Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেন এক পাতা গল্প60 Mins Read0

    না যাওয়ার কাহিনি

    মন উড়ু উড়ু, কিন্তু পায়ে শিকলি। মনে মনে যদি মথুরা দর্শন করা যায়, তবে অযোধ্যা পাহাড় বা আরও দূরে ফারাওদের দেশ মিশরেই বা নয় কেন। স্ফিংসের মুখ রহস্যময়। বনে পাহাড়ে মাদল বাজে।

    স্থলে

    আকাশে এখনও শুকতারা, যদিও অনেকক্ষণ ধরেই অল্প অল্প করে ফর্সা হয়ে আসছে আকাশ। আপনি বসে আছেন জানলার ধারে। রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি আপনার। প্যাসেঞ্জার ট্রেন কেবলই থমকে দাঁড়িয়েছে, স্টেশনে স্টেশনে লোকজনের ওঠানামা চলেছে সারারাত, এমনকি চা-ও বিক্রি হয়েছে রাত দুটো নাগাদ এক জংশন স্টেশনে।

    আপনি উঠে গিয়ে দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন। ট্রেন তখন মস্ত এক নদী পার হচ্ছিল, তারার আলোয় চিকচিক করছিল অনেক নিচে জল, না বালি? হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড়। নদীর মিঠে বাতাস আপনার সর্বাঙ্গে বৃষ্টির মতো ঝরেছিল, আর সেতু পেরোনোর ঝঙ্কারের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল মধ্যযামের অশ্রুত স্তব্ধতার নিরালোক ছন্দ। মাটির ভাঁড়ে চা খেতে যত আরাম, বিদেশি বোন-চায়নার দামি পেয়ালার স্বাদ গন্ধ তার ধারেকাছেও লাগে না, তাই না? এখন ভোর হয়ে আসছে, তালশাঁসের মতো স্বচ্ছ ঠাণ্ডা আঁশে বেদানার দানার গোলাপী ছাপ ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসে একটা টাকা ছোঁওয়া, আপনার খুব চা-তেষ্টা পেল, এই বাতাসে—আকাশের গায়ে গা লাগিয়ে ঝাঁকড়া কালো গাছের সারি ছায়ার মতো সরে যাচ্ছে পিছনে। সূর্যের আলো পেলেই তারা সবুজ হয়ে ঝলসে উঠবে। আপনার মনটা খুশি খুশি ট্রেনে উঠলেই এই নির্ভেজাল খুশিটা আপনার শিরাধমনি বেয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কলকাতার বিষবাষ্পে ম্রিয়মাণ আপনাকে মুহূর্তে মুহূর্তে চাঙা করে তোলে। যেই রেল কাম ঝমাঝম, তারপরেই কলকাতা পা পিছলে আলুর দম।

    এই কলকাতা সেই সুন্দরী তিলোত্তমা চিরযৌবনা পরমা প্রেমিকা নয় এ আপনার কলহপরায়ণা প্রখরবসনা ঘরণী যার গায়ে মাছের বাজারের আঁশটে গন্ধ। রেশনের লাইনের ধুলোঘাম, ঝুলন্তবাসের হৃৎকম্প যার ধস্ নামা বুকে। প্রাত্যহিক জীবনযন্ত্রণার সেই নিদারুণা নগরী কলকাতাকে পেছনে ফেলে ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত। অথচ নিরুপায়। তারই সঙ্গে সাত নয়, চোদ্দ পাকে বাঁধা আপনার অস্তিত্ব। তাই মাঝে মাঝে ট্রেন, মাঝে মাঝে এমন খোলা মাঠের গায়ে ডুবে-যাওয়া ক্ষয়া নক্ষত্রের পায়ে পায়ে উঠে-আসা উগ্র তরুণ সুর্য—আপনাকে একটু উলটে পালটে দেয়—কিন্তু স্টেশনটা আসছে না কেন? এবার তো আপনাকে নেমে যেতে হবে। ওই যে, ওই যে স্টেশন, ট্রেনের শব্দ পালটাচ্ছে, ট্রেনের ছন্দ পালটাচ্ছে, তার গতি কমে আসছে। ওই তো এসে পড়ল লাল সুরকি ঢালা পরিচ্ছন্ন জনহীন প্ল্যাটফর্ম, মাঝে মাঝে গোল ইটের বেড়া ঘেরা ওগুলো কী গাছ? কে জানে! বাঁধানো সিমেন্টের বেঞ্চিতে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বসে পাগড়ি মাথায় যে-বুড়ো খক্খক্ করে কাশছে আপনি ওকে ছেলেবেলা থেকেই চেনেন। রেলগাড়িতে চড়ে ও কোথাও যাবে না, ওর ছেলেটার আসার কথা এই ট্রেনে। শহর থেকে ছেলে আসবে, টাকা আসবে, ভাঙা চালাঘরটা মেরামতি হবে। একটা বলদ মরে গেছে, বুড়োর এই কাশির অসুখ আর সারছে না, বুড়ির কোমরে বাত, বড় কষ্টে দিন যাচ্ছে, কিন্তু ছেলেটা যে আসছে না! এখানেই আপনি নেমে পড়েছেন বুড়োর ছেলের সঙ্গে আপনার অনেকবার দেখা হয়ে গেছে কলকাতার রাস্তাঘাটে—হয়নি কি? অথবা আয়নাতেও? গায়ের চাদরটা আরেকটু জড়িয়ে নিলেন আপনি, ওই বুড়োর সঙ্গে দেখা হওয়া আপনার কাম্য নয়, আপনি পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন, গাছে গাছে এখন শিশির মাখানো সবুজ রং ধরেছে, ঘুম ভাঙা পাখির ডাক শুনতে শুনতে ভোরবেলাকার তাজা বাতাসে বুকটা ভরে নিলেন আপনি, চা-স্পৃহ চাতকের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন—এই ধরনেরই কোনও স্টেশনে একবার গয়লানির কাছে কে যে গরম দুধ চেয়ে পেয়েছিল, কোথাও এরকম পড়েছেন আপনি, কিন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়েও আপনার কপালে কোনও গয়লানি জুটল না বলেই মনে হচ্ছে,…আরে? ওখানে বাঁশঝাড়ের পাশে ওটা কী? একটা ঝোপড়ি না? উনুনে কাঠ গুঁজছে মাঝবয়সী এক দেহাতি পুরুষমানুষ। দেখেই আপনি নিজের পকেট হাতড়ালেন। দেশলাইটা গেল কোথায়? সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করল?—থাক না, সিগারেট থাক, ওই যে দেখুন, দেখুন, দূরের দিগন্তে নীলরঙের ঢেউগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন তো একবার? মাঠের আর আকাশের মাঝখানে কোমরবন্ধের মতো ও কোন্ আশ্চর্য রেখা ফুটে উঠছে? এতক্ষণ কি তবে কুয়াশায় ঢাকা পড়েছিল এত বিপুল এত সুন্দর এমন আশাতীত উপহারটি? চঞ্চল নাড়ীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া দ্রুতপায়ে আপনি এগিয়ে চললেন, ঝোপড়ির দিকে, ওই কি তবে অযোধ্যাপাহাড়? ওখানেই রয়েছে সেই আমলকির বন, যে আমলকির বনে খেলা করে বেড়ায় বনময়ূরের ঝাঁক? এখান থেকে কতদূর? কতক্ষণের রাস্তা এই স্টেশন থেকে ওই ধূপছায়া পাহাড়ের ঢেউ? হঠাৎ কোথা থেকে ভেসে উঠল ওরা? যেন শুধু আপনাকেই অভ্যর্থনা জানাতে নীল পোশাকে প্রভাত ফেরির সারি বেঁধেছে! এই পুরস্কার কিন্তু একেবারেই অনর্জিত—এই সকালটি পাওয়ার জন্যে কিছুই করতে হয়নি আমাদের। হ্যাঁ, আমিও আছি। ওই ঝোপড়িতেই আমিও বসে রয়েছি পড়ি দুজনে, উঠে যাই অযোধ্যাপাহাড়ের জঙ্গলে যেখানে লালকাঁকর ঢেকে গেছে ঝিরিঝিরি মহুয়া ফুলে, মহুয়া আর মাংসল মুচকুন্দ চাঁপার সুগন্ধ মাড়িয়ে মাড়িয়ে সদ্য শিলাবৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় মতো মাটি ছাপিয়ে পড়ে-থাকা আমলকি ফল কুড়োতে কুড়োতে কখন সন্ধে হয়ে যাবে, বেজে উঠবে মাদল আর বাঁশি, মহুয়া মদের সুবাস বয়ে আনবে সন্ধ্যার বাতাস, আমরা খুঁজে নেব একটা শূন্য কুঁড়েঘর, চাঁদ চাই না, আমাদের অরণ্যের এই সুগন্ধি অন্ধকারই ভাল, শীতল, সবুজ, স্বয়ংসম্পূর্ণ এই বিশুদ্ধ আঁধারের একটা নিজস্ব দ্যুতি আছে; আছে না? যেমন তারাহীন আকাশেরও একটা দীপ্তি থাকে? চলুন আমি অপেক্ষা করছি আপনার জন্যে, এখনই সময়, ওই দেখুন আমাদের জন্যে আকাশে আজ অসময়ের মেঘ, আমাদের জন্যেই অসময়ের বুনো কদম্বের ফুল ফুটছে এই বনে, আঃ। না! ওই তীব্র সুরভির দিকে যাবেন না, দাঁড়ান। ও যে কেয়াফুলের গন্ধ, ওখানে সাপখোপ থাকতে পারে—সরে আসুন এদিকে, এই যে, আমার হাতটা ধরুন, টুক টুক করে পাথরে পা রেখে রেখে আসুন আমরা দুজনে পার হয়ে যাই এই নুড়ি—উচ্ছ্বল ধবধবে ঝর্নাটা—মেঘের ডাক শুনে অযোধ্যা পাহাড়ে এতক্ষমে বনময়ূরেরা নেচে উঠেছে—।

    জলে

    লাল চিমনি, কালো চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে, গম্ভীর ভোঁ বাজিয়ে সাদা জাহাজটা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট ঢেউ ভেঙে নীলচে সবুজের ওপর সাদা ফেনার রেখা টেনে। দু’পাশেই জনবসতি, কানালের জলের রং যেন চীনদেশী জেড পাথরের মতো স্বচ্ছ সবুজ। আপনি একটু বেশিই ঝুঁকে দাঁড়িয়েছেন ডেকের খোলা বারান্দার লোহার রেলিঙে হেলান দিয়ে, একটা কড়া মিশরি চুরুট ধরিয়েছেন, লোহিত সাগরের ক্লান্ত, ক্লান্ত, ক্লান্ত করা হিন্দোলা আপনার স্নায়ুতে এতদিনে থেমে এসেছে বুঝি বা, খালের জলটি কী শান্ত, নিস্তরঙ্গ। ওই তো এসে গিয়েছে বন্দর, ছোট্ট ছোট্ট নৌকো ঘিরে ধরেছে আপনার সাদা জাহাজকে, এই বন্দর খালের ভিতরে, এখানে উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক নেই, আছে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ুক্কু মানুষ। পশারি আর ভিখারি। জাহাজের গা বেয়ে দড়ির সিঁড়ি দুলিয়ে দিয়েছে নাবিকরা, তাই ধরে দ্রুত উঠে আসছে মিশর দেশের পশারির দল, তাদের হাতে রঙিন পাথরের গয়না, হাতির দাঁতের কারুকার্য করা বাক্সো, কাপড়ের তৈরি তুলোভরা উট, কাটা কাপড় বসিয়ে তৈরি করা ওয়াল হ্যাংগিং উট, গাধা, নেফ্রাতিতি, পিরামিড, মামি, আর দ্বিতীয় রামেসিসের ছবি। বাটিক কাজ করা চামড়ার তৈরি বাতাসভরা আসন, কত কিছু–ডেকের ওপরে বসে পড়ছে তারা। দরাদরি করে যাত্রীরা কিনছে সেই বিচিত্র পশরা। আপনি শুধু চেয়ে আছেন, অলস নজরে, দেখছেন মানুষদের অবিরাম বেচাকেনা, আর এই বেচাকেনায় বিরামহীন মানুষদের। আপনাকে একটুও টানছে না ওই বর্ণময় রত্নের মালা, ওই সংসারের খেলাঘর সাজিয়ে তোলার আসবাবপত্তর (নাকি খেলনাপাতি?) ওসব দেখুক অন্য লোকে, আপনি যে চান খাস মিশরকেই বুকের মধ্যে তুলে নিতে, কী হবে আপনার এই সব তুচ্ছ বস্তু সংগ্রহ করে? আপনি তো দেখতে চান বালক টুটান খামেনের স্বর্ণভার, সুন্দরী নেফ্রোতিতির রত্নভাণ্ডার, রাজা রামেসিসের মন্দির, ক্লিওপট্রার রহস্যময় লিপির স্তম্ভের তলায় দুমিনিট স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াতে চান আপনি, চান পিরামিডের গায়ের সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে, এবং তার অন্ধকার গর্ভগৃহে নামতে—আপনি চান উটে চড়ে মধ্যদিনের আগুনকরা সাহারা পার হয়ে শীতল কোনও মরুদ্যানে পৌঁছে যেতে—ঠিক বিভূতিভূষণের অপুর মতো, কোনও বেদুইন কিশোরীর কাছে একপাত্র তৃষ্ণার জল যেখানে প্রার্থনা করা সম্ভব।

    এই হাটবাজার দেখতে দেখতে আপনি অস্থির হয়ে পড়ছেন, আপনাকে যেতে হচ্ছে মিশরে নয় অন্য দেশে, যে দেশে আপনার হৃদয় যেতে চান না কিন্তু কর্ম ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ আপনার যাওয়ার কথা ছিল তো মিশরেই—কে? কে ডাকল? হঠাৎ জল থেকে কে যেন ডাক দিল—আপনাকেই? হ্যাঁ, আপনাকেই তো! কে ওই ছেলেটি? নীল জলের তলায় তার শুভ্র চঞ্চল শরীর নগ্ন সহজ এক মাছের মতো ঝকঝকে সুন্দর। তার দীর্ঘ হাতে পায়ে কী সাবলীল ছন্দ, সবুজ জল কেটে জাহাজের আশেপাশে মাছের মতোই সাঁতরে বেড়াচ্ছে সে, জাহাজের নাবিকরা হাসতে হাসতে পয়সা ছুঁড়ে দিচ্ছে জলে। মুহূর্তেই ডুবসাঁতার দিয়ে সেই পয়সা তুলে আনছে-ও কি যুবক? না, না, যুবক কোথায়, বালক, কিশোর মাত্র, নারীর মতো নির্লোম তার মুখমণ্ডল, ভিজে চুলের রং কটা, সোনালি চোখ। হঠাৎ কোথা থেকে এসে পড়ল তার সঙ্গী সাথীরা ঢেউয়ে ঢেউয়ে তোলপাড় করে তুলল খালের নীলসবুজ স্বচ্ছতা, বালকদের হাসির কলরোলে পশারিদের দরদস্তুরের শব্দ নিবে গেল, কে যেন বলল, নামবে নাকি? যাবে নাকি পারে? সময় অবিশ্যি হাতে নেই বেশি—আপনার মনে হল, ধুৎ! কী বিলেতে যাব? কেন যাব লণ্ডন শহরে? যাই, নেমে যাই, মিশরেই যাই। মিশরেই তো যাবার কথা ছিল চিরকাল, সেই কবে থেকে, তাই না? দড়ির সিঁড়ি বেয়ে আপনি নামতে শুরু করলেন, নিচেই অপেক্ষা করছে নৌকো, আমার নৌকো। আপনার জন্য নৌকো নিয়ে আমি নিচেই আছি-আমরা এখন যাচ্ছি আবু সিম্বেলের মন্দির দেখতে। নীলনদের বাঁধে তার ঠিক কতখানি হারাল, দেখতে হবে না? ওখান থেকে আমরা যাব নীলনদের উৎস সন্ধানে, আকাশ যেখানে তাতানো রুপোর পাত, গগনে, ঝাঁঝাঁ সাদা, চোখ পড়লে চোখ ঝলসে যায়, মাটিও যেখানে জ্বল্‌ছে, পা বাড়ালে পা ঝলসে যায়, সেই মরু পার হয়ে আমরা যাব খেজুরবীথির ঝিরঝিরে ছায়া সাজানো পাড়ে বাঁধানো কোনও শীর্ণ তীব্র স্রোতে উজান বেয়ে। উচ্ছৃঙ্খল ফেনার ফোয়ারা হঠাৎ হঠাৎ ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের, উপলসঙ্কুল সেই স্রোত হঠাৎ হঠাৎ হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার গুহার গর্ভে, সেখানে জ্বলে উঠছে আশ্চর্য আলেয়া। স্যাঁতসেতে জল-ঝরা পাথুরে দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমাদের বুকের ভেতরকার অনুচ্চারিত প্রশ্ন—’কৈ। কৈ! কে আছো?’

    আপনি চলে আসুন আমার নৌকোয়, হাতির দাঁতের কাজ-করা এই সরু গলুইতে আপনি আরাম করে বসুন, এই নৌকো আমাদের নিয়ে যাবে মিশরের হৃৎপ্রদেশে। কালো ঘোমটায় সর্বাঙ্গ ঢাকা একফালি খোলা—চোখের রহস্যভরা বিদ্যুৎ সেখানে আপনাকে ডাকছে। আর আমাকে? আমাকে ডাকছে উঠের সারি। হ্যাঁ সাহারার ওই চিরপিপাসার্ত উটেরা আমারই স্বগোত্র। সেই যে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন মনে নেই? কাঁটাঝোপ খেতে খেতে ঠোট কেটে রক্ত পড়বে তবু উপায় নেই জীবনধারণ করতে হবে ওই অখাদ্য কাঁটাঝোপই চিবুতে হবে উটকে—আমারও যে সংসারে ঠিক সেই অবস্থা। জীবনধারণের জন্যে কাঁটাঝোপ চিবুতে চিবুতে ঠেংটি কেটে রক্ত পড়ছে, কিন্তু উপায় নেই। তবে শুনুন, গোপনে বলি, মিশরে আমি খুঁজছি একটা মুখ, আমি জানি কোনও একটি মমির মুখে আঁকা থাকবেই দর্পণে-দেখা, আমার অতি-চেনা সেই মুখচ্ছবিটি। কতদিন স্বপ্ন দেখেছি এক পিরামিড থেকে আরেক পিরামিডের গর্ভগৃহে যুগ যুগান্তের অন্ধকারে নেমে মোমবাতি জ্বেলে, রত্নসম্ভার এড়িয়ে আমি খুঁজছি আমার সেই নিরলঙ্কার নিজস্ব মমিকে। গোপন পিরামিডের শীতল অন্ধকার আমাকে হাতছানি দিচ্ছে। আসুন আমার সঙ্গে, আমি যদি বা ভুলেই গিয়ে থাকি, যদি চিনতে না-ও পারি, আপনিই তখন চিনিয়ে দেবেন আমার সেই জন্মান্তরের মুখখানা।

    কি?—পারবেন না চেনাতে? চলুন, এই খালের নিশ্চিন্ত পান্না-সবুজ জল আমাদের নয়, এই অস্থি-সাদা সাহেবি জাহাজ আমাদের নয়, ওই যে চিরকালের মিশর তার সোনালি ধুলোবালি উড়িয়ে প্রখর রোদ্দুরে আমাদের ডাকছে—, আরব বেদুইন আমরা নাই বা হলুম, তবু পায়ের তলায় দিগন্তের দখল পেয়ে যেতে আপত্তি কীসের? যে যায়, পথ তো তারই। চলুন, আমরা যাই।

    না-যাওয়ার ভ্রমণকাহিনী? হায়! তারই নাম কি জীবন যাপন? জীবন-যাত্রা—?

    প্রকাশ : আনন্দবাজার ২০০৮

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – নবনীতা দেবসেন
    Next Article ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    Related Articles

    নবনীতা দেবসেন

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    নবনীতা দেবসেন

    ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না – নবারুণ ভট্টাচার্য

    September 1, 2025

    মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.