আনিকা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
আনিকা
টুনি দাদি (কিংবা নানির) ঘরে ঢুকতে গিয়ে থেমে গেল। ভেতর থেকে আরেকজন মহিলার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে, তার মানে কেউ একজন দাদির সাথে কথা বলতে এসেছে। এখন ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না। ভেতরে গেলে ভদ্রতার কথা বলতে হবে। কিন্তু অন্যদিকে যারা দাদির সাথে দেখা করতে আসে তারা মাঝে মাঝেই যথেষ্ট আজব হয়। একজন মানুষকে দেখে সেই মানুষটা আসলে কী রকম সেটা অনুমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে টুনির হবি। তাই মহিলাটি দেখতে কী রকম সেটা একনজর দেখার জন্য খুব আস্তে আস্তে দরজাটা একটু ফাঁক করল। দাদি টের পেয়ে গেলেন, গলা উঁচিয়ে বললেন, “কে? টুনি নাকি?”
টুনি ধরা পড়ে গেছে, তাই মাথা ঢুকিয়ে বলল, “জি দাদি, আমি।”
“ভেতরে আয়।”
টুনি ভেতরে ঢুকল। ভেতরে শুধু একজন মহিলা নয়, টুনির সমবয়সি কিংবা তার থেকে একটু বড়ো একটা মেয়েও আছে। মেয়েটা খুবই শান্তভাবে কোলের উপর হাত রেখে বসে আছে। শুধু তার চোখ দুটো নড়ছে। টুনির মনে হলো মেয়েটা তার চোখ দুটো দিয়ে টুনিকে দেখছে, উপর থেকে নিচে। ডান থেকে বামে। বাম থেকে ডানে। মেয়েটা খুবই শান্তভাবে বসে থাকলেও তার ডান হাতের একটা আঙুল নড়ছে। আঙুলটা যে অর্থহীনভাবে নড়ছে তা নয়, চোখের মতোন আঙুলটাও নড়ছে উপর থেকে নিচে, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। মনে হয় অদৃশ্য কোনো একটা কিছুতে সে কিছু একটা লিখে যাচ্ছে! মেয়েটা যথেষ্ট ইন্টারেস্টিং—তার সাথে কথা বলতে হবে। টুনি যে এতকিছু দেখে ফেলল সেটা কেউ বুঝল না। কোনো কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা টুনির অভ্যাস। অন্য কেউ যেখানে কিছুই দেখে না, টুনি সেখানেও অনেক কিছু দেখে ফেলে।
দাদি কিছু একটা বলছেন, টুনি দাদির কথায় মনোযোগ দিলো। দাদি মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে আমার একটা নাতনি। টুনি।”
টুনি এবার মহিলাটির দিকে নজর দিলো, নিশ্চয়ই মেয়েটির মা। মহিলা কাঠির মতো শুকনা এবং এই শুকনা শরীরের সাথে মিল রেখে গলার স্বরটিও কেমন যেন শুকনা। মহিলা শুকনা গলায় বললেন, “এত বড়ো চশমা। বেশি টিভি দেখে চোখ নষ্ট করেছে?”
টুনি মহিলাকে অপছন্দ করে ফেলল, মহিলা ধরেই নিয়েছেন বেশি টিভি দেখে টুনির চশমা নিতে হয়েছে। তার চোখ মোটেও নষ্ট হয় নাই—চোখ পাউরুটি না যে ফেলে রাখলে ফাংগাস পড়ে নষ্ট হয়ে যায়।
টিভি দেখে নয়, ছোটো থেকে বেশি বই পড়ে টুনির চশমা নিতে হয়েছে। দাদি আর ঝুমু খালা ছাড়া এই বাসায় কেউ টিভি দেখে না। দাদিও যে খুব আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখেন তা নয়, বেশিরভাগ সময় টিভিতে কিছু একটা হতে থাকে দাদি বসে বসে বই পড়েন। নাহলে কারো সাথে কথা বলেন। টিভিটা থাকে শুধু একটু শব্দ তৈরি করার জন্য! যেন মনে হয় ঘরটা খালি না, কেউ একজন কিংবা কিছু একটা আছে।
মহিলার কথার উত্তরে টুনি কিছু একটা বলবে নাকি চিন্তা করল, শেষ পর্যন্ত কিছু বলল না। দাদি বললেন, “এই বাসার বাচ্চারা কেউই টিভি দেখে না। টিভি ছাড়াই তাদের এত রকম বাঁদরামো যে টিভি দেখতে হয় না।”
শুকনো মহিলা শুকনো গলায় বললেন, “ঠিকই বলেছেন খালা। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা হচ্ছে যন্ত্রণা।” কথা শেষ করে মহিলা তার নিজের মেয়ের দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন। দাদি বাঁদরামোর কথাটা কথার কথা হিসেবে বলেছেন, কিন্তু এই মহিলা সেটা সত্যি ধরে নিয়ে নিজের মেয়েকে রীতিমতো দোষী বলে দিলেন।
মায়ের কথাতেও মেয়ের মুখের এতটুকু পরিবর্তন হলো না। সে তার মায়ের দিকে তাকাল, তার চোখ নড়ল, সাথে সাথে হাত নড়তে লাগল। স্পষ্ট মনে হলো অদৃশ্য একটা কলম ধরে কিছু লিখছি বা আঁকছে! মেয়েটির কাজকর্ম খুবই মজার। মা’টাকে টুনির পছন্দ হয় নাই কিন্তু মেয়েটাকে পছন্দ হলো। টুনি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখানে বসে থেকে কী করবে? আমার সাথে চলো—”
দাদি বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিয়ে যা ওকে। ঝুমুকে বল গেস্ট রুমটা খুলে দিতে—বাথরুমে হাত-মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে পারবে। একটু চা- নাশতাও দিতে বল।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে দাদি। বলছি।”
শুকনো মহিলা বললেন, “না খালা আমরা বেশিক্ষণ বসব না। অনেক দূর যেতে হবে।”
“শুধু শুধু অন্যখানে যেতে চাচ্ছ কেন? আমাদের এখানে থাকো। আলাদা গেস্ট রুম আছে, তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।”
“না না খালা, এখানে থাকতে আমাদের আবার কীসের অসুবিধা? কিন্তু মায়ের পেটের বোন, না গেলে কেমন করে হবে?”
“ঠিক আছে, কোনো একদিন গিয়ে দেখা করে আসো। আর থাকো এইখানে।”
টুনি মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল—তার চোখ দুটো দেখে বোঝা গেল সে মনেপ্রাণে চাইছে তার আম্মু রাজি হয়ে যাক- সে যেন এই বাসাতেই থাকতে পারে। খুব আশা নিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
শুকনা ভদ্রমহিলা বলল, “না খালা, আমাকে যেতেই হবে, বোনকে বলে রেখেছি।”
টুনি দেখল মেয়েটার মুখটা যেন দপ করে নিভে গেল। টুনির মেয়েটার জন্য খুব মায়া হলো। তখন টুনি শুকনা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “আন্টি, আপনাকে যেহেতু আপনার বোনের কাছে যেতেই হবে, আপনি না-হয় চলেই গেলেন—” টুনি মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, “আর এই আপু এই বাসায় আমাদের সাথে থাকুক।”
শুকনা ভদ্রমহিলা বেশ অবাক হয়ে বললেন, “অ্যাঁ?”
টুনি মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল, দপ করে নিভে যাওয়া মুখটা যেন আবার লাইট বাল্বের মতো জ্বলে উঠল। তার মানে মেয়েটার একা এখানে থাকতে কোনো আপত্তি নাই। কাজেই টুনি এবারে জোরেশোরে চেষ্টা করল, বলল, “এই আপুর কোনো অসুবিধা হবে না। ইচ্ছে হলে আমাদের সাথে ঘুমাতে পারে। ইচ্ছে হলে গেস্ট রুমে থাকতে পারে। আমরা অনেক ভাই- বোন—অনেক মজা করব আমরা।
শুকনা ভদ্রমহিলা এবারে আমতা আমতা করে বললেন, “মানে আনিকা এখানে থাকবে?”
মেয়েটার নাম আনিকা, টুনি তাই এবারে তার নামটা ব্যবহার করে বলল, “হ্যাঁ আনিকাপু এখানে থাকুক। আপনার যেদিন ইচ্ছা ফোন করে বলে দেবেন আমরা আনিকাপুকে আপনার বোনের বাসায় পৌঁছে দেবো।” টুনি বুঝল এখন দাদিকে বিষয়টার সাথে লাগাতে হবে। তাই দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদি, আইডিয়াটা ভালো না?”
দাদি বললেন, “হ্যাঁ এখানে তো থাকতেই পারে। আমি জানি না তোমার বোনের বাসায় তার সমান কেউ আছে কি না। এই বাসায় সব সাইজের পোলাপান আছে। সবসময় ক্যাঁচম্যাচ ক্যাঁচম্যাচ।”
শুকনা মহিলা শুনে মনে হয় নরম হতে শুরু করছেন, কপাল কুঁচকে বললেন, “তা অবশ্য ঠিক—বোনের বাচ্চা ছোটো, দিনরাত ফোন টিপাটিপি করে, কারো সাথে মিশে না।”
দাদি বললেন, “তাহলে ওখানে তো একলা হয়ে যাবে। রেখে যাও এই বাসায়।”
শুকনা মহিলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তা ছাড়া বোনের ফ্ল্যাটটা ছোটো। থাকতেও অসুবিধা।”
টুনি বুঝতে পারল আর একটু ধাক্কা দিলেই কাজ হয়ে যাবে, ধাক্কাটা দাদি দিলেই ভালো, টুনি আশা নিয়ে দাদির দিকে তাকাল, দাদি নিরাশ করলেন না। মামলার রায় দেওয়ার মতো করে বললেন, “তাহলে এটাই ফাইনাল। তুমি তোমার বোনের বাসায় যাও, তোমার মেয়ে এখানে থাকুক। যখন চাইবে তুমি এখানে আসবে, না হলে তোমার মেয়ে তোমার বোনের বাসায় যাবে।”
টুনি তখন একটা সূক্ষ্ম বুদ্ধির খেলা খেলে ফেলল, খুবই দুশ্চিন্তার ভঙ্গি করে বলল, “আমরা আনিকাপুকে কিছু জিজ্ঞেস না করে ঠিক করে ফেলেছি! আনিকাপু তোমার আপত্তি নাই তো? প্লিজ রাজি হয়ে যাও। প্লিজ প্লিজ—”
আনিকা কিছু বলার আগেই শুকনা মহিলা বলল, “আনিকা আবার কী বলবে?” তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খালা এভাবে চাইছেন, তুই থাক এইখানে কয়দিন। খবরদার কাউকে ডিস্টার্ব করবি না, জ্বালাবি না। ঠিক আছে?”
আনিকা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল। টুনি লক্ষ করল পুরো সময়টাতে মেয়েটা তার গলা থেকে একটা শব্দ বের করেনি।
শুকনো মহিলা চলে গেলে দাদির ঘর থেকে বের হওয়ার পর আনিকা প্রথম তার গলা থেকে শব্দ বের করল। সে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাঙ্কু টুনি।”
টুনি অনুমান করল কেন থ্যাঙ্কু বলেছে, তারপরও জিজ্ঞেস করল, “কেন? আমাকে থ্যাঙ্কু কেন?”
“আমাকে এখানে রাখার জন্য। তুমি চেষ্টা না করলে হতো না।”
টুনি ঠোঁট উল্টে বলল, “আমার কথা কে শুনে? দাদি বলেছেন বলে— আনিকা বলল, “তোমার দাদি অনেক সুইট। তোমাদের অনেক আদর করেন। তোমরা যেটা চাও সেটাই করেন।
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “সেইটা ঠিক।” তারপর গলার স্বর পাল্টে বলল, “চলো তোমাকে তোমার রুম দেখিয়ে দেই। তোমাকে গেস্ট রুমে একা একা থাকতে হবে না। যেখানে ইচ্ছা সেখানে থাকতে পারবে। তুমি একটু হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর তোমাকে আমাদের ভাই-বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আগে থেকে বলে রাখি, সবাই কিন্তু কমবেশি পাজি।”
আনিকা একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “আমারও পাজি হওয়ার খুব ইচ্ছা।”
টুনি আনিকার মুখের দিকে তাকাল, মেয়েটার মাথায় মনে হয় বুদ্ধি আছে। সুন্দর করে কথা বলতে পারে।
টুনি আনিকাকে নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে যেতে থাকে। আনিকা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমার মা হচ্ছে একজন হাইপোকন্ড্রিয়াক। হাইপোকন্ড্রিয়াক মানে জানো তো?”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “জানি।”
“মা সবসময় মনে করেন তার একটা অসুখ হয়েছে। অসুখের সব লক্ষণ মিলে যায় কিন্তু টেস্ট করে কিছু পাওয়া যায় না। এখনও মনে করছেন তার ব্রেন টিউমার হয়েছে। সিটি স্ক্যান করতে হবে। শুধু শুধু টাকা নষ্ট।”
টুনি কিছু বলল না। ব্রেন টিউমার হয়েছে কি হয় নাই সেইটা নিয়ে তার ডাক্তারিবিদ্যা ব্যবহার করা ঠিক হবে না।
আনিকা বলল, “এই গুগলটা হয়েছে একটা যন্ত্রণা। আমার মা দিন-রাত গুগলে বসে বসে দুনিয়ার সব অসুখের বর্ণনা পড়তে থাকেন। চিন্তা করতে পারো?”
“তোমার আব্বু?”
“আমার বাবা এদিক-সেদিক কোনোদিকেই নাই। মা যেটা বলেন চুপচাপ শুনে যান।”
“তোমার অন্য ভাই-বোন?”
আনিকা হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আমার আর কোনো ভাই-বোন নাই। আমার মা যে আমাকে জন্ম দিয়েছেন সেইটাই বেশি। যখন আমি মায়ের পেটে ছিলাম তখন আমার মা যে কত রকম দুশ্চিন্তা করেছে আমি চিন্তাও করতে পারি না।”
দুইজন কথা বলতে বলতে তাদের গেস্ট রুমে চলে এলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে আনিকা এদিক-সেদিক তাকাল। তার মুখ দেখে বোঝা গেল রুমটা তার পছন্দ হয়েছে। আনিকা বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “বাথরুমটা কী সুন্দর! দেখে লোভ হচ্ছে, আমি গোসল করে ফেলি!”
টুনি বলল, “করো। আমি তোমার জন্য চা-নাশতা রেডি করতে বলি।” আনিকা বলল, “না না, কিছু লাগবে না।”
টুনি বলল, “তুমি যখন এই বাসাতে থাকতে রাজি হয়েছো, এখন তোমার
নিজের ইচ্ছা বলে কিছু নাই। সব হেড অফিস থেকে কন্ট্রোল হবে।”
আনিকা একটু অবাক হয়ে বলল, “হেড অফিস? হেড অফিস কোনটা?”
টুনি বলল, “তুমি দেখবে।”
টুনি একটু হাসার ভঙ্গি করে বের হয়ে গেল। আনিকা তার ব্যাকপ্যাক খুলে কাপড় বের করে বাথরুমে ঢুকে গেল।
আনিকা গোসল করে বাথরুম থেকে বের হয়ে থতমত খেয়ে গেল, কারণ গেস্ট রুম বোঝাই নানা বয়সি বাচ্চাকাচ্চা ক্যাঁচম্যাচ করছে। এদের মাঝে টুনিও আছে। আনিকাকে বের হতে দেখে টুনি বলল, “আনিকাপু, তুমি মনে কোরো না এরা তোমাকে দেখতে এসেছে। এখানে নাশতা দেবে, তাই সবাই নাশতা খেতে এসেছে।”
আনিকা বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “গুড! আমার মাঝে দেখার মতো কিছুই নাই—নাশতা খাওয়ার মাঝে আনন্দ আছে।”
শান্ত মুখ শক্ত করে বলল, “আমি মোটেও নাশতা খেতে আসি নাই।”
প্রমি বলল, “টুনি বলল আমাদের বাসায় বাচ্চা গেস্ট এসেছে—সেই জন্য দেখতে এসেছি। এই গেস্ট রুমে সবসময় দাদির বুড়া বুড়া গেস্ট থাকে।”
শান্ত বলল, “বুড়া আর বদ।”
প্রমি বলল, “সবাই বদ না। কেউ কেউ বদ।”
শান্ত বলল, “মনে নাই একজন মাস্টারনি কীভাবে আমাকে জ্বালিয়েছিল? তারপর আমরা কীভাবে টাইট করেছিলাম?” শান্ত পুরো ঘটনাটা চিন্তা করে আনন্দে হা হা করে হাসল।
আনিকা একটু অবাক হয়ে একেকবার একেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের কথা শুনছিল।
টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি থামো। আনিকাপু মাত্র এসেছে, তাকে শুধু শুধু ভয় দেখিও না।”
প্রমি বলল, “হ্যাঁ। আমাদের একমাত্র বাচ্চা গেস্ট।”
টুম্পা বলল, “আমি ভেবেছিলাম আরও বাচ্চা হবে। আমার মতো না হলে আরও ছোটো।” তারপর আনিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপু তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?”
আনিকা বলল, “ক্লাস এইট।”
টুম্পা বলল, “ইস! তার মানে তুমি অনেক বড়ো।”
টুনি বলল, “মোটেও অনেক বড়ো না। আমরা সবাই কাছাকাছি।”
টুম্পা তখন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন ঝুমু খালা হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে ভেতরে ঢুকল এবং সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
ঝুমু খালা টেবিলের উপর খাবারের ট্রে রেখে কোমরে হাত দিয়ে বলল, “আমি গেস্টের জন্য নাশতা আনছি—তোমরা চিল্লাও কেন?”
মুনিয়া বলল, “ঝুমু খালা, গেস্ট এত নাশতা খেয়ে শেষ করতে পারবে না।”
টুম্পা বলল, “সেই জন্য আমরা নাশতা খেয়ে গেস্ট আপুকে সাহায্য করব।”
ঝুমু খালা তার কোমরে হাত দিয়ে বলল, “মাঝেমধ্যে একটু শাকসবজি আর মাছ খেয়ে নিজের শরীলটারেও সাহায্য কইরো।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কেন ঝুমু খালা? শাকসবজি খেলে শরীরের সাহায্য হয় কেন?”
ঝুমু খালা হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তুমি এটাও জানো না? শাকসবজি আর ছোটো মাছের মাঝে সব ভাইটামিন থাকে।”
মুনিয়া ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “সব?”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। সব। এক্কেবারে এ বি সি ডি থেকে শুরু করে ডাব্লিউ এক্স ওয়াই জেড পর্যন্ত সব।”
টুম্পা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, “না ঝুমু খালা, আমি জন্মেও এক্স ওয়াই জেড ভাইটামিনের নামও শুনি নাই। এক্স ওয়াই জেড ভাইটামিন হয় না।”
ঝুমু খালা হাত ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুমি আমার থেকে বেশি জানো? এইগুলা তো ইংরেজি ভাইটামিন। বাংলা ভাইটামিন আছে তুমি জানো?”
টুম্পা মাথা নাড়ল, অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যিই আছে?”
“সত্যি না তো মিছা নাকি? বাংলা ভাইটামিনের নাম হচ্ছে পেট কাটা মূর্ধন্য-ষ ভাইটামিন। কঠিন ভাইটামিন!”
মুনিয়া জানতে চাইলে, “এটা খেলে কী হয়?”
“কী হয় না সেটা বলো। সবকিছু হয়। আমাদের গ্রামে একজন পাগল ছিল, শিকল দিয়া বাইন্ধা রাখতে হইতো। এক শিশি পেট টাকা মূর্ধন্য-ষ ভাইটামিন খাইছে। এখন পুরা নরমাল। এক চান্সে ম্যাট্রিক পাস দিছে—”
অন্যরাও খাওয়া শুরু করে দিয়েছে, তাই টুম্পা আর মুনিয়াও মূর্ধন্য-ষ ভাইটামিনের আলাপ বন্ধ করে খাওয়া শুরু করল। টুনি আনিকাকে বলল, “আনিকাপু, এই নাশতা ঝুমু খালা তোমার জন্য এনেছে—তুমিও খাও। ভদ্রতা করলে অন্যরা খেয়ে শেষ করে ফেলবে-
আনিকা একটা ডালপুরিতে কামড় দিয়ে বলল, “কী মজা!”
শান্ত খেতে খেতে বলল, “আমাদের ঝুমু খালা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ভালো ডালপুরি তৈরি করে।”
টুনি বলল, “আনিকাপু, তোমাকে হেড অফিসের কথা বলছিলাম না? আমাদের ঝুমু খালা হচ্ছে হেড অফিস! আর ঝুমু খালা, এই আপু হচ্ছে আনিকাপু। আমাদের বাচ্চা গেস্ট।”
ঝুমু খালা মাথা নেড়ে আনিকার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ, সেই জন্য এই পাগলদের মাঝে আইসা পড়ছো। বাইরের মেয়ে তুমি, সাবধানে থাকবা, এদের একজন থেকে আরেকজন বেশি বিচ্ছু!”
আপত্তি করে সবাই চেঁচামেচি শুরু করে দিলো। ঝুমু খালা কাউকে কোনো পাত্তা না দিয়ে গটগট করে বের হয়ে গেল। আনিকা টুনিকে বলল, “ঝুমু খালা খুবই ইন্টারেস্টিং।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। ঝুমু খালা হচ্ছে এই বাসার প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, জেনারেল, কমান্ডার সবকিছু।”
আনিকা বলল, “হ্যাঁ, দেখলেই বোঝা যায়।”
টুনি লক্ষ করল ঠিক আগের মতো আনিকা সবার দিকে তাকাচ্ছে, উপর থেকে নিচ, নিচ থেকে উপরে, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। শুধু তাই না, হাতের একটা আঙুল নড়ছে। উপর থেকে নিচে, নিচ থেকে উপরে, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে, যেন অদৃশ্য একটা কিছুতে সে লিখে যাচ্ছে, কিংবা এঁকে যাচ্ছে। এখন মাত্র পরিচয় হয়েছে, আরও একটু সময় পার হলে টুনির এই রহস্যটা বের করতে হবে।
.
টুনির অবশ্য আলাদাভাবে রহস্য বের করতে হলো না, সন্ধ্যাবেলা নিজ থেকেই রহস্য ভেদ হয়ে গেল। যখন এই বাসার নিয়ম অনুযায়ী সবাই পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে কিংবা পড়ার ভান করছে, তখন আনিকাকেও তাদের সাথে বসার জন্য একটা চেয়ার দিয়েছে। আনিকা সেখানে বসে একটা বই নাড়াচাড়া করতে করতে একটা কাগজে অন্যমনস্কভাবে আঁকিবুকি করছে।
হঠাৎ সবাই একটা চিৎকার শুনতে পেল, আনিকার পাশে টুম্পা বসেছে, সে এই চিৎকারটা দিয়েছে। সবাই সবাই টুম্পার দিকে তাকাল, টুম্পা আনিকার হাতের কাগজটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে, “দেখ দেখ দেখ-
সবাই নিজের চেয়ার থেকে উঠে আনিকার পাশে গিয়ে তার কাগজটা দেখার চেষ্টা করল। আনিকা একটু লজ্জা পেয়ে কাগজটা ঢেকে ফেলার চেষ্টা করছিল কিন্তু ততক্ষণে টুম্পা সেই কাগজটা টেনে তার হাতে নিয়ে নিয়েছে। সবাই অবাক হয়ে দেখল সেখানে টুনির একটা ছবি। তার গোল গোল চশমা, মাথার দুই পাশে পনিটেল, মুখ টিপে হাসছে—হুবহু টুনির চেহারা। এত সুন্দর করে যে একজনের ছবি আঁকা যায় সেটা কল্পনাও করা সম্ভব না। শুধু তাই না, এই ছবিটা এঁকেছে সে এখানে বসে, মাত্র কয়েক মিনিটে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে সবাই চেঁচামেচি করতে লাগল, তখন আনিকা কেমন যেন অপরাধীর মতো বলল, “বেশি ভালো হয় নাই—”
টুনি বলল, “বেশি ভালো হয় নাই? কী বলছো আনিকাপু! হুবহু আমার চেহারা—ক্যামেরা থেকে ভালো।”
আনিকা বলল, “চেহারা তো সোজা। কিন্তু খালি চেহারা আঁকলে তো হয় না। ছবির মাঝে মানুষটার চরিত্রটা ফুটে উঠতে হয়।”
সবাই আবার টুনির ছবির দিকে তাকাল—টুনির চরিত্রটা ছবির মাঝে আছে কি না সেটা দেখার জন্য। আনিকা বলল, “চোখের মাঝে টুনির বুদ্ধিটা আসে নাই।”
ততক্ষণে মুনিয়া আর টুম্পা তাদের খাতা নিয়ে চলে এসে আনিকাকে দুই পাশ থেকে দুইজন টানাটানি করতে থাকে, বলতে থাকে, “আমার ছবি আপু। আমার ছবি। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
কাজেই আনিকাকে তাদের ছবি আঁকতে হলো। টুনি দেখল ছবি আঁকার আগে আনিকা মুনিয়ার দিকে তাকাচ্ছে, তাকে দেখছে, উপর থেকে নিচে, নিচ থেকে উপরে, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে, তারপর একটা সত্যিকার আনিকার বল পয়েন্ট কলম নড়ছে, উপর থেকে নিচে, নিচ থেকে উপরে, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। আর দেখতে দেখতে কাগজের উপর মুনিয়ার চেহারাটা ফুটে উঠছে। মুনিয়ার ঝকঝকে চোখ, দুষ্টু হাসি, সবকিছু। ঠিক একইভাবে টুম্পার খাতায় টুম্পার ছবি। কী আশ্চর্য!
টুনি আনিকার আঙুল নাড়ানোর রহস্য বুঝতে পারল। মেয়েটি সারাক্ষণ ছবি এঁকে যাচ্ছে। যখন হাতে কাগজ আর কলম, তখন কাগজের উপর কলম দিয়ে, যখন হাতে নাই তখন অদৃশ্য কাগজে অদৃশ্য কলম দিয়ে।
শাহানাও আনিকার পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার ছবি আঁকা দেখছিল। সবার প্রাথমিক আহা-উঁহু শেষ হওয়ার পর শাহানা জিজ্ঞেস করল, “আনিকা, তোমার স্কেচ বুকটা সাথে আছে? আমাদের দেখাবে?”
আনিকার মুখটা হঠাৎ কেমন জানি ম্লান হয়ে গেল। মাথা নেড়ে জানাল তার সাথে নেই।
শাহানা বলল, “ইস! কেন নিয়ে এলে না? আমরা দেখতাম।”
আনিকা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার আসলে কোনো স্কেচ বুক নাই।”
শাহানা অবাক হয়ে বলল, “সে কী! তোমার কোনো স্কেচ বুক নাই?”
আনিকা মাথা নিচু করল, হঠাৎ তার চোখে পানি টলটল করে উঠল। সে কোনোভাবে নিজেকে সামলে বলল, “আসলে আমার বাসায় আমাকে কখনো ছবি আঁকতে দেয় না।”
একসাথে সবাই চিৎকার করে উঠল, “তোমাকে ছবি আঁকতে দেয় না?”
আনিকা মাথা নাড়ল, প্রায় শোনা যায় না সেভাবে বলল, “না।”
“কেন? কেন?”
“আমার আম্মু মনে করেন ছবি আঁকলে গুনাহ হয়। আর ছবি এঁকে কী হবে? ছবি না এঁকে বই মুখস্থ করলে কাজ হয়।”
সবাই হতাশ হয়ে আনিকার দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের মনে হলো এই হাসিখুশি মেয়েটা থেকে দুঃখী মনে হয় পৃথিবীতে আর একজনও নাই।
.
আনিকা যেহেতু তার বাসায় ছবি আঁকতে পারে না, তাই সবাই মিলে ঠিক করল সে এখানে যে কয়দিন থাকবে সবাই মিলে তাকে যত খুশি ছবি আঁকতে দিবে। তাই গেস্ট রুমটা হয়ে গেল আনিকার ছবি আঁকার স্টুডিও। শাহানা তার জন্য বড়ো বড়ো ড্রয়িং শিট কিনে আনল। বাচ্চাদের যার যার রঙের বাক্স আছে সবাই সেগুলো এনে আনিকাকে দিলো। টুনি স্টেশনারি দোকান থেকে এইচ বি থেকে শুরু করে এইট বি পর্যন্ত সব রকম পেন্সিল কিনে আনল। প্রমি লাইব্রেরি থেকে ছবি আঁকার বই এনে দিলো। মুনিয়া আর টুম্পা বাসায় পেইন্টিংয়ের ওপর যতগুলো বই আছে সবগুলো গেস্ট রুমে নিয়ে একত্র করল। আনিকা দিনরাত ছবি আঁকছে। শাহানা তার জন্য দামি রঙের বাক্স আর নানা সাইজের তুলি কিনে আনল। শান্ত খোঁজখবর নিয়ে কোথায় কোথায় পেইন্টিংয়ের গ্যালারি আর আর্ট এক্সিবিশন হচ্ছে সেগুলো বের করে আনল। ছবি আঁকার জন্য গেস্ট রুমের মেঝেতে, টেবিলে রং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়লেও ঝুমু খালা এতটুকু বিরক্ত না হয়ে নাশতা বানিয়ে আনতে লাগল।
এক মাঝে বাসার প্রায় সবার পোর্ট্রেট কয়েকবার করে আঁকা হয়ে গেছে। কোনোটা পেন্সিলের, কোনোটা কলমের আবার কোনোটা ওয়াটার কালারের। সবাই ঝুমু খালার পোর্ট্রেটা সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে, মাথা নিচু করে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে! দেখলে মনে হয় এক্ষুনি ঝুমু খালা বলে উঠবে, “এই বাচ্চাকাচ্চারা তোমরা কি চিল্লাফাল্লা থামাবে?”
টুনি যখনই সময় পায় গেস্ট রুমে এসে আনিকার ছবি আঁকা দেখে। মেয়েটা একেবারে বাচ্চা, বলতে গেলে টুনির সমান বয়স, কিন্তু যখন ছবি আঁকে তখন মনে হয় সে না জানি কত বড়ো হয়ে গেছে—কী অসাধারণ মনোযোগ দিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে! চোখ দুটো অন্য রকম হয়ে যায়। মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটকে কামড়ে ধরে! মনে হয় কিছু একটা করতে তার বুঝি পরিশ্রম হচ্ছে!
এর মাঝে একদিন সবাই মিলে জয়নুল গ্যালারিতে একটা ছবি প্রদর্শনীতে গেল। অন্য সবার কিছুক্ষণের মাঝে সব ছবি দেখা শেষ হয়ে গেল, আনিকার শেষ হলো না। কোনো কোনো ছবির সামনে দাঁড়িয়েই থাকে—দাঁড়িয়েই থাকে, ছবি দেখা আর শেষ হয় না। টুনির মনে হতে থাকে ছবি দেখা থেকে আনিকা যে ছবি দেখছে সেটা দেখাই বুঝি বেশি মজার
আনিকা একটা ছবির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, মুনিয়া কাছে এসে আনিকার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, “আপু তুমি কী দেখো?”
আনিকা বলল, “এই ছবিটা দেখি।”
মুনিয়া ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “ছবিটার মাঝে মেয়েটার গায়ের রং সবুজ কেন? মানুষের গায়ের রং তো সবুজ হয় না। হয়?”
আনিকা মাথা নাড়ল, বলল, “নাহ্।”
“তাহলে?”
আনিকা বলল, “ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে সবসময় মেয়েটার গায়ের রং ঠিক আসবে। কিন্তু এইটা তো ক্যামেরার ছবি না। আর্টিস্টের কাছে মেয়েটাকে এই রকম মনে হয়, তাই সে এইরকমভাবে এঁকেছে।”
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তার মানে আর্টিস্টদের একটু মাথা খারাপ হয়।”
আনিকা হাসল, বলল, “মনে হয়।”
মুনিয়া জানতে চাইল, “তুমি যখন বড়ো হবে তখন তোমারও একটু মাথা খারাপ হবে?”
“আমার এখনই একটু একটু মাথা খারাপ। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে একটা ছবি আঁকি, যেখানে আকাশটা বেগুনি, চাঁদটা সবুজ আর সব গাছ লাল।”
“কেন আপু?”
“জানি না।”
“তুমি অনেকক্ষণ এই ছবিটা দেখছো তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“সেটাও জানি না। দেখতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, ইস! আমি যদি এই রকম আঁকতে পারতাম!”
টুম্পা গম্ভীরভাবে বলল, “তুমি এই আর্টিস্ট থেকে ভালো ছবি আঁকো আনিকাপু।”
আনিকা হি হি করে হেসে বলল, “থ্যাঙ্কু টুম্পা।”
তিন দিন পর সন্ধ্যাবেলা যখন সবাই পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে কিংবা পড়ার ভান করছে এবং আনিকাও তার চেয়ারে বসে ক্লাস এইটের একটা অঙ্ক বই নিয়ে বসে বসে অঙ্ক করছে, তখন হঠাৎ করে শান্ত মাথা তুলে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”
সবাই হালকা আতঙ্ক নিয়ে শান্তর দিকে তাকাল। কারণ এখন পর্যন্ত যখনই শান্ত তার কোনো একটা ‘আইডিয়া’ নিয়ে এসেছে তখনই দেখা গেছে সেই আইডিয়া থেকে ছোটো-বড়ো বিপজ্জনক ঘটনা ঘটেছে।
টুনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী আইডিয়া শান্ত ভাইয়া?”
“আমরা আমাদের বাসায় আনিকার একটা পেইন্টিং এক্সিবিশন করতে পারি। চিত্র প্রদর্শনী।”
সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল এবং সবার মুখে কমবেশি হাসি ফুটে উঠল। শান্তর মতো মানুষের মাথায় এ রকম চমৎকার একটা আইডিয়া আসতে পারে সেটা বুঝতে তাদের একটু সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল তখন শাহানা প্রথমে টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক আইডিয়া শান্ত! ঠিকই বলেছিস, আমাদের বাসায় একটা প্রদর্শনী হতেই পারে।”
আনিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “কী বলছো তোমরা? আমার ছবির প্রদর্শনী? কক্ষনো না।”
প্রমি বলল, “সমস্যা কী? আমরা তো আর শিল্পকলাতে কিংবা জয়নুল গ্যালারিতে প্রদর্শনী করছি না! আমরা আমাদের বাসায় করছি। এখানে সবাই নিজেদের মানুষ!”
টুম্পা সাহস দিলো, বলল, “আমরা সবসময় করি আনিকা আপু। লুডু টুর্নামেন্ট করছিলাম মনে আছে? দাদি প্রধান অতিথি?”
সবাই মাথা নাড়ল, মুনিয়া বলল, “ঝুমু খালা বক্তৃতা দিয়েছিল।”
টুনি মনে করিয়ে দিলো, “একবার তোদের পুতুলের বিয়ে হলো।”
টুম্পা বলল, “যেবার ছোটাচ্চু আর ফারিহাপু—”
সবাই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে টুম্পাকে থামিয়ে দিলো, তাই ছোটাচ্চু আর ফারিহাপুর মাঝে কী হয়েছিল তখন আনিকা আর জানতে পারল না। কিন্তু টুম্পা ফিসফিস করে আনিকাকে জানিয়ে দিলো যে সে ঘটনাটা আনিকাকে নিরিবিলি বলে দেবে।
টুনি বলল, “আনিকা আপু, তোমার কোনো ভয় নাই। আমরা নিজেরা নিজেরা চিত্র প্রদর্শনী করব। আমাদের আব্বু-আম্মুরাই এখনও তোমার আঁকা ছবি দেখে নাই। সবাই মিলে দেখবে।”
শান্ত বলল, “তারপর একটু চা-নাশতা। ছোটাচ্চু হবে স্পন্সর।”
আনিকা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছিল না। এবারে অন্যদের থামিয়ে সে বলল, “শোনো—তোমরা আমার কথা শোনো। তোমরা যে সবাই মিলে আমাকে ছবি আঁকতে দিচ্ছ সে জন্য আমার যে কী ভালো লাগছে তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না। আমি কখনোই ভাবি নাই আমি কোনোদিন এইভাবে ছবি আঁকতে পারব। কিন্তু আমি তো সত্যিকারের আর্টিস্ট না—আমার খালি ছবি আঁকতে ভালো লাগে। যেগুলো আঁকি সেগুলো ছবি হয় কি না সেটাও জানি না। এখন এইগুলি দিয়ে এক্সিবিশন করলে আমার এত লজ্জা লাগবে যে, আমার এতদিনের ছবি আঁকার আনন্দটা নষ্ট হয়ে যাবে। প্লিজ প্লিজ প্লিজ, আমার আনন্দটা নষ্ট কোরো না।”
টুনি বলল, “আপু, তুমি বুঝতে পারছো না! এটা আমাদের বাচ্চাদের বাচ্চা এক্সিবিশন। দুধভাত এক্সিবিশন! আমরা সবসময় এইগুলা করি।”
আনিকা তবু মাথা নাড়তে থাকে, বলে, “না, না, না, প্লিজ না—”
টুনি বলল, “ঠিক আছে, তাহলে আমরা আমাদের কেসটা হেড অফিসের কাছে নিয়ে যাই। দেখি হেড অফিস কী বলে। এই বাসায় হেড অফিসের কথার বাইরে কারো কথা বলার কোনো সাহস নাই।”
আনিকা জিজ্ঞেস করল, “হেড অফিস মানে কে? ঝুমু খালা?”
“হ্যাঁ ঝুমু খালা। এর আগে আমাদের যতবার গোলমাল লেগেছে ততবার ঝুমু খালা ডিসিশন দিয়েছে।”
মুনিয়া বলল, “তুমি যদি ঝুমু খালার কথা না শোনো তুমি খাওয়া পাবে না। না খেয়ে থাকতে হবে।”
টুম্পা তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি ঝুমু খালাকে ডেকে আনি।”
তারপর ঝুমু খালাকে ডেকে আনার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আনিকা বলল, “তোমরা বুঝতে পারছো না! আমার আম্মু যদি জানতে পারে আমি এখানে বসে ছবি আঁকছি, তাহলে আমাকে কোনোদিন ঘরের বাইরে যেতে দিবে না। আর যদি জানতে পারে আমি ছবি এক্সিবিশন করছি, সেটা দুধভাত এক্সিবিশন আর মাছভাত এক্সিবিশন যেটাই হোক, আমার কী অবস্থা হবে আমি জানি না। মনে হয় লেখাপড়া বন্ধ করে একটা বুড়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে।”
সবাই একটু অবাক হয়ে আনিকার দিকে তাকাল। তারা আসলে আনিকার আম্মুর ব্যাপারটা চিন্তা করে নাই।
টুম্পা কিছুক্ষণের মাঝে ঝুমু খালাকে নিয়ে হাজির হলো। ঝুমু খালা কোমরে হাত দিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি মাত্র ডাইলে বাগাড় দিছি, এখন চুলা থেকে ডাল নামাইয়া আসছি। তোমাগো সমিস্যা যদি কঠিন সমিস্যা না হয় আর আমার ডাইলের যদি কোনো ক্ষতি হয়, তোমাগো কিন্তু বড়ো সমিস্যা আছে।”
টুনি বলল, “ঝুমু খালা, আমাদের সমস্যা কঠিন সমস্যা। তুমি বসো।”
ঝুমু খালা একটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর গালে হাত দিয়ে বলল, “বলো কী সমিস্যা?”
টুনি কিছু বলার আগে মুনিয়া বলল, “ঝুমু খালা, তুমি বলছো সমিস্যা, আসলে বলতে হবে সমস্যা।”
“থাউক থাউক। আমারে শুদ্ধ ভাষা শিখাইতে হইবে না। তোমাগো এই শুদ্ধ ভাষা আমি বহুত আগে পানি দিয়া গুলাইয়া খাইছি।”
টুনি বলল, “মুনিয়া তুই থাম। যখন দরকার হয় তখন ঝুমু খালা আমাদের সবার থেকে ভালো শুদ্ধ ভাষা বলতে পারে। মনে নাই—”
ঝুমু খালা টুনিকে থামিয়ে বলল, “আসল কথা বলো। সমিস্যাটা কী?” টুনি গলা পরিষ্কার করে বলল, “ঝুমু খালা, তুমি তো জানো আনিকা কী সুন্দর ছবি আঁকে।”
“হ্যাঁ জানি।” ঝুমু খালার মুখে হাসি ফুটে উঠল, “আমার কত সুন্দর একটা ছবি আঁকছে।”
“আমরা তাই এই বাসায় আনিকা আপুর ছবির এক্সিবিশন করতে চাই। আনিকাপু এই কয়দিন যে ছবিগুলো এঁকেছে, সেগুলো টানিয়ে রাখব, বাসার সবাইকে দাওয়াত দিব, সবাই দেখবে।”
ঝুমু খালার মুখের হাসিটা বড়ো হলো, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “ফাস ক্লাস আইডিয়া।”
শান্ত বলল, “আসলে এইটা আমার আইডিয়া ঝুমু খালা।”
ঝুমু খালা বলল, “তাহলে এইটা ফাস ক্লাসের উপরে আরেক ফাস ক্লাস আইডিয়া। শান্তর আইডিয়ারে তো সবাই ভয় পায়।”
প্রমি বলল, “তাহলে ঝুমু খালা, তুমি মনে করো আমরা আনিকার ছবির এক্সিবিশন করতে পারি?”
আনিকা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার আগে ঝুমু খালা বলল, “একশবার। আমি সবার জন্য চা-নাশতা বানাব।”
টুম্পা বলল, “না না ঝুমু খালা, তোমাকে বক্তৃতা দিতে হবে।”
টুনি বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও, সবাই দাঁড়াও। আমার আলোচনা এখনও শেষ হয় নাই। আসল সমস্যার কথা এখনও বলাই হয়নি।”
ঝুমু খালা মুখ গম্ভীর করে বলল, “এখনও সমিস্যা আছে?”
“হ্যাঁ, আছে।” টুনিও গম্ভীর মুখে বলল, “ঝুমু খালা, তুমি তো জানো আনিকাপু কত সুন্দর ছবি আঁকে, কিন্তু তোমাকে এখনও একটা জিনিস বলা হয় নাই।”
“কী জিনিস?”
“আনিকাপুর বাসায় কেউ তাকে ছবি আঁকতে দেয় না।”
ঝুমু খালা আঁতকে উঠল, “ছবি আঁকতে দেয় না? কী বলো তুমরা?
“হ্যাঁ ঝুমু খালা। আনিকাপুর আম্মু যদি জানেন আনিকাপু এইখানে বসে ছবি আঁকছে তাহলে তার অনেক বিপদ হবে। আর যদি জানেন যে এখানে তার ছবির এক্সিবিশন হচ্ছে তাহলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
প্রমি বলল, “আনিকা মনে করে তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিবে।”
মুনিয়া বলল, “আর আনিকাপুকে একটা বুড়ার সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে।”
“হুঁ।” ঝুমু খালা মুখ গম্ভীর করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমাগো আর্টিসরে বিপদে ফেলা ঠিক হবে না।”
ঝুমু খালার কথা শুনে আনিকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আস্তে আস্তে বলল, “থ্যাঙ্কু ঝুমু খালা।”
শান্ত একেবারে হতাশ হয়ে বলল, “তাহলে আমাদের ছবি এক্সিবিশন হবে না?”
ঝুমু খালা হ্যাঁ কিংবা না কিছু না বলে বলল, “আমারে একটু চিন্তা করবার দাও।”
তারপরে ঝুমু খালা চিন্তা করতে লাগল। ঝুমু খালার চিন্তা করার বিষয়টা যথেষ্ট আকর্ষণীয়। তার মুখ একটু এদিক-সেদিক বাঁকা হলো, চোখ ছোটো-বড়ো হলো, কয়েকবার চুল টানল, মুখ দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করল, তারপর হাত মুঠি করল, তারপর মুঠি খুলে আঙুলগুলো দেখল, তারপর মুখ তুলে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসছে।”
সবাই আইডিয়াটা শোনার জন্য সামনে ঝুঁকে ঝুমু খালার দিকে তাকাল। ঝুমু খালা বলল, “তোমরা ছবির এক্সিবিশন করো। কিন্তু কাউরে বলব না এই ছবিগুলো আঁকছে আনিকা।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কী বলব?”
“বলবা এইটা তোমাদের ক্লাসের অন্য একটা ছেলে না হলে মেয়ে আঁকছে।”
সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। যদি বলতেই না পারে আনিকার ছবির এক্সিবিশন, তাহলে এক্সিবিশন করে কী লাভ? শুধু আনিকার মুখে প্রথমবার হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, “তাহলে ঠিক আছে।”
শান্ত বলল, “কিন্তু কিন্তু—”
ঝুমু খালা জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”
“তাহলে এক্সিবিশন করে কী লাভ?”
ঝুমু খালা বলল, “লাভ হচ্ছে গিয়া সবাই ছবিগুলান দেখল। আনিকা আর তার মা বাড়ি চলে যাবার পর তুমরা ইচ্ছা করলে সবাইরে বলতে পারো যে আসলে এইগুলান আনিকায় আঁকছে।”
আনিকা ইতস্তত করে বলল, “কোনোদিন না বললে সবচেয়ে ভালো।”
ঝুমু খালা বলল, “সেইটা পরে দেখা যাবে।”
শাহানা বলল, “ঝুমু খালার আইডিয়ার একটা বড়ো সমস্যা আছে।”
ঝুমু খালা ভুরু কুঁচকে বলল, “কী সমিস্যা?”
“আনিকা এই বাসার সবার ছবি এঁকেছে—মুনিয়া থেকে শুরু করে একেবারে ঝুমু খালার—সবার। যে-কেউ এই পোর্ট্রেটগুলো দেখলে বুঝে যাবে আর্টিস্ট এই বাসায় থাকে, নাহলে সবার ছবি আঁকল কেমন করে?”
টুনি বলল, “শাহানাপু ঠিকই বলেছে। আমরা একটা কাজ করতে পারি।”
সবাই টুনির দিকে তাকাল, “কী কাজ?”
“আমরা আমাদের নিজেদের ছবিগুলি ছাড়া ছবির এক্সিবিশন করব।”
প্রমি বলল, “তাহলে ছবি কম হয়ে যাবে।”
মুনিয়া ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আর আমার এত সুন্দর ছবিটা কাউকে দেখাতে পারব না?”
শান্ত বলল, “শুধু আমার ছবিটা দেখাতে পারব।”
সবাই শান্তর দিকে তাকাল, টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কেন? খালি তোমার ছবি কেন দেখাতে পারবে?”
শান্ত দাঁত বের করে হেসে বলল, “তার কারণ, আমরা বলব আমাদের আর্টিস্ট আমাদের স্কুলে আমার সাথে পড়ে। সেই জন্য আমার ছবি এঁকে দিয়েছে।”
প্রমি বলল, “কেন? আমার ক্লাসের ছাত্রীও তো হতে পারে!”
শান্ত বলল, “নো, নো, নেভার। এক্সিবিশনটা আমার আইডিয়া, কাজেই সিক্রেট আর্টিস্ট হবে আমার ক্লাসের।”
সবাই মেনে নিল, কারণ শান্তর কথায় হালকা একটা যুক্তি আছে, তার চেয়ে বড়ো কারণ, শান্তর সাথে কেউ ঝগড়াঝাঁটি করতে চায় না। কার ঘাড়ে দুইটা মাথা আছে!
শেষ পর্যন্ত সবাই ঝুমু খালার আইডিয়া মেনে নিল। শুধু প্রমি ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু আমরা সবচেয়ে সুন্দর পোর্ট্রেটগুলো দেখাতে পারব না। আর ছবিও কম হয়ে যাবে।”
আনিকা বলল, “তোমরা সেটা চিন্তা কোরো না। আমি এর মাঝে আরও অনেকগুলো ছবি এঁকে ফেলব।”
.
প্রদর্শনীর দিন আনিকার আঁকা ছবিগুলো তাদের পড়ার ঘর আর সাথে লাগানো বারান্দায় টানানো হয়েছে। আর্ট এক্সিবিশনে সবসময় পেইন্টিং ফ্রেম করে ঝোলানো হয়। বাচ্চাদের জন্য সেটা সম্ভব না, তাই শাহানা বুদ্ধি করে আর্ট পেপার এনে তার মাঝখানে চৌকোনা করে কেটে পেছন থেকে টেপ দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। সে জন্য মোটামুটি ছবিগুলোর মাঝে ফ্রেম লাগানোর একটা ভাব চলে এসেছে। আর্ট এক্সিবিশনে সব পেইন্টিংয়ের একটা নাম থাকে, আনিকা তার কোনো ছবির নাম দেয় নাই, তাই বাচ্চারা নিজেরাই ছবিগুলোর একটা নাম দিয়ে পাশে ছোটো করে লিখে দিয়েছে। ছবির বিষয়বস্তুর সাথে নামের কোনো মিল নেই। যেমন একটা গ্রামীণ দৃশ্যের নাম ব্ল্যাক ড্রাগন আবার শান্তর পোর্ট্রেটের নাম সাইক্লোন! তবে ছবির নাম নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। পাশে ছবিগুলোর দাম লেখা আছে—কোনোটাই দুই-তিন লাখ টাকার কম না।
পড়ার ঘরের দরজায় একটা লাল ফিতা লাগানো হয়েছে। দাদি (কিংবা নানি) কাঁচি দিয়ে সেই ফিতা কেটে ছবি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন। বেলা তিনটা সময় দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সবাই আগেই হাজির হয়ে গেছে বলে দাদি (কিংবা নানি) আগেই ফিতা কেটে উদ্বোধন করে ফেললেন।
যারা দেখতে এসেছে, তাদের সবারই একটা প্রশ্ন, এই ছবিগুলি যে এঁকেছে সে কোথায়?
বাচ্চারা সবাই মিলে তার একটা উত্তরও তৈরি করে রেখেছে। উত্তরটা এ রকম: শান্তর ক্লাসে একটা ছেলে খুব সুন্দর ছবি আঁকে। তাই সবাই মিলে ঠিক করেছে তারা ক্লাসে ছেলেটার আঁকা ছবি দিয়ে একটা চিত্র প্রদর্শনী করবে। ছেলেটা খুব উৎসাহ নিয়ে অনেকগুলি ছবি এঁকে দিয়েছে। তাদের ফ্রেম করার পয়সা নাই, তার আর্ট পেপার কেটে তার পেছনে ছবিগুলো লাগিয়েছে, স্কুলের প্রিন্সিপাল থেকে পারমিশন নিয়েছে, ঠিক যেদিন প্রদর্শনী হবে তার আগের দিন শান্তর ক্লাসের অন্য একটা পাজি ছেলে একটা বড়ো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলল। (ঝামেলাটা কী সেটা পরিষ্কার করে বলা হবে না, খানিকটা রহস্যের মতো রাখা হবে।) তখন প্রিন্সিপাল রেগে গিয়ে তাদের চিত্র প্রদর্শনীর পারমিশন বাতিল করে দিলেন—অর্থাৎ ছেলেটার চিত্র প্রদর্শনী আর হতে পারবে না। ছেলেটার খুবই মন খারাপ, তাই ক্লাসের সবাই মিলে ঠিক করল অন্য কোথাও এই চিত্র প্রদর্শনী করা হবে। কিন্তু কোথাও জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না তখন শান্ত বলল সবাই চাইলে শান্তদের বাসায় করা যেতে পারে। সবাই রাজি হলো, তখন শান্ত ঝুমু খালার সাথে কথা বলল (এই বাসায় কিছু করতে হলে ঝুমু খালার সাথে কথা বললেই হয়, ঝুমু খালা বিচার-বিবেচনা করে বড়োদের জানিয়ে রাখে)। ঝুমু খালা রাজি হলো (চা-নাশতা পর্যন্ত বানানোর দায়িত্ব নিল)।
শান্ত তখন বাসার অন্য বাচ্চাদের সাথে কথা বলেছে, সবাই সাহায্য করতে রাজি হয়েছে, তারপর একটা তারিখ ঠিক করে সবাইকে জানিয়েছে। তখন হঠাৎ করে শান্তর স্কুলের প্রিন্সিপালের রাগ কমেছে এবং আবার তাদের স্কুলের ক্লাসে প্রদর্শনী করার অনুমতি দিয়েছেন। কাজেই প্রদর্শনীটা স্কুলেই হবে কিন্তু এই বাসায় যেহেতু সবকিছু রেডি করা হয়ে গেছে তাই এই বাসার মানুষজনের জন্য প্রদর্শনীটা করে ফেলাই ঠিক হয়েছে।
সেই জন্য যে ছবিগুলো এঁকেছে সে এখানে নেই।
ব্যাখ্যাটা যথেষ্ট জটিল, কিন্তু যেহেতু যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা, তাই সবাই মেনে নিয়েছে। সুন্দর সুন্দর ছবিগুলো দেখে সবাই শান্তকে বলেছে সে যেন তার বন্ধুকে বলে সে খুব সুন্দর ছবি আঁকে। বড়ো হয়ে নিশ্চয়ই সে খুব বড়ো একজন শিল্পী হবে।
যখন সবাই প্রদর্শনীর ছবিগুলো দেখে, আহা-উঁহু করে চা-নাশতা খাচ্ছে তখন দুইটা ঘটনা ঘটল। একটা ভালো ঘটনা। আরেকটা খুবই ডেঞ্জারাস ঘটনা।
ভালো ঘটনা হচ্ছে ফারিহাপু তার এক শিল্পী বান্ধবীকে নিয়ে চিত্র প্রদর্শনী দেখতে এলো।
ডেঞ্জারাস ঘটনা হচ্ছে, আনিকার শুকনা-লিকলিকে মা আনিকাকে দেখার জন্য হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি হাজির হলেন। এতক্ষণ আনিকা খুবই হাসিখুশি হয়ে সবার কথা শুনছিল, হঠাৎ করে তার মা’কে দেখে সে ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। যদিও কাউকে বলা হয়নি যে এগুলো আনিকার আঁকা তবুও আনিকা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মুখে কোনো কথা না বলে বাচ্চারা সবাই শুধু চোখের দৃষ্টি দিয়ে আনিকাকে সাহস দিলো, কিন্তু আনিকা সাহস পেল না, ভয়ে ফ্যাকাশেই হয়ে রইল।
আনিকার মা’কে দেখে দাদি বললেন, “তুমি তোমার মেয়ের খোঁজ নিতে এসেছো? তোমার মেয়ে আমার নাতি-নাতনিদের সাথে ভালোই আছে। দেখছো না আজকে ছবির প্রদর্শনী করছে!”
আনিকার মা জিজ্ঞেস করল, “কার ছবি?”
“আমরা চিনি না, নাতির ক্লাসের কোন ছেলের।”
আনিকার মা কী ভাবলেন কে জানে, হেঁটে একটা ছবির সামনে গেলেন। একজন বিধ্বস্ত বুড়ো মানুষের ছবি। মানুষটা উবু হয়ে বসে সামনে তাকিয়ে আছে। চোখের দৃষ্টিটা জানি কেমন, মনে হয় মানুষটার ভেতরে একধরনের হতাশা।
ফারিহাপুর শিল্পী বান্ধবী ঠিক তখন সেই ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্য সবাই ছবি দেখে আহা-উঁহু করছে, কী সুন্দর, কী সুন্দর বলেছে, কিন্তু ফারিহাপুর শিল্পী বান্ধবী কিছু না বলে ছবিটার দিকে কেমন জানি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে। তার কেমন জানি ঘোরলাগা দৃষ্টি। বেশ কিছুক্ষণ পর বন্ধ নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে সে ফারিহাকে ডাকল, জিজ্ঞেস করল, “তুমি বলছো এগুলো একটা স্কুলের ছাত্রের আঁকা ছবি?”
“আমাকে তো তাই বলল।”
“তুমি চিন্তা করতে পারো! যদি স্কুলের একটা তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলে এ রকম ছবি আঁকতে পারে তাহলে পরে সে কত বড়ো শিল্পী হবে!” ফারিহার শিল্পী বন্ধু ফারিহাকে বলল, “আমার এই ছেলেটার সাথে দেখা করতে হবে, তার সাথে কথা বলতে হবে।”
ফারিহা বলল, “দাঁড়াও, আমি ব্যবস্থা করে দিই।”
কিছুক্ষণের ভেতরে ফারিহা শান্তকে নিয়ে হাজির হলো। শান্তর সাথে শিল্পীর কী কথা হয় শোনার জন্য টুনি এবং টুনির সাথে অন্য বাচ্চারাও চলে এসেছে। আনিকার মা’ও ঠিক তখন কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নিস্পৃহভাবে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন।
শান্ত আনিকার মা’কে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু ঘাবড়ে গেল, তারপরেও মুখের ভাবা স্বাভাবিক করে রাখার চেষ্টা করল। ফারিহার শিল্পী বন্ধু শান্তকে জিজ্ঞেস করল, “এই যে ছবিগুলো এঁকেছে, সে তোমাদের ক্লাসে পড়ে?”
শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
“ছেলেটার নাম কী?”
“আহসান।”
“আমি আহসানের সাথে একটু দেখা করতে চাই, বুঝেছো?”
শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
“কীভাবে দেখা করা যায়?”
শান্ত মাথা চুলকে বলল, “অ্যাঁ…অ্যাঁ…” তখন টুনি সামলে নিল।
টুনি বলল, “আপনার টেলিফোন নম্বরটা শান্তকে দেন, শান্ত তার বন্ধুকে দিয়ে আপনাকে ফোন করতে বলবে।”
শিল্পী বন্ধু বলল, “গুড আইডিয়া। আমি আমার একটা কার্ড দিয়ে দিই।” বলে সে তার ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে শান্তর হাতে দিলো। সবাই গলা লম্বা করে কার্ডটা দেখল, কার্ডটা খুবই সুন্দর, দেখেই বোঝা যায় এটা একটা শিল্পীর কার্ড। মেয়েটার নাম ফারহানা জাহিন, একটা ম্যাগাজিনের হেড আর্টিস্ট, এ ছাড়াও অনেকগুলো মিডিয়ার আর্ট ডিরেক্টর। মেয়েটার নামের পেছনে অনেকগুলো ডিগ্রি, মেয়েটাকে দেখে বোঝাই যায় না সে এতকিছু।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “আপু, আপনি এই ছেলেটার সাথে দেখা করে কী করবেন?”
ফাহানা জাহিন নামের মেয়েটা একটু হাসি হাসি মুখে বলল, “এ রকম প্রডিজি তো ডজন ডজন হয় না, হঠাৎ করে এক-দুইটা পাওয়া যায়। এই ছেলেটা এখনই হান্ড্রেড পার্সেন্ট আর্টিস্ট। শুধু মানুষের চেহারা আঁকে না, তার ভেতরের এক্সপ্রেশন বের করে আনে। এর মাঝে সে তার একেবারে নিজস্ব নূতন টেকনিক বের করেছে। এক কথায় অসাধারণ। তাই তাকে নিজের চোখে দেখতাম। তাকে উৎসাহ দিতাম—আমাদের দেশে অনেক ফ্যামিলিতে ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকতে দিতে চায় না। এ ছাড়াও আমার পার্সোনাল সেলফিশ একটা ইন্টারেস্ট আছে—”
ফারহানা জাহিনের কথার মাঝখানে হঠাৎ করে আনিকার মা মুখ শক্ত করে বললেন, “কিন্তু কথাটা তো সত্যি।”
ফারহানা জাহিন থতমত খেয়ে বললেন, “কোন কথাটা?”
“মানুষের ছবি আঁকা ঠিক না, গুনাহ হয়।”
“কেন?”
“এই ছবির মানুষগুলোকে কি ছেলেটা জান দিতে পারবে?”
ফারহানা জাহিন হাসল, বলল, “না। পারবে না। ছেলেটা একবারও বলে নাই সে তার ছবিগুলোর মানুষকে জান দিবে। আপনি যখন পাসপোর্টে ছবি তুলেন তখন কি সেই ছবিতে জান দেওয়া হয়?”
আনিকার মা বলল, “সেইটা অন্য কথা। ফুল-লতাপাতার ছবি আঁকা ঠিক আছে। জন্তু-জানোয়ার-মানুষের ছবি আঁকা ঠিক না।”
ফারহানা জাহিন হাসি হাসি মুখে বলল, “ফুল-লতাপাতার ছবি আঁকা যদি ঠিক থাকে তাহলে মানুষের ছবি আঁকাও ঠিক আছে। কেন জানেন?”
“কেন?”
“মানুষের শরীর যে রকম কোষ দিয়ে তৈরি, ভেতরে যে রকম নিউক্লিয়াস, নিউক্লিয়াসের ভেতরে যে রকম ক্রোমোজম, ক্রোমোজমের ভেতর ডিএনএ— ফুল গাছ, লতাপাতাও হুবহু একই রকম। তারাও কোষ দিয়ে তৈরি, কোষের ভেতরে নিউক্লিয়াস, নিউক্লিয়াসের ভেতরে ক্রোমোজম ডিএনএ—বায়োলজি ক্লাসে এইগুলা উদ্ভিদকোষ, প্রাণিকোষ মুখস্থ করতে করতে জান বের হয়ে গেছে।”
ফারহানা জাহিনের কথা শুনে অনেকেই এগিয়ে এসেছে, বায়োলজি ক্লাসে মুখস্থ করার যন্ত্রণার কথা শুনে সবাই মাথা নাড়ল। চারপাশে এতজনকে দেখে ফারহানা জাহিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আনিকার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি প্লিজ আমার কথা শুনে কিছু মনে করবেন না। আমি কারো বিশ্বাসকে আঘাত দিতে চাই না—আমি নিজে যখন আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতে গিয়েছিলাম, আমাকেও অনেকে ভর্তি হতে দিতে চায় নাই—”
আনিকার মা বললেন, “না। ঠিক আছে। হেঁটে চলে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, “আমার মেয়েও ছবি আঁকতে চায়, আমি দেই না।” তারপর চারপাশের ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আনিকা অবশ্য এত সুন্দর আঁকতে পারে না। আলতুফালতু ছবি আঁকে।”
ঠিক তখন রিনরিনে গলায় মুনিয়া বলল, “কিন্তু এই সব ছবিগুলো তো আসলে আনিকা আপুই এঁকেছে। তাই না আপু?”
ঘরের মাঝে একটা বজ্রপাত হলো। নিঃশব্দ বজ্রপাত। যে যেখানে ছিল সে সেখানে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না, ফারহানা জাহিন প্রথম কথা বলল, জিজ্ঞেস করল, “কে এঁকেছে?”
হঠাৎ করে মুনিয়া বুঝতে পারল তার এই কথাটা বলার কথা না। সে তার জিভে কামড় দিলো। তারপর ভয়ে ভয়ে সবার দিকে তাকাল।
যেটা ঘটার ঘটে গেছে, যারা আনিকাকে চিনে তারা সবাই তখন খুব ধীরে ধীরে আনিকার দিকে তাকিয়েছে। আনিকার মাও।
আনিকা কেমন যেন আতঙ্ক নিয়ে সবার দিকে তাকাল, যখন একজন মানুষকে অসংখ্য মানুষ ধারালো অস্ত্র নিয়ে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে তাকে আক্রমণ করতে যায় তখন সেই মানুষটার চেহারা যে রকম হয়, আনিকার চেহারা হলো ঠিক সে রকম। ভয়ার্ত চোখে সবার দিকে তাকাল, তারপর দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে মাথা নিচু করল, তাকে দেখে মনে হলো সে খুব বড়ো একটা অপরাধ করে ধরা পড়ে গেছে।
ফারহানা জাহিন আনিকার মায়ের দিকে তাকাল, আনিকাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ আপনার মেয়ে?”
আনিকার মা মুখ শক্ত করে বললেন, “হ্যাঁ।”
“সে এই ছবিগুলো এঁকেছে?”
“আমি ঠিক জানি না—”
ফারহানা জাহিন এবারে আনিকার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রাখল, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আনিকা, তুমি এই ছবিগুলো এঁকেছো?”
আনিকা ভয়ে ভয়ে একবার মুখ তুলে ফারহানা জাহিনের দিকে তাকাল, তারপর মাথা নিচু করল। প্রায় শোনা যায় না এভাবে বলল, “হ্যাঁ।”
“তুমি কোথায় এ রকম ছবি আঁকা শিখেছো?”
আনিকা ফিসফিস করে বলল, “কখনো শিখি নাই। নিজে নিজে…”
ফারহানা জাহিন আবার আনিকার মাথায় হাত বুলিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে হেঁটে হেঁটে চলে আসতে আসতে আনিকার মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। বলতে গেলে সবাই তখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। ফারহানা জাহিন আনিকার মা’কে বলল, “আপনাকে একটা কথা বলি?”
আনিকার মা বললেন, “বলেন।”
ফারহানা জাহিন বললেন, “দেখেন, আমি একজন আর্টিস্ট। আমি কে ভালো আর্টিস্ট আর কে খারাপ আর্টিস্ট সেটা বলতে পারি। আপনার মেয়ে কিন্তু একজন আর্টিস্ট হয়ে গেছে—কীভাবে হয়েছে জানি না। আপনি তাকে ছবি আঁকতে না দিলেও সে কিন্তু আর্টিস্ট হবেই। কাজেই তাকে ছবি আঁকতে দেন—প্লিজ—আপনার পায়ে পড়ি—”
দাদি তাদের কথা শুনছিলেন, এবারে আনিকার মা’কে রীতিমতো ধমক দিয়ে বললেন, “এসব কী শুনি জোবেদা? তুমি তোমার মেয়েকে ছবি আঁকতে দাও না? তোমার মেয়ে কি খালি তোমার একার নাকি? খবরদার—”
আনিকার মা থতমত খেয়ে বললেন, “না খালা, আসলে লেখাপড়ার ক্ষতি হবে—”
“কীসের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে? আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাই নাই? আমাদের নাতি-নাতনিরা লেখাপড়া করে না? খবরদার এ রকম উল্টাপাল্টা কাজ করবা না—”
“ঠিক আছে খালা, ঠিক আছে—আমি ছবি আঁকতে দিব—
হঠাৎ করে সব বাচ্চা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। তারা আনিকার কাছে ছুটে গেল, সবাই মিলে তাকে জাপটে ধরল। আর আনিকা দুই হাতে মুখ ঢেকে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
* * *
মাসখানেক পর বাচ্চাদের নামে একটা বড়ো খাম এসেছে, ভেতরে কোনো একটা বই না-হয় ম্যাগাজিন। টুনি খামটা খুলতেই ভেতর থেকে একটা চিঠি বের হলো—ছোটো চিঠি। চিঠিতে লেখা :
প্ৰিয় সবাই
তোমাদের মনে আছে তোমাদের বাসায় চিত্র প্রদর্শনীর সময় ফারহানা জাহিন ম্যাডাম বলেছিলেন, ছবিগুলির শিল্পীর সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য তার একটা “সেলফিশ ইন্টারেস্ট” আছে? তার সেলফিশ ইন্টারেস্টটা কি ছিল জানো? ম্যাডামকে বাচ্চাদের নূতন একটা ম্যাগাজিনের জন্য ভালো একজন আর্টিস্ট খুঁজে বের করতে বলেছিল—ম্যাডাম আমাকে তার দায়িত্ব দিয়েছেন, যদিও আমি খুবই ছোটো। আমি ছবি এঁকে এতগুলো টাকা পেয়েছি, সব আম্মুকে দিয়েছি, আম্মু খুব খুশি (হি হি হি)। পরের বার আমি কিছু নেব, কেন জানো? ঢাকা এসে তোমাদের সবাইকে নিয়ে চায়নিজ খেতে যাব।
আমার ছবি আঁকা প্রথম ম্যাগাজিনটা পাঠালাম। কেমন হয়েছে বলো।
তোমাদের
আনিকা
চিঠি পড়া শেষ করে টুনি ম্যাগাজিনটা খুলল। প্রচ্ছদে ঝকঝকে একটা ছবি! অনেকগুলো বাচ্চা আনন্দে চিৎকার-চেঁচামেচি করছে আর পেছনে তাদের মা, কোমরে হাত দিয়ে বাচ্চাদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছেন।
বাচ্চাগুলো হচ্ছে এই বাসার সব বাচ্চা—মুনিয়া, টুম্পা থেকে শুরু করে টুনি, প্রমি, শান্ত, শাহানা সবাই আছে। হুবহু তাদের চেহারা।
আর পেছনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটি হচ্ছে ঝুমু খালা!
