Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কোজাগর – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প561 Mins Read0
    ⤶

    কোজাগর – ৪৬

    ৪৬

    মানি গরু দুটোকে নিজের ঘরের সামনে ছেড়ে দিয়ে দু’হাঁটুর মধ্যে মুখ রেখে বসে ছিল। মুঞ্জীর সঙ্গে অনেক বছরই তার কোনো শারীরিক সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক যা ছিল, তা শুধুমাত্র সংসার বিষয়ক। ছেলেমেয়ে সম্বন্ধেও কথা হত। গরু বাছুর সন্ধেবেলা ঘরে ফিরল কী ফিরল না। মাটিয়া তেল আছে কী নেই। ক্ষেতে গোবর সার দেওয়া হল কী হল না। শীত বা গ্রীষ্ম বা বর্ষার প্রকোপ বা অভাব কতখানি এবং তাতে ক্ষেতের ফসলের ক্ষতি হবে না ভালো হবে, এই সব কথা। হাট থেকে ক’ আনার নুন আর আনাজ আনবে, ওর ছেঁড়া ধুতিটাতে আরও ক’টা তালি সব-সুদ্ধু মারা যাবে, আগামী বর্ষায় শতচ্ছিন্ন ছাতাটা ফেলে দিয়ে নতুন একটা ছাতা কেনার সামর্থ্য হবে কি হবে না এই রকম সব কথা, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথাবার্তাই হত ওদের মধ্যে। তার মধ্যে শারীরিক বা মানসিক ভালোবাসার মতো অপ্রয়োজনীয় কোনো কথার স্থান ছিল না। মুঞ্জরী, মাহাতোর বাড়ি রাত কাটিয়ে আসার পর থেকে সে সমস্ত প্রগাঢ় জাগতিক বিষয়ের কথাও বন্ধ হয়ে গেছে। হুলুক্ পাহাড়ের মতো মৌনী ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেছে মানিয়া। রোগাও হয়েছে ভীষণ। এক্কেবারে কঙ্কালসার। চেনা যায় না ওকে। আর রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা; বুলকি। বুলকির এগারো বছর বয়স হল প্রায়। ও ঋতুমতী হয়েছে। তাইই সবসময়ে আতঙ্কে থাকে মুঞ্জরী। গরিবের ঘরে নারীর যৌবন বড় আতঙ্কর। এখন বুলকি মানির সঙ্গে এখানেই থেকে যাবে বলে জেদ ধরায়, তার সব দায়ই এসে পড়েছে তার অপদার্থ বাবার ঘাড়ে। কী করবে যে, ভেবেই পায় না মানি। ভেবে ভেবে ওর ঘাড়ের কাছটাতে বড় ব্যথা করে। একবার ভাবে গোদাশেঠের দোকানে গিয়ে গেঁহুর জমির তীব্রগন্ধী সার কিনে অনেকখানি একসঙ্গে খেয়ে ফেলে নিজেকে একেবারেই শেষ করে দেয়। রোজ রোজ একটু একটু করে মরার চেয়ে একবারে মরা অনেক ভালো। তাইই দিত ও হয়তো এতদিনে যদি না বুলকিটা তাকে এতখানি সম্মানিত না করত, এতখানি ভালো না বাসত তাকে। আসলে সার কেনার পয়সাও তার নেই। ও এমনই হতভাগ্য যে, বিষ কেনার সামর্থ্যও ভগবান দেননি ওকে। হায় রাম।

    পরেশনাথ দৌড়ে আসছিল। একবার মুখ তুলে তাকাল মানি—। দূর থেকে তার ছেলেকে দেখছিল সে। দেখতে দেখতে পরেশনাথ তার চোখের মণির মধ্যে বড় হতে লাগল, বড়ো হতে হতে প্রাপ্তবয়স্ক চওড়া কাঁধের যুবক—তার পর আরও বড়, দৈত্যের মতো বড়ো হয়ে গেল। মানির দু’চোখ, তার মস্তিষ্কের সমস্ত কোষে পরেশনাথ ভরাট করে ভরে রইল স্বল্পক্ষণ। পরক্ষণেই সম্বিত ফিরে পেল মানি। তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন, তার জীবনবীমা, তার বার্ধক্যর শেষ অবলম্বন, তার একমাত্র ছেলে পরেশনাথ! মানি ভেবেছিল, আর কয়েকটা বছর পরেই সব কাজ ছেড়ে দিয়ে টিহুলের বউ সহেলীর মতো শুধুই বাড়ি বসে দড়ি বানাবে আর শীতের দিনে রোদ পোয়াবে চাটাই পেতে বসে। তার শরীরের আনাচে-কানাচে তার বোঝা বওয়া রুক্ষ, মলিন হাড়ে হাড়ে, গত পঞ্চাশ বছরে যত শীত, আর খিদে, অপমান আর অসম্মান জমে উঠেছে, সেই সব শীতের পাখিদের তাড়িয়ে দেবে সে; রোদের তাপে শরীরের অণু-পরমাণু ভরে নিয়ে। ভেবেছিল। খ্যায়ের্ ‘ক্যা হো গেল্! হো রাম!

    পরেশনাথ একবার মানির দিকে তাকাল। কোনো কথা বলল না। মানির নাকে পরেশনাথের গায়ের গন্ধটা হঠাৎ ফিরে এল। শীতের রাতে, লেপ কম্বলের অভাব মেটাবার জন্যে গরিব বাপ যখন তার শিশুছেলেকে বুকের মধ্যে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে একটু উষ্ণতা দেবার এবং পাবারও করুণ চেষ্টা করত সেই সময়কার ওম্-এর গন্ধের কথাও। যা কিছু জাগতিক, ও দিতে পারেনি তার আদরের ব্যাটা পরেশনাথকে; লাল-জামা, ভালোমন্দ খাওয়া জুতো, দশেরার মেলায় বুড়ির চুল কিনে খাওয়ার পয়সা অথবা নাগরদোলায় চড়ার, তার সব কিছু অপূর্ণতাই ঘুমন্ত পরেশনাথকে বুকে জড়িয়ে ধরে মানি পূরণ করতে চাইত। মানির অন্তরের এই বোধের স্বরূপ পরেশনাথের এখনও বোঝার সময় হয়নি, কিন্তু মুণ্ড্রীর তো জানার কথা মাহাতোর তো জানার কথা! মাহাতো তো ভালুমার নামক পাহাড়া গ্রামের মাহাতোই মাত্র! রাজা মহারাজা হলেও কি তার বোধ মানির মতো বাপের বোধের থেকে তফাত হত? বাবা-মায়েদের তাদের সন্তানের প্রতি বোধ কি একই রকম নয়? কে জানে? বোধহয় নয়। নইলে, পারল কী করে মাহাতো আর মুঞ্জী! কী করে পারল? মানি ভাবে, ও কতোটুকুই না দেখেছে দুনিয়ার? এই ভালুমারের টাঁড়ে টাঁড়ে আর হুলুক্ পাহাড়ের ছায়ায়, মীরচাইয়ার ঝরনার গানের মধ্যেই ত জীবন বীতিয়ে দিল—ওর জ্ঞানগম্যি আর কতটুকু?

    পরেশনাথ বুলকির দিকে তাকাল। বুকি বর্ষায় নেতিয়ে যাওয়া তেলচিটে কাঁথা-টাথা রোদে দিচ্ছিল, চাটাই বিছিয়ে মায়ের কথা মতো। মুঞ্জরী গাছতলার রোদে পিঠ দিয়ে বসে তার নিজের চুলে যত্ন করে তেল মাখছিল। এ ক’দিনেই মুঞ্জীর বয়স অনেকই কমে গেছে। আসলে, কতই বা বয়স। দেখতে মনে হয় বুড়ি। এখনও যে মাটির তলার বীজের মধ্যের সুপ্ত প্রাণের মতো তার মধ্যেও এত প্রাণ ছিল, এত যৌবন ছিল, এত খুশি ছিল, চাওয়া ছিল এমনকী কাউকে এমন করে এখনও দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও ছিল, এ কথা মাহাতোর আদর না খেলে, ও তাকে আদর না করলে মুঞ্জুরী জানত না। মাহাতোকে অত্যাচারের প্রতীক, অসভ্যতা এবং দুর্বিনয়ের প্রতীক বলেই জেনে এসেছিল এত বছর মুঞ্জরী। ওকে দেখলে ওর আতঙ্ক হত। পুরুষ এক অদ্ভুত জাত! ভাবছিল, মুঞ্জী। বড় মজারও জাত। মানির অকর্মণ্যতায়, মদ্যপতায়, জীবনকে অসহায়ের মতো হাঁটু গেড়ে বসে মেরুদণ্ডহীনতার সঙ্গে মেনে নেওয়ার লজ্জাকর মানসিকতার কারণে কতবার ও মানিকে লাথি মেরে তার ভিতরের পৌরুষকে জাগাতে চেয়েছে, যে পুরুষকে সে শিশুকাল থেকে মনে মনে কল্পনা করে এসেছিল, বনদেওতার মূর্তির মাথায় জল ঢালতে ঢালতে, সারহুল উৎসবে গান গাইতে গাইতে, সেই পুরুষকে। কিন্তু পারেনি। অথচ মানি মানুষটা সৎ, অত্যন্ত ভালো, চাহিদাহীন এবং পুরোপুরি পরনির্ভর।

    পরনির্ভরতাকে, ভালোবাসার এক বড় অঙ্গ বলেই জেনে এসেছিল মুঞ্জরী। মানি যে তার ওপর নিঃশেষে নির্ভর করে এসেছে এত বছর, এ জানাটা চূড়ান্ত ভাবে জানত বলেই কখনও মানিকে ফেলতে পারেনি ও। তাকে অপমান করেছে, মেরেছে, পদাঘাত করেছে তবু ত্যাগ করার কথা কখনও ভাবতে পারেনি। কিন্তু মাহাতো তার জীবনে পরনির্ভরতার অন্য এক রূপ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, পৌরুষের প্রতীকের মতো। এতদিন মানিকে, মুঞ্জরী পরগাছার মতো বহন করেছে তার জীবনে। আজ নিজে পরগাছা হয়ে, সোনালি হলুদ উজ্জ্বল রঙের বাহারে নিজেকে সাজিয়ে সে নিঃশর্তে মাহাতোর ওপর নির্ভর করবে বলে ঠিক করেছে। মুঞ্জী তার জীবনের পথে অনেকখানি চলে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ বুঝতে পেরেছে যে, অন্যকে বইবার যেমন আনন্দ আছে, অন্যর দ্বারা বাহিত হওয়ারও তেমনই আনন্দ আছে। আনন্দর দরজা সকলের জন্যে খোলে না এ জীবনে। যারা সেই সুখ-কুঠুরির চাবির খোঁজ পেয়েছে, তারাই হয়তো জানে যে, বহন করে যতখানি সুখ, বাহিত হওয়ার সুখও তার চেয়ে কম ছাড়া বেশি নয়।

    পরেশনাথ ডাকল, দিদি!

    কী?

    চোখ না তুলেই বুলকি বলল।—বুলকির গলার স্বরে চমকে উঠে মুঞ্জরী একবার তাকাল মেয়ের দিকে। গত ক’দিনে মেয়েটার ব্যক্তিত্বই যেন বদলে গেছে। ওকে দেখলে আজকাল ভয় করে মুঞ্জীর। অথচ এগারো বছরের মেয়ে! বয়স বোধহয় বয়স হয় না, অভিজ্ঞতায় হয়। ব্যক্তিত্বে হয়। কাউকেই ভয় করে না আর মুঞ্জরী। মানিকে না, পরেশনাথকে তো নয়ই, কিন্তু বুলকির নির্বাক চোখের চাউনি তাকে যেন জ্বলন্ত লোহার মতো ছ্যাঁকা দেয়। তার শরীরের কেন্দ্রবিন্দু লজ্জায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। পরক্ষণেই ভাবে, লজ্জা কীসের? নিজেকে বোঝায়, আমার জীবন আমার। অনেক কষ্ট করেছি, আর নয়। এবার আমি বাঁচার মতো বাঁচব। এরা আমার কে? এদের জন্যে আমার জীবনের বাকি ক’টা দিন কেন এই অসামান্য সুযোগ থেকে, অনাস্বাদিত সব গা-শিউরানো সুখ থেকে বঞ্চিত হব!

    পরেশনাথ আবারও ডাকল, মা।

    কী বলছিস?

    মুঞ্জুরী তেল মাখতে মাখতেই মুখ ফিরিয়ে তাকাল ছেলের দিকে।

    মাহাতো-বাবা কখন আসবে?

    মুঞ্জরী একটু লজ্জা পেল। গলা নামিয়ে বলল, সময় হলেই আসবে। এত লাফাবার কী আছে?

    চোখের কোণে চেয়ে দেখল মুঞ্জী, বুলকি সোজা নিষ্কম্প চোখে চেয়ে আছে তার বাবার দিকে। বুলকির চোখে এক আশ্চর্য জ্বালা আর দরদ যেন একই সঙ্গে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। মেয়েটার চোখ দুটো বড়ো সুন্দর। সকলে বলে, মুঞ্জরীর চোখ পেয়েছে ও।

    পরেশনাথের মুখের ‘মাহাতো-বাবা’ কথাটা মানির কানেও গেছিল। এই কথাটা যখন শোনে, তখনই ওর মনে হয় যে, ওর বুকের মধ্যে পরেশনাথ, টাঙ্গির ফলাটাই আমূল বসিয়ে দিল। ছোটবেলার কথা সব মনে ভিড় করে আসে। কত লগসার দিন, তেওহারের দিন, মাদলের শব্দ-মেশা শালফুলের আর হাঁড়িয়ার আর শম্বরের মাংসের গন্ধের দিন। কিশোরী মুঞ্জরীর শরীরের গভীর ঘ্রাণ, মানির দুই মুঠির মধ্যে মুঞ্জরীর নরম স্তনকুঁড়িদের ধীরে ধীরে দৃঢ় যুগল ফুল হয়ে ফুটে ওঠার অনুভূতির দিন। তার সফল না হওয়ার স্বপ্নগুলো সব সারি বেঁধে চোখের সামনে এসে হাত ধরাধরি করে ভিড় করে দাঁড়ায়। স্বপ্নগুলো যেন দল বেঁধে তাকে ঘিরে ঘিরে ভেজ্জা নাচ নাচতে থাকে। মাথা ঝিমঝিম্ করে মানির। পরেশনাথের গলার স্বরে ঘোর কাটে। পরেশনাথ দিদির কাছে এসে আবার ডাকে, দিদি।

    বুলকি মুখ তুলে তাকায়। পরেশনাথের চোখে চোখ রাখে। কিন্তু কথা বলে না। একদৃষ্টে চেয়ে থাকে।

    পরেশনাথ বলে, দিদি! লগন বলছে, একদিন দুপুরে আসবে। মাছ ধরতে জলে ঝাঁপাঝাঁপি করতে নিয়ে যাবে আমাদের এক জায়গায়।

    নিরুৎসাহ গলায় বুলকি বলে, কোথায়?

    সে ওই লগনই জানে। সেখানে অনেক রকম মাছ এসে জমায়েত হয়েছে। তুই যাবি তো?

    বুলকি এক দৃষ্টে আরও অনেকক্ষণ পরেশনাথের চোখে চেয়ে রইল। কথা বলল না কোনো।

    কী রে? যাবি না?

    গেলেও হয়; না গেলেও হয়।

    মুঞ্জরী বুলকির দিকে ফিরে বলল, তোর কথা শুনলে মনে হয় যেন, সাত বুড়ির এক বুড়ি! কত বয়স রে তোর বুলকি? শেষের দিকে মুখে হাসি ফোটাল মুঞ্জরী, পরিবেশ লঘু করার জন্যে, তার অবচেতনে যে এক স্বার্থপরতার লজ্জা আজ সকালবেলার পুবাকাশের পরত ঘন কালো মেঘের মতো জমে উঠেছে, সেই লজ্জাকে একটু দ্রবীভূত করতে চাইল ও।

    কিন্তু বুলকি হাসল না। মেঘ ছেঁড়া রোদে কাঁথা উল্টে দিতে দিতে স্বগতোক্তির মতো বলল, বাচ্চাও বুড়ি হতে পারে, বুড়িও বাচ্চা; কখনও কখনও।

    এমন সময় কার সাইকেলের ঘণ্টি শোনা গেল ঝোপের আড়ালে। বুলকি উৎকর্ণ হয়ে চোখ তুলল।

    কে? নান্‌কু ভাইয়া?

    চোখ তুলল মানি। ভয় পেল, ফরেস্ট গার্ডরা কি আবারও এল?

    নাঃ। কেউই নয়। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একজন ঠিকাদারের কর্মচারী, হলুদ আর সাদা খোপ খোপ শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। কোথায় গেল কে জানে? তিরিশে জুনের পর থেকে তো জঙ্গলে সব রকম কাজই বন্ধ থাকে।

    নানকু সশরীরে না থেকেও এই ভালুমারের প্রত্যেকটি মানুষের বুকের মধ্যেই প্রচণ্ড জীবন্তভাবে বেঁচে আছে। হনুমান ঝাণ্ডা যেমন একটু হাওয়া লাগলেই পত্পতিয়ে উড়ে, মহাবীর যে আছেন, এ কথাই ওদের মনে করিয়ে দেয় অনুক্ষণ এত অন্যায়, অবিচার, অধর্মর মধ্যেও কোথাও যে ন্যায়, বিচার এবং ধর্ম সুপ্ত হয়ে থাকলেও আছেই, এ সত্য সম্বন্ধে ওদের সচেতন করে, তেমনই বনপথে শুকনো পাতা ওড়ার আওয়াজে, ভিজে হাওয়ায় লতাপাতার আকুলি-বিকুলি আর শন্‌শনানিতে ওরা চমকে ওঠে, ভাবে এই বুঝি নানকু এল। নানকুর সত্তা এখন আর কোনো একটি মানুষী ব্যক্তিত্বে সীমাবদ্ধ নেই, সে এখন আশার প্রতীক, ন্যায়ের, বিচারের, ধর্মর জ্বলন্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে এদের সকলের কাছে। হঠাৎ ও উদয় হয়ে, ওরা যতখানি সাহসী নয়, যতখানি আশাবাদী নয়, যতখানি বিশ্বাসী নয়, অথবা যতখানি হতে পারার কল্পনাও ওরা কখনও করতে পারেনি, তার চেয়েও অনেক বেশি সাহস, আশা ও বিশ্বাস ওদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়ে আবার শ্রাবণের বৃষ্টি-ঝরানো মেঘের মতো নিজেকে ভারমুক্ত করে বন পাহাড়ের দিগন্তে মিলিয়ে যায়। শুধু বুলকি বা মানিই নয়, নানকু কী বলতে চায়, কীসের বার্তা ও বয়ে আনে, কোন দিকে পথনির্দেশ করে তা এই ভালুমারের একজন মানুষও স্পষ্ট বোঝে না। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের হৃদয়ে এক নতুন প্রাণ সঞ্জীবিত হয়, বেঁচে থাকার এক নতুন মানে, জীবনের এক অনাস্বাদিত ভবিষ্যৎ-এর আভাস চমক তুলে ঝিলিক্ মেরে যায় প্রত্যেকেরই মনের মর্মস্থলে। ওরা ভাবে, একদিন হয়তো ওদের জীবনযাত্রা পাল্টাবে, জীবন শুধুই একঘেয়ে বারোমেসে ঘামগন্ধময় পরম ক্লান্তির পথ চলার রোজনামচা থেকে উত্তীর্ণ হবে এক নতুন দিগন্তের উজ্জ্বল উপত্যকায়—যে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সুখের দেশ সম্বন্ধে ওদের কারোরই কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই; কিন্তু অস্পষ্ট কল্পনা আছে। তাই-ই, বনপথে যে কোনো শব্দ হলেই, ভালোমারের প্রত্যেক মানুষ নানকুর আশায় মুখ তুলে চায়।

    নানকুকে একদিন মুঞ্জরীও ভীষণ ভালোবাসত। এমনকী, সেদিনও বাঁশবাবু আর নানকু যখন এসে মুঞ্জরীর ইজ্জত বাঁচালো হাটের মাঝে, সেদিনও নানকুর মতো ভালোবাসা, স্নেহ এমনকী শ্রদ্ধাও মুঞ্জরীর আর দ্বিতীয় কারো প্রতিই ছিল না। কিন্তু আজ ওর ছোট্ট পৃথিবীতে শয়তান শোচিতোয়াটার চেয়েও বেশি ভয় পায় নান্‌কুকে। নানকু এসে মুঞ্জরীর সামনে দাঁড়ালে মুঞ্জরী কী করে মাথা তুলে কথা বলবে, জানে না মুঞ্জরী। আদৌ মাথা তুলতে পারবে কি? নানকু কী বলবে ওকে? জবাবে ওই-ই বা কী বলবে নানকুকে? এ সব ভেবে মুণ্ড্রী শুধুই আতঙ্কিত বোধ করছে।

    পুবের আকাশে খুব মেঘ করে এসেছে। দেখতে দেখতে বেলা বারোটার সময় একেবারে অন্ধকার করে এল। ঠিস্ ঠিস্ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল ঘন তৃণপল্লবাচ্ছাদিত মাটিতে আর বনে বনে। হুড়োহুড়ি করে কাঁথা-ত্যানা ঘরে তুলল বুলকি আর পরেশনাথ! মুঞ্জরী বৃষ্টির মধ্যেই হাসির মতো হেলেদুলে এগোল কুয়োতলার দিকে, গা ছেড়ে দিয়ে ভালো করে চান করবে বলে।

    মানি যেমন দু হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে ছিল তেমনি করেই বসে রইল। বৃষ্টির তোড় বাড়ল মুহূর্তের মধ্যে। পরেশনাথ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে তার পুরনো বাবাকে বৃষ্টির সাদা ঝিরঝিরে চাদরের এপারে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। ওর মনে হল এ বাবাকে ও চেনে না। অন্য বাবা। বুলকি জলের মধ্যে দৌড়ে গেল ওদিকে, ধাক্কা দিয়ে বলল, বাবা! বাবা! ভিজে গেলে যে বসে বসে।

    মানি তবু জবাব দিল না। বুলকির মনে হল, মানি মরে গেছে। শক্ত, অনড় শরীরটা।

    মানি তবু জবাব দিল না। বুকির চিৎকার শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। মরেই গেল নাকি লোকটা! মরলে মরল। ওর কিছু করার নেই। তবুও, এতদিনের কাছে থাকার, সুখ-দুঃখের ভাগীদার, সংস্কার, কু-অভ্যেস এই লোকটা। বুকটা হঠাৎ একবার ধ্বক্-ধ্বক্ করে উঠল মুঞ্জরীর। চেঁচিয়ে ধমকে উঠল বুলকিকে নাড়া দিয়ে দ্যাখনা, মরে গেল নাকি লোকটা? কী আপদ!

    বুলকি আবারও মানির কাঁধ ধরে নাড়া দিতেই মানি নড়ে উঠল। তারপর বুলকির হাত ধরে বৃষ্টির মধ্যে এগিয়ে চলল ঘরের দিকে। মুঞ্জীর বুকের হঠাৎ ধাক্কাটা থেমে গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও।

    ঠোঁট কামড়ে বলল, মরা এত সোজা! জন্মানো সোজা, মরা অত সোজা নয়! কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়ে গেল। আজ শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন। আজকের দিনে তীর্থযাত্রীরা অমরনাথ দর্শন করেন। দর্শনের জন্যে নয়, পথের দৃশ্য দেখার জন্যে একবার যাবার বড় ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু যাওয়া কী হবে কখনও? কোথায়ই বা গেলাম আজ পর্যন্ত, যাওয়ার মতো জায়গায়? তিতলিকে বিয়ে করে, ভালুমারের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে জড়িয়ে ফেলে, বোধহয় বাকি জীবনের মতো এই জংলি গর্তের মধ্যেই সবুজ পোকার মতো বেঁচে থাকতে হবে।

    আজ দুপুরেও এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। বৃষ্টির পর আকাশ একদম পরিষ্কার হয়ে গিয়ে চনচনে রোদ উঠল। আঃ! বন-পাহাড়, খোয়াই, লাল-মাটির পথ সব ঝক্‌ক্‌ করছে আজ। দারুণ গন্ধ উঠতে লাগল চারপাশের সোঁদা মাটি থেকে ওঠা বনজ বাষ্পের। ফড়িং উড়তে লাগল সমস্ত টাঁড়ের ওপরের আকাশ জুড়ে। দুরকমের ফ্লাইক্যাচার পাখি তাদের মধ্যে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে কপাকপ্ করে ফড়িং গিলে খেতে লাগল। হুলুক পাহাড়ের গায়ের কাছের ঘন জঙ্গলের ঢাল বেয়ে একদল নীলগাই হঠাৎ শোভাযাত্রা করে নেমে এল একেবারে টাঁড়ের মধ্যে। বোধহয়, পথ ভুলে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে তিতলিকে ডাকলাম। ও তখনও ঘরের মধ্যে শুয়ে ছিল। আমার দ্বিপ্রাহরিক আদর খাওয়ার পর। দৌড়ে এসে, বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়াল। অবাকও কম হলো না। নীলগাই-এর দলকে দেখে গ্রামের শেষপ্রান্ত থেকে দুটি কুকুর ভুকে উঠল। তখন নীলগাইয়েরা বুঝতে পারল যে, তারা পথ ভুল করেছে এবং বোঝা মাত্রই মুহূর্তের মধ্যে উল্টো দিকে আবার ক্লোরোফিল উজ্জ্বল জঙ্গলে ঢুকে গেল।

    এদিকের জঙ্গলে নীলগাই খুব বেশি দেখিনি। নীলগাই উড়িষ্যার জঙ্গলে দেখেছি। যখন ছিলাম সেখানে। বিহারের কোডারমা ও হাজারিবাগের জঙ্গলেও অনেক দেখেছি। তিতলি এখানেই জন্মেছে। ও-ও বলল, ও মাত্র একবার দেখেছিল ছোট্টবেলায়। কে জানে, কোন জঙ্গল থেকে এরা এসে পৌঁছল। জংলি কুকুর তাড়া করে নিয়ে এল কি? আমি আবার গিয়ে শুলাম। বাইরে সেই পাখিটা ক্রমান্বয়ে ডেকে চললো, ঘুমপাড়ানি ছড়ার মতো, টাকু, টাকু, টাকু, টাকু!

    আজকে পাঠশালার পরে, লোহার চাচার সঙ্গে গাড়ুর দিকে একটা জমি দেখতে গেছিলাম। অনেকখানি জমি। ওটা পাকাপাকি হয়ে গেলে কো-অপারেটিভ ফার্মিং শুরু করা যাবে। পাঁচ ভাই-এর জমি। তিনজন ডালটনগঞ্জে, একজন মুজাফ্ফরপুরে আর অন্যজন বিহার-শরিফে; অনেকের মালিকানার সম্পত্তি বলেই ব্যাপারটা আটকে আছে। তবু হয়ে যাবে। গাড়ুতে তাদের যে রিস্তেদার থাকে, সে তো তাই-ই বলছে। দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার আগেই ভালো করে দেখে-টেখে কোথায় ডিপ-টিউবওয়েল বসাবো, কোথায় ঘর বানাবো, কোথায় ভাণ্ডার, এ সবের নক্শা করে নিতে চাই। অনেকখানি পথ এই শ্রাবণের কাচপোকা-রঙা রোদে হেঁটে গিয়ে, হেঁটে ফিরে, খুবই ক্লান্তি লাগছিল। আর একটু ঘুমিয়ে উঠে, চা খাব। তিতলিকে বললাম। তিতলি বারান্দাতেই বসে রইল। বলল, সময় মতো চা করে, ডেকে দেবে আমাকে।

    গভীর ঘুমের মধ্যে হঠাৎ, কে যেন আমাকে জোরে ধাক্কা দিল। কাঁচা ঘুম ভেঙে চমকে উঠে দেখলাম তিতলি। ধড়মড় করে উঠে বসলাম।

    তিতলি বলল, টিহুল।

    টিহুল? কী হয়েছে? হঠাৎ! চোখ কচলে উঠে বসলাম।

    তিতলি আবার বলল, টিহুল দাঁড়িয়ে আছে। তোমাকে ডাকছে। বলছে, খুব জরুরি দরকার। আমাকে কিছুতেই বলছে না।

    কী ব্যাপার? বলতে বলতেই, আমি ঘরের বাইরে এলাম। টিহুল বলল, বাঁশবাবু! শিগগির জামাটা গায়ে দিয়ে এসো। বেলা পড়ে আসছে। এক্ষুণি আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।

    কোথায়? তিতলি আতঙ্কিত গলায় শুধোল।

    তিতলির মা নেই ক’দিন হল, লাতেহারে তিতলির এক চাচেরা ভাইয়ের অসুখ; তাই দেখতে গেছে। ও যে একা থাকবে!

    থাকুক। আমরা একঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব। পারলে, আরও তাড়াতাড়ি।

    কোথায় যাবে?

    যেতে যেতে বলব।

    তারপর তিতলির দিকে ফিরে বলল, দেরি হলে আজ তোদের এখানেই থেকে যাব তিতলি, রাতে। তাই-ই বলে এসেছি। আমরা আসছি। সাবধানে থাকিস।

    পুরো ব্যাপারটাই রীতিমতো রহস্যময়। কিন্তু টিহুল চুপচাপ। মুখ অত্যন্ত গম্ভীর। তাড়াতাড়ি পা চালালো ও আগে আগে।

    কয়েক মিনিট হেঁটে বললাম, নানকু খবর পাঠিয়েছে?

    উত্তর না দিয়ে টিহুল বলল, সামনে গাড়হাটা আছে, দেখবে। ফরেস্ট ডিপার্ট শালারা কী ভেবেছে বলো তো? যেখানে-সেখানে গর্ত করে রাখবে?

    নানকু কি একা? কী রে টিহুল? মরে গেছে নাকি? বল্‌ না?

    কয়েক মিনিট হেঁটে বললাম, নানকু খবর পাঠিয়েছে?

    নানকু নয়। সংক্ষেপে বলল টিহুল।

    তবে?

    আমরা যাচ্ছি মানির বাড়িতে।

    মানির বাড়িতে? কেন? মাহাতো কি আবার কোনো গোলমাল করেছে? নানকু কি মাহাতোকে খুন করেছে? নাকি, মুঞ্জরীকে টাঙ্গি দিয়ে কেটে ফেলেছে মানিই?

    না। না। সে সবও নয়। তাড়াতাড়ি চলতে চলতে টিহুল বলল।

    তবে কী? কী ব্যাপার বলবি তো?

    হঠাৎই পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে, টিহুল নিরুত্তাপ গলায় বলল, পরেশনাথ এবং বুলকি দুজনে একই সঙ্গে বৃষ্টির জল-ভরা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খোঁড়া গাড়হাতে ডুবে মারা গেছে কিছুক্ষণ আগে। তিতলি মা হবে শিগগিরি তাই ওকে সে খবরটা হঠাৎ দিতে চাইনি। পরে, ধীরে-সুস্থে সময় মতো দিও তুমি।

    এমন সময় দেখা গেল, টুসিয়ার ভাই লগন দৌড়তে দৌড়তে এদিকেই আসছে। আমাদের দেখেই সে কেঁদে উঠল হাঁউ-মাউ করে।

    বুঝলাম, ও খবর দিতে আসছিল আমাকেই।

    কথা না বলে, চলতে লাগলাম। আমাদের সঙ্গে লগনও চলতে লাগল। দেখলাম, ওর ছেঁড়া প্যান্টটা আর গেঞ্জিটা জলে চুপচুপে ভিজে রয়েছে। জল-ভেজা চুল। একেবারে ঝোড়োকাক!

    মুখ দিয়ে কথা সরছিল না আমার। কোনো রকমে বললাম, কী করে হল রে লগন?

    লগনকে দেখে মনে হল, তখনও ধাক্কাটা পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি। কাঁদতে কাঁদতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি তো সাঁতার জানিই। ওরা পাড়ে বসেছিল। আমি সাঁতার কাটছিলাম। বুলকি মাছ ধরবে বলেছিল নালায়। আমার সাঁতার কাটা হয়ে গেলে ওদের বললাম, নামিস না তোরা। ততক্ষণে পরেশনাথ নেমে পড়েছে হাঁটু জলে। বললাম, বহুত্ পানি পরেশনাথ, জদি উপর চড় যা। পরেশনাথ হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আমার মাথার ওপর দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে কী যেন দেখছিল। হঠাৎই চিৎকার করে উঠল, সিসি! দিদি! ফিন্ আয়া। আ গ্যয়া।

    বলতে বলতেই, সোজা হেঁটে আসতে লাগল আমারই দিকে। ভূতে পাওয়ার মতো আমি তখন গাড়হাটার মধ্যিখানে।

    আমি ডাকলাম, পরেশনাথ! পরেশনাথ!

    পরেশনাথ যেন আমার ডাক শুনতেই পেল না। এগিয়ে আসতে লাগল জলের মধ্যে হেঁটে হেঁটে। দু-পা এসেই ও হঠাৎ তলিয়ে গেল। পরেশনাথকে তলিয়ে যেতে দেখেই বুলকি চেঁচিয়ে উঠল, ভাইয়াঃ! ভাইয়াঃ বলে।

    সঙ্গে সঙ্গে সেও পরেশনাথকে খোঁজবার জন্যে জলে ঝাঁপাল। ব্যস্!

    তুই ওদের বাঁচাবার চেষ্টা করলি না কোনো?

    না! পারলাম না। আমাকেও কে যেন জলের নীচে টেনে নিয়ে যেতে লাগল খুব জোড়ে।

    কে? পরেশনাথ, না বুলকি?

    না না। ওরা কেউই নয়। ওরা আমার থেকে অনেকই দূরে ছিল। কোনো মানুষ নয়। জলের মধ্যে জলেরই দুটো হাতই যেন সাঁড়াশির মতো আমাকে চেপে ধরতে লাগল। কোনোরকম ভাবে আমি সাঁতরে পাড়ে উঠে, ওদের নাম ধরে খুব ডাকতে লাগলাম। ওরা কেউ উত্তর দিলো না। জলের ওপর বুড়িবুড়ি ভেসে উঠতে লাগল শুধু। আমি চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়তে লাগলাম। লীট্টিবাগে মগনলাল চাচা বয়েল নিয়ে মাটিতে চাষ দিচ্ছিল! তাকে বললাম। কিন্তু সেও সাঁতার জানে না। সে দৌড়ে ডেকে আনল জগদীশ চাচাকে ওর বাড়ি থেকে। জগদীশ-চাচাও নাকি সাঁতার জানে না। সাঁতার জানে শুধু বাবা। আমি বাড়ি অবধি দৌড়ে এসে, বাবাকে বললাম। বাবা আমার সঙ্গে গাড়হার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে আধঘণ্টা সময়েরও বেশি নষ্ট হয়ে গেল। বুড়ো হয়ে গেছে তো বাবা। বাবার সঙ্গে আমিও নামলাম।

    বাবা বলল, সাবধান, সাবধান, লগন, টুসি গেছে। তুই ছাড়া কেউ নেই আমাদের; অনেক ডুব জল সেখানে আমার। আর আমি তো ডুব সাঁতার জানি না। তাই-ই আমি পাড়ে উঠে এলাম।

    বাবা এক একবার ডুব দেয়, ওদের খোঁজে, আবার ওপরে ভেসে উঠে দম নেয়। লালমাটি-ধোওয়া ভারী জলে বাবার চোখ নাক বুজে আসতে লাগল। তবু বাবা বার বার ডুবে, প্রথমে বুলকিকে টেনে আনল চুল ধরে।

    আমি, কত ডাকলাম বুলকিকে। ওর গাল টিপে ডাকলাম, ওর দুচোখের পাতা মেলে ধরলাম বুলকি তবু কথা বলল না। তারও অনেকক্ষণ পরে পরেশনাথকে নিয়ে বাবা উঠল। পরেশনাথ অনেকক্ষণ মরে গেছিল। মগনলাল, আর জগদীশ চাচা বাবার সঙ্গে ওদের হাত পা ভাঁজ করতে লাগল আর খুলতে লাগল। ওদের দুজনের নাক মুখ দিয়ে জল বেরোতে লাগল। নাক বোধহয় কাদাতে বন্ধ হয়ে গেছিল। তারপর একসময় বাবা বলল, নাঃ। বেকার। সব বেকার। হায় রাম! বলে একবারও পিছনে না চেয়ে, বাড়ির দিকে চলে গেল। মগনলাল চাচা বুলকিকে আর জগদীশ চাচা পরেশনাথকে কাঁধে করে নিয়ে এল বুলকিদের বাড়িতে।

    আমরা ততক্ষণে মানির বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি।

    দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল! মানি ডাক ছেড়ে কাঁদছিল। সে কান্না শুনে পাথরেরও বুক ফাটে! আর আমরা তো মানুষ! বর্ষণসিক্ত বন-পাহাড়, লাল-মাটির পথকেও সেই কান্না দ্রব করে তুলছিল।

    মানি একবার পরেশনাথকে চুমু খাচ্ছে, আরেকবার বুলকির গালে হাত রাখছে আর কাটা-পাঁঠার মতো গড়াগড়ি যাচ্ছে মাটিতে। নিজের বুকে নিজে কিল মারছে, গাছের গুঁড়িতে মাথা খুঁড়ছে, নাক ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে মানিয়ার। আশ্চর্য! মুঞ্জরী একেবারেই চুপ। মাটিতে শুইয়ে রাখা ছেলেমেয়ের কাছেও যাচ্ছে না। পাথরের মতো স্থির হয়ে দূর থেকে তাদের দিকে চেয়ে আছে।

    আমি প্রথমেই গিয়ে বুলকি আর পরেশনাথের নাড়ি দেখলাম।

    মানি দৌড়ে এল। বলল, আছে নাকি? বেঁচে আছে? আমার পরেশনাথ? আমার বুলকি? একটু প্রাণও কি আছে? বাঁশবাবু?

    বলেই, হঠাৎ মানি আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। গাছের গোড়ায় ফেলে রাখা টাঙিটা তুলে নিয়ে বলল, ভুলেই গেছিলাম। তোরই জন্যে আমার এমন সর্বনাশ হল। তোর কথায়ই আমি গুহমন্ সাপের চামড়া ছাড়ালেম, তোর জন্যেই আমার বংশনাশ হল। আজ তোরা খোড়ি ফাড় দেবি, দো টুক্রা কর্। আয়। আয়। এবার তোকে দেখি আমি। বেজাত, আমাদের মেয়েকে বিয়ে করে পাপ করলি শালা। বাবু হয়ে আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেলি। তুইই তো নষ্টের গোড়া! আয়! আয়, বিট্‌চোদোয়া! তোর আজ শেষ দিন!

    বস্তির চারপাঁচজন লোক দৌড়ে গিয়ে মানির সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে ওকে মাটিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে, ওর হাত থেকে টাঙিটা কেড়ে নিল। মানি শুয়ে শুয়েই বলতে লাগল, কোথায় যাবি তুই দেখব! কোথায় পালাবি তুই? তোর রক্তে আমি চান করব। না করলে, আমার পরেশনাথ, আমার বুলকি আমাকে ক্ষমা করবে না। বুলকিয়া- আ-আ-আ-আ-রে, এ-এ-এ-এ। মেরি লাল, মেরি বেটা; পরেশনাথ-আ- আথ-থ!

    মানির মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না আমি। চোখ নামিয়ে, দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার হাঁটু দুটো থরথর করে কাঁপছিল।

    মুঞ্জরী, এত কাণ্ডতেও চোখের ভুরু পর্যন্ত তুলল না। একদৃষ্টে ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়েই রইল। মানির দিকেও তাকালো না একবারও। ও যেন অন্য কোনো দেশে চলে গেছে। এ পৃথিবীর সঙ্গে ওর যেন কোনো সম্পর্কই নেই আর।

    একে একে বহু লোক আসতে লাগল। প্রত্যেকেই কাঁদতে লাগল। আর আমি খুনি আসামির মতো এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। গোদা শেঠও কাঁদছে দেখলাম। এমন সময় মাহাতো এল। আশ্চর্য। তার চোখেও জল। কিছুক্ষণ চুপ করে সব দেখেশুনে মুঞ্জরীর কাছে গিয়ে কী যেন বলতে গেল। মুঞ্জরী যে মাহাতোকে আদৌ চেনে, তা তার চোখ দেখে মনে হল না। তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মুঞ্জরী তার কাপুরুষ, মাতাল, জড়পদার্থ স্বামী, যাকে সে কতদিন চড়, কিল, ঘুষি মেরেছে, লাথি মেরেছে, সেই মানিরই একেবারে কাছে মানির দুপায়ের ওপর সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। অপদার্থ, অযোগ্য মাতাল মানি উঠে বসে ওর স্ত্রীর মুখটা দুহাতে ধরল, কত যুগ পরে, বড়ো সোহাগে। মনে হল, যেন আদর করবে ও। তারপরই, এত লোকের সামনে তার বিবাহিতা স্ত্রীকে, তার সন্তানের জননীকে, চুমু খেল। মানি আর মুঞ্জুরীর চোখের জল, দুজনের মুখে-নাকে মাখামাখি হয়ে গেল।

    এত কষ্ট, এত, এত কষ্ট। তবু এদেরই কোলের দুটি শিশুকে একই সঙ্গে এমন করে ছিনিয়ে নেবার দরকার কী ছিল? কে সেই যমদূত? যে এমন নিষ্ঠুর? কে সেই ভগবান, এই মানুষগুলোর তো বটেই, আমারও যার শুভবোধে একধরনের বিশ্বাস ছিল? কে এদের এমন নিঃশেষে সর্বস্বান্ত করতে পারে, এমনিতেই যারা এমন নিঃস্ব! বড় অন্যায় এ। বড় পাপ! বড় কাণ্ডজ্ঞানহীন হে, তুমি ভগবান!

    সকলে তাড়াতাড়ি ঠিক করল, কাল খুব ভোরে বুলকি আর পরেশনাথকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হবে নিদিয়া নদীর পাড়ের শ্মশানে। এখন গেলে, শ্মশান থেকে ফিরতে রাত হয়ে যাবে অনেক। তাছাড়া শ্মশানের পথও গভীর নির্জন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। শ্মশানযাত্রীরা সকলে ফিরে নাও আসতে পারে শয়তানটার জন্য। এই ছোট্ট ভালুমারের মানুষরা শোনচিতোয়ার অভিশাপে অল্প কিছু দিনের মধ্যে অনেকই মৃত্যু দেখেছে। মৃত্যুতে তারা এখন অভ্যস্ত। কিন্তু একই সঙ্গে দুটি ভাই-বোনের মৃত্যু ভালুমারের আবালবৃদ্ধবনিতাকে স্তব্ধ, বোবা করে দিয়ে চলে গেল।

    সকলে মিলে ধরাধরি করে, যারা এক ঘণ্টা আগেও উচ্ছ্বল উদ্বেল ছিল; সেই বুলকি আর পরেশনাথের প্রাণহীন দেহ বয়ে, মানির ঘরের মধ্যে নিয়ে এল। বলল, আমরা কাল সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আসব। বুলকিকে নতুন শাড়ি পরিয়ে দিও আর পরেশনাথকে নতুন জামা-প্যান্ট।

    গোদা শেঠ বলল, রঘু শেঠের দোকান খুলিয়ে আমিই নিয়ে আসব। নিজেই নিয়ে আসব।

    জগদীশ আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ফিফিস্ করে বলল, গোদা শেঠের আট বছরের ছেলে মারা গেছিল সাপের কামড়ে অনেক দিন আগে।

    সন্ধে হয়ে এল প্রায়। মানি মুঞ্জরীর ঘরে গ্রামের অনেক পুরুষ ও নারী থাকতে চেয়েছিল ওদের সঙ্গ দেবার জন্যে আজ রাতে। কিন্তু মানি বলেছিল, কাল আমার মেয়ে চলে যাবে। নইহার ছুট্ যাওয়া নয়-এ। বরাবরের মতো ছুটি নিয়ে চলে যাবে বাবা-মাকে ছেড়ে। আর পরেশনাথ যাবে এমন এক দেশে, যেখানে কোনো দুঃখ নেই, যেখানে শুখা-মহুয়া চিবিয়ে খেয়ে আর কান্দা-গেঁঠি খুঁড়ে বাঁচতে হয় না শিশুদের। ওর বাবা-মাকে চিরদিনের মতো ছেড়ে যাবে ও। না। আজ ওরা আমাদের কাছে থাকবে। আমাদের পাশে শুয়ে থাকবে। অনেক কথা বাকি আছে ওদের সঙ্গে আমাদের। শ্বশুরবাড়িতে কেমন ব্যবহার করতে হয় তাও তো জানে না আমার মেয়ে। বড়ো, ছোটো যে এখনও ও! ছেলেও জানে না, নতুন দেশের ফসলের নাম।

    না! তোমরা সকলে যাও। আমাদের বিরক্ত কোরো না আর। আয়রে পরেশনাথ। বুলকিয়ারে-এ-এ-এ-এ…

    আস্তে আস্তে ভিড় পাতলা হয়ে এল। পশ্চিমে সূর্য ঢলছে। পুবে সারিবদ্ধ ঘনসন্নিবিষ্ট গাছেদের ছায়া দ্রুত দীর্ঘতর হচ্ছে। সন্ধে আসছে। আর আসছে সন্ধের অন্ধকারে থাবা গেড়ে বসে শয়তান শোনচিতোয়াটার ভয়।

    মৃত্যুর মধ্যে মৃত্যু।

    বড় বড় পা ফেলে একা একা বনপথ দিয়ে ফিরে আসছিলাম। চিতায় কাঠ পুড়লে যেমন ফুটফুট্ আওয়াজ হয়, তেমন ফুটফুট করে মানি-মুঞ্জরী নিজেদের ঘরের মধ্যে বসে কথা বলছিল। আমি ভাবছিলাম, মৃত্যুর মতো বড়ো সত্য আমাদের জীবনে বোধহয় আর নেই। মৃত্যুর এ রূপ দেখে বড় ভয় হল। এখনও আমি বাবা হইনি। মানি-মুঞ্জরীকে চোখের সামনে দেখে বাবা হওয়ার ইচ্ছা আমার আর একটুও নেই। মানুষ নিজের কষ্ট সহ্য করতে পারে। সব কষ্ট। কিন্তু আত্মজ, আত্মজাকে, ফুলের মতো শিশুদের, এমন করে ভাসিয়ে দেওয়া?

    যাবেই যদি? তবে এরা আসে কেন?

    যারা এক অভাগা আর এক অভাগীকে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিল আজ সন্ধেতে তাদের মধ্যেও কাউকে যদি শোনচিতোয়াটা নেয় তাহলে বলতে হবে যে, চিতাটা ভগবানের সৃষ্ট জীব আদৌ নয়। সত্যিই কোনো শয়তানের বাহন সে। ভগবান, এমন করে তার অন্ধ বিশ্বাসে ভর করে যারা থাকে, যদি তাদের আঘাত দেন, তাহলে তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সত্যিই সন্দেহ জাগে মনে

    আমার আওয়াজ পেয়েই তিতলি দৌড়ে এল লণ্ঠন নিয়ে। ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করল। আমার দিকে চেয়ে বলল, কী হয়েছে? তোমার? চা আনি?

    না।

    আমার মুখ চোখ লক্ষ করে ও বলল, কী হয়েছে বল? বলেই, আমার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসল।

    সাপের চামড়া ছাড়ালে যে বংশনাশ হয় একথা জানলি কী করে?

    কেন? বংশনাশ? কার বংশনাশ?

    বুলকি এবং পরেশনাথ। দুজনেই। দুজনেই একই সঙ্গে জলে ডুবে মারা গেছে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের খোঁড়া গড়হার জলে। মা-বাবা হওয়া যে এত কষ্টের তা আগে জানলে…

    তিতলি একটি অতর্কিত আর্তনাদ করে আমার দু-হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

    এখন অনেক রাত। তিতলি কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। চা তো দূরের কথা কোনো কিছুই খাওয়ার মতো মানসিক অবস্থা আমাদের কারোই ছিল না। পরেশনাথটা, আজ সকালেই নাচতে নাচতে গেছিল। ‘মাহাতো-বাবা আসবে’ বলতে বলতে।

    আমি তো লেখাপড়া শিখেছি! মানি মুঞ্জরী, জগদীশ, মগনলাল, টিহুল, এদের মতো অশিক্ষিত তো আমরা নই। শিক্ষিত মানুষরা আবেগের, শোকের বহিঃপ্রকাশকে হেয় করেন। কিন্তু শিক্ষিত হলেই তো মানুষ তার স্বাভাবিক ধর্মকে কবর দিতে পারে না। আবেগ যার নেই, সে কি মানুষ? যতই শিক্ষা তার থাক না কেন। আমি কেন চোখের জল সামলাতে পারিনি? কেন গোদা শেঠ বা মগনলালের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারিনি এই শোকে? কী জানি? কিন্তু ভাগ্যিস পারিনি! যে শিক্ষা, মানুষকে ভগবান বা ভূতে পর্যবসিত করে, তেমন শিক্ষার প্রয়োজন অন্তত আমার নেই।

    কেঁদে কেঁদে তিতলির মুখ-চোখ ফুলে গেছে। আমি ফুঁপিয়ে কাঁদিনি। কিন্তু সম্পূর্ণ অপারগতায় এখনও দুচোখ বয়ে জলের ধারা বইছে আমার। মানি-মুঞ্জরীর দুঃখে, ওদের চোখের জলে ওদেরই সমান হয়ে গেছি।

    শোকের মতো, এত বড় সাম্যবাদ; বোধহয় আর কিছুই নেই।

    খুব জোর বৃষ্টি এল একপশলা। যেমন হঠাৎই এল তেমন হঠাৎই গেল। বাইরে এমন একটানা ব্যাঙ আর ঝিঁঝি ডাকছে। হাতিরা বোধহয় মীরচাইয়াতে জলকেলিতে নেমেছে। তাদের বৃংহনের শব্দে রাতের বৃষ্টি ভেজা বনপাহাড় চমকে চমকে উঠছে বার বার! বৃষ্টি থামলে আকাশ একেবারে পরিষ্কার হয়ে গিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ বেরোল চরাচর উদ্ভাসিত করে। ঝকঝক করছে এখন চারদিক। কে বিশ্বাস করবে, এই সুন্দর পৃথিবীতে এত কষ্ট আছে? এই মুহূর্তে দুটি শিশুর শক্ত হয়ে যাওয়া ফুলে ওঠা

    মৃতদেহ বুকে করে মানি আর মুঞ্জরী শেষ রাতের মতো তাদের অনেক অনাদরের সন্তানদের আদর করছে, তাদের নিঃশব্দ, নিথর অভিমানী মুখ দুটির ওপর ঝুঁকে পড়ে। ওরা নিজেরাই শিশু হয়ে গিয়ে দেয়ালা করছে বিধাতার সঙ্গে এখন। বড় দুর্বোধ্য সে দেয়ালা! এই মুহূর্তেই, এই চন্দ্রালোকিত ভালুমারেরই কোনো কোণে, অন্যায় আর অশুভর প্রতীকের মতো শয়তান শোনচিতোয়াটা তার নখ-লুকোনো কালো থাবার থাপ্পড়ে আলোকে গুঁড়িয়ে অন্ধকার করে দিচ্ছে। মৃত্যুই সব ভরন্ত জীবনের অমোঘ, রিক্ত পরিণতি, এই সত্য তার শরীরের কালো নিঃশব্দ ছায়ার চলমান বিজ্ঞাপনে দিকে দিকে বিজ্ঞাপিত করেছে। নিদিয়া নদীর পাড়ের শ্মশানে এখন শকুনরা সভা বসিয়েছে।

    আজকের রাতেই শ্রাবণী পূর্ণিমা। শ্রাবণ গিয়ে ভাদ্র আসবে। ভাদ্রর পরই আসবে আশ্বিন। দেখতে দেখতে আসবে কোজাগরী পূর্ণিমা। নানকুর মায়ের মৃত্যুদিন। এই বিরাট দেশের আনাচে-কানাচে এবং এই দেশেরই এক ছোট্ট অখ্যাত ঘুমন্ত পাহাড় বনের গ্রাম, এই ভালুমারের অণুপরমাণুতে অঝোর ধারে ঝরবে ভরা চাঁদের দুধ-ঝিনুকের নরম আলো।

    যে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে দু ভাই বোন পরেশনাথ আর বুলকি শর্টকাট করে আসতে-যেতে পায়ে চলা পথের সৃষ্টি করেছিল, তা তখন সবুজ ঘাসে ঢেকে যাবে। আলো ঝরবে তার ওপরেও। পরের বছর শীতে আবারও সরগুজা বা অন্য ফসল লাগাবে সেখানে মানি ও মুঞ্জরী। সমস্ত ক্ষেত ফসলে ভরে যাবে। সেই দিকে চেয়ে মুঞ্জরীর জরায়ু টনটন করে উঠবে। কিন্তু সেই ক্ষেতে আর পায়ের চিহ্ন পড়বে না দুটি নিষ্পাপ শিশুর। ওদের বাবা-মাও ভুলে যাবে একদিন, অনেকই গালাগালি-খাওয়া সেই দুটি শিশুর পায়ের চিহ্ন বুকে করা সেই পথের কথা।

    কোজাগরী রাতে কারো ঘরে নবজাত শিশু কাঁদবে কচি গলায়। গোবর আর গরুর গায়ের গন্ধ মিশে যাবে শরতের বনের গায়ের গন্ধর সঙ্গে। পেটে খিদে নিয়ে, অনেক মানুষ শব্দ করে পাশ ফিরবে ঘুমের মধ্যে। কোনো ঘরে, পুরুষ আদর করবে নারীকে, অস্থিসার বৃদ্ধ দীর্ঘ হাই তুলবে নিদ্রাহীন রাতে সারা জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে, মহুয়াতলীর লোম উঠে-যাওয়া চলচ্ছক্তিহীন অসহায় বৃদ্ধ শম্বরের মতো।

    শোনচিতোয়াটা হয়তো সেদিনও ঘুরবে, ছায়ায় ছায়ায়।

    শুধু শয়তানেরই মৃত্যু নেই। মৃত্যু, শুধু বিবেক, শুভ বোধ নিরপরাধেরই জন্যে। ততদিনে মাহাতো আর গোদা শেঠ আবারও তাদের স্বমূর্তি ধারণ করবে। তাদের স্বধর্ম দখল নেবে তাদের ওপর।

    না মরলে; মানুষের স্বভাব যে যায় না।

    ভালুমারের সকলেই আবারও মাথানীচু করে তাদের সবাইকে মেনে নেবে।

    মানুষ যদি নিজের মাথা নিজে না উঁচু করে, সম্মানিত না করে নিজেকে; তবে অন্য কেউই তাকে উন্নতমস্তক, সম্মানিত করতে পারে না। যার যার মুক্তি তার তার বুকের মধ্যেই বয়ে বেড়ায় মানুষ। সেই প্রচণ্ড শক্তিকে সে নিজে যত দিন না মুক্ত করছে, ততদিন কারোরই সাধ্য নেই তাকে মুক্ত করে।

    সম্মানেরই মতো; মুক্তিও ভিক্ষা পাওয়া যায় না।

    বুলকি আর পরেশনাথের জন্যে এই ভালুমারের আমাদের সকলের চোখের জল, সব সমবেদনা, সমস্ত হঠাৎ-ঔদার্য যে চরম মিথ্যা তা প্রমাণ করে মানি ও মুঞ্জরী আবারও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে খিদেয় জ্বলতে জ্বলতে অশক্ত শরীরে নিজেদের ধিক্কার দিতে দিতে, নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করতে করতে বুনো শুয়োর আর শজারুদের সঙ্গে লড়াই করে কান্দ-গেঁঠি খুঁড়ে খাবে। আবারও মাতাল হয়ে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে করতে মানি বাড়ি ফিরবে হাট থেকে; যে বাড়িতে, বাবা বলে তাকে আর কেউ ডাকবে না কোনোদিন।

    মানুষের জীবনে বোধ হয় অনেকই ধরে। অনেক আঁটে। আনন্দ, দুঃখ, উৎসব, শোক, মহত্ত্ব নীচতা সব, সব।

    এই সমস্ত কিছু নিয়েই, ভরে তুলে; আবারও ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে দিতেই তো আমাদের মতো নগণ্য সাধারণ সব মানুষদের বেঁচে থাকা! আমাদের কাছে, এর নাম জীবন। শুধুই প্রশ্বাস নেওয়া; আর নিশ্বাস ফেলা। ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং সুখ-দুঃখের ওপরে আমরা তো কোনোদিনও উঠতে পারি না! আর, পারি না বলেই হতাশ নিশ্চেষ্টতায় এই দুঃখময় রাতেও আমরা ঘুমোই, ঠান্ডা রক্তের সরীসৃপের মতো। পরম আশ্লেষে, কুণ্ডলী পাকিয়ে।

    একটু পরে আমি নিজেও ঘুমোব, নিজের ছোট্ট সুখের ছোট্ট ঘরে, আমার যুবতী, গর্ভিণী স্ত্রীর মসৃণ শরীরে হাত রেখে।

    জাগে না কেউই। এ দুঃখরাতে, এ দেশে; এ যুগে।

    না কি? কেউ জাগে?

    কে জাগে?

    ***

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঋজুদা সমগ্ৰ ৫ – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article লবঙ্গীর জঙ্গলে – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }