Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌহকপাট – জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)

    জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) এক পাতা গল্প980 Mins Read0

    লৌহকপাট – ১.২

    দুই

    জি. বি. এস.-এর নাটকে যেমন প্রিফেস্, সরকারী চাকরীর তেমনি প্রোবেশন। মূল বস্তুর পুরোপুরি রসগ্রহণ করতে হলে উভয়ই অবশ্য লঙ্ঘনীয়। কিন্তু লঙ্ঘন-পথ কিঞ্চিৎ কণ্টকময়। সকলের কথা জানি না। প্রোবেশনার জীবনের ইতিহাস বিচিত্র হওয়াই স্বাভাবিক। নিজের সম্বন্ধে এইটুকু শুধু বলতে পারি, এই পথটা পার হতে গিয়ে কণ্টকের আস্বাদ যা পেয়েছি, সেটা মিশ্ররস—আঘাতের সঙ্গে মেশানো কৌতুক, খোঁচার সঙ্গে পরিহাসের প্রলেপ।

    গিরীনদা বলেছিলেন, চাকরি-গ্রন্থের প্রথম পাঠ হল—সেলাম। ঐ বস্তুটি ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায় এবং ঠিকমত যদি ঠুকতে না পার, সারা জীবনটা কপাল ঠুকেই কাটাতে হবে। বহুদর্শী বান্ধবের এই মূল্যবান উপদেশ আমি অবহেলা করিনি। শুনলাম, মনিব আমার একাধিক। তার জন্যে দুশ্চিন্তা কিসের? One cannot please every body – এটা হচ্ছে সেই দেশের দর্শন, যেখানে দেবতা নেই। আমাদের দেশে দেবতার সংখ্যা তেত্রিশ কোটি। তাদের সবাইকে খুশী রাখা সম্ভব নয়, দুজন মনিবকে প্লীজ করা এমন কি আর শক্ত?

    ছোট মনিবের সঙ্গেই প্রথম সাক্ষাৎ। তিনি পূর্বাহ্ণেই জানতে পেরেছিলেন তাঁর এই নবীন অনুকর্মীটির ঝুলির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোটাকয়েক তুচ্ছ ডিগ্রী ছাড়া মূল্যবান কিছু নেই। অর্থাৎ, চাকরির বাজারে যেটা আসল সম্পদ — experience, সেখানে সে একেবারেই নিঃস্ব। তিনি আবার শুধু এই ধনেই ধনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব অনেকটা বয়স্ক লোকের চোখে খেলনার মত। ছেলেরা নাড়াচাড়া করে করুক। দেখে কিঞ্চিৎ সস্নেহ কৌতুকের উদ্রেক হতে পারে, এই পর্যন্ত। কিন্তু কাজের জগতে ওগুলো মূল্যহীন এবং অনাবশ্যক।

    তাঁর প্রথম প্রশ্ন হল, আমি কাজকর্ম কতদূর শিখেছি, “এ” ক্লাস কয়েদীর সঙ্গে “বি” ক্লাসের তফাৎ বুঝি কিনা, স্টকবুক, রিলিজ ডায়েরি বা তেইশ নম্বর রিটার্ন সম্বন্ধে জ্ঞান কতখানি, ইত্যাদি। সব ক’টি প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তর শুনে তিনি হতাশভাবে আরাম কেদারায় এলিয়ে পড়লেন এবং তাঁর স্বদেশী ভাষায় আক্ষেপ জানালেন, “আপনারে লইয়া আমি কী করুম?”

    ভদ্রলোকের জন্য সত্যিই বড় দুঃখ হল। মনে মনে সমবেদনা জানিয়ে চলে আসছিলাম। তিনি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে মুখখানা বিকৃত করে বললেন, উঃ, ঘাড়ের ব্যথাটা বড্ড কাবু করলে দেখছি। হ্যাঁ, দেখুন একটা ক্যাজুয়েল ছুটির দরখাস্ত লিখে দিন তো। একদিন—হ্যাঁ, একদিন হলেই চলবে। এই ঘাড়ের ব্যথাটার জন্য।

    একটু থৈমে মুচকি হেসে বললেন, আপনারা সব বিদ্বান লোক। দেখি কি রকম লেখেন।

    লিখলাম দরখাস্ত। বুঝলাম জীবনের আসল পরীক্ষা এই শুরু হল। পরীক্ষা অনেক দিয়েছি, সারা জীবন রাত জেগে আর ঝুড়ি ঝুড়ি কেতাব গলাধঃকরণ করে “সেনেট হল” কিংবা “দ্বারভাঙ্গার” পাঁচতলায় গিয়ে উদ্‌গিরণ করেছি। সে-সব আজ ধুয়েমুছে নির্মূল হয়ে গেল। তার খবর আর কেউ কোনোদিন জানতে চাইবে না।

    জেলসাহেব আমার লেখা কাগজখানায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সেই চোখ কপালে তুললেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে ফেটে পড়লেন তাঁর নির্জলা নিজস্ব ভাষায়—এডা কী ল্যাখলেন? এ কি আপনার ইস্কুলের দরখাস্ত? অ্যাঁ! রেফারেন্স কই? অফিসিয়েল করেপণ্ডেস্। প্রথমেই চাই রেফারেন্স। ওড়াও কি আপনি শেখেন নাই? ন্যান্‌, ল্যাখ্যেন-

    আমি কাগজ কলম নিয়ে তৈরি হলাম। মনিব ডিকটেশন দিলেন।

    Honoured Sir,

    With reference to the pain on my neck dated, দাঁড়ান (ক্যালেণ্ডার দেখে বললেন) dated the 20th instant, I have the honour to state —ব্যাস, এইবার ল্যাখ্যেন, একদিনের ছুটি চাই। শ্যাষে লাগাবেন I have the honour to be Sir, your most obedient servant বোঝলেন?

    সরকারের অশেষ কৃপা। শুধু চাকরিই দেননি, তার সঙ্গে দিয়েছিলেন একখানি বাসা। শুধু রাজকন্যা নয়, তার সঙ্গে অর্ধেক রাজত্ব। ছোট্ট একখানি বাংলো। পেছন দিকে পাথরের পাঁচিল-ঘেরা। পাইন বনের ভিতর দিয়ে এঁকে-বেঁকে উঠে গেছে পীচঢালা পথ; মিশেছে গিয়ে ভিক্টোরিয়া রোডের সঙ্গে। সামনেও নেমে গেছে সর্পিল রাস্তা। হারিয়ে গেছে গভীর উপত্যকার অদৃশ্য গর্ভে। বাড়ির ঠিক গায়ে একফালি জমি; যার মালিকানাস্বত্ব আমার, কিন্তু দখলী-স্বত্ব ভোগ করছিল পাড়ার যত ছোট ছোট পাহাড়ী ছেলেমেয়ের দল। প্রতিদিন এমন একটি জৈব কর্ম ওরা ওখানে অসঙ্কোচে করে যেত, যেটা ওদের কাছে অবশ্যকরণীয় হলেও, তার ফলটা আমার চক্ষু এবং নাসিকার পক্ষে আরামদায়ক ছিল না।

    শিক্ষানবিশির ফাঁকে ফাঁকে আমার প্রচুর অবসর। তাকে ব্যবহার করবার মত কাজ বা অকাজ কোনোটাই চোখে পড়ে না। তাই অগত্যা ঐ জমিটা নিয়েই পড়া গেল। উদ্দেশ্য—ফুলের চাষ। কাস্তে কোদাল, খুরপী-শাবলের সশস্ত্র আক্রমণে জমির চেহারা তো বদলে গেলই, আমার চেহারাতেও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা দিল।

    সেদিন বিকালবেলা। বিপুল উদ্যমে কাজে লেগে গেছি। হঠাৎ পেছনে বিকট আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম। মনে হল যেন একটা ফাটা কাঁসার থালায় কে লোহার মুশল নিয়ে আঘাত করল। ফিরে চাইতেই চোখে পড়ল অনতিদূরে দুটি পর্বত-দুহিতা—প্রৌঢ় আর তার পাশে তন্বঙ্গী তরুণী। ভাবছি, এই বিচিত্র শব্দ কি এদের কারো কণ্ঠ থেকেই—কান জুড়িয়ে গেল জলতরঙ্গ বাজনার মধুর মূর্ছনায়। তরুণীটি সম্ভবত আমার হতভম্ব ভাব লক্ষ্য করে কলস্বরে হেসে উঠলেন। আমি বিমূঢ় বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।…হাসি এত সুন্দর! মানুষ এমন করে হাসে, তা তো কখনো শুনিনি! কিংবা হয়তো এ মানুষ নয়, কোন মধুকণ্ঠী কিন্নরবালা সহস্রশীর্ষ হিমালয়ের নিভৃত অন্তরাল থেকে মেঘের ভেলায় ভেসে এসে দাঁড়াল আমার বাগানের পাশটিতে।

    শিউরে উঠলাম। ভগ্ন কাংস্যখণ্ডে ঘা পড়ল। প্রৌঢ়ার শ্রীমুখ থেকে বাণী নির্গত হল। কিন্তু একবর্ণও বোধগম্য হল না। তরুণীটি যেন অপ্রতিভ হয়ে ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে বললেন, ইনি বড়ী আম্মা, আমি কাঞ্ছী।

    ও-ও, ইনিই তাহলে স্বনামধন্য বড়ী আম্মা! আমাদের সহকর্মী ডাক্তার থাপার জ্যেষ্ঠা মহিষী। এসে অবধি ডাক্তারের ছেলেমেয়েদের কাছে অনর্গল শুনেছি এঁর কাহিনী। কদিন ইনি ছিলেন না। কার্সিয়ং-এর কাছে কোন্ পাহাড়ী গ্রামে গিয়েছিলেন, তাঁর ভাইঝিকে নিয়ে আসতে। এই কাঞ্ছীই তাহলে সেই ভাইঝি

    বড়ী আম্মাকে যথারীতি অভিবাদন জানালাম। তাঁর কণ্ঠ-গিরি আবার কী একটা উদ্‌গিরণ করল। মেয়েটি বুঝিয়ে দিল, বড়ী আম্মা বলছেন, এত কষ্ট করে এই বাগান কার জন্যে করছ বাবুজী? ফুল ফুটলে খোঁপায় পরবার লোকটি তো দেখছিনে। তিনি কবে আসবেন? –

    কণ্ঠ যতই ভয়াবহ হোক, সুরটি অন্তরঙ্গ। বললাম, তা তো জানিনে।

    —জানে-না কি রকম?

    —কারুর খোঁপার দেখা তো পাইনি আজও। কেমন করে জানবো?

    —ও-ও, বলে নেপথ্যে কাঞ্ছীর সঙ্গে মাথা নেড়ে কি বাক্য-বিনিময় হল। তারপর আবার বললেন, আমরা তাহলে সন্ধান করি?

    বললাম, আপনি গুরুজন। করতে পারেন বৈকি। কিন্তু যিনি আসবেন, তাঁকে গোড়াতেই বলে দেবেন, এখানে খোঁপায় গুঁজবার মত ফুল পেতে পারেন, কিন্তু মুখে গুঁজবার মত অন্নের বড় অভাব। ওটার ব্যবস্থা আপনাকেই করতে হবে।

    আমার প্রস্তাব শুনে কিংবা আমার অভিনব হিন্দীর বহর দেখে এবার কাঞ্ছীর হাসির বাঁধন খুলে ছড়িয়ে পড়ল, সুরময় স্বচ্ছন্দ ধারায়। তার সঙ্গে হঠাৎ যোগ দিলেন বড়ী আম্মা। প্রচণ্ড ল্যাণ্ডস্লিপের বিপুল চাপে হারিয়ে গেল পাহাড়ী ঝরণার কলধ্বনি।

    ডাক্তার থাপা আমার প্রতিবেশী। দেখা হয় রোজ। গুড মর্নিং বিনিময় হয়। কিন্তু ঘনিষ্ঠতা হয় না। নির্বিরোধ ভালমানুষ। প্রায়-অদৃশ্য চোখ-দুটিতে কেমন একটা নির্লিপ্ত দৃষ্টি। একদিন একটু জ্বরভাব হতেই ডেকে পাঠালাম। এলেন। বাঁ হাত গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে বাঁধা

    —ও কি? হাতে কি হল ডাক্তার?

    ডাক্তার ঠোঁট উল্টে ডান হাতে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী করে বললেন, দ্যাট ওল্ড ট্রাবল

    তাঁর ক্ষুদ্র চোখদুটোর ভিতর থেকে প্রচ্ছন্ন কৌতুক উঁকি দিতে লাগল। বুঝলাম, ব্যাপারটা ডাক্তারের দাম্পত্য-জীবন ঘটিত। এত কাছে এই পাশের বাড়িতে বসে সে সম্বন্ধে অজ্ঞতা রক্ষা করা যে কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, একথা ডাক্তারের অগোচর ছিল না।

    ডাক্তার থাপা দ্বিপত্নীক। বিবাহদ্বয়ের ব্যবধান পনেরো বছর। শোনা যায়, এই দীর্ঘকাল ঘর করবার পরেও সে ঘর যখন একটি শিশু-মুখ দর্শনে বঞ্চিত রয়ে গেল, বড়ী আম্মা স্বামীকে আদেশ করলেন, বিবাহ কর! নিরীহ ডাক্তার সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। হয়তো বা কপালকুণ্ডলার মত একবার অস্ফুটে উচ্চারণ করেছিল, বি-বা-হ! কিন্তু সে শুধু একটিবার। দ্বিরুক্তির দুঃসাহস হয়নি নিশ্চয়ই। এমনি করে এলেন কাঞ্ছী আম্মার কোন্ দূর সম্পর্কের বোন; উনিই আনলেন জুটিয়ে। বছর না ঘুরতেই ডাক্তারের সংসারে শুরু হল পুত্র-কন্যার প্রসেশন। কিন্তু কাঞ্ছী আম্মার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শুধু জন্মদান। বাকী সবটাই বড়ী আম্মা তুলে নিলেন তাঁর নিজের হাতে। তাঁর বিশাল সংসারে, কড়া ডিসিপ্লিন এবং সকলের ওপরেই তাঁর সমদৃষ্টি। ডাক্তারের সঙ্গে পুত্রকন্যার পার্থক্য শুধু বয়সের। শাসনপদ্ধতির যে তারতম্য, সেও কেবলমাত্র বয়সের অনুপাতে। ছোটদের বেলায় চড়চাপড়, বড়দের বেলায় হকি-স্টীক কিংবা চ্যালা কাঠ।

    সংক্ষেপে এই হল ডাক্তার থাপার স্লিং-বদ্ধ বাম হস্তের ইতিহাস।

    ডাক্তার আমাকে কোনরকম পরীক্ষা না করেই বললেন, টেক এ কাপ অফ টী। আমি ডাক্তার বোসকে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।

    আমি আপত্তি করলাম সামান্য ব্যাপারে আবার ডাক্তার বোসকে ডাকাডাকি কেন? তুমিই দাও না যা হোক একটা ওষুধ পাঠিয়ে।

    ডাক্তার হেসে বললেন, আমি তো চিকিৎসা করি না, চাকরি করি।

    আমি তাকিয়ে আছি দেখে, আর একটু পরিষ্কার করে বললেন, জেলডাক্তারি করছি এক নাগাড়ে এই পঁচিশ বছর। বুঝতেই পার—

    সেদিন বুঝিনি। বুঝেছিলাম ক’দিন পরে। সে-কথাটা এখানেই বলে রাখি।

    শীতের দার্জিলিং। বেলা চারটে বেজে গেছে। অফিসের দোতলায় বসে একটা কি রিটার্ন করবার চেষ্টা করছি। ঘরের কোণে চিমনি জ্বলছে। অর্থাৎ সরকারী বরাদ্দমত কাঠ পোড়াতে হয়, তাই পুড়ছে। কিন্তু তার ফলাফল সম্বন্ধে কেউ উৎসুক নয়। প্রত্যেকের টেবিলের পাশেই একটা করে লোহার তোলা উনুন। তার মধ্যে জ্বলছে কাঠকয়লা। দু-আঙুলকাটা দস্তানা পরে একটু লিখছি আর হাতটা সেঁকে নিচ্ছি। একটা বাঁশির টানা সুর কানে এল। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে উঠল তার প্রতিধ্বনি—তীক্ষ্ণ কর্কশ হুইসিলের ঘন ঘন আর্তরব। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই জেলগেটের পেটা ঘণ্টাটাকে কে প্রাণপণে পিটতে শুরু করে দিল। ব্যাপার কি অনুমান করবার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল এক সিপাই। বুট্ ঠুকে সেলাম করে বলল, পাগলী হো গিয়া।

    —পাগলী হো গিয়া! কে পাগল হল?

    —নেহি, নেহি, কৈ নেহি; পাগলী ঘণ্টী, এলারাম্।

    এবার বুঝলাম, এটা হচ্ছে জেলের এলার্ম (alarm)। ছুটলাম ভিতরে। লাঠি আর বন্দুক নিয়ে দু’দল সিপাইও দেখলাম ছুটে আসছে ডবল মার্চ করে। রক্তচক্ষু, পাকানো- গোঁফ হাবিলদার খড়্গবাহাদুর সুনোয়ার ভাঙা মোটা গলায় “কম্যাণ্ড” দিচ্ছে পাহাড় ফাটিয়ে। কয়েদীগুলো প্রাণভয়ে এবং প্রাণপণে ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে লম্বা লম্বা ব্যারাকগুলোর মধ্যে। যারা ছুটতে পারছে না কিংবা পিছনে আছে, তাদের পিঠে পড়ছে -বেটনের ঘা। জমাদার নোট বুক আর পেন্সিল নিয়ে ছুটোছুটি করছে ‘গুনতি’ মেলাবার জন্য। দেখতে দেখতে জেলের ভিতরকার রাস্তাগুলো সব ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু হাসপাতালের সামনে পড়ে আছে রিয়াজুদ্দিন মেট, যার মুখে হিন্দী বাৎ শুনে মনে করেছিলাম, ওর দেশ বোধ হয় ছাপরা কিংবা মজঃফরপুর। এখন শুনলাম, অকথ্য এবং অশ্রাব্য বরিশালীয়া ভাষায় ও কার মুণ্ডুপাত করছে, আর মাঝে মাঝে মাটিতে থুতু ফেলছে; তার সঙ্গে রক্ত। কয়েক গজ দূরে উত্তেজিতভাবে দাঁড়িয়ে এক ভুটিয়া। ছ’ ফুট লম্বা, পরিধিও বোধ হয় চার পাঁচ ফুটের কম নয়। দুজন ওয়ার্ডার তাকে দু’দিক থেকে ধরে আছে, আর কথা বলতে গেলেই বেটন। এমন সময় জেলর সাহেব তাঁর বিপুল দেহ নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পৌঁছলেন এবং দু-একটা কথা শুনবার পরেই তাঁর হাতের লাঠিখানা ভেঙে ফেললেন ভুটিয়ার পিঠের ওপর। তারপর ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে হুকুম দিলেন, ডিগ্রিমে লে যাও।

    ভুটিয়াকে cell-এ নিয়ে যাওয়া হল।

    ঘটনাটা যা শুনলাম, সত্যিই “পাগলী” হবার মত।

    ডাক্তার থাপা পনের বছর জেলে চাকরি করার পর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে আবিষ্কার করেছিলেন, মানুষের যত রকম ব্যাধি আছে তাদের দুটো দলে ভাগ করা চলে—বুখার আর পেটগড়বড়। ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, বসন্ত, নিউমোনিয়া—এসব হল বুখার। আর কলেরা, ডিসেন্ট্রি, ডাইরিয়া, কোলাইটিস্—এগুলো হচ্ছে পেটগড়বড়। রোগ শ্রেণীভুক্ত হবার পর চিকিৎসাও সরল হয়ে গেল। অনাবশ্যক জটিলতা না বাড়িয়ে এই দু’ দল রোগের জন্যে তিনি দুটিমাত্র মিক্চার ঠিক করে দিলেন। কুইনাইন আর কার্মিনেটিভ একটা সাদা দাওয়াই আর একটা লাল দাওয়াই।

    ডাক্তার থাপাকে কোনো কম্পাউণ্ডার দেওয়া হয়নি। নিজস্বহিন্দীভাষী বরিশালীয়া মেট রিয়াজুদ্দিনই ছিল তাঁর হাসপাতালের পিওন, চাপরাসী, নার্স এবং কম্পাউণ্ডার। তার উপরে ডাক্তারের নির্দেশ ছিল, রুগীদের রোগের ফিরিস্তি শোনবার দরকার নেই, স্রেফ্ দেখতে হবে সে কোন্ দলে পড়ে—বুখার না পেট-গড়বড়। যদি বুখার হয়, সাদা দাওয়াই আর পেটগড়বড় হলে লাল।

    হাসপাতালে ডাক্তারের আবির্ভাব সকালে মাত্র একটি ঘণ্টা এবং তখন তাঁর একমাত্র কাজ সংবাদপত্র পাঠ। বাকী সব রিয়াজুদ্দিন। দিনে দু’বার করে তার ওষুধ বিতরণ। সকাল ন’টা আর বিকাল চারটা। রুগীরা জড়ো হলেই যুদ্ধশিবিরে সেনাপতির মত তার হুঙ্কার শোনা যায়—বুখারওয়ালা ইধার বৈঠো, পেটগড়বড় উধার যাও।

    শিক্ষাপ্রাপ্ত সৈন্যদলের মত লোকগুলোও সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট লাইনে আলাদা হয়ে যায়। রিয়াজুদ্দিন মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়—মুখ তোলো এবং তারপরেই শেষ কমাণ্ড, হাঁ করো। রুগীরা আকাশের দিকে হাঁ করে বসে থাকে আর দুটো প্রকাণ্ড বোতল থেকে খানিকটা করে তরল পদার্থ ঘটাৎ ঘটাৎ করে তাদের মুখগহ্বরে ঢেলে দেওয়া হয়। তারা নিঃশব্দে, বোধহয় খুশী হয়েই চলে যায়।

    বছরের পর বছর ধরে রিয়াজুদ্দিন মেট এমনি করেই তার প্রভুর নির্দেশ বিশ্বস্তভাবে পালন করে আসছে, হয়তো আরো কত বছর পালন করত। কিন্তু, কি ছিল বিধাতার মনে। হঠাৎ একদিন বোতল বদল হল। বুখারের দল সেদিন বেজায় খুশী। কুইনাইন-গোলার বদলে পেয়ে গেল মিষ্টি কার্মিনেটিভ। কিন্তু অদৃষ্ট মন্দ ছিল পেটগড়বড় দলের। তারা জানাল প্রতিবাদ। তাদের মধ্যে ছিল এক ভুটিয়া। সে তার নিজস্ব ভাষায় মেটকে দিল গালাগালি। মেট কথা না বুঝলেও সুরটা বুঝল, এবং সে গালি সুদসুদ্ধ ফিরিয়ে দিল তার পেটেণ্ট বরিশালীয়া হিন্দীতে। তারপর যে সরোষ সম্ভাষণ ও প্রতিসম্ভাষণ শুরু হল, সে দৃশ্যের আর একটিমাত্র দৃষ্টান্ত আছে পৃথিবীর ইতিহাসে—টাওয়ার অব্ ব্যাবেলের মাথার উপর। ভুটিয়া স্বল্পবাক্ জাতি। মুখের চেয়ে হাতের ব্যবহার তাদের কাছে বেশী প্রশস্ত। অতএব বাষট্টি পাউণ্ড ওজনের এক চপেটাঘাত এবং মেটপুঙ্গবের ঘূর্ণমান অবস্থায় পতন। লোকজন ছুটে এসে দেখল, এই পতনকার্যে মেট-সাহেবের চার-চারটি দন্ত তার অনুগমন করেছে। তার বিকট বিলাপে আকৃষ্ট হয়ে যে ওয়ার্ডারটি দৃশ্যপটে আবির্ভূত হল সে দিশাহারা হয়ে এবং আর কোনো রাস্তা না দেখে বাজিয়ে দিল হুইসিল। সঙ্গে সঙ্গে “পাগলী”।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডাইস লস্ট – জন মিল্টন
    Next Article ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }