Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গুহামানবী – আফজাল হোসেন

    লেখক এক পাতা গল্প231 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    বিয়ের আংটি

    মাঘ মাসের শীতের রাত। পৌনে দশটা বাজে। চারদিক ডুবে আছে ঘন কুয়াশায়। কয়েক দিন ধরে ভয়াবহ শীত পড়ছে। শীতের দাপটে সন্ধ্যার পরপরই রাস্তা-ঘাট একেবারে জনশূন্য হয়ে যায়।

    মতি মিয়া তাঁর পুরানো মোটর বাইকটায় সর্বোচ্চ গতি তুলে ফাঁকা রাস্তায় ছুটে চলেছেন। বাইকটা যতটা না ছুটছে তারচেয়ে ভটভট শব্দ করছে বেশি। বাইকটার এই ভটভট শব্দের কারণে, অনেকে এটাকে ট্রলার বলে। অনেকে বলে মতি মিয়ার ভটভটি। লোকের ধারণা, তাঁর এই ভটভটির সর্বোচ্চ গতির চেয়ে বোধহয় একটা ঠেলা গাড়ির গতিও বেশি হবে।

    মতি মিয়ার কাঠের ব্যবসা। সদরের চক বাজারে ‘মতি টিম্বার’ নামে তাঁর একটি কাঠের দোকান আছে। তিনি দূর-দূরান্তের বিভিন্ন গ্রাম থেকে অপেক্ষাকৃত কম দামে আস্ত গাছ কিনে, চেরাই করিয়ে কাঠ বানিয়ে বিক্রি করেন।

    আজও গিয়েছিলেন ঠাকুরপুর নামে এক গণ্ডগ্রামে, গাছের দর- দাম করতে। সেখান থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেল।

    .

    মতি মিয়া তাঁর বাড়ির উঠানে পৌঁছে গেছেন। বাড়িতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী, দু’জন মাত্র মানুষ থাকেন। তাঁর এক ছোট ভাইও আছে। ছোট ভাইয়ের নাম মিলন। মিলন ঢাকায় থাকে। একটা বায়িং হাউসে চাকরি করে। ছুটি-ছাটায় মাঝে-মাঝে বাড়ি আসে। প্রতিবারই ভাই-ভাবির জন্য অনেক উপহার নিয়ে আসে। ভাই- ভাবিকে খুব ভালবাসে।

    মিলনের বয়স তিরিশ পেরিয়েছে। মতি মিয়া অনেক দিন ধরেই মিলনকে বিয়ে করানোর কথা ভাবছেন। তিনি নিজে বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন, ভাইয়ের ক্ষেত্রেও আবার কোনওভাবেই সেটা হতে দেবেন না।

    মতি মিয়া বিয়ে করেছেন পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে। বয়স বেশি হওয়ায় বিয়ের কনে পেতে বেশ ঝামেলা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত পঁচিশ বছর বয়সী লতিফাকে বিয়ে করেন। লতিফা দেখতেও বেশ সুন্দরী। তবে লতিফাদের পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। বলা যায় নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। এ কারণেই হয়তো লতিফার বাবা-মা বেশি বয়সী পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে রাজি হয়েছিলেন।

    লতিফা দেখতে-শুনতে যেমন সুন্দরী, তেমন সংসারীও বটে। খুবই ভাল মেয়ে। মতি মিয়ার অনেক খেয়াল-যত্ন নেয়। সমস্ত বাড়ি-ঘর ঝেড়ে-মুছে একেবারে ঝকঝকে-তকতকে করে রাখে। রান্নার হাতও চমৎকার। যা-ই রান্না করুক অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। লতিফাকে পেয়ে মতি মিয়া নিজেকে ধন্য মনে করেন। কপাল জোরেই বোধহয় এমন রূপবতী, গুণবতী স্ত্রী তাঁর জুটেছে।

    .

    বাড়ির উঠানে পা রেখে মতি মিয়ার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। কারণ, সমস্ত বাড়ি ডুবে আছে গাঢ় অন্ধকারে। সে সঙ্গে যেন সমস্ত বাড়িটা ঘন ধোঁয়ায়ও আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। কেমন একটা পোড়া গন্ধও নাকে লাগছে। যেন তিনি ভুল করে অন্য কোনও বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন-যে বাড়িতে কেউ থাকে না। পরিত্যক্ত পোড়ো বাড়ি।

    এমনিতে প্রতি রাতে মতি মিয়া বাড়ি ফেরার পর তাঁর মোটর বাইকের ভটভট শব্দ শুনেই লতিফা হারিকেন হাতে দরজা খুলে বেরোয়। মুখ-হাত ধোয়ার জন্য এক বালতি পানি আর তোয়ালে হাতের কাছে এগিয়ে দেয়।

    কিশোরীদের মত রিনরিনে আহ্লাদী গলায় অনুযোগ করে, ‘আফনে আইজ রাইতেও ফিরতে এত দেরি করলেন! আমার বুঝি একলা-একলা ডর লাগে না!’

    কিন্তু আজ লতিফাকে দেখা যাচ্ছে না। লতিফাকে বিয়ে করে আনার পর এমনটা আর কোনও দিনও হয়নি।

    মতি মিয়া মোটর বাইকটাকে উঠানের মাঝে দাঁড় করিয়ে, ‘লতিফা, লতিফা…’ বলে ডাকতে-ডাকতে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

    লতিফার কোনও সাড়া মিলল না। কী হলো লতিফার?! ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?

    মতি মিয়া জোরে-জোরে দরজার কড়া নাড়তে শুরু করলেন।

    নাহ্! ভিতর থেকে কারও কোনও সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না!

    মতি মিয়া জোরে-জোরে দরজার কড়া নাড়ার সঙ্গে, ‘লতিফা, লতিফা…’ বলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুললেন। সেই শব্দে আশপাশের বাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন প্রতিবেশী চলে এল।

    প্রতিবেশীরাও মতি মিয়ার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ডাকাডাকি শুরু করল।

    ‘ভাবিজান, ও ভাবিজান…’

    কিন্তু ভিতর থেকে কারও কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, লতিফা যেন বাড়িতে নেই।

    সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার। নিশ্চয়ই ভিতরে কোনও সমস্যা হয়েছে। কেমন একটা পোড়া গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে।

    দরজা ভেঙে ফেলা হলো। পোড়া গন্ধ অনুসরণ করে সবাই মিলে চলে এল বাড়ির রান্নাঘরে।

    রান্নাঘরে ঢুকে সবার চোখ ছানাবড়া। রান্নাঘরের মেঝেতে পোড়া বিকৃত এক নারী দেহ পড়ে রয়েছে। কারও বুঝতে এক মুহূর্তও দেরি হলো না এই পোড়া মৃতদেহটা যে লতিফার।

    মতি মিয়া স্থবিরের মত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।

    খবর পেয়ে স্থানীয় থানা থেকে পুলিশ চলে এল। পুলিশ পোড়া লাশটাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল।

    পুলিশের ধারণা রান্নাঘরের কেরোসিনের স্টোভ থেকে লতিফার গায়ে আগুন লেগেছিল। স্রেফ দুর্ঘটনা। কোনওভাবেই আত্মহত্যা বা খুন নয়। তেমন কোনও আলামত পাওয়া যায়নি।

    .

    লতিফার মৃত্যুর পর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। সেই থেকে মতি মিয়া একেবারে মন মরা হয়ে আছেন। আগের মত কোনও কাজেই এখন আর তাঁর উৎসাহ নেই। কাঠের ব্যবসারও তেমন একটা খোঁজ-খবর নেন না। অধিকাংশ সময় বাড়িতেই থাকেন। একা-একা লতিফার স্মৃতি রোমন্থন করে, চোখের জল ফেলে দিন পার করেন। নাওয়া-খাওয়া ঘুম কিছুই ঠিক মত হয় না। দিনে- দিনে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ছে।

    দু’দিন ধরে মতি মিয়া জ্বরে ভুগছেন। ঘরে থাকা জ্বরের ওষুধ খাচ্ছেন। ওষুধ খাওয়ার পরপর জ্বর কমে যায়, আবার ওঠে বাড়িতে তিনি একা। তাঁকে দেখাশোনার কেউ নেই। অসুস্থ অবস্থায়ও নিজেরটা নিজেরই করতে হচ্ছে। তাঁর শরীর এতই দুর্বল হয়ে গেছে যে, জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতেও কষ্ট হচ্ছে। তবে জ্বরে পড়ার পর থেকে একটা ব্যাপার লক্ষ করে তিনি অবাক হচ্ছেন। সেটি হলো, তাঁর যখন যেটার প্রয়োজন পড়ছে তা হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছেন। এই যেমন গতকাল রাতে গায়ে জ্বর ওঠার পরপর একটা কম্বলে যখন শীত মানছিল না, ভাবলেন আলমিরা থেকে আরেকটা কম্বল বের করে নেবেন। পাশ ফিরে বিছানা থেকে উঠতে গেলেন, দেখলেন, কে যেন আগেই আলমিরা থেকে অন্য কম্বলটা বের করে তাঁর পায়ের কাছে রেখে গেছে।

    মাঝ রাতে ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড পিপাসা নিয়ে। দেখলেন বেড সাইড টেবিলে কে যেন এক গ্লাস পানি পিরিচ দিয়ে ঢেকে রেখে দিয়েছে। অথচ তাঁর স্পষ্ট মনে আছে ঘুমোবার আগে তিনি বেড সাইড টেবিলের উপর গ্লাস ভর্তি পানি রাখেননি।

    সকালে ঘুম ভাঙার পর মনে হলো গরম দুধ দিয়ে যদি পাউরুটি ভিজিয়ে খেতে পারতেন! জ্বর হলে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। কিছুই খেতে ভাল লাগে না। দুধে ভিজানো পাঁউরুটি খেতে ভাল লাগতেও পারে। ভাবলেন, আশপাশের বাড়ির কাউকে ডেকে দোকান থেকে দুধ আর পাউরুটি আনিয়ে নেবেন। খাবার ঘরে ঢুকে দেখেন, খাবার টেবিলের উপর কে যেন আগেই এক গ্লাস ধোঁয়া ওঠা গরম দুধ আর পাউরুটি রেখে গেছে।

    এ রকম ছোট-খাট অনেকগুলো ব্যাপারই ঘটছে, জ্বর মাপার জন্য থার্মোমিটার খুঁজছেন, দেখেন থার্মোমিটারটা তাঁর বালিশের পাশে। চশমাটা খুঁজে পাচ্ছেন না, কিছুক্ষণ পর দেখেন চশমাটা বেড সাইড টেবিলের উপর। জগে পানি ছিল না, কিছুক্ষণ পর দেখেন জগ ভর্তি পানি। কিছুক্ষণের জন্য টয়লেটে গেছেন, বেরিয়ে দেখেন তাঁর ঘর-দোর কে যেন ঝাড়-পৌঁছ দিয়ে, বিছানা-আলনা সব পরিপাটি করে রেখে গেছে।

    সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে আজ দুপুরে। ঘরে খাওয়ার কিছু ছিল না। তবে চাল, ডাল, আলু, ডিম, পিঁয়াজ, রসুন, গরম মসলা…এসবই ছিল। ভাবলেন সামান্য খিচুড়ি পাকিয়ে ডিম ভেজে খেয়ে নেবেন। বিছানা থেকে উঠে দুর্বল শরীরে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। যেতে-যেতেই নাকে সদ্য চুলো থেকে নামানো ধোঁয়া ওঠা গরম খিচুড়ি আর ডিম ভাজার লোভনীয় গন্ধ পেলেন। রান্নাঘরে ঢুকে দেখেন সত্যিই কে যেন তাঁর জন্য খিচুড়ি আর ডিম ভাজি করে রেখেছে। অথচ বাড়িতে তিনি একা। তা হলে এসব কে করছে?!

    তিনি যেমন অবাক হচ্ছেন, তেমন কিছুটা ভয়ও পাচ্ছেন। লতিফার আত্মা ফিরে এল কি?! এমন দরদ এই পৃথিবীতে একমাত্র লতিফাই তাঁকে দেখিয়েছিল। অল্প বয়সেই বাবা-মা দু’জনকে হারান। সেই থেকে অনাদর আর অবহেলায় অনেক সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন। ছোট ভাই মিলনকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মত মানুষ করেছেন। শেষ পর্যন্ত প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে তাঁর জীবনে লতিফা এসেছিল মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টির মত ভালবাসা আর মমতা নিয়ে। সত্যিই লতিফা তাঁকে খুব ভালবাসত। হয়তো সে কারণেই তাঁর এই দুঃসময়ে মৃত্যুর ওপারের জগৎ থেকেও লতিফার আত্মা ফিরে এসেছে তাঁকে সেবা-যত্ন করার জন্য। মাঝে-মাঝে নাকি অপঘাতের মৃতরা এভাবে প্রিয় মানুষটার কাছে ভালবাসার টানে ফিরে আসে।

    .

    সন্ধ্যার পর থেকে মতি মিয়ার গায়ে জ্বর খুব বাড়ছে। বাড়তে- বাড়তে জ্বর সাংঘাতিক রূপ নিয়েছে। তিনি এখন চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছেন। যেন অন্ধকারের মাঝে লক্ষ জোনাকি উড়ে বেড়াচ্ছে। মাথাটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত শরীর কেমন অসাড় হয়ে আসছে।

    এমন জ্বরের মুহূর্তে মাথায় পানি ঢালার প্রয়োজন। এবং কিছুক্ষণ পরপর ভেজা তোয়ালে দিয়ে সমস্ত শরীর মুছিয়ে দিতে হয়। মতি মিয়া বাড়িতে একা। কে তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করবে? এমন সময় টের পেলেন লাল শাড়ি পরা, লম্বা ঘোমটা টানা কে যেন এসে তাঁর মাথার কাছে বসেছে। তাঁর কপালে হাত রেখেছে। ঠাণ্ডা, তুলোর মত নরম আর হালকা একটা হাত। তবে লাল শাড়ি পরা মেয়ে-মানুষটাকে কেমন ছায়া-ছায়া লাগছে। দিঘির টলমলে জলে কারও ছায়া পড়লে যেমন দেখায় ঠিক তেমন। যেন ছায়ামানবী! কে এই ছায়ামানবী?! নিশ্চয়ই লতিফা! লতিফা ছাড়া আর কে হবে?! লতিফা লম্বা করে ঘোমটা টেনে রেখেছে কেন? মুখটা তো দেখা যাচ্ছে না। লতিফার মুখটা তাঁর খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘মুখের উপর থেকে ঘোমটাটা একটু সরাও। প্রাণ ভরে তোমার মুখটা দেখি!’

    ক্রমেই জ্বরের ঘোরে তলিয়ে-যাওয়া মতি মিয়া বুঝতে পারলেন, লাল শাড়ি পরা মেয়ে-মানুষটা তাঁর মাথায় পানি ঢালছে, আর কিছুক্ষণ পরপর ভেজা তোয়ালে দিয়ে তাঁর সমস্ত গা মুছিয়ে দিচ্ছে। খুব আরাম লাগছে তাঁর। আরামে চোখ বন্ধ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এর পরও তিনি অতি কষ্টে চোখ মেলে রেখেছেন লাল শাড়ি পরা ছায়ামানবীকে চোখে-চোখে রাখার জন্য। যেন চোখ বন্ধ করলেই সে পালিয়ে যাবে। এমন দরদিয়াকে তিনি হারাতে চান না! এক মুহূর্তের জন্যও হারাতে চান না।

    .

    লম্বা ঘোমটা টানা ছায়ামানবী সারা রাত ভর মতি মিয়ার সেবা- শুশ্রূষা করেছে। এক পর্যায়ে মাথায় পানি ঢালা এবং ভেজা তোয়ালে দিয়ে গা মুছিয়ে দেয়া বন্ধ করে শুধু কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। রাত এখন ফুরিয়ে এসেছে। মতি মিয়ার জ্বরও ধীরে- ধীরে কমে আসছে। ঘুমে তাঁর চোখ জড়িয়ে যেতে চাইছে। ঘুম- ঘুম চোখে তিনি দেখতে পাচ্ছেন, লাল শাড়ি পরা ছায়ামানবী তাঁর শিয়রের পাশ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বোধহয় সে চলে যাচ্ছে। আরে! ছায়ামানবী তো কাঁদছে! নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার শরীর কেঁপে-কেঁপে উঠছে। কাঁদতে-কাঁদতে সে মতি মিয়ার বালিশের নীচে কী যেন রাখল। মতি মিয়া তাঁর চোখ দুটো আর মেলে রাখতে পারলেন না। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।

    .

    দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে মতি মিয়ার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙতেই অভ্যাসবশত তাঁর চোখ পড়ল দেয়াল ঘড়িতে। বেলা সাড়ে দশটা বাজে। তিনি উঠে বসলেন। গায়ে একটুও জ্বর নেই। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে নেমে গিয়ে দরজা খুললেন।

    দরজায় স্থানীয় থানার ওসি সাহেব দাঁড়ানো। ওসি সাহেব মতি মিয়াকে দেখে সালাম দিলেন।

    মতি মিয়া ওসি সাহেবের সালামের জবাব দিয়ে কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওসি সাহেব যে?!’

    ওসি সাহেব বললেন, ‘আপনাকে একটা বিষয় জানাতে এলাম।’

    মতি মিয়া বললেন, ‘আসুন, আগে ভিতরে এসে বসুন। বলুন তো কী ব্যাপার?!’

    ওসি সাহেব আমতা-আমতা করে বললেন, ‘আপনাকে যে কী করে বলি…’

    মতি মিয়া অবাক গলায় বলে উঠলেন, ‘ভূমিকা না করে কী হয়েছে বলুন তো। কোনও বিপদ-আপদ ঘটল কি?’

    ওসি সাহেব ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আপনার স্ত্রী মারা যায়নি। সে বেঁচে আছে।’

    মতি মিয়া প্রচণ্ড আশ্চর্য-হওয়া গলায় বলে উঠলেন, ‘কী বলছেন এসব! আপনারাই তো তার পোড়া মৃতদেহ উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলেন!’

    ‘সেটা অন্য আরেকজনের মৃতদেহ ছিল।’

    বিস্ময়ে বুজে-আসা গলায় মতি মিয়া বললেন, ‘সেটা অন্য আরেকজনের মৃতদেহ ছিল, মানে?! কার মৃতদেহ ছিল?! তা হলে লতিফা কোথায়?! কিছুই তো বুঝতে পারছি না!’

    ওসি সাহেব বলতে লাগলেন, ‘আপনাকে তা হলে খোলসা করেই সব বলি। আপনার স্ত্রী লতিফা এখন ঢাকায়। আপনার ছোট ভাই মিলনের সঙ্গে আছে সে। সে মিলনের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। আপনার অজান্তে অনেক আগে থেকেই তাদের মধ্যে পরকীয়া চলছিল। আগুনে পোড়া বিকৃত যে লাশটা আমরা পাই সেটা সদরের হাসপাতালের মর্গ থেকে আনা একটা বেওয়ারিশ লাশ। মিলন আর আপনার স্ত্রী মিলে সদরের হাসপাতালের মর্গ থেকে ওই বেওয়ারিশ লাশটা কিনে এনেছিল। তারা সেই বেওয়ারিশ লাশটাকে কেরোসিন ঢেলে এমনভাবে পুড়িয়ে রেখে গিয়েছিল, যাতে সবাই মনে করে ওটা লতিফার লাশ। মানে তারা সবার কাছে লতিফাকে মৃত প্রমাণ করতে চেয়েছিল।’

    মতি মিয়া বিষাদে ভারাক্রান্ত গলায় কোনওক্রমে প্রশ্ন করলেন, ‘এমনটা তারা কেন করল?! লতিফাকে মৃত প্রমাণ করার কী দরকার ছিল?’

    ওসি সাহেব বললেন, ‘আপনার ভাই ঠিকই অকৃতজ্ঞের মত একটা কাজ করেছে। আপনার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছে। কিন্তু তার মন থেকে আপনার প্রতি সবটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ, শ্রদ্ধাবোধ আর ভালবাসা চলে যায়নি। সে আপনাকে ছোট ভাইয়ের হাত ধরে স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়ার লজ্জা, অপমান আর সবার তিরস্কার থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল।’

    মতি মিয়া কিছুই বললেন না। শুধু ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

    ওসি সাহেব আবার বলতে লাগলেন, ‘আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যে বেওয়ারিশ লাশটা আগুনে পোড়ানো হয়েছিল সেটা নয়নপুরের এনায়েত মোল্লার মেয়ে জুলেখার ছিল। মেয়েটার বিয়ে হচ্ছিল না। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছিল। দু’-দু’বার বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। ঘরে ছিল সৎ মা। সৎ মায়ের অত্যাচার আর বিয়ে না হওয়ার অপমান, লাঞ্ছনা সইতে না পেরে মেয়েটা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে সদরে গিয়েছিল চাকরি-বাকরির খোঁজে। সদরে গিয়েও দুর্ভাগ্য মেয়েটার পিছু ছাড়ে না। একটা মাইক্রোবাসের ধাক্কায় পথের মাঝে মৃত্যু হয়। সনাক্ত করার কাউকে না পাওয়ায় হাসপাতালের মর্গে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে ঠাঁই মেলে।’

    ওসি সাহেবের মুখে নয়নপুরের জুলেখার করুণ মৃত্যুর কথা শুনে মতি মিয়ার মুখটা আরও থমথমে হয়ে গিয়েছে। জুলেখাকে তিনি চিনতে পেরেছেন। লতিফার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার আগে এই জুলেখার সঙ্গেই তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কথাবার্তা একেবারে পাকা হয়ে গিয়েছিল। আংটি পরিয়েও এসেছিলেন। বিয়ের দিনও ধার্য হয়েছিল। বিয়ের দু’দিন আগে নয়নপুরের এক লোকের কাছে জানতে পারেন, জুলেখা নাকি পুরোপুরি সুস্থ নয়। মাথায় ছিট আছে। সারাক্ষণ চুপচাপ, গম্ভীর হয়ে থাকে। অনেক সময় গভীর রাতে বাড়ির উঠানে বেরিয়ে, চাঁদের আলোতে গুনগুন করে গান গায়। মাঝে-মাঝে আবার গভীর রাতে তার ঘর থেকে ভেসে আসে অদ্ভুত করুণ সুরের কান্নার আওয়াজ। এসব শুনে মতি মিয়া বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন। তড়িঘড়ি করে লতিফার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিলেন। জুলেখাকে দেয়া আংটিটাও আর ফেরত আনা হয়নি।

    জুলেখাকে বিয়ে না করায় মতি মিয়ার এখন খুব অনুশোচনা হচ্ছে। জুলেখাই তাঁর জন্য ঠিক ছিল। লতিফার মত জুলেখার সঙ্গে তাঁর বয়সের ফারাকটাও ততটা ছিল না। জুলেখার মাথায় ছিট ছিল সবার এই ধারণা বোধহয় ঠিক নয়। যে মেয়েটার মা নেই, সারাক্ষণ মুখ বুজে সৎ মায়ের অত্যাচার-নির্যাতন সইতে হয়, সে অন্য সবার মত হবেই বা কেন? তার এমনিতেই চুপচাপ গম্ভীর স্বভাবের হয়ে যাবার কথা। কী বলতে কী বলবে, কোন্ দোষে আবার সৎ মায়ের মার খেতে হবে! অন্য সব তরুণী মেয়েদের মত তারও হয়তো কখনও-কখনও গুনগুন করে গান গাইতে ইচ্ছে করত। সৎ মায়ের ভয়ে যা সে পারত না। তাই হয়তো গভীর রাতে সবার অজান্তে উঠানে বেরিয়ে গান গাইত। আর মাঝে-মাঝে গভীর রাতে বালিশে মুখ গুঁজে করুণ সুরে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে হয়তো নিজের বুকের ভিতরের জমে থাকা কষ্টগুলোকে একটু হালকা করে নিত। এমন জনম দুঃখী অসহায় মেয়েটাকে প্রত্যাখ্যান করে মতি মিয়া বড়ই অন্যায় করেছেন। কাজটা তাঁর মোটেই ঠিক হয়নি। খুব অনুশোচনা হচ্ছে তাঁর!

    ওসি সাহেব চলে গেছেন। মতি মিয়া বিমর্ষ মুখে বসার ঘর থেকে শোবার ঘরে এসে ঢুকেছেন। তাঁর মাথায় আরেকটা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। গত রাতে লাল শাড়ি পরা, লম্বা ঘোমটা টানা ছায়া-ছায়া কাকে তিনি দেখেছেন? তিনি তো ভেবেছিলেন ওটা লতিফার আত্মা ছিল। লতিফা যেহেতু মারাই যায়নি, লতিফার আত্মা আসার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। নাকি তিনি জ্বরের ঘোরে স্রেফ চোখে ধান্ধা দেখেছেন? বাস্তবে লাল শাড়ি পরা কেউ ছিলই না।

    মতি মিয়ার মনে পুড়ল লাল শাড়ি পরা ছায়ামানবী চলে যাবার সময় তাঁর বালিশের নীচে কী যেন একটা রেখে গেছে। তিনি সঙ্গে- সঙ্গে বালিশটা উল্টালেন, সত্যিই বালিশের নীচে কিছু রয়েছে কি না দেখার জন্য।

    বালিশের নীচে একটা আংটি পাওয়া গেল। লাল পাথর বসানো খুব সুন্দর একটা আংটি। এটা সেই আংটি, বিয়ের জন্য যে আংটিটা তিনি জুলেখাকে পরিয়েছিলেন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅপার্থিব প্রেয়সী – আফজাল হোসেন
    Next Article ক্যামিল – পিয়ের লেমেইত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }