Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    বীর শ্রেষ্ঠ – জাহানারা ইমাম

    জাহানারা ইমাম এক পাতা গল্প61 Mins Read0

    আমি চাই এমন মানুষ

    ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ

    পরনে লুঙি, গায়ে গেঞ্জি, মাথায় বাঁধা লাল গামছা, পায়ে ক্যানভাসের জুতো—এই হলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।

    ৭নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার।

    পাকিস্তানের ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ান থেকে পালিয়ে-আসা এই ২৩-২৪ বছরের কচি চেহারার তরুণটিকে দেখে মেহেদীপুরের মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের লোকেরা প্রথমে ভাবতেই পারেননি কী কঠিন ইস্পাতে তৈরী ছেলেটি! কিন্তু কিছুদিন যেতে-না-যেতেই সবাই টের পেলেন— তাঁর কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, নিরলস কর্তব্যপরায়ণতা এবং ক্লান্তিহীন অধ্যবসায় তাঁর অল্প বয়স আর বাচ্চা-বাচ্চা চেহারাটাকে অতিক্রম করে তাঁকে পরিণত করেছে এক প্রবল ব্যক্তিত্বে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নামে সবাই একডাকে খাড়া হয়ে ওঠেন I

    ৭নং সেক্টরের কমান্ডার লে. ক. নুরুজ্জামানের সঙ্গে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর যখন ভারতীয় জেনারেলদের সঙ্গে মিটিঙে যেতেন, তখনও তাঁর পরনে থাকত এই একই পোশাক—লুঙি, গেঞ্জি, গামছা। বয়স ছিল এত কম— দেখতে লাগত আরো বাচ্চা— কিন্তু প্রবল ব্যক্তিত্ব, অটুট গাম্ভীর্য, প্রখর চিন্তাধারা ও সুস্পষ্ট মতামতের জন্য তাঁর চেয়ে দ্বিগুণবয়সী লোকেরাও তাঁকে যথেষ্ট সমীহ এবং মনে মনে ভয়ও করতেন। ভারতীয় জেনারেলদের, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর সম্বন্ধে খুবই উচ্চ ধারণা ছিল। তাঁরা তাঁর মতামতের দামও দিতেন যথেষ্ট। লে. ক. নুরুজ্জামানকে তাঁরা বলেছিলেন, ‘এ-রকম অপূর্ব মানুষ আমরা খুব কম দেখেছি। কারো সঙ্গে মেলে না, এ একেবারে অন্যরকম, অসাধারণ।’

    ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাঁর সাব-সেক্টরের প্রধান ছিলেন। তাঁর অধীনে যে ছোটছোট সাব-সেক্টর ছিল, সেগুলোর কার্যকলাপের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা তাঁর দায়িত্ব ছিল। মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লোক এসে যোগ দিয়েছিলেন— সাবেক ইপিআর, পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রভৃতি থেকে পালিয়ে-আসা লোকজন, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, মজুর, চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ী। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আগত বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন মানসিকতার লোকগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে, বিভিন্ন ধরনের অ্যাকশনে, অপারেশনে পাঠানো, সেই দুঃসহ পরিবেশে সবাইকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে রেখেও, সুখী রাখা সোজা ব্যাপার ছিল না। কিন্তু স্বল্পবাক, গম্ভীর প্রকৃতির ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এই অসাধ্য-সাধন করেছিলেন অবলীলায়। এমনই তাঁর সুনাম ছিল যে, সেক্টর কমান্ডার লে. ক. নুরুজ্জামান — রক্তগরম, মাথা-গরম মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠিয়ে দিতেন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের ক্যাম্পে—যাতে সৈনিক জীবনের শৃঙ্খলা ও কষ্টসহিষ্ণুতা শিখতে তাদের দেরি না লাগে।

    ২নং সেক্টর থেকে আগত সতের বছরের টগবগে, রক্তগরম মুক্তিযোদ্ধা নাদিম, কাঁধ লম্বা চুল নিয়ে ৭নং সেক্টরে এসে যোগ দেন। সে-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের লম্বা চুল-দাড়ি-জুলপি রাখাটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তবু ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর যখন তাকে হুকুম করলেন যে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার লম্বা চুল কেটে ছোট করে ফেলতে হবে, তখন সেই ‘একরোখা মুক্তিযোদ্ধাও জাহাঙ্গীরের প্রবল ব্যক্তিত্বের কাছে নতি স্বীকার করে চুল কেটে ফেললেন। কেবল তাই নয়, পরে নাদিম ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সাদাসিধে জীবনযাপন, মুক্তিযুদ্ধের কারণে নিবেদিতপ্রাণ কর্মতৎপরতা, অসাধারণ কষ্ট-সহিষ্ণুতা এবং অসমসাহসিকতা দেখে এমনই মুগ্ধ হন যে, পরে যখন তিনি তাঁর বাবা লে. ক. নুরুজ্জামান এবং মা সুলতানা জামানের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর সম্বন্ধে বলেন, ‘ইনি এক অবিশ্বাস্য চরিত্র। এমনটি আমি আর কোথাও দেখিনি। এর নিজের বলতে কি কোনো জিনিস থাকতে নেই?

    .

    সত্যি, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের নিজের বলতে কোনো জিনিসই ছিল না। যে প্যান্ট-সার্ট বা অন্যান্য কাপড়চোপড় পরে এসেছিলেন, সেগুলো পর্যন্ত চারপাশের অভাবী লোকজনদের দিয়ে দিয়েছিলেন।

    মুক্তিবাহিনীতে বেশির ভাগই দরিদ্র ও হৃতসর্বস্ব মানুষ এসেছিলেন। দু-চারজন মুক্তিযোদ্ধার হয়তো দামি প্যান্ট-সার্ট ছিল। অন্যদের যাতে মনে কষ্ট না হয়, সে কারণে তিনি সকলের জন্য একরকম পোশাকের নিয়ম প্রবর্তন করেছিলেন— লুঙি, গেঞ্জি, লাল গামছা আর ক্যানভাসের জুতো। যুদ্ধের খবর শোনার জন্য একটি রেডিও, আর অন্ধকার রাত্রের অত্যাবশ্যকীয় সঙ্গী একটি টর্চ। এ-ছাড়া আর কোনো শখের বা দরকারের জিনিস বলতে তাঁর কিছুই ছিল না। একজন যুদ্ধরত সৈনিকের এর বেশি কিছু লাগে না। লাগা উচিতও নয়—এই ছিল তাঁর অভিমত।

    রেডিওর গান শুনে সময় নষ্ট করারও বিপক্ষে ছিলেন তিনি। একবার কয়েকটি মুক্তিযোদ্ধা ছেলে অবসরে বসে রেডিওর গান শুনে কিছু আনন্দ-কোলাহলে মগ্ন ছিলেন, তাই দেখে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ক্রুদ্ধ হয়ে রেডিও ভেঙে ফেলেন এবং ছেলেগুলিকে তিরস্কার করে বলেন, ‘গ্রাম পুড়ছে, মানুষ মরছে, মেয়েদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, আর তোমরা গান শুনে ফুর্তি করছ? রেডিও শুধু খবর শোনার জন্য। খবর শুনবে, তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে কালকে কোথায় যুদ্ধ করতে যাবে, কীভাবে যুদ্ধ করবে, আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা কী হবে।’

    যুদ্ধ, অ্যাকশন, অপারেশন— এ ছাড়া আর কিছু যেন তাঁর চিন্তায় থাকত না।

    তাঁর অধীনে অনেক অ্যাকশন-গ্রুপ থাকত যারা ব্রিজ উড়াত, রেললাইন ভাঙত, থানা দখল করত। সবরকম অ্যাকশন-অপারেশনের পরিকল্পনা জাহাঙ্গীর করতেন, নিজেও সবসময় অপারেশনে যেতেন। মজা এই যে, প্রত্যেকটি অ্যাকশন-গ্রুপই চাইত জাহাঙ্গীর তাঁদের দলে থাকুক। শারীরিকভাবে যতগুলি দলের সঙ্গে সম্ভব, জাহাঙ্গীর যেতেন এবং সর্বদাই সামনে থাকতেন। অন্য সময় তিনি বাংকারে থাকা পছন্দ করতেন। টেন্টে যেতেন না।

    মুক্তিযোদ্ধা নাদিম তাঁর মাকে বলেছিলেন, ‘এ-রকম সাহসী আমি আর কাউকে দেখিনি। জীবনের মায়া একদম নেই।’

    জাহাঙ্গীর যেন সদাই কী এক ধ্যানে থাকতেন— যুদ্ধের ধ্যান, শত্রুহননের ধ্যান, দেশের মাটিকে মুক্ত করার ধ্যান।

    বরিশালের এক সুদূর গ্রামে তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোনের কথাও নিশ্চয় তাঁর মনে পড়ত। বড় আদরের ছোট বোনটির একটি ফটো ছিল তাঁর মানি-ব্যাগে। হয়তো সেই কিশোরী বোনটির নিরাপত্তার কথা ভেবেই, যুদ্ধ করে শত্রুকে পরাজিত করার চিন্তা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা তাঁর মনে স্থান পেত না। হয়তো, তরুণবয়স্ক ছোট ভাই দুটোর নিরাপত্তার চিন্তাও তাঁর ধ্যানে থাকত। হয়তো বৃদ্ধ বাবা-মার অসহায়ত্বের কথা মনে পড়ে মাঝেমাঝে তাঁর মন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত। তখন পৃথিবীর সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ, ব্যক্তিজীবনের সমস্ত সাধ-আহ্লাদ, আশা-আকাঙ্খা তাঁর কাছে অর্থহীন হয়ে পড়ত। তখন ধ্যানে শুধু জেগে থাকত— যুদ্ধ, অপারেশন, শত্ৰুহনন।

    কিন্তু ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কি শুধুই ইস্পাতে গড়া কঠিন মানুষ ছিলেন? তাঁর কি কোনো মানবিক আবেগ ছিল না? ছিল। অন্তত একবার তাঁর চারপাশের মানুষজন সেটা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

    একদিন একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তিনি পরবর্তী অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন, সে-সময় একটি ছেলে হঠাৎ বলে বসলেন, ‘স্যার, আমরা যে অপারেশন করতে যাচ্ছি, আমি যদি আজ মরে যাই, ইতিহাসে তো আমার নাম থাকবে না।’

    শুনে জাহাঙ্গীর বললেন, ‘আরে আহাম্মক! তুমি-যে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারছ, এটাই তো মস্তবড় সৌভাগ্য। এরপরও কি আর ইতিহাস লাগে?’

    অদৃষ্টের কী পরিহাস!

    সেইদিনের অপারেশনেই ছেলেটি মারা গেল।

    এই ঘটনাতে জাহাঙ্গীর ভয়ানক রকম বিচলিত হন। এই প্রথমবারের মতো তাঁর অটুট গাম্ভীর্য ও আপাত-নিষ্ঠুর কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যেকার এক ফাটল দিয়ে তাঁর সংবেদনশীল হৃদয়ের মানবিক আবেগ দেখা গেল।

    সেদিন জাহাঙ্গীর কাঁদলেন।

    তিনি মাঝেমাঝে লংমার্চের কথা বলতেন। মৃত্যুর সাতদিন আগেও বলেছিলেন, ‘আমরা একদিন এখান থেকে সবাই লংমার্চ করে ঢাকায় যাব সবাই—ছেলে-বুড়ো, মহিলা, চাষি, মজুর, মুক্তিযোদ্ধা—সব্বাই। এইরকম কঠিনে-কোমলে মেশানো মানুষটি কোন্ ঘরে জন্মে কীরকম পরিবেশে এরকমটি হয়ে গড়ে উঠেছিলেন, জানতে ইচ্ছা করে।

    এই-যে জীবনের প্রতি অনাসক্তি, শৌখিন ব্যক্তিগত জিনিসের প্রতি অনীহা, এ তিনি পেয়েছিলেন তাঁর পিতা মোতালেব হাওলাদারের কাছ থেকে।

    বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে আবদুল মোতালেব হাওলাদারের বাড়ি। তাঁর পিতা আবদুর রহিম হাওলাদার প্রতাপশালী ও সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরই নামানুসারে গ্রামের নাম রহিমগঞ্জ।

    মায়ের খুবই আদরের সন্তান ছিলেন আবদুল মোতালেব হাওলাদার। আদরের আতিশয্যে লেখাপড়া বিশেষ হয়নি। মাইনর পাশের পর আর এগোতে পারেননি। গান-বাজনার প্রতি আসক্তি ছিল। মুর্শিদী, মারফতি, বাউল ইত্যাদি ধরনের মরমী গান তাঁর জীবনকে প্রভাবিত করেছিল কিছুটা, বলা যায়। ·

    বাপ-দাদার আমলে তৈরী পাকা দালানেই চিরকাল বসবাস করে গেলেন, বাপ-দাদার রেখে যাওয়া জমিজমার উপর নির্ভর করেই জীবন কাটালেন। ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে সে সম্পত্তি ভাগ হতে হতে এখন তলায় এসে ঠেকেছে। নিজ সম্পত্তি বৃদ্ধি করার তাগিদ কোনো দিন অনুভবও করেননি মোতালেব হাওলাদার। মা ছোট বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন। ক্রমে তিন ছেলে, তিন মেয়ে হয়েছে, সংসারে খাওয়ার মুখ বেড়েছে, সেই অনুপাতে কমেছে খাওয়ার জিনিসের পরিমাণ। সেদিকে লক্ষ রাখেননি মোতালেব হাওলাদার। তিনি মনের আনন্দে মুকুন্দ দাসের গান গেয়ে বেড়িয়েছেন :

    আমি চাই এমন মানুষ
    আমি চাই এমন প্ৰাণ
    বক্ষে যাহার আকাশখানি
    চক্ষে যাহার স্নেহের খনি
    আমি চাই এমন মানুষ এমন প্ৰাণ
    হবে কি গো এমন, মানুষ
    হবে কি গো এমন প্ৰাণ …

    মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর একের পর এক ক্লাস ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে আইএসসি পর্যন্ত পাশ করে ফেলেন। স্বল্প-বাক নিরাসক্ত অথচ পরোপকারী ছেলে জাহাঙ্গীর তাঁর এলাকায় সুপরিচিত এবং সুপ্রিয় ছিলেন। খেলাধুলাতেও খুব নাম করেছিলেন কলেজ-জীবনে প্রবেশ করার পর লেনিন, মাও-সে-তং, চে গুয়েভারা—এঁদের রচনাবলীর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

    একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭নং সেক্টরে তাঁর ঘরে ব্যক্তিগত শখের জিনিস বলতে কিছুই ছিল না বটে, কিন্তু ছিল একগাদা বই—যেমন, মাও-সে-তুং-এর সামরিক রচনাবলী, রক্তে রাঙা লাওস, চট্টগ্রাম বিপ্লব, কাম্বোডিয়া নয়াফ্রন্ট, বিপ্লবী চে গুয়েভারা এবং আরো অনেক বই। সবই বিপ্লব, মুক্তিযুদ্ধ, গণআন্দোলন, গেরিলা ত ৎপরতা—এসব বিষয়ের উপরই।

    জাহাঙ্গীর আইএসসি পাশ করেন ১৯৬৬ সালে। পরের বছর তিনি পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৬৮ সালের জুন মাসে ইঞ্জিনিয়ার্স-কোরে কমিশন্ড্ অফিসারের র‍্যাংক লাভ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাকোরাম এলাকায় ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ানে বহাল ছিলেন।

    পূর্ববাঙলায় গণহত্যার নারকীয় তাণ্ডব শুরু হবার পর থেকে জাহাঙ্গীরের মনে শান্তি ছিল না। কী করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া যায়, সেই চিন্তায় তাঁর ঘুম হচ্ছিল না। তিনি গোপনে চেষ্টা করতে রাগলেন কী উপায়ে পালানো যায়। তাঁর মতো আরো কিছু তরুণ বাঙালি সামরিক অফিসারও পালাবার উপায় খুঁজছিলেন। এরকম আরো তিনজন অফিসারের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটতে তিনমাস লেগে গেল। ৩ জুলাই তিনি আরো তিনজন অফিসার— ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন বীর উত্তম ( শহীদ ), মেজর (অব.) শাহরিয়ার ও লে. কর্নেল (অব.) আনাম— এঁদের সঙ্গে শিয়ালকোটের কাছের সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে সক্ষম হন। জাহাঙ্গীর এঁদের কাউকে আগে থেকে চিনতেন না। তাঁর বন্ধু ক্যাপ্টেন হামিদের সহায়তায় এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। সে-সময় অবশ্য এঁরা সবাই ক্যাপ্টেন ছিলেন।

    শিয়ালকোট থেকে ২০-২৫ মাইল দূরে মারালা বলে একটা জায়গা, সেখানে মুনাওয়ার তাবী নদীর ওপরে ড্যাম আছে, নাম মারালা হেডওয়ার্ক। ঠিক হল, ঐ ড্যাম পেরিয়ে পালানো হবে।

    ওখানে একটা দরগা ছিল। আগের দিন চারজনে শিয়ালকোটে এসে একটা হোটেলে উঠেছেন। আগেই মিলিশিয়াদের পোশাক—কালচে ছাই রঙের সালোয়ার কামিজ কিনে রেখেছেন সবাই। ৩ জুলাই একটা ট্যাকসি ভাড়া করে ওরা চললেন দরগা জিয়ারত করতে। দরগাটা একটা টিলার ওপর। টিলার নিচে ট্যাকসি ছেড়ে ওঁরা ট্যাকসিওয়ালাকে একটা এক’শ টাকার নোট দিয়ে বললেন, ‘আমরা দরগাশরিফের মধ্যে দু-তিন ঘণ্টা কাটাব। আপনি মাগরেবের পর এসে আমাদের ফেরত নিয়ে যাবেন।

    ট্যাকসি ভাড়া ঠিক হয়েছিল চল্লিশ টাকা। ভাংতি নেই বলে ওঁরা আগে থেকেই এক’শ টাকার নোট দিলেন যাতে ড্রাইভারের মনে কোনোরকম সন্দেহ না হয়।

    ড্রাইভার ট্যাকসি নিয়ে চলে গেল। ওঁরা আর টিলার উপর উঠলেন না। নিচেই মাগরেবের নামাজ পড়ে অন্ধকার গাঢ় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন। তারপর প্যান্ট-সার্ট খুলে মিলিশিয়াদের পোশাক পরে নিলেন। সকলের কোমরে একটা করে পিস্তল, সালাহউদ্দিনের হাতে ছোট্ট একটা কোরআন শরিফ। রাত্রির অন্ধকারে সেই অজানা প্রান্তরে বাঙলা মায়ের চার বীর সন্তান অনিশ্চয়ের পথে পা বাড়ালেন।

    দু-তিনদিন আগে থেকে শিয়ালকোটে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে সারা এলাকা প্লাবিত। কোথাও কোমর পানি, কোথাও গলা পানি— সেই পানির ভিতর দিয়ে চুপিচুপি কখনো হেঁট হয়ে, কখনো সোজা হয়ে পার হচ্ছিলেন। যেখানে পানি নেই, সেখানে মাঠের উপর দিয়ে বুকে হেঁটে পার হতে হচ্ছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু দেখাও যায় না, কিছু বোঝাও যায় না। একসময় পাকিস্তান রেঞ্জারদের এক ক্যাম্পের কাছে চলে গিয়েছেন। রেঞ্জাররা ভেবেছে চোরাচালানিদের কেউ হবে। ‘কোন্ হ্যায়’— বলে হাঁক দিয়ে উট নিয়ে বেরিয়েছে। পাকিস্তানের এই সীমান্তে ওরা উটে চড়ে টহল দেয়।

    এঁদের চারজনের তো প্রায় ধরা পড়ার মতো অবস্থা। শুধু নাকটা জাগিয়ে পানির মধ্যে সারা শরীর-মাথা ডুবিয়ে বেঁকে-চুরে অনড় হয়ে কোনোমতে রুদ্ধশ্বাসে লুকিয়ে রয়েছেন। তখনো বৃষ্টি হচ্ছিল। রেঞ্জারগুলি খানিক এদিক-ওদিক খোঁজাখুঁজি করে, ‘কোই নেই, শালা ভাগ গিয়া’ বলে ক্যাম্পে ফিরে গেল। বৃষ্টির মধ্যে কে আর অত কষ্ট করে। হবে কোনো ছ্যাচড়া চোরাচালানি।

    .

    এই চার ক্যাপ্টেন তখন আবার এগোনো শুরু করলেন। রাত প্রায় ১টার সময় মুনাওয়ার তাবী নদীর ধারে এসে পৌঁছালেন। এই নদীটা পার হলেই ওপারে ইন্ডিয়া। কিন্তু নদীর পানিতে পা রেখেই চমকে গেলেন— কী সাংঘাতিক তীব্র স্রোত। বিশাল পদ্মা-মেঘনা-যমুনার দেশের ছেলে তাঁরা। কিন্তু এমন ভয়ংকর খরস্রোতা নদী, বুঝি জীবনে দেখেননি। সাঁতারও তাঁরা খুবই ভালো জানেন, তা সত্ত্বেও এইরকম হিম-ঠাণ্ডা, ছুরির ধারের মতো হিংস্র স্রোতে পার হওয়া প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হল। কিন্তু পার তাঁদেরকে হতেই হবে। অসম্ভবকে সম্ভব করার অসম্ভব পথেইতো তাঁরা যাত্রা করেছেন। তাঁরা পরামর্শ করে নিলেন, ২-৩ মাইল নদীর পাড় ধরে উজানে হেঁটে যাওয়া যাক, নদীটা যেখানে বেশ সরু মনে হবে সেইখান দিয়ে পার হতে হবে।

    একজায়গায় এসে মনে হল এখান দিয়েই পার হতে হবে। কাপড়-চোপড় খুব শক্ত করে গিঁট দিয়ে আল্লাহর নাম স্মরণ করে ওঁরা পানিতে নামলেন। কী যে অসম্ভব স্রোত। উলটোপালটা খেয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, শেষপর্যন্ত সেই নদী পার হয়ে ওঁরা ভারতের মাটিতে পা রাখলেন।

    .

    প্রথমে সেখানকার নিকটবর্তী বিএসএফ-এর ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টারে তাঁরা গেলেন। সেখান থেকে দিল্লী এবং তারপরেই কলকাতা।

    পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চারজন বাঙালি সামরিক অফিসার পালিয়ে আসতে পেরেছেন— এ সংবাদ যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনী ও পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী লাখ-লাখ বাঙালির প্রাণে সাহস ও উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী রণক্ষেত্র থেকে কলকাতায় এসেছিলেন এই চার বীরকে অভ্যর্থনা করার জন্য।

    এখান থেকেই চারজনে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন। জাহাঙ্গীরের পোস্টিং হল ৭নং সেক্টরে—মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে যোগ দিলেন তিনি। ক্যাপ্টেন আনাম গেলেন সিলেট রণাঙ্গনে— ৪নং সেক্টরে। বিদায় নেবার আগে জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, ‘যদি বেঁচে থাকি, আবার দেখা হবে। না হলে এই শেষ দেখা। জানেন তো, স্বাধীনতা- -যুদ্ধে যারা অংশ নেয়, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই বাঁচে। অনেকেই স্বাধীনতার ফলভোগ করতে পারে না, যারা পারে তারা ভাগ্যবান। আমার সে ভাগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যাবে না।’

    খুব হালকাভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন জাহাঙ্গীর, খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে—যেন ব্যাপারটা নাওয়া-খাওয়া-শোয়ার মতোই কিংবা মালদহ থেকে মেহেদীপুর যাওয়ার মতোই খুব সাধারণ এবং স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

    শিয়ালকোট থেকে কলকাতা পর্যন্ত সমস্ত সময়টা একত্রে থাকলেও এই চারজন ক্যাপ্টেনের মধ্যে খোশগল্প হয়ই নি বলা যায়। সবাই নিজের নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার চিন্তায় বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ কাটিয়ে দিতেন। তা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে একধরনের অকথিত সখ্যর বন্ধন গড়ে উঠেছিল, সে কারণেই বিদায়ের প্রাক্কালে তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেছিলেন। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন তাঁর ঘড়ির সোনার ব্যান্ডটা দেড়হাজার টাকায় বিক্রি করে টাকাটা চারভাগ করে নিজে একভাগ রাখলেন। বাকি টাকাটা তিন বন্ধুকে জোর করে দিলেন। ক্যাপ্টেন আনাম হঠাৎ জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা, পালাবার ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেকের মনেই এক-একটা বিশেষ কারণ কাজ করেছে। আপনার পালানোর পেছনে কোন বিশেষ কারণ ছিল?

    অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর গভীর বেদনাবিদ্ধ স্বরে বলেন, ‘প্রথম থেকেই পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাব—এ-রকম ইচ্ছে ছিল। তবে পালাবার পথ বা সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু লাহোরে যেদিন জানতে পারলাম যে পাকিস্তানীরা কিছু বাঙালি মেয়েকে ধরে এনে লাহোরে বিক্রি করে দিয়েছে, সেদিন থেকে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। খবরটা জানার পর আট-দশদিন পানি ছাড়া আর কিছু খেতে পারিনি।’

    .

    বাংলাদেশের মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সমগ্র জীবনের রূপরেখা বদলে দিয়েছিল। তাই বুঝি শত্রু-হনন ছাড়া আর কোনো বিষয়ই তাঁর মনে স্থান পেত না। তাই বুঝি সর্বদা জীবনটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে তিনি অ্যাকশন-অপারেশনে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। যে-কোনো মূল্যেই হোক, দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করতেই হবে। জানিনা, ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি’- গানটি তাঁকে কতখানি বিচলিত ও ক্ষিপ্ত করত।

    .

    রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য সেক্টর কমান্ডার লে. ক. নুরুজ্জামান তিনটি দল গঠন করেন। প্রথম দলের নেতৃত্ব দিলেন মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) গিয়াসকে। তাঁর উপর দায়িত্ব পড়ল চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী সড়কে ব্লকিং পজিশন নিয়ে নবাবগঞ্জকে রাজশাহী থেকে বিচ্ছিন্ন করার। দ্বিতীয় দলের নেতা মেজর ( বর্তমানে কর্নেল) রশীদ দায়িত্ব পেলেন কাটঅফ পার্টি নিশ্চিত করার। তৃতীয় দলের নেতা ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের উপর অর্পিত হল সবচেয়ে দুঃসাহসিক দায়িত্ব—চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করা।

    ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ডিসেম্বরের দশ তারিখে লে. (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) কাইয়ুম, লে. (বর্তমানে মেজর) আউয়াল ও আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন।

    পাশ দিয়েই প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে মহানন্দা নদী। নদীর ওপারে লম্বা উঁচু বাঁধ। বাঁধ ঘিরে চারপাশের চর এলাকায় শত্রুর প্রতিরক্ষা-ঘাঁটি। এই চর এলাকার শত্রু-প্রতিরক্ষা খুবই শক্তিশালী। পূর্বাহ্নে স্থির হয়েছিল, ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী এগারো তারিখে শত্রু-প্রতিরক্ষা এলাকার উপর আর্টিলারির গোলাবর্ষণ করবে শত্রুকে বিভ্রান্ত ও দুর্বল করার জন্য। আর্টিলারি গোলাবর্ষণ শুরু হবার সঙ্গেসঙ্গেই ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরও তাঁর বাহিনী নিয়ে আক্রমণ শুরু করবেন— এই মর্মে ভারতীয় অফিসার ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং-এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয়ও করা হয়েছিল আগে থেকেই। সেই ব্যবস্থানুযায়ী ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর একদিন আগেই বেরিয়ে পড়েছেন দলবল নিয়ে

    কিন্তু ১১ তারিখে নির্ধারিত সময়ে শত্রুর উপর ভারতীয় গোলাবর্ষণ হয়নি। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ১২ ও ১৩—এ দুদিন ধরে পাগলের মতো চেষ্টা করতে থাকেন ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে ওয়ারলেসে যোগাযোগ স্থাপনের।

    কিন্তু ব্যর্থ হন।

    শেষে তিনি খেপে গেলেন। এতদূর এসে ফিরে যাবেন? কখনই না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, ভারতীয় বাহিনীর আর্টিলারি কাভার ছাড়াই শত্রু-অবস্থানের উপর আক্রমণ করবেন।

    ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে, দেশ স্বাধীন হবার মাত্র দুদিন আগে সকাল আটটার দিকে, মাত্র জনাবিশেক মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গে নিয়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর বারঘরিয়ার অবস্থান থেকে বের হলেন নদী পার হবার জন্য। ৩-৪টি দেশি নৌকা করে রেহাই-চর এলাকা দিয়ে মহানন্দা নদী পার হলেন।

    নদী অতিক্রম করার পর তিনি উত্তরদিক থেকে একটি-একটি করে প্রত্যেকটি বাংকারের শত্রু হনন করে দক্ষিণে এগোতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এমনভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে উত্তর থেকে শত্রুহনন করার সময় দক্ষিণদিক থেকে শত্রু গুলি করতে না পারে। সম্মুখ ও হাতাহাতি-যুদ্ধ ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। বাঁধের উপর থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের সেকশন অর্থাৎ জনা-দশেক সৈন্য দৌড়ে এসে চর এলাকায় শত্রু-প্রতিরক্ষায় যোগ দেয়। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আরো মরিয়া, আরো ক্ষিপ্ত হয়ে জীবনের পরোয়া না করে সমানে এগিয়ে যান।

    এবং এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ শত্রুপক্ষের একটি গুলি এসে তাঁর কপালে লাগে। মুহূর্তে তাঁর প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়, তাঁর লাশ পড়ে যায় শত্রুর একটি বাংকারের মধ্যে।

    তাঁর মৃত্যুতে মুক্তিযোদ্ধারা আরো প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। ২-৩জন সহযোদ্ধা মহানন্দা নদী সাঁতরিয়ে বারঘরিয়ায় এসে জাহাঙ্গীরের মৃত্যু-সংবাদ দেয়। আরো মুক্তিসেনা নিয়ে নতুন আক্রমণ পরিকল্পনা করে বিকালের মধ্যেই তারা শত্রু-অবস্থানের উপর পুনরায় আঘাত হানে। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর শত্রুপক্ষকে পর্যুদস্ত করে মুক্তিবাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখল করেন।

    ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ চর এলাকার বাংকারটি থেকে বহন করে আনে মুক্তিযোদ্ধারা। কাছেই ছিল বহু প্রাচীন এবং বহুবিখ্যাত সোনা মসজিদ। জীবদ্দশায় সোনা মসজিদ জাহাঙ্গীরের একটি প্রিয় স্থান ছিল। অবসর পেলেই তিনি সোনা মসজিদে যেতেন। এই সোনা মসজিদের এলাকার ভিতরেই তার মরদেহ সমাহিত করা হয়।

    স্বাধীনতার মাত্র দুদিন আগে শহীদ হলেন স্বাধীনতা-যুদ্ধের অদম্য সৈনিক ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ। স্বাধীনত-যুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ করে, তাদের মধ্যে খুব কম লোকই বাঁচে। তাঁর মুখের কথাটা তাঁরই জীবনে সত্য হয়ে দেখা দিল।

    ‘আমি চাই এমন প্ৰাণ
    বক্ষে যাহার আকাশ খানি
    চক্ষে যাহার স্নেহের খনি’

    বরিশালের আবদুল মোতালেব হাওলাদারের ঘরেই জন্ম নিয়েছিল সেই প্রাণ, যে-প্রাণ উৎসর্গিত হয়েছিল স্বাধীনতার বেদিতে।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম
    Next Article বিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম

    Related Articles

    জাহানারা ইমাম

    একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম

    August 13, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নিঃসঙ্গ পাইন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    সাতটি তারার ঝিকিমিকি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বুকের ভিতর আগুন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }