Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌহকপাট – জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)

    জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) এক পাতা গল্প980 Mins Read0

    লৌহকপাট – ২.৩

    তিন

    দেড়গজি ফদটার উপর আর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ‘বুঝিয়া পাইলাম’ বলে সই করে দিলাম। তিনদিন ধরে অবিরাম চলেছে এই চার্জ আদান-প্রদান-পর্ব। দাতা—প্রাজ্ঞ এবং সিনিয়র জেলর রায়সাহেব বনমালী সরকার। গ্রহীতা—তাঁর এই অজ্ঞ এবং অ্যাকটিনি জুনিয়র, বাবু মলয় চৌধুরী। শুরু থেকেই উনি আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, ‘বেশ করে দেখে শুনে মিলিয়ে নেবেন, মশাই। এর পরে যেন বলে বসবেন না, এটা পাইনি আর ওটা পাইনি!’ অতএব এই তিনদিন ধরে দেখছি শুনছি এবং মেলাচ্ছি। ঘানিঘরের কয়েদী থেকে রসদ-গুদামের বস্তা, ডেহরির ষাঁড় থেকে পোলট্রির আণ্ডা। আলাদা ইনচার্জ আছেন প্রতি বিভাগে। নিজ নিজ এলাকাভুক্ত সবকিছুর জন্য তাঁরা দায়ী। কিন্তু তার দ্বারা এই বিশাল কারা-সম্পত্তির উপর জেলরের যে সর্বময় দায়িত্ব, তার খণ্ডন হয় না। সুতরাং ওজন কর পেঁয়াজ আর পাঁচফোড়ন, গুনে নাও রসুইখানার খুন্তি আর গোসলখানার মগ।

    ফর্দের একটা নকল পকেটস্থ করতে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন রায়সাহেব—’ওঃ হো! আসল বস্তুটাই তো আপনাকে বোঝানো হয়নি।’ -বলে হাঁক দিলেন, ‘রতিকান্ত!’ অফিসের পেছনদিকে একটা ছোট্ট ঘর থেকে বেরিয়ে এল এক কৃষ্ণমূর্তি। ছায়ামূর্তি বললেই চলে। হাড়ের ফ্রেমের ওপর চামড়ার খোলসটা জড়াবার আগে মাঝখানে যে একটা মাংসের প্লাস্টার দিয়ে নেওয়া দরকার, সে কথা বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলেন ওর বিধাতাপুরুষ। সে অভাব পূরণ করেছে পিঠের উপর একটা মস্ত বড় কুঁজ। ঝুঁকে পড়া দেহটাকে আরও খানিক নুইয়ে ডবল প্রণাম ঠুকল রতিকান্ত। তারপর যুক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল হুকুমের অপেক্ষায়। রায়সাহের বললেন, এটি আপনার খাস্ বয়, বেয়ারা, বাহন একাধারে সব। টেবিল ঝাড়বে, ফাইল গোছাবে, এটা ওটা এগিয়ে দেবে। কাজের লোক, তবে কাজটা মাঝে মাঝে একটু বেশী করে ফেলে। যে চিঠিটা ডাকে দেওয়া দরকার, সেটা তাকে তুলে রাখে, আর কালো কালির দোয়াতে ঢেলে দেয় লাল কালি।

    প্রশংসা শুনে রতিকান্তর মুখের ওপর একটি সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল। বললাম, তোমার নামটি তো বেশ।

    হাসি আকর্ণ বিস্তৃত হল। বিগলিত কণ্ঠে বলল রতিকান্ত, ‘আজ্ঞে, ওটা আমার গুরুদেবের দেওয়া। আগে নাম ছিল ভজহরি।

    গুরুদেবের রসজ্ঞানের তারিফ করে বললাম, বেশ, বেশ, তারপর জেল হল কিসের জন্যে।

    —৩৭৯, আর কি! উত্তর করলেন রায়সাহেব। রতিকান্তের মাথাটা নুইয়ে পড়ল মাটির দিকে।

    প্রশ্ন করলাম, কী চুরি করেছিলে?

    মৃদু কণ্ঠের কুণ্ঠিত উত্তর—গরু।

    জেলের অধিবাসী যারা, তাদেরও একটা সমাজ আছে। তার বিভিন্ন স্তর। স্তরভেদের মাপকাঠি হল ক্রাইম অর্থাৎ কৃত অপরাধের জাতি এবং গুরুত্ব। কুলীন-পাড়ায় থাকেন খুন, তহবিল তছরূপ, Criminal breach of trust কিংবা ‘স্বদেশী’ ডাকাতি। চুরির স্তর তার অনেক নীচে। সবার নীচে সবার শেষে সবহারাদের মাঝে যার বাস তার নাম গরুচোর। শুধু হরিজন নয়, অভাজন। চোর হলেও এরা চোর জাতির কলঙ্ক। স্বজাতির আসরেও হুঁকাবন্ধ। এই জন্যে জেলে এসে এরা সহজে মুখ খোলে না। আমার এক সহকর্মী ছিলেন। কয়েদী খালাস দেবার সময় নাম ধাম বিবরণ ইত্যাদি মেলাবার পর তিনি সবাইকে একটি প্রশ্ন করতেন—’কী চুরি?’ যাদের অপরাধ চুরি নয় তারা সগর্বে উত্তর দিত, খুন, ডাকাতি, কিংবা নারীহরণ। যারা চুরি সেকশনে দণ্ডিত, তারাও বলত টাকা চুরি, কাঁঠাল চুরি কিংবা অন্য কিছু। একবার এমনি এক ৩৭৯ কিছুই বলতে চায় না। জেলর সাহেব নাছোড়বান্দা। টেবিল চাপড়ে গর্জে উঠলেন, কী চুরি?

    —আজ্ঞে, গরুর বিষয়ে।

    রতিকান্তকে দেখলাম একটি বিরল ব্যতিক্রম। জেলে ঢুকবার কয়েক দিনের মধ্যেই তার কৃতিত্বটুকু বন্ধু-সমাজে প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। বলেছিল, যাই বল ভাই, তোমাদের ঐ টাকাকড়ি বাক্স প্যাট্রার চেয়ে আমার এই চার-পা-ওয়ালা মাল পাচার করা অনেক সোজা। তাছাড়া ঝামেলাও কত কম! সিঁদ কাটা নেই, তালাভাঙা নেই; গেরস্তের ঘরে ঢুকে প্রাণটি হাতে করে ইষ্টনাম জপ করা নেই। সোজা গোয়ালে গিয়ে দড়িটা খোল, তারপর হাঁটা দাও। রাতটা কোনো রকমে কাবার হলে আর তোমাকে পায় কে? ধরা পড়ার কথা বলছ? ওসব কপালের লেখা। শাস্তরে বলেছে, দশদিন চোরের, একদিন গেরস্তের।

    এহেন অকপট স্বীকারোক্তির পর গাঁজা, বিড়ি কিংবা ‘দশ পঁচিশে’র গোপন আড্ডায় রতিকান্তের ঠাঁই পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াল। সে গল্প শুনলাম রায়সাহেবের মুখে। এক রবিবার উনি ফাইল দেখছেন। একজন মাতব্বর গোছের কয়েদী সেলাম জানালো, ‘নালিশ আছে হুজুর।’

    —কি নালিশ?

    —আমাকে ১৩ নম্বর থেকে আর কোথাও সরিয়ে দেবার হুকুম দিন।

    —কেন?

    —বড্ড চোর-ছাঁচড়ের আড্ডা, বলে আড়চোখে তাকাল রতিকান্তের দিকে। রায়সাহেব তার টিকেট লক্ষ্য করলেন, ৩৮১ ধারা। বললেন, তুমি কী করেছিলে?

    —আজ্ঞে, মনিব মাইনে দেয়নি বলে ঘড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম।

    —ও-ও, সেটা বুঝি চুরি নয়?

    —চুরি হতে পার স্যার, কিন্তু গরু-চুরি নয়।

    জেলর সাহেব এই ঘড়ি নিয়ে প্রস্থানকারীর নালিশ মঞ্জুর করেন নি। যদিও বুঝেছিলেন তার নালিশটা নেহাত লঘু নয়, এবং তার পেছনে রয়েছে ‘জনমতের’ সমর্থন। কয়েকদিন পরেই সেটা স্পষ্ট হল, এবং রতিকান্ত নালিশ জানাল, তাকে অন্য জেলে চালান দেওয়া হোক। বেচারার বেগতিক অবস্থা বিবেচনা করে রায়সাহেব তাকে জেলরের খাস্ ফালতুর ছাপ দিয়ে নিয়ে এলেন নিজের অফিসে এবং রাতে শোবার ব্যবস্থা করে দিলেন ‘সেল’ ব্লকে।

    চার্জ নেবার তিন-চার দিন পর। বিকেলবেলা অফিসের টেবিলে বসে কাজ করছি, পায়ের উপর ঠাণ্ডা একটা কি ঠেকতেই ভয়ে লাফিয়ে উঠলাম। সাপটাপ নয় তো? টেবিলের নীচে থেকে সাড়া এল, আমি রতিকান্ত, হুজুর।

    —ওখানে কি করছিস হতভাগা?

    —আজ্ঞে একটু পদসেবা। সে-হুজুরের করতে হত কিনা রোজই—

    থাক, এ-হুজুরের করতে হবে না। দয়া করে বেরিয়ে এসো।

    রতিকান্ত বিস্মিত হল। এ বিস্ময় লক্ষ্য করেছি আমার সহকর্মী মহলেও—শুধু বিস্ময় নয়, স্থানবিশেষে বিদ্রূপ, নব্যতন্ত্রের ‘লোক দেখানো উদারতা’র উপর কটাক্ষ। বৈকালিক অফিস ঠিক অফিস নয় জেলবাবুদের। দেহে নেই ইউনিফর্মের নাগপাশ, মনে নেই ব্যস্ততার বোঝা। অর্ধনিমীলিত নেত্রে আরাম-কেদারায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বিশ্বস্ত কয়েদীর হাতে নিপুণ চরণদলন কিংবা পক্ককেশ উত্তোলন—তখনকার দিনে এই ছিল সিনিয়র অফিসারদের নিত্য বরাদ্দ। আমরা সে রসে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। হায়রে কবে কেটে গেছে পদসেবার কাল!

    কিছুদিন আগে রতিকান্তের অর্ধমেয়াদ শেষ হয়েছে। মাঝে মাঝে দেখি টিকেটখানা হাতে করে আমার সামনে বিনা কারণে ঘুরে যায়। একদিন বললাম, কিরে রতিকান্ত কিছু বলবি?

    মাথা নীচু করে দু-চারবার ঢোক গিলে বহু সঙ্কোচে জানাল, বড় ডিটি-বাবুকে টিকিট দেখিয়েছিলাম। বললেন, ‘মেট’-এর হক হয়েছে।

    কয়েদীজীবনে ‘মেট’ পদলাভ বহু আকাঙ্ক্ষিত সৌভাগ্য। বললাম, মেট হতে চাস? জবাব দিল না। শীর্ণ মুখখানা শুধু উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

    –তোর এই চেহারা। কয়েদীরা তোকে মানবে কেন?

    —মানবে না কেন? হঠাৎ উত্তেজনায় একটা শকারাদি শব্দ উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল, দাঁতে জিব কেটে থেমে গেল।

    রতিকান্তকে মেট-পদে প্রমোশন দেওয়া গেল। ডেপুটি জেলর বিনয়বাবু বললেন, আপনার রতিকান্তের কুঁজ বোধহয় আর রইল না, স্যার।

    —কি রকম?

    —মেট হবার পর সে রীতিমত বুক টান করে হাঁটবার চেষ্টা করছে।

    সেটা আমিও লক্ষ্য করেছিলাম। দেখলাম, বেল্টা খালি কোমরে ঢলঢল করে বলে গামছা জড়িয়ে তার ওপর বেল্ট্ এঁটেছে। নিত্য পালিশের ফলে চক্‌চক্ করছে তার পিতলের চাপরাস।

    জেলের বাইরে যেসব কয়েদী কাজ করে, তাদের প্রত্যেকটা গ্যাঙ্ বা দফার জন্যে অন্তত একজন ‘মেট’ চাই। বাইরে যাবার অধিকার সকলের নেই। যেতে পারে শুধু তারাই, যাদের বাকী দণ্ডকাল একবছর অথবা তার কম! বড় বড় জেলে যেখানে স্বল্প- মেয়াদী লোকের সংখ্যা বেশী নয়, বাইরে যাবার যোগ্য মেট মাঝে মাঝে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। একদিন দেখা গেল জেলরের ‘কুঠিতে যে সব কয়েদী বাগানে এবং ‘জলভরি’র কাজ করে তাদের মেট নেই। সবগুলো মেট-এর টিকেট পরীক্ষা করে বড় জমাদার এসে জানাল, বাইরে যাবার হক্ আছে শুধু একজনের।

    জিজ্ঞাসা করলাম, কে সে?

    —আকা রোতিকান্ত।

    রতিকান্তের দিকে তাকালাম। অফিসের কোণে বসে সে আমার স্যাম্রাউন বেল্টে পালিশ লাগাচ্ছিল। একটিবার চোখ তুলেই হঠাৎ দ্বিগুণ বেগে বুরুশ চালনা শুরু করল। বললাম, কিরে, পারবি?

    উঠে দাঁড়িয়ে জোড়হাত করে বলল, হুজুরের দয়া।

    ‘মেট’-এর চেহারা দেখে গৃহিণী তো হেসেই খুন। বললেন, এ ঘিয়ে-ভাজা কুঁজো দিয়ে কাজ চলবে না বাপু।

    আমি বললাম, ‘রসে-ভেজা যদ্দিন না পাচ্ছ, ঘিয়ে ভাজা দিয়েই চালিয়ে নাও।

    —কী যে বল! ঐ কুঁজ নিয়ে পাহারা দেবে কি গো! সব কয়েদী পালিয়ে যাবে। বললাম, সে ভয় নেই। পালাতে গেলেই কুঁজে আটকে যাবে।

    আমার একটা নিজস্ব ফুলের বাগান ছিল। তার ভার পরেছিল ব্যক্তিগত ভাবে মেটের উপর। আগে যে ছিল, সে নিজে হাতে সব কাজ করত। তাই শুনে রতিকান্তও লেগে গেল কোদাল শাবল খুরপি নিয়ে। একদিন দেখলাম, তার কোদাল চালানোর কসরত দেখে বাগানের পাশে ভিড় জমে গেছে। সিপাই বেটন দেখিয়ে থামাতে পারছে না। জটলার আড়ালে তার দু-একটি কয়েদী পাছে নিঃশব্দে মিলিয়ে যায়, এই ভয়েই সে সন্ত্রস্ত। বেগতিক দেখে বাগান পরিচর্যার দায় থেকে রতিকান্তকে রেহাই দিতে হল। গৃহিণীকে ডেকে বললাম, ওর আর বাগানে গিয়ে দরকার নেই, বাড়ির ভেতরেই করুক যাহোক কিছু।

    —হ্যাঁ, করবার তো ওর কতই আছে! শ্লেষের সঙ্গে বললেন গিন্নী, বারান্দায় বসে রাস্তার লোক গুনুক না। অনেক উপকার হবে।

    বারান্দাতেই আশ্রয় নিল রতিকান্ত, এবং সেই সুযোগে আমার সাত বছরের কন্যা মঞ্জু ওকে দখল করে বসল। মায়ের সংসারে অকেজো হলেও মেয়ের সংসারের কাজে- অকাজে তার আর ফুরসত রইল না।

    মাসখানেক বাদে যোগ্য মেট জুটে যেতেই রতিকান্তকে আসতে হল আবার সেই অফিস-ফালতুর কাজে। কিন্তু যে গিয়েছিল সে আর ফিরে এল না। অফিসের সেই ছোট্ট কোণটি তার হারিয়ে গেছে। আগের মতো সেইখানে এসেই সে বসল, নিজেকে বাঁধতে চাইল পুরানো দিনের সব কিছুর সঙ্গে। কিন্তু কোথায়, কি করে যেন ছিঁড়ে গেছে একটা তার; কিংবা মনের মধ্যে দেখা দিয়েছে কোনো বাঁধনের সূত্র। তাই কথায় কথায় তার ত্রুটি, পদে পদে তার ভুল। টেবিলের একটা দিক ঝাড়া হয় তো, আর একদিকে ধুলো লেগে থাকে। কুঁজোয় জল ভরা হয় না। সন্ধ্যাবেলা ধুনো দেবার কথা মনে করিয়ে দিতে হয়। একদিন বলল, শরীরটা ভাল ঠেকছে না, বাবা। একটু হাসপাতালে যেতে চাই। টিকিটে লিখে দিলাম হাসপাতালে যাবার নির্দেশ। দু-দিন পরে ফিরে এসে বলল, ভালো লাগল না। ডাক্তারকে বলে একটু দুধের ব্যবস্থা করে দিলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সেটাও সে নিয়মিত আনতে ভুলে যায়। কদিন পরে দেখি সাপ্তাহিক ফাইলে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ-হাতে টিকেট। ডান-হাত ঝুলছে দেহের পাশ দিয়ে।

    —কি চাই?

    —একখানা চিঠি দিন, হুজুর। মেয়েটার খবর পাচ্ছি না অনেক দিন।

    রতিকান্তের ঘরসংসারের বালাই নেই, এইটাই জানা ছিল। এই প্রথম শুনলাম তার একটি মেয়ে আছে। সাত আট বছরের। মামাদের কাছে থাকে। টিকিটের পাতা উল্টে দেখলাম, চিঠিপত্রের আদান বা প্রদান, কোনোটারই কোনো চিহ্ন নেই। জিজ্ঞেস করলাম, মেয়ের খবর দেয় না তারা?

    —কেই দেয়?

    —তুই নিসনি কেন এতদিন?

    কোনো উত্তর নেই। লিখে দিলাম চিঠি লিখবার অনুমতি।

    ছ-মাস এবং তার বেশী সাজা নিয়ে যারা জেলে আসে, মাসে মাসে তারা খানিকটা করে মাপ পায়, যার নাম ‘রেমিশন’। ওরা বলে ‘মার্কা’। মার্কার পরিমাণ নির্ভর করে প্রার্থীর কাজ এবং চালচলনের উপর। এর জন্য আবেদন-নিবেদনের অন্ত নেই। সকলেই চায় যতটা বেশী মার্কা পেয়ে খালাসের দিনটা যতখানি এগিয়ে আনা যায়। রতিকান্ত খোদ জেলরের আফিস-মেট। মার্কা লাভের সুযোগ এবং সুবিধা, তার সব চেয়ে বেশী। এজন্য কয়েদী মহলে সে সার্বজনীন ঈর্ষার পাত্র। কিন্তু এ সুবিধার সৎ বা অসৎ ব্যবহার সে কোনোদিন করেনি। সপ্তাহান্তে প্যারেড দেখতে গিয়ে মার্কার আবেদন শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে, রতিকান্ত সেখানে অনুপস্থিত।

    সেদিন অফিসে গিয়ে বসতেই টেবিলের উপর চোখ পড়ল, রতিকান্তের টিকেট। বললাম, এটা এখানে কেন? যথারীতি নিরুত্তর।

    —কি চাই বল না?

    —কটা দিন বকশিশ্ দেবেন, হুজুর!

    বিস্মিত দৃষ্টিতে চাইলাম ওর দিকে। অনেকটা যেন কৈফিয়তের সুরে বলল রতিকান্ত, মেয়েটাকে দেখবার জন্য মনটা বড় ছটফট করছে।

    পুরো ‘মার্কা’ পেয়ে দিন পনেরো পরে রতিকান্তের খালাসের দিন স্থির হয়ে গেল। একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি, তুমুল কাণ্ড। মঞ্জুর দোলখাওয়া মেমসাহেবটি নিরুদ্দেশ! মেয়ে কেঁদে বাড়ি মাথায় করছে আর তার মা যে-ভাবে পা ফেলে বেড়াচ্ছেন, বাড়িটা যে-কোন মুহূর্তে আমাদের মাথায় পড়তে পারে। শুনে আমারও মন খারাপ হয়ে গেল। সুন্দর পুতুলটি। একটা স্প্রিং-লাগানো ছোট্ট চেয়ারে ফুটফুটে একটি মেম বসে। চাবি ঘোরালেই সবসুদ্ধ দোল খেতে থাকবেন; আর তার সঙ্গে দুলিয়ে দেবেন শিশু-দর্শকের সমস্ত হৃদয়। মঞ্জুর শোকটা যেন কত তীব্র, অনুভব করতে চেষ্টা করলাম। বাড়িতে একদল কয়েদী। স্বাভাবিক নিয়মে চুরির সন্দেহ তাদের উপরেই পড়বে। বড় জমাদার যথারীতি সবাইকে কিঞ্চিৎ পুরস্কার দিলেন। কিন্তু মেমসাহেব উদ্ধার হল না। মঞ্জুর মা বললেন, এ নিশ্চয় সেই কুঁজোটার কাণ্ড!

    আমি মৃদু প্রতিবাদ জানালাম, তা কেমন করে সম্ভব? সে তো ছিল সেই কতদিন আগে!

    —হ্যাঁ। সেই তখনই সরিয়ে ফেলেছে। মেয়ের কি খেয়াল ছিল নাকি অ্যাদ্দিন? আজ হঠাৎ খোঁজ পড়েছে, আর নাকে-কান্না শুরু হয়েছে।—বলে গৃহিণী এক মোক্ষম ধমক লাগালেন মেয়েকে! ফলে নাকে-কান্নার পর্দা চড়ে গেল এবং তার মধ্যেই শোনা গেল তার প্রতিবাদ, কখোনো না। কুঁজো মেট খুব ভালো। সে কখনো আমার মেমসাহেব নেয়নি।

    অগত্যা সন্দেহজনক দুজন কয়েদী এবং সেই সঙ্গে বর্তমান মেটটিকেও দল থেকে সরিয়ে অন্য কাজে দেওয়া হল।

    নির্ধারিত দিনে সকাল আটটায় রতিকান্ত খালাস হয়ে গেল। তাকে দেওয়া হল একদিনের খোরাকি ছ’আনা, তার গন্তব্য স্টেশনের একখানা রেলের পাস, আর ভালো কাজ দেখানোর বক্‌শিশ্ দু’টাকা। যাবার সময় ভিড়ের মধ্যে নজরে পড়ল তার সেই পেটেন্ট প্রণাম, হাতে কাপড়-চোপড়ের একটা ছোট পুঁটলি।

    বেলা তখন নটা। অফিসের পুরো মরসুম। নিঃশ্বাস ফেলবার অবসর নেই। গেটের বাইরে কিসের একটা গোলমাল শোনা গেল! আমার নতুন মেটটা এসে জানাল, রতিকান্তকে ধরে এনেছে সিপাইরা।

    —কেন!

    —চোরাই মাল পাওয়া গেছে ওর পুঁটলির মধ্যে।

    অফিস থেকে বেরিয়ে দেখলাম, জেলফটকের সামনে ভিড় জমে গেছে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে কুঁজো রতিকান্ত। একজন পালোয়ান সিপাই শক্ত করে ধরে রয়েছে তার একটা হাত। আমাকে দেখে একবার মুখ তুলে তাকাল। চোখে পড়ল, কপালের পাশে খানিকটা জায়গা ফুলে উঠেছে। গালের উপর কালশিরের দাগ। পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের বড় জমাদার। ডান হাতে বেটন, বাঁহাতে একটা পুতুল। বীরদর্পে এগিয়ে এসে বিজয়-উল্লাসে জানাল, উসকো গাঁটরিসে নিকালা—খোকী বাবাকা মেসার্।

    পুরোপুরি ব্যাপারটা শোনা গেল সেই পালোয়ান সিপাইয়ের কাছে। গেট থেকে বেরিয়ে রতিকান্ত যখন রাস্তার দিকে না গিয়ে আমার বাগানের দিকে যাচ্ছিল, তখনই তার কেমন সন্দেহ হয় এবং লুকিয়ে তার অনুসরণ করতে থাকে। তারপর বাগানের ধারে একটা গাছের গোড়ার মাটি সরিয়ে এ জিনিস বের করে যেমনি পুঁটুলির মধ্যে ভরা, সিপাই ছুটে গিয়ে হাতে হাতে ধরে ফেলেছে।

    আমার সহকর্মী বিনয়বাবু মন্তব্য করলেন, ‘আমি আগেই বলেছি স্যার, ব্যাটার ঐ কুঁজ হচ্ছে আসলে একটা শয়তানির বস্তা। ওকে ভালোরকম শায়েস্তা করা দরকার।’ সে বিষয়ে কারও ভিন্ন মত আছে বলে মনে হল না। অপেক্ষা শুধু আমার হুকুমের। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। সামনের লোকজন ঠেলে বেরিয়ে এল আমার কন্যা মঞ্জু। বড় বড় চোখ করে একবার তাকিয়ে দেখল সবদিকটা। তারপর ছুটে গিয়ে বড় জমাদারের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল তার মেমসাহেব। রতিকান্তের হাতের মধ্যে সেটা গুঁজে দিয়ে বলল, টুনিকে দিও। বলো, মঞ্জু দিয়েছে। অ্যাঁ?

    উত্তরের অপেক্ষা না করে, আর কোনো দিকে না চেয়ে ছুটে মিলিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।

    রতিকান্তের মুখে এতক্ষণ কোনো বিকার ছিল না। চোখ দুটোও ছিল শুষ্ক। এবার তার কুৎসিত শুকনো তোবড়ানো গাল দুটোও কুঁচকে কেঁপে উঠল। তারই সঙ্গে দু-চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে এল জলের ধারা।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডাইস লস্ট – জন মিল্টন
    Next Article ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }