ফারাজ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
ফারাজ
নার্গিস ম্যাডাম ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজকে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তোমাদের সাথে কথা বলতে আসবেন।”
একটা সময় ছিল যখন ছেলেমেয়েরা নার্গিস ম্যাডামকে এত ভয় পেত যে ক্লাসে কেউ টু শব্দ করার সাহস পেত না। ম্যাডাম কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে একটা জানা জিনিসও তারা ভুলে গিয়ে তোতলাতে শুরু করত। নিজের থেকে ম্যাডামকে কিছু জিজ্ঞেস করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। এখন ভয়টা অনেক কমেছে, তাই রাজু প্রশ্ন করল, “কেন ম্যাডাম? প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আমাদের সাথে কী নিয়ে কথা বলবেন?”
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আমি তোমাদের সেটা না বললাম। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকেই বলতে দিই।”
ক্লাসের সবাই হালকা একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, ক্লাসে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চলে আসার ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায়। ক্লাসের কেউ বাড়াবাড়ি কোনো অপকর্ম করেছে কি না অনুমান করার চেষ্টা করে। ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে সবুজের পেটে একজন গুঁতো মেরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “তুই কিছু করেছিস?”
সবুজ চোখ পাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আমি কী করব?”
টুনি নার্গিস ম্যাডামকে সাহস করে সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলল, “প্রিন্সিপাল ম্যাডাম যেটা বলবেন সেটা কি ভালো কিছু, না খারাপ কিছু সেইটা একটু আভাস দিবেন ম্যাডাম?”
নার্গিস ম্যাডাম দার্শনিকের মতো বললেন, “তোমার কি ধারণা পৃথিবীর সবকিছুকে ভালো আর খারাপ এই দুই ভাগে ভাগ করা সম্ভব?”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “তা সম্ভব না। তবে—”
নার্গিস ম্যাডাম হাসি গোপন করে বললেন, “তবে কী?”
টুনি বলল, “মানে জানতে চাচ্ছিলাম, আমরা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের জন্য ভয় নিয়ে অপেক্ষা করব, নাকি আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করব?”
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আনন্দ মিশ্রিত ভয় নিয়ে অপেক্ষা করতে পারো। কিংবা—”
রাজু কথাটা শেষ করে দিলো, “ভয় মিশ্রিত আনন্দ নিয়ে!”
তবে তার কোনোটারই প্রয়োজন হলো না, কারণ ঠিক তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে হেঁটে হেঁটে তাদের ক্লাসে আসতে দেখা গেল।
ম্যাডাম ক্লাস রুমে ঢোকার পর নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আপনার এই ছাত্রছাত্রীরা খুবই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে আপনি কী বলবেন সেটা শোনার জন্য।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটু অবাক হয়ে বললেন, “তুমি এদের এখনও কিছু বলোনি?”
“না। আপনার মুখ থেকেই শুনুক।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “ঠিক আছে।” তারপর একটু এগিয়ে গিয়ে একবার পুরো ক্লাসের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, “আমি তোমাদের একটা খবর দিতে এসেছি।”
সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “তোমাদের ক্লাসে একটা নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছে। সে আগামীকাল থেকে ক্লাস করতে আসা শুরু করবে।
সবাই একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকায়। বছরের মাঝামাঝি একজন ভর্তি হওয়া একটা খবর হতে পারে, কিন্তু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের নিজে এসে দেওয়ার মতো খবর না। নিশ্চয়ই এখানে অন্য কোনো ব্যাপার আছে। এই ছেলেটা নিশ্চয়ই অন্য দশজনের মতো না, অন্য রকম। কিন্তু কীভাবে অন্য রকম? সবাই সেটা শোনার জন্য প্রিন্সিপাল ম্যাডামের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “তোমাদের ক্লাসে যে ছেলেটা ভর্তি হয়েছে, তাকে ভর্তি করার আগে আমরা অনেক আলাপ-আলোচনা করেছি, অনেক চিন্তাভাবনা করেছি। কারণ ছেলেটা তোমাদের অন্য দশ জন ছেলের মতো সাধারণ-স্বাভাবিক নয়, ছেলেটা অটিস্টিক।” প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটু থামলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা আর্টিস্টিক বলতে কী বোঝায় জানো?”
টুনি জানে, কিন্তু সে তার চোখের কোনা দিয়ে ক্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখল অনেকেই জানে না। কেউ কেউ ইতস্ততভাবে মাথা নাড়ছে, টুনি অনুমান করল তারা জানলেও ভুলভাবে জানে।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “শব্দটা হচ্ছে অটিজম। যাদের অটিজম থাকে তাদের বলে অটিস্টিক। অটিজম কোনো রোগ না, এটা হচ্ছে ব্রেনের একটু ভিন্ন ধরনের গঠন। তারা পৃথিবীটাকে একটু ভিন্নভাবে দেখে। অটিজম একরকম না, খুব কম অটিজম থেকে অনেক বেশি অটিজম হতে পারে। যদি খুব বেশি অটিজম থাকে সে হয়তো একা কোনো কাজই করতে পারে না, এমনকি হয়তো কথাও বলতে পারে না। তার সব কাজে একজনকে সাহায্য করতে হয়। আবার যার খুবই কম অটিজম, সে হয়তো নিজেই সেটা টের পায়নি। তার পরিচিতেরা হয়তো ভেবেছে সে একটু ইন্ট্রোভার্ট—বা—বা—”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ইন্ট্রোভার্ট শব্দটার বাংলা অর্থ খুঁজতে লাগলেন, নার্গিস ম্যাডাম তাকে সাহায্য করলেন, বললেন, “অন্তর্মুখী।”
“হ্যাঁ, অন্তর্মুখী। যারা অটিস্টিক হয় তাদের অনেকেরই অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে একটু সমস্যা হয়। হয়তো নিজেকে ঠিকভাবে বোঝাতে পারে না। যখন বোঝাতে পারে না তখন হয়তো একটু অস্থির হয়ে যায়। অনেকের হয়তো শেখা নিয়ে সমস্যা হয়। কারো হয়তো বেশি কারো কম। এক কথায় এটা হচ্ছে একটা বিস্তৃত স্পেক্ট্রাম।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটু থামলেন। সারা ক্লাসের দিকে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের কারো কোনো প্রশ্ন আছে?”
টুনি চোখের কোনা দিয়ে তাকাল, সবার ভেতরে নিশ্চয়ই অনেক প্ৰশ্ন কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। টুনি তখন দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল, “ম্যাডাম, আমাদের সাথে যে ছেলেটা ভর্তি হয়েছে সে স্পেক্ট্রামের কোন জায়গায়? কম না বেশি?”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “মাঝামাঝি। তার লেখাপড়া শেখায় সমস্যা আছে। তোমাদের ক্লাসে ভর্তি না হয়ে তোমাদের নিচের ক্লাসে ভর্তি হলে হয়তো আরেকটু ভালো হতো। কিন্তু চিন্তাভাবনা করে আমরা তাকে তোমাদের ক্লাসে দিলাম।”
“কেন ম্যাডাম?”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটু হাসির ভঙ্গি করলেন, তারপর বললেন, “আমি সব ক্লাসের খবর নিয়েছি। খবর নিয়ে দেখেছি, প্রথমবার এই ধরনের একটা ছেলেকে কোনো ক্লাসে ভর্তি করাতে হলে তোমাদের ক্লাসটাই সবচেয়ে ভালো। তার কারণ তোমাদের ক্লাসে সব ধরনের ছেলেমেয়ে আছে।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম সব ধরনের ছেলেমেয়ে বলতে কী বোঝাতে চাইছেন জানার জন্য সবাই একটু উশখুশ করতে লাগল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম নিজেই তখন সেটা ব্যাখ্যা করলেন, বললেন, “তোমাদের ক্লাসে খুবই দায়িত্বশীল একজন আছে, যে এই বয়সে নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে (সবাই চোখের কোনা দিয়ে সালমার দিকে তাকাল), আবার পড়াশোনায় ভালো একজন আছে, যে সবাইকে সাহায্য করে (চোখের কোনা দিয়ে সবাই রাজুর দিকে তাকাল), আবার খুবই বুদ্ধিমান একজন আছে, যার মাথায় বুদ্ধি গিজগিজ করছে (সবাই একসাথে টুনির দিকে তাকাল), আবার এমন একজন আছে, যার দুষ্টুমি পাজির পর্যায়ে চলে যায় (সবাই সবুজের দিকে তাকাল, সবুজ চট করে মাথা নিচু করে ফেলল), আবার এমন একজন আছে, যে এখনই বড়ো সাহিত্যিকদের মতো লিখে (সবাই ফিরোজার দিকে তাকাল, ফিরোজের গালটা একটু লাল হয়ে উঠল), আবার খেলাধুলায় অসম্ভব ভালো বেশ কয়েকজন আছে (এখন কে কার দিকে তাকাবে ঠিক করতে পারল না), আবার সুন্দর গান গাইতে পারে, আবৃত্তি করতে পারে, নাচতে পারে এ রকম অনেকেই আছে (কয়েকজন মৌটুসির দিকে তাকাল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একজন আছে না বলে অনেকেই আছে বলায় মৌটুসি একটু হতাশ হলো)। শুধু তাই না, তোমরা পুরো ক্লাস মিলে গতবার কালচারাল উইকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর খুব সুন্দর অনুষ্ঠান করেছো (এবার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা একটা আনন্দের শব্দ করল)। সুন্দর অনুষ্ঠান থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তোমাদের পুরো ক্লাসের সব ছেলেমেয়ের টিম ওয়ার্ক। আমাদের মনে হয়েছে তোমাদের ক্লাসে শুধু সব রকম ছেলেমেয়ে আছে তা নয়, তোমরা অনেক দায়িত্বশীল। সে জন্য আমি এই ছেলেকে তোমাদের ক্লাসের দায়িত্বে দিতে চাই। তোমরা দায়িত্ব নেবে?”
ক্লাসের সবাই বলল, “নেব ম্যাডাম।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “ভেরি গুড। কাল থেকে ছেলেটা তোমাদের ক্লাসে আসবে।” তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের কারো
কোনো প্রশ্ন আছে?”
রাজু দাঁড়িয়ে বলল, “জি ম্যাডাম।”
“কী প্রশ্ন?”
“ছেলেটা সম্পর্কে যদি আরও কিছু বলতেন। তার সঙ্গে আমরা কীভাবে কথা বলব। কী করব। তার কী ভালো লাগে, খারাপ লাগে। আমাদের কী করা উচিত—এইসব।”
ম্যাডাম কী একটা চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে, আমি একটা কাজ করি, ছেলেটার বাবা-মা আমার অফিসে বসে আছেন। আমি তাদের ডেকে আনি। তোমরা তাদের সাথে কথা বলো। তারা সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন—”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কথা শেষ করার আগেই নার্গিস ম্যাডাম তাকে থামালেন, বললেন, “না ম্যাডাম, ছেলেটার বাবা-মা’কে ডাকবেন না।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একটু অবাক হলেন, বললেন, “ডাকব না?”
“না। আমার মনে হয় ছেলেমেয়েরা নিজেরাই চিন্তাভাবনা করে ঠিক করুক কীভাবে এই ছেলেটার সাথে তারা কথা বলবে, বন্ধুত্ব করবে। এটা হোক তাদের একটা নূতন অভিজ্ঞতা—”
“মানে তাদের নিজস্ব একটা প্রজেক্ট?”
নার্গিস ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, বললেন, “জি। তাদের নিজস্ব একটা কার্যক্রম।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম কিছু একটা চিন্তা করলেন, তারপর মাথা নাড়লেন, বললেন, “তোমার আইডিয়াটা খারাপ না। বাচ্চাদের জন্য চমৎকার একটা চ্যালেঞ্জ—”
নার্গিস ম্যাডাম মাথা নাড়লেন, বললেন, “জি।”
“ঠিক আছে।” প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রাজুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে ব্যাপারটা একটা রহস্যের মতো থাকুক। তোমরা নিজেরাই এই ছেলেটাকে আবিষ্কার করো।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর নার্গিস ম্যাডাম ক্লাসের সবার দিকে তাকালেন, “তোমরা জানতে চাইছিলে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম যেটা বলবেন সেটা ভালো না খারাপ। এখন তো শুনলে। তোমরাই বলো, বিষয়টা কি ভালো না খারাপ?”
টুনি বলল, “ভালো ম্যাডাম, অবশ্যই ভালো। কিন্তু একটু ভয় ভয় লাগছে।”
নার্গিস ম্যাডাম হাসলেন, বললেন, “ভয়ের কী আছে? তোমরা তো শুনেছো ছেলেটার মস্তিষ্কের গঠন ভিন্ন, তাই একটু অন্যভাবে চিন্তা করে, পৃথিবীটাকে অন্যভাবে দেখে। তোমরা তাকে মোটেও করুণা করবে না, তাকে নিজেদের আরেকজন হিসেবে ধরে নেবে। ভাব বিনিময়ে সমস্যা হতে পারে, তার জন্য সহমর্মিতা দেখিয়ে কাটিয়ে উঠবে—”
টুনি নার্গিস ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে রইল। ম্যাডাম কী সুন্দর করে কথা বলেন! বাংলায় কথা বলার সময় কখনো ইংরেজিতে একটা শব্দও বলেন না। ভাব বিনিময়, সহমর্মিতা এ রকম শব্দ এত সহজে ব্যবহার করেন যে সেগুলো শুনলে মনে হয় শব্দগুলো কত সহজ। টুনি যদি কথা বলতে গিয়ে এ রকম একটা শব্দ বলে তাহলে সেটা খট করে কানে লাগবে!
.
রাতে ঘুমানোর আগে টুনি তার আম্মুকে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু, তুমি কি অটিস্টিক ছেলেমেয়ে নিয়ে কিছু জানো?”
“কেন?” আম্মু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হঠাৎ অটিস্টিক ছেলেমেয়ে নিয়ে জানতে চাইছিস কেন?”
“কালকে আমাদের ক্লাসে একটা অটিস্টিক ছেলে আসবে। “ “সত্যি?”
“হ্যাঁ আম্মু।”
“ইন্টারেস্টিং! একসময় এদেরকে শুধু স্পেশালাইসড স্কুলে পাঠাত। আজকাল দেখি নরমাল স্কুলেও পাঠাচ্ছে। বাহ!”
টুনি মাথা নাড়ল। তারপর উৎসাহ নিয়ে বলল, “তুমি জানো আম্মু, এই ছেলেটাকে অন্য কোনো ক্লাসে না দিয়ে আমাদের ক্লাসে পাঠাচ্ছেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম মনে করেন এই বাচ্চাটার জন্য আমাদের ক্লাসটা সবচেয়ে ভালো।”
কেন? তোদের ক্লাস সবচেয়ে ভালো কেন?”
“মনে হয় আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে বেশি আজব আজব ছেলেমেয়ে আছে সেই জন্য। আজব ছেলেমেয়েরা তাড়াতাড়ি বন্ধু বানাতে পারে।”
টুনির কথা শুনে আম্মু শব্দ করে হাসলেন। টুনি তখন আবার জিজ্ঞেস করল, “আম্মু, তুমি কি অটিস্টিক ছেলেমেয়েদের কথা জানো? আগে তো আমরা কোনোদিন অটিস্টিক ছেলের সাথে মিশি নাই। সে জন্য আমরা সবাই একটু নার্ভাস।”
আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, “এক্সপার্টের মতো জানি না, কমনসেন্সের মতো জানি। পত্রিকা, বইপত্র, ম্যাগাজিন পড়ে যেটুকু জানা যায়—”
“একটু বলবে প্লিজ।”
আম্মু কাঁধ ঝাঁকালেন, বললেন, “যে রকম মনে কর, এরা সাধারণত চোখের দিকে তাকাতে চায় না—অনেকে তাদেরকে ছুঁতে দেয় না। একই ধরনের কাজ বারবার করতে থাকে। কেউ কেউ আবার অটিস্টিক সেভান্ট—”
“সেটা আবার কী?”
“হয়তো খুব সুন্দর পিয়ানো বাজায়। না-হয় ছবি আঁকে। কিংবা এ রকমও আছে যেকোনো বছরের যেকোনো দিন কী বার এক সেকেন্ডে বলে দিতে পারে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। আমি নিজে এ রকম একটা বাচ্চাকে দেখেছি।” আম্মু একটু থেমে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোদের টিচাররা তোদেরকে একটু বলে দেয়নি কীভাবে তার সাথে ডিল করতে হবে?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমাদের ম্যাডাম বলেছেন আমাদের নিজেদেরকে বের করতে হবে। এইটা আমাদের প্রজেক্ট।”
আম্মু চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? নিজেদের প্রজেক্ট হলে নিজেরা বের করবি। আমি আর কিছু বলব না।”
টুনি হতাশার মতো একটা শব্দ করে তার চশমাটা খুলে পাশের টেবিলে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
.
পরদিন টুনি একটু সকাল সকাল স্কুলে গেল। তখনও সবাই আসেনি কিন্তু অনেকে এসে গেছে। টুনিকে দেখে সবাই তার দিকে এগিয়ে আসে। রাজু বলল, “গুড, তুইও এসে গেছিস। আমরা কথা বলছিলাম কীভাবে নতুন ছেলেটাকে ওয়েলকাম করব।”
মৌটুসি বলল, “সে যখন ক্লাসে ঢুকবে আমরা তখন একটা গান করতে পারি। এসো এসো হে …”
সবুজ বলল, “তারপর মনে কর একটা স্লোগান দিলাম, অটিস্টিকের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগত।”
সবাই সবুজের দিকে তাকাল, রাজু চোখ কপালে তুলে বলল, “অটিস্টিকের আগমন? অটিস্টিক?”
সবুজ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “নামটা জানি না দেখে বললাম। নাম জানার পর আসল নামটাই বলব।”
সালমা মাথা নাড়ল, বলল, “না, গান-স্লোগান কোনোটাই ঠিক হবে না। আমরা এখনও ছেলেটার কিছুই জানি না। তার সাথে অস্বাভাবিক কিছুই করা যাবে না। খুবই স্বাভাবিক রাখতে হবে সবকিছু।”
টুনি বলল, “আমারও তাই মনে হয়। এমন ভান করতে হবে যেন ব্যাপারটা খুবই নরমাল। আমরা সবাই মিলে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকাব পর্যন্ত না।”
রাজু বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু বসবে কোনখানে?”
টুনি বলল, “সবুজের পাশে না এটুকু বলতে পারি।”
সবুজ মুখ শক্ত করে বলল, “আমি আমার পাশে কাউকে বসাতেও চাই না।”
কেউ সবুজের কথার উত্তর দিলো না। ফিরোজা বলল, “রাজুর পাশে বসতে পারে।”
রাজু বলল, “না-না—আমার পাশে না। আমি নার্ভাস হয়ে কী না কী বলে ফেলব।”
ফিরোজা বলল, “এর মাঝে নার্ভাস হওয়ার কী আছে?”
রাজু মাথা নেড়ে বলল, “আছে। আছে। আমি বোকাসোকা মানুষ লেখাপড়া ছাড়া আর কিছু করতে পারি না।”
ফিরোজা বলল, “তাহলে টুনির পাশে বসুক। টুনির মাথায় অনেক বুদ্ধি।”
টুনি বলল, “এর মাঝে বুদ্ধি আর বোকার কী আছে?”
সালমা বলল, “তা ঠিক। যেটা দরকার সেটা হচ্ছে মায়া। ছেলেটার জন্য মায়া।”
ফিরোজা বলল, “টুনির মায়াও আছে।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, ছেলেটার পাশে আমি বসতে পারি।”
রাজু বলল, “গুড। টুনির পাশে একটা সিট খালি করে রাখি।”
টুনি বলল, “আর একজন বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। ছেলেটাকে দেখলে ভেতরে নিয়ে আসবি।”
রাজু বলল, “চিনব কেমন করে?”
“চিনবি চিনবি। নূতন একটা ছেলে, আগে কখনো দেখিসনি—না চেনার কী আছে?”
“তা ঠিক।”
“আর ক্লাসে সবাইকে বলে রাখতে হবে সবাই যেন স্বাভাবিক ব্যবহার করে। তুই ক্লাস মনিটর, তুই বলে দে। কেউ যেন আলগা কৌতূহল না দেখায়।”
“ঠিক আছে।”
.
কাজেই একটু পর দেখা গেল রাজু আরও কয়েকজন নিয়ে ক্লাসের বাইরে অপেক্ষা করছে। ভেতর যারা আছে তারাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবার ভেতর একটা চাপা কৌতূহল কিন্তু কেউ সেটা প্রকাশ করছে না।
কিছুক্ষণের মাঝে সত্যি সত্যি ছেলেটাকে দেখা গেল। রাজু ভেবেছিল প্রথম দিন হিসেবে হয়তো কোনো একজন স্যার না-হয় ম্যাডাম ছেলেটাকে নিয়ে আসবেন কিন্তু দেখা গেল ছেলেটা একা একাই আসছে। মনে হয় সবাই চাইছে ছেলেটা যেন সবকিছু নিজে নিজে করতে শিখে। টুনি ঠিকই বলেছিল, ছেলেটাকে চিনতে কোনো অসুবিধাই হলো না। রাজু তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের বলল, “তোরা ক্লাসের ভেতরে ঢুকে যা, আমি ছেলেটাকে নিয়ে আসি।”
রাজু দাঁড়িয়ে রইল, ছেলেটার চোখ-মুখ কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো। দেখে মনে হয় বিশাল এক জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে—কখন কোথা থেকে বাঘ-ভাল্লুক তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দূর থেকেই রাজু দেখতে পারল ছেলেটা তার মাথাটা উপর-নিচে করছে আর ঠোঁট দুটি নড়ছে—মনে হয় কথা বলছে। রাজুর কাছে আসার পর সে ছেলেটার কথা শুনতে পেল। সে মন্ত্র পড়ার মতো করে বলে যাচ্ছে, “ক্লাস সেভেন সেকশন বি। ক্লাস সেভেন সেকশন বি। ক্লাস সেভেন…”
ছেলেটা বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, রাজু তাকে থামাল, বলল, “তুমি ক্লাস সেভেন সেকশন বি খুঁজছো?”
ছেলেটা থামল। সরাসরি রাজুর চোখের দিকে না তাকিয়ে একটু অন্যদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, “ক্লাস সেভেন সেকশন বি।”
রাজু তাদের ক্লাস রুমটা দেখিয়ে বলল, “এই যে। এইটা ক্লাস সেভেন সেকশন বি। তুমি এই ক্লাসে পড়বে?”
ছেলেটা একটু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ক্লাস সেভেন সেকশন বি- তে পড়ব।”
রাজু মুখটা হাসি হাসি করে বলল, “আমিও ক্লাস সেভেন সেকশন বি-তে পড়ি। আসো আমার সাথে।” ছেলেটা রাজুর সাথে ক্লাসে ঢুকল, তখন রাজু জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
“আমার নাম ফারাজ হোসেন।”
রাজু বলল, “আমার নাম রাজু।”
ছেলেটা আবার বলল, “আমার নাম ফারাজ হোসেন।”
রাজু বলল, “আসো ফারাজ। তুমি কোথায় বসবে?”
ফারাজ নামের ছেলেটা বলল, “আমি তোমার সাথে বসব।”
রাজু বলল, “আমার পাশে জায়গা খালি নাই। তোমাকে অন্য সিটে বসিয়ে দেই।”
ফারাজ বলল, “আমি অন্য সিটে বসব।”
রাজু ফারাজকে নিয়ে দ্বিতীয় বেঞ্চের কাছে গেল। সেখানে টুনি আগে থেকেই বসে ছিল। টুনি সরে একটু জায়গা করে দিলো। রাজু বলল, “তুমি এখানে বসো। টুনির পাশে। টুনি, ফারাজ আমাদের ক্লাসে পড়বে।”
ফারাজ সরাসরি টুনির দিকে তাকাল না। একটু অন্যদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “আমি ক্লাস সেভেনে পড়ব। আমার নাম ফারাজ হোসেন।”
টুনি বলল, “আমার নাম টুনি। তুমি ডেস্কের উপরে ব্যাগটা রেখে আমার পাশে বসো।”
ফারাজ বাধ্য ছেলের মতো টুনির পাশে বসল। তারপর ব্যাগটা খুলে সেখান থেকে একটা খাতা, একটা বল পয়েন্ট কলম আর ক্লাস সেভেনের বাংলা বইটা বের করে পাশাপাশি রাখল। তারপর এদিক-সেদিক তাকাল। তারপর আবার সেগুলো নিয়ে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল। তারপর আবার ভয়ে ভয়ে এদিক- সেদিক তাকাল। সবাই ইচ্ছে করে একটু দূরে দূরে আছে—কেউ সরাসরি তাকাচ্ছে না কিন্তু চোখের কোনা দিয়ে কী হচ্ছে লক্ষ করছে। ফারাজ আবার তার ব্যাগের ভেতর থেকে তার খাতা-কলম আর বই বের করে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। কিছুক্ষণ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার চারপাশে তাকাল। তারপর সেগুলো একটা একটা করে ব্যাগে ঢোকাল। মনে হয় সে এটাই করতে থাকবে। টুনি তখন তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল, বলল, “মনে আছে, আমার নাম টুনি?”
ফারাজ বলল, “আমার নাম ফারাজ হোসেন।”
টুনি বলল, “হ্যাঁ। তোমার নাম ফারাজ হোসেন। আর আমার নাম টুনি।”
ফারাজ কিছু না বলে সরাসরি টুনির দিকে না তাকিয়ে একটু অন্য পাশে তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না। টুনি বলল, “বলো, টুনি।”
ফারাজ অনিশ্চিতের মতো বলল, “টুনি।”
টুনি খুশি হয়ে বলল, “ভেরি গুড।” তারপর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “তোমার নাম ফারাজ আমার নাম টুনি। ফারাজ টুনি।”
ফারাজ বলল, “আমার নাম ফারাজ, তোমার নাম টুনি।”
“হ্যাঁ। তোমার নাম ফারাজ আমার নাম টুনি।”
রাজু পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে টুনি রাজুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওর নাম কী?”
ফারাজ রাজুর চোখের দিকে না তাকিয়ে মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তারপর বলল, “আমার নাম ফারাজ, তোমার নাম টুনি।”
“হ্যাঁ। আর এর নাম রাজু।”
ফারাজ অনিশ্চিতের মতো বলল, “রাজু?”
রাজু খুশি হওয়ার ভান করে বলল, “হ্যাঁ, রাজু।”
টুনি একজন একজন করে তিনজনকে দেখিয়ে বলল, “ফারাজ, টুনি, রাজু।”
ফারাজ বলল, “ফারাজ, টুনি, রাজু।”
“আমরা সব বন্ধু।”
ফারাজ অনিশ্চিতের মতো বলল, “বন্ধু।”
টুনি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের দেখিয়ে বলল, “আমরা সবাই বন্ধু।”
“বন্ধু।”
“হ্যাঁ, এই দেখো তোমার নূতন বন্ধু।” টুনি হাত নেড়ে অন্যদের ডাকল। ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো সবাই যেন একসাথে না আসে। প্রথমে এলো সালমা। টুনি বলল, “এই যে তোমার আরেকজন বন্ধু। এর নাম সালমা।”
ফারাজ বলল, “সালমা।”
টুনি একইভাবে আরও কয়েকজনের পরিচয় করিয়ে দিলো। ফারাজ একজন একজন করে সবার নাম উচ্চারণ করল, কিন্তু সবার নাম তার মনে থাকবে কি না এখনও জানা নেই। সবুজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে সে নিজেই এগিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে নিল, বলল, “আমার নাম সবুজ। বুঝলি? সবুজ। তোর কোনো ভয় নাই। কেউ যদি তোকে নিয়ে ইয়ার্কি করে আমাকে বলবি। বুঝলি? আমি পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেবো। তক্তা।”
টুনি সবুজকে থামানোর চেষ্টা করল কিন্তু লাভ হলো না। সবুজ নিজ থেকে কথা চালিয়ে গেল, “আমার নামটা মনে আছে তো? বল দেখি আমার নাম কী?
ফারাজ বলল, “তক্তা।”
সবাই হি হি করে হেসে উঠল, তখন ফারাজও হাসল, তবে কেন হাসল সে বুঝল বলে মনে হয় না। এটা সত্যিকারের হাসি না, হাসির মতো ভান। সবুজ মুখ শক্ত করে বলল, “না, না, না, তক্তা না। তক্তা কখনো নাম হয় না। সবুজ। সবুজ—লাল, নীল যে রকম রং, সেই রকম—”
টুনি সবুজকে থামাল, বলল, “ঠিক আছে সবুজ, অনেক হয়েছে। প্রথম দিনেই সবকিছু জেনে ফেলতে হবে না।”
সবুজ তর্ক শুরু করতে চেয়েছিল কিন্তু ঠিক তখন ঘণ্টা পড়ে গেল। কাজেই সবাই নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল।
একটু পরেই নার্গিস ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকলেন। হাতের খাতাপত্র, বই টেবিলে রাখলেন, ব্ল্যাকবোর্ডটা যথেষ্ট পরিষ্কার, তারপরও ডাস্টার দিয়ে সেটা মুছলেন, তারপর ক্লাসের দিকে তাকালেন। বললেন, “তোমাদের ক্লাসে আজকে নূতন একজন ছাত্র আসার কথা, ফারাজ হোসেন। কোথায় তুমি?”
টুনি বলল, “এই যে ম্যাডাম। আমার পাশে।”
নার্গিস ম্যাডাম ডাকলেন, “ফারাজ।”
ফারাজ শোনা যায় না এভাবে শব্দ করল, “উঁ।”
টুনি ফিসফিস করে বলল, “ফারাজ, ম্যাডাম তোমাকে ডাকছেন। তুমি উঠে দাঁড়াও। কথা বলো।”
“দাঁড়াব?”
“হ্যাঁ, দাঁড়াও।”
ফারাজ উঠে দাঁড়াল।
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “স্কুলে ছেলেমেয়েরা সারাদিন থাকে। তুমি ও থাকবে। কিন্তু আজকে তোমার প্রথম দিন। তোমার সারাদিন থাকতে হবে না। তোমার যতক্ষণ ইচ্ছা থাকো। তোমার যখন ইচ্ছা হয় তখন তুমি চলে যেতে পারো। ঠিক আছে?”
ফারাজ অনিশ্চিতের মতো বলল, “ঠিক আছে।” কিন্তু সে ঠিক করে বুঝল কি না সেটা বোঝা গেল না।”
নার্গিস ম্যাডাম বললেন, “আমি যেটা পড়াব তুমি সেটা মন দিয়ে শুনবে। বুঝেছো?”
ফারাজ বলল, “আমি মন দিয়ে শুনব।”
“বসো।”
ফারাজ বসল। নার্গিস ম্যাডাম তখন পড়ানো শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা। টুনি নিজে যখন পড়েছে তখন কবিতাটা কঠিন মনে হয়েছে। নার্গিস ম্যাডাম যখন কবিতাটা পড়লেন, একটা-দুইটা কথা বললেন তখন হঠাৎ করে কবিতাটা সহজ হয়ে গেল। কী আশ্চর্য!
টুনি ফারাজকে লক্ষ করল, সে তার বইটা বের করেছে, বের করে সেটা উল্টেপাল্টে দেখছে। মনে হয় তার পক্ষে কবিতাটা খুঁজে বের করা সম্ভব না। টুনি তখন কবিতাটা বের করে দিয়েছে। ফারাজ তখন কবিতাটার নিচে তার আঙুল রেখে সেটা বানান করে পড়ার চেষ্টা করল। খাতাটা বের করল। সেখানে তার নাম লিখল। বোঝাই যাচ্ছে এই ক্লাসটা থেকে লেখাপড়া বলতে যেটা বোঝায় সেটা তার জন্য নয়। পুরো সময়টা শান্ত হয়ে বসে থাকাটাই তার জন্য অনেক কিছু।
তাকে ব্যস্ত রাখার জন্য টুনি ফিসফিস করে বলল, “তুমি খাতায় কবিতাটা লিখে ফেলো।”
“লিখব?”
“হ্যাঁ। বসে বসে লিখো।”
ফারাজ বাধ্য ছেলের মতো বই দেখে দেখে কবিতাটা খাতায় লিখতে থাকে। হাতের লেখাটা ছোটো বাচ্চাদের মতো—কিন্তু সে যে লিখতে পারে সেটাই অনেক কিছু।
.
রাতে আম্মু টুনিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোদের ক্লাসে অটিস্টিক ছেলেটা এসেছিল?”
টুনি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ আম্মু, এসেছিল।”
“কেমন দেখলি?”
টুনি একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “বয়সে আমাদের সমান কিন্তু একেবারে ছোটো বাচ্চাদের মতোন।”
“অন্য কোনো সমস্যা?”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী সমস্যা?”
“এই মনে কর মনোযোগ দিতে না পারা, রেগে যাওয়া, অস্থির হয়ে যাওয়া, টিফিন করা, বাথরুম—”
“আজকে প্রথম দিন, সেই জন্য পুরোদিন থাকে নাই। দুই পিরিয়ড পরে তার আব্বু-আম্মু নিয়ে গেছে। সে ভালোই ছিল।”
“কী নাম বাচ্চাটার?”
“ফারাজ।”
আম্মু মুখটা একটু হাসি হাসি করে বললেন, “তোদের ভালোই একটা অভিজ্ঞতা হবে।”
টুনিও হাসল, বলল, “হ্যাঁ আম্মু।”
.
শুধু টুনি না, তাদের ক্লাসের সব ছেলেমেয়েদেরই একটা নতুন অভিজ্ঞতা হতে শুরু করল। প্রথম কয়েকদিন চলে গেল ফারাজ কী কী পারে আর কী কী পারে না সেটা বুঝতে। সেটা বোঝার পর তাদের কাজটা সহজ হয়ে গেল। যেমন বাথরুমে যাওয়ার মতো সহজ কাজটাও ফারাজের জন্য যথেষ্ট জটিল। সে জন্য একেকদিন একেকটা ছেলে তার বাথরুম ডিউটি করার দায়িত্ব নিল। টুনি খুবই অবাক হলো যখন দেখল ছেলেরা খুবই আনন্দের সাথে কাজটা করে যাচ্ছে। শুধু তাই না, ফারাজের বাথরুমে যাওয়ার দরকার না থাকলেও তাদের কেউ কেউ তাকে ঠেলেঠুলে বাথরুমে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
সবাই ধরে নিয়েছিল ফারাজ ধীরে ধীরে সত্যিকারের পড়াশোনা শুরু করে দেবে, রচনা লিখে ফেলবে কিংবা ভগ্নাংশের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করে ফেলবে কিংবা ইংরেজি ট্রান্সলেশন করে ফেলবে কিন্তু কয়েক সপ্তাহ যাবার পর বোঝা গেল সে আসলে এত সহজে ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের সমান হতে পারবে না। তাকে ছোটো ক্লাসে দেওয়া হয়নি, কারণ সেখানে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের ভেতর সে পুরো বেমানান হতো। এই ক্লাসে সবাই তার সমবয়সি, তাই অন্যদের সাথে তার বন্ধুর মতো একটা সম্পর্ক হতে পারে। সেটা মনে হয় হতে শুরু করেছে। তার চোখে-মুখে সেই ভয়াবহ আতঙ্ক আর নেই। ছেলেমেয়েদের অনেকের ওপর সে ভরসা করতে শুরু করেছে।
যেহেতু ক্লাসের অন্যদের সমান পড়াশোনা তাকে করতে হবে না, পরীক্ষা দিয়ে উপরের ক্লাসে উঠতে হবে না, বছর শেষে এমনিতেই তাকে উপরের ক্লাসে নিয়ে যাওয়া হবে, তাই সবাই মিলে ক্লাসে ব্যস্ত রাখার নানা রকম উপায় খুঁজে বের করছে। সে মোটামুটি বুঝতে পারে সবাই তাকে সে রকম বাচ্চাদের বই এনে দিতে লাগল। ক্লাসের শুরুতে তার খাতায় সোজা সোজা যোগ-বিয়োগ অঙ্ক লিখে দিতে লাগল এবং ক্লাসের সময়টাতে ফারাজ সেগুলো করে সময় কাটাতে লাগল।
তবে ফারাজের সত্যিকারের প্রতিভা দেখা গেল ছবি আঁকার বেলায়। ছবির ভেতর অসংখ্য খুঁটিনাটি সে খুবই যত্ন করে আঁকতে পারে। আঁকার জন্য তার প্রিয় বিষয় হচ্ছে জাহাজ। দেখে মনে হয় সেই বিশাল জাহাজের প্রত্যেকটা স্ক্রু পর্যন্ত সে এঁকে রেখেছে। জাহাজের ঘর, ইঞ্জিন, খালাসি, ক্যাপ্টেন, শোয়ার জায়গা, বাথরুম, ডেক, মাস্তুলের উপর সি গাল, লাইফবয়, প্রোপেলার, সার্চলাইট, সমুদ্রের ঢেউ, এমনকি পানির নিচে মাছ, হাঙর, অক্টোপাস কিছুই বাকি থাকে না। জাহাজের একটা ছবি এঁকে শেষ করতে তার কয়েকদিন লেগে যায়। ছবি শেষ হওয়ার পর একেকজন একেকটা ছবি নিয়ে যায়। ফারাজ বেশ খুশি হয়েই তার ছবি উপহার দিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় ক্লাসের সবাই এখন ফারাজকে নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
শুধু ফারাজের ব্যাপারটা নিয়ে সবুজকে একটু অসন্তুষ্ট দেখা গেল—কোনো লেখাপড়া না করে, কোনো পরীক্ষা না দিয়ে একজন যদি উপরের ক্লাসে উঠে যেতে পারে, তাহলে এই অপূর্ব সুযোগটা অন্য কেউ কেন পাবে না? মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে বলে, “আমি কেন অটিস্টিক হলাম না। তাহলে আমাকেও লেখাপড়া করতে হতো না।”
টুনি হাসি গোপন করে বলল, “হতে পারে তুইও আসলে অটিস্টিক, শুধু টের পাচ্ছিস না। হঠাৎ একদিন টের পাবি।”
.
বেশ কয়েক মাস পার হয়ে গেছে। সামনে তাদের বার্ষিক কালচারাল উইক। সে জন্য নোটিশ চলে এসেছে। প্রত্যেক ক্লাসের প্রত্যেক সেকশনের জন্য এক ঘণ্টা করে সময় দেওয়া হয়েছে, অনুষ্ঠানের জন্য আধাঘণ্টা, স্টেজ সাজানোর জন্য আধাঘণ্টা। গতবার মুক্তিযুদ্ধের ওপর করা তাদের অনুষ্ঠানটা খুবই সুন্দর হয়েছিল, কাজেই এবারও তাদের ওপর একটা চাপ রয়েছে, সুন্দর একটা অনুষ্ঠান করতে হবে। কী ধরনের অনুষ্ঠান করা হবে সেটা আলোচনা করার জন্য একটা মিটিং ডাকা হয়েছে। যারা গান, কবিতা, নাচ এসব পারে তাদের সবাই আছে। টুনি এসব পারে না কিন্তু সেও আছে। এ রকম অনুষ্ঠান ম্যানেজ করার জন্য কিছু মানুষ দরকার, টুনি হচ্ছে সে রকম মানুষ।
মিটিংয়ের শুরুতেই মৌটুসি বলল, “তোমরা চাইলে আমি একটা একক সংগীতানুষ্ঠান করতে পারি। তাহলে তোমদের কাউকে কোনো কষ্ট করতে হবে না।”
কেউ. কোনো কথা বলল না, তখন টুনি বলল, “তুমি খুবই সুন্দর গান গাইতে পারো, আমার মনে হয় সেটা খুবই সুন্দর একটা অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু— ক্লাসের ছেলেমেয়েরা একজন আরেকজনের সাথে তুই তুই করে কথা বলে, শুধু মৌটুসির সাথে সবাই তুমি তুমি করে কথা বলে। কেন জানি মৌটুসির সাথে তুই সম্পর্ক এখনও তৈরি হয় নাই।
মৌটুসি চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু কী?”
টুনি বলল, “কিন্তু আমাদের ক্লাসের সবাইকে নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হবে।”
“সবাইকে? যে গান, নাচ, আবৃত্তি পারে না তাকে নিয়েও?”
“হ্যাঁ। যে কিছু পারে না তাকে নিয়েও। আমিও তো কিছু পারি না কিন্তু আমি কি অনুষ্ঠানের সময় থাকি না?”
“ফারাজকে নিয়েও?”
টুনির কী মনে হলো কে জানে, বলল, “হ্যাঁ ফারাজকে নিয়েও।”
মৌটুসি কেমন জানি মুখ বাঁকা করে হাসল, বলল, “ফারাজ কী করবে? নাচবে?”
টুনি বলল, “সবাই মিলে যদি ঠিক করে তাহলে নাচবে। ছেলেরা কি নাচে না?”
মৌটুসির বাঁকা হাসিটা আরেকটু বড়ো এবং আরেকটু বাঁকা হলো, শুধু তাই না, নাক দিয়ে একটা শব্দও বের হলো।
টুনি এই আলাপটা আর লম্বা করতে চাইল না, সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো? আমাদের হাতে বেশি সময় নাই, কী করবি ঠিক করে ফেল।”
রাজু বলল, “হ্যাঁ, হাতে সময় নাই।”
সবুজ কোথা থেকে জানি হঠাৎ করে হাজির হলো, সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “কীসের মিটিং? পরীক্ষা পিছাবি?”
রাজু বলল, “আমাদের কালচারাল উইকের অনুষ্ঠানে কী হবে সেইটা ঠিক করছি।”
“ও!” সবুজ উৎসাহ হারিয়ে চলে যাচ্ছিল, আবার ফিরে এলো। বলল, “আমার জন্য দশ মিনিট আলাদা করে রাখ।”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “তোর জন্য? তুই কী করবি?”
“ব্রেক ড্যান্সিং।”
সালমা বলল, “সেইটা আবার কী?”
সবুজ উৎসাহ নিয়ে বলল, “করে দেখাব?”
সবাই একসাথে বলল, “না-না-না—এখন না।”
সবুজ তখন মনমরা হয়ে বলল, “ঠিক আছে পরে দেখাব। কালচারাল অনুষ্ঠানে তোদের প্যানপ্যানানি নাচ আর গান এখন কেউ আর দেখতে চায় না। এখন হচ্ছে মডার্ন টাইম। র্যাপ সংয়ের সাথে ব্রেক ড্যান্সিং। একেবারে যাকে বলে ফাটাফাটি।”
সবাই চুপ করে রইল তখন সবুজ ঘাড় ঝাঁকিয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গেল।
রাজু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “জ্বালাবে মনে হচ্ছে।”
টুনি বলল, “আমার ওপর ছেড়ে দে।”
রাজু বলল, “আয় তাহলে ঠিক করে ফেলি, কী করব।”
সালমা বলল, “হ্যাঁ। আমার কি মনে হয় জানিস?”
সবাই তার দিকে তাকাল, রাজু জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“স্কুলের সবাই মোটামুটি জানে এই স্কুলের প্রথম অটিস্টিক ছাত্রটা আমাদের ক্লাসে আর আমরা তাকে খুব ভালোভাবে দেখেশুনে রাখছি। এবারে যদি আমাদের অনুষ্ঠানে প্রথমবার তাকে ঠিকভাবে স্টেজে তুলে তাকে দিয়ে কিছু একটা করাতে পারি, সবাই তাহলে অবাক হয়ে যাবে।”
মৌটুসি ছাড়া সবাই মাথা নাড়ল। ফিরোজা বলল, “ঠিক বলেছিস।”
মৌটুসি মুখ শক্ত করে বলল, “ফারাজ এখনও ঠিক করে কথাই বলতে পারে না। সে স্টেজে উঠে কী করবে?”
সালমা বলল, “সেটা ঠিক করতে হবে।”
রাজু বলল, “ফিরোজা একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে পারে, যেখানে ফারাজের একটা অংশ থাকতে পারে। খুব সোজা কয়েকটা ডায়ালগ, তারপর একটা গানের তালে তালে নাচ। সোজা একটা নাচ, যেখানে খালি হেলেদুলে একটু লাফাবে—”
সালমা হাতে কিল দিয়ে বলল, “তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল—খুবই সোজা হবে—একটা ঢোল গলা থেকে ঝুলিয়ে দেবো। ফারাজ ঢোল বাজাবে আর গানের তালে তালে লাফাবে
মৌটুসি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “পারবে?”
টুনি বলল, “পারবে না কেন? আমরা প্রত্যেকদিন রিহার্সাল করব।”
অন্যরা মাথা নাড়ল।
আরও কিছুক্ষণ আলোচনা হলো, গতবার তারা মুক্তিযুদ্ধের ওপর করেছিল, এই বছর তাই অন্যকিছুর ওপর করতে পারলে ভালো। তারপর ফিরোজার ওপরে লেখার দায়িত্ব দিয়ে তাদের মিটিং শেষ করা হলো।
.
ফিরোজা পরের দিনই একটা স্ক্রিপ্ট লিখে আনল। খুবই সুন্দর স্ক্রিপ্ট। একটা ছোটো জেলে পরিবারের কাহিনি। প্রথম দিকে অল্প কয়েকটা চরিত্র, শেষের দিকে শুধু পরিবার নয়, জেলে পল্লির সবাই চলে আসে। ফারাজের জন্য প্রথম দিকেই একটা অংশ। ছোটো একটি মেয়ে আকাশের ঘন কালো মেঘ দেখে দুশ্চিন্তা করছে—তার বাবা নৌকা নিয়ে গহিন দরিয়ায় গিয়েছে—কালবোশেখি ঝড়ে তার কোনো বিপদ হয় কি না। গালে হাত দিয়ে বসে আছে। তখন ফারাজ এসে জিজ্ঞেস করবে, “ওগো ময়না, তুমি কেন মুখ কালো করে বসে আছো?”
ময়না নামের মেয়েটা বলবে, “বাবা গেছে গহিন দরিয়ায় আর আকাশ কালো করে ঝড় আসছে। তাই আমার মনটা ভালো নাই।”
তখন ফারাজ তার দুই নম্বর ডায়ালগটা বলবে, “ময়না, আমি তোমার মনটা ভালো করে দেই?”
ময়না বলবে, “দাও দেখি।”
ঠিক তখন তাকদুম তাকদুম গান শুরু হয়ে যাবে আর ফারাজ গানের তালে তালে ঢোল বাজাতে বাজাতে লাফাতে শুরু করবে। এর মাঝে ভুল হওয়ার জায়গা খুব বেশি নাই।
কাজেই সেই দিন থেকেই ফারাজের রিহার্সাল শুরু হয়ে গেল। সবাইকে বলে দেওয়া হলো যখনই ফারাজকে পাবে তার সাথে ডায়ালগ প্র্যাকটিস করতে হবে। ফারাজও বাধ্য ছেলের মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগল, “ওগো ময়না, তুমি কেন মুখ কালো করে বসে আছো।” কিংবা, “ময়না, আমি তোমার মনটা ভালো করে দেই?”
ক্লাসের কয়েকটা ছেলে কার্ডবোর্ডকে গোল করে ঢোলের মতো তৈরি করে দিয়েছে। সেটাকে দড়ি দিয়ে ফারাজের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। যার গলায় সুর আছে সে রকম কেউ তাকদুম তাকদুম গানটা গায়, তখন ফারাজকে ঢোলে থাবা দিয়ে লাফাতে হয়। সে অবশ্য একা লাফায় না, তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য অনেকেই তার সাথে লাফায়।
এর মাঝে আরও একটি ব্যাপার ঘটল। স্কুলের সময় কারো বাইরে যাওয়ার নিয়ম নাই কিন্তু অনুষ্ঠানের ছোটোখাটো কেনাকাটা করার জন্য স্যারদের অনুমতি নিয়ে তাদের কয়েকজনকে একদিন বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। একসাথে বেশ কয়েকজন যাবে, তখন ফারাজকেও সাথে নেওয়া হলো। ফারাজ মনে হলো ব্যাপারটা যথেষ্ট উপভোগ করল, তবে বাইরে যাওয়া নাকি আইসক্রিম খাওয়া কোনটা বেশি উপভোগ করেছে সেটা বোঝা গেল না। এতদিনে তারা জেনে গেছে ফারাজকে বেশি মিষ্টি জিনিস খেতে দেওয়া হয় না। মিষ্টি জিনিসের চিনি নাকি ফারাজের মতো বাচ্চাদের বেশি উত্তেজিত করে ফেলে। স্টেশনারি দোকান থেকে রঙিন কাগজ, টেপ, আঠা এসব কেনার পর ফারাজকে দাম মিটিয়ে দিতে দেওয়া হলো। সে বেশ ভালোভাবেই ভাংতি টাকা গুনে বুঝে নিল। অনেকদিন থেকেই সবাই ফারাজকে টাকাপয়সার হিসাব বুঝিয়ে আসছে। কখন কী দরকার হয় সেই জন্য ফারাজের আব্বু-আম্মু সবসময় তার পকেটে কিছু টাকা রেখে দেন। আজকে প্রথমবার সে এই টাকা দিয়ে নিজে আইসক্রিম কিনেছে!
যাই হোক, দেখতে দেখতে অনুষ্ঠানের দিন চলে এসেছে। সবার ভেতরে প্রবল উত্তেজনা। অনেকগুলো ক্লাস তার আবার অনেকগুলো সেকশন, প্রত্যেক সেকশনের জন্য আধাঘণ্টা সময়, এর আগে স্টেজ সাজানোর জন্য আরও আধাঘণ্টা। কাজেই টানা দুই দিন বিকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠান হবে। যখন যে ক্লাসের অনুষ্ঠান তখন সেই ক্লাসের ছেলেমেয়েদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন সেটা দেখতে আসতে পারবেন, অন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা তো আছেই। স্কুলের মাঝখানে প্যান্ডেল টানিয়ে স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। বড়ো সামিয়ানা, তার নিচে সারি সারি প্লাস্টিকের চেয়ার। পুরো দুই দিন জায়গাটা গমগম করবে।
টুনিদের ক্লাসের অনুষ্ঠান প্রথম রাতে। তাদের আগে ক্লাস সেভেন সেকশন এ’র ছাত্রছাত্রীদের অনুষ্ঠান। সবাইকে বলা হয়েছে অনুষ্ঠানের দিন সময়মতো চলে আসতে। স্টেজের পেছনে গ্রিনরুম, সেখানে মেকআপ নিতে হবে।
.
অনুষ্ঠানের দিন সবাই সময়মতো চলে এসেছে। ফারাজকে তার আব্বু-আম্মু পৌঁছে দিয়েছেন। সে বিড়বিড় করে তার দুই লাইন ডায়ালগ মুখস্থ বলে যাচ্ছে। অন্যদের তুলনায় সে-ই বরং একটু শান্ত। ফারাজের পোশাক খুব সহজ, তাই তাকে আগেই সেটা পরানো হচ্ছে না। সে তার প্যান্টের উপর একটা লুঙ্গি পরবে, উপরে একটা নীল ফতুয়া, মাথায় একটা লাল গামছা বেঁধে দেওয়া হবে, তার সাথে গলায় একটা বড়ো মাদুলি।
অন্যরা যখন সাজ-পোশাক পরছে তখন ফারাজ তাদের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টুনি তাকে চোখে চোখে রাখছে। সবুজের ব্রেক ড্যান্সটা অনুষ্ঠানে দেওয়া যায় নাই। তাকে বোঝানো হয়েছে দশ মিনিটের ব্রেক ড্যান্স দেখে কারো মন ভরবে না, এটা আরও বেশি সময় ধরে দেখতে হবে। তাই শুধু তার জন্য একক একটি ব্রেক ড্যান্সের ব্যবস্থা করা হবে। তা ছাড়া অনুষ্ঠানের সময় একজন খুবই দায়িত্বশীল ভলান্টিয়ার দরকার, কারণ গোপন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে, ক্লাস এইট সেকশন এ’র কিছু পাজি ছাত্র নাকি তাদের অনুষ্ঠানের সময় ভুয়া ভুয়া করে চিল্লাবে। তাদেরকে সামলানোর জন্য একজন শক্ত ভলান্টিয়ার দরকার—শুধু সবুজই সেটা করতে পারবে। গোপন সূত্রটাই যে আসলে ভুয়া সেটা সবুজকে বলা হয়নি। সে ভলান্টিয়ার চিফ, সেই হিসেবে শার্টের হাতায় একটা টকটকে লাল ফিতার ব্যান্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবুজ সেটা নিয়ে গম্ভীর মুখে একবার গ্রিনরুমের ভেতর এবং বাইরের খবরদারি করছে। গ্রামীণ জেলে পল্লির অনুষ্ঠানের মাঝখানে ব্রেক ড্যান্স থেকে এটা অনেক ভালো।
যাই হোক, ক্লাস সেভেন সেকশন এ’র অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হলো এবং তাদের ছেলেমেয়েরা স্টেজে উঠে যাবার পর গ্রিনরুমটা খালি হয়ে গেল।
রাজু তার চুলে একটু সাদা রং দিয়ে চুলটা কাঁচাপাকা করতে করতে বলল, “এখন ফারাজকে তার পোশাক পরিয়ে দে। আর আধাঘণ্টা পরে আমরা স্টেজ সাজাব, এক ঘণ্টা পরে অনুষ্ঠান শুরু করব।”
সালমা জিজ্ঞেস করল, “ফারাজের লুঙ্গি, ফতুয়া, গামছা কার কাছে?”
একজন ছেলে একটা ব্যাগ নিয়ে বলল, “এই যে আমার কাছে।”
সালমা টুনিকে বলল, “টুনি, তুই ফারাজকে সাজিয়ে দে।”
টুনি বলল, “ঠিক আছে। শুধু লুঙ্গিটা আরেকজনকে পরিয়ে দিতে হবে।
লুঙ্গি কীভাবে পরে আমি জানি না।”
সালমা বলল, “কোমরে পেঁচিয়ে বেল্ট বেঁধে দিবি। এমন কী কঠিন?”
“আবার স্টেজে খুলে না যায়!”
“খুলে গেলেই সমস্যা কী? ভেতরে প্যান্ট আছে না?”
টুনি ব্যাগ খুলে লুঙ্গি বের করে ফারাজকে ডাকল কিন্তু ফারাজকে পাওয়া গেল না। এক সেকেন্ডে টুনির ভুরু কুঁচকে যায়, গ্রিনরুমের ভেতরে ফারাজ নাই। টুনি চাপা গলায় ডাকল, “ফারাজ! ফারাজ!”
কেউ উত্তর দিলো না। হঠাৎ করে সবাই কেমন যেন ভয় পেয়ে যায়।
রাজু বলল, “বাথরুমে গেছে নাকি?”
টুনি বলল, “দেখে আসবি?”
রাজু বলল, “ঠিক আছে।” সে জেলে সর্দারের কাঁচাপাকা চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে বাথরুমে ছুটে গেল। অন্যরা চাপা ভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
রাজু দুই মিনিটের মাথায় ফিরে এলো, শুকনো মুখে বলল, “নাই। বাথরুমে নাই।”
ফিরোজা বলল, “বাইরে গিয়ে দর্শকদের সাথে বসে যায় নাই তো?”
ফারাজ সাধারণত ভিড়ের মাঝে যেতে চায় না, তবুও সবুজ আরও কয়েকজনকে নিয়ে দর্শকদের ভেতরে খুঁজে এলো, তাকে সেখানেও পাওয়া গেল না। সবুজ বলল, “আমরা পুরো স্কুল বিল্ডিং খুঁজে এসেছি, সেখানেও নাই।”
মৌটুসি বলল, “আমাদের অনুষ্ঠানের কী হবে? এত কষ্ট করে গান রেডি করেছি!”
রাজু বলল, “অনুষ্ঠানের কথা ভুলে যা—ফারাজকে পাওয়া না গেলে কী সর্বনাশ হবে টের পাচ্ছিস?”
সালমা বলল, “স্যার-ম্যাডামদের বলতে হবে।”
রাজু বলল, “সবাই আমাদের ওপর ভরসা করে ফারাজকে দেখেশুনে রাখতে দিয়েছে আর ফারাজ হারিয়ে গেল? কী সর্বনাশ!”
মৌটুসি বলল, “পুলিশকে খবর দিতে হবে।”
ফিরোজা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। সবাই আস্তে আস্তে টুনির দিকে তাকাল। সালমা চাপা গলায় বলল, “এখন কী করব টুনি?”
টুনি তার চশমাটা খুলে টি-শার্টের তলাটা দিয়ে সেটাকে মুছল, যদিও তার কোনো দরকার ছিল না। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সবার বাবা-মা এসেছে, তাদের মন খারাপ করানোর দরকার নাই। ফারাজকে যদি শেষ পর্যন্ত পাওয়া না যায় তাহলে আরেকটা ছেলেকে রেডি করে রাখ। সে স্টেজে যাবে। ঠিক ডায়ালগেরও দরকার নাই—গানের সাথে ঢোলে বাড়ি দিয়ে একটু লাফিয়ে আসবে আর আমি ফারাজকে একটু খুঁজে আসি।”
সবাই কেমন জানি আশা নিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। ফিরোজা বলল, “তুই খুঁজে পাবি?”
টুনি বলল, “জানি না, কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে।”
টুনি তার চশমাটা চোখে দিয়ে গ্রিনরুম থেকে বের হতে গিয়ে থেমে সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল, “সবুজ, তুই আমার সাথে আয়।”
সবুজ বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ। তোর তো স্টেজে কোনো পার্ট নাই। ভলান্টিয়ারের কাজ অন্য কেউ
করতে পারবে।”
“ঠিক আছে।”
দুইজন গ্রিনরুম থেকে বের হওয়ার পর সবুজ জিজ্ঞেস করল, “ফারাজকে কোনখানে খুঁজবি?”
টুনি বলল, “আমরা তো স্কুলের ভেতরে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“তার মানে সে স্কুল থেকে বের হয়ে গেছে।”
“বের হয়ে গেছে!” সবুজ অবাক হয়ে বলল, “একা?”
“ফারাজ একটা বাচ্চা ছেলের মতো। এত অবাক হচ্ছিস কেন?” “এখন বাইরে কোথায় খুঁজবি? ঢাকা শহরে দুই কোটি মানুষ।”
“ফারাজ হেঁটে বের হয়েছে, বেশি দূর যেতে পারবে না। নিশ্চয়ই আশেপাশে আছে। আমাকে দুই কোটি মানুষের মাঝে খুঁজতে হবে না, আশেপাশে খুঁজলেই হবে।”
সবুজ মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “তা ঠিক।” একটু হেঁটেই সে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু সে হঠাৎ করে বের হলো কেন? আগে তো কখনো বের হয় নাই।”
টুনি বলল, “ভেবে দেখ—হঠাৎ করে কেন হতে পারে?”
সবুজ ভাবার চেষ্টা করল কিন্তু বিষয়টা তার জন্য কঠিন। মাথা চুলকে বলল, “না মাথায় কিছু আসছে না।”
“ফারাজ কি নূতন কিছু করতে শিখেছে?”
“আমি কেমন করে বলব?”
টুনি বলল, “সে এখন টাকা দিয়ে জিনিস কিনতে শিখেছে। তাই আমার ধারণা সে কিছু একটা কিনতে গেছে।”
“কী কিনবে ফারাজ? তার আবার কী দরকার?”
“আইসক্রিম। আমার ধারণা আইসক্রিম কিনতে গেছে। তাকে বাসায় বেশি আইসক্রিম খেতে দেয় না, সেই জন্য।”
সবুজ মাথা নাড়ল, “ঠিকই বলেছিস। তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। রাত্রে ঘুমাস কেমন করে?”
টুনি কোনো উত্তর দিলো না, মাথায় বুদ্ধি থাকলে একজনের রাত্রে ঘুমাতে সমস্যা হয় এ রকম কথা সে জন্মেও শুনে নাই।
স্কুলের গেট থেকে বের হওয়ার সময় টুনি দারোয়ান ভাইকে জিজ্ঞেস করল সে ফারাজকে বের হতে দেখেছে কি না। দারোয়ান বলল, আজকে সারাদিন বাবা-মা, ছেলেমেয়েরা আসছে-যাচ্ছে তাই সে আলাদা করে কাউকে লক্ষ করছে না। টুনি আর সবুজ যে স্কুল থেকে বের হয়ে যাচ্ছে সেটা নিয়েও তাদের কিছু বলল না।
তাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই, টুনি আর সবুজ তাই খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে হেঁটে আইসক্রিমের দোকানটাতে চলে এলো, এর আগে তারা এটা থেকেই আইসক্রিম কিনেছে, তাই ফারাজ নিশ্চয়ই এটাতেই আসবে। সেখানে ফারাজ নেই, অন্য মানুষেরা অন্য কিছু কেনাকাটা করছে।
টুনি আর সবুজের আশাভঙ্গ হলো। সবুজ গলা উঁচিয়ে দোকানের মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, এখানে কি কোনো ছেলে আইসক্রিম কিনতে এসেছিল?”
মানুষটা বলল, “সারাদিন কতজনই তো আইসক্রিম কিনতে আসে।”
সবুজ বলল, “না, মানে কিছুক্ষণের মাঝে। একটু অন্য রকম ছেলে—”
দোকানের মানুষটা ভুরু কুঁচকে বলল, “অন্য রকম? সেইটা মানে কী?”
টুনি ব্যাখ্যা করল, “মানে, বাচ্চাদের মতো কথা বলে
পাশে আরেকজন মানুষ দোকানের অন্য জিনিস বিক্রি করছিল, সে বলল, “হ্যাঁ, এই ঘণ্টা-আধাঘণ্টা আগে একটা ছেলে একটা ভ্যানিলা আইসক্রিম কিনে নিয়ে গেছে। দাম দিতে গিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে।”
সবুজ প্রায় চিৎকার করে বলল, “ফারাজ! পাওয়া গেছে।” মানুষটাকে ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন দিকে গেছে? কোন দিকে?”
মানুষটা ঠোঁট ওল্টাল, বলল, “কবে কেডা! কোন দিকে গেছে তো খেয়াল করি নাই।”
টুনি চিন্তিত মুখে বলল, “আধাঘণ্টা হলে তো এতক্ষণে ফিরে যাওয়ার কথা।”
দুইজন দোকান থেকে বের হয়ে এদিক-সেদিক তাকাল, ফারাজকে দেখা গেল না। সবুজ টুনিকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করবি?” সে ধরেই নিয়েছে টুনি চিন্তা করে বের করে ফেলবে এখন কোথায় খুঁজলে ফারাজকে পাওয়া যাবে।
টুনি কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, “সেইদিন আমরা যখন এসেছিলাম তখন পাশের মার্কেটটাতে ঢুকে স্টেশনারি দোকান থেকে রঙিন কাগজ, বোর্ড, আঠা এইসব কিনেছিলাম। ফারাজ এখানে ঢুকতে পারে।”
সবুজ বলল, “কেন? এইখানে কেন ঢুকবে?”
“হতে পারে সে ভুলে গেছে যে ফিরে যেতে হবে, কিংবা মনে করেছে এদিক দিয়েই ফিরে যেতে হবে। ভুলে যাচ্ছিস কেন তার ব্রেনটা অন্য রকম।”
সবুজ মাথা নাড়ল, তারপর দুইজন পাশের মার্কেটের ভেতর ঢুকল। চোখ খোলা রেখে চারিদিক তাকাতে তাকাতে দুইজন ফারাজকে খুঁজতে খুঁজতে মার্কেটের ভেতর ঢুকে। স্টেশনারি দোকানটাতেও গেল, দোকানের মানুষটাকেও জিজ্ঞেস করল, তাদের বয়সি কোনো ছেলে এসেছিল কি না। কিন্তু লাভ হলো না। দুজন যখন আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন হঠাৎ টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “ওই কোনায় একটা টেলিভিশনের দোকান না?”
সবুজ মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ।”
টুনি বলল, “নিশ্চয়ই ওখানে আছে।” “তুই কীভাবে জানিস?”
“অটিস্টিক বাচ্চাদের টেলিভিশন, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন এসব একেবারে নিষেধ। কোনো ছোটো বাচ্চার ভেতরে অটিজমের লক্ষণ দেখা গেলেই তাদের টেলিভিশন দেখা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফারাজ নিশ্চয়ই ওই টেলিভিশনের দোকানে দাঁড়িয়ে টেলিভিশন দেখছে। আয়—আয়—যাই।”
দুজনে প্রায় দৌড়ে গেল এবং দূর থেকেই দেখল ফারাজ দোকানের বাইরে মেঝেতে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে গভীর মনোযোগ দিয়ে টেলিভিশন দেখছে। টেলিভিশনে রাক্ষসের মতো বিশাল বিশাল দুইজন মানুষ দাবড়াদাবড়ি করে কুস্তি করছে। এর চাইতে কুৎসিত কোনো দৃশ্য হওয়া সম্ভব না।
সবুজ দৌড়ে ফারাজের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে টান দিয়ে দাঁড়া করানোর চেষ্টা করে বলল, “ফারাজ! তুই এখানে? তোকে খুঁজে খুঁজে আমরা হয়রান। চল, চল, তোর নাচ আছে।”
ফারাজ ঝাটকা মেরে সবুজের হাত থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে বলল, “না। আমি যাব না।” সে আবার টেলিভিশনের দিকে তাকাল এবং রাক্ষসের মতো মানুষ দুটির কুস্তি দেখে তার মুখে অদ্ভুত আনন্দের একটা হাসি ফুটে উঠল। গাঁজা খেয়ে নেশা করলে মানুষ মনে হয় এভাবে হাসে।
টুনিও এতক্ষণে চলে এসেছে, সে ফারাজের পাশে বসল, তারপর বলল, “ফারাজ।”
ফারাজ টুনির দিকে তাকাল না, বলল, “উঁ।”
‘তোমার মনে আছে, আজকে তোমার নাটকে ডায়ালগ বলতে হবে আর তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল গানের সাথে নাচতে হবে?”
টেলিভিশনের স্ক্রিনে রাক্ষসের মতো একজন রাক্ষসের মতো আরেকজনকে উপরে তুলে ছুড়ে ফেলল এবং সেটা দেখে ফারাজ আনন্দে হেসে ফেলল, টুনির কথার উত্তর দিলো না, তার কথা শুনতে পেয়েছে বলেও মনে হলো না।
টুনি বলল, “সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। চলো।”
সবুজ বলল, “তোর আব্বু-আম্মুও আছেন।”
টুনি বলল, “আর দেরি করা যাবে না। এক্ষুনি যেতে হবে।”
ফারাজ ওঠার কোনো লক্ষণই দেখাল না, নেশাগ্রস্তের মতো টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। সবুজ আবার ফারাজকে ধরে তোলার চেষ্টা করল। ফারাজ উঠল না, উল্টো কেমন জানি গোঙানোর মতো শব্দ করল। ক্লাসের সবাই ফারাজকে হাসি-খুশি-শান্ত স্বভাবের দেখে এসেছে, তার এই রূপটা কেউ কখনো দেখেনি।
সবুজ হতাশ হয়ে বলল, “স্কুলে গিয়ে ফারাজের আব্বু-আম্মুকে ডেকে আনি। আমাদের অনুষ্ঠানের বারোটা বাজল।”
টুনি কী যেন একটা ভাবল, তারপর বলল, “দাঁড়া। আমি শেষ চেষ্টা করে দেখি।”
টুনি টেলিভিশনের দোকানে ঢুকে গেল। দোকানের মানুষ একজন কাস্টমারের সাথে কথা বলছে আরেকজন কী একটা কাগজ দেখছিল। মাথা তুলে টুনিকে একনজর দেখে আবার কাগজের দিকে চোখ ফেরাল। ধরেই নিয়েছে আর যাই হোক টুনির মতো বাচ্চা একটা মেয়ে নিশ্চয়ই টেলিভিশন কিনতে আসে নাই।
টুনি মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আঙ্কেল—” টুনি আগেও দেখেছে বাংলায় চাচা-মামা বলার থেকে ইংরেজিতে আঙ্কেল বললে দোকানের মানুষ বেশি খুশি হয়।
মানুষটা চোখ তুলে টুনির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”
“আঙ্কেল আমরা খুব বিপদে পড়েছি। একটু সাহায্য করবেন?”
বিপদের কথা শুনে দুইজন মানুষই একসাথে ভুরু কুঁচকে বলল। একজন বলল, “কী বিপদ?”
টুনি হাত তুলে বাইরে বসে থাকা ফারাজকে দেখিয়ে বলল, “ওই ছেলেটা আমাদের ক্লাসে পড়ে, স্কুল থেকে বের হয়ে সে এখানে এসে বসে আছে। টেলিভিশন দেখছে, এখন সে কিছুতেই উঠছে না। তাকে এক্ষুনি স্কুলে যেতে হবে, স্কুলের অনুষ্ঠানে তার পার্ট আছে।”
দুজন মানুষই টুনির কথা শুনে একটু অবাক হলো, একজন বলল, “ওকে বলো যেতে।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “লাভ নাই। ছেলেটা অটিস্টিক। কথা শুনছে না। আপনারা যদি একটু সাহায্য করেন।”
“কীভাবে সাহায্য করব?”
“যদি টেলিভিশনটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেন।”
মানুষ দুইজন একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। তারপর একজন কোথায় গিয়ে কী একটা সুইচ টিপে দিলো তখন একসাথে সব টেলিভিশন বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে ফারাজ কেমন জানি চমকে উঠল, তার মুখটা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কী জানি একটা বলল, টুনি শুনতে পেল না।
টুনি দরজা খুলে বাইরে যায়, ফারাজ তার দিকে তাকাল, বলল, “টেলিভিশন বন্ধ কেন?
টুনি বলল, “দোকানের টেলিভিশন। বন্ধ হয়ে গেছে। এখন স্কুলে চলো।”
“না, যাব না। টেলিভিশন দেখব।”
“টেলিভিশন শেষ। আর চলবে না।”
“চলবে।”
দোকান থেকে একজন মানুষ বের হয়ে অবাক হয়ে ফারাজের দিকে তাকাল। টুনি বলল, “ওই যে ফারাজ উনাকে জিজ্ঞেস করে দেখো। টেলিভিশন বন্ধ।”
মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, টেলিভিশন বন্ধ। আর চলবে না। স্কুলে যাও।”
সবুজ আবার হাত ধরে টানল, ফারাজ এবারে খুব অনিচ্ছার সাথে উঠে দাঁড়াল, বলল, “শেষ? বন্ধ?”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, শেষ। বন্ধ।
টুনি বলল, “চলো স্কুলে চলো। তাড়াতাড়ি, এখনও গেলে তুমি তোমার পার্টটা করতে পারবে। মনে নাই? তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল?”
ফারাজের মনে পড়ল, সে একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, “তাকদুম তাকদুম—”
সবুজ তাড়া দিলো, বলল, “চলো, চলো—”
ফারাজ শেষ পর্যন্ত হাঁটা শুরু করল। টুনি ফারাজের সাথে তাদের অনুষ্ঠানের কথা বলতে থাকে, ফারাজের তখন আস্তে আস্তে সবকিছু মনে পড়ে যায়। তখন সে তার ডায়ালগ দুইটাও বিড়বিড় করে বলতে থাকে।
তিনজন মিলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হেঁটে যেতে থাকে। সবুজ বলল, “আমি দৌড়ে গিয়ে সবাইকে বলব ফারাজকে পাওয়া গেছে, সবাই রেডি হয়ে যাক?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “না, তুই থাক। তুই না থাকলে আমি নার্ভাস হয়ে যাব।”
সবুজের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল, এই প্রথম কেউ একজন তাকে বলেছে যে সে খুবই প্রয়োজনীয় মানুষ, তাকে ছাড়া চলবে না।
তিনজন হাঁটতে হাঁটতে ঘড়ি দেখতে থাকে। এভাবে বাকি পথটা হেঁটে যেতে পারলে তারা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে পৌঁছাতে পারবে। ফারাজকে খুব তাড়াতাড়ি তার পোশাক পরাতে হবে।
স্কুল গেটের ভেতর দিয়ে ঢোকার পর টুনি সবুজকে বলল, “সবুজ, এখন তুই দৌড়ে যা, সবাইকে বল আমরা ফারাজকে নিয়ে আসছি, সবাই যেন রেডি থাকে, দুই মিনিটের মাঝে ফারাজকে তার পোশাক পরাতে হবে।”
“ঠিক আছে।” বলে সবুজ দৌড়ে গেল, প্যান্ডেলের পেছনে গ্রিনরুমে সবাই মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেক কষ্টে একজন ছেলেকে ফারাজের জায়গায় অভিনয় করতে রাজি করানো হয়েছে। সে ফারাজের পোশাক পরে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অন্যরাও এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন পরিবারের কেউ মারা গেছে। সবুজ দৌড়ে ভেতরে ঢুকে চিৎকার করে বলল, “ফারাজকে পাওয়া গেছে! টুনি নিয়ে আসছে!”
আনন্দের একটা চিৎকার শোনা গেল। এক মুহূর্তে সবার মনমরা ভাব দূর হয়ে গেল। সবাই খুশিতে ছোটাছুটি শুরু করল। যে ছেলেটা ফারাজের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে ছিল সে এক সেকেন্ডে তার সবকিছু খুলে ফেলেছে। সালমা বলল, “সবাই রেডি থাক, ফারাজ আসামাত্র তাকে পোশাক পরাতে হবে—একেকজন একেকটা পরিয়ে দিবি।
শেষ পর্যন্ত টুনি যখন ঢুকেছে তখন একেকজন ফারাজের একেকটা কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আবার আনন্দের একটা চিৎকার করল, তারপর সবাই একসাথে ফারাজের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
একজন তার প্যান্টের উপর লুঙ্গিটা পরিয়ে দিলো, আরেকজন লুঙ্গির উপরে বেল্ট পরিয়ে দিলো। যখন একজন তাকে লুঙ্গি পরাচ্ছে তখন আরেকজন তার শার্টটা খুলে ফেলেছে—আরেকজন সাথে সাথে ফতুয়াটা পরিয়ে দিলো। আরেকজন মাদুলিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সে ঝপ করে সেটা মাথা দিয়ে গলিয়ে দিলো। তখন একজন তাকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে মাটিতে বসিয়ে দিয়ে টেনে জুতা খুলতে শুরু করেছে। যখন একজন জুতা খুলছে তখন আরেকজন ফারাজের মাথায় গামছা বেঁধে দিলো। দুইজন দুটো ঘুঙুরের গোছা বেঁধে দিলো—এটা একটা নূতন কায়দা, কীভাবে ঘটে গেল কেউ জানে না। কয়েকজন মিলে যখন ফারাজকে টেনে দাঁড়া করাচ্ছে তখন একজন তার ঢোলটা মাথা দিয়ে গলিয়ে ঝুলিয়ে দিলো।
পুরো সময়টা ফারাজ ধৈর্য ধরে সহ্য করেছে কিন্তু একজন যখন পাউডার পাফের মাঝে পাউডার লাগিয়ে তার মুখে লাগানোর চেষ্টা করল, সে তার মাথা সরিয়ে নিল। কিছুতেই পাউডার লাগাতে দিলো না। কেন কে জানে!
ঠিক তখন মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, “এখন ক্লাস সেভেন সেকশন বি তাদের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে যাচ্ছে। তাদের উপস্থাপনা হচ্ছে জেলে পল্লিতে একদিন।”
সাথে সাথে স্টেজের স্ক্রিনটা খুলে গেল, বাতি জ্বলে উঠল এবং দেখা গেল স্টেজে একটা জেলে পল্লি, এক কোনায় একটি মেয়ে বসে জাল বুনছে। তার বাবা স্টেজে ঢুকল, মেয়ের সাথে একটু কথা বলল। বাবা নৌকা করে মাছ ধরতে যাবে, আবহাওয়া খুবই খারাপ সে জন্য মেয়ে বাবাকে যেতে দিতে চাচ্ছে না, কিন্তু বাবাকে যেতেই হবে। বাবা চলে যাওয়ার পর মেয়ের মন খারাপ, বসে বসে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। তখন মেয়েটা একাকী বিষণ্ন মুখে বসে আছে। টুনি তখন ফারাজকে ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “যাও, স্টেজে যাও, ডায়ালগ বলো।”
ফারাজ ঢোল নিয়ে পায়ে ঘুঙুরের ঝুনঝুন শব্দ করতে করতে স্টেজে ঢুকল। স্টেজে দাঁড়িয়ে উপর থেকে ঝোলানো তীব্র আলোতে তার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সে চোখ পিটপিট করে সামনে তাকাল, অসংখ্য দর্শক বসে আছে—হঠাৎ সে একটু ভয় পেয়ে স্টেজ ছেড়ে ভেতরে চলে আসতে চাইল। টুনি চাপা গলায় বলল, “ডায়ালগ! ডায়ালগ!”
ফারাজের হঠাৎ তার ডায়ালগের কথা মনে পড়ল। সে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল, “ওগো ময়না, তুমি কেন মুখ কালো করে বসে আছো?”
ময়না বলল, “বাবা গেছে গহিন দরিয়ায়, আর আকাশ কালো করে ঝড় আসছে। তাই আমার মনটা ভালো নাই।
ফারাজের এবারে ভুল হলো না, হাত-পা নেড়ে রীতিমতো সত্যিকার অভিনয় করে বলল, “ময়না, আমি তোমার মনটা ভালো করে দেই?”
ময়না বলল, “দাও দেখি!”
মৌটুসি তার দল নিয়ে রেডি ছিল, সাথে সাথে তারা শুরু করে দিলো, “তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল…”
সাথে সাথে ফারাজ তার ঢোলে চাটি দিয়ে নাচা শুরু করল। সে কী নাচ! লাফিয়ে-কুঁদিয়ে-ঝাঁপিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে ঘুরে ঘুরে নাচ।
দর্শকদের এক সেকেন্ড লাগল বুঝতে কী হচ্ছে, যখন বুঝল তখন প্ৰচণ্ড হাততালি। সে কী হাততালি, কান ফেটে যাবার অবস্থা। শুধু হাততালি নয়, তার সাথে চিৎকার।
ফারাজও উৎসাহ পেয়ে গেল, রিহার্সেলে যে রকম করেছিল তার থেকে একশগুণ বেশি উৎসাহ নিয়ে সে পুরো স্টেজে লাফাতে লাগল। স্ক্রিপ্টে ছিল না, কিন্তু ময়নাও চুপচাপ বসে থাকল না, উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে শরীর দুলিয়ে সেও ফারাজের সাথে নাচতে লাগল। শুধু তা-ই না, গানটা শেষ হবার পরও মৌটুসির দল থেমে গেল না—তারা গাইতেই থাকল।
সবাই বুঝে গেল এখন আর কোনো ভয় নেই, সবাই উৎসাহ পেয়ে গেছে।
আধাঘণ্টার অনুষ্ঠান শেষ হতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেগে গেল কিন্তু দর্শক কিংবা আয়োজক কেউ সেটা নিয়ে কিছু মনে করল না।
শেষ পর্যন্ত যখন পর্দা নেমে এলো তখন দর্শকদের হাততালি আর থামে না। টুনি স্টেজের ভেতর এসে সবার সাথে একটু জাপ্টাজাপ্টি করে হঠাৎ হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “এক সেকেন্ড! এক সেকেন্ড! খুবই জরুরি একটা কথা। খুবই জরুরি।”
সবাই চেঁচামেচি থামিয়ে টুনির দিকে তাকাল। রাজু জিজ্ঞেস করল, “কী জরুরি কথা?”
টুনি চাপা গলায় বলল, “ফারাজ যে হারিয়ে গিয়েছিল সেটা যেন আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ না জানে।”
সবুজ একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন? কী হবে জানলে?” ফারাজকে খুঁজে বের করার কাহিনিটা সবাইকে বাড়িয়েচাড়িয়ে কীভাবে বলবে সে তার জন্য রেডি হচ্ছিল।
টুনি বলল, “তাহলে আমাদের ওপর কেউ ভরসা করতে পারবে না। ঠিক আছে?”
সবাই বলল, “ঠিক আছে।”
ভাগ্যিস টুনি সবাইকে বলে দিয়েছিল কারণ ঠিক তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম আর নার্গিস ম্যাডামের সাথে ফারাজের বাবা-মা এসে ঢুকলেন।
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “ক্লাস সেভেন সেকশন বি?”
ছেলেমেয়েরা একসাথে বলল, “জি ম্যাডাম।”
প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বললেন, “আমি আমার ডিসিশান নিতে ভুল করিনি। ফারাজকে অনেক ভরসা করে তোমাদের ক্লাসে দিয়েছিলাম। তোমরা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছো। শুধু যে সবসময় তাকে চোখে চোখে রেখেছো তা নয়, ফারাজকে চমৎকারভাবে গ্রহণ করেছো, এমনকি যেটা প্রায় অবিশ্বাস্য, তাকে দিয়ে স্টেজে পারফরম্যান্স পর্যন্ত করিয়েছো।”
মৌটুসি বলল, “আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম এবারের ফাংশানে তাকে দিয়ে পারফর্ম করাব।”
সবুজ বলল, “কাজটা সহজ ছিল না—অনেক ঝামেলা হয়েছে।”
রাজু সবুজের পেটে চিমটি কাটল তাই সবুজ ঝামেলা আর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল না।
ফারাজের মা সারাক্ষণ তার শাড়ির আঁচলটা মুখে চেপে রেখেছিলেন। এবার সেটা সরিয়ে ভাঙা গলায় বললেন, “দেখো বাবারা আর মায়েরা, আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার ফারাজ কখনোই অন্য দশটা ছেলেমেয়ের মতো স্বাভাবিক একটা জীবন পাবে না। কিন্তু তোমরা সবাই মিলে তাকে একটা পরিপূর্ণ জীবন দিয়েছো, আমি তোমাদের কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না।”
ফারাজ একটু অবাক হয়ে বলল, “আম্মু, তুমি কাঁদছো কেন? আমি অনেক ভালো নেচেছি।” সে সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নাচি নাই?”
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ ফারাজ। একেবারে অসাধারণ।”
ফারাজের মা আঁচল দিয়ে আবার তার চোখ মুছলেন। চোখে পানি থাকলেও তার মুখে হাসি।
***
