Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কোজাগর – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প561 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কোজাগর – ১৭

    ১৭

    টুসিয়া অনেক ভেবেছে। কাল সারারাত ভেবেছে আর কেঁদেছে আর কেঁদেছে। কিন্তু ভেবে কোনো কুল-কিনারাই পায়নি।

    আজ সকাল দশটা নাগাদ বাবা গেছিল বাংলোতে। দেখা করতে। কিন্তু দাদার সঙ্গে দেখা হয়নি। নানা জায়গার পুলিশের লোকেরা নাকি সেখানে রয়েছেন। বাইরে থেকে আসা পুলিশের পাহারা ছিল বাংলোর বাইরে। তারা পরিচয় দেওয়া সত্ত্বেও হীরুর সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। বলেছে, বকোয়াস্ মত্ করনা। পাগল কাঁহাকা! তুম্ হামলোগোঁকা এস-পি সাহাবকা বাপোয়া না ঔর কুছ। ভাগো হিয়াসে। এখন ঢুকতে দেওয়ার অর্ডারই নেই আমাদের। তবু জুগ, ওদের বলেছিল হীরুকে ডেকে দিতে একবার। তাতে ওরা বলছিল, ওদের ঘাড়ে মাত্র একটা করেই মাথা। ডাকাডাকির মধ্যে ওরা নেই।

    বাবা ফিরে আসার পর বিকেলের দিকে টিহুলও আবার এলো। টিহুলের চোখ লাল, দেখেই মনে হল ওরও বুঝি ঘুম হয়নি রাতে। একটা খাম হাতে নিয়ে এসেছিল টিহুল। বাবা মহুয়া গাছটার তলায় দাঁড়িয়েই খামটা খুলেছিল। খামটার মধ্যে টাকা ছিল। দুটো একশ টাকার নতুন নোট। আর কিছুই ছিলো না। না টুসিয়ার জন্যে কোনো চিঠি, না অন্য কিছু। টিহুল বলেছিল, রাতের বেলা আজ হীরু আসতে পারে। তবে কখন আসবে বলতে পারে না। দিনের আলোয় সে আসতে চায়ও না। সে পুরোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। তবে আবার কখন গ্রামে আসা হয় না হয়, তাই-ই একবার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে যাবার চেষ্টা করবে। ইচ্ছে আছে।

    টিহুলের এই কথা শুনে বুড়ো জুগ্ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল।

    তারপর ফসস্ করে তার কাছে যা মহামূল্যবান, সেই নোট দুটোকে হঠাৎই ছিঁড়ে ফেলল টুকরো টুকরো করে। তারপর টিহুলকে টুকরোগুলো খামে ভরে ফেরত দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, শোন্ টিহুল, হীরুকে বলে দিস, তার আলোতে অথবা অন্ধকারে কোনো সময়েই আসতে হবে না। হীরু সিং শহরের ভারী অসর হতে পারে, হতে পারে সে পুলিশ সাহেব কিন্তু তার জন্যে কোনো জায়গা নেই আর ভালুমারের জুগনু ওরাওঁ-এর বাড়িতে। একটুও জায়গা নেই। যদি হীরু আসে, তবে তাকে ঢুকতে দেবো না আমি।

    টিহুল নিস্তেজ ক্লান্ত গলায় বলল, মাথা ঠাণ্ডা করো জুগনু চাচা। যে টাকা ছিঁড়ে ফেললে, এই-ই আমি নিয়ে গিয়ে কী বলব তা জানি না। তাছাড়া, তোমার ছেলে এখন পুলিশের বড় সাহেব। ছেলের সঙ্গেও সাবধানে ব্যবহার কোরো, নইলে তোমারও বিপদ আছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি হীরুকে আর তার দোস্ত্ অসরকে মারুমার আর গাড়ুর থানার দারোগারা ফটাফট্ সেলাম ঠুকছে। কথা শোনো, এরকম কোরো না। কত রকম বিপদ যে ঘটতে পারে তা তোমার ধারণারও বাইরে। বাবা বলেই যে ছেলে খাতির করবে সে যুগ কি আর আছে?

    জুগনু বলল, তুই চুপ কর! বিপদ? কীসের বিপদ? আমার ঘরে কি টাঙ্গি নেই? আমার আর কোনো বিপদেরই ভয় নেই। ঐ ছেলে যদি আমার ধারে-কাছে আসে তাহলে টাঙ্গি দিয়ে তার মাথা দু ফাঁক করে দেবো। ইজ্জৎ বড়, না জান বড়? না কি টাকাই বড়? তুই কী বলিস?

    আস্তে আস্তে।

    টিহুল ফিস্ ফিস্ করে বলল। কে কোথায় শুনে ফেলবে। গাছেরও কান আছে।

    তারপর বলল, টাকাটার তো এই দশা করলে। আমার কপালে এখন কী আছে তা কে জানে। তবে আমি এগোচ্ছি।

    বলেও, ও একটু দাঁড়াল, টুসিয়ার মায়ের সামনে।

    টিহুল জানতো, হীরুর বাবা অমন করলেও, ছেলে সত্যি সত্যিই যদি আসে, মা তাকে আদর করে ঘরে ডাকবেই। তাই টিহুল কিছুক্ষণ টুসিয়ার মায়ের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে শুধালো, কী চাচি? তোমারও কি চাচার মতেই মত?

    টুসিয়ার মাও অনেক কেঁদেছে কাল থেকে। চোখের দৃষ্টি ভাসা-ভাসা। অনেক দূরে সেই দৃষ্টি নিবদ্ধ। যেন একদা-উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে আসন্ন রাতের অন্ধকারে মাখামাখি হতে দেখছে টুসিয়ার মা। সেই পরস্পরবিরোধী সাদা কালো ছবিতে তার চোখের মণি জ্বলে গেছে। একটুক্ষণ নীরব থেকে টুসিয়ার মা একবার তার স্বামীর দিকে চকিতে চেয়েই কঠিন গলায় টিহুলকে বলল, হ্যাঁ, আমারও তাই মত

    টিহুল স্তম্ভিত হল, কিন্তু কিছু বলল না। এখন সহজে বিস্মিত হয় না টিহুল। কিছুদিন পর বোধ হয় আর কিছুতেই বিস্মিত হবে না। কাল বিকেলে যখন সে টুসিয়াদের বাড়ি এসেছিল তখন তার কুঁড়েতে দুজন কনস্টেবল গিয়েছিল মুরগি খোঁজার অছিলায়। এবং মুরগি তার বাড়িতে ছিলও গোটা চারেক। দুটো মুরগির দাম দিয়ে তারা টিহুলের বৌকে বলেছিল, সন্ধে লাগতে-না-লাগতে যেন সেই মুরগি দুটো নিয়ে বাংলোতে আসে। সাহেবদের অর্ডার। টিহুলকে যেন না পাঠায়।

    যাঁরা এদেশের বনে জঙ্গলে বসবাস না করেছেন তাঁদের পক্ষে পুলিশ ও বনবিভাগের নিম্নতন কর্মচারীদের দৌরাত্ম্য যে অসহায় বুভুক্ষু সাধারণ মানুষদের ওপর কী প্রকার রূঢ়, তা বিশ্বাস করাও মুশকিল। ওঁদের এই ব্যবহারে সাধারণ লোকেরা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশের এত বড় বড় কর্তাদেরও এহেন আচরণ টিহুলের মতো বহু অত্যাচারিত ও আজীবন বঞ্চিত মানুষেরও অজানা ছিল। বিদেশি, সাদা সাহেবরা চলে গেছে দেশ ছেড়ে, টিহুল জন্মাবার আগেই। কিন্তু তারা থাকলে আজ যারা দেশের রক্ষক এবং ভক্ষক তাদের দেখে লজ্জায় লাল হয়ে যেত। কুকুর-বেড়ালের দেশেই এমন সম্ভব। কুকুরের বাচ্চাদের মালিক কি আর বাঘ সিংহ হয়?

    তার সুন্দরী বাঁজা-বউ কুঁড়েতে ফিরেছিল গভীর রাতে। দুজন কনস্টেবল টর্চ এবং রাইফেল হাতে তাকে সসম্মানে পৌঁছে দিয়ে গেছিল বাড়িতে। টিহুলকে যা মর্মাহত করেছিল তা পুলিশের বড় সাহেবদের আচরণ নয়, তার নিজের স্ত্রীর আচরণ। সে নেশাগ্রস্ত হয়ে হাসি হাসি মুখে মাঝরাতে বাড়ি ফিরে একটা দশটাকার নোট টিহুলের সামনে মেলে ধরে বলেছিলো, জীবনে তুই এমন সোহাগ করতেও জানিসনি আর হাতে ধরে এত টাকাও কখনও দিসনি। আমরা কিম্মত তুই কখনও বুঝিসনি, বুঝবি না। তোর হাতে পড়ে আমার জীবনটাই নষ্ট হয়েছে, শুনে রাখ্ টিহুল।

    টিহুল অবাক চোখে তাকিয়েছিল তার বউ-এর দিকে। আর ভাবছিল, এ গ্রামের আরও দু-পাঁচজন আত্মসম্মানজ্ঞানহীন পুরুষের মতো সেও কি তার বউ-এর শরীর-ভাঙানো পয়সায়ই বেঁচে থাকবে আজ থেকে? পুরো ব্যাপারটার পেছনে যে চৌকিদারের যোগসাজশ ছিল তা তার বুঝতে অসুবিধে হয়নি। রোগা-পট্‌কা টিহুল বেদম মার মেরেছিল তার বউকে। তারপর সাত সকালে গুরবক্স সিং ঠিকাদারের লাতেহার যাওয়া একটি ট্রাকে উঠিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে বলে দিয়েছিল, তার বউকে লাতেহারের কাছারির সামনে যেন নামিয়ে দেয়। বউকেও বলে দিয়েছিল বারবার, এখন থেকে সে যেন তার বাবার কাছেই থাকে। আর শরীর ভাঙিয়েই যদি খেতে চায়, ভালো শাড়ি পরতে চায় বা রুপোর মল আর বাজুবন্দ কিনতে চায়; তাহলে লাতেহারেও তার অভাব হবে না।

    পৃথিবীতে এই একটি মাত্র পণ্যকেই বাজারিকৃত করতে যে কোনো মার্কেটিং ম্যানেজারের সহায়তা লাগে না—অশিক্ষিত কিন্তু সহজাত শিক্ষায় শিক্ষিত টিহুলের মতো মানুষও এই কথাটা ভালো করেই জানত। টিহুল জানতে চেয়েছিল, তার বউ কোন্ সাহেবের বিছানায় শুয়েছিল? হীরুর না হীরুর দোস্ত-এর। বউ কিন্তু অত মারেও জবাব দেয়নি। তারপর থেকেই টিহুলের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছিল যে, নিশ্চয়ই হীরুই তাহলে তার বৌকে….।

    কী করে, কীভাবে ও তার প্রতিশোধ নেবে সকাল থেকে শুধু এই এক চিন্তা মাথায় ঘুরছিল ওর। টিহুল জানে না, এমনকী ভাবতেও পারে না; চৌকিদারের বিরুদ্ধে, পুলিশের বড় সাহেবের বিরুদ্ধে কী করে প্রতিশোধ নিতে হয়। ওরা বংশপরম্পরায় অত্যাচার সয়েছে, অন্যায় দেখেছে, কিন্তু কখনও প্রতিবাদ করার বা প্রতিশোধ নেওয়ার সাহস ওদের হয়নি। একদল অত্যাচার করেছে আর অন্যদল মুখ বুজে তা সয়েছে। এই-ই নিয়ম বলে জেনে এসেছে চিরকাল ওরা। মালিকদের গায়ের রঙ সাজপোশাক, ভাষা সব বদলেছে ধীরে ধীরে, কালে কালে; কিন্তু ওদের অবস্থার বিশেষ কোনো হেরফের হয়নি। ওরা যেমন ছিল তেমনই আছে। টিহুলের গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন সংস্কার, ওর বাপ-ঠাকুর্দা, ওকে শিখিয়ে গেছে ওদের কপালের এই লিখন। কপালের মারের বড় আর মার নেই।

    সন্ধে লাগতে-না-লাগতেই বাড়িসুদ্ধু শুয়ে পড়েছিল জুরা। লগন আর জুগ্ এক ঘরে শোয়। লাগোয়া ঘরে টুসিয়া আর টুসিয়ার মা। টুসিয়ার মা গতকাল সারাদিন সারারাত এবং আজকের পুরো দিনও কিছুমাত্র মুখে দেয়নি। তাই বোধ হয় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছিল। টুসিয়ার চোখে আজও ঘুম নেই। বাইরে শিশির পড়ার শব্দ শুনছে আর চমকে চমকে উঠছে। বারবার মনে হচ্ছে, এই বুঝি দাদা এল, ডাকলো, ‘টুসি, এই টুসি’ বলে। ঘণ্টাখানেক পর টুসিয়া মার নাকের সামনে হাত এনে বুঝতে চাইল ঘুম কতখানি গভীর। মা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। টুসিয়া তার চাদরখানা তুলে নিয়ে আলতো হাতে দরজার খিল খুলে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে। ও কী করছে? কোথায় যাচ্ছে? কেনইবা যাচ্ছে?

    জানে না টুসিয়া। ওকে যেন নিশিতে পেয়েছে।

    আকাশে চাঁদ উঠেছে। হুলুক্ পাহাড়ের নিচটা চাঁদের আলোতে আর কুয়াশাতে নীল স্বপ্নময় দেখাচ্ছে। একটা শম্বর ডেকে উঠল বাঁ-দিকের খাদ থেকে। শম্বরটা বাঘ দেখেছে নাকি? এমন শীতের রাতেই বাঘেরা পথের ধুলোর ওপর বসে থাকে, গাছ-পাতা থেকে ঝরে-পড়া বৃষ্টির মতো শিশিরের হাত থেকে বাঁচতে। টুসিয়ার ভীষণ শীত করছিল বাইরে বেরিয়েই, কিন্তু একটু চলতেই ওর গা গরম হয়ে এল। যদিও ওর মাথা ভিজে গেল হিমে এবং পথের পাশের গাছ-পাতা থেকে ঝরে-পড়া শিশিরে।

    আজ অবধি কোনোদিন এমন রাতে একা টুসিয়া বাড়ির বাইরে আসেনি। পরবের রাতে যখন গাঁ-সুদ্ধু লোক মহুয়া খেয়ে নাচগান করে সারারাত ফুর্তি করে, তখনও না। ওর দাদা হীরু ভীষণ গোঁড়া ছিল। সেই দাদার জন্যেই আজ ওর এমন রাতে বেরোতে হয়েছে। প্রথমে ভীষণই ভয় করেছিল ওর। এখন আর ভয় করছে না। দাদা পুলিশের বড় অসর। তাতে আজ আর কিছুমাত্র যায় আসে না। তার নিজের ভালো-মন্দ মান-সম্মান, ভবিষ্যৎ এসব কিছু নিয়েই ভাবে না আর। তার মা-বাবার অপমান, তার ছোট্ট ভাই লগনের ব্যথাতুর মুখ। তাকে হিংস্র করে তুলছে। এই অন্ধকার বনের জ্বলজ্বলে-চোখ হিংস্রতম শ্বাপদের মতো। ও হীরুর মুখোমুখি হতে চায়। এই অপমানের ফয়সালা করে, তবে তার শান্তি। সমস্ত পরিবারকে ওর দাদার দেওয়া সব অসম্মান অপমানকে আজ মুখের ওপর ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। একটা হেস্ত-নেস্ত করবেই আজ টুসি।

    দূর থেকে সাদা রঙ করা বন-বাংলোটাকে ফিকে চাঁদের আলোয় ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল। মনে হল, ধারে কাছে কেউ কোথাওই নেই। বাবুর্চিখানায় দরজা বন্ধ করে আগুনের পাশে বসে দুজন লোক পুটুপাট্ করে কথা বলছে। ফরেস্ট গার্ডদের কোয়ার্টার্সেই বোধহয় কনস্টেবলরা আছে। বাইরে কোনো জিপ-টিপও দেখলো না। তবে কি ওরা চলে গেছে? ও জানে না; জানতে চায়ও না। ও শুধু হীরুকে মুখোমুখি পেতে চায় একবার। নরম পায়ে, শিশির ভেজা বাংলোর হাতায় ঢুকে পড়ল ও। নাঃ। ওকে কেউই দেখেনি। এই শীতে কেউই বাইরে নেই। বাংলোর পাশ দিয়ে ঘুরে পিছনের চওড়া বারান্দায় এল টুসি, দুদিকে দুটি ঘর। মধ্যে রসার ও খাওয়ার ঘর। ছোটোবেলায় এই বাংলোর হাতার পেয়ারা গাছের পেয়ারা চুরি করে খেতে আসত ওরা সদলে। ও আর ওর সমবয়সি ছেলেমেয়েরা। হীরু শুধু ওদের চেয়ে বয়সে বড় ছিল বলেই নয়, এমনিতেও কখনও আসতো না। পড়াশুনো করত গাছতলার পাথরে বসে। হীরু চিরদিনই অন্যরকম ছিল। এই ভালুমার বস্তির কোনো ছেলেমেয়েরই মতো সে ছিল না ছোটবেলায়, ওদের গর্বের হীরু।

    বারান্দায় উঠেই টুসিয়ার বড় ভয় করতে লাগল। মেয়েদের নানারকম ভয় থাকে। কোনো পুরুষ কখনও কোনো মেয়ের ভয়ের স্বরূপ বুঝতে পারবে না। একমাত্র অন্য কোনো মেয়েই টুসিয়ার এই মুহূর্তের ভয়ের কথা বুঝতে পারত। মধ্যের ঘরে, ফায়ার প্লেসে জোর গগনে কাঠের আগুন জ্বলছিল। বাইরে থেকে কাঠ-পোড়ার ফুটফাট্ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল টুসিয়া। ঘরের মধ্যে একটা কুর্সি সরানোর আওয়াজ হল। টুসিয়া বুঝতে পারল, হীরু এবং বন্ধু বসবার ঘরেই আছে। দরজাটা ভেজানো ছিল। টুসিয়ার বুকের শব্দ ওর কানে আছাড়ি-পকার আওয়াজের মতো শোনাচ্ছিল। কী করবে, কী করল; না বুঝেই টুসিয়া এক ধাক্কায় দরজা খুলে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল। যেন ওর রাশিচক্র-জালেরই ভিতরে!

    টুসি ঢুকতেই, ইজিচেয়ারে আধো শুয়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি আর শাল গায়ে যে একজন মানুষ উল্টো দিকে মুখ করে বসেছিল, সে লাফিয়ে উঠল। টুসিয়া এক মুহূর্তের জন্য তার নিখুঁত ভাবে দাড়ি কামানো সুন্দর মুখ, একখানা উজ্জ্বল কালো চুল এবং চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেল। কী লম্বা সুপুরুষ, সুগঠিত মানুষটি। কী রহিস্।

    মানুষটি কথা না বলে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে দরজা ভিতর থেকে ছিটকিনি তুলে বন্ধ করে দিল। তারপর বড় সুন্দর করে হাসল টুসিয়ার দিকে চেয়ে। এটাই রহিস্ আদমিদের হাসি। বহুত্ পড়ে-লিখে বড় শহরে বড় খান্দানের ছেলেরা বোধ হয় এরকম করেই হাসে। টুসিয়া অবাক হয়ে চেয়ে ছিল সব ভুলে; তাঁর দিকে। মানুষ? না যেন দেবতা!

    হঠাৎ একটা উগ্র গন্ধ এল টুসিয়ার নাকে। ঘরময় গন্ধ। টুসিয়া হঠাৎই লক্ষ করল, ইজিচেয়ারের পাশে মাটিতে বসানো একটা কালো রঙের বিলিতি মদের বোতল এবং আধভর্তি গ্লাস একটা। টুসিয়া তখনও মানুষটির মুখের দিকে চেয়ে ভাবছিল। মনে মনে কুমারী টুসি বলছিল, আমি জানি, আমি নিশ্চয় জানি, তুমি আর কেউই নও। তুমিই সেই। যার স্বপ্ন দেখেছি আমি গত একমাস চুল বাঁধতে বাঁধতে, চান করতে করতে গান গাইতে গাইতে, বনপথে একা একা হাঁটতে হাঁটতে, শুখা মহুয়া আর মকাই-এর দানা বাছতে বাছতে। যার স্বপ্ন দেখেছি ঘুমের মধ্যে। তুমিই তাহলে সেই রাজপুত্র। আমার স্বপ্নের ধন! আমার পরম পুরুষ।

    লোকটি সত্যিই তার স্বপ্নেদেখা মানুষটির মতো। হুবহু এক। একটুও অমিল নেই। টুসিয়া মানুষটির দিকে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল। তারপর তার হুঁশ হবার আগেই মানুষটি বলল, এতক্ষণে এলে? সেই কখন থেকে তোমার অপেক্ষায় আছি আমি।

    একটু চুপ করে থেকে বলল, বিশ্বাস করবে না বললে, ঠিক তোমারই মতো কাউকে স্বপ্ন দেখেছি আমি। তুমি কাল এলে না কেন?

    টুসিয়া শুনছিল তার গভীর, সুললিত মার্জিত কণ্ঠস্বর। যেন কোনো দেবদূত কথা বলছিল ওর সঙ্গে।

    চৌকিদার কাল অন্য কাকে যে নিয়ে এসেছিল, তার সঙ্গে তোমার কোনো তুলনাই চলে না। সে সুন্দর, কিন্তু শুধু সুন্দরই! তোমার নাম কী গো?

    টুসিয়া নিজে বলল কিনা টুসিয়া জানে না, টুসিয়ার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, টুসিয়া। ও প্রতিমুহূর্তেই আশা করছিল যে, পাশের ঘর থেকে এক্ষুনি তার দাদা বেরিয়ে আসবে। এসে তার পরিচয় দিয়ে তার বন্ধুকে বলবে যে, এই-ই আমার আদরের বোন। যার কথা তোমাকে বলছিলাম। কিন্তু হীরু কি তার এই বন্ধুকে আদৌ বলেছিল টুসিয়ার কথা? না সবাই তার বোকা বাবা-মায়ের কল্পনা এবং তাদের মিথ্যা কল্পনায়-ভরা টুসিয়ার দিবাস্বপ্ন?

    কিন্তু হীরু এল না। দাদা এল না। মানুষটি তার দিকে এগিয়ে এসে হঠাৎ ডান হাত বাড়িয়ে তার গাল টিপে দিয়ে বলল, টু-সি-য়া। আহাঃ কী রূপ! এই বনজঙ্গলের মধ্যে এমন উজ্জ্বল রঙের যে এমন কোনো ফুল ফোটে তা তোমাকে না দেখলে কখনও জানতাম না।

    টুসিয়ার কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। মাথাটা কাজ করছিল না মোটেই।

    তুমি একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছ। আগুনের কাছে চলে যাও। তারপর এক গ্লাস তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। গরম হয়ে যাবে। শাড়ি জামা সব খুলে ফেল তাড়াতাড়ি। তোমার সব শীত আমি শুষে নেব। আমার শরীরের সব গরম দিয়ে তোমার ঠাণ্ডা শরীরকে একেবারে গরম করে দেব। তুমি দেখো, কত ভালো লাগবে তোমার। এক মুহূর্ত থেমে, সুন্দর মানুষটি আরো সুন্দর করে বলল, আমি খুব ভালো আদর করতে পারি। তোমার পাখির মতো শরীর আমার হাতে পড়ে, পোষা ময়নার মতো কথা বলবে, দেখো। দেখো তুমি।

    বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছিল টুসিয়া। তার স্বপ্নের রাজপুরুষকে সামনে দেখে তার যে ঘোর লেগেছিল দু’চোখে, তা কাটতে বড় বেশি সময় লেগে গেল।

    হঠাৎ টুসিয়া বলে উঠল, আমাকে যেতে দাও, এক্ষুনি যেতে দাও, নইলে চেঁচাব আমি। নইলে…

    মানুষটি কী একটা বের করল, কিন্তু কোথা থেকে বের করল, তা টুসিয়া বুঝতে পারল না, কিন্তু একটি ছোট্ট কালো জিনিস তার হাতের মধ্যে আগুনের আলোয় চক্‌চক্‌ করে উঠল। এমন জিনিস সে দারোগাদের হাতে দেখেছে এর আগে। জিনিসটা যে কী তা টুসিয়া জানত।

    মানুষটি নিচু গলায় বলল, একদম চুপ। রাণ্ডীদের ছেনালি আমার একেবারেই পছন্দ নয়। তাড়াতাড়ি শাড়ি খোলো। কাজ শেষ হয়ে গেলে ঐ শাড়িতেই তোমার ঝরানো ইজ্জত মুছে নিয়ে তোমার স্বামী বা মায়ের কোলে লক্ষ্মী সতী মেয়ে হয়ে গিয়ে আবার শুয়ে থেকো। এমন অনেক দেখেছি আমি। কিন্তু তুমি, মাল কিম্‌তি। তোমাকে বিশ রুপাইয়া দেব। আমি ভারী অস্সর বলেই যে বিনা পয়সায় সওদা করব, এমন কামিনা ভেবো না আমাকে।

    টুসিয়া অস্ফুটে বলল, দাদা! বড়ে ভাইয়া। কিন্তু হীরু এল না। মানুষটি অদ্ভুত এক নিষ্ঠুর হাসি হাসল। টুসিয়া এতক্ষণে বুঝল যে, মানুষটি একেবারে নেশাতে চুর হয়ে আছে। মানুষটি বলল, বাবাও ডাকতে পারো। আর কথা নয়, এক্ষুনি শাড়ি খোলো; বলেই রিভলবারটা তাক্ করে ধরল টুসিয়ার দিকে।

    মানুষটির হাত কাঁপছিল, উপর-নিচে হচ্ছিল হাতটা। টুসিয়ার হঠাৎ মনে হল, অতর্কিতে, অনিচ্ছাতেও মত্ত লোকের হাত থেকে গুলি বেরিয়ে যেতে পারে। এতদিন টুসিয়ার সংস্কারের গোপন গভীরে এই কথাই দৃঢ়মূল ছিল যে, মেয়েদের ইজ্জতের চেয়ে দামি আর কিছুই নেই। কিন্তু সেই মুহূর্তেই টুসিয়া প্রথম বুঝলে পারল যে, অভাবী, বঞ্চিত, হতভাগ্য হলেও তার এই জীবনকে সে তার ইজ্জতের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে। নিজের প্রাণটা বাঁচাতে ইজ্জতও দিয়ে দেওয়া যায়। সকলেই বুঝি পদ্মিনী হয় না। হতে পারে না

    আর একটি কথাও নয়। তাড়াতাড়ি। রিভলবারটা যেমন ধরাছিল তেমনই ধরা রইল টুসিয়ার বুক লক্ষ্য করে।

    কী করে করল, কেমন করে করল কিছু বোঝার আগেই শীতে আর ভয়ে ভীত, বিবর্ণ, নীল হওয়া টুসিয়া সম্পূর্ণ ভাবে বিবস্ত্র করল নিজেকে। বসবার ঘরের হ্যাটস্টান্ডে একটা বড় আয়না ছিল। আগুনের লালচে আভা-লাগা তার নগ্ন শরীরের হঠাৎ ছায়া পড়ল সেই আয়নায়। টুসিয়া নিজের চোখেই বড় সুন্দর দেখল নিজেকে। গত একমাস ধরে বড় যত্ন করে চান করেছিল মীরচা-বেটীতে। ওর মা যে বড় যত্ন করে করৌঞ্জ আর নিমের তেল মাখিয়েছিল। তার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গে রূপের বান ডেকেছিল। তখন আর কোনো ভয় ছিল না টুসিয়ার। ও নিজেও মরতে পারত, কিন্তু ও নিজে না মরে, ওর ভয়টা মরে গেল। মরে গিয়ে, মরা পাখির মতো শক্ত হয়ে রইল ওর ধুপুক্-করা দুটি বুকের ভিতরে। মানুষটি দুহাত, দুহাতের দশ আঙুল দিয়ে টুসিয়ার কুমারী শরীরের ভাঁজে ভাঁজে, খাঁজে খাঁজে কী যেন অধীর আগ্রহে খুঁজছিল। কী খুঁজছিল তা সেই-ই জানে। অবাক, বোকা হরিণীর মতো বনজ-বিবশ-বিস্ময়ে টুসিয়া নিষ্পলকে তাকিয়ে ছিল আগুনের আভায় এবং কামনায় লাল, ভারি শহরের, বহত্ পড়ে লিখে খুবসুরৎ অসর জানোয়ারটার দিকে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঋজুদা সমগ্ৰ ৫ – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article লবঙ্গীর জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }