Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কোজাগর – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প561 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কোজাগর – ৩২

    ৩২

    সন্ধে হয়ে আসছে। পাহাড়তলির প্রায়ান্ধকার বনস্থলীর আলো-আঁধারির চাঁদোয়া ফুঁড়ে উড়ে যাচ্ছে ধূসর-কালো দীর্ঘগ্রীবা রাজহাঁসের দল দ্রুতপক্ষে, দূরের মৎস্যগন্ধী নদীর নূপুর-ি -নিক্বণিত জলজ নির্জনে। ওরা সব পরিযায়ী পাখি। কত দূর থেকে আসে শীতে, আবার শীত ফুরোলেই খেলা শেষ করে উড়ে যায় নিজেদের জলাভূমিতে। ওরা যখন বনজঙ্গলের মাথা ছুঁয়ে উড়ে যেতে যেতে ওদের হলুদ-কালচে ঠোঁটে কীসব দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ করে, তখন মনে হয় সেই কোয়াক্ কোয়াক্ মন্ত্রে প্রকৃতিকে ওরা এই মাত্র গর্ভবতী করে দিয়ে গেল।

    টুসি আকাশের দিকে চেয়ে, ওদের সাবলীল স্বচ্ছন্দে উড়ে-যাওয়া দেখছিল উদাস অবাক চোখে। ওর স্নিগ্ধ শরীরের উন্মুখ জমিতে সতেজ নরম চিকন জীবনের বীজ বুনে গেছে এমনি এক শীতের সুন্দর অচেনা পাখি। অথচ ওর চেনা, চির-চেনা অন্য বন্য এক প্রাণবন্ত পাখির পথ চেয়ে টুসি কোনো প্রতীকী নারীর মতো শীষতোলা গা-শিউরানো সুখের আশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে, এই সুন্দর দেশের এক সুন্দরী সরল নারী, যেন যুগযুগান্ত ধরে। পাহাড়ে চূড়া থেকে হঠাৎ উড়ে-আসা দামাল ভেজা হাওয়ার মতো নানকু পাখিটি বুঝি এখনি এসে লেবুফুলের গন্ধ-ভরা নূপুর-পরা, দুষ্টু বৃষ্টির মতো পুটুর-টুপুর টুপুর-পুটুরের দীর্ঘ নিচের দৌরাত্ম্য শুরু করে দেবে তার ঝিম্-ধরা যুবতী শরীরের ঝিঁঝিঁ ডাকা গহীন ঝিলে।

    এখুনি।

    কিন্তু নানকু আসে না; আসে নি। কোথায় কোথায় যে উধাও হয়ে যায় নানকু না বলে-কয়ে; তা নানকুই জানে।

    অন্যমনস্ক টুসির চমক ভাঙলো বুলকি আর পরেশনাথের ডাকে। চমকে উঠে টুসি বলল, তোরা এই ভরসন্ধেতে এখানে কী করছিস! এখনও বাড়ি যাসনি? জানিস না, শোনচিতোয়াটা রোজ হামলা করছে।

    বুলকি বলল, জানি আবার না? আমাদের বাছুরটাকে এক্ষুনি ধরে নিয়ে গেছে তাই-ই তো দৌড়ে এলাম তোমার কাছে। কাড়ুয়া চাচা কোথায় জানো?

    টুসি আতঙ্কিত গলায় বলল, বলিস কীরে? কাড়ুয়া চাচা যেখানেই যাক, তোরা এখুনি দৌড়ে বাড়ি চলে যা! জানিস না, চিতাটা মানুষ ধরছে। একি এমনি শোনচিতোয়া? তোদের সাহস তো কম নয়?

    পরেশনাথ বলল, সাহস নেই আমাদের টুসিদিদি! কিন্তু চিতাটা আমাদেরই বাড়ির পিছনের নালায় বসে সফেদি বাছুরটার হাড় চিবিয়ে খাচ্ছে কড়মড় করে। বাবা কোমরের ব্যথায় হাঁটতে পারে না, জ্বর খুব; সকাল থেকে। কী করব, বুঝতে না-পেরে তোমার কাছেই দৌড়ে এলাম আমরা।

    টুসি ওদের ধমক দিয়ে বলে, তোরা আবার দৌড়ে বাড়ি যা। দরজা বন্ধ করে থাকবি। সারা রাত কেউ বেরুবি না। কাল সকালে যা হয় হবে। আমি বাবাকে বলব। বাবা ফিরলে। বাবা গাড়ুতে গেছে। কাল ফিরবে। আজকাল তো বিকেলের পর কেউ বাড়ির বাইরে বেরোয় না। কারো উপায়ই নেই বেরুবার। দেখছিস না, হাট পর্যন্ত ভেঙে যাচ্ছে বেলাবেলি এই শোনচিতোয়ারটারই জন্যে! আর বলিহারি তোদের সাহস! কোনো কথা নয়। এক্ষুনি পালা তোরা। এক্ষুনি কাড়ুয়া চাচাকে কোনোক্রমে খবর দিতে পারলে, দেবো।

    চলে যেতে যেতে, বুলকি বলল, নানকু ভাইয়া কোথায়?

    টুসি বলল, তোর নানকু ভাইয়াই জানে। ছাতার বিয়ে হল আমার! ছাতার ভাতার বিয়ের নামে বিয়ে করে, উধাও হল! কখনও আসে হপ্তাহে একবার। কখনও তাও না। কে বলবে, আমার বিয়ে হয়েছে একমাস! কবে তাকেই ধরবে চিতাটা, সেই ভয়েই মরে যাচ্ছি আমি। রাত-বিরেতো বনে-জঙ্গলে কী যে করে বেড়ায়। ভূত একটা! যাচ্ছেতাই।

    এবার ভাই-বোন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে চলল বাড়ির দিকে। যখন বাড়ির কাছাকাছি পৌঁচেছে তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। তাড়াতাড়িতে আবারও ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে শর্ট-কাট করল ওরা। প্রায় বাড়িতে পৌঁছে গেছে, হঠাৎ দেখে; নালার মধ্যে থেকে উঠে এসে চিতাটা একটা বড় পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দুধ-সাদা বাছুরটার রক্তে চিতাটার মুখ-নাক-বুক-গোঁফ সব লালে লাল হয়ে আছে। ওদের দু’ ভাইবোনের পায়ের আওয়াজ শুনে কী ব্যাপার দেখার জন্যেই বোধ হয় উঠে এসেছিল শোনচিতোয়াটা। তাকে দেখতে পেয়েই ওরা দু’ভাইবোন একই সঙ্গে চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ মনে হল, চিতাটা বোধহয় ওদের দিকেই দৌড়ে আসছে।

    ঘরের মধ্যে থেকে মানিয়া বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে টাঙ্গি হাতে দরজা অবধি এল অনেক কষ্টে। মুখে চিৎকার করে গালাগালি করে চিতাটাকে ভয় পাওয়াবার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর অনুনয়-বিনয় করে ভগবানের আশীর্বাদ চেয়ে অসহায়, সম্বলহীন বাপ তার সন্তানদের প্রাণ ভিক্ষা করল বারবার চিতাটার কাছে। ওরা দু’ ভাইবোন দৌড়ে ঘরে এসে ঢুকলেই, তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করল মানি। ঘরের ভিতরে মাটির ওপরে কাঁথাতে শুয়ে মুঞ্জরী গালাগালি করতে লাগল মানিকে, ছেলেমেয়ে দুটোকে পাঠাবার জন্যে।

    বলল, বে-আক্কেলে লোক! নিজের মুরোদ নেই ঘর থেকে বেরোবার, দুধের ছেলেমেয়ে দুটোকে বাঘ দিয়ে না-খাওয়ালে হচ্ছিল না। বাপ না শত্ৰু!

    মানি বলল, বাজে কথা বলিস না। আমার না-হয় কোমর ভেঙেছে—তাই-ই না এত কথা!

    মুঞ্জরী পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল, তোমার কোমর আবার কবে ছিল? চিরদিনই তো কোমরভাঙা মরদ তুমি। কোন সুখটা দিয়েছো তুমি আমাকে জীবনে? এখন এই ছেলে-মেয়ে দুটোকে বাঘে খেলেই তোমার হাড় জুড়োয়!

    হঠাৎ ওরা সবাই চুপ করে গেল। মনে হল বন্ধ দরজার ওপরে নখ দিয়ে কেউ আঁচড়াচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকেই ওরা একসঙ্গে আবার চিৎকার করে উঠল। মুঞ্জরীও কাঁথা ছেড়ে উঠে বসে হাতা দিয়ে হাঁড়ি বাজাতে লাগল। ভয়ে,

    ভীষণ ভয়ে; ওদের উপবাসী পেটের মধ্যে একদল ছাতার পাখি যেন নড়ে-চড়ে বসতে লাগল। ছ্যাঃ ছ্যাঃ করে ডাকতে লাগল।

    কিছুক্ষণ পর শব্দ মরে গেল। ওরাও ঘরের ভিতর মরার মতো পড়ে রইল। একটু পরে হাড় কামড়ানোর কড়মড় আওয়াজ আবার শোনো গেল নালা থেকে। উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল ওরা। তারপর সারারাত ঘুমিয়ে ও জেগে কোনোক্রমে কাটিয়ে দিল। মুঞ্জরী পথ্য পেলো না কোনো। ওষুধ পেলো না। ছেলেমেয়ে দুটো ও মানি কিছু খেতেও পেলো না সে রাতে।

    চিতাটার সাহস দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। টেটরা চাচাকে ধরার পর কোনো মানুষ ধরে নি ঠিকই। কিন্তু একটা কুকুর, দুটো পাঁঠা, ধাঙ্গড় বস্তির দুটো শুয়োর এবং আজ এই বুলকিদের বাছুরটা তার পেটে গেল।

    পুরো ভালুমার অঞ্চলে অলিখিত সান্ধ্য আইন জারি হয়ে গেছে। বিকেল থাকতে থাকতে সকলেই যে যার ঘরে ঢুকে পড়ে। উঠোনেও কেউ থাকে না। যদি কেউ অন্য বস্তিতে যায়, তাহলে সেখানেই থেকে যায়। বিকেলে ভালুমারে ফেরার চেষ্টাও করে না। দিনের বেলাতেও বড় বড় দল করে ওরা জঙ্গলে পাহাড়ে যায়, সশস্ত্র হয়ে। একা একা জঙ্গলে যাওয়ার কথা আর কেউই ভাবে না।

    রথীদার বাড়িতে একটা ছোট্ট মিটিং বসেছিল। আমরা ডালটনগঞ্জ থেকে যেদিন ফিরলাম তার পরদিন রাতে। কাড়ুয়াও এসেছিল। আমিও ছিলাম। রথীদা কাড়ুয়াকে বলেছিল কাড়ু, তুই এর জিম্মা নে। পরে যা হওয়ার হবে। কাড়ুয়া বলেছিল, আপনি বলার আগেই নিয়েছি। মাহাতো আর গোদা শেঠ-এর মতো দু’ পেয়ে শোন্ চিতোয়া তো এমনিতেই কত্ত আছে গ্রামে! তার ওপর এ ব্যাটাকে আর সহ্য করা যায় না।

    ইতিমধ্যে গতকাল একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। কয়েকটি অল্পবয়সি অচেনা ছেলে বিকেল তিনটের সময় গোদা শেঠের দোকানে ঢুকে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে তার কোমরে দড়ি বেঁধে লাঠিপেটা করতে করতে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। তারা কারা, কোত্থেকে এল ভালুমারে; তার কিছুই জানা যায়নি। ছেলেগুলো গোদা শেঠকে খুন করে রেখে যেতে পারত, কিন্তু তা না-করে শোনচিতোয়াটা যে-পথে প্রায় রোজই যাতায়াত করে সেই পথেই একটা গাছের সঙ্গে তাকে বেঁধে রেখে কোথায় উধাও হয়ে গেছিল। সারা রাত শোনচিতোয়াটা গোদা শেঠের ধার দিয়ে অন্তত বার চারেক গেছে। গোদা শেঠকে মুখ তুলে দেখেছে। তারপর চলে গেছে ওকে স্পর্শ না করেই। বস্তির লোকে বলছে, গোদা, যমেরও অরুচি।

    পরদিন সকালে গোদার লোকজন যখন তাকে উদ্ধার করে দড়ি খুলে, তখন সে ভয়ে মরা। প্রত্যেক মানুষই সত্যি সত্যি মরার আগে অনেকবার মরে। এর চেয়ে মরে যাওয়াও ঢের ভাল ছিল। পাগলের মতো তার দৃষ্টি। উল্টোপাল্টা কথা বলছে; গায়ে ধূম জ্বর। গোদাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডালটনগঞ্জে চিকিৎসার জন্যে আর পুলিশে ডায়েরি করার জন্যে।

    দিনে দিনে ভালুমার জায়গাটা সত্যিই সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে। ছোট্ট বুকের ছোট্ট সুখের দিন বুঝি দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। ছেলেগুলো কোত্থেকে এল, এই মানুষখেকো চিতার জঙ্গলে রাতের অন্ধকারে কোথায়ই বা গেল; কেউই তার কিনারা করতে পারেনি। এই বস্তিতে একটার পর একটা উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটছে টেটরার মৃত্যুর পর থেকে প্রায় রোজই।

    যেদিন বুলকিদের বাছুর নিল চিতাটা, তার পরদিন আরও এক সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটল। সেই যে দাড়িওয়ালা ফরেস্ট গার্ড—যে বলেছিল, আমরা গভরমেন্টের অফিসার, বাঘ-চিতা ভয়ে কখনওই আমাদের কাছে আসবে না, সে তার কোয়ার্টার্সেরই সামনে ভর দুপুরবেলা খাওয়া- দাওয়ার পর চৌপাই পেতে কাঁটাল গাছতলায় ঘুমোচ্ছিল। কোয়ার্টার্সে অন্য গার্ডরাও ছিল। ফরেস্ট বাংলোতে একজন টাইগার প্রোজেক্টর ডি এফ-ও ক্যাম্প করেছিলেন। তাঁর জিপ গাড়ির ড্রাইভার, বেয়ারা, লোকজন সকলেই ছিল। তাছাড়া, কোয়ার্টার্সের পাশেই কুয়োতলা। সেখানে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি ভিড় লেগেই আছে। ঘটি-বালতির আওয়াজ। লাটা খাম্বার ক্যাচোর-ক্যাঁচোর। কিন্তু এত লোকজন, শোরগোলের মাঝেই শোনচিতোয়াটা এসে সেই দাড়িওয়ালা গার্ডকেই ঘুমন্ত অবস্থাতে টুটি কামড়ে ধরে তুলে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে সাফ্ করে দিয়েছে। অদৃষ্টের কী পরিহাস। সে অবশ্য সেই সময় লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে শুয়েছিল। তার সরকারি পোশাকটা শরীরে না থাকায় শোনচিতোয়াটা সরকারের প্রতি সম্মান দেখায় কী দেখায় না, তা ঠিক পরখ করে দেখার সুযোগ হয়নি কারো। যাই-ই হোক, সেই গার্ডের শরীরের অংশবিশেষকে ও কাল দাহ করা হয়েছে নিদিয়া নদীর পাড়ের শ্মশানে। সেও এখন টেটরার মতোই ভালুমারের স্মৃতি হয়ে গেছে।

    এখন সকাল এগারোটা বাজে। কাড়ুয়া আর নানকু হুলুক্-এর দিকে একটি ছায়াচ্ছন্ন পাহাড়ী নালার পাশে গভীর গুহার মধ্যে বসে আছে। খিচুড়ি চাপিয়েছে নানকু, সঙ্গে আলু ফেলে দিয়েছে দুটো। আর বনমুরগির তিনটে ডিম। মুরগিটা গুহার পাশে বসেই ডিমে তা দিচ্ছিল। ওদের আসতে দেখেই কঁক্ কঁক্ করে উড়ে যেতেই কাড়ুয়ার চোখে পড়েছিল ডিমগুলো। সঙ্গে সঙ্গে নদীর জলে ধুয়ে নিয়ে, খিচুড়ির মধ্যে চালান করে দিয়েছে। বনদেওতার দান। কাড়ুয়া বলেছিল।

    নানকুর হাতে একটা দো-নালা দেশি বিদেশি শগান। কাড়ুয়াকে বুঝিয়ে দিচ্ছে নানকু, সেটি ক্যাচ কোথায় আছে, কী করে বন্দুকটা খুলতে ও জোড়া লাগাতে হয়। অ্যালফ্যাম্যাক্স-এর টাটকা এল-জি আর লেথাল্ বল্ জোগাড় করে এনেছে ও। বন্দুকটা কিন্তু চোরাই বন্দুক নয়। বন্দুকটা আসলে হীরুর। নানকু হাজারিবাগে গেছিল ক’দিন আগে টুসিয়ার কাছে সব শুনে। নাম ভাড়ায়নি। কিন্তু হীরুই তার পরিচয় গোপন করে অন্য পরিচয় দিয়েছিল। ওকে বলেছিল, তুই? তুইই সেই নানকু? তোর দুঃসাহস তো কম নয়? বাঘের মুখে মাথা ঢোকাতে এসেছিস?

    টেটরাকে বাঘে নেওয়ার একদিন পরই গেছিল ও।

    হীরুকে চিতার কথা সবই বলেছে নানকু। হীরুর সেই রইস্ খুবসুরৎ বন্ধুর সঙ্গে আলাপও হয়েছে নানকুর। হীরুর মাধ্যমেই। নানকু তার সম্বন্ধে কিন্তু আর কিছুই বলে নি হীরুকে। যা করার একদিন নিজেই করবে। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত। হীরুর চোখমুখ কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ দেখেছিল নানকু। হীরু যেন অনেক বদলেও গেছে বলে মনে হয়েছিল। শোনচিতোয়াটার কথা সব শোনার পর নিজে পুলিশ সাহেব হয়েও, তার বস্তির লোকদের বাঁচাবার জন্যেই এমন বেআইনি কাজ করেছে হীরু। তার লাইসেন্সড্ বন্দুকটা নানকুর হাতে তুলে দিয়েছে।

    একটা বড় থলে দিয়েছিল হীরু বন্দুকটাকে ভেঙে লক্-স্টক্-ব্যারেল আলাদা করে লুকিয়ে নিয়ে আসার জন্যে। নানকুকে বলেছিল কাড়ুয়া চাচাকে দিস্ আর বলিস, যেন সাব্‌ড়ে দেয় চিতাটাকে। বন্দুকটা এক্ষনি নিয়ে আসার দরকার নেই। আমি শিগগিরই যাব অফিসিয়াল ডিউটিতে ভালুমারে। ততদিন যেন কাড়ুয়া চাচা এটাকে লুকিয়ে রাখে কোথাও। আমি গেলে, ফেরত নেওয়ার বন্দোবস্ত করব।

    নানকু চিন্তিত হয়ে বলেছিল, কাড়ুয়া চাচা তোমার বন্দুক সমেত ধরা পড়লে?

    হীরু হেসেছিল। বলেছিল, ধরা ও পড়বে না কখনও হাতে নাতে। ওর মতো শোনচিতোয়া আমাদের বন পাহাড়ে আর একটাও নেই। যদি একান্ত ধরা পড়েই, তবে তো পুলিশ কেসই করবে ওরা! আমি আছি। ভয় নেই কোনো। বলিস্ চাচাকে। জবান্ দিলাম।

    কাড়ুয়া বন্দুকটা নিজের হাতে ভালো করে বসিয়ে নিচ্ছিল। নতুন বৌয়েরই মতো, নতুন বন্দুকেও সড়গড় হতে সময় লাগে।

    চিরদিন গাদাবন্দুক চালিয়েই অভ্যেস। এরকম বন্দুক যে কাড়ুয়া আগে, ব্যবহার করেনি; তা নয়। শহুরে শৌখিন শিকারিরা শিকারে এসে তাকে বলেছে শিকার করে দিতে, তাদের বহুমূল্য বন্দুক হাতে তুলে দিয়ে। অবশ্য তারপর শিকার হয়ে গেলে, শম্বর ও হরিণের চামড়া ও মাংস, বাঘের মাথা ও চামড়া নিয়ে তারা ফিরে গেছে। তাদের ভালো-ভালো বন্দুক রাইফেলগুলো ফিরিয়ে দেবার সময় চিরদিনই বুকের মধ্যে ভীষণ এক কষ্ট হয়েছে কাড়ুয়ার। বাবুরা কাড়ুয়াকে দশ-বিশ টাকা বকশিস দিয়ে, নিজের নিজের শ্বশুর বাড়িতে রোমহর্ষক শিকারের গল্প করার অধীর আগ্রহে তন্ময় হয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে গেছেন যার যার শহরে।

    কিন্তু সে-সব অনেক দিনের কথা। শিকার বন্ধ হয়ে গেছে এ তল্লাটে বহু বছর। বন্দুকটাকে নেড়ে চেড়ে পরখ করে কুঁদোর সঙ্গে গাল লাগিয়ে, ঝকঝকে ব্যারেলের শেষে মাছিটাকে ভালো করে দেখে স্বগতোক্তি করল। বেহেতরিন!

    হীরু একটা ছোট ক্ল্যাম্প ও দু ব্যাটারির টর্চও দিয়েছিল নান্টুকে। টর্চটা ক্ল্যাম্পের সঙ্গে ফিট করা থাকবে রাতে। যেখানে আলোর ফোকাস্ পড়বে, সেখানেই গুলি লাগবে গিয়ে ট্রিগার টানা মাত্র। এ বন্দুকটা হাতে করে কাড়ুয়ার মনে হলো মুঙ্গেরি গাদা বন্দুকটা যেন বছর বছর বাচ্চাবিয়োনা রুখু বুড়ি বউ আর এই বন্দুকটা যেন কুমারী মেমসাহেব। কাড়ুয়ার সঙ্গে প্রথম মিলন তার। কাড়ুয়া অবশ্য নানকুকে বলেছে, এই বন্দুক হাতে থাকলে যমকেও ভয় করি না আমি!

    কাড়ুয়া শুধোল, এটা কোন দিশি বন্দুক রে নানকু?

    ইংলিশ। ডাব্লু-ডাব্লু গ্রিনার কোম্পানির বন্দুক। বন্দুকের মধ্যে এ রাজা।

    কত দাম রে নানকু?

    কম করে দশহাজার হবে! আজকের বাজারে।

    দশ হাজার টাকা? কী বলিস রে? হীরুর আমাদের এত টাকা?

    বল কী চাচা! ফুঃ। দশ হাজার আবার টাকা নাকি? যাদের টাকা আছে, তাদের কাছে এ কোনো টাকাই নয়। এতো হীরুর এক ঘণ্টায় কামাই।

    কাড়ুয়া বারবার বিড়বিড় করে বলতে লাগল; দশ হাজার, দশ হাজার

    তারপরই, চুঃ শব্দ করে; চুমু খেল বন্দুকটাকে একবার।

    নানকু হাসল। বলল, ভাগ্যিস চাচি নেই ধারে কাছে। থাকলে, সতীনের ওপর রেগে যেত।

    কাড়ুয়া আসলে এই শোনচিতোয়াটার মধ্যে শুধুমাত্র একটা চিতাবাঘকেই দেখেনি। চিতা বাঘ, বড় বাঘ, এবং মানুষখেকোও সে অনেকই মেরেছে জীবনে। কিন্তু বাঘ মেরে আর সে আনন্দ পায় না। সে মাহাতোকে মারতে চায়, গোদা শেঠকে মারতে চায়। সমাজের নর-নারী খাদকগুলোকে এক এক গুলিতে ধরাশায়ী করতে চায় কাড়ুয়া। কিন্তু তার সাধ্য কতটুকু? সাধ্য নেই বলেই এই শোনচিতোয়াকে ও মাহাতোদের আর গোদা শেঠদের প্রতিভূ হিসেবে দেখছে। এই বস্তির যা কিছু অমঙ্গল অশুভ, সবকিছুর প্রতীক এই চিতাটা—মাহাতোদেরই প্রতীক এ। একে না মারতে পারলে কাড়ুয়া রাতে ঘুমোতে পারবে না। বস্তির মঙ্গলও ফিরে আসবে না।

    খিচুড়ি ফুটে গেল। ওরা গুহার মধ্যে বন্দুকটাকে রেখে নদীর মধ্যে নেমে, জল দিয়ে পাথর পরিষ্কার করে পাথরের ওপরই মাটির হাঁড়িসুদ্ধু ঢেলে গরম ধোঁয়া-ওঠা খিচুড়ির মধ্যে নুনী থেকে একটু নোনা মাটি তুলে এনে ছড়িয়ে দিয়ে হাপুস্-হাপুস্ করে খেলো। খাওয়া হয়ে গেল, নানকু বলল, আমি চলি চাচা। জিম্মা, তোমার রইল।

    কাড়ুয়া হাসল। ওর কুচকুচে কালো বলিরেখাময় কপালে খুশি আর চিন্তামেশা অদ্ভুত একটা ঢেউ খেলে গেল। সাদা দাঁতগুলো ঝিমিক করে উঠল। একটা চুট্টা ধরাল কাড়ুয়া। নান্‌ন্ককেও একটা দিল। বাঁ হাত দিয়ে টিকিটকে আদর করল স্নেহভরে।

    তারপর বলল, সাবধানে যারে! আর দেরি করিস না। সন্ধে হয়ে এল।

    নানকু হাতের ফলা-বসানো লাঠি দেখিয়ে বলল, এই তো আছে। তাছাড়া, ফাঁকায় ফাঁকায় যাবো আমি। আমার সঙ্গে এখনও অনেক চিতার মোকাবিলা বাকি আছে চাচা। এই একটা ঘেয়ো, মানুষখেকো বুড়ো শোন্ চিতোয়াটার হাতে মরলে কি আমার চলে? আমার মওত্ হবে অনেক বড় মওত্। এমন মওত্ কি আমাকে মানায়? তুমিই বল? কাড়ুয়া আবার হাসল। বলল, ঠিক ঠিক। তবে মওতের কথা কেন? তুই তো এখনও শিশু।

    নানকু আর কথা না-বাড়িয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে যেতে বলল, চললাম চাচা।

    কাড়ুয়া কয়েক মুহূর্ত অন্যমনস্ক হয়ে ওর চলে-যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইল। এক নীরব, নিঃশব্দ আশীর্বাদ আর শুভকামনা কাড়ুয়ার বুকের গভীর থেকে ওঠা এক দীর্ঘশ্বাসে মথিত হয়ে নানকুর পায়েমাড়ানো জঙ্গলের শুকনো পাতার মচমচানোর সঙ্গে মিশে গেল।

    কাড়ুয়া কিছুক্ষণ উদাস চোখে উদ্দেশ্যহীনভাবে ওখানে বসে রইল। তারপর উঠে, মাটির হাঁড়িটাকে নিয়ে গিয়ে গুহার ভিতরে লুকিয়ে রাখল। অনেকগুলো বাদুড় আর চাচিকের গুহার মধ্যে। বিশ্রী একটা গন্ধ। কাড়ুয়া ঠিক করল, ইউক্যালিপটাস্ প্লানটেশানে গিয়ে বেশ কিছু পাতা ছিঁড়ে এনে গুহাটির মধ্যে পোড়াবে। যতদিন না শোনচিতোয়াটাকে মারা যাচ্ছে, ততদিন এই গুহাটাই তার ঘর বাড়ি; সব। নানকু চাল-ডাল দিয়ে গেছে। গোটাকয় আলু পেঁয়াজ আর কাঁচালংকাও। অনেকদিন এত ভাল স্বাদু খাবার খায়নি কাড়ুয়া। কিন্তু খাবারের স্বাদের চেয়েও অনেক বেশি ভালো লাগছে নতুন টোটাগুলোর গন্ধ। বন্দুকটার নীলচে-কালো ইস্পাতের জোড়া নলের ঠান্ডা পরশ! আঃ। জীবনে বেশি তো কিছুই চায়নি কাড়ুয়া। শুধু এমনি একটি মাত্র বন্দুক চেয়েছিল। আর চেয়েছিল, বনপাহাড়ে অবাধ বিচরণের স্বাধীনতা। চোরের মতো নয়। মানুষের মতো, মাথা উঁচু করে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর, থাকার অবাধ, অকুণ্ঠ, অকুতোভয় অধিকার

    বন-জঙ্গল, বনের হরিণ, পাখি, প্রজাপতি, বাঘকে কাড়ুয়া তো অন্য কারো থেকে কম ভালোবাসেনি। তবে, তার ভালোবাসার রকমটা অন্য। সব ভালোবাসার রকমই অন্য। ভালোবাসা যদি একই রকম হত, হত একই জনের প্রতি; তাহলে ভালোবাসা হয়তো আর ভালোবাসা থাকত না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঋজুদা সমগ্ৰ ৫ – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article লবঙ্গীর জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }