চক্র – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
চক্র
ছোটাচ্চু দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসে তার চেয়ারে বসে সেক্রেটারিয়ে টেবিলে পা তুলে দিয়ে একটা বল পয়েন্ট কলমের গোড়া চিবুতে চিবুতে একটা কাগজ দেখছে। টেবিলের অন্য পাশে বসে টুনি তার একটা বই খুলে পড়ছে—আজকে তার একটা বই কেনার দরকার ছিল, বইটা কিনে এনেছে। সে ছোটাচ্চুর সাথে বাসায় ফিরে যাবে।
এ রকম সময় আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির রিসিপশনিস্ট, সেক্রেটারি এবং অন্য যা কিছু হওয়া সম্ভব তার সবকিছু, নীলিমা অফিসে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “শাহরিয়ার ভাই, একজন ক্লায়েন্ট এসেছে।
“কী নিয়ে?”
“ঠিক বুঝি নাই? কোনো একটা ভৌতিক ব্যাপার।”
“অ্যাঁ?” ছোটাচ্চু টেবিলে পা রেখেই কেমন যেন লাফিয়ে উঠল। চাপা
গলায় বলল, “ভৌতিক ব্যাপার আমার কাছে কেন?”
“সেটা আমি জানি না।”
“বিদায় করতে পারো কি না দেখো—”
টুনি চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “না-না ছোটাচ্চু, আসতে বলো প্লিজ।”
ছোটাচ্চু মুখ ভোঁতা করে বলল, “ঠিক আছে পাঠাও।” তারপর পা নামিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “টুনি, তুই যা বাইরে গিয়ে বস।”
টুনি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “প্লিজ—আমি থাকি? যদি মানুষটা আমার সামনে কথা বলতে না চায় তখন বাইরে যাব। প্লিজ—”
ছোটাচ্চু কিছু বলার আগেই নীলিমা মানুষটাকে নিয়ে চলে এসেছে। টুনি খুবই দ্রুত তার বইয়ের মাঝে পুরোপুরি ডুবে আছে সে রকম ভান করে মাথা নিচু করে ফেলল।
মানুষটা এসে ছোটাচ্চুর সামনে বসে। টুনি বইয়ে পুরোপুরি মগ্ন হয়ে আছে ভান করার কারণে মুখ তুলে সরাসরি মানুষটার চেহারা দেখতে পেল না। মনে হলো মানুষটা মধ্যবয়সি, মোটামুটি ভালো পোশাক পরে এসেছে।
টুনি কান খাড়া করে রেখেছে, শুনল ছোটাচ্চু বলল, “আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“আমার একটু হেল্প দরকার।”
“আপনার কী ধরনের হেল্প দরকার?”
“ঠিক আমার নিজের না, আমার ছেলের হেল্প দরকার।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনার ছেলের কী ধরনের হেল্প দরকার?”
মানুষটা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। টুনি টের পেল মানুষটা এখন তার দিকে তাকিয়ে দেখছে, এক্ষুনি নিশ্চয়ই বলবে সে টুনির সামনে বলতে চায় না—কিন্তু মানুষটা শেষ পর্যন্ত সেটা বলল না। আবার ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পড়ে—সামনে পরীক্ষা। পরীক্ষার জন্য লেখাপড়া না করে সে অন্য কায়দা শুরু করেছে।”
“কী কায়দা?”
“কী একজন অলৌকিক মানুষ খুঁজে বের করেছে—তার পিছু ধরেছে।”
“অলৌকিক মানুষ?”
“হ্যাঁ। তার বাসায় সন্ধ্যার পর ভূতের আসর শুরু হয়—সেখানে ভূত নামানো হয়?”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “ভূত?”
মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তারা অবশ্য ভূত বলে না। তারা বলে বিদেহী আত্মা।”
“বিদেহী আত্মা?”
“হ্যাঁ। সেই বিদেহী আত্মা নামানো গিয়ে দেখা যায়। আত্মা নামানোর কাজে অংশ নেওয়া যায়।”
ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “অংশও নেওয়া যায়?”
“হ্যাঁ।”
“যে কেউ অংশ নিতে পারে?”
“সবাই পারে না—যারা বিশ্বাসী, তারা।”
ছোটাচ্চু শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, “ইন্টারেস্টিং!”
টুনি শুনল মানুষটা বলছে, “ইন্টারেস্টিং না—খুবই আজব।”
“কারা যায় ওইখানে?”
“আমার ছেলে বলেছে অনেকে যায়। বসার জায়গা নাকি পাওয়া যায় না। দেশে কি পাগলের অভাব আছে?”
“কোনো ফি দিতে হয় না?”
“না। দেখতে কোনো ফি লাগে না—কিন্তু কেউ যদি কোনো প্রশ্ন করে, কোনো উপদেশ নেয়, ওষুধের প্রেসক্রিপশন, পরকালে কারো কাছে কোনো খবর পাঠাতে চায়—তাহলে একজন চাইলে খুশি হয়ে একটা ফি দিতে পারে। তারা অবশ্য ফি বলে না। বলে চ্যারিটেবল কন্ট্রিবিউশান। সেই ফান্ড দিয়ে অসহায় আত্মাদের পুনর্বাসন করা হয়—”
“সেটা কীভাবে হয়?”
মানুষটা অধৈর্য হয়ে বলল, “আমার কোনো ধারণা নাই। আমার ছেলে এই দলের সাথে জুটেছে। সে বিদেহী আত্মাদের সাথে যোগাযোগ করে কোনোমতে ইন্টারের কয়েকটা প্রশ্ন নামাতে চায়।”
টুনি চোখ তুলে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ছোটাচ্চু নিশ্চয়ই মুখ হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মানুষটা আবার কথা বলল, “আপনি আমাকে বাঁচান। এই ছেলেটাকে এদের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে দেন।”
ছোটাচ্চু বলল, “এখানে দুইটা ব্যাপার। প্রথমত, আপনি যেটুকু বলেছেন সেখান থেকে আমি নিশ্চিত না যে এই লোকটা কোনো আইন ভেঙেছে-
মানুষটা বলল, “ঠিক লোক না, মহিলা।”
“মহিলা?”
“হ্যাঁ। খুব নাকি স্মার্ট মহিলা।”
ছোটাচ্চু বলল, “পুরুষ-মহিলা যাই হোক, একই ব্যাপার। সেই মহিলা কাউকে জোর করছে না—যার ইচ্ছা সে নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে। টাকাপয়সা নিয়েও জোরাজুরি নাই। যার ইচ্ছা দিচ্ছে। পুরোটাই বিশ্বাসের ব্যাপার—কারো বিশ্বাসকে তো আমার বেআইনি বলতে পারব না।” ছোটাচ্চু গলার স্বর পরিবর্তন করে বলল, “এটা হচ্ছে প্রথম ব্যাপার। দ্বিতীয় ব্যাপারটি আরও ইম্পরট্যান্ট।”
“দ্বিতীয় ব্যাপারটা কী?
“দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে, আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি নীতিগতভাবে কোনো ভৌতিক ঘটনা নিয়ে তদন্ত করে না।”
মানুষটা কেমন জানি কাঁচুমাচু হয়ে গেল, বলল, “প্লিজ, ডিটেকটিভ সাহেব। আমি তাহলে কার কাছে যাব? একটু চেষ্টা করে দেখেন। আপনার এজেন্সির যত ফি লাগে—”
ছোটাচ্চু মানুষটাকে থামাল, বলল, “এটা আসলে ফি’র ব্যাপার না। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনার বিচলিত হওয়ার কারণটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা এসব ব্যাপারে জড়িত হতে চাই না। আই অ্যাম সরি।”
টুনি না তাকিয়েই বুঝতে পারল মানুষটা উঠে দাঁড়িয়েছে। মানুষটা ছোটাচ্চুর সামনে কিছু একটা রাখল, তারপর বলল, “এই যে আমি আমার কার্ডটা দিয়ে গেলাম। যদি মাইন্ড চেঞ্জ করেন আমার সাথে যোগাযোগ করবেন, প্লিজ।”
“ঠিক আছে।”
মানুষটা যেতে যেতে বলল, “ভেবেছিলাম আপনাদের হেল্প নিয়ে ছেলেটাকে উদ্ধার করব। কিন্তু এখন একটাই উপায় বাকি থাকল—”
“কী করবেন?”
“ছেলেটাকে পিটিয়ে সোজা করা ছাড়া আর উপায় কী?”
মানুষটা অফিস থেকে বের হতেই টুনি মুখ তুলে তাকাল, চাপা গলায় বলল, “ছোটাচ্চু—
“কী হয়েছে?”
““
“প্লিজ তুমি কেসটা নাও। প্লিজ! প্লিজ!”
ছোটাচ্চু মুখ বাঁকা করে বলল, “আমার আর কাজ নাই—আমি এখন ভূতপ্রেতের পেছনে দৌড়াব!”
টুনি বলল, “প্লিজ! প্লিজ! ছোটাচ্চু—প্লি-ই-জ!”
ছোটাচ্চু একটা ধমক দিলো, বলল, “আমার সাথে এসব ব্যাপার নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করবি না।”
টুনি কাতর গলায় আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার দরকার হলো না, ঠিক তখন ফারিহা এসে ঢুকল, সাথে সাথে ছোটাচ্চুর মুখটা একশ ওয়াট বাতির মতো জ্বলে উঠল। সব দাঁত বের করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, “আরে ফারিহা! তুমি? কী মনে করে?”
ফারিহা বলল, “এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম—ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। যদি বাসায় যাও লিফট দিতে পারি—”
ছোটাচ্চু বলল, “কোনো তাড়াহুড়া নাই। বসো। একটু কফি খাও।”
টুনি বলল, “হ্যাঁ, ফারিহাপু বসো। তোমার সাথে একটা জরুরি কথা আছে।”
“কী কথা?”
ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে বলল, “তোর আবার কী কথা? চুপ কর।”
টুনি বলল, “না ফারিহাপু, তুমি এসেছো খুব ভালো হয়েছে। খুবই ইন্টারেস্টিং একটা কেস এসেছে—ছোটাচ্চু নিতে চাচ্ছে না। প্লিজ তুমি ছোটাচ্চুকে রাজি করাও! প্লিজ!”
ফারিহা বলল, “তোমার ছোটাচ্চুকে রাজি করাতে হবে কেন? ইন্টারেস্টিং কেস হলে তুমি আর আমি মিলে সলভ করে ফেলব। আমি আর তুমি আগে করি নাই? কী কেস বলো—”
টুনি দাঁত বের করে হেসে বলল, “বলছি ফারিহাপু।”
টুনি বলতে শুরু করল, ছোটাচ্চু তার চেয়ারে বসে পড়ে হতাশভাবে মাথা নাড়তে লাগল।
* * *
দুই দিন পর সন্ধ্যাবেলা ফারিহা ঠিকানা দেখে তার গাড়িটা একটা নির্জন পুরানো বিল্ডিংয়ের সামনে থামাল। গাড়ির পিছনে টুনি বসে আছে, ফারিহার পাশে বসেছে তার এক বান্ধবী। ফারিহা যে রকম খুব মজার একটা মেয়ে তার বান্ধবীরাও সে রকম। এই বান্ধবীর নাম জান্নাত। ছোটাচ্চু যেহেতু কিছুতেই ভূত নামানোর আসরে আসবে না, ফারিহা তাই তার এই বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। টুনি জান্নাতকে দেখেই বুঝে গেছে এ রকম জায়গায় কেন ফারিহাপু জান্নাতকে নিয়ে এসেছে। জান্নাত আপু কথা বলার মাঝে এক্সপার্ট—গভীর রাতে তাকে যদি রাস্তায় ছিনতাইকারী ধরে তাহলে জান্নাত আপু ছিনতাইকারীকে বুঝিয়েসুঝিয়ে উল্টো তার কাছ থেকে রিকশা ভাড়াটা আদায় করে নিবে। শুধু যে কথা বলার মাঝে এক্সপার্ট তা না—জান্নাত আপুর বাস্তব বুদ্ধিও আছে। যেমন ফারিহা গাড়ি থামানোর সাথে সাথে জান্নাত আপু বলল, “আমাদের গাড়ি থেকে নামার আগে কয়েকটা জিনিস ঠিক করে নিতে হবে।”
ফারিহাপু জিজ্ঞেস করল, “কী জিনিস?”
জান্নাত আপু টুনিকে দেখিয়ে বলল, “টুনিকে নিশ্চয়ই ঢুকতে দেবে না। ভূতপ্রেত তো আর বাচ্চাদের ছেলেখেলা না!”
ফারিহা বলল, “তা ঠিক। আমি ভেবেছিলাম বড়ো কন্ট্রিবিউশন করার লোভ দেখিয়ে—”
জান্নাত আপু মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। এটা কাজ নাও করতে পারে।” ফারিহাপু বলল, “তাহলে?”
টুনি নিজেও এটা ভেবেছে। সে না আসলেই ঝামেলা মিটে যেত। কিন্তু সে পুরো ঘটনাটা নিজের চোখে খুব দেখতে চাইছে। যদি তাকে ঢুকতে না দেয় তাহলে সে ফারিহাপুর গাড়িতে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে ঠিক করেছে।
জান্নাত আপু অবশ্য এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না। সে বলল, “এখানে কন্ট্রিবিউশনের কথা কাজ নাও করতে পারে—অন্য কায়দা করতে হবে।”
“অন্য কী কায়দা?”
“গিয়ে বলা হবে, টুনির ওপর মাঝে মাঝে ভূতের আসরের মতো হয়— উল্টোপাল্টা মানুষের মতো কথা বলে—অনেক ডাক্তার, সাইকোলজিস্ট দেখানো হয়েছে—কাজ হয় নাই, এখন সত্যিকারের এক্সপার্টকে দেখানোর জন্য এনেছি।”
ফারিহাপু বলল, “ঠিক আছে, আমাকে বলে দে কী বলতে হবে।”
জান্নাত আপু মাথা নাড়ল, বলল, “না, না—তুই পারবি না। জীবনে একটা মিছা কথা বলিস নাই, কী বলতে গিয়ে কী বলে ফেলবি। যা বলার আমি বলব। টুনি হবে আমার খালাতো বোনের মেয়ে। ঠিক আছে?”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “আমি কী করব?”
“তোমাকে কিছুই করতে হবে না। শুধু চোখ বড়ো বড়ো করে এদিক- সেদিক তাকাবে—একটা কথাও বলবে না।”
টুনি আবার মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে আপু।”
জান্নাত আপু বলল, “আগে আমি আর টুনি যাই। ফারিহা, তুই একটু পরে আয়। ভিতরে ঢোকার পর তুই আমাকে চিনিস না, আমিও তোকে চিনি না। ঠিক আছে?”
ফারিহাপু একটু হাসল, বলল, “ঠিক আছে। আর তুই যদি টুনিকে ঢোকাতে না পারিস—”
জান্নাত আপু ফারিহাপুকে থামিয়ে দিলো, বলল, “কেন পারব না? আমার ওপর ভরসা রাখিস—”
কাজেই টুনি আর জান্নাত আপু গাড়ি থেকে নেমে গেল। এই বাসার তিন তলায় একটা ফ্ল্যাটে আত্মা নামানো হয়। বাসায় লিফট নাই, কাজেই দুইজন সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠে গেল। ফ্ল্যাটের দরজায় জান্নাত আপু টোকা দিলো—ভেতর থেকে একজন দরজা খুলে দিলো, শাড়ি পরা একটা মেয়ে কোনো কিছু না বলে চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাদের দিকে তাকাল।
জান্নাত আপু বলল, “এখানে সেয়ান্স হয়, আমরা সেই সেয়ান্সে এসেছি।”
মেয়েটা একটু অবাক হয়ে বলল, “সেয়ান্স?”
“ও আচ্ছা, দেশে এটাকে কী বলে? যেখানে আত্মা নামানো হয়?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, এখানে আমাদের গুরুমা বিদেহী আত্মার সাথে যোগাযোগ করেন।”
জান্নাত আপু বলল, “আমি এখানে যোগ দিতে এসেছি।”
মেয়েটা বলল, “ঠিক আছে কিন্তু এই বাচ্চা মেয়েটা এখানে কেন? এটা তো বাচ্চাদের ব্যাপার না।”
জান্নাত আপু খুবই গম্ভীর মুখে বলল, “কিন্তু আমি এসেছি এই বাচ্চাটার জন্য। আমার খালাতো বোনের মেয়ে—মেয়েটার সিরিয়াস প্রবলেম—’
“কী প্রবলেম?”
জান্নাত আপু গলা নামিয়ে মেয়েটাকে ফিসফিস করে বলল, “আমি ওর সামনে বলতে চাই না—গুরুমা’কে বলব—প্লিজ—”
মেয়েটা কী যেন ভাবল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, আসেন ভেতরে।” মেয়েটার পিছু পিছু জান্নাত আপু আর টুনি ভেতরে ঢুকল। ভেতরে রীতিমতো অন্ধকার, ঘরে কোনো ফার্নিচার নাই। মেঝেতে কার্পেট বিছানো, সেখানে অনেকে গোল হয়ে বসে আছে। ঠিক মাঝখানে একটা প্রদীপ জ্বলছে, সেই প্রদীপের আলোতে মানুষগুলোকে কেমন যেন রহস্যময় দেখাচ্ছে। সবাই চুপ করে বসে আছে। তাদের নিঃশ্বাসের চাপা শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।
মাঝখানের জায়গাটুকু ফাঁকা, বোঝা যাচ্ছে গুরুমা এখানে এসে বসবে। ঘরে হালকা একধরনের সুগন্ধ—মনে হয় প্রদীপের তেলে কোনো ধরনের সুগন্ধি কিছু রয়েছে।
জান্নাত আপু টুনিকে নিয়ে নিঃশব্দে বসে পড়ে। ঘরটা যেহেতু অন্ধকার তাই জান্নাত যে টুনির মতো ছোটো একজন মেয়ে নিয়ে এসেছে সেটা খুব বেশি মানুষ দেখল না। টুনিও কার্পেটে বসে যতটুকু সম্ভব মাথা নিচু করে রাখল। কিছুক্ষণের ভেতরে ফারিহাপু এসে ঢুকল এবং ওদের কাছাকাছি একটা ফাঁকা জায়গায় বসে পড়ল।
ওদের বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকতে হলো—তবে কেউ অধৈর্য হলো না, সবাই চুপচাপ বসে রইল। একসময় একটু উত্তেজনা দেখা গেল এবং ভেতরের দরজা খুলে একজন মহিলা এসে ঢুকল, প্রদীপের মৃদু আলোতে মহিলাকে কেমন জানি রহস্যময় দেখায়—চুলগুলো ফুলে আছে, কপালে একটা বড়ো টিপ, ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। একটা ধবধবে সাদা শাড়ি পরে আছে। মহিলাটি কোনোরকম ভূমিকা না করে খসখসে গলায় বলল, “আমি এখন চক্রে বসব। আমার সাথে যারা বসবে তারা সামনে চলে এসো।”
কয়েকজন সামনের দিকে বসেছিল, তারা একটু নড়েচড়ে গোল হয়ে বসল। টুনি প্রদীপের আলোতে দেখল সবাই একজন আরেকজনের হাতেরও উপর হাত রেখে মাথা নিচু করে বসেছে।
গুরুমা নামের রহস্যময় মহিলা তার খসখসে গলায় বলল, “আমি এখন বিদেহী আত্মাদের ডাকছি।” তারপর অদ্ভুত একটা গলার স্বরে কথা বলতে থাকে, “হে বিদেহী আত্মা, হে মহাত্মা, হে সম্মানী অতিথি, আপনাদের এই ছোটো ঘরটিতে স্বাগত। আপনাদের জন্য আমাদের ভালোবাসা এবং গভীর ভালোবাসা। মর্তের মানুষ আপনাদের সাহচর্য পাওয়ার জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আপনারা আসুন, আমি পূতপবিত্র হয়ে আমার দেহটি আপনাদের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছি, আপনাদের একজন আমার দেহে প্রবেশ করুন, আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে আমার কণ্ঠস্বরে মর্ত্যের মানুষের সাথে যোগাযোগ করুন। আসুন… আপনারা আসুন… আপনাদের আমি আহ্বান করছি… সুদূর পরপার থেকে এই পৃথিবীতে আসুন… আসুন… আসুন…”
টুনি অবাক হয়ে দেখল সারা ঘরে কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, পুরো ঘর নিঃশব্দ, সবাই যেন অজানা কিছু রহস্যময় ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছে। ঠিক তখন একটা ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। কেউ যেন অনেক কষ্ট করে গভীরভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে—তারপর একটা চাপা আর্তনাদের শব্দ তারপর হঠাৎ করে একজন পুরুষের গলার স্বর গুরুমায়ের গলা থেকে বের হয়ে এলো, “কে? কে আমাকে ডেকে এনেছে?”
বোঝাই যাচ্ছে বিদেহী আত্মাটি গুরুমায়ের ওপর ভর করেছে, কাজেই গুরুমা আর তার মতো করে কথা বলতে পারছে না। কাছাকাছি অন্য একজন বসেছিল, নিশ্চয়ই গুরুমায়ের সহকারী, আরেকটি মেয়ে, সে বিদেহী আত্মার প্রশ্নের উত্তর দিলো, বলল, “আমরা আপনাকে ডেকেছি। আমরা।”
“কেন? কেন তোমরা আমাকে ডেকে এনেছো?” পরিষ্কার পুরুষ মানুষের গলা।
অন্য মেয়েটি বলল, “আমরা আপনাদের জগৎ সম্পর্কে জানতে চাই, জনাব।”
গুরুমায়ের কণ্ঠ থেকে পুরুষ মানুষের গলায় উত্তর দিলো, “যে জগৎ সম্পর্কে জানতে আমাদের পরপারে যেতে হয়েছে, তোমরা এই জগৎ থেকেই সেটা জানতে চাও!” তারপর মানুষটি একটু হাসার মতো শব্দ করল।
“আপনি কি আপনার নামটি বলবেন?”
“নাম-ঠিকানা এই বিষয়গুলো তোমাদের পৃথিবীতে দরকার হয়—আমাদের তো সেই পরিচয়গুলোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
টুনি বুঝতে পারল এই বিদেহী আত্মাটি একটু দার্শনিক ধরনের, তাকে যে প্রশ্নই করা হোক সে খুবই দার্শনিক ধরনের উত্তর দেয়। গুরুমা’র সহকারী মেয়েটি ঘরের মানুষজনের কাছে জিজ্ঞেস করল তাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না। এক-দুইজনের প্রশ্ন ছিল, দুটো প্রশ্নই ধর্ম নিয়ে এবং সৃষ্টিকর্তা নিয়ে। দার্শনিক বিদেহী আত্মা খুব সুন্দরভাবে সেগুলোর উত্তর দিলো। তখন গুরুমা’র সহকারী মেয়েটি তাকে বিদায় দিলো।
টুনি ভেবেছিল এখন গুরুমা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, কিন্তু স্বাভাবিক হলো না, প্রায় সাথে সাথে আরেকটি আত্মা তার ওপর ভর করল। এটিও পুরুষ মানুষ, তবে একটু নার্ভাস টাইপের, কোনো একটা কিছু নিয়ে তার ভেতরে আতঙ্ক। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে কথা বলছে। তাকে বিদায় দেওয়ার পর যে এসেছে সেটি একটি মেয়ে। এই বিদেহী আত্মাটি একটু খ্যাপা ধরনের। চিৎকার- চেঁচামেচি করে একটা ভয়ংকর পরিবেশের সৃষ্টি করল। কোনো উপায় না দেখে যখন তাকে বিদায় নিতে বলা হলো তখন সে চিৎকার করে বলল, “নানা— আমি যাব না। যাব না—” তারপর আর্তনাদ করে কাঁদতে লাগল।
টুনির মনে হলো এটা খুবই বিপজ্জনক একটা পরিবেশ—এখন যদি এই মেয়েটি না যায় তখন কী হবে?
গুরুমায়ের সহকারী জানে কী করতে হবে, সে চক্রে বসা সবাইকে বলল চক্র ভেঙে ফেলতে। সবাই ধরে রাখা হাত ছেড়ে দিলো এবং গুরুমা তখন মাথা সোজা করে বসে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিতে নিতে এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
সহকারী মেয়েটি বলল, “আপনার ওপর একটা আত্মা ভর করেছিল, কিছুতেই যেতে চাচ্ছিল না।”
“ছেলে না মেয়ে?”
“মেয়ে।”
“সুইসাইড করা মেয়েটি নাকি?”
“না। অন্য মেয়ে।”
গুরুমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আহা বেচারিরা। বড়ো কষ্ট হয় এ রকম মানুষের জন্য!”
সহকারী মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “আরও কি করবেন? নাকি শেষ করে দেবেন? আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে।”
গুরুমা বলল, “না, কষ্ট কীসের? এক গ্লাস পানি দাও।”
একজন তাকে সুন্দর একটা গ্লাসে পানি দিলো, গুরুমা পানি খেয়ে বলল, “ঠিক আছে তাহলে আবার শুরু করি। সবাই চক্রে বসে যাও।”
তখন খুবই বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। টুনির পাশে বসে থাকা জান্নাত আপু তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “আমিও বসব।’
তারপর কাউকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, সবাইকে ডিঙিয়ে সামনে গিয়ে চক্রে বসা মানুষগুলোর কাছে গিয়ে দুইজনকে ঠেলেঠুলে দুই পাশে সরিয়ে মাঝখানে বসে গেল। শুধু বসেই থেমে গেল না, দুই পাশের দুইজনের হাত চেপে ধরে চক্র পুরো করে ফেলল।
পুরো ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে কেউ কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত পেল না। হতভম্ব ভাবটা কাটার পর গুরুমা অবাক হয়ে বলল, “তুমি— মানে আপনি চক্রে বসতে চান?”
“জি গুরুমা।”
“আগে কখনো বসেছেন?”
জান্নাত আপু হাসি হাসি মুখে বলল, “আমাকে তুমি করে বলবেন গুরুমা।”
“আগে কখনো চক্রে বসেছো?”
“না বসি নাই। কিন্তু আমি পারব। আমি পূতপবিত্র হয়ে এসেছি। আমার মন শান্ত—”
গুরুমায়ের সহকারী মেয়েটি কঠিন গলায় বলল, “না। যার যখন খুশি এভাবে বসতে পারবে না। কিছু একটা ঘটে গেলে, তখন কী হবে?”
গুরুমা হাত তুলে তার সহকারীকে থামিয়ে বলল, “থাকুক। বসতে দাও।”
জান্নাত আপু আনন্দে তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসল।
আবার চক্র শুরু হলো। গুরুমা আবার তার রহস্যময় গলায় বিদেহী আত্মাদের ডাকতে শুরু করল। যখন খুবই আন্তরিকভাবে ডাকছে তখন আরেকটি বিচিত্র ঘটনা ঘটল। জান্নাত আপু জোরে জোরে ভারী নিঃশ্বাস নিতে থাকে। শুধু যে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে তা নয়, সবাই স্পষ্ট দেখল তার শরীরটা কাঁপছে। পাশে বসা দুইজন জান্নাত আপুর দিকে তাকিয়ে আছে। গুরুমা ফিসফিস করে বলল, “ভালো মিডিয়াম মনে হচ্ছে।”
জান্নাত আপু উঠে যাওয়ার পর সেখানে একটু জায়গা খালি হয়েছে। খালি জায়গাটাতে ফারিহাপু এসে বসেছে। সে তার মাথা নামিয়ে টুনির কানে ফিসফিস করে বলল, “জান্নাতটা কত বড়ো পাজি দেখেছো?”
টুনি এত অবাক হয়েছে যে তার বলার কিছু নেই, হতবাক হয়ে জান্নাত আপুর দিকে তাকিয়ে আছে।
জান্নাত আপুর কাঁপুনি একটু কমল কিন্তু পুরোপুরি থামল না। কাঁপতে কাঁপতেই তার মাথা একটু তুলে পরিষ্কার পুরুষের মোটা গলায় বলল, “কে? কে আমাকে ডেকেছে?”
আগেরবার গুরুমায়ের ওপর আত্মা ভর করেছিল বলে অন্য একজন আত্মার সাথে কথা বলেছে। এবারে গুরুমা নিজেই কথা বলল, “মহাত্মা, আমরা আপনাকে ডেকেছি।”
পুরুষ কণ্ঠ বলল, “কেন এখন আমাকে ডেকেছো? যখন আমি বেঁচে ছিলাম তখন আমি কতবার সবাইকে ডেকেছি। তখন তো কেউ আসে নাই। আসে নাই।” মানুষটা কান্নায় ভেঙে পড়ল।
গুরুমা সান্ত্বনা দিলো, বলল, “আপনি কেমন করে মারা গিয়েছিলেন?”
“আমি আত্মহত্যা করেছিলাম।”
ঘরের সবাই চমকে উঠল। জান্নাত আপু বলল, “আমার মনে হয়েছিল আমার সাথে কেউ নেই। বেঁচে থেকে কী হবে?”
গুরুমা বলল, “আমরা খুবই দুঃখিত। খুবই দুঃখিত।”
“এখন আর দুঃখ করে কী হবে? ঠিক আছে, বলো, আমাকে কেন ডেকেছো?”
“আপনি কি কিছুক্ষণ আমাদের সাথে থাকবেন? আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবেন?”
“যদি এই মেয়েটা আমাকে সহ্য করতে পারে।” আত্মাটি জান্নাত আপুর কথা বলছে।
“মনে হয় পারবে।”
“ঠিক আছে তাহলে প্রশ্ন করো।”
গুরুমা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কারো কোনো প্রশ্ন আছে?”
একজন মহিলা কান্না কান্না গলায় বলল, “আমার মেয়েটা কেমন আছে? কত কষ্ট করে ভুগে ভুগে মারা গেল।”
জান্নাত আপু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “নিশ্চয়ই ভালো আছে। পৃথিবীতে অনেক কষ্ট। কেউ যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তখন তার আর কোনো কষ্ট থাকে না মা।”
মহিলাটা আরেকটা প্রশ্ন করতে চাইছিল, তার আগেই পিছন থেকে কিশোর কণ্ঠে একজন জিজ্ঞেস করল, “ইন্টারের একটা প্রশ্ন বলবেন প্লিজ?”
টুনি মাথা ঘুরিয়ে ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করল। এটা নিশ্চয়ই সেই ছেলেটা, যার বাবা ছোটাচ্চুর কাছে গিয়েছিল। যার কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে তারা আজকে এখানে এসেছে।
জান্নাত আপু কয়েকবার বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিল, নিয়ে বলল, “বাবার কাছে আই ফোন কেনার টাকা চেয়ে পত্র লেখো। বাংলা দ্বিতীয় পত্র।”
আরও কিছু বলতে চাইছিল, তখন হঠাৎ করে জান্নাত আপু কেমন জানি কাঁপতে থাকে, তার গলার স্বরটা এলোমেলো হয়ে যায়। কোনোমতে বলল, “এই মেয়েটা আমাকে আর সহ্য করতে পারছে না। মেয়েটা দুর্বল। আমাকে যেতে হবে—যেতে হবে—অন্য কারো কাছে যেতে না পারলে আমাকে চলে যেতে হবে, নাহলে এই মেয়েটার অনেক ক্ষতি হবে—”
গুরুমা বলল, “আমার কাছে আসেন মহাত্মা। আমি আমার পুরো সত্তা আপনার জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছি।”
জান্নাত আপু বলল, “আমি আসছি। আসছি… আসছি…।”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে জান্নাত আপু চোখ খুলে পিটপিট করে তাকাতে লাগল। একই সাথে গুরুমা মাথা নিচু করে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিতে নিতে পুরুষের কণ্ঠস্বরে বলল, “এসেছি। আমি এসেছি—আমি তোমার ওপর এসেছি। ওই মেয়েটা দুৰ্বল—তুমি ভালো—”
পিছনে বসে থাকা ইন্টার পরীক্ষার্থী আবার চেষ্টা করল, “ইন্টারের আরেকটা প্রশ্ন প্লিজ। ফিজিক্সের না—”
গুরুমা বলল, “তোমাকে একটা বলেছি সেটাই যথেষ্ট। না না, আর বলব
“প্লিজ! প্লিজ!”
তখন একজন মহিলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “আমার মেয়েটা হঠাৎ করে মারা গেল। কেন? কী হয়েছিল তার?”
গুরুমায়ের কণ্ঠে পুরুষটি কী উত্তর দেবে সেটি আর শোনা হলো না। হঠাৎ জান্নাত আপু আবার তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এই টুনি, ফারিহা, চল বাসায় যাই। আর নাটক দেখে লাভ নেই।”
মনে হলো ঘরের ভেতর একটা বাজ পড়ল।
জান্নাত আপু বলল, “কেউ একজন লাইটটা জ্বালাবেন, প্লিজ। অন্ধকারে কার ঘাড়ে পা দিয়ে দিব—”
সত্যি সত্যি টুক করে একটা লাইট জ্বলে উঠল, খুব বেশি আলো নেই কিন্তু অন্ধকারে বসে থেকে সবার চোখ এমনভাবে সয়ে গেছে যে এই আলোতেই সবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সবাই চোখ পিটপিট করে জান্নাত আপুকে দেখার চেষ্টা করছে, কী হয়েছে সবাই বোঝার চেষ্টা করছে।
গুরুমায়ের সহকারী মেয়েগুলো কেমন যেন রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিল কিন্তু জান্নাত আপু হাত তুলে তাদেরকে শান্ত করে বলল, “আপু, আপনাদের গুরুমা হয়তো পুরোপুরি খাঁটি! কিন্তু আমি ভুয়া। আমি পুরোপুরি ভুয়া। আমি পুরোটা অ্যাক্টিং করেছি।”
বসে থাকা একজন অবাক হয়ে বলল, “অ্যাক্টিং?”
“হ্যাঁ।” জান্নাত আপু সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল, “আমি অ্যাক্টিং করি। নাটকের দল আছে আমার, নাম জাহ্নবী। আমার ওপর কোনো ভূতটুত আসে নাই। অ্যাক্টিং করেছি—দেখতে চাচ্ছিলাম আমার ভুয়া ভূত গুরুমায়ের ওপর ট্রান্সফার করা যায় কি না। ট্রান্সফার করা গেছে—তাই অন্যগুলোর কথা জানি না। এইবারেরটা ভুয়া। আমারটাও ভুয়া গুরুমায়েরটাও ভুয়া।”
গুরুমা কেমন জানি হকচকিত হয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে জান্নাত আপুর দিকে তাকিয়ে রইল। জান্নাত আপু হাসি হাসি মুখে বলল, “গুরুমা—”, তারপরে থেমে গিয়ে গলার স্বর পাল্টে বলল, “তোমার বয়স এত কম, মা ডাকি কেমন করে? গুরু-আপু, ঠিক আছে?”
গুরুমা কিংবা গুরু-আপু কোনো উত্তর দিলো না।
জান্নাত আপু উত্তর নিয়ে কোনো মাথা ঘামাল না, বলল, “গুরু-আপু, তুমি অ্যাক্টিং লাইনে খুব ভালো করবে। তোমার ভয়েস কন্ট্রোল অসাধারণ। এই মেয়ে এই পুরুষ—কয়জন পারে? আমরা পরের নাটকের জন্য অডিশান নিচ্ছি। চলে আসো, আমাদের দলের নাম জাহ্নবী।”
গুরুমা কিংবা গুরু-আপু কিছু বলল না, কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। জান্নাত আপু উপস্থিত অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সামনের সপ্তাহে বেইলি রোডে আমাদের নাটকের একটা শো আছে, নাটকের নাম ‘যখন যেমন তখন তেমন’—আপনারা দেখতে আসবেন।”
একজন জিজ্ঞেস করল, “আপনি অ্যাক্টিং করেছেন সেখানে?”
“হ্যাঁ। করেছি—সাইড রোল কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জিং।”
উপস্থিত আরেকজন কেমন জানি খ্যাপা গলায় বলল, “এত বড়ো ভুয়া বিজনেস—”
জান্নাত আপু হাত তুলে বলল, “না-না-না—আগেই ভুয়া বলবেন না- খালি আমার সাথে যেইটা করেছে সেইটা ভুয়া। অন্যগুলি হয়তো খাঁটি। ওদের কাছে শুনেন।”
এবারে বিরক্ত ভঙ্গি করতে করতে বেশ কয়েকজন উঠে দাঁড়াল। জান্নাত আপু বলল, “টুনি, ফারিহা—তোমরা কই, চলো যাই।”
ফারিহা আর টুনি উঠে দাঁড়াল। বের হতে হতে জান্নাত আপু হঠাৎ থেমে গেল, মাথা ঘুরিয়ে বলল, “আমাদের ইন্টারের ছাত্র কই?”
পিছন দিকে একজন কিশোর ছাত্র মুখ কাঁচুমাচু করে উঠে দাঁড়াল। জান্নাত আপু তার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলল, “শোনো ছেলে, বাসায় গিয়ে লেখাপড়া করো—তোমার বাংলা সেকেন্ড পেপারে বাবার কাছে আই ফোনের টাকা চেয়ে চিঠি মোটেও আসে নাই, বুঝেছো?”
ছেলেটি মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে।
টুনি এই প্রথম কথা বলল, ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা এই জায়গাটার কথা জেনেছি তোমার আব্বুর কাছে। তোমার আব্বু কিন্তু তোমার ওপর অনেক রেগে আছেন। বলেছেন—”
টুনি থেমে গেল। ছেলেটা একটু ভয় পেয়ে বলল, “কী বলেছেন?”
একটু ইতস্তত করে বলল, “বলেছেন তুমি যদি এ রকম প্রশ্ন নামানো বন্ধ করে লেখাপড়া শুরু না করো, তাহলে তোমার—তোমার—”
টুনি আবার থেমে গেল। ছেলেটা ফ্যাকাশে হয়ে বলল, “আমার কী?”
“তোমার গায়ে হাত তুলবেন। তোমার আব্বু অবশ্য এত সুন্দর করে বলেন নাই—অনেক খারাপভাবে বলেছেন।”
“খারাপভাবে কী বলেছেন?”
“সেইটা আর না বললাম। অনেক খারাপ–”
টুনি জান্নাত আপু আর ফারিহাপুর পিছে পিছে বের হয়ে এলো—আরও অনেকেও তাদের সাথে বেরিয়ে এসেছে।
ফারিহাপু তার গাড়ি স্টার্ট করে জান্নাত আপুর দিকে তাকিয়ে বলল, “সর্বনাশ! তুই এত ডেঞ্জারাস। জীবনে আর কোনোদিন যদি তোকে নিয়ে বের হই!”
জান্নাত আপু হি হি করে হাসল, বলল, “এইটা আর এমন কী?”
