Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌহকপাট – জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)

    জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) এক পাতা গল্প980 Mins Read0

    লৌহকপাট – ৪.২

    দুই

    প্রথমটা চিনতে পারিনি। একটু ঠাহর করে দেখতেই মুখ থেকে অজ্ঞাতসারে বেরিয়ে এল, আপনি!

    —ভাবছেন, এতদিন পরে খোঁজ পেলাম কি করে?

    সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম, আপনার কি কোনো অসুখ করেছিল?

    —অসুখ? হ্যাঁ, তা, বলতে পারেন। করেছিল নয়, বছর সাতেক ধরে চলছে।

    –বলেন কি! কী অসুখ?

    —রিটায়ারমেণ্ট; আপনারা যাকে বলেন, অবসর-গ্রহণ। বলে হেসে উঠলেন ভূতপূর্ব ভূতনাথ দারোগা। সেই আগেকার মতো পিলে চমকানো ঝড়ো হাসি, শুধু তার বেগটা পড়ে গেছে। তারপর বললেন, চেহারা জিনিসটা দাঁড়িয়ে থাকে কিসের ওপর জানেন? আপনি বলবেন ভালো স্বাস্থ্য, ভালো খাবারদাবার, যত্নআত্তি, এই সব। অন্যের বেলায় হয়তো তাই। কিন্তু পুলিসের বেলায়—পোশাক। সেই খোলসটা যেদিন ছেড়েছি সেদিন থেকে শাঁসও শুকোতে শুরু করেছে। যাক সে কথা। এটা নিশ্চয়ই আপনার কাণ্ড!

    হাতে ছিল একটা খাঁকী কাগজে মোড়া প্যাকেট। এতক্ষণ লক্ষ্য করি নি। মোড়ক খুলে ভেতরকার বস্তুটি সামনে ধরতেই আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। আমার সাহিত্যিক অপচেষ্টার এই নিদারুণ চিহ্নটি ভূতনাথ দারোগার নজরে পড়ে যাবে, স্বপ্নেও কি কোনোদিন ভেবেছিলাম? এর ভিতরে ওঁর যে রূপটি ফুটে উঠেছে, তাকে মধুর বলা চলে না। কে জানে তার কোন্ রেখায় ফৌজদারি আইনের কোন্ মারাত্মক ধারা শুঁড় তুলে দাঁড়িয়ে আছে? ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ে বলবে, দাও দশ হাজার টাকার ড্যামেজ, কিংবা মানহানির দায়ে চল শ্রীঘর।

    না, ভূতনাথবাবু সেদিক দিয়ে গেলেন না। খুশির সুরে বললেন, কদিন আগে পুলিশ ক্লাবে গিয়েছিলাম। পুরনো আমলের জনকতক অফিসার এখনও আছে। মাঝে মাঝে গিয়ে বসি তাদের কাছে। মনটা ভালো থাকে। হালআমলের ছোকরারাও খাতির যত্ন করে। তাদেরই একজন সেদিন একটা বই নিয়ে এসে বলল, ‘এর থেকে আপনার সম্বন্ধে অনেক কথা জানা গেল।’ আমার সম্বন্ধে! আমি তো অবাক। আমাকে নিয়ে আবার বই লিখল কে? ছাপিয়ে বের করবার মতো এমন কীর্তি রেখে এলাম? তবে অনেক গরম গরম স্বদেশীওয়ালাকে ঠাণ্ডা করতে হয়েছে। তারই মধ্যে কেউ বোধ হয় ঝাল ঝেড়ে থাকবে। বললাম, পড় তো শুনি। খানিকটা শুনেই বুঝলাম, আপনি। অনেকদিন এক স্টেশনে ছিলাম, একসঙ্গে উঠেছি, বসেছি। কই, এসব বিদ্যা আছে বলে তো টের পাই নি। আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই।

    ভয় কেটে গেল, কিন্তু বিস্ময় রয়ে গেল। যা লিখেছি, তাতে করে এতটা খুশী হবার কথা নয়। বললাম, আমার কিন্তু আশঙ্কা ছিল, আপনি রাগ করবেন।

    —রাগ করব! কেন?

    —আপনার সম্বন্ধে ভালো কথা তো কোনোটাই লিখি নি।

    —আপনি হাসালেন দেখছি। আমি যা, তাই তো লিখবেন। বানিয়ে বানিয়ে ভালো ভালো কথা লিখলে খুশী হতাম ভাবছেন? না। ভূতনাথ দারোগা ভূতনাথ দারোগাই থাকতে চায়। নব্যতন্ত্রের বাবুদের মতো মহাপুরুষ হতে চায় না। জানেন দেশ স্বাধীন হবার পর পুলিস অফিসার মানে এক একটি খুদে মহাত্মা। বিষ তো গেছেই, ফণা পর্যন্ত নেই। সব ঢোঁড়া সাপ। আমার সেই মুষ্টিযোগগুলো ভুলেও কেউ ব্যবহার করে না। সে গাট্স্ নেই কারও। অথচ আপনি তো জানেন, তার প্রত্যেকটা থেকে কী অব্যর্থ ফলটাই না পেয়েছি সেদিন।

    কথাটা ঠিক। সাক্ষী তৈরী করা কিংবা কনফেশান আদায় করবার যে কটি পেটেণ্ট ওষুধ তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, ফলের দিক দিয়ে দেখতে গেলে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের রীতি পদ্ধতি তার কাছেও ঘেঁষতে পারে না। প্রয়োগ দূরে থাকে, অনেক সময় নাম শুনিয়েই কার্যোদ্ধার হত। নামকরণের মধ্যেও রীতিমত প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। বৃহৎ যষ্টি-মধু-চূর্ণ; তাতে যদি কাজ না হয়, দাও ডোজ-কয়েক গুম্ফোৎপাটন রসায়ন কিংবা শ্মশ্রুছেদন বটিকা, স্থান কাল বুঝে কোথাও মহানিমজ্জনী সুধা, চপেটাঘাতসহ সেব্য।

    চোখের দিকে চেয়ে মনে হল, ভূতনাথবাবু বোধহয় তাঁর অতীত কীর্তির গৌরবময় স্মৃতির মধ্যে ডুবে গেছেন। কিছুক্ষণ পরে নিঃশ্বাস ফেলে গভীর সুরে বললেন, সারাজীবন ধরে এত যে করলাম, কী পেলাম তার বদলে! একদিন হয়তো ঐ নামগুলোও লুপ্ত হয়ে যেত। সেই পরিণাম থেকে আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, মিস্টার চৌধুরী। প্রকৃত বন্ধুর কাজ করেছেন।

    হঠাৎ মুন্সীর কথা মনে পড়ল। বললাম, বদরুদ্দিন মুন্সীকে আপনার মনে আছে?

    —নেই আবার! ঐ একটা লোক ছাড়া ভূতনাথ ঘোষাল সারাজীবন কারও কাছে হার মানে নি। একবার নয়, বার বার। বড় আশা ছিল ব্যাটাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারবো। সে সুযোগ আর দিলে না। মুখের ওপর যেন থাবড়া মেরে চলে গেল। বাহাদুর বটে! মরে তো সবাই, অমন মরার মতো মরতে পারে কজন?

    একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। বহুদিনের ওপার হতে বদর মুন্সীর মরণাহত বীভৎস মুখখানা বিস্মৃতির পরদা ঠেলে চোখের উপর এসে দাঁড়িয়েছিল, ভেসে আসছিল তার সেই ভাঙা গলার আর্তনাদ—আমার সর্বস্ব দিয়েও কি তাকে বাঁচাবার উপায় নেই, হুজুর?

    ভূতনাথবাবুর কথা কানে যেতেই যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম। উনি বললেন, আর একটা লোককেও আমি মরদের মতো মরতে দেখেছি। তবে তার ব্যাপারটা একেবারে আলাদা।

    —বলুন না, শুনি।

    ভূতনাথ হেসে বললেন, ও-ও, নতুন খোরাকের গন্ধ পেলেন বুঝি? কিন্তু যা ভাবছেন, তা নয়। তাকে দিয়ে আপনার বিশেষ সুবিধে হবে না। আপনারা যাকে বলেন ড্রামাটিক, তেমন কিছু সে করে নি। কোনো মহত্ত্ব-টহত্ত্ব দেখায় নি যে আপনার গল্প লেখার মশলা হবে।

    চা এসে পড়েছিল। সেদিকটা দেখিয়ে বললাম, তা না হোক, চা-এর সঙ্গে কিঞ্চিৎ স্ন্যাকস্ এর কাজ করবে তো?

    —তা করতে পারে।

    —তাহলে শুরু করুন।

    ভূতনাথবাবু পেয়ালাটা তুলে নিয়ে বললেন, বি.এ. পাস করে কলেজে ঢুকেছিলেন নিশ্চয়ই?

    —আজ্ঞে না। ওদিকটা আর মাড়াই নি।

    —বলেন কি! দুপুরে এম. এ. সকালে ল’–আমাদের কালে এইটাই তো ছিল সাধারণ রেওয়াজ।

    —আমাদেরও তাই। আমি কোনো রকমে এড়িয়ে গেছি।

    —তাই আপনার চুলগুলো এখনও কিছু কাঁচা আছে। মহামেডান্ ল-এর সাকসেশন চ্যাপ্টার মুখস্থ করতে হলে দশ বছর আগেই আমার দশা হতো!

    —কেন, খুব জটিল ব্যাপার বুঝি?

    —জটিল মানে? বাড়ির মুরগিটা পর্যন্ত ওয়ারিস, তারও একটা ভাগ আছে। একবার কোনো মিঞা চোখ বুজলে হল; সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ জন দাবিদার। তিন-চারটে বিবি, তাদের তিন ডজন ছেলেমেয়ে, বোন, ভাগনে, শালা যে যেখানে আছে। তারপর শুরু হল মামলা। দু-নম্বর দেওয়ানি তো পাঁচ নম্বর ফৌজদারি। খুন, জখম, দাঙ্গা। তার জের যে কোথায় গিয়ে থামবে, কেউ বলতে পারে না। ঐ অঞ্চলের কথা বলছি, সারা জীবন যাদের মধ্যে কাটিয়ে এলাম। আপনিও তো বেশ কিছুদিন ছিলেন। অন্য দশ জায়গায়ও ঘুরতে হয়েছে। ঐরকমটা দেখেছেন কোথাও?

    স্বীকার করলাম, দেখি নি। মামলা মোকদ্দমা সব দেশের লোকেই করে। সাধারণত তাদের দৌড় ঐ আদালত পর্যন্ত। সেইখানেই শেষ ফয়সালা। কিন্তু ভূতনাথবাবুর দীর্ঘ চাকরি-জীবন এবং আমারও অনেকগুলো বছর এমন কতকগুলো মানুষের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল যাদের অভিধানে ‘হার মানা’ বলে কোনো শব্দ নেই, প্রতিশোধ যাদের নিত্য ধৰ্ম, এবং আক্রোশ মেটাবার কোনো পন্থাকেই যারা হীন বা অন্যায় মনে করে না। সে বিষয়ে তাদের উদ্ভাবনী শক্তিও অসামান্য।

    একটা অভিনব খুনের মামলা মনে পড়ল। অতিশয় হুঁশিয়ার ব্যক্তি তোরাপ গাজী। বাড়িতে দো-নলা বন্দুক। লোক ও লাঠি ছাড়া বাইরে বেরোয় না। দারুণ গ্রীষ্মেও জানালা খুলে শোয় না। সেদিন সদর থেকে মামলা জিতে খোসমেজাজে বাড়ি ফিরে পাল্লা দুটোয় খিল আঁটতে বোধহয় ভুলে গিয়েছিল। গভীর রাত্রে বিকট চিৎকার ‘ইয়া আল্লা’! ঠিক বুকের উপর ফণা তুলেছে কালকেউটে। লাফিয়ে উঠবার আগেই বসিয়ে দিল মোক্ষম ছোবল। ‘বেলে বেলে জ্যোৎস্নায়’ চোখে পড়ল, জানালা থেকে নিঃশব্দে সরে যাচ্ছে একটা লম্বা বাঁশের চোঙা। বোঝা গেল সাপ উড়ে আসে নি, ছাদ থেকেও পড়ে নি, এসেছে বাঁশের ফোঁকর আশ্রয় করে। তার মধ্যেও ইচ্ছে করে ঢোকে নি নিশ্চয়ই। অনেক কৌশল করে বহু সাবধানে চরম বিপদের ঝুঁকি নিয়ে একজন কেউ তাকে ঢুকিয়েছে। যাকে বলে সাক্ষাৎ যম নিয়ে খেলা। ভিতরকার মনোভাব হল—যে কোনো উপায়ে শত্রুতা-সাধন। শত্রুর প্রাণ নিতে গিয়ে নিজের প্রাণটা যদি যায় ক্ষতি নেই, সে জন্যে তারা ভাবে না। একে শুধু রিভেঞ্জ বা প্রতিশোধ বলে ছোট করে দেখলে ভুল হবে। এ এক উঁচুদরের জীবনদর্শন। হায়ার ফিলজফি অব্ লাইফ্, সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে যা বোঝা যায় না। মনে হয়, অবাস্তব, অসম্ভব।

    আরেকজন মামলাবাজ গ্রাম্য মাতব্বরের কথা শুনেছিলাম। অন্ধকার রাত্রে ঘরের বাইরে লোকের সাড়া পেয়ে ‘চোর চোর’ বলে লাঠি হাতে ছুটে বেরিয়েই ‘মাগো’ বলে এক লাফ এবং তারপরেই ‘বাবাগো’ বলে বসে পড়া। সঙ্গে সঙ্গে গগন-ভেদী আর্তনাদ। ‘কী হল গো’ বলে দৌড়ে এলেন গৃহিণী এবং ‘উঃ’ বলে পা ধরে বসে পড়লেন চৌকাঠের উপর। ছেলে ছিল পাশের ঘরে। বুদ্ধি করে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়েছিল। দেখল, বাবা- মায়ের ঘরের ঠিক সামনে সারি সারি পোঁতা আছে মোটা মোটা খেজুরের কাঁটা, ছুঁচলো মাথাটা উপরের দিকে। তারই দুটো বিঁধে আছে তার বাবার দু-পায়ের তলায় এবং ধপ্ করে বসে পড়ার ফলে গোটা তিনেক তাঁর পরনের ধুতি ভেদ করে ইঞ্চিখানেক ভিতরে ঢুকে গেছে। চৌকাঠের আশ্রয় না জুটলে মায়ের অবস্থাও অনুরূপ হত। তাঁর খোঁচাটা আপাতত শুধু পায়ের উপর দিয়ে গেছে।

    যারা এসেছিল, তারা যে নিপুণ শিল্পী, কাঁটাগুলো বসাবার মধ্যেই তার পরিচয় পাওয়া গেল। ‘চুরি’ নামক হেয় কর্মের মতলব নিয়ে তারা আসে নি, তাও বোঝা গেল। গৃহিণীর পায়ের কাঁটা খুলে দেবার পর তিনি হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, রান্নাঘরের তালাটা ভাঙা। ছেলের সাহায্যে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে দেখলেন, বাসনপত্র যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে। হাঁড়িতে কিছু পান্তাভাত এবং কড়াতে কয়েক টুকরো ইলিশ মাছ ভাজা রেখেছিলেন পরদিন প্রাতরাশের জন্যে। অতিথিরা সেগুলো তাদের নৈশ ভোজনের কাজে লাগিয়েছে। কাঁটা-রোপণে সময় কম লাগেনি, অনেকটা মেহনতও হয়ে থাকবে। ক্ষুধার উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক। সেটা সঙ্গে সঙ্গে মেটাবার জন্যেই রান্নাঘরে ঢুকবার প্রয়োজন হয়েছিল। যাবার সময় সাড়া-শব্দটা ইচ্ছাকৃত। কর্তা-গিন্নী চোর মনে করে ব্যস্তভাবে ছুটে বেরোবে, এবং তারপরে—।

    এই ধরনের ব্যাপার আমি আর কতগুলো জানি? ভূতনাথবাবুর ভাণ্ডারে দু-চার-দশটা জড়ো হয়ে থাকবে। তারই একটা ঝাড়বার আয়োজন করলেন। চায়ের পেয়ালায় কয়েকটা দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বললেন, রহমতগঞ্জের জব্বার মোল্লাকে ভোলেন নি আশা করি!

    —কানা জব্বার?

    —’কানা’ কি বলছেন! ব্যাটা ঐ এক চোখে যা দেখত, দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর সহস্র চক্ষু দিয়ে তার চেয়ে একচুল বেশি দেখতেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। সারাটা জীবন পুলিসকে নাস্তানাবুদ করে একদিন সে পটল তুলল। সেদিন জোড়া-খাসির ফিষ্টি হল আমাদের ক্লাবে। সারারাত ধরে ডজন ডজন বোতল উড়ে গেল। সকালে গেলাম কণ্ডোলেন্স জানাতে। শুনলাম, সোনাদানা টাকাকড়ি বিশেষ কিছু না থাকলেও জমিজমা অনেক রেখে গেছে। স্বনামে বেনামে গোটা চরটাই প্রায় তার।

    বললাম, হবে না? ডাকাতি তো একটা দুটো করে নি। আমার আমলেই তো—

    —ভুল করলেন, বাধা দিয়ে বললেন ভূতনাথবাবু। ওর এক ছটাকও ডাকাতির রোজগার নয়। কিছুটা পৈতৃক আর বেশির ভাগ মামলা মোকদ্দমা করে জ্ঞাতিদের কাছ থেকে বাগিয়ে নেওয়া। ডাকাতিটা ছিল শখ। তার পেছনে বরং বেশ কিছু ঢালতে হত।

    —এত সম্পত্তি থাকতে ডাকাতি করে বেড়াত!

    —করবে না? আগেকার দিনে রাজারা যে দিগ্বিজয়ে বেরোতেন, সবটাই কি লাভের লোভে কিংবা অভাবের তাড়নায়? ওটা ছিল তাঁদের ব্যসন। এদেরও তাই। খন্দটা ভালোয় ভালোয় উঠে গেছে। বড় বড় গোলা ভরা ধান, পাটের বাজার বেশ চড়া, রাখী কারবারেও মোটা রকম মুনাফা এসেছে ঘরে। অতএব চল একটু বেরোনো যাক। সঙ্গে সঙ্গে চর চলে গেল গ্রামে গ্রামে সব শাঁসালো গেরস্তের খোঁজে। খবর এসে গেল—কার সিন্দুকে কি রকম মাল আছে, কার ঘরে যুবতী বৌ-ঝি আছে, কোথায় বাধা পাবার সম্ভাবনা। তাই বুঝে দলবল জোটানো হল। রাতারাতি তেল পড়ল বন্দুকে। কাত্রা, বল্লম, ল্যাজা সড়কি শানিয়ে তোলা হল। তারপর দিনক্ষণ দেখে শুরু হল অভিযান। পুরোদস্তুর শিকার যাত্রা। তফাৎ শুধু লক্ষ্যের বেলায়। জন্তু-জানোয়ারদের বদলে মানুষ।

    যাক, যা বলছিলাম। জব্বারের সাক্ষাৎ ওয়ারিস অর্থাৎ ডিরেক্ট ডিসেণ্ডেণ্টস বেশী নয়। এক জরু, এক ছেলে। জরুটি প্রথম পক্ষ, ছেলে দ্বিতীয় পক্ষের। তার আবার দুটো বিবি আর তিন-চারটে অপোগণ্ড কাচ্চাবাচ্চা। বাড়ির সামনে খাল। তার ওপরে জব্বারের মেয়ের বাড়ি, আর একটু ওদিকে থাকে ভাগনেরা। তিন বাড়িতে ভাবসাব কোনোকালেই ছিল না। মামলা দু’এক নম্বর প্রায়ই লেগে থাকত। তাহলেও জব্বারের সামনে জামাই বা ভাগনেরা মাথা তুলতে সাহস করে নি। ছেলে, অর্থাৎ কাদের মোল্লা বাপের স্বভাব আর চালটা কিছু কিছু পেয়েছিল, বুদ্ধিটা পায় নি। গোঁয়ার, বদরাগী, নানা রকম নেশাভাঙে ওস্তাদ। খুনজখম আর মেয়েমানুষ-ঘটিত মামলায় কয়েকবার জড়িয়েও পড়েছিল। বাপের ভয়ে অন্য পক্ষ বেশীদূর এগোয় নি। দু-একটা ব্যাপারে থানা পর্যন্ত গড়ালেও কোর্টে ওঠে নি। আপনার এলাকায় তাকে আসতে হয় নি কোনোদিন। এবার অবস্থা কাহিল হয়ে উঠল। জ্ঞাতি-কুটুম্ব-পড়শীর দল জোট বেঁধে লাগল তার পেছনে। হাতে মারতে না পারলেও অন্তত ভাতে মারতে হবে। নদীর ধার ঘেঁষে এক বন্দে অনেকগুলো জমি। ফি বছর সোনা ফলে। অনেকের নজর ছিল সেদিকে। তারই স্বত্ব নিয়ে লাগল মোকদ্দমা।

    —কিন্তু ওগুলো তো ওর পৈতৃক মোকদ্দমা।

    —হলই বা। এতক্ষণ তাহলে শুনলেন কি? বাপের সম্পত্তি ছেলে পাবে—আইন কি অত সোজা? নানারকম ফ্যাকড়া বেরোল। উকিলবাবুরা মওকা পেলেন। তাঁদের হাতে পড়ে যা ছিল জলের মতো পরিষ্কার, তাই এবার তেলের মতো ঘোলাটে হয়ে দাঁড়াল। ও পক্ষের পাণ্ডা হল বোনাই। বোনাই বোঝেন তো?

    হেসে বললাম, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। কথাটার জন্মস্থান হয়তো পূব অঞ্চলে, কিন্তু পশ্চিমেও চলে। ‘চলন্তিকা’য় চড়িয়ে পরশুরাম ওকে জাতে তুলে দিয়ে গেছেন।

    —তাই নাকি! বিস্ময় প্রকাশ করলেন ভূতনাথবাবু, আমি তো শব্দটাকে নেহাৎ গেঁয়ো বলেই জানতাম, আপনারা যাকে বলেন ‘গ্রাম্য’ অর্থাৎ ভালগার। যাই হোক, বোনাই মানে তোফাজ্জল মানুষটি কিন্তু মোটেই গেঁয়ো নয়। লেখাপড়া জানে, দু-পাতা ইংরেজিও পড়েছিল। পোশাকে-আশাকে আদবকায়দায় ভদ্র, মুখে হাসিটি লেগেই আছে। কখনও উত্তেজিত হয় না। অর্থাৎ বাইরে গোবেচারা, ভিতরে ভিতরে একটি দারুণ চীজ। ফল যা হবার হল। একখানি একখানি করে জমিগুলো কাদের মোল্লার হাতফসকে ও তরফে চলে গেল। নগদ টাকাপয়সা যৎসামান্য যা ছিল, সে তো গেছে প্রথম চোটে। কাদেরের অবস্থা তখন ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো, কিন্তু বোনাই-এর গায়ে দাঁত বসাবে, সে মুরদ নেই। তোফাজ্জল সে দিক দিয়ে অত্যন্ত হুঁশিয়ার।

    জজকোর্টে একটা আপিলের মামলা চলছিল। কাদেরের খুব আশা ছিল, এটাতে তার জিত হবে। উকিলও অনেক ভরসা দিয়েছিলেন। কিন্তু রায় বেরোতেই বসে পড়ল কাছারির বারান্দায়। বসতবাড়ির ঠিক লাগোয়া আড়াই বিঘে সুপুরিবাগান বন্ধক রেখে কবে নাকি শ’খানেক টাকা ধার করেছিল জব্বার মোল্লা। সুদ সমেত মোটা টাকার ডিক্রি পেয়েছেন হালদারবাবুরা। মানে বাগানটি গেল। তোফাজ্জল এসে শ্যালকের হাত ধরে টেনে তুলল, আহা, অমন ভেঙে পড়লে চলবে কেন ভাইজান? বাড়ি চল। জজের ওপরে জজ আছে। টাকার জন্যে ভেবো না। আমি তো এখনও বেঁচে আছি।

    আসল খবর সবাই জানত। হালদারদের সঙ্গে যোগসাজশে মামলাটা দায়ের করেছে তোফাজ্জল। ধারের কাহিনী মিথ্যা, দলিলটাও জাল। কাদের এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ল। দু-চোখ থেকে ঠিকরে পড়ল আগুনের জ্বালা। বোনাই সকলের অলক্ষ্যে মুচকি হেসে সরে গেল।

    বাড়ি ফিরতে কাদেরের রাত হল। সমস্ত পথ শুধু একটা কথাই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছিল—শোধ নিতে হবে। কিন্তু কেমন করে? কত রকমের আজগুবি উপায় মনে হয়েছে। সবটাই তার সাধ্যের বাইরে।

    ছোট ছেলেটা বছর পাঁচেকের। জেগে বসে আছে, বাপ কখন আসবে। সদরে গেছে, একটা কোনো মিঠাই হাতে করে ফিরবে নিশ্চয়ই। বলেও দিয়েছিল যাবার সময় বাপজান, আমার জন্যে লজেঞ্চুস আনিস!

    সাড়া পেয়ে ছুটে আসতেই কাদের ছেলেকে ঠেলা মেরে ফেলে দিল। পড়ে গিয়ে যেমনি কেঁদে ওঠা, পিঠের উপর বসিয়ে দিল চড়। ছেলের মা এল ছাড়াতে। ফোড়ন- টোড়ন কিছু একটা কেটে থাকবে হয়তো, তাকেও তেড়ে গেল—ছুটে না পালালে ঐখানেই খুন-জখম যাহোক একটা ঘটে যেত। মা বুড়ি ঘরে শুয়ে কাতরাচ্ছিল। নানা রোগে ভুগে হাড্ডিসার চেহারা। সৎমা হলেও কাদের বুড়িকে বিশেষ হেলাফেলা করতো না। দূরে কোথাও গেলে, ফিরে এসে খোঁজ নিত, মা কেমন আছে। আজ গোঁজ হয়ে বসে রইল দাওয়ার ওপর। মা কয়েকবার ডাকতে রেগেমেগে ঘরে ঢুকে খেঁকিয়ে উঠল, ডাকাডাকি করছ কিসের জন্যে?

    মামলার ব্যাপারে মায়ের মনে উদ্বেগ ছিল। ছেলের হাবভাব থেকে ফলটা আন্দাজ করতে পারলেও সেই কথাই জিজ্ঞেস করল। কাদের কোনো জবাব না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, পেছন থেকে কানে গেল, মা বলছে, ‘এত লোক মরে, খোদা আমাকে একবার চোখে দেখে না।’

    অতি মামুলী আপসোস। কথাগুলোও নিতান্ত সাধারণ। বুড়ো বয়সে কখনও কোনো ক্ষোভের কারণ ঘটলে সবাই একবার আওড়ায়। মায়ের মুখ থেকে কাদের নিশ্চয়ই আরও অনেকবার শুনে থাকবে। কান দেয় নি। আজ কী মনে করে থমকে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে ফিরে গিয়ে মা-র বিছানার পাশে বসল। কোনো কথা বলল না। দুটো জ্বলন্ত চোখ শুধু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই তোবড়ানো গাল, ছানি পড়া চোখ, আর ঠেলে-ওঠা কণ্ঠার দিকে। ছেলের সেই চাউনি দেখে বুড়ির শুকনো মুখ আরও শুকিয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বলল, অমন করে কী দেখছিস?

    কাদের জবাব দিল না। আপনমনে বিড় বিড় করে আউড়ে গেল, হ্যাঁ, আর বেশীদিন নেই। আরও কিছুক্ষণ বসে বসে কী ভাবল। তারপর মায়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, আমার একটা কথা শুনবে?

    বুড়ি আরও ভয় পেল। ছেলেকে সে চেনে। যা বলে সোজাসুজি, ভূমিকা করা তার অভ্যাস নেই। জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

    —যা দেখছি, তোমার ডাক এসে গেছে। যেতে যখন হবেই তার আগে আমার একটা উবগার করে যাও না কেন?

    —উবগার! আমি কী উবগার করবো তোর! সে সাধ্যি যদি থাকত—

    —আছে সাধ্যি। তুমি ইচ্ছে করলেই পার।

    বুড়ি কিছুই ভেবে পেল না, ছেলের কী উপকার সে করতে পারে। কাদের উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ফিরে এসে মায়ের খানিকটা কাছ ঘেঁষে বসল। তারপর ফিস ফিস করে বলল, কাগপক্ষী কেউ জানবে না, খালি তুমি আর আমি, ব্যাস।

    বুড়ি বিরক্ত হয়ে উঠল, কী চাস, খুলে বলবি তো না কি?

    কাদের তখনও ঠিক আসল কথায় গেল না। বলল, এই যে আমরা ভরগুষ্টি পথে বসতে চলেছি, কার জন্যে তুমি তো জান!

    —জানি বইকি বাপজান, জেনে কী করবো? খোদা এর ইনসাব করবে। এসব জমিজমা পুকুর বাগান কিছুই ওদের ভোগে লাগবে না, তুই দেখে নিস।

    —খোদা কি করবে, সে ভরসায় আর বসে থাকা চলে না। আমি আর থাকতে পারছি না। হাত দিয়ে দ্যাখ, আমার সারা কলজেটা দাউ দাউ করে জ্বলে যাচ্ছে।

    মায়ের একটা হাত খপ্ করে তুলে নিয়ে চেপে ধরল বুকের উপর। তারপর নামিয়ে রেখে বলল, আমার মুখের গ্রাস ঐ শালা কেমন করে বসে বসে খায়, আমি একবার দেখে নেবো।

    বুড়ি নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। বুঝল এ শুধু নিষ্ফল আস্ফালন, নিরুপায়ের যা একমাত্র পথ। এ করেও যদি কিছু সুখ পায় তো পাক। তোফাজ্জলের দাড়ি ওপড়ানো দুটি থাক, এক গাছা চুলে হাত দেবার, আপনারা যাকে বলেন কেশ স্পর্শ করবার মতো ক্ষমতা যে ওর নেই সে কথা সবাই জানে।

    বুড়ির বিছানা যেখানটায়, তার উল্টোদিকের দেওয়ালে একখানা ছোট সাইজের রামদা ঝোলানো ছিল। সেই দিকে হাত তুলে কাদের বেশ সহজ ভাবেই বলল, শোনো মা, ঐ যে দা-টা দেখছ, ওটা দিয়ে আমি তোমার গলায় একটা কোপ মারবো।

    মা আঁতকে উঠতেই ভরসা দিল, ভয় নেই, এমন ভাবে মারবো যে আমার চেঁচানি শুনে লোকজন যারা আসবে, তাদের কাছে যেন বলে যেতো পারো, কোপটা মেরে গেল তোফাজ্জল। মুখে না বললেও চলবে, আমি ঐ বলে চেঁচাবো, তুমি খালি মাথা নেড়ে সায় দেবে।…পারবে না?

    মা চুপ করে আছে দেখে বলল, আচ্ছা, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। যা করবার আমিই করবো।

    বুড়ির অবস্থা কল্পনা করুন। ছেলেকে যদি না চিনত, মনে করতে পারত সে ঠাট্টা করছে। কিন্তু এটা যে ঠাট্টা নয়, ছেলের যে রকম মতিগতি, কাজটাও তার পক্ষে বিশেষ কঠিন হবে না। সবই বুঝল। কান্নাকাটি করে লাভ হবে না, পালাবে যে সে উপায়ও নেই। জবাই করবার আগে গরুগুলো যে চোখে তাকায়, তেমনি ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইল।

    কী একটা হয়তো বলতে গিয়েছিল, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। কাদের বলল, তুমি ভাবছ, লোকে বিশ্বাস করবে কেন? তোমার ঐ তেঁতুলতলার জমিটা যে সে হাত করতে চায়, সেজন্যে কয়েকবার এসে তোমাকে ফুঁসলে -ফাঁসলে সাদা কাগজে টিপসই নেবার চেষ্টা করেছে, সে খবর কে না জানে?

    এতক্ষণে কথা সরলো বুড়ির গলায়। বোধহয় আশা হল টিপ যখন সে দেয় নি, গলাটা এ যাত্রা বাঁচতে পারে। চোখের জল মুছে ভাঙা গলায় বলল, তোর মুখ চেয়েই আমি রাজি হই নি।

    —হও নি বলেই তো সুবিধে। সবাইকে বোঝানো যাবে, সেই জন্যেই তোমার ওপরে তার আক্রোশ।

    বুড়ি এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। কপাল চাপড়ে স্বামীর উদ্দেশে ইনিয়ে বিনিয়ে কী সব নালিস জানাতে যাচ্ছিল, ছেলের দিকে নজর পড়তেই মাঝপথে থেমে গেল। কাদের মুখে কিছুই বলল না। ডান হাতের এই আঙুলটা একবার ঠোটের উপর রেখে দু-চোখে আগুন ছড়িয়ে বেরিয়ে চলে গেল।

    পরদিন রাত প্রায় আটটা। কাদের মোল্লার বিকট কান্নায় গোটা পাড়াটা কেঁপে উঠল।

    আমি বললাম, পরদিনই!

    কথাটায় হয়তো কিছু বিস্ময় প্রকাশ পেয়ে থাকবে। কিংবা অজ্ঞাতসারে কোনো আঘাত। ভূতনাথবাবু একটা আধপোড়া চুরুট ধরাচ্ছিলেন, কাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে একরাশ কড়া ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তবে কি সাতদিন ধরে প্ল্যান আঁটবে, এই বুঝি আপনি আশা করেছিলেন? অতখানি কাঁচাছেলে সে নয়। এসব কাজ ফেলে রাখলেই নানারকম বাধাবিঘ্ন এসে জোটে, এই সোজা কথাটা সে জানত। তবু যে একটা দিন দেরি করেছিল, সে শুধু বাধ্য হয়ে। এক নম্বর, এ রকম ঘটনা ঘটবার জন্যে রাতের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আর দু নম্বর, ব্যাপারটাকে পাকাপোক্ত ভাবে দাঁড় করাতে গিয়ে একটা—কী বলবো, রোমান্সের সুবিধে নিতে হয়েছিল! পুরনো রোমান্স।

    এবার সত্যিই চমকে উঠলাম। এত বড় বীভৎস কাণ্ডের মধ্যে ‘রোমান্স’!

    ভূতনাথবাবু আমার ভাবান্তর লক্ষ্য করে বললেন, এতে আর অবাক হবার কী আছে? রোমান্স কোথায় নেই বলুন! ওর কি স্থানকাল আছে, না পাত্রাপাত্রের ভেদ আছে? কেন, ঐ বইটা পড়েননি? কী নাম যেন। দাঁড়ান….বেশ নামকরা লোকের লেখা। শ্রীকান্ত। পড়েছেন নিশ্চয়ই?

    বললাম, তা পড়েছি। কিন্তু এটা তো আপনার জুরিসডিকশন নয়। ওসব বই-এর খোঁজখবর-

    —আমি পেলাম কি করে, এই বলবেন তো? কী করবো মশাই! বেকায়দায় পড়লে বাঘেও ঘাস খায়। ভূতনাথ দারোগাকেও বাংলা নভেল পড়তে হয়। আমার নতুন বৌমাটি একটি নাটক নভেলের পোকা। বদভ্যাসটি সে-ই ধরিয়েছে। প্রথমে ছিলাম চিনির বলদ। পাড়ার লাইব্রেরী থেকে তার ফরমাশ-মতো বই নিয়ে আসা আর পড়া হয়ে গেলে পৌঁছে দেওয়া। ভেতরে কী আছে, পাতা উল্টে দেখি নি। কিন্তু আমার খুদে মা-টি রীতিমতো নাছোড়বান্দা—’এই গল্পটা একটু পড়ে দেখুন না, বাবা। শুনুন, কী চমৎকার লিখেছেন ভদ্দরলোক!’ এমনি করে করে এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে দুপুরবেলা খেয়ে উঠে ওরই যে কোনো একটা টেনে নিয়ে দু-চারপাতা না ওল্টালে ঘুম আসতে চায় না। একদিন হাতে এসে গেল শ্রীকান্ত। ওর আবার অনেকগুলো পর্ব আছে। সেটা কোন্ পর্ব বলতে পারবো না, আপনার হয়তো জানা আছে। ঘটনাটা হল—কোথায় যেন নতুন রেল-লাইন বসানো হচ্ছে। মাটি-কাটা কুলী এসেছে এক দঙ্গল—নানবয়সের মেয়েপুরুষ, কাচ্চাবাচ্চাও কম নয়। কতগুলো ছাদখোলা ওয়াগন হচ্ছে তাদের আস্তানা। এক-একটার মধ্যে দু-তিনটে করে সংসার। কাছেপিঠে কোথাও মুখে দেবার মতো জল নেই, অন্য সব স্যানিটারি অ্যারেঞ্জমেন্টট্স কাগজে কলমে ছিল নিশ্চয়ই, কাজের বেলায় না-ই বা রইল। যা হয়ে থাকে। গরমের দিন। শুরু হল কলেরা। একই গাড়ির একপাশে লোক মরছে, আর তার থেকে দু-হাত দূরে একটি পেয়ার—কাঁচা বয়স নিশ্চয়ই—সারারাত ধরে চালিয়েছে উৎকট রোমান্স। নায়ক রুগীর কাছে বসে। তারই চোখের ওপর পাশাপাশি এই দুই দৃশ্য।

    বললাম, ও তো গল্প!

    —গল্প বলেই একটু রেখে ঢেকে আব্রু বাঁচিয়ে বলেছেন লেখক। আসলে যা ঘটে, সে তো আরও উৎকট। আমার নিজের পাড়াতেই দেখুন না? ভদ্রমহিলার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। স্বামীটি মরমর, ছেলেমেয়েরা যে যার মনে আছে, একটা ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের মাসতুতো না পিসতুতো ভাইকে বগলদাবা করে রাত দশটা অবধি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনও দোকানে দোকানে, কখনও নির্জন নদীর ধারে, কখনও অন্ধকার মাঠে। বাড়ি এসেও রাতদুপুর পর্যন্ত দুজনে মিলে গানবাজনা, হৈ-হুল্লোড়।

    —আপনাদের পাড়ায় ছেলে-ছোকরা নেই?

    কথাটার সুরে বোধহয় কিঞ্চিৎ উষ্মা প্রকাশ পেয়ে থাকবে। ভূতনাথবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, নাঃ, আপনি দেখছি এখনও রিয়ালিস্টিক রাইটার হতে পারেন নি! অল্পেতেই নীতিবোধ চাড়া দিয়ে ওঠে! ছেলে-ছোকরারা কী করবে? এদিকে যে আবার ভাইবোন তবে হ্যাঁ করত, মহিলাটি যদি- তরুণী হতেন। তখন ঐ ছেলেটা হত ওদের রাইভ্যাল। এখন ওকে পিটি করে। আহা বেচারা! সবাই মিলে নাম দিয়েছে ল্যাং-বোট। যাক, যে রোমান্সের কথা বলতে গিয়ে এতখানি ভণিতা, সেটা এবার শুনুন।

    কাদের মোল্লার ছোট বিবি ফতিমা খালের ওপারের মেয়ে, তোফাজ্জলের কী রকমের বোন। দুজনের মধ্যে বেশ কিছুটা আশনাই ছিল। সাদিও হয়ে যেত। কোনো একটা ব্যাপারে জব্বার জামাইকে জব্দ করবার জন্যে মেয়েটাকে একদিন ছোঁ মেরে নিয়ে এসে রাতারাতি ছেলের বৌ বানিয়ে ফেলল। কিন্তু প্রথঢ় বয়সে মনে যে রঙ লাগে তা কি অত সহজে মোছে? ওদের অন্তত মোছে নি। কাদের সে কথা জানত, কিন্তু কিছু মনে করত না, বরং মাঝে মাঝে সেটা কাজে লাগাত। তোফাজ্জলের কাছ থেকে কোনো কিছু সুবিধে আদায় করতে হলে সে ভার পড়ত ঐ দু-নম্বর বিবির ওপর। তাছাড়া তার হাত দিয়ে যখন-তখন মাছটা মুরগীটা, কখনও-সখনও হঠাৎ দরকারে লুঙিটা জামাটাও আসত। ঘটনার দিন দুপুরবেলা বেরোবার নাম করে কাদের ছোট বৌকে দিয়ে বোনাই-এর একটা লুঙি আনিয়ে নিয়েছিল। ফতিমা নিশ্চয়ই খুশী হয়ে ছুটতে ছুটতে গিয়েছিল। বাঁশের সাঁকোটা পেরোতে অন্যের যদি লাগে পাঁচ মিনিট, তার হয়তো তিন মিনিটের বেশী লাগেনি। এই সুযোগে একবার কাছে আসা, দু-একটা কথা, একটুখানি হাসি। সেদিন অবিশ্যি তার কোনোটাই হয়নি। তোফাজ্জল তখন বাড়ি ছিল না। ফতিমা কাউকে কিছু না জানিয়ে বাইরের উঠোনে দড়ির ওপর থেকে লুঙিটা টেনে নিয়ে তেমনি ছুটতে ছুটতে ফিরে এসেছিল। কাদের দাঁড়িয়ে আছে, দেরি হলে বকুনি খেতে হবে।

    ভূতনাথের কাহিনীতে এইখানে হঠাৎ একটু ছেদ পড়ল।

    কারণটা বুঝতে না পেরে চোখ তুলে দেখলাম, তিনি জানালার বাইরে চেয়ে আছেন। মিনিটখানেক পরে ফিরে বললেন, আচ্ছা মিস্টার চৌধুরী, আপনি তো একজন লেখক। বলুন তো, লুঙি নিয়ে ফিরে আসতে আসতে কী ভাবছিল ফতিমা?

    আমি হেসে বললাম, লেখকরা কি হাত গুনতে জানে?

    —হাত গুনতে হবে কেন, মন গুনে বলুন।

    —আমি এখনও তত বড় লেখক হতে পারিনি।

    —আমি কিন্তু বেশ দেখতে পাচ্ছি, মৃদু এবং অনেকটা আবেশময় সুরে বললেন ভূতনাথবাবু, লুঙিটা পাড়তে গিয়ে মেয়েটার ঠোটের কোণে একটু দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠেছিল। মাথা নেড়ে মনে মনে বলেছিল, বেশ মজা হবে। বাড়ি এসে খুঁজে পাবে না, ভাববে কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। একে ডাকবে, ওকে বকবে, তারপর যখন জানতে পারবে কে সেই ‘চোর’, তখন?… পরের অবস্থাটা মনে মনে কল্পনা করে তার মুখখানা নিশ্চয়ই রাঙা হয়ে উঠেছিল। হয়তো একা একা খিল্‌ খিল্‌ করে হেসে উঠেছিল সেই নির্জন খালের ধারে। কী বলেন?

    আমি উত্তর দিলাম না। আমার চোখের সামনে যে নতুন ভূতনাথ দারোগা বসে আছেন, নিজের চোখে দেখেও যার এই রূপান্তর অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছিল, তারই মুখের পানে সবিস্ময়ে চেয়ে রইলাম।

    তিনি আমার উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন, এমনি ভাবে অনুচ্চ সুরে বললেন, নিতান্ত সরল ছেলেমানুষ মেয়েটা। সে কেমন করে জানবে, সামান্য একটা লুঙির মধ্যে কত বড় সর্বনাশ সেদিন লুকিয়েছিল। একদিন যাকে সে মন দিয়েছিল এবং তার পরেও মন থেকে মুছে ফেলতে পারে নি, তাকে নিয়ে এই ছোট্ট লুকোচুরির রঙিন লোভটুকু সে ছাড়তে পারে নি। এ যদি পাপ হয়, তার প্রায়শ্চিত্ত সে নিজের জীবন দিয়ে করে গেছে।

    অজ্ঞাতসারে চমকে উঠলাম, কী করেছিল? আত্মহত্যা?

    —তার কথা যখন আসবে, তখন বলবো। আপাতত আসুন, কাদেরের কাছে ফিরে যাওয়া যাক।

    মরা-কান্না শুনে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে এসে দেখল, কাদের মোল্লা মায়ের পায়ের ওপর পড়ে মাথা খুঁড়ছে। দু-দুটো বিবি তাকে ধরে রাখতে পারছে না। বুড়ির ঘাড়ের বাঁ দিকের প্রায় আদ্ধেকটা নেমে গেছে। বালিস বিছানা রক্তে লাল। রামদাটা কাৎ হয়ে পড়ে আছে শিয়রের কাছে। শোকের বেগটা একটু পড়ে এলে কাদেরের মুখ থেকে যে বয়ান বেরোল তার থেকে জানা গেল, পাশের গাঁয়ে কোন্ দোস্তের বাড়ি তার দাওয়াৎ ছিল। বাড়িতে মায়ের অসুখ, তাই খেয়ে উঠে আর দাঁড়ায় নি, জোরে পা চালিয়ে যখন ফিরবার কথা, তার আগেই ফিরে এসেছে। বাড়ি ঢুকে মায়ের কান্না আর তার সঙ্গে পুরুষমানুষের গলায় চাপা ধমকানি শুনে তাড়াতাড়ি দরজার সামনে এসে যা দেখল, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, তার নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারে নি। যতই দুশমনি থাক, তাই বলে শাশুড়ি, আর ঐ রকম বুড়ো মানুষ, অতদিন থেকে ভুগছে, তাকে কেউ খুন করতে পারে! নিজের চোখে তাই তাকে দেখতে হল। ঐখানে হাঁটু গেড়ে বসে তার মায়ের মাথার ওপর দা উঁচিয়ে ধরেছে তার বোনাই! দেখেই মাথাটা ঘুরে গেল। চেঁচাতে চেষ্টা করেছিল, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় নি। ভিতরে ঢুকতে না ঢুকতেই বসিয়ে দিল কোপ। ছুটে গিয়ে দু-হাতে কোমর জাপটে ধরেছিল। রাখতে পারবে কেন? ‘শালা তো মানুষ নয়, নয়, দাঁতাল শুয়োর।’ এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে।

    কে একজন জানতে চাইল, বৌ দুটো ছিল কোথায়?

    —বড়টি বলল, সে রসুইখানায় ছেলেকে ভাত খাওয়াচ্ছিল। ছোট কিছু বলল না। তার হয়ে কাঁদুনে সুরেই জবাব দিল কাদের, ও ঘাটে গিয়েছিল। ওরা দুজনে আসবার আগেই পালিয়েছে হারামজাদা।

    পাঁচ মাইল দূরে থানা। দুজন প্রতিবেশীর কাঁধে হাত দিয়ে সমস্ত পথ একটানা বিলাপ করতে করতে কাদের গিয়ে লুটিয়ে পড়ল বড়বাবুর পায়ের ওপর। এজাহার লিখে নিয়েই তিনি ঘোড়া নিয়ে ছুটলেন। লাশ চালান দিয়ে সেই রাত থেকেই শুরু হল তদন্ত। তোফাজ্জলকে বাড়ি পাওয়া গেল না। কোথায় গেছে কেউ বলতে পারল না। কাদেরের বাড়ি আর খালের পুলের মধ্যে রশি চারেক ব্যবধান, সেই পথে এবং সাঁকোর বাঁশে তিন- চার জায়গায় রক্তের দাগ দেখা গেল। তোফাজ্জলের বাড়ির উঠোনেও খানিকটা খানাতল্লাশে বাড়িঘরে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না। পেছনে ছিল পুরনো খড়ের গাদা। যাবার সময় দারোগার হঠাৎ খেয়াল হতেই সেটা ভেঙে ফেলবার হুকুম দিলেন। তার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল রক্ত-মাখা লুঙি।

    ভোরবেলা বাজারের পাশে একটা মেয়েমানুষের ঘর থেকে বেহুঁশ অবস্থায় তোফাজ্জলকে গ্রেপ্তার করা হল।

    ভূতনাথের দেশলাই-এর কাঠি ফুরিয়ে গিয়েছিল। চাকরকে ডেকে তার ব্যবস্থা করবার পর তিনি পকেট থেকে একটি বিশাল সিগার বের করে ধরালেন। মিনিট কয়েক নিঃশব্দে ধোঁয়া ছেড়ে আবার শুরু করলেন :-

    আমি তখন সদরে। ডি. এস. পি. ভবতোষ সেন ছুটি নিয়েছেন, তাঁর জায়গায় কাজ করছি। কয়েকটা ডিপার্টমেন্টাল প্রসিডিংস নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। এস. পি. ডেকে বললেন, ‘ও-সব থাক। আপনি এই কেসটা দেখুন।’ ও. সি-র রিপোর্ট পড়ে তাঁর বোধ হয় কোনো সন্দেহ হয়ে থাকবে। আমার কাছে অবিশ্যি কিছুই ভাঙলেন না।

    পরদিন থেকেই লেগে পড়লাম। সদর থেকে অনেকটা দূরে। প্রায় সন্ধ্যা হল থানায় পৌঁছতে। গিয়ে দেখি, কাদের বসে আছে। চোখ দুটো লাল, চুল উস্কুখুস্কু। কী ব্যাপার? কাল রাত থেকে ফতিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ও-সি’র মুখ গম্ভীর। ইংরেজীতে বললেন, ‘কোনো গোলমাল আছে মনে হচ্ছে। দু-দিন চেষ্টা করেও মেয়েটাকে মিট করতে পারিনি। রোজই শুনি, অসুখ।’

    কয়েকজন সিপাই নিয়ে তখনি দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। সারারাত খোঁজাখুঁজির পর কাদেরের বাড়ি থেকে মাইল চারেক দূরে ঐ খালের মধ্যেই পাওয়া গেল। একটা বাঁশঝাড় কবে উপড়ে জলে পড়ে গিয়েছিল। ভাঁটার টানে ভেসে এসে তার সঙ্গে আটকে গেছে।

    ভূতনাথবাবু আবার জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেরালেন। মিনিট খানেক চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বললেন, কতদিন হয়ে গেল। মুখখানা এখনও স্পষ্ট মনে আছে।

    ঐ সম্বন্ধেই বোধহয় কোনো প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই ওঁর গলা শোনা গেল। বললেন—

    ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকে আমাদের দেশের চাষীদের সম্বন্ধে অনেক ভালো ভালো কথা পড়েছি। লোকগুলো কী সরল উদার! একজনের বিপদে দশজন বুক দিয়ে এসে পড়ে। এক বাড়ির উৎসব মানে গোটা গাঁয়ের উৎসব। এসব যাঁরা লিখেছেন, সম্ভবত তাঁরা শহরের লোক। গ্রাম্যজীবনের স্বাদ দূরে থাক, কাছ থেকে দেখবার সুযোগও বোধহয় হয়নি। হলে বুঝতেন, একের বিপদে অন্যেরা এসে পড়ে ঠিকই, তবে সেটা অন্য উদ্দেশ্যে। যে লোকটা পড়েছে তাকে সবাই মিলে চেপে ধরবার জন্যে, যাতে করে আর সে মাথা তুলতে না পারে। তোফাজ্জলের ব্যাপারেও তাই হল। একে তো ফেরেববাজ লোক বলে কেউ তার উপর খুশী ছিল না। কখন কার পেছনে লাগে এই ভয়েই তটস্থ! তার ওপরে নানা কাণ্ড করে হঠাৎ অবস্থাটা ফিরিয়ে ফেলবার পর অনেকের মনেই জ্বালা ধরেছিল। এই সুযোগ তারা ছাড়ল না। একগাদা সাক্ষী জুটে গেল কাদেরের পক্ষে। কেউ কেউ সেদিন তোফাজ্জলকে সন্দেহজনক ভাবে বুড়ির ঘরে ঢুকতে দেখেছে, কেউ দেখেছে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে। তার নিজের চাকরটা পর্যন্ত বলে বসল, মনিব যখন বাড়ি ঢোকে, তার গায়ে আর লুঙিতে রক্তের দাগ ছিল। কারণটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, ধমক খেয়ে আর সাহস করেনি।

    আমাদের ও. সি.-টিও কোনো কারণে লোকটার ওপর নারাজি হয়ে থাকবেন। এবার বাগে পেয়ে এঁটে ধরলেন। মামলাখানা যা তৈরী হল, তার মধ্যে দাঁত ফোটাবার মতো এতটুকু নরম জায়গা কোনোখানে খুঁজে পাওয়া গেল না।

    হ্যাঁ, ফতিমার মৃত্যুটা নিয়ে টানা-হেঁচড়া করতে ছাড়িনি, কিন্তু কাদেরের মুখে ঐ এক কথা—’জানি না, হুজুর। মাঠ থেকে বাড়ি ফিরে দেখলাম ঘরে নেই। যেখানে যেখানে যেতে পারে কোথাও না পেয়ে থানায় গিয়েছিলাম খবর দিতে।’

    পাড়ার লোকের বিশ্বাস—দু-চারজন মুখ ফুটে বলেও ফেলল—তোফাজ্জলের সঙ্গে মেয়েটার যে গোপন সম্পর্ক ছিল তার থেকে অন্য ভাবে না হলেও খবরাখবর দিয়ে হয়তো কিছুটা সাহায্য করে থাকবে। পাছে সে কথা বেরিয়ে যায় সেই ভয়ে জলে ঝাঁপ দিয়েছে। একটি সদ্য-গোঁফ-ওঠা কলেজে-পড়া ছোকরা কথাটাকে একটু অ্যামে করে দিল, ভয়ে নয় স্যর, লজ্জায়, ঘেন্নায়। তোফাজ্জলকে সে সত্যিই ভালবাসত।

    ইনভেস্টিগেশন শেষ করতে লেগে গেল ছ’মাস। আমরাই তারিখে তারিখে দরখাস্ত করে সময় নিয়েছি। সাহেব এস. পি.; তার ওপরে দারুণ একরোখা মানুষ। ঐ যে একবার মাথায় ঢুকেছিল এর মধ্যে মিস্ট্রি আছে, ব্যাস, গোঁ চেপে গেল, যেমন করে হোক সেটা বের করতেই হবে। নিজেও কম চেষ্টা করেননি ভদ্রলোক। তারপর হাল ছেড়ে দিলেন।

    আসামী গোড়া থেকেই জেলহাজতে। এস. ডি. ও. জামিন দেয়নি। বড় ব্যারিস্টার লাগিয়ে প্রথমে সেশন্স, তারপর হাইকোর্ট পর্যন্ত লড়েও কাজ হয়নি। আমরা বারবার অপোজ করে গেছি। জোরালো প্রমাণ রয়েছে ওর বিরুদ্ধে। জামিন দিলেই সাক্ষী ভাগাবার চেষ্টা করবে। অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক, সুতরাং এ ঝক্কি নেওয়া যায় না—এই ছিল সরকার পক্ষের যুক্তি। সব কোর্টই সেটা মেনে নিয়েছিলেন।

    ওর পক্ষে মামলা চালানো, উকিল ব্যারিস্টার লাগানো এবং অন্যান্য তদ্বির- তদারকের ভার ছিল বড় ভাই-এর ওপর। দু-হাত দিয়ে লুটছিল লোকটা। এমন সুযোগ কে ছাড়ে? ও-অঞ্চলের চাষী গেরস্তর হাতে নগদ টাকা-কড়ি বড় একটা থাকে না। যা ছিল গোড়াতেই শেষ হয়ে গেছে। তারপর টান পড়েছিল জমিজমায়। ওর নিজের যা ছিল, তাছাড়া এক বছরে কাদেরকে ঠকিয়ে যা কিছু হাত করেছিল, কিছু বাঁধা পড়ল, বেশীর ভাগ জলের দামে বিক্রি হয়ে গেল। হালদারদের পোয়া বারো। মামলা যখন উঠল, তখন আর বিশেষ কিছু বাকী নেই। কাদেরের খুশি আর ধরে না। এক একখানা জমি যায় আর তার ফুর্তি বাড়ে। তার বাড়ির লাগোয়া সেই তেঁতুলতলার বাগানটা যেদিন গেল, সেদিন আনন্দের চোটে একেবারে ক্ষেপে যাবার মতো অবস্থা। বৌ-এর গলায় ছিল একটা রুপোর হাঁসুলি, ভুলিয়ে ভালিয়ে কিংবা এক রকম কেড়ে নিয়েই বলতে পারেন, স্যাকরার দোকানে বাঁধা রেখে সেই টাকায় মস্ত বড় এক খাসী কিনে এনে লাগিয়ে দিল ভোজ। প্ৰায় গাঁসুদ্ধ নেমন্তন্ন!

    প্রতি তারিখে কোর্টে যাওয়ার ওর কোনো দরকার ছিল না, কিন্তু সক্কলের আগে গিয়ে হাজির হত। কাছারির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত, তোফাজ্জলকে কখন নিয়ে আসবে জেল থেকে, চোরডাকাত গাঁটকাটাদের সঙ্গে একটা দড়িতে বেঁধে, একই হাতকড়ায় গেঁথে মামলা যখন চলত, সাক্ষীর জবানবন্দি বা উকিল ব্যারিস্টারের সওয়াল জবাব—এসব দিকে তার নজর ছিল না, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত আসামীর কাঠগড়ার পানে। দলের লোকের কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে বলত, দ্যাখ্ দ্যাখ্, বোনাই আমার কত আরামে আছে জেলে গিয়ে, মুখখানা একেবারে আমসি হয়ে গেছে।

    ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, মিসফরচ্যুন নেভার কাম্‌স্‌ অ্যালোন। কপাল যখন ভাঙে, নদীর মতো এক পাড় ভাঙে না, দু-পাড়ে একসঙ্গে ভাঙন লাগে। তোফাজ্জলেরও তাই হল। একটা মাত্র ছেলে, বছর সাতেক বয়স, বাপের ভীষণ ন্যাওটা। জন্ম থেকেই রোগা, বাপ জেলে যাবার পর থেকে আরও শুকিয়ে যাচ্ছিল। তারপর পড়ল জ্বরে। যেদিন রায় হবার কথা, তার আগের রাত্রে হঠাৎ মারা গেল। কাদেরের কাছে খবর এল। সে গেল না। মনে মনে হয়তো খুশী হবার চেষ্টা করেছিল। তাও পারল না। হঠাৎ কী রকম গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার কেউ কেউ পরে তার বৌ-এর মুখে শুনেছিল, সে রাতটা নাকি সে ঘুমোতে পারেনি। বার বার উঠে উঠে তামাক খেয়েছিল।

    পরদিন ভোরেই সদরে রওনা দেবার কথা। বৌকে আগেই বলে রেখেছিল। রাত থাকতে উঠে ভাতে-ভাত নামিয়ে স্বামীকে ডাকতে এসে দেখে, পুব পোতার ঘরে তার মাকে যেখানে খুন করা হয়েছিল, সেইখানে দাঁড়িয়ে শূন্য মেঝের দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। দেখে কী রকম ভয় পেয়েছিল বৌটা। কাছে সরে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, কী দেখছ! কাদের কোনো জবাব দেয়নি। আরও খানিকক্ষণ তেমনি ভাবে তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত গলায় থেমে থেমে বলেছিল, মা নিশ্চয়ই সব আগে থেকে জানতে পেরেছিল। তা না হলে অমন জোর দিয়ে কইল কেমন করে—তুই দেখে নিস্ কাদের, এর কিছুই ওদের বরাতে সইবে না! তাই তো হল। শেষকালে ছেলেটাও গেল…। বলেই হঠাৎ বৌ-এর দিকে ফিরে তাড়া দিয়েছিল, ভাত দিবি চল্‌।

    কোর্টে সেদিন ভীষণ ভীড়। আমিও দলবল নিয়ে উপস্থিত। রায় সম্বন্ধে আমরা একদম নিশ্চিত ছিলাম। হাতিয়াঙ্গাদি জজ; না ঝুলিয়ে ছাড়বে না, তাও একরকম জানা কথা। চার্জ বোঝানো শেষ হতেই জুরিরা যখন ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন, হাকিমের সঙ্গে আমরাও উঠে পড়লাম। এক পেয়ালা কড়া চা-এর প্রয়োজন বোধ করছিলাম। হরিশ পাইন ছাড়া সে জিনিস কেউ দিতে পারবে না। কোর্ট-কম্পাউণ্ড ছাড়িয়ে দু-পা গেলেই তার দোকান। গেট পেরোতে গিয়ে হঠাৎ নজরে পড়ল, বটগাছের নীচে কাদের মোল্লা গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছে। আশ্চর্য! উল্টোটাই বরং আশা করেছিলাম। অন্য দিন দেখেছি, খুশী মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসে সেলাম করেছে, মামলার হালচাল সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়েছে, আজ চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল। ব্যাপার কী? বোনাই-এর জন্যে মন-কেমন করছে? অসম্ভব, কাদের মোল্লার মন অত কাঁচা—এ অপবাদ তার পরম শত্রুও দিতে পারবে না। তবে কি ওর সন্দেহ হচ্ছে তোফাজ্জল ছাড়া পেয়ে যাবে? তেমন কোনো সম্ভাবনা যে নেই, একটা ছোট ছেলেও তা বুঝতে পারছে, আর ওর মতো ঝানু-মামলাবাজ পারবে না? তাহলে ওর কিসের চিন্তা? ভাবলাম, চা খেয়ে ফিরবার পথে জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু তখন আর ওকে দেখতে পেলাম না।

    পরিষ্কার কেস্। কোথাও কোনো প্যাচ-গোঁজ নেই। জজ অবিশ্যি জুরিদের বোঝালেন, যেমন বোঝাতে হয়, ‘ফ্যাক্ট সম্বন্ধে আপনারাই মাস্টার, আপনাদের মত আমি মেনে নিতে বাধ্য, যেমন আইন সম্পর্কে আমার ব্যাখ্যা আপনাদের মানতে হবে।’ কিন্তু সেই ফ্যাক্ট-এর বর্ণনা দিতে গিয়ে আসল জায়গাগুলোয় এমন সব প্রচ্ছন্ন কিন্তু সুগম ইঙ্গিত দিলেন, ইংরেজীতে যাকে বলে থ্র সাম ক্লিয়ার হিস্‌, যাতে করে তাঁর মত সম্বন্ধেও জুরিদের কোনো সন্দেহ না থাকে। ফলে যা আশা করা গিয়েছিল তাই হল। একেবারে ইউন্যানিমাস ভারডিক্ট—গিলটি। ৩০২ ধারার মামলা; জুরিরা একমত; চরম শাস্তি না দেবার কোনো কারণ নেই। কোনো কোনো বয়স্ক জজ এরকম ক্ষেত্রেও, দুটো একটা, আইনের ভাষায় যাকে বলে এক্সটেনুয়েটিং ফ্যাক্টর খাড়া করে ফাঁসিটা এড়াবার চেষ্টা করেন। কিন্তু হাতিয়াঙ্গাদি সে দলে পড়েন না। ভদ্রলোক একে সিভিলিয়ান, তায় বয়স অল্প, সুতরাং বুঝতেই পারছেন।

    এই পর্যন্ত এসে ভূতনাথবাবুর বাক্যস্রোত হঠাৎ মন্থর হয়ে এল। যেন কোনো দূর- নিরীক্ষ্যমাণ বস্তুর দিকে দৃষ্টি রেখে ধীরে ধীরে বললেন, সেদিনকার সেই দৃশ্যটা আজও চোখের ওপর ভাসছে। খুনী মামলার বিচার তো একটা দুটো দেখি নি, ফাঁসির হুকুমও সেদিন প্রথম শুনলাম তা নয়। কিন্তু আগে বা পরে যা দেখেছি এবং শুনেছি, সেদিনের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। অত বড় সেশন্স কোর্ট লোকে লোকারণ্য। কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। সব যেন একসঙ্গে বোবা হয়ে গেছে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, লাল শালু ঘেরা উঁচু প্ল্যাটফর্মের পেছনে যিনি বসে আছেন তাঁর মুখের দিকে। জজসাহেব শান্ত গম্ভীর গলায় তাঁর রায় পড়ে চলেছেন।

    ফাইণ্ডিং শেষ করে একটুখানি দম নিলেন, মাথা তুলে একবার তাকালেন আসামীর দিকে, তারপর এল সেনটেন্স। কয়েকটি মাত্র কথা, যার ফলে একজন সুস্থ সবল রোগ- ব্যাধিহীন মানুষকে অকালে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। ইণ্ডিয়ান পিনাল কোডের সেই চরম শব্দ কটি তখনও পুরোপুরি উচ্চারণ করেন নি জজ সাহেব, সবে মাত্র বলেছেন, আই দেয়ারফোর অর্ডার দ্যাট দি তোফাজ্জল হোসেন বি হ্যাংড্ বাই-

    হঠাৎ সারা আদালতের মাথায় যেন বাজ পড়ল। কোন্ একটা কোণ থেকে ছুটে এল একটি মাত্র শব্দ—’না’! হাকিম থমকে থেমে গেলেন। অতগুলো লোক—প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। ভিড়ের ভিতর একটা চাঞ্চল্য দেখা দিতে সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল একটি মাত্র লোকের মুখের উপর। লোকজন ঠেলে একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মামলার ফরিয়াদী কাদের মোল্লা। জজ কিছু বলবার আগেই সেলাম করে জানাল, গোস্তাকি মাপ করবেন, হুজুর। ও হুকুম ভুল, তোফাজ্জল বেকসুর। আমার মাকে খুন করেছি আমি।

    চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম সবাই যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। মায় হাকিম পর্যন্ত। তোফাজ্জলের দিকে চোখ পড়তেই দেখি, দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। ঠোঁট দুটো কাঁপছে, কী যেন বলতে চায়, স্বর ফুটছে না। ধীরে ধীরে আবার সাড়া জাগল। একটা চাপা গুঞ্জন উঠল—যারা জানে না, জানতে চাইছে, কে লোকটা? কেউ বলছে, হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেছে। জজ সাহেব হাত তুললেন, অর্ডার, অর্ডার। তারপর হঠাৎ আমার দিকে ফিরে কাছে যাবার ইঙ্গিত করলেন। তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতেই বললেন, “ডিটেন্‌ দ্যাট্ ম্যান্।’ বলেই পাবলিক প্রসিকিউটরকে ডেকে নিয়ে খাস কামরায় গিয়ে ঢুকলেন। বাকী রায় আর পড়া হল না। ফাঁসির হুকুম মুলতুবী রইল। বলতে পারেন শেষ ধাপে এসে আটকে গেল।…একটু চা আনতে বলুন।

    চাকরকে ডেকে চা-এর অর্ডার দিলাম। আমি যথারীতি এক কাপের কথাই বলেছিলাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে সংশোধন প্রস্তাব যোগ করলেন—দু-কাপ এবং বেশ কড়া করে।

    চা আসবার আগেই ভৃত্যের হাতে এল একখানা ভিজিটিং কার্ড। দেড় ইঞ্চি লম্বা এক ইঞ্চি চওড়া সেই বৃহৎ আপদটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিলাম, কোনো রকমে নিজেকে সংবরণ করে রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, কে? কী চায়?

    ভূতনাথ হেসে বললেন, সে কথা ও বেচারী জানবে কেমন করে? আজ এই পর্যন্ত থাক। আরেকদিন এসে

    আপনি ক্ষেপেছেন! একটু বসুন, আমি কার্ডওয়ালাকে ভাগিয়ে দিয়ে আসি। আপনার চা শেষ হবার আগেই এসে পড়বো।

    ভূতনাথবাবু আর বেশীক্ষণ বসতে চান নি। তাঁর ‘নাটক’ও শেষ অঙ্কে এসে গিয়েছিল। বাকী দৃশ্যগুলোর যে বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন, তার একটা সংক্ষিপ্তসার পরিবেশন করে আমিও এগিয়ে যেতে চাই।

    কিছুক্ষণ পরেই জজসাহেব এজলাসে ফিরে এলেন। তোফাজ্জলের মামলার আবার তারিখ পড়ল। কাদের মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হল। ওয়ারেন্টের মাথায় লাল কালি দিয়ে বড় বড় হরফে লিখে দিলেন পেশকারবাবু, ‘কনফেসিং অ্যাকিউজ্‌ড্; টু ‘বী কেপ্ট সিগ্রিগেটেড।’ একরারী আসামীকে আলাদা করে রাখাই রীতি। সব জেলেই সে ব্যবস্থা আছে। এর বেলায় সে নিয়মে যেন কোনো রকম শৈথিল্য না ঘটে, সে বিষয়ে বিশেষ নির্দেশ দিলেন জজসাহেব। ভূতনাথবাবু জেলরের সঙ্গে দেখা করে ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে হুঁসিয়ার করে দিয়ে এলেন। আসামীর স্বীকারোক্তি গ্রহণ করবার ভার পড়ল একজন দক্ষ ও সিনিয়র ম্যাজিস্টেটের উপর। নির্জন খাসকামরায় ডেকে নিয়ে তিনি তাকে ভেবে দেখবার যথেষ্ট সময় দিলেন, বারংবার বোঝাবার চেষ্টা করলেন, পুলিস বা শত্রুপক্ষের ভয়ে, কোনো দিক থেকে কারও প্রভাব বা প্ররোচনায়, ঝোঁকের মাথায়, কিংবা অন্য কোনো কারণে যদি এই স্বীকারোক্তির প্রবৃত্তি তার মনে জেগে থাকে, সে যেন এই বিপজ্জনক কাজ থেকে নিরস্ত হয়। একরার করবার কোনো দায় তার নেই। জজের আদালতে কি বলেছে না বলেছে, আইনত সেটা মূল্যহীন, এবং এখনও যদি সেকথা প্রত্যাহার করে, সেটা কোনো অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

    কিন্তু কাদের মোল্লা নিরস্ত হয় নি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনার হুবহু বর্ণনা দিয়ে মাতৃহত্যার গুরুতর অপরাধ অকপটে স্বীকার করেছিল। শত্রুর প্রতি যে দুর্জয় আক্রোশ তাকে এই কাজে প্ররোচিত করেছিল, তাও কিছুমাত্র গোপন করে নি।

    আবার মামলা শুরু হল। একই মামলার পুনর্বিচার কথাটা বোধহয় ঠিক হল না। সাধারণ কোনো আইন-ঘটিত কারণে বিচারকার্য যেখানে অসিদ্ধ বলে প্রতিপন্ন হয়, সেইখানে রিট্রায়াল বা পুনর্বিচারের প্রয়োজন ঘটে। সেই পুরনো আসামীকে আবার নতুন করে দাঁড়াতে হয় কাঠগড়ায়। একই অভিযোগের পুনরুক্তি। আরেকবার সেই প্রশ্নের জবাব দিতে হয়—তুমি দোষী না নির্দোষ। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ তাই রইল, ঘটনাও এক, বদল হল শুধু আসামীর। নাটকের প্রথম কয়েক অঙ্কে যে ছিল ফরিয়াদী, শেষ অঙ্কে তাকেই দেখা গেল আসামীর ভূমিকায়। অভিযোক্তা স্বেচ্ছা-প্রণোদিত পদক্ষেপে অভিযুক্তের আসনে গিয়ে উঠল।

    এবারও সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন। প্রশ্ন উঠবে—কেন? আসামী তো নিজে এগিয়ে এসে তার কৃত অপরাধ স্বীকার করেছে, আদালতে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছে ‘আমি দোষ করেছি ধর্মাবতার, আই প্লিড্‌ গিলটি টু দি চার্জ’, তা সত্ত্বেও তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে বাধা কোথায়? আছে বাধা। আপাতদৃষ্টিতে না থাকলেও আইনের দৃষ্টিতে আছে। একমাত্র আসামীর উক্তির উপর নির্ভর করে তাকে শাস্তি দেওয়া যায় না—এই হল ফৌজদারী দণ্ডবিধির সুস্পষ্ট নির্দেশ।

    আইনের প্রসঙ্গে অনেকদিন আগেকার অন্য একটা ঘটনা মনে পড়ছে। মামলার দিক থেকে এর সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। অতি সাধারণ কেস্। আসামীটি তার চেয়েও সাধারণ। একটা চৌদ্দ-পনরো বছরের ছেলে। কোথায় দেখেছিলাম? সম্ভবত কৃষ্ণনগর জেল-হাজতে। নাম ছিল পটল দাস।

    সপ্তাহান্তে একদিন আমার রাউণ্ড। লাইনবন্দী লোকগুলোর সামনে দিয়ে সদলবলে জোর কদমে ঘুরে যাওয়া। বিশেষ কারও উপর নজর পড়বার কথা নয়। হঠাৎ একবার কেমন করে যেন খেয়াল হল, এই ছেলেটাকে এই বিশেষ জায়গায় অনেকদিন থেকে পুরোপুরি অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। হাত থেকে ওর হিস্ট্রি টিকেটখানা নিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, তাই বটে, প্রায় ছ’মাস ধরে আছে এখানে। অথচ কেস্টা সামান্য। খুন, ডাকাতি, ঘরে আগুন দেওয়া বা ঐজাতীয় কিছু নয়, ৩৭৯ ধারা— চুরি। জিজ্ঞাসা করলাম, কী চুরি করেছিস?

    উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আশে-পাশে যারা দাঁড়িয়ে, তাদের মুখেও চাপা হাসি। একজন বলে উঠল, পটল চুরি, হুজুর!

    হাসি আর চাপা রইল না। পটলের মাথাটা আর একটু নুয়ে পড়ল; লজ্জায় নিশ্চয়ই, তবে তার মূলে চুরিটা যতখানি তার চেয়ে বেশি বোধ হয় চোরাই মাল। চোরেরও জাতিভেদ আছে। কে কুলীন আর কে হরিজন, নির্ভর করে অপহৃত দ্রব্যের উপর। ‘লুটি তো ভাণ্ডার’ যারা, তারা সম্ভ্রমের পাত্র, ছিঁচকের প্রাপ্য শুধু উপহাস।

    ঘটনার বিবরণও পাওয়া গেল। দিদির বাড়ি থেকে ফিরছিল। জলঙ্গীর চরের উপর দিয়ে পথ। সারি সারি পটলের ক্ষেত। বেশ ভালো ফলন হয়েছে সেবার। পাতার ফাঁকে ফাঁকে নধর কচি ফলগুলোকে উঁকি মারতে দেখে লোভ হল। বাড়ি নিয়ে ভেজে খাবার চেয়ে তুলবার আনন্দটাই বেশী। এখান থেকে কয়েকটা ছিঁড়ে নিয়ে কোঁচড়ে ভরে ফেলল। সবসুদ্ধ সেরখানেক হবে। কয়েক পা যেতেই দেখল সামনে থেকে একজন লোক আসছে। কাছাকাছি গাঁয়ের কোনো মোড়ল চাষী বা কৃষাণ হবে হয়তো। বুকের ভিতরটা ঢিপ্ টিপ্ করতে লাগল। কোনো দিকে না চেয়ে যদি গট গট্ করে এগিয়ে যেত, লোকটা হয়তো লক্ষ্যই করত না। কিন্তু পটল দাসের মনটা তখন তার কাপড়ে বাঁধা পটলগুলোর মতোই একেবারে কাঁচা। এক পা যায়, আর ভয়ে ভয়ে তাকায় সেই লোকটার মুখের পানে। গাঁয়ের মানুষ এমনিতেই একটু সন্ধিৎসু। অচেনা লোক দেখলে খোঁজখবর না নিয়ে ছাড়ে না। তার উপরে ছেলেটার হাবভাব অনেকটা সন্দেহজনক।

    দূর থেকে হেঁকে বলল, ‘এই, বাড়ি কোথায় তোর?’

    জবাব দিতে গিয়ে পটলকে বারকয়েক ঢোক গিলতে হল। তারপরেই দ্বিতীয় প্রশ্ন—’কোঁচড়ে কী?’

    এবার আর জবাব নয়, তার বদলে সোজা দৌড়। কিন্তু গ্রহ বিরূপ। একখানা জমি পেরোবার আগেই পটলের লতায় পা বেধে সজোরে ভূমিসাৎ। পটলগুলোও কোঁচড় ছেড়ে মাটিতে লুটোপুটি।

    হাতেনাতে চোর ধরার মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে, তা সে যেরকম চুরিই হোক না কেন। একজন সামান্য গ্রাম্য কৃষক হাতের কাছে এত বড় সুযোগ পেয়েও বীরত্ব প্রকাশে বিরত হবে, আশা করা যায় না। গাঁটের পয়সা খরচ করে চোরকে কোনো দূরবর্তী থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশের হেফাজতে পৌঁছে দেবার ব্যাপার যদি হত হয়তো ততটা উৎসাহ দেখা যেত না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সেদিকেও সুবিধা ছিল। কী তদন্ত উপলক্ষে থানার জমাদারবাবু তখনও পাশের গ্রামে উপস্থিত। পটলকে মালসমেত তাঁরই হাতে সঁপে দেওয়া হল। তাঁর সঙ্গে সে প্রথমে গেল থানায়, তারপর কাছারি হয়ে জেলখানায়। তার বিরুদ্ধে যে মোকদ্দমা দায়ের হল, তার আলামত্ বা এক্‌জিবিট হিসাবে সেই পটল কটি সযত্নে তোলা রইল কোর্টের মালখানায়। আদালতে দাখিল করবার সুযোগ আর এল না। আই. ও. অর্থাৎ তদন্তকারী অফিসার তারিখে তারিখে একই রিপোর্ট দিতে লাগলেন— কম্‌প্লেনেট নট্ ট্রেসেল্‌। ফরিয়াদী নিখোঁজ। কার ক্ষেত থেকে পটল তুলেছিল পটল দাস,

    তার পাত্তা পাওয়া গেল না। নানাভাবে চেষ্টা করেও পুলিস সেই চোরাই মালের কোনো দাবীদার খাড়া করতে পারল না। মামলার যে একমাত্র সাক্ষী, সেই গ্রামের লোকটি, তার নামও ‘পত্তা’ জমাদার সাহেবের নোটবুকের এক কোণে পেন্সিলে লেখা ছিল। তিনি নিজেই তার পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন। পটল দাসের হাজতবাস বেড়ে চলল। তারিখের পর তারিখ পড়তে লাগল।

    অনেককে দুঃখ করতে শুনি, মানুষের যেটা সব চেয়ে বড় গুণ পরোপকার-প্রবৃত্তি— সংসার থেকে তার ক্রমশ বিলোপ ঘটছে। তা যদি হয়, আমার মতে সেটা শুভলক্ষণ। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, পৃথিবীর যত জটিল সমস্যা তার বেশীর ভাগের মূলে রয়েছে পরের ভালো করবার চেষ্টা। তুমি না চাইলে কি হয়, আমি তোমার উপকার না করে ছাড়বো না—একদল মহৎ মানুষের মনে যদি এই উগ্র মহত্ত্বের প্রাদুর্ভাব না ঘটত, সাধারণ মানুষ সুখে থাকতে পারত, অন্তত আজকের তুলনায় তাদের দুঃখের ভার অনেক লঘু হয়ে যেত। সুসভ্য শ্বেতকায়ের অন্তরে যেদিন সভ্যতা-বিস্তারের মঙ্গলেচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, ‘অসভ্য ও অর্ধসভ্য’ কৃষ্ণাঙ্গের জীবনে সেটা ছিল প্রথম দুর্দিন। বহু শতাব্দী ধরে বহু রক্ত দিয়ে সেই মহোপকারের ঋণ তাদের শোধ করতে হয়েছে এবং কারও কারও এখনও হচ্ছে।

    শুভাকাঙ্ক্ষী শক্তিমানের কল্যাণ-হস্ত কখন কী ভাবে কার মাথায় এসে পড়বে, এই ভয়ে দুর্বলেরা সর্বদা তটস্থ। তাদের মনোভাব হল—কাজ নেই আমার ভালোয়, এই বেশ আছি। বলা বাহুল্য, বৃহতেরা সে কথায় কর্ণপাত করেন না। ক্ষুদ্রের সরব ও নীরব বাধা অগ্রাহ্য করে তার মঙ্গলার্থে কাজ করে যান। দুনিয়ার সর্বত্র এই রীতি। প্রবল রাষ্ট্র যখন তার হীনবল প্রতিবেশীর ‘লিবারেশন’ বা উদ্ধারের জন্যে ‘মুক্তি ফৌজ’ পাঠিয়ে দেন, সেই অজস্র অর্থ ও লোকক্ষয়ের মূলেও এই পরহিতৈষণা।

    পটল দাস ভালোই ছিল জেলখানায়। বিনা পরিশ্রমে নিয়মিত তিন বেলা দক্ষিণহস্তের নিশ্চিত ব্যবস্থা। নতুন কোঠাবাড়ির দক্ষিণ-খোলা বারান্দায় লোভনীয় কম্বলশয্যা। কলের জলে আশ মিটিয়ে স্নান, বেলা পড়লেই হাডুডুডু, মাঝে মাঝে বাড়ির বা গাঁয়ের লোকের সঙ্গে দেখাশুনো। মন কেমন করলে এখানেও সঙ্গী-সাথীর অভাব নেই। এ আরাম চিরস্থায়ী নয়, জেল হলেও বড় জোর এক মাস। তার পরে আবার তো সেই জলপড়া খড়ো ঘর, পচা পুকুর, পান্তা ভাত আর দুপুর রোদে জনখাটার কঠিন জীবনে ফিরে যেতে হবে। তার আগে যে কটা দিন পারা যায়, এই স্বাদটুকু নিয়ে যাওয়া মন্দ কী? এই বোধহয় ছিল তার মনোভাব। গোড়াতে না থাকলেও অভিজ্ঞ বন্ধুদের সংস্পর্শে এসে গড়ে উঠেছিল। সুতরাং মামলার আশু ফয়সালা নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না।

    মাথাব্যথা হল। সে না চাইলেও আমি তার ভালোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। একজন অল্পবয়সী আসামী অনির্দিষ্ট কালের জন্যে হাজতে বসে পচবে, জেলখানার পুরনো চাঁইদের সঙ্গে মিশে অধঃপতনের পথ ধরবে, এটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। দায়িত্বশীল কারা-শাসক হিসাবে আমার প্রথম কর্তব্য যত শীঘ্র সম্ভব ওর বিচারের ব্যবস্থা করা। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হল, সামান্য এক সের পটল চুরি, তার জন্য আবার সাক্ষীসাবুদের কী দরকার? দোষ কবুল করলেই তো সব হাঙ্গামা চুকে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সাজা হয়ে যাবে। কতদিন আর, বড় জোর মাসখানেক। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

    পটল দাসকে ডেকে এনে সেই পরামর্শ দিলাম। বললাম, এবার যেদিন কোর্টে যাবি, ডকে উঠেই হাকিমকে বলবি, আমি দোষ স্বীকার করছি।

    সে বলল, হাকিমের কাছে নেয় না, হুজুর।

    ব্যাপারটা আমার অজানা ছিল না। নির্দিষ্ট তারিখে অর্থাৎ চৌদ্দদিন অন্তর বিচারাধীন আসামীকে বিচারকের সামনে হাজির করতে হবে, এটা তার আইন প্রদত্ত অধিকার। কিন্তু বেশির ভাগ মফঃস্বল কোর্টে যে আসামীর কেস ‘তৈরী’ হয়নি, যাকে বলে রেডি ফর্ হিয়ারিং, তার দৌড় কোর্ট-হাজত বা ‘লক-আপ’ পর্যন্ত। কাঠগড়ায় তার ডাক পড়ে না। কোর্টবাবুর মর্জি না হলে হাকিমের মুখ সে দেখতে পায় না। প্রথম জীবনে অর্থাৎ যতদিন রক্ত গরম ছিল, এই নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক গরম গরম নোট পাঠিয়েছি। সরকারী কাগজ ও বেসরকারী কালি-কলমের কিঞ্চিৎ অপব্যয় ছাড়া আর কোনো ফল হয় নি।

    এবার আর লেখালেখির পথ দিয়ে গেলাম না। পটলকে আশ্বাস দিলাম, আচ্ছা, আমি, কোর্টবাবুকে বলে দেবো। আসছে তারিখে তোকে হাকিমের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে।

    পটল মাথা নাড়ল, অর্থাৎ মাথাটা একদিকে কাত করল। কিন্তু কতটা খুশী হয়ে, আর কতটা আমাকে খুশী করবার জন্যে, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়ে গেল। তার সদিচ্ছার উপর নির্ভর না করে আরেক ধাপ এগিয়ে গেলাম।

    বন্দীদের চিঠিপত্র, আপীল ইত্যাদি লিখে দেবার জন্যে একজন কনভিক্ট রাইটার বা কয়েদী মুন্সী ছিলেন। জেলে আসবার আগে তিনি ওকালতি করতেন। মক্কেলের কিছু গচ্ছিত অর্থ নিজস্ব আমানতে পরিণত করার দরুন বছর দুয়েকের জন্য সরকারী আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাকে দিয়ে পটলের জবানিতে একখানি চোস্ত দরখাস্ত লিখিয়ে নিয়ে বিচারকারী ম্যাজিস্ট্রেটের বরাবর পাঠিয়ে দেওয়া হল। প্রার্থনা রইল’অধীনের এই অকপট স্বীকারোক্তি গ্রহণপূর্বক তাহার অপরাধের আশু বিচারের ব্যবস্থা হউক

    পর পর দুটো তারিখ অর্থাৎ আটাশ দিল চলে গেল, কোনো ব্যবস্থা হল না। প্রতি সোমবার রাউণ্ডে গিয়ে দেখতে পাই, পটল দাস সেই বিশেষ জায়গাটিতে বিশেষ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। ‘প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ’। আমাকে দেখলেই মুচকি হেসে মাথা নিচু করে। জিজ্ঞাসা করি, দরখাস্তের কোনো জবাব এসেছে কিনা, হাকিমের এজলাসে ডাক পড়েছে কিনা। দু’দিকে মাথা নাড়ে, অর্থাৎ ‘না’।

    জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে একটা ডি. ও. অর্থাৎ আধা সরকারী চিঠি লিখব কিনা ভাবছি, এমন সময় ‘জেল-ভিজিট’-এর পালা সারতে তিনি নিজেই একদিন এসে উপস্থিত। পটল দাসের কেস্টা কি অবস্থায় আছে জেনে নিয়ে আমাকে জানাবেন বলে গেলেন। পরদিনই তাঁর টেলিফোন পেলাম। সেইদিন থেকে সাবধান হয়ে গেছি। পরোপকার-আকাঙ্ক্ষা যখনই মাথা তুলে ওঠে, পটল দাসের নজির দেখিয়ে নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে নিরস্ত করি।

    কোন মিথ্যাবাদী প্রচার করেছে—ল’ ইজ নাথিং বাট কমন সেন্স! আসল কথা—ল’ ইজ কন্ট্রারি টু কমনসেন্স। মানুষের সুস্থ সহজ সাধারণ বুদ্ধির বিরোধী বা বিপরীত যদি কিছু থাকে, তার’ নাম আইন। জোনাথান সুইফ্‌ট ঠিকই বলেছিলেন—সাত পুরুষ ধরে যে সম্পত্তি তুমি ভোগদখল করে আসছ, আইনের এক খোঁচায় হঠাৎ একদিন সাব্যস্ত হতে পারে, তুমি সেখানে অনধিকারী বা ইউজাপরি। তার চেয়েও তাজ্জব বাত ভেসে এল টেলিফোনের তার বেয়ে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব জানালেন, যথেষ্ট সময় নিয়েও পুলিস যখন পটল দাসের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারল না, প্রমাণাভাবে হাকিম তাকে বেকসুর খালাস দিতে যাচ্ছিলেন ঠিক এমন সময় তার দরখাস্ত গিয়ে হাজির। দোষ কবুল করবার পর আর তাকে ছাড়া যায় না। কিন্তু শাস্তি তো দিতে পারেন। না, তাও পারেন না। আইন বলছে, কেবলমাত্র স্বীকারোক্তির বলে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। তার সমর্থনে অন্য সাক্ষ্য বা প্রমাণ চাই। কনফেশান অব্ দি অ্যাকিউজ্‌জ্ড মাস্ট বি করোবোরেটেড বাই আদার এভিডেন্স। যতদিন সেই আদার এভিডেন্স বা অন্য সাক্ষ্য সংগ্রহ করা না যাবে, অর্থাৎ কেউ এসে সেই মালখানায় গচ্ছিত পচা পটলগুলো দেখিয়ে না বলবে, হ্যাঁ, এই আসামীকে এই পটল আমি ক্ষেত থেকে তুলতে দেখেছি, ততদিন পটল দাস পচতে থাকবে জেলখানায়।

    ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, কেন মরতে দোষ কবুল করতে গেল ছেলেটা? এমনিতেই খালাস হয়ে যাচ্ছিল, খালি খালি আটকে গেল।

    কেমন করে বলি, সে যায়নি, আমি তার ভালো করতে গিয়েছিলাম।

    তারপর কী হল, অর্থাৎ কোন্ উপায়ে সেই এক সের পটল চুরির জটিল মামলার ফয়সালা হল, সে কথা এখানে অবান্তর। অন্তত একটা সাক্ষী যেমন করে এবং যেখান থেকে হোক পুলিসকে জুটিয়ে আনতে হয়েছিল’ নিশ্চয়ই।

    কাদেরের বেলাতেও সরকার পক্ষের অর্থাৎ পুলিসের উপর সেই দায়িত্ব এসে পড়ল। এবারে ভূতনাথবাবু স্বয়ং তার ভার নিলেন।

    কাজটা সহজ নয়। খুন করতে কেউ দেখেনি। অর্থাৎ চাক্ষুষ সাক্ষী ছিল না। কাদেরের বড় বউ সেই এক কথাই ধরে রইল। সে কিছু জানে না, রসুইঘরে ছেলেকে ভাত খাওয়াচ্ছিল, স্বামীর চিৎকার শুনে ছুটে এসেছে। আগের বারে এর উপর আরেকটা কথা যোগ করেছিল—ঘর থেকে কাউকে পালাতে দেখেনি, তবে পুলের উপর দিয়ে একজন কাউকে বেশ জোরে জোরে পা চালিয়ে চলে যেতে দেখেছিল; অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারেনি, কে; কিন্তু চলবার ধরনটা তোফাজ্জলের মতো।

    এবারকার সাক্ষ্যে এ শেষের অংশটা উল্লেখ করল না। পুলিসও তার জন্যে পীড়াপীড়ি করল না। ভূতনাথবাবু জিজ্ঞাসাবাদ করে অন্য একটা মূল্যবান সূত্রের সন্ধান পেলেন। ও পাড়ার এক বুড়ি মাঝে মাঝে কাদেরের মাকে দেখতে আসে। বেশ ভাব ছিল দুজনের মধ্যে। সেদিনও সন্ধ্যার আগে বেশ কিছুক্ষণ রোগীর কাছে কাটিয়ে গিয়েছিল। কী কথা হয়েছিল বড় বৌ জানে না, সেদিকে খেয়ালও করেনি। শুধু একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিল। অন্যান্য বারে বুড়ি যখন আসে তার শাশুড়ীর কাছে, মাঝখানে কোনো কারণে বৌয়েরা এসে পড়লে দুই বুড়ির কথাবার্তায় কোনো ছেদ পড়ে না। সেদিন কী একটা কাজে বড় বৌ হঠাৎ ঘরে ঢুকতেই দুজনে কেমন চকিত হয়ে উঠল। কথা হচ্ছিল চাপা গলায়, অনেকটা ফিসফিস করে। তাও বন্ধ হয়ে গেল।

    ‘কথাটা নিশ্চয়ই তোমাকে নিয়ে। পাড়ার লোকের কাছে বৌয়ের নিন্দে করছিলেন তোমার শাশুড়ী। তোমার কানে যায় সেটা চাননি’।—হালকা সুরে এমনিধারা একটা মন্তব্য করেছিলেন ভূতনাথবাবু। পিছনে কোনো পুলিসী মতলব থেকে থাকবে। সাক্ষীকে চটিয়ে দিয়ে যদি কিছু তথ্যোদ্ধার ঘটে। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বৌটি দৃঢ়স্বরে বলেছিল, তার শাশুড়ী সে রকম লোক ছিলেন না। তাকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসতেন। সেও পারতপক্ষে তাঁর কোনো অযত্ন করেনি। বলতে বলতে তার চোখ দুটি জলে ভরে উঠেছিল।

    ভূতনাথ প্রশ্ন করেছিলেন, তাহলে কী এমন কথা হচ্ছিল ওদের মধ্যে, তোমার সামনে যা বলা যায় না!

    —তা কেমন করে জানবো?

    অতঃপর ‘সেই বুড়ির শরণ নিলেন ভূতনাথ। প্রথমটা সে কিছুই বলতে চায়নি। ঐদিন যে কাদেরের মাকে দেখতে গিয়েছিল, তাও অস্বীকার করে বসল। পুলিস পক্ষ উৎসাহিত হয়ে উঠল। এই সত্য গোপনের পথ ধরে বুড়ির উপর চাপ দেবার সুবিধা হল। ফলও পাওয়া গেল আশাতীত।

    ছেলের সেই ভয়ংকর প্রস্তাব কাদেরের মাকে প্রচণ্ড ভাবে বিচলিত করেছিল, সহজেই বোঝা যায়। সপত্নী-পুত্রটিকে চিনতে বৃদ্ধার বাকী ছিল না। বিদ্বেষের জ্বালা মেটাতে গিয়ে যে কোনো অমানুষিক নৃশংসতার চরম পথ সে বেছে নিতে পারে, দয়া মমতা ভয় সঙ্কোচ বা বিবেক সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, এর প্রমাণ সে আগেও দিয়েছে। প্রাণ নামক বস্তুটির উপর তার দরদ অতি সামান্য, শুধু পরের নয় নিজেরও, শিশুকাল থেকে তার অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে। প্রাণ নিতে সে অনভ্যস্ত নয়, দিতেও অপ্রস্তুত ছিল না। এই কার্যটি সম্পন্ন করতে গিয়ে দু-একবার যে চরম বিপদের ঝুঁকি তাকে নিতে হয়েছে, তার তুলনায় বৃদ্ধা রোগজীর্ণা বিমাতার ঘাড়ে একটা রামদার কোপ বসিয়ে দেওয়া কিছুই নয়। এই রকম একটা অকেজো অনাবশ্যক জীবন (যার মেয়াদ আপনা থেকেই শেষ হয়ে এসেছে) বলি দিয়ে যদি শত্রু নিপাতের মতো মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করা যায়, সে প্রলোভন ত্যাগ করবার মতো মহত্ত্ব বা দুর্বলতা কাদের মোল্লার কাছে আশা করা যায় না।

    ভূতনাথবাবু বলেছিলেন, বেচারীর অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন। মরণ একেবারে শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে, অথচ করবার কিছু নেই। উঠবার চলবার শক্তি নেই যে পালিয়ে বাঁচবে, চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে হলে যতটুকু গলার জোর দরকার তাও তার ছিল না। শেষের দিকে লোকজনও বড় একটা আসত না তার কাছে। ঐ বুড়ি হঠাৎ এসে পড়েছিল। সে আবার ওর চেয়েও অসহায়। কেউ কোথাও নেই। লোকের দোরে চেয়েচিন্তে কোনোরকমে পেট চলে। তবু ডুবার আগে মানুষ যেমন একগাছা খড়কুটো পেলে তাই আঁকড়ে ধরে, কাদেরের মাও তেমনি ঐ বুড়িটাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল, ওর হাতদুটো চেপে ধরে বলেছিল, আমাকে বাঁচাও।

    তৃণখণ্ডের সাধ্য কি ডুবন্ত মানুষকে টেনে রাখে? নিজেকেই যে তাহলে ডুবতে হয়। তাই গা বাঁচিয়ে নিঃশব্দে সরে পড়া ছাড়া তার আর কি উপায় আছে? বুড়িও সরে পড়েছিল, কিন্তু একেবারে নিঃশব্দ থাকতে পারেনি। মুখ খুলেছিল এমন একজনের কাছে যে তারই মতো নিরুপায় কিংবা তার চেয়েও অক্ষম। কাজীপাড়ার খোঁড়া আবদুল। চলতে পারে না। উরুতের উপর নাটাই ঘুরিয়ে সারাদিন পাটের সুতুলি পাকায় আর নিজের মনে গুন গুন করে গান গায়। এই তার কাজ। বুড়ির বিচারে সে-ই বোধহয় ছিল সবচেয়ে নিরাপদ শ্রোতা। তাই ঘরে না ফিরে সোজা চলে গিয়েছিল খোঁড়া আবদুলের কাছে। সে কিন্তু ব্যাপারটাকে তেমন আমল দেয়নি। হয়তো খোদার সৃষ্টি মানুষের উপর তখনও তার কিছুটা বিশ্বাস ছিল। বলেছিল, দূর, তাই কখনও হয়? বুড়িকে মিছিমিছি ভয় দেখিয়েছে কাদের। গোঁয়ার হলেও মানুষটার দিল সাদা।

    সাক্ষী বলতে এই দুজন। যেটুকু জানে, শুধু সেইটুকুই বলেছিল। জেরার পাল্লায় পড়ে রাতকে দিন এবং দিনকে রাত করতে হয়নি। জেরা পর্বটাই ছিল অনুপস্থিত। আসামী কোনো উকিল দেয়নি। খুন-মামলার আসামী যদি অক্ষম হয়, সরকারী খরচে তার পক্ষে উকিল নিযুক্ত করবার ব্যবস্থা আছে। কাদেরের কাছেও যথারীতি সে প্রস্তাব এসেছিল। সে আমল দেয়নি। একজন জুনিয়র উকিল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। বলেছিলেন, তোমাকে কোনো ফী দিতে হবে না। আমি এমনিই—

    ‘কী বললেন!’ গর্জন শুনে থতমত খেয়ে থমকে গিয়েছিলেন উকিলবাবু, ‘দরকার হলে আপনার মতো এক ডজন উকিল কাদের মোল্লা ফী দিয়েই রাখতে পারে। কিন্তু দরকার নেই। আপনি এবার আসুন। আদাব।

    দেখাটা হয়েছিল জেলখানায়। কাদেরের সেল-এর সামনে। সঙ্গে যে জেল-অফিসারটি ছিলেন, মাথা নেড়ে বলেছিলেন, এর নাম অনুতাপের জ্বালা।

    ‘অনুতাপ!’ এবারে হো হো করে হেসে উঠেছিল খুনের আসামী।

    পরের তারিখেই কাদের মোল্লার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেল। সেই সঙ্গে তোফাজ্জলের মুক্তির আদেশ। খালাস পেয়েই সে শ্যালকের সঙ্গে দেখা করতে ছুটেছিল। পুলিসের আর কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু কাদের রাজী হয়নি। জেলখানার সেই জালে ঘেরা কালো গাড়িটার দরজার সামনে ভূতনাথবাবুর দিকে নজর পড়তে বলেছিল, লোকগুলো কি বলছে জানেন বড়বাবু? আমি নাকি আপসোসের জ্বালায় থাকতে না পেরে খুন কবুল করেছি। হাঃ হাঃ হাঃ!

    হঠাৎ হাসি থামিয়ে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর দু-চোখের তারায় আগুন ছড়িয়ে কেমন ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিল, ফাঁসি হলে তো বেঁচে যেত হারামজাদা। এক নিমেষে সব খতম। এবার সারা জীবন জ্বলে-পুড়ে মরুক।

    বলতে বলতে সহসা তার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ থেকে উপচে পড়েছিল খুশির জোয়ার— ‘একছিটে জমি নেই কোনোখানে। বসতবাড়িটা পর্যন্ত হালদারবাবুদের সেরেস্তায় বাঁধা একটা ছেলে, তাকে তো আগেই নিয়ে নিয়েছে খোদাতাল্লা। আমার বোনটা কেন কষ্ট পাবে খালি ভিটেয় পড়ে? রহিম তালুকদারের সঙ্গে নিকে দিয়ে দিলাম। বাড়ি গিয়ে দেখুক না একবার। সব খাঁ খাঁ করছে। মিঞা সাহেবকে এবার পরের জমির ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে পেট চালাতে হবে। হাঃ হাঃ হাঃ!”

    জেলের গাড়ি চলে গেল। তারপরেও অনেকক্ষণ সেই হাসিটা যেন এক বীভৎস উল্লাসের জ্বালা ছড়িয়ে চারদিকে গগম্ করতে লাগল।

    হাসি বলছি বটে, বললেন ভূতনাথবাবু, কিন্তু সে যে কী, আমি বলতে পারবো না। মানুষ অমন করে হাসে না।

    ভূতনাথবাবুর ট্রেন ধরবার তাড়া ছিল। কিন্তু ওঠবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। দীর্ঘ কাহিনী যখন শেষ হল, তারপরেও কেমন আচ্ছন্নের মতো নিঃশব্দে বসে রইলেন। তাঁর স্পেশাল সিগারেটের আধখানা টেবিলের উপর পড়ে ছিল। আমি দেশলাইটা এগিয়ে দিলাম। সেদিকেও নজর পড়ল না। মিনিট কয়েক পরে বললাম, একটু চা আনতে বলি? সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, প্রতিহিংসার তাড়নায় মানুষ কত কী করতে পারে! অনেক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত আমি নিজের চোখে দেখেছি, আপনিও দেখে থাকবেন। কিন্তু শত্রুর ওপর এত বড় প্রতিশোধ এমন করে বোধহয় কেউ কোনদিন নেয়নি।

    তিনি চলে যাবার পর আমি সেইখানেই বসে রইলাম। হঠাৎ খেয়াল হল, ফতিমার কথা তো কিছু বলে গেলেন না। সে সত্যিই জলে ঝাঁপ দিয়েছিল, না—। উনি নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিলেন। বলতে ভুলে গেছেন। আবার যখন আসবেন, জেনে নেবো। তারপর মনে হল, থাক। ভূতনাথ দারোগার কঠিন পুলিসী-হৃদয়ের কোণে কোনো একটা তুচ্ছ দ্বিচারিণী গ্রামের মেয়ে যদি একটু স্নিগ্ধ ছায়া ফেলে থাকে, তাকে রূঢ় আলোয় টেনে এনে কী লাভ? অনেক কিছু তো জানা গেল। ঐ জায়গায় থাক না একটুখানি গোপনত অন্তরাল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডাইস লস্ট – জন মিল্টন
    Next Article ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }