Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গুহামানবী – আফজাল হোসেন

    লেখক এক পাতা গল্প231 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ক্লীব

    হানিফ সাহেব হাসি-হাসি মুখ করে বসে আছেন। অথচ তিনি বিরক্ত। মহা বিরক্ত। তিনি বিরক্তি চেপে রেখে অনেক কষ্টে মুখ হাসি-হাসি করে রেখেছেন। তাঁকে ঘিরে গ্রামের বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য মুরব্বি বসে আছেন। তাঁদেরকে দু’-দু’বার চা-নাস্তা দেয়া হয়েছে। চা-নাস্তার পর বেশি করে জর্দা দেয়া খিলি বানানো পান। পান মুখে তাঁরা আয়েশি ভঙ্গিতে আলতু-ফালতু গুরুত্বহীন গাল-গল্প করেই যাচ্ছেন। সেই সন্ধ্যায় এসেছেন, এখন রাত দশটা বাজতে চলল—উঠবার নাম নেই। ভদ্রতার খাতিরে হানিফ সাহেব কিছু বলতেও পারছেন না। তিনি গ্রামে আসার পর থেকেই প্রতিদিন সকালে-সন্ধ্যায় এভাবে গ্রামের ময়-মুরব্বিরা জমায়েত হচ্ছেন। গ্রাম-গাঁয়ের এটাই নাকি নিয়ম-শহর থেকে কেউ বেড়াতে এলে তাঁকে এভাবে সঙ্গ দেয়া।

    হানিফ সাহেব তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে কয়েক দিনের জন্য গ্রামে বেড়াতে এসেছেন। ঢাকায় তাঁর গার্মেন্টস ব্যবসা। সেই সঙ্গে সুতোর মিল, কাপড়ের মিল, ডাইং মিল আর বায়িং হাউসের ব্যবসাও রয়েছে। এক হাতে এতগুলো ব্যবসা সামলাতে তাঁকে হিমশিম খেতে হয়। তাঁর স্ত্রী গত হয়েছেন দশ বছর হতে চলল। ব্যস্ততার কারণে তিনি তাঁর মা মরা দুই মেয়েকে মোটেও সময় দিতে পারেন না। সারাদিনে হয়তো মেয়েদের সঙ্গে একবার কি দুইবার দেখা হয়। মাঝে-মাঝে তা-ও হয় না। তাই ভেবেছিলেন গ্রামে বেড়াতে এসে পুরো সময়টা মেয়েদের সঙ্গেই কাটাবেন। কিন্তু গ্রামে এসেও গ্রামের ময়-মুরব্বিদের ভিড়ে সেটা তিনি পারছেন না।

    হানিফ সাহেবের বড় মেয়ে টুম্পা এ বছর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেছে। ছোট মেয়ে রুম্পা টেনে পড়ে। দুই বোনের স্বভাব-চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বড় বোন টুম্পা হাসিখুশি, চটপটে, মিশুক স্বভাবের। ছোট বোন রুম্পা চুপচাপ, গম্ভীর, আত্মকেন্দ্রিক। গ্রামে আসার পর থেকে টুম্পা গ্রামের বিভিন্ন বয়সী মহিলাদের সঙ্গে গল্প করে, আড্ডা দিয়ে, গ্রাম ঘুরে সময় কাটাচ্ছে। আর রুম্পা নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে গল্প-উপন্যাস পড়ে দিন পার করছে।

    হানিফ সাহেব বছর পাঁচেক আগে নিলামে গ্রামের এই বাড়িটা কেনেন। এখানে পুরানো একটা জমিদার বাড়ি ছিল। দু’শো- আড়াইশো বছরের পুরানো। একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। হানিফ সাহেব পুরানো ধ্বংসস্তূপ ভেঙে বাংলো টাইপের একতলা বাড়ি করেন। বাংলো বাড়িটা বানানোর পর থেকে খালিই পড়ে ছিল। অবশ্য বাড়ির দেখাশোনার জন্য কেয়ারটেকার রাখা আছে।

    কেয়ারটেকারের নাম হাবলু। হাবলু তার স্ত্রীকে নিয়ে এ বাড়িতেই থাকে। একতলা মূল বিল্ডিং-এর পাশে হাবলুদের থাকার জন্য ছোট্ট টিনশেড ঘর রয়েছে।

    হাবলুর স্ত্রীর নাম জরিনা। জরিনা দেখতে খুবই সুন্দরী। বলা যায় পরীর মত সুন্দরী। বুদ্ধিমতীও। যেন গোবরে পদ্মফুল। সেই তুলনায় হাবলু একেবারেই হাবাগোবা, গোবেচারা টাইপের। চেহারা-শ্রীও ভাল নয়। গায়ের রঙ পাতিলের তলার মত কালো। উপরের পাটির উঁচু দাঁত সবসময় বেরিয়ে থাকে। মাথা ভর্তি বেলের মত চকচকে টাক।

    হানিফ সাহেব এই বাড়িটা বানানোর পর মনে-মনে যখন বাড়ির জন্য কেয়ারটেকার রাখার কথা ভাবছিলেন, তখন একদিন হাবলু আর জরিনা এসে উপস্থিত হয়। হাবলু-জরিনা হাত জোড় করে তাঁকে জানায়, নদীভাঙনে তাদের বাড়ি-ঘর সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। দয়া করে যদি তাদেরকে এই বাড়ির কেয়ারটেকারের কাজ দেয়া হয়…বলতে-বলতে তারা দু’জন হানিফ সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে।

    হানিফ সাহেব রাজি হয়ে যান। ছেলেপুলে নেই, দু’জন মাত্র মানুষ। এ ছাড়া তারা নিজ থেকে কোনও বেতন-ভাতাও দাবি করেনি। হানিফ সাহেব যা দেবেন তাতেই খুশি। একেবারে মন্দ হবে না!

    .

    গ্রামের ময়-মুরব্বিরা চলে যাবার পর হানিফ সাহেব তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে খেতে বসেছেন।

    রাত প্রায় সোয়া এগারোটা। এরই মধ্যে চারদিক একেবারে গভীর রাতের মত নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। রাত সোয়া এগারোটা মানে গ্রামে অনেক রাত। এত রাত পর্যন্ত গ্রামের মানুষরা সাধারণত জেগে থাকে না। তারা সব আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়ে।

    খাবার পরিবেশন করছে জরিনা। ধোঁয়া ওঠা সরু চালের ভাত, বেগুন ভাজা, পাবদা মাছের ঝোল আর কষানো মুরগির মাংস।

    প্রতিটা পদই জরিনা নিজ হাতে রান্না করেছে। জরিনার রান্নার হাত খুব ভাল। যা-ই রান্না করুক অত্যন্ত সুস্বাদু হয়।

    হানিফ সাহেব খেয়ে খুব তৃপ্তি পাচ্ছেন। রাতে সাধারণত তিনি খুব অল্প খান। কিন্তু গ্রামে আসার পর থেকে তিনি সেই নিয়ম রক্ষা করতে পারছেন না। জরিনার হাতের রান্না এতই সুস্বাদু হয় যে প্রতি বেলায়ই বেশি খাওয়া হচ্ছে।

    হাবলু হানিফ সাহেবের পিছনে তোয়ালে হাতে, মাথা নুইয়ে, ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। হানিফ সাহেব খাওয়া শেষ করে কখন হাত ধোবেন সেই অপেক্ষায়। হানিফ সাহেবের হাত ধোয়া হলেই হাত মোছার জন্য তোয়ালে এগিয়ে দেবে। গ্রামে আসার পর থেকে প্রতিটা মুহূর্তেই এভাবে হাবলু তাঁর খেদমত করার চেষ্টা করছে। হানিফ সাহেবের সুবিধা-অসুবিধার দেখ-ভাল করার জন্য সারাক্ষণ তাঁর আশপাশেই থাকছে। এমনকী রাতে ঘুমের মধ্যেও একবার ‘হাবলু’ বলে ডাক দিলেই হাবলু এসে তাঁর সামনে উপস্থিত হয়। যেন সারারাত হাবলু তাঁর পায়ের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।

    হানিফ সাহেবের খাওয়া শেষ। তিনি থালার মধ্যেই হাত ধুয়ে ফেললেন। হাবলু তোয়ালে এগিয়ে দিয়েছে। তিনি তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে-মুছতে লক্ষ করলেন তাঁর দুই মেয়েরও খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিনি একটু অবাক হলেন। আজ খাওয়ার টেবিলে তাঁরা তিনজন একেবারে নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে উঠলেন। সাধারণত তো এমনটা হয় না। বিশেষ করে গ্রামে আসার পর থেকে। ছোট মেয়ে রুম্পা বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের, কিন্তু বড় মেয়ে টুম্পা তো খেতে-খেতে অনেক গল্প করে। সারাদিনে গ্রামের কার-কার সঙ্গে কথা হয়েছে, কী কথা হয়েছে, গ্রামের কোথায়- কোথায় ঘুরে বেড়িয়েছে, কী-কী দেখেছে-সবই বিস্তারিতভাবে জানায়। আজ টুম্পাটাও কেন গোমড়া মুখে নিঃশব্দে খেয়ে উঠল বোঝা যাচ্ছে না। কোনও কারণে মেয়েটার কি মন খারাপ?

    প্রতি বেলার খাওয়া-দাওয়ার শেষে জরিনা হানিফ সাহেবের সামনে পানদানিতে বেশ কয়েকটা খিলি বানানো পান পরিবেশন করে। তাঁর পান খাওয়ার অভ্যাস নেই। এরপরও সামনে পান পেয়ে আজকাল তিনি নিয়মিত পান খাচ্ছেন। বোধহয় কড়া করে জর্দা দেয়া পান তাঁকে দেয়া হয়। পান মুখে দেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর শরীরে এক ধরনের আরামদায়ক ঝিমুনি চলে আসে। এই সময়টা তিনি অত্যন্ত উপভোগ করেন।

    হানিফ সাহেব এক খিলি পান মুখে পুরে টুম্পাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘টুম্পা, মামণি, তুমি আজ এত চুপচাপ কেন?’

    টুম্পা মুখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘বাবা, আমরা যাচ্ছি কবে?’

    ‘কেন, মা, হঠাৎ এ কথা কেন বলছ? গ্রামে আসার ব্যাপারে তোমার আগ্রহই তো সবচেয়ে বেশি ছিল। কিছু হয়েছে নাকি?’

    ‘না, কিছু হয়নি। অনেক দিন তো হয়ে গেল, আর ভাল লাগছে না।’

    হানিফ সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। তাঁর ঝিমুনি ভাব চলে এসেছে। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই মেয়ের পীড়াপীড়িতেই সব ফেলে গ্রামে আসা হলো। এখন আবার সবার আগে সে-ই চলে যাবার কথা বলছে। মেয়েদের মন বোঝা বড়ই মুশকিল। হানিফ সাহেবের এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আরও কয়েকটা দিন থেকে যাবার ইচ্ছে তাঁর। জরিনার হাতের ভাল-ভাল রান্না আর খিলি বানানো পান তাঁকে একেবারে জাদু করে ফেলেছে।

    হানিফ সাহেব সরাসরি তাঁর শোবার ঘরে চলে এসেছেন। তাঁর পিছু-পিছু হাবলুও এসেছে। পান খাওয়ার পর আজ ঝিমুনি ভাবটা খুব বেশি হচ্ছে। শরীরটা কেমন তুলোর মত হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে আশপাশটা ঘোলাটে হয়ে ধীরে-ধীরে তিনি গভীর অতলে হারিয়ে যাচ্ছেন।

    হানিফ সাহেব বিছানায় শুয়ে পড়লেন। হাবলু উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘খালুজানের শইলড্যা কি খারাপ লাগতেছে?’

    হানিফ সাহেব জড়ানো গলায় বললেন, ‘না, তেমন কিছু না। মাথাটা কেমন যেন ঘুরছে।’

    ‘খালুজান, মাথা বানায়ে দিমু?’

    হানিফ সাহেব ঘোর লাগা গলায় বললেন, ‘যা খুশি করো।’

    হাবলু হানিফ সাহেবের মাথা বানিয়ে দিতে লেগে পড়ল। কপালসহ সমস্ত মাথায় হাত বুলাচ্ছে, চুলের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে ছোট-ছোট মুঠি করে আলতোভাবে টানছে, বিলি কাটছে, চুলের গোড়ায়-গোড়ায় চুলকে দিচ্ছে…মাঝে-মাঝে আঙুলের ডগা দিয়ে হালকাভাবে টিপছেও।

    হানিফ সাহেবের খুব আরাম লাগছে। আরামে চোখে ঘুম চলে এসেছে। তিনি ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছেন। অথচ তিনি মনে-প্রাণে জেগে থাকার চেষ্টা করছেন। ঘুমিয়ে পড়লেই তো সমস্ত আরাম শেষ। এমন আরামের মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়ার কোনও মানে হয় না।

    .

    শেষ রাতে একবার হানিফ সাহেবের ঘুম হালকা হয়ে এল। তিনি চোখ না খুলেও বুঝতে পারলেন তখনও হাবলু মাথা বানিয়ে যাচ্ছে। বেআক্কেল কোথাকার! ঘুমিয়ে পড়ার পরও মাথা বানানোর কী দরকার! ভাবলেন, হারামজাদাকে একটা রাম ধমক দেবেন। কিন্তু তার আগেই তিনি আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে লাগলেন। ঘুমে তলিয়ে যেতে-যেতে তাঁর মনে হলো, যে মাথা বানাচ্ছে, সে হাবলু নয়-অন্য কেউ! কোনও মেয়ে মানুষ! মেয়ে মানুষটার হাতের কাচের চুড়ির রুনঝুন শব্দ হচ্ছে। গা থেকে মিষ্টি একটা সুগন্ধ বেরুচ্ছে। এমন সুন্দর গন্ধ তো জরিনার গা থেকে পাওয়া যায়! জরিনা হাতে কাচের চুড়িও পরে। কোনওভাবে জরিনা নয়তো?!

    দুই

    গ্রামে আসার ব্যাপারে টুম্পার আগ্রহই বেশি ছিল। কিন্তু এখন আর টুম্পার এক মুহূর্তও গ্রামে থাকতে ইচ্ছে করছে না।

    গ্রামে আসার প্রথম দিনই বাথরুমে গোসল করতে ঢুকে টুম্পার মনে খটকা লাগে। গোসল করতে-করতে মনে হয় কেউ তাকে লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখছে। এই ব্যাপারগুলো মেয়েরা খুব ভাল বোঝে। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের অবচেতন মনই তাদেরকে সতর্ক করে দেয়।

    টুম্পা বাথরূমের ভিতরটা খুব ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে। নাহ্, বাথরূমের কোথাও থেকে তাকে লুকিয়ে দেখার কোনও সুযোগ নেই। ভেন্টিলেশনের জন্য ছোট্ট জানালাটা ছাড়া একেবারে নিশ্ছিদ্র বাথরূম। সেই জানালাও বন্ধ। জানালায় ট্রান্সলুসেন্ট গ্লাস বসানো। এই গ্লাস ভেদ করে ভিতরে কিছুই দেখতে পাবার কথা নয়। বাথরূমে নিরেট কাঠের মজবুত দরজা। কোথাও কোনও ধরনের ছিদ্র বা ফুটো নেই।

    প্রথম দিকে টুম্পা ব্যাপারটায় তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। ভেবে নেয় নিশ্চয়ই তার মনের ভুল। যে-কোনও মেয়েরই অপরিচিত বাথরূমে গোসল করার সময় প্রথম-প্রথম এমনই মনে হয়। ধীরে-ধীরে মনের এ অস্বস্তি কেটে যায়। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে টুম্পার ক্ষেত্রে সন্দেহটা আরও তীব্র হচ্ছে। আজকাল তার শুধু বাথরূমেই নয়, সবসময়ই মনে হয় কেউ তাকে লক্ষ করছে-আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখছে।

    টুম্পা বিষয়টা নিয়ে তার ছোট বোন রুম্পার সঙ্গে আলাপ করে।

    রুম্পা সব শোনার পর তার স্বভাবসুলভ গম্ভীর গলায় বলে, ‘কে তোকে লক্ষ করবে?’

    টুম্পা সন্দিহান গলায় বলে ওঠে, ‘গ্রামের কোনও বখাটে ছেলে-ছোকরা হয়তো!’

    রুম্পা বলে, ‘গ্রামের ছেলে-ছোকরা বাড়ির ভিতরে আসবে কোত্থেকে? বাড়ির চারপাশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের উপর বসানো তীক্ষ্ণ কাচের টুকরো। তার উপরে লোহার অ্যাঙ্গেলের সাথে তিন সারি কাঁটাতার। জেলখানার চেয়েও কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী। ভিতরে ঢোকার একমাত্র মেইন গেটও থাকে সবসময় তালাবদ্ধ। এমন নিরাপত্তা বেষ্টনী টপকে কেউ বাড়ির ভিতর ঢুকবে কীভাবে?’

    টুম্পা চিন্তিত গলায় বলে, ‘আমাদের বাড়ির কেয়ারটেকার হাবলু ভাইও তো হতে পারে।’

    হাবলু ভাইয়ের কথা শুনে রুম্পা কিছুটা চটে-যাওয়া গলায় বলে, ‘কী যে বলিস, আপা, হাবলু ভাইয়ের মত অমন আলাভোলা চেহারার একটা লোককেও সন্দেহ করছিস!’

    টুম্পা মুখ বেজার করে বলে, ‘তা হলে কে হতে পারে?’

    রুম্পা বিজ্ঞের মত বলে, ‘কেউ না। পুরোটাই তোর মনের ভুল। শুধু-শুধুই তুই একে-ওকে সন্দেহ করছিস।’

    তারা টুম্পা বিষয়টা নিয়ে জরিনার সঙ্গেও আলাপ করে। সব শোনার পর জরিনা রুম্পার মত পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দেয় না। বরং টুম্পার মনে আরও ভয় ধরিয়ে দেয়।

    জরিনা বলে, ‘আফা, জিন-ভূতও হইতে পারে। সুন্দর চেহারার মাইয়্যাগো উফর অনেক সময় জিন-ভূত আছর করে। মাশাল্লাহ! আফনের যে চেহারা!’

    শোন টুম্পা বিরক্ত গলায় বলে ওঠে, ‘জিন-ভূত বলে কিছু আছে নাকি! যত্তসব কুসংস্কার

    ‘কী কন, আফা! আছে মানে! আমাগো চাইরপাশে সবসময়ই জিন-পরীরা ঘুইর‍্যা বেড়ায়। অনেক সময় মাইনষের রূপ নিয়াও হেরা সামনে আয়। চেহারা দেইখ্যা কিছুই বোঝন যায় না। বদ জিনেরা অল্পবয়সী সুন্দরী মাইয়্যাগো নিরিবিলি সুযোগ মত পাইলে চাইপ্যা ধইর্যা মেলামেশা করে। তাগো মেলামেশায় বাচ্চা- কাচ্চাও পয়দা হয়। হিজড়া বাচ্চা। হিজড়ারা তো জিনের মেলামেশার কারণেই জন্ম নেয়।’

    জরিনার কথা শুনে টুম্পা ধমকে ওঠে, ‘কী সব আজেবাজে কথা বলছ!’

    ‘আফা, মোডেও আজেবাজে কথা না। সত্যই জিনেরা সুন্দরী মাইয়্যাগো লগে মেলামেশা করে। আর পুরুষ মাইনষেরে বশ করে পরীরা। জিন-পরীগো চেহারা-সুরতও মাশাল্লাহ ভাল। তয় তাগো গা দিয়া কেমন গোবর-গোবর গন্ধ আয়। এই জন্যেই হেরা গায়ে সবসময় সুগন্ধি আতর লাগায়।’

    টুম্পা আবার ধমকে ওঠে, ‘চুপ করো তো, জরিনা। তোমার আলতু-ফালতু কথা আর শুনতে ইচ্ছে করছে না।’

    টুম্পা জরিনাকে ধমকে থামিয়ে দিলেও তার মনে ঠিকই কিছুটা ভয় ঢুকে পড়েছে। মনে ভাবনা জাগে সত্যিই কি তার উপর কোনও জিন-ভূতের আছর হয়েছে? না হলে কে তাকে লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখে?

    .

    মাঝ রাত।

    টুম্পা নিজের ঘরে গভীর ঘুমে মগ্ন। এই মুহূর্তে সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নে সে মাটির নীচের ছোট্ট একটা কামরা দেখতে পাচ্ছে। কামরার মেঝেতে সারি করে সাতটা সোনার কলস সাজানো। কলসগুলোর গা বেয়ে-বেয়ে কুচকুচে কালো রঙের একটা সাপ এঁকেবেঁকে অনবরত সারির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাচ্ছে। যেন সাপটা কলসগুলোকে পাহারা দিচ্ছে। হঠাৎ সাপটা ফণা তুলে টুম্পার দিকে তাকাল। সাপটার চোখ দুটো টকটকে লাল। যেন গনগনে আগুনের দুটো মার্বেল।

    কী আশ্চর্য! দেখতে-দেখতে সাপটা একটা মানুষে রূপ নিল। কালো লিকলিকে চেহারার উলঙ্গ একটা মানুষ। মানুষটা সাধারণ কোনও মানুষ নয়। হিজড়া। শরীরের উপরের অংশ মেয়ে মানুষের মত, আর নীচের অংশ পুরুষের।

    হিজড়াটা চার হাত-পায়ে কুকুরের মত গন্ধ শুঁকতে-শুঁকতে টুম্পার দিকে এগিয়ে এল। টুম্পার পায়ের কাছে এসে প্রভুভক্ত কুকুরের মত চার-হাত পায়ে থাবা গেড়ে বসে, জিভ দিয়ে টুম্পার পা চাটতে শুরু করল। জিভ বেয়ে গড়িয়ে নামছে আঠাল লালা।

    ঘৃণায় টুম্পার সমস্ত শরীর রি-রি করে উঠল। এমন মুহূর্তে উত্তেজনায় ঘন-ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে টুম্পার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার পর বেশ কিছুক্ষণ লাগল এটা বুঝতে যে, এতক্ষণ সে দুঃস্বপ্ন দেখেছে—ওটা সত্যি ছিল না।

    ঘর সম্পূর্ণ অন্ধকার। গোবর-গোবর কেমন একটা বাজে গন্ধ টুম্পার নাকে লাগছে। যেন সে তার শোবার ঘরে নয়, কোনও গোয়াল ঘরে শুয়ে আছে। সে অন্ধকারে শোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসল। অমনি আরেকটা ব্যাপার অনুভব করে তার বুকটা ধক করে উঠল। অন্ধকারে কালো একটা অবয়ব তার খাটের চারপাশে পড়ছে। যে হাঁটছে তার গা থেকেই গোবর-গোবর গন্ধটা বেরোচ্ছে।

    টুম্পা আতঙ্কে কোনওক্রমে বলে উঠল, ‘কে, কে?! কে আমার খাটের চারপাশে ঘুরছে?’

    সঙ্গে-সঙ্গেই খাটের চারপাশে ঘুরতে থাকা কালো অবয়বটা অদৃশ্য হয়ে গেল। শোনা গেল জরিনার গলা, ‘আফায় কি ডরাইছেন?’

    জরিনার কণ্ঠস্বরটা যেন খাটের নীচ থেকে এল। খাটের নীচে জরিনা কী করছে?

    টুম্পা বলল, ‘জরিনা, তুমি খাটের নীচে কী করছ?’

    ‘কী যে কন, আফা, খাটের নীচে থাকমু ক্যান? আমি তো আফনের খাটের মাথার দিকে দাঁড়ানো।’

    ‘অন্ধকারে তুমি খাটের মাথার দিকেই বা দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? এতক্ষণ আমার খাটের চারপাশে ঘুরছিলে কেন?’

    ‘আফা, এইট্যা আফনে কী কইলেন! আফনের খাটের চাইরপাশে ঘুরতে যামু কোন্ দুঃখে! আফনের ডাক শুইন্যা আইলাম। পানি নিয়া আইছি।’

    ‘আচ্ছা, আগে বাতি জ্বালাও।’

    বাতি জ্বলে উঠল। জরিনাকে দেখা গেল। জরিনার পরনে লাল রঙের নতুন একটা শাড়ি। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। চোখে কাজল। মাথার চুল দু’দিকে বেণী করে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। হাতে পানি ভর্তি গ্লাস।

    গ্লাসটা টুম্পার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, ‘নেন, আফা, পানি খান। ডর বড় খারাপ জিনিস! ডরাইলে মাইনষের কইলজ্যা শুকাইয়া এট্টুহানি হইয়্যা যায়।’

    টুম্পা হতভম্বের মত জরিনার দিকে তাকিয়ে রইল। এত রাতে জরিনা এমনভাবে সেজেছে কেন? আর জরিনা যতই বলুক সে তার ডাক শুনে পানি নিয়ে এসেছে, এটা কোনওভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। জরিনা আগে থেকেই এই ঘরে ছিল। না হলে ডাকার সঙ্গে-সঙ্গেই সাড়া দিল কীভাবে? জরিনাই খাটের চারপাশে চক্কর মারছিল। গ্রামের অনেকে যে বলে জরিনার মাথায় ছিট আছে, কথাটা মনে হয় ঠিকই বলে।

    টুম্পা গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক চুমুকে পানিটুকু শেষ করল। খালি গ্লাসটা জরিনার হাতে ফিরিয়ে দিতে-দিতে বলল, তুমি আমার খাটের চারপাশে না হাঁটলে, কে হাঁটছিল? ভুল হবার কথা নয়, নিশ্চয়ই কাউকে আমি দেখেছি!’

    ‘আফা, মনে অয় আফনের উফর বদ জিনের আছর হইছে। বদ জিনেরা সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় আশপাশেই থাহে। অনেক সময় ঘুমের মইধ্যেও চাইপ্যা ধইর্যা মেলামেশা করে।

    টুম্পা গর্জে উঠল, ‘যাও, এখান থেকে যাও, এখনি আমার সামনে থেকে দূর হও। বেআক্কেল কোথাকার! সুযোগ পেলেই জিনের গল্প শোনাতে আসে।’

    জরিনা চলে গেল। টুম্পা টয়লেটে যাবার জন্য বিছানা থেকে নামল। তার দু’পায়ে আঠাল চটচটে কী যেন লেগে রয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে তার দুঃস্বপ্নটার কথা মনে পড়ল। স্বপ্নে লিকলিকে চেহারার হিজড়াটা তার পা চাটছিল। হিজড়াটার জিভ দিয়ে লালা ঝরছিল। সেই লালাই কি তার পায়ে লেগে আছে?! সেটা কী করে সম্ভব?!

    তিন

    রুম্পা সঙ্গে করে এক স্যুটকেস বই নিয়ে এসেছিল। এ ক’দিনে সবগুলো বই পড়ে শেষ করেছে। বই পড়া তার কাছে নেশার মত। বই ছাড়া সে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। ভেবেছিল, সে সঙ্গে করে যতগুলো বই নিয়ে এসেছে সেগুলো শেষ হবার আগেই তাদের ঢাকা ফেরা হবে। এখন মনে হচ্ছে আরও কয়েক দিন থাকা হবে। বিশেষ করে তার বাবার কারণেই যাওয়া হচ্ছে না। আজকাল তার বাবা সারাদিন-রাত পড়ে-পড়ে ঘুমাচ্ছেন। যাওয়ার কথা বললে বলছেন, ‘ঢাকায় গেলে তো আবার সেই ব্যস্ত জীবন, আরও দুটো দিন একটু আরাম করে নিই।’

    গ্রামে আসার পর তার বাবা যেন সম্পূর্ণ বদলে গেছেন। যে লোকটা কাজ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতেন না, তিনি এখন দিন-রাত শুধু ঘুমান। লম্বা ঘুমের পর জেগে উঠে পেট পুরে খাওয়া-দাওয়া করেন। খাওয়া-দাওয়ার শেষে দুই-তিন খিলি পান একসঙ্গে মুখে পুরে আবার শুয়ে পড়েন। কেয়ারটেকার হাবলু মাথা বানিয়ে দিতে লেগে পড়ে। পান চিবোতে-চিবোতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে যান। এটাই তাঁর এখনকার দৈনিক রুটিন।

    রুম্পা ভাবনায় পড়েছে এই অজপাড়াগাঁয়ে এখন সে নতুন বই পাবে কোথায়? বই ছাড়া সময় কাটানো সম্ভব নয়।

    রুম্পার মনে পড়ল, জমিদার মহলটা ভাঙার সময় জমিদার মহলের ভিতরে পুরানো কিছু বই, ব্যক্তিগত ডায়েরি, পুঁথি, নথি- পত্র আর দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া যায়। সেগুলো নাকি ফেলে না দিয়ে বাড়ির স্টোররূমে রাখা হয়েছে। ভাবল, সেগুলো ঘেঁটে পড়ার মত যদি কিছু পাওয়া যায়।

    রুম্পা স্টোররূম ঘেঁটে পড়ার মত শুধু একটা ডায়েরি উদ্ধার করতে পারল। চামড়ায় বাঁধানো তুলট কাগজের একটা ডায়েরি। অন্য সবই ইঁদুরে কেটে একাকার করে ফেলেছে। ডায়েরিটা চামড়ায় বাঁধানো বলেই মনে হয় রক্ষে পেয়েছে।

    রুম্পা ডায়েরিটা পড়তে শুরু করল। কার লেখা ডায়েরি বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, ডায়েরিতে লেখকের নাম নেই। গোটা- গোটা স্পষ্ট হাতের লেখা। পড়তে একটুও বেগ পেতে হচ্ছে না। লেখার ভঙ্গিও সাবলীল।

    ঘণ্টাখানিকের মধ্যে পুরো ডায়েরি পড়ে শেষ করে ফেলল রুম্পা। পড়া শেষে এখন তার হাত-পা রীতিমত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কপাল ঘামছে। অজানা আতঙ্কে বুক ধুকপুক করছে।

    ডায়েরি পড়ে রুম্পা জানতে পেরেছে, এখানকার জমিদার মহলটা ছিল জমিদার আদিত্য নারায়ণ রায়চৌধুরীর। লোকটা অত্যন্ত জেদি, বদমেজাজি, স্বেচ্ছাচারী আর নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিলেন। তাঁর কোনও সন্তানাদি হচ্ছিল না। সন্তানের আশায় তিনি একের পর এক সাতটা বিয়ে করেন। কিন্তু তাঁর সাতজন স্ত্রীর কেউই সন্তানের মুখ দেখাতে পারে না। এ কারণে তিনি স্ত্রীদের উপর অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন চালাতেন। একসময় তিনি বুঝতে পারেন সমস্যাটা তাঁর নিজের। স্ত্রীদের কোনও সমস্যা নেই। তিনিই আঁটকুড়ে জমিদার। নিজের অক্ষমতা জানার পরও তিনি সন্তানের আশা ছাড়েন না। বরং আরও মরিয়া হয়ে ওঠেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নামকরা বৈদ্য, কবিরাজ, হেকিম, তান্ত্রিক, ওঝাদের শরণাপন্ন হতে থাকেন। কেউই তাঁর সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। শেষ পর্যন্ত এক সাঁওতাল ওঝা এসে বলে, সে তাঁর সমস্যার সমাধান দিতে পারবে-দেখাতে পারবে সন্তানের মুখ। এজন্যে তাঁকে গুডরোবোঙ্গা নামে এক অপদেবতার সাহায্য নিতে হবে।

    এই অপদেবতা দেখতে বামনদের মত। পুরুষ ও স্ত্রী লোকের সংমিশ্রণ যেন। কাছ থেকে দেখলে মনে হয় দুই-তিন বছরের কোনও বাচ্চার কাঁধে ভয়ঙ্কর চেহারার কোনও মহিলার মাথা জুড়ে দেয়া হয়েছে। তার সমস্ত মুখের চামড়া কুঁচকানো ভাঁজ-ভাঁজ। নাকের জায়গাটায় থ্যাবড়ানো মাংসপিণ্ড। গনগনে লাল চোখ পিঠের উপরে কুঁজের মত। বানরের পায়ের মত ঘন লোমযুক্ত পা।

    সাঁওতালরা এই বামন অপদেবতাকে প্রচণ্ড ক্ষমতার আধার বলে মনে করে। তাকে খুশি করতে পারলে সবকিছু পাওয়া যায়। বিশেষ করে সন্তান না হলে সাঁওতালরা এই অপদেবতার পূজা-অর্চনা করে সন্তান লাভ করে।

    জমিদার গুডরোবোঙ্গা অপদেবতার সাহায্য নিতে রাজি হয়ে যান। এজন্যে তাঁকে সাঁওতাল ওঝার নির্দেশ মোতাবেক বাড়িতে গুডরোবোঙ্গা অপদেবতার জন্য একটা মন্দির বানাতে হয়। মন্দিরটা বানানো হয় বিশ-পঁচিশ ফুট মাটির গভীরে। ছোট্ট একটা মন্দির। মন্দিরে স্থাপন করা হয় গুডরোবোঙ্গা অপদেবতার মূর্তি। অপদেবতাকে খুশি করার জন্য মূর্তির সামনে নৈবেদ্য দেয়া হয় সাতটা সোনার কলস ভর্তি মোহর আর একটা জলজ্যান্ত হিজড়াকে। হিজড়াটাকে মন্দিরের ভিতরে বন্দি করে প্রবেশদ্বার চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর মাটির গভীরে থাকা মন্দিরটা উপর থেকে মাটি ফেলে চাপা দিয়ে লোকচক্ষুর আড়াল করা হয়। জায়গাটা চিহ্নিত করার জন্য সেখানে একটা বট গাছ লাগানো হয়।

    সব শেষে সাঁওতাল ওঝা চলে যায়। যাওয়ার আগে জমিদারকে বলে যায় সন্তানের জন্য আর মাত্র কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে। শীঘ্রিই তাঁর ঘর আলো করে সন্তান আসছে।

    গুডরোবোঙ্গা অপদেবতার মন্দির বানানোর কয়েক মাসের মাথায় জমিদার আদিত্য নারায়ণের দরবারে এক অসহায় দম্পতি এসে উপস্থিত হয়। নদীভাঙনে সেই দম্পতি বাড়ি-ঘর সবকিছু হারিয়েছে। জমিদারের কাছে অনুরোধ করে তাদেরকে একটু ঠাঁই দেয়ার জন্য। মহিলাটি ছিল অপরূপা। সেই তুলনায় পুরুষটি ছিল একেবারে কদাকার। স্ত্রী লোকটার চেহারা ভাল হওয়ায় জমিদার লালসার বশীভূত হয়ে জমিদার মহলেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন।

    অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্ত্রী লোকটা জমিদারের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে। জমিদার সেই স্ত্রী লোকটার সঙ্গ অত্যন্ত পছন্দ করেন। তার হাতের রান্না খেতে পছন্দ করেন, তার হাতের খিলি বানানো পান পছন্দ করেন—তার সেবা-যত্ন নিতে পছন্দ করেন।

    স্ত্রী লোকটার হাতের রান্না ভরপেট খাওয়া-দাওয়ার পর জমিদার পান মুখে হুক্কায় টান দিতে-দিতে বিছানায় গা এলিয়ে দেন। আর তখন সেই স্ত্রী লোকটা জমিদারের হাত-পা- মাথা-সমস্ত শরীর বানিয়ে দিতে লেগে পড়ে। এক পর্যায়ে জমিদার আরামে ঘুমিয়ে পড়েন। জমিদার ঘুমিয়ে পড়ার পরও স্ত্রী লোকটা তাঁর হাত-পা-মাথা-সমস্ত শরীর বানিয়ে দিতেই থাকে।

    জমিদার লম্বা ঘুমের পর জেগে উঠে আবার পেট পুরে খেয়ে, পান মুখে হুক্কায় টান দিতে-দিতে বিছানায় গা এলিয়ে দেন…জমিদারি দেখাশোনা থেকে শুরু করে অন্যান্য সব কাজই যেন তিনি ভুলে যান। তাঁর জীবন আটকে যায় খাওয়া আর ঘুমের মধ্যে। সেই স্ত্রী লোকটা তাঁকে যেন জাদু করে ফেলে। স্ত্রী লোকটা সবসময় জমিদারের পাশে-পাশেই থাকে। মহলে কানাঘুষা শোনা যায় তার গর্ভে জমিদারের সন্তান এসেছে। তবে সত্যিই সে গর্ভবতী কি না সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।

    এদিকে পুরো জমিদার বাড়িতে যেন অভিশাপ নেমে আসে। জমিদারের স্ত্রীদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কবিকৃতি দেখা দেয়। একজন- একজন করে পর্যায়ক্রমে আক্রান্ত হতে থাকে। প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটে। প্রথমে তারা বলে কেউ তাদের সবসময় লক্ষ করে, তাদের লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখে, গোসলখানায়, শোবার ঘরে, খাবারঘরে-সব জায়গায়। ধীরে-ধীরে সেই সন্দেহ ভয় রোগে পরিণত হয়। সারাক্ষণ ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। একসময় পুরোপুরি মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটে। মাথা খারাপ হয়ে যাবার পর কোনও একদিন আত্মহত্যা করে মারা যায়। কেউ বিষ খেয়ে, কেউ গলায় দড়ি দিয়ে, কেউ মহলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে…এভাবে একের পর এক সাত স্ত্রীরই মৃত্যু ঘটে। এমনকী জমিদার মহলের দাস-দাসীরাও বিভিন্ন অপঘাতে মরতে শুরু করে। কেউ-কেউ আবার ভয়ে জমিদার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে।

    ওদিকে দিনে-দিনে জমিদারের খাওয়া আর ঘুম বাড়তেই থাকে। সব শেষে একদিন ঘুমের মধ্যে জমিদারেরও মৃত্যু হয়। সেদিন জমিদার এমন লম্বা ঘুম দেন যে তাঁকে আর জাগানো যায় না।

    ডায়েরি লেখক এই পর্যায়ে নিজের কথা লিখেছে। ডায়েরি লেখক বুঝতে পেরেছে জমিদার বাড়িতে অভিশাপ নামার কী কারণ। কারণ, গুডরোবোঙ্গা অপদেবতার মন্দির বানানো। গুডরোবোঙ্গা অপদেবতাকে ডেকে আনার পূজা-অর্চনার কোথাও এমন কোনও ভুল হয়েছে যে নৈবেদ্য হিসেবে দেয়া হিজড়াটার আত্মা আবার ফিরে এসেছে। নদীভাঙনে বাড়ি-ঘর সব হারিয়ে গেছে বলে যে দম্পতি জমিদার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে, তারা আসলে মানুষ নয়। তারা দু’জনই একজন। অপদেবতাকে নৈবেদ্য দেয়া হিজড়াটার দুটি রূপ। নারী-পুরুষের রূপ ধরা দু’জনই হিজড়াটার অতৃপ্ত আত্মার ভিন্ন-ভিন্ন দুই রূপ।

    ডায়েরি লেখক যতদিনে এসব বুঝতে পেরেছে ততদিনে সবই শেষ। তখন আর কিছুই করার নেই। ডায়েরি লেখকের নিজের মধ্যেও অদ্ভুত-অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। সে স্বাভাবিক মানুষ থেকে হিজড়ায় রূপান্তর হয়ে যাচ্ছে।

    ডায়েরিটা পড়ে রুম্পা আতঙ্কিত হচ্ছে এই ভেবে, জমিদারের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল-এখন কিন্তু তার বাবার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। সারাদিন পড়ে-পড়ে ঘুমানো। জমিদারের স্ত্রীদের ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল, তা এখন তার বড় বোন টুম্পার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে-অহেতুক ভয় পাওয়া। দিনে-দিনে টুম্পার ভয় পাওয়া মস্তিষ্কবিকৃতির দিকেই যাচ্ছে।

    হাবলু-জরিনা এরা কারা? জমিদার মহলের সেই দম্পতি যেমন বলেছিল নদীভাঙনে তাদের বাড়ি-ঘর হারিয়েছে, হাবলু- জরিনাও সেই একই কথা বলেছে। হতে পারে হাবলু-জরিনা সেই অপদেবতাকে নৈবেদ্য দেয়া হিজড়াটারই দুটি রূপ। তখন জমিদার বাড়ির সবাইকে যেমন মেরে ফেলেছিল, তেমনি এখন এসেছে তাদেরকে মারতে।

    বাড়ির পিছনে অনেক পুরানো ঝুরি নামানো একটা বিশাল বট গাছ আছে। হতে পারে এটা সেই বট গাছ, যে বট গাছের নীচে রয়েছে গুডরোবোঙ্গা অপদেবতার মন্দির।

    রুম্পার রূমের জানালা দিয়ে বট গাছটা দেখা যায়। রুম্পা জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। বট গাছটা দেখা যাচ্ছে। রূপালী চাঁদের আলোতে বিশাল বট গাছটা দানবের মত ডাল- পালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রুম্পার মনে হলো বট গাছের ছায়ায় কে যেন রয়েছে। অস্পষ্ট কালো একটা অবয়ব।

    ধীরে-ধীরে কালো অবয়বটা স্পষ্ট হলো। বামন আকৃতির একটা উলঙ্গ হিজড়া। যেন দুই-তিন বছরের একটা বাচ্চা ছেলের কাঁধে কুৎসিত চেহারার কোনও মহিলার মাথা জুড়ে দেয়া হয়েছে।

    রুম্পার বুকটা ধক করে উঠল। চোখ দুটো ভয়ে ছানাবড়া হয়ে গেল। তার ভীত চাউনি দেখে হঠাৎ হিজড়াটা আকাশ- বাতাস কাঁপিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। হাসির শব্দে বট গাছ ছেড়ে এক ঝাঁক বাদুড় ডানা ঝাপটে উড়ে গেল।

    আর এক মুহূর্তও দেরি না করে রুম্পা জানালার পর্দাটা টেনে ওখান থেকে সরে এল। মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিল যেভাবেই হোক কালই তাদের এ বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে যেতে হবে।

    পরিশিষ্ট

    ঢাকায় চলে আসার পর রুম্পাদের পরিবারের সবকিছু আবার আগের মত স্বাভাবিক নিয়মে চলতে শুরু করে। রুম্পার বাবা হানিফ সাহেব আগের মত দিন-রাত ব্যবসার দেখাশোনায় ডুবে যান। বড় বোন টুম্পা নিয়মিত ভার্সিটির ক্লাস করে আর বন্ধু- বান্ধব নিয়ে হৈ-হল্লায় মেতে থাকে। রুম্পাও আগের মত সারাদিন নিজের কামরায় বই নিয়ে পড়ে থাকে। তবে রুম্পার শরীরে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। বিষয়টা সে গোপন রাখছে, কাউকে বলছে না। এসব কথা কাউকে বলাও যায় না। তার জননাঙ্গটা ধীরে-ধীরে পুরুষাঙ্গে রূপান্তর হচ্ছে। অর্থাৎ সে হিজড়া হয়ে যাচ্ছে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপার্থিব প্রেয়সী – আফজাল হোসেন
    Next Article ক্যামিল – পিয়ের লেমেইত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }