Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কোজাগর – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প561 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কোজাগর – ৩৫

    ৩৫

    গরমটা এবার বেশ ভালোই পড়েছে। দুপুরে ঘণ্টাদুয়েক বড়োই কষ্ট হয়। পোস্তর তরকারি আর বিউলির ডাল, এইই এখন স্ট্যান্ডার্ড দ্বিপ্রাহরিক খাবার। বিকেলে রোদ পড়লে, আমপোড়া সরবৎ অথবা বাড়িতে-পাতা টক-দইয়ের ঘোল বানিয়ে তাতে আদা, কাঁচা লংকা ও কারিপাতা কুচো করে ফেলে দিয়ে একটু নুন দিয়ে খাওয়া। কারিপাতার কোনো অভাব নেই। উঠোনের মধ্যেই তিতলি একটা কারিপাতার গাছ লাগিয়েছিল। মুঠো মুঠো পাতা ছিঁড়ে নিলেই হল।

    সন্ধের পর অবশ্য বেশ প্লেজেন্ট। তবে সন্ধে উপভোগ করার জো নেই আর শোনচিতোয়াটার জন্যে।

    কাড়ুয়া মরে গেছে। হারিয়ে গেছে টুসি। কেউ বলেছে, ওকে শোনচিতোয়াতে খেয়েছে! কেউ বলেছে, ও আত্মহত্যা করেছে। কেউ বলেছে ঝারিতালাও-এর পাশে হীরুর বন্ধু পুলিশ সাহেব তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার ওপর অত্যাচার করার পর তাকে খুন করে তার লাশ গুম করে দিয়েছে। কিন্তু সেই পুলিশ সাহেবকে এবং বাংলোর চৌকিদারকেও কে বা কারা খুন করেছে গুলি করে ঐখানেই। সকলেই সেই নবাগন্তুক. ছেলেগুলোকেই সন্দেহ করেছে। টুসির লাশটা কোথাও পাওয়া যায়নি। তাই মেয়েটা যে মরেইছে এমন কথাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। মেয়েটা কোথায় যে নিখোঁজ হয়ে গেল। অনেকে মনে করছে টুসির নিখোঁজ হওয়ার পিছনে গোদা শেঠ এবং মাহাতোর হাত আছে। তবে টুসি, পুলিশ সাহেব হীরু সিং-এর বোন। তার মৃত্যুর কিনারা হবেই, আজ আর কাল। ও তো আর সাধারণ মানুষ নয়। ছোট্ট জায়গা। একসঙ্গে এতগুলো সাংঘাতিক ঘটনা ঘটাতে খুবই শোরগোল পড়ে গেছে। সকলের মুখে একই কথা।

    হীরু পরদিন চলে গেছিল ভালুমার ছেড়ে দলবল সমেত। তারপর ডি, আই, জি, সাহেবের নেতৃত্বে খুব বড়ো পুলিশ ফোর্স এসে বাংলো এবং তার চারপাশে তাঁবু ফেলে থেকে, প্রায় সাতদিন ধরে পুরো এলাকাতে তল্লাসি চালিয়েছিলো, কিন্তু সবই নিষ্ফল। তাও প্রায় দিন পনেরো হয়ে গেল।

    নানকুর বিরুদ্ধে ওরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে এসেছিল, কিন্তু নানকুকে ধরা যায়নি। নানকু কোথায়, তাও কেউ জানে, না, টুসি থাকতে মাঝে মাঝে সে এসে উদয় হত। গত পনেরো দিন থেকে কেউ তাকে এ তল্লাটে দেখেনি। নানকু আজকাল কখনও বড়ো রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে না। সব সময় বনে-বনে পাহাড়-ডিঙিয়ে নদী পেরিয়ে যায় আসে। তার যাওয়া-আসার খবর ভালুমার এবং অন্যান্য বস্তির লোকদের কাছেও অজানা থাকে। কে জানে? শোন্‌চিতোয়ার শিকার হয়েছে কি না। মাহাতো আর গোদা শেঠ শোনচিতোয়াটার সঙ্গে দোস্তির হাত মিলিয়ে আবার ও তল্লাটে মালিক হয়ে গেছে। কালকে একটা সাংঘাতিক খবর এসেছে এই গ্রামে ডালটনগঞ্জ থেকে, পাটনা হয়ে, একজন বিড়িপাতার ঠিকাদারের মাধ্যমে। হীরুকে নাকি গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিপ্লবী ছেলেটির লাশের কাছে যে বন্দুক পাওয়া গেছিল সেটি যে তারই বন্দুক, এ কথা নাকি প্রমাণ হয়েছে। পুলিশের ওপর মহল সন্দেহ করছেন যে, পুলিশ সাহেব ও চৌকিদারের খুনের সঙ্গেও হীরুর যোগ আছে, যেহেতু বিপ্লবীদের সঙ্গে ও আছে বলে ওদের সন্দেহ। হীরুকে জামিনও দেওয়া হয়নি।

    আমার, মানে এই বাঁশবাবুর জীবনেও অনেক খবরের উন্মেষ ঘটেছে। প্রথম খবর, আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। এই মাস, শেষ মাস। দ্বিতীয় খবর, তিতলিকে বিয়ে করার কথা আমি খুব সিরিয়াসলি ভাবছি। এই ভালুমার গ্রামেই বাকি জীবন পাকাপাকি ভাবে থাকার বন্দোবস্ত করছি। মালিকের যে ডেরাতে আমি এখন আছি তা এবং তার সংলগ্ন সামান্য জমি ন্যায্য মূল্যের বিনিময়ে মালিকের কাছ থেকেই কিনে নেব। হাজারখানেক টাকা হয়তো হবে দাম। এতদিন ধরে ব্যাঙ্কে যা সামান্য জমেছে তা-ই মূলধন করে কিছু একটা শুরু করব ভাবছি। নইলে, জমি কিনে চাষবাস করে এদেরই একজন হয়ে থেকে যাবো। ঠিক, কী যে করব, তা কিছুই পাকাপাকি স্থির করিনি। ভাবা-ভাবিই চলছে এখনও।

    টেটরার মৃত্যু ও ম্যালিগ্নান্ট ম্যালেরিয়া এই দুই হঠাৎ-অভিশাপে তিতলি অনেকই বদলে গেছিল। প্রথম প্রথম বোবার মতো থাকত। কাজেকর্মে অবশ্য কোনো গাফিলতি ছিলো না।

    যদি সত্যিই বিয়ে করি ওকে, তবে ওর মাকেও এখানে নিয়ে আসব। ওদের বাড়ি ও জমি বেচে দিয়ে যা টাকা পাওয়া যাবে তা পোস্টাপিসে রেখে দেব তিতলির মায়ের নামে। সুদ নামমাত্রই পাবে। তবে, আমি যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন সেও তিতলির সঙ্গেই থাকবে। তিতলিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ততে পৌঁছবার আগেই আর প্রস্তাবনামাত্রই আমাকে আমার সমস্ত পারিপার্শ্বিক, আমাদের তথাকথিত ভদ্র শিক্ষিত সমাজ এবং আমাদের ভদ্রলোকী মুখোশের চটে-যাওয়া রঙ আমাকে এমনই গভীর ও মর্মান্তিক-ভাবে সচেতন করেছে যে, আমি নিজেই তাতে অবিশ্বাস্য রকম চমকে গেছি। এখন পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটার অভাবনীয়তা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। ঘটনা পরম্পরার অবিসংবাদিতা আমাকে একেবারেই বোবা করে দিয়েছে।

    কাল ছোটমামা-মামির একখানা চিঠি পেয়েছি। সে চিঠির ভাষার পুনরাবৃত্তি না করেই বলছি যে মামা-মামি আমার মতো কুলাঙ্গার, ব্রাহ্মণ পরিবারের মুখে কালি-দেওয়া এই মানুষটিকে নিয়ে যে আর কোনোদিনও মাথা ঘামাবেন না, এ-কথা প্রাঞ্জল ভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন। আমার সহকর্মীরা গজেনবাবু, নিতাইবাবু, নান্টুবাবু সকলেই আমার এই সিদ্ধান্তে রীতিমতো শকড়। আমার বাহ্যত শক্ত এবং নিষ্কলঙ্ক চরিত্রে যে এত বড়ো অধঃপতনের বীজ লুকোনো ছিল, এ কথা তাঁরা নাকি স্বপ্নে ও ভাবতে পারেননি। অথচ পতন যে চিরকাল অধঃলোকেই হয়, ঊর্ধ্বলোকে কেউ যে কখনও পড়েনি, আজ পর্যন্ত এ-কথা তাঁরা যে মেনে নিতে পারছেন না আমার বেলাতে, তা জানি না। জিন্-এর সঙ্গে যে আমার বিয়ে হয়নি, এ নাকি জিন্-এর পরম সৌভাগ্য ও ভগবানের অশেষ আশীৰ্বাদ।

    এর চেয়েও অবাক হবার মতো আরো কিছু ঘটেছে! সে-ঘটনা যে আদৌ ঘটতে পারে, তা আমার ভাবনার অগম্য ছিল। তা হল, উদার, উচ্চশিক্ষিত, মহাপণ্ডিত, আমাদের প্রত্যেকের লোকাল গার্জিয়ান্ এবং আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ রথীদার প্রতিক্রিয়া। কথাটা যেদিন ও’কে প্রথম বলি, উনি পাথর হয়ে গেছিলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে, গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেছিলেন, সায়ন, সমাজসেবা করা এক আর নিজেকে তার মধ্যে এমন ভাবে ইনভল্ভ করে ফেলা আর এক জিনিস। ওঁর কথা শুনে আমি যত-না শকড্ হয়েছিলাম, উনি আমার সিদ্ধান্তের কথা শুনে তার চেয়ে অনেকই বেশি শক পেয়েছিলেন। উঠে চলে আসবার আগে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ভেবে দ্যাখ্ সায়ন। এমন সাংঘাতিক ভুল করার আগে ভাল করে ভেবে দ্যাখ। কুষ্ঠ রোগীদের জন্যে লেপারস্হোম্ করা বা তাদের জন্যে চাঁদা-তোলা এক ব্যাপার; আর নিজেই কুষ্ঠ-রোগী হয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ আর এক ব্যাপার। প্রথমটা গৌরবের। শিক্ষিত এনলাইটেন্‌ড লোকের গর্বময় কাজ। আর দ্বিতীয়টা, নিজেকে ঘৃণ্য করে তোলার ব্যাপার।

    মুখে কথা সরেনি। আমার সবচেয়ে বড়ো বল ভরসা ছিলেন রথীদাই। আমার চোখে উনি ছিলেন মেসায়াহ্। অসাধারণ মানুষ। সমস্ত সংকীর্ণতা, অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতার অনেক ওপরে। চিরদিন। এই গরিব-গুরুবো, হতভাগা আদিবাসী ও দেহাতি মানুষগুলোকে তিনি ভালোবাসতেন বলেই জানতাম। হীরুকে, নানকুকে মানুষ, করার পিছনে, এই বস্তির শুভাশুভর পিছনে, তাঁর অবদান কতখানি, তা এখানের সকলেই জানে। তিনি যে মহামান্য পোপের মতো এক দারুণ উঁচু আসনে বসে আছেন তা ওঁর নিজেরই মতো আমরা সকলেই শুধু জানতাম যে, তাই-ই নয়, জেনে ধন্যও হতাম। দুঃখ এইটুকু যে, তাঁর সমস্ত শিক্ষার গর্ব, পাণ্ডিত্যর ভ্রান্তিবিলাস, ঔদার্যর আত্মতুষ্টি যে জাতপাতের গোড়ার সংস্কারেই এখনও আটকে আছে এমন করে, একথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। অথচ তিনি সহজেই ভাগীরথী হতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সমস্ত মহানুভবতার গঙ্গা, ভগীরথের জটারই মতো তাঁর দৃঢ়বদ্ধ সংস্কারেই আটকে রইল। এ-জীবনে গঙ্গা নেমে নেমে এসে এই দুঃখী মানুষগুলোর জীবনে স্নিগ্ধতা এবং উর্বরতা আনতে পারলো না।

    এ ক’দিন হল যতই ভাবছি, এ-ব্যাপারটা নিয়ে, ততই আমার মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হচ্ছে যে, এই দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এবং আমাদের সংসিধানে যাই-ই বলুক না কেন, এ-দেশের সংখ্যালঘু উচ্চবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত, উচ্চজাত সমাজ বাকি সমস্ত দেশটাকে চিরদিন তাদেরই পদতলগত কারে রাখতে বদ্ধপরিকর। তারাই আবহমানকাল ধরে সমস্ত ভোগ করে এসে আজও সব ভোগ করতে চায়, সর্বেসর্বা থাকতে চায়; তারা তাদের উচ্চাসনে বসেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রতি করুণা এবং দয়াধর্ম দেখাতে চায়, বকশিস দিতে চায়, মাঝে মাঝে টাকার বাণ্ডিল ছুড়ে দিয়ে। আমার মালিক রোশনলালবাবুর মতোই প্রমাণ করতে চায় চিরদিন যে, তারাই বড়ো। অন্যরা তাদের দয়ারই ভিখারি, করুণার সংবেদনশীলতার ক্বচিৎ পাত্র বই আর কিছু নয়! কোনোক্রমেই তাঁদের সমকক্ষ নয়; কোনোদিনও হতে পারে না, তাঁদের সমাজের সঙ্গে এই বুভুক্ষু যুগ-যুগান্ত ধরে বঞ্চিত, চমৎকার সৎ, মানুষগুলোর সমাজের কখনও সত্যিকারের মিল ঘটুক; এ তাঁরা চান না।

    এইসব পণ্ডিত মানুষই আমেরিকার, ইংল্যান্ডের এবং সাউথ-আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। আর স্বদেশ, স্ব-বর্ণের, স্বজাতিদের আপন করে নিতে, আপনার বলে বুকে ঠাঁই দিতে তাঁদের ভ্রূ-কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। এখনও তাঁদের ড্রাইভার বেয়ারাকে তাঁদের সঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানে একাসনে বসতে দিলে তাঁদের মর্যাদা ক্লিষ্ট হয়। যে-দেশ, মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেয় না, সে দেশের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক, বৈদ্যুতিক, পারমাণবিক অগ্রগতি সম্পূর্ণই যে অর্থহীন, একথা তাঁদের একবারও মনে হয় না।

    রথীদার এই প্রতিক্রিয়া অনেক বছর আগে দেশ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় পড়া হিরণকুমার সান্যাল মশায়ের একটি লেখার কথা মনে করিয়ে দিল। কোলকাতায় এক ছুটিতে গিয়ে পড়ায় দৈবাৎ পত্রিকাটি হাতে এসেছিল। লেখাটি ছিল প্রিয় কবি, সুদর্শন, দেবদুর্লভ, জীবদ্দশায়ই অমরত্বর অধিকারী সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মশায় সম্বন্ধে। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে এক সারিতে তাঁর গাড়ির ড্রাইভারকে খেতে বসতে দেওয়ায় তিনি নাকি প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করে না খেয়েই উঠে গেছিলেন।

    ঐ ঘটনাটির কথা মনে পড়ার পর, ছোটবেলা থেকে সুধীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তিল তিল করে গড়ে তোলা আমার সব সম্মান রাতারাতি ধূলিসাৎ হয়ে গেছিল। কবি তিনি যেমনই হন না কেন, পৈতৃকধন তাঁর যতই থেকে থাকুক না কেন; সেদিন থেকে তাঁকে আমি অমানুষ বলেই মনে করে এসেছি। অনেকেই এরকম তাও আমি জানতাম। কিন্তু রথীদা! অফ্ অল পার্সনস্!

    যখনই একা থাকি আজকাল তখনই অনেক কথা মনে পড়ে। অনেকদিন আগে এক আন্‌ইউজুয়াল, একসেপশানাল, জমিদার তনয়, লিখে গেছিলেন :

    দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে,
    অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
    সবারে না যদি ডাক
    এখনো সরিয়া থাক,
    আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান—
    মৃত্যু মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান

    কিন্তু কী হল?

    অনেক বছর তো হয়ে গেল। এ দুর্ভাগা দেশ যখন পরাধীন ছিল, তখনও তৎকালীন নেতা-সুলভ নেতারা এবং দায়িত্ববান কবি-সাহিত্যিকরা যা বলে গেলেন বার বার করে, আজ পঁয়ত্রিশ বছরের স্বাধীনতার পরও তার কতটুকু আমাদের কানে পৌঁছল? কানে যদি-বা পৌঁছল হৃদয়ে পৌঁছল না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঐকতান কবিতাতে শুধু ভঙ্গি দিয়ে চোখ ভোলানোকেও তিরস্কার করে গেছিলেন। কিন্তু আজ এতদিন পরও এই মানি-মুঞ্জরী, টুসি-লগন, বুলকি-পরেশনাথ, টেটরা-তিতলি রামধানীয়া চাচা, এদের কাছে রথীদার মতো বড়ো মানুষ তো শুধু ভঙ্গি দিয়েই চোখ ভুলোতে এসেছিলেন। তাঁর ড্রেসিং-গাউনেরই মতো, আম-জনতার প্রতি দরদও তাঁর একটা পোশাক। শুধু পোশাকই। ভিতরের মানুষটা এখন মুখার্জি বামুনের সঙ্গে কাহারের মেয়ের বিয়ের কথাতে ভিরমি খান। ছিঃ ছিঃ। বড় লজ্জা। বড় দুঃখ। রথীদা!

    তিতলিকে যেদিন প্রথম ওকে বিয়ে করবার কথাটা বলি, তিতলি অবাক হয়ে গেছিল। ওরা তো চিরদিন ধর্ষিতাই হয়েছে। ওদের মন ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হয়ে, শূকরীর মতো হয়ে গেছে। সে মনে কোনো ভালোর সার ডাক যেমন আর সাড়া তোলে না; ঘৃণার ধিক্কারও না। ওদের চোখে পৃথিবীর অবিশ্বাস। বিশ্বাসকে, কোনোরকম শুভবিশ্বাসকেই বিশ্বাস করার মতো মনের জোর আর ওদের অবশিষ্ট নেই। তাই, তিতলি কথাটা প্রথমে বিশ্বাসই করেনি।

    সেদিন সকালবেলা। এগারোটা হবে। ওকে বললাম, একটু চা খাওয়া তো তিতলি। উত্তর না দিয়ে, ও চা করে নিয়ে এল। আমি বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে ছিলাম। অদ্ভুত কায়দায় ও চা এগিয়ে দিল। যেমন বারবার দেয়। বাঁ হাতটা এনে ডান হাতের কনুইয়ের কাছে ছুঁয়ে দু’হাতে এগিয়ে চা-এর গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয়। প্রণাম করতে হলে, উবু হয়ে বসে, আঁচলটা নিয়ে দু’পায়ের পাতা ঢেকে দেয়; তারপর দু’হাত একসঙ্গে বাড়িয়ে দিয়ে প্রণাম করে। যুগ-যুগান্ত ধরে কত শালীনতা, কত গভীর বিনয় সহজাত হয়ে রয়েছে এদের মধ্যে। কত কী শেখার ছিল আমাদের মতো ফাল্‌তু শহুরে উঁচুঘরের বাবুদের এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে। এত বছর, যতই এদের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছি, ততই মাথা নীচু হয়ে এসেছে আমাদের মিথ্যা উচ্চমন্যতার, অহংকারের, অসারতার কথা ভেবে।

    তিতলি, মোড়াটা এনে আমার পাশে একটু বোস্। তোর সঙ্গে কথা আছে।

    ও এসে মাটিতে বসল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে

    বলল, কী কথা? তাড়াতাড়ি বল। আমি ডাল বসিয়ে এসেছি। পুড়ে যাবে।

    না মাটিতে নয়। তুই মোড়াটা এনে আমার পাশে বোস্।

    এ আবার কী?

    বলে, বিরক্ত হয়ে তিতলি মোড়াটা এনে বসল।

    আমার দিকে তাকা ভালো করে।

    ও আমার দিকে তাকালো।

    তিতলির ঠোটে একটা কালো তিল আছে। ওর চিবুকের কাছটা, চোখের গভীর আনত দৃষ্টি ওকে এমন এক দৃপ্ত মহিমা দিয়েছে তা বলার নয়। হয়তো আমিও এই রকম একেবারে ভিন্ন চোখে পূর্ণদৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে কখনও চাইনি এর আগে তাই লক্ষও করিনি।

    আমার এই নতুন দৃষ্টিতে চমকে উঠে, ও চোখ নামিয়ে নিল।

    হঠাৎ ওকে ভীষণ চুমু খেতে ইচ্ছে করল আমার। ও যে আমার বিবাহিত স্ত্রী হবে। পরক্ষণেই ভাবলাম, নাঃ। থাক। প্রাক্-বিবাহের পরশ থেকে না-হয় এ-জন্মে বঞ্চিতই হয়ে রইলাম।

    তিতলি, আমাকে তোর কেমন লাগে? তোর পছন্দ আমাকে? মনিব হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে?

    ও মুখ তুলে বলল আবার পানের দাগ লাগিয়েছ পাঞ্জাবিটাতে? তোমাকে নিয়ে আমি সত্যি আর পারি না।

    কথা ঘোরাস না। আমার কথার জবাব দে।

    মানুষ টানুষ তো অনেক বড়ো ব্যাপার। মনিবকে মনিব বলে জেনেই তো খুব খুশি ছিলাম এতদিন। অত সব বড়ো বড়ো কথা আমার মাথায় আসে না।

    তোকে আমি বিয়ে করতে চাই তিতলি। তুই আমাকে বিয়ে করবি তো?

    তিতলির মুখ লাল হয়ে গেল। কানের লতিও। নাকের পাটা ফুলে উঠল।

    ও বলল, দ্যাখো, বাবা মরে যাওয়ায়, আর এই অসুখে আমার এমনিতেই মাথার ঠিক নেই। এমন রসিকতা আমার সঙ্গে করা তোমার ঠিক হচ্ছে না।

    আমি এক ঝটকায় বাঁ হাত দিয়ে ওর হাতটা তুলে নিলাম আমার কোলে। ওর হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, রসিকতা নয়। খুব জরুরি কথা এ। বল্ আমাকে বর হিসেবে তোর পছন্দ কি-না।

    অসুখ হল আমার, আর মাথাটা দেখছি খারাপ হল তোমার! পাগল না-হলে, এমন কথা কেউ বলে! আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে?

    বুঝতে পারছিলাম ও কিন্তু ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠছিল ভিতরে ভিতরে।

    গম্ভীর গলায় বললাম, তাহলে আমাকে তোর পছন্দ নয়!

    ও অসহায় এবং বিভ্রান্ত চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। অনেকক্ষণ। ওর হাতটা আমার হাতের মধ্যে হঠাৎই নরম হয়ে এলো। ঘেমে উঠল ওর হাতের পাতাটা। ও তাকিয়েই ছিল আমার চোখে, একদৃষ্টে। হঠাৎই মুখ নামিয়ে নিল। মাটির দিকে চেয়ে রইল।

    বললাম, দ্যাখ, আমার নিজের মা ছাড়া তোর মতো এত ভালো আমায় আর কেউ বাসেনি রে তিতলি। তুই বড় ভালো মেয়ে। তোর বাবা মরে গেল। এখন তোর ভার অন্য কেউ না নিলে তোর আর তোর মায়েরই বা চলবে কী করে?

    একটু চুপ করে থেকে ও উদাস গলায় কুয়োতলির দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, দয়ার কথা বলছ মালিক? তুমি খুব দয়ালু। ওর দুচোখ জলে ভরে উঠল।

    আমি বললাম, ছিঃ! ছিঃ!

    মালিক তো নোক্রানিকে দয়া এমনিই দেখাতে পারে। আমার কাছ থেকে তোমার যদি কিছু চাওয়ার থাকে, তাহলে তা এমনিই দেব আমি। তুমিই তো অন্যরকম। অনেকেই তো জওয়ান্ নোক্রানির সবকিছু না-নিয়ে মাইনেই দেয় না! গোদা শেঠ-এর হয়ে আমলকী কুড়োতে গেলেও তো তা দিতে হবে। তুমি তো কত ভালো ব্যবহার কর। কত ভালো মালিক তুমি। এমনিতেই তো আমি তোমারই। খুশি হয়েই তোমার। আমার জন্যে নিজেকে এত ছোট করবে কেন? নীচে নামবে কেন?

    ছোট করব?

    আমি রেগে গেলাম।

    হঠাৎ মনে হল, নানকু বোধহয় ঠিকই বলে। ওরা যে অত্যাচারিত হয়েছে এবং বঞ্চিত হয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে, এর পেছনে ওদেরও একটা নিশ্চিত নেতিবাচক ভূমিকা আছে। ওরা নিজেদের আসন সম্বন্ধে এখনও একেবারেই সচেতন নয়! সেই অস্পষ্টতা কাটিয়ে ওঠার কোনো সুযোগই হয়তো ওরা পায়নি। তবুও, এটা খারাপ। ভীষণই খারাপ। নানকুটা একদম খাঁটি কথা বলে। পুরোপুরি খাঁটি!

    বললাম, ছোটো করব কেন? আমি তোর চেয়ে কিসে বড়?

    তিতলি গম্ভীর মুখে বলল, ওসব কথা ছাড়ো। সে কথা তুমি জানো ভালো করেই। আমিও জানি।

    আমি বললাম, বাজে কথা রাখতো। কাজের কথা বল্, বিয়ে করবি কি-ন বল্ নইলে আমি অন্য মেয়ে দেখব। আমার বিয়ের বয়স হয়েছে অনেকদিন। একা একা আর ভালো লাগে না। আমার একটা সুন্দর মেয়ের খুব শখ।

    তিতলি এবার মুখ নামিয়ে বলল, আমি তো আর সুন্দরী নই!

    তোর কথা হচ্ছে না। বাচ্চা, বাচ্চার কথা বলছি আমি। বিয়ে হলে বাচ্চা হবে তো? একটা মেয়ের শখ আমার!

    তিতলি এক ঝঙ্কায় হাতটা সরিয়ে নিয়ে, ধেৎ বলে এক দৌড়ে পায়ের মল আর হাতের বালাতে রিন্ ঠিন্ শব্দ তুলে রান্নাঘরে চলে গেল। যেতে যেতে উষ্মার সঙ্গে বলে গেল, তুমি ভারি অসভ্য!

    আমি চেঁচিয়ে বললাম, তাহলে তুই রাজি! যাই তোর মায়ের মতটা চাই গিয়ে। তারপর নেমন্তন্ন-টেমন্তন্ন করতে যাব। সময় বেশি নেই। যত তাড়াতাড়ি হয় ব্যাপারটা সেরে ফেলব।

    ও উত্তরে বলল, দেখেছো। ডালটা পুড়িয়ে দিলে তো!

    বললাম, সবে তো ডাল দিয়ে শুরু হল। এবার দেখবি, তোর অনেক কিছুই পুড়বে।

    এরপর স্বাভাবিক গতিতেই ব্যাপারটা এগিয়ে গেছিল। কিন্তু মুশকিল হল এই-ই যে, তিতলি আর আমার মুখের দিকে সোজাসুজি তাকায়ই না, কাছেও আসে না। বিয়ের আগেই, নতুন বউ হয়ে গেল। অন্য দিকে মুখ করে খেতে দেয়। ইনডাইরেক্‌ট ন্যারেশানে কথা বলে। কোথায় যাওয়া হচ্ছে? কখন ফেরা হবে? কী খাওয়া হবে? জামাটা খুললেই তো হয়? চানটা করে নিলেই তো খাবার দেওয়া যায়। এইভাবেই চালাতে লাগল। দিন যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, আমার ততই মজা লাগতে লাগল। আর তিতলি ততই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যেতে লাগল।

    একদিন খেতে বসে হঠাৎ ওকে বললাম, মেয়ে যদি না-হয় আমার, তো তোকে দেখাব আমি!

    পরিবেশন ছেড়ে এক দৌড়ে ও পাশের ঘরে চলে গিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিল। বলল, আমি চাকরি ছেড়ে দেব কিন্তু এমন করলে।

    আমি খেতে খেতে বললাম, আমি মরলেই যাবে এ চাকরি। চাকরি যেন তোর ইচ্ছেয় যাবে। দাঁড়া না! তোকে কী করি আমি দেখবি! বিয়েটা হয়ে যাক। তোকে মজাটা টের পাওয়াব।

    ঐ ঘর থেকেই ও চেঁচিয়ে বলল, আমি তোমাকে বিয়ে করব না।

    আমি বললাম, তুই-ই নাই-ই বা করলি। আমি তো তোকে করব।

    ও বলল, বাঃ রে! গায়ের জোরে?

    একশোবার গায়ের জোর।

    এবার হাসতে হাসতে ও আবার এ-ঘরে এল। বলল, ভাত তো ঠান্ডা হয়ে গেল। দয়া করে খাওয়া হোক।

    এমনি করে একটা একটা দিন এগোচ্ছে বিয়ের দিকে।

    আমার আর তিতলির মানসিক অ্যাডজাস্টমেন্ট একেবারে পুরোপুরি হয়ে গেছে এ ক’বছরে। আমরা দুজনেই কে কখন রাগ করলাম, কে কখন খুশি হলাম, বুঝতে পারি। কী করে রাগ ভাঙতে হয়, তাও জানি। দুজনেই। একে দুঃখী থাকলে বা অখুশি থাকলে কী করে অপরকে সুখী বা খুশি করতে হয় তাও। তবে, শরীরটাও তো বড় কম কথা নয়। আমার এই ভালুমায়ের দিগন্ত-বিস্তৃত বন পাহাড় অরণ্যানী নদী ঝরনা টাড় তালাও-এর সামগ্রিক ঠাসবুনোন রহস্যের জগতের মতো সেও তো এক দারুণ জগৎ। অনাস্বাদিত, অনাঘ্রাত, অদেখা। মনে মনে, শরীরের ভালোবাসার কল্পনায় বুঁদ হয়ে আছি এখন আমি সব সময়।

    নিজে লাইফবয় সাবান মাখি। তিতলির জন্যে সুগন্ধ সাবানের বন্দোবস্ত করতে হবে। আমার যতটুকু সাধ্য, আমি ওকে মাথায় করে, যত্ন করে রাখব। মেয়েরা আমার চোখে চিরদিনই একটা আলাদা জাত, সুন্দর পাখির মতো, প্রজাপতির মতো। পুরুষের কর্তব্য, তাদের আতর মাখানো তুলোর মধ্যে রাখা, যাতে ধুলো না লাগে, রোদ না লাগে, তাদের শরীরে। আর সেই কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করার মধ্যেই তো পুরুষের সমস্ত সার্থকতা!

    মানি, মুঞ্জরী, পরেশনাথ, বুলকিকে নেমন্তন্ন করতে গেছিলাম। বিয়ে হবে ওদেরই বাড়ির সামনের টাঁড়ে। অনেকখানি জায়গা আছে। তাছাড়া ওদের বাড়ির গা দিয়ে বয়ে গেছে একটা পাহাড়ী নালা। জলের সুবিধে আছে হাত-পা-ধোবার। সব সময়ই জল থাকে। বস্তি-সুদ্ধ লোক হাঁড়িয়া, শুয়োরের মাংস আর ভাত খাবে সেদিন। মাদল বাজবে, নাচ-গান হবে সারারাত। এ হল বিয়ের খাওয়া। মালিকের চাকরি করি আর নাই-ই করি, এতবছরে সহকর্মীদের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা তো’ রাতারাতি চলে যাবার নয়! ভদ্রলোক সহকর্মীরা যত অভদ্র ব্যবহারই করুন না কেন, যারা তথাকথিত ভদ্রলোক নয়, তাদের সকলের কাছে থেকেই আজ থেকে বহুদিন পর্যন্ত যথেষ্ট ভদ্রজনোচিত ব্যবহার পাবো বলেই আমার বিশ্বাস। অনেক কাজ এখন। বিয়ের বাজার করতে যেতে হবে তিতলিকে নিয়ে ডালটনগঞ্জে। ওর তো কিছুই নেই। নতুন বউ বলে ব্যাপার। মেয়েদের কত কী লাগে। কিছুই তো জানি না। এতদিন যা জানতাম এখন তার চেয়ে অনেক বেশি জানতে হবে। বরপক্ষ কন্যাপক্ষ সবই তো আমি একা। এ বড়ো অভাবনীয় অবস্থায় পড়লাম। ভেবেছিলাম, রথীদাই দাঁড়িয়ে থেকে বিয়েটা দেওয়াবেন –আমার পিঠ চাপড়ে বললেন সাব্বাস্ সায়ন। গজেনবাবু নন্টুবাবু নিতাইবাবু, গণেশ মাস্টার এঁর সকলেই এসে উৎসাহ-সহকারে পাশে দাঁড়াবেন এই আশাও ছিল। তা নয়, চিপাদোহর, ডালটনগঞ্জ, লাতেহার, টোরী, চাত্রা, জৌরী, গাড়োয়া, বানারী, মহুয়াডার সমস্ত জায়গায় ঢি-ঢি পড়ে গেছে। ভদ্রলোকদের প্রেস্টিজ আমি একেবারেই পাংচার করে দিয়েছি নাকি! এখন থেকে ওঁদেরও যদি কুলি-কামিনা দামাদ্ বা জিজাজি বলে ডাকতে আরম্ভ করে, এই ভয়ে তাবৎ ভদ্রলোকমণ্ডলী কুঁকড়ে আছেন। বাঙালি সহকর্মীদের চেয়েও বেশি চটেছেন স্থানীয় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। দু-একজন তো মারবেন বলেও শাসিয়েছেন শুনতে পাচ্ছি। মারলে, মারবেন। এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছি। পেছনে ফেরার আর উপায় নেই।

    বিকেলে গিয়ে মানিয়ার বাড়িতে অনেকক্ষণ গল্প করলাম মুঞ্জরী আর ওর সঙ্গে। ব্যবস্থা-ট্যবস্থা সব ওরাই সকলে মিলে করে রাখবে। বিয়ে আর একটা কী বড় ব্যাপার! আমাকে কোনোরকম ভাবনা করতে মানা করল ওরা দু’জনেই। বললো, তিতলিটার খুব ভালো বরাত। তারপরই বলল, মেয়েটাও বড় ভালো। মানিয়ার কোমরটা ঠিক হয়েও হচ্ছে না। অথচ ঐ ভাঙা কোমর নিয়েই করতে হচ্ছে সব কিছুই। ওর জীবিকা, ফরেস্ট ডিপার্টের কেস, মাহাতো এবং গোদা শেঠের হয়রানি এ সবই সমান একঘেয়েমির সঙ্গে চলেছে। মানির কোনো তাপ উত্তাপ নেই। কেবলই বলে, পরেশনাথটা তো বড়ো হয়েই এসেছে প্রায়। আর চার-পাঁচটা বছর কোনোক্রমে চালিয়ে দিতে পারলেই এবার বসে বসে খাবো। পায়ের ওপর পা তুলে।

    মানি বলল, চলো মালিক, এগিয়ে দিই তোমাকে একটু। বেলা পড়ে আসছে। যাবে? শোনচিতোয়ার কথা কি ভুলে গেলে?

    অনেকদিন তো এ বস্তিতে তার খবর নেই। কোন দিকে চলে গেছে কে জানে? মাসখানেক হতে চলল, তাই না? দ্যাখো, এতদিন কোনো বস্তিতে বিষ-তির মেরে খতম করে দিয়েছে ব্যাটাকে। তির ছুড়লে তো আর শব্দ হয় না। কতদিন আর মুখ বুজে সহ্য করবে মানুষ?

    একমাস কোনো খবর নেই ঠিকই। সেইজন্যেই তো বেশি সাবধানে থাকা উচিত।

    মানি বলল, ঠিক্কে হ্যায়। চলো তো! অনেক বেলা আছে এখনও

    বলে, লাঠিটা হাতে করে বেরোল আমার সঙ্গে কোমর বাঁকিয়ে। ওদের বাড়ি থেকে দুশো গজও আসিনি, আমি আগে যাচ্ছি; মানি পেছন পেছন, হঠাৎ আমার একেবারে পাশেই কী যেন হিস্ করে উঠল।

    থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে উঠল, বিষম বিপদ। সাবধান! স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে মুখ ঘুরিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড বড়ো কালো কুচকুচে গোখরো সাপ সুঁড়ি-পথের ওপরে লেজে ভর দিয়ে প্রায় কোমর সমান উঁচু হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। প্রকাণ্ড ফণাটা হেলছে-দুলছে। ছোবলটা মারলেই হয়। মারা না-মারা তারই দয়া।

    মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেল। বোধশক্তি রহিত হয়ে গেল। তিতলির মিষ্টি মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। উজ্জ্বল কালো দুটি চোখ, গভীর কালো আনত দৃষ্টি; তার পাতলা ঠোঁটের ওপর ছোট্ট তিলটি। সে যেন নীরবে বলছে তুমিও? আমাদের যে আর কেউই নেই!

    পরক্ষণেই মনে হল, পিছন থেকে একটা ছায়া দ্রুত এগিয়ে আসছে। একটুও না নড়ে ঐখানে দাঁড়িয়েই আমি ভাবছিলাম, সাপটাকে কে পাঠালো আমাকে খতম করার জন্যে? শ্রেণীশত্রু নিপাত করবে? ব্রাহ্মণ, না ক্ষত্রিয়, না কায়স্থ, না ভূমিহার?

    এমন সময়, ঐ ভয়াবহ সাপকে এবং সেই সাপের অনুপস্থিত মেয়েকে একটা অত্যন্ত অশালীন সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলে, অশ্রাব্য ভাষায় বিভিন্ন মৌখিক বিভূষণে বিভূষিত করতে করতে ঝপাঝপ করে লাঠি চালাতে লাগল মানিয়া। ওকে দেখে বিশ্বাস হলো না যে, ওর কোমরের অবস্থা শোচনীয় ছিল ক’দিন আগেও।

    প্রথম লাঠি সাপের পিঠে পড়তেই, আমি একলাফে সরে গেলাম সেখান থেকে। কোমরের ও ফণার ওপর লাঠির পর লাঠি পড়তে সাপটি মাটিতে শুয়ে পড়ল। কিন্তু তখনও নড়ছিল। সাপেরা মরে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ নড়ে। মানুষের বিবেকের মতো।

    কোমরভাঙা মানি কোমরে হঠাৎ এত জোর এল কোথা থেকে তা ওই-ই জানে। সাপটা মারার পরই যেন ওর কোমরের ব্যথাটা ফিরে এল। ব্যথাও যেন সাপের ভয়ে ওকে ছেড়ে দূরে সরে গেছিল। মানি, লাঠিতে ভর দিয়ে কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে বলল, যা মালিক্! আজ তোরা যাত্রা বন্ গেল।

    বললাম, এই নাকি তোর কোমরভাঙা?

    মানি খুশি হয়ে, ফোকলা দাঁতে হেসে, পিচিক্ করে থুথু ফেলল পথের পাশের ওকটা ঝোপ লক্ষ্য করে।

    এটা কী সাপ রে?

    কালো গহুমন। কালে আর দেখতে হতো না। স্বর্গে গিয়ে বিয়ে করতে হতো।

    এই সাপের চামড়াটা আমাকে ছাড়িয়ে দিবি? কী দারুণ চামড়াটারে।

    মানি গররাজি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই কালো গহুমনের চামড়া যদি কেউ ছাড়ায় তো তার বংশ নাশ হয় মালিক।

    হেসে বললাম, তোদের যতরকম কুসংস্কার!

    মানি হাসল বোকার মতো। কী যেন ভাবছিল ও।

    তারপর বলল, আচ্ছা, আচ্ছা দেব। আমি গরিব মানুষ! তোমার বিয়েতে আর কিছু তো দিতে পারব না! ঠিক আছে। এইটাই ভালো করে ছাড়িয়ে, সুন্দর করে শুকিয়ে দেব। এখুনি উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি সাপটাকে।

    একটু দম নিয়ে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আর যাচ্ছি না তাহলে। তুমি এগোও। অন্ধকারও হয়ে এল।

    আচ্ছা! বলে, আমি ডেরার পথ ধরলাম।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঋজুদা সমগ্ৰ ৫ – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article লবঙ্গীর জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }