কোজাগর – ২০
২০
লগনের প্রাণের বন্ধু পরেশনাথ। পরেশনাথ আর বুলকির কাছে লগন গত একমাস ধরে শুধু তার দাদার আসার গল্পই করেছে। দাদা নিশ্চয়ই এসে গেছে, তাই লগনের পাত্তা নেই একেবারে। দাদা কী কী নিয়ে এসেছে তার জন্যে, কে জানে? কত খাবার, কত খেলনা, কত জামাকাপড়। আর তা থেকে লগন নিশ্চয়ই- ভাগ দেবে পরেশনাথকে। লগনের দিদির জন্যে যে মালাটালা আনবে তা থেকেও টুসিয়া দিদি নিশ্চয় একটা দেবে বুলকি দিদিকে। পরেশ আর বুলকি তাই হাত ধরাধরি করে, রোদ ভালো করে উঠতে না উঠতেই চলেছে লগনদের বাড়ির দিকে। মুঞ্জরী বার বার বলে দিয়েছে, অসভ্যতা করবে না; হ্যাংলামি করবে না। লগনদের বাড়ি একটু থেকে জিনিসপত্র দেখেই চলে আসবে তোমরা
পরেশনাথ আর বুলকি সরগুজার ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে যথারীতি শর্টকাট করলো। মুঞ্জরীর রাগে গা জ্বালা করে উঠল। চেঁচিয়ে ডাকল দুটোকেই।
ওরা গুটি গুটি ফিরে এলো। মুঞ্জরী তাদের ধরে মাথা ঠুকে দিল। বলল, এতবার মানা করি, একদিনও কি তোমাদের হুঁশ থাকে না? কতদিন বলেছি, পথ ধরে যাবি, ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হাঁটবি না। দেখেছিস, তোদের পায়ে পায়ে কত চওড়া রাস্তা হয়ে গেছে ফসলের মধ্যে। কতগুলো সরগুজা গাছ মেরেছিস বস্ত তোরা? কম করে দুকেজি তেল হতো তা থেকে। আর কতদিন বলতে হবে। লজ্জা বলে কি তোদের কিছুই নেই?
পরেশনাথ একটু কেঁদেছিল।
বুলকি খুব শক্ত মেয়ে। একটুও কাঁদেনি।
মোটে বারো বছর হলে কী হয়, দারিদ্র্য, জীবনের কোনো কোনো ক্ষেত্রে; বাইশ বছরের প্রাপ্তমনস্কতা দিয়েছে বুলকিকে। হাঁটায়, চলায়; কথা বলায়।
ওরা যখন এগোচ্ছে তখন মুঞ্জরী হেঁকে বলল, গোদা শেঠের দোকান থেকে দশ পয়সার নুন নিয়ে আসবি বুলকি।
বলেই, ঘরে গিয়ে ঘরের কোণায় কাপড়-চোপড় চাপা দেয়া কালো মাটির-হাঁড়ি থেকে বের করে দশ নয়া এনে দিল ওর হাতে। আর বলল, নুনের পয়সা দিয়ে দিবি। ধার করে নুন আনতে নেই।
পয়সাটা ওঁর হাতে দিতে দিতে মুঞ্জুরী আতঙ্কিত হয়ে হঠাৎ লক্ষ করল, ছেঁড়া নীলরঙা ফ্রকটার আড়ালে তার ছোট্ট মেয়ে বুলকি যেন রাতারাতি বড় হয়ে গেছে। কী জ্বালা! তার মেয়েটা চিরদিন কেন ছোটই থাকল না। আজকালকার দিনে শাড়ির খরচ কত! বুলকি মেয়ে না হয়ে, ছেলে হলেই ভালো হতো। মেয়েদের নিয়ে কী কম জ্বালা! মুঞ্জরী ভাবছিল, চলে যাওয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে।
ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর নানকুয়া এলো। সাইকেলে করে। কিছু শেওই আর গুজিয়া নিয়ে এসেছে।
সাইকেলটা গাছে ঠেস দিয়ে রেখে বলল, নাও মাসি।
তারপর বলল, তোমরা কেমন আছো? মেসো কোথায় গেল?
মুঞ্জরী খুশি হয়ে ওকে বসতে দিল।
বলল, গোঁলদনি ধানের পায়েস করেছিলাম কাল একটু। গাইটা এখন ভালোই দুধ দিচ্ছে। বাঁশবাবুকে দুবেলা দিয়েও কিছু থাকে। খাবি একটু?
দু-স্-স্-স্।
নানকুয়া বলল, আমি নাস্তা করেই বেরিয়েছি। তাছাড়া দুধ তো বাচ্চা আর বুড়োরাই খায়।
তারপর বলল, এদিকে হরিণ খুব বেড়ে গেছে, না? আমার সাইকেলের সঙ্গে একটা বড় দলের প্রায় ধাক্কা লেগে গেছিল আর একটু হলে।
মুঞ্জরী বলল, হরিণদের আর কী? সারারাত বস্তির ফসল খেয়ে ধীরে সুস্থে রোদে হেঁটে জঙ্গলে ফিরছে। এখানে বাড়েনি কী? শুয়োর আর খরগোশই বা কী কম? মটরছিম্মি তো এবারে মাত্র পাঁচ কে-জি বিক্রি করতে পেরেছি। হওয়ার কথা ছিল মণ খানেক, তা, ক্ষেতে কি কিছু থাকতে দিল?
মেসো কোথায়? নান্কু আবার শুধলো।
জঙ্গলের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে মুঞ্জরী বলল, নালাটাকে গাড়ুহা করছে। যাতে সামনের বর্ষায় ক্ষেতে জল একটু বেশি থাকে। এবারে যদি মকাই ভালো হয় তবেই বাঁচোয়া। নইলে, বড়ই মুশকিল হবে।
এমন সময় পায়ে-চলা পথে মাহাতোকে মুঞ্জরীদের ডেরার দিকে আসতে দেখা গেল। আসতে আসতে সে কর্কশ গলায় চিৎকার করতে লাগল, এ মানি, মানিয়া হো। মানি আওয়াজ পেয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এদিকে এগিয়ে আসতে লাগল। হাতে কোদাল।
নানকুয়া যেন মাহাতোকে দেখেও দেখেনি এমন করে অন্যদিকে মুখ করে বসে রইল।
মানি এলেই, মাহাতো বলল, তোর বলদ দুটোকে এক্ষুনি নিয়ে চল, আমার ক্ষেতে লাঙল দিবি।
মানি মিন্ মিন্ করে বলল, আমার নিজের ক্ষেতের কাজই তো শেষ হয়নি মালিক। আর সাত দিনের মধ্যেই হয়ে যাবে। গতবারের টাকাটাও মিটিয়ে দিলে না এখনও। বড়ই অসুবিধার মধ্যে আছি।
মাহাতোর পায়ে শুঁড়-তোলা নাগড়া জুতো, পরনে ফিফিনে মিলের ধুতি আর বাদামি রঙের টেরিলিনের পাঞ্জাবি। সোনার বোতাম দেওয়া। একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে মাহাতো বলল, তোদের অসুবিধা তো’ সারাজীবনই। কিন্তু তোদের সুবিধা দেখতে গেলে যে আমার বড়ই অসুবিধা। অত কথা শুনতে চাই না। আসবি কি না বল্ এক্ষুনি।
সাংসারিক বুদ্ধি, মানিয়ার চেয়ে মুঞ্জুরীর চিরদিনই বেশি। মুঞ্জরী বলল, আগের টাকাটা মিটিয়ে দিলে তবু কথা ছিল। আর টাকা বাকি থাকতে, নিজের চাষের ক্ষতি করে কী করে বলদ নিয়ে যাবে ও। আপনিই বলুন মালিক!
আচ্ছা! এই কথা? তা কত টাকা বাকি আছে শুনি?
মুঞ্জরী মাটির দিকে চেয়ে বলল, তিরিশ টাকা।
ভালো কথা।
তারপর বলল, মানিয়া বয়েল নিয়ে চল্ এক্ষুনি, আমার নিজের চার জোড়ার ওপরেও তোর দুটো চাই। চার দিনই আমার কাজ হয়ে যাবে। সব টাকা শোধ করে দেবো একবারেই। গতবারের এবং এ-বারের।
মানিয়া হাত জোড় করল, বলল, দয়া করো মালিক, গরিবের ওপর দয়া করো। আমি আমার ক্ষেত চষতে না পারলে বাল-বাচ্চা নিয়ে উপোস থাকব সারা বছর। কয়েকটা দিন সবুর করো। আমার ইজ্জত-এর দোহাই।
এই রকম ব্যাপার? তোরও ইজ্জত? মাহাতো বলল। বলেই, মুঞ্জুরীকে, উদ্দেশ করে বলল, তুই-ই তো’ দেখছি মানিয়াকে চালাস, তুই-ই বদ বুদ্ধি জোগাস ওকে। নইলে ও লোক খারাপ নয়। তারপরই, মুঞ্জরীর কাছে এগিয়ে এসে বলল, ঠিক আছে। গোদা শেঠের কাছে কত ধার তোদের? আমি গোদাকে বলে দিচ্ছি যে, আর ধার যেন না দেয়। ধার যা বাকি আছে তাও যেন এক্ষুনি সুদে আসলে ওসুল করে। শোধ না করলে হাটের মধ্যে তোর শাড়ি খুললেই বা লজ্জা কীসের? গোদাকে তোরা সকলেই চিনিস। তখন তোদের ইজ্জত কোথায় থাকে দেখব।
হঠাৎই মানিয়া মাহাতোর নাগড়া জুতো পরা দুই পায়ের ওপর হুমড়ে পড়ে বলল, দয়া করো মালিক, গোদা শেঠকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিও না। তোমাদের দয়া ছাড়া, ধার ছাড়া; আমরা বাঁচি কী করে?
মানিয়াকে একটা লাথি মেরে সরিয়ে দিল মাহাতো, তারপর বলল, দয়া করে করেই তো এত বড় আস্পদ্দা তোদের। নিজে বাড়ি বয়ে একটা উপকার চাইতে এলাম, তার বদলে এই নিমকহারামের ব্যবহার তোদের!
নানকুয়া রোদে পিট দিয়ে চৌপাইয়ে বসেছিল। হঠাৎ ও ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মতো সটান হয়ে দাঁড়িয়েই উবু হয়ে বসে-থাকা মানিয়ার কাছে গেল, গিয়ে মানিয়াকে ওর ফতুয়া সুদ্ধু তুলে ধরল বাঁ হাতে, তুলে ধরেই ঠাস্ করে এক চড় লাগালো গালে।
মাহাতো, মুঞ্জরী এবং মানিয়া, নানকুয়ার এই অতর্কিত আক্রমণে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
নানকুয়া বলল, ইজ্জত? তোমার আবার ইজ্জত কীসের মেসো। যে, কথায় কথায় লোকের পায়ে পড়ে, তার ইজ্জতটা আর আছে কী? ধার কি গোদা শেঠ এমনি-এমনিই দেয়? সুদ নেয় না তোমাদের কাছ থেকে? তবে মাহাতোর এতো বক্তৃতার কী?
নানকুয়া মাহাতোর দিকে চোখ তুলে তাকালো না পর্যন্ত। ওর হাবভাবে মনে হলো, লোকটা যে সামনেই আছে তা নানকুয়া লক্ষ করেনি।
তেল-চুক্চুক্ মাহাতো অনেকক্ষণ একদৃষ্টে স্থির চোখে চেয়ে রইলো নানকুয়ার দিকে।
তারপর স্তম্ভিত হয়ে, আস্তে আস্তে বলল, কী দাঁড়ালো তাহলে ব্যাপারটা! এই যে, নানকুয়া! এদিকে যে তাকাচ্ছিসই না আমি কি একটা মানুষই নই?
নানকুয়া অন্যদিকে মুখ করে বলল, ব্যাপারটা যা ছিল, তাই-ই। নতুন কিছু নয়। তুমি মানুষ হলে, মানুষদের লজ্জা রাখার জায়গা থাকবে না। তারপরই বলল, তোমার সঙ্গে আমি কথা বলছি না। আমি আমার মেসোর সঙ্গে কথা বলছি।
মাহাতো ধমকের স্বরে বলল, কিন্তু আমি তোর সঙ্গে বলছি। তুই-ই তাহলে এখন মানিয়ার পরামর্শদাতা? তাই-ই এত সাহস মানিয়ার আর তার বৌ-এর?
এবার নানকুয়া মাহাতোর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, সাহস? মানিয়ার সাহস কোথায়? সাহস থাকলে তোমার পায়ে পড়ে? কিন্তু এও জেনে যাও মাহাতো যা হয়েছে তা হয়েছে। মানিয়া আর কখনও তোমার পায়ে পড়বে না। আজ থেকে তোমাকে বলে দিলাম, তুমি এ বাড়ির চত্বরে ঢুকবে না। তোমার সঙ্গে মানি ওরাওঁ-এর কোনো লেনদেন নেই। আর বাকি টাকাটা এক্ষুনি চাই ওদের। গোদার দোকানের ধার শোধ করার জন্যে।
মাহাতো গভীর বিস্ময়ে স্পর্ধিত নানকুয়ার দিকে চেয়ে রইল। তার দু’শ বিঘা চাষের জমি। দেড়শ গোরু বাছুর। তার অঙ্গুলিহেলনে এই ভালুমারের বাঘে-গোরুতে এক ঘাটে জল খায়। তার মুখের ওপর এত বড় কথা বলে অন্য লোকের উপস্থিতিতে! এত বড় সাহস যে কারো হতে পারে, এটা মাহাতোর ভাবনারও বাইরে ছিল।
মাহাতো বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল, আমি তোর বাপের চাকর নইরে ছোকরা, যে, তোর কথায় উঠব বসব। টাকা চাইলেই, টাকা পাওয়া যায় না। টাকা নেই। ঐ টাকা আমি দেবোই না। দেখি, তুই কী করতে পারিস।
নানকুয়া এবার ঘুরে দাঁড়ালো মাহাতোর দিকে।
বলল, দ্যাখো মাহাতো, আমার সঙ্গে লাগতে এসো না। তোমার কপালে আগুন লেগে যাবে। বেশ জাঁকিয়ে বসে আছে। ঘিয়ে ভাজা পরোটা খাচ্ছো; আর বস্তির যত ছোরিদের নিয়ে মজা লুটছ। যা করছ, করে যাও আরও কিছুদিন; যতদিন না তোমার সময় আসে। তোমার সময় ফুরিয়ে আসছে। সাবধান করছি তোমাকে। আমার সঙ্গে লাগতে এসো না। খুব খারাপ হয়ে যাবে।
খারাপ হয়ে যাবে?
মাহাতো কথাটার পুনরাবৃত্তি করলো। তারপর বলল, বটে! এইরকম ব্যাপার! আচ্ছা!
বলেই, চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালো।
নানকুয়া পথ আগলে বলল, চললে কোথায়? টাকাটা দিয়ে তবে যাও। টাকা না দিলে, যেতে দেব না তোমায়।
যেতে দিবি না। আমায়? আজীব বাহ্!
মাহাতোর মুখে একটা ক্রূর হাসি ফুটল।
বলল, টাকা-ফাকা আমার কাছে নেই। থাকলেও দিতাম না। তোর কথাতেই। তোর কথায় আমায় চলতে হবে নাকি রে ছোকরা?
নানকুয়া অদ্ভুত ভাবে হাসল একবার। বলল, টাকাটা না দিলে তোমার ধুতি-পাঞ্জাবি, জুতো-আংটি, হাতের ঘড়ি পর্যন্ত খুলে রেখে দেব। টাকা এনে, ছাড়িয়ে নিও পরে।
মানিয়া চেঁচিয়ে উঠলো, নানকুয়া; এই নানকুয়া তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এ কী করছিস? এ কী করছিস? বলতে বলতে, মানিয়া এগিয়ে এল নানকুয়ার কাছে। কাছে আসতেই, নানকুয়া আরেক থাপ্পড় লাগালো মানিয়াকে। বলল, তোমার ইজ্জত তোমার বুকের মধ্যে মরে গেছে। তোমাকে অনেক থাপ্পড় মারলে যদি সে কখনও জাগে। বলেই, মাহাতোর গলার কাছে বাঁ হাত দিয়ে পাঞ্জাবিটা মুঠি পাকিয়ে ধরলো। ধরেই বলল, বের কর টাকা, শালা মাহাতোর বাচ্চা।
মাহাতো নানকুয়াকে একটা লাথি মারলো নাগরা জুতো-সুদ্ধু। সঙ্গে সঙ্গে নানকুয়া তার মুখে প্রচণ্ড এক ঘুষি মারল; মেরেই তাকে মাটিতে চিৎ করে ফেলে তার বুকের ওপর বসল। বসেই, দু হাত দিয়ে গলা টিপে ধরল। মাহাতো ছট্ফট্ করতে লাগল। ভয়ে, উত্তেজনায় মুঞ্জরীর ঠোঁট নীল হয়ে গেছিল। সারা শরীর কাঁপছিল থরথর করে। মানিয়া হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিল।
হঠাৎ কারা যেন নানকুয়ার পিছনে হাততালি দিয়ে উঠল।
সকলেই চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখে, পরেশনাথ, বুলকি আর জুর ছোট ছেলে লগন এক সঙ্গে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে নানকুয়াকে বাহবা দিয়ে। জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে। নানকুয়া, মাহাতোর গলা থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে ওর বুকে বসা অবস্থাতেই ওর পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে টাকা আর কাগজ বের করল এক তাল। বের করেই, পরেশনাথ আর লগনকে ডাকল।
ওরা দৌড়ে কাছে যেতেই, মানিয়াকে শুধলো, কত টাকা মেসো?
মানিয়া ঘোরের মধ্যেই অস্ফুটে বলল, তিরিশ টাকা।
এতো ভয় মানিয়া জীবনে কোনোদিন পায়নি। জঙ্গলে বাঘের মুখে পড়েও নয়।
নানকুয়া টাকাগুলো গুনে, তিরিশ টাকা পরেশনাথের হাতে দিয়ে, বাকি টাকাটা আবার পকেটে রেখে দিল। রেখে দিয়ে, মাহাতোকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
কিন্তু মাহাতো উঠল না। মারার মতো পড়ে রইল।
মুঞ্জরী দৌড়ে গেলো ঐ দিকে। বুলকিকে বলল, দৌড়ে জল নিয়ে আয় বুলকি। মাহাতো বোধ হয় মরেই গেছে।
নানকুয়া আবার এসে চৌপাইতে বসল। নানকুয়া জানতো যে, মাহাতো প্ৰাণে মরেনি। কিন্তু মরেছে ঠিকই। ভালুমারে মাহাতো বলে প্রবল পরাক্রান্ত, ধনশালী, কর্তৃত্বর বাহক যে লোকটা এতদিন বেঁচে ছিল সে মরে গেলো। আজ এই মুহূর্তে। মানিয়ারাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এতদিন। ঘন ঘন তার কাছে হাত জোড় করে, তার পায়ে পড়ে। কিন্তু পরেশনাথ, লগন, ওরা আর সেইভাবে মাহাতোকে বাঁচতে দেবে না। ঐ শিশুদের হাততালিই তার প্রমাণ। একটুকু শিশুরাও অত্যাচারের স্বরূপ বুঝেছে, যদিও সেটাকেই নিয়ম বলে জেনে এসেছে এতদিন; তাদের গুরুজনদের সাহসের অভাবের জন্যে। নানকুয়ার মতো একজনের দরকার ছিল এদের কাছে; যে এসে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটালে, অন্যায়কে অন্যায় বলে আঙুল তুলে বলার সাহস দেখালে, ওরা সব দৌড়ে, হাততালি দিতে দিতে নানকুয়ার পিছনে এসে দাঁড়াবে। নানকুয়া জানে, তার আসল জোরটা তার নিজের শরীরের জোর নয়। সেটা কিছুই নয়। তার আসল জোর অসংখ্য মুক, সরল, নির্যাতিত মানুষের মদতের মধ্যে। ওরা জানে না, ওরা সকলে এক জোটে দাঁড়ালে ওরা হাতির দলের চেয়েও বেশি বল ধরবে। তখন মাহাতোর মতো, গোদা শেঠের মতো; একটা দুটো শেয়াল কুকুর ওদের এমনি করে ভয় দেখিয়ে কুঁকড়ে রাখতে পারবে না আর। নানকুয়া জানে যে, পরেশনাথরা তার সঙ্গে আছে। সঙ্গে আছে ভবিষ্যৎ-এর সব মানুষ, আবালবৃদ্ধবণিতা। নানকুয়া এও জানে যে, আজকে ছোট্ট-মুঠির, হালকা-শরীরের শিশুরা একদিন যুবক হবে। মানিয়ার মতো কাপুরুষ, ভীরু পরিবেশের ভারে ন্যূব্জ জীব হবে না তারা। তারা মরদ হবে সত্যিকারের। এই সমস্ত গরিব-গুরবো মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ তখন ওদের শক্ত মুঠিতে ধরা থাকবে। সে ভবিষ্যৎ নাড়ানোর ক্ষমতা মাহাতোদের, গোদা শেঠদের আর কখনওই হবে না।
প্রায় দশ মিনিট পরে মাহাতো উঠল। জল খেলো। মুঞ্জরী আর বুলকি তার মুখে-চোখে জল-দেওয়াতে মাহাতোর বুকের কাছে পাঞ্জাবির অনেকটা জায়গা ভিজে গেছিল। মাহাতো উঠে দাঁড়াতেই নানকুয়া মাহাতোকে ডাকলো ওর দিকে। বলল, এদিকে একটু শুনে যাও। অবাক চোখে মানিয়া, মুঞ্জরী, বুলকি, পরেশনাথ আর লগন দেখল যে, নানকুয়াই যেন মাহাতো হয়ে গেছে হঠাৎ আজ সকালে। আর মাহাতো, ওদেরই একজন। আশ্চর্য!
মাহাতো আস্তে আস্তে নানকুয়ার কাছে এসে দাঁড়াল।
নানকুয়া ধীরে সুস্থে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে, তার লাল-নীল রঙ টিনের লাইটার বের করে কুটুং করে আগুন জ্বেলে সিগারেটটা ধরালো, এবং একটা সিগারেট দিল জ্বালিয়ে, মাহাতোকে। মাহাতো নেবে কি-না একটা ভেবে, সিগারেটটা নিলো নানকুয়ার কাছ থেকে। ধরে রইল। কিন্তু টানলো না। নানকুয়া আস্তে আস্তে নৈর্ব্যক্তিক গলায় বলল, মাহাতো, আমি ছেলেমানুষ নই, বোকাও নই। আমি জানি যে, তুমিও নও। আমি এও জানি যে, তুমি এরপর কী করবে। মানে, কী করে আমাকে শায়েস্তা করবে। তোমার লেঠেলরা, তোমার লোকজনেরা আমাকে মেরেও ফেলতে পারে। তার জন্যে আমার ভয় নেই। তোমাকে শুধু একটা কথাই বলতে চাই। আজ থেকে ঝগড়াটা তোমার সঙ্গে আমার। আমাকে যা করতে পারো, কোরো। কিন্তু এই মেসোদের, মানিয়া-মুঞ্জরীকে এর মধ্যে টেনো না। ওদের ওপর যদি তুমি অথবা গোদা শেঠ অথবা তোমাদের কোনো লোক, কোনো হামলা করে, তাহলে খুবই খারাপ হবে। ব্যস্, এইটুকুই বলার ছিল।
মাহাতো কিছু না বলে চলে যাচ্ছিলো। ওর চোখ দুটো বাঘের মতো জ্বলছিল। নাকের ফুটো দিয়ে ক্ষীণ ধারায় রক্ত গড়িয়ে এসে পাঞ্জাবির বাঁ দিকের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছিলো।
নানকুয়া চিৎকার করে বলল, কোতোয়ালিতে গিয়ে কিন্তু নালিশ কোরো না। তাতে আমার হাজত হতে পারে, কিন্তু ছাড়া পেয়েই আবার আমি ফিরে আসব এখানেই। তার চেয়ে আমার ওপরেই বদলা নিও, যা পারো। পুরুষ, ফাতু ফাল্গু কোতোয়ালিতে যায় না। তারা নিজেদের ব্যাপারের ফয়সালা নিজেরাই করে।
মাহাতো দাঁড়িয়ে পড়ে ওর কথা শুনে আবার চলতে লাগলো, টলতে টলতে। নানকুয়া আরেকবার চেঁচিয়ে বলল, আরও একটা কথা। জেনে রেখো যে, আমি একা নই। তুমি বুদ্ধিমান। তোমার বোঝা উচিত যে, আমি একা হলে, আমার এত সাহস হতো না।
মাহাতো দাঁড়িয়ে, বিকৃত মস্তিষ্ক, বিবশ, শ্লথবুদ্ধি লোকের মতো একবার চাইল নানকুয়ার মুখের দিকে। তারপরই আবার চলতে লাগল।
মাহাতো জঙ্গলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাবার অনেক, অনেকক্ষণ পর প্রথম কথা বলল মানিয়া, অস্ফুটে বলল; ক্যা খাত্রা বন গেঁয়ো, হো রাম।
নানকুয়া বলল, কী হল মাসি? গোঁলদনির পায়েস খাওয়াবে না? পায়েস খাওয়াও।
পরেশনাথ নানকুয়ার কাছে এগিয়ে এসে ওর কোলের মধ্যে বসে বলল, নাক ফাটিয়ে দিলে বড়ে-ভাইয়া। ইস্, তোমার হাতে কী জোর? নানকুয়া পরেশপাথের রোগা হাড় জিরজিরে হাত দুটোকে আদর করে নিজের হাতে তুলে বলল, তোর হাতেও অনেক জোর আছে রে। জোর আছে কি নেই, জোর না খাটালে তা জানবি কী করে?
লগন পরেশনাথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নানকুয়ার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে। বলল, পরেশনাথ এবারে আমি যাই রে। মা রাগারাগি করবে দেরি করলে। বলেই, ও চলে গেলো।
নানকুয়া লগনকে বলল, তোর মা-বাবা কেমন আছে রে?
ভালো।
তারপর লাজুক গলায় বলল, তোর দিদি?
সেও ভালো।
বলেই, লগন দৌড়ে গেলো।
বুলকি একটি অ্যালুমিনিয়ামের কালচে হয়ে যাওয়া প্লেটে করে একটু পায়েস নিয়ে এলো নানকুয়ার জন্যে। অন্য হাতে লোটাতে করে জল। কিন্তু লগনকে পায়েস খেতে ডাকল না কেউ। মুঞ্জরীরা বড়ই গরিব। ভদ্রতা, আদব-কায়দা, এসব ওরা জানতো একসময় কিন্তু এখন সবই ভুলে গেছে। কখনও যে এ সব জানতো; এখন সেই কথাটাও বোধহয় ভুলে গেছে। নানকুয়া পায়েসটা হাতে নিয়ে বুলকিকে বলল, কোথায় যাওয়া হয়েছিল সাত-সকালে সকলে দল বেঁধে!
লগনদের বাড়ি। লগনের হীরুদাদা আসবার কথা ছিলো তো’! অনেক জিনিস আর খেলনা-টেলনা সব নিয়ে আসবে বলেছিল। তাই আমরা গেছিলাম ওর জিনিস দেখতে।
তাই? নানকুয়া বলল। কী এনেছে? দেখলি?
দূর্। আসেই নি। ঠোঁট উল্টে বলল, বুলকি। মানে, এসেছে কিন্তু ওদের কাছে আসেনি। দেখাও করেনি ওদের সঙ্গে। এখন লগনের দাদা ভারী অসর। নাম বদলে ফেলেছে নাকি! হীরু দাদা এখন আর ওরাওঁ নেই। সিং হয়ে গেছে। ফরেস্ট বাংলোয় উঠেছে।
নানকুয়া পায়েস খাওয়া থামিয়ে অবাক গলায় বলল, বলিস কী রে?
হ্যাঁ! সত্যি। তুমি পরেশনাথকে জিগেস করো। কালকে সারারাত টুসিয়া দিদি খুব কেঁদেছে।
তাই বুঝি। নানকুয়া বলল। অন্যমনস্ক গলায়।
নানকুয়ার চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এল। টুসিয়ার জন্যে তার আর কোনো ভালোবাসা নেই। খুব ভালো হয়েছে। শিক্ষা হোক ওর। বড় অসরকে বিয়ে করবে। নানকুয়ার মতো ছেলে কি ওর যোগ্য? নিজের অসর দাদাই যদি এমন করে, তাহলে আর দাদার বন্ধুর ভরসা কী? খুবই ভালো হয়েছে।
নানকুয়া বলল। মনে মনে।
তারপর টুকিটাকি অনেক কথা হলো।
বুলকি আর পরেশনাথ নানকুয়াকে পেলে ছাড়তেই চায় না। মুঞ্জরীও না। কেবল মানিয়াই বিব্রত বোধ করে এ ছেলেটা এলে। এ ছেলেটা তার এতদিনের শুভবুদ্ধি, ন্যায়-অন্যায় বোধ, ভালো-মন্দ, বড়-ছোট সম্বন্ধে ধারণা সব ওলটপালট করে দিয়ে চলে যায়। যখনি ও আসে।
কিছুক্ষণ পর সাইকেলে উঠে, নানকুয়া গোদা শেঠের দোকানের দিকে চলল।
নানকুয়া জানে, এতক্ষণে কী কী ঘটেছে। মাহাতো অনেকক্ষণ বাড়ি পৌঁছে গেছে। গোদা শেঠকে খবর দেওয়া হয়েছে নিশ্চয়ই।
ওর সাইকেলের ক্যারিয়ারে একটা চেন বাঁধা থাকে। সেটাকে ক্যারিয়ার থেকে খুলে নিয়ে হ্যান্ডেলের সঙ্গে ঝুলিয়ে নিল নানকুয়া। গোদা শেঠের দোকানের সামনে এসে সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে ভিতরে ঢুকে বলল, সিগারেট। এক প্যাকেট।
কী খবর? নানকু মহারাজ?
গোদা শেঠ কপট বিস্ময়ের সঙ্গে বলল।
গোদা শেঠের চোখ দেখেই নানকুয়া বুঝল যে, খবরটা মাহাতোর কাছ থেকে গোদা শেঠের কাছে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে। মাহাতোর একজন লোক দোকানের গদিতে শেঠের পাশেই বসে ছিল।
বিশেষ কোনো খবর নেই। চলে যাচ্ছে একরকম করে।
কয়লা খাদের কাজ বন্ধ বুঝি?
হ্যাঁ। স্ট্রাইক চলেছে।
সরকার কয়লা খাদগুলো নিয়ে নেবার পর এত মাইনে বাড়ালো আর কয়লার দাম সোনার দাম হয়ে গেলো, তবুও বুঝতাম যদি কয়লা ঠিক পাওয়া যেত। তবে বন পাহাড়ের হাটের বড় বড় সব মোরগাগুলো এখন তো তোমাদেরই জন্যে। ভারত সরকারের জয় হোক। সরকার মালিক হওয়ার পরে সব সুবিধা তোমাদেরই। তোমাদের যে অনেক ভোট। হাঃ। আজকাল আমরা তো হাতই দিতে পারি না কিছুতে। তবুও আবার স্ট্রাইক কীসের? এততেও তোমরা সন্তুষ্ট নও?
ওতো আমার ব্যাপার নয়। ইউনিয়নের ব্যাপার। ইউনিয়ন বলে, সব সময় লড়ে যেতে হবে। আমাদের অবস্থা আগের থেকে ভালো হয়েছে বলেই যে, আরো ভালো হতে পারবে না; এমন কথা কি আর কিছু আছে?
এত মাইনে বাড়িয়েও তো খাদ থেকে বেশি কয়লা উঠছে না। সব সরকারি খাদই লস্ এ চলেছে।
নানকুয়া বলল, তা তো চলবেই। এতদিন মালিকরা যা চুরি করত, ট্যাক্স ফাঁকি দিত, তার কিছুটা অংশ কয়লা খাদের উন্নতির জন্যেও খরচ করত। এখন চুরি আরও বেড়েছে। তবে চুরি করছে অনেকে মিলে, অফসর, অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কেরানি সবাই। টিভি, ফিরিজ, মোটর সাইকেল, গাড়ি মদ আর মেয়েমানুষে খরচ হচ্ছে সেই টাকা। কয়লার দাম আর সস্তা হবে কী করে? খাদের মধ্যে নেমে কালি-ঝুলি মেখে আমরা কাজ করি বলেই তো আমরা একাই দায়ী নই। পুরো ব্যাপারটা অনেকই গোলমেলে। ভালুমারের দোকানের এই গদিতে বসে সুদে টাকা খাটিয়ে এই গর্তের মধ্যে থেকেই তো তুমি আর সব খবর রাখতে পারো না গোদা শেঠ। রাখোও না। তাই এসব আলোচনা তোমার অথবা আমার মতো কয়লা খাদের সামান্য মেটের না করাই ভালো। আমরা কতটুকুই বা বুঝি, কিসে কী হয়, তার?
আমি তো মুখ্যু-সুখ্য লোক, চিরদিনই কম বুঝি। তা যা শুনতে পাচ্ছি, তাতে তুমি যে অনেক বোঝো, বা বুঝছ আজকাল; তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। তোমার মতো ছেলে দু-চারটে থাকলে ভালুমারের মতো অনেক বস্তির লোকের অবস্থা ভালো হয়ে যেত। মানুষ হয়ে উঠত তারা। কী বল?
খোঁচাটা নানকুয়া বুঝল
বলল, তা সত্যি। তবে, হবেও হয়তো একদিন। আমার মতো কেন? আমার চেয়ে সবদিক দিয়ে ভালো ছেলেরাই আছে, থাকবে সব গ্রামে। ক্রমে ক্রমে দেখতে পাবে।
সে আর দেখছি কই? এই আমাদের জুর ব্যাটা হীরু! পুলিশ সাহেব হয়ে, অ্যাফিডেভিট্ করে নাম বদলে সিং হয়ে গেলো। ভাবা যায়? নিজের বস্তিতে এসে নিজের বাড়ি যায়নি, বাপকে চেনেনি, বোনকে মানেনি, তা এই-ই যদি ভালোত্বর নমুনা হয়, তাহলে আর বস্তির ছেলেদের ভরসা কী?
নানকুয়া, সিগারেটের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে বলল, ভালোর নানা রকম আছে। হীরু ভাইয়া একরকম ভালো। সেই সব ছেলেরা অন্য রকম ভালো হবে। এটুকু বলেই, আর কথা না-বাড়িয়ে বলল, মানিয়া মেসোর হিসাবটা বের করো তো?
গোদা শেঠ অবাক হবার ভান করে বলল, মানিয়ার হিসেবে তোমার কী দরকার?
নাঃ, কিছু টাকা পাঠিয়েছে মেসো; তোমাকে দেওয়ার জন্যে।
কেন? মানিয়ার কি পক্ষাঘাত হয়েছে? সে নিজে আসতে পারলো না?
অত কথা দিয়ে তোমারই বা দরকার কি? আমি তো ধার করতে আসিনি তার হয়ে টাকা শোধ করতেই এসেছি। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। হিসেবটা বের করো।
গোদা শেঠ একটা খাতা বের করে বলল, এত তড়বড় করলে হবে না। গত মাসের সুদ কষা হয়নি। একটা বসতে হবে।
হিসেব করতে করতে গোদা শেঠ বলল, এখান থেকে তুমি যাবে কোথায়?
নানকু উত্তর দিল না।
নানকুয়া যাবে না কোথাওই। কারণ এখানেই ওর বিপদ কম। ও জানে যে, মাহাতো ওকে খুন করালে, জঙ্গলের নির্জন রাস্তায় এই বস্তির বাইরেই খুন করাবে। করে, লাশ গুম করে দেবে।
গোদা শেঠের এ প্রশ্নের তাৎপর্য নানকুয়া আঁচ করে বলল, যাবো চিপাদোহরে। কাজ আছে। সেখানেই থাকব দিনকতক। কয়লা খাদের স্ট্রাইকটা মনে হচ্ছে মিটে যাবে দিন সাতেকের মধ্যে।
স্ট্রাইক মিটতে যে এখনও কমপক্ষে দিন পনেরো বাকি, তা নানকুয়া জানে। এখানে পাগলা সাহেবের সঙ্গে একটু পরামর্শ করবে। বিপদে-আপদে উনিই নানকুয়ার সব। নানকুয়া ভাবছিলো যে, হীরুও তো পাগলা সাহেবের দাক্ষিণ্যেই মানুষ। তাকে রাঁচিতে কলেজে পাঠিয়ে লেখাপড়া শেখানো, অসর হওয়ার পরীক্ষাতে বসানো, সবই তো তাঁরই করা! অথচ হীরু ভাইয়া এমন অমানুষ হলো কেন? নিজে বড় হয়ে কোথায় নিজের অত্যাচারিত, বঞ্চিত, বুভুক্ষু স্বজাতিদের ভালো করবে, তাদের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেবে, তা নয়, নাম পাল্টে অন্য জাতে গিয়ে উঠলো? নিজের পূর্ব পরিচয়, নিজের বাবা-মা, নিজের গ্রামের লোককে এমন করে ধুলোয় ফেলে দিল? একে কি সত্যিকারের বড় হওয়া বলে? কে জানে? হীরু ভাইয়ার কথা হীরু ভাইয়াই বলতে পারবে।
গোদা শেঠ সুদ কষে বলল, নাও। দুশো তেরো টাকা হয়েছে সবসুদ্ধু। আরও পঞ্চাশ টাকা ধারের কথা বলে গেছে মানিয়া পরশুই, ফসল উঠলে শোধ করে দেবে বলেছে।
নানকুয়া টাকাটা ফেলে দিয়ে বলল, খাতাটা দেখি। তারপর নিজে হাতে বুক পকেট থেকে বল-পয়েন্ট পেনে টাকার অঙ্কটা বসিয়ে দিয়ে দিল।
গোদা শেঠ-এর চোখে চেয়ে বললো, একশ টাকা দিয়ে গেলাম।
আমাকে বিশ্বাস হলো না বুঝি তোমার? নিজেই লিখলে?
যা দিনকাল পড়েছে। দেখলে না, জুগনু ওরাওঁ তার নিজের ছেলেকে বিশ্বাস করে কীরকম ঠকল? আজকাল কাউকে বিশ্বাস না করাই ভালো।
ওঃ তাই-ই। গোদা শেঠ বলল। গোদা শেঠ নানকুয়ার ঔদ্ধত্যে ক্রমাগতই চটে যাচ্ছিল। কিন্তু বানিয়ারা কখনও রাগ প্রকাশ করে না। রাগ হাসিমুখে চেপে রাখার ক্ষমতা যার যত বেশি, সে তত বড় বানিয়া।
এমনভাবে নানকুয়া কখনও কথা বলেনি গোদা শেঠের সঙ্গে এর আগে। হয়তো কেউই বলেনি।
নানকুয়া ভাবছিলো, যারা হাসতে হাসতে এখন তাকে খুন করাবার প্ল্যান আঁটছে, তাদের কাছে হাত কচলে, আমড়াগাছি করে লাভ কী? ওদের মানে না এমন কিছু লোকও যে আছে, যারা গোদা শেঠ বা মাহাতোকে তোয়াক্কা করে না এবং না করেও বাঁচে; বেঁচে থাকতে চায় এই কথাটাই ওদেরও জানান দেওয়ার সময় হয়েছে।
নানকু বললো, আরও একটা কথা। আমি না বললে, মানিয়া মেসোকে তুমি আর একটা টাকাও ধার দেবে না। আর যে টাকাটা বাকি আছে সেটা একমাসের মধ্যেই আমি এসে শোধ করে দেব।
তোমাকে একটা খৎ লিখে দিই যে, তোমার কথাই মেনে চলব?
গোদা শেঠ কৃত্রিম বিনয় এবং বিদ্রূপের সঙ্গে নানকুয়াকে বলল।
তার দরকার হবে না। আমার মুখের কথাই তোমার কাছে যথেষ্ট বলে মনে করি আমিই।
নানকু কেটে কেটে বললো। তারপর গোদার দু’চোখে তার দু’চোখ রেখে বলল, আশা করি, তুমিও তা-ই মনে করবে। কিছুক্ষণ চোখে চোখ রেখে, গোদা শেঠের জবাবের অপেক্ষা না করেই; দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে সাইকেলে উঠে নানকুয়া চলে গেলো। কাঁকুরে মাটির রাঙা ধুলোয় কিরকির শব্দ উঠলো।
নানকুয়া চলে গেলে মাহাতোর লোকের দিকে চেয়ে, একটা দেশলাই কাঠি দিয়ে তন্ময় ভাবে কান চুলকোতে চুলকোতে গোদা বলল, তাহলে? সব তো নিজের চোখেই দেখলে শুনলে? বোলো গিয়ে মাহাতোকে।
গোদার ডান চোখটা আস্তে আস্তে গুটিয়ে ছোট হয়ে এলো কান চুলকোবার আরামে। আর বাঁ চোখটা, পুরোপুরি বন্ধ। ঐ অবস্থায় গোদা বিড় বিড় করে বলল, কালকে দোকানে একটা নতুন হনুমান ঝাণ্ডা লাগাতে হবে। আর বজ্রলীর পুজো ও চড়াতে হবে।
কত পুজো চড়াবে? পাঁচ সিকের?
গোদা শেঠ বলল, আরে না, না। পাঁচ সিকের পুজোয় এ-রাবণ বধ হবে না। মোটা পুজো চড়াব।
কোজাগর – ২১
২১
রথীদা মানুষটার শেকড় সম্বন্ধে আমরা প্রত্যেকেই অজ্ঞ। এখানের একজন মানুষও জানে না রথীদার দেশ কোথায়, বাড়িতে কে কে আছেন অথবা আগে উনি কী করতেন! কেউ জানতে চাইলে, উনি চিরদিনই এড়িয়ে যান। যদি কেউ বেশি বাড়াবাড়ি করেন তাহলে হাব-ভাবে বুঝিয়ে দেন যে, তিনি নিজের ব্যাপারে অন্যের বেশি ইন্কুইজিটিভনেস্ পছন্দ করেন না। এখানে রথীদা আছেন গত পনেরো বছর। আমি ভালুমারে বদলি হয়ে এসেছি হান্টারগঞ্জ-জৌরী-পতাপ্পুরের জঙ্গলের এলাকা থেকে, তাও বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। হাজারিবাগ জেলার হান্টারগঞ্জ-জৌরীতে চিলাম দু’বছর মাত্র। তার আগে পালামৌ। পরেও পালামৌ। আমি আসার পর-পরই একদিন আমার ভালুমারের পূর্বসূরি নান্টুবাবু রথীদার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেন। প্রথম দিনই রথীদা আমাকে বলেছিলেন, দ্যাখো সায়ন, আমার কেবল দুটি শর্ত আছে। প্রথম শর্ত হল, আমার সম্বন্ধে আমি যতটুকু বলি, বা জানাই, তার চেয়ে বেশিকিছু জানতে চেয়ো না। আর দ্বিতীয় শর্ত হল এই যে, সকাল দশটার আগে কখনও আমার বিনা অনুমতিতে আমার বাড়িতে এসো না।
শর্ত মেনে নিয়েছিলাম।
প্রথম শর্তের মানে বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি। দ্বিতীয় শর্তর মানেও প্রাঞ্জল। আমি স্বভাবতই ভেবেছিলাম যে, উনি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন এবং হয়তো যোগাভ্যাসটাস করেন। যাই-ই হোক এ-পর্যন্ত শর্ত দুটি মেনে চলেছি, অতএব কোনো ঝামেলা হয়নি। কিন্তু মাঝে মাঝেই রথীদা সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছে করে। মানুষটার অতীত বলতে কি কিছুই নেই? অতীতকে এমন করে লুকিয়ে বেড়ায় একমাত্র খুনি আসামিরা। নয়ত সাধু-সন্তরা। রথীদাকে তো এই দুইয়ের কোনো পর্যায়েই ফেলা যায় না। একজন পণ্ডিত অথচ অমায়িক, কোনোরকম এয়ার-হীন অতি উদার মানুষ। ধর্ম সম্বন্ধে গোঁড়ামি নেই, পুজোআচ্চাও করেন না। সব কিছুই খান, অনেক বই পড়েন, ভালুমারের প্রত্যেকের ভালো ভাবেন এবং ভালো করেন। বলতে গেলে, বনদেওতার থানের বিরাট জটাজুট-সম্বলিত প্রাগৈতিহাসিক অশ্বত্থ গাছটাকে যেমন এ গ্রামের সকলে একটি চিরাচরিত প্রতিষ্ঠান বলে মেনে নিয়েছে, রথীদাকেও তেমনি। রথীদার বর্তমান অস্তিত্ব সম্বন্ধে এখানের বড় ছোট কারো মনেই কোনো সন্দেহ বা জিজ্ঞাসা নেই। নীরব জিজ্ঞাসা থাকলেও, হুলুক্ পাহাড়ের গুহাগাত্রের ছবিগুলির মতোই রথীদার অতীতও সেই জিজ্ঞাসার উত্তরে মূক, নিথর। যেভাবে রথীদা এ গ্রামের সকলের জন্য সবসময় ভাবেন ও করেন, বিপদে-আপদে অকাতরে অর্থব্যয় করেন, তাতে এ-কথা মনে হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই যে, রথীদার অবস্থা স্বচ্ছল নয়। কিন্তু একথাটা একজন মহামূর্খের পক্ষেও বোঝা অসুবিধের নয় যে, এই স্বচ্ছলতার সামান্য এক অংশ ওঁর বাংলো সংলগ্ন এবং ভালুমার বস্তির শেষপ্রান্তে অবস্থিত জমি-জমার গেঁহুবাজরা ধান-মাকাই ইত্যাদি থেকে যা রোজগার হয় তা থেকে কখনোই আসতে পারে না। সেই ক্ষেত-খামারে যা হয়, তা থেকে নিজের সারা বছরের খাওয়ারটুকু রেখে, বাকিটা যারা চাষ করে তাদের মধ্যেই বিলিয়ে দেন। রথীদার যে অন্য কোনো সূত্রে আয় নিশ্চয়ই আছে, বা ছিল তা বোঝা যায়।
নান্টুবাবুই একদিন ডালটনগঞ্জ থেকে এখানে বেড়াতে এসে বলেছিলেন, ডালটনগঞ্জে যে ব্যাঙ্কে রমিদার অ্যাকাউন্ট আছে সেখানে তাঁর এক বন্ধু কাজ করেন। তাঁর কাছ থেকেই নাকি উনি শুনেছেন যে, রথীদার নামে ঐ ব্যাঙ্কেই ফিক্সড্ ডিপোজিট আছে মোটা টাকার। প্রতিমাসে তাঁর কারেন্ট অ্যাকাউন্টে সেই ফিক্সড্ ডিপোজিটের সুদ জমা পড়ে। তার থেকেই খরচ চালান রথীদা। মাঝে মাঝে আমার যে একটু গোয়েন্দাগিরি করতে সাধ হয় না এমন নয়। মানুষটার রহস্যটা কী এবং সেই রহস্য এমন করে লুকিয়ে রাখার চেষ্টাই-বা যে কেন তাও জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সমস্ত গোয়েন্দাদেরই যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে সময়। হাতে অফুরন্ত সময় না থাকলে গোয়েন্দাগিরি করা যায় না। তাই আমার গোপন ইচ্ছাটা সফল করা হয়ে ওঠেনি।
রথীদা সেদিন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ওঁর লোকে এসে তিতলিকে বলে গেছিল যে, আমি জঙ্গল থেকে ফিরে যেন ওঁর কাছে যাই এবং আজ রাতে যেন ওখানেই খাই। যেতে যেতে রাত হয়ে গেল। হুলুক্ থেকে ফেরার পথে রাস্তাতে একটি কালভার্ট ভেঙে ছিল। আমাদেরই অন্য কোনো ট্রাক ভেঙে থাকবে, তাই, ট্রাক থেকে কুলিদের নামিয়ে হাতে হাতে জঙ্গল এবং মাটি কেটে ডাইভার্সন তৈরি করে তবে ট্রাক পার করা গেল। ধুলোতে গা-মাথা একেবারে ভরে গেছিল। বাড়ি ফিরে চানটান করেই রথীদার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি, নানকুয়া বসে আছে।
আমাকে দেখেই রথীদা বললেন, শুনেছিস নাকি? নানকুয়া তো এদিকে বেশ গণ্ডগোল পাকিয়ে বসে আছে।
কী রকম?
মাহাতোকে মেরেছে। গোদা শেঠের দোকানে মানিয়ার ধারের টাকার অনেকখানি শোধ করে দিয়েছে। মনে, হি হ্যাজ থ্রোন দ্যা গলে টু দিজ গাইজ। এরপর কী হবে, বা হতে পারে; তা অনুমান করা শক্ত নয়। কী বলিস?
বললাম, তা ঠিক।
নানকুয়া কাল কিংবা পরশু খাদে চলে যাচ্ছে। ওকে বলেছি, কয়েক মাস আর এদিকে যেন না আসে। কিন্তু কথা শুনছে না ও।
নানকুয়া মেঝেতে বসে ছিল, কার্পেটের ওপর। আমার দিকে চেয়ে ও বলল, বাপ-দাদার গ্রামে ক’টা ঘেয়ো কুকুর আছে বলে আমি কোন দুঃখে আমার নিজের গ্রাম ছাড়তে যাব? তাহলে তো ওরা আরও পেয়ে বসবে। আর ভাববে নানকু ওরাওঁ ওদের ভয়ে পালিয়ে আছে। পালাতে হলে, ওরাই পালাক। নানকুয়া পালায় না।
ওরে গাধা! যারা যুদ্ধ করতে জানে, এমনকী পৃথিবীর বড় বড় সেনাপতিরাও পালাতে জানে। সময়মতো পালিয়ে যাওয়া বা পিছু হটে যাওয়াটাও যুদ্ধের একটা অঙ্গ, স্ট্র্যাটেজি। সাময়িকভাবে পালিয়ে বা পিছু হটে গেলেই যে হার হলো এমন মনে করা ভুল। তাতে অনেক সময় জিতটাই পোক্ত হয়। রথীদা বললেন।
নানকুয়া হাসল। বলল, আমি ওসব জানি না। আমি তো বড় সেনাপতি নই, ছোট সেনাপতি।
রথীদা নান্কুকে শুধোলেন, গোদা শেঠের দোকানে মানিয়ার আর কত ধার আছে রে?
একশ কত টাকা যেন।
টাকাটা আমি তোকে দিয়ে দিচ্ছি। তুই এখান থেকে যাওয়ার আগেই শোধ করে দিবি। আর মানিয়াকে বলে দিয়ে যাবি যে, এর পরেও কোনো হাঙ্গামা হলে যেন ও …. সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দেয়।
নানকুয়া বলল, আচ্ছা।
রথীদা আমাকে বললেন, তুই নিশ্চয়ই শুনেছিস, হীরু কী করেছে? নাম পাল্টেছে অ্যাফিডেভিট করে। জাতে উঠেছে। ভালুমারে এসেও নিজের মা-বাবা ভাই-বোনের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেনি।
সে কী? আমি তো জানি না। আমি তো সারাদিন ক্যুপে থাকি। এখানের কম খবরই আমার কাছে পৌঁছয়। তিতলিরও তো সারাদিন কাজে-কর্মেই কাটে। ও-ও খবর রাখে কম।
তাহলে আর বলছি কী? আমার সঙ্গে ও দেখা করতে এসেছিল। পাঁচ মিনিটের জন্যে। কিন্তু কেন জানিস?
কেন?
রথীদা অন্যদিকে মুখ করে বললেন, ওরা বন্ধুর জন্যে হুইস্কি চাইতে এসেছিল। অবাক হয়ে বললাম, বলেন কী?
দু’বোতল বেশি ছিল আমার কাছে। দিয়ে দিয়েছিলাম। ও যে জুর সঙ্গে বা ভাইবোনের সঙ্গে দেখা করেনি তাও তো জানলাম নানকুয়ার কাছ থেকেই। জুগ্ নাকি মানিয়াকে দুঃখ করে বলেছে যে, পাগলা সাহেব আমার ছেলেটাকে মানুষ করতে গিয়ে এতবড় একটা জানোয়ার করে তুলল! এর চেয়ে আমার ছেলের লেখাপড়া না শেখাই ভালো ছিল।
বললাম, আপনি তাহলে সত্যিই ভুল লোককেই লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন; কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসিয়েছিলেন। সে যদি বড় হয়ে ফিরে এসে নিজের জাতের মানুষ, নিজের গ্রাম, নিজের আত্মীয়-পরিজনের জন্যে কিছুমাত্রই না করে; তাহলে সেই বড় হওয়ার মানে কী?
নানকুয়া বলল, গ্রাম বড় না হলে, গ্রামের মানুষকে টেনে তুলতে না পারলে দেশ কি শুধু শহরের বাবুদের ভালো নিয়েই আগে বাড়তে পারবে? সেই বড় হওয়া কি বড় হওয়া? গ্রাম বাদ দিয়ে এদেশের থাকে কী?
বোঝাই যাচ্ছিল যে, হীরুর ব্যাপারে রথীদা প্রচণ্ড শক্ড হয়েছিলেন। বললেন, আমি সে কথাই ভাবছি। হীরু আর ওর বন্ধুকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে আমার সঙ্গে রাতে খেতে বললাম একদিন, তা পর্যন্ত এলো না। পাছে আমার কথাবার্তায় ওর বন্ধুর সামনে ওর ইমেজটা নষ্ট হয়। বুঝলি নানকুয়া, আমি যদি বিয়ে করতাম, তবে হীরুর মতো বা তোর মতোই আমারও ছেলে থাকত। তোরাও তো আমার ছেলেই। হীরু বলছিল, ওরা একটা জরুরি এনকোয়ারিতে এসেছে। এই বন-পাহাড়ে নাকি সিংভূম ডিস্ট্রিকট থেকে কিছু নকশাল ছেলে এসে লুকিয়ে আছে। তারা নাকি এই অঞ্চলের গ্রামের অল্পবয়সি ছেলেদের মাথা খাচ্ছে। গোপনে মিটিং করছে জঙ্গলে। অস্ত্র শিক্ষা দিচ্ছে। শ্রেণীশত্রু কারা, সে সম্বন্ধে জ্ঞান দিচ্ছে। হীরুদের ইনফরমেশান এইই যে, এই সব ঘুমন্ত গ্রামেও নাকি সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম শুরু হবে শীগগিরই। সেই সব কারণে ওরা তদন্তে এসেছে পটনা থেকে। সময় ছিলো না নাকি একেবারেই।
নানকুয়া মুখ নিচু করেই বলল, হীরু ভাইয়া নিজেই তো সবচেয়ে বড় শ্রেণীশত্রু। বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, নিমকহারাম। যে নিজের গ্রামকে ভুলে যায়, মা-বাবাকে ভুলে যায়, চাকরির ভারে, ঘুষের টাকার গরমে যে বামুন-কায়েতের মেয়ে বিয়ে করে জাতে উঠতে চায় তার মতো শ্রেণীশত্রু আর কে আছে? আমরা আগে কখনও বড় হবার, দশজনের একজন হবার সুযোগ পাইনি। যখন সুযোগ পেল কেউ কেউ, তারা অমনি যারা এতোদিন আমাদের বঞ্চিত করেছে, মানুষ বলে মনে করেনি তাদের দলেই ভিড়ে গেল।
রথীদা একটা হুইস্কি ঢাললেন গ্লাসে।
বললেন, খাবি নাকি একটা? বড় ঠান্ডা পড়েছে আজকে।
নাঃ জর্দা পান রয়েছে মুখে। আমার ঠান্ডা লাগে না।
তুই যে দিলেও খাস্ না, এটা আমার খারাপ লাগে। মনে হয়, তুই এই ব্যাপারে আমাকে ছোট জাতের লোক বলে মনে করিস।
আমি হেসে উঠলাম। নানকুও।
আজকাল এ সব খেলেই তো বড় জাতের বড় মাপের বলে গণ্য হয় সকলে। রথীদা আপনি উল্টোটাই বললেন। আমি ছোট, ছোটই থাকতে চাই।
রথীদা বললেন, তথাস্তু! তুমি তাই-ই থাকো!
আত্মমগ্ন হয়ে রথীদা বললেন, এই জাত-পাত করেই দেশটা জাহান্নমে গেল। কী বলিস? এমন একটা দেশ! সোনার দেশ। কতকগুলো মিছিমিছি কারণ কিছুতেই এগোতে পারছে না। অটোপাসের মতো এইসব কারণগুলো পা জড়িয়ে আছে। এগোবে কী করে? আরও একটা ব্যাপার আছে। গভীর ব্যাপার। যে সব অফিসারদের তৈরি করছেন সরকার দেশ চালানোর জন্যে, তাঁদের ট্রেনিং-এর জন্যে মুসৌরিতে ইনস্টিটুউট আছে। সেই ইনস্টিটুউটে যে রকম শিক্ষা দেওয়া হয়, তা, প্রায় সাহেবি আমলের শিক্ষারই অনুরূপ। তাঁরা কাঁটা চামচে খান। লাউঞ্জ স্যুট পরে মদের গ্লাস হাতে টোস্ট প্রোপোজ করা শেখেন সেখানে। হীরুও শিখেছে নিশ্চয়ই। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। কিন্তু কোনো নেতা বা সরকারি আমলার শিকড় রইল না আর দেশের গভীরে। একমাত্র লালবাহাদুর শাস্ত্রী ছাড়া পুরোপুরি ভারতীয় পটভূমির কোনো লোক প্রধানমন্ত্রীই হলেন না আজ পর্যন্ত। যাঁরা হলেন, তাঁরা নামেই ভারতীয়, দেশের গরিবদের সঙ্গে, মাটির কোনো যোগাযোগই ছিল না তাঁদের। দেশটা চালানোর ভার এখনও সাহেবি-ভাবাপন্ন, ইংরিজি-শিক্ষিত, পশ্চিমি ভাবনায় দীক্ষিত কিছু লোকের হাতে। তাদের নিজেদের শিকড়গুলি যত দিন দেশের মাটিতে গভীর ভাবে না ছড়িয়ে যাচ্ছে, তারা এই দেশ শাসন করবে কী করে?
নানকু এবং আমি সমস্বরে বললাম, ঠিক!
বললাম, দেশটা তো ভালোই রথীদা। দেশের লোকেরাও ভালোই ছিল। এই অসৎ, ভণ্ড, পাজি নেতাগুলোই দেশটাকে চোরের দেশ বানিয়ে তুলল। ভণ্ডামির কম্পিটিশান্ লাগিয়ে, গণতন্ত্রকে একটা ফাতু বুলি করে তুলল এই তিরিশ বছব। এই শালারাই দেশের সবচেয়ে বড় শত্রু। কাগজে বক্তৃতা ঝাড়ে, প্যারালাল ইকনমি আর কালো টাকার সমস্যা সম্বন্ধে। কালো টাকা তৈরি করল কারা? তিরিশ বছর আগে ব্ল্যাকমার্কেটিয়ারদের ল্যাম্পপোস্টে ঝোলালে দেশে স্মাগলার আর ব্ল্যাকমার্কেটিয়ারদের এমন মোচ্ছব লাগত না। নেহরু বলেছিলেন যে, ঝোলাবেন। যত কালো টাকা দেশের নেতাদের আর কিছু সরকারি আমলাদের কাছে আছে, তার কণামাত্রও বোধহয় নেই অন্যদের কাছে। অথচ চোখ রাঙায় সবচেয়ে বেশি তারাই।
রান্নার লোকটিকে ডেকে রথীদা শুধোলেন, রান্নার কতদূর?
সে বলল, হয়ে এসেছে।
জানিস সায়ন, আজ নান্কু হাট থেকে সবচেয়ে বড় মোরগটা কিনে এনেছে আমার জন্যে।
নানকুর দিকে ফিরে বললেন, কী রে? বল্ নানকুয়া?
নাঃ। বলল নানকুয়া। তারপর বলল, চিপাদোহরের গণেশ মাস্টারবাবু এসেছিলেন গাড়ুর হাটে। সস্তায় মুরগি কিনবেন বলে। সবচেয়ে বড় মোরগটা ওঁরই কেনার ইচ্ছা ছিল। দরও দিয়েছিলেন ভালই। কিন্তু আমার জেদ চেপে গেল।
আমার দিকে চেয়ে নানকু হেসে বলল, বুঝলে, বাঁশবাবু। তোমরা এই বাবুরা, চিরদিনই আমাদের চোখের সামনে থেকে যা কিছু ভালো সবই কিনে নিয়ে গেছ। ছিনিয়ে নিয়ে গেছ যা-কিছুই আমাদের ভালোবাসার। সময় বদলাচ্ছে, বদলাবে। হাসতে হাসতে আবার বলল, বুঝলে, তাই আমি দর চড়িয়ে দিয়ে মাস্টারবাবুর হাত থেকে কেড়ে নিলাম মোরগটা। মাস্টারবাবুর মুখটা যদি দেখতে তখন!
রথীদা হো হো করে হেসে উঠলেন।
হাসিটা ভালো লাগলো না আমার। ভাবছিলাম, পৈতৃক রোজগারের ফিকসড্ ডিপোজিটের সুদের টাকায় স্বচ্ছল, হুইস্কি-খাওয়া রথীদা কোনোদিনও গণেশ মাস্টারের দুঃখটা বুঝবেন না! মধ্যবিত্ত, সাধারণ স্কুলে অল্প-স্বল্প লেখাপড়া শেখা আমরা যে এই কেরানিবাবুর দল, আজকে আমাদেরই সবচেয়ে বড় দুর্দিন। আমাদের পোশাকি ‘বাবু’ পদবিটাই রয়ে গেছে শুধু, বাইরে বেরোলে এখনও আমাদের ফর্সা, ইস্ত্রি-করা জামা-কাপড় পরে বেরোতে হয়। আমাদের মেয়েরা আব্রু রাখার জন্যে ন্যূনতম ভদ্র ও সভ্য পোশাক পরেন এখনও। বংশপরম্পরায় সাহিত্য ও সংগীতের সঙ্গে যোগসূত্র বাঁচিয়ে রাখতে এখনও বই এবং রেকর্ড কিনতে হয় একটা দুটো। ছেলেমেয়েদের এখনও স্কুলে-কলেজে পাঠিয়ে লেখাপড়া শেখাতে হয় আমাদের। নিজেরা খেয়ে কি না-খেয়ে। এবং এ সবই, এই দুর্দশা ও কষ্ট, উঠতি-বড়লোক নানকু বা পৈতৃক সম্পদে বড়লোক রথীদারা বুঝতে পারবেন না।
নানকুয়া আমার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, কি বাঁশবাবু? রাগ করলে?
না রে নানকুয়া, ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, আমরা বাবু বলে পরিচিত হলেও আসলে তো কখনওই বাবু ছিলাম না! সরকারের, রেল কোম্পানির, চা বাগানের বা কয়লাখাদের মালিকের বা বড় বড় ঠিকাদারের আমরা কর্মচারিমাত্র। চিরদিনই তাই-ই ছিলাম। আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। না সত্যিকারের পুরানো বাবুরা আমাদের দুর্দশা বোঝে, না বুঝিস তোরা; এই নতুন বাবুরা। আজকে তোর মতো কয়লাখাদের একজন শ্রমিক বা চা-বাগানের একজন শ্রমিক যা রোজগার করিস একা, এবং সপরিবারে তো বটেই; তা গণেশ মাস্টারের বা আমার মতো বাবুর রোজগারের অনেকগুণই বেশি। তোরা যে বেশি রোজগার করিস, এটা আনন্দের। তোরা অনেক কষ্ট করেছিস অনেকদিন। কিন্তু আমাদের, এই মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তদের অবস্থাটাও ভাববার আমাদের জন্য কারুরই সমবেদনা নেই। আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছি, কৃষ্টিতে, শিক্ষায়, রুচিতে এবং জীবনেও। আমাদের কোনোই ভবিষ্যৎ নেই! আমাদের মতো মধ্যবিত্তরাই জানে তাদের অবস্থার কথা। আমাদের কথা নেতারা কেন ভাববে বল? আমাদের আর কটা ভোট? এদেশে এখন ভোট যার, সব তার। তোদের কথা না ভেবে যে তাদের উপায় নেই! এখন দায়ে পড়েই ভাবতে হবে। ভুজুংভাজুং দিয়ে আর কতদিন চলবে?
রথীদা কিছুক্ষণ চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, তুই কিন্তু খুব উত্তেজিত হয়ে গেছিস। স্বাস্থ্যের পক্ষে এটা ক্ষতিকর।
হাসবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না।
সায়ন, ইটস্ অ্যা ম্যাটার অফ পারস্পেকটিভ্। তোর একার কথাই তুই ভাবছিস। তুই ভাবছিস, তোর নিজের বা তোর কাছাকাছি লোকদের ভালোর কথা। একটু থেমে বললেন, আমিও হয়তো তাই ভাবছি। কিন্তু যে-দেশের লোকে এখনও কান্দা-গেঁঠি খুঁড়ে খায়, শম্বরের সঙ্গে ভাল্লুকের সঙ্গে রেষারেষি করে বুনো কুল বা মহুয়া খেয়ে বেঁচে থাকে; সে দেশের বৃহত্তম সংখ্যার কারণে তোর ও আমার স্বার্থ বা ভালো-মন্দ বিসর্জন দেওয়ার সময় কি এখনও আসেনি? ভেবে দ্যাখ, যেসব দেশ এগিয়েছে, তারা সকলেই তাই দিয়েছে।
চটে উঠে বললাম, শুয়োরের বাচ্চার মতো মানুষের বাচ্চা পয়দা হবে, একগাদা অশিক্ষিত, স্বাস্থ্যহীন, ভবিষ্যহীন মানুষ প্রতি মুহূর্তে জন্মাবে বলেই তার খেসারৎ দিতে হবে অন্য সকলকে? জন্মরোধ করানো হয় না কেন? যে মা-বাবা ছেলে মেয়েকে খাওয়াতে পারে না, তাদের ছেলেমেয়ে হয় কেন। আমি জানি কেন হয়। ঐ ভোট। বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কোন ইঁদুর। কোন্ পার্টি আছে এখন দেশে, যে দেশের ভালো চায়? তারা শুধু তাদের ভালো চায়। জন্মরোধ করতে গেলে ভোট যে বেহাত হয়ে যাবে। আর ভোট বেহাত হলে, গদিও বেহাত। তাতে দেশের যা হয় হোক, দেশ জাহান্নমে যাক্।
রথীদা চুপ করে থাকলেন।
নানকুয়াকে বিচলিত দেখাল। কিঞ্চিৎ উত্তেজিতও।
কিন্তু নানকুয়াই ঠাণ্ডা গলায়, শান্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলছো বাঁশবাবু। সবচেয়ে বড় সমস্যা এটাই। আমি সেদিন পাগলা সাহেবকে বলেছি যে, আমরা সকলে চাঁদা দেব। সেই চাঁদায় ভালুমারে একটা ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর স্কুল খুলতে হবে। মেয়েদের সবচেয়ে আগে বোঝাতে হবে এর সুফলের কথা তুমি কী বল বাঁশবাবু? করলে কেমন হয়?
নানকুয়ার চেয়ে আমি অনেক বেশি লেখাপড়া করেছি। শিক্ষিত সমাজেই আমার মুখ্যত ওঠা-বসা। তা সত্ত্বেও আমি অতখানি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম আর নানকুয়া নিরুত্তাপ গলায় শান্তভাবে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারল দেখে বড় লজ্জা লাগল। বললাম, খুবই ভালো। করো না, আমরাও চাঁদা দেব।
বাঁশবাবু! তুমি কিন্তু আমাদেরই একজন। মিথ্যামিথ্যি দূরে থাকতে চাইলে চলবে কেন? আমরা যারাই দেশকে ভালোবাসি, দেশের কথা ভাবি, তারা সকলেই একটা জাত! এতে কে ওরাওঁ, কে কাহার, কে ভোগ্তা, কে মুণ্ডা, কে দোসাদ, কে চামার অথবা তোমার মতো কে মুখার্জি বামুন তাতে কিছুই যায় আসে না। তাছাড়া আমি একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না বলো?
বলো।
না, আগে বলো যে মনে করবে না?
না।
অনেকক্ষণ আমার চোখের দিকে চেয়ে ও বলল, আমি তোমার চেয়ে কম ক্লাসে পড়েছি। তিতলি আমার চেয়েও কম পড়েছে এবং আমরা দু’জনেই এই জংলি গ্রামে বড় গরিবের ঘরে জন্মেছি বলেই মানুষ হিসেবে আমরা কি তোমার চেয়ে খারাপ? যে সুযোগ আমরা পাইনি, আমাদের যে সুযোগ দেওয়া হয়নি, তোমার মতো সাহিত্য পড়বার, গান শুনবার, ভালো ভালো বই পড়বার, সেই জন্যেই কি তোমরা আমাদের চেয়ে অন্যরকম? তোমার ছেলে যদি আমার মতো হতো, অথবা মেয়ে তিতলির মতো, তাহলেই তুমি আমাদের দুঃখটা কোথায়, কেন তা বুঝতে পারতে। তুমি এবং তোমাদের মতো অনেকেই আমাদের মধ্যেই আছো অথচ তবু তোমরা আমাদের কেউই নয়। তোমাদের মন পড়ে থাকে সব সময় কলকাতায় বা অন্য শহরে। বিয়ের কথা হলে, কলকাতা বা অন্য জায়গা থেকে তোমাদেরই সমাজের, তোমারই মতো শিক্ষিত মেয়ে আসে তোমাকে দেখবার জন্যে, তোমার সঙ্গে মেশবার জন্যে। তাই, তোমরা তোমরাই থেকে যাও। আমরা, আমরাই। আমরা তোমাদের বুঝি না; তোমরা বোঝ না আমাদের। আমরা এক হতে পারলাম না, এই সব মিছিমিছি কারণে। আর তোমাকেই বা কী বলব? আমাদের হীরুকে দেখছি না চোখের সামনে! ও কিন্তু আমাদের গর্বের একজন হয়েও আমাদের ঘেন্না করছে এখন। দ্যাখো। যেই সুযোগ পেয়েছে, অমনি তোমাদের একজন হয়ে গেছে পুরানো স্লেট মুছে ফেলে। বেইমান, হারামি, শালা!
রথীদাকে খুব আপসেট্ দেখালো এই কথায়।
নানকু আবার বলল, আসল কথাটা কী জানো বাঁশবাবু? সাহিত্যের খিদে, সংগীতের খিদে, সংস্কৃতির খিদের চেয়েও অনেক বড় একটা খিদে আছে। তার নাম পেটের খিদে। ছোটবেলা থেকে তুমি যে খিদেকে কখনও জানোনি। জানলে আমার সঙ্গে তর্ক করতে না তুমি! আমি এখন পেটভরে খেতে পাই। মোরগাও খাই মাঝে মধ্যে। কিন্তু যতক্ষণ ভালুমারের একজন মানুষের পেটেও সেই গন্গনে খিদে আছে, ততক্ষণে যাই-ই খাই না কেন, আমার কিছুতেই পেট ভরে না। আচ্ছা, বাঁশবাবু, তুমি তিনদিন একদম উপোস করে থাকো। তারপরই না হয় আমরা আবার আলোচনা করব সাহেবের বাড়িতে। এই বিষয়ে। একসঙ্গে তিনদিন কখনও না খেয়ে থেকেছো? একবার থেকে দ্যাখো।
রথীদা আরেকটা হুইস্কি ঢাললেন।
একটু হেসে বললেন, বেশ জমে গেছে তোদের তক্ক। কী বল্ সায়ন?