Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কোজাগর – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প561 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কোজাগর – ৩৩

    ৩৩

    এখন কত রাত কে জানে? আকাশে হঠাৎ যেন একটু মেঘের আভাস দেখা দিল। দিগন্তে ধুঁয়ো ভাব। অস্থির একটা হাওয়া জঙ্গলের নিস্তব্ধ বুক থেকে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল! লাফিয়ে উঠে, খুব জোরে দৌড়ে এসেই যেন পথ খুঁজে না-পেয়ে থেমে গেল বনের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে। আচমকা নতুন বনে, বুড়ো হাওয়ার ছেলেমানুষি দেখে পাতায়-পাতায় হাসাহাসি-কানাকানি শুরু হল। বুড়ি পাতারা বুড়ো হাওয়ার সামনে ঝুপঝাপ্ করে লাফিয়ে পড়তে লাগল লাল-হলুদ শাড়ি উড়িয়ে। তারপর তার সঙ্গে জড়াজড়ি করে, তাকে সুড়সুড়ি দিতে দিতে ও চাপা হাসি হাসতে হাসতে গভীর নালার অন্ধকারে গড়িয়ে গেল।

    হাওয়ার যেমন আছে, ঝরা পাতাদেরও কাম আছে।

    এসব ভেবে কাড়ুয়া নিজেদের মনে হেসে উঠল নিঃশব্দে।

    অনেকক্ষণ ধরে গাছের ওপরে মাচাতে বসে থাকায় কাড়ুয়ার পা ধরে গেছিল। নিঃশব্দে, চুপিসারে যেন অন্ধকারের গায়েও পা না লেগে যায় এমনই সাবধানে, ও পা-টা বদলে বসলো। ওপরে তাকালো একবার। মেঘটা উড়ে গেছে। এখন ঝড়-বৃষ্টি হওয়ার সময়ও নয়।

    কাড়ুয়া ভাবছিল। চারধারে যা অন্যায়, অনাচার, প্রকৃতি বুঝি তার অভ্যেস-টভ্যেস সব গুলিয়ে ফেলেছেন। তার রোজকার রুটিন বলে আর কিছুই নেই। বছরের রুটিন বলেও নেই। কাড়ুয়াকে এই নিয়মভাঙার কথা কেউই বলে দেয়নি। কিন্তু পাহাড়চূড়োর নরম ঘাসে কান পেতে শুনলেই ও আজকাল আসন্ন ভূমিকম্পর শব্দ শুনতে পায়। বনের পাখির ডাক ওর কানে কত কী সাবধানবাণী উড়িয়ে আনে। গভীর জঙ্গলের মধ্যের নিভৃত তালাওর নীচে জল যেখানে খুব গভীর, যেখানে কুমির আর বড় বড় মাছ আর সাপ থাকে; সেখানে গিয়ে চুপ করে বসে থাকলে ও কুমিরদের গলায় আসন্ন বন্যার আগমনী গানও শুনতে পায় যেন। যারা কুমিরদের ডাক আর শিস শুনেছে কখনও, তারাই জানে কী অদ্ভুত গা ছম্‌ছম্ করা সে ডাক। কুমিরদের ইদানীংকার আশ্চর্য গলার স্বর আর জলের স্তব্ধতা কাড়ুয়ার মনে এ ধারণাই বদ্ধমূল করে তোলে যে, এক দারুণ বন্যা আসছে পৃথিবীতে, আসছে ভূমিকম্প। এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে শিগগিরই। যারা থাকবে, তারা আবার নতুন করে, সুন্দর করে, স্নিগ্ধ সততার সঙ্গে গড়ে নেবে সে পৃথিবীকে।

    হঠাৎই কাড়ুয়ার মনে হল, একটা ছায়া যেন সরে গেল অন্ধকার ভুঁড়িপথে। তারপর ছায়াটা সোজা এগিয়ে আসতে লাগল অন্ধকারের গাছ-গাছালির তলার ছায়াভরা সুঁড়ি-পথটা দিয়ে। বন্দুকটা কোলের ওপরই রাখা ছিল আড়াআড়ি। ছায়ারই মতো নিঃশব্দে সেটাকে তুলে নিল। তারপর কাঁধে ছোঁওয়াল।

    কিন্তু পরক্ষণেই নামিয়ে নিল আবার।

    শোনচিতোয়া নয়। মানুষ

    মানুষ?

    দুটি মানুষ আসছে এই গহন নির্জন বনের অন্ধকারে, আলো না-নিয়ে। নিঃশব্দে। এরা নিশ্চয়ই মানুষখেকো চিতার চেয়েও গোপনে চলে।

    এরা কারা?

    মানুষ দুটো কাড়ুয়ারই গাছের নীচে এসে থেমে গেল। তারপর ফস্-ফস্ করে দেশলাই জ্বালল। জ্বেলে কিছু শুকনো পাতা এক জায়গায় জড়ো করে আগুন করল। একটা হ্যারিকেনও জ্বালল। তারপর হ্যারিকেনটা নিভু-নিভু করে ওখানেই ফেলে রেখে কোথায় যেন চলে গেল পরক্ষণেই।

    শোনচিতোয়ার ভাবনা ভুলে এখন কাড়ুয়া ছেলে দুটোর কথা ভাবতে লাগল। একেবারে বাচ্চা ছেলে! বয়স আঠারো কুড়ির বেশি হবে না। সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে একজনের। দুধের শিশু। এরাই কি সেই ছেলেরা? যাদের খোঁজে পুলিশ সাহেবরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন? এতটুকু টুকু সুন্দর সব ছেলে, ওরা কীসের টানে, কীসের লোভে, মা-বাবার কোল, বাড়ি ঘর ভাই বোন ফেলে এই মানুষখেকো বাঘের জঙ্গলে অন্ধকার রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে? কোন আগুনে পুড়ছে সোনার বাছারা? কী ওরা খায়? কে ওদের শত্রু? ওদের মিত্রই বা কে?

    কাড়ুয়া লেখাপড়া করেনি। বেশি জানে টানেও না। বোঝে আরও কম। বোঝার মধ্যে বোঝে, জঙ্গল-পাহাড়। তাই ছেলেগুলোকে নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবলে ওর চলবে না। শোনচিতোয়াটাকে কায়দা করতে হবে। এই গাছের নীচ দিয়েই যে-চিতাটা প্রত্যেকদিন যাতায়াত করে বনপথে তার ভাঞ্জ দেখে ও বুঝেছে চিতাটা প্রকাণ্ড বড়। এরই পায়ের দাগ দেখেছিল সে বাঁশবাবুর ডেরার উঠানে। তিলদের বাড়ির সামনের পথের ধুলোয়। ধুলোর ওপর তার চার পায়ের ভাঞ্জ-এ এমন কিছু অস্বাভাবিকতা নেই যে, ভাবা যায় তার পায়ে কোনো চোট আছে। চিতাটা বোধহয় বয়সের কারণেই হরিণ-শম্বর ধরতে পারে না তাই প্রথমে কুকুর-পাঁঠা দিয়ে শুরু করে মানুষে এসে থেমেছে। মানুষের মতো সহজ শিকার তো আর কিছুই নেই। ছোটো বড় সব জানোয়ারের শিং আছে, খুর আছে, গায়ের কাঁটা আছে, দাঁত, নখ আছে, মানুষের তো এসবের কিছুই নেই। পিছন থেকে বা পাশ থেকে এক লাফে উঠে ঘাড় কামড়ে ধরলেই হল।

    চিতাটা যে-পথে আসবার কথা, সেই ছেলে দুটো ফিরে গেল লণ্ঠনটাকে ফেলে রেখে। ওরা নিশ্চয়ই এইখানে আবার ফিরে আসবে।

    কিন্তু কেন?

    চিতাটার জন্যেই নয়, ছেলে দুটোর জন্যে কাড়ুয়া গাছ থেকে নামতে পারছে না। ছেলে দুটোর জন্যে চিন্তাও আছে। আবার ছেলে দুটো ওকে দেখে কী ভাববে, কী করবে, তা ওর জানা নেই। তার হাতে বন্দুক আছে বটে। কিন্তু অনভিজ্ঞ ছেলেগুলোও নিরস্ত্র নয়।

    কাড়ুয়া শিশুবধ করতে চায় না। তাছাড়া এই ছেলেগুলো যখন কিছু একটা করবে বলে, কোনো গভীর বিশ্বাসে ভর করে এত এবং এতরকম বিপদ মাথায় নিয়ে এতদূরে এসেছে! কী খাচ্ছে, কে জানে? কে এদের সাহায্য করছে? ওরা যেখানে আছে সেখান থেকে কোন বস্তি কাছে? কিছুই ঠাহর করতে পারছে না কাড়ুয়া। শুধু আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে বাচ্চা-বাচ্চা ছেলে দুটোর সাহস দেখে

    একটু পরই আবার সুঁড়িপথে ছায়া নড়ে উড়ল। আবার শুকনো পাতাতে পায়ের শব্দও পেলো। অত্যন্ত আস্তে আস্তে ওরা এল। এবারে তিনজন। ওদের প্রত্যেকের হাতে বন্দুক। অথবা রাইফেল। এবং গোল-গোল কালো-কালো কী যেন। ওগুলো কী? বোমা? হবে। বোমা কখনও দেখেনি কাড়ুয়া আগে। শুনেছে শুধু!

    ছেলেগুলো গাছতলার নালাতে শাবল দিয়ে গর্ত করতে লাগল। তাড়াতাড়ি গর্ত করে ফেলল হাঁটু সমান। কাড়ুয়া চুপটি করে মাচায় বসে দেখতে লাগল। গর্ত করতে করতে ওরা কাড়ুয়া যে-গাছে বসেছিল, সে-গাছেরই গুঁড়িতে তাকিয়ে দেখল অনেকগুলি বাঘের নখের দাগ সেখানে। ওরা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। কাড়ুয়ার ইচ্ছে হল, ওদের বলে যে, যে পথ দিয়ে বাঘ রোজ যাওয়া-আসা করে তার আশেপাশের গাছের গুঁড়িতে নখের দাগ অনেক সময়েই থাকে। এ দেখে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। কিন্তু কাড়ুয়া কিছুই বলতে পারবে না। বোবা হয়েই থাকতে হল তাকে। জিনিসগুলো একটা ত্রিপলের টুকরো মুড়ে পুঁততে পুঁততে ছেলে তিনটি বারবার পেছনে তাকাচ্ছিল। ওদের মধ্যে আরো কেউ কি আছে? যার আসার কথা ছিল ওদের পিছনে পিছনে? কিন্তু সে বোধহয় এসে পৌঁছয়নি। ওরা ফিফিস্ করে কথা বলছিল। এবং বেশ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল ওদের। এমন সময় ওদের মধ্যে একজন একটা টর্চ বের করল। টর্চ বের করে যে পথে এসেছিল, সে পথেই বন্দুক বাগিয়ে ওই পথেই ফিরে গেল। বাকি ক’জন ওখানেই বসে রইল। লণ্ঠনের আলোতে ছেলে দুটির মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, খুব খিদে পেয়েছে ওদের।

    একটু পরেই যে ছেলেটি চলে গেছিল, সে দৌড়ে ফিরে এল। তার হাতের বন্দুক ছাড়াও অন্য বন্দুক ও একটি থলে সঙ্গে নিয়ে। ও খুব উত্তেজিত হয়ে বলল, বাঘোয়া! বাঘোয়া!

    বাঘোয়া?

    ওরা সমস্বরে বলল, বাঘোয়া! বাঘোয়া!

    তারপর যে-ছেলেটি দৌড়ে গেছিল, সেই বলল, গিরিধারীকো বাঘোয়া লে গ্যায়া। ছেলে তিনটে বালির নীচে থেকে বন্দুক, রাইফেলগুলো আবার তুলে নিয়ে জোরালো টর্চ জ্বেলে ওদিকেই চলে গেল। বোধহয়, তাদের বন্ধুকে বাঘের মুখ থেকে উদ্ধার করতে। কাড়ুয়া মনে মনে বলল, আহাঃ বেচারা! ওদের মধ্যে আরও কাউকে আবার না ধরে। বললই। কিন্তু আর কী করতে পারে কাড়ুয়া? মানুষখেকো চিতা যে কী জিনিস তা তো ছেলেমানুষ ওরা জানে না! কাড়ুয়া এক অসহায় অস্বস্তি নিয়ে গাছের ডালে বসে রইল। হাতে বন্দুক নিয়ে নীচে নামলেই ওদের কিছু বুঝিয়ে বলার আগেই ওরা হয়তো মেরে দেবে কাড়ুয়াকে। ওদের মনেও দারুণ ভয়। বাঘের নয়। পুলিশের। কাড়ুয়া যে তাদের শত্রু নয় এ কথা বলার সুযোগটুকুও পর্যন্ত হয়তো কাড়ুয়া পাবে না।

    ছেলেগুলো চলে গেলে, গাছ থেকে নেমে ও তার গুহার দিকে রওয়ানা হল। কালকে দিনের বেলাই মারবে ঠিক করল চিতাটাকে। ওদের মধ্যে একজনকে যদি সত্যিই বাঘে নিয়ে থাকে, তাহলে কাড়ুয়ার পক্ষে চিতাটাকে মারা অনেক সহজ হবে। এই বস্তির লোকও বটেই, এই জঙ্গলের ডেরা-গাড়া ছেলেগুলোর জীবনের জন্যেও এ চিতাকে আর একদিনও বাঁচতে দেওয়া ঠিক নয়।

    গুহাতে পৌঁছে কাড়ুয়ার গরম লাগতে লাগল। বাইরে শোওয়ার সাহস করল না ও। গুহার মুখে কতগুলো কাঁটা-ঝোপ টাঙ্গি দিয়ে কেটে ফেলে রেখে নিজে ঢুকে গিয়ে সেগুলোকে টাঙ্গি দিয়ে টেনে এনে মুখটা বন্ধ করল। দরজার মতো হল একটা। দু’হাত মাথার নীচে জড়ো করে, চিৎ হয়ে ও যখন শুয়েছে, ঠিক তখনই পর পর দুটি গুলির আওয়াজ কানে এলো। কিন্তু এখন কিছুই করার নেই। ছেলেগুলোর কী হল না হল, তাও এখন কিছুই জানার নেই। চিতাটারও যে কী হল তাও নয়। কিন্তু এইগুলির শব্দ ছেলেগুলোর বিপদ ডেকে আনবে। কারণ বস্তির লোক, ফরেস্ট গার্ড এরা সকলেই এই শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে। ছেলেগুলোর বিপদের চেয়ে বেশি বিপদ কাড়ুয়ার নিজের। তবে স্বস্তির কথা একটাই যে, কাড়ুয়ার কাছেও যে ওইরকমেরই বন্দুক রয়েছে সে-কথা কেউই জানে না। কাড়ুয়া যদি এখন বস্তির কোনো লোককে বা কোনো ফরেস্ট গার্ডকে গুলি করে মেরেও ফেলে, তাহলেও কেউ বুঝতে পারবে না যে, কাড়ুয়াই মেরেছে। কারণ, কাড়ুয়ার বন্দুক তো গাদা বন্দুক। প্রত্যেকে তাইই জানে। তাতে অনেক বারুদ গাদাগাদি করে, সামনে লোহার গুলি দিয়ে, তারপর মারতে হয়। গাদা বন্দুকের আওয়াজ, চোট; সবই আলাদা। জানোয়ারের আকৃতি ও হিংস্রতা অনুসারে বারুদ গাদাগাদির প্রকারভেদ হয়। আঙুলের হিসেবে দো-আলি, তিন-আঙুলি এই রকম। এ-কথাও এ-বস্তির সকলেই জানে।

    কী ব্যাপার ঘটল কে জানে? এই রাতে এখন কিছুই করার নেই। কাড়ুয়া কিছুক্ষণ এ-কথা-সে-কথা ভাবার পর ঘুমিয়ে পড়ল। শেষ রাতে একটুক্ষণের জন্যে ঘুম ভেঙে গেছিল। একটা বিরাট বেঁকা দাঁতের দাঁতাল শুয়োর ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে-করতে বালি ছিটোতে-ছিটোতে ভেজা নদীর বুক ধরে এগিয়ে আসছিল। কাড়ুয়ার বড় লোভ হয়েছিল যে, উঠে, গুহা থেকে বেরিয়ে গিয়ে, সাবড়ে দেয় শুয়োরটাকে, তারপরই সংযত করেছিল নিজেকে। যদিও বুনো শুয়োরের মাংস সে ময়ূরের মাংসের চেয়েও ভালোবাসে খেতে।

    ভোর হবার একটু আগে এক-জোড়া শজারু কোনো কারণে খুব ভয় পেয়ে কাঁটা ঝম্-ঝম্ করে দৌড়ে গেছিল নদীর বুক বেয়ে।

    সূর্য উঠতেই কাঁটা-ঝোপ সরিয়ে, টাঙ্গি দিয়ে টেনে, দূরে একটা গর্তর মধ্যে ফেলে দিলো ও। তাড়াতাড়ি খিচুড়ি বসাল। প্রাতঃকৃত্য সেরে এসেই। কারণ, ফরেস্ট গার্ডরা আজ এদিকে আসবে সদলবলে। কাল গুলির শব্দ শুনেছে তারা। প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা, ওদের দাড়িওয়ালা সহকর্মীকে খেয়েছে এই শোনচিতোয়াটাই তাই এর সম্বন্ধে তাদের এক বিশেষ উৎসাহ আছে। এদেশে আইন যারা বানায়, আর আইন যারা মানায়, তারা আইন ভাঙলে দোষ হয় না কোনোই। ওদের বাপের জমিদারির বাঘ ওরা একশবার মারতেই পারে।

    তাড়াতাড়ি চান-খাওয়া-দাওয়া সেরে কাড়ুয়া বন্দুকটা নিয়ে বনের গভীরে চার-চারটি বনপথের সংযোগস্থলের একটা ঝাঁকড়া বড় পিপুল গাছের উঁচু ডালে লুকিয়ে রইল। সকালে যতক্ষণ না ফরেস্ট গার্ডরা ফিরে যাচ্ছে এখান থেকে ততক্ষণ নামতে পারবে না। বিশ্বাস কী? রেঞ্জার সাহেবদের আসাও অসম্ভব নয়। কোর্-এরিয়ার মধ্যে গুলি চলেছে গভীর রাতে। দু’বার। গাদা বন্দুক নয়, খাস্ বিলিতি বন্দুকের গুলি।

    পুলিশে সাহেবরাও আসতে পারেন। অতএব, খুব সাবধান থাকতে হবে। গাছে বসে-বসেই কাড়ুয়া দেখল যে, বেলা এগারোটা নাগাদ দুটি জিপ এলো গুড়গুড়িয়ে একটি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের। অন্যটি পুলিশের। বড় বড় চোখে কাড়ুয়া দেখল যে, একটাতে ডি-এফ-ও সাহেব এবং তাঁর সঙ্গে রেঞ্জার সাহেব। আর অন্যটিতে পুলিশ সাহেবের পোশাক পরা হীরু আর তার সঙ্গে আরও একজন পুলিশ সাহেব। তার চেহারা ভারি খুবসুরৎ। মনে হল, বড়া খানদান-এর ছেলে, হীরুর মতো সাধারণ ঘরের ছেলে নয়। এক নজরেই বোঝা যায়।

    জিপ দুটো ধুলো উড়িয়ে মারুমারের দিকে চলে গেল। মারুমার যাবে, না মহুয়াড়াঁর যাবে; তা ওরাই জানে। বড় রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে সময় বাঁচাচ্ছে ওরা।

    জিপের আওয়াজ যখন আর শোনা গেল না এবং পথের ধুলোর মেঘ যখন গাছ-গাছালির কাঁধ ছেড়ে মাটিতে নেমে এল, তখন কাড়ুয়াও মাটিতে নামল গাছ থেকে! আপাতত পুলিশ আর বনবিভাগের ভয় নেই। মাটিতে নেমেই দ্রুত, নিঃশব্দ পায়ে কাল যেখানে গুলির শব্দ শুনেছিল; সেই দিকেই এগিয়ে গেল। চিতল হরিণদেরই মতো, কাড়ুয়া যখন জঙ্গলে জোরে যায়, মনে হয়, ও-ও উড়ে যাচ্ছে। ওর পায়ের পাতা পড়ে না তখন মাটিতে।

    মিনিট দশেকের মধ্যে কাল রাতের জায়গাটাতে পৌঁছেই কাড়ুয়া যা দেখল, তাতে তার মন বড়ই খারাপ হয়ে গেল। এইখানে নিশ্চয়ই শোন্‌চিতোয়াটা যে চারনম্বর ছেলেটি—কালকের গাছের তলায় গিয়ে পৌঁছতে পারেনি; তাকে ধরেছিল। ধরে টেনে নিয়ে কতগুলো বড়ো ছোটো কালো পাথরের টিলার আড়ালে গিয়ে খাচ্ছিল। পায়ের দাগ দেখে বুঝল যে, ওর বন্ধুরা টর্চ আর বন্দুক হাতে নিয়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছয়। চিতাটা তাদের আক্রমণ করতে যাওয়ার সময়ই তারা গুলি করে পরপর দুবার।

    কাড়ুয়া আরও এগিয়ে গেল চিতার পায়ের দাগ ও টেনে নিয়ে যাওয়ার ঘষ্টানির দাগ দেখে। দেখল, শোনচিতোয়াটা গুলির শব্দে বিরক্ত হয়ে পরে আবার ফিরে এসে ছেলেটির দেহাবশেষ নিয়ে সরে গেছে জঙ্গলের অনেক গভীরে। খুব সম্ভব একটি গুলিও লাগেনি চিতাটার গায়ে। মানুষ মারা খরগোশ মারার চেয়েও সোজা। কিন্তু বাঘ মারা খরগোশ মারার চেয়ে অনেকই কঠিন।

    এইবার কাড়ুয়ার সত্যিই সাবধান হবার সময় হয়েছে। চিতাটার জন্যে সাবধান। ফরেস্টের লোক, পুলিশের লোক, সকলের জন্যেই সাবধান। এখানে তাকে কেউ আবিষ্কার করলে তাকে শুধু কোর্-এরিয়ার মধ্যে চিতাবাঘ মারা নয়, মানুষ খুন করার অভিযোগেও অভিযুক্ত হতে হবে। কাড়ুয়ার ওপর ওদের অনেক দিনের রাগ। পেলে একেবারেই ঝুলিয়ে দেবে। খুশি হবে মাহাতো। খুশি হবে গোদা শেঠ। আর মারা পড়বে হীরু, তার বন্দুক কাড়ুয়ার হাতে পাওয়া গেলে।

    ছেলেগুলোর কী হল? ভাবছিল কাড়ুয়া। যাকগে! এখন চিতাটা ছাড়া অন্য কিছু সম্বন্ধেই ভাববার সময় নেই কাড়ুয়ার।

    চিতাটা খুব বুড়ো সেগুনের পুরোনো একটা গভীর প্ল্যানটেশানে নিয়ে গেছে ছেলেটাকে টেনে, হেঁচড়ে, হেঁচড়ে, কিছুটা মুখে করে। বেড়ালনি যেমন ছানাকে নেয়। মোটা মোটা সেগুন। প্রকাণ্ড তাদের গুড়ি। নীচে নীচে পুটুস, রাহেলাওলা, লিট্‌পিটিয়া এবং নানারকম ঝাঁটি জঙ্গল। এত গভীর বন যে দিনেও ভালো দেখা যায় না। হাতির কানের পাতার মতো বড় বড় সেগুন পাতা জায়গাটাকে সম্পূর্ণ ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছে। ভর দুপুরের বৈশাখের বনের গা থেকে সুন্দর পবিত্র শুকনো ঝাঁঝালো গন্ধ বেরুচ্ছে একরকম। রুখু হাওয়ায়, শিকাকাই-ঘষা পাতার মাথার চুলের গন্ধ। প্রজাপতি উড়ছে চারধারে।

    না।

    বুলকি-পরেশনাথকে ভয়-পাওয়ানো লাল-তিল নয়। এমনি তিতলি। সাদা-কালো, বেশিই হলুদ, খয়েরি। কতরকম যে প্রজাপতি। দূরের বনে বসে কাঠঠোকরা কাঠ ঠুকে চলেছে ক্রমাগত। যেন ঠিকাদারের ক্যুপ্-কাটা হপ্তা-পাওয়া কুলি। তিতির ডাকছে মন উদাস করে তিত্র—তিতৃর তির্—তিত্বর্র্র্। ভারি ভালো লাগছে কাড়ুয়ার। কতদিন বাঘ কী চিতা মারেনি। হীরু আর নানকু তার পিছনে আছে। আর আছে এই সুন্দর বন্দুকটি। বন্দুকটাকে বড় ভালোবেসে ফেলেছে ও।

    এরকম একটা বন্দুক ছাড়া আর ও চেয়েছিল একটাই জিনিস। মাথা উঁচু করে বাঁচতে। এই লুকিয়ে-বেড়ানো চোরা গোপ্তা খুন করা শোনচিতোয়াটার মতো নয়। বড় বাঘের মতো। যারা পালাতে শেখে নি কখনও,। ভয় কাকে বলে, সে কথা যাদের রক্ত জানে না। যারা সত্যিই স্বাধীন। চিরদিনের স্বাধীন। যাদের স্বাধীনতা ইজারা নিতে লাইন দিয়ে ভোট দিতে হয় না প্রতি পাঁচ-বছর অন্তর। যাদের একবেলা পেট ভরে খাওয়ার জন্যে হাত পাততে হয় না কারো কাছে। ঘাড়-নীচু করে, মাথা-ঝুঁকিয়ে যাদের কখনও একদিনের জন্যও বেঁচে থাকতে হয় না কান্দা-গেঁঠি খুঁড়ে খেয়ে। তেমন স্বাধীন হয়ে বাঁচতে।

    কাড়ুয়া ছোটবেলা থেকেই বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে মনে মনে নিজেও একটা বাঘই হয়ে গেছে। হ্যাঁ বড় বাঘ! তাই-ই তো এই বন্দিদশা, মিথ্যিমিথ্যি আইনকানুন ওর আদৌ ভালো লাগে না। লেখাপড়া শেখেনি। শেখেনি বলেই কি ও জঙ্গল-পাহাড়কে জানে না? না বোঝে না! যে দেশের মানুষকে বাঘ মারতে দেওয়া না-হয় পায়ে হেঁটে, একা একা সে দেশের মানুষের সাহস জন্মাবে কী করে? কাড়ুয়া ভাবে। কাড়ুয়াকে, এক সাহেব শিকারি অনেক বছর আগে বলেছিলেন যে, আফ্রিকা বলে একটা দেশ আছে, সেখানে মাসাই বলে একরকমের লম্বা-লম্বা মিশকালো মানুষ আছে তারা নাকি একা হাতে বল্লম দিয়ে পায়ে হেঁটে সিংহ শিকার করে। এবং যে-ছেলে একা-হাতে সিংহ শিকার করতে পারে না, তাকে নাকি কোনো মেয়ে বিয়েই করে না।

    তবে?

    বাঘ মারাটা কি কেবলই বাঘ মারা? মানুষ কি নিজেকে নিজের সাহস ও আত্মবিশ্বাসকে বার বার নতুন করে, নিশ্চিন্ত করে আবিষ্কার করে না মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার এই পুরুষালি খেলা খেলতে এসে? কাড়ুয়া তার জীবনে বন ও বন্যপ্রাণী সম্বন্ধে যা জেনেছে সেই জানা কারোই কাজে লাগল না। কারণ ও ইংরিজী শেখে নি হিন্দি ও লিখতে পর্যন্ত পারে না। ওর কাছে কেউ জানতেও আসে নি। ও-যে অশিক্ষিত; ছোটলোক। ওর সারা জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ওর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। যারা ইংরিজি জানে, তারা কিছু না-জেনেই পণ্ডিত হতে পারে; আর কাড়ুয়া অনেক জেনেও মূর্খই রয়ে গেল।

    কাড়ুয়া থমকে দাঁড়াল। হঠাৎই মৃত্যুর গন্ধ পেল ও। হঠাৎ!

    যেদিন ওর বন্ধু চিকেরিকে বড় বাঘে ধরেছিল এক জেঠু-শিকারের দিনে ছুলোয়ার লাইনের মধ্যে থেকে—সেদিনও এরকম একটা গন্ধ নাকে পেয়েছিল কাড়ুয়া। বন্দুকটা স্টেডি-পজিশানে ধরে ও মাথাটাকে ডাইনে-বাঁয়ে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিল নিঃশব্দে। ওর কদমছাঁট চুলের শেষে এক বিঘৎ টিকিটা একটা কালো উপোসি টিকটিকির মতো দুলতে লাগল কিছুক্ষণ। হাওয়া উঠল জোর, তার পিছন দিক থেকে। যেদিকে সে তাকিয়ে আছে, সেদিকে এক দৌড়ে পৌঁছে গিয়েই হঠাৎ থেমে গেল হাওয়াটা। যেন ধাক্কা খেল অদৃশ্য কোনো বাধায়। হাওয়াটা কাচের বাসরেরই মতো ভেঙে ঝুঝুর্ করে গুঁড়ো হয়ে বনের পায়ের কাছে ছড়িয়ে গেল। হাওয়া-তাড়ানো একরাশ শুকনো পাতাও পেছন থেকে উড়ে এসে সেগুন বনের পায়ের কাছের ঝাঁটিজঙ্গলে আটকে রইল।

    কাড়ুয়া আস্তে আস্তে সেগুন বনের অন্ধকারে ঢুকে যেতে লাগল। সেগুনের নীচের পুটুস ঝাড়ের তীব্র কটু গন্ধ নাকে যেতেই কাড়ুয়ার হঠাৎ মনে হল, ও যেন ওর মৃত মায়ের গভীর অন্ধকারে তীব্র-গন্ধী-গর্ভেই পুনঃপ্রবেশ করছে। এমন কোনোদিনও মনে হয়নি আগে। এক আশ্চর্য অনুভূতি হল ওর! ঢুকে যেতে লাগল কাড়ুয়া। শোনচিতোয়াটার পায়ের দাগ দেখে, জঙ্গলের ভিতরের গভীরতর নিবিড় সেগুন-গন্ধী সবুজ অন্ধকারে। যেটুকু আলো আসছে, তাও আটকে যাচ্ছে সেগুনের বড় বড় গোলপাতাতে। আলো-ছায়ার গোল-গোল গয়না-বড়ির মতো বুটি-কাটা গালচে তৈরি হয়েছে জঙ্গলের নীচের সমস্তটা জুড়ে।

    হঠাৎ কাড়ুয়ার চোখে পড়ল একটা অনাবৃত, কর্তিত নিটোল পা। শুয়ে-থাকা পুরুষের একটা পা বেরিয়ে আছে ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে দিয়ে। মনে হল, পা-টা যেন একটু নড়ে উঠল।

    বাঁ পা।

    কাড়ুয়া জায়গাটাকে ঘুরে দণ্ডি কেটে যাবে ঠিক করল। ও দুদিকে চেয়ে দেখল, ডানদিকে একটা প্রকাণ্ড চারকোণা পাথর। প্রায় একমানুষ উঁচু পাথরটা একেবারে সমান আর মসৃণ। পাথরটার চারপাশে পুটুসের ঝাড়। কী করবে এক মুহূর্ত ভাবল ও। এখানে চড়ার মতো কোনোই গাছ নেই। এত বড় সেগুনে চড়া যাবে না। গুঁড়ির বেড়ই পাওয়া যায় না। চড়তে গেলেও যা শব্দ হবে, তাতে শোনচিতোয়াটা সাবধান হয়ে পালিয়ে যাবে।

    এবার হঠাৎই পচা গন্ধ এল নাকে। হাওয়াটা পাক খেয়েছে। দিক বদলেছে। ক্রমান্বয়ে ঝুনঝুনি বাজানোর মতো আওয়াজ করে নীলনীল বড় বড় পোকাগুলো মরা ছেলেটির রক্তাক্ত পচা শরীরের ওপর উড়ছিল আর বসছিল। তার মানে এই যে, শোনচিতোয়াটা মড়ির কাছে নেই। সরে গেছে। অথবা, হয়তো দূরে কোনো নদীর বালিতে কিংবা ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় গিয়ে বিশ্রাম করলে।

    কাড়ুয়া আবারও মৃত্যুর গন্ধ পেলো।

    নাঃ, ওর মন বলছে যে, শোনচিতোয়াটা ধারে কাছেই আছে। নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। ওকে দেখছে। যা-ই করুক। এ গন্ধ শোনচিতোয়ারই মৃত্যুর গন্ধ। শোনচিতোয়ার সব হরকৎ আজ শেষ হবে। সততা জিতবে ধূর্তামির ওপর। হার হবে অন্যায়ের, ন্যায়ের কাছে। চরম হার

    স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে মুণ্ডু ঘুরিয়ে সামনে পেছনে কাড়ুয়া এবার বাঁ থেকে ডান, ডান থেকে বাঁ তিনশ ষাট ডিগ্রি কোণে দেখতে লাগল সবকিছু। তার চোখে একটি ঘাসের নড়াচড়াও অদেখা থাকবে না।

    স্তব্ধ হয়ে ফসিল হয়ে গেল মুহূর্তটি।

    কাড়ুয়ার মনে হল, সৃষ্টির আদি থেকে চলতে চলতে বড় ঘর্মাক্ত ক্লান্ত হয়ে, সময় হঠাৎই থেমে গেল। কাড়ুয়ার আগে-পেছনে কিছুই নেই আর। একমাত্র বর্তমান আছে। এই ক্ষণটি। কাড়ুয়া। আর শোনচিতোয়াটা।

    বন্দুকটা একেবারে তৈরিই আছে। সেটি-ক্যাটাও ঠেলে সরানো আছে। সব তৈরি। কেবল হারামির বাচ্চা একবার চেহারা দেখাক। একবার শুধু। এক মুহূর্তর জন্যে।

    কিন্তু কাড়ুয়ার গা ছম্ছম্ করে উঠলো। কোনো নাম-না-জানা প্রেত, দার্হা নয়, কীচিং নয়; যে-ভূতের নাম সে কখনও শোনেনি এমন কোনো এক অদৃষ্টপূর্ব ভূত তার কটা-হলুদ একজোড়া চোখে যেন তাকে দেখছে আড়াল থেকে। অপলকে। অথচ সে তাকে দেখতে পাচ্ছে না। কটা-হলুদ কুটিল একজোড়া চোখ। কাড়ুয়া তার নিজের চোখের তারায়, মেরুদণ্ডে, ঘাড়ে, সব জায়গায় মরা ব্যাঙের শরীরের মতো ঠান্ডা সেই দৃষ্টিকে অনুভব করতে পারছিল। কিন্তু সেই দৃষ্টির উৎসকে দেখতে পাচ্ছিল না।

    নাঃ। চারধারে গভীর মৃত্যুর গন্ধ। ছেলেটির মৃতদেহের উপর নীল পোকাগুলো ঝিন্ ঝিন্ করে উড়ছে আর বসছে। শুধুই সেই শব্দ। আর কোনো শব্দ নেই। হাওয়াটা উল্টোলেই নাকে উৎকট গন্ধ আসছে, পচা, ছিন্নভিন্ন মৃতদেহটা থেকে

    খুব সাবধানে কাড়ুয়া বন্দুকটা এইভবেই ধরে পুরো শরীরটাকে ঘুরিয়ে নিল একবার। এক চুলও নড়েনি ও হাওয়াটা ঘোরার পর থেকে। পিছনটা আর একবার ভালো করে দেখল। নাঃ! সে-করে হোক একটু উপরে ওঠা দরকার। নইলে সেগুনবনের নীচের ঘন ঝাঁটি-জঙ্গলে কিছুই দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। কাড়ুয়া ডানদিকের সেই কালো চারকোণা পাথরটার দিকে আস্তে আস্তে সরে এল—এক-চুল এক-চুল করে। তারপর একসময় পাথরটার উপরে সোজা উঠে দাঁড়াল।

    ঈস্। কী সুন্দর ছেলেটা! ওর মুখটা দেখে যেন মনে হয়, ঘুমিয়ে আছে। মাছি উড়ছে, মাছি বসছে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ, আধখানা শরীর। কিন্তু তার চোখ দুটোতে এক দারুণ চিৎকৃত প্রতিবাদ স্তব্ধ, হিম হয়ে আছে। সে জানে না যে, তার বন্ধুরা তাকে খুঁজে পেলে তার মাথাটা কেটে নিয়ে যেত, পাছে, পুলিশ শনাক্ত করে ফেলে। কিন্তু সে নিজে সব শনাক্তকরণের বাইরে এখন। কোন ঠিকানা থেকে সে এসেছিল আর কোন ঠিকানাতে যাবে, সবই তার কাছে অবান্তর।

    পাতা ঝরে পড়ছে উপর থেকে। সুন্দর মুখটার একপাশে সোনার মোহরের মতো গোল এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে। কাড়ুয়া দশ বছর বয়স থেকে নিজে হাতে হাজার হাজার জানোয়ার ধড়কেছে। জানোয়ারেরা জিভ বের করে, মুখ-ব্যাদান করে মরে। করুণা ভিক্ষা করে, মরার সময়। একমাত্র মানুষই এমন নীরব চিৎকারে সমস্ত প্রতিবাদ উৎসারিত করে মরতে পারে। ওর নিজস্ব, সাদামাটা; নিরুক্ত ভাষায় এই কথাটাই সেই মুহূর্তে ভাবছিল কাড়ুয়া।

    কাড়ুয়া ছেলেটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ভাবছিল শোনচিতোয়াটা ধারে-কাছে না থাকলে ওর মাথা সে নিজেই কেটে নিয়ে গিয়ে কোথাও পুঁতে দেবে। আহাঃ কোন মায়ের বাছা! কতদূরে না জানি? পাটনা, না কলকাতা, কে জানে? কোন গভীর সর্বনাশা বিশ্বাসে ভর করে এসেছিলিরে বাছা তোরা? তোরা কি এই জবরদস্তিতে এঁটেবসা মাহাতো আর গোদা শেঠদের কিছু করতে পারবি? বোকা রে! তোরা বড় বোকা! কেন মিছিমিছি মরতে এলি এমন করে? তাও যদি মেরে মরতিস্। লড়ে মরার সুযোগ পেতিস্। তোদের ঝগড়া যাদের সঙ্গে, তারা যে সব শোনচিতোয়াদেরই মতো। বাইরে এসে দাঁড়ানোর সাহস নেই তাদের। তারা আড়াল থেকে খুন করে। তারা বড়ো ছোটো রে, বড়ো ছোটোলোক তারা! তোরা, আহা! বাছারা আমার; তোরা কি জানতিস না?

    হঠাৎই কাড়ুয়ার ভাবনা স্তব্ধ হয়ে গেল।

    চিতাটা নিশ্চয়ই ঐ কালো পাথরটার নীচেরই ঝাঁটি-জঙ্গলে লুকিয়ে শুয়ে ছিল, কাড়ুয়াকে আসতে দেখেই অথবা তার গন্ধ পেয়েই পিছন থেকে, কোনানকুনি; দম্-দেওয়া অতিকায় স্প্রিং-এর পুতুলের মতো নিঃশব্দে লাফিয়ে উঠেই কাড়ুয়ার গলা আর ডান কাঁধের মধ্যে কামড়ে ধরে কাড়ুয়াকে নিয়ে এক ঝটকাতে আছড়ে পড়ল পাথরের উপর। টুটি কামড়ে ধরাতে, কাড়ুয়ার হাত থেকে বন্দুকটা ছিট্‌কে গিয়ে পড়ল ছেলেটির লাশের কাছে। সেটি-ক্যাচ্ অন্ থাকাতে আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুটি ব্যারেলই একসঙ্গে ফায়ার হয়ে গেল। অতর্কিত শব্দে শোন্‌চিতোয়াটা ভয় পেয়ে গিয়ে কাড়ুয়াকে ফেলে রেখে এক লাফে সরে গেল একটু। কিন্তু পরক্ষণেই মাটিতে পড়ে-যাওয়া নিরস্ত্র, আহত কাড়ুয়ার কাছে এল। ফিরে এসে, মাহাতোর মতো, গোদা শেঠেরই মতো দাঁতে-দাঁতে কড়মড়ানি তুলে, এ ব্যাটার বড্ড বাড় বেড়েছিল বলে, আবারও ওর ঘাড় কামড়ে পড়ে রইল অনেকক্ষণ। রক্ত চুষে চুষে শরীরটাকে, একেবারে নিস্পন্দ করে ফেলার পর একটা জোর ঝাঁকানি দিয়েই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছেড়ে দিল।

    কাড়ুয়া তারপরও কিছুক্ষণ থর্ থর্ করে কাঁপল। মানুষ মরেও মরতে চায় না। মরার পরও পুরোনো অভ্যেসবশে কিছুক্ষণ বেঁচে থাকে। ওর মুখ-নাক দিয়ে ঝলক্ ঝলক্ রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগল। তারপর বাঁ হাতটা লম্বা করে পাথরের উপর ছড়িয়ে দিয়ে ডান হাতটা পেটের কাছে চেপে ধরল। যেন বড় নিশ্চিন্তে ঘুমোবে এবার।

    থেমে থাকা সময় আবার হঠাৎ চলতে শুরু করল।

    আস্তে আস্তে কাড়ুয়ার মুখে এক গভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে গেল। উত্তেজিত, কুঞ্চিত, সারা শরীরের মাংসপেশী শিথিল হয়ে এল। কাড়ুয়া কোনোদিনও ভালুমারের অন্য দশজনের মতো প্রতিদিন একটু একটু করে মান, সম্মান, বিবেক, সবই খুইয়ে ছোট্ট এক শিশি মিটিয়া তেলের জন্যে, দুটো বাজরার রুটি বা একমুঠো শুখা-মহুয়া বা মাটিখোঁড়া কান্দা-গেঁঠির জন্যে কারো দয়া ভিক্ষা করে বেঁচে থাকতে চায়নি। বাঁচে নি। তার কাছে এই জীবনের মানে একেবারেই অন্য ছিল! তার মওত্‌ও এলো তার জিন্দগির মতোই।

    মৃত্যুর ক্ষণে কোনো দরিদ্র ভাবনাই কাড়ুয়াকে ক্লিষ্ট করেনি।

    সেদিনই সন্ধের সময় কাড়ুয়ার বন্দুকের গুলির শব্দ শোনার পরই পুলিশ আর ফরেস্ট-ডিপার্টমেন্টের লোকদের মিলিত চেষ্টাতে একটি বড়ো দল লাশ দুটি উদ্ধার করেছিল। চিতাটি সরে গেছিল গোলমাল শুনে আগেই। যখন কাড়ুয়ার লাশকে বস্তিতে এনে হ্যাজাক জ্বেলে শুইয়ে রাখা হয়েছিল বন-বাংলার হাতার কাঁকরের উপর তখন বস্তির ছোটোবড়ো সকলেই একটা কথাই বলেছিল কাড়ুয়া সম্বন্ধে।

    ওরা বলেছিল, টাইগার প্রোজেক্টের কোর্-এরিয়ার একেবারে বুকের মধ্যে একটা এত বড়ো বাঘ এমন ভাবে যে মারা যাবে, একথা ওদের কল্পনারও বাইরে ছিল। তাও, একটা সামান্য শোনচিতোয়ার হাতে!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঋজুদা সমগ্ৰ ৫ – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article লবঙ্গীর জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }