Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌহকপাট – জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)

    জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) এক পাতা গল্প980 Mins Read0

    লৌহকপাট – ১.১৫

    পনেরো

    রবিবার। বিকেল চারটা বেজে পঁয়ত্রিশ। সদলবলে ফাইল দেখছি। লাল-ফিতে-বাঁধা কাগজের ফাইল নয়; আইনের শিকলে বাঁধা মানুষের ফাইল। কিন্তু মানুষের প্রাথমিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। সজ্জন-সমাজ তাকে বর্জন করেছে, তার মানবতার দাবিকে করেছে প্রত্যাখ্যান। সংসারের সহজ এবং প্রকাশ্য পথ থেকে স্খলিত হয়ে তারা এসেছে দলে দলে, অন্ধকার পিচ্ছিল পথ ধরে। ললাটে মুদ্রিত অপরাধীর পঙ্ক-তিলক। সেই সব মানুষের ফাইল দেখছি।

    একপাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ লাইনটা একবার দেখে নিলাম। পরনে জাঙ্গিয়া কুর্তা, কোমরে বাঁধা গামছা, মাথায় টুপি, বাঁ হাতে টিকিট, ডান হাতটা ঝুলে আছে দেহের পাশ দিয়ে। বুকের উপর আঁটা অ্যালুমিনিয়ামের চাকতি। সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ইণ্ডিয়ান পিনাল কোডের এক-একটি জীবন্ত ধারা। ৩৭৯, তার পাশে ৩০২, তারই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ৪২০ কিংবা ৩৯৫—খুনী, তস্কর, নারীমেধভুক, দস্যু, প্রতারক, পকেট-কর্তকের বিচিত্র সমাবেশ। কিন্তু আমার চোখে সে বৈচিত্র্য অর্থহীন। ‘এখানে আসিলে সকলেই সমান।’ আমার কাছে রামের সঙ্গে শ্যামের যে তফাত সে শুধু নম্বরের। রাম ৭৫৭, শ্যাম ১১০৪। তাদের অপরাধের বিবরণ আমি জানি না; জানি না তাদের প্রাক-কারাজীবনের কোন ইতিবৃত্ত। একথা আমার জানা নেই, রাম বলে যে লোকটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে, সে তার প্রতিবেশীর হাঁড়ি থেকে চুরি করেছিল একবাটি পান্তা ভাত, আর তার পাশে যে শ্যাম, সে তার প্রতিবেশীর আট বছরের মেয়ের বুকে ছুরি বসিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছে দেড়ভরি ওজনের সোনার হার। আমার কাছে তাদের একমাত্র পরিচয়—কয়েদী। এইটুকু মাত্র জেনেই আমি তাদের ‘রিফর্ম’ করবার ভার নিয়েছি।

    আমার কয়েদীবাহিনীর মনের খবর আমি রাখি না। তাই সবার উপরে আমার সমদৃষ্টি, সকলের প্রতি আমার সম আচরণ। একটা মানুষের সঙ্গে আর একটা মানুষের যে দুস্তর ব্যবধান, আমাদের শাস্ত্র একথা মানে। তার মতে রাম ও শ্যাম এক ও অভিন্ন। আহারে, বিহারে, কর্মে, অবসরে, শাসন ও শৃঙ্খলার একই সূত্রে গাঁথা। মুড়ি এবং মিছরি একই পাত্রে রেখে একই ডিসিপ্লিনের পেষণ-যন্ত্রে আমি তাদের গুঁড়িয়ে চলেছি। যে বস্তু তৈরি হচ্ছে, তার স্বাদ, গন্ধ, অথবা বর্ণ সম্বন্ধে আমি নির্বিকার।

    বর্তমানে আমি যে কার্যে রত, তার নাম সাপ্তাহিক ‘ফাইল’ পরিদর্শন। জানতে এসেছি কার কি অভিযোগ, কার কি নিবেদন; যদিও জানি, সত্যিকার অভিযোগ যদি কিছু থাকে, আমার কাছে তা অনুক্তই থেকে যাবে। কেননা, যাদের সম্বন্ধে অভিযোগ, আমারই পেছনে চলেছে তাদের দীর্ঘ প্রসেশন।

    —নালিশ আছে বাবু—

    প্রসেশন থেমে গেল।

    —কি নালিশ?

    বক্তা বোধ হয় সত্তরের গণ্ডি পার হয়ে গেছে। ঝুঁকে, কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে কোনো রকমে ফাইলের শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। টিকিটখানা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দ্যাখ তো বাবু, বয়স কত লিখেছে? তার পাশে যে কয়েদীটি দাঁড়িয়ে, দেখে মনে হয়, প্রায় একই বয়সী, তার টিকিটখানাও টেনে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল, আর এটাও দ্যাখ।

    কণ্ঠে উত্তেজনার আভাস।

    বললাম, ব্যাপার কি, বল দিকিনি?

    —বলছি। বয়সটা আগে দ্যাখ।

    সঙ্গে সঙ্গে অধীর প্রশ্ন—কি লেখা আছে?

    এসব বেয়াদপি অসহ্য হল চীফ জমাদারের। খেঁকিয়ে উঠে কি একটা বলতে যাচ্ছিল। ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললাম বুড়োর দিকে তাকিয়ে, তোমার বয়স তো দেখছি ৭২ আর ওর ৬৫।

    —তাহলে তো ‘আইটার বাবু’* ঠিকই বলেছে। কিন্তু এ তোমাদের কি রকম বিচার বাবু? আমার ছেলের চেয়ে আমি মোটে সাত বছরের বড়?

    [* কথাটি “রাইটার” (Writer) অর্থাৎ যে সব লেখাপড়া-জানা কয়েদী এদের চিঠিপত্র দরখাস্ত ইত্যাদি লিখিবার জন্য নিযুক্ত।]

    —এ লোকটি তোমার ছেলে?

    —আমার ছেলে না তো পাড়ার লোকের ছেলে?

    এবার উত্তেজনা চাপা রইল না। পাশের লোকের বিনীত কণ্ঠ বলল, হাঁ, হুজুর, উনি আমার বাপ। বয়স হয়েছে কিনা; মেজাজটা তাই একটু—

    —তুই থাম—গর্জে উঠল বুড়ো। জেল খাটতে এসেছি বলে, যাকে জন্ম দিলাম, তাকে ছেলে বলতে পারব না?

    নরম সুরে বললাম, না, না। কে বললে, পারবে না? ওটা আমাদেরই ভুল হয়েছে। ডাক্তারের দিকে তাকালাম। বেচারার বিশেষ দোষ নেই। বয়স নির্ধারণের ডাক্তারি প্রক্রিয়া কি আছে, জানি না। তবে এরা যে পিতাপুত্র, কেবলমাত্র চোখে দেখে একথা বলতে হলে রীতিমত দিব্যজ্ঞান থাকা দরকার। টিকিট দু-খানা ডাক্তারের হাতে দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, তিনি চাপা গলায় বলছেন, তুমি যে এই কচি খোকাটির বাপ, আগে বললেই পারতে।

    বৃদ্ধের সুর চড়া—আমি আবার কি বলবো? তোমার আক্কেল নেই?

    ‘নালিশের’ বিষয়বস্তু বেশির ভাগই চিঠি। সাধারণ কয়েদী চিঠি লিখতে পারে দু-মাস অন্তর একখানা। বাইরে থেকে যে চিঠি আসে তাদের নামে, তারও একটার থেকে আর একটার ব্যবধান—দু-মাস। ডেপুটিবাবুরা টিকিট দেখে তারিখ গুনে গুনে চিঠি মঞ্জুর করে চলেছেন।

    —একটা পিটিশান চাই, হুজুর, আবেদন জানাল এক ছোকরা। নাম পানাউল্লা।

    -তোর আবার কিসের পিটিশান?

    আশপাশে ছোকরা-মত যারা দাঁড়িয়ে ছিল সবারই মুখে দেখলাম চাপা হাসি। পানাউল্লা একটু ইতস্তত করে বলল, চাচা লিখেছে, বৌ নাকি নিকা বসতে চায়।

    আমি কিছু বলার আগেই জবাব দিলেন আমার ডেপুটি খালেক সাহেব, নিকা বসবে না তো কি করবে? তুমি মেহেরবানি করে সাত বছর জেলে পচবে, আর কচি বৌটা তোমার পথ চেয়ে বসে থাকবে, না?

    পানাউল্লা কিছুমাত্র দমে গেল না। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, নিকা বসতে চায়, বসুক। কিন্তু ঐ গয়জদ্দি ছাড়া কি মানুষ নেই দেশে? আমি যদ্দিন ছিলাম, তখন তো ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেখিনি। নেড়িকুত্তার মত ন্যাজ গুটিয়ে বেড়াত। আজ আমি নেই বলে—

    তার চোখ দুটো জ্বলে উঠল হিংস্র পশুর চোখের মত। বুঝলাম, পানাউল্লাকে যে বস্তু বিচলিত করেছে, সেটা আসন্ন পত্নী-বিচ্ছেদের আশঙ্কা নয়, তার চেয়েও গভীর এবং জটিলতর। দরখাস্ত মঞ্জুর করতে হল। তবু একবার জিজ্ঞেস করলাম, পিটিশান করে এ- নিকা তুই ঠেকাবি কি করে?

    —নিকা ঠেকাতে চাই না, বলল পানাউল্লা, বছির দারোগাকে খালি জানিয়ে দেবো, পানাউল্লা সারা জীবন জেলে থাকবে না। ছাড়া একদিন সে পাবেই।

    এর পর যেসব পিটিশনের আবেদন পেলাম, তার মধ্যে কোন নতুনত্ব নেই। বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র না খেয়ে মরছে, শত্রুপক্ষীয় লোকেরা অত্যাচার করছে, জমিদার খাজনার দাবিতে বাড়িঘর নিলামে চড়িয়েছে, প্রতিকার চাই। এই একই ক্লান্তিকর কাহিনী শুনে আসছি বছরের পর বছর, যেদিন থেকে এই চাপরাস কাঁধে নিয়েছিলাম। প্রথম জীবনে মনটা উত্তেজিত হয়ে উঠত। নির্বিচারে দরখাস্ত মঞ্জুর করতাম; গরম গরম নোট লিখতাম তার উল্টো পিঠে, জাগাতে চেষ্টা করতাম নিষ্প্রাণ কর্তৃপক্ষের নিদ্রাগত কর্তব্যবোধ। মনকে বোঝাতে চাইতাম, প্রতিকার একটা হবেই, যদিও কী সেই প্রতিকার, তার সঠিক চেহারাটা নিজের কাছেও কোনদিন স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। আজ আর এই দুঃখের কাহিনী মনকে স্পর্শ করে না। তবু যন্ত্রের মত দরখাস্ত মঞ্জুর করি। কিন্তু তার ফলাফল সম্বন্ধে আর কোন মিথ্যা ধারণা পোষণ করি না।

    বড় বড় মামলার সুদীর্ঘ শুনানির পর সুবিজ্ঞ বিচারক যখন অপরাধীকে সাত, আট, দশ কিংবা বিশ বছরের জন্যে জেলে পাঠিয়ে দেন, আমরা অর্থাৎ সৎ, শিষ্ট এবং ভদ্র ব্যক্তিরা নিশ্চিন্ত হই, জজসাহেব আত্মপ্রসাদ লাভ করেন, খবরের কাগজের সম্পাদকীয় স্তম্ভে তাঁর ন্যায়বিচারের গুণকীর্তন ধ্বনিত হয়। কিন্তু একথা বোধ হয় তিনি জানেন না, আমরাও ভেবে দেখিনি—এই কঠোর দণ্ডটা ভোগ করে কে? লোকটা জেলে গেল ঠিকই। এই জেলে যাওয়ার মধ্যে যে দুঃখ আছে, লজ্জা আছে, সাংসারিক ক্ষয়-ক্ষতি আছে এবং তার চেয়েও বেশি আছে অসম্মান ও অপযশ তাকে আমি ছোট করে দেখছি না। স্বাধীনতা- হীনতা এবং প্রিয়জন-বিচ্ছেদের যে বেদনা সদ্য-কারাগতের দৈনন্দিন জীবন ভারাতুর করে তোলে, তার সম্বন্ধেও আমি সচেতন। কিন্তু শুধু এই কারণে যতখানি আহা-উহু আমরা বন্দীর উদ্দেশে নিক্ষেপ করে থাকি, ঠিক ততখানি বোধ হয় তার প্রাপ্য নয়। নিজের চোখেই দেখেছি, যত দিন যায়, মহাকালের হস্তস্পর্শে মিলিয়ে আসে তার মনের ক্ষত, জুড়িয়ে আসে লজ্জা আর অপমানের গ্লানি, স্তিমিত হয়ে আসে প্রিয়-বিচ্ছেদের তীব্রতা। দুঃসহ দিন সহনীয় হয়ে আসে। অনভ্যস্ত জীবনের অসংখ্য ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং অস্বাচ্ছন্দ্যের তীক্ষ্ণ ধারগুলো আর খচখচ করে বেঁধে না। ধীরে ধীরে এই বন্দী-জীবনের সঙ্গবহুল নতুন পরিবেশের মধ্যে গড়ে ওঠে এক নতুন সমাজ; স্বধর্মী, সহকর্মী, সহযাত্রীদের জড়িয়ে নিত্য-নবজাত অলক্ষ্য আকর্ষণ। সঙ্গী থেকে বন্ধু, বান্ধব থেকে আত্মজন।

    আরো দিন যায়। ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসে গৃহের স্মৃতি, শিথিল হয়ে আসে বহির্জগতের আকর্ষণ। তারপর একদিন আসে, যখন জেলের এই কঠোর রূপটা তার চোখে বদলে যায়। এই সংকীর্ণ জগতের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনধারার মধ্যে সে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়। কদাচিৎ মনে পড়ে, এ তার গৃহ নয়, কারাবাস।

    কিন্তু তাই বলে বিচারালয় থেকে যে দণ্ড সে বহন করে এনেছিল, সেটা কি নিষ্ফল হবে? না। শুধু তার লক্ষ্যস্থল বদলে যায়। সে দণ্ড ভোগ করে কতগুলো নারী ও শিশু, দণ্ডিত আসামীর উপর একদিন যারা ছিল একান্ত-নির্ভর এবং যাদের পথের প্রান্তে বসিয়ে রেখে সে এই জেলের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। সে-দরজা পার হতে না হতেই নিজের জন্যে পেল সে অন্নবস্ত্রের নিশ্চয়তা, পেল নতুন সমাজ, নতুন বন্ধন, আর তার কারাদণ্ডের সমস্ত কঠোরতা রয়ে গেল তার পরিত্যক্ত প্রিয়জনের জন্যে। জেলে যে আসে সে তার শেষ সম্বল নিঃশেষ করেই আসে।

    জানি, এর ব্যতিক্রম আছে। সুযোগ ও সুবিধা বুঝে মাঝে মাঝে কারাবরণের ব্যবসা করেন যাঁরা, তাঁরা আলাদা জীব। তাঁদের কথা আমি তুলছি না। তাদের কথাও বলছি না, যারা আমার আপনার এবং অন্য দশজন রাম-শ্যাম-যদুর বহু-দুঃখার্জিত সঞ্চয়টুকু বন্ধুবেশে আহরণ করে, ব্যাঙ্ক কিংবা লিমিটেড কোম্পানির নামে সাততলা এমারত গড়ে লালদীঘির কোণে; তারপর হঠাৎ একদিন সেই ভবনশীর্ষে একটি লালবাতি জ্বালিয়ে রেখে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, কখনো কখনো বা ছিটকে এসে পড়ে আমার এই অতিথিশালায়। স্ত্রীর বেনামীতে রেখে আসে লেক অঞ্চলে বিশাল প্রাসাদ, সেই সঙ্গে মোটা অঙ্কের পাশ-বই, আর নিজের জন্যে সংগ্রহ করে আনে একখানা উচ্চশ্রেণীর প্রবেশপত্র। সেই সব ভাগ্যবান্ ‘ডিভিশন্ বাবু’ আমার লক্ষ্য নয়। জেলের অরণ্যে তারা মুষ্টিমেয় অতিবিরল বকুল কিংবা কৃষ্ণচূড়া।

    আমি বলছিলাম, সেই সব শ্যাওড়া কচু, ঘেঁটু আর বনতুলসীর কথা, সংখ্যায় যারা শতকরা আটানব্বই। প্রতিদিন দলে দলে এসে তারা ভিড় করছে আমার এই তৃতীয় ডিভিশনের লঙ্গরখানায়। এখানে আসবার আগে থানা থেকে হাইকোর্ট পর্যন্ত মামলা লড়েছে কোমর বেঁধে, উকিলের ঘরে পাঠিয়েছে বাক্স-প্যাঁটরা, ঘটি-বাটি আর স্ত্রীর হাতের শেষ অলংকার, মহাজনের গদিতে তুলে দিয়েছে ক্ষুধার্ত পরিবারের একমাত্র সম্বল— দু-চারবিঘা ধানের জমি, জমিদারের কবলে নিক্ষেপ করেছে বাপ-পিতামহের ভিটা মাটি, আর বৃদ্ধা মাতা, যুবতী স্ত্রী এবং শিশুসন্তানের জন্যে রেখে এসেছে কলঙ্ক, অনশন আর লাঞ্ছনা।

    কোর্ট যে শাস্তি দেন আইনের ভাষায় তার নাম rigorous imprisonment, তার imprisonment অংশটাই শুধু পড়ে আমার কয়েদীর ভাগে, আর rigour বহন করবার জন্যে রইল তার বর্জিত আশ্রিত দল।

    প্রতি রবিবার ভোর না হতেই সেই সব পিছনে ফেলে-আসা নারী ও শিশুর ভিড় জমে ওঠে আমার এই জেল-গেটের সামনেকার মাঠে। আমি আমার দোতলার বারান্দায় বসে তাদের দেখতে পাই। অসহায়, উদ্‌ভ্রান্ত দৃষ্টি; মুখে নেই গৃহস্থের শ্যামল শ্রী। একদল ছন্নছাড়া যাযাবর। বিকেল চারটা বাজতেই শুরু হয় মোলাকাত। ছিন্নবসনা স্ত্রী এসে দাঁড়ায় ইন্টারভিউ জানালায় লোহার গরাদে-দেওয়া বেষ্টনীর বাইরে। তাকে ঘিরে দাঁড়ায় একদল ছোট ছোট উলঙ্গ কঙ্কাল। কোটরগত চোখের জলে অনশনক্ষীণ কণ্ঠ মিলিয়ে কয়েদী- স্বামীর কাছে বলে যায় তার একটানা দুর্দশার কাহিনী—ছোট ছেলেটা গেল একদিনের জ্বরে; না পেল ওষুধ না জুটল পথ্য; সেয়ানা মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেছে আজগর মুন্সীর ভাইপো; বড়ছেলেটা মাসখানেক হল উধাও; বাকীগুলো আগোপণ্ড; বুড়ী এখনো মরেনি; জমিদারের পাইক দু-বেলা শাসিয়ে যাচ্ছে মাস গেলেই ভিটে ছেড়ে দিতে হবে।

    আমি আর কি করবো? জানলার এ-ধার থেকে উদাস কণ্ঠে জবাব দেয় স্বামী। দেহে তার পরিচ্ছন্ন জেলের পোশাক। সর্বাঙ্গে স্বাস্থ্যের জলুস, মুখে দার্শনিক গাম্ভীর্য।

    এমনি করে বছর কেটে যায়। মাঝে মাঝে এসে ঐখানে দাঁড়িয়ে ঐ একই কাহিনী শুনিয়ে যায় স্ত্রী। তারপর আর আসে না তার হাড়সর্বস্ব ছেলের পাল নিয়ে। কে জানে, তার কি হল? বেঁচে আছে কিনা, সে খবর দিয়েই বা কার কি প্রয়োজন?

    দণ্ডদাতা দণ্ড দিয়েই খালাস। তাঁর কি এসে যায় কোথায় গিয়ে পড়ল তার উদ্যত মুষল, নির্মূল হয়ে গেল কোন্ সাজানো সংসার, নিস্তব্ধ হয়ে গেল কার কোলাহলমুখর গৃহ-প্রাঙ্গণ?

    দিন যায়। দীর্ঘ দণ্ডকাল শেষ হয়। যে লৌহতোরণের প্রসারিত বাহু দণ্ডিত বন্দীকে নিঃশব্দে গ্রহণ করেছিল, সে-ই তাকে সশব্দে বর্জন করে। তার বুক কেঁপে ওঠে। পাদুটো আড়ষ্ট হয়ে যায়। কোথায় এলাম? এ কোন্ দেশ? ঐ যে অবিশ্রান্ত জলস্রোতের মত বয়ে চলেছে জনপ্রবাহ, কোনোদিকে তাকিয়ে দেখবার অবসর নেই, কিসের টানে কোথায় চলেছে তারা? এক পাশে দাঁড়িয়ে বিস্ময়-বিহ্বল দৃষ্টি মেলে সে চেয়ে থাকে ঐ মোহাবিষ্ট জনতার দিকে। দশ বারো পনেরো বছর এ বস্তু সে দেখেনি। সে ভুলে গেছে জীবন-যুদ্ধের তাড়না। ভুলে গেছে, এই যে অগণিত মানুষ উদয়াস্ত কাজ করে যাচ্ছে, এদের চোখের সামনে রয়েছে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, সমৃদ্ধি, সম্মান আর স্বাচ্ছন্দ্য চাই; শুধু নিজের জন্যে নয়, প্রিয়জনের জন্যে। সেই আশায় মোহ তাদের অন্ধবেগে চালিয়ে নিয়ে চলেছে। প্রতিদিন নতুন করে যুগিয়ে যাচ্ছে কর্মপ্রেরণা। অক্ষুণ্ণ রেখেছে সতত-ক্ষীয়মাণ প্রাণ-শক্তি। এই মোহাবেশের উন্মাদনা সে পায়নি তার দশ বছরের বন্দীজীবনে; অনুভব করেনি আত্মজনের জন্যে আত্মপীড়নের আনন্দ। অন্নবস্ত্র-আশ্রয়ের ভাবনা তাকে ভাবতে হয়নি। সে-সব দিয়েছেন সদাশয় সরকার, আর সেই সঙ্গে দিয়েছেন প্রিয়জনের দায় এবং দুশ্চিন্তা থেকে পূর্ণমুক্তি। তাকে কাজ করতে হয়েছে, কিন্তু কাজ করে খেতে হয়নি। সে তো কাজ নয়, শুধু হস্ত-পদ-সঞ্চালন। তার মধ্যে না ছিল প্ৰাণ, না ছিল প্রেরণা। জেলের কারখানায় সে ছিল একটা সজীব যন্ত্র—যে যন্ত্র সে চালাত, তারই একটা বৃহৎ অংশ।

    এই চলমান জনস্রোতের পাশে দাঁড়িয়ে দশ বছরের কুয়াশার আবরণ ভেদ করে সে দৃষ্টি পাঠাল পেছনের দিকে একদা যেখানে ছিল তার গৃহ। প্রাণপূর্ণ স্নেহনীড়। মনে পড়ল সব; মনে পড়ল সবাইকে। কিন্তু বুকের ভিতরটা টনটন করে উঠল না। মমত্ববোধ চলে গেছে, অসাড় হয়ে গেছে দায়িত্বের অনুভূতি। বুকে হাত দিয়ে দেখল। হাতে ঠেকল একটা শুষ্ক নিরেট মরুভূমি। শ্রদ্ধা, প্রীতি, ভালবাসার কোনো ক্ষীণ ফল্গুধারাও বইছে না তার অস্তস্তলে।

    পাশে এসে দাঁড়াল এক সদ্য-আহরিত কারাবন্ধু। তিন মাস জেল খেটে আজ খালাস পেয়েছে একই সঙ্গে। বলল, এখানে দাঁড়িয়ে যে? বাড়ি যাবে না?

    —বাড়ি! শ্লেষবিকৃত কণ্ঠে এল উত্তর। ঠোটের উপর ফুটে উঠল এক অদ্ভুত ব্যঙ্গ- হাসির কুঞ্চন-রেখা।

    —নাও, বিড়ি খাও, এগিয়ে এসে হাত বাড়াল নতুন বন্ধু।

    সেদিকে না তাকিয়েই বিড়িটা সে হাত পেতে নিল, ধরাল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে ঔদাস্যভরে ধোঁয়া ছাড়ল কয়েকবার, তারপর পা চালিয়ে দিল যেদিকে দু-চোখ যায়, মিশে গেল জনারণ্যের অন্তরালে।

    ফাইলের পরেই কেস টেবল (case table), সেন্ট্রাল টাওয়ারের নীচে খোলা প্রাঙ্গণে আমার বৈকালিক অফিসের এক টুকরো। এই টেবিলে বসেই প্রতি সন্ধ্যায় আমি কেস লিখি কয়েদীর টিকিটে। হরেক রকমের কেস। কারো কম্বলের ভাঁজে পাওয়া গেছে দু-খানা তামাকপাতা আর এক ডিবা চুন; কারো “খাটনি” অর্থাৎ দৈনিক task পুরো হয়নি, এক মণ ছোলা ভেঙে ডাল করবার কথা, ভেঙেছে ছত্রিশ সের বারো ছটাক; কেউ “চৌকা” থেকে লুকিয়ে এনেছে পেঁয়াজ আর তিনটা লঙ্কা; কিংবা গামছার বিনিময়ে হাসপাতালের মেট-সাহেবের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে আধসের দুধ আর এক ছটাক চিনি।

    এইসব এবং এর চেয়েও গুরুতর কেসের তদন্ত করি, রিপোর্ট লিখি টিকিটের পাতায়, এবং পরদিন সকালবেলা আলামত-সহ অপরাধীদের হাজির করে দিই সুপারের দরবারে। আর একদফা শুনানির পর তিনি বিচার শেষ করেন। কাউকে দেন ডাণ্ডাবেড়ি, কাউকে হাতকড়া, কাউকে বা পরতে হয় চটের কাপড় কিংবা সেলে বসে খেতে হয় চালের গুঁড়োর মণ্ড, আইনের ভাষায় যার নাম penal diet ।

    “ফেকু গোয়ালা”—–দরাজ গলায় হাঁক দিল বড় জমাদার। একটা লোকের হাত ধরে নিয়ে এল “আমদানীর” মেট। আমার টেবিলের সামনে দাঁড় করাতেই গর্জে উঠল জমাদারের দ্বিতীয় হুকুম—সেলাম করো।

    দেখলাম, চোখ দুটো তার জবাফুলের মত লাল, ফুলেও উঠেছে অনেকখানি, আর জল ঝরছে অবিরাম।

    —ও কি! চোখে কি হল?

    —চুন লাগায়া আউর কেয়া? জবাব দিল জমাদার।

    —কিরে, চুন লাগিয়েছিস চোখে?

    —নেহি, হুজুর।

    -চোখ লাল হল কি করে?

    -বেমার হুয়া —বলে মুচকে হাসল।

    দুজন সহকর্মী সাক্ষী বলে গেল, দেয়াল থেকে চুনবালি নিয়ে ও ঘষে দিয়েছে চোখের মধ্যে, নিজের চোখে দেখেছে তারা। বলছে হাসপাতাল যাবো।

    টিকিট উলটে দেখলাম, কয়েকমাস আগে খানিকটা সাবান না সাজিমাটি খেয়ে, আমাশা বাধিয়ে আর একবার পনেরো দিন পড়ে ছিল হাসপাতালে। ধমক দিয়ে বললাম, চোখে চুন দিয়েছিস কেন?

    —বারো সের গহুঁ পিষণে নেহি সত্তা।

    —নেহি সতা! আব্দার পেয়েছ?

    টিকিটের পাতা খুলে দেখলাম ডাক্তারের নোট রয়েছে—হেল্থ—গুড, লেবার হার্ড। জেলকোডের বিধানে এ হেন ব্যক্তির গম-পেষণের দৈনিক বরাদ্দ বারো সের। অতএব রিপোর্ট করতে হল। কিন্তু চোখে চুন দেওয়া তার একেবারে ব্যর্থ হল না। আপাতত কিছুদিন হাসপাতালে আশ্রয় মিলবে। ফিরে এসে হাজির হবে বড় সাহেবের কাছে।

    সকলের শেষে যাকে আনা হল, একটি সতেরো-আঠারো বছরের ছেলে। মুখের দিকে তাকালে চোখ ফিরিয়ে নিতে সময় লাগে। গৌরবর্ণ দীর্ঘদেহ আর অনিন্দ্য মুখশ্রী বলে নয়, সে মুখের প্রতি রেখায়, কপালে, ওষ্ঠে, চিবুকের বন্ধনীতে একটা সুস্পষ্ট আভিজাত্যের ছাপ, জেলখানায় সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এ কোত্থেকে এল? ঝগড়াঝাঁটি করে, কিংবা খুন-জখম করেও কখনো কখনো এসে থাকে দু-চারটি বড়ঘরের ছেলে কিন্তু এর অপরাধ দেখছি চুরি। ৩৭৯ ধারায় ছ মাস জেল।

    একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। চমক ভাঙল জমাদারের গর্জনে—এক নম্বর হারামী, হুজুর। ফাইল পর কভি নেহি আয়গা।

    জিজ্ঞেস করলাম, কেন, ফাইলে আসনি কেন?

    —ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, স্যর।

    কথাটা বিশ্বাস হল না। মনে হল, আসল কারণ ঘুম নয়। বোধ হয় সবার সঙ্গে পংক্তিভুক্ত হয়ে দাঁড়াবার লজ্জাটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

    তোমার নাম কি?

    —পরিমল ঘোষ।

    —বাবার নাম?

    —ঐ টিকিটেই লেখা আছে, স্যর।

    রুক্ষ স্বরে বললাম, জানি। তবু তোমার কাছ থেকেই শুনতে চাই।

    ছেলেটা এক মিনিট ভাবল, তারপর বলল, বিজয়গোপাল ঘোষ।

    এ কোন্ বিজয়গোপাল? এক নামের কত লোকই তো দেখা যায়। কিংবা একি আমাদের সেই বিজয়ের ছেলে? জমাদারকে বললাম, উসকো অফিসমে লে যানা।

    অফিসে এসে সহকর্মীদের কাছ থেকে যে সব তথ্য পেলাম, আমার সন্দেহ সমর্থিত হল। বিজয় আমার বন্ধু এবং সহপাঠী। এম. এ. আর ল পাশ করে প্রথমটা যেমনি হয় আলিপুর কোর্টে হাঁটাহাঁটি। তারপর হঠাৎ সরকারী চাকরি নিয়ে চলে গেল মফঃস্বলে। সেই থেকে ছাড়াছাড়ি। কার মুখে শুনেছিলাম কোন্ এক বিশাল বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করবার পর সে নাকি হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল তার আত্মীয়-বন্ধু-মহলের সংস্রব থেকে। সত্যি মিথ্যা জানি না। আমিও কোনোদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবার চেষ্টা করিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম একরকম। কে জানত এতকাল পরে এভাবে তাকে স্মরণ করতে হবে?

    আমার কলেজের একটা গ্রুপ ফটো বাসা থেকে আনিয়ে পরিমলের হাতে দিয়ে বললাম, দ্যাখ তো কাউকে চেন কিনা? সে চমকে উঠল, এ কি! এ ছবি আপনি কোথায় পেলেন? এর মধ্যে আমার বাবা আছেন।

    বললাম, তোমার বাবার ঠিক পাশের লোকটিকে চিনতে পারছ?

    —না তো।

    —ভালো করে দ্যাখ।

    বুদ্ধিমান ছেলে। আর একবার দেখে সলজ্জ হাসির সঙ্গে বলল, আপনি?

    বললাম, এখানে যেমন দেখছ, ঠিক এমনি একই সঙ্গে পাশাপাশি আমরা কাটিয়েছি আমাদের কলেজ-হস্টেলের ছটা বছর। বিজয় আর ঐ আমি বন্ধু এবং সহপাঠী। বাইরের সম্পর্ক এইটুকু। কিন্তু যে সম্পর্ক চোখে দেখা যায় না, সেটা শুধু আমরাই জানতাম। সেই বিজয়ের ছেলে তুমি! আজ এইখানে—

    ওর দিকে নজর পড়তেই কথাটা আর শেষ করা হল না। দাঁত দিয়ে ঠোট চেপে ধরে উদ্‌গত অশ্রু রোধ করবার সে কি আপ্রাণ চেষ্টা! কিন্তু একটিবার মাত্র আমার চোখের দিকে চেয়ে সে চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়ে গেল। দু’চোখের কোল ছাপিয়ে গড়িয়ে পড়ল জলধারা।

    আত্মীয়স্বজন যদি কেউ জেলে এসে পড়ে, সংশ্লিষ্ট জেলকর্মীকে সেটা কর্তৃপক্ষের গোচরে আনতে হবে—এটা জেল কোডের বিধান। আত্মীয়টিকে তখন অন্যত্র চালান দেবার ব্যবস্থা করতে হয়। পরিমল আমার আত্মীয় নয়, স্বজন বলতে যা বোঝায়, তাও নয়। তবু অনেক ভেবে ঐ আইনের আশ্রয় নিলাম। যাবার সময় সে বলল, এ ভালোই হল। আমিও ভাবছিলাম বলবো, আমাকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিন।

    হঠাৎ যেন ধাক্কা খেলাম। সেও আমাকে ছেড়ে যাবার জন্য ব্যস্ত! বললাম, কেন, তুমি যেতে চাইছিলে কেন?

    পরিমল উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। আমিও জবাবের জন্য পীড়াপীড়ি করলাম না। শুধু বললাম, যেখানেই থাক, একটা কথা আমার মনে রেখো। জেলের আইন-কানুনগুলো মেনে চলবার চেষ্টা কোরো। অনেক অনর্থক অসুবিধার হাত এড়াতে পারবে।

    মাস চার-পাঁচ কেটে গেল। তারপর একদিন সকালের ডাকে একটা মোটা খামের চিঠি পেলাম। অচেনা হাতের লেখা। শেষ পাতায় সকলের শেষে নাম রয়েছে— হতভাগ্য পরিমল। সে যে আমাকে চিঠি লিখবে ভাবতে পারিনি। আমাকে এড়িয়ে চলতেই সে চেয়েছিল, আর সেটাই তো তার পক্ষে স্বাভাবিক। কিন্তু সংসারের কটা ঘটনাই বা স্বভাবের নিয়মে ঘটে?

    চিঠিখানা আজ আমার হাতে নেই। সমস্ত যত্ন অগ্রাহ্য করে কোনো একটা বদলির হিড়িকে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। চিঠি নেই। তার প্রতি ছত্রের প্রতিটি কথা আমার মনে গাঁথা হয়ে আছে। কিন্তু তাকে বাইরে এনে রূপ দিতে পারি, এমন দিব্য শক্তি বিধাতা আমাকে দেননি। ফটোগ্রাফ যেমন চিত্র নয়, যে চিঠিটা এখানে তুলে দিলাম, সেটাও তেমনি পরিমলের চিঠি নয়। তার অবয়বটা হয়তো রইল, রইল না তার প্রাণস্পন্দন। কতদিন হয়ে গেল, তবু সেই হারিয়ে-যাওয়া চিঠির অবলুপ্ত অক্ষরের বুকের ভিতর থেকে আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি—

    কাকাবাবু,

    আপনার শেষ উপদেশ আমি এতদিন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। কিন্তু আর পারলাম না। এই জেলে আসবার পর এই চিঠিই আইন-ভঙ্গের প্রথম অপরাধ। সে অপরাধ কেন করেছি, কেন প্রকাশ্য রাস্তায় না গিয়ে গোপন পথের আশ্রয় নিলাম, এ চিঠিটা শেষ পর্যন্ত পড়লেই বুঝতে পারবেন।

    আমার এই চিঠি পেয়ে আপনি বিরক্ত হবেন কিনা জানি না, বিস্মিত হবেন নিশ্চয়। যার চোখের সামনে থেকে পালিয়ে আসবার জন্যে একদিন অস্থির হয়ে উঠেছিলাম, আজ তাকেই আবার এ দীর্ঘ কাহিনী শোনাতে যাবো, একথা কি আমিও কোনদিন ভাবতে পেরেছিলাম? কিন্তু কি করবো? যাকে ভালবাসি তাকে আঘাত দেওয়াই বোধ হয় আমার কপালের লিখন। তাই পালিয়ে এসেও থাকতে পারলুম না। আমার হাত থেকে এখনো যে আপনার অনেক দুঃখ পাওনা আছে। এখনো যে আমার বলা হয়নি, কি করে কোন্ ঘোর দুর্যোগের দিনে এই নরকের পথে প্রথম পা বাড়িয়েছিলাম, এতবড় সর্বনাশ কেমন করে হল, অতবড় বাপের কঠিন আদর্শ কেন আমাকে রক্ষা করতে পারেনি।

    একথা জানি, সে কাহিনী যে শুনবে, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে। আমি ক্রিমিনাল। সংসারে আমার জন্যে দয়া নেই, ক্ষমা নেই, নেই কারো মনে এতটুকু সংবেদন। কিন্তু আপনাকে তো অন্য সবার সঙ্গে এক করে দেখতে পারি না। এখানে বসেই আমি যে আপনার বুকের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছি।

    যে জিনিস ওখানে সঞ্চিত হয়ে আছে এ হতভাগার জন্যে, একমাত্র বাবা ছাড়া আর কারো কাছেই তা পাইনি। তাই তো লিখতে বসে আজ আপনা হতেই এ মুখ থেকে বেরিয়ে এল—কাকাবাবু। আপনাকে কাকাবাবু বলে ডাকবার মত স্পর্ধা আমার হবে, এক মুহূর্ত আগেও ভাবতে পারিনি।

    আমার কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে আমার বাবার কথা। আপনাকে সেদিন বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। বাবা নেই। প্রায় আট মাস হল, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর এই অকালমৃত্যু যত বড় মর্মান্তিক হোক, একদিন হয়তো সইতে পারবো। কিন্তু যেভাবে, যে নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশা-লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে তিনি তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, এতবড় পাষণ্ড হয়েও এক নিমেষের তরে ভুলতে পারছি না। সে-কথা আমার কারো কাছেই বলবার উপায় নেই। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার মায়ের কথা—এমন কথা, যা উচ্চারণ করাও সন্তানের পক্ষে অপরাধ। সে শুধু রইল আমার বুকের মধ্যে। যতদিন বাঁচবো, সে বোঝা আমাকে একাই বয়ে বেড়াতে হবে।

    সেই ভয়ঙ্কর দিনটা আজও চোখের উপর ভাসছে। বাবা হাওড়ায় বদলি হয়ে এসেছেন। শিবপুরে একটা বাড়িতে আমরা থাকি। কিছুদিন আগে থেকেই তিনি “ব্লাড প্রেসার’-এ ভুগছিলেন। দারুণ সাংসারিক অশান্তি তাঁর উপর বিষের মত কাজ করছিল। মাঝে মাঝে এত বাড়াবাড়ি হত যে একনাগাড়ে পাঁচ-সাত দিন মাথা তুলতে পারতেন না। ছুটি নিলে সংসার চলে না। এই অবস্থাতেই তাঁকে কাজ করতে হত। সেদিনও কোর্টে বেরোবার আয়োজন করছিলেন। মা এসে বললেন, টাকার কদ্দূর হল? মাঝে আর তিনটি দিন বাকী। জিনিসটা দেখেশুনে কিনতে হবে তো।

    বাবা জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বললেন, অতো টাকা তো যোগাড় করতে পারছিনে। ধারও মিলছে না কোনোখানে।

    মা অবাক হয়ে বললেন, অতো টাকা মানে? অন্তত শ’পাঁচেক টাকা না হলে একটা চলনসই জড়োয়া নেকলেস হয় কি?

    একটু থেমে বললেন, পাঁচটা নয়, সাতটা নয়, ঐ একটা মায়ের পেটের বোন। তার প্রথম মেয়ের বিয়ে। না গিয়ে এড়ানো যাবে না। তা তোমার হাতে যখন পড়েছি, বল তো খালি হাতেই যাবো।

    বাবা টুপিটা তুলে নিয়ে ধীরে শান্ত কণ্ঠে বললেন, আর তো কোনো উপায় দেখছিনে। আপাতত সংসার খরচের টাকা থেকে শ’খানেক দিয়ে যাহোক একটা—

    “শ’খানেক!” মা একেবারে রুখে উঠলেন, “বলতে একটু বাধলো না? তোমার না হয় মান-ইজ্জতের বালাই নেই, কিন্তু একশ টাকার একটা জিনিস হাতে করে গেলে আমার বাবার মুখখানা কোথায় থাকে ভেবে দেখেছ?”

    আমি পাশের ঘরে স্কুলে যাবার আগে বই গোছাচ্ছিলাম। বাবার হঠাৎ নজর পড়তেই গম্ভীর গলায় বললেন, খোকা তুমি নিচে যাও। আমি তাঁর চোখের দিকে চেয়ে চমকে উঠলাম। এ কী চেহারা হয়েছে বাবার? বুঝলাম এই মুহূর্তে তাঁর শুয়ে পড়া দরকার। কিন্তু তাঁর কথার অবাধ্য কোনোদিনই হইনি। তাই কোনো কথা না বলে বই খাতা নিয়ে নিচে নেমে গেলাম। আমার পেছনে বাবাও নামতে লাগলেন। মার গলা শোনা গেল, টাকার বাবস্থা না করেই চলে যাচ্ছ যে?

    বাবা নিম্নস্বরে কি একটা বললেন। মার উত্তেজিত উত্তর নিচে থেকেই শুনতে পেলাম। রেগে গেলে মার জ্ঞান থাকত না, কি বলছেন আর কাকে বলছেন। যা বললেন, তার সবটা আমার কানে গেল না, যেটুকু গেল তাও বলবার মত নয়। সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ সিঁড়িতে একটা শব্দ শুনে ছুটে এলাম। দেখলাম বাবা পড়ে আছেন। কপালের একটা ধার কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। জ্ঞান নেই। চাপরাসী আর ঠাকুর- চাকরে মিলে ধরাধরি করে তাঁকে কোনো রকমে উপরে নিয়ে গেল। আমি ছুটলাম ডাক্তার ডাকতে। ঘন্টা দুই চেষ্টার পর জ্ঞান ফিরে এল। কিন্তু সমস্ত বাঁ অঙ্গটা অচল। তখনো বুঝিনি মুহূর্তমধ্যে কত বড় সর্বনাশ আমাদের ঘটে গেল। বাবা চিরদিনের তরে শয্যায় আশ্রয় নিলেন।

    মাসের প্রথম তারিখে সমস্ত মাইনেটা বাবা মার হাতে ধরে দিতেন। কিন্তু সেটা ছিল চৌদ্দ পনেরো দিনের খরচ। বাকি মাসটা যেভাবে চলত, আপনি অনুমান করুন। সামান্য পুঁজি যা ছিল, আগেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থাই সম্ভব হল না। বাবা প্রথমে কিছুদিন ছুটি পেলেন। তারপর নামমাত্র পেনসন দিয়ে সরকার তাঁকে একেবারেই ছুটি দিয়ে দিলেন। পেটের দায়ে তাঁকে তখন কত কি করতে হত। কখনো খবরের কাগজে প্রবন্ধ, কখনো আইনের বই-এর নোট লেখা। শুয়ে শুয়ে লিখতে পারতেন না। ডিকটেট করতেন, আমি ইস্কুলের ছুটির পর দু-ঘণ্টা করে রোজ লিখে দিতাম। তারপর যেতে হত প্রেসে। যা আসত, অতি সামান্যই।

    সে কী জীবন! গল্প শুনেছি, শিব বিষপান করে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন। দেবাদিদেবকে চোখে দেখা যায় না। আমি দেখেছি আমার বাবাকে। শিবের চেয়েও শান্ত; সর্বংসহা বসুমতীর চেয়েও সহিষ্ণু। এত বিষ, এত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর অপমান! উত্তরে একটা কথাও তাঁর মুখ থেকে কোনোদিন বার হতে শুনিনি। আমি অস্থির হয়ে উঠতাম। বাবা আমার মন বুঝতে পারতেন। কাছে ডেকে গায়ে হাত বুলিয়ে বলতেন, খোকা, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শেখা হল সইতে শেখা। একথা কোনোদিন ভুলো না।

    এই নিরবচ্ছিন্ন রোগশয্যায় আমিই ছিলাম তাঁর একমাত্র সঙ্গী। মাঝে মাঝে দু-একজন পুরনো সহকর্মী দেখা করতে আসতেন। মামুলী সান্ত্বনা দিয়ে চলে যেতেন। তার কোনোটাই বাবাকে স্পর্শ করত না। দূর ছাত্রজীবনের একটিমাত্র বন্ধু তাঁর সমস্ত অন্তর জুড়ে ছিলেন। কতদিন কতভাবে তিনি তাঁর কথা আমায় শুনিয়েছেন। তখন কি জানি, একদিন এমনিভাবে আমি তাঁর দেখা পাবো? সেই দেখা পেলাম, কিন্তু সময়ে পেলাম না কেন? যদি পেতাম, বাবাকে বোধ হয় এমন করে হারাতে হত না; আর আমিও আজ এই পাঁকের মধ্যে ছট্‌ফট করতাম না।

    এই সময়ে আমাদের সংসারে একটি নতুন মানুষের আবির্ভাব হল। মার কোন্ দূর সম্পর্কের দাদা। আমাদের মণীশ-মামা। শুনেছি মার যখন বিয়ে হয়নি, দাদামশাই তাঁর এই আত্মীয়টিকে একদিন তাঁর মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন : এতকাল পরে এই নিখুঁত সাহেবিপোশাক পরা ভদ্রলোক তাঁর একটা নতুন-কেনা টু-সীটার অস্টিন চড়ে যখন-তখন আমাদের বাড়ি চড়াও করে অতিশয় অন্তরঙ্গ হয়ে উঠলেন। তারপর একদিন এঁকে উপলক্ষ করেই দেখা দিল জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। সেই কথা বলেই এ চিঠি শেষ করবো।

    সেবার আমি ম্যাট্রিক দেবো। ইস্কুলে ভালো ছেলে ছিলাম। বাবার একান্ত ইচ্ছা প্রথম দশজনের মধ্যে যেন দাঁড়াতে পারি। পাছে তাঁকে দুঃখ দিতে হয়, তাই পড়াশুনোয় কোনোদিন অবহেলা করিনি। সেদিনও নিজের ঘরে বসে জিওমেট্রি মুখস্থ করছিলাম। রাত প্রায় এগারোটা। পাশের ঘরে বাবা। শরীরটা আবার কদিন থেকে খারাপ যাচ্ছে। গোবিন্দ তাঁর পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। অনেক দিনের পুরনো এই চাকরটি তখনো আমাদের ছেড়ে যায়নি। রান্নাবান্না থেকে বাবার দেখাশোনা সবই ওর হাতে। বাড়ির সামনে মোটর থামবার পরিচিত শব্দ শোনা গেল। গোবিন্দ উঠে গেল দরজা খুলতে। তারপরেই দেখলাম মণীশ-মামা উপরে উঠছেন। বারান্দা পেরিয়ে সোজা বাবার ঘরে ঢুকলেন এবং সাবধানে একটা চেয়ারে বসে বললেন, বিজয়বাবু, ঘুমুলেন নাকি?

    বাবার বোধ হয় তন্দ্রা এসেছিল। একটু চমকে উঠে বললেন, কে?

    —আমি মণীশ।

    -ও, কি বলুন?

    মামা একটু কেশে নিয়ে বললেন, বলছিলাম, সুরমার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। একটা কোথাও চেঞ্জে-টেঞ্জে যাওয়া দরকার।

    বাবা শান্তভাবেই বললেন, কোনো অসুখ করেছে কি?

    —না, অসুখ তেমন কিছু নয়। এই বাড়ির আবহাওয়াটা তেমন সহ্য হচ্ছে না।

    —কিন্তু চেঞ্জে পাঠাবার মত টাকা তো আমার নেই।

    —টাকার জন্যে আপনাকে ভাবতে হবে না। ওটা আমিই ম্যানেজ করবো। সুরমার ইচ্ছা পরিমলও সঙ্গে যায়। ওর পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়তে চাই। একটা বাড়ি- টাড়ি তাহলে এখন থেকেই দেখতে হয়।

    বাবা একটুখানি চুপ করে থেকে বললেন, আপনারা স্বচ্ছন্দে যেতে পারেন। পরিমলের যাওয়া হবে না।

    —কেন হবে না, জানতে পারি কি? প্রশ্ন করলেন মা। কখন এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, দেখতে পাইনি। বাবাও বোধ হয় টের পাননি। সেদিকে একবার তাকিয়ে বাবা বললেন, সে আলোচনা করে লাভ নেই। ওকে আমি যেতে দিতে পারি না।

    মা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, চব্বিশ ঘণ্টা রুগী ঘেঁটে ঘেঁটে ওর অবস্থাটা কি হয়েছে দেখতে পাচ্ছ? আমার চোখের সামনে আমার ছেলেটাকে তুমি মেরে ফেলতে চাও?

    বাবা আস্তে আস্তে বললেন, মণীশবাবু আমাকে মাপ করবেন, রাত বোধ হয় অনেক হল। এবার একটু ঘুমোতে চাই।

    মণীশ-মামা কিছু বলবার আগেই মা চেঁচিয়ে উঠলেন, ও সব ভড়ং রেখে দাও। আমার ছেলে আমি যেখানে খুশি নিয়ে যাবো। দেখি তুমি কেমন করে বাধা দাও।

    মণীশবাবু বললেন, আমার মনে হয়, আপনি অন্যায় করছেন, বিজয়বাবু। ছেলেটা ক’দিন একটু ঘুরে আসবে এতে আপত্তির কারণ কি থাকতে পারে?

    বাবা মিনিট কয়েক চুপ করে থেকে বললেন, আমার স্ত্রী-পুত্রকে চেঞ্জে পাঠাবার মত সঙ্গতি যদি থাকতো, অবশ্যই পাঠাতাম। তা যখন নেই, অন্যের অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে চাই না। কিন্তু যেখানে আমার জোর খাটবে না, সেখানে বাধা দিতে গেলে লাঞ্ছনা ভোগই সার হবে। তাই আপত্তিটা শুধু পরিমলের বেলাতেই জানিয়ে রাখছি।

    মামা সিগারেট ধরালেন। মার তিক্ত স্বর শুনতে পেলাম, অন্যের অনুগ্রহ! বলতে একটু চক্ষুলজ্জা হল না তোমার? এই অনুগ্রহ না পেলে কোথায় থাকত তোমার স্ত্রী-পুত্র, আর কোথায় থাকতে তুমি নিজে? তোমার বুঝি ধারণা, তোমার ঐ গোটাকয়েক পেনশনের টাকা আর ঐ নোট-ফোট লিখে যা ভিক্ষে জোটে, তাই দিয়েই এই সংসারটা চলছে? এ অনুগ্রহ যে করতে চাইছে, সে আজ নতুন করছে না, অনেকদিন আগে থেকেই করে আসছে। তা না হলে আজ সবাইকেই পথে দাঁড়াতে হত।

    মণীশ-মামা বললেন, আহা! এসব তুমি কি বলছ সুরমা? অনুগ্রহ আবার কোথায় দেখলে? এ তো আমার কর্তব্য। একেবারে ছেলেমানুষ। রেগে গেলে আর—

    বাবার গম্ভীর কণ্ঠে ডুবে গেল তাঁর নাকী-সুর—কই, এসব কথা তো আমার জানা ছিল না। জানি, আমি আজ নিতান্ত দুঃস্থ এবং অক্ষম। কিন্তু অন্যের দয়ায় বেঁচে আছি, আমার একমাত্র সন্তান হাত পেতে পরের অন্ন গ্রহণ করছে, একথা তো আমি ভাবতেই পারি না।

    শেষের দিকে তাঁর সুরটা এমন করুণ শোনাল যে, আমার চোখে জল এসে পড়ল। ইচ্ছে হল, ছুটে গিয়ে বলি, না বাবা, আমরা এখনো পরের কাছে হাত পাতিনি। ও সব মিথ্যে কথা। কিন্তু যাওয়া হল না। জানতাম বাবা রাগ করবেন। একটুখানি থেমে উনি তেমনি ধীরে ধীরে বললেন, যা হয়ে গেছে, তা তো আর ফেরানো যাবে না। তবে এ অন্যায়ের এইখানেই শেষ। কাল ভোর থেকেই সব ব্যবস্থা বদলে যাবে।

    বাঁ হাত অচল। শুধু ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে বাবা বললেন, মণীশবাবু, আমার এবং আমার পরিবারের জন্যে আপনি যা করেছেন, তার জন্যে অশেষ ধন্যবাদ। কিন্তু আর নয়। আপনার অনুগ্রহের দান থেকে আমাদের মুক্তি দিন।

    বাবাকে ভালো করেই চিনি। কাল থেকে যে ব্যবস্থা তিনি করতে চাইছেন, সেটা যতো কঠোরই হোক, তবু যে তার নড়চড় হবে না, সেটাও আমার জানা ছিল। এমনিতেই তাঁর খাবার বরাদ্দ এত সাধারণ যে, তার নীচে আর এক ধাপ নামতে গেলে, সেটা হবে অনাহার। অথচ সেই রাস্তাই যে তিনি ধরবেন, তাতে আর সন্দেহ নেই। সে তো আত্মহত্যার সামিল। সেই ভীষণ পরিণাম থেকে তাঁকে বাঁচাবার কি কোন পথ নেই? আমি তাঁর একমাত্র সন্তান, একমাত্র বংশধর। যতই ছোট হই, অক্ষম হই, আমি কি শুধু নীরব দর্শক হয়ে থাকবো? পীড়িত, অভাবগ্রস্ত পিতার মুখে একমুঠো অন্ন তুলে দেবার ক্ষমতা ও আমার নেই? এই তো, আমার বয়সী কত ছেলে পথে-ঘাটে কতরকম কাজ করে খাচ্ছে। আমি ভদ্রঘরে জন্মেছি বলেই তা পারবো না?

    গভীর রাত পর্যন্ত নানা রকমের উদ্ভট কল্পনা মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ জেগে উঠে দেখি পাঁচটা বেজে গেছে। খাতা থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে লিখলাম, বাবা, ভেবে দেখলাম সংসারের আয় বাড়াবার জন্যে আমার কিছু রোজগার করা দরকার। সেই চেষ্টাতেই চললাম। আমার জন্যে ভেবো না। আশীর্বাদ করো যেন সফল হয়ে ফিরে আসতে পারি।

    বাবার ঘরে যেতে সাহস হল না। পাছে তিনি জেগে ওঠেন, কিংবা তাঁর মুখের দিকে চোখ পড়লে আমার সকল সঙ্কল্প ভেঙে যায়, তাই পড়ার টেবিলে চিঠিটা চাপা দিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়লাম।

    এর পরে যে জীবন শুরু হল, তার বর্ণনা দিতে গেলে এ চিঠি শেষ হবে না। সে চেষ্টা করবো না। ঘরের বাইরে এসে পৃথিবীকে দেখলাম এক নতুন রূপে। দেখলাম, নরক বলে কোনো আলাদা দেশ নেই। এই সংসারটাই একটা প্রকাণ্ড নরক। দেখলাম, মানুষ কত নীচ, কত কঠোর, কত নির্মম! দয়া নেই, প্রীতি নেই, একবিন্দু সহানুভূতি নেই। আছে শুধু সন্দেহ, পীড়ন আর বঞ্চনা। ভিক্ষা চাইলে হয়তো সহজেই পেতাম, কিন্তু যার কাছেই বলেছি, আমাকে একটা কাজ দাও, আমি খেটে খেতে চাই, সবারই চোখে দেখেছি অবিশ্বাস, শুনেছি কারো নীরব কারো-বা সরব মন্তব্য—কোনো মতলব আছে ছোকরার

    দু-দিন পেটে পড়ল শুধু কলের জল। অনেক ঘুরে অনেকের দুয়ারে ঢুঁ মেরে এক দোকানে জুটল খাতা লেখার কাজ। খোরাক আর পনেরো টাকা। হাতে স্বর্গ পেলাম। মাস গেলেই প্রথম মাইনের টাকাটা মনিঅর্ডার করে পাঠালাম বাবার কাছে। লিখলাম, এই টাকাটা দিয়ে ফল আনিয়ে নিও। আমার জন্যে কিছু ভেবো না। আমি ভাল আছি। সুবিধা হলেই গিয়ে তোমাকে দেখে আসবো!

    কিছুদিন পরে মালিকের বাক্স থেকে পঞ্চাশ টাকা চুরি গেল। সন্দেহ পড়ল আমার উপর। বিশ্বাস যখন গেল তারপরে আর সেখানে থাকা চলে না। বেরিয়ে পড়লাম। এবার জুটল এক চায়ের দোকানে বয়-এর কাজ। টেবিলে টেবিলে খাবার যোগানো। কাটল কিছুকাল। একদিন একখানা প্লেট ধুতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। কদর্য ভাষায় বাপ তুলে গালাগালি। আবার পথ। সেখান থেকে মোটরের কারখানা। সে চাকরি টিকল না। মাতাল মিস্ত্রিটার সঙ্গে এক বিছানায় শুতে হত। তার কুৎসিত ঘনিষ্ঠতা সহ্য হল না। এর পরে জুটলাম গিয়ে এক দেশী মদের দোকানে। কাজ, মদ বিক্রি। মাইনে তিরিশ টাকা। বেশ কিছুকাল কাটিয়ে দিলাম।

    কতবার কতভাবে পাঁকের স্পর্শে এসেছি। কিন্তু পাঁক গায়ে লাগতে দিইনি। কিছু টাকা হাতে করতে পারলেই বাবার কাছে ফিরে যাবো, এই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। কারো পরামর্শ, কারো কোনো প্রলোভন সে লক্ষ্য থেকে আমাকে নড়াতে পারেনি। এতদিন পরে এই মদের দোকানের বারান্দায় এমন একটি লোকের সাক্ষাৎ পেলাম একদিন, যার কাছে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলুম না। জানি না, কি যাদু ছিল তার চোখে, তার কথায়, তার হাতের স্পর্শে। স্রোতের মুখে তৃণের মত আমি তার ইচ্ছার তোড়ে ভেসে চলে গেলাম।

    দোকান বন্ধ হবার পর বারান্দায় একটা বেঞ্চিতে চুপ করে বসে ছিলাম। সে এসে বসল পাশটিতে। যেন কতদিনের বন্ধু, এমনিভাবে হাত ধরে বলল, তোমায় তো এখানে মানাচ্ছে না, ভাই। তুমি এ রাস্তায় কেমন করে এলে?

    অনেকদিন পরে মানুষের কণ্ঠে যেন একটু দরদের আভাস পেলাম। সে আমার চেয়ে বোধ হয় বছর-পাঁচেক বড় হবে। কিন্তু তার পাশে নিজেকে মনে হল শিশু। একটা ভালো হোটেলে নিয়ে গিয়ে সে প্রচুর খাওয়ালে। তারপর ট্যাকসি করে নিয়ে গেল বেড়াতে। একদিন, দু-দিন, তিনদিন। তারপর এক নিভৃত সন্ধ্যায় গঙ্গার ঘাটে বসে তাকে খুলে বললাম আমার জীবনের বিচিত্র কাহিনী। সে নিঃশব্দে শুনল সব কথা। তারপর সস্নেহে বলল, তুমি ঠিক করেছ ভাই। এ ছাড়া আর পথ ছিল না। কিন্তু এই মাতালের দোকানে মদ বেচে তো বাবার দুঃখ ঘোচাতে পারবে না। তার চেয়ে আমার সঙ্গে চল। আমি তোমার পথ বাতলে দেবো।

    তার সঙ্গ নিলাম।

    সে রাতটা আমার চোখের উপর ভাসছে। অত্যন্ত সরু গলি। অন্ধকার পথ, দু-পাশে নোংরা জঞ্জাল। টর্চের আলোয় কোনো রকমে এগিয়ে যাচ্ছি। একটা পোড়ো মতন বাড়ি। সেটা ছাড়িয়ে ভেতরের দিকে আর একটা প্রকাণ্ড জীর্ণ কোঠা। সামনের দিকটা ভেঙে পড়েছে। ভাঙা স্তূপের পাশ দিয়ে একফালি পথ। অতিকষ্টে পার হয়ে ডানদিকে পেলাম একটা সিঁড়ি। যেমন স্যাঁতসেঁতে, তেমনি অন্ধকার। উঠছি তো উঠছিই। তার যেন আর শেষ নেই। সে আমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। অনেক হোঁচট খেয়ে, অনেক মোড় ঘুরে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলাম একটা হল-মতন ঘরে। একঘর লোক। বিশ্রী ভাষায় আলাপ করছে, আর মাঝে মাঝে হাসছে বিকট কদর্য হাসি। এ কোথায় নিয়ে এলে? ভয়ে ভয়ে বললাম তাকে। সে উত্তর দিল না। হাত ধরে নিয়ে গেল পাশের একটা ঘরে। মোমবাতির আলোয় দেখলাম, একটা লোক খাটিয়ায় শুয়ে বিড়ি টানছে। বয়েস হয়েছে; কিন্তু দেখতে গুণ্ডার মত।

    আমার বন্ধু বলল, এনেছি ওস্তাদ।

    —এনেছো? বেশ, এদিকে নিয়ে এসো।

    তেমনি হাত ধরেই সে আমাকে আরো খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেল। লোকটা উঠে এসে আমার মুখের কাছে মুখ এনে অনেকক্ষণ কি দেখল। তারপর বলল, বাঃ, খাসা মাল এনেছিস রে। ঠিক আছে, ও পারবে।

    ধেনো মদের উগ্র গন্ধে গা পাক দিয়ে উঠল। পিছন ফিরে বন্ধুকে আর দেখতে পেলাম না। আর কোনোদিন দেখতে পাইনি।

    পরদিন সকালেই বুঝলাম, কোথায় এসেছি। পকেটমারদের প্রধান ট্রেনিং সেন্টার। বন্ধুটি একজন পাকা আড়াকাঠি। আমি নতুন রংরুট। আমাকে নজরবন্দী করে রাখা হল। কিছুক্ষণ পরেই ওস্তাদ ডেকে পাঠালে। কাঁধের উপর হাত রেখে বলল, ভয় কিসের? তোমার মত কত ছেলে আছে আমাদের দলে। সক্কলের সঙ্গে আলাপ-সালাপ করো। খাও-দাও ফুর্তি করো। আর মন দিয়ে কাজ শেখো, ভাল করে শিখতে পারলে এরকম লাইন আর নেই। রাতারাতি বড়লোক। আচ্ছা, সব চাইতে কাকে বেশী ভালবাস বল তো?

    বললাম বাবাকে।

    —বেশ। বল দিকিনি, ‘বাবার নাম নিয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, দল ছেড়ে কোনো দিন যাবো না; দলের কোনো কথা কারো কাছে প্রকাশ করবো না। বল—

    প্রতিজ্ঞা করলাম। এমনি করে আমার দীক্ষা হল।

    মাসখানেক ট্রেনিং দিয়েই ওরা আমাকে রাস্তায় পাঠাতে শুরু করল। পালানোর উপায় নেই, পেছনে ভিড়ের মধ্যে ওদের গার্ড। বেগতিক দেখলে ছোরা চালাতে দ্বিধা করবে না। হাতেখড়ি শুরু হল। সারাদিনে কিছু কেস দিতেই হবে। তা না হলে নানারকম নির্যাতন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেটা আমাকে বেশী সইতে হয়নি। দক্ষ এবং বিশ্বস্ত কর্মী বলে অল্পদিনেই আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। যা পেতাম, সব জমা দিতে হত সর্দারের কাছে। আমার প্রাপ্য ছিল খোরাক আর সামান্য কিছু হাতখরচ।

    গহর বলে একটা লোক ছিল আমাদের দলে। আমাকে সত্যিই ভালবাসত। একদিন আড়ালে নিয়ে বলল, তুমি কি বোকা! যা পাও সবই দিয়ে দিচ্ছ! কিছু কিছু সরাতে হয়। তা নৈলে তোমার রইল কি? আমরা সবাই কি করছি দেখতে পাও না?

    সেকথা আমি জানতাম। তার বিপদটা কম ছিল না। একদিন একটু ঝুঁকি নিলাম। এক ভাটিয়া ভদ্রলোক বাসে উঠতে যাবে। ভীষণ ভীড়। মনিব্যাগটা সরিয়ে নিয়ে আমিও সরে পড়লাম। নিরাপদ জায়গায় এসে ব্যাগ খুলে দেখলাম, দুখানা হাজার টাকার নোট। ব্যস্, আর নয়। এবার ফিরতে হবে।

    কতকাল পরে বাড়ি ফিরছি। রাত প্রায় দশটা। কড়া নাড়তে গিয়ে বুক কাঁপছে। মনে হল অনেক দূরে চলে গেছি, অনেক নীচে নেমে গেছি। এ বাড়ি আমার নয়। মাথা উঁচু করে এখানে ঢুকবার অধিকার আমার চলে গেছে। তারপর ঢুকে কি দেখবো কে জানে? এমন সময় হঠাৎ দরজা খুলে গেল। সামনেই গোবিন্দ। আমাকে দেখেই হাউ-হাউ’ করে কেঁদে উঠল—অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে দাদাবাবু? এ কি চেহারা হয়েছে তোমার? তার মুখ চেপে ধরে বললাম, চুপ চুপ! বাবা কেমন আছেন?

    গোবিন্দ চোখ মুছতে মুছতে বলল, আর কেমন! তুমি যাবার পর থেকেই একেবারে ভেঙে পড়েছেন। আর মাথা তুলতে পারেন না। বুকের অবস্থাও খুব খারাপ। কোন্দিন প্রাণটা বেরিয়ে যায়।

    —মা কোথায়?

    গোবিন্দ সেকথার জবাব দিল না। বাইরে যেতে যেতে বলল, তুমি ওপরে যাও, আমি চট করে একটা সোডা নিয়ে আসছি।

    বাবার ঘরে ঢুকে শিউরে উঠলাম। চোখ বুজে পড়ে আছেন—বাবা নন, বাবার কঙ্কাল। পায়ে হাত দিতেই চমকে উঠলেন, কে?

    —আমি, বাবা।

    —খোকা? অ্যাদ্দিনে এলি? বড্ড ভুল করেছিলি বাবা। আয় কাছে আয়।

    কাছে যেতেই ডান হাতটা কোনো রকমে তুলে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তাঁর বুকের উপর মাথা রেখে চোখের জল আর রাখতে পারলুম না। অনেকক্ষণ সেইভাবে পড়ে রইলাম। চোখের জলের ভিতর দিয়ে আমার মনের সব তাপ সব পাপ যেন গলে বেরিয়ে গেল। হালকা হয়ে গেল বুকটা। তিনি আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, তুই বড় হবি, মানুষ হবি, এই তো আমার একমাত্র সাধ। কিন্তু এ তুই কী করলি, খোকা? দশ-বিশ টাকায় আমাদের কি উপকার হবে বল? আর তার জন্যে তুই এমন করে নিজেকে ক্ষয় করে চলেছিস্? তোর সবগুলো মনিঅর্ডার আমি তুলে রেখে দিয়েছি। কচি ছেলের এত কষ্টের রোজগার আমি পেটের দায়ে খরচ করবো!

    আমি উঠে বসে বললাম, এবার অনেক টাকা এনেছি, বাবা। সকাল হলেই সবচেয়ে বড় ডাক্তার ডেকে আনবো। তোমাকে শীগির শীগির সেরে উঠতে হবে। তারপর চল, আমরা একটা চেঞ্জে গিয়ে থাকি।

    মনিব্যাগটা খুলে নোট দু’খানা বের করলাম।

    সেদিকে একবার তাকিয়েই বাবার মুখটা হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল। রুক্ষ স্বরে বললেন, একি! এত টাকা তুই কোথায় পেলি?

    আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

    —কে দিয়েছে বল? আমার কাছে লুকোসনে। বল, কে দিয়েছে?

    অতখানি বিচলিত হতে বাবাকে কখনো দেখিনি। ভয়ে ভয়ে বললাম, কেউ দেয়নি; আমি পেয়েছি।

    —কি করে, কোত্থেকে পেয়েছিস?

    আমি নিরুত্তর।

    বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, চুরি করেছিস?

    এ প্রশ্নের কোনো জবাব আমার মুখে এল না।

    বাবা একেবারে ভেঙে পড়লেন।চোর! আমার ছেলে চোর! হা ভগবান, এও আমাকে দেখতে হল!….

    দুর্বল দেহ থরথর করে কাঁপছে। চোখ দুটো মনে হল যেন ঠিকরে বেরিয়ে পড়বে। অদম্য উত্তেজনায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে চান। কী সর্বনাশ! আমি তাড়াতাড়ি ধরে শুইয়ে দিয়ে শীর্ণ মুখখানা দু’-হাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম, বাবা তুমি চুপ কর, ঠাণ্ডা হও। এ টাকা আমি ফিরিয়ে দেবো, ফেলে দেবো। তোমায় ছুঁয়ে বলছি, একাজ আর করবো না। তুমি স্থির হও।

    আর বলতে হল না। তিনি তৎক্ষণাৎ স্থির হয়ে গেলেন। চিরদিনের মত স্থির। আমি কি ছাই তখনো বুঝতে পেরেছি? যখন বুঝলাম, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। সেই নিস্পন্দ দেহের উপর লুটিয়ে পড়লাম।

    শেষকৃত্য যখন শেষ হল, তখনো সূর্যোদয় হয়নি। সকলের অলক্ষ্যে শ্মশান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। সেই মনিব্যাগটা পকেটেই ছিল। সোজা থানায় গিয়ে সেটা জমা দিয়ে বললাম, আশা করি, মালিককে দেখলে চিনতে পারবো।

    ভাটিয়া ভদ্রলোক থানায় ডায়রি করিয়ে রেখেছিলেন। তাঁকে ডেকে পাঠানো হল। চিনলাম। তিনিও তাঁর ব্যাগ এবং নোট সনাক্ত করলেন।

    আমার বিরুদ্ধে পুলিশ কেস দায়ের হল। কোমরে দড়ি এবং হাতে হাতকড়া পরিয়ে জেলে নিয়ে গেল।

    হাকিমের বোধ হয় দয়া হয়েছিল আমাকে দেখে। প্রথম অপরাধ বলে একটা বণ্ড নিয়ে ছেড়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু ছাড়া পেয়ে কোথায় যাবো আমি? কার জন্যেই বা যাবো? বললাম, এটা আমার প্রথম অপরাধ নয়। এ অপরাধ অনেকবার করেছি; ধরা পড়িনি। পুলিশ আমাকে সমর্থন করল। তাদের খাতায় আমার নাম ছিল। ম্যাজিস্ট্রেট বাধ্য হয়েই ছ’মাসের জেল দিয়ে দিলেন।

    ছ’মাস শেষ হয়ে এসেছে। খালাসের আর তিন দিন বাকি। কিন্তু যা চেয়েছিলাম, তা পেলাম কই? কোথায় আমার শাস্তি? কোথায় আমার প্রায়শ্চিত্ত? আমি তো শুধু চোর নই, অমি পিতৃহন্তা। সে মহাপাপের দণ্ডভোগ তো আমার শেষ হয় নি। কোনে দিন হবে কিনা, তাও জানি না। যদি হয়, সেই দিন আপনার কাছে ফিরে যাবো।

    —হতভাগ্য পরিমল

    সে আর ফিরে আসে নি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডাইস লস্ট – জন মিল্টন
    Next Article ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }