Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌহকপাট – জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)

    জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) এক পাতা গল্প980 Mins Read0

    লৌহকপাট – ৪.১

    এক

    সাধারণ ভাবে দেখতে গেলে, লেখক ও পাঠকের মধ্যে যে সম্পর্ক, সেটা দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক। প্রথম জন দেয়, দ্বিতীয় জন নেয়। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, সম্পর্কটা পারস্পরিক, যাকে বলে মিউচুয়্যাল। পাঠকও দেয়, অনেক সময় অকাতরে, এবং লেখক সে দান অজ্ঞাতসারে গ্রহণ করে।

    নিতান্ত দৈবক্রমে সহসা যেদিন লেখকের ভূমিকায় নেমে পড়েছিলাম, তারপর থেকে বুঝেছি, অদৃশ্য হাত থেকে পাওয়া সেই অজানা দানের দাম অনেক।

    জানি, সকলে এ-মত মানতে চাইবে না; বলবেন, লেখক যেখানে স্রষ্টা, তার সৃষ্টিই তো তার মন ভরে দেয়। পাঠকের কাছ থেকে কি এল আর না এল, সে বিষয়ে সে উদাসীন।

    কথাটা আংশিক সত্য। নিজের সৃষ্টির মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে। কিন্তু তার গভীরতা থাকলেও স্থায়িত্ব বড় কম। খোলা পাত্রে রাখা কর্পূরের মতো দুদিনেই উবে যায়, যদি তার উপরে একটি আচ্ছাদন না থাকে। সেই আচ্ছাদন হল পাঠকের স্বীকৃতি।

    যে-আনন্দ শুধু আমার, যেখানে আপনার অংশ নেই, তার মধ্যে তৃপ্তি কোথায়? একা আমি যা পেলাম সেটা নিছক ভোগ, অন্যের সঙ্গে ভাগ করে যা পেলাম, সেটা উপভোগ।

    অনেক সময় দেখা গেছে, আমার কাছে আমার সৃষ্টির কোনো মূল্য নেই, কিন্তু আপনার কাছে আছে। আমি কিছুই পেলাম না, আপনি তাকে গ্রহণ করলেন, সেখানে সেই গ্রহণই আমার পরম পাওয়া।

    বিখ্যাত স্কটিশ লেখক এ জে ক্রোনিন যখন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘হ্যাটাস্ ক্যাসল’ লিখতে শুরু করেন, তখন তাঁর বয়স তেত্রিশ। ডাক্তার মানুষ; লেখার নেশা কোনোকালে ছিল না। সাহিত্যিক হবার দুরাশা কোনোদিন পোষণ করেন নি। দীর্ঘ রোগভোগের পর স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে হাইল্যাণ্ডসে ঘুরছিলেন। হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে অগত্যা একদিন কালি-কলমের শরণ নিলেন। একখানা উপন্যাস। একটু একটু করে এগুতে লাগলেন। মাঝামাঝি পৌঁছে মনে হল, কিছুই হয় নি, আগাগোড়া সবটাই পণ্ডশ্রম। পাণ্ডুলিপিখানা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ডাস্টবিন-এ। বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লেন। এক চাষী প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা। ডাক্তারকে সে ভালবাসত। অসুস্থ শরীরে জলে ভিজছেন দেখে অনুযোগ দিতে লাগল। ক্রোনিন হয়তো বলতে চান নি; কিন্তু কথায় কথায় ভারাক্রান্ত মনের ব্যর্থতার ক্ষোভ আপনা থেকেই বেরিয়ে এল। উপন্যাসের কাহিনীর একটা মোটামুটি খসড়াও জানিয়ে দিলেন সেই সঙ্গে।

    চাষীর সাহিত্যজ্ঞান সামান্য। কিন্তু অত দিন ধরে যত্ন করে গড়ে তোলা একটা জিনিস নিজের হাতে নষ্ট করার মধ্যে যে বেদনা আছে, সেটা তার মনে লাগল। হয়তো সান্ত্বনাচ্ছলেই বলেছিল, বেশ তো হচ্ছিল লেখাটা। ফেলে দিলেন কেন?

    বেশ হচ্ছিল। একজন অজ্ঞ কৃষকের এই সামান্য স্বীকৃতি যেন এক আশ্চর্য মন নিয়ে এল ক্রোনিনের প্রাণে। তখনই বাড়ি ফিরে এলেন, ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করলেন জলে- ভেজা কাগজগুলো, উনুনের ধারে শুকিয়ে নিয়ে নতুন উদ্যমে শুরু করলেন লেখা। বই যখন বেরোল, রাতারাতি বেস্ট-সেলার।

    অকস্মাৎ জীবনের মোড় ফিরে এল। স্টেথস্কোপ ছেড়ে বরাবরের জন্যে লেখনী আশ্ৰয় করলেন এ. জে. ক্রোনিন। সারা পৃথিবীর এক বিপুল পাঠকসমাজ তাঁকে তার ডিস্পেনসারির অজ্ঞাত কোণ থেকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিল সাহিত্যের আম-দরবারে।

    লেখকের ভাগ্যবিবর্তনে পাঠকের দান অপরিসীম।

    শোনা যায়, এর ঠিক উল্টোটা ঘটেছিল হতভাগ্য তরুণ কবি কীটস-এর জীবনে। উত্তরকালে যাঁর সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ সমালোচকেরা রায় দিয়েছিলেন, বেঁচে থাকলে এ কবি শেক্সপীয়রকে ছাড়িয়ে যেত, ছাব্বিশ বছর বয়সে ক্ষয়রোগে হল তাঁর জীবনাবসান। দায়িত্বহীন সমালোচকের তীক্ষ্ণ আঘাত ছাড়া সাধারণ পাঠকের কাছ থেকে কিছুই তিনি পেয়ে যান নি। যদি পেতেন, আমার মনে হয়, যে জীবন ও ধরণীকে তিনি অমন প্রগাঢ়ভাবে ভালবেসেছিলেন তার দ্বার থেকে হয়তো তাঁকে অত শীঘ্র বিদায় নিতে হত না।

    কিন্তু সব দেশেই একদল ব্যর্থ লেখক ও উন্নাসিক সমালোচক ‘সাধারণ পাঠক’কে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখে থাকেন। ‘জনপ্রিয়’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে তার মধ্যে বেশ খানিকটা শ্লেষ না মিশিয়ে ছাড়েন না। তাঁদের মতে যে-বস্তু অনেকে পড়ে তার মধ্যে বস্তু নেই। কে জানে, ‘অনেকে’র উপর এই অবজ্ঞার অন্তরালে কিঞ্চিৎ ‘টক আঙুর’- ক্ষোভ লুকিয়ে আছে কি না!

    তাঁরা যাই বলুন, এ-কথা না মেনে উপায় নেই, বৃহৎ পাঠকগোষ্ঠীর সাগ্রহ দৃষ্টি যিনি লাভ করেছেন, সে লেখক পরম ভাগ্যবান। যিনি শুধু কৌতূহল জাগাতে পেরেছেন, তিনিও মন্দভাগ্য নন। যিনি তাও পারেন নি, চারদিক থেকে পেয়েছেন শুধু ঔদাসীন্য, তাঁর মতো দুর্ভাগা আর নেই।

    আজ থেকে দশ বছর আগে নিছক খেয়ালের বশে যেদিন ‘লেখনী ধারণ করেছিলাম—কথাটা বোধহয় ঠিক হল না, লেখনীকে চালনা করেছিলাম তার স্বধর্ম থেকে পরধর্মে, ‘ড্রাফট, নোটিং আর সিগনেচার’-এর বাঁধা পথ থেকে অজানা পথে, ‘সাহিত্য’ নামক অজ্ঞাত ও নিষিদ্ধ রাজ্যের সীমানায়—সেদিন আমার মনশ্চক্ষে অনাগত পাঠকের যে-রূপটি ভেসে উঠেছিল, সেটা উদাসীনের রূপ, ইংরেজিতে যাকে বলে কোল্ড। তোষ নয়, রোষও নয়, নির্বিকার তাচ্ছিল্য। তার বেশি আর কোনো প্রত্যাশা আমার ছিল না। কেমন করে থাকবে? লেখক তো রাতারাতি জন্মায় না। তার পিছনে দীর্ঘদিনের সাধনা চাই, চাই অবিশ্রান্ত অনুশীলন। সেখানে একটি বৃহৎ শূন্য ছাড়া আর কোনো মূলধন যার নেই, পাঠক মহারাজের দৃষ্টিপ্রসাদ দূরে থাক, দৃষ্টিপাতের সৌভাগ্যই বা আশা করবে সে কোন্ অধিকারে?

    তাছাড়া, কী তার বিষয়বস্তু। রাজ-রাজড়ার গৌরব-কাহিনী, অভিজাত সমাজ বা সুখী সংসারের মধুর আলেখ্য, কিংবা বিশ্বনাথ কবিরাজ যাকে বলেছেন ‘ধীরোদাত্ত সুমহান’ মানব-গোষ্ঠীর কীর্তিগাথা অথবা আধুনিক মতে ‘মেহনতী মানুষের জীবনযন্ত্রণা’–এর কোনোটাকে অবলম্বন করে মহৎ সাহিত্য রচনার আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে সে আসে নি। সে সুযোগ ও সামর্থ্য তার থাকলে তো? লোকচক্ষুর অন্তরালে যে মসিলিপ্ত সঙ্কীর্ণ জীবনধারা যুগ যুগ ধরে অবরুদ্ধ হয়ে আছে, মানবতার প্রাথমিক স্বীকৃতি পর্যন্ত যেখানে গিয়ে পৌঁছয় নি, তারই ভিতর থকে কয়েকটি খণ্ডচিত্র আহরণ করে লৌহতোরণের একটা পাল্লা খুলে বাইরের পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিল। তার মধ্যে না ছিল চোখ- ধাঁধানো বর্ণ-সম্ভার, না ছিল তাক-লাগানো শিল্প-শৈলী। অত্যন্ত সাধারণ সুরে বলা কতগুলো অবাঞ্ছিত মানুষের কলঙ্কের কথা। সংসারে কার তাতে কী প্রয়োজন? কোন্ কল্যাণ সে বয়ে আনবে সৎ ও সভ্য সমাজের দ্বারে? কে শুনবে সে কাহিনী? এই প্রশ্নটাই মনের মধ্যে মুখর হয়ে উঠেছিল।

    দীর্ঘ আট বছর পরে কী পেলাম আর ন্যায়ত কী আমার পাওনা ছিল, মনে-মনে তার সালতামামির খসড়া করতে গিয়ে বারবার শুধু একটি কথাই মনে হচ্ছে—সংসারে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে কী দুস্তর ব্যবধান! পাওয়া যে আমার প্রাপ্যকে এমন করে ছাড়িয়ে যাবে, কে ভেবেছিল? যা পেয়েছি, তার মধ্যে কতটা প্রশস্তি আর কতটা দোষারোপ, সে প্রশ্ন আমার কাছে অবান্তর। কারা খুশী হয়ে জিন্দাবাদ দিয়ে গেছে, আর কারা রুষ্ট হয়ে নিন্দাবাদ শুনিয়ে গেল, তার হিসাবও অর্থহীন। সাড়া যে মিলেছে, সেইটাই তো সবচেয়ে বড় পুরস্কার। দীর্ঘদিন ধরে আমি যা দেখেছি, তার কথা যেমন করেই বলে থাকি না কেন, সে বলা একেবারে ব্যর্থ হয় নি, সাধারণ মানুষের সংবেদনশীল হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি, তার চেয়ে বড় গৌরব আর কী থাকতে পারে? আজ মুক্তকণ্ঠে কৃতজ্ঞ অন্তরে এই কথাটি বলে যেতে চাই।

    এ শুধু আমার ঋণস্বীকারের তাগিদ নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছুটা জবাবদিহির দায়। আমার ‘পাঠক-পাঠিকা’ নামক কঠোর মনিবের কাছে জবাবদিহি।

    কথাটা আর একটু খুলে বলা প্রয়োজন।

    যে-সব খ্যাতনামা ব্যক্তি লেখকদের কাছ থেকে ভুরি ভুরি বই উপহার পেয়ে থাকেন এবং প্রত্যুপহারস্বরূপ দরাজহস্তে প্রশংসা-পত্র বিতরণ করেন, আমি তাঁদের কৃপা-লাভে বঞ্চিত রয়ে গেছি। সুতরাং প্রসিদ্ধ মাসিক বা সাপ্তাহিকের পাতায় ক্ষুদ্র অক্ষরে মুদ্রিত বৃহৎ বৃহৎ ‘অভিমত’ শোভিত বিজ্ঞাপন আমার ভাগ্যে জোটে নি। আমার যারা পাঠক, তাদের বেশির ভাগই খ্যাতি-প্রতিষ্ঠাহীন সামান্য মানুষ। বই তাদের অর্থমূল্যে সংগ্রহ করতে হয়, কাজেই না পড়ে ছাড়ে না। পড়ে, বন্ধুদের পড়ায় এবং ভাল-লাগা ও মন্দ- লাগা দুটোকেই প্রচণ্ডভাবে প্রকাশ করে। সাধারণত সে প্রকাশ-স্থল—ক্লাব, হস্টেল, কলেজের করিডোর, পাড়ার লাইব্রেরি, রেলের কামরা কিংবা মেস বা পারিবারিক খাবার ঘর। যাদের উৎসাহ কিঞ্চিৎ প্রবল, তারা আর একটু এগিয়ে যায়, অর্থাৎ কালি-কলমের আশ্রয় নেয়। না, সাময়িক পত্রে প্রবন্ধ বা পত্রাঘাতের উদ্দেশ্যে নয়। সেখানে প্রথম বাধা—তারা সম্পাদকের প্রিয়পাত্র বা পরিচিত নয়, দ্বিতীয় এবং দুর্জয় বাধা, রচনাটা যার সম্বন্ধে সে-লোকটা কোনো কাগজ-গোষ্ঠীর বশ্যতা স্বীকার করে নি, সুতরাং আনুকূল্য বা অনুগ্রহও পায় নি। তখন এই সব উৎসাহী পাঠক-পাঠিকার সামনে একমাত্র খোলা পথ—তাদের মনের কথাটি সরাসরি লেখকের কাছে তুলে ধরা। একখানা চিঠি। তার মধ্যে নিন্দা প্রশংসা অনুকূল বা প্রতিকূল আলোচনা যতটা থাকে, তার বেশি থাকে প্রশ্ন—’এটা কেন হল, ওটা কেন হল না। অমুকের উপর কি আপনি অবিচার করেন নি? তমুক কি আর ফিরে আসবে না? ওর সঙ্গে তার মিলন ঘটালে কী দোষ হত? যাই বলুন, নায়িকা চরিত্রের প্রথম দিকটার সঙ্গে শেষ দিকের সঙ্গতি-রক্ষা হয় নি, আপনি কী বলেন?’ ইত্যাদি।

    মাঝে মাঝে সেই বিচিত্র প্রশ্নে ভরা চিঠির ঝাঁপি যখন খুলে বসি, ভারি কৌতুক লাগে, তার সঙ্গে বিস্ময়। ভেবে চিন্তে, গুছিয়ে, সাজিয়ে বলার যে মুন্সিয়ানা, তা কোথাও নেই। কতগুলো সরল নিরাভরণ আড়ম্বরহীন অন্তরঙ্গ ঘরোয়া উক্তি। কিন্তু তার প্রতিটি ছত্রে যে আন্তরিকতা ও সহজ রসানুভূতির স্পর্শ জড়িয়ে আছে তার একটা কণাও কি পাওয়া যায় নামজাদা সাময়িক পত্রের ভাড়াটে সমালোচকের গাল চিবিয়ে বলা ধোঁয়াটে কিংবা জটিল মুরুব্বিয়ানার মধ্যে?

    পুরনো চিঠির তাড়ার ভিতর থেকে কত অশ্ৰুত কণ্ঠ কানে আসছে। কোনোটা কোমল, কোনোটা কঠোর। কারও সুরে অভিভূতের উচ্ছ্বাস, কারও কণ্ঠে বিচারকের তীক্ষ্ণতা। কিন্তু এক জায়গায় সকলেই এক। সকলেরই কিছু জিজ্ঞাসা আছে।

    একটি প্রশ্ন দেখছি অনেকের। বারংবার এসেছে, নানা আকারে এবং নানাজনের কাছ থেকে—’জেলখানার লোক হয়ে জেলের দরজা খুলে ধরলেন কোন্ সাহসে?’ ‘দরদ প্রীতি ও সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে যাদের দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন, তাদের কঠোর শৃঙ্খলার নিগড়ে বেঁধে রাখাই তো ছিল আপনার সরকারী কর্তব্য। এ দুয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখলেন কেমন করে?’ ‘আপনার সহকর্মী, অনুকর্মী এবং উপরমহল—কে কী ভাবে নিলেন আপনার সাহিত্যকর্ম?’ ‘যে সব রূঢ় এবং স্পষ্ট কথা লিখে গেছেন, তার জন্যে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল কি?’

    এই জাতীয় প্রশ্ন যাঁরা করেছেন, বুঝতে পারি তাঁরা অনেকেই আমার জন্যে উদ্বেগ বোধ করেছিলেন। কেউ কেউ হয়তো সরকারী অফিসের লোক, সুতরাং ভুক্তভোগী। এঁদের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। কিন্তু উত্তর দিতে গিয়ে কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ করছি। সকলেই জানেন, সরকারী দপ্তরখানার সব অংশটা প্রকাশ্য নয়। আজ যদিও তার আওতা থেকে দূরে সরে এসেছি। তবু যা গোপন, তাকে লোকচক্ষুর অন্তরালেই রাখতে চাই। তার দ্বারা হয়তো অনেক মুখরোচক তথ্যের স্বাদ থেকে পাঠককে বঞ্চিত করছি। কি করি, নিরুপায়।

    কারাপ্রাচীরের অন্তরালে যে অলক্ষ্য জীবনস্রোত, আমার আগেও তার কিছু-কিছু অন্তরঙ্গ পরিচয় বাংলা সাহিত্যে রূপলাভ করেছে। তার মধ্যে অনবদ্য শিল্পসৃষ্টির অভাব নেই। যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন রাজনৈতিক বন্দী। কারাশাসনের সঙ্গে জড়িত আমিই বোধহয় প্রথম, যার মাথায় এই অদ্ভুত খেয়াল চেপেছিল। দুঃসাহসের কাজ সন্দেহ নেই এবং দুঃসাহস মাত্রেরই ফলভোগ করতে হয়, আমাকেও হয়েছে। তার অপ্রিয় অংশটা যথাসম্ভব বাদ দিয়ে সেইটুকু শুধু বলি, যার মধ্যে জিজ্ঞাসিত প্রসঙ্গের সঙ্গে হয়তো কিঞ্চিৎ কৌতুকরসের সন্ধান পাওয়া যাবে।

    .

    সকালের ‘ডাক’ এসে পৌঁছল। একরাশ বাদামী রঙের লম্বা লেফাফা ‘অল ইণ্ডিয়া গভর্ণমেন্ট সার্ভিস’। তার আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একখানি হাল্কা সবুজ চৌকো খাম, তার উপরে সুঠাম হস্তাক্ষর। রাবীন্দ্রিক ধাঁচের সঙ্গে মেয়েলি ঢংয়ের সংমিশ্রণ। মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। পাঠিকার চিঠি। এর আগে কয়েকখানা মাত্র পেয়েছি। মোহ তখনও কাটে নি। খুলতেই যেন ধাক্কা খেয়ে স্বপ্নের জাল কেটে গেল। নিতান্ত অ-নারীসুলভ রূঢ় ভাষায় লিখেছেন জনৈক কলেজের ছাত্র—”লৌহকপাট পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখনি সন্দেহ ছিল, একজন জেল-কর্মচারীর কলম থেকে এমন সুন্দর সরস লেখা বেরোয় কি করে? পরে জেনেছি, আপনি একটি পাকা তস্কর, আর এক নম্বর জালিয়াৎ। এ বইয়ের একবর্ণও আপনার লেখা নয়। একজন রাজনৈতিক বন্দীর ডায়েরি থেকে হুবহু টুকে নিয়ে নিজের নামে ছেপে দিয়েছেন। আমাদের বাংলার প্রফেসর মিস্—বলেছেন ক্লাসে। তাঁর ভাই জেলে চাকরি করেন, তাঁর নিজের মুখ থেকে শোনা। এ-কথা আপনি অস্বীকার করতে চান?”

    না, চাই না। কারণ অস্বীকার করে লাভ নেই। একে অধ্যাপিকার উক্তি, তার উপর তাঁর ভাইয়ের সাক্ষ্য, তিনি আবার জেলের লোক—একজন কলেজের ছাত্রের পক্ষে ডবল বেদবাক্য। আমার প্রতিবাদ সেখানে দাঁড়াবে কিসের জোরে?

    ঠিক এরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল আমার এক পরম শুভানুধ্যায়ী প্রাক্তন মনিবের কাছে। পিঠের উপর প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে বললেন, সাবাস! যেখানে যাই, শুধু তোমারই নাম, সেই সঙ্গে পয়সাও বেশ আসছে শুনলাম। তা (এবার গলা খাটো করলেন ভূতপূর্ব মনিব) ব্যাপারটা কি বল দিকিন? রাতারাতি লেখক হয়ে পড়লে কেমন করে? এসব মাল পেলে কোথায়?

    এখানেও অস্বীকার করা বৃথা। তাঁর চোখেমুখে রহস্যময় খুশির হাসি ফুটিয়ে তুলে বললাম, পেয়েছি এক জায়গায়।

    “তাই বল”, ভীষণ ‘খুশি’ হলেন ভদ্রলোক। পরক্ষণেই তাঁর সারামুখে ঘনিয়ে এল নৈরাশ্যের কালো ছায়া। নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কি জানো? সবই হচ্ছে এই কপাল। তা না হলে আমি তো বলতে গেলে সারাজীবন ঐ স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চেই কাটিয়ে এলাম। রাত জেগে একগাদা ডেটিন্যু আর স্টেট্‌প্রিজারের খাতা সেন্সর করে মাথা ধরাই সার হল। আগাগোড়া সবটাই রাজনীতির কচকচি। অমন মিষ্টি গল্প কি একটাও থাকতে নেই।”

    একদিন শুনলাম, ‘লৌহকপাট’-এর আর একজন গ্রন্থকার আবিষ্কৃত হয়েছেন। ডেটিন্যু বা পলিটিক্যাল প্রিজনার নয়, আমারই জনৈক প্রীতিভাজন সহকর্মী ও বন্ধু। এক সময়ে এখানে ওখানে দু-চারটে গল্প, প্রবন্ধ লিখেছিলেন, ছবি আঁকেন, চমৎকার বক্তৃতা করতে পারেন। তার ফলে ডিপার্টমেন্টের নীচের মহলে কিছুসংখ্যক ভক্ত লাভ করেছেন। তাদেরই একজন ছুটি নিয়ে গাঁটের পয়সায় রেল-ভাড়া দিয়ে তাঁর কর্মস্থলে গিয়ে এ রকম ‘যুগান্তকারী গ্রন্থরচনা’র জন্যে উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন জানিয়ে এসেছে। বন্ধুটি রসিক ব্যক্তি। ‘হাঁ’ ‘না’ কিছুই না বলে মধুর হাসি দিয়ে ভক্তকে আপ্যায়িত করেছেন। তারপর আমার সঙ্গে যখন দেখা হল, ব্যাপারটার সরস বর্ণনা দিয়ে যোগ করলেন, “ছদ্মনামের বিপদটা দেখলেন তো? কার নৈবেদ্য কে পায়!”

    ছদ্মনাম নিয়ে একদিন কিন্তু সত্যিই এক ‘বিপদ’ ঘটবার উপক্রম হল। আমার অফিসের এক কর্মীর সঙ্গে বন্ধুর আর এক ভক্তের তুমুল বিরোধ বেধে গেল। এ পক্ষের হাতে অকাট্য প্রমাণ—ছাপাখানা থেকে বাণ্ডিল বাণ্ডিল ‘প্রুফ’ আসতে দেখেছে তার ‘সাহেবে’র নামে। ও-পক্ষ তা শুনবে কেন? তার ‘হিরো’ যে নিজে মুখে স্বীকার করেছেন, তিনিই গ্রন্থকার। মৌন যে সম্মতির লক্ষণ, তার এমন নিদারুণ দৃষ্টান্ত বোধহয় আর কখনও দেখা যায় না। বচসা যখন হাতাহাতির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, আশেপাশের লোকজন এসে ছাড়িয়ে দিল।

    আমার চেয়ে কিছু সিনিয়র একজন ‘দাদা’-স্থানীয় সহকর্মী একদিন লোক-মারফৎ একটি প্রস্তাব পাঠালেন, যাকে রীতিমত লোভনীয় বলা চলে। বইয়ের দৌলতে আমি যে এরই মধ্যে ‘লাল’ হয়ে গেছি, এই ‘খবরটা’ তখন বিভিন্ন জেলের অফিসপাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ‘দাদা’ নিশ্চয় তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ এবং কিঞ্চিৎ প্রলুব্ধ হয়ে থাকবেন। বলে পাঠালেন আমি যা জানি এবং লিখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি চাঞ্চল্যকর মালমসলা তাঁর ভাণ্ডারে সঞ্চিত আছে। ইচ্ছা করলেই তিনি যে কোনো সময়ে সেগুলো লিখে ছাপিয়ে ফেলতে পারেন এবং সে জিনিস হাতে পেলে আমার এই সব জোলো কাহিনীর দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না। সেই জন্যেই সে ‘ইচ্ছা’ সংবরণ করছেন। অনুজ-স্থানীয় বন্ধুর কোনো অনিষ্ট হয় এটা তিনি চান না। মালগুলো তিনি আমাকে দিয়ে দিতে পারেন, অবশ্য কিঞ্চিৎ বাণিজ্যের বিনিময়ে। টারস্‌ আমারই অনুকূল—ফিটি ফিটি।

    ভাবছি, সেদিন যদি সেই সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতাম, ‘দাদা’র দাক্ষিণ্যে আজ আমি কোথায়!

    আর একজন বন্ধুও সত্যিকার বন্ধুর কাজ করেছিলেন। একটা সাধারণ খাম খুলতেই বেরিয়ে পড়ল একখানা পাঁচ টাকার নোট, সেই সঙ্গে বিরাট চিঠি। তার সারমর্ম—আমার মতো একজন প্রতিভাবান লেখককে লাভ করে সমস্ত কারাবিভাগ গৌরবান্বিত, এবং তার সহকর্মী হবার সৌভাগ্যে তিনিও গর্বিত। দুঃখের বিষয়, এখনও আমার লেখার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটে নি। বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও স্থানীয় কোন দোকানে আমার ব‍ই পাওয়া যায় নি। সেই জন্য পাঁচটি টাকা পাঠালেন। বাকী প্রাপ্যের বিল-সমেত দু-খণ্ড পুস্তক যেন অবিলম্বে তাঁর নামে পার্সেল করা হয়।

    আমি টাকা পাঁচটি মণিঅর্ডারে ফেরৎ দিয়ে সবিনয়ে জানালাম, আমার কোনো বইয়ের দোকান নেই, সুতরাং টাকা গ্রহণে অক্ষম। বই দুখানা তাঁর কাছে উপহারস্বরূপ পাঠাবার জন্যে কোলকাতায় প্রকাশককে নির্দেশ দেওয়া হল।

    পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম, যে শহরে তিনি থাকতেন সেখানকার সবগুলো বইয়ের দোকানেই এ বই বিক্রি হচ্ছিল। স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরিও একাধিক কপি সংগ্রহ করেছিল।

    পরের খবর। বই উপহার পেয়ে বন্ধু যত্ন করে পড়েছিলেন এবং কতকগুলো বিশেষ বিশেষ জায়গা লাল পেন্সিলে চিহ্নিত করে সোজা গিয়ে হাজির হয়েছিলেন এমন এক বৃহৎ ব্যক্তির দরবারে, যাঁর হাতে আমাদের জীবনমরণের কলকাঠি। তাঁকে পরিষ্কার করে বুঝিয়েছিলেন, জেলখানার উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থেকেও এই দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখক যেখানে সেখানে যথেচ্ছভাবে প্রচলিত কারা-ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেছে; বন্দীদের জন্যে যে-সব সংস্কারমূলক বিধি-বিধান ও সুযোগ-সুবিধার প্রবর্তন করা হয়েছে এবং হচ্ছে, তার উপর বক্র কটাক্ষ করেছে; বিশ্বস্ত কর্মী এবং সরকার নিযুক্ত সম্মানিত জেল ভিজিটরদের সম্বন্ধে মানহানিকর মন্তব্য করেছে; এবং চোর ডাকাত গুণ্ডা বদমাসদের উপর সস্তা দরদের ভান করে জেল-ডিসিপ্লিনের কোমর ভেঙে দিয়েছে—ইত্যাদি।

    কোনো ব্যক্তিগত কারণে (সুতরাং অপ্রকাশ্য) বৃহৎ ব্যক্তিটি আমার উপরে আগেই রুষ্ট হয়ে ছিলেন। লালরেখাঙ্কিত লাইনগুলো সেখানে কিঞ্চিৎ ইন্ধনের কাজ করে থাকবে। বন্ধু তাঁর কাছ থেকে কী আশ্বাস নিয়ে ফিরেছিলেন, প্রকাশ পায় নি। তবে যে-রকম ব্যস্ততার সঙ্গে ছুটে এসে আমার আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত দিয়ে সবিস্তারে সমবেদনা জানিয়েছিলেন, তার থেকে অনুমান করি, তাঁর দৌত্য একেবারে ব্যর্থ হয় নি।

    প্রতিদিন নানা সূত্র থেকে নানা রকম ভয়াবহ খবর কানে আসতে লাগল। বোঝা গেল, আমার মাথার উপরে খড়্গ শাণিত হচ্ছে। কখন কি ভাবে এসে পড়ে তার জন্যে অপেক্ষা করে রইলাম। যখন সত্যি সত্যি এল, তার আকার ও ওজন দেখে আমার বন্ধু ও তার দলবল তো বটেই, আমিও হতাশ হলাম। ‘টার্ম’ পুরো হবার আগেই আমাকে বড় জেল থেকে মফঃস্বলের ছোট জেলে বদলি করলেন কর্তৃপক্ষ। হয়তো এটাকেই তাঁরা ‘শাস্তি’ বলে ধরে নিয়েছিলেন। পদ বা পকেটে হাত না পড়লেও, বৃহৎ দায়িত্ব থেকে ক্ষুদ্র দায়িত্বে অবতরণ। কিন্তু চাকরির দিক থেকে যেটা ‘শাপ’, অন্য দিকে আমি তাকে ‘বর’ বলেই গ্রহণ করলাম। যে দুষ্কার্য ওঁরা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, অপেক্ষাকৃত নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশে তারই খানিকটা বেশি সুযোগ পাওয়া গেল।

    পরে শুনেছিলাম, তোড়জোড় যেভাবে শুরু হয়েছিল, এত সহজে আমার নিষ্কৃতি পাবার কথা নয়। একজন ব্রিটিশ আমলের শীতলমস্তিষ্ক ঝানু সিভিলিয়ান ক্রুদ্ধ মালিককে কিঞ্চিৎ বাস্তব জ্ঞান দান করাতে ব্যাপারটা আর বেশীদূর গড়ায় নি। কোন্ আইনের কোন্ ধারায় ফেলে বইটাকে বাজেয়াপ্ত এবং তার লেখককে শায়েস্তা করা যায়, এই নিয়ে যখন গবেষণা চলছে, তখন ঐ ভদ্রলোক নাকি বলেছিলেন, ‘তা হয়তো যায়। ও বেচারী আর কী করতে পারে? জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে লড়বে না। তবে আর একটা দিক ভাববার আছে। বইখানা যে রকম পপুলার হয়ে গেছে, ড্রাসটিক কিছু করলে প্রেস আমাদের পেছনে লাগতে পারে।

    এর পরে বৃহৎ ব্যক্তিটি আর অগ্রসর হন নি। হয়তো প্রেস নামক গোলমেলে জিনিসটাকে ঘাঁটাতে যাওয়া সমীচীন মনে করেন নি, চক্ষুশূল লোকটাকে চোখের উপর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েই বোধহয় আপাতত মনের ঝাল মিটিয়েছিলেন।

    আর একজন কর্তাব্যক্তির সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করেই বর্তমান প্রসঙ্গে দাঁড়ি টানতে চাই। তিনি যে দরের এবং যে স্তরের লোক, স্বাভাবিক রাস্তায় অর্থাৎ যাকে বলে নরম্যাল কোর্স-এ তাঁকে আমাদের পাবার কথা নয়। কি করে পেলাম, সেই ক্ষুদ্র ইতিহাসটুকু বলা দরকার।

    শোনা যায়, তাঁকে নিয়ে ততটা না হলেও, তাঁর পাণ্ডিত্য নিয়ে মহাকরণের উচ্চমহল বড় বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন। পাণ্ডিত্য অনেকেরই থাকে, কিন্তু সরকারী ফাইলের যেখানে সেখানে তার উগ্র প্রকাশ মন্ত্রী ও বিভাগীয় প্রধানদের ভাবিয়ে তুলেছিল।

    মফঃস্বলে পাঠিয়েও মহাসমস্যা। যেখানে যে পদে যান, দু-দিন যেতে না যেতেই নীচের মহলে গণ্ডগোল দেখা দেয়। কোথায় নাকি কোনো একজন কেরানীর গাফিলতি উপলক্ষ করে সমস্ত কেরানীকুলকে ডেকে এনে উপদেশচ্ছলে এমন সব বাক্য প্রয়োগ করেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত তারা দল বেধে তেড়ে এসেছিল। ‘পাবলিক’-হামলা তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোনো এক জায়গায় একদল ধর্মঘটী মজুরের জমায়েত কার্ল মার্কস, কেইট্স্ এবং হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতামত উদ্ধৃত করে এমন জ্ঞানগর্ভ দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছিলেন যে কুলীগুলো সেই ভয়েই, শুধু কাজ ছেড়ে নয়, ডেরা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, এবং মালিকপক্ষ এ হেন বিদ্বান ব্যক্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার আবেদন নিয়ে তখনই মোটর নিয়ে ছুটলেন কলকাতায়।

    এমনি করে নানা বিভাগে ঘুরবার পর ভদ্রলোক যখন সরকারের কাছে একটি দুঃসাধ্য ‘প্রব্লেম’ হয়ে উঠলেন তখন কোনো সুরসিক উপরওয়ালার হঠাৎ মাথায় এল—লোকটাকে “জেলে পাঠিয়ে” দিলে কেমন হয়। যে কথা সেই কাজ। এক সপ্তাহ না যেতেই তিনি অপ্রত্যাশিত ভাবে জেলের ঘাড়ে এসে চাপলেন।

    এই যে ব্যবস্থা হল, তার মধ্যে সরকারের কৌতুক বোধ যেমন আছে, কূটনীতিও কম নেই। কারাবিভাগ এমন একটি রাজ্য, যেখানে আর যাই হোক ‘পাবলিক’ নামক কোনো বস্তুর মুখোমুখি হতে হবে না। বক্তৃতার পক্ষেও জেল অতি আদর্শ স্থান। শ্রোতারা ঘুমিয়ে পড়তে পারে, কিন্তু পালিয়ে যেতে পারবে না।

    মহাকরণ কর্তৃপক্ষ এতদিনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।

    কিন্তু সরকারী শাস্ত্রে এক্সপিরিয়েন্স বলে একটা বহু-ব্যবহৃত শব্দ আছে, চাকরির বেলায় বিদ্যা ও পাণ্ডিত্যের চেয়ে যাকে বেশী দাম দেওয়া হয়। আমাদের এই কর্তাব্যক্তিটি অন্য অনেক জায়গায় ঘুরলেও জেলের মুখ দেখেন নি। সুতরাং নতুন তক্তে বসাবার আগে তাঁর জন্যেও কয়েক সপ্তাহ-ব্যাপী একটা শিক্ষানবিসির ব্যবস্থা করতে হল। উদ্দেশ্য—সেখানকার কাজকর্ম, রীতিনীতি এবং লোকলস্কর সম্বন্ধে মোটামুটি জ্ঞানলাভের সুযোগ দেওয়া।

    ব্যবস্থাটা নতুন নয়। ইংরেজ আমলেও দেখেছি। তার আকার যেমন ব্যাপক, প্রকারও ছিল তেমনি সুষ্ঠু। জাঁদরেল জাঁদরেল সব মেজর, কর্ণেল জেলের হাল ধরবার আগে সোজা গিয়ে ঢুকতেন সামান্য একজন ডেপুটি জেলরের ক্ষুদ্র সেরেস্তায়। তার পাশে টুল পেতে বসে প্রথম পাঠ নিতেন তার অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে।

    এই সূত্রে আমাদের স্বনামধন্য খালেকদার কথা মনে পড়ল। কিঞ্চিৎ মোড়ফের হলেও বলে ফেলা যাক।

    প্রথম জীবনে অনেকের মতো আমিও একদিন তাঁর সাকরেদি করেছি। কিছু জানতে চাইলেই তিনি গম্ভীর ভাবে একটি প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উক্তির পুনরাবৃত্তি করতেন—রিড, অ্যাণ্ড ইউ উইল নো। বলে পনেরো কুড়ি বছর আগেকার বিশাল বিশাল সার্কুলার ফাইল পড়তে দিতেন। মই চড়ে ছাদসংলগ্ন র‍্যাকের উপর থেকে আধ ইঞ্চি পুরু ধুলোর স্তর ভেদ করে আমাদেরই সেগুলো পেড়ে আনতে হত। এই জাতীয় কাজের জন্যে দু-তিন জন কয়েদী মোতায়েন ছিল। দাদা তাদের সাহায্য নিতে দিতেন না। বলতেন, এটাও ট্রেনিং-এর অঙ্গ। মই এবং ধুলোর ভয় করলে কাজ শেখা যায় না।

    একবার একজন সদ্য লড়াই-ফেরত আই. এম. এস. মেজরকে (যিনি দু-দিন পর ওঁর ‘বস’ হয়ে বসবেন) খালেকদা ঐ একই আদেশ দিয়ে বসলেন। ভদ্রলোক পাঞ্জাবী, ছ’ফুটের উপর লম্বা; প্রস্থটাও সেই অনুপাতে। উঠে গিয়ে চেরা বাঁশের তৈরি নড়বড়ে মইটাকে ধরে ঝাঁকানি দিতেই তার গোটা কয়েক ধাপ খুলে গেল। মৃদু হেসে দাদার দিকে চেয়ে বললেন, এখুনি যে খুনের দায়ে পড়তে, বাবু।

    একটা রোগা মতন ছোকরা কয়েদী ছিল খালেকদার খাস বেয়ারা। অগত্যা তাকে দিয়েই বইগুলো নামিয়ে আনা হল। সাহেব একটা খণ্ড তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ পাতা উল্টে বললেন, সব তো দেখছি মান্ধাতার আমলের ব্যাপার। কোন্ কাজে লাগবে এগুলো?

    খালেকদা দমবার পাত্র নন। বিজ্ঞের মতো মুখ নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, ‘এই যে বাড়িটা দেখছ সাহেব, যখন তৈরি হয়, এর তলায় একটা ভিত গড়তে হয়েছিল। এখন সেটা মাটির নীচে চাপা পড়ে গেছে, আমাদের কোনো কাজে লাগছে না। আসলে কিন্তু তারই ওপর সব দাঁড়িয়ে আছে। ঐগুলো হচ্ছে সেই ভিত।’

    উনি তখন অ্যাডমিশান ব্র্যাঞ্চ, অর্থাৎ ‘আমদানী সেরেস্তা’র ভারপ্রাপ্ত ডেপুটি জেলার। সাহেব এসেছিলেন দেখতে কি করে কয়েদী ভর্তি করা হয়, কি কি রেজিস্টার আছে তার জন্যে, কি সব তথ্য লেখা হয় সেখানে, কোন্টার পর কি করণীয় ইত্যাদি। খালেকদা জেল কোড়-এর সংশ্লিষ্ট অধ্যায়টি খুলে প্রথমেই তার শিরোনামা নিয়ে পড়লেন—অ্যাডমিশান অফ প্রিজনার্স; শুরু করলেন প্রিজনার্স্ জন্মের আগের পর্ব থেকে, অর্থাৎ প্রিজ বস্তুটি কী, কী তার প্রয়োজন, কোথায় তার সার্থকতা। যে-ভাষায় বলছিলেন সেটা ইংরেজি নিশ্চয়ই, তবে কিংস ইংলিশ-এর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ওঁর নিজস্ব সৃষ্টি। আমরা বলতাম “খালেকদা’জ পেটেণ্ট ইংলিশ”। আমাদের মতো অন্তরঙ্গ সহচর ছাড়া বাইরের লোকের পক্ষে বোধগম্য হবার কথা নয়। মেজর সাহেব কিছুক্ষণ তাঁর মুখের দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে থেকে বললেন, এক্সকিউজ মি, আই ডোন্ট ফলো গ্রীক। বেটার স্পীক্ ইন্ বেঙ্গলি। হামি কুছ কুছ্ বাংলা বুঝে।

    যাক, যা বলছিলাম। সরকারী আদেশে আমাদের এই জ্ঞানী ব্যক্তিটিও জেল-সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ‘ট্রেনিং’ নিতে প্রথমেই আমার অফিসে পদার্পণ করলেন এবং গেট্ পেরিয়েই জেলখানার প্রবীণ অধ্যক্ষ থেকে গোটা স্টাফকে ট্রেন-আপ করতে শুরু করলেন। আমরা এতকাল ধরে যা কিছু করেছি, যে-পথে চলেছি, সব ভুল, সজোরে ও সবিস্তারে সেই কথাই প্রমাণ করে দিলেন। শেষের দিকে যোগ করলেন, আমাদের মধ্যে যেসব দুর্নীতি, অনাচার ও অযোগ্যতা বাসা বেঁধে আছে, সেগুলো দূর করতেই সরকার তাঁকে বিশেষ ভাবে নিয়োজিত করেছেন। (নিয়োগের আসল কারণটা যে আগেই ভিতরে ভিতরে রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল, সে কথা বোধহয় তাঁর জানা ছিল না।) আমার প্রায়-সাদা হয়ে-যাওয়া চুলগুলোর দিকে লক্ষ্য রেখে এবং কত বছর জেলে আছি জেনে নিয়ে মন্তব্য করলেন, গভর্মেণ্টও হয়েছে তেমনি, এক্সপিরিয়েন্স আর একসপিরিয়েন্স! ওটা যেন একটা ফেটিস্ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার তো মনে হয়, অনেক দিন একই জিনিস নিয়ে পড়ে থাকা একটা ড্র-ব্যাক, আপনাদের সব ড্রাইভ চলে গেছে, ইনিশিয়েটিভ নেই, শুধু গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে চলেছেন। আমাকে কিছু নিউ ব্লাড আমদানি করতে হবে দেখছি। চলুন, ভেতরটা একবার দেখে আসি।

    তাঁর আগমন সংবাদ জেলের ভিতরে পৌঁছে গিয়েছিল। শীতকাল। প্রচুর মরসুমী ফুল ফুটে আছে এখানে ওখানে। একজন মাতব্বর গোছের হাজতী আসামী কতকগুলো বড় বড় গাঁদা তুলে বিশাল এক মালা গেঁথে রেখেছে। আমরা সদলবলে হাজত-ওয়ার্ডের বারান্দায় উঠতেই সে অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে এগিয়ে এল। উনি থমকে দাঁড়িয়ে রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, কতদিনের জেল তোমার?

    —আজ্ঞে জেল নয়, আমি আণ্ডারট্রায়াল।

    —কী কেস্-এ এসেছ?

    —ডাকাতি কেস্।

    —আমি ডাকাতের হাতের মালা নিই না।

    মুহূর্তের জন্যে লোকটা যেন একটু ক্ষুণ্ণ হল। তারপরেই বেশ সপ্রতিভ হাসি হেসে বলল, ভুল করলেন হুজুর। আমি যে ডাকাত সেটা এখনো প্রমাণ হয় নি। বলে মালাটা হাতে জড়াতে জড়াতে গম্ভীর ভাবে নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। উনি আর এগোলেন না। একটা দৃপ্ত ভঙ্গি করে ফিরে এলেন। বাইরে এসে বললেন, লোকটা তো ভারি পাজী দেখছি! আমার মুখের ওপর জবাব করে! এই সব বদমাসগুলোকে কড়া শাসনে রাখা দরকার। হ্যাড আই বিন ইউ, আমি ওটাকে এখনই সেল্-এ পাঠিয়ে দিতাম।

    ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হলেও আমি যখন সেটা না বোঝার ভান করে নিশ্চেষ্ট রইলাম, তিনি কিঞ্চিৎ শ্লেষের সুরে যোগ করলেন, আমার মনে হয় সনেস্ জিনিসটা সাহিত্যে হয়তো চলে, কিন্তু অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর পক্ষে মারাত্মক। কী বলেন?

    বুঝলাম, আমার ‘অপকর্মে’র খবরটা আগেই ওঁর কানে পৌঁছে গেছে এবং তাতে করে আর যাই হোক, আমার সম্বন্ধে তাঁর মনোভাবটা অনুকূল হয়নি! কয়েকদিন পরে সেটা আরও স্পষ্ট হল। ট্রেনিং পর্ব (কাগজে কলমে তাঁর, কিন্তু আসলে আমার) যেদিন শেষ হল, চলে যাবার মুখে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ভালো অফিসার বলে আপনার সুনাম আছে শুনেছি, এ-কদিনে আমার ইম্প্রেশানও নট্‌ ব্যাড; কিন্তু এসব কী করছেন?

    বক্তব্যটা হঠাৎ ধরতে না পেরে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখের দিকে তাকাতেই যোগ করলেন, এ-রকম একটা বদনেশা জোটালেন কোত্থেকে! না না; ওসব ছাড়ুন। সেণ্টিমেণ্টাল সিনেমার গল্প না লিখে কাজকর্মের দিকে মন দিন।

    একটু মজা করবার লোভ হল। আনন্দে বিগলিত হয়ে বললাম, আমার লেখা আপনি পড়েছেন স্যার?

    —আমি! এমন ভাবে আমার দিকে তাকালেন, যেন এর চেয়ে মানহানিকর অভিযোগ আর হতে পারে না। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমার সময়ের দাম আছে।

    রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়েছেন দেখে আর এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। ছদ্ম নৈরাশ্যের সুরে বললাম, আমি ভেবেছিলাম পড়ে থাকবেন হয়তো। তা নাহলে সিনেমার গল্প লিখি জানলেন কেমন করে?

    —কেন? আপনার কী একটা বই নাকি ছবি হয়েছে শুনলাম! একেবারে হিট পিকচার!

    কথা নয়, একরাশ শ্লেষ ও অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিলেন আমার মুখের উপর। তার ফলে আমার ভিতরে আরও খানিকটা কৌতুক রস উথলে উঠল। মাথা নীচু করে ঘাড় চুলকে সবিনয়ে নিবেদন করলাম, তার থেকে যদি বলেন, আমি সিনেমার গল্প লিখি, তাহলে কিন্তু, স্যার, সেক্সপীয়র, টলস্টয়, ডিকেন্স, রবীন্দ্রনাথ, ডস্টয়ভস্কি এবং নানা দেশের সব বড় বড় নোবেল প্রাইজ উইনার্সও সকলেই আমার দলে পড়বেন।

    আমার দিকে একটা জ্বলন্ত ভ্রূকুটি নিক্ষেপ করে ভদ্রলোক গট্ গট্ করে বেরিয়ে গেলেন। চোখের দৃষ্টি এবং গমনভঙ্গি দুই-ই এত সুস্পষ্ট যে তার অর্থ বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয় নি। এও বুঝেছিলাম, সেইখানেই শেষ নয়, জের অনেকদূর চলবে। তাই চলেছিল। শুনছি নাকি, আমার বেরিয়ে আসবার পরেও চলছে। আমার এই বিদঘুটে নামটা কিংবা সেই ‘সেণ্টিমেণ্টাল সিনেমার গল্প’ যখনই তাঁর নজরে পড়ে, বিশেষ করে জেল-লাইব্রেরির বইয়ের তালিকার কোনো কোণে—আশেপাশের সকলকে ইষ্টনাম জপতে হয়। এগুলো যেন প্রাণী বিশেষের কাছে লাল ন্যাকড়া বা রেড র‍্যাগ।

    আর একটা মজার ঘটনা কানে এসেছে। বড় বড় জেলের কয়েদীরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে বাইরে থেকে ফিল্ম আনিয়ে জেলে বসে সিনেমা দেখতে পায়। কোনো জেল নাকি সুঃসাহসভরে সেই রেড-রাগ-চিহ্নিত ছবিখানা (যাকে তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন হিট পিকচার) আনাবার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। শেষ মুহূর্তে খবর পেয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং শুনেছি, এ বিষয়ে যারা উদ্যোক্তা তাদেরও একহাত নিতে ছাড়েন নি।

    প্রশ্নকর্তাদের কাছে আমার সশ্রদ্ধ নিবেদন, এসব যা বলছি, তাকে যেন তাঁরা খেদোক্তি বলে মনে না করেন। আমার সামান্য সাহিত্যকর্মের উপর মুষ্টিমেয়র এই রোষদৃষ্টি আমি সানন্দে উপভোগ করেছি। এঁদের বাইরে যাঁরা, লেখার জগতে এসে যাঁদের পেলাম, তাঁদের কথা বলছি না, কর্মী হিসাবে যাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্নস্তর, বহুজনের কাছে যে সস্নেহ প্রসন্ন দৃষ্টিলাভ করেছি, তার কথাই মনে রয়ে গেছে। এক দিক দিয়ে ক্ষোভের কারণ যদি কিছু ঘটেও থাকে, আরেক দিকের প্রাপ্তি তার সবটুকু ধুয়ে মুছে দিয়ে গেছে। মানুষের জীবন তো একটা নিস্তরঙ্গ জলধারা নয়। সে নদীর স্রোতের মতো গতিময়। ক্ষণেকের তরে কোনো আবিলতা যদি আসেও, গতি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যে মানুষ জীবন্ত, তার পথ একটানা মসৃণ নয়, উত্থান-পতনে বন্ধুর। তার একদিকে যেমন অভিঘাত, আরেক দিকে তেমনি অভিনন্দন।

    জেল-পরিধির বাইরেও একটা বিরাট সরকারী মহল আছে। সেখানে কি প্রতিক্রিয়া হল, সেটাও অনেকে জানতে চেয়েছেন। সে সম্বন্ধে বিশেষ করে বলবার মতো কিছু দেখছি না। এইটুকু শুধু বলতে পারি, সেখানকার দু-একজন হোমরা-চোমরা প্রথম প্রথম আমাকে যে দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, তাকে ঠিক প্রসন্ন দৃষ্টি বলা চলে না। বড় শহরের ভিড়ের মধ্যে হয়তো আমার উপর তাঁদের নজর পড়ত না। কিন্তু থাকি মফঃস্বলে, তার উপর সাহিত্য করি। এখানে ওখানে সভা সমিতিতে ডাক পড়ে। সভাপতিত্ব কিংবা প্ৰধান অতিথির প্রাধান্যও মাঝে মাঝে জুটে যায়। তার আগে এজাতীয় সম্মানে একচ্ছত্র অধিকার ছিল সরকারী বড় কর্তাদের। স্বাধীনতার পরে সাধারণের চোখে তাঁদের সে জমক নেই। তা ছাড়া ইতিমধ্যে জনজীবনের আনাচে-কানাচে সংস্কৃতি নামক একটি নতুন বস্তুর আবির্ভাব ঘটেছে, প্রাদুর্ভাব বলাই উচিত। তাকে বাদ দিয়ে কোনো জমায়েত জমে না। তারই সূত্র ধরে সভামণ্ডপের উচ্চমঞ্চে রাজপুরুষের বদলে টান পড়ছে সাহিত্যিকের। সাহিত্যিক যেখানে বাইরে থেকে আমদানি, তাকে উপেক্ষা করা চলে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে গোল বাধল—সে যে তাঁদেরই একজন। সুতরাং সরকারী কর্তৃমহলে সে প্রথমে চাপা কটাক্ষ, ক্রমশ প্রকাশ্য ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

    প্রথমটা একটু ক্ষুব্ধ হলেও পরে বুঝলাম এইটাই স্বাভাবিক। আমার অপরাধ তো একটি নয়। অফিসার্স্ ক্লাবে চাঁদা দিই, কিন্তু ধরণা দিই না, কর্তাব্যক্তিরা যখন স-পারিষদ আসর জাঁকিয়ে বসে রাজা-উজির বধ করেন, মাথা নাড়ার দলে আমাকে পাওয়া যায় না, সন্ধ্যার পর তাস না পিটে ‘অন্ধকার মাঠে ঘুরে বেড়াই কিংবা ঘরের কোণে বসে লিখি।’ সবটাই বাড়াবাড়ি। সুতরাং ক্লাবে লাইব্রেরির বাৎসরিক ‘পারচেজ’- এর সময় কয়েকজন তরুণ মেম্বার যখন ‘লৌহকপাট’-এর নাম করে বসল, প্রবীণ সিনিয়ারদের কাছ থেকে এল এক দুর্জয় ধমক—কী আছে ঐ জেলের কেচ্ছায়? ও আবার একটা বই নাকি! নবীন সভ্যরা কিন্তু অত সহজে হঠতে চাইল না। বেশির ভাগই সদ্য বেরিয়েছে কলেজ থেকে, চাকরির অহিফেনে ধাতস্থ হয়ে ওঠে নি। তখন রফা হল—বিনা পয়সায় পেলে আপত্তি নেই। কেউ কেউ অভিযোগ করলেন, লেখক যখন ক্লাবের মেম্বার, তারই উচিত ছিল দু-এক খণ্ড বই লাইব্রেরিকে প্রেজেন্ট করা।

    কদিন পরে ক্লাবে যেতেই কর্তৃস্থানীয় এক ব্যক্তি সেই ঔচিত্যের কথাটা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। বললেন, এই যে! আপনাকে তো আজকাল দেখাই যায় না। হ্যাঁ শুনুন, আপনার নাকি একখানা কি বই আছে?

    আমি মাথা নাড়লাম, আছে।

    —ছাপানো বই?

    কথাটা ঠিক ধরতে পারলাম না। বই তো ছাপানোই হয়ে থাকে। তিনি কি মনে করেছেন হাতে লেখা তালপাতার পুঁথি? জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম, তার আগে অর্থটা তিনিই পরিষ্কার করে দিলেন, ‘মানে, বইটা কি পাবলিড্ হয়েছে?’

    —আজ্ঞে হ্যাঁ।

    —আপনি নিজেই বুঝি পাবলিশার?

    —আজ্ঞে না।

    —তবে?

    পাবলিশারের নাম করলাম।

    —ও, তাই নাকি! বেশ, বেশ। তা কই, এখানে তো দেখছি না আপনার বই! আমাদের লাইব্রেরিতে দু-একখানা দেবেন তো? মানে যাকে বলে প্রেজেন্টেশান।

    প্রশ্ন ও প্রস্তাবের ধরনে আমার মাথায় হয়তো কিঞ্চিৎ দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হয়ে থাকবে। সবিনয়ে উত্তর দিলাম, দেখুন, দু-রকমের লেখক বই প্রেজেন্ট করে থাকেন। এক, যাঁরা অনুগ্রাহক, মনে মনে বলেন, আমার বই পড়ে তোমরা কৃতার্থ হও। দুই, যাঁরা অনুগ্রহপ্রার্থী, তাঁরা বলেন—আমার বই পড়ে আমাকে কৃতার্থ কর। আমি এর কোনো দলেই পড়ি না। অতএব মাপ করবেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডাইস লস্ট – জন মিল্টন
    Next Article ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }