Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কোজাগর – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প561 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কোজাগর – ২৭

    ২৭

    বিসপাতিয়া আর শনিচারিয়া এই দুই বোনের মতো কুৎসিতদর্শন নারী খুব কমই দেখেছি। অবশ্য গড়বার সময় বিধাতা অসুন্দর করে গড়েন নি; এদের দুজনকেই গাড়ুর কাছে কোয়েলের পাশে, এক শীতের দুপুরে ভল্লুকে আক্রমণ করেছিল। তখন তাদের বয়স ছিল আট-নয়। মা-বাবা কেউই ছিল না। মামাবাড়িতে অনাদরে পালিত হচ্ছিল তারা। বিস্পাতিয়ার নাকের জায়গায় একটা বিরাট ক্ষত, ওপরের ঠোটটা নেই। আর নেই গালের ডানদিকের অনেকখানি। শনিচারিয়ার অবস্থা আরও শোচনীয়। তার একটি চোখ খুলে নিয়েছিল ভল্লুকটা বড় বড় নখে এবং কানমলা দিয়েছিল দুটি কানেই। তাই কান থাকবার কথা ছিল যেখানে সেই দুটি জায়গাতেই দুটি বীভৎস গর্ত।।

    এই দু’বোনের কারোই বিয়ে হয়নি, বয়স এখন চল্লিশ পেরিয়েছে। ভালুমার এবং আশেপাশের বস্তিতে এদের খুব নামডাক আছে ভাল ধাত্রী বলে। কাছাকাছি প্রায় সব বস্তির মেয়েরাই প্রসবের সময় এই দুই বোনের সাহায্য নেয়। এদের একজন দূর সম্পর্কের ভাইপো আছে। তার বয়সও হবে এখন তিরিশ। সেই-ই হাটে যায়, গোরু দেখে এবং ওদের সামান্য ক্ষেত-জমিন দেখাশোনা করে। ওদের দু’জনেই, চেহারার বীভৎসতার জন্যে বাইরে বিশেষ একটা বেরোয় না, রাতের বেলা ছাড়া। এবং প্রসূতিদের ডাক ছাড়া। এ অঞ্চলে কোনো নতুন আগন্তুক এদের দু’জনের একজনকেও হঠাৎ জঙ্গলের পথে রাতে দেখলে ভূত-পেত্নী ভেবে অতি সহজেই অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।

    বিসপাতিয়া আর শনিচারিয়ার, আগেকার দিনের বড় বড় শহরের অনেকানেক গায়নাকোলজিস্টেরই মতো, দুরকমের রোজগার আছে। এই রকমের তফাতটা কী এবং কোথায় তা একমাত্র ওরাই জানে। গোদা শেঠ এবং মাহাতো প্রায়ই ভালুমার কি অন্য কোনো কাছাকাছি গ্রামের অল্পবয়সি কুমারী এবং বিবাহিতা মেয়েদেরও নিয়ে আসে রাতের অন্ধকারে—গর্ভপাত করাতে। তখন মোটা বকশিস পায় ওরা দু’বোন। মাহাতো এবং গোদা শেঠ এই জঙ্গলের হায়না আর শেয়ালদেরই মতো। পর-উচ্ছিষ্ট গলিত, মৃত কুৎসিত অথবা দুর্গন্ধময় কোনোকিছুই ওদের রুচিতে বাধে না। তাই দুষ্টুলোকে বলে, যে শারীরিক মিলনের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের বীভৎস চেহারার কারণে এই দুই বোন চিরদিনই বঞ্চিত থেকেছে, সেই আনন্দে মাহাতো এবং গোদা শেঠ এদের দুজনকেই ধন্য করে! এ বক্‌শিস, উপরি বক্‌শিস। ওদের দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে ওদের খরচটা ওরা এইভাবে উশুলও করে নেয় কিছুটা।

    আনন্দ বলতে এই একটিই আছে এখানে। সারাদিনের খাটুনির পর, ক্বচিৎ বৈভবের খেসারির ডাল আর রুটি খেয়ে ভগবানদত্ত খেলনা নিয়ে নিজেদের খেলবার বাক্স বের করে খেলতে বসে ওরা। “ছোট পরিবার সুখী পরিবার”, এসব এরা শোনে বটে; কিন্তু বিশ্বাস করে না। পয়সা খরচ করে নিরোধ পর্যন্ত কেনার পয়সাও নেই এখানের লোকেদের। যাদের সে সামর্থ্য আছে, তাদের ইচ্ছে নেই। প্রকৃতির মধ্যে বাস করে কোনো অপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতে তারা বিশ্বাস করতে ভয় পায়।

    এই বিসপাতিয়া শনিচারিয়ার কাছেই গোদা শেঠ নিয়ে এসেছিল পাঁচবছর আগে বুলকির বড় বোন জীরুয়াকে! বড় হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়ে ছিল জীরুয়া। যখন বাসন্তি রঙা শাড়ি পরে, চক্‌চকে কালো সাপের মতো চিকন জীরুয়া, মুখে করৌঞ্জ তেল মেখে কাঁকড়ের মালা পরে, চুলে ফুল গুঁজে হাটে যেত, তখন অনেক লোকই চেয়ে থাকত তার দিকে। বিয়ে দিয়েছিলাম মানি আর মুঞ্জরী একজন সর্দারজি ঠিকাদারের কুপকাটা কুলিদের মেট-এর সঙ্গে ওর। একটু বেশি বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। প্রায় আঠারোতে। বিয়ের পরই যখন প্রথম ফিরে আসে জীরুয়া, তখন গোদা শেঠ তাকে ফাঁসায়-জোর করে। খবরের কাগজের ভাষায় যাকে পাশবিক অত্যাচার বলে, তাই করে। পশুদের যতটুকু জানি, তারা ঠিক এ ধরনের মানবিকতার মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত। এই উপাধি দিয়ে পশুদের যে কেন বিনা কারণে ছোট করা হয়, বুঝতে পারি না।

    ভীত এবং অসহায় জীরুয়া নতুন এবং প্রেমময় স্বামীর কাছে লজ্জায় মুখ দেখাবে না ভেবে গোদা শেঠের পরামর্শ মেনে বিসপাতিয়া আর শনিচারিয়ার কাছে আসে। কিন্তু তাদের ওষুধ খাওয়ার তিনদিন পর পেটের অহস্য যন্ত্রণায় কঁকিয়ে কেঁদে জীরুয়া মরে যায়। মানি-মুঞ্জরী ব্যাপারটা আন্দাজ করেছিল শুধু। কিন্তু ঠিক কখন হাট-ফিরতি জীরুয়াকে ঝাঁঝর নালার কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে তার সস্তা হলুদ ছিটের ব্লাউজের মধ্যে একটা লালরঙা দুটাকার নোট গুঁজে দিয়ে গোদা শেঠ ওর সর্বনাশ করেছিল তা মৃত্যুর মাত্র কিছুক্ষণ আগে স্রাব-সিক্ত জীরুয়া ওর মা-বাবাকে বলে। বিসপাতিয়া ও শনিচারিয়ার কথাও বলে। এবং তারপই হঠাৎ মারা যায়।

    আঠারে-উনিশ বচরের মেয়ের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হল, অথচ মানি-মুঞ্জরী কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না। গোদা শেঠ-এর বিরুদ্ধে এমন সাংঘাতিক অভিযোগ আনলে এখানে তারা আর থাকতে পারত না। শেঠের চোখদুটো সবসময় লাল হয়ে থাকে, ফর্সা বেঁটে গোলগাল চেহারা। লোকটার চোখের দৃষ্টিকে মুঞ্জরী চিরদিন ঘেন্না করে এসেছে। যখন ও নিজে হাটেবাজারে যেত, তখন গোদা শেঠ একা পেয়ে মুঞ্জরীকেও একদিন প্রস্তাব দিয়েছিল। মুঞ্জরী তখন এরকম রুখু-শুখু হয়ে যায়নি! এক সময়ে ভালুমার বস্তিতে মুঞ্জরীরও খ্যাতি ছিল সুন্দরী হিসাবে। তাই গোদাকে দেখলে জীরুয়ার কথা মনে পড়ে যেত, আর তার বুকের গভীরে প্রোথিত একটা ঘিঘিনে ঘৃণা ওর বুক ঠেলে অগ্ন্যুৎপাতের মতো বেরিয়ে আসতে চাইত।

    জামাই এসেছিল জীরুয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে। বুলকিটা আর একটু বড় হলে বুলকির সঙ্গে বিয়ে দিত ওরা। কিন্তু তখন বুলকি খুবই ছোটো ছিল। সে সব দিনের কথা ভাবে না আর মানি-মুঞ্জরী। কিন্তু জীরুয়ার শোকটাই ওদের দু’জনকে একেবারে ভেঙে দিয়ে গেল। শরীরে, মনে। মানিয়ার হাড়ের মধ্যে কেমন একরকমের ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। তাই নানকু আজ মানিয়াকে সাহস জাগানো, আত্মসম্মান জাগানো; থাপ্পড় মারলেও বুকের মধ্যে সেই ভয়টা নড়ে না। নড়বেও না, মরবেও না, মানি, যতদিন নিজে না মরে। মানি, একথা মেনেই নিয়েছে যে, আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে ক’জন আর পারে? তেমন বাঁচার বরাত করে আসেনি ও এ জীবনে।

    রাত হয়েছে ন’টা-দশটা। ভালুমারে ন’টা-দশটা গভীর রাত। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। একটা প্রকাণ্ড জংলি মহানিমের গাছের নীচে বিস্পাতিয়া আর শনিচারিয়ার বাড়ি। সামনে কাঠের বেড়া-লাগানো এক ফালি উঠোন। ওদের বাড়ির ঠিক সামনেই একটা প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছ পড়ে। অনেক শাখা-প্রশাখা ঝুরি। তার ফোকরে থাকে একজোড়া শঙ্খচূড়। গরম পড়লেই তারা রাস্তার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। কখনও বা লেজে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়েউঠে মিলিত হয় রাস্তার ওপরেই। তখন কেউ কাছে এলেই বিপদ। রামধানীয়া চাচার বড় ছেলেক আধমাইল তাড়া করে নিয়ে গিয়ে এই জোড়া শঙ্খচূড় তার পিঠে কামড়ে দিয়েছিল। পিঠে কামড়াতে, বাঁধন, দেবার সময় বা সুযোগও আসেনি। শএই মারা গেছিল সে। নিজে স্বয়ং গুণিন্ হয়েও বাঁচাতে পারেনি ছেলেটাকে। টুসিয়া আর তার মা ঐ জোড়া সাপের কথা জেনেশুনেই অন্ধকারে হেঁটে এসেছিল অশ্বত্থ গাছ অবধি। ভরসা ছিল, গরম এখনও পড়েনি। তবু গাছের সামনে পৌঁছবার আগেই আঁচলের আড়াল করে লণ্ঠনটা জ্বালল।

    সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে এইসব অঞ্চলে অলিখিত সান্ধ্য আইন জারি হয়ে যায়। যদিও পুলিশকে বা মিলিটারিকে টহল দিয়ে বেড়াতে হয় না পুরো এলাকা। এদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা, এদের অসুবিধা, রাতের বাঘ, বাইসন, হাতি, ভল্লুক এবং সাপের ভয় তো আছেই, তাছাড়া কুসংস্কার এবং অতিপ্রাকৃত কত কিছুর ভয়। অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বারান্দা বা বড় জোর উঠোন থাকলে, উঠোনে বসে থাকে চৌপাইতে ওরা খাওয়া-দাওয়ার পর। পরদিন আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে উঠেও পড়ে। ওদের জীবন বাঁধা; সূর্যের সঙ্গে।

    লণ্ঠনের আলোয় টুসিয়া মার মুখের দিকে তাকায়। যে মা, তাকে এক মাস ধরে সুন্দর করে তুলেছিল, চুল বেঁধে দিয়েছিল, করৌঞ্জ আর নিমের তেল মাখিয়েছিল মুখে, যে মায়ের মুখ আশা আর আনন্দে সব সময় ঝলমল করত সেই মায়ের মুখে আজকে ঘেন্না আর গ্লানি, আর ভয়। যে-ভয়ের কোনো ব্যাখ্যা হয় না। যে-ভয়ের স্বরূপ অন্তঃসত্ত্বা কোনো কুমারী মেয়ের মায়ের পক্ষেই একমাত্র জানা সম্ভব।

    মান বাঁচাতে গিয়ে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবে তো টুসি-লগনের মা? নাকি এমন মহুয়া ফুলের মতো মিষ্টি মেয়ে টুসি মরেই যাবে। মরে যাবে জীরুয়ারই মতো? জীরুয়ার কথা কানাঘুষোয় শুনেছিল সে। এত ছোট্ট বস্তিতে কোনো কথাই চাপা থাকে না। জানতে পারে সকলে সবকিছুই। শালীনতা ও ভব্যতার কারণে ভাব দেখায় যে, জানে না। টুসিয়ার কথাও কি সকলে জেনে যাবে? পুলিশ সাহেবের বোন টুসিয়া তার ছেলে হল গিয়ে কত বড় অসর। আর আজ তারই মেয়ের জন্যে তাকে এইভাবে এতবড় ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। কী ছেলেই পেটে ধরেছিল হীরুর মা। ধন্য হীরু! ধন্য হীরুর বন্ধু!

    বিসপাতিয়া আর শনিচারিয়ার বাড়ির প্রায় সামনেই যখন পৌঁছে গেছে ওরা, ঠিক সেই সময় ঘরের দরজা খুলে গেল। খোলা দরজার আলোতে দেখল, মাহাতো বেরিয়ে এল ঘর থেকে, পিছন পিছন গোদা শেঠ। আর তার পিছনে টিহুলের বউ। টুসিয়া জানত যে, সে লাতেহারে আছে। কবে ফিরে এসেছে সেই-ই জানে। উজ্জ্বল টর্চের আলোর বন্যা বয়ে গেল চারপাশে। টুসি আর টুসির মা লুকোতে চেষ্টা করল জঙ্গলের মধ্যে, কিন্তু ততক্ষণে উঠোনের বেড়াতে হেলান দেওয়া দুটো সাইকেল তুলে নিয়ে মাহাতো আর গোদা বাইরে চলে এসেছে।

    আলোটা প্রথমে টুসির মুখেই পড়ল। যে-মুখ মানুষ যখন সবচেয়ে বেশি লুকোতে চায়, ঠিক তখনই সেই মুখ আলোকিত হয়।

    মাহাতো সাইকেলটাতে না চড়ে, হাতে ধরে এগিয়ে এল। ভালো করে আলো ফেলল এদিক-ওদিক। হঠাৎই আলো পড়ল টুসির মুখে। টুসির মা গাছের আড়ালে সরে দাঁড়াতে তাকে দেখতে পায়নি মাহাতো। টুসি কংক্রীটের খুঁটির মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাহাতো হঠাৎ তার থুনি ধরে নেড়ে দিল। বলল, লাইন পর তুম্ভী অগ্যায়ী। হীরু সিংকা বহীন। খায়ের। মিলুঙ্গা কোই রোজ! গোদা শেঠ ভরপেট পচা-মাংস খাওয়া শেয়ালের মতো একটা ফ্যাক্ ফ্যাক্ হাসি হাসল। তারপর টিহুলের বৌকে পিছনের ক্যারিয়ারে বসিয়ে আগে গোদা শেঠ এবং পরে মাহাতো নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করতে করতে যার যার সাইকেল চড়ে পাথুরে পথে টায়ারে কির্ কির্ আওয়াজ তুলে চলে গেল।

    লগনের মা অবাক হয়ে ভাবতে লাগল মাহাতো আর গোদা শেঠের এলেম আছে। টিহুলের বাঁজা বউটাকেও গাভীন্ করে দিল এরা। আজীব বাহ্! সে চলেই গেছিল। ধরে আনল কোথা থেকে?

    ওরা চলে যেতেই অশ্বত্থ গাছটার ফোকর থেকে, যে-ফোকরে জোড়া শঙ্খচূড় থাকে বলে ওরা জানত, লাফিয়ে নামল নানকু।

    নেমেই, ঠাস্ করে এক চড় কসালো টুসিয়ার গালে।

    টুসিয়া কথা বলল না। ঠোঁটে ঠোঁটে কামড়ে ধরল! দুচোখ বেয়ে জল বইতে লাগল!

    বিসপাতিয়া আর শনিচারিয়ার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। খুব সম্ভব ওরা বুঝতে পারেনি টুসিয়াদের আসার কথা।

    নানকু, টুসির বাহু ধরে ওকে পথ দেখিয়ে শনিচারিয়াদের বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে চলল। পিছনে পিছনে লজ্জায়, অপমানে বারুদ্ধ টুসির মা আসতে লাগল! একটু দূরে গিয়েই, পথের পাশের একটা ঝোপ থেকে ওর লুকিয়ে রাখা সাইকেলটা টেনে বের করল নানকু। টুসিকে হ্যান্ডেলে বসাল। তারপর টুসির মাকে পিছনের ক্যারিয়ারে বসিয়ে নিয়ে অন্ধকারের ভূতুড়ে সাদা পথ দিয়ে সাইকেল চালাতে লাগল। সাইকেলে আলো নেই ওর। টর্চও জ্বালালো না।

    কেউ কোনো কথা বলছিলো না। হ্যান্ডেলের ওপর-বসা টুসিয়ার কোমর, ঊরু ও হাতের ছোঁয়া নানকুর গায়ে লাগছিল। খুব ভালো লাগছিল নানকুর। কিন্তু বড় লজ্জা করছিল টুসির। এ জন্মে তো কিছুই দিতে পারল না নানকুকে। অন্য সব মেয়েরা নিদেনপক্ষে যা দিতে পারে, দেয়, সেটুকুও নয়। সেটুকুও লুটিয়ে দিয়ে এল অন্যখানে।

    কিছুদূর এসে নানকু বলল, কী মাসি? মেসো জানে এ কথা?

    মেসো? জানলে, কেটে ফেলবে। টাঙির কোপে আস্ত টুকরো করে ফেলবে মা-মেয়ে দুজনকেই।

    মেসো লোকটা মরদের বাচ্চা? আমার মানিয়া মেসোর মতো নয়।

    মানিয়াই কি আর এরকম ছিল। আহা, ওর জুরীয়াটা। আর ঐ গোদা শেঠ। তারপরই বলল, নানকু, তুই জানলি কী করে টুসির…কথা, আর আমরা যে আজ এখানে আসব?

    সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল ও, আমার সব খবর রাখতে হয়।

    টুসির মায়ের খুব রাগ হচ্ছিল নানকুর ওপর। সবই যদি জানে, তাহলে এইটুকুও কি নানকু বোঝে না যে, এছাড়া টুসির আর কোনো পথ খোলা নেই? ভালো করতে পারে না, মাতব্বরি করার কে ও? ওর কথাতেই চলতে হবে নাকি ওদের? ছোক্রাটা ভাবে কী? ভাবে কী নিজেকে?

    আমাদের তুই জোর করে ফিরিয়ে নিয়ে এলি কেন? আমাদের কাজ ছিল ওখানে।

    উপায় আর কী আছে? কেন, তুই যেতে দিলি না?

    ধমকের সুরে নানকু বলল, আমার ইচ্ছা।

    তোর ইচ্ছাতেই কি আমাদের চলতে হবে?

    হ্যাঁ। যারা নিজেদের ইচ্ছায় চলতে শেখেনি ভালো করে, তাদের আমার ইচ্ছাতেই চলতে হবে।

    একি তোর হুকুম?

    হ্যাঁ! হুকুম।

    আ-চ্ছা! বড় ওস্তাদ হয়েছিস দেখছি তো তুই। জানিস্ আমার হীরু পুলিশ সাহেব! তোকে আমি…!

    ও নাম তুমি মুখেও আনবে না মাসি! তুমি আর হীরুর মা নও। ভালুমারের হীরু মরে গেছে। তুমি টুসির মা, লগনের মা।

    একটু থেমে বলল, আমার তো মা নেই, তুমি আমারও মা।

    সাইকেল চলতে লাগল অন্ধকারে। বাঁ দিকে পথের পাশ দিয়ে কী একটা জানোয়ার হড় বড় খড় বড় আওয়াজ করে নীচে নেমে গেল।

    কী ওটা?—টুসি শুধোলো আতঙ্কিত গলায়।

    কিছু না। একটা বাইসন দাঁড়িয়েছিল। মস্ত বাইসন।

    রাস্তার ডানদিকে দূরে শ্মশানের দিক থেকে নিদিয়া নদীর ওপার থেকে ফেউ ডাকতে লাগল বার বার। টুসিয়ার মা ফিফিস্ করে বলল, বাঘ বেরিয়েছে? না রে নানকু…?

    বলতে না বলতেই হুঁ-আঁ-উঁ-উঁ-আঁ-ম্ করে বাঘের ডাক ভেসে এল রাতের অন্ধকারে।

    নানকু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, হুঁ। তোমার ভয় করছে নাকি মাসি?

    বাঘকে ভয় করবে না?

    নানকু গভীর আক্ষেপের গলায় বলল, তোমরা না মা! তোমরাই তো এই গোদা শেঠ আর মাহাতোদের বাড়তে দিয়েছো। তোমরা বাঘের জন্ম দিতে পারো না? ঘরে ঘরে কেবল ফেউ—ফ্যাচ্চ্ ফ্যাচ্ করে কাঁদে। তোমাদের নিজেদের ঘরে ঘরে বাঘ থাকলে আর বনের বাঘকে ভয় পেতে না।

    টুসির মা চুপ করে রইল। টুসিও।

    নানকুর প্রসারিত দু’হাতের মধ্যে ও শরীরটাকে সংকুচিত করে বসে আছে। হীরু আসার আগে একদিন মীচা-বেটিতে জঙ্গলের ছায়াতে পুরোপুরি জংলি হয়ে চান করার সময় নানকু তাকে দেখে ফেলেছিল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল টুসিয়ার। কোনো মানুষ কারো শরীরে শুধু তার চোখের চাউনি ছুঁইয়ে দিয়ে যে এমন জ্বালা ধরাতে পারে তা জানত না টুসি। আসলে সেই মুহূর্ত থেকে নানকুকে এক বিশেষ ভয় করতে শুরু করেছিল ও। একটা ভীষণ ভালোলাগা-মেশানো ভয়। মাঝে, সবকিছুই যে কেন এমন সাংঘাতিকভাবে গণ্ডগোল হয়ে গেল, সব কেন যে শেষ হয়ে গেল এমনভাবে! হঠাৎ, ও নিজেরই অজান্তে, হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে নানকুর বুক আর ছড়ানো দুটি হাতের মধ্যে মাথা হেলিয়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, আমি আত্মহত্যা করব। আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো পথই আর খোলা নেই।

    ধমক দিয়ে নানকু বলল, কাপুরুষেরা আত্মহত্যা করে।

    আমি তাই। কাঁদতে কাঁদতে বলল টুসি।

    তাহলে তোর ছেলেও কাপুরুষ হবে।

    আমার ছে…? এটুকু বলেই, টুসি আবারও ভেঙে পড়ল কান্নায়।

    টুসির মা বলল, থাক্ টুসি। আমরা বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি। তোর বাবা শুনতে পেলে আমাদের মাথা আর আস্ত থাকবে না। এতক্ষণে মহুয়ার নেশা ছুটে গেলেও যেতে পারে। নানকু লম্বা লম্বা দুটি পা মাটিতে নামিয়ে দিয়ে ব্রেক কষে, একটি গাছের ছায়ায় দাঁড় করাল সাইকেলটাকে—যেখানে রাতের অন্ধকার অন্ধকারতর। টুসি আর টুসির মা নামল। নেমে, একবার নানকুর দিকে চেয়ে বাড়ির দিকে এগোল।

    নানকু ডাকল, মাসি। টুসি যেখানে দাঁড়িয়েছিল দাঁড়িয়েই রইল।

    আজ থেকে তুমি এক নতুন ছেলে পেলে মাসি। হীরুর মতো বিদ্বান ছেলে নয়, সাধারণ, অতি সাধারণ, এই বস্তির ছেলের মতো আরেকজন ছেলে। আজ থেকে তোমাকে আমি মা বলে ডাকব। বাঘকে আর ভয় পেয়ো না মা। কখনো না। বুঝেছো। আর শোনো। একটা ভালো দিন ঠিক করো। টুসিকে আমি বিয়ে করব। গাঁয়ের লোকদের বোলো যে, মালা-বদল করে গান্ধর্ব মতে আমাদের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়া নাচ-গান পরে হচ্ছে। আর…। সকলেই বুঝে নেবে বাকিটা।

    একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার তো কোনো আত্মীয় নেই। তোমরাই আমার সব! যখন বরাত আসবে, মাত্র দু’জন মেহমান থাকবে আমার। পাগলা সাহেব আর বাঁশবাবু। বুঝলে!

    বলেই, বলল, আমি চললাম।

    যাবার আগে টুসির মাকে তার শক্ত দুহাতে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেল শব্দ করে নানকু। ব্যাপারটার অভাবনীয়তায় চমকে উঠল টুসির মা। টুসির মায়ের সারা শরীরে কেমন যেন একটু কাঁপুনি উঠল, মাঝরাতের হাওয়া-বওয়া জঙ্গলে যেমন ওঠে। এক আশ্চর্য অনুভূতি, একেবারে নতুন একটা অভিজ্ঞতা। স্বামীর সোহাগে যা কখনও হয়নি, ছেলের আলিঙ্গনেও যা হয় নি, তার কাছে পরপুরুষ, তার ভাবী-জামাইয়ের গালের চুমুতে তাই-ই হল। টুসির মা জীবনে এই প্রথম বুঝতে পারল, স্বামী পাওয়ার মতো, ছেলে পাওয়ার মতো, জামাই পাওয়াটাও প্রত্যেক নারীর জীবনে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। এক অবশ ভালোলাগায় ভরে রইল টুসির মা, শরীর মনের অণু-পরমাণুতে।

    অন্ধকারে টুসি দাঁড়িয়েছিল। সবই শুনেছিল ও। ওর দুচোখ বেয়ে ঝরঝরিয়ে জল ঝরছিল। অন্ধকারে, কোরা রঙের ধুলোর রাস্তাটাতে সাইকেলের অন্ধকারতর ছায়াটা, চাকার কিরকির র্ র্ র্ শব্দটা একসময় মিলিয়ে গেল। সেই রাতের অন্ধকারে তাকিয়ে হঠাৎই টুসির মনে হল যে, খুব আস্তে আস্তে, কোমরে সামান্য দোলা তুলে একটা বড় বাঘ যেন চলে যাচ্ছে ধুলোর পথ বেয়ে। একদিন দেখেছিল ও একটা বড় বাঘকে চলে যেতে ঠিক এমনি করে, বাবার সঙ্গে মহুয়াডার থেকে ফিরে আসার সময়।

    শব্দটা, ছায়াটা মিলিয়ে গেছে অনেকক্ষণ। তবুও যেদিকে নানকু চলে গেল টুসি সেই দিকেই একদৃষ্টে চেয়ে রইল। অনেকই কথা ছিল নানকুর সঙ্গে। অনেক কিছু বলার ছিল। শোনার ছিল। কিন্তু নানকুর কি সময় হবে? নানকু কি জানে, কতখানি ঠকাচ্ছে নানকু নিজেকে এবং যে আসছে তাকেও?

    টুসির মা ভাবছিল, টুসিটা খুব ভাগ্যবতী।

    হঠাৎ কী মনে হওয়ায় টুসির প্রতি টুসির মা এক তীব্র ঈর্ষা বোধ করতে লাগল। নানকুর চুমুটা তার গালে তখনও নরম হয়ে লেগে ছিল। বিরক্তিমাখা ধমক দিয়ে বলল, পা চালিয়ে চল্ না মুখপুড়ি। মেয়েকে যেন পরীতে ভর করেছে। ঢঙ্‌ দেখলে গা জ্বালা করে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঋজুদা সমগ্ৰ ৫ – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article লবঙ্গীর জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }