতাটা ভাল করে চেনা দরকার।

    রাইটার্স বিল্ডিং, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্র্যাবোর্ন রোড, বৌবাজার স্ট্রিট, চিৎপুর রোড, নাখোদা মসজিদ, ইত্যাদি দেখাতে দেখাতে ওরা হ্যাঁরিসন রোডের ক্রসিংয়ে চলে এল। সেখান থেকে ডান দিকে ঘুরে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ।

    জগদীশ গুহঠাকুরতাদের কাগজের অফিসটা বিবেকানন্দ রোডের কাছাকাছি। বিনুরা যখন সেখানে এল, পাঁচটা বেজে দশ। পাঁচ মিনিট আগেই তারা পৌঁছে গেছে।

    .

    তেতলা বাড়িটা পুরনো হলেও বেশ মজবুত। ভিত এত শক্তপোক্ত যে অনায়াসে আরও তিরিশ চল্লিশ বছর টিকে যাবে। দেখতে আহামরি কিছু নয়। খুবই সাদামাঠা। কারুকার্যহীন।

    ভেতরে ঢুকতেই বিনুর চোখে পড়ল, বিশাল একটা হল-ঘর। সেটার একদিকে ছাপাখানা। বেশ কিছু লোজন সেখানে রয়েছে। একটা লম্বা ধরনের মস্ত যন্ত্রে ঝড় তুলে কী যেন ছাপা হচ্ছে। আনন্দ বলল, ওটা রোটারি মেশিন। জগদীশবাবুরা যে কাগজ বার করবেন, সেটা এই মেশিনেই ছাপা হবে। এখন তার ট্রায়াল চলছে।

    হল-ঘরের আরেক দিকে তিনটে লাইনো মেশিনের সামনে বসে তিনটে লোক বোম টিপে টিপে কম্পোজ করে চলেছে। মেশিনগুলো বিনুকে চিনিয়ে দিল আনন্দ। এ দিকেই এক কোণে বিরাট বিরাট গোলাকার চাকার মতো বিদেশি নিউজপ্রিন্টের রিল উঁই হয়ে পড়ে আছে।

    হল-ঘরের শেষ প্রান্তে চওড়া চওড়া সিঁড়ি। আনন্দরা দোতলায় এল। এখানেও মস্ত হল-ঘরে কাঠ আর কাঁচ দিয়ে তৈরি ছোট বড় অনেকগুলো ছোট বড় খুপরি। সেগুলোর ভেতর কিছু লোজন দেখা গেল।

    আনন্দ বিনুকে সঙ্গে করে এবার সোজা তেতলায় উঠে এল। নিচের ফ্লোর দুটোর মতো এখানেও একই মাপের হল-ঘর। সেটার আধাআধি জুড়ে প্রচুর চেয়ার টেবল পাতা রয়েছে। বাকি অর্ধেকটায় কাঁচ দিয়ে ঘেরা অনেকগুলো চেম্বার। কয়েকটা চেম্বারে কিছু লোকজন দেখা গেল। বাকিগুলো ফাঁকা।

    একটা টেলিপ্রিন্টার মেশিন অবিরল খটখট আওয়াজ তুলে হিল্লিদিল্লির খবর নিয়ে আসছে। ওটার মুখ থেকে লম্বা কাগজে সেই সব সংবাদ বেরুচ্ছে একটানা। ছেদহীন।

    টেলিপ্রিন্টারের কার্যকারিতা বুঝিয়ে দিয়ে হল-ঘরের শেষ প্রান্তে সবচেয়ে বড় চেম্বারটার সামনে চলে এল আনন্দরা।

    চেম্বারের দরজার সামনে উঁচু টুলে বসে ছিল একটি অল্প বয়সের বেয়ারা। ত্বরিত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, সাহেব আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন–

    বিনু আন্দাজ করে নিল, এখানে আনন্দর যাতায়াত আছে। বেয়ারাটা তাকে চেনে।

    চেম্বারের ভেতরে যেতেই বিনু দেখতে পেল, বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবলের ওধারে রিভলভিং চেয়ারে যিনি বসে আছেন তার বয়স পঁয়ষট্টি ছেষট্টি। মাঝারি হাইট। টকটকে ফর্সা রং। লম্বা ধাঁচের মুখ। শরীরে কিছু মেদ জমেছে, এই বয়সে যেমনটা হয়। চওড়া কপাল। এই বয়সেও প্রচুর চুল। তবে বেশির ভাগই সাদা। চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। পরনে ঢোলা ট্রাউজার্স, শার্ট এবং কোট। তাঁর সমস্ত চেহারায় শান্ত গাম্ভীর্য। তিনিই যে জগদীশ গুহঠাকুরতা, না বলে দিলেও চলে।

    জগদীশ বললেন, এস আনন্দ। বসো

    পুরো চেম্বারটার মেঝে জুট কার্পেট দিয়ে মোড়া। এক পাশের দেওয়াল ঘেঁষে ঝকঝকে নতুন দু’টো আলমারি।

    জগদীশের টেবলে তিনটে টেলিফোন। সাত আটটা পেন। অজস্র ফাইল। এধারে দর্শনপ্রার্থীদের জন্য গদিমোড়া, আরামদায়ক আট দশটা চেয়ার।

    জগদীশ চেয়ারগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আনন্দরা বসে পড়ল।

    অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল বিনুর। সেটা কি ভয়? নার্ভাসনেস? মৃদু উত্তেজনা? না কি সব কিছুর মিশ্রণ? আনন্দ যদিও শতকরা একশ ভাগ আশ্বাস দিয়েছে, তবু সে জানে, টেবলের উলটো প্রান্তে বসে-থাকা রাশভারী মানুষটির ইচ্ছা বা মর্জির ওপর তার চাকরি নির্ভর করছে।

    বিনুকে দেখিয়ে জগদীশ আনন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, এর কথাই তো বলেছিলে?

    হ্যাঁ। আনন্দ মাথা হেলায়।

    জগদীশ ধীর, স্থির, তীক্ষ্ণবুদ্ধি মানুষ। কোনও রকম তাড়াহুড়ো নেই। ছোট ছোট ক’টি প্রশ্ন করে বিনুর শিক্ষাগত যোগ্যতা, পাকিস্তান থেকে সে কবে এসেছে, সেখানকার পরিস্থিতি কতটা আতঙ্কজনক কলকাতায় আসার সময় বিপদে পড়তে হয়েছিল কিনা, ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন।

    ঝিনুকের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বাকিটা ঠিক ঠিক বলে গেল বিনু। এমনকি জগদীশ জানতে না চাইলেও তার সার্টিফিকেট এবং ডিগ্রি কিভাবে খোয়া গেছে তাও শোনাল।

    ডিগ্রি টিগ্রিগুলোর ব্যাপারে আপাতত খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না জগদীশ। ওগুলো পরে আনিয়ে দিলেও চলবে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আনন্দকে কথা দিয়েছি, আমার কাগজে তোমাকে নিশ্চয়ই নেব। কাগজে অনেক ডিপার্টমেন্ট থাকে। সার্কুলেশন, অ্যাকাউন্টস, রিপোর্টিং, প্রুফ রিডিং, সাব এডিটিং–এমনি কত কী। কোথায় কাজ করতে চাও?

    বিনুর সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল। এখন সে নিশ্চিত, এখানে চাকরি তার হচ্ছেই। আনন্দ অলীক আশ্বাস দেয় নি। কাঁপা গলায় বলল, আমি আগে কোথাও কাজ করি নি। চাকরির কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আপনি যেখানে বলবেন–

    জগদীশ বিনুর সঙ্গে কথা বলে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। বললেন, ইয়াং ম্যান, তোমাকে এমন একটা কাজ দিতে চাই, যার মধ্যে চ্যালেঞ্জ আছে। বলেই বেল বাজালেন।

    শশব্যস্ত সেই বেয়ারাটা দৌড়ে চেম্বারে চলে আসে। জগদীশ বললেন, তারাপদবাবুকে আমার চেম্বারে আসতে বল। এখুনি যেন চলে আসেন।

    কিছুক্ষণ পর মাঝবয়সী তারাপদ এলেন। পাতলা চুল, গোল মুখ। শ্যামবর্ণ। একহারা মেদহীন চেহারা। পুরু লেন্সের আড়ালে ঝকঝকে, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরনে ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি। পায়ে মোটা সোলের চপ্পল।

    জগদীশ বিনুর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ হল বিনু, মানে বিনয়। আর উনি তারাপদ ভৌমিক, আমাদের কাগজের নিউজ এডিটর। তারাপদকে বললেন, এই ছেলেটি দিন কয়েক আগে পাকিস্তান থেকে এসেছে। ওকে আমাদের কাগজে নিচ্ছি। বিনয় পাকিস্তানে যা চলছে তার ভিভিড ডেসক্রিপশন দিচ্ছিল। রিফিউজি প্রবলেম তো এখন ইণ্ডিয়ার একটা জ্বলন্ত সমস্যা। কবে যে তা মিটবে, কেউ জানে না। অন্য সব কাগজে রিফিউজিদের নিয়ে লেখালিখি নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু আমরা এই বিষয়টার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই। একটু থেমে বললেন, বিনয় যা বলল সেটা কাগজে বেরুলে সেনসেশন হবে। তবে ও কিরকম লিখতে পারবে, জানি না। আপনার সঙ্গে ওকে নিয়ে যান। একটা ছোট কিছু লিখতে দিয়ে দেখুন, কতটা কী পারে। আধ ঘণ্টা পর ওকে নিয়ে আমার কাছে আসবেন।

    তারাপদ ভৌমিকের কামরাটা হল-ঘরের অন্য প্রান্তে। মানুষটি সহৃদয়, স্নেহপ্রবণ। নতুন করে পাকিস্তানে তার নানা অভিজ্ঞতার কথা তাঁকে বলতে হল। গভীর মনোযোগে সব শুনে তিনি বিনুকে রামরতন গাঙ্গুলির শোচনীয় মৃত্যুর ঘটনাটা লিখতে বললেন।

    বিনুর চোখের সামনে দৃশ্যটা ভাসছে। কুড়ি বাইশ মিনিটের ভেতর সেটা লিখে ফেলল সে।

    মাত্র আড়াইটা পাতা। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললেন তারাপদ। দু’চারটে সংস্কৃত-ঘেঁষা খটমট শব্দ বাদ দিলে লেখার স্টাইলটা ভাল। নির্ভুল, ঝরঝরে বাংলা।

    তারাপদ খুঁত শুধরে দিয়ে বললেন, খবরের কাগজ কলেজ ইউনিভার্সিটির পণ্ডিত মাস্টারমশাইরাই শুধু পড়ে না। নাইন্টি পারসেন্ট হল সাধারণ আধা-শিক্ষিত পাঠক। শক্ত শক্ত শব্দ লিখলে তারা বুঝতে পারবে না। ভাষাটা সহজ না হলে তাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করা যাবে না। কথাটা মনে থাকবে?

    থাকবে। ঘাড় হেলিয়ে দেয় বিনু। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, লেখাটা ঠিক হয়েছে?

    উত্তর না দিয়ে তারাপদ বললেন, চল আমার সঙ্গে। বিনুকে সঙ্গে করে জগদীশের চেম্বারে আবার এলেন তিনি।

    জগদীশ উৎসুক চোখে তাকালেন।

    তারাপদ বললেন, ল্যাংগুয়েজের ওপর দখল আছে। লেখার স্টাইল ভাল। ছোট একটা পিস লিখতে দিয়েছিলাম। রিয়ালি গুড। মনেই হয় না আনকোরা, ইন-এক্সপিরিয়েন্সড একটা ছেলে লিখেছে।

    একজন পাকা বার্তা-সম্পাদক এমন ঢালাও প্রশংসা করবেন, ভাবতে পারে নি বিনু। ভেতরে ভেতরে প্রবল উদ্দীপনা বোধ করছিল সে। সেই সঙ্গে বিহ্বলও হয়ে পড়েছিল।

    জগদীশ জিজ্ঞেস করলেন, কী হিসেবে ওকে নিলে ভাল হয়? সাব-এডিটর, না রিপোটার?

    তারাপদ বললেন, আমার তো মনে হয়, রিপোর্টিংয়ে দিলে যথেষ্ট ভাল করবে।

    ঠিক আছে। আপনাকে আর আটকে রাখব না।

    তারাপদ চলে গেলেন।

    জগদীশের আগের সেই গাম্ভীর্য এখন অনেকখানি উধাও। তারাপদর সুপারিশ তাকে খুশি করেছে। হাসিমুখে বিনুকে বললেন, এ মাস তো শেষ হয়ে এল। আমার ইচ্ছা, নেক্সট মান্থের এক তারিখ থেকে জয়েন কর। অসুবিধে নেই তো?।

    আজই চাকরিটা হয়ে যাবে, কল্পনাও করে নি বিনু। মনে মনে ডানা মেলে মহাকাশে উড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল তার। বলল, না না, কোনও অসুবিধে নেই।

    জগদীশ বললেন, গুড। তবে একটা কথা প্রথমেই বলে রাখি—

    জিজ্ঞাসু চোখে বিনু তাকায়।

    জগদীশ বলেন, আমাদের নতুন কাগজ। এখনও পাবলিকেশন শুরু হয় নি। খুব বেশি কিছু এক্সপেক্ট করো না। আপাতত ট্র্যাভেল এক্সপেন্স মিলিয়ে দেড়শ’র মতো পাবে।

    বিনু চুপ করে থাকে।

    আনন্দ তার হয়েই জবাবটা দেয়, ঠিক আছে। আসছে মাস থেকে ও কাজ শুরু করে দেবে।

    জগদীশ বললেন, নিউজপেপারের প্রসপেক্ট যথেষ্ট ভাল। স্বাধীনতার পর থেকে লোকে নানা খবর জানতে চায়। রিডারশিপ বাড়ছে। আমাদের কাগজ দাঁড়িয়ে গেলে এমপ্লয়ীরা বঞ্চিত হবে না।

    .

    ৩.৩৯

    নিত্য দাস কথা রেখেছে। ঠিক তের দিনের মাথায় হেমনাথের চিঠি নিয়ে হাজির হল। লোকটা যে করিঙ্কৰ্মা, তাতে আর বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।

    যথারীতি সুধাদের দোতলার ড্রইং রুমে নিত্যকে বসানো হয়েছে। তার মুখোমুখি বসেছে হিরণ, বিনু এবং সুধাও। হেমনাথ বিনুর চিঠির কী উত্তর দিয়েছেন তা জানতে বিনুদের মতো সুধাও ভীষণ উগ্রীব। ঝিনুক অবশ্য আসে নি। সে ভেতর দিকের একটা ঘরে রয়েছে। নিত্যকে সে পছন্দ করে না। তবে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় টান টান। বাইরের ঘরে কী কথা হয়, শোনার জন্য তার শ্বাসপ্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গেছে।

    পকেট থেকে মুখবন্ধ একটা মোটা খাম বার করে বিনুর হাতে দিতে দিতে নিত্য দাস বলল, এই ন্যান (নিন) হ্যামকুত্তার জবাব–

    খামটা নিয়ে বিনু জিজ্ঞেস করল, কী লিখেছে দাদু?

    নিত্য দাস হাসল, হেয়া (তা) আমি ক্যামনে জানুম? জবাবখান তো খামের ভিতরে। পইড়া দ্যাখেন–

    বিনু বুঝল, প্রশ্নটা আহাম্মকের মতো হয়ে গেছে। খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠি বার করল সে। হেমনাথের হাতের লেখা একটু টানা হলেও খুবই পরিচ্ছন্ন। কাটাকুটি নেই। সাধু বাংলায় তিনি চিঠিপত্র লেখেন।

    বিনু পড়তে লাগল :

    কল্যাণীয় বিনু,

    তোমরা রাজদিয়া হইতে চলিয়া যাইবার পর কী উৎকণ্ঠার ভিতর আমাদের দিন কাটিয়াছে, বুঝাইয়া বলিতে পারিব না। রাজেকের মুখে শুনিয়াছি, মহা বিপদের মধ্যে তোমরা তারপাশার স্টিমারঘাটায় পৌঁছাইয়াছিলে। যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যু ঘটিতে পারিত। তারপাশায় যাইবার পর কী হইয়াছে, জানিতে পারি নাই।

    যাহা হউক, তোমরা শেষ পর্যন্ত শত বিপত্তির মধ্যেও যে কলিকাতায় যাইতে পারিয়াছ, ইহা ঈশ্বরের অশেষ করুণা।

    লিখিয়াছ, বর্তমানে সুধা এবং হিরণের বাড়িতে নিরাপদে আছ। অবনীমোহন তীর্থধর্ম সারিয়া কলিকাতায় ফিরিলে তাহার নিকট চলিয়া যাইবে। সুনীতিদের সম্পর্কে কিছু জানাও নাই। উহাদের সঙ্গে কি তোমার দেখাসাক্ষাৎ হয় নাই?

    বর্তমানে রাজদিয়া সম্পর্কে তোমাকে কিছু সংবাদ দিতেছি। এখানকার অবস্থা আগের তুলনায় অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ। চারিদিকের গ্রামগঞ্জে হঠাৎ রাজাকারদের উৎপাত বাড়িয়া গিয়াছে। তবে রাজদিয়ায় এখনও তাহারা হানা দেয় নাই। তোমরা চলিয়া যাইবার পর কিছু বিহারী মুসলমান ইণ্ডিয়া হইতে আসিয়া এখানে প্রচণ্ড উৎপাত করিতেছে। আমাকে না হইলেও অন্যদের প্রকাশ্যেই শাসাইতেছে। উদ্দেশ্য, হিন্দুরা চলিয়া গেলে তাহাদের জমিজমা বাড়িঘর দখল করিয়া বসা।

    মানুষের মনোবল প্রায় ধসিয়া পড়িয়াছে। প্রতিদিন দলে দলে তাহারা দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে। এই ভাঙন রোধ করিবার উপায় নাই।

    সাধারণ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, নিরীহ মানুষজনকে দোষ দিয়া কী হইবে? গান্ধীজি একবার স্থির করিয়াছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে আসিয়া থাকিবেন। হয়তো আসিতেন, কিন্তু তাহার পূর্বেই নিহত হইলেন। তিনি আসিলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি হয়তো বদলাইয়া যাইত।

    তোমার খুব সম্ভব মনে নাই, সাতচল্লিশের অক্টোবরে এক প্রার্থনাসভায় গান্ধীজি পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহারা যেন দেশত্যাগ না করে। ঈশ্বর ছাড়া অন্য কাহাকেও ভয় পাওয়ার কারণ নাই। যাহারা প্রকৃত সাহসী শাসানির ভয়ে তাহারা কেহ পিতৃপুরুষের ঘরবাড়ি ছাড়িয়া আসে না। আত্মসম্মান নষ্ট হওয়ার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়।

    পরবর্তী কালে বহু ভারতীয় নেতার মুখেও প্রায় একই উপদেশ শোনা গিয়াছে। দূর হইতে উপদেশবর্ষণ করা অনেক সহজ। তাঁহাদের নিকট আমার বিশেষ আর্জি, ছদ্মবেশে, প্রহরীহীন অবস্থায় একবার আসিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়া যান।

    তুমি তো জানো, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে এই বঙ্গের শিক্ষিত সম্প্রদায় বলিতে যাহাদের বুঝি উকিল, অধ্যাপক, স্কুলশিক্ষক, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতা তাহাদের শতকরা নব্বই ভাগ ইণ্ডিয়ায় পলায়ন করিয়াছে। সাধারণ মানুষ কাহার ভরসায়, কাহার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিবে? পুলিশের নিকট অভিযোগ জানাইতে গেলে লাঞ্ছিত হইতে হয়। প্রশাসন সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। ভারত সরকার পাকিস্তানের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি না করিলে দেশত্যাগ বন্ধ হইবে না।

    তুমি সম্পত্তি বিনিময়ের যে কথা লিখিয়াছ তাহা যথেষ্ট উৎসাহজনক। শাজাহান সাহেবের জমিজমা এবং বাড়ির মূল্য আমাদের বিষয় আশয়ের সমান সমানই হইবে। সেদিক হইতে কোনও লোকসান নাই। তবু এই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত লইতে পারিতেছি না। তাহার কারণও জানাইতেছি।

    তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, পাকিস্তানকে ইসলামিক স্টেট বা মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হইয়াছে। কিছুকাল আগে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা করার দাবি নাকচ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। যদিও বাংলা অধিকাংশ পাকিস্তানির মাতৃভাষা।

    লিয়াকৎ আলির যুক্তি, যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, সুতরাং ইহার উপযোগী একটি ভাষা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে উর্দুই সর্বোত্তম। খাজা নাজিমুদ্দিন, সিন্ধু প্রদেশের প্রতিনিধি এন এইচ গজদার প্রমুখ অনেকেই উর্দুর পক্ষে সওয়াল করেন।

    পূর্ব পাকিস্তানের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কংগ্রেসের এস সি চট্টোপাধ্যায় বাংলার পক্ষে বলেন। তাঁহাদের যুক্তি, পাকিস্তানের প্রায় সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে চার কোটি বাংলাভাষী। কাজেই তাহা উপেক্ষা করা উচিত নয়। কিন্তু তাহাদের কথায় পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য কেহ কর্ণপাত করিতে চাহেন নাই। তবে পূর্ব পাকিস্তানের তমিজদ্দিন খান বলিয়াছিলেন, ধীরেনবাবু এবং এস সি চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

    যাহা হউক, সম্প্রতি বাংলাভাষার প্রতি উপেক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার হইয়াছে। ঢাকায় এবং অন্যান্য ক’টি শহরে তীব্র প্রতিবাদ চলিতেছে। এই প্রতিবাদ শুধু মুসলমানরাই করিতেছে না। হিন্দুদেরও তাহাদের পাশে টানিয়া লইতেছে। আমার বিশ্বাস, খুব শীঘ্রই পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটিবে। আমি সেই লক্ষণ দেখিতে পাইতেছি।

    শত্রু সম্পত্তি ঘোষণার কথা আমিও শুনিয়াছি। তবে এখনও তাহা কার্যকরী হয় নাই। আমি অন্তত তেমন কিছু জানি না।

    ভাষা লইয়া যে আন্দোলন শুরু হইয়াছে তাহাতে এই তমসাচ্ছন্ন সময়ে আলোর রেখা দেখা যাইতেছে। আমি তাই আরও কিছুকাল অপেক্ষা করিতে চাই।

    যে লোকটি তোমার পত্র লইয়া আসিয়াছে তাহার নাম জয়নাল। সে পাকিস্তানি, ফরিদপুরে বাড়ি। তোমার চিঠি কিভাবে পাইল, জিজ্ঞাসা করায় জানাইল, নিত্য দাস তাহাকে দিয়াছে। নিত্য নাকি জয়নালের মতো আরও বহু পাকিস্তানি মারফত সম্পত্তি বিনিময়ের কারবার করিতেছে। লোকটা যে অত্যন্ত ধুরন্ধর তাহা অনেক দিন ধরিয়াই জানি। অবশ্য একটা বিশেষ উপকার সে করিয়াছে। তোমার পত্র কৌশলে আমার নিকট পৌঁছাইয়া দিয়া দুর্ভাবনার অবসান ঘটাইয়াছে।

    জয়নালকে আমি কিছু টাকা দিয়াছি। সে বলিয়াছে, তুমি চিঠি লিখিলে সে নিত্য দাসের নিকট হইতে লইয়া আসিবে। আপাতত উহাদের মাধ্যমে তোমার সহিত যোগাযোগ রাখিতে হইবে।

    তোমার দুই দিদা এবং আমি ভাল আছি। সুধাদের কাছে ঝিনুক আনন্দে আছে, তাহার অপ্রকৃতিস্থ ভাবটা কাটিয়া গিয়াছে, ইহাতে নিশ্চিন্ত বোধ করিলাম।

    তোমাদের সকলের কুশল কামনা করি। আমাদের আশীর্বাদ এবং স্নেহ লইও। তোমার পত্রের আশায় রহিলাম।

    ইতি
    আশীর্বাদক দাদু

    চিঠিটা এক নিশ্বাসে পড়ে মুখ তুলল বিনু। সবাই ধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

    নিত্য দাস বলল, জয়নাল আমারে খবর পাঠাইছে, হ্যামকত্তা বাড়ি জমিন অহন এচ্চেঞ্জ করতে চান না। চিঠিতে কি হেই কথাই লেখছেন ছুটোবাবু?

    বিনু আস্তে মাথা নাড়ে, যা।

    আপনে তেনারে বুঝাইয়া আবার চিঠি দ্যান। লেখবেন, পাকিস্থানে হিন্দুরা থাকতে পারব না। দ্যাশের মায়ায় হেইখানে পইড়া থাইকা তেনি য্যান নিজের সব্বনাশ ডাইকা না আনেন। শাজাহান সাহেবরে কমু আর কয়দিন অপেক্ষা করেন। হুড়পার কইরা অন্যের জমিন জুমিনের লগে এঞ্জে (এক্সচেঞ্জ) কইরা য্যান না ফেলান।

    বিনু দ্রুত ভেবে নিল, হেমনাথকে তার খোয়ানো সার্টিফিকেট আর ডিগ্রির জন্য চিঠি তো লিখতেই হবে। তা ছাড়া, সম্পত্তি বিনিময়ের ব্যাপারে যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন সেটার ওপর বিশেষ ভাবে জোর দেবে। হেমনাথ বড় বেশি আবেগপ্রবণ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে তিনি যা ভাবছেন সেটা হয়তো অলীক স্বপ্নমাত্র। বাংলা ভাষার ব্যাপারে পূর্ব বাংলা যে খুবই ক্ষুব্ধ, পাকিস্তানের কাগজগুলোতেও তার কিছু কিছু রিপোর্ট বেরিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হল করাচি। অবাঙালি মুসলমানদের হাতেই সর্বস্ব। অর্থ, রাজনৈতিক শক্তি, সেনাবাহিনী। বাঙালি মুসলমানেরা সংখ্যায় বেশি হতে পারে কিন্তু অবাঙালিদের বিরুদ্ধে কতটা কী করতে পারবে, তাদের ক্ষোভ আদৌ বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে কিনা, সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সংশয় আছে। এই তো সেদিন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হল। এর মধ্যেই পূর্বপাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নব জাগরণ ঘটাবে, এতখানি আশাবাদী বিনু অন্তত নয়। সে হেমনাথকে লিখবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন কলকাতায় চলে আসার ব্যবস্থা করেন। অবশ্যই সম্পত্তি বিনিময় করে।

    নিত্য দাস বলল, আমার অন্যখানে এট্টা জরুরি কাম আছে ছুটোবাবু। অহনই উঠতে হইব। আপনে ভালা কইরা গুছাইয়া চিঠি লেইখা রাইখেন। দুই এক দিনের মইদ্যে আইসা আমি লইয়া যামু।

    নিত্য চলে যাবার পর ঝিনুকরা ছুটে বাইরের ঘরে চলে আসে। তিনজনেরই এক প্রশ্ন, হেমনাথ কী লিখেছেন?

    চিঠিটা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বিনু বলল, পড়ে দেখ—

    একে একে সবাই পড়ে ফেলল। প্রথমে ঝিনুক। তারপর সুধা। শেষে হিরণ।

    .

    ৩.৪০

    আরও সপ্তাহখানেক বাদে সন্ধেবেলায়, ভীষণ ব্যস্তভাবে অফিস থেকে ফিরে এল হিরণ।

    অন্য সব দিন তাকে লঘু মেজাজে দেখা গেছে। হাসিখুশি, আমুদে। ফিরেই সুধা আর ঝিনুককে নিয়ে চা খেতে খেতে জমজমাট আসর বসিয়ে দিত। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা, হইচই, মজার মজার গল্প। ছুটির দিনে কোথায় বেড়াতে যাবে তার পরিকল্পনা।

    আজ হিরণকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। কেমন যেন চিন্তাগ্রস্ত, চোখে মুখে অস্থিরতার ছাপ।

    বিনুরা তার পরিবর্তনটা লক্ষ করেছিল। সুধা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? তোমাকে আজ এরকম দেখাচ্ছে কেন?

    হিরণ জানায়, মাঝে মাঝে সে যেমন অফিস ছুটির পর ভবানীপুরে যায়, তেমনি আজও গিয়েছিল। অবনীমোহন উত্তরকাশী, আলমোড়া, হরিদ্বার, নানা তীর্থস্থান ঘুরে কাল কলকাতায় ফিরে এসেছেন। ধর্মের দিকে ঝোকার পর গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তখন থেকেই সংসারের সঙ্গে তার সম্পর্ক আলগা হয়ে গিয়েছিল। এবার যেন পার্থিব সমস্ত ব্যাপারে তাকে আরও বেশি উদাসীন মনে হয়েছে হিরণের। ঝিনুক আর বিনুর কথা জানাতে তাদের ভবানীপুরে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। কিন্তু সেই বলার মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই। বেশ ক’বছর বাদে ছেলের সঙ্গে দেখা হবে, অথচ তাকে কেমন যেন অবেগশূন্য মনে হল। এটাই হিরণকে ভাবিয়ে তুলেছে।

    হিরণ জিজ্ঞেস করল, কবে ভবানীপুরে যেতে চাও?

    বিনু ভেতরে ভেতরে ব্যকুল হয়ে উঠেছিল। বলল, এখনই যাব।

    হিরণ এবং সুধা বুঝতে পারছে, অবনীমোহনের কাছে যাওয়াটা বিনুদের পক্ষে কতটা জরুরি। কেউ বাধা দিল না।

    সুধা বলল, তা হলে চল। আমরা তোদের পৌঁছে দিয়ে আসি। বাবার সঙ্গেও অনেক দিন বাদে দেখা হবে।

    অবনীমোহনের সঙ্গে ঝিনুককে নিয়ে একাই দেখা করতে চায় বিনু। বাবা কতখানি বদলে গেছেন, ঝিনুকের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবেন, কিছুই অনুমান করা যাচ্ছে না। অবনীমোহন হয়তো সরাসরি ঝিনুক সম্পর্কে কিছু বলবেন। তারও কিছু বলার থাকবে। সুধা এবং হিরণ তার অত্যন্ত আপনজন, তবু আজ তাদের সঙ্গে আর কেউ থাকুক, সেটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।

    বিনু বলল, তোরা কাল যাস। আমি ঝিনুককে নিয়ে গিয়ে আগে বাবার সঙ্গে কথা বলি–

    তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়েছিল হিরণ। সুধা কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ওরাই যাক–

    স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সুধা কী অনুমান করে নিল। আর কিছু বলল না।

    দ্রুত পোশাক পালটে, ব্যাগে জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিনু আর ঝিনুক। হিরণ বড় রাস্তা পর্যন্ত এসে ওদের ট্রামে তুলে দিয়ে গেল।

    জোড়া সিটে পাশাপাশি বসে ছিল বিনুরা। প্রায় ফাঁকা ট্রাম চাকায় ধাতব আওয়াজ তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। বাইরে রাতের কলকাতার নানা দৃশ্য। আলো। ভিড়। বড় বড় বাড়ি। উঁচু উঁচু গাছ। পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটে যাওয়া অজস্র গাড়ি ঘোড়া।

    ঝিনুক কথা বলছিল না। বিনু লক্ষ করল, তার চোখে মুখে ফিরে এসেছে পুরনো উৎকণ্ঠা, ভয়, অস্থিরতা। বলল, অত ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

    এমন ভরসা বিনু আগেও বহুবার দিয়েছে। ঝিনুক উত্তর দিল না।

    .

    আধ ঘন্টার মধ্যে ভবানীপুরে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে সেই তেতলা বাড়িটায় পৌঁছে গেল বিনুরা।

    কুড়ি বাইশ দিন আগে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে শিয়ালদা স্টেশন থেকে অনেক রাতে এখানে এসেছিল তারা। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, দিশেহারা। সেদিন বাড়িটা অন্ধকারে ডুবে ছিল। দরজা-জানালা সব বন্ধ। অদ্ভুত নিঝুম। মনে হচ্ছিল ভুতে-পাওয়া। আজ কিন্তু প্রতিটি ঘরে আলো জ্বলছে। জানালাগুলো খোলা।

    সদর দরজা বন্ধ রয়েছে। এটা তাদেরই বাড়ি। তার বাবার তৈরি। তবু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিনু অনুভব করল, হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে গেছে। পরক্ষণে প্রায় মরিয়া হয়ে জোরে কড়া নাড়ল সে।

    কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিল মাঝবয়সী একটা কাজের লোক। পরনে খাটো ধুতি আর আধময়লা ফতুয়া। খুব ছেলেবেলায় একে দেখেছে কি? বিনুর মনে পড়ল না। খুব সম্ভব অবনীমোহন পরে ওকে রেখেছেন।

    লোকটা জিজ্ঞেস করল, কাকে চাইছেন?

    বিনু বলল, বাবা বাড়ি আছেন?

    লোকটা ধন্দে পড়ে গেল, আপনার বাবা! কে তিনি?

    বিনু অবনীমোহনের নাম করল।

    লোকটা এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আসুন আসুন। বাবুর মুখে আপনার কথা শুনিচি। পাকিস্থানে থাকতেন তো?

    হ্যাঁ—

    লোকটা দরজা বন্ধ করে বিনুদের সঙ্গে নিয়ে একটা লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে ওপরে যাবার সিঁড়ির কাছে চলে এল।

    বিনু জিজ্ঞেস করল, বাবা কোথায় আছেন?

    তিনতলায়—

    সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চারদিকে তাকাচ্ছিল বিনু। জাতিস্মরের মতো সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। কে কোন ঘরে থাকত, কোনটা ড্রইংরুম, কোনটা রান্নাঘর, কোনটা ভাঁড়ার ঘর, কোথায় বসে খাওয়া হত, ইত্যাদি।

    লোকটা তাদের প্রকাণ্ড একখানা ঘরে নিয়ে এল। এটা ছিল সুরমা আর অবনীমোহনের ঘর। মা নেই, রাজদিয়ায় চিতাভস্মে কবেই তিনি বিলীন হয়ে গেছেন।

    অবনীমোহন দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের ধারে একটা বিশাল মেহগনি কাঠের খাটে বসে আছেন। পরনে লুঙ্গির মতো করে পরা থান এবং গেরুয়া পাঞ্জাবি। তার ওপর পাতলা চাদর জড়ানো।

    বিনু লক্ষ করল, বাবার চেহারা আগের মতো পাতলা ছিপছিপে নেই। যথেষ্ট মেদ জমেছে। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। মুখ কাঁচাপাকা দাড়িতে ঢাকা। চোখে মুখে শান্ত, সমাহিত একটা ভাব। মনে হয়, অলৌকিক কোনও কিছুর মধ্যে মগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর খাটের পাশে উঁচু টেবলে অধোলঙ্গ, বিরাট বিরাট জটাওলা এক সাধুর বড় ফোটো। ফোটোটা ঘিরে ফুলের মালা। সামনে অনেকগুলো ধূপকাঠি জ্বলছে। ধূপের ধোঁয়ায়, ফুলের সুগন্ধে ঘর ভরে আছে।

    অন্য দিকের দেওয়ালগুলোর পাশে ভারী ভারী আলমারি, একটা মাঝারি লোহার সিন্দুক, ড্রেসিং টেবল, কটা চেয়ারও রয়েছে।

    কয়েক পলক বিনুর দিকে তাকিয়ে রইলেন অবনীমোহন। কৈশোরে যে ছেলেকে শেষ দেখেছেন, সে এখন পূর্ণ যুবক। তবু চিনতে অসুবিধা হল না। মৃদু হাসি ফুটল তার মুখে। নির্লিপ্ত সুরে বললেন, এস– দূরের চেয়ারগুলো দেখালেন, ওখান থেকে দুটো নিয়ে এসে কাছে বসো।

    বিনু আর ঝিনুক অবনীমোহনকে প্রণাম করে চেয়ার টেনে এনে বসল। বিনু লক্ষ করেছে, হেমনলিনীর মতো পা সরিয়ে নেন নি অবনীমোহন। অর্থাৎ ঝিনুক তার কাছে অচ্ছুৎ নয়। আশান্বিত হয়ে ওঠে বিনু।

    অবনীমোহন বললেন, সন্ধের একটু আগে হিরণ এসেছিল। তার মুখে তোমাদের সম্বন্ধে সব শুনলাম। ভেবেছিলাম, দু’একদিন পরে আসবে। হঠাৎ কী খেয়াল হতে জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন, খগেন–খগেন–

    সেই মাঝবয়সী লোকটা তেতলায় বিনুদের পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এল। অবনীমোহন তাকে বললেন, ওরা রাত্তিরে খাবে। তার ব্যবস্থা করো–

    আচ্ছা– খগেন চলে গেল।

    অবনীমোহন এবার বিনুর দিকে তাকালেন, খবরের কাগজে পড়ি পাকিস্তানের অবস্থা খুব খারাপ। দলে দলে রিফিউজি চলে আসছে। তোমরা এসে ভাল করেছ। তোমার হেমদাদু আর দিদাদের নিয়ে এলে না কেন?

    ওঁরা এলেন না। না আসার কারণ জানিয়ে দিল বিনু।

    কিছুক্ষণ নীরবতা।

    তারপর অবনীমোহন বললেন, তুমি নিশ্চয়ই অনেক আশা নিয়ে আমার কাছে চলে এসেছ। কিন্তু আমি কী অবস্থায় আছি, সেটা কি জানো?

    বিনু বলল, কিছু কিছু শুনেছি।

    কিছু কিছু নয়, সবটাই তোমার জানা দরকার।

    অবনীমোহন শুরু করলেন। রাজদিয়া থেকে আসামে গিয়ে কনট্রাক্টরি করে দু’হাতে অঢেল টাকা রোজগার করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে কলকাতায় চলে আসেন। তখন ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ব্যাঙ্ক গজিয়েছে। তার একটায় তার সমস্ত টাকা জমা রেখেছিলেন। সেই ব্যাঙ্কের মালিকরা রাতারাতি লাল বাতি জ্বালিয়ে সব টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আরও অনেকের মতো সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন অবনীমোহন। তবু নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছেন। বাড়ি মর্টগেজ দিয়ে এবং নানা জায়গা থেকে কিছু টাকা যোগাড় করে ফের অন্য ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও ডাহা ফেল। তার মাথায় এখন বিপুল ঋণের বোঝা।

    নতুন ব্যবসাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার সমস্ত উদ্যম, মনের জোর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার। আশাহীন, বিপর্যস্ত অবনীমোহন তখন উদভ্রান্তের মতো এখানে ওখানে ছুটছেন, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। সেই সময় অপার শান্তির সন্ধান পেলেন।

    জটাধারী সেই সাধুর ফোটোটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে অবনীমোহন বললেন, হঠাৎ একজন এঁর খোঁজ দিল। যোশিমঠে গিয়ে দর্শন পেলাম। এঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছি। আর কোনও দুঃখ নেই। টাকাপয়সা দু’দিনের মোহ মাত্র। সে সব নিয়ে এখন আর ভাবি না। জীবনে কোনটা লাভ, কোনটা লোকশান, গুরুদেব চোখে আঙুল দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

    অনন্ত বিস্ময়ে বাবাকে দেখছিল বিনু। এই কি তার আজন্মের চেনা অবনীমোহন! কখনও এক জায়গায় স্থিত হন নি। কত কী-ই না করে বেড়িয়েছেন! ব্যবসা, অধ্যাপনা, সুদূর পূর্ব বাংলায় জমিজমা কিনে চাষবাস। যুদ্ধের আমলে আসামে গিয়ে কনট্রাক্টরি। ফের ব্যবসা। ঝুঁকির পর ঝুঁকি। অ্যাডভেঞ্চারের পর অ্যাডভেঞ্চার। নির্বিঘ্ন, ঝঞ্ঝাহীন, এমন কোনও কিছুর প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। সেই অবনীমোহন কিনা শেষ জীবনে শান্তির সন্ধানে গুরুদেবের পদতলে আশ্রয় নিয়েছেন!

    অবনীমোহন বলতে লাগলেন, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিনু–

    কী সিদ্ধান্ত?

    আমার ঋণ সুদে আসলে বিরাট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই বাড়িটা বিক্রি করলে সেই ঋণ শোধ হয়ে হাতে কিছু টাকা থাকবে। ভেবেছিলাম, আমি তাই নিয়ে গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাব। কিন্তু তুমি এসে পড়েছ। নিশ্চয়ই ওপার থেকে কিছু আনতে পার নি। সেই টাকার অর্ধেকটা তোমাকে দেব।

    বিনুর মাথায় সমস্ত সৌরলোক খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে। এই বাড়ি বেচে দিলে ঝিনুককে নিয়ে কোথায় থাকবে সে? রুদ্ধশ্বাসে বলল, বাড়িটা কি কোনওভাবেই বাঁচানো যায় না বাবা?

    অসম্ভব। অঋণী থেকেই আমি মরতে চাই।

    ঘরের ভেতর হঠাৎ অন্তহীন নৈঃশব্দ নেমে আসে।

    একসময় অবনীমোহন বলেন, হিরণের মুখে শুনলাম, তুমি একটা চাকরি পেয়েছ।

    বিনু বলল, হ্যাঁ। আনন্দদা কাজটা যোগাড় করে দিয়েছেন। আসছে মাসে জয়েন করব।

    এটা ভাল খবর। একটু চিন্তা করে অবনীমোহন বললেন, তোমার সঙ্গে আমার একটা দরকারী কথা আছে। সেটা তোমাকেই শুধু বলতে চাই। ঝিনুক, তুমি পাশের ঘরে যাও। ওখানে খাট বিছানা চেয়ার টেয়ার সবই আছে।

    নতমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ঝিনুক।

    অবনীমোহন সোজাসুজি ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঝিনুকের খবরটা অনেক আগেই আমি পেয়েছি। ভীষণ দুঃখজনক ঘটনা। শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু

    নীরবে বাবাকে লক্ষ করতে থাকে বিনু।

    অবনীমোহন থামেন নি, ঝিনুককে যে পাকিস্তান থেকে আনলে, ওকে নিয়ে কী করবে ভেবেছ?

    ঠিক এই ধরনের প্রশ্ন সেদিন ঝুমাও করেছিল। বিনুর বুকের ভেতরটা আমূল কেঁপে যায়। সে উত্তর দেয় না।

    অবনীমোহন সমানে বলে যান, কোনও আত্মীয়স্বজন এমন মেয়েকে শেলটার দেবে কিনা সন্দেহ। তুমি যদি আলাদা বাড়ি ভাড়া করে ওকে নিজের কাছে রাখতে চাও, হাজারটা প্রশ্ন উঠবে। লোকে জানতে চাইবে মেয়েটা কে। তোমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? কী জবাব দেবে তখন? শুধু একটা পথ খোলা আছে–

    আবছা গলায় বিনু জিজ্ঞেস করল, কী?

    যদি তুমি ওকে বিয়ে কর, সমস্যাটা মিটতে পারে। কিন্তু আত্মীয়রা তোমাদের ত্যাগ করবে। তা ছাড়া, এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করার সাহস কি তোমার আছে?

    বিনুর মনে হল, তার চারপাশের সমস্ত পৃথিবী ধসে পড়ছে। বিষবাষ্পে-ভরা পূর্ব বাংলা থেকে কী নিদারুণ আতঙ্কের মধ্যে ঝিনুককে সীমান্তের এপারে নিয়ে এসেছে, শুধু সে-ই জানে। কিন্তু অবনীমোহন তাকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে দুরূহ সংকটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বিপন্ন, দ্বিধাগ্রস্ত, শ্বাসরুদ্ধ বিনু কী জবাব দেবে, ভেবে পেল না।

    অবনীমোহন বললেন, একটা কথা ভেবে দেখতে পার। এ জাতীয় মেয়েদের জন্যে গভর্নমেন্টের হোম’ আছে। সেখানে আপাতত ঝিনুককে রাখা যেতে পারে।

    বিনু এবারও চুপ।

    অবনীমোহন বলতে লাগলেন, তুমি ঝিনুকের কাছে যাও। এক্ষুনি নয়, সময় নিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হোম’-এর ব্যাপারটা বলল।

    শরীর এবং মন কঠিন আঘাতে অসাড় হয়ে গেছে। নিজেকে ধীরে ধীরে টেনে তুলল বিনু। পাশের ঘরে এসে দেখল, সেটা একেবারে ফাঁকা। সে ডাকতে লাগল, ঝিনুক-ঝিনুক।

    সাড়া নেই।

    তেতলার অন্য ঘরগুলো আতিপাতি করে খুঁজল বিনু। কোথাও ঝিনুককে পাওয়া গেল না। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে দোতলায়, তারপর একতলায় নেমে এল সে। ঝিনুক কোথাও নেই।

    একতলার কিচেনে রান্না করছিল খগেন। তাকে জিজ্ঞেস করল, ঝিনুককে দেখেছে কিনা। খগেন জানালো, রান্নাবান্না নিয়ে সে ব্যস্ত ছিল। দিদিমণিকে লক্ষ করে নি।

    অবনীমোহন ঝিনুককে পাশের ঘরে যেতে বলেছিলেন। নিশ্চয়ই সে সেখানে যায় নি। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অবনীমোহনের কথাগুলো শুনেছে। বিনুর শাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে এসেছে। সে সদর দরজার দিকে দৌড়ল। সেটা হাট করে খোলা। বাইরে বেরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ঝিনুককে ডাকতে ডাকতে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের এক মাথা থেকে অন্য প্রান্তে ছুটতে লাগল। তারপর চলে এল ট্রাম রাস্তায়। নেই, নেই, নেই। যেদিকে যতদূর নজর যায়, অবিরল গাড়ির স্রোত। ভিড়, ভিড় আর ভিড়। তার মধ্যে চিরদুঃখী মেয়েটাকে কোথাও দেখা গেল না।

    অঘ্রাণ মাস পড়ে গেছে। কুয়াশায় চারদিক ঝাঁপসা। উত্তরে বাতাসে গাঢ় হয়ে হিম মিশে যাচ্ছে।

    কুহেলিবিলীন আকাশের নিচে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিনু।

    ॥ তৃতীয় ও শেষ পর্ব সমাপ্ত ॥

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.