Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌহকপাট – জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)

    জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) এক পাতা গল্প980 Mins Read0

    লৌহকপাট – ৪.৫

    পাঁচ

    কোনো প্রসিদ্ধ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ অধ্যাপক একবার আমার জেল ‘ভিজিট’ করতে এসেছিলেন। দিগ্‌গজ ব্যক্তি। যেমনি পাণ্ডিত্য, তেমনি ভূয়োদর্শন। দু-দুটো ‘ওলজীচে ডক্টর—ক্রিমিনোলজী এবং পিনোলজী। অর্থাৎ একাধারে অপরাধতত্ত্বের ও দণ্ডবিধানে বিশেষজ্ঞ। আমার চাকরি তখন শেষ হব-হব করছে। বহু জেল ঘুরে এবং ঘেঁটে ‘বিশেষজ্ঞ’ আখ্যা না পেলেও অভিজ্ঞতার ব্যাঙ্কে মোটা সঞ্চয়ের দাবী করতে পারি। সম্ভবত সেই কারণেই কারাবিভাগের কর্তারা তাঁকে আমার স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। আমিও বেশ কয়েক দফা বাক্‌চক্রের জন্য তৈরী হচ্ছিলাম, সরকারী পরিভাষায় যার নাম রাউণ্ড অব টক্স। বলা বাহুল্য অন্যদিকে যাই হোক, এই একটা বিষয়ে আমরা কোনো দেশের কারও চাইতে কম যাই না।

    কিন্তু ভদ্রলোক আমাকে রীতিমত নিরাশ করলেন। নিজেও কোনো পাণ্ডিত্য প্রকাশের চেষ্টা করলেন না, আমাকেও তার সুযোগ দিলেন না। তাঁর কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে দু-চারটি কথাবার্তার পর, প্রথম দিন থেকেই ‘ফিল্ড-ওয়ার্কে’ নেমে পড়লেন। ‘অ্যাডমিশন রেজিস্টার’ (যার মধ্যে কয়েদীদের নাম ধাম এবং যাবতীয় বিবরণের ফিরিস্তি থাকে ) চেয়ে নিয়ে, তার থেকে বেছে বেছে কতগুলো নাম সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে দেখাশুনো, আলাপ-সালাপ শুরু করলেন।

    কোন্ মন্ত্রবলে তিনি জাতি, বর্ণ, দেশ ও ভাষার বর্ম ভেদ করে ‘অপরাধী’ নামক প্রাণীর প্রাণকেন্দ্রে পৌঁছে যেতেন, সেখান থেকে কেমন করে কি তথ্য সংগ্রহ করতেন, সে-সব কথা এখানে আলোচ্য নয়। দু-সপ্তাহের উপর আমার জেলে কাটিয়ে এখান থেকে কি অভিজ্ঞতা নিয়ে গেলেন, যাবার আগে তারই আভাসস্বরূপ যে কথাটি বলেছিলেন, সেইটুকুই আমার বক্তব্য। তিনি বলেছিলেন, ‘যাকে জাত-ক্রিমিনাল বলে, আপনার এখানে একটাও পেলাম না। আপনার এখানে বলি কেন, যে-ক’টা ইণ্ডিয়ান জেল ঘুরলাম—তা কম ঘুরি নি, সবখানেই তাদের সংখ্যা বড় কম।’

    ‘জাত-ক্রিমিনাল’ বলতে তিনি বোধহয় বোঝাতে চেয়েছিলেন—’ক্রাইম্’ যাদের ধর্ম এবং প্রকৃতি। হঠাৎ একদিন ঝোঁকের মাথায়, আবেগের বশে কিংবা প্রতিহিংসার তাড়নায় খুন করে বসল, বাহাদুরি দেখাবার জন্য দল বেঁধে ডাকাতি করে এল, সহসা কোনো অরক্ষিত স্ত্রীলোককে পেয়ে কামেচ্ছা মিটিয়ে নিল, কিংবা অপরের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু টাকাকড়ি আত্মসাৎ করে গা-ঢাকা দিল—এই জাতীয় অপরাধীকে তিনি, ‘ক্রিমিনাল’ বলে যে একটা জাত আছে, তার মধ্যে ফেলতে চান নি। তাঁর মতে ওরা সব ‘ক্যাজুয়াল অফেনডার’। আসল ক্রিমিন্যাল তারা, ‘ক্রাইম্’ যাদের ধ্যান জ্ঞান সাধনার বস্তু, মজ্জাগত সংস্কার কিংবা অত্যাজ্য জীবন-দর্শন।

    ‘এখানে যাদের দেখলাম’, বলেছিলেন অধ্যাপক, ‘তাদের বেশির ভাগই অবস্থার দাস, যা কিছু করেছে, লোভে বা বিপাকে পড়ে কিংবা জীবিকার প্রয়োজনে। তার পেছনে জীবনের কোনো গভীর প্রেরণা নেই। সত্যিকার ক্রিমিনাল কর্মযোগীর মতো নিষ্কাম, নিরুদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য হয়তো একটা থাকে, কিন্তু সেটা অজুহাত মাত্র, অনেক সময়ে ওটা নিজের মনকে ভোলাবার প্রয়াস। আসলে “ক্রাইম্” তার কাছে এক ধরনের ওয়ার্ক অব আর্ট, শিল্পীর সৃষ্টি। ইচ্ছা করে যে করে তা নয়, ভিতর থেকে কে একজন ঠেলে এগিয়ে দেয়, না করে উপায় নেই।’

    সেদিন তার কথা শুনতে শুনতে আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ রাজাবাহাদুরের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। হয়তো তার কারণ, অধ্যাপক যাদের সম্বন্ধে আলোচনা করছিলেন, তাদের সঙ্গে তাঁর কোথায় যেন মিল আছে। কিংবা হয়তো এমনিই মন কখন কি ভাবে, কেন ভাবে তার কি কোনো হেতু আছে? থাকলেও তাকে খুঁজতে যাওয়া নিছক বিড়ম্বনা। সেসব ‘কেন’র পিছনে না ছুটে যে লোকটিকে সেদিন মনে পড়েছিল, তার প্রসঙ্গটা কিঞ্চিৎ সবিস্তারে বলবার চেষ্টা করি।

    রাজাবাহাদুরের সঙ্গে দেখা আমার চাকরি-জীবনের প্রথম অধ্যায়ে। তখনও জেলের হাল-চাল, আইন-কানুন পুরোপুরি ধাতস্থ হয়নি। কারাবাসী ও কারাকর্মীর ভিতরে যে দুস্তর ব্যবধান, সেটা ঠিক বজায় রাখতে পারিনি। ‘প্রিজনার’ হিসাবে এই মানুষটিকে যতটা দূরে রাখা দরকার, তার চেয়ে একটু বেশী কাছে এসে পড়েছিলাম। তার প্রাথমিক কারণ বোধহয় তাঁর রূপ। নারীপুরুষ নির্বিশেষে রূপের যে একটি সর্বজনীন আকর্ষণ আছে, রাজাবাহাদুরকে দেখেই সেটা প্রথম অনুভব করেছিলাম। অতুলনীয় অঙ্গ-সৌষ্ঠব। দীর্ঘ উন্নত দেহ, প্রশস্ত ললাট, আয়ত চক্ষু। কাঁধ এবং বাহুযুগলের দিকে চেয়ে মনে হয়েছিল, ‘বৃষস্কন্ধ’ ও ‘শালপ্রাংশু’ বলে যে দুটি বিশেষণ কালিদাস ব্যবহার করে গেছেন, তার মধ্যে কোনো কবিজনোচিত অত্যুক্তি নেই। আর একটা কথা মনে হয়েছিল, এ দেহের প্রতি কণায় শোভাকে ছাড়িয়ে গেছে সম্ভ্রম, সৌষ্ঠবকে ছাপিয়ে উঠেছে আভিজাত্য। গিরীনদা বলেছিলেন, ‘সত্যিই রাজাবাহাদুর — Every inch an aristocrat!’ আমাদের অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ওয়ার্ডার জোস্-এর উপর ভার পড়েছিল ওঁকে সেল্‌-এ পৌঁছে দেবার। ফিরে এসে বলেছিল, Bloody Mountain. বিশেষণ ও প্রকাশের ভঙ্গিটা কিঞ্চিৎ অমার্জিত হলেও, এক কথায় এর চেয়ে যথার্থ পরিচয় বোধহয় আর হতে পারত না। যখনই দেখেছি মনে হত, লোকটা যেন গিরিশৃঙ্গের সমস্ত মহিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    রাজাবাহাদুর খুন-মামলার আসামী। ভ্রাতৃহত্যা। অব্যবহিত উপায়ে বিষপ্রয়োগ। কিন্তু তার প্রক্রিয়া অত্যাশ্চর্য ও অভিনব। বিষ সংগ্রহের সুদীর্ঘ এবং জটিল ইতিহাস অনুধাবন করতে গিয়ে পুলিস যে সব তথ্য উদ্ধার করেছিল, তার থেকে চিররহস্যাবৃত মানব-মনের একটি অনাবিষ্কৃত গোপন কক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। সবটুকু তখনও উন্মোচিত হয়নি। যেটুকু দৃশ্যমান, তাতেই আমরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। একজন মানুষকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবার জন্যে আর একজন মানুষের কি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, তার রূপায়ণে কি গভীর অভিনিবেশ, কি দুর্জয় নিষ্ঠা, কি ক্লান্তিহীন সাধনা! শুধু তাই নয়, যে মস্তিষ্ক সেই গুপ্ত চক্রান্তের প্রতিটি পদক্ষেপ পরিচালিত করেছে, যে ধীর স্থির শাণিত কূটবুদ্ধি প্রতি স্তরে তার স্বাক্ষর রেখে গেছে, তা দিয়ে অনেক কম আয়াসে একটা গোটা রাজ্য ছিনিয়ে আনা যেত। আর এখানে সেই বিপুল প্রচেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য ছিল একটিমাত্র নিরীহ মানুষের প্রাণটাকে ছিনিয়ে নেওয়া!

    আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এই হত্যাযজ্ঞের অন্তর্নিহিত প্রেরণা সেই চিরন্তন রাজ্য- লোলুপতা, ক্ষমতা ও বিত্তের অধিকার-লিপ্সা, অনাদিকাল থেকে ছোট-বড় রাজপরিবারে যা বহু ভ্রাতৃহত্যা পিতৃহত্যার ইন্ধন যুগিয়ে এসেছে। তাই যদি হয়, সেই ঈপ্সিত বস্তুটিকে অনায়াসে আয়ত্ত করবার পথে এখানে তো কোনো বাধা ছিল না। যাকে হত্যা করা হল, সে তো স্বেচ্ছায় তার সব স্বত্ব ও স্বামিত্ব থেকে নিঃশব্দে সরে দাঁড়িয়েছিল। উনিশ বছরে পা দিয়েই সামান্য মাসোহারার বিনিময়ে তার অংশের সমস্ত সম্পত্তি বড় ভাইকে লিখে দিয়েছিল। পৈতৃক প্রাসাদে বাস করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত রাখেনি। সব ছেড়ে বেরিয়ে চলে এসেছিল। ব্যক্তিগত ব্যবহারের দু-চারটি তুচ্ছ জিনিস ছাড়া আর কিছুই সঙ্গে আনেনি। কোলকাতার এক অখ্যাত গলির ছোট ভাড়া-বাড়িতে লেখাপড়া নিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। বিয়ে করেনি। করবার ইচ্ছাও ত্যাগ করেছিল। যাতে করে তার কোনো উত্তরপুরুষ, সুদূর ভবিষ্যতে, সে যা ছেড়ে দিয়ে চলে এল, তারই দাবী নিয়ে সেই প্রাসাদের দ্বারে গিয়ে দাঁড়াতে না পারে।

    উত্তরাধিকারের সঙ্গে জড়িত দুটিমাত্র জিনিস সে নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। একটি পিতার আমলের ভৃত্য গঙ্গাচরণ, আর একটি তারই মুখের ডাক—ছোট কুমার’। প্রথমটি তাকে ছাড়েনি, দ্বিতীয়টি সে অনেক বকাবকি করেও ছাড়াতে পারেনি। ঐ নামটুকু ছাড়া ‘কুমারত্বের’ আর কোনো নিদর্শন তার জীবনযাত্রার কোনোখানেই দেখা যায় নি। স্বভাবে নিতান্ত নিরীহ, নির্বিরোধ, সরল ও অমায়িক। চালচলনে অতিশয় সাদাসিদে। বই ছাড়া আর কোনো নেশার বালাই নেই। বন্ধু-সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ অতি ক্ষীণ। যেটুকু ছিল, তার মধ্যে স্বার্থের সংঘাত ঘটবার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও দেখা দেয়নি। সে যে কোনো দিন কারও আক্রোশ বা বিদ্বেষের পাত্র হয়ে দাঁড়াতে পারে, একথা কে ভেবেছিল?

    তবু তাকেই একদিন আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হল। আকস্মিকভাবে নয়, তার পিছনে কি বিপুল আয়োজন! সেই একই প্রশ্ন আবার আসছে—কেন? কি প্রয়োজন ছিল এই ছেলেটিকে অত কাণ্ড করে মেরে ফেলবার? কি উদ্দেশ্য?

    সে প্রশ্ন আজও আমার কাছে অমীমাংসিত রয়ে গেছে। পুলিস কিংবা আদালত সেই নিগূঢ় সত্যে পৌঁছতে পারেনি। কোনো মনস্তত্ত্ববিদ হয়তো এর উপরে কিছুটা আলোকপাত করতে পারেন, কিন্তু তাঁকেও স্বীকার করতে হবে, ‘এটা হয় এই পর্যন্ত জানি, কেন হয় তা জানি না।’

    আমার যেটুকু আবিষ্কার, তার মূলসূত্র রাজাবাহাদুরের নিজের উক্তি। দীর্ঘদিন পরে যখন তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসবার সৌভাগ্য লাভ করেছি, তখন একদিন কথাচ্ছলে বলেছিলেন। মনে আছে, সেদিন আবিষ্কারের উল্লাসে আমি আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। এত চেষ্টা, এত সাধ্য-সাধনা, এত দীর্ঘদিনের গবেষণা ও অনুসন্ধানে যা কেউ পায়নি, আমি তাই পেলাম। কলম্বাসের চেয়েও আমি ভাগ্যবান। তারপর যেমন বয়স বেড়েছে, জীবনে অনেক কিছু দেখেছি এবং শুনেছি, ঘা খেয়ে খেয়ে অনেক কিছু শিখেছি, তখন মনে হয়েছে, রাজাবাহাদুর সেদিন যা বলেছিলেন, তার মধ্যে কপটতা হয়তো ছিল না, কিন্তু সেটাই যে সত্য সে-বিষয়ে কি নিজেই নিশ্চিত ছিলেন? আমার মনে হয়, ছিলেন না। উকিল, হাকিম, পুলিস এবং আমাদের মতো তিনিও একজন অনুসন্ধানী মাত্র। নিজের মনের ভিতরটা হাতড়ে দেখতে গিয়ে ঐ উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিলেন। সেক্সপীয়রের ওথেলো নাটকের ভিলেন ইয়াগো মাঝে মাঝে নিজের কাছে তার চিন্তা ও আচরণের একটা কৈফিয়ত খাড়া করবার চেষ্টা করেছে। সেই সম্পর্কে একজন প্রসিদ্ধ সমালোচক বলেছেন—motive hunting of a motiveless malignity. আমার মনে হয়েছে, কথাটা রাজাবাহাদুরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটাও motive-hunting ছাড়া আর কিছু নয়। নিজের উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায়কে খুঁজে বের করবার চেষ্টা, আত্মানুসন্ধান—আসলে হয়তো কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। নিছক নিরুদ্দেশ্য ম্যালিগনিটি কিংবা আর কিছু।

    তবু রাজাবাহাদুরের সেই স্বীকারোক্তি আজ আর আমি গোপন করতে চাই না। যথাসময়ে প্রকাশ করব। তার আগে আরও কিছু বলার আছে। বিশেষ করে আর একজনের কথা, যার বিস্ময়কর প্রতিভার সুবর্ণ সংযোগ না ঘটলে রাজাবাহাদুরের পরিকল্পনা সার্থক হতো না। সে একজন তরুণ ডাক্তার। নাম ধরুন নিশানাথ লাহিড়ী।

    নিশানাথ মেডিক্যাল কলেজের কৃতী ছাত্র। সেখানে তার প্রধান অধীত বিষয় ছিল জীবানুতত্ত্ব। বেরিয়ে এসে তাই নিয়েই গবেষণা শুরু করেছিল। অণুবীক্ষণের ভিতর দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কিন্তু মহাশক্তিধর মারীকীটের সন্ধান। উপযুক্ত সহায় ও সুযোগ পেলে এই তরুণ বিজ্ঞানী মানব-কল্যাণে এই বিশেষ ক্ষেত্রে চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেখিয়ে একদিন বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠালাভ করবে, সে বিষয়ে তার অধ্যাপকেরা নিঃসন্দেহ ছিলেন। কিন্তু কোত্থেকে আসবে সেই সুযোগ? কে হবে সেই সহায়? নিজের সঙ্গতি বলতে কিছুই ছিল না। বরং পাস করে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ মা-বাপ, অপোগণ্ড ভাইবোন স্ত্রী ও একটি শিশুকন্যার ভার কাঁধে এসে চেপেছিল। নিশানাথ বুঝেছিল, ‘রিসার্চ’-এর বিলাস তাকে ছাড়তে হবে। ল্যাবরেটারী ছেড়ে নামতে হবে রোজগারের ধান্দায়।

    সে পথও সহজ বা সরল নয়। তখনকার দিনে চাকরি মেলা দুষ্কর। আর প্র্যাকটিস? তার পিছনেও অনেকখানি প্রস্তুতির প্রয়োজন। সেই সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আনুকূল্যের আশা নিয়ে নিশানাথ একদিন হাজির হল তার হিতৈষী মুরুব্বি এবং প্রাক্তন শিক্ষক ডাক্তার মুস্তাফির কাছে। মুস্তাফি নামী ডাক্তার এবং রাজাবাহাদুরের গৃহ-চিকিৎসক। লাহিড়ী যখন গিয়ে পৌঁছল, তিনি তখন বেরোবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কয়েক সেকেণ্ড কি ভেবে নিয়ে বললেন, গাড়িতে ওঠো। নিশানাথ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই যোগ করলেন, “চল না!’—বলে সোজা নিয়ে গেলেন রাজাবাহাদুরের দরবারে। মোটামুটি একটা ক্লিনিক কিংবা ডিসপেনসারি সাজিয়ে বসবার মতো কিছু সাহায্য বিকল্পে একটা চাকরি—এর বেশি কোনো প্রত্যাশা মুস্তাফির মনেও ছিল না। কিন্তু ভাগ্যচক্রের কি আশ্চর্য বিবর্তন! ‘ছেলেটি’র প্রতিভার পরিচয় পাবার পর রাজহস্তের বদান্যতা আরও অনেকখানি প্রসারিত হল। সহকারী গৃহ-চিকিৎসক হিসাবে একটা মাসমাইনে চাররির ব্যবস্থা তখনই হয়ে গেল। রাজাবাহাদুর বিনীত মৃদু স্বরে মুস্তাফিকে বললেন, আত্মীয়-পরিজন, জ্ঞাতি- গোষ্ঠী, লোক-লস্কর নিয়ে পরিবারটি তো আমার ছোট নয়, স্যার। কারও না কারও একটা কিছু রোজই প্রায় লেগে আছে। সব ব্যাপারে আপনাকে ধরে টানাটানি—তার চেয়ে এ ভালোই হল। উনি একবার করে ঘুরে যাবেন। তেমন তেমন প্রয়োজন দেখা দিলে আপনি তো রইলেনই।

    এটা গেল প্রাথমিক বন্দোবস্ত। পরের পর্বটাই আসল। নিরুদ্বিগ্ন মন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাবার মতো একটি সুসজ্জিত ল্যাবরেটরী। রাজাবাহাদুর খাজাঞ্চিকে ডেকে তখনই একটা মোটা টাকার চেক লিখে আনতে বললেন এবং নিশানাথের দিকে ফিরে বললেন, এটা শুধু ঘর আসবাবপত্তর আর আনুষঙ্গিক যা কিছু দরকার তার জন্যে। যন্ত্রপাতি বা রিসার্চের দরুন আর যা যা প্রয়োজন, তার একটা লিস্টি করে ফেলুন। কোনো রকম টানাটানি করবেন না। যেখানকার যেটা সেরা জিনিস বেছে নেবেন। দামের দিকটা আপনাকে ভাবতে হবে না। আমার ম্যানেজার এখন বিলেতে আছে। লিস্টিটা তার কাছে পাঠিয়ে দেবো। নিজে দেখে-শুনে সংগ্রহ করে সামনের ওপর প্যাক করিয়ে একেবারে সঙ্গে নিয়ে আসবে। কি বলেন স্যার, এইটাই ভালো ব্যবস্থা নয়? ও-সব ডেলিকেট জিনিস, সাবধানমতো নাড়াচাড়া না করলে পথেই কোনোটা খারাপ হয়ে যেতে পারে।

    শেষে কথাগুলো ডাক্তার মুস্তাফির উদ্দেশে। তিনি আবেগের সুরে বললেন, আমি আর কি বলবো, রাজাবাহাদুর? বলবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার এই মহৎ দান-

    -–এই দেখুন, আপনিও যদি অমন করে বলেন স্যার, তাহলে তো বড় মুশকিল। দানটান কিছু নয় ডক্টর মুস্তাফি। একরাশ পড়ে পাওয়া টাকা ব্যাঙ্কে বসে বসে পচছে। একটা ছেলে নেই যে তার জন্যে রেখে যাবো। একটা মাত্র ভাই, সেও তো দেখলাম বিবাগী হয়ে বেরিয়ে গেল। কি হবে টাকা দিয়ে? তবু যদি এই রকম একটি প্রভিভাবান ছেলেকে একটু দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়, শুধু ওর নয়, দেশের-দশের মঙ্গল হবে। এই সুযোগটুকু যে আপনি আমাকে পাইয়ে দিলেন, তার জন্যে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আচ্ছা তাহলে ঐ কথাই রইল লাহিড়ী। তোমাকে কিন্তু ভাই আমি ‘তুমি’ বলেই ডাকবো।

    —নিশ্চয় নিশ্চয়, তুমি বলবেন বৈকি। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ডাক্তার মুস্তাফি। একেবারে ছেলেমানুষ, তাছাড়া আমার ছাত্র।

    —শুধু ছাত্র নয় স্যর, আপনার উপযুক্ত ছাত্র।

    মাসখানেকের মধ্যেই ইউরোপ থেকে কয়েকটি সদ্য-আবিষ্কৃত মহামূল্য যন্ত্র এসে পৌঁছল। একেবারে আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত হল ল্যাবরেটরী। রাজাবাহাদুর একদিন এসে দেখে গেলেন। নিশানাথ তখন কাজ করছিল, রাজ-অতিথিকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করে একটি একটি করে প্রতিটি যন্ত্রের বৃত্তি সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা দিয়ে দিল। তিনি মন দিয়ে শুনলেন। যাবার সময় বললেন, কোথাও কোনো ত্রুটি নেই তো? যা চেয়েছিলে, সব পেয়েছ?

    —তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি রাজাবাহাদুর। আশীর্বাদ করুন, যেন সেই পাওয়ার গৌরব বজায় রাখতে পারি।

    রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গীর মধ্যে একটি অরাজোচিত বিনম্র সঙ্কোচ সর্বদাই লেগে আছে। যেন তাঁর দৈবায়ত্ত রাজপদ এবং তার বাহক এই বিশাল দেহটার জন্যে তিনি সকলের কাছেই লজ্জিত। ব্যবহার ও কথাবার্তার মাধুর্য দিয়ে ঐ দুটি বস্তুকে যতখানি আড়াল করে রাখা যায় তারই জন্যে সচেষ্ট। নিশানাথের মতো একান্ত আশ্রিতজনের কাছেও তাঁর কুণ্ঠার সীমা নেই। তার কথায় অত্যন্ত লজ্জা পেয়েছেন এমনিভাবেই দাঁতে জিভ কেটে মাথা নেড়ে বললেন, না না, ও ‘কথা বলো না তোমাকে আশীর্বাদ করবার মতো স্পর্ধা আমার নেই। প্রাণভরে শুভেচ্ছা জানাই, তুমি অনেক বড় হও, আমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল কর, এই প্রার্থনা করি।

    বছর দেড়েক কেটে যাবার পর নিশানাথ তার গবেষণার এমন একটা স্তরে এসে পৌঁছল যেখানে বিশেষজ্ঞের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তেমন ব্যক্তি এদেশে অত্যন্ত দুর্লভ। দু-একজন যাঁরা আছেন, তাঁরা অন্য ক্ষেত্রে ব্যস্ত। ঐ বিশেষ গবেষণার উপযোগী কোনো ল্যাবরেটরীও তখন কোলকাতায় নেই। পশ্চিমভারতের একটি প্রসিদ্ধ ইনস্টিটিউট্-এ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাওয়া যেতে পারে। উচ্চাঙ্গ রিসার্চে সাহায্য করার মতো বিদেশী বিজ্ঞানীও আছেন ক’জন। কিন্তু সেখানে জায়গা পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। অত্যন্ত নামী লোকের জোরালো সুপারিশ চাই। ডাক্তার মুস্তাফিকে কত আর বিরক্ত করা যায়? তাছাড়া তাঁর কথা কতখানি টিকবে, তাই বা কে জানে? সেদিক দিয়ে সুরাহা দেখা দিলেও আর্থিক প্রশ্নটা আরও বড়। অনেক টাকার দরকার।

    ওখানকার খরচ, কতদিন থাকতে হবে ঠিক নেই—তার উপরে কোলকাতার সংসারের ব্যয়ভার। অর্থাৎ চাকরিটি খোয়ালে চলবে না।

    রাজাবাহাদুরের কাছে কথাটা কেমন করে পাড়া যায়, এইসব যখন ভাবছে, হঠাৎ তাঁর কাছ থেকে ডিনারের নিমন্ত্রণ এসে হাজির। উপলক্ষের উল্লেখ নেই। অনেক সময়েই থাকে না। বিনা উপলক্ষে যখন-তখন বন্ধুবান্ধব এবং আশ্রিত-পরিজনদের ভুরিভোজে আপ্যায়িত করা ওঁর একটা বিলাস।

    কিন্তু এবারে সবিস্ময়ে লক্ষ্য করল নিশানাথ, নিমন্ত্রিত সে একা। খাবার যেখানে দেওয়া হল, সেটাও ভোজনশালা নয়, সদর ও অন্দরমহলের মাঝামাঝি রাজাবাহাদুরের নিজস্ব গোপন-মহলের একটি ছোট ঘর। তিনিও বসলেন অতিথির মুখোমুখি। মাঝখানে টেবিলের উপর খাবার সাজানো। উপকরণ যথারীতি, অর্থাৎ বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের অভাব নেই। অভাব পরিবেশকের। সেই জমকালো পোশাকের তকমা-আঁটা ‘বয়’ বা ওয়েটারদের কোথাও দেখা গেল না। রাজাবাহাদুর তাঁর সেই নিজস্ব মধুর হাসির সঙ্গে মৃদু কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন, রকম-সকম দেখে তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে গেছ?

    নিশানাথ অস্বীকার করল না—তা একটু হয়েছি।

    রাজাবাহাদুরের মুখে সেই হাসিটি মিলিয়ে গেল, কিন্তু তার স্নিগ্ধ রেখাগুলো লেগে রইল। কয়েক মুহূর্ত বিরতির পর বললেন, অনেকদিন থেকে ভাবছি, একটা বেলা দুজনে একসঙ্গে বসে খাবো, সেখানে আর কেউ থাকবে না, এমনি কি বয়-বেয়ারার উৎপাত পর্যন্ত না। তোমার যেটি ভালো লাগবে, আমি নিজের হাতে পাতে তুলে দেবো। প্ল্যানটা খুব অরিজিন্যাল, কি বল?

    নিশানাথ বোধ হয় একটু বেশি অভিভূত হয়ে পড়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারল না। রাজাবাহাদুরও সেজন্যে অপেক্ষা করলেন না। বললেন, কিন্তু গোড়াতে কাজটা যত সোজা বলে মনে করেছিলাম, এখন দেখছি তা মোটেই নয়। ধর এই পদার্থটি—কি এটা? বোধ হয় চিংড়িমাছের মালাইকারী—এটিকে পাতে ঢালতে গিয়ে ডিশখানা যদি একবার তোমার কোলের উপর উপুড় করে ফেলি, ব্যাপারটা কি রকম দাঁড়াবে বল দেখি?

    বলে হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর চেয়ারটা একটু টেনে গোছগাছ করে বসে নিয়ে বললেন, নাও এসো। আরম্ভ তো করা যাক। তারপর তোমার সিল্কের পাঞ্জাবির কপালে যদি চিংড়িমাছের ঝোল ভক্ষণ লেখা থাকে, কে খণ্ডাবে বল?

    খেতে খেতে যে-সব কথাবার্তা চলল—রাজাবাহাদুরই চালালেন—তার বিষয় হাল্কা এবং সুরটি অন্তরঙ্গ; তার ফলে লাহিড়ীর মধ্যে প্রথমে যেটুকু আড়ষ্টতা দেখা দিয়েছিল, কাটিয়ে উঠতে দেরি হল না। নানা প্রসঙ্গের পর কিসের একটা সূত্র ধরে রাজাবাহাদুর হঠাৎ বলে উঠলেন, তোমার কাছে আমার কিন্তু একটি প্রার্থনা আছে, নিশানাথ

    ‘প্রার্থনা!’ ডাক্তারের কাঁটা-চামচে যেন ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল।

    —হ্যাঁ, প্রার্থনাই বলবো। সে জিনিস আর কারও কাছে চাওয়া যায় না, আর কেউ তা দিতেও পারবে না।

    —এ শুধু আমাকে লজ্জা দেওয়া রাজাবাহাদুর। আপনার কোনো কাজে যদি কখনও লাগতে পারি নিজেকে ধন্য মনে করবো—এ কথাও কি আপনাকে বলে দিতে হবে? কিন্তু এমন কি জিনিস থাকতে পারে, যা আমি আপনাকে দিতে পারি, কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না।

    –তোমার কাছে তা অতি সাধারণ, কিন্তু আমার কাছে ভীষণ মূল্যবান।

    মুহূর্তকাল থেমে ডাক্তারের মুখের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন রাজাবাহাদুর। তারপর যোগ করলেন, আমাকে কিছুটা প্লেগের জার্ম যোগাড় করে দিতে হবে।

    লাহিড়ী কাঁটায় গেঁথে একটা কি মুখে তুলতে যাচ্ছিল, সবসুদ্ধ ডিশের উপর পড়ে গেল। বিস্ময়-বিমূঢ় চোখ দুটো রাজাবাহাদুরের মুখের উপর রেখে ভীতি-বিহ্বল চাপাগলায় তাঁরই কথাটা শুধু আউড়ে গেল— প্লেগের জার্ম!

    রাজাবাহাদুর সহজ সুরেই বললেন, আমার বিশেষ দরকার।

    —ও দিয়ে আপনি কি করবেন! প্রশ্ন নয়, আরেক দফা বিস্ময় প্রকাশ।

    রাজাবাহাদুর সজোরে হেসে উঠলেন। পরক্ষণেই কুঞ্চিত চোখে লাহিড়ীর দিকে চেয়ে বললেন, তুমি না একজন প্যাথলজিস্ট! হাজার রকম রোগের জীবাণু ঘাঁটাই তো তোমার কাজ! প্লেগের নাম শুনেই ভয় পেয়ে গেলে?

    কথাটা বোধ হয় জীবাণু-বিজ্ঞানীর অভিমানে আঘাত করল। সোজা হয়ে বসে আত্মপ্রত্যয়ের সুরে বলল, আজ্ঞে না, ভয় পাই নি। জিজ্ঞেস করছিলাম, ওরকম মারাত্মক জিনিস আপনার কি কাজে লাগবে?

    ‘মারাত্মক কাজেই লাগবে’—তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন রাজাবাহাদুর -সেটাও তোমাকে জানাবো বৈকি। কিন্তু তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না! আর দুটো পোলাও নাও! দাঁড়াও আমি দিচ্ছি।

    চামচে করে খানিকটা পোলাও ডাক্তারের প্লেটে তুলে দিতে দিতে বললেন, আব্দুল রাঁধে ভালো, ওর ঠাকুরদার বাবা নাকি জাহাঙ্গীর বাদশার খানা পাকাত। নূরজাহান খুশী হয়ে তাকে একটা সোনার মেডেল দিয়েছিলেন। সেটা অবিশ্যি নেই।

    নিশানাথের ভোজনস্পৃহা চলে গিয়েছিল। তবু পাছে দুর্বলতা ধরা পড়ে, তাই আপত্তি করল না। এটা-ওটা নিয়ে খানিকটা নাড়াচাড়াও করতে হল। এই ভাবান্তর রাজাবাহাদুরের নজরে পড়লেও তিনি আর ও নিয়ে কোনো কথাবার্তা বললেন না।

    ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল থেকে প্লেগ তখন বিদায় নিয়েছে। পুনরাক্রমণের সম্ভাবনাও নেই। সুতরাং কোনো ল্যাবরেটরীতে তার জীবাণু নিয়ে কারও গবেষণা করবার কথা নয়। করলেও লাহিড়ীর সে খবর জানা নেই। এই কথাই যে সে বলবে, রাজাবাহাদুর অনুমান করেছিলেন এবং তার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন। উত্তরে বললেন, এখানে সুবিধে হবে না তা জানি। তোমাকে একটু কষ্ট করে বাইরে যেতে হবে। বাইরে মানে বেশি দূরে নয়, দেশের মধ্যেই–

    বলেই পশ্চিমভারতের সেই প্রসিদ্ধ ইনস্টিটিউটের নাম করলেন। লাহিড়ী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ওরে বাপরে, ওখানে আমাকে ঢুকতে দেবে কেন?

    –দেবে না মানে? দেখবে?

    রাজাবাহাদুর উঠে গিয়ে পাশের কোনো একটা কামরায় ঢুকলেন। মিনিটখানেক পরে লোহার সিন্দুকের ভারী পাল্লা খোলার শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই একখানা খাম হাতে করে বেরিয়ে এসে ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে বললেন, পড়।

    খামের মুখটা খোলাই ছিল। ভিতরকার চিঠিখানায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ডাক্তার প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ওরা রাজী হয়ে গেছে! স্যার তো আমাকে এসব কিছুই বলেন নি?

    —বলবার সময় আসে নি বলেই বলেন নি। চিঠিটাও সবে দু-দিন হল পেয়েছি।

    লাহিড়ীর মুখে কথা সরলো না। আজ কার মুখ দেখে ভোর হয়েছিল? কে জানে আরও কত আশ্চর্য অপ্রত্যাশিত ঘটনা তার জন্যে সঞ্চিত হয়ে আছে? প্রতিটির মধ্যেই তার ভাগ্যলক্ষ্মীর ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। যা ছিল তার একান্ত অন্তরের অব্যক্ত কামনা মাত্র, এক অন্তর্যামী ছাড়া আর কেউ যার সন্ধান পায় নি, তিনিই অলক্ষ্যে বসে তার সফল রূপায়ণের সমস্ত আয়োজন করে রেখে দিয়েছেন! এ সুযোগ সে অবহেলা করবে না। তার গবেষণার বিষয় অবশ্য প্লেগ নয়, তবু একে অবলম্বন করেই যাত্রা শুরু করা যাক। অত বড় প্রতিষ্ঠানের সিংহদ্বার একবার যদি খোলা পাওয়া যায়, তার পথ সে নিজের শক্তিতেই করে নিতে পারবে, ততখানি আত্মবিশ্বাস তার আছে।

    রাজাবাহাদুরের কাজ নিয়ে যাবার সব চেয়ে বড় সুবিধা হল—এখানকার চাকরিটি বজায় থাকবে। অন্তত সে দাবী করা চলবে। তার নিজের প্রয়োজনে যদি যেতে হত, মুস্তাফির সুপারিশ পাওয়া গেলেও, তাতেও সন্দেহ ছিল—চাকরির আশা ছেড়ে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তার মানে যাওয়া হত না। এতবড় একটা সাফল্যের স্বপ্ন চিরদিন আকাশ-কুসুমই থেকে যেত। আজ তার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

    ডাক্তার যখন এইসব দিকগুলো ভেবে দেখছিল, রাজাবাহাদুর তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন। যখন দেখলেন, যেটুকু টোপ ফেলা হয়েছে ব্যর্থ হয় নি, তখন বাকীটুকু ফেলবার আয়োজন করলেন। বললেন, এদিকের জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি, ওখানে তোমার যত দিনই লাগুক, সবটাই পুরো মাইনের ছুটি বলে গণ্য হবে। মাসের ১লা তারিখে আমারই লোক গিয়ে টাকাটা তোমার বাবার হাতে পৌঁছে দিয়ে আসবে। তার ওপরে যদি কখনও কিছু দরকার হয়, আমাকে একটু জানালেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা করে দেবো। বৌমাকেও সেই কথা বলো। যে প্রয়োজনই হোক, জানাতে যেন কোনোরকম সঙ্কোচ না করেন।

    বলতে বলতে ভারী মুখের উপর একটা গাম্ভীর্যের ছায়া ঘনিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ মাটির দিকে নীরবে তাকিয়ে রইলেন। আবার যখন শুরু করলেন, গলাটাও ভারী শোনাল। তেমনি নতমুখেই বললেন, কোনোদিন মুখ ফুটে না বললেও একথা তুমি নিশ্চয়ই জানো নিশানাথ, তোমাকে আমি নিজের ভাই-এর থেকে আলাদা করে দেখি না। সে হতভাগাটা যেদিন সব ছেড়েছুড়ে বাউণ্ডুলে হয়ে বেরিয়ে গেল, এতবড় বংশের মানটুকু রাখল না, একটা বিয়ে-থা পর্যন্ত করল না, সেদিন থেকে আমার মন ভিতরে ভিতরে কাকে যেন খুঁজছিল। সে যে নিজে থেকে বাড়ি বয়ে এসে ধরা দেবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। তোমাকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যে আমার নিজেরই গরজ।……থাক সে-কথা। ও, আর একটা ছোট্ট কাজ বাকী রয়ে গেছে।

    বলে তখনই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। পাশের ঘরে আবার সেই লোহার সিন্দুক খোলা এবং বন্ধ করার আওয়াজ। যখন বেরিয়ে এলেন, হাতে একখানা বিশেষ আকৃতির কাগজ, ডাক্তারের সঙ্গে যার পরিচয় আরও অনেকবার ঘটে গেছে। এগিয়ে ধরে বললেন, এটা রেখে দাও।

    কাগজের অঙ্কটা চোখে পড়তেই লাহিড়ীর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল—পাঁচ হাজার টাকা! তবু হাত না বাড়িয়ে অনেকটা নিস্পৃহকণ্ঠে বলল, কি ওটা?

    রাজাবাহাদুর সরাসরি তার জবাব না দিয়ে বললেন, যে পরিমাণ ক্ষতি তোমার করিয়ে দিলাম, অর্থ দিয়ে তার পূরণ হয় না, সে চেষ্টাও আমি করছি না। এটা এমনিই—মনে কর, ব্রাহ্মণ-ভোজনের দক্ষিণা। আমার ঠাকুর্দা হলে হয়তো একটা গ্রাম দান করে বসতেন। সে তুলনায় এ তো কিছুই নয়। নাও।

    লাহিড়ী দু-হাত বাড়িয়ে চেকখানা গ্রহণ করল এবং নত হয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বলল, যে ভাবেই দিন, আপনার স্নেহের দানকে অস্বীকার করবো, সে স্পর্ধা আমার নেই। আপনার কাছে হাত পাতা আমার নতুন নয়। তার মধ্যে লজ্জারও কোনো কারণ দেখি না। লজ্জা পাচ্ছি অন্য কারণে। আপনি আমার ক্ষতি করিয়ে দিলেন, এমন কথাও আপনার মুখ থেকে আমাকে শুনতে হল!

    —ক্ষতি করছি না?

    —কোথায়, কেমন করে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

    রাজাবাহাদুর মৃদু হেসে হাল্কা সুরে বললেন, দ্যাখ ডাক্তার, তোমার ঐ ল্যাবরেটরীতে বসে দিনের পর দিন তুমি কি কর, কি আছে ঐ যন্ত্রগুলোর মধ্যে, সে সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান দূরে থাক, ধারণা করবার মতো বিদ্যেও আমার পেটে নেই, তা আমি জানি। আমি তো কোন্ ছার, অনেক মহা-মহা পণ্ডিতেরও নেই। কিন্তু তোমার ঐ সাধনার দামটা যে কত বড়, সেটুকু বুঝবার মতো বুদ্ধিও এ ঘটে নেই, একথা মনে করছ কেন?

    নিশানাথ ভীষণ অপ্রস্তুতে পড়ে গেল। দাঁতে জিভ কেটে বলল, ছিঃ ছিঃ, কি যে বলেন তার ঠিক নেই! আমি বুঝি তাই বলেছি? আপনি বড্ড—

    ডাক্তারের কথা শেষ হবার আগেই তাঁর মৃদু কণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে বেজে উঠল সুগম্ভীর স্বর—নিছক নিজের স্বার্থে সেই সাধনাপীঠ থেকে অন্তত কিছুদিনের জন্যে তোমাকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, সে লোকসানের কি তুলনা আছে?

    –এখানে আপনার ভুল হল, রাজাবাহাদুর। লোকসান তো নয়ই, রিসার্চের দিক থেকে আমি অনেকখানি লাভবান হলাম। এত বড় সুযোগ ক’জনের ভাগ্যে জোটে? কিন্তু এর মধ্যে আপনার নিজের স্বার্থটা কী এখনও জানতে পারি নি!

    —আজ থাক, সে কথা আরেকদিন বলবো।

    সে ‘আরেকদিন’ ক’দিনের মধ্যেই এসে গেল। নিজের প্রাসাদে নয়, নিশানাথের ল্যাবরেটরীর নিভৃতকক্ষে বসে নিতান্ত সহজ সুরে রাজাবাহাদুর তাঁর এই বিচিত্র অভিযানের গোপন উদ্দেশ্যটি ব্যক্ত করলেন। সেটি যে মারাত্মক’, সে আভাস তিনি আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। ডাক্তার তার জন্যে নিশ্চয়ই প্রস্তুত ছিল। মনে মনে তার একটা কল্পিত রূপও দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। শুনবার পর মনে হল, তার কল্পনাশক্তি কত দীন! আরও মনে হল, ভাষাকে যে ভাবপ্রকাশের বাহন বলা হয়, তার মধ্যে কোনো সত্য নেই, আসলে সে অনেক পিছনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে। সংগৃহীত কীটাণুগুলোকে যে কাজে এবং যে ভাবে নিয়োগ করা হবে, ‘মারাত্মক’ নামক নিরীহ বিশেষণ দিয়ে তার শতাংশের এক অংশও ব্যক্ত করা যায় না। তাকে পুরোপুরি প্রকাশ করবার মতো যোগ্য বিশেষণ এখনও তৈরী হয় নি।

    তারা দুজন ছাড়া সেখানে আর কেউ উপস্থিত ছিল না। ছিল কতকগুলো যন্ত্র। নিশানাথ সভয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, যেন যে-কোনো মুহূর্তে তারা সরবে প্রতিবাদ করে উঠবে। তারপর মনে পড়েছিল ওরা নিষ্প্রাণ, জড়পদার্থ। কিন্তু সে নিজে তো জড় নয়, পরিপূর্ণ চেতনাসম্পন্ন মানুষ। তবু প্রতিবাদ করতে পেরেছিল কি? পারে নি। তার ভিতর থেকে একজন সবেগে মাথা তুলে দাঁড়ালেও, আরেকজন এগিয়ে গিয়ে তার গলা টিপে ধরেছিল। প্রথমটার চেয়ে দ্বিতীয়টি অনেক বেশি শক্তিমান।

    একবার মনে হয়েছিল সে ডাক্তার, মানুষের কল্যাণ তার ব্রত, তার একমাত্র লক্ষ্য মানুষকে ব্যাধিমুক্ত করা, জরা ও মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা। তারই জন্য তার এই দুস্তর সাধনা, এই বিপুল আয়োজন। সে আদর্শ থেকে স্খলিত হলে আর রইল কি? পরক্ষণেই সমস্ত মন আচ্ছন্ন করে জেগে উঠল লোভ—অর্থ, খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠার লালসা। বড় হতে হবে, নৈতিক আদর্শকে আঁকড়ে ধরে একটা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে হাত পা ছুঁড়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকবার জন্যে তার জন্ম হয় নি। প্রচলিত ভালোমন্দ, ন্যায়- অন্যায় এবং পাপ-পুণ্যের সংস্কার দিয়ে তৈরি যে বন্ধন, তার পাশ কেটে তাকে বেরিয়ে যেতে হবে। তার নির্ধারিত ভবিষ্যৎ সেই দিকেই তাকে টেনে নিয়ে চলেছে।

    তা যদি না হবে, কোথাকার কোন্ নিশানাথ লাহিড়ী, মেডিক্যাল কলেজের দরজা পেরোতেই যে হিমশিম খেয়ে মরছিল, দু’শ টাকা মাইনের একটা চাকরি পেলেই যে বর্তে যেত, তার জীবনে কোথা থেকে কেমন করে দেখা দিল স্বপ্নাতীত সুযোগ ও সাফল্যের ধারাবর্ষণ? এই অব্যাহত অগ্রগতির পিছনে নিশ্চয়ই কোনো অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত আছে, কোনো অলক্ষ্য বিধান, যা তাকে মেনে চলতেই হবে। এই তার ভাগ্যবিধাতার অভিপ্রায়।

    মানুষের অন্তরে ‘অ্যাম্বিশন’ নামক পদার্থটি (‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ বলা যেত কিন্তু ইংরেজির তুলনায় শব্দটি বড় নিষ্প্রভ) অগ্নিশিখার মতো ঊর্ধ্বগতি। একবার জ্বলে উঠলে নিজের শক্তিতেই বেড়ে চলে এবং চলতে চলতে পথের দু-ধারে যা কিছু পায়,—চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনা, দ্বিধা-সংস্কারের বাধা-বন্ধন—সব জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। নিশানাথের মনের মধ্যে যখন সেই প্রক্রিয়া চলছিল, রাজাবাহাদুর তার সঙ্গে কিঞ্চিত ইন্ধন যোগ করলেন। বললেন, এটা যে সাধারণ লোকের কাজ নয় তা আমি জানি। তাদের কাছে এর নৈতিক আর আইনের দিকটাই বড় হয়ে দেখা দেবে। তার বাইরে তাদের দৃষ্টি পৌঁছায় না। কিন্তু আমি তো তেমন কারও কাছে আসি নি। যার কাছে এসেছি, সে সাধারণ স্তরের অনেক ওপরে এবং তার চেয়ে বড় কথা, সে বৈজ্ঞানিক। আমার এই সঙ্কল্পকে সে বিজ্ঞানের নিরপেক্ষ দৃষ্টি দিয়ে দেখবে, সে বিশ্বাস আছে বলেই সবকিছু তাকে বলতে পেরেছি। তা না হলে এ-সব তো কাউকে বলবার নয়।

    কোনো রকম দ্বিধা যদি লাহিড়ীর মনে তখনও থেকে থাকে, এর পরে তার লেশমাত্র রইল না। উত্তুঙ্গ উচ্চাশার কাছে হার হল শুভবুদ্ধির।

    দু-সপ্তাহের মধ্যেই পশ্চিমাঞ্চলের সেই বিশেষ শহরের উদ্দেশে রওনা হল নিশানাথ লাহিড়ী। ভারতবর্ষের মধ্যে ওখানকার ইন্‌স্টিটিউটই তখন একমাত্র গবেষণাগার যেখানে প্লেগের বীজাণু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছিল। মুষ্টিমেয় বিশ্বস্ত, অভিজ্ঞ এবং কৃতী গবেষক সেখানে কাজ করছিলেন। অত্যন্ত জোরালো এবং বিশেষ বিশেষ সুপারিশ ছাড়া ডিরেক্টর কাউকে গ্রহণ করতেন না। সেই গোপন গণ্ডির মধ্যে তার প্রিয়তম ছাত্রের জন্যে একটি স্থান সংগ্রহ করা ডাক্তার মুস্তাফির মতো ভারত-বিখ্যাত চিকিৎসাবিদের পক্ষেও সহজ হয় নি। বহু চেষ্টার ফলেই শেষ পর্যন্ত সেটা সম্ভব হয়েছিল। নিশানাথের প্রতিভার উপর তাঁর গভীর আস্থা ছিল এবং সেটা যে অপাত্রে ন্যস্ত হয় নি, তার প্রমাণ কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া গেল। ডিরেক্টরকে খুশী করতে লাহিড়ীর বিশেষ বেগ পেতে হয় নি।

    রাজাবাহাদুরের পিতার যখন মৃত্যু হয়, ছোটকুমার তখন শিশু। তার কয়েক বছর পরে রাণীমাও স্বামীর অনুসরণ করলেন। প্রাচীন রাজবংশের ঐতিহ্য অনুসারে রাজাবাহাদুর তার কিছুদিন আগে একটি সুন্দরী কিশোরীর পাণিগ্রহণ করেছেন। বধূ নির্বাচন রাণীমাই করেছিলেন। তেমন কোনো বড় ঘরের মেয়ে নয়। একমাত্র রূপের জোরেই এখানে তার প্রবেশাধিকার। রূপের সঙ্গে ঐশ্বর্যের মিলন ঘটলে তার মধ্যে যে উগ্র জলুস বা তীব্র চমক ফুটে ওঠে, এ মেয়েটির তা ছিল না। তার শান্ত মুখশ্রী, স্নিগ্ধোজ্জ্বল শ্যামকান্তি এবং বিনম্র পেলব দেহসৌষ্ঠবের মধ্যে একটি মধুর কমনীয়তা ছিল। সম্ভবত সেইটিই রাণীমাকে আকৃষ্ট করে থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি আত্মীয় পরিজন আশ্রিত অমাত্য, কারোরই বিশেষ সমর্থন পান নি। নববধূ প্রাসাদে পা দিয়েই সেটা জানতে পেরেছিল। স্বামীর কাছ থেকে বাক্যে বা আচরণে বিশেষ কোনো রূঢ়তা বা অনাদর না পেলেও, তিনিও যে ঐ দলভুক্ত একথাও তার বুঝতে বাকী ছিল না। তার ফলে তার মনে প্রথম থেকেই কেমন একটা অপরাধীসুলভ সঙ্কোচ গড়ে উঠেছিল। দীর্ঘদিন ঘর করবার পরেও সে মনোভাব সে কাটিয়ে উঠতে পারে নি। স্বামী-স্ত্রীর মাঝখানে একটা অলক্ষ্য দূরত্ব বরাবর রয়ে গেছে।

    ছোটকুমারের প্রকৃতি ছিল তার জ্যেষ্ঠের ঠিক বিপরীত। ঐশ্বর্যলিপ্সা কিংবা আভিজাত্য-গৌরব তাকে কোনদিন আকর্ষণ করে নি। রাজপ্রাসাদের বিলাস-বহুল জীবনযাত্রার অসংখ্য প্রলোভন থেকে নিজের মনটাকে মুক্ত রাখবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা বিধাতা তাকে বোধহয় মাতৃগর্ভ থেকেই দিয়েছিলেন। শিশুকাল থেকে সেখানকার সব কিছুর উপর তার নীরব ঔদাসীন্য ভৃত্যমহলেও আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নববধূ এসে যখন দেখল, এত বড় প্রাসাদের কোনো মহলে তার জন্যে সস্নেহ অভ্যর্থনার প্রসন্নদৃষ্টি নিয়ে কেউ অপেক্ষা করে নেই, তখন সকলের চেয়ে আলাদা এই কিশোর দেওরটির প্রতিই একটি অলক্ষ্য আকর্ষণ অনুভব করে থাকবে। সে নিজেও তখন কিশোরী। কৈশোরের স্বাভাবিক ধর্মও তাদের নিকটতর করবার সুযোগ দিয়েছে। কালক্রমে বৌরাণী এবং ছোটকুমারের মধ্যে যে প্রগাঢ় সখ্যবন্ধন গড়ে উঠেছিল, এইখানেই তার সূত্রপাত।

    রাণীমার মৃত্যুর পর সে বন্ধন দৃঢ়তর হল। বৌরাণীও তাঁর এই আত্মভোলা, উদাসীন দেওরটির মাতৃস্থানও অধিকার করলেন। বন্ধুত্ব ও মাতৃত্বের সে এক বিচিত্র সংযোগ। কিন্তু তার মিলিত শক্তিও এই সৃষ্টিছাড়া মানুষটিকে বেঁধে রাখতে পারল না। স্নেহ, প্রীতি, ঐশ্বর্য, বংশমর্যাদা—সব বন্ধন অনায়াসে ছিন্ন করে ছোটকুমার যেদিন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এল, কিছুতেই তাকে নিরস্ত করা গেল না। বৌরাণী সেদিন একটি কথা বলেন নি, একফোঁটা চোখের জলও তাঁকে কেউ ফেলতে দেখে নি। আত্মীয়-পরিজনেরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ভৃত্য ও আশ্রিতমহলে কানাকানি পড়ে গিয়েছিল—দেওরের ওপর কত যে দরদ, এইবার সব বোঝা গেছে! কেউ বলেছিল—সব কিছু যে লিখে-পড়ে দিয়ে গেল ছেলেটা! আজ তো ওর সুখের দিন, কাঁদতে যাবে কোন্ দুঃখে?

    সেইদিন থেকে বৌরাণীর মুখে ছোটকুমারের কোনো উল্লেখ একবারও শোনা যায় নি। যেন কিছুই হয় নি, এমনিভাবে সব কিছুর মধ্যে নিজেকে তিনি আরও নিবিড়ভাবে নিবিষ্ট করে দিয়েছিলেন। আগে মাঝে মাঝে বাইরে যেতেন, তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শুধু কাজ আর কাজ, বিশ্রামহীন নিরলস ব্যস্ততা। যে দেখেছে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে। শুধু রাজাবাহাদুর বুঝেছিলেন, এ কর্মশক্তি সবটাই যান্ত্রিক, ভিতরে কোনো প্রাণের প্রেরণা নেই। একজনের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে তার সবটাই বোধ হয় নিঃশেষ হয়ে গেছে।

    এক অনেকদিন পরে ভাই-এর কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, লোকে জানে, আমাকে সে তার সর্বস্ব দিয়ে গেছে। কি নিয়ে গেছে, সে খবর কেউ রাখে না। সে কথা শুধু আমিই জানি।

    সেই যে একদিন পিতৃ-পিতামহের প্রাসাদতোরণ পিছনে ফেলে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এসেছিল, তারপর আর একদিনের তরেও ছোটকুমার সেদিকে ফিরে তাকায় নি। ডাক এসেছে অনেকবার। প্রতিবারেই মৃদু হেসে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে। রাজাবাহাদুর এসেছেন, এ গলিতে তাঁর গাড়ি ঢোকে না—বড় রাস্তার মোড় থেকে গলিপথটুকু হেঁটে পার হয়ে, অতিকষ্টে সরু সিঁড়ি বেয়ে, কোনো রকমে উঠেছেন এসে দোতলার অপ্রশস্ত বসবার ঘরে। অনুযোগ দিয়েছেন, অভিমান প্রকাশ করেছেন, কখনও সস্নেহ আবেদন জানিয়ে দু-দিনের জন্যে একবারটি ঘুরে আসবার অনুরোধ করেছেন। একটি কুণ্ঠাপূর্ণ বিনীত হাসি ছাড়া আর কোনো উত্তর পান নি। কখনও বৌরাণীর নাম করে বলেছেন, তোকে একবার দেখতে চেয়েছে, বলেছে, যেমন করে পার ধরে নিয়ে এসো।

    এবার জবাব দিয়েছে ছোটকুমার—তাঁকে আমার প্রণাম জানিয়ে বলবেন, সময় হবে না।

    —কি রাজকাজে ব্যস্ত আছ যে সময় হবে না? তেড়ে উঠেছেন রাজাবাহাদুর। এ প্রশ্নের আর উত্তর আসে নি।

    প্রথমদিকে তাঁর আসাটা ছিল ঘন ঘন। ভাইকে বাড়ি নিতে পারুন আর না পারুন, একবার করে দেখে গেছেন। ক্রমশ তার ব্যবধান বেড়ে গেছে। ইদানীং কয়েক বছর তাঁর দেখা পাওয়া যায় নি। ম্যানেজার বা অন্য কোন আমলা পাঠিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তারপর সেটাও বিরল হয়ে এসেছে।

    অনেকদিন পরে সকালের দিকে ছোটকুমারের বাড়ির সামনে মোটর থামবার শব্দ শোনা গেল। তার কাছে যারা আসে, (বড় একটা কেউ আসে না) কারও গাড়ি নেই। গঙ্গাচরণের কৌতূহল হল। বারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়ে একপলক তাকিয়েই ছুটে গেল মনিবের কাছে। ছোটকুমার তখন পড়বার ঘরে। গঙ্গাকে ব্যস্তভাবে ঢুকতে দেখে চোখ তুলতেই সে ফিসফিস করে বলল, রাজাবাহাদুর! বলেই নীচে নেমে গেল দরজা খুলতে।

    এত ছোট গাড়িতে রাজাবাহাদুরকে কখনও চড়তে দেখা যায় নি। বেশ কষ্ট হচ্ছিল নামতে। ড্রাইভারের সঙ্গে গঙ্গাচরণকে এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করতে হল। আগের চেয়ে অনেকটা কাহিলও হয়ে পড়েছেন। কুমার আছে কিনা জেনে নিয়ে গঙ্গার কাঁধে হাত দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন।…

    বারান্দায় পড়তেই ছোটকুমার অগ্রজের বাহু ধরে বসবার ঘরের দিকে নিয়ে চলল। যেতে যেতে অনুযোগের সুরে বলল, এতটা শরীর খারাপ, একটা খবরও তো দেন নি?

    —কাকে খবর দেবো? তোমাকে? ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন রাজাবাহাদুর, কি লাভ হত?

    ছোটকুমার যেমন মাথা নীচু করে চলছিল, তেমনিভাবে চুপ করে রইল।

    রাজাবাহাদুর সঙ্গে সঙ্গে সুর বদলে নিলেন। ঘরে ঢুকে সামনে যে কৌচটা পেলেন, তার উপর বসে পড়ে প্রসন্নমুখে বললেন, খুব রোগা হয়ে গেছি, না? ওটা কিছু না। শরীর আমার ভালোই আছে। খানিকটা চর্বি ঝরে গিয়ে বরং উপকারই হয়েছে। কিন্তু—কয়েক সেকেণ্ড থেমে ভাইয়ের মুখের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে যোগ করলেন, তোকে তো তেমন ভালো দেখছি না। রাজ জেগে খুব-ই পড়াশুনো হচ্ছে? দেখবার তো কেউ নেই— আচ্ছা, আমিও পরোয়ানা নিয়ে এসেছি।

    পকেট থেকে একখানা খাম বের করে হাত বাড়িয়ে বললেন, এই নাও।

    —কি ওটা?

    —পড়েই দ্যাখ।

    ছোটকুমার খামটা খুলে চিঠিখানায় একবার চোখ বুলিয়েই শুষ্ক-মুখে বলল, কি হয়েছে বৌরাণীর?

    —কি করে জানবো? মুখ ফুটে কিছু বললে তো? দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, জিজ্ঞেস করলে সেই এক কথা—কিছু হয় নি আমার। কত করে বললাম, একবার কোলকাতায় চল। মুস্তাফির মতো অতবড় ডাক্তার রয়েছে হাতের মধ্যে, দরকার হলে আরও বড় কাউকে দেখানো যেতে পারে। কিছুতেই রাজী হল না। কাল যখন কোলকাতায় ফিরছিলাম, ঐ চিঠিখানা দিয়ে বলল, ঠাকুরপোকে দিও, আর একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে এসো।

    হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ব্যস্তভাবে বললেন, ট্রেনের সময় হয়ে এল, যা, জামা- কাপড়টা বদলে আয়। গঙ্গা….

    গঙ্গাচরণ পাশের কোনো ঘর থেকে সাড়া দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে জোড়হাত করে দাঁড়াল। রাজাবাহাদুর হুকুম দিলেন, একটা স্যুটকেসে ‘ছোট’র জিনিসপত্তরগুলো গুছিয়ে দে, দেরি করিস নে।

    ছোটভাইকে নাম ধরে বড় একটা ডাকতেন না। অন্যের কাছে উল্লেখ করবার বেলায় বলতেন ছোটকুমার, ডাকবার সময় তাকেই একটা সাদর ও সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়েছিলেন—‘ছোট’।

    ছোটকুমার চিঠিখানা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ কি ভাবল। তারপর মুখ তুলে বলল, আজ তো আমার যাওয়া হবে না।

    —কেন?

    —একটা বিশেষ কাজ আছে।

    —কি কাজ?

    —যাঁর কাছে ফ্রেঞ্চ শিখি, তাঁর আজ আসবার দিন। সন্ধ্যাবেলায় আসবেন।

    —কি শিখিস?

    —ফ্রেঞ্চ, ফরাসীভাষা।

    —তা দিয়ে কি হবে?

    কুমার মৃদু হেসে চুপ করে রইল। রাজাবাহাদুর বললেন, যত সব উদ্ভট খেয়াল! কোন্ দেশের লোক তিনি?

    —ইংরেজ।

    বেশ তো, একটা চিঠি লিখে রাখ—বিশেষ জরুরী কাজে বাড়ি যাচ্ছি। উনি এলে গঙ্গা সেটা দিয়ে দেবে।

    —তা হয় না, আমি বরং কাল যাবো। আপনাকে আসতে হবে না।

    —যাবে তো?

    কুমার একটু হাসল।

    রাজাবাহাদুর উঠে পড়ে বললেন, দেখো, তা না হলে আমাকে আবার ছুটতে হবে। ন’টা পঁচিশে ট্রেন। আমিও যাচ্ছি। টিকিট করে রাখবো। তাহলে অন্তত মিনিট পনেরো সময় হাতে রেখে যেও, ঠিক আটটায় এখানে গাড়ি আসবে।

    —গাড়ি লাগবে না।

    —কেন? অস্টিন্‌টা বেশ আসতে পারবে, আমি তো তাতে করেই এলাম। ছোটকুমার মাথা নেড়ে বলল, দরকার নেই। এখান থেকেই একটা ট্যক্সি নিয়ে নেবো।

    নিজের অজ্ঞাতসারেই রাজাবাহাদুরের কপালে কুঞ্চন দেখা দিল। রাজপরিবারের কেউ কোনোদিন ট্যাক্সিতে ওঠে না, তবু এ নিয়ে আর পীড়াপীড়ি করলেন না। বুঝলেন, এ ‘না’-কে ‘হ্যাঁ’ করানো যাবে না।

    রাজাবাহাদুরকে গাড়িতে তুলে দিয়ে ছোটকুমার ধীরে ধীরে সিঁড়ি ক’টা পেরিয়ে তার লাইব্রেরির কামরায় ফিরে গেল। কিছুক্ষণ আগে যে বইখানা পড়ছিল এবং খোলা রেখেই পাশের ঘরে চলে গিয়েছিল, সেটা তেমনি পড়ে রইল। পড়বার টেবিলে আর ফিরে যাওয়া হল না। কোণের দিকে একটা ইজিচেয়ার ছিল, তারই কোলে নিজেকে এলিয়ে দিল। মিনিট কয়েক পরে জামার পকেট থেকে বেরিয়ে এল একখানা ধার ছেঁড়া খাম, যার ভিতরকার বস্তুটির সঙ্গে এইমাত্র তার চাক্ষুষ পরিচয় ঘটে গেছে, তবু সেই ছোট্ট কাগজখানারই ভাঁজ খুলে আরেকবার তুলে ধরল চোখের উপর।

    গোটা গোটা অক্ষরে লেখা কয়েকটি মাত্র লাইন—

    কল্যাণীয়েসু,

    ঠাকুরপো,

    কিছুদিন যাবৎ আমার শরীরটা বিশেষ ভালো যাইতেছে না। তোমাকে একবারটি দেখিতে ইচ্ছা করে। যত শীঘ্র হয়, অবশ্য অবশ্য আসিও।

    ইতি-
    আশীর্বাদিকা
    তোমার বৌরাণী

    আনমনে ধীরে ধীরে চিঠিখানা আবার ভাঁজ করে মুঠোর মধ্যে রেখে তেমনি অসাড়ের মতো অনেকক্ষণ পড়ে রইল ছোটকুমার। বৌরাণীর চিঠি। বৌরাণী তাকে ডাকছে! কত বছর পরে। কিন্তু এ কথা-ক’টির মধ্যে তাকে যেন কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ‘ঠাকুরপো’ সম্বোধনটি কানে বড় নতুন ঠেকছে। এ বাড়িতে আসবার পর প্রথম প্রথম কয়েকদিন মাত্র ঐ নামে তাকে ডাকতে শুনেছিল, তারপর আর শোনে নি। হঠাৎ একদিন দাদার মতো ‘ছোট’ বলতে শুরু করল। তারপর কবে, কেমন করে মধুরতর রূপান্তর লাভ করে সেই ডাক ক্রমশ ‘ছোটু’তে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, আজ আর মনে করতে পারে না। কেমন একটা আশ্চর্য তার ছিল সেই মিষ্টি-কণ্ঠের এই ছোটু কথাটুকুর মধ্যে, আজও দু-কান ভরে আছে। চিঠি যদি এল, তার উপরে ঐ সম্ভাষণটুকু জুড়ে দিলে কি ক্ষতি হত? একবার মনে হল, ঐ দুটি অক্ষরের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক একদিন জড়িয়ে ছিল, আজ তার অবসান ঘটেছে বলেই ওদের প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে। হয়তো ইঙ্গিতে সেই কথাটিই বলতে চলেছে বৌরাণী।

    তাই যদি হয়, তবে আর গিয়ে কি লাভ? যেখানে যা কিছু বন্ধন, সবই তো একদিন নিজে হাতে ছিন্ন করে চলে এসেছিল। ঐ একটি জায়গায় শুধু পারে নি। একটা অলক্ষ্য সূত্র রয়ে গেছে। ক্ষীণ হলেও তার ধার বড় তীক্ষ্ণ। অগোচরে থেকেও নিজের বেদনাময় অস্তিত্ব কোনদিন ভুলতে দেয় নি। আজ যদি তার একটা দিক কালক্রমে কিংবা অন্য কোনো কারণে বিলীন হয়ে গিয়ে থাকে, আর এক দিক থেকে সেই ছিন্ন সূত্রে জোড়া দিতে যাওয়া নিরর্থক।

    সহসা আবার হাতের চিঠিখানার দিকে নজর পড়তেই ছোটকুমারের সমস্ত চিন্তাস্রোত ঐ একটি ধারায় গিয়ে মিলিত হল। সমস্ত ক্ষোভ অভিমান ছাপিয়ে উঠল একটিমাত্র দুর্ভাবনা—কি অসুখ বৌরাণীর? কি জানি কেমন আছে?

    অকস্মাৎ কে যেন তাকে সজোরে ঠেলে তুলে দিল। কাল ন’টা পঁচিশে গাড়ি। তার আগে অনেকগুলো কাজ সেরে নিতে হবে।

    যে-ভাষায়, যেমন করেই আসুক, বৌরাণীর রোগশয্যার ডাক তার কাছে অলঙ্ঘ্য—এই পরম সত্যটাই সবকিছু ছাপিয়ে ছোটকুমারের অন্তরের মধ্যে প্রতিভাসিত হল।

    ন’টা পঁচিশের গাড়িটা দূরপাল্লার যাত্রী। বরাবরই বেশ ভিড় থাকে। তাছাড়া তার মিনিট দশেক আগে ঠিক পাশেই একখানা লোক্যাল এসে দাঁড়ায় এবং তার গহ্বর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসে একপাল ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান ডেলিপ্যাসেঞ্জার। এই দুটো বিপরীতমুখী স্রোতের সংঘাতে মাঝখানের প্লাটফরমে যে ঘূর্ণাবর্ত দেখা দেয়, তার ভিতর থেকে নিজের দেহটাকে উদ্ধার করে গাড়ির কামরায় পৌঁছে দেওয়া শক্তির প্রয়োজন।

    ছোটকুমার যখন সেই সুকঠিন শক্তিপরীক্ষায় নাজেহাল হবার উপক্রম, হঠাৎ মনে হল কে যেন তার পিছন থেকে ঘাড়ের ঠিক নীচে একটা সূচ ফুটিয়ে দিলে। ‘উঃ’ বলে তৎক্ষণাৎ ফিরে তাকাল, কিন্তু সেই জনারণ্যের ভিতরে এমন কোনো লোককে চোখে পড়ল না, যাকে এই বিশেষ কর্মটির সঙ্গে জড়িত করা যেতে পারে। ব্যাপারটাকে মনে মনে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল, কার এমন কি গরজ পড়ল খামকা তার গায়ে সূচ ফোটাবার? পিন-জাতীয় কিছু একটা কারও হাতে থেকে থাকবে হয়তো, ভিড়ের ধাক্কায় হঠাৎ লেগে গেছে।

    আহত স্থানটায় তখন রীতিমত জ্বালা করছে। গাড়িতে উঠে দেখতে হবে কি ব্যাপার, এই কথা ভেবে সেই দিকেই পা বাড়াতে যাবে, এমন সময় চোখে পড়ল গঙ্গাচরণ ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছে। চোখে মুখে ব্যস্ততার চিহ্ন। তাকে দেখে কুমারের মুখেও চিন্তার ছায়া পড়ল। গঙ্গার তো তার সঙ্গে যাবার কথা নয়! কাছে আসতেই জানতে চাইল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

    গঙ্গাচরণ একখানা খাম এগিয়ে ধরে চাপাগলায় বলল, বিধু এসে দিয়ে গেল। বৌরাণীর চিঠি। বলল, খুব জরুরী খবর আছে এর মধ্যে। আর বলেছে, এ চিঠির কথা রাজাবাহাদুর যেন জানতে না পারে।

    ভিড়ের মুখ থেকে একটুখানি সরে গিয়ে তাড়াতাড়ি খামের ধারটা ছিঁড়ে ফেলল ছোটকুমার। আগের মতো এ চিঠিখানাও সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সুর একেবারে আলাদা।

    ভাই ছোটটু,

    এর আগে যে-চিঠিটা পেয়েছ, তার অক্ষরগুলো আমার, কিন্তু কথা আমার নয়। তবু লিখতে হয়েছিল। কেন, তা জিজ্ঞেস করো না। সে চিঠিতে তোমাকে আসতে বলেছিলাম। এবার বলছি, এসো না। বলতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। কতকাল তোমাকে দেখিনি, তবু বলছি, আমার মাথা খাও, তুমি এসো না।

    বৌরাণীর নাম সুষমা, তারই আদ্যক্ষর সু।

    ইতি সু—।

    সমস্ত চিঠিখানার মধ্যে যে শঙ্কা ও সংশয় ঘেরা গূঢ়রহস্য জড়িয়ে আছে, এই ছোট্ট অক্ষরটিও যেন তার থেকে মুক্ত নয়। ছোটকুমার বিস্ময়বিহ্বল দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর চিঠিটা মুড়ে যখন খামে ভরতে যাবে, গঙ্গাচরণ চেঁচিয়ে উঠল, এ কি! তোমার জামার পিঠে রক্ত কিসের? লোকটা কি তাহলে কিছু একটা ফুটিয়ে দিয়ে গেল?

    —কোন্ লোকটা! চমকে উঠল ছোটকুমার।

    —ঢ্যাঙা কালো মতন একটা লোক। যা ভিড়, পাছে হারিয়ে ফেলি, তাই ঐখান থেকে আমি ঠায় তোমার দিকে নজর রেখেছি। মনে হল, সেই লোকটা যেন ডান হাতটা তুলে তোমার ঘাড়ের ওপর গিয়ে পড়ল। তারপর আর দেখতে পেলাম না।

    কুমার কি একটা বলতে যাচ্ছিল, থেমে গেল—ঠিক পিছনেই রাজাবাহাদুরের কণ্ঠস্বর—কি হল, এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? এখনই যে গাড়ি ছেড়ে দেবে!

    —আপনি উঠে পড়ুন, আমি যাই।

    —কোথায় যাবি?

    —বাসায়।

    –কেন?

    গঙ্গাচরণ বলে উঠল, এইমাত্তর কে একটা লোক ওর পিঠে কি যেন ফুটিয়ে দিয়ে গেল, রক্ত বেরুচ্ছে।

    রাজাবাহাদুর চিন্তিত মুখে উদ্বেগের সুরে বললেন, সে কি! কই দেখি!

    জামার পিছনটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গঙ্গার দিকে চেয়ে বললেন, তুই দেখেছিস লোকটাকে?

    —আজ্ঞে ঠিক ঠাহর করে দেখিনি, দূর থেকে মনে হল যেন—

    —মনে হল! গাঁজার দমটা বোধহয় একটু বেশি হয়ে গেছে!

    কুমারের দিকে ফিরে বললেন, ও কিছু না। পোকায়-টোকায় কামড়েছে মনে হচ্ছে। গাড়িতে চল্–জামাটা খুললেই বোঝা যাবে কি হয়েছে। আমার ব্যাগে আইডিন আছে, লাগিয়ে দিলেই সেরে যাবে। ঐ লাস্ট্ বেল পড়ে গেল, আর মোটে পাঁচ মিনিট আছে গাড়ি ছাড়তে।

    —আজ ইচ্ছে করছে না, আরেক দিন যাবো।

    —তোরও কি গঙ্গার ঐ গাঁজাখুরি গল্প শুনে মন খারাপ হয়ে গেল?

    —না তা নয়। শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছে না।

    —তাই নাকি? সঙ্গে সঙ্গে সুর বদলে গেল রাজাবাহাদুরের, তাহলে আর গিয়ে কাজ নেই! সোজা ভবানীপুরের বাড়িতে চল। ওখানে তো এক গঙ্গা ভরসা।

    —এখন থাক, পরে, যদি দরকার হয় যাবো।

    বলেই ছোটকুমার ফিরে যাবার জন্যে পা বাড়ালো। রাজাবাহাদুর পিছন থেকে বললেন, আমিও তাহলে থেকে গেলাম। কেমন থাকিস, কাল সকালেই যেন একটা খবর পাই। দরকার হলে মুস্তাফিকে একবার দেখিয়ে দেওয়া যাবে।

    .

    সেদিন যদি মুস্তাফিসাহেবের দেখা পাওয়া যেত, ঘটনার গতি চলে যেত অন্য পথে। এ কাহিনীর পরিণতি শুধু ভিন্ন নয়, নিকটতর হত। ব্যস্ত পাঠকদের অনেকখানি সময় বাঁচত। এইখানে ট্রামের টিকেট কিংবা ছেঁড়া হ্যাণ্ডবিল গুঁজে দিয়ে আর একটা ‘সিটিং’-এর জন্যে অপেক্ষা করতে হতো না। গোটা কয়েক পাতা কোনো রকমে এগিয়ে গিয়ে এ ঝঞ্ঝাট চুকিয়ে ফেলে অন্য বই ধরতে পারতেন। সংসারের নানা কর্মে রত যেসব ক্লান্ত পাঠিকা গল্প-উপন্যাসকে নিদ্রাকর্ষণের টনিক হিসাবে ব্যবহার করে থাকেন, তাঁদেরও এই পর্যন্ত এসে পাতা মুড়ে রেখে পাশ ফিরে শোবার দরকার হত না। ঘনায়মান তন্দ্রার দোলায় দুলতে দুলতেই যবনিকায় পৌঁছে যেতেন।

    কিন্তু অলক্ষ্যে বসে যে বিশ্ববিধান-রচয়িতা বুদ্ধিগর্বিত মানুষের বহু-যত্ন-রচিত পরিকল্পনা একটিমাত্র অঙ্গুলিহেলনে ওলট-পালট করে দেন, তাঁর অভিপ্রায় ছিল অন্যরূপ। তাই ডাক্তার মুস্তাফিকে পাওয়া গেল না।

    রাজাবাহাদুর মনে মনে তাঁর প্রত্যাশিত ঘটনাগুলোকে পর পর সাজিয়ে রেখেছিলেন, এবং কার কোথায় কখন কি প্রয়োজন হবে, সব সেই অনুসারে স্থির করা ছিল। স্ত্রীকে চাপ দিয়ে চিঠি লেখানো, সেখানা হাতে করে ছোট গাড়ি নিয়ে একটা বিশেষ সময়ে ভাই-এর বাসায় গিয়ে ওঠা, নানা অভিনয়ের জাল ফেলে তখনই তাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা, সে চেষ্টা ব্যর্থ হলে অন্য দিন-নির্বাচন, তার সঙ্গে একটি বিশেষ ট্রেনের সাহায্য গ্রহণ—সবই তাঁর পূর্ব-পরিকল্পিত। তার মধ্যে ঐ ন’টা পঁচিশের গাড়ির ভূমিকাও কিছুমাত্র অপ্রধান ছিল না। ঐরকম ভিড়ের আড়াল না পেলে যত পাকা হাতই হোক এবং যত কম সময়ই লাগুক, সকলের অগোচরে ইনজেকসন পর্বটার নির্বিঘ্ন ও সফল সমাধান সম্ভব হত না।

    এ পর্যন্ত সবই পূর্ব-প্রস্তুত-নির্ঘণ্ঠ অনুসারে ঠিকমত চলেছিল, গোল বাধল এর পরের দফায়। গাড়িতে উঠবার পূর্বমুহূর্তে ছোটকুমার বেঁকে বসল—সে যাবে না। হাওড়া স্টেশনের ভিড়ের ভিতর কিসের না কিসের সামান্য একটা খোঁচা—সেই তুচ্ছ জিনিসটা যে ওর কাছে এত বড় হয়ে উঠবে, বৌরাণীর রোগশয্যার আহ্বান পর্যন্ত তার কাছে হার মানবে, এই আশ্চর্য ঘটনা রাজাবাহাদুরের হিসাবের মধ্যে ছিল না। এর জন্যে দায়ী ঐ ‘গঙ্গা-আপদটা’। কে ভেবেছিল যে ঠিক ঐ মুহূর্তে ঐখানটিতে তার আবির্ভাব ঘটবে এবং তারই কথায় কুমার দাদা ও বৌরাণীর সব উপরোধ উপেক্ষা করে ফিরে যাবে। তাও যদি তাকে ভবানীপুরের প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত, কার্যসুচীর সামান্য পরিবর্তন ঘটলেও শেষ পর্যন্ত কার্যোদ্ধার আটকে থাকত না। কিন্তু সেখানেও রাজাবাহাদুর ব্যর্থ হলেন। সেই ব্যর্থতার জ্বালা ক্ষণিকের তরে হয়তো তাঁর চোখের তারায় ফুটে উঠে থাকবে, গঙ্গার নজর পড়তেই সে চমকে উঠল। কিন্তু সে বেচারা তখনও জানে না, সে নিজেই এই রাজ- রোষের লক্ষ্যস্থল এবং অদূর ভবিষ্যতে নিজের জীবন দিয়ে তাকে তার অসতর্ক হঠকারিতার মূল্য দিতে হবে।

    হতভাগ্য গঙ্গাচরণ। সে যে নিমিত্ত মাত্র, যে বস্তুটি তার মনিবকে শেষ-মুহূর্তে স্টেশন থেকে ফিরিয়ে এনেছিল, তার নির্দোষ বাহক, এই সত্যটি যদি রাজাবাহাদুর জানতে পারতেন, হয়তো তাকে অকালে অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হত না। জানতে তিনি পেরেছিলেন, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, ঘটনাস্রোতের গতিপথও তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে।

    সে চিঠি যিনি লিখেছিলেন, তিনিও ভাবতে পারেননি গভীর উৎকণ্ঠায় ভরা ঐ সামান্য ক’টি ছত্র একদিন তাঁর সমগ্র শ্বশুরকুলের ইতিহাস রচনা করবে। স্বামীর মনোরাজ্যে বৌরাণীর প্রবেশাধিকার ছিল না, তাঁর গতিবিধির কোনো খবরও তিনি রাখতেন না। তাকে দিয়ে এর আগের চিঠিখানা লেখাবার জন্যে রাজাবাহাদুর কেন যে অত পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কি ছিল তাঁর মনে, তার কোনো আভাসও তিনি পাননি। শুধু মনে হয়েছিল, একটা কিসের কালো ছায়া যেন ঘনিয়ে আসছে। একটা কোনো অকল্যাণের ইঙ্গিত, যার লক্ষ্যস্থল তার পরম স্নেহ ও প্রীতিভাজন ছোটকুমার। এমনি একটা অস্পষ্ট আশঙ্কা তাঁকে ভিতরে ভিতরে চঞ্চল করে তুলেছিল। ভেবেছিলেন, যেমন করে হোক তাকে নিরস্ত করতে হবে।

    কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে গোপনে বিশ্বস্ত ভৃত্যের হাত দিয়ে চিঠিখানা তাঁর আকৈশোর সখা সোদরোপম দেবরের কাছে পাঠিয়েছিলেন, সেটা সিদ্ধ হয়নি—তাকে তিনি বাঁচাতে পারেননি, তবু কুমারের কাছে ঐ কথা ক’টিই ছিল তার শেষ দুটি দিনের মহামূল্য সম্পদ।

    তার মৃত্যুর পরে খোলা খামখানি তার বালিশের তলায় পাওয়া গিয়েছিল। সকলের অলক্ষ্যে রাজাবাহাদুর সেটি সংগ্রহ করেছিলেন। তিনিও এর জন্যে কিছুমাত্র কম মূল্য দেননি। সেকথা যথাস্থানে প্রকাশ করবো।

    স্টেশন থেকে রাজাবাহাদুর সোজা গিয়ে উঠলেন ডাক্তার মুস্তাফির বাড়িতে। তাঁকে পাওয়া গেল না। ছুটলেন মেডিক্যাল কলেজে। সেখানেও নেই। আবার তাঁর বাড়ি ফিরে এসে শুনলেন, তিনি বর্ধমানে রোগী দেখতে গেছেন। ফিরতে রাত হবে কিংবা পরদিন সকালেও আসতে পারেন। রাজাবাহাদুরের মুখে বিরক্তির কুঞ্চন দেখা দিল। তার লক্ষ্য বোধহয় তিনি নিজেই। তাঁর কার্যসূচীতে ডাক্তারের স্থান রয়েছে তারও পরের দিন। টেলিগ্রাম পাওয়ামাত্র তাঁদের ‘দেশে’র বাড়িতে রওনা হবার কথা। ততক্ষণে ছোটকুমারের দেহে ইনজেকশনের ক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। তারপর যা করণীয়, মুস্তাফিই তার ভার নেবেন—এই ছিল ব্যবস্থা। কিন্তু ঘটনাচক্রে এই মুহূর্তেই তার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

    রাজাবাহাদুরের আর ভবানীপুরে ফেরা হল না। ভাগ্যক্রমে বর্ধমানের রোগীর ঠিকানা মুস্তাফির বাড়িতে পাওয়া গেল। সেটি সংগ্রহ করে ওখান থেকে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড-এ গিয়ে পড়লেন। কিন্তু ভাগ্যের আনুকূল্য শেষ পর্যন্ত পেলেন না। গন্তব্যস্থলে গিয়ে শুনলেন রোগীটি মারা গেছে, সুতরাং নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ডাক্তার কোলকাতায় রওনা হয়ে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ফেরালেন রাজাবাহাদুর। এতক্ষণে মনটা একটু প্রসন্ন হল। এই মৃত্যুটা বোধহয় শুভলক্ষণ। এর মধ্যে তাঁর উদ্দেশ্যসিদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

    ছোটকুমার যখন ট্যাক্সি করে বাসায় ফিরছিলেন, একটি চিন্তাই তাঁর সমস্ত মন অধিকার করে রইল—গুরুতর কারণ না থাকলে বৌরাণী তাকে এমন করে নিষেধ করত না। কিন্তু কী সেই কারণ? নিশ্চয়ই তার কোনো বিপদের আশঙ্কা করেছে বৌরাণী। কিসের বিপদ? সে তো কারও কোনো ক্ষতি করেনি! তার বিরুদ্ধে কার কি অভিযোগ থাকতে পারে, কুমার কিছুতেই ভেবে পেল না। তবু এই চিঠির পর আর তার কোনোমতেই যাওয়া চলে না। বৌরাণী তাকে যেতে বলেনি, বলেছে তুমি এসো না। তবু তার এই সুস্পষ্ট ‘না’-এর ভিতর থেকে একটি ব্যাকুল অন্তরের স্নেহনির্ঝর ঝরে ঝরে পড়ছে। তাতেই সে অভিভূত হয়ে রইল।

    বাসায় ফিরবার কিছুক্ষণ পরেই কুমার বুঝল তার জ্বর এসেছে। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ল। গঙ্গা ব্যস্ত হয়ে উঠল। বারবার এসে বলতে লাগল, একজন ডাক্তার ডেকে আনি, তোমার সেই যে বন্ধুটি আসে, তাকেই না হয় খবর দিই।

    কুমার নিষেধ করল, এখন থাক, দরকার হলে পরে ডাকা যাবে।

    বিকেলের দিকে জ্বর খুব বেড়ে গেল। আর ওকে জিজ্ঞাসা করল না, শিয়ালদর কাছে ওর ডাক্তার-বন্ধু অমলবাবুর বাসা তার জানা ছিল, তাকে একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে এল। কুমার তখন ভুল বকছে।

    রোগীকে পরীক্ষা করতে গিয়ে তার দেহের কয়েকটি বিশেষ জায়গায় এক ধরনের স্ফীতি লক্ষ্য করে অমল সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। তার যতদূর জানা, ওটা প্লেগের লক্ষণ। কিন্তু প্লেগ আসবে কোত্থেকে? হয়তো অন্য কারণে ফুলে থাকবে—যাই হোক, রক্তটা দেখা দরকার। তার এক সতীর্থ ছিল প্যাথলজিস্ট। তার কাছে ছুটে গেল। সে এসে তখনই স্লাইড্ নিয়ে গেল এবং মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলে চমকে উঠল। সত্যিই প্লেগের বীজাণু দেখা যাচ্ছে। দুজনেই টাটকা পাস করা অনভিজ্ঞ চিকিৎসক। নিজেদের বিদ্যার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করে পরদিন সকালেই আর কয়েকটা স্লাইড্‌ নিয়ে দিয়ে এল মেডিক্যাল কলেজে এবং রিপোর্টের জন্যে সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগল। রোগীর কাছে করবার বিশেষ কিছু ছিল না, চিকিৎসার গতি-প্রকৃতি, এমন কি আরোগ্যও নির্ভর করছিল রোগ-নির্ণয়ের উপর।

    ওখানকার যিনি বিশেষজ্ঞ, কোনো কারণে তিনি তখন অনুপস্থিত। অনেক দেরিতে ফিরলেন। আরও বহু কেস্ ছিল, তাতেও খানিকটা দেরি হল। তারপর লালফিতার বেড়া পার হয়ে সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষিত কাগজখানি যখন অমল এবং তার বন্ধুর হাতে এসে পৌঁছল, তখন সন্ধ্যা হতে আর বাকী নেই। রিপোর্টে নিজেদের মতের সমর্থন দেখে তখনই ট্যক্সি নিয়ে ছুটল কুমারের বাসায়। গিয়ে দেখল কেউ নেই, শূন্য খাটখানা খাঁ খাঁ করছে।

    পাশের ঘর থেকে ঠাকুর এসে কেঁদে পড়ল

    তার মুখেই শোনা গেল, অমল বেরিয়ে যাবার পরমুহূর্তেই রাজাবাহাদুর কোনো এক বড় ডাক্তার নিয়ে এসে পড়েছিলেন, গোটা কয়েক ইন্জেকশনও দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কুমারের আর জ্ঞান ফিরে আসেনি। তারপর দুপুরের মধ্যেই সব শেষ। এই কিছুক্ষণ হল যোগাড়যন্তর করে শ্মশানে নিয়ে গেছে। রাজাবাহাদুর সঙ্গে গেছেন। গঙ্গাকে তিনি নিতে চাননি, সে একরকম জোর করেই গেছে। কোন্ শ্মশানে, ঠাকুর ঠিক বলতে পারল না। হাত দিয়ে দক্ষিণ দিকটা দেখিয়ে দিল। অমল তার প্যাথলজিস্ট বন্ধুকে বলল, তাহলে বোধহয় কেওড়াতলায় নিয়ে গেছে। ওর বাবাও শুনেছি কোলকাতাতেই মারা যান এবং তাঁকেও কেওড়াতলায় দাহ করা হয়েছিল।

    —তার কারণ, ওদের ভবানীপুরের বাড়ি থেকে সেটা কাছে পড়ে। এখান থেকে নিশ্চয়ই অদূরে নিয়ে যায় নি।

    –যেখানেই নিক, শ্মশানে গিয়ে আর কী লাভ? উদাসকণ্ঠে বলল অমল। এই মৃত্যুতে সে অনেকটা ভেঙে পড়েছিল।

    বন্ধু বলল, তাহলেও একবার চল। ব্লাড-রিপোর্ট রইল আমাদের কাছে। সেটা না দেখেই ডেথ-সার্টিফিকেট দিলো কে, আর তাতে কি লিখল, একবার জানা দরকার। রাজারাজড়ার ব্যাপার, কোনো গণ্ডগোলও তো থাকতে পারে।

    —ওকে তুমি দ্যাখনি, তাই ওকথা বলছ। সব দাবিদাওয়া ছেড়ে এব কাপড়ে চলে এসেছিল। ওর বিরুদ্ধে কারও কোনো আক্রোশ থাকতে পারে না।

    —তবু একবার আমাদের যাওয়া উচিত। কোলকাতার শহরে হঠাৎ একটা লোক প্লেগে মারা গেল, ব্যাপারটা suppress করা ঠিক হবে না।

    কাশীমিত্তির এবং নিমতলায় সন্ধান না পেয়ে, কেওড়াতলাতে যখন ওরা পৌঁছল, তখন দাউ দাউ করে চিতা জ্বলছে। রাজাবাহাদুর এককোণে চুপ করে বসে আছেন। অমলকে দেখে গঙ্গা ছুটে এল। ওর পায়ের উপর পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল— সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে ডাক্তারবাবু? আমি নিজে গিয়ে তোমায় ডেকে নিয়ে এলাম!

    অমল কিছুক্ষণ তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে রাজাবাহাদুরের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অনুকূল শ্রোতা পেয়ে তাঁর শোকোচ্ছ্বাস তীব্র আকারে দেখা দিল।

    সেই সুযোগে অমলের বন্ধুটি ডেথ-সার্টিফিকেটের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করল। কিন্তু শ্মশান-কর্তৃপক্ষ তাকে আমল দিল না। একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির এজাতীয় কৌতূহল মেটাবার সরকারী দায় বোধহয় তাঁদের ছিল না। তখন অমল মনে মনে অনিচ্ছুক হলেও, ব্যাধি এবং তার সঙ্গে জড়িত অন্য দু-একটি বিষয়ের (যেমন হাওড়া স্টেশনে সুঁচ ফোটানো) গুরুত্ব বিবেচনা করে রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টখানা পুলিসের গোচরে আনাই তার কর্তব্য বলে মনে করল।

    ইংরেজ-আমলের পুলিস। সরকারী কর্তব্য করতে গিয়ে চাকরির ভাবনা ভাবতে হত না। সুতরাং তৎপরতার অভাব হয়নি। সেই রাত্রেই ডেথ সার্টিফিকেটখানা তাদের দখলে এসে গেল। তার মধ্যে কোনো একটি মারাত্মক রোগের উল্লেখ নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সেটা প্লেগ নয়। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার মুস্তাফি তাদের হেফাজতে এসে গেলেন। তাঁর অফিস-কামরায় তল্লাশ চালিয়ে যে-সব চিঠিপত্র পাওয়া গেল, তার সূত্র ধরে তারা প্রথমে হানা দিল নিশানাথের গবেষণাগারে এবং তারপর রাজাবাহাদুরের প্রাসাদে। আরেক দল চলে গেল সেই ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের কাছে এবং বহু চাঞ্চল্যকর তথ্যাদি নিয়ে ফিরে এল। তার ফলে রাজাবাহাদুর এবং নিশানাথ একই দিনে আমাদের আতিথ্য গ্রহণ করলেন।

    সেই চিরস্মরণীয় দিনটির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তদন্ত শেষ করে মামলা দায়ের করতে পুলিসের বহুদিন লেগেছিল। এই সুদীর্ঘ হাজতবাসের প্রতিটি দিন আমি রাজাবাহাদুরের নিকট থেকে নিকটতর সান্নিধ্যে এসেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। কার্য-সূত্রে যখনই একনম্বর সেল-ব্লকে যাবার প্রয়োজন হয়েছে, দেখেছি শ্বেতমর্মরে গড়া একটি বিশাল মূর্তি কখনও বসে, কখনও দাঁড়িয়ে, কখনও শুয়ে আছে। শান্ত, মৌনী, অবিচল। দেখামাত্র সৌম্য মুখখানি জুড়ে একটি বিনম্র মৃদু হাসি, তার সঙ্গে দীর্ঘ হাত দুটি তুলে একটি ক্ষুদ্র বিনীত নমস্কার। কোনোদিন তার অন্যথা দেখি নি। নালিশ নেই, অভিযোগ নেই, বিন্দুমাত্র বিরক্তি-প্রকাশ নেই। কুশল প্রশ্নের একটিমাত্র উত্তর, ‘ভালো আছি’। অথচ আমরা তো জানি, এই অভিশপ্ত জীবনের অনভ্যস্ত কৃচ্ছ্রতায় দিন দিন তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছিল, ভালো তিনি ছিলেন না।

    হাজত থেকে যেদিন তাঁকে Condemned Cell অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কয়েদীদের সেল-ব্লকে নিয়ে যাওয়া হল, সেদিনও তাঁর মধ্যে কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায় নি। পাশের ঘরেই নিশানাথ। তারও ঐ একই দণ্ড। তার চিৎকারে, আবদারে, অভিযোগে আমরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু রাজাবাহাদুর তেমনি নীরব, নিশ্চল। শুধু একটি দিন তাঁকে কিঞ্চিৎ ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছিলাম, মুহূর্তের জন্যে একটুখানি ধৈর্যচ্যুতি। ঘটনাটির মধ্যে কিছু মজাও আছে। পাঠকের সেটা উপরি-পাওনা, সুতরাং বলে ফেলা যাক।

    ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে মাঝে মাঝে জেল পরিদর্শনে আসতে হয়। তখন ওখানে ছিলেন একজন শ্বেতাঙ্গ সিভিলিয়ন। বেশ কড়া লোক, তার সঙ্গে একটু বোধহয় ছিটও ছিল। রাজাবাহাদুরের সেল্-এর সামনে গিয়ে যথারীতি জানতে চাইলেন—কোনো নালিশ আছে? তার অনেকদিন আগে ওঁরা দায়রা আদালতের রায়-এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপীল করেছেন। বিচার দূরে থাক, শুনানির দিন পর্যন্ত ধার্য হয় নি। ব্যাপারটা শুধু আশ্চর্য নয়, অভূতপূর্ব। ফাঁসির আসামীর আপীল কখনও এতদিন পড়ে থাকে না। দিনের পর দিন এই অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে কাটানো এক দুঃসহ শাস্তি। তার থেকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মুক্তি দেওয়াই হাইকোর্টের চিরাচরিত রীতি। এক্ষেত্রে এই দীর্ঘ বিলম্বের কারণ কি, তাঁরাই বলতে পারেন।

    ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্নের সেই মামুলী উত্তরই আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু রাজাবাহাদুরের নিঃসীম সহিষ্ণুতা, সেখানেও রোধহয় একটু ফাটল ধরেছিল। গরাদে দেওয়া রুদ্ধ দরজার সামনে একটু এগিয়ে এসে বললেন, আপনার যদি ক্ষমতা থাকে সাহেব, একটা উপকার করলে বিশেষ বাধিত হবো। মাসের পর মাস ধরে মাধার ওপর যে সোর্ডখানা ঝুলছে, তাকে সোজা ফেলে দিতে বলুন। এছাড়া আমার আর কোনো প্রার্থনা নেই।

    সাহেব আমাদের দিকে তাকালেন। ব্যাপারটা তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া হল। কোনো ক না বলে অফিসে চলে এলেন, ওয়ারেন্ট এবং অন্যান্য কাগজ-পত্রাদি দেখলেন, তার ভিজিটরস্ বুক টেনে নিয়ে মামলার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে শেষের দিকে লিখলেন, কেটি মহামান্য হাইকোর্টের বিচারাধীন। এ বিষয়ে কোনোরকম মন্তব্য করবার অধিকার আমার নেই। কিন্তু এই জাতীয় কোনো পরিস্থিতি পৃথিবীর আর কোনো সভ্য দেশে ঘটেছে . বলে আমার জানা নেই, ঘটতে পারত কিনা সে-বিষয়েও আমি সন্দিহান।

    জেলের নিয়মানুসারে ভিজিটররা যে মন্তব্য করেন, সুপারিন্টেণ্ডেন্টের বক্তব্যসহ তার একটা নকল স্বরাষ্ট্রবিভাগে পাঠাতে হয়। দিন-তিনেক পরে হোম্ মেম্বারের কাছ থেকে ভীষণ জরুরী টেলিফোন, তার মধ্যে রীতিমত সন্ত্রাসের সুর—এ করেছ কি! এই কথাগুলো যদি কোনোরকমে হাইকোর্টের নজরে পড়ে, কালেক্টরকে যে তখনই তোমাদের অতিথি হতে হবে! সিরিয়স্ কনটেমপ্‌ট অব কোর্ট!

    —কি করতে হবে? ততোধিক ভীতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন সুপার

    —ভিজিটরস্ বুকের ঐ পাতাটি এখুনি ছিঁড়ে ফেলে দাও। অফিসে যদি তার নকল থাকে, ডেস্‌ট্রয় অ্যাটওয়ান্স! আমরাও তাই করছি।

    যথাসময়ে অর্থাৎ তার অনেক পরে হাইকোর্টের রায় বেরোল। ডেথ সেটেন্স কমিউটেড টু ট্রানসপোর্টেশন ফর লাইফ। নিশানাথেরও তাই। মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। ডাক্তার মুস্তাফি আগেই খালাস পেয়েছিলেন।

    “রক্তপরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সে খবর আমার আগে জানা ছিল না। তাহলে অবশ্যই তার রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করতাম। আমার বুদ্ধি-বিবেচনা মতো যে রোগে মৃত্যু বলে মনে হয়েছে, ডেথ সার্টিফিকেটে তারই উল্লেখ করেছি”–

    তাঁর এই উক্তি কোর্ট অবিশ্বাস করে নি।

    নিশানাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, “প্রতিভাবান ছাত্র হিসাবে গবেষণার সুবিধার জন্যেই আমি তার জন্যে যা কিছু করেছি। সেখানে থেকে বীজাণু সংগ্রহ করে খুনের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ ইত্যাদি ব্যাপার যদি ঘটে থাকে, তার সঙ্গে আমার কোন সংস্রব নেই।”

    এ বিষয়েও দায়রা জজ তাঁকে বেনিফিট্ অব্ ডাউটের সুবিধা দিয়েছিলেন।

    রাজাবাহাদুরকে আন্দামানে পাঠানো হয় নি, ঐ জেলেই ছিলেন। তাঁর সেই পুরনো জায়গায়—একনম্বর সেল-ব্লক। সেখানে বসেই একদিন, হয়তো কোনো দুর্বল মুহূর্তে—যা সকলের জীবনেই আসে—তিনি আমার কাছে তাঁর সমস্ত অপরাধ স্বীকার করেছিলেন। সে কথা এই আখ্যায়িকার গোড়ার দিকে উল্লেখ করেছি। আমার মনের মধ্যে সেদিন যে অসামান্য আবিষ্কারের উল্লাস জেগে উঠেছিল, তাও গোপন রাখি নি। কিন্তু সত্যিই কি আমি তাঁর দুয়ে মানসের রুদ্ধকক্ষে প্রবেশের অধিকার পেয়েছিলাম? মনে আছে, সেদিন তাঁকে কোনো প্রশ্ন করি নি, তার কদিন পরে আমার সাধারণ বুদ্ধিতে যে স্থূল সন্দেহ জেগেছিল, তারই একটু আভাস দিয়েছিলাম। অনেক ইতস্তত করে বলে ফেলেছিলাম, আচ্ছা বৌরাণী এবং ছোটকুমারের আচরণে এমন কিছু কি আপনি দেখেছিলেন, যার থেকে-

    রাজাবাহাদুর কথাটা শেষ করতে দেন নি। তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে দাঁতে জিব কেটে বলেছিলেন, ছিঃ ছিঃ, ওদের সম্বন্ধে একথা ভাবাই যায় না। দুজনেই নিষ্পাপ, পবিত্র।

    তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলেছিলেন, হয়তো সেই জন্যেই আমি ঐ ছেলেটাকে কোনোদিন সইতে পারি নি। ও বড় বেশী শুদ্ধ, বড় বেশী মহৎ। ছেলেবেলা থেকে কোনো কিছুতে আসক্তি নেই, লোভ নেই। সেই সৃষ্টিছাড়া বৈরাগ্য আমাকে উঠতে বসতে পীড়া দিত। কখনও ভুলতে পারি নি, ও আমার অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে, আমার সাধ্য নেই কোনোদিন সেখানে উঠি। বিয়ে করে যাকে নিয়ে এলাম, সেও আমার নাগালের বাইরে চলে গেল। আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। ওরা যে আমাকে একঘরে করে তাড়িয়ে দিল—কি করে যে আমার দিন কেটেছে, আপনাকে বোঝাতে পারবো না, মিস্টার চৌধুরী।

    আবার কিছুক্ষণের বিরতি। বোধহয় সেই দিনগুলোর মধ্যে ফিরে গিয়ে নতুন করে সেই যন্ত্রণাটা অনুভব করলেন। তেমনি গভীর সুরে বললেন, তারপর যেদিন সব কিছু আমাকে লিখে দিয়ে চলে গেল, আমার কি মনে হল জানেন? মনে হল সম্পত্তি নয়, সোনা-দানা নয়, একতাল কাদা ছুঁড়ে দিয়ে গেল আমার মুখের ওপর।

    —আপনি নিলেন কেন সে সম্পত্তি?

    —নিলাম তার কারণ, না নেবার মতো জোর আমার মধ্যে ছিল না। তাছাড়া আমি না নিলে হয়তো যাকে-তাকে দিয়ে যেত। যে সে আমার পিতৃ-পিতামহের সম্পত্তির অংশীদার হয়ে বসবে, আমার প্রাসাদের অর্ধেক অধিকার দাবি করবে, আমার জীবন থাকতে তা হতে পারে না। তাই নিতে হল, কিন্তু নিয়ে কি একদিনের তরেও স্বস্তি পেয়েছি মনে করেন? কেবলই মনে হত, সে আমাকে চিরদিনের তরে হারিয়ে দিয়ে গেল। সে স্পর্ধা কেমন করে সহ্য করা যায়, বলুন?

    আরেকদিন অন্য কি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আমাকে লোকে বলে রূপবান পুরুষ। রূপ আমার পূর্বপুরুষের দান। ও সেটা পায় নি, তার বদলে এমন একটা halo ছিল ওর মধ্যে দেখতাম আর হাড়ে হাড়ে অনুভব করতাম, তার কাছে আমি কত কুৎসিত! চোখের ওপর একটি চোখ ঝলসানো আলো কতক্ষণ বরদাস্ত করা যায়?

    কোলকাতা এবং তার আশেপাশের জেলগুলোতেই অনেকদিন ধরে ঘুরেছি, লালদীঘির কর্তাদের সেটা খেয়াল হয় নি, যখন হল, মোটা কলমের এক খোঁচায় আমাকে একেবারে দক্ষিণ বাংলার শেষ প্রান্তে ঠেলে দিলেন। বছর কয়েক পরে সেখান থেকে পাঠালেন উত্তরে। তারপর গোটা পূর্বাঞ্চল ঘুরিয়ে দিলেন। এমনি করে তিনদিকব্যাপী দীর্ঘ পরিক্রমা শেষ করে স্বাধীনতার টানে ‘অপটী’-রূপে (optee) আবার পশ্চিম বাংলায় ফিরে এলাম। ততদিন আমার মাথার চুল উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছে। কিন্তু রাজাবাহাদুরের রূপ বিস্মৃতির কালিমায় ম্লান হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে কয়েক ধাপ উপরে উঠেছি, এবারে একটা বড় সেন্ট্রাল জেলের হাল ধরবার ডাক এসে গেল।

    চার্জ নেবার পরদিন সদলবলে ‘রাউণ্ডে’ চলেছি। দ্বিতীয় শ্রেণীর কয়েদীদের চত্বর পার হয়ে বারান্দায় পড়ে ডানদিকে মোড় নিতে যাব, হঠাৎ সামনের দিকে নজর পড়তেই থমকে দাঁড়ালাম। মুখ থেকে অজ্ঞাতসারে বেরিয়ে গেল—এ কে! নমস্কারের সেই বিশেষ ভঙ্গিটি তেমনি আছে। কিন্তু যে স্নিগ্ধ হাসিটি সেদিন মুহূর্তমধ্যে সমস্ত মুখখানাকে উদ্ভাসিত করে দিত, আজ শুধু কতকগুলো বিকৃত কুঞ্চন দিয়ে তাকে কুৎসিত ও ভয়াবহ করে তুলল। কণ্ঠস্বরের সে গাম্ভীর্যও কোথায় চলে গেছে। কেমন একটা কর্কশ খনখনে আওয়াজ বেরিয়ে এল—চিনতে পাচ্ছেন?

    উত্তর দিতে ভুলে গেলাম।

    আমি তখন অনেকগুলো বছর পার হয়ে সেই দিনটিতে ফিরে গেছি, যেদিন প্রথম এঁকে দেখেছিলাম। সহসা-জ্বলে-ওঠা তড়িৎচমকে আমার স্মৃতিকক্ষের সব অন্ধকার সরিয়ে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল এক দীর্ঘ, ঋজু, ভাস্বর পুরুষ, যার দিকে তাকিয়ে গিরীনদা বলেছিলেন—Every inch an Aristocrat. তার সঙ্গে এই কঙ্কালের কোনোখানে কোনো মিল নেই। চিনতে যে পেরেছি, সেটাই আমার কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হল।

    যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ কুড়ি বছর। কিন্তু ‘Fourteen years’ rule নামক আইনের বলে রেমিশন সমেত চৌদ্দ বছর পার হলেই সুপারের অভিমত নিয়ে প্রাদেশিক সরকার বেশির ভাগ লোককে ছেড়ে দিয়ে থাকেন। রাজাবাহাদুরকে সে আইনের সুযোগ দেওয়া হয় নি। জেল থেকে যথারীতি সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল। সরকার রাজী হন নি। এক বছর পরে কেসটা আবার নতুন করে পাঠাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

    পরের সপ্তাহে খবর এল, রাজাবাহাদুর আমার দর্শন-প্রার্থী। অফিসে নিয়ে আসতে বলে দিলাম। ধীরে ধীরে নুইয়ে-পড়া-দেহটাকে যেন কোনোরকমে টেনে নিয়ে আমার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বসতে বললাম। খানিকটা ইতস্তত করে সসঙ্কোচে সেটি দখল করলেন। বললাম, বৌরাণী কেমন আছেন?

    —অনেকদিন খবর পাই নি।

    —মাঝে মাঝে দেখা করতে আসেন না?

    —আমিই বারণ করেছি। শুনেছি বেশির ভাগ সময় ঠাকুরঘরেই পড়ে থাকে, তাই আর ডিস্টার্ব করতে চাই নি।

    আর কোনো প্রশ্ন না করে জিজ্ঞাসু-দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকালাম। ইঙ্গিতটা বুঝলেও আরও কিছু সময় গেল দ্বিধার জড়তা কাটিয়ে উঠতে। তারপর ক্ষীণস্বরে ধীরে ধীরে বললেন, আসতে না আসতেই বিরক্ত করছি, অথচ-

    বললাম, আপনি নিঃসঙ্কোচে বলুন, আমি কিছুমাত্র বিরক্ত হবো না।

    —বেশ বুঝতে পারছি, ডাক এসে গেছে। আর বেশিদিন নেই। তাই ভাবছিলাম, শেষ নিঃশ্বাসটা যদি বাপ-পিতামহের ভিটেয় ফেলতে পারতাম তবু খানিকটা তৃপ্তি হত।

    বলতে যাচ্ছিলাম, ওসব আপনার মিথ্যা আশঙ্কা, সাহস হারাবেন না ইত্যাদি। ওঁর শরীরের দিকে চেয়ে নিরস্ত হলাম। ঐজাতীয় মামুলী সান্ত্বনা অন্য কাউকে দেওয়া যেত, এঁর বেলায় নিরর্থক। শুধু বললাম, আপনার কেস্টা আমি দেখেছি। আমার পক্ষে যতখানি সাধ্য চেষ্টার ত্রুটি করবো না।

    —জানি সেইটুকুই আমার ভরসা।

    কয়েকদিনের মধ্যেই খবর এল মন্ত্রী আসছেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রথম মন্ত্রী এবং এ জেলে তাঁর প্রথম পদার্পণ। রাজাবাহাদুরকে বলে পাঠালাম, ঐ ওয়ার্ডে যখন যাবেন, ওঁর প্রার্থনা যেন তাঁর কাছে পেশ করা হয়। তাই হল। এই কুখ্যাত মামলার বীভৎস ইতিহাস মন্ত্রীমহাশয়ের না জানবার কথা নয়। সেই হত্যাকাণ্ডের যে প্রধান নায়ক, তার উপরে কঠোর মনোভাব পোষণ করাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই লোকটার এই পরিণাম বোধহয় তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। তার উপরে তার শেষ নিবেদনের বিষয়বস্তু এবং যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে সেটা বর্ণিত হল, সবকিছু মিলে তাঁর মনে একটা অনুকূল আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে বুঝতে পারলাম। ওখানে একটা সময়োচিত জবাব দিয়ে অফিসে ফিরে গিয়ে বললেন, বিষদাঁত ভেঙে গেছে মনে হচ্ছে। এবার বোধহয় ছেড়ে দেওয়া যায়, আপনি কি বলেন?

    —আজ্ঞে আমারও তাই মনে হয়। Let him have the comfort of dying at home.

    কথাটা আমার রচনা নয়, জেলকোড-এর কোনো একটি ধারার পুনরুক্তি। যে হতভাগ্য বন্দীর জীবনের মেয়াদ শেষ হয়ে এসেছে, কিন্তু জেলের মেয়াদ বাকী, তার বেলায় ঐ আরামটুকু মঞ্জুর করবার বিধান আছে।

    মন্ত্রী বললেন, তাহলে একটা পিটিশন দিতে বলুন, আর তার ওপরে আপনি একটু ভালো করে লিখে-টিখে দিন। তার মধ্যে ঐ কথাটা যেন থাকে—বেরিয়ে গিয়ে আবার একটা কিছু করবার মতো দেহের শক্তি বা মনোবল দুটোই চলে গেছে? অর্থাৎ পুলিস যাকে বলে reversion to further crime—তার কোনো chance নেই।

    দু-দিনের মধ্যে দরখাস্ত চলে গেল, এবং মন্ত্রীমহাশয়ের উপদেশমত আমার সুপারিশের সঙ্গে ঐ বিশেষ মন্তব্যটুকু জুড়ে দেওয়া হল।

    মাসখানেক পরে রাজাবাহাদুর মুক্তি পেলেন। তার আগে ওঁকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবার জন্যে জেল থেকে ওঁর দেশের বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছিল। দুজন পুরনো কর্মচারী এসেছিল—তারা এবং আমার কজন কর্মী ধরাধরি করে ওঁকে গাড়িতে তুলে দিল।

    এর পরের ঘটনাগুলো আমার সংগ্রহ। কিছুটা খবরের কাগজ থেকে, এবং বাকী অংশ একজন পুলিস অফিসার মারফৎ, এ বিষয়ে যাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে।

    রেলস্টেশন থেকে প্রাসাদে পৌঁছবার পরেও রাদাবাহাদুরকে গাড়ি থেকে ধরে নামাতে হয়েছিল। একতলায় তাঁর নিজস্ব মহলে কোনো একটা ঘরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর নানা প্রশ্নের মধ্যে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার বন্দুকগুলো সব আছে তো?

    —আজ্ঞে, সবগুলো নেই। পুলিস লাইসেন্স দিতে চাইল না। কয়েকটা আছে।

    —চল তো দেখি।

    —এখনি যাবেন? খাওয়া-দাওয়ার পর বরং—

    —না, তার আগেই ঘুরে আসি চল।

    লোকজনের কাঁধে ভর করে তেমনি ধীরে ধীরে আর্মারিতে গিয়ে ঢুকলেন। তাঁর প্রথম যৌবনের শিকার-সঙ্গী প্রিয় রাইফেলটা বের করলেন, কয়েকটা রিভলবার নাড়া- চাড়া করে দেখলেন, গুলির বাক্সটাও খুলতে বললেন। ম্যানেজার ছিলেন দরজার বাইরে। তাকে লক্ষ্য করে বার বার অনুযোগ দিতে লাগলেন, এ করেছ কী? সব যে নষ্ট হতে বসেছে!

    এমন সময় বাইরে দাঁড়ানো চাকর-বাকরদের মধ্যে একটু চাঞ্চল্য দেখা দিল। কে যেন বলল, বৌরাণী আসছেন। চক্ষের নিমেষে সেই ভেঙে-পড়া অশক্ত দুর্বল ন্যুব্জ দেহটা সবেগে মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়াল, এবং ক্ষিপ্রবেগে দৃঢ় পদক্ষেপে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। হাতে রাইফেল, কাঁধে গুলিভর্তি ব্যাণ্ডোলিয়র। বৌরাণী ওদিকের বারান্দা দিয়ে এগিয়ে আসছিলেন—পরনে পট্টবাস, হাতে ঠাকুরের আশীর্বাদী ফুল। চেঁচামেচি শুনে মাথা তুলতেই চোখে পড়ল বন্দুকের নল তাঁরই দিকে উদ্যত। চিৎকার করে একটা থামের আড়ালে সরে গেলেন। গুলি গিয়ে লাগল পেছনের দেয়ালে। ছুটে এগিয়ে গিয়ে আবার নিশানা নিলেন রাজাবাহাদুর, ঠিক সেই মুহূর্তে একটা চেয়ার সজোরে তাঁর পিঠের উপর এসে পড়ল। তিনি মুখথুবড়ে পড়ে গেলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে গুলি ছুঁড়লেন। একজন চাকর ছুটে পালাচ্ছিল, পিঠে লাগতেই সে পড়ে গেল। ততক্ষণে দুজন দারোয়ান বন্দুক নিয়ে ছুটে এসেছে। রাজাবাহাদুর গুলি চালাতে চালাতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেন।

    থানায় খবর দেওয়া হয়েছিল। ও. সি. ও এসেছিলেন জনকয়েক পুলিস নিয়ে, কিন্তু সেই গুলিবৃষ্টির মুখে এগোতে সাহস করেন নি। সদরে টেলিগ্রাম করে বেশ কিছু আম পুলিস আনিয়ে তারপরে আততায়ীকে আয়ত্তে আনতে পেরেছিলেন। তাও জীবন্ত মানুষটাকে ধরতে পারেন নি, পেয়েছিলেন তার প্রাণহীন দেহ। তার এক পকেটে ছিল সরকার প্রদত্ত মুক্তির আদেশের নকল, আরেক পকেটে এক টুকরো বহুদিনের পুরনো ভাঁজ করা বিবর্ণ কাগজ। তার সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নি। পুলিস অফিসারের কাছে দু-একটি লাইন যা শুনেছিলাম, তার থেকে বুঝেছি ওটা সেই চিঠি—’ছোটু’র উদ্দেশে বৌরাণীর শেষ সম্ভাষণ।

    আমি রাজাবাহাদুরকে চিনি। যে-চিঠি তাঁর দীর্ঘদিনব্যাপী বহুযত্নরচিত পরিকল্পনাকে সাফল্যের পূর্ব-মুহূর্তে অকস্মাৎ বানচাল করে দিয়েছিল, তাকে তিনি কোনোদিন ভুলতে পারেন না, একথা সহজেই বুঝতে পারি। সে চিঠি যার হাত থেকে বেরিয়েছিল, সে যে-ই হোক, তার বিরুদ্ধে এই আঠারো বছরের সঞ্চিত জিঘাংসা এবং প্রথম সুযোগেই তাকে চরিতার্থ করবার প্রচেষ্টা—এ-সবও আমার কাছে দুর্বোধ্য নয়, কিন্তু বিভিন্ন জেলখানার সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে ঐ কাগজটুকু কেন যে তিনি এত বছর ধরে এত যত্নে বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন—সে রহস্য আজও ভেদ করতে পারি নি।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডাইস লস্ট – জন মিল্টন
    Next Article ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }