Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মোমচোর

    উপন্যাস ছোটগল্প সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প12 Mins Read0

    মোমচোর

    মালবিকার একটুও ভয় নেই। বাজি পোড়ানোর নেশায় সে খুশিতে ঝলমলে হয়ে উঠেছে। কালি পটকাগুলো সে অনায়াসে হাতে ধরে ধরেই ফাটায়। পলতেয় আগুন লাগিয়ে পটকাটা ছুড়ে দেয়, হাতখানা যতদূর সম্ভব লম্বা করে রাখে, মুখখানা তার হাসি ও উত্তেজনায় অপরূপ হয়ে ওঠে, শেষ মুহূর্তে সেটা শূন্যে ছুড়ে দেয়, মাটিতে পড়ার আগেই দুম করে ফাটে। অভিজিৎ আর রণদেব চেঁচিয়ে ওঠে, এই কী হচ্ছে কী? হাত পুড়ে যাবে! হাতে ফাটবে! মালবিকা খিলখিল করে হেসে দু-একটা পটকা ওদের দিকে ছুড়ে দেয়, একেবারে রণদেবের মুখের সামনে দুম করে শব্দ হয়।

    রণদেব একগাদা বাজি কিনে এনেছে। অন্তত কুড়ি-পঁচিশটাকার তো হবেই। পটকা, তুবড়ি, হাউই, রংমশাল। রণদেবের মনে আছে ছেলেবেলায় মুঙ্গেরে দেখেছিল, দেওয়ালির দিনে। মালবিকাকে বাজি নিয়ে হইহই করতে। রণদেব নিজেও অবশ্য তখন বাজি নিয়ে খুব মেতে উঠত, নিজের হাতে সে উড়নতুবড়ি বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। কিন্তু এখন আর তার ওই শখ নেই, গত চার-পাঁচ বছর দেওয়ালিতে রণদেব একটা বাজিও চোখে দেখেনি।

    ছেলেবেলায় চেনা সেই মালবিকার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তারই বন্ধু অভিজিতের, একথা রণদেব যখন শুনল, বেশ খুশিই হল। অভিজিতের বিয়ের সময় সে এখানে ছিল না। দিনদশেক আগে অভিজিতের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার পর সে রণদেবকে জোর করে নিয়ে এল বাড়িতে। তখন বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে ভাব জমাবার জন্য রণদেবের একটুও সময় লাগল না। মালবিকাও তাকে দেখেই চিনতে পেরেছে।

    আজ তাই রণদেব একগাদা বাজি কিনে এনে হাজির হয়েছে। আজ তার অন্য কোথাও যাওয়ার ছিল না, আর এত দুমদাম আওয়াজের মধ্যে ঘরের মধ্যেও চুপ করে বসে থাকা যায় না। আওয়াজের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় নিজেরও আওয়াজ করা।

    মালবিকা ঠিক আগের মতনই ছেলেমানুষ আছে, একবার অবশ্য বলল, ইস, এত টাকার বাজি কিনেছ? খুব বড়লোক হয়েছ বুঝি? কিন্তু পরমুহূর্তেই বাজিগুলো ধ্বংস করার কাজে লেগে গেল।

    বাড়ির সামনে ছোট্ট একটুখানি চত্বর, সামনে লোহার গেট। সেই চত্বরে দাঁড়িয়ে বাজি পোড়াল ওরা, দেওয়ালে-জানলায় মোমবাতির মালা, রাস্তায় ছোট ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটি। অভিজিৎ শব্দ করা বিপজ্জনক বাজির তেমন উৎসাহী নয়, সে স্মিতমুখে রংমশাল জ্বালছে মাঝে-মাঝে। মালবিকার ঝোঁক পটকা বোমা ফাটানোর দিকে।

    দু-একটা পটকা শেষপর্যন্ত ফাটে না। মাটিতে পড়ে পলতেটা জ্বলতে থাকে, সবাই চেয়ে থাকে। উদগ্রীবভাবে, কিন্তু শব্দ আর হয় না। মালবিকা রণদেবের দিকে চেয়ে ঠাট্টা করে বলে, কী যা-তা বাজি এনেছ? একদম ফাটে না!

    অভিজিৎ তাড়াতাড়ি বলে, বাঃ, রণদেবের দোষ কী! ও তো আর বাজিগুলো বানায়নি। পয়সা দিয়ে কিনে এনেছে। আজকাল সব ব্যাপারেই ফাঁকি—

    গেটের ওপাশেদাঁড়িয়ে আছে একটা দশ-এগারো বছরের ছেলে। যে পটকাগুলো ফাটে না, সে দৌড়ে এসে কুড়িয়ে নেয়। আবার ছুটে চলে যায় গেটের ওপারে। রণদেব তাকে লক্ষ করে জিগ্যেস করে, ওই ছেলেটা ওই খারাপ বাজিগুলো কুড়িয়ে নিলে কেন? কী করবে ও দিয়ে?

    মালবিকা বলল, তাও জানোনা! বিলেতে গিয়ে সব ভুলে গেছ! ওই কালিপটকাগুলোর মাঝখানটা ভেঙে আগুন ধরালে ফুলঝুরির মতন একটু জ্বলে—

    -তাই নাকি?

    —হ্যাঁ। মোমবাতিটা নিভে গেছে, জ্বালিয়ে দাও তো!

    —ওই ছেলেটাকে কয়েকটা ভালো বাজিই দিয়ে দাও না! অনেক তো আছে!

    —দাও না। ওদেরই তো বেশি আনন্দ। ছেলেবেলায় আমরা মুঙ্গেরে কীরকম মজা করতাম, মনে আছে?

    —হ্যাঁ, সব মনে আছে। তুমি তখন বড় ঝগড়া করতে।

    —মোটেই না!

    —এই খোকা, এদিকে এসো। বাজি নেবে?

    ছেলেটা এক-পা দু-পা করে গেটের ভেতরে এল, তারপর আবার কী ভেবে পেছন ফিরে ছুটে পালিয়ে গেল।

    অভিজিৎ বাড়ির ভেতরে গিয়েছিল হাউই ওড়াবার জন্য একটা বোতল আনতে। সে একটা অ্যালমুনিয়ামের ডেকচিও নিয়ে এল। একপাতা কালিপটকায় একসঙ্গে আগুন দিয়ে ডেকচি চাপা দিলে মজা হয়, তখন ডেকচিটা লাফাতে থাকে। কিন্তু সবকটা পটকা অবশ্য ফাটে না, দু-একটা থেকে যায়। সেই ছেলেটা আবার দৌড়ে এল পড়ে-থাকা পটকাগুলো কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য।

    রণদেব বলল, ছেলেটা ভারী অদ্ভুত তো! ওকে ভালো বাজি দেওয়ার জন্য ডাকলুম, তখন এল না, কিন্তু কুড়িয়ে নিতে আবার এসেছে।

    অভিজিৎ বলল, কোন ছেলেটা?

    তারপর ছেলেটাকে দেখতে পেয়ে অভিজিৎ প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, এই, তুই আবার এসেছিল? দাঁড়া, এবার তোকে পুলিশে দেব।

    মালবিকা জিগ্যেস করল, ও চোর বুঝি?

    —তুমি জানো না, প্রত্যেকবারে ও সব মোমবাতি চুরি করে নিয়ে যায়।

    মালবিকার বিয়ে হয়েছে আট মাস আগে, আগের দেওয়ালিতে সে এ পাড়ায় ছিল না। হাসতে হাসতে বলল, তা ছেলেমানুষরা তো একটা আধটা মোমবাতি নেবেই। আমরাও অন্যদের বাড়ির পাঁচিল থেকে নিয়ে যেতুম, না রণদেবদা?

    অভিজিৎ বলল, একটা আধটা নয়, পাড়ার সব বাড়ির মোমবাতি ও সাফ করে দেয়। সারা বছর ধরে বোধহয় সেইগুলো জ্বালে।

    মালবিকা এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করল, এই খোকা, তোমার নাম কী?

    ছেলেটা উত্তর দিল না, মালবিকাকে এগুতে দেখেই একছুটে পালিয়ে গেল।

    অভিজিৎ বলল, ওর নাম মানিক। পাশের বস্তিটায় থাকে।

    রণদেব বলল, এখনও তো অনেক বাজি পড়ে রইল, নাও ফাটাও, কখন শেষ করবে?

    মালবিকা বলল, এত বাজি এনেছ, এ কি আর ফুরনো সহজ!

    অভিজিৎদের বাড়িতে বাচ্চা ছেলেমেয়ে কেউ নেই, বাচ্চারা ছাড়া বাজি পোড়ানো বেশিক্ষণ জমে না। তা ছাড়া আর-একটা কাণ্ড হয়ে গেল। মালবিকা পরে আছে সিল্কের শাড়ি। একবার নীচু হয়ে রংমশাল জ্বালতে গিয়ে তার আঁচলে আগুনের ছোঁয়া লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে দপ করে জ্বলে উঠল। সেই জায়গা। মালবিকা দারুণ ভয় পেয়ে ও মাগো-ও মাগো বলে চেঁচিয়ে উঠল।

    রণদেব জানে এ সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। ব্যস্ত হয়ে হুড়োহুড়ি কিংবা চেঁচামেচি করলে কোনও লাভ নেই। আঁচলটা খুলে, সম্ভব হলে শাড়িটা খুলে ফেলে মাটিতে চাপড়ালেই সহজে আগুন নিভে যায়। সেটা করার জন্য রণদেব আর একটু হলে ছুটে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার মনে পড়ল, মালবিকা এখন শুধু আর তার ছেলেবেলার বান্ধবী নয়, এখন সে অভিজিতের স্ত্রী। সুতরাং ওই সুযোগটা অভিজিৎকেই দেওয়া উচিত।

    রণদেব চিৎকার করে অভিজিৎকে বলল, তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ কী? যাও, আঁচলটা খুলে ফেলে মাটিতে–

    মালবিকা নিজেই শাড়ির অর্ধেকটা খুলে ফেলে তখন লাফাচ্ছে, অভিজিৎ ঠিক মতো আগুন নেভাতে পারছে না—তখন রণদেব গিয়ে বুটশুদ্ধ পা দিয়ে আগুনের ওপর চপড়াতে লাগল।

    সাংঘাতিক কিছু ব্যাপার নয়, একটুতেই আগুন নিভে গেল। মালবিকার শাড়িও বেশি পোড়েনি, ইঞ্চিখানেক জায়গা ঝলসে গেছে। রণদেব বলল, বাবাঃ, কী চেঁচামেচিই শুরু করেছিলে! বাজি ফাটাবার সময় এত সাহস, আর সামান্য একটু আগুন দেখেই এত ভয়?

    মালবিকা বলল, মোটেই আমি আগুন দেখে ভয় পাইনি।

    —ভয় পাওনি? এত জোর চিৎকার শুরু করেছিলে—

    —বাঃ, আমার শাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল। এমন ভালো শাড়িটা।

    —একটা শাড়ির জন্য এত মায়া?

    অভিজিৎ হাসতে-হাসতে বলল, মেয়েদের শাড়ির জন্য কীরকম মায়া থাকে তুমি জানো না। মালবিকার তো হাত কেটে রক্ত পড়লে ততটা কষ্ট হয় না, যতটা কষ্ট পায় ওর কোনও শাড়িতে একটু খোঁচা লেগে ফেঁসে গেলে।

    মালবিকা বলল, সব শাড়ির জন্য হয় না। কিন্তু এটা আমার পুজোর শাড়ি রণদেব বলল, মালবিকার শাড়ি-টাড়ির ওপর মায়া হবে, আমি আশাই করিনি। অবশ্য ওকে শাড়ি-পরা অবস্থায় আগে দেখিনি। মুঙ্গেরে ওকে শেষ যখন দেখেছি, তখন মালবিকা ফ্রক পরত। অভিজিৎ বলল, শুধু মালবিকা নয়, সব মেয়েরই শাড়ির জন্য এরকম অদ্ভুত টান। বিয়ে করো, তখন বুঝবে।

    মালবিকা বলল, বিয়ে না হলেও বুঝত। নেহাত এতগুলো বছর বিলেতে কাটিয়ে এসেছে, সেখানে তো আর শাড়ি-পরা মেয়ে দেখেনি বেশি।

    বাজি পোড়ানোর আর উৎসাহ নেই। মালবিকা বলল, এগুলো আর কী হবে! পাড়ার ছেলেমেয়েদের দিয়ে দাও বরং।

    রণদেব বলল, কেন, হাউইগুলো এবার ছাড়ো না।

    —নাঃ, আর ভালো লাগছে না। এই খোকা, এসো, বাজি নেবে?

    সেই ছেলেটা, মানিক যার নাম, আবার এসে গেটের পাশে দাঁড়িয়েছে। মালবিকা তাকে ডাকছে, এসো, বাজি নেবে এসো। ছেলেটা এক-পাদু-পা করে এগোচ্ছে, মুখে একটা লাজুক-লাজুক ভাব, খানিকটা বিশ্বাস, খানিকটা অবিশ্বাস। কোনওদিন কেউ তাকে ডেকে বাজি দেয়নি।

    অভিজিৎ বলল, কাকে দিচ্ছ? সেই চোরটা আবার এসেছে? না, না, ওকে দিতে হবে না।

    মালবিকা বলল, দিই না! কী হবে রেখে।

    —না, না, ও একটা মহাচোর। কিছুতেই দেবে না। রেখে দাও বরং, কাল দিদির ছেলেমেয়েরা আসবে।

    —কাল পর্যন্ত রাখলে মিইয়ে যাবে।

    —তবু রেখে দাও, ওকে দিও না। অ্যাই, তুই আবার এসেছিস? যা, পালা—

    ছেলেটা মালবিকার কাছে অনেকটা এগিয়ে এসেছিল। অভিজিতের কাছে তাড়া খেয়েই সে আবার ছুটে পালাল। যাওয়ার আগে সে ছোঁ মেরে দুটো মোমবাতি তুলে নিল।

    অভিজিৎ বলল, দেখলে, দেখলে, আবার নোম নিয়ে গেল। এমন বিচ্ছু ছেলে—

    রণদেব হাসতে-হাসতে বলল, ছেলেটার বেশ সাহস আছে কিন্তু। আমাদের চোখের সামনে মোম দুটো তুলে নিল!

    মালবিকা বলল, কী হবে আর মোম দিয়ে। আমাদের তো আরও এক প্যাকেট মোম আছে। একে দিয়ে দিলেই হত!

    মালবিকা চলে গেল শাড়ি পালটাতে। অভিজিৎ আর রণদেব ঘরে এসে বসল। অবিলম্বেই এল খাবার, মালবিকা ফিরে এল আরও একটা জমকালো শাড়ি পরে। মেরুন রঙের মুর্শিদাবাদি সিল্কের শাড়িটায় তাকে মানিয়েছে খুব। রণদেব মুগ্ধভাবে তাকাল তার দিকে একবার। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ রাখল না সেদিকে। বলল, বাঃ, এ-শাড়িটা বেশ সুন্দর!

    রণদেব এটা বলেছে নেহাত কথার কথা হিসেবে। কিন্তু ওতেই মালবিকা একেবারে হাসিতে ভেঙে পড়ল। বলল, রণদেবদা, তুমি এখনও মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে শেখোনি! শাড়িটা সুন্দর না বলে, শাড়িটা যে পরেছে তাকে খুব মানিয়েছে, এই কথা বলতে হয়।

    অভিজিৎ বলল, শিখে নাও রণদেব, শিখে নাও।

    রণদেব বলল, ইস, তোমাকে খুশি করা কথা বলতে যাব কেন? মুঙ্গেরে যখন তোমায় চিনতাম, তখন কি ওরকম কথা বলতাম? এখন বন্ধুর বউ হয়েছ বলে—

    অভিজিৎ বলল, মুঙ্গেরে থাকার সময় ওকে কীরকম দেখতে ছিল? তোমার মনে আছে রণদেব?

    —হ্যাঁ। সব মনে আছে। মালবিকা তখন ছিল রোগা আর লম্বা, রংটাও এত ফরসা ছিল না, নাক দিয়ে সর্দি গড়াত, আর কী দুরন্তই ছিল—

    —এই, মোটেই আমি ওরকম ছিলাম না। কী মিথ্যুক!

    —মোটেই মিথ্যে কথা নয়।

    –দাঁড়াও, তোমাকে আর এ বাড়িতে ঢুকতেই দেব না। বিলেতে গিয়েও তুমি একটুও শিভালরি শেখোনি! তোমাকে দেখাবার জন্য আমি আমার সবচেয়ে ভালো শাড়িটা পরে এলাম—

    অভিজিৎ আর রণদেব প্রাণ খুলে হাসতে লাগল। মালবিকারও সেই হাসিতে যোগ দিতে দেরি হল না।

    একটু বাদে মালবিকা জিগ্যেস করল, আচ্ছা, রণদেবদা, সত্যি কি আমি অনেক বদলে গেছি?

    তুমি আমাকে অনেকদিন বাদে দেখছ, ঠিক বলতে পারবে।

    —হ্যাঁ, অনেক-অনেক বদলে গেছ।

    —সবাই বদলায়। তুমি বুঝি বদলাওনি?

    —তোমার একটা ব্যাপার কিন্তু তেমন বদলায়নি। তুমি এখনও ছেলে মানুষের মতন বাজি পোড়াতে ভালোবাসো। মনে আছে, সেই মুঙ্গেরে। সেই দশেরার দিন থেকে আমরা বাজি ফাটাতে শুরু করতাম। তোমার একটা টকটকে লাল রংয়ের কোট ছিল, তুমি আমদের সঙ্গে ছুটোছুটি করতে বাজি পোড়াবার সময়…একবার একটা ছুঁচোবাজি তোমার কোটটা পুড়িয়ে দিল, তুমি একটুও দুঃখ পাওনি তোমার দাদা হেমেন বরং খুব রেগে গিয়েছিল।

    অভিজিৎ মিটমিট করে হাসছে। বলল, ইস, তোমাদের সেই ছেলেবেলায় আমি সেখানে ছিলাম না! আমার ছেলেবেলাটাও কেটেছে এই বিশ্রী কলকাতায়—

    রণদেব বলল, বিলেতে থাকলেও আমার মধ্যে-মধ্যে সেই মুঙ্গেরের দিনগুলির কথা মনে পড়ত, বিশেষ করে পুজোর সময় মালবিকা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, আমার কিন্তু আজ বাজি পোড়াতে একটুও আনন্দ হয়নি।

    —বাঃ, তুমি যে অত হইহই করছিলে?

    —সে প্রথম দিকে। কিন্তু এত বাজি পুড়িয়ে আমরা নষ্ট করছি, আর এখানে কত বাচ্চা ছেলেমেয়ে একটাও পায় না। ওই ছেলেটাকে বাজিগুলো দিয়ে দিলেই হত, ও আরও বেশি আনন্দ করত।

    অভিজিৎ বলল, তোমার দেখছি বেশি-বেশি! ও তো একটা চোর—

    —শুধু তো মোম নেয়। আর কিছু চুরি করে?

    —ওই করেই হাত পাকাচ্ছে।

    —কিন্তু ছেলেটা আমার সামনে হাত বাড়িয়ে ছিল!

    রণদেব বলল, ওসব কথা বাদ দাও। চলো, একটু বেড়িয়ে আসবে নাকি?

    মালবিকা উৎসাহিত হয়ে বলল, চলো!

    অভিজিৎ বলল, পাগল, আজ রাত্রে কেউ বেরোয়! কখন মাথায় এসে উড়নতুবড়ির খোল পড়বে!

    —বাঃ, গাড়ি আছে তো!

    —গাড়ি থেকে নামতে হবে তো একবার-না-একবার!

    —তোমার এত ভয়?

    রণদেব বলল, ঠিক আছে নামতে হবে না। চলো, চৌরঙ্গিপাড়ায় কোথাও আজ খেয়ে আসি সবাই মিলে। ওখানে তো বাজির ভয় নেই। তোমাদের বিয়ে উপলক্ষে আমার তো এমনিতেই একদিন খাওয়ানো উচিত।

    মালবিকা বলল, আজ নয়। আজ আমাদের বাড়িতেই ভালো রান্না হচ্ছে।

    রণদেবদা, তুমি আজ এখানে খেয়ে যাবে।

    —কোনও আপত্তি নেই।

    কথায়-কথায় বারবার এসে পড়তে লাগল ছেলেবেলার গল্প। রণদেব মাঝে-মাঝে বিশ্বাসই করতে পারছে না, এই সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, সুসজ্জিতা মহিলাটিই সেদিনের সেই ছটফটে কিশোরী মালবিকা। মুঙ্গেরে মালবিকাদের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো ছিল না, কিন্তু এখন সে বেশ বড়লোকের বউ, এবং বেশ মানিয়ে গেছে। মালবিকা একবার চারটে তুবড়ি চুরি করেছিল তাদের। বাড়ি থেকে সে ঘটনা রণদেবের স্পষ্ট মনে আছে, কিন্তু ইচ্ছে করে উল্লেখ করেনি। মালবিকার স্বভাব মোটেই খারাপ ছিল না, ভারী সরল আর দুরন্ত মেয়ে ছিল, সে যে ও ভাবে আঁচলের। আড়ালে তুবড়ি নিয়ে যাবে, কেউ ভাবতেই পারেনি। মালবিকার দাদা হেমেনই সেটা দেখে ফেলে। মালবিকার তখন কী কান্না! সেরকম কান্না আর কোনও মেয়েকে এ পর্যন্ত কাঁদতে দেখেনি রণদেব।

    অভিজিৎ রেকর্ড-প্লেয়ারে একটার পর একটা রেকর্ড চাপিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরের গোলমালে গান শোনার উপযুক্ত আবহাওয়া তৈরি হতে পারছেনা। খানিকটা বাদেই সে শুরু করল চাকরির গল্প। দুজন পুরুষের দেখা হলে বেশিক্ষণ এ প্রসঙ্গ চেপে রাখতে পারে না।

    খাওয়ার ডাক পড়েছে, ওরা সবেমাত্র খেতে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে, এমনসময় বাইরে একটা প্রচণ্ড গোলমাল শোনা গেল। কীসের গোলমাল, তা আর কারুকে বলে দিতে হল না, ওরা নিজেরাই বুঝতে পারল। পাশের বস্তিতে আগুন লেগেছে, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর লকলকে আগুনের শিখা ওরা জানলা দিয়েই দেখতে পেল। ওরা তক্ষুণি এসে দাঁড়াল বাইরে। লোকজনের ছুটোছুটি আর প্রচণ্ড চিৎকার, দুটো ছাগল একটা গরু ছাড়া পেয়ে দিশেহারার মতন ছুটছে। দমকল ডাকতে গেছে দু-একজন, এখনও আসেনি।

    অভিজিৎ বলল, ইস, অনেকগুলো ঘরে আগুন লেগে গেছে! ভেতরের লোকজন সব বেরিয়েছে কি না–

    রণদেব নির্লিপ্তের মতন বলল, নিশ্চয়ই বেরুতে পারেনি চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারছ না? এরা শুধু চেঁচামেচি করতেই জানে, বাঁচাবার চেষ্টা করবে না!

    —ওই ছেলেটাও এই বস্তিতে থাকে।

    মালবিকা একদৃষ্টিতে আগুন দেখছিল, একবার মন্তব্য করেছিল, কালীপুজোর দিন কী বিরাট বাজি পুড়ছে! এবার অভিজিতের কথা শুনে বলল, কোন ছেলেটা? সেই মানিক, যে মোম চুরি করে?

    —হ্যাঁ।

    হঠাৎ কী হল মালবিকার, সে দৌড়তে লাগল, ওই আগুন-জ্বলা বস্তির দিকে।

    অভিজিৎ আর রণদেব ছুটে এসে ওকে আটকাবার চেষ্টা করল, কিন্তু ধরে রাখতে পারে না কিছুতেই। মালবিকা তেতো গলায় বলল, তোমাদের লজ্জা করে না!—মানুষ পুড়ছে, আর তোমরা দাঁড়িয়ে আছ?

    অভিজিৎ ধমক দিয়ে বলল, কী পাগলামি করছ! আমরা কী করব? দমকলের লোক এসে যা করার করবে।

    —তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। তুমি না পারো, তুমি দাঁড়িয়ে থাক—আমি ওই ছেলেটাকে—

    মালবিকা যখন সত্যি-সত্যি আগুনের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছে, তখন রণদেব ছুটে এসে শক্ত করে হাত চেপে ধরল। তারপর বলল, তুমি দাঁড়াও, আমি দেখছি। শাড়ি পরে তুমি এই আগুনের মধ্যে ঢুকে কারুকে বাঁচাতে পারবে নাকি? তুমি নিজেই মরবে! সরে যাও, সরে যাও, একটা বাঁশ ভেঙে পড়ছে—

    মালবিকা বলল, রণদেবদা, আমি জানি, চেষ্টা করলে তুমি ঠিক পারবে!

    রণদেব গায়ের কোটটা খুলে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় এগিয়ে গেল, যেদিকে তখনও আগুন লাগেনি, সেদিক দিয়ে ঢুকতে গেল। তার মধ্যেই এসে গেল দমকল।

    আগুন নিভল প্রায় এক ঘণ্টা বাদে। ততক্ষণ ওরা ঠায় দাঁড়িয়ে। রাস্তা লোকে লোকারণ্য। দমকলের লোকদের সাহায্য করার বদলে সবাই বাধার সৃষ্টি করছে।

    অভিজিৎ বলল, একি মালবিকা, তোমার এই শাড়িটাও পুড়ে গেল! মালবিকা একটুও চমকে উঠল না, নিরুত্তাপ গলায় বলল, কোথায়?

    —এই যে!

    কখন যেন কয়েকটা ফুলকি পড়ে মালবিকার আঁচলে গোল-গোল গর্ত হয়েছে। মালবিকার সবচেয়ে ভালো শাড়ি। মালবিকা কিন্তু একটুও বিচলিত হল না। উদাসীন ভাবে বলল, যাক গে! আবার তাকিয়ে রইল সেই বস্তির দিকে।

    অ্যাম্বুলেন্সও এসে গেছে। সবশুদ্ধ পাঁচটা ঝলসানো দেহ বার করে আনা হল, তার মধ্যে একটা আর কার, সেই মানিকের! ছেলেটা তো এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে মোম চুরি করে বেড়াচ্ছিল, কখন ও ফিরে গেল বস্তির মধ্যে? ও কি একসঙ্গে সব কটা মোমবাতি জ্বেলে উৎসব করছিল?

    এই অপ্রীতিকর দৃশ্য অভিজিৎ তার স্ত্রীকে দেখাতে চায় না। সে বলল, চলো, এবার ভেতরে যাই!

    মালবিকা যেন সে কথা শুনতেই পেল না, রণদেবকে বলল, তুমি গিয়ে একবার দেখে আসবে, ছেলেটা এখনও বেঁচে আছে কি না?

    ভিড় ঠেলে রণদেব গেল অ্যাম্বুলেন্সের কাছে, আবার ফিরে এল। তাকে কিছু বলতে হল না, তার মুখ দেখেই বুঝতে পারল মালবিকা। রিক্ত গলায় বলল, বেঁচে নেই!

    তারপর ফিসফিস করে শুধু নিজেকে শোনাবার জন্যই বলল, ও আমার সামনে হাত বাড়িয়ে ছিল, আমি ওকে দিইনি।

    রণদেব বুঝতে পারল, মালবিকা আজ রাত্রে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদবে। ছেলেবেলায় ধরা-পড়ে একদিন যেরকম কেঁদেছিল।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমেয়েদের ভয়
    Next Article ময়নার বোন

    Related Articles

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }