Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প1251 Mins Read0

    ১.০৯ ভেতর-বাড়ির উঠোনে

    ভেতর-বাড়ির উঠোনে এসে ফিটন থামালেন লারমোর। তারপর খানিক আগের মতোই লাফ দিয়ে নেমে চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন, রমু কই রে–আমার সুরমা কোথায়?

    সুরমা কাছেই ছিলেন। দক্ষিণ-দুয়ারী বড় ঘরখানার বারান্দায় পিঠময় চুল মেলে দিয়ে শিবানী আর স্নেহলতার সঙ্গে চাল বাছতে বাছতে গল্প করছিলেন। ডাকটা কানে যেতে চকিত হয়ে মুখ ফেরালেন। উঠোনের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, লারমোর দাঁড়িয়ে আছেন। আশ্বিনের এলোমেলো বাতাসে তার সাদা দাড়ি এবং চুল উড়ছে।

    এতকাল পরও লারমোরকে দেখেই চিনতে পারলেন সুরমা। নিমেষে তার বয়স থেকে কুড়ি পঁচিশটা বছর যেন মুছে গেল। কৈশোর যৌবনের মাঝামাঝি একটা সময় কিছুকাল রাজদিয়ায় কাটিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সুরমা নীরোগ, সুস্থ। পরিপূর্ণ উজ্জ্বল স্বাস্থ্যে ঝলমল করতেন। প্রাণবন্ত চঞ্চল পাখিটির মতো সারাদিন ছিল তার ছোটাছুটি, ছেলেমানুষির খেলা। বিশেষ করে লারমোরকে কাছে পেলে আবদার আর লাফালাফির মাত্রাটা যেত হাজার গুণ বেড়ে।

    এতদিন পর লারমোরকে দেখে সেই উচ্ছল স্নিগ্ধ দিনগুলোতে যেন ফিরে গেলেন সুরমা। রাজদিয়ায় এসে বার বার নিজের বয়স ভুলছেন। অসুস্থ রুণ শরীরের কথা ভুলছেন, পারিবারিক মর্যাদার কথা ভুলছেন। আজও সব ভুলে কুড়ি পঁচিশ বছর আগের মতো কিশোরীটি হয়ে উড়তে, উড়তে ছুটতে ছুটতে উঠোনে নেমে এলেন। লারমোরকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এই তো আমি লালুমামা–

    এক মুহূর্ত সুরমার দিকে তাকিয়ে রইলেন লারমোর, তারপরেই নির্মল স্নেহের আলোয় মুখখানা ভরে গেল। সুরমাকে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে একসঙ্গে কত কথা যে বলে গেলেন। স্নেহলতা, শিবানী বা হেমনাথ যা যা বলেছিলেন সেই সব কথা। এতকাল কেন রাজদিয়ায় আসেন নি সুরমা, শরীর কেন এত রোগা হয়ে গেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। লারমোরের বুকের ভেতর থেকে সুরমা একে একে উত্তর দিতে লাগলেন।

    এদিকে ফিটন থেকে সুধা-সুনীতি-বিনু আর অবনীমোহনও নেমে এসেছেন। ইলিশ মাছ হাতে ঝুলিয়ে হেমনাথও নেমেছেন। ওধারের বারান্দা থেকে স্নেহলতা শিবানী পায়ে পায়ে কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।

    প্রাথমিক উচ্ছাস খানিক কেটে গেলে বন্দিনী সুরমা লারমোরের বুকের ভেতর থেকে মুক্তি পেলেন। আর তখনই চোখ পাকিয়ে, তর্জনী নাচিয়ে স্নেহলতা এগিয়ে এলেন, এই যে সাহেব–

    দু’পা পিছিয়ে লারমোর ভয়ে ভয়ে শুধোলেন, এমন রণরঙ্গিণী মহিষমর্দিনী রূপে কেন? আমার বুক কিন্তু কাঁপছে।

    আগের সুরেই স্নেহলতা বললেন, ক’দিন পর এ বাড়িতে আসা হল?

    বোধহয় ছ’সাত দিন।

    মোটেও না।

    ঢোক গিলে লারমোর বললেন, তবে?

    স্নেহলতা বললেন, বারো দিন।

    অত দিন আসি নি!

    নিশ্চয়ই, আমি গুনে রেখেছি।

    গলাটাকে খাদের ভেতর নাময়ে লারমোর এবার বিড়বিড় করলেন, আবার গোনাগুনির কী দরকার ছিল!

    স্নেহলতার চোখ আরও বড় হল, গলা আরও তিন পর্দা চড়ল, গুনে রেখে অন্যায় করেছি?

    অসহায়ের মত এদিক সেদিক তাকিয়ে লারমোর কোনওরকমে বলতে পারলেন, না মানে–

    তাঁর কথা শেষ হবার আগেই স্নেহলতা ঝলকে উঠলেন, কী কথা হয়েছিল শুনি? ঠিক ছিল, এবার থেকে এ বাড়িতে খাওয়া হবে। আমি রোজ দু’বেলা করে বারো দিন চব্বিশ বেলা ভাত ফুটিয়ে মরছি আর আসল মানুষের টিকির দেখা নেই।

    লারমোর উত্তর দিলেন না।

    স্নেহলতা থামেন নি। একবার অবনীমোহনকে, একবার সুরমাকে, একবার সুধা সুনীতিকে সাক্ষী মেনে সমানে গজগজ করতে লাগলেন। তিনি যা বললেন, সংক্ষেপে এইরকম। লারমোরের কেউ নেই, একা একা রাজদিয়ার আরেক প্রান্তে পড়ে থাকেন। তার ওপর যথেষ্ট বয়সও হয়েছে। খাওয়া দাওয়ার ঠিকঠিকানা নেই। ওঁর গাড়ির বুড়ো কোচোয়ানটা যেদিন চাট্টি ভাত ফুটিয়ে দেয় সেদিন খান, নইলে দু’দিন হয়তো খেলেনই না। এমন করলে শরীর টেকে? তাই স্নেহলতা কদিন আগে কথা আদায় করে নিয়েছিলেন, এবার থেকে তার কাছে দু’বেলা খেয়ে যাবেন লারমোর। কথা দিয়ে। ভদ্রলোক সেই যে উধাও হয়েছেন, বার দিন পর আবার তাকে দেখা গেল। কাজেই স্নেহলতার রেগে যাবার কারণ আছে।

    লারমোর আধবোজা চোখে আঁটা-ঠোঁটে চুপচাপ সব শুনে গেলেন।

    স্নেহলতা বললেন, তোমাকে যখন একবার পেয়েছি সাহেব, চব্বিশ বেলার ভাত একসঙ্গে খাওয়াব।

    পাশ থেকে শিবানী আস্তে করে বললেন, আমি একটা মোটা লাঠি যোগাড় করে রেখেছি বৌদি। খেতে না পারলে–

    স্নেহলতা বাকিটুকু পূরণ করে দিলেন, ওই লাঠিটা দিয়ে আমরা ননদ-ভাজে গলার ভেতর খুঁজে গুঁজে দেব।

    হঠাৎ দু’হাত জোড় করে, মাথা ঝুঁকিয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে লারমোর বলে উঠলেন, তার চাইতে আমার প্রাণদন্ডের আজ্ঞা হোক মহারানী।

    স্নেহলতা রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললেন, খুব হয়েছে। কত রঙ্গই যে জানো সাহেব!

    সমস্ত ব্যাপারটাই যে নির্মল কৌতুকের খেলা, চারধারে দাঁড়িয়ে বিনুরা বেশ বুঝতে পারছিল। হেমনাথদের সঙ্গে লারমারের সম্পর্কটা কতখানি মধুর আর মনোরম তাও টের পাচ্ছিল। যাই হোক, স্নেহলতাকে হাসতে দেখে সবাই হেসে উঠল।

    হাসতে হাসতেই স্নেহলতা বললেন, নেহাত ভাগনী, ভাগনীজামাই, নাতি নাতনীরা কলকাতা থেকে এসেছে, তাই ছুটে আসা হয়েছে। নইলে কবে আসত তার কি কিছু ঠিক আছে! সারা দিন এত রাজকার্য করতে হয়ে যে দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে যাবার ফুরসত হয় না।

    এই সময় পেছন থেকে হেমনাথ বলে উঠলেন, রমুদের জন্যেই শুধু না গো গিন্নি, ইলিশের গন্ধেও লালমোহন ছুটে এসেছে। বলে হাতের মাছগুলো তুলে দেখালেন।

    ইলিশ দেখাতে গিয়ে এমন বিপদ হবে, কে জানত। বেশ আড়ালে আড়ালে ছিলেন হেমনাথ, একেবারে তোপের মুখে পড়ে গেলেন। স্নেহলতার মনোযোগ লারমোরের দিক থেকে এবার তার ওপর এসে পড়ল। চোখ কুঁচকে স্নেহলতা বললেন, এই যে আরেক জন

    ভীত সুরে হেমনাথ বললেন, আমি আবার কী করলাম?

    সেই সকাল থেকে কোন দিগ্বিজয় করে আসা হল শুনি? এখন কত বেলা হয়েছে হুঁশ আছে?

    হেমনাথ ভেবেছিলেন, ইলিশের কথা তুললে লারমোরকে নিয়ে মজাটা আরও জমবে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি তার বিরুদ্ধেই গেল। মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন, ওদের রাজদিয়া দেখাতে দেরি হয়ে গেল। তা ছাড়া রামকেশবটা

    তার কথা শেষ হতে না হতে স্নেহলতা গলা চড়ালেন, চান নেই খাওয়া নেই, ঘুরে ঘুরে আমার সোনাদের মুখগুলো কালো হয়ে গেছে। এদিকে রমুটাও না খেয়ে বসে আছে, অসুস্থ রোগা মানুষ। বাড়ি থেকে একবার বেরুতে পারলে ফেরার কথা কি তোমার মনে থাকে!

    মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভরসা হল না হেমনাথের, ইলিশ মাছ নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে রান্নাঘরের দিকে অদৃশ্য হলেন।

    স্নেহলতা ঠোঁট টিপে হেসে ফেললেন, যাবার রকম দেখ না! সারাদিন চড়ায় বড়ায় ঘুরে এখন ইলিশ দিয়ে ভোলাতে এসেছে। ভেবেছে ইলিশ দেখলে আমি স্বর্গে চড়ব। বলতে বলতে লারমোরের দিকে তাকালেন, এই যে সাহেব, আর সঙের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ঘরে আসা হোক। ভাল কথা, আমি কিন্তু এ বেলা ইলিশ বেঁধে খাওয়াতে পারব না।

    লারমোর বললেন, বেশ তো, রাত্তিরেই খাব। ও জিনিস যখন চোখে একবার দেখেছি, না খেয়ে যেতে পারব না। গুরুর বারণ।

    ইলিশের নামে জিভ একেবারে সাত হাত। মধুর হৃভঙ্গে লারমোরকে বিদ্ধ করে বিনুদের দিকে চোখ ফেরালেন স্নেহলতা, এস দাদারা, এস অবনী—

    .

    এ বেলার খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে বেলা হেলে গেল। পশ্চিম আকাশের ঢালু পাড় বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি নেমে গেছে। রোদের রং এখন কাঁচা হলুদের মতো। গাছের পাতাগুলো দিনশেষের আলোয় যেন সোনালি ঝালর হয়ে উঠেছে। দু’টো পাখি ওধারের ঘরের চালে বসে ছিল। হঠাৎ কী হল, একটা পাখি চঞ্চল ডানায় তার সঙ্গীকে ঘিরে কিছুক্ষণ উড়ে উড়ে মুখোমুখি বসল, তারপর ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে সোহাগ জানাতে লাগল, আদর করতে লাগল। বুঝিবা আশ্বিনের এই বিকেল তাদের যাদু করেছে।

    উঠোনের এক ধারে আঁচিয়ে অবনীমোহনরা পুবের ঘরের ঢালা তক্তপোশে এসে বসলেন। সবাই এসেছেন, শুধু সুধা বাদ। অবশ্য স্নেহলতা শিবানী এবং সুরমাও আসেন নি। তাদের এখনও খাওয়া হয় নি। হেমনাথদের খাইয়ে এই সবে তারা খেতে বসেছেন।

    পুবের ঘরে এসে কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর লারমোরই শুরু করলেন। প্রথমে বিনু আর সুনীতির সঙ্গে ঠাট্টাটাট্টা করে অবনীমোহনের সঙ্গে কলকাতার গল্প জুড়ে দিলেন। হালকাভাবে হিটলার, ইউরোপ এবং যুদ্ধের প্রসঙ্গও উঠল।

    বড় বড় পলকহীন চোখে লারমোরের দিকে তাকিয়েই আছে বিনু। এই মানুষটি সম্বন্ধে তার বিস্ময় আর কাটছে না। কলকাতায় হাজার হাজার সাহেব দেখেছে সে। কিন্তু এদেশের পোশাক, এদেশের ভাষা, এদেশের অন্ন এমন নিষ্ঠায় এমন মমতায় গ্রহণ করে এরকম বাঙালি হয়ে যেতে আগে আর কাউকে দেখে নি।

    কলকাতার গল্প, যুদ্ধের গল্প শেষ করে লারমোর হেমনাথের দিকে ফিরলেন, বুঝলে ভাই–

    হেমনাথ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন, কী বলছ?

    ওষুধ তো ফুরিয়ে গেছে।

    ফুরিয়ে গেছে।

    হ্যাঁ, হেম। আস্তে মাথা নাড়লেন লারমোর।

    বালিশে শরীর সঁপে দিয়ে আধশোয়ার মতো ছিলেন হেমনাথ। এবার উঠে বসলেন, কুড়ি দিনও হয়নি, ঢাকা থেকে আড়াই শ’ টাকার ওষুধ তোমাকে আনিয়ে দিয়েছি। এর ভেতর খতম করে ফেললে!

    লারমোর হাসলেন, কী করব বল?

    অবাক চোখে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল বিনু। এবার বিমূঢ়ের মতো লারমোরকে দেখতে লাগল। আড়াই শ’ টাকার ওষুধ তো একটুখানি ব্যাপার না, লারমোর কি কুড়ি দিনে সব খেয়ে ফেলেছেন। বিনুর একবার ইচ্ছে হল, জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই অবনীমোহন শুধোলেন, এত ওষুধ দিয়ে কী হল? বিনুর মতো তিনিও বুঝিবা কিছুটা বিমূঢ় হয়েছেন।

    হেমনাথ বললেন, বিরাট লাভের কারবার কেঁদেছে যে লালমোহন।

    লারমোর হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন, তা যা বলেছ হেম। পনের দিন, বিশ দিন পর পর ঢাকা থেকে দেড়শ’ দুশ’ টাকার করে ওষুধ আনিয়ে দিচ্ছ। আর চক্ষের পলকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি। কারবারটা লাভের বৈকি।

    অবনীমোহনের মুখ দেখে মনে হল, কিছুই বুঝতে পারছেন না। তার মনের কথা খানিক আন্দাজ করে হেমনাথ বললেন, আমি মুখে আর কতটুকু বলতে পারব? লারমোরকে ক’দিন দেখ, এত ওষুধ নিয়ে ও কী করে নিজেই বুঝতে পারবে।

    অবনীমোহন কী বলতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় পানের রসে ঠোঁট টুকটুকে করে সুরমা আর স্নেহলতা এ ঘরে এলেন। শিবানী অবশ্য আসেন নি।

    ঘরে পা দিয়েই স্নেহলতা বললেন, এ বেলা তো  বাঁচা মাছ, সরপুঁটি আর পাবদাখাওয়া হল। ওবেলা কী হবে?

    হেমনাথ বললেন, কেন, ইলিশই তো আছে—

    স্নেহলতা কিছু বলবার আগেই হঠাৎ সুর করে ছড়া কেটে উঠলেন লারমোর :

    পয়লা পাতে কিছু তিক্ত
    ঘৃত দুই হাতা।
    তাহার পর মুগ দাইল (মুগ ডাল)
    সহ ইলিশ মাথা।
    সরিষার পাক দিয়া ইলশার ঝাল,
    কাঁচা মরিচ ফোড়ন দিয়া ইলশার ঝোল,
    এর সাথে পাই যদি ভাজা খান চার,
    স্বর্গ তো থাকে না রামা বেশি
    দূরে আর।
    শাস্ত্রমতে রাইন্ধা ইলিশ
    অন্যথা না হয়
    অন্যথা করিবে যে, আমার
    মাথা খায়।

    চোখ এবং ঠোঁট কুঁচকে শুনে গেলেন স্নেহলতা। তারপর বললেন, আজকাল বুঝি খুব মঙ্গলকাব্য পড়া হচ্ছে।

    ঘাড় কাত করলেন লারমোর, হ্যাঁ, খুব ভাল জিনিস।

    কী ভাল? চোখের তারা তীক্ষ্ণ করে স্নেহলতা জিজ্ঞেস করলেন, সারা মঙ্গলকাব্য, না তার ভেতর বেছে বেছে এই ইলিশ মাছের জায়গাটা?

    এক গাল হেসে লারমোর বললেন, ইলিশ মাছের জায়গাটা। ঈশ্বরের পৃথিবীতে এমন বস্তু আর সৃষ্টি হয় নি।

    সস্নেহ প্রশ্রয়ের সুরে স্নেহলতা বললেন, একটা মেছো বেড়াল।

    লারমোর কী বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে বিনুর চোখ জানালার বাইরে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠল সে। দূরে বাগানের ভেতর ডালপালাওলা ঝুপসি মতো কী যেন টেনে টেনে আনছে যুগল।

    আজ এই প্রথম যুগলকে দেখল বিনু। সকালবেলা হেমনাথের সঙ্গে রাজদিয়া দেখতে বেরিয়েছিল তারা। নদীতীর, স্টিমারঘাট, মাঝিঘাট, আশ্বিনের যাদুভরা নীলাকাশ, ইলিশ মাছের আড়ত, রামকেশব, রুমা ঝুমা-নানা দৃশ্য, বিভিন্ন মানুষ, বিচিত্র সব ঘটনা বিনুকে এত মুগ্ধ এবং বিস্মিত করে রেখেছিল যে যুগলের কথা একবারও তার মনে পড়ে নি। অথচ রাজদিয়াতে এসে যাকে সব চাইতে তার ভাল লেগেছে, বিস্ময়কর মনে হয়েছে, সে যুগল।

    জানালার বাইরে থেকে চোখদুটো এবার ভেতরে নিয়ে এল বিনু, একবার লারমোরকে দেখে নিল। এই মানুষটিও তার কাছে কম বিস্ময়কর নন। যুগল এবং লারমোর–দু’ধারের দুই বিস্ময়ের টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত যুগলই জিতল। পায়ে পায়ে ঘরের বাইরে এসে এক ছুটে বিনু বাগানে এসে হাজির।

    দূর থেকে ঝুপসি জঙ্গলমতো মনে হয়েছিল। কাছে এসে বিনু দেখতে পেল, সরু সরু লম্বা পাতা আর কাঁটাভর্তি মোটা মোটা অসংখ্য লতা স্তুপাকার হয়ে আছে। রুপোর মতো চকচকে ধারাল দা দিয়ে ক্ষিপ্র হাতে পাতাটাতা হেঁটে যুগল লতাগুলো একধারে সাজিয়ে রাখছিল। বিনুকে দেখে মুখ ভরে হাসল সে, এই যে ছুটোবাবু, সকাল থিকা আপনের দেখা নাই। কতবার যে খোঁজ করছি!

    বিনু বলল, আমরা দাদুর সঙ্গে বেরিয়েছিলাম।

    হে তো জানিই। আপনেরা রাইজদা দেখতে গেছিলেন। তা অ্যাত দেরি করলেন ক্যান?

    দেরি হবার কারণটা সংক্ষেপে জানিয়ে দিল বিনু।

    যুগল শুধলো, আমাগো রাইজদা ক্যামন দেখলেন ছুটোবাবু? বলে এমনভাবে তাকাল যেন বিনুর ভাল-মন্দ’ বলার ওপর তার বাঁচামরা নির্ভর করছে।

    বড্ড ছোট। অন্যমনস্কের মতো উত্তর দিয়ে কাঁটালতাগুলো দেখিয়ে বিনু বলল এগুলো কী?

    ব্যাত, ব্যাতের লতা।

    কী হবে এগুলো দিয়ে?

    রহস্যময় হেসে যুগল বলল, হইব এট্টা জিনিস। এটু খাড়ন, নিজের চৌখেই দেখতে পাইবেন।

    বিনু উত্তর দিল না।

    যুগল আবার বেলল, বেথুন খাইছেন ছুটোবাবু?

    ‘বেথুন’ শব্দটা জীবনে এই প্রথম শুনল বিনু। অবাক হয়ে সে বলল, বেথুন কী?

    ব্যাতের ফল। বেতফল আবার খায় নাকি?

    খায়, খায় ছুটোবাবু। অ্যামন বস্তু না খাইলে জীবন এক্কেরে ব্রেথা (বৃথা)। বলে, চোখ বুজে মুখের ভেতর যেন বেতফলের স্বাদ নিতে লাগল যুগল।

    বেতফল কখনও খায় নি বিনু। ওটা না খেলে জীবন বৃথা হয়ে যায় কিনা, এই মুহূর্তে বুঝতে পারল না সে। আস্তে করে শুধু বলল, কেমন লাগে খেতে?

    নিজের মুখে আর কী কমু ছুটোবাবু, চত্তির মাসে ব্যাতফল পাকব। তহন খাইয়া দ্যাখবেন।

    বিনু বুঝল, যুগলের কথার সত্যাসত্য যাচাই করতে হলে চৈত্র মাস পর্যন্ত তাকে ধৈর্য ধরে থাকতে হবে। এখন সবে আশ্বিন।

    দেখতে দেখতে সবগুলো বেতের লতা থেকে পাতাটাতা হেঁটে ফেলল যুগল। লতাগুলোর গায়ে অবশ্য চোখা চোখা ধারাল কাটা থেকেই গেল, সেগুলো আর চাছল না। পাতা ছাঁটা হলে কাটাসুদ্ধ একেকটা বেত নিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে এক ধরনের অদ্ভুত আকারের গোল ঠোঙা তৈরি করতে লাগল যুগল। ঠোঙাগুলোর একটা দিক খুব সরু, তারপর বেতের পাক ক্রমশ বড় হয়ে মুখের কাছটা মস্ত হয়ে উঠেছে। মুখটার ব্যাস প্রায় পৌনে এক হাতের মতো।

    পঁচিশ তিরিশটা ঠোঙা তৈরি হলে প্রতিটার সরু দিকে একটা করে লম্বা দড়ি বাঁধতে লাগল যুগল।

    চুপচাপ বিনু দেখে যাচ্ছিল। দড়ি বাঁধা যখন শেষ হয়ে এসেছে সেই সময় কোত্থেকে যেন সুধা এসে হাজির। অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে বলল, এগুলো কী?

    যুগল বলল, ফা (ফাঁদ)।

    কী হবে এসব দিয়ে?

    বিনুকে যেভাবে বলেছিল তেমনি রহস্যের সুরে হেসে হেসে যুগল সুধাকে বলল, অহন কমু না।

    সুধা ভুরু কুঁচকে তাকাল, বললে কী হবে?

    আগে থিকা কইলে গুণ নষ্ট হইয়া যাইব।

    সুধার চোখমুখ বিরক্ত, কিছুটা বা বিমূঢ় দেখাল। আর কিছু বলল না সে।

    দড়ি বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। যুগল বলল, আসেন ছুটোবাবু, আসেন ছুটোদিদি, ফাল্গুলার ব্যবোস্তা কইরা আসি।

    সুধা আর বিনুকে নিয়ে পুকুরপাড়ে চলে এল যুগল। তারপর বেতের ফাঁদগুলো জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগল। লম্বা দড়ির একদিক দিয়ে ফাঁদগুলো বাঁধা, দড়ির অন্য প্রান্তগুলো চারপাশের গাছপালার মোটা ডাল বা গুঁড়িতে বেঁধে রাখল যুগল।

    বিনু বলল, এগুলো জলে ফেললে যে?

    যুগল বলল, সাতখান দিন সবুর করেন ছুটোবাবু, তারপর বুঝতে পারবেন ক্যান ফেলাইছি।

    ফাঁদটাঁদ ফেলা হয়ে গেলে সুধা-বিনু-যুগল কথা বলতে বলতে আবার বাগানে ফিরে এল। আর তখনই দেখা গেল, রাস্তার দিক থেকে মস্ত এটা বাক্স হাতে ঝুলিয়ে হিরণ আসছে। বিনুরা দাঁড়িয়ে পড়ল।

    কাছাকাছি এসে একমুখ হাসল হিরণ। সুধার চোখে চোখ রেখে খুব খুশি গলায় বলল, আরে আপনি! বাগানে কী করছেন?

    কেমন করে যেন হাসল সুধা। রাজহাঁসের মতো গলাটা ঈষৎ বাঁকিয়ে মজার গলায় বলল, আপনার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি।

    আমার জন্যে!

    হ্যাঁ স্যার—

    আমি এখন আসব, আপনি জানতেন?

    স্বরে দীর্ঘ টান দিয়ে সুধা বলল, হুঁ—

    হিরণ বলল, কেমন করে জানলেন?

    হাত গুনে—

    হিরণ আর কিছু বলল না, উজ্জ্বল হাসিভরা চোখে তাকিয়ে রইল।

    একটুক্ষণ নীরবতা। তারপর হিরণের হাতের বাক্সটা দেখিয়ে সুধা বলল, ওটা কী?

    গ্রামোফোন। আপনাদের জন্যে নিয়ে এলাম।

    পাশ থেকে যুগল বলে উঠল, গামাফোন কী হিরু দাদা?

    হিরণ বলল, কলের গান।

    যুগল এবার প্রায় লাফিয়ে উঠল গান শুনুম, গান শুনুম—

    সুধা হিরণকে বলল, বাগানে দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে, ঘরে গিয়ে গান শোনা যাক।

    চলুন–

    চারজনে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করল। সুধা হিরণ আগে আগে, যুগল বিনু পেছনে।

    যেতে যেতে হিরণের সঙ্গে খুব কথা বলতে লাগল সুধা, আর হাসতে লাগল। এমনিতেই প্রচুর কথা বলে সে, দিনরাতই বকবকায়মান। কিন্তু এখনকার প্রগলভতার তুলনা নেই।

    পেছন থেকে আড়ে আড়ে বিনু দেখতে লাগল, ছোটদির চোখে মুখে হাসি নাচছে, আর কী এক অলৌকিক আলো খেলে যাচ্ছে। সুধার মুখে এমন হাসির ছটা, আলোর খেলা আগে আর কখনও দেখে নি বিনু।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়
    Next Article আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.