Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কোজাগর – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প561 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কোজাগর – ৩৬

    ৩৬

    সেদিন মানিয়া যখন সাপটাকে মারছিল এবং আমি দাঁড়িয়েছিলাম পথে, ঠিক তখনই আমাদের দেড়শ গজ দক্ষিণে লোহার চাচার মেয়ে গোরী একটা দু মানুষ সমান কুণ্ডার গাছে উঠে একা একা কুণ্ডার পাতা পাড়ছিল।

    কুণ্ডার গাছগুলো ছোট ছোট হয়। গুঁড়িটা সোজা এক কোমর সমান উঠে বিভিন্ন ডাল ছড়িয়ে দেয় ওপরে। ডালগুলো সমান্তরাল নয়। দেড় দু মিটার ব্যাসের মধ্যে সব ডালগুলো থাকে। বড়রা ঐ ডালে চড়লে ডাল ভেঙে যেতে পারে বলে বাচ্চারাই সাধারণত উঠে কুণ্ডার পাতা পাড়ে। কুণ্ডার পাতার তরকারি বানিয়ে খায় আমাদের বন-পাহাড়ের লোকেরা। গোল, গোল, পালা পালা দেখতে হয় পাতাগুলো। আরও কিছুদিন পরে কুণ্ডার গাছে ফলও আসবে। তখন ফলও খাবে সকলে।

    বাড়িতে খাওয়ার মতো কিছুই ছিল না বলে গোরীর মা গোরীকে পাঠিয়েছিল। ন’ বছরের মেয়ে গোরী, কুণ্ডার পাতা পেড়ে নিয়ে যখন গাছ থেকে নামছিল ঠিক তখনই পিছন থেকে শোনচিতোয়াটা দু’পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে ওর ঘাড়-কামড়ে ধরে নিচে নামায়। বেচারি শিশু তার হাতে যত জোরে পারে ডাল আঁকড়ে ধরে। গাছের কর্কশ ডালে তার নরম হাতের পাতার ভিতর দিককার মাংস ছিঁড়ে রয়ে যায় সেখানেই। শোন্-চিতোয়াটা দিনের বেলা এই প্রথম ভালুমার গ্রামের প্রায় মধ্যে থেকে মানুষ নিল।

    এখানে বিপদ এক রকমের নয়। অনেক রকমের। কিন্তু দিনের পর দিন শুধু মকাই বা বাজ্রার রুটি বা গত বছরে শুখা-মহুয়া কারই বা মুখে রোচে? তাছাড়া, ভাত বা রুটিও বা ক’দিন খেতে পায় ওরা? বেঁচে থাকতে হলে এইসব বিপদ নিয়েই বাঁচতে হয় সকলকে। আমাকেও হবে। এতে কোনো বীরত্ব বা বাহাদুরি নেই। বরং এই জীবনের কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়ার মধ্যে কেমন এক নির্লিপ্ত নিরুপায় প্রশান্তি আছে। যে প্রশান্তির কথা ভাবলে, মাঝে মাঝে আমার গা-জ্বালা করে। নানকুর নিশ্চয়ই আমার চেয়ে অনেকই বেশি করে।

    ভগবানে বিশ্বাস করতে দোষ দেখি না। কিন্তু এই ভালুমারের মানুষজন তাদের এই অসহায়, সম্বলহীন, প্রতিকারহীন জীবনের সব দায় ওদের অদৃশ্য কিন্তু সাকার ভগবানের ওপরই চাপিয়ে দিয়ে বংশপরম্পরায় বেঁচে এসেছে ভাবলে বড়ই রাগ ধরে। ওরা বোধহয় মনে করে যে, যে দায় যে দেন ওদের, তা বুঝি ভগবানের কাঁধে চাপিয়ে দিতে পারলেই তা পালন বা শোধ করা হয়ে যাবে।

    আমার ব্যাঙ্কে যে টাকা ছিল, তা থেকে মালিকের কাছ থেকে ডেরাটি এগারো শ’ টাকাতে কিনে নিতে হলেও আরো কিছু থাকবে। এটা সোজা অঙ্কের হিসাব। বড় শহরের মূল্যমানে এ টাকা কোনো টাকাই নয়। কিন্তু ভালুমারের পটভূমিতে এ টাকা যার আছে, সে বিড়লার মতো বড়লোক। এই জায়গায়, এই পরিপ্রেক্ষিতে এক নতুন জীবন আরম্ভ করতে আমার মতো লোকের পক্ষে এই টাকাই যথেষ্ট টাকা! মানি-মুঞ্জরী, কি তিতলি, কি রামধানীয়া চাচা বা লোহার চাচার বাড়ি তল্লাশি করলেও একসঙ্গে হয়তো কুড়ি টাকাও বেরোবে না। অথচ তবু ওরা বেঁচে আছে, সারাদিন কাজ করছে, হাসছেও। কষ্টে হলেও, বেঁচে আছে। টাকা যেমন ওদের নেই, তেমন শহরের কেরানিবাবু থেকে বিরাট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের মতো টাকার পিছনে পাগলের মতো দৌড়ে বেড়ানোর মতো অন্ধ মত্ততাও নেই। ওরা অল্পতেই খুশি। সুখ যে ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স-এর ওপর নির্ভরশীল নয়, তা প্রত্যেক গড়পড়তা গ্রামীণ ভারতবাসীই জানে। জানে না, কেবল শহরের লোক। কিন্তু এই দুরারোগ্য আতি-ছোঁয়াচে ব্যাধি শহুরেরা ক্রমাগত গ্রামীণ ভারতবর্ষেও ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। এ রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই। চিকিৎসাও নেই। এই অপ্রয়োজনের প্রয়োজনের ব্যাধি মারাত্মক আকার ধারণ করছে প্রতি মুহূর্তে।

    কাল রাতে যখন আমি খেতে বসেছিলাম ঠিক তখনই কে যেন দৌড়ে এসে বারান্দায় উঠল। তারপর ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে এলো। এসেই, আমার পাশে বসে পড়ে, তিলকে অর্ডার করলো, বড়ী ভুখ্ লাগলথু, রে তিতলি। খানা দে।

    নানকুকে এতদিন পর দেখে খুব ভালো লাগল। ও বলল, সবই শুনেছি। বড় খুশির কথা বাঁশবাবু। তুমি সত্যিই আমাদের একজন হলে।

    আমার বিয়ের দিন আসবে তো নান্‌কু?

    আলবৎ। তিতলির সঙ্গে তোমার বিয়ে, আর আমি না এসে পারি? তবে, বোলো না কাউকে।

    রথীদা তো আসবেন না, শুনেছো?

    সব শুনেছি। নানকু বলল। কিছুই বলার নেই আমার। অন্য কথা বলো।

    ছেলেগুলোর কী খবর? তোমার সঙ্গে যোগাযোগ কি সত্যিই ছিল?

    মরদের বাচ্চা ওরা। ওদের কাজ আমার চেয়েও অনেক বড় কোনো কাজ। আর বেশি কিছু জিগগেস কোরো না। আমি জানিও না ওদের সম্বন্ধে বেশি কিছু। আমি তো ফালতু একজন মানুষ। আমার ভালুমার আর তার আশপাশের লোকেরা তাদের নিজেদের নিজেরা আবিষ্কার করলেই আমার ছুটি। কিন্তু এত ছোট কাজ যে এতখানি কঠিন, আগে ঠিক বুঝতে পারিনি।

    তোমার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট তুলে নিয়েছে পুলিশ?

    তুলে নিয়েছে? পাগল! কে কত ভালো লোক এ দেশে তা বুঝতে হয় কার কত শত্রু আছে এবং কার নামে কত মামলা ঝুলছে দেখে। যত বেশি শত্রু আর যত বেশি মামলা ততই ভালো লোক সে। আমার নামে তিন তিনটে খুনের মামলা। তার মানে, লোক আমি এমনি ভালোর চেয়ে তিনগুণ ভালো। অথচ যারা খুন হল…

    জানি।

    আমি তো কাউকে খুন করিইনি, মধ্যে দিয়ে টুসিও পর্যন্ত গুম হয়ে গেল। তার খুনের দায়ও চেপেছে আমার ঘাড়ে। বলতে বলতে মনে হল ওর গলা ভারী হয়ে এল। আমার মনের ভুলও হতে পারে। বলল, বিয়ে তো আমিও করেছিলাম বাঁশবাবু! কপালে সইল না।

    তিতলি রান্নাঘরে গেল আটা মাখতে। হয়তো চোখের জলও লুকোতে।

    টুসি বড় মিষ্টি মেয়ে ছিল। আমি বললাম।

    মিষ্টি মেয়ে অনেকই আছে। সেটা বড়ো কথা নয়। ওর খুব সাহস ছিল। কথা কী জানো? আসল সাহস হচ্ছে মনের সাহস।

    ওর কথাতে মনে পড়ে গেল আমার এক বন্ধু, যে আর্মিতে আছে। একদিন আমাকে বলেছিল ফিজিকাল কারেজ ইজ দ্যা লিস্ট ফর্ম অফ কারেজ। যে কোনো মিলিটারি অফিসারকে জিজ্ঞেস কোরো, শুনবে, ওঁদের যখন ট্রেনিং দেওয়া হয়, এই কথাটাই বড় করে শেখানো হয়। আর্মড-ফোর্সেস-এর প্রত্যেক ভালো অফিসার জানেন, যুদ্ধ করার সহাসের চেয়েও আরও অনেক বড় সাহসের পরিচয় তাঁদের দিতে হয় যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে। আর সেই সাহস তাঁদের আছে বলেই, তাঁরা বড় অফিসার।

    নানকু এইসব আলোচনায় চলে গেলেই বড় উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ওয়ার্মডআপ্প হয়ে ওঠে। আমি তাই কথা ঘুরিয়ে বললাম, তুমি যে, এই রাতে এলে, শোন্‌চিতোয়াটা থাকা সত্ত্বেও; এটাও তো কম সাহসের কথা নয়! অবশ্য তোমার সাহস নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না কখনও

    লোহার চাচার ন’ বছরের ছোট্ট মেয়ে গোরী, যে শোনচিতোয়া যখন খুশি তাকে ধরতে পারে তা ভালো করে জেনেও কুণ্ডার পাতা ছিঁড়তে জঙ্গলে আসতে পারে, তার সাহসের কাছে আমার সাহস কিছুই নয়। একজন জওয়ান যুদ্ধক্ষেত্রে যে সাহসের পরিচয় দেয় অটোমেটিক্ ওয়েপন হাতে নিয়ে, সেই শারীরিক সাহসের চেয়ে ন’ বছরের গোরীর এই মনের সাহস কি কোনো অংশে কম? দুঃখ সইবার সাহস, বইবার সাহস, বিপদের মধ্যে মাথা উঁচু করে নিরস্ত্র অবস্থায় বিপদকে অগ্রাহ্য করবার সাহসও একটা দারুণ সাহস! ক’জন পারে?

    তিতলি এল এ ঘরে। বলল, তুমি কি পালিয়েই বেড়াবে এমন করে? নানকু ভাইয়া?

    কী করব? এই ব্যক্তির মালিক তো গোদা শেঠ আর মাহাতো। তারা যা ইচ্ছে তাই-ই করতে পারে। নইলে, খুন না করেও তিন তিনটে খুনের মামলা ঝোলে আমার ঘাড়ে। তুই-ই বল, তিতলি? তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ধরা দিলেই, ঝুলিয়ে দেবে। মাঝে মাঝে মনে হয় একই দিনে দিই দুটোকে শেষ করে। সেটা একটুও কঠিন কাজ নয়। তারপরই ভাবি, সেইটে কি ঠিক রাস্তা? সে তো আমার হার। যেদিন এই টিহুল-লগন-পরেশনাথ, এমনকী আমার মানিয়া চাচাও বুঝতে শিখবে, তাদের সত্যিকারের জায়গা কোথায়, যেদিন আমাদের এই বন পাহাড়ের প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের ভূমিকা আর আত্মসম্মান নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে : সেদিনই আমার সত্যিকারের জিৎ হবে। যখন এদেশের নেতারা নতুন জিপগাড়ির প্রশেসান করে, ফুলের মালা গলায় দিয়ে, শহর থেকে হেলিকপ্‌টার চড়ে আর আসবে না, যেদিন নেতা আসবে এই মানী, লোহারচাচা, টিহুল, পরেশনাথদের মধ্যে থেকে, যাদের গায়ে মাটির গন্ধ, ঘামের গন্ধ; সেদিনই নানকু ওরাওঁ-এর কাজ শেষ হবে। যতদিন সে নেতারা না-আসে, ততদিন আমাকে পালিয়েই বেড়াতে হবে। বুঝলে বাঁশবাবু, মনের সাহসে এদের সবাইকে সাহসী করে তুলতে পারলে শুধু ভালুমার বস্তি কেন, আমার এই মস্ত সুন্দর দেশটা একটা দেশের মতো দেশ হয়ে দাঁড়াবে। সারা পৃথিবী তাকে মাথা নীচু করে প্রণাম করবে।

    তোমার কয়লাখাদের চাকরিটা নিশ্চয়ই চলে গেছে? থাকলেও তো যেতে আর পারো না সেখানে নিশ্চয়ই!

    চাকরি? তুমি জানো না? কবে ছেড়ে দিয়েছি। সম্মানে লাগে। ওরা কাজ না করেই ট্রেড-ইউনিয়নিজম্ করতে চায়। দায়িত্বটা কর্তব্যটা অস্বীকার করে, খালি পাওনাটা নিয়েই মাথা ঘামায়। আমি ওদের কেউ নই। তুমি কিন্তু একথাটা ছেলেগুলোকে শিখিও তোমার স্কুলে। কাজ করতে হবে। সকলের অনেক কাজ করতে হবে। কাজ ছাড়া কোনো দেশ বড়ো হয় না। কাজের কথা শিখিও। আর যে মনের সাহসের কথা বল্‌লাম, ওদের সেই সাহসের কথাও শিখিও, তাহলেই হবে।

    রথীদার কাছে গেছিলে নাকি? কথা ঘুরিয়ে বললাম আমি।

    ও মাথা নাড়ল। বলল, অন্য কথা বলো।

    হীরুর কোনো খবর জানো? জুগনু বেচারার বড়োই খারাপ অবস্থা। টুসিয়া যে কোথায় হারিয়ে গেল। তারপর হীরু। জামিনও পায়নি শুনলাম।

    হীরুদাদার ফাঁসি হবে। নানকু বলল, গলা নামিয়ে। কাউকে বোলো না। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে।

    কোন ব্যাপারটা?

    হীরুদাদাই যে চৌকিদার আর পুলিশ সাহেবকে মেরেছিল।

    বল কী? শুনেছিলাম এমন একটা গুজব, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। হীরু!

    হীরুদাদার বন্ধু খুব রহিস্ ঘরের ছেলে। খুবই প্রতাপ-প্রতিপত্তি। অনেক এম. এল. এ., এম. পি., মিনিস্টারের জানাশোনা তার বাপ-কাকাদের সঙ্গে। অথচ হীরুদাদার কেই বা আছে? তাছাড়া খুন তো আলবাৎ করেছে। সাক্ষী কেউ নেই। তবে পয়সা থাকলে সাক্ষীর অভাব কী? তোমার গোদা শেঠ বা মাহাতো বা তাদেরই কোনো চাচা সাক্ষী দাঁড়িয়ে যাবে। মদত দেওয়ার লোক থাকলে লোককে বাঁচাতেই বা কী, আর ফাঁসাতেই বা কী? দশটা খুন করেও কত লোক বেকসুর খালাস হয়ে যাচ্ছে। একটু চুপ করে থেকে নানকু বলল, সারা দেশটা ক্রমশ বরবাদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বুঝলে বাঁশবাবু। বেশরম্, বেয়াকুফ, বে-নজীর ববাদীর দিকে।

    খাবার দিয়ে ডাকল তিতলি।

    নানকু ভোর হবার অনেক আগেই উঠে পড়েছিল। তিতলি তাড়াতাড়ি স্টোভ ধরিয়ে নানকুকে মাঠুরি দিয়ে চা দিয়েছিল! চা খেতে খেতে হঠাৎ নানকু বলেছিল, তোর বিদাইয়া করপুরা; মোর ছাতি বিহরে—একদিন এই গানটা গাইছিলাম, এমন সময় টুসিয়ার সঙ্গে দেখা। মীরচা-বেটীতে। বুঝলি তিতলি। টুসিটার বিদাইয়ার জায়গাটাও যদি বা জানতাম তাহলেও মনটা একটু শান্ত হতো। কোথায় যে হারিয়ে গেল। পেটে আমারই বাচ্চা নিয়ে।

    তিতলি ওকে কী বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই, চলি রে! বলেই উঠে চলে গেল ও।

    আজকাল নান্‌কু এমনই ফলি-রটেরের মতো হঠাৎ হঠাৎ আসে, হঠাৎ হঠাৎ চলে যায়। মাঝে মাঝে জুগনু চাচার বাড়িতেও যায়। তার শ্বশুরবাড়ি।

    ওকে দেখে অবাক লাগে আমার। ও যে ফেরারি, ওকে যে পুলিশ অথবা গোদা শেঠ কিংবা মাহাতোরা খোঁজ করে বেড়াচ্ছে এ নিয়ে ওর কোনোই দুশ্চিন্তা নেই। ওর চলাফেরার মধ্যে বড় বাঘের চলাফেরার এক অদ্ভুত মিল আছে। যাঁরাই জঙ্গলে বড় বাঘকে কখনও দেখেছেন, তাঁরাই জানেন যে ভয় বা বিপদাশঙ্কা নিয়ে বড় বাঘের কখনও কোনো মাথা-ব্যথা নেই। মাথা উঁচু করে, ডোন্ট-কেয়ার তার চলা-ফেরা। বাঘ যে বনের রাজা, তা মিটিং করে জানান দিতে হয় না। সম্মান কেউই কখনও ভিক্ষা করে পায়নি সংসারে। বাঘকে দেখে এমনিতেই মাথা নুয়ে আসে শ্রদ্ধায়। নান্‌কুকে দেখলেও তাই।

    সকাল হতেই চা খেয়ে রোজ আমি আমার স্কুল খুলি। পড়ুয়ারা সব আসে। ছেলেই বেশি। মেয়ে কম। সকাল সাতটা থেকে ন’টা, দুঘণ্টা পড়াই ওদের। আমিই শ্লেট-পেন্সিল কিনে দিয়েছি। জনা-দশেক সবসুদ্ধু। তিতলিকে নিয়ে। ওদের সঙ্গে ও-ও শেখে। অক্ষর পরিচয় করানো এবং বাচ্চাদের পড়ানো যে কত কঠিন এবং কত ধৈর্যের কাজ তা এই পাঠশালা শুরু না করলে কখনও জানতে পেতাম না। সমস্ত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষিকাদের প্রতি শ্রদ্ধা গভীর হয়েছে আমার এ ক’দিনেই। মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চেয়েও বোধহয় এ কাজ অনেক কঠিন।

    মানিয়া একদিন সত্যি সত্যিই সেই কালো গহুমন্ সাপের চামড়াটা নিয়ে এল। বলল, ভালো করে রোদে শুকিয়ে ঠিকঠাক করে দিয়েছি। তুমি অনেক বছর রাখতে পারো। তোমার জন্যে ভারি গালাগালি খেতে হল মুণ্ড্রীর কাছে!

    কেন? আমি শুধোলাম।

    বলেছিলাম না তোমাকে! ঐ যে! লোকে বলে, এই সাপের চামড়া ছাড়ালে নাকি বংশনাশ হয়।

    তিতলি বলল, হয়ই তো! তুমি কেন ও সাপের চামড়া ছাড়াতে গেলে? বলাম তিতলিকে। যত বাজে কুসংস্কার।

    মানি বলল, আমি তো মুঞ্জরীকে তাই-ই বললাম। বললাম মালিক বলেছে।

    মানির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভাবখানা, মালিক আর ভগবানের কোনো তফাত নেই। তাও যদি ওর মালিকও হতাম! বললাম, আমাকে অনেকদিন তোরা সকলে মালিক, আর হুজৌর, করে রেখেছিস। এখন তো তোদের গাঁয়ের দামাদ হতে যাচ্ছি। এবার তোদের একজন করে নে। আপন করে নে আমাকে।

    কী বলে ডাকব তোমাকে? মানি মুশকিলে পড়ে বলল।

    তিতলি খিল্‌ খিল্‌ করে হেসে উঠল।

    বললাম, না-হেসে আমার একটা নাম ঠিক করে দে না বুঝি।

    তিতলি আচানক্ বলল, গাঁও-দামাদ।

    বাঃ ফারস্ট ক্লাস্। আমি বললাম! ঘর-জামাই-এর চেয়ে অনেকই ভালো।

    মানির মুখ দেখে মনে হল, প্রচণ্ড এক সমস্যার নিরসন হল ওর।

    মানি চলে যাবার সময় লক্ষ করলাম, কুঁজো হয়ে হাঁটছে তো বটেই। একটু যেন খোঁড়াচ্ছেও।

    বললাম, আবার কী হল রে মানি!

    বোলো না মালিক, পড়ে গেছিলাম আবারও এক গর্তে। এই ফরেস্ট ডিপার্ট মীরচা-বেটী নদীর শুকনো খোলে ইয়া বিরাট বিরাট সব গর্ত করেছে। বর্ষায় নাকি তাতে জল জমিয়ে নেবে, তারপর শীতে প্ল্যানটেশানে জল দেবে সেখান থেকে। গরমে জানোয়ারেরা জলও খেতে পারবে। তা খুঁড়বে তো খোঁড়, গ্রামটা ছেড়েই খোঁড়। তা না, লোকের চলাচলের পথের ওপরই প্রায় এইসব কাণ্ড। এই ফরেস্ট ডিপার্টই আমাকে মারবে দেখছি। ধনে প্রাণে।

    তোর কেসের তারিখ আবার কবে পড়বে রে মানিয়া? টাকা-পয়সার দরকার থাকলে বলিস কিন্তু। লজ্জা করিস না।

    মানি দু-হাত ওপরে তুলে বলল, সে হয়ে যাবে। সবই ভগবানের দয়া। আর চালিয়ে তো এলাম এতবছর এমনি করেই।…

    ও চলে গেলে আমি আমার স্বাধীন জীবনযাত্রার গতিপ্রকৃতি, আয়-ব্যয় ভবিষ্যতের একটা বাজেট নিয়ে বসলাম। ভাবছি, বিড়িপাতার ছোট একটা জঙ্গল ইজারা নিয়ে সকলে মিলে কাজ করব। যা মুনাফা হবে, তা সকলে মিলে সমান ভাগে ভাগ করে নেব। সকলকেই নেব এই কাজে। যারাই খাটতে চাইবে। মানিয়া, জুগ, টিহুল, পরেশনাথ, লগন, বুলকি, যে কেউ, যে ভাবে সাহায্য করতে পারে। সকলের সমান হিস্সা। কিন্তু সকলকে মেহনত করতে হবে সমান। কেউ যে পরগাছার মতো বসে বসে অন্যের ঘাড়ের রক্ত চুষবে, সেটি হবে না। আমিও শারীরিক পরিশ্রম করব ওদেরই মতো। আমার হয়ে শুধু আমার ক্যাপিটালই খাটবে; সেটিও হবে না। অনেক কিছুই তো করতে সাধ যায়। দেখি, কী পারি? কতটুকু পারি? তবে যাই-ই করি না কেন, এবার গোদা শেঠ আর মাহাতোর নজর পড়বে আমারই ওপর। এতদিন রোশনলালবাবুর কর্মচারী, বহিরাগত বাঁশবাবু ছিলাম। এখন গাঁও-দামাদ হয়ে গিয়ে ওদের শত্রুতার মুখোমুখি হতেই হবে। তিতলি যে এমনভাবে গোদা শেঠের হাত-ফকে পড়ে-লিখে শহুরে বাবুর একেবারে বিয়ে-করা বউ হয়ে উঠবে, এ কি গোদা শেঠ দুঃস্বপ্নেও ভেবেছিলো?

    মানি চলে গেলে আমি তিতলিকে ডাকলাম। ও ওর মার কাছে বসেছিলো, শেষের ঘরে। তিতলির মা সুরাতিয়ার বয়স বড় জোর চল্লিশ হবে। কিন্তু দেখলে মনে হয় ষাট। তিতলির আগে আরও নাকি দু-ভাই ছিল। তারা কেউই বেঁচে নেই। একজনকে সাপে কামড়েছিল পাঁচ বছর বয়সে। অন্যজন বসন্তে মারা যায়। ভারি চুপচাপ মহিলা। টেটরার শোকটা একেবারেই ভুলতে পারেনি। তিতলির কাছ থেকে আমার ঘরকন্নার রকম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার রীতি-নীতি, এসব একটু একটু শিখে নিচ্ছে। শিখে নিচ্ছে যত্ন করে রান্নাবান্নাও। আমার কাছে যে থাকবে, তার প্রতিদানে যে কী এবং কতটুকু সে করতে পারবে আমার জন্যে, এই চিন্তাই মনে হয় তাকে পেয়ে বসেছে। বড় আত্মসম্মানজ্ঞান মানুষটার। রাসেল বলেছিলেন, সেল্ফরেসপেক্ট ইজ দ্য বেটার হাফ্ অফ্‌ প্রাইড।

    তিতলি এলে বললাম, কাল সকালের বাসে ডালটনগঞ্জ যাব, বিয়ের কেনাকাটা করতে। তোর জন্যে কী কী কিনতে হবে তার একটা লিস্টি বানা। তোর যা কিছু দরকার। আর আমি যা দেবো, তাতো দেবোই। তোকেও সঙ্গে যেতে হবে।

    ও বলল, ধ্যেৎ! আমি যাবো না। কী করতে যাবো আমি?

    না-গেলে আমি মেয়েদের জিনিস কিনব কী করে? আমি কি এর আগে বিয়ে করেছি?

    ও আবার বলল, ধ্যেৎ? তারপর বলল, আনতে হবে না কিছুই। একটা নতুন শাড়ি হলেই হবে। বিয়ের দিন পরবো।

    পাগলি! তোর কি গোদা শেঠের দোকানের মাল সাফাই করা গরিব মজুরের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে? তোর বর যে বেজায় বড়লোক! তবে যে বর গোদা তোর জন্যে ঠিক করে রেখেছিল, সে কিন্তু দেখতে ভালোই ছিল। এখনও বল্ ইচ্ছে করলে তাকেও বিয়ে করতে পারিস।

    ভালো হচ্ছে না কিন্তু।

    ওর মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে এসে বলল, এখনও তো বিয়ে হয়নি। একসঙ্গে শহরে গেলে বস্তির নানা লোকে নানা কথা বলবে। তাছাড়া, ওরা গরিব লোক। যেমন করে এখানের আর সকলের বিয়ে হয়; তেমনি করে হলেই খুশি হবে ওরা। তিতলির কিছুই চাই না।

    তা বললে কী হয়? আমার পাঁচটা নয়, দশটা নয়, একাট মাত্র বউ, তাকে কিছুই না দিয়ে, না সাজিয়ে-গুজিয়ে বিয়ে করি কী করে?

    আমি জানি না; তোমার যা খুশি তাই-ই করো মালিক।

    তুই কি চিরদিনই মালিক বলবি?

    তিতলি মাথা নুইয়ে বলল, হ্যাঁ।

    গলা নামিয়ে লজ্জামাখা গলায় বলল, তুমিই তো আমার আসল মালিক। তোমাকে মালিক বলব না, তো কাকে বলব?

    তিতলি না গেলেও আমাকে যেতেই হবে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে হবে। বাজারও করতে হবে। তাই কালই যাবো ঠিক করলাম। ওকে বললাম, একটা দিন সাবধানে থাকিস। মা বেটিতে। আমি না হয় লগনকে থাকতে বলব তোদের সঙ্গে।

    অথবা পরেশনাথকে।

    আহা! আমি আর মা একা একা অত দূরের ঐ জঙ্গলের গভীরের বাড়িতে থাকিনি দিনের পর দিন, বাবা চলে যাওয়ার পরও? তোমার এখানে তো সেদিনই এলাম আমরা। তোমার ভাবনা নেই কোনো। তবে, পারলে দিনেদিনেই চলে এসো।

    তাই-ই তো আসতাম। কিন্তু শোনচিতোয়া? বাস থেকে নেমে তো হাঁটতে হবে এতটা। রাত হয়ে যাবে যে।

    ওরে বাব্বা। ভুলেই গেছিলাম। না না, পরদিন সকালের বাসেই এসো তুমি। রাতে এসে একদম দরকার নেই।

    পরেশনাথ আর বুলকি কোথা থেকে হুড়োহুড়ি করে, চিঠি হ্যায়, চিঠি হ্যায় করতে করতে এসে উঠোনে ঢুকলো।

    তিতলি ওদের গলার আওয়াজ শুনে দৌড়ে এল বাইরে।

    বলল, কী রে? তোদের যে পাত্তাই নেই অনেকদিন?

    আমরা দুলহান্ দেখতে এলাম। আর ক’দিন বাকি গো তিতলি দিদি?

    চুপ্। ফাজিল। তিতলি বলল। কী খাবি বল্ তোরা?

    দু’জনেই সমস্বরে বলল, শেওই-ভাজা।

    দু ভাইবোনেই শেওই-ভাজা আর প্যাড়ার যম। খুব ভালোবাসে খেতে। তাই যখনি চিপাদোহর কি ডালটনগঞ্জ যাই, এনে রেখে দিই। গরমের দিন প্যাড়া থাকে না। নষ্ট হয়ে যায়। তিতলি প্লেটে করে ওদের শেওই-ভাজা এনে দিল। বারান্দাতে বসে তিতলির সঙ্গে হাসি-গল্প করতে করতে খাচ্ছিল ওরা। বুলকির হঠাৎ মনে পড়ায় বলল, এই চিঠিটা দিল আমাকে চিহুল চাচা। চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলাম। খামের ওপরের হাতের লেখা সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমাকে লেখার লোকও আজ আর কেউ নেই-ই বলতে গেলে। ছোটমামা ও ছোটমামি লিখতেন মাঝে মধ্যে, তিতলির কারণে সে পাটও চুকে গেছে। খামটা খুলেই দেখলাম দার্জিলিং-এর ঠিকানা।

    দার্জিলিং? আমার পরিচিত কেউই দার্জিলিং-এ থাকে না। তাড়াতাড়ি চিঠির শেষে চলে গেলাম। চমকে উঠলাম খামটি দেখে, সুন্দর মেয়েলি হস্তাক্ষর; শেষে লেখা আছে আপনার স্ত্রী ও আপনাকে নমস্কার, শুভেচ্ছা ও অনেক অভিনন্দন জানিয়ে এ চিঠি শেষ করছি—ইতি জিন্।

    জিন?

    তিতলি বুলকি পরেশনাথ হাসাহাসি করছিল, উঁচু স্বরে কথা বলছিল, আমার কানে সব শব্দ মরে গেল। তাড়াতাড়ি প্রথম পাতায় ফিরে গেলাম।

    দার্জিলিং
    ২৫। ৫

    প্রীতিভাজনেষু,

    আপনি এ চিঠি পেয়ে যতখানি না অবাক হবেন, এ চিঠি লিখতে বসে আমিও তার চেয়ে কম অবাক হইনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, খুব ভালো লাগছে চিঠিটা শুরু করতে পেরে।

    আপনার মনে আমার সম্বন্ধে নিঃসন্দেহভাবে যে ভুল ধারণাটি আজ পর্যন্ত রয়ে গেছে তা একদিন ভেঙে দেব বলে ঠিক করেই রেখেছিলাম। আজ তা ভাঙতে পেরে আনন্দিত বোধ করছি! তিতলিকে আপনি বিয়ে করছেন এ খবর আমি বৌদি ও দাদার কাছ থেকে পাই গতকাল তাঁদের লেখা চিঠিতে। তাদের এ ব্যাপারে কী প্রতিক্রিয়া, সে খবরে আপনার অথবা আমার কারোই কোনো প্রয়োজন নেই। দামি তো নয়ই। এখন আমি ঘোরতর গৃহিণী। ভীষণরকম বিবাহিতা।

    আমার স্বামী দেখতে আপনার চেয়ে অনেক খারাপ। হয়তো আরও অনেক ব্যাপারে আপনার চেয়ে নিকৃষ্ট। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বনবিভাগে চাকরি করেন। আমার বন-জঙ্গলের প্রতি প্রেম চিরদিনই খুব গভীর। যদিও আমার বৌদির মতো তার বহিঃপ্রকাশ কখনওই ছিলো না। এক একজন মানুষ, এক-এক রকম হন। বিশেষ করে অনুভূতি এবং তার প্রকাশের ব্যাপারে। এত কথা বলছি এই জন্যেই যে, আপনাকে আমি হেনস্তা বা অপমান করতে ভালুমারে যাইনি যে, এ কথাটা আজ অন্তত আপনার বিশ্বাস করতেই হবে। না যদি করেন, তাহলে আমি নিজের কাছে অপরাধীই থেকে যাব আজীবন। ঠিক যে-সময়টিতে আমরা ভালুমারে আপনার ডেরায় গিয়ে পৌঁছই তখন আপনি বাড়ি ছিলেন না। আপনারই বিছানাতে শুয়ে, গৃহস্বামীর অনুপস্থিতিতে জিপের ঝাঁকুনির অনভ্যস্ত ধকল পুষিয়ে নিচ্ছিলাম। এমন সময় আপনি এলেন। আপনার গলার স্বর শুনে আমার মনে হল, ঠিক এমনই গলার স্বরের কারো জন্যে আমার এতদিনের অপেক্ষা ছিল। সত্যি বলতে কী, আমি এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম শুধু আপনার কণ্ঠস্বর শুনেই যে হঠাৎ বাইরে আসতে আড়ষ্টবোধ করছিলাম। বাইরে যখন এলাম, তখন আপনার চেহারাও আমার ছোটবেলা থেকে কল্পনা করা স্বামীর চেহারার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। আজও স্পষ্ট মনে আছে…ধূলি ধূসরিত আপনার পা। পাজামা আর সবুজ-রঙা খদ্দরের পাঞ্জাবি গায়ে। পাঞ্জাবিতে তিনটের জায়গায় দুটো বোতাম লাগানো ছিল। তাও একটি চন্দনের। অন্যটি প্লাসটিকের। এক নজরেই ভোলাভালা অথচ, বুদ্ধিমান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটিকে ভালো লেগে গেছিল আমার। আজ আপনাকে বলতে কুণ্ঠা নেই, লজ্জারও কোনো কারণ দেখি না যে, আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে তখন আমার মতো খুশি আর কেউই হতো না।

    চিঠিটা এই অবধি পড়ে আপনার সন্দেহ নিশ্চয়ই দৃঢ়তর হচ্ছে যে, আমার মাথার গোলমাল আছে।

    মাথা আমার অত্যন্ত সুস্থ এবং বুদ্ধি অনেকের চেয়েই তীক্ষ্ণ। এইবার বলি, কেন আমি আপনার সঙ্গে অমন ঠান্ডা ব্যবহার এবং হয়তো কিঞ্চিৎ অভদ্রতাও করেছিলাম। না, অভদ্র বলব না। কারণ অভদ্রতা আমার ক্ষমতার বাইরে। বরং বলব, দুর্বোধ্য। ঠিক কি না? অমন ব্যবহার করেছিলাম শুধুমাত্র এই কারণেই যে ওখানে পৌঁছনোর একঘণ্টার মধ্যেই তিতলিকে আমি আবিষ্কার করেছিলাম। তিতলির মধ্যে আমি এমন কিছু দেখেছিলাম, যাতে আমার বুঝতে একটুও ভুল হয়নি, যে ও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। অথচ এও বুঝেছিলাম যে, আপনি সে-ভালোবাসা সম্বন্ধে অবগত বা অবহিত নন। আপনি জানতেন না, তিতলির চোখ থাকত সবসময় আপনার ওপরে, ওর সমস্ত অস্তিত্ব আবর্তিত হতো আপনাকেই ঘিরে। সে কারণে, প্রথম রাত কাটানোর পর পরদিন ভোরেই আমি মনস্থির করে ফেলি।

    তিতলি আমার প্রতিপক্ষ হিসাবে অতি সহজেই হেরে যেত, হয়তো সব দিক দিয়েই। কিন্তু আমি এও বুঝেছিলাম যে, আমার হয়তো আপনাকে না হলেও চলে যাবে, কিন্তু আপনি নইলে তিতলি অচল। ওর কাছে এটা জীবনমরণের প্রশ্ন ছিল। অন্য একটা দিকও ভেবেছিলাম। তিতলি আপনাকে যে ধরনের গভীর, একতরফা ভালোবাসা বাসে বলে আমার মনে হয়েছিল, তাতে আপনাকে আমার বিয়ে করার পর ওর পক্ষে আত্মহত্যা করা অথবা আমাকে বিষ খাইয়ে বা অন্যভাবে মেরে ফেলাও আশ্চর্য ছিল না। মেয়েরা ভালোবেসে করতে না-পারে, এমন কিছুই নেই। এই পারা না-পারার ক্ষমতা সম্বন্ধে আপনারা চিরদিনই অজ্ঞ। তাছাড়া, ভেবেছিলাম; গভীর বনের বাসিন্দা আপনি। বন্যকেই পছন্দ করবেন বেশি। তিতলির ভালোবাসা যদি কখনও আপনার গোচরে আসত, যেমন এখন এসেছে; তখন আমাকে নিয়ে আপনি বিপদে পড়তেন। এবং আমিও, আপনাকে নিয়ে। সত্যিকারের ভালোবাসা অত সহজে ফেরানো যায় না; ফেলেও দেওয়া যায় না। সে ভালোবাসা প্রাক্‌বিবাহিত জীবনেরই হোক কী বিবাহোত্তর জীবনেরই হোক। ভালোবাসা, সে যারই ভালোবাসা হোক না কেন হৃদয়ের যত গভীর থেকে তা ওঠে, ভালোবাসার জনের হৃদয়ের ঠিক ততখানি গভীরে গিয়েই তা পৌঁছয়। ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলব না। কিন্তু এর ব্যতিক্রম ঘটাতে একপক্ষকে অশেষ জোরের সঙ্গে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হয়। তাতেও কষ্ট কম নয়। কেউ কাউকে খুবই ভালোবাসে জেনেও, তাকে ভালো-না-বাসা অত্যন্ত নিষ্ঠুরের পক্ষেই সম্ভব। কেউ কেউ নিষ্ঠুর হয়। হতে পারে। সবাই পারে না। হতে পারলেও কষ্ট; না-হতে পারলেও কষ্ট।

    আপনি হয়তো ভাবছেন, যে-মেয়ে আপনার সঙ্গে এতখানি খারাপ ব্যবহার করে অপমান করে চলে গেছিল একদিন সে হঠাৎ এতদিন পর ভালোবাসার ওপর চিঠি লিখে আপনাকেই বা পাঠাতে গেল কেন? কারণ কোনোই নেই। চিঠি লিখতে বসে কথা প্রসঙ্গে কথা এসে গেল তাইই…। তিতলিকে আমার কথা বলবেন। আমার মনে আছে ও আমাকে জিন্ দিদি বলে ডাকত। জঙ্গলে-পাহাড়ে জিন্-পরীরাও থাকে। কোনো সন্দেহ নেই আমার এবং সেদিনও ছিলো না যে তিতলি আমাকে সেই জিন্‌ বলেই জানত। মেয়েরা যা দেখে, যা বোঝে; যা হৃদয় দিয়ে অনুভব করে তা আপনাদের সমস্ত বুদ্ধি জড়ো করেও আপনারা কখনও বুঝতে পারবেন না। সেইরকম কোনো পুরোপুরি মেয়েলিবোধ ভর করেই আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আজ এতদিন পর তা যে নির্ভুল তা জেনে স্বাভাবিক কারণেই খুবই ভালো লাগছে। নিজের বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না, অত্যন্ত নির্লজ্জের মতো হলেও। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনারা সুখী হোন।

    তিতলিকে বিয়ে করার সৎ-সিদ্ধান্তে পৌঁছে, আপনি মানুষ হিসেবেও যে কতখানি খাঁটি, তা প্রমাণ করেছেন। আপনাকে সেই স্বল্প দেখাতেও চিনতে আমরা ভুল হয়নি। এ কারণেও আমি স্বভাবতই গর্বিত।

    আমরা একটি ছোটো বাংলোতে থাকি। চারধারে কনিফারাস্ বন। চমৎকার পরিবেশ। এক্সট্রা বেডরুমও আছে। আপনি যদি সস্ত্রীক আমাদের এখানে কখনও বেড়াতে আসেন তাহলে খুব খুশি হব। হানিমুনেও আসতে পারেন। তিতলিও জানবে যে, তার জিদিদি তার মঙ্গলই চেয়েছিল। এবং এই জিন্, সেই জিন্ নয়। আমরা খুব সম্ভব আরো বছর দুই এখানে থাকব। আমার স্বামীর তার আগে ট্রান্সফার হবার সম্ভাবনা নেই। যে-কোনো সময়েই আসার নেমন্তন্ন রইল। একটি পোস্টকার্ড ফেলে দেবেন। এসে পৌঁছবার একদিন আগে পেলেই হল। এই নিমন্ত্রণে, আন্তরিকতার কোনো অভাব আছে বলে ভুলেও ভাববেন না। আমি এরকমই, অন্তরে যা থাকে, কখনওই তাকে ঠিকমতো বাইরে আনতে পারি না। তাই হয়তো যে ভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে লেখা উচিত ছিল সে-ভাবে লেখা হয়ে উঠলো না। আপনার স্ত্রী ও আপনাকে নমস্কার, শুভেচ্ছা ও অনেক অভিনন্দন জানিয়ে এ চিঠি শেষ করছি—

    ইতি
    শুভার্থী জিন্‌

    চিঠিটা পড়া শেষ করে তিতলিকে ডাকলাম। ততক্ষণে বুলকি আর পরেশনাথ চলে গেছিল। তিতলি দৌড়ে এল। বললাম, সেই জিন্‌দিদিকে মনে আছে? জিন্‌দিদিই চিঠি লিখেছে। আমাকে বিয়ে করতে চায়।

    ভালোই তো! তিতলি ঢোক গিলে বলল। মুখ কালো হয়ে গেল একেবারে। কিন্তু বলল খুবই ভালো কথা। কী সুন্দর দিদি! তোমার যোগ্য বউ তো সেই-ই। বলতে বলতে তিতলির গলা প্রায় ধরে এলো।

    বললাম, তা তো হল। এখন কী করি বলত? তোকেও কথা দিয়ে ফেলেছি। এদিকে বিয়ের বন্দোবস্তও পাকা। কী যে ঝামেলা বাধল!

    মালিকের সঙ্গে আবার নোক্রানির বিয়ে হয় কখনও! বিয়ের কথাতেই এতরকম বাধা, পাগলা সাহেব, তোমার কোম্পানির সব বাবুরা সকলেই তোমাকে ছাড়ল। আমার জন্যে এত হয়রান করবেই বা কেন তুমি নিজেকে? এ বিয়ে কি হতে পারে? আমি জানতাম। তোমাকে তো প্রথম থেকেই বলছি…….

    এবারে তিতলির দু-চোখ জলে ভরে এলো।

    বললাম, নাঃ! তাকে লিখে দেবো যে তার চেয়ে আমার তোকেই অনেক বেশি পছন্দ। আমাকে তোর জিন্‌দিদির পছন্দ হলেই যে, আমারও তাকে পছন্দ হবে এমন কথা কিছু আছে?

    তিতলি মুখ নামিয়ে নিচু গলায় বলল, তাকে তো তোমার পছন্দ ছিল তখন। খুব পছন্দ ছিল।

    কখনও না। আমার চিরদিন তোকেই পছন্দ। এখনও তোকে। তোকে যে আমি খুব ভালোবাসিরে তিতলি। তুই কি কিছুই বুঝতে পারিস না? কখনও পারিসনি? ভীষণ বোকা মেয়ে তুই।

    তিতলির গলা দিয়ে ফোঁপানির মতো একটা আওয়াজ বেরিয়ে থেমে গেল। দু চোখে জলের ধারা নামল। তিতলি ঘর ছেড়ে চলে গেল।

    মনে মনে, চলে-যাওয়া তিতলিকে বললাম, এখন তোকে যত কাঁদাচ্ছি, বিয়েটা হয়ে যাক, আদরে আদরে তোর সব কান্নাকে মুক্তো করে তুলব। দেখিস্ তখন। আমার পাগলি, মিষ্টি, সোনা বউ।

    খামটা থেকে আরও একটা ছোট্ট চিঠি বেরিয়ে মাটিতে পড়ল। চিরকুটেরই মতো। ডিয়ার স্যার,

    আমার স্ত্রীর নিকট আপনার কথা এতই শুনিয়াছি যে, আপনাকে না-চিনিয়া ও চিনি। আমাদের এখানে আপনার নিমন্ত্রণ রহিল। সস্ত্রীক আসিলে অত্যন্ত খুশি হইব। পত্রের সহিত একশত টাকাও পাঠাইলাম। মিসেস্ মুখার্জিকে একটি শাড়ি কিনিয়া দিলে আমরা দুজনেই ভেরি প্লিসড্ হইব।

    থ্যাংক ইউ!

    ইওরস্ ফেইথফুলি
    বি. ব্যানার্জি

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঋজুদা সমগ্ৰ ৫ – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article লবঙ্গীর জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }