Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গুহামানবী – আফজাল হোসেন

    লেখক এক পাতা গল্প231 Mins Read0
    ⤷

    রূপান্তর

    এক নবদম্পতি। রায়হান আর পলি।

    রায়হান একটা বেসরকারি ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার। আটটা-পাঁচটা অফিস। কাগজে-কলমে আটটা-পাঁচটা হলেও অফিস থেকে বেরোতে ছ’টা-সোয়া ছ’টা বেজে যায়। বাসায় ফিরতে-ফিরতে সাতটা-সোয়া সাতটা।

    অফিস থেকে বেরিয়ে রায়হান সরাসরি বাসায় চলে আসে। নতুন বউকে একলা ঘরে ফেলে বাইরে সময় কাটাতে তার মোটেই ভাল লাগে না। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় চলে আসে।

    .

    রায়হান বাসায় ফিরে গোসল করতে ঢুকেছে। অনেকক্ষণ ধরে গোসল শেষে বাথরুম থেকে বাইরে বেরোল। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে-মুছতে তাদের বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় এল, ভেজা তোয়ালেটা বারান্দার তারে মেলে দিতে। বারান্দায় এসে দেখে পলি বারান্দার গ্রিল ধরে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। পলির ঘন কালো চুলগুলো পিঠের উপর ছেড়ে দেয়া। ঝিরঝিরে বাতাসে রেশমি চুলগুলো অল্প-অল্প উড়ছে।

    পলিকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রায়হানের মনটা রোমান্টিক হয়ে উঠল। সে পা টিপে-টিপে গিয়ে পিছন থেকে পলিকে জড়িয়ে ধরল।

    পলি চমকে উঠে বলল, ‘এই, কী হচ্ছে?!’

    রায়হান পলির গালে গাল ঘষতে ঘষতে গাঢ় স্বরে বলল, ‘আমার সোনা বউটার কি মন খারাপ?

    পলি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আরে! তুমি এ কী করছ! রাস্তার লোকজন দেখবে যে!’

    এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। পলি বলল, ‘যাও, গিয়ে দেখো, কে আবার এল।’

    রায়হান তোয়ালেটা কাঁধের দু’পাশ থেকে গায়ের উপর ফেলে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলে কপাট মেলতেই সে যেন আকাশ থেকে পড়ল।

    কারণ, দরজার সামনে যে দাঁড়ানো সে আর অন্য কেউ নয়, তার স্ত্রী পলি। এতক্ষণ যে তার সঙ্গেই বারান্দায় ছিল।

    রায়হান চোখ বড়-বড় করে বুজে আসা গলায় তোতলাতে- তোতলাতে কোনওক্রমে বলল, ‘তু-তু-তু-তুমি?!’

    পলি রায়হানের চেহারা দেখে অবাক হওয়া গলায় বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?! এমন চমকে গেছ কেন?! যেন ভূত দেখছ?!’

    রায়হান আগের মত তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘তুমি না এই মাত্র আমার সঙ্গে শোবার ঘরের বারান্দায় ছিলে?! এখানে এলে কী করে?!’

    পলি বিরক্তি ভরা গলায় বলতে লাগল, ‘কী যে আবোল- তাবোল বকছ! শোবার ঘরের বারান্দায় আমি আসব কোত্থেকে?! তুমি যখন বাথরুমে আমি তো তখন মোড়ের দোকানটা থেকে নুডল্স্ আর ডিম আনতে গিয়েছিলাম। তোমাকে চায়ের সঙ্গে দেবার মত ঘরে কিছু ছিল না। তাই ভাবলাম মোড়ের দোকানটা থেকে কিছু একটা নিয়ে আসি। ততক্ষণে তোমার গোসল শেষ হোক। যাওয়ার সময় দরজার নবটা ভিতর থেকে লক করে যাই।’

    রায়হান পলকহীন অবিশ্বাসী চোখে কিছুক্ষণ পলির দিকে তাকিয়ে রইল। যেন তার পলির কোনও কথাই বিশ্বাস হয়নি। এরপর আগের মত বুজে আসা গলায় বলল, ‘তা হলে বারান্দায় কে?!’

    পলি রায়হানকে পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল, ‘কই, দেখি তো বারান্দায় কে?!’

    পলির পিছু-পিছু রায়হানও তাদের শোবার ঘরের বারান্দায় চলে এল। বারান্দায় কেউ নেই। বারান্দার তারে শুকাতে দেয়া পলির এক সেট সালোয়ার-কামিজ দেখা যাচ্ছে।

    রায়হান ভীষণ আশ্চর্য হওয়া গলায় বলল, ‘বিশ্বাস করো, একটু আগে তুমি এখানেই ছিলে!’

    পলি মৃদু হেসে বলল, ‘তোমার মাথাটাই বোধ হয় গেছে। আজ অফিসে কি খুব কাজের চাপ গেছে?’

    রায়হান ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল। সত্যিই কি তার মাথাটা গেছে?! সারাক্ষণই পলির কথা ভাবে বলে বারান্দার তারে শুকাতে দেয়া পলির সালোয়ার-কামিজ দেখেই কি সে পলিকে ভেবেছে?

    পলি বলল, ‘ভেজা তোয়ালে গায়ে আর দাঁড়িয়ে না থেকে, শুকনো পোশাক পরে বসার ঘরে এসো। তোমার জন্য চা আর নুডল্স্ করে আনছি।

    রায়হান শুকনো পোশাক পরে, চুল আঁচড়ে, পরিপাটি হয়ে বসার ঘরে এসে বসল। রিমোট টিপে টিভিটা অন করে দিল। চ্যানেল পাল্টে খবরের একটা চ্যানেল ধরল। আজও হরতালে ব্যাপক হানাহানি হয়েছে। যাত্রীবাহী বাসে পেট্রল বোমা মেরেছে। এগারোজন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। এদের মধ্যে চারজন মারা গেছে। বাকি সাতজনের মধ্যেও তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সরকার এবং বিরোধী দল যে যার অবস্থানে অনড়। কোনও সংলাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

    খবর দেখতে-দেখতে রায়হান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দেশটা যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, দেশের অর্থনীতি যে ভেঙে পড়ছে, সাধারণ জনগণ কষ্ট পাচ্ছে, পুড়ছে, মরছে-তা নিয়ে কোনও মাথা ব্যথাই নেই রাজনীতিবিদদের। তাঁদের চাই শুধু ক্ষমতা। ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা।

    এমন সময় পলি চা নিয়ে এল। চায়ের সঙ্গে গরম ধোঁয়া ওঠা পিঁয়াজু আর বেগুনী।

    পলি ট্রে থেকে চায়ের কাপ আর পিঁয়াজু-বেগুনীর প্লেট নামিয়ে রায়হানের সামনে পরিবেশন করতে-করতে বলল, ‘গোসল করে বেরোতে তোমার এত সময় লাগল?! নাও, তাড়াতাড়ি গরম-গরম খেয়ে নাও।’

    রায়হান বলল, ‘তুমি না বললে আজ নুডল্স্ করবে? এখন দেখি পিঁয়াজু আর বেগুনী করেছ?’

    পলি অবাক হয়ে বলল, ‘কখন আবার তোমাকে বললাম আজ নুডল্স্ করব?! এ ছাড়া ঘরে নুডল্‌স্ তো নেইও।’

    রায়হান বলল, ‘একটু আগেই না তুমি মোড়ের দোকানটা থেকে নুডল্স্ আর ডিম আনলে!’

    পলি বলল, ‘কী যে বলো, তুমি গোসলে ঢোকার পর থেকেই তো আমি রান্নাঘরে। রান্নাঘরে বসে পিঁয়াজু আর বেগুনী ভাজছিলাম। নুডল্‌স্‌ আনতে যাব কখন!’

    রায়হান বিস্ময়ে বিমূঢ় হওয়া অস্ফুট গলায় বলল, ‘তা হলে একটু আগে বাইরে থেকে ডিম আর নুডল্স্ নিয়ে কে এল?! তার আগে শোবার ঘরের বারান্দায়ই বা কাকে দেখেছি?!’

    পলি বিরক্ত হওয়া গলায় বলল, ‘তোমার কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝছি না! একবার বলছ, আমি বাইরে থেকে এসেছি। আবার বলছ, শোবার ঘরের বারান্দায় ছিলাম। কী উল্টা-পাল্টা বকছ?!’

    রায়হান পলিকে শুরু থেকে সবটা শোনানোর পর চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি নিশ্চিত, তুমি বাইরে থেকেও আসনি বা বারান্দায়ও ছিলে না?’

    পলি গলায় জোর দিয়ে বলল, ‘না, পুরো সময়টাই আমি রান্নাঘরে ছিলাম। পিঁয়াজু-বেগুনী এসব অল্প আঁচে একটু সময় নিয়ে ভাজলে বেশি স্বাদ হয়।’

    রায়হান বসে যাওয়া গলায় বলল, ‘তা হলে আমার সঙ্গে এসব কী হলো?! আমি তোমার মত কাদের দেখতে পেয়েছি?! নাকি আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?’

    পলি বলল, ‘তুমি বোধ হয় আজ খুব ক্লান্ত। যা গরম পড়েছে! সেজন্যেই হয়তো উল্টো-পাল্টা দেখছ। চা-টা খেয়ে একটু রেস্ট নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

    দুই

    মাঝ রাত।

    দুঃস্বপ্ন দেখে রায়হানের ঘুম ভেঙে গেল।

    স্বপ্নে রায়হান একটা খোলা মাঠের মধ্যে নিজেকে পেয়েছে। দিগন্তছোঁয়া বিশাল বিস্তৃত এক মাঠ। আকাশে কালো মেঘ জমেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। একটু বাদেই রায়হান বুঝতে পারল-খোলা মাঠটা জুড়ে শুধু সারি-সারি কবর। যতদূর চোখ যায় শুধু কবর আর কবর। লক্ষ-লক্ষ কবর যেন সেখানে। তার গা ছমছম করে ওঠে। দুরু- দুরু বুকে সে সামনে এগোতে শুরু করে। মনের ভিতর তাগিদ অনুভব করে যত দ্রুত সম্ভব তাকে এ জায়গা থেকে চলে যেতে হবে। এখানে অশুভ কিছু আছে!

    সে ক্রমেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। লম্বা-লম্বা পা ফেলতে থাকে। কিন্তু পথ যেন ফুরোবার নয়। যদ্দূর চোখ যায় শুধু ধু-ধু প্রান্তর।

    চলতে-চলতে একসময় প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। সেই সঙ্গে ঘন- ঘন বাজ পড়তে থাকে। ঝড়ো হাওয়ায় কবরগুলোর উপরের শুকনো ধুলো-মাটি ঘূর্ণির মত হয়ে উড়তে আরম্ভ করে। কয়েক মুহূর্তে সমস্ত জায়গাটা ঘন ধুলোর মেঘে ঢাকা পড়ে। যেন মরুভূমির বালুঝড়। চোখের সামনে ধুলোর মেঘ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। রায়হান ধুলোর ঝাপটা থেকে চোখ-মুখ রক্ষা করতে দু’হাতে সমস্ত মুখ আগলে ধরে।

    ধীরে-ধীরে ঝড়ের তীব্রতা কমে আসে। বড়-বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামে। রায়হান মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলে তাকায়। এ কী কাণ্ড! প্রত্যেকটা কবর খুলে গেছে! ঝড়ো হাওয়া প্রত্যেকটা কবরের উপরের মাটি উড়িয়ে নিয়েছে। এখন কবরের ভিতরে সাদা কাফনে মোড়ানো ধুলোমাখা লাশগুলো দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি লাশগুলোর গায়ের ধুলো ধুয়ে নিচ্ছে।

    কী আশ্চর্য! সাদা কাফনে পেঁচানো লাশগুলো এক-এক করে সব উঠে বসছে! এরপর হামা দিয়ে কবর থেকে বেরিয়ে আসছে। লাশগুলো রায়হানকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে আসছে।

    ভয়ে রায়হানের সমস্ত শরীর জমে গেল। সে এক পা-দু’পা করে পিছিয়ে যেতে থাকল। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হলো না। সামনে-পিছনে চারদিক দিয়ে লক্ষ-লক্ষ লাশ তার দিকে এগিয়ে আসছে।

    হামা দিয়ে এগিয়ে আসা লাশগুলোর মুখ থেকে এক পর্যায়ে কাফনের কাপড় খুলে পড়ল। চেহারা দেখা গেল। সবগুলো লাশের একই চেহারা। পরিচিত চেহারা! তার স্ত্রী পলির চেহারা! রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ। শুকনো কালো ঠোঁট। রক্ত জমা লাল চোখ।

    ক্রমেই লাশগুলো চারদিক দিয়ে তাকে ঘিরে ধরল। আর একসঙ্গে সম্মিলিত স্বরে টেনে-টেনে বলতে লাগল, ‘আমাদের তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমরা তোমার স্ত্রী। আমরা তোমার স্ত্রী। আমরা তোমার…’

    এমন মুহূর্তে উত্তেজনায় হাঁপাতে-হাঁপাতে রায়হানের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে বেশ কিছুক্ষণ গেল ধাতস্থ হতে। ঘরে লাল রঙের ডিম বাতি জ্বলছে। ডিম বাতির আলোতে তার পাশে ঘুমন্ত পলিকে দেখা যাচ্ছে। পলি তার থেকে অন্য দিকে মুখ করে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। একবার ভাবল পলিকে জাগিয়ে দুঃস্বপ্নের কথা বলবে। আবার ভাবল, না, থাক, কী দরকার একটা ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে শুধু-শুধু বিরক্ত করার।

    রায়হান বিছানা থেকে উঠে বসল। খুব পিপাসা লেগেছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। খাবার ঘরে গিয়ে পানি খাবে।

    রায়হান বিছানা থেকে নেমে খাবার ঘরের দিকে যাবে এমন সময় লাগোয়া বাথরুমে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পেল। যেন বাথরুমে কেউ আছে!

    রায়হান খাবার ঘরের দিকে না গিয়ে বাথরুমের সামনে গেল। বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। এখন সে নিশ্চিত বাথরুমের ভিতর কেউ রয়েছে। কিন্তু কে সে?! ঘরে দু’জন মাত্র মানুষ, পলি আর সে, পলি বেঘোরে ঘুমোচ্ছে-তা হলে বাথরুমে কে?! চোর- টোর এসে ঢুকল নাকি! সে জেগে ওঠায় চোরটা হয়তো বাথরুমে লুকিয়েছে।

    রায়হান বাথরুমের দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বুজে আসা ভীত গলার স্বর যতটা সম্ভব তুলে বলল, ‘এই, কে, কে বাথরুমে?’

    দরজা খুলে গেল। দেখা গেল পলিকে। পলি স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কী, বাথরুমে যাবে?’

    রায়হান বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ পলির দিকে তাকিয়ে থেকে ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে বিছানার দিকে তাকাল। বিছানায় ঘুমন্ত পলিকেও দেখা যাচ্ছে। বাথরুমের ভিতরে একটা পলি, বিছানায় ঘুমন্ত আরেকটা পলি-এটা কী করে সম্ভব?!

    রায়হান ভীত-সন্ত্রস্ত মুখে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তার সামনে দাঁড়ানো বাথরুমের ভিতরের পলির দিকে তাকাচ্ছে, আবার বিছানায় ঘুমন্ত পলির দিকে তাকাচ্ছে-তাই দেখে পলি অবাক হওয়া গলায় বলল, ‘তুমি এমন করছ কেন?! কী হয়েছে?!’

    রায়হান থতমত খাওয়া গলায় বলল, ‘তুমি বাথরুমে, তা হলে বিছানায় ঘুমাচ্ছে কে?!’

    পলি বলল, ‘কই, দেখি তো-কে বিছানায় ঘুমাচ্ছে?!’

    পলি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। বিছানায় কেউ নেই। পলি ভুরু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বলল, ‘কোথায়, কেউ তো বিছানায় নেই। তোমার যে আজকাল কী হয়েছে!’

    রায়হান বলল, ‘বিশ্বাস করো, তোমার মত দেখতে কে যেন বিছানায় ছিল।’

    পলি অসহিষ্ণু গলায় বলল, ‘এখন তা হলে কোথায় গেল?’

    রায়হান ক্লান্ত গলায় বলল, ‘জানি না!’

    পলি বলল, ‘এসো তো, এখানে ফ্যানের নীচে একটু বসো। মাথাটা ঠাণ্ডা করো।’

    পলি আর রায়হান দু’জন বিছানার উপর পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে বসল। পলি রায়হানের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে খুলে বলো তো আমায়। অফিসে কোনও ঝামেলা চলছে?’

    রায়হান শান্ত গলায় বলল, ‘না।’

    ‘তা হলে?’

    ‘আজ তোমাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটা কী যে ভয়ঙ্কর…’

    পলি রায়হানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রশ্ন করে উঠল, ‘কী দুঃস্বপ্ন দেখেছ? আমি মরে গেছি?’

    রায়হান কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকার পর পুরো স্বপ্নটা বিস্তারিতভাবে বলল। বলা শেষ হলে পলি হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘তোমার উচিত, অফিস থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে আসা। তা হলেই সব ঠিক হয়ে যেত। এমন দুঃস্বপ্নও দেখতে না আর আমাকেও দুটো-তিনটে করে দেখতে না। খুব ঘুম পাচ্ছে, এসো শুয়ে পড়ি।’

    রায়হান বলল, ‘আমার খুব পিপাসা লেগেছে। খাবার ঘর থেকে পানি খেয়ে আসছি। তুমি শুয়ে পড়ো।

    রায়হান খাবার ঘরে এসে পর-পর দু’গ্লাস পানি ঢেলে খেল। খাবার ঘরের ওপাশেই বসার ঘর। বসার ঘর থেকে টিভি চলার মৃদু শব্দ কানে আসছে। রায়হান ভাবল, রাতে শোবার আগে ভুলে কি টিভিটা অন রেখেই তারা বসার ঘর থেকে চলে এসেছিল?

    রায়হান বসার ঘরে ঢুকে ভয়ানক চমকে উঠল। বসার ঘরের সোফায় বসে, রিমোট হাতে পলি টিভি দেখছে। পলির সামনে খালি চায়ের কাপ।

    রায়হানকে দেখে পলি বলল, ‘কী, তোমারও ঘুম ভেঙে গেছে?’

    রায়হান আশ্চর্য হওয়া গলায় বলল, ‘একটু আগেই না বললে, তোমার খুব ঘুম পাচ্ছে-এখন এসে টিভি দেখতে বসেছ কেন?!’

    পলি অবাক গলায় বলল, ‘একটু আগে কখন তোমায় বললাম আমার খুব ঘুম পাচ্ছে?! আমি ঘণ্টাখানিক ধরেই এখানে টিভির সামনে। ঘুম আসছিল না। মাঝে-মাঝে আমার এমন হয়, কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। তাই বিছানা ছেড়ে উঠে এসে এক কাপ চা বানিয়ে টিভি দেখতে বসি। তোমার ঘুম ভাঙল কখন?’

    রায়হান দু’হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল, ‘আমি আর পারছি না, আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি! শোবার ঘরে এতক্ষণ তা হলে আমি কার সঙ্গে ছিলাম?!’

    রায়হানের আচরণে পলি হতভম্ব হয়ে গেল। বেশ ঘাবড়েও গেল। সঙ্গে-সঙ্গে টিভিটা অফ করে, ছুটে এসে রায়হানকে ধরে বলল, ‘কী হলো তোমার, হঠাৎ এমন করছ কেন?!’

    রায়হান পলির নাগাল থেকে ছিটকে সরে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে ছোঁবে না! এই তুমি আসল, না শোবার ঘরের তুমি আসল-কে জানে?!’

    পলি সাংঘাতিক আশ্চর্য হওয়া গলায় বলল, ‘এসব তুমি কী বলছ! আসল-নকল! তোমার মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেছে?!’

    রায়হান অপ্রকৃতিস্থের মত চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! মাথা খারাপ হয়ে গেছে…’ বলতে-বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

    তিন

    রায়হান এক সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারের ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছে। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম ডা. রেজা আহমদ। একজন নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক।

    বিভিন্ন মানসিক রোগীতে লাউঞ্জ ভর্তি।

    সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে এসে রায়হানের বেশ অস্বস্তি লাগছে। সবাই হয়তো তাকে পাগল ভাবছে। পাগলের ডাক্তারের কাছে পাগল রোগীই আসবে-এটাই সবাই ধরে নেয়।

    রায়হান একাই এসেছে। সঙ্গে কাউকে আনেনি। সে একজন বিচক্ষণ বুদ্ধিমান মানুষ। যতই অস্বস্তি লাগুক আর লোকে যা-ই ভাবুক—এই মুহূর্তে সাইকিয়াট্রিস্টের চিকিৎসা তার খুব প্রয়োজন। তার যে সমস্যা, এই সমস্যার সমাধান একজন অভিজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্টই দিতে পারবেন। লজ্জা করে কোনও লাভ নেই। যে-কোনও রোগের শুরুতেই চিকিৎসা নিতে হয়। না হলে ছোট্ট টিউমারই একসময় ক্যান্সারে রূপ নেয়।

    ওয়েটিং লাউঞ্জে প্রায় দু’ঘণ্টা অপেক্ষার পর রায়হান ভিতরে ঢোকার ডাক পেল। ভিতরে ঢুকে ডা. রেজা আহমদ-এর মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

    ডা. রেজা আহমদ রায়হানকে তীব্র চোখে পর্যবেক্ষণ করছেন, সেটা লক্ষ করল রায়হান। রেজা আহমদ-এর বয়স বোধ হয় ষাটের কাছাকাছি। উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রঙ। ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা। উঁচু নাক। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। মুখ ভর্তি কাঁচা-পাকা চাপ দাড়ি। চোখে গোল্ড রিমের চশমা। চশমার ভিতরে বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণ চোখ।

    ডা. রেজা আহমদ ভারী গম্ভীর কণ্ঠে প্রথমে রায়হানের নাম, বয়স, পেশা, পরিবারে ক’জন সদস্য, জীবন-যাপন পদ্ধতি, বংশের কেউ মানসিক রোগী ছিল কি না বা রয়েছে কি না, ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা বা শারীরিক অন্য কোনও সমস্যা রয়েছে কি না জেনে নিয়ে মূল সমস্যা জিজ্ঞেস করলেন।

    রায়হান তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সব কিছু প্রথম থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করল। ডা. রেজা আহমদ আগ্রহী শ্রোতার মত মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। শুনতে-শুনতে সামনে থাকা প্রেসক্রিপশন প্যাডে ছোটখাট কী যেন নোট করলেন। মাঝে- মাঝে প্রশ্ন করে খুঁটিনাটিও জেনে নিলেন।

    রায়হানের বলা শেষ হবার কিছুক্ষণ পর ডা. রেজা আহমদ প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার স্ত্রীর মত চেহারার কাউকে কি শুধু আপনার বাড়িতেই দেখতে পান? নাকি অন্য কোথাও-ও? যেমন: অফিসে, রাস্তায়, বাসস্টপে, রেস্টুরেন্টে, শপিং মলে, পার্কে অথবা বাড়ির বাইরে যে-কোনও জায়গায়?’

    রায়হান বলল, ‘শুধু বাড়িতেই, অন্য কোথাও দেখতে পাই না।’

    ‘আপনার স্ত্রীর মত যাকে দেখতে পান, তার গায়ে কি আপনার স্ত্রী সেদিন যে পোশাক পরে-সেই পোশাকই থাকে?’

    ‘হ্যাঁ, সেই একই পোশাক থাকে।’

    ‘আচ্ছা, আপনার স্ত্রীর মত যাকে দেখতে পান, তার সঙ্গে কি আপনার স্ত্রীর কোনও অমিল খুঁজে পান?’

    ‘না, কোনও অমিল পাই না।’

    ‘ভালভাবে ভেবে বলুন। শুধু চেহারা-পোশাকের মিল নয়, কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, ব্যবহার-এসব।’

    রায়হান খানিকক্ষণ ভেবে বলল, ‘কিছুটা অমিল যেন রয়েছে। বাস্তবে আমার স্ত্রী যতটা বুদ্ধিমতী, যতটা স্মার্ট—তাকে তারচেয়ে যেন একটু বেশি মনে হয়। এ ছাড়া বাস্তবে আমার স্ত্রী আমার- প্রতি যতটা আন্তরিক, তখন ততটা আন্তরিক থাকে না।’

    ডা. রেজা আহমদ চশমা খুলে রুমাল দিয়ে কাঁচ মুছতে- মুছতে বললেন, ‘আপনাদের কি লাভ ম্যারেজ? নাকি দেখে-শুনে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ?

    ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ।’

    ‘আপনি কি আপনার স্ত্রীকে খুব ভালবাসেন?’

    ‘হ্যাঁ, খুব ভালবাসি।’

    ‘স্ত্রীকে কি সন্দেহ করেন?’

    ‘নাহ, সন্দেহ করব কেন?!’

    ‘ঠিক সন্দেহ না, ধরুন, আপনার মনে কি কখনও ভাবনা জাগে না-বিয়ের আগে সে কেমন ছিল, তার জীবন-যাপন পদ্ধতি কেমন ছিল, কারও সঙ্গে তার প্রেম ছিল কি না, সে আসলে যতটা ভালবাসা-আন্তরিকতা আপনাকে দেখায়-সত্যিই সে ততটা ভালবাসে কি না? নাকি সবটাই মেকি, ভান?’

    ‘হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছেন-এমন ভাবনা মাঝে-মাঝে জাগে। আমাদের নতুন বিয়ে, আমার ধারণা প্রত্যেক নববিবাহিতের মধ্যেই এমন ভাবনা জাগে।’

    ‘আচ্ছা, আপনার স্ত্রী দেখতে কেমন?’

    ‘সুন্দরী! অসম্ভব সুন্দরী! সাধারণত এত রূপবতী মেয়ে দেখা যায় না। বলা যায় তার চেহারা দেখেই আমার পরিবার তাকে পছন্দ করেছে। তার মা-বাবা কেউই বেঁচে নেই। শিশুকালেই মা- বাবাকে হারিয়েছে। বড় হয়েছে এক মামার কাছে। মামার অবস্থাও তেমন ভাল নয়।’

    ‘ও, তাই! আপনার স্ত্রী এত রূপবতী হওয়ায় আপনার মনে কোনও শঙ্কা জাগে না? মানে, অন্য কারও চোখে পড়তে পারে, গুণ্ডা-বদমাশের নজরে পড়তে পারে?’

    ‘জাগে, এমন শঙ্কা জাগে। তাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বেরোলে সারাক্ষণই আমার মনে হতে থাকে রাস্তার সব পুরুষ হায়েনার দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। অফিস কলিগ, বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে স্ত্রীর হাতের চা খেতে বাসায় আসতে চায়, আমি কাউকেই আনি না। মনে হয় চা খাওয়ার ছুতোয় তারা আমার স্ত্রীকে লালসার দৃষ্টিতে দেখবে।’

    ডা. রেজা আহমদ কপালে ভাঁজ ফুটিয়ে বললেন, ‘আপনার স্ত্রী খুব রূপবতী, সেই তুলনায় আপনি ততটা সুদর্শন নন, গায়ের রঙ ময়লা, রোগা হাড় জিরজিরে শরীর—এই নিয়ে আপনি কি কোনও রকম হীনম্মন্যতায় ভোগেন?’

    ‘হ্যাঁ, প্রচণ্ড হীনম্মন্যতায় ভুগি। শুধু গায়ের রঙ ময়লা আর শুকনো শরীরই নয়-আমার মাথার চুলও পাতলা হয়ে আসছে। অথচ আমার স্ত্রীর মাথা ভর্তি চুল। ঘন, কালো, দিঘল চুলগুলো কোমর পর্যন্ত নেমে গেছে।’

    ডা. রেজা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আপনাদের সেক্স লাইফ কেমন?’

    ‘ভাল, কোনও সমস্যা নেই।’

    ‘কখনও কি কারও দিক থেকে অনীহা দেখা যায়?’

    ‘না, আমাদের নতুন বিয়ে-এত তাড়াতাড়ি কারও দিক থেকেই অনীহা দেখা দেয়ার কথা নয়

    ডা. রেজা আহমদ আর কোনও প্রশ্ন না করে খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখতে লাগলেন। লেখা শেষে প্রেসক্রিপশনটা রায়হানের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এই ওষুধগুলো নিয়ম মাফিক খাবেন। রিলাক্সেন জাতীয় ওষুধ। আশা করি এই ওষুধ খাওয়া শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই আপনার সমস্যা থাকবে না। এক মাস খাওয়ার পরেও যদি সমস্যা থেকেই যায়, তা হলে আবার আমার কাছে আসবেন। প্রয়োজনে সাইকোথেরাপি দেয়া হবে।’

    রায়হান প্রেসক্রিপশনটা হাতে নেবার পর ডা. রেজা আহমদ নড়েচড়ে বসে আবার বলতে লাগলেন, ‘আপনার সমস্যাটা সম্পূর্ণ মনের। আপনার অবচেতন মন আপনার স্ত্রীর মত চেহারার কাউকে সৃষ্টি করে নেয়। আপনি আপনার স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসেন। বলা যায় অস্বাভাবিক রকমের ভালবাসেন। কিছুতেই তাকে হারাতে চান না। হারানোর ভয় থেকেই মনের ভিতর সন্দেহ, শঙ্কা, হীনম্মন্যতা জন্ম নেয়। মনের সেই সন্দেহ, শঙ্কা, হীনম্মন্যতাই কাল্পনিক স্ত্রীকে সৃষ্টি করে। আপনি সারাদিন অফিসে কাটালেও আপনার মন পড়ে থাকে বাসায়। বাসা মানে স্ত্রী, স্ত্রীর সান্নিধ্য। বাসায় যে মুহূর্তে স্ত্রী পাশে থাকে না সে মুহূর্তেও আপনার মন কাল্পনিক স্ত্রীকে সৃষ্টি করে নেয়। কাল্পনিক স্ত্রী বাস্তবের স্ত্রীর চেয়ে কিছুটা বেশি বুদ্ধিমতী হওয়া, বাস্তবের স্ত্রীর চেয়ে আপনার প্রতি কম আন্তরিকতা দেখানোর কারণ, আপনার মনের গভীরে থাকা স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ। কাল্পনিক স্ত্রী যেহেতু আপনার মনের কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়, তাই সেই কাল্পনিক স্ত্রীর বৈশিষ্ট্যও আপনার মনের কল্পনা থেকেই সৃষ্টি হয়। আমার ধারণা, আরেকটা কাজ করলে আপনি দ্রুত এই সমস্যা থেকে রেহাই পাবেন। তা হলো আপনাদের দু’জনের সংসারে তৃতীয় কাউকে এনে রাখলে। আপনাদের কোনও আত্মীয় অথবা একটা কাজের মেয়ে-টেয়ে এনে রাখলেও হয়। তখন আর আপনার কাছে বাসা মানেই শুধু স্ত্রী মনে হবে না।’

    চার

    রায়হান গ্রামের বাড়ি থেকে একটা কাজের মেয়ে আনিয়ে নিয়েছে। মেয়েটার নাম শেফালি। বয়স ষোলো-সতেরো। চেহারা মোটেই ভাল নয়। গায়ের রঙ কালো। উঁচু কপাল। থ্যাবড়ানো নাক। বেশ মোটাসোটা শরীর। তবে মেয়েটা ঘরের কাজ-কর্মে খুবই পারদর্শী। পলির অনেক সাহায্য হয়। ভদ্র-শান্ত-লাজুক স্বভাবের মেয়ে। বেশ বুদ্ধিমতীও। যে-কোনও কাজ একবার বুঝিয়ে দিলেই ঠিকঠাক করতে পারে। পলি মাঝে-মাঝে বাসার কাছের মোড়ের দোকানটায় পাঠিয়ে সাংসারিক টুকটাক প্রয়োজনীয় সদাই-পাতিও আনায়। যেমন: ডিম, আলু, গরম মসলা, পিঁয়াজ, রসুন, টিস্যু পেপার, সাবান, হারপিক-এসব। মেয়েটা সদাই এনে খুচরো টাকাও ঠিকঠাক মত পলির হাতে বুঝিয়ে দেয়। চুরি-টুরিরও অভ্যাস নেই।

    কাজের মেয়েটাকে আনার পর রায়হানের সমস্যা আর দেখা দেয়নি। অর্থাৎ সে তার স্ত্রীর মত কাউকে আর দেখতে পায়নি। সব মিলিয়ে বলা যায় কাজের মেয়েটাকে আনায় তাদের যথেষ্ট ভাল হয়েছে।

    .

    গ্রাম থেকে পলির মামা মোবারক হোসেন বেড়াতে এসেছেন। সেই মামা, যে মামা অসহায়-এতিম পলিকে নিজের মেয়ের মত লালন-পালন করে বড় করেছেন।

    মোবারক হোসেন ঠিক বেড়াতে নয়, চিকিৎসার জন্য এসেছেন। অনেক দিন ধরে তিনি খুব কোমর ব্যথায় ভুগছেন। গ্রামের অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েছেন, কোনও লাভ হয়নি। তাই শহরের ভাল ডাক্তার দেখাতে এসেছেন।

    এক সন্ধ্যায় রায়হান মোবারক হোসেনকে একজন নামকরা অর্থোপেডিক-এর কাছে নিয়ে গেল। রাত প্রায় সোয়া ন’টা। ডাক্তারখানা থেকে রায়হান আর মোবারক হোসেন রিকশা করে বাড়ি ফিরছেন। অনেক ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার এক মাসের ওষুধ লিখে দিয়েছেন। এক মাস পর আবার যেতে বলেছেন।

    ভাগ্নী জামাই নিজে মোবারক হোসেনকে নিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনায় তিনি খুব খুশি হয়েছেন। এ ছাড়া বাপ-মা মরা ভাগ্নীর সুখের সংসার দেখেও তাঁর খুব ভাল লাগছে। রিকশায় যেতে- যেতে তিনি সন্তুষ্ট গলায় রায়হানের সঙ্গে অনেক গল্প করছেন।

    ‘রায়হান, বাবাজি, পলির কপালে আল্লাহ যে এত সুখ লিখে রেখেছেন-তা ওর জন্মের সময় বুঝিনি। মনে করেছিলাম মেয়েটা জনমদুঃখী হবে। জন্মের আগেই ট্রলারডুবিতে ওর বাপ মারা যায়। জন্ম দিতে গিয়ে ওর মা মারা যায়। কী যে দুঃখের দিন! আমার মরা বোনটার সদ্য জন্মানো বাচ্চার দায়িত্ব নিই আমি। সবাই বলাবলি করে, ‘বাপ-মা খাওয়া এই মাইয়ার কপালে যে আরও কত কী আছে আল্লাহ-মাবুদই জানে। গায়ের রঙড়াও ঘোর কালা। বড় হইলে যে ভাল ঘরে বিয়া হইব তারও কোনও নিশ্চয়তা নাই। এমন কালা মাইয়ারে আর কেডায় বিয়া করব?’

    রায়হান বলে উঠল, ‘কী বলছেন! পলির গায়ের রঙ তো একেবারে দুধে-আলতা! জন্মের পর ওর গায়ের রঙ কালো ছিল?!’

    ‘জি, বাবাজি, বারো-তেরো বছর বয়স পর্যন্ত ওর গায়ের রঙ কালোই ছিল। পাতিলের তলার মত কালো। চেহারাও তেমন ভাল ছিল না। একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটার পর থেকে ও সুন্দর হতে থাকে।’

    রায়হান অত্যন্ত আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী ঘটনা?’

    মোবারক হোসেন বলতে লাগলেন, ‘ওর বারো-তেরো বছর বয়সেরই ঘটনা এটা। একদিন আমাদের বাড়ির কাছের অনেক পুরানো জমিদার বাড়ির দিঘিতে গোসল করতে গিয়ে ডুবে যায়। সাঁতার জানত না। ঘাটলায় আরও বেশ কয়েকজন ছিল। তারা ওকে বাঁচাতে চায়। তার আগেই হাবুডুবু খেতে-খেতে দিঘির গভীর জলে তলিয়ে যায়। সেই সব লোকের চিৎকার-চেঁচামেচিতে আরও অনেক লোক জড় হয়। আমি, ওর মামী, আমরাও খবর পেয়ে ছুটে যাই। অনেকে দিঘিতে নেমে পড়ি খোঁজাখুঁজি করতে। কিন্তু ওর কোনও চিহ্নই মেলে না। অত গভীর দিঘিতে খুঁজে পাবার কথাও নয়। এ ছাড়া ওই দিঘিটার একটা বদনাম আছে, ওই দিঘিতে কোনও বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ডুবে গেলে তাকে আর জীবিত ফেরত পাওয়া যায় না। গ্রামের চেয়ারম্যান খবরটা শুনে এক দল জেলে পাঠিয়ে দেন। জেলেরা জাল ফেলে উদ্ধারের জন্য অনেক চেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনও খোঁজই মেলে না। জীবিত না হোক লাশটা তো অন্তত পাওয়ার কথা। কোনও হদিশই মেলে না। চেয়ারম্যানের পাঠানো জেলেদের জালে অনেক পুরানো পঁয়তাল্লিশ কেজি ওজনের বিশাল এক রুই মাছ ধরা পড়ে। সেই মাছ দিয়ে সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান বাড়িতে গ্রামের গণ্যমান্যদের জন্য ভোজের আয়োজন করা হয়। এদিকে আমি আর ওর মামী কেঁদে- কেঁদে বুক ভাসাই।

    ‘তিন দিনেও কোনও খোঁজ মেলে না। এত দিনে লাশটা ভেসে ওঠার কথা ছিল। লাশটা ভেসেও ওঠে না। কী হলো মেয়েটার! অন্তত লাশটা পেলে ওর মা-বাবার কবরের পাশে দাফন-কাফন করে মনকে একটু বুঝ দিতে পারতাম!

    ‘তিন দিন পর ভর দুপুরবেলা গ্রামের কয়েকজন লোক মাঝদিঘিতে কাউকে হাবুডুবু খেতে দেখতে পায়। তক্ষুণি তারা উদ্ধারের ব্যবস্থা করে। উদ্ধারের পর সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখতে পায়, হাবুডুবু খাওয়া মানুষটা হচ্ছে পলি। তিন দিন আগে দিঘিতে ডুবে যাওয়া মেয়ে কীভাবে তিন দিন পর ফিরে এসেছে এই নিয়ে সবার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। আঞ্চলিক কয়েকটা খবরের কাগজেও নিউজটা ছাপা হয়।

    ‘দিঘি থেকে উদ্ধারের পর পলিকে সবাই জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছিল ওর? এই তিন দিন ও কোথায় ছিল? কীভাবে বেঁচে ফিরল? কিন্তু পলি কিছুই বলে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। যেন ওর কোনও বোধজ্ঞানই নেই।

    ‘পরবর্তী তিন-চার মাস ও প্রতিবন্ধীদের মত আচরণ করে। এরপর ধীরে-ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। আশ্চর্যজনকভাবে দেখা যায় ওর চেহারা পরিবর্তন হয়ে খুলে যাচ্ছে। গায়ের রঙ ফর্সা হচ্ছে। থ্যাবড়ানো নাক উঁচু হচ্ছে। চোখ টানা-টানা হচ্ছে। কোঁকড়ানো লালচে চুল রেশমি কালো ঝলমলে হচ্ছে। যেন ওর রূপান্তর ঘটছে।’

    রায়হান বলে উঠল, দিঘিতে ডুবে যাবার ঘটনা ও তো আমাকে কিছুই বলেনি।

    ‘এই ঘটনা কেন জানি ও সবার কাছে লুকিয়ে রাখতে চায়। আজ পর্যন্ত কেউ ওর কাছ থেকে জানতে পারেনি, দিঘিতে ডুবে গিয়ে তিন দিন ও কোথায় ছিল। কখনওই ও কাউকে কিছু বলে না। আমি আর ওর মামী অনেক জেরা করি। শুধু এটুকুই বলে, দিঘির গভীর কালো জলে ধীরে-ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে-এ ছাড়া ওর আর কিছুই মনে নেই।’

    পাঁচ

    পলির মামা মোবারক হোসেন ডাক্তার দেখিয়ে আসার পরদিনই চলে যান। কাজের মেয়ে শেফালিকে নিয়ে পলিদের সংসার খুব সুন্দরভাবে চলছে। রায়হান রোজ সকালে অফিসে চলে যায়, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। কাজের মেয়ে শেফালিকে নিয়ে পলির সারাদিন কাটে ঘরের টুকটাক কাজ, রান্না-বান্না আর ঘর গোছগাছ করতেই। শেফালি অনেক ধরনের পিঠা বানাতে পারে। প্রতিদিনই শেফালি আর পলি মিলে একেক ধরনের পিঠা বানায়। সন্ধ্যায় রায়হান বাড়ি ফিরলে রায়হানের সামনে চায়ের সঙ্গে পিঠা পরিবেশন করা হয়। রায়হান খুব আগ্রহ নিয়ে পিঠা খায়। বলা যায় খুবই সুখে আছে তারা।

    তবে একটা বিষয় নিয়ে ওরা সামান্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তাদের বাসার কাছের মোড়ের দোকানের দোকানদারকে নিয়ে। দোকানদার ব্যাটার চরিত্র ভাল না। শেফালি টুকটাক সদাই-পাতি আনতে গেলে, একলা পেলে শেফালিকে বিভিন্ন কুপ্রস্তাব দেয়। তাই আজকাল আর শেফালি বা পলি কেউই ওই দোকানে যায় না। কিন্তু বদমাশটা কয়েক দিন ধরে খুবই বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। সকাল-বিকাল বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। তা-ও একা নয়, তিন-চারজন উচ্ছৃঙ্খল বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। বারান্দায় বা ছাদে এক মুহূর্তের জন্য শেফালিকে দেখতে পেলে কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসে আর নোংরা ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করে। শেফালি মেয়েটা সারাক্ষণই ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। প্রায়ই কেঁদে-কেটে বলে, ‘আমি আর এহানে থাকুম না। আমারে বাড়ি পাঠায়ে দেন।

    রায়হান সান্ত্বনা দেয়, ‘এত ভয় পাস নে, একটু ধৈর্য ধরে থাক। এক মাসের মধ্যেই এই বাসা ছেড়ে অন্য কোনও এলাকায় বাসা ভাড়া নেব।’

    পলিও রায়হানকে অন্য কোনও এলাকায় বাসা ভাড়া নেবার জন্য খুব তাড়া দিচ্ছে। রায়হান প্রতিদিনই অফিস শেষে ফেরার পথে বিভিন্ন এলাকায় তার সাধ্যের মধ্যে নিরিবিলি ভাল বাসা ভাড়া নেবার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে।

    .

    বিকেল সাড়ে পাঁচটা।

    পলি একটা সুপার মার্কেটে এসেছে ঘরের প্রয়োজনীয় নানান জিনিসপাতি কিনতে। কয়েক দিন ধরে রায়হান অফিস আর বাসা খোঁজা নিয়ে এতই ব্যস্ত রয়েছে যে বাজার-সদাই করার মোটেই সময় পাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে পলির আসা। শেফালিকেও সঙ্গে আনতে চেয়েছিল। শেফালি আসেনি। সে লম্পট দোকানদার ব্যাটার ভয়ে বাসার বাইরে বেরোতেই চাইছে না।

    কেনাকাটা শেষে পলি ভারী-ভারী দুটো ব্যাগ হাতে সুপার মার্কেট থেকে বেরিয়েছে।

    সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই। বাসায় ফেরার জন্য সে খালি রিকশা খুঁজছে। এমন সময় তার মাথার মধ্যে ভীষণ ঝিম-ঝিম করতে শুরু করল। সেই সঙ্গে এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসতে লাগল। ক্রমেই যেন সে কেমন ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি। ছোট বেলায় দিঘির গভীর জলে তলিয়ে যাবার সময় যে অনুভূতি হয়েছিল, ঠিক যেন তেমন। সে যেন অতল গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।

    তলিয়ে যেতে-যেতে সে কিছু দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। শেফালির খুব বিপদ। বাসায় শেফালি ছাড়া আর কেউ নেই, এটা টের পেয়ে দোকানদার লম্পটটা তার চার বন্ধুকে নিয়ে হানা দিয়েছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে গাঁজা ভরা সিগারেট। প্রত্যেকের চোখ টকটকে লাল। সেই চোখে দানবীয় লালসা।

    ঘন-ঘন বাসার কলিং বেল বাজছে। শেফালি বুঝতে পারছে না কে এসেছে। ভাবছে, তার পলি আপা এসেছেন। শেফালি দরজা খুলে দিল। পাঁচ শয়তান হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কিছু বুঝে উঠবার আগেই শেফালির মুখ চেপে ধরল। ঘর কাঁপিয়ে ভয়ঙ্কর কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসতে শুরু করল শয়তানগুলো।

    ফুটপাতে দাঁড়ানো পলি ঘোরের মধ্যেই তীব্র তাগিদ অনুভব করল শেফালিকে বাঁচানোর। যে করেই হোক অসহায় মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে! মেয়েটাকে বাঁচাতেই হবে! রক্ষা করতে হবে ওই দানবদের হাত থেকে।

    পলির হাত থেকে বাজারের ব্যাগ দুটো খসে পড়ল। সে মাতালের মত এলোমেলো পা ফেলে চলতে শুরু করল। রাস্তার মাঝখানে চলে এল। ঝড়ের বেগে ছুটে এল একটা মাইক্রোবাস। অতি দ্রুত গতিতে থাকা মাইক্রোবাসটার ব্রেক কষায় চাকার ‘ঘ্যাচচচ…’ শব্দ আর পলির মরণ আর্তনাদে কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন আশপাশের সব কিছু থমকে গেল। পরমুহূর্তেই সব কিছু আবার সচল হয়ে উঠল। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পিচ ঢালা রাস্তা। লোকজন ছুটে আসছে। চিৎকার, চেঁচামেচি, হই-হট্টগোল।

    .

    ফোন পেয়ে ছুটে হাসপাতালে চলে এসেছে রায়হান। জরুরি বিভাগে একটু খোঁজ নিতেই সে খুঁজে পেল পলিকে। স্ট্রেচারে শোয়ানো রয়েছে পলি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা। সমস্ত চাদরটা চাপ-চাপ রক্তে ভেজা।

    জমে যাওয়া ধীর পায়ে রায়হান এগিয়ে গেল স্ট্রেচারটার কাছে। কাঁপা-কাঁপা হাতে কোনওক্রমে মুখের উপর থেকে চাদর সরাল। নিথর, শান্ত, অভিব্যক্তিহীন ফ্যাকাসে একটা মুখ। নাকের ফুটোয়, ঠোঁটের কোনায় রক্ত জমা। চোখ দুটো বন্ধ। যেন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে তার প্রিয়তমা স্ত্রী।

    রায়হান আলতো করে হাত ছোঁয়াল প্রিয়তমার গালে। হাতটা এগাল থেকে ওগালে সমস্ত মুখের উপর আলতোভাবে ছুঁয়ে যেতে লাগল। এই মুখে কত শতবার সে ঠোঁটের উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে দিয়েছে! এখন সেই মুখটা বরফের মত শীতল আর নিষ্প্রাণ! নরম কোমল মুখটা শক্ত টান-টান হয়ে গেছে!

    এক পর্যায়ে রায়হান আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। বজ্রাহতের মত দু’হাতে মাথা চেপে ধরে, হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে ভেউ-ভেউ করে কাঁদতে শুরু করল।

    কান্নায় ভেঙে পড়া রায়হানের বুকপকেটের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। অনেক কষ্টে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বুকপকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করল। তাদের বাড়িওয়ালা ফোন করেছেন।

    রায়হান কোনওক্রমে ফোনটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরে কান্নাজড়িত ভাঙা গলায় বলল, ‘হ্যালো।’

    ওপাশ থেকে শোনা গেল বাড়িওয়ালার উত্তেজিত অস্থির গলার স্বর, ‘রায়হান, আপনি কোথায়? এক্ষুণি বাসায় চলে আসেন। বাসায় বিরাট ঝামেলা হয়েছে। আপনার বাসার ভিতর চার-পাঁচজন লোক খুন হয়েছে। পুলিশ, সাংবাদিক, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের লোকেরা আপনাকে খুঁজছে। এক্ষুণি চলে আসেন।’

    .

    রায়হান বিধ্বস্ত চেহারায় টলতে-টলতে কোনওক্রমে বাসায় চলে এল। লোকে গিজ-গিজ করছে বাড়ি। বাড়ির সামনে দাঁড় করানো বেশ কয়েকটা পুলিশের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স আর টিভি চ্যানেলের গাড়ি। মোটর বাইক রয়েছে অগণিত।

    রায়হান ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল। রায়হানকে দেখতে পেয়েই বাড়িওয়ালা তাঁর পাশে দাঁড়ানো পুলিশের ওসি সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই হচ্ছে রায়হান। যার বাসার ভিতর খুনগুলো হয়েছে।’

    ওসি সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনার বাসার ভিতর পাঁচ-পাঁচজন লোক নারকীয়, বীভৎস, ভয়ঙ্করভাবে খুন হয়েছে। কারও ঘাড় মটকে মাথাটা পিছন দিকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে ফেলেছে। কারও ধড় থেকে মাথাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে। কারও শ্বাসনালী কামড়ে অথবা খামচে ধরে টেনে বিচ্ছিন্ন করেছে। কারও আবার মুখের ভিতর থেকে জিভটা টেনে ছিঁড়ে এনেছে। খুনগুলো খুবই রহস্যজনক। কোনও মানুষের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। শুনেছি হিংস্র পশুরা অনেক সময় এভাবে মানুষকে মারে। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, ওই সময় আপনি বা আপনার স্ত্রী কেউই বাসায় ছিলেন না। ছিল শুধু আপনাদের কাজের মেয়ে শেফালি। খুন হওয়া ওই পাঁচজনের সাথে আপনাদের কাজের মেয়ে শেফালিকেও আমরা অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করেছি। শেফালির জ্ঞান ফিরেছে। তবে মেয়েটার সাময়িক মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। ঠিকঠাক কিছুই বলতে পারছে না। শেফালির বলা উল্টো-পাল্টা কথা শুনে এবং ওর গায়ের ছেঁড়া জামা-কাপড় দেখে বোঝা যাচ্ছে খুন হওয়া ওই পাঁচজন ওকে রেপ করতে এসেছিল। শেষ মুহূর্তে ওই পাঁচজনকে খুন করে কেউ ওকে বাঁচায়। ভেবেই কূল পাচ্ছি না এমন দানবীয় শক্তিধর কে হতে পারে?! কী হতে পারে?! কাজের মেয়ে শেফালিকে যতবারই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সে আপনার স্ত্রীর কথা বলছে। আপনার স্ত্রী নাকি তাকে বাঁচিয়েছে। আপনার স্ত্রীই ওই পাঁচজনকে খুন করেছে। আবোল-তাবোল কথা বলছে, আপনার স্ত্রী নাকি একা ছিল না—অনেকে ছিল। মানে, আপনার স্ত্রীর মত চেহারার অনেকজন ছিল। তা-ও কি হতে পারে?! আচ্ছা, আপনার স্ত্রী এখন কোথায়? তার সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।’

    রায়হান বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাঙা গলায় বলল, ‘রোড অ্যাক্সিডেন্টে সে মারা গেছে। তার ডেডবডি এখনও হাসপাতালে রয়েছে।’

    পরিশিষ্ট

    পাঁচ বছর কেটে গেছে।

    পলির মৃত্যুর পর থেকে রায়হান নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছে। বলা যায় কোনওক্রমে জীবনটাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। যেন সে বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই।

    গত পাঁচ বছর ধরেই রায়হানের পরিবার রায়হানকে আবার বিয়ে করাতে চাইছে। কিন্তু কিছুতেই রায়হান রাজি হচ্ছে না। রায়হান একটি কথাই বলে, পলির জায়গায় সে আর কাউকে বসাতে পারবে না।

    রায়হানের পরিবার অনেক খোঁজাখুঁজির পর পলির মত চেহারার একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছে। তবে মেয়েটা খুবই গরিব ঘরের। দু’বেলা ঠিক মত খাওয়া-পরা জোটে না এমন গরিব ঘরের মেয়ে।

    পরিবারের সবার অনুরোধ আর শত পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেই মেয়েকে দেখতে এসেছে রায়হান।

    মেয়ের মা মেয়েকে সামনে নিয়ে এসেছেন। রায়হান কিছুতেই চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। তার খুব পলির কথা মনে পড়ছে। পলির কথা মনে পড়ে বুকের ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

    রায়হানের মা পাশ থেকে বলছেন, ‘বাবা, একবার চোখ তুলে তাকিয়ে একটু দেখ। তোর পছন্দ না হলে কিছুই হবে না। আল্লাহর দোহাই একটু চোখ তুলে তাকা।’

    মায়ের অনুরোধে বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত রায়হান চোখ তুলে তাকাল। তাকাতেই রায়হান যেন হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক শক খেল। হুবহু একই চেহারা! পলির চেহারা! যেন পলিই তার সামনে বসে আছে! এটা কী করে সম্ভব?!

    রায়হান অপ্রকৃতিস্থের মত পলকহীন তাকিয়ে রইল। মনে হচ্ছে সে যেন কোনও স্বপ্নদৃশ্য দেখছে। যে স্বপ্নে সে পলির দেখা পেয়েছে।

    রায়হানের মা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘চলেন, আমরা সবাই কিছু সময়ের জন্য অন্য ঘরে যাই। ওদের দু’জনকে নিজেদের মধ্যে কথা বলার একটু সুযোগ করে দিই।’

    সবাই চলে গেল। রায়হান আর মেয়েটা মুখোমুখি বসে আছে। দু’জনের কারও মুখেই কথা নেই। মেয়েটা মাথা নুইয়ে রয়েছে। রায়হান হতভম্বের মত তাকিয়েই আছে।

    কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটার পর প্রথমে মেয়েটাই কথা বলে উঠল, ‘আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

    রায়হান কিছু বলল না। মেয়েটার গলার স্বরও পলির মত। বিস্ময়ে রায়হান যেন বোবা হয়ে গেছে।

    মেয়েটাই আবার বলতে লাগল, ‘আমি শেফালি। আপনাদের বাসার কাজের মেয়ে শেফালি। যাকে নষ্ট করতে এসে পাঁচজন খারাপ লোক রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছিল। ওই ঘটনার পর আশ্চর্যজনকভাবে আমার রূপান্তর ঘটে। আমার চেহারা পলি আপার মত হয়ে যায়। শুধু চেহারাই নয়, আমার আচার-আচরণ, ভাব-ভঙ্গি, গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি…সব কিছু একেবারে পলি আপার মত হয়ে যায়। মাঝে-মাঝে মনে হয় আমি এখন আর শেফালি নই, পলি, আপনার স্ত্রী পলি-শেফালির মৃত্যু হয়েছে।’

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপার্থিব প্রেয়সী – আফজাল হোসেন
    Next Article ক্যামিল – পিয়ের লেমেইত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }