Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌহকপাট – জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী)

    জরাসন্ধ (চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) এক পাতা গল্প980 Mins Read0

    লৌহকপাট – ৪.৮

    আট

    এতদিন যেসব জেল-থেকে-ফেরা অচেনা পত্রলেখক ও লেখিকা আমাকে তাদের আত্মকাহিনী শুনিয়েছেন (যার কিছু কিছু আমি পাঠক-দরবারে পেশ করেছি), তাদের দুটো দলে ফেলা যেতে পারে। এক যাঁরা বলতে চেয়েছেন, তাঁরা নিরপরাধ অর্থাৎ বিভ্রান্ত বিচারের বলি, দুই—যাঁরা প্রমাণিত অপরাধ স্বীকার করলেও তার পুরোপুরি দায়িত্ব মেনে নিতে চান নি, তার পিছনে দাঁড় করিয়েছেন হয় কোনো সামাজিক অসাম্য কিংবা অত্যাচার, অবস্থার প্রতিকূলতা, নয়তো কোনো অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন বা সাময়িক উত্তেজনা। আজ যে চিঠিখানা আমার ঝাঁপির তলা থেকে বের করলাম, তার লেখক এর কোনো দলেই পড়েন না। তাঁকে জেলে যেতে হয় নি, অর্থাৎ গুরুতর যে অপরাধে অভিযুক্ত হলেও আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন নি, কিন্তু তিনি যে অপরাধী, এই চিঠির মধ্যে সে কথা অকুণ্ঠ অবলীলায় কবুল করেছেন, নিজেকে কোথাও সমর্থন করবার চেষ্টা করেন নি। একটি লোমহর্ষক ঘটনার এমন সহজ ও নিরুত্তাপ বর্ণনা দিয়ে গেছেন, যেন তিনি তার নায়ক নন, রিপোর্টার মাত্র।

    বেশীর ভাগ · আসামীর মতো আদালতের কাঠগড়ায় তিনিও নীরব ভূমিকা নিয়েছিলেন, ইংরেজের ফৌজদারী আইন যেটুকু পেলেই সন্তুষ্ট। অর্থাৎ হাকিমের প্রশ্নের উত্তরে দুটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি নির্দোষ’। তার দীর্ঘদিন পরে এই স্বীকারোক্তির উদ্দেশ্য কী এবং তার শ্রোতার পদে আমাকে কেন বরণ করলেন, সে কথা বলতে গিয়ে আমার সম্বন্ধে যে-সব মন্তব্য করেছেন, তার কোনোটাই শ্রুতিমধুর নয়। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছুটা প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি। তা না হলে তাঁর আসল বক্তব্যের মূল সূত্রটি ধরা যাবে না।

    তিনি লিখছেন, “গোড়াতেই বলে রাখি, আপনার লেখার সাহিত্যিক গুণাগুণ সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার নেই।। সাহিত্য আমি বুঝি না, তা নিয়ে মাথা ঘামাবারও প্রয়োজন বোধ করি না। আমার ইন্টারেস্ট আপনার বিষয়বস্তু, – ক্রিমিন্যাল মাইণ্ড—আপনি যাকে কবিত্ব করে বলেছেন, ‘অপরাধী মানুষের মানস-লোক’। দুঃখের সঙ্গে বলছি, সেখানকার রহস্যোদ্ঘাটন করতে গিয়ে আপনি দার্শনিক স্বচ্ছ দৃষ্টির পরিচয় দিতে পারেন নি, সাহিত্যিক ভাবালুতার আশ্রয় নিয়েছেন। তাই যত কয়েদী আপনি আমদানি করেছেন; কোনোটাকেই ক্রিমিন্যাল বলে চেনা যাচ্ছে না, সবাই এক একটি রোমান্টিক হিরো কিংবা হিরোয়িন।

    “খুনী মাত্রেই মহানুভব, ডাকাত মাত্রেই হৃদয়বান। আপনার আয়রন-গে-এর অন্তরালে একটাও আয়রন-হার্টেড অমানুষ খুঁজে পেলাম না, সব কটাই গোল্ডেন্-হার্টেড অতিমানুষ। আপনার ভক্তেরা হয়তো বলবেন, কী আশ্চর্য লেখনী, যার স্পর্শে সব লোহা সোনা হয়ে গেছে। আমি ভাবছি, কী আশ্চর্য উপাদান আপনার হাতে ছিল। আপনি সেগুলোকে সত্যানুসন্ধানের কাজে না লাগিয়ে টিয়ারগ্যাস্-এর মতো ব্যবহার করেছেন। যার ফলে আপনার ভাবপ্রবণ পাঠক-পাঠিকার চক্ষুযুগল থেকে প্রচুর অশ্রু-পতন ঘটেছে আর কোনো কাজ হয় নি। আমার মনে হয়, ঐটাই আপনার উদ্দেশ্য ছিল। তা না হলে কেমন করে বিশ্বাস করি, এতদিন ধরে এত জেল ঘুরে এমন একটা অপরাধীও আপনি দেখতে পেলেন না, যার হৃদয় বলে কোনো বস্তু নেই? হয়তো দেখেছিলেন কিন্তু তার কথা বলতে চান নি, কিংবা যাদের কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে ঐ পদার্থটি আপনি বসিয়ে দিয়েছেন, যে যা নয় তার উপর সেটি আরোপ করেছেন, প্রকৃতিকে বিকৃত করেছেন, সাহিত্যের স্বার্থে সত্যকে বিসর্জন দিয়েছেন।

    “কিংবা এও হতে পারে, জেলে বসে আপনার চারদিকে যে লোকগুলোকে বিচরণ করতে দেখেছেন, তারা তাদের আসল চেহারাটা আপনাকে দেখতে দেয় নি। কেউ কেউ সামনে এসে মুখ খুললেও মুখোশ খোলে নি। আপনি খোলকে আসল বলে ভুল করেছেন, খোসাকে মনে করেছেন শাঁস।

    “আজ আমি এমন একজনের কথা আপনাকে শোনাতে বসেছি, যার মুখে কোনো মুখোশ নেই, কোনো খোলসের আড়ালেও সে নিজেকে ঢেকে রাখতে চায় না। জেলের ছাপ তার গায়ে লাগে নি। তার কারণ এ নয় যে সে নিরপরাধ। তার অপরাধ প্রমাণিত হয় নি, আপনি তো জানেন, সেটা এমন কিছু নতুন বা আশ্চর্য নয়। আইন এবং তার প্রয়োগপদ্ধতি দুই অতি বিচিত্র ব্যাপার। নিতান্ত নির্দোষ লোকও যেমন অনেক সময় তার জালে জড়িয়ে পড়ে, তেমনি বহু দোষী ব্যক্তি কোনো একটা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি যার কথা বলতে যাচ্ছি, সে এই দ্বিতীয় দলের।

    “ডিটেকটিভ গল্পের মতো রহস্যের আবরণটা শেষ পর্যন্ত ঝুলিয়ে না রেখে শুরুতেই তুলে দেওয়া যাক। সে ব্যক্তিটি স্বয়ং আমি, আপনার এই দুর্মুখ পত্রলেখক। কি, চমকে উঠলেন তো?….”

    না, চমকাই নি। অজ্ঞাতসারে চোখ দুটো একবার শুধু চিঠির শীর্ষ ও তলদেশটায় চকিতে ঘুরে এল। যা অনুমান করেছিলাম তাই। নাম এবং ঠিকানা দুই-ই অনুপস্থিত।

    এর পরে লেখক তাঁর দীর্ঘ কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। পুরোপুরি পুনরুক্তির লোভ ত্যাগ করছি—দুটো কারণে! এক নম্বর—তার মধ্যে বিকৃত মানব-মনের এমন সব বিস্ময়কর তথ্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে, যা আমি বিশ্বাস করলেও আমার পাঠকবৃন্দের কাছে নিতান্ত অবিশ্বাস্য এবং অবান্তর বলে মনে হবে। দু নম্বর—প্রগাঢ় বীভৎস রসের এমন স্বচ্ছন্দ পরিবেশন কোনো কোনো কোমলহৃদয় পাঠক-পাঠিকার স্পর্শকাতর স্নায়ুদেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। অন্তত আমার প্রতি বিশেষ বন্ধুভাবাপন্ন কয়েকটি সাময়িক পত্র সেই অভিযোগ তুলে আসর গরম করবার চেষ্টা করবেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

    কেবলমাত্র অনুমানের উপর ভিত্তি করে একথা বলছি না। এর নজির আছে এবং আশা করি এই সূত্রে তার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

    ছ-সাত বছর আগেকার কথা। কোনো সুপরিচিত সাহিত্যিক তখন অল-ইণ্ডিয়া রেডিও’র কলকাতা কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। সম্ভবত তাঁরই উদ্যোগে আমার রচনা থেকে সংগৃহীত কয়েকটি কাহিনীর নাট্যরূপ বেতারে পরিবেশন করবার প্রস্তাব এল। আমি সম্মতি দিলাম। শর্ত রইল নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে। আমি মফঃস্বলে থাকার দরুন এ বিষয়ে খানিকটা অসুবিধা দেখা দিয়েছিল। সে কথা এখানে বক্তব্য নয়।

    যথাসময়ে ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে বিজ্ঞপিত হল, পর পর ছ’টি নাটক অভিনীত হবে। তিনটি কি চারটি প্রচারিত হবার পর দীর্ঘকাল অনুষ্ঠানসূচীতে বাকী ক’টির কোনো উল্লেখ না দেখে স্টেশন ডিরেক্টর মহাশয়কে লিখতে হল, ওগুলোর সম্বন্ধে কি স্থির করলেন জানালে বাধিত হব এবং এ বিষয়ে আমার কাছে যে ডজনখানেক অনুসন্ধান পত্র জড়ো হয়েছে, তাদের কৌতূহল নিবৃত্তির সুবিধা হবে। উত্তরে বলা হল, আপাতত আমার আর কোনো কাহিনীর নাট্যরূপ প্রচার করা হবে না। বললাম, তাহলে সেইমতো আর একটি বিজ্ঞপ্তি ‘বেতার-জগতে’ প্রকাশ করুন। ডিরেক্টর অফিস সংক্ষেপে জানালেন, তার কোনো প্রয়োজন দেখি না।’

    মনে করলাম, দু-একটি নাটক এবং অভিনয় সম্বন্ধে আমি কিঞ্চিৎ বিরূপ মন্তব্য করেছি, এটা বোধ হয় তারই প্রতিক্রিয়া। আসল ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলাম বেশ কিছুদিন পরে।

    যে মন্ত্রিবরের আদেশক্রমে আমাকে একদিন কলকাতার বৃহৎ জেল থেকে মফঃস্বলের ক্ষুদ্রতর জেলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তিনি তখন গদিচ্যুত। তাঁর স্থলে যিনি নতুন অধিষ্ঠিত, তিনি হয়তো আমার সাহিত্যিক কার্যকলাপ তেমন বিপজ্জনক মনে করেন নি। অতএব নির্বিবাদে রাজধানীতে ফিরে এসেছি এবং এমন একটি বিশিষ্ট জেলের কর্তৃত্বভার আমার হাতে দেওয়া হয়েছে, যেখানে গোড়া-থেকে-পুরোপুরি-জেল-গোষ্ঠীভুক্ত আমিই বোধ হয় প্রথম ভারতীয়। এই ক’বছরে সাহিত্যিক মহলে সাক্ষাৎ পরিচয়ের সূত্রপাত হয়েছে, এবার সেই সুযোগ আরও বিস্তৃত হল। তাঁদেরও কারও মুখে একদিন জানতে পারলাম, আকাশবাণীর নাট্যশালায় আমার কাহিনীর উপর্যুপরি অভিনয় জন-দুই প্রবীণ সাহিত্যিককে অত্যন্ত বিচলিত করে তুলেছিল এবং তাঁরাই অগ্রণী হয়ে কোনো ইংরেজী দৈনিকপত্রে কয়েকখানা কড়া চিঠি প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল—এই সমস্ত বীভৎস ‘ক্রাইম-স্টোরী’ বহু সুকুমারমতি বেতার-শ্রোতার অন্তরে ‘বিভীষিকার উদ্রেক করছে, তরুণ-তরুণীদের মনে পাপের প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তুলে তাদের বিপথে চালিত করছে, ইত্যদি ইত্যাদি। সুতরাং এদের প্রচার অবিলম্বে বন্ধ করা হোক।

    স্থানীয় বেতার কর্তৃপক্ষ চিঠিগুলোকে বিশেষ আমল দেন নি, কিন্তু দিল্লীর কর্তারা হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠলেন। সম্ভবত সেখানে কিছুটা সরাসরি তদ্বিরাদি হয়ে থাকবে। কলকাতার অফিসে নাকি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, কাহিনীগুলো ঠিক ‘ক্রাইম-স্টোরী’ নয়, যে গ্রন্থ থেকে তাদের সংগ্রহ করা হয়েছে, অল্পদিনেই সেটি প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এবং চিঠিগুলোতে যে-সব আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তার কোনো ভিত্তি নেই।

    মিনিস্ট্রি অব্ ইনফরমেশন অ্যা ব্রডকাস্টিং এ কৈফিয়তে সন্তুষ্ট হলেন না। আদেশ হল—অভিনয় বন্ধ কর।

    বলা বাহুল্য, ইংরেজী দৈনিকে করেসপণ্ডেন্ট বা পত্রদাতার যে নাম ছিল সেটা কাল্পনিক।

    এই কৌতুকাবহ তথ্যটি যিনি আমাকে শুনিয়েছিলেন, আসল লেখকদের নামও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমি সে সম্বন্ধে নীরব রইলাম। উভয়েই সাহিত্যক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত, তবে যদ্দুর শুনেছি, পাঠকমহলে বর্তমানে তেমন সমাদৃত নন। যাক সে কথা।

    আজ যে নির্লজ্জ এবং নিরাবরণ স্বীকারোক্তি আমার সামনে খোলা রয়েছে, তার কাছে সেদিনকার বেতার প্রচারিত কাহিনীগুলো নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য। এর হুবহু চিত্রটা যদি প্রকাশ করি, আমার শির লক্ষ্য করে শুধু যে একদল সৎ সাহিত্যিক ও সম্পাদকের তীক্ষ্ণ লেখনী উদ্যত হবে তাই নয়, পুলিসের বাণও নিক্ষিপ্ত হতে পারে। সুতরাং শুধু অংশবিশেষের উল্লেখ করছি; তাও অনেক ক্ষেত্রে আমার নিজের ভাষায় ‘কোটিং’ দিয়ে।

    পত্রলেখক জানাচ্ছেন—আমার কাহিনীর প্রধান চরিত্র আমার স্ত্রী। ধরুন তার নাম মন্দাকিনী। তাকে নিয়েই উদ্বোধন, তাকে দিয়েই উপসংহার। সুতরাং একেবারে বিয়ের রাত থেকে শুরু করা যাক। না, প্রেম-ট্রেমের ব্যাপার কিছু নেই। বিয়ের আগে তাকে দেখি নি, এমন কি ছবি পর্যন্ত না। সম্বন্ধটা আমার বাবা এবং তার বাবা মিলে স্থির করেছিলেন, যেমন আগেকার দিনে হত, বিশেষ করে আমাদের মতো পরিবারে। আমার ঠাকুর্দার ছিল কতকগুলো পেটেণ্ট ওষুধের ব্যবসা। তার সঙ্গে কয়েকটা বাজার-চলতি নামকরা ওষুধের এজেন্সি নিয়ে কারবারটাকে বেশ বাড়িয়ে তুলেছিলেন। তার মুলে কিছু গোপন রহস্য ছিল, আজকের দিনে যা সকলেই জেনে ফেলেছে এবং ব্যাপকভাবে চালাচ্ছে। অর্থাৎ ঐসব ওষুধের খালি শিশি সংগ্রহ করে আমরা আমাদের নিজেদের তৈরী রসায়ন বা বটিকা ভরে দিতাম। তার জন্যে আমাদের একটা ছোটখাটো কারখানা ছিল। আমি তার দেখাশুনা করতাম। বিশেষ করে সেই উদ্দেশ্যেই বাবা আমাকে বি.এস-সি পাস করিয়েছিলেন। আমার যা কাজ, তাতে অতখানি বিদ্যার দরকার ছিল না। নানা রকমের জংলী গাছগাছড়া সংগ্রহ করে তার নির্যাস বের করা এবং প্রয়োজনমত রং-টং মেশানো—সেসব আমাদের কর্মীরাই করত। যে জিনিস তৈরী হল তার গুণাগুণ নিয়ে আমরা কখনও মাথা ঘামাই নি। প্রথম প্রথম এ নিয়ে খানিকটা মন খুঁত-খুঁত করলেও অল্পদিনেই সেটা কাটিয়ে উঠেছিলাম।

    এই পরিবারে এবং এই পরিবেশে মানুষ হয়ে রোমান্স বা পূর্বরাগের চর্চা করবার মতো সময় সুযোগ বা মনোবৃত্তি সব কিছুরই অভাব ছিল। সুতরাং বিয়েটাকে নিছক দৈহিক এবং সাংসারিক প্রয়োজন বলে ধরে নিয়ে লক্ষ্মীছেলের মতো পিতৃ-আজ্ঞা পালন করেছিলাম।

    আমার স্ত্রী যে পরিবারের মেয়ে সেখানে স্ত্রী-শিক্ষার দৌড় ছিল গ্রাম্য পণ্ডিতের পাঠশালা পর্যন্ত। তার পর রান্না-বান্না এবং যাবতীয় গৃহকর্মে হাতেখড়ি, নানারকম ব্রত ও পূজানুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে ‘পতি পরম গুরু’ নামক বৃহৎ আদর্শে দীক্ষাদান। সে বিষয়ে যে কোনো রকম ত্রুটি হয় নি, তার প্রমাণ বিয়ের রাতেই পাওয়া গেল।

    আপনারা অর্থাৎ সাহিত্যিক নামক বাস্তবজ্ঞানহীন ভাবপ্রবণ ব্যক্তিরা বলে থাকেন, স্ত্রীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করবার আগে তার মনকে জয় করতে হয়, ধীরে ধীরে ধৈর্যের সঙ্গে মধুর কলাকৌশলের ভিতর দিয়ে তার নারীসুলভ লজ্জা সঙ্কোচময় জড়িমার ঘুম ভাঙিয়ে—ইত্যাদি ইত্যাদি, আমি তার কোনোটাই করি নি। বাসর জাগতে যে মেয়েগুলো এসেছিল, তারা সরে যেতেই নিজের হাতে দরজা বন্ধ করে কোনো রকম ভূমিকার পথে না গিয়ে সরাসরি তার উপর পুরুষের সনাতন অধিকার প্রয়োগ করেছিলাম। সেই উদগ্র লালসার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সে যে কিছুটা যন্ত্রণা বোধ করেছিল, সেটা সহজেই বুঝতেই পেরেছিলাম। তখন তার বয়স চৌদ্দ পূর্ণ হয় নি, কিন্তু কথায় বা ব্যবহারে কিছুমাত্র আপত্তি প্রকাশ করে নি। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখকে তুচ্ছ করে স্বামীর ইচ্ছার কাছে নিজেকে একান্তভাবে বলি দেওয়া—এটাকেই সে ধর্ম বলে জেনেছিল এবং নিঃশব্দে পালন করেছিল।

    আমার দৈহিক দাহ মিটে যেতেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরের দিকে যখন ঘুম ভাঙল, দেখি সে পাশে নেই। জ্যৈষ্ঠ মাস। ছোট শহর। বিদ্যুতের এলাকা নয়। অথচ বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল। উপরের দিকে তাকাতেই কারণটা ধরা পড়ল। আমার শিয়রের কাছে বসে একটা হাতপাখা দিয়ে সে আমাকে বাতাস করছে। বোধ হয় সারারাত ধরেই চালিয়েছে। বেশ লাগল। তাই বলে মনটা যে স্নেহ ও কৃতজ্ঞতায়, আপনারা যাকে বলেন উদ্বেলিত হয়ে উঠল তা নয়। স্ত্রীর কাছে যা প্রাপ্য তাই সে দিয়েছে। এই তো তার কাজ। তবু নেহাত কিছু একটা বলতে হয় তাই বললাম, একি! তোমাকে হাওয়া করতে কে বলেছে?

    মন্দাকিনী কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নোয়াল।

    —তুমি বুঝি একটুও ঘুমোও নি?

    মৃদু কণ্ঠে উত্তর এল, আপনার খুব ঘাম হচ্ছিল।

    —তাই বলে সারারাত ধরে এত কষ্ট করে পাখা চালাতে হবে!

    —এতে আমার কোনো কষ্ট হয় না।

    কষ্ট যে তার কোনো কিছুতেই হয় না, সে প্রমাণ দীর্ঘজীবন ধরে প্রতি মুহূর্তে দিয়ে গেছে। কষ্ট হয় না—এ কথাটা ঠিক নয়। মানুষের শরীর তো! আমার কথা হল, আমার জন্যে সব কষ্টই সে স্বচ্ছন্দে এবং হাসিমুখে সয়ে নিতে পারে এবং তাই নিয়েছে। শুধু আমার জন্যে কেন, সমস্ত সংসারের জন্যে।

    অনেকদিন আগেই আমার মা মারা গিয়েছিলেন। সুতরাং বাবার সেবাশুশ্রষা, যত্ন- আত্তির সব ভারও ছিল তার হাতে। কেউ বলে দেয় নি। স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে সে নিজেই তুলে নিয়েছিল। তার বদলে বাবার কাছ থেকেও যে বিশেষ কোনো আদর স্নেহ কিংবা মিষ্টি ব্যবহার পেয়েছে তা নয়। বরং কোথাও কোনো ত্রুটি হলে তৎক্ষণাৎ সেটা তাকে কড়াভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

    আমরা পিতাপুত্র দুজনেই ছিলাম ভোজন-বিলাসী। রোজকার রান্নার ব্যাপারটার পদ ও পরিমাণ দু-দিকেই বেশ ব্যাপক আকারে চালানো হত। কিন্তু ‘ঠাকুর’ রাখবার মতো বিলাসকে আমরা কোনোদিন প্রশ্রয় দিই নি। চাকর একটা ছিল, বাকী সব মন্দাকিনী। আমরা একসঙ্গে খেতে বসতাম এবং আশমিটিয়ে খেতাম। সে অবিরাম যুগিয়ে যেত। তারপর কী থাকত, তা নিয়ে আমরা কখনও মাথা ঘামাই নি। মেয়েদের খাওয়া-পরার দিকে নজর দেওয়া “মেনীমুখো” পুরুষের লক্ষণ। মাঝে মাঝে খোঁজ নিতে ইচ্ছে হলেও কেমন যেন পৌরুষে বাধত। মনে হত, তাতে করে নিজেকে অনেকখানি নামিয়ে আনা হবে।

    বাজার করবার ভার ছিল বাবার হাতে। কিন্তু ভালো ভালো জিনিসের লোভ যতখানি হাত ততটা দরাজ ছিল না। রসনার সঙ্গে পকেটের বিরোধ প্রায়ই লেগে থাকত এবং তার জের গিয়ে পড়ত পুত্রবধূর উপর। বাজারে বেরোবার সময় রোজই একবার জিজ্ঞাসা করতেন, ‘কি কি আনতে হবে, বৌমা?’ প্রশ্নটা অনাবশ্যক। ‘বৌমা’ তো গৃহিণী নয়, রাঁধুনী মাত্র। কোন্ কোন্ জিনিসের প্রয়োজন, স্থির করবার কর্তা তিনি নিজেই। মন্দাকিনী তা জানত। তাই মৃদুস্বরে শুধু জানাত, মাছ তরকারী আপনার যেটা পছন্দ হয় আনবেন। মশলাপাতি, ঘি, তেল সব আছে।

    ওসব জিনিস মাসের গোড়াতেই পুরো মাসের মতো সংগ্রহ করা হত। সে ফর্দ তিনি নিজে করতেন। মাঝে মাঝে ঘাটতি পড়ত। সেদিনই হত মুশকিল। ‘বৌমা’ হয়তো ঘিয়ের টিনটা হাতে করে ভাঁড়ার থেকে বাইরে পা দিয়েছে, শ্বশুর অমনি গর্জে উঠতেন, ‘এই তো সেদিন ঘি নিয়ে এলাম, এরই মধ্যে শেষ করেছ?

    মন্দা জবাব দিত না, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকত। কখনও বলতো না, ইদানীং পর পর কদিন রাত্রে রুটি-পরটার বদলে লুচি হয়েছে বলেই ঘিটা যদ্দিন যাবার কথা ছিল তা যায় নি।

    মাঝে মাঝে বাবা আবার আমাকে মধ্যস্থ মেনে বসতেন, বৌ-এর সামনে ডাকিয়ে এনে বলতেন, তুমি কি বল, পুরো মাসের হিসেবমত জিনিস আনা হচ্ছে, আর পঁচিশ তারিখ না যেতেই বাড়ন্ত—এরকম করলে চলবে কেমন করে?

    আমি মুখে কোনো জবাব দিতাম না বটে, কিন্তু জ্বলন্ত চোখে বৌ-এর দিকে তাকাতাম। চোখ না তুলেও সে নিশ্চয়ই দেখতে পেত। এই অপব্যয়ের সব অপরাধ যে তারই, সে বিষয়ে পিতার সঙ্গে পুত্রের মতান্তর হতে পারে, সেটা তার ধারণার অতীত। সব অভিযোগ নিঃশব্দে মেনে নিয়ে কাজে গিয়ে লাগত। উনুনে হয়তো কিছু একটা বসিয়ে এসেছে, পুড়ে গেলে রক্ষা থাকবে না!

    ‘বন্ধু’ বলতে যা বোঝায় তেমন কেউ আমার ছিল না। আপনার সাহিত্যিক ডাইঅ্যাগ্‌নৌসিস্ যদি এই হয় যে তার কারণ কারও সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠবার মতো হৃদয় আমার মধ্যে নেই, আমি আপত্তি করব না। জীবনে আর যা কিছুর চর্চা করে থাকি না কেন, হৃদয়চর্চা কখনও করি নি। ব্যবসায়-সুত্রে কারও কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। তার মধ্যে একজনের নাম ছিল রমণীমোহন (বলা বাহুল্য আসল নামটা আলাদা)। কাজের কথার বাইরে যেসব আলাপ সে করত (প্রলাপ বললেই হয়), তার প্রায় সবটুকু জুড়ে থাকত একটি বিশেষ রমণী, অর্থাৎ তার বৌ। তারই হাসি-কান্না, মান-অভিমান, রাগ- অনুরাগ, খেয়াল-খুশির লম্বা ফিরিস্তি যখন শুনতাম, আমার মাঝে মাঝে মনে হত, কই মন্দার মধ্যে তো এর কোনোটাই কখনও দেখতে পাই না! রমণীমোহনের বৌ-এর মতো সে কোনোদিন ‘অকারণ পুলকে’ আমার গলা জড়িয়ে ধরে নি, অহেতুক অভিমানে ছলছল চোখে জানালার গরাদের পাশেও বসে থাকে নি! সে ‘বিচিত্ররূপিণী’ নয়, তার একটি মাত্র রূপ—উদয়াস্ত মুখ বুজে কাজ করে, সংসারের প্রয়োজন মেটায়; অস্তের পরেও তার কাজ থাকে, সেটা আমার প্রয়োজন মেটানো। তাও সে মুখ বুজেই করে।

    আমাকে ভুল বুঝবেন না। সেজন্য আমার কোনো আপসোস ছিল না, কোনো অভাবও কোনোদিন বোধ করি নি। বরং মন্দা যে রমণীমোহনের বৌ-এর মতো হাবভাব ছলা- কলার ধার ধারে না, কথায় কথায় বায়না ধরে না, কোনো কিছু নিয়ে আবদার করে না, সেজন্য আমি মনে মনে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম।

    একদিন সন্ধ্যার দিকে রমণীমোহন গম্ভীর মুখে আমার দোকানে ঢুকে বলল, চল বেরোই।

    —কোথায়?

    —চল না? যেতে যেতে বলবো।

    আমি একটু চিন্তিত হয়েই ওর গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। রাস্তায় কোনো কথা হল না। নিউ মার্কেটের সামনে গাড়ি রেখে যখন নেমে পড়ল, তখনও তার মুখ ভার। বললাম, কী ব্যাপার বল দিকিন?

    মার্কেটে ঢুকতে ঢুকতে তেমনি মুখেই বলল, একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি ভাই।

    —কী ভুল করলে?

    —কাল ছিল আমাদের বিয়ের অ্যানিভারসারী, ফিফ্থ্ মানে পঞ্চবার্ষিক উৎসব। আমার ছাই মনে নেই। এদিকে কারখানায় স্ট্রাইক, মাথার ঠিক ছিল না। ফিরতেও রাত করে ফেলেছি। ঘরে ঢুকে বৌ-এর দিকে নজর পড়তেই মনে পড়ে গেল। একটা নেহাত আটপৌরে ময়লা কাপড় পরে হাঁড়িমুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে খালিহাতে ঢুকতে দেখে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল। সারারাত ঘরে আসে নি। অনেক সাধ্যসাধনা করেও পাশের ঘরের দোর খোলানো গেল না। একটা বেশ ভালোরকম প্রেজেন্ট নিয়ে না গেলে আজ আর বাড়িমুখো হবার উপায় নেই।

    আমি এত জোরে হেসে উঠেছিলাম, আশেপাশের লোকগুলো নিশ্চয়ই মনে করে থাকবে, লোকটা হয় পাগল, নয় একোবারে গেঁয়ো অর্থাৎ কোলকাতার মতো সভ্য শহরে থাকবার যোগ্য নয়। কি করব বলুন, ব্যাপারটাকে নিছক হাস্যকর ন্যাকামি ছাড়া আমি আর কোনো ভাবে দেখতে পারি নি। আপনি হয়তো আপনার সাহিত্যিক দৃষ্টি দিয়ে এর মধ্যে একটা সম্রাট সাহাজান-সুলভ গভীর প্রেম আবিষ্কার করে বসবেন, আমার সে দৃষ্টি নেই। তাছাড়া আমার জীবনে এরকম দূরে থাক, এর কাছাকাছি কোনো অভিজ্ঞতাও কোনোদিন ঘটে নি এবং ঘটতে পারত না। বিয়ের অ্যানিভারসারী উদযাপন পড়ে মরুক, তার তারিখটাও মনে করে রাখি নি। আমার বিশ্বাস, আমার স্ত্রীও রাখে নি।

    রমণীমোহন সেদিন একটা কাণ্ড করে বসল। একগাদা বেনারসীর ভিতর থেকে অনেক বাছাবাছির পর (তার মধ্যে আমাকেও দু-একটা ‘হ্যাঁ’ ‘না’ বলতে হয়েছে) দু-খানা শাড়ি পছন্দ করল। একটা ভীষণ জমকালো, আর একটা ওরই মধ্যে একটু যাকে বলে sober—সেখানা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, এটা তুমি নাও।

    ‘আমি!’ রীতিমতো চমকে উঠলাম।

    —আহা, ভয় পাবার কি আছে? ঘরে বৌ থাকলে মাঝে মাঝে দু-একটা বাড়তি খরচ করতে হয়। এমন কিছু দামও নয়। সঙ্গে টাকা না থাকলে আমি চালিয়ে দিচ্ছি। যখন সুবিধে হবে দিও।

    –বৌ-এর শাড়ি কেনা আমার কাজ নয়, ওটা বাবার ডিপার্টমেন্ট। তাছাড়া এরকম দামী শাড়ি সে কখনও পরে না।

    —দাও না বলেই পরে না। একদিন দিয়ে দ্যাখ, কত খুশী হবে।

    ততক্ষণে বিল এসে গেছে এবং পুরো টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি বিরক্তির সুরে বললাম, কী যে কর তার ঠিক নেই। কথা নেই বার্তা নেই, হুট্ করে একটা শাড়ি নিয়ে গিয়ে উঠবো কী বলে? পূজোটুজোর সময় হলেও না হয়—

    —বৌকে প্রেজেন্ট্ দেবার আবার সময়-অসময় আছে নাকি? নাও!

    কাগজের বাক্সটা জোর করে আমার হাতে গুঁজে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠল—চল চল, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে জুয়েলারীর দোকানটাও একবার ঘুরে যেতে হবে।

    বাক্সটা লুকিয়ে নিয়ে বাড়ি ঢুকলাম এবং লুকিয়ে রেখে দিলাম। তখন বাবা বাড়ি ছিলেন, মন্দাও রান্না-বান্না নিয়ে ব্যস্ত। রাত্রে যখন শুতে এল, কাপড়খানা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম, দ্যাখ তো কেমন হল?

    এখানে একটা গোপন কথা স্বীকার করছি, যদিও জানি, হয়তো বিশ্বাস করতে দ্বিধা করবেন। কিন্তু সত্য বলছি, শাড়িটা দেবার পর মন্দার মুখে খুশির ঝলক না হলেও অন্তত একটা আভাস দেখতে পাব, এইরকম একটু আশা মনের মধ্যে ছিল। কিন্তু তার বদলে দেখলাম জিজ্ঞাসা। পরে ভেবে দেখলাম, সেইটাই স্বাভাবিক। বস্ত্র নামক বস্তুটিতে খাদ্যের মতো নিতান্ত দৈহিক প্রয়োজন হিসাবেই সে দেখে এসেছে। সেটা যে কখনও ‘উপহার’-এর মতো অনাবশ্যক রূপ নিতে পারে, সে অভিজ্ঞতা তার ছিল না। কাজেই তার মুখ থেকে যে কথাটি বেরিয়ে এল, সেটা একটি সরল প্রশ্ন—’এটা কার?’

    —কার আবার, তোমার।

    —’আমার!’ এটা নিছক বিস্ময়। ‘আমার তো শাড়ি রয়েছে!

    —থাকলই বা, এটা তোলা হিসেবে রইল। কোথাও যেতে আসতে পরবে।

    —বাবা জানেন?

    আমার পৌরুষে কিঞ্চিৎ আঘাত লাগল, যদিও লাগা উচিত নয়। উষ্মার সুরে বললাম, সব কিছুই যে বাবাকে জানাতে হবে, তার কি মানে আছে?

    —উনি শুনলে রাগ করবেন।

    কথাটা মিথ্যা নয়। তাই আমার মুখে তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর যোগাল না। মন্দা মুহূর্তকাল কি ভেবে নিয়ে বললে, দোকানে ফেরত দিতে গেলে নেবে না?

    আমি কিছু বলবার আগেই হঠাৎ যেন সব সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে গেছে, এমনি ভাবে বলে উঠল, ভালই হয়েছে, ৭ই বীণার বিয়ে, আজই সকালে চিঠি এসে গেছে। একটা শাড়ি তো দিতে হত, এটা দিলেই হবে।

    বলে বেশ “খুশি” হয়েই মন্দা কাপড়খানা বাক্সে ভরে আলমারিতে তুলে রাখল। এই “খুশিই” কি আমি দেখতে চেয়েছিলাম?

    বীণা আমার পিসীমার মেয়ে। কাপড় দেখে বাবা যথারীতি মন্দার উপরই এক হাত নিতে ছাড়লেন না, যেন সে-ই আমাকে দিয়ে এমন একটা দামী শাড়ি আনিয়েছে। মেয়েমানুষকে তো রোজগারের ধান্দায় বেরোতে হয় না, পয়সার দাম বুঝবে কোত্থেকে— ইত্যাদি মন্তব্য তার মতো আমিও নীরবে গ্রহণ করলাম। বললাম না যে, এর ভিতরে ওর কোনো হাত নেই। কেন বলতে যাব? আপনি হয়তো বলবেন, মন্দার এই স্বার্থত্যাগের জন্যে তার উপর আমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত ছিল, অন্তত কিছুটা সহানূভূতি সে দাবি করতে পারত। কিন্তু তার এই প্রত্যাখ্যান তাকে আমার কাছে বড় করা দূরে থাক, আরও ছোট করে দিল। ‘প্রত্যাখ্যান’ কথাটা বোধহয় ঠিক হল না। তার মধ্যে একটা জোর থাকে; যা ওর চরিত্রে একেবারেই ছিল না। একে বলা যেতে পারে গ্রহণ করার অক্ষমতা। মন্দাকে যদি আমি ভালোভাবে না জানতাম, হয়তো তার উপরে রাগ হত, এই ভেবে যে সে আমার স্বামিত্বের অধিকারকে অগ্রাহ্য করছে, আমাদের ভিতরকার যে-সম্পর্কটা— প্রভু ও দাসীর সম্পর্ক—সেই বিয়ের রাত থেকে মেনে আসছিল, তাকে যেন অস্বীকার করছে। কিন্তু মন্দাকিনীকে আমার চিনতে বাকী নেই, একথা তার সম্বন্ধে ভাবাই যায় না। এটা আর কিছু নয়, স্ত্রী হিসেবে তার নিছক অযোগ্যতা। কে জানে, রমণীমোহনের মাথার ভূতটা হয়তো কোনো দুর্বল মুহূর্তে আমার মাথায় চেপে থাকবে। মনে মনে তার বৌ-এর পাশে আমার বৌকে কখন বসিয়ে ফেলেছিলাম। ধাক্কা খেয়ে ভুল ভাঙল। হয়তো ঐ কল্পিত তুলনার ফলেই ও আমার কাছে আরও খেলো হয়ে গেল। স্ত্রীকে শ্রদ্ধা বা প্রীতির চোখে আমি কোনোদিন দেখিনি, এই ঘটনার পর থেকে তাকে রীতিমত ঘৃণা করতে শুরু করলাম।

    আপনার অনুচ্চারিত বিশেষণটা আমি শুনতে পাচ্ছি, বলছেন লোকটা কি পাষণ্ড! কি করবো বলুন? আমি যা তাই, আপনি কী ভাববেন তাই ভেবে মনের আসল রূপটা চাপা দিতে চাই না। তাহলে এই চিঠি লেখার কী প্রয়োজন ছিল?

    তবে আপনার তূণে যে-সব কড়া কড়া বিশেষণ আছে, সবগুলো যেন এখনই-নিঃশেষ করে বসবেন না। তাদের আসল প্রয়োজন দেখা দেবে শেষ অঙ্কে। অনাবশ্যক ভূমিকা না বাড়িয়ে এবার সেই দিকেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।

    আমার এবং আমাদের সংসারের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে মন্দাকিনী কোথাও কোনো ত্রুটি রাখে নি। ফাঁক ছিল শুধু এক জায়গায়। আমাদের একটি বংশধর সে দিতে পারে নি। বন্ধ্যা হলে হয়তো বা মার্জনা পেতে পারত, কিন্তু তার অপরাধ তার চেয়েও গুরুতর। সন্তান সে ধারণ করেছিল, জীবিতাবস্থায় পৃথিবীতে আনতে পারে নি। মাস পূর্ণ হবার আগে কি সব জটিলতা দেখা দেয়, যার ফলে হাসপাতালে না পাঠিয়ে উপায় ছিল না। ডাক্তারেরা এসব ক্ষেত্রে যা করে থাকেন তাই করলেন, অর্থাৎ ওঁদের ভাষায়—ফলের আশা ছেড়ে দিয়ে গাছের দিকেই পুরো নজর দিলেন, অনেক ধাক্কা ও ধকল খেয়ে ‘গাছ’ শেষ পর্যন্ত রইল বটে কিন্তু জানা গেল, সে চিরদিনের তরে নিষ্ফলা হয়ে গেছে।

    মোটা টাকা বেরিয়ে যাওয়ায় বাবার মেজাজ আগে থেকেই তেতে ছিল, তার উপর ডাক্তার এসে যখন এই শুভ সংবাদটি শুনিয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আগুন হয়ে উঠলেন। আমার উপর হুকুম হল, ‘আবার বিয়ে কর’। আমার বিশেষ আপত্তি ছিল না। মন্দাকে দিয়ে সত্যিই আর কাজ চলছিল না। কিন্তু রমনীমোহন অজান্তে কখন আমার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। তার ঘরে যে চীজটি আছে, সেই রকম কিংবা তার কাছাকাছি কেউ এসে যদি ঘাড়ে চাপে, তখন কি করব। বাবা এদিকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যেতে লাগলেন। বৌ তাঁকে একটি পৌত্র-মুখ-দর্শনে বঞ্চিত করেছে, এইটাই তাঁর একামাত্র কারণ নয়, সংসারের চাকাগুলোকেও সে আগের মতো স্বচ্ছন্দ গতিতে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না, তাঁর সেবা-যত্ন-বিরামের ব্যবস্থায় মাঝে মাঝে ত্রুটি দেখা দিচ্ছে এবং সে-সব পূরণ করতে একটি বাড়তি ঝি-এর প্রয়োজন হয়েছে।

    যাই হোক, বেশি দিন আর তাঁকে এই অসুবিধাগুলো ভোগ করতে হল না। ইদানীং যাকে তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারছিলেন না, সেই পুত্রবধূর কোলে মাথা রেখেই হঠাৎ একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

    গোটা ব্যবসাটা আমার হাতে এসে পড়ল। সেই দিকেই বেশি নজর দিলাম। মন্দা ফালতু ঝিকে ছাড়িয়ে দিয়ে গোটা সংসারের ভার আবার নিজের হাতে তুলে নিল। আমার চিরাচরিত অভ্যাস এবং প্রয়োজনগুলো কোথাও বিশেষ বাধা পেল না। সে বিষয়ে তার দৈহিক অক্ষমতা যতই থাক, অতিরিক্ত উৎসাহ দিয়ে তাকে ঢেকে রাখবার চেষ্টা করছে, সেটুকু বুঝতে কোনো অসুবিধা ছিল না। সেটা লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে উঠতাম।

    —এতদিন হাসপাতালে কাটিয়ে এলে, ডাক্তারে ও ওষুধে এক ঝুড়ি টাকা বেরিয়ে গেল, এদিকে চেহারায় তো তার কোনো লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। কী হয়েছে, খুলে বলবে তো?

    —হবে আবার কী? মুখে একটা মৃদু হাসি টেনে আনবার চেষ্টা করত মন্দা। তাতে তাকে আরও কুৎসিত দেখাতো, আমি তো ভালোই আছি।

    —তবে শরীর সারছে না কেন?

    —আর কত সারবে? এর চেয়ে মোটা তো আমি কোনো কালেই ছিলাম না।….বলে কোনো একটা কাজের অছিলা করে তখনই আমার সামনে থেকে সরে যেত।

    .

    মন্দার এক ভগ্নীপতি থাকতেন পশ্চিমের কোনো স্বাস্থ্যকর শহরে। নামটা আপনার পক্ষে নিষ্প্রয়োজন, সুতরাং উহ্য রইল। কোলকাতায় বড় একটা আসতেন না। একবার কী কাজে আসতে হল। যাবার আগে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। শ্যালিকা এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মন্দা হাসিমুখে বলল, চিনতে পারছেন না?

    –পেরেছি, তবে অতি কষ্টে। এ কী চেহারা হয়েছে তোমার?

    আমি বাড়িতেই ছিলাম। শ্যালিকার সম্বন্ধে তাঁর উদ্বিগ্ন প্রশ্নের উত্তরে গত কয়েক মাসের একটা মোটামুটি ইতিহাস দিলাম। বলা বাহুল্য, এ বিষয়ে আমাদের তরফ থেকে চিকিৎসাদির যথাসাধ্য ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি হয় নি এবং তা সত্ত্বেও মন্দার স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি দেখা যাচ্ছে না—এই কথাটাই বোঝাবার চেষ্টা করলাম। আমার ভায়রাভাই বললেন, তার মানে একটা চেঞ্জ দরকার। তাহলে এক কাজ করা যাক, আমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। জল-হাওয়ার দিক দিয়ে জায়গাটা খুব ভালো। মাসখানেক থাকলেই সেরে উঠবে। না হয় আরও কিছুদিন কাটিয়ে আসবে। অনেকদিন দেখাশুনো নেই, ওর দিদিও খুব খুশী হবে। তাই করি, কী বলো?

    আমি বললাম, বেশ তো, আপনি নিয়ে যাবেন, তাতে আর আমার বলবার কি আছে? সেই সময়ে মন্দা এল চা এবং খাবার নিয়ে। তিনি খুশিমুখে তাঁর প্রস্তাব এবং আমার সম্মতি তাকে জানিয়ে দিয়ে বললেন, কাল সন্ধা সাতটায় গাড়ি। নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি সেরে আমি সাড়ে পাঁচটার আগে আসতে পারবো না, তুমি একেবারে তৈরী হয়ে থাকবে কিন্তু— আপনি একটু বসুন, আমি চুল বেঁধে আসি, তা বললে চলবে না। বাঁধা-ছাদা সব আগেই সেরে রাখবে।

    মন্দা চুপ করে রইল এবং ভগ্নীপতি চলে যেতেই বলল, কাল যখন আসবেন তুমি ওঁকে বুঝিয়ে বলো, আমার এখন যাওয়া হবে না।

    —কেন?

    কাপডিগুলো গোছাতে গোছাতে বলল, সংসারে আর কোনো লোক নেই, তোমাকে দেখবে কে? তাছাড়া

    ‘তাছাড়া’র ফিরিস্তি শোনবার আগেই শ্লেষের সুরে ঝাঁজিয়ে উঠলাম, এই শরীর নিয়ে যা দেখা দেখছ, সেটা কিছুদিন বন্ধ রাখলে কোনো ক্ষতি হবে না। তার চেয়ে বরং নিজেকে দেখবার চেষ্টা করো। এই পোড়া-কাঠের ওপর যদি একটু মাংস লাগাতে পার, তাহলেই আমি কৃতার্থ হবো।

    এর পরেও বোধহয় সে এখানকার ব্যবস্থার কথা তুলত। সব রকম অপমান এবং রূঢ় ব্যবহার সহ্য করবার এক অদ্ভুত শক্তি ছিল তার। ‘শক্তি’ না বলে তার অভাব বলাই বোধহয় ঠিক। এক ধরনের অসাড়তা। যাই হোক, তখনকার মতো আর কিছু বলবার সুযোগ আর তাকে দিলাম না, সশব্দে চেয়ারটা পেছনে ঠেলে দিয়ে উঠে পড়লাম।

    হাসপাতাল থেকে ফিরবার কিছুদিন পরে যে ঠাকুরকে সে ছাড়িয়ে দিয়েছিল, তাকেই কোত্থেকে খুঁজেপেতে ডেকে এনে নানারকম উপদেশ দিয়ে পরদিন সন্ধ্যার মুখে মন্দাকিনী এই প্রথম আমাকে ছেড়ে দূরে চলে গেল। যাবার আগে যথারীতি প্রণাম, সাবধানে থাকবার এবং অসুবিধা বোধ করলেই ফিরিয়ে আনবার অনুরোধ ইত্যাদি কোনো পর্বই বাদ যায় নি। চোখের জলও দেখেছিলাম। কিন্তু কিছুই আমার মনে এতটুকু স্নেহ বা করুণা জাগাতে পারে নি। নিজের চোখ দুটো অবশ্য দেখতে পাই নি, তবু নিশ্চয় করে বলতে পারি, তার মধ্যে তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু ছিল না।

    আজ ভাবছি, সেদিন তার চোখে জলের বদলে এক কণা আগুন যদি দেখতাম, হয়তো কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধা সে আমার কাছে পেলেও পেতে পারত, অন্তত এতটা হেয় এবং তুচ্ছ হয়ে যেত না। আপনি কী বলেন?

    য়া আশঙ্কা করেছিলাম তাই, মাসখানেক যেতে না যেতেই মন্দার চিঠি পেলাম, সে এরই মধ্যে অনেকখানি সেরে উঠেছে, আর ওখানে থাকবার দরকার নেই, সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন তাকে বাড়ি আনবার ব্যবস্থা করি।

    শ্যালিকার যে চিঠি পেলাম, তার বয়ান ঠিক উল্টো। মন্দার শরীরে কোনো উন্নতি হয় নি। বেশ কিছুদিন ওখানে থাকা দরকার। কিন্তু আমাকে এখানে একা ফেলে সে কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সুতরাং আমি যেন এদিকের কাজকর্মের কোনো একটা ব্যবস্থা করে অন্তত মাসখানেকের জন্যে ওখানে গিয়ে থাকি। তাহলে আমরা সকলেই খুব আনন্দিত হবো। অনেকদিন তোমাকে দেখি নি, তোমার দাদা তবু কালেভদ্রে কলকাতায় যেতে পারেন, আমার কোথাও নড়িবার উপায় নাই। ইত্যাদি।

    আমাদের কারবারের কথা আগেই বলেছি। তার মধ্যে কারচুপির অংশটাই বড়। কালক্রমে এইসব লাইনে আরও কিছু লোক এসে জুটল। শুধু প্রতিযোগীর সংখ্যাই যে বাড়ল তাই নয়, তার মধ্যে কয়েকজন রীতিমতো পেছনে লাগল। বাবা পাকা লোক, এদের সঙ্গে খানিকটা এঁটে উঠতে পারতেন। তিনি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে উঠল। ক্রমশ নানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম। শ্যালিকার নিমন্ত্রণ যখন এল, তখন আমারও এক পা নড়বার উপায় নেই। মন্দার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছে না এ খবর পেয়ে দুশ্চিন্তার বদলে বিরক্তিটাই বেড়ে গেল। এটা যেন তার ভালো না হবার পণ, এখানকার শত্রুদের মতো এই দুঃসময়ে সেও আমার পেছনে লেগেছে। তার উপরে তার ঐ প্যানপেনে ‘পতি-বিরহ’ অসহ্য আদিখ্যেতা বলে মনে হল। শ্যালিকার চিঠির উত্তরে অবশ্য তার ভগিনীর জন্যে যথারীতি উদ্বেগ প্রকাশের ত্রুটি হল না। সেই সঙ্গে তাঁর আমন্ত্রণ গ্রহণে অক্ষমতার জন্য ক্ষমা চাইলাম। আলাদা চিঠিতে মন্দাকে বেশ কড়া করে লিখলাম, রীতিমত সুস্থ হবার আগে ফিরে আসবার কোনো কথাই উঠতে পারে না, এবং আমার জন্যে তার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।

    এর পরে রমণীমোহনের স্ত্রী বা তার দোসর কোনো মেয়ে হয়তো লিখত, না, আমি এখনই যেতে চাই, কিংবা ঐ ধরনের একটা কিছু। কিন্তু আমার স্ত্রী একেবারে অন্য জাতের। সে কোনো কথাই লিখল না, অর্থাৎ স্বামীর ইচ্ছাকেই নিঃশব্দে মেনে নিল!

    যদি বলি, মেনে না নিলেই আমি মনে মনে খুশি হতাম এবং স্পষ্ট বা জোরালো হলেও আমার চিঠির একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ আশা করে বসে ছিলাম—আপনি বিশ্বাস করবেন কি, করবেন না। কিন্তু এটুকু জেনে রাখুন, সে আশা যখন পূরণ হল না, আমার মনটা তার উপরে শুধু তিক্ত নয়, বিষাক্ত হয়ে উঠল।

    মন্দার আর কোনো চিঠি আমি পাই নি, তার দিদিরও না। পরের চিঠিটা এল তার ভগ্নীপতির কাছ থেকে। বেশ কিছুদিন, তা প্রায় মাস দুই পরে। প্রথমে আমার কুশল সম্বন্ধে আশা প্রকাশ করে লিখেছেন, “বড়ই দুঃখের বিষয়, শ্রীমতী মন্দাকিনীর শরীর দিন দিন খারাপের দিকে যাইতেছে। বর্তমানে সে প্রায় শয্যাগত। এখানকার সর্বাপেক্ষা বড় ডাক্তারকে দেখাইয়াছি। তাঁহার মতে শ্রীমতীকে অবিলম্বে কলিকাতায় লইয়া গিয়া কোনো বিশেষজ্ঞের চিকিৎসাধীনে রাখা প্রয়োজন। এখানে একটি বিশেষ জরুরী কার্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছি। শীঘ্র ছাড়া পাইবার আশা নাই, নতুবা আমিই লইয়া যাইতাম। তুমি অতি সত্বর চলিয়া আসিবে। অন্য সকলে এক প্রকার আছে। ইতি।”

    অতি সত্ত্বর না হলেও কয়েকদিনের মধ্যেই আমাকে যেতে হল। দেখলাম, “শয্যাগত” শব্দটিকে আমার ভায়রাভাই যে ‘প্রায়’ নামক বিশেষণ দিয়ে মডিফাই অর্থাৎ মোলায়েম করবার চেষ্টা করেছেন, সেটা প্রকৃত ঘটনার দিকে চেয়ে নয়, আমার দিকে চেয়ে, আমি পাছে অতিরিক্ত বিচলিত হয়ে পড়ি আশঙ্কায়।

    মন্দার অবস্থা দেখে, তার ব্যাধির ইতিহাস এবং কাশির শব্দ শুনে আমি সত্যিই ‘বিচলিত’ হয়ে পড়লাম। বলা বাহুল্য, ওঁদের বা অন্য দশজনের মনে যে কারণ জাগবে, সে কারণে নয়। একে এই “শয্যা’ থেকে টেনে তুলে দাঁড় করাতে যে বিপুল অর্থ, পরিশ্রম, শুশ্রুষা অপব্যয় হবে, সেই চিন্তাই আমাকে চঞ্চল করে তুলল। তার চেয়েও বেশী মনে হল—একে দিয়ে আমি করবো কী?

    আশা করি, আমার কথাটা আপনি বুঝতে পারছেন। আপনার গল্পের নায়কদের মতো আমার মধ্যে কোনো রোমান্স নেই বা কোনোদিন হৃদয়-চর্চার ধার ধারি না, সে কথা আগেই জানিয়েছি। আমি রমণীমোহন নই, ‘প্রেম’জ্বরে কখনও ভুগি নি। দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রীতি এসব বড় একটা নিজেও পাই নি, অন্য কারও জন্যেও অনুভব করি না। নিছক ‘ইউটিলিটি’ বা প্রয়োজন ছাড়া ‘স্ত্রী’ নামক মানুষটিকে আর কোনো দিক থেকে দেখি নি। সেও কোনোদিন বুঝতে দেয় নি, এর বাইরে তার আর কোনো অস্তিত্ব আছে। সেই ইউটিলিটির কষ্ঠিপাথরে তার দাম অনেকদিন থেকেই কমে আসছিল। আজ যখন সেটা শূন্যে এসে ঠেকল, তখন একটি মাত্র প্রশ্নই আমার মনের মধ্যে মাথা তুলে উঠল—একে দিয়ে আমি করবো কি? আমার জীবনে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সেইখানেই শেষ নয়, তারপরেও সে থাকবে—কে জানে কত বছর–আমার বা আমার সংসারের ভার নিয়ে নয়, আমার দুর্বহ ভার হয়ে। অথচ —

    ফার্স্ট ক্লাসের একটা ‘কুপে’ আমাদের জন্যে রিজার্ভ করা হল। ভাড়াটা অবশ্য আমিই দিলাম, কিন্তু ব্যবস্থাটা আমার ভায়রাভাই-এর। অনেকটা পথ, সঙ্গে ঐরকম রুগী, তার ওপর মেয়েছেলে, তৃতীয় যাত্রীর ঝঞ্ঝাট রইল না, নির্বিবাদে যাওয়া যাবে।

    স্ট্রেচার লাগল না। দিদি আর ভগ্নীপতি দুজনে দুবাহু ধরে ধীরে ধীরে প্লাটফরমটুকু পার করিয়ে গাড়িতে তুলে দিলেন। বিছানা করে ওকে শুইয়ে ঘণ্টা পড়তে নেমে গেলেন। গাড়ি যখন চলতে শুরু করেছে, আমার শালিকার অনুচ্চ কণ্ঠ থেকে শোনা গেল, দুর্গা দুর্গা’। ভায়রাভাই চেঁচিয়ে বললেন, পৌঁছেই একটা তার করে দিও।

    গরম কাল। রাত নটা। জামাটা খুলে ঝুলিয়ে দিয়ে মন্দার মাথার কাছে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। ও চোখদুটো তুলে আমার মুখের দিয়ে চেয়ে বলল, হ্যাঁগো, এ গাড়িতে আর কেউ উঠবে না?

    —না।

    আর কিছু বলল না। লক্ষ্য করলাম, ওর মুখের উপর খুশির আভা ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ পরে বলল, তুমি কোথায় শোবে?

    হাত দিয়ে উপরের বার্থটা দেখিয়ে দিয়ে বললাম, ঐখানে।

    —ওখানে! উঠবে কেমন করে?

    —ঐ শেকলটা ধরে উঠবো।

    —না, না, তার চেয়ে আমার বিছানাটা মেঝেতে নাবিয়ে দাও, তুমি এইখানে শোও। এই ছেলেমানুষি প্রস্তাবে অন্য কেউ হলে হয়তো হেসে ফেলত, আমি গম্ভীরভাবেই বললাম, মেঝেটা শোবার জায়গা নয়। আমি ওপরেই শোবো। তুমি ঘুমোও—আমার এখন ঘুম পাচ্ছে না।

    কয়েক মিনিট চুপ করে থেকে আবার বলল, একটু উঠে বসবো?

    —পারবে?

    —খুব পারবো। তুমি যদি এই বালিশটাকে একটু-

    বাকীটুকু আর বলল না। আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম। নিজের জন্যে আমাকে হঠাৎ কিছু একটা ফরমাশ করে বসেছে—হলই বা সে অতি তুচ্ছ—এটা ওর পক্ষে একেবারে নতুন। সেই লজ্জাটা তখনও ওর চোখমুখে জড়ানো। আমি উঠে বালিশটা ওর পিঠের দিকে খানিকটা সরিয়ে দিলাম। আধশোয়া মতো বসে মন্দা অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি একমনে সিগারেট টানতে টানতে শুনলাম, ‘এই ক’মাসে তুমি অনেক রোগা হয়ে গেছ। খুব কাজ পড়েছে বুঝি?’

    আমি জবাব দিলাম না। ও তার অপেক্ষাও করল না। অনেকটা যেন নিজের মনে বলল, তাছাড়া দেখাশুনো কে করে, খাওয়া দাওয়া—

    বাধা দিয়ে বললাম, সেসব পরে ভাবলেও চলবে, এখন নিজের কথা ভাবো।

    —আমি এবার দু’দিনেই সেরে উঠবো।

    আমার মুখে বোধহয় অবিশ্বাসের কোনো চিহ্ন ফুটে উঠে থাকবে। হাসিমুখে তারই যেন প্রতিবাদ জানাল মন্দা— সত্যি দেখো তুমি!’

    এই জোর, এই তরল সুর—সবটাই আমার কাছে নতুন। যে মন্দাকে এতদিন দেখে এলাম, যাকে নিয়ে এতগুলো বছর ঘর করলাম, তার স্বভাবের সঙ্গে এটা যেন ঠিক খাপ খাচ্ছিল না।

    —’কী ভাবছ?’

    —’কিছু না।’ জবাবটা নিজের কানেই বেশ রূঢ় লাগল। ‘রাত দশটা বেজে গেছে, এবার ঘুমিয়ে পড়’ বলে উঠে পড়লাম।

    মন্দা আর কোনো কথা না বলে বালিশটা নিজেই ঠিক করে নিয়ে শুয়ে পড়ল।

    রাত বেড়ে চলল। আমার চোখে ঘুম নেই। গাড়ির সব জানালাগুলো খোলা, তার উপরে পুরোদমে পাখা চলছে, তবু মনে হচ্ছে, কী দুঃসহ গরম! দরজা খুলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চাঁদ নেই, কিন্তু আকাশ ভরা তারা। খোলা মাঠের ভিতর দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। বিহারের রুক্ষকঠিন, গাছপালাহীন, অসমান পাথুরে মাঠ। পাতলা অন্ধকারে ঢাকা। তারই মধ্যে চোখ দুটোকে ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম। বৃথা চেষ্টা। তারা বার বার গাড়ির ভিতরে ফিরে আসতে লাগল। মন্দা শুয়ে আছে দেয়ালের দিকে পেছন ফিরে। আর সব আলো নেভোনো। শুধু একটা কম পাওয়ারের নীল আলো জ্বেলে রেখেছি। ওর কাঁধ পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। মুখের একটা দিক আর নীচে নীচে গলাটা দেখা যাচ্ছে। অস্পষ্ট আলোয় শুকনো ভাঙা গালের ঠেলে ওঠা হাড়গুলো আরও ঠেলে উঠেছে, চোখটা যে কোন্ কোটরে তলিয়ে গেছে, দেখা যায় না। কণ্ঠার হাড় ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। মানুষের মুখ যে এত কুৎসিত, এর আগে কোনোদিন দেখি নি। শুধু কুৎসিত নয়, কী বীভৎস! একটা জীবন্ত কঙ্কাল! কী মূল্য এই জীবনের? কী সার্থকতা এই বেঁচে থাকার? ভাবতে গিয়ে সমস্ত মনটা গভীর নৈরাশ্যে ভরে উঠল! সেই একই প্রশ্ন মনে এল—এই জীবন্ত অভিশাপ নিয়ে আমি করবো কী?

    রেলগাড়ির চলন্ত চাকায় তারই প্রতিধ্বনি বেজে চলল—আমি করবো কী—আমি করবো কী?

    এই কিছুক্ষণ আগে সে আমাকে ভরসা দিয়েছে (ভরসাই বটে!)—’আমি দুদিনেই সেরে উঠবো।’ আমি জানি, সে কোনোদিনই সেরে উঠবে না। কিন্তু সেই মিথ্যা আশা, বেঁচে থাকবার সেই প্রবল আকাঙ্ক্ষা ওকে সহজে মরতে দেবে না, মৃত্যু-কবলিত প্রাণটাকে কোনো রকমে জীইয়ে রেখে দেবে। কে জানে সে কত কাল, কত বছর!

    বিধাতার কি নিষ্ঠুর পরিহাস! আমি যখন প্রায় সারারাত ধরে এমনি করে জ্বলেপুড়ে মরছি, যাকে ঘিরে সেই জ্বালা, সে তখন নির্বিবাদে ঘুমোচ্ছে। মাঝে মাঝে কোনো ছোট স্টেশনে গাড়ি থামতেই তার সেই নিশ্চিন্ত নিঃশ্বাস আমাকে পাগল করে তুলছিল। ভাবছিলাম প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে কত আকস্মিক ঘটনা ঘটছে, এই নিঃশ্বাসের গতিটা হঠাৎ থেমে যেতে পারে না? নিজে থেকে না থামলেও—

    কাশির শব্দে চমকে উঠলাম। একটানা প্রবল কাশি। তার দমকে গলার শিরাগুলো ফুলে উঠেছে, চোখ দুটো যেন ঠিকরে পড়ছে। এমনি করেও তো দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে! কিন্তু গেল না। কাশির বেগটা পড়ে যেতেই গলায় কেমন একটা বোবা আওয়াজ তুলে হাত দিয়ে মুখের দিকে ইঙ্গিত করল। বুঝলাম, যেটা উঠে এসেছে, কোথাও ‘ফেলতে হবে। সঙ্গে একটা ঝুড়ি ছিল, তার মধ্যে পিকদানি বা ঐরকম কিছু আছে কিনা খুঁজে দেখছিলাম। মন্দা ইশারায় বাথরুমটা দেখিয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করল। ধরে তুলে ধীরে ধীরে সেইখানে নিয়ে গেলাম। বেসিনের দিকে নজর পড়তেই গা পাক দিয়ে উঠল গয়েরের সঙ্গে জড়ানো রক্ত। অজ্ঞাতসারে হাতটা ওর বাহু থেকে সরে এল। দু-পা পিছিয়ে এলাম। সহসা মাথার ভিতরটা কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল—ঘৃণায়, আতঙ্কে, আক্রোশে না কিসের তাড়নায় আমি বলতে পারবো না। গাড়ির গতিটা একটু কমে এল। তারপরেই তলা থেকে ছুটে এল একটা জোরালো ঘর্ঘর ঠঠুন্ শব্দ। হঠাৎ চমকে উঠলাম—কিসের শব্দ? বুঝলাম ভয়ের কিছু নয়, গাড়িটা কোনো পুলের উপর দিয়ে চলেছে। তবু সেই বিপুল শব্দের সঙ্গে তাল রেখে কে যেন আমার মাথার ভিতরে অবিরাম হাতুড়ির ঘা মারতে লাগল। মন্দা এসে দাঁড়াল বাথরুমের বাইরে এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার ডানদিকের দরজাটা দড়াম্ করে খুলে গেল। হাতলটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। খোলা নদীর দমকা হাওয়ায়, কিংবা ব্রীজের ঝাঁকুনি লেগে হঠাৎ খুলে গেছে।

    যে কারণেই হোক, সেদিন সেই মুহূর্তে গাড়ির পাল্লার সঙ্গে আমার গোপন মনের কোনো অজ্ঞাত কুঠরির অদৃশ্য পাল্লাটাও সহসা খুলে গিয়ে থাকবে। হয়তো তারই আলোয় দেখেছিলাম, আমার ঠিক বুকের কাছে যে এসে দাঁড়াল, সে আমার স্ত্রী নয়, একটা ভয়াবহ বিষাক্ত ভাইপার। তার উদ্যত ছোবল থেকে নিজেকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে–এই একটি মাত্র চিন্তাই সমস্ত মনটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আর কোনো দিকে না চেয়ে দু’হাতে তার কাঁধ দুটো চেপে ধরে প্রচণ্ড বেগে খোলা দরজা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলাম।

    গভীর রাত্রির বুক চিরে একটা ভাঙা গলার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আমার কানে এসে লাগল।

    পাঁঠা-বলি দেখেছেন? গলাটা হাড়িকাঠের মধ্যে পুরে দিলে তার ভিতর থেকে যে অন্তিম ডাক ঢাকের শব্দ ছাপিয়ে বেরিয়ে আসে, তেমনি একটা আওয়াজ। একবার উঠেই গাড়ির শব্দে মিলিয়ে গেল।

    চলন্ত গাড়ির নিচে ও দু-পাশ জুড়ে তখনও সেই তুমুল ঘর্ঘর ঝন্‌ঝন্ বিপুল বেগে বেজে চলেছে, বলির পরেও যেমন চলতে থাকে ঢাক ঢোল কাঁসরের উন্মত্ত গর্জন। আমার মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহে শুদু তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। সেই উত্তপ্ত উদ্দাম উত্তেজনা। আর কিছুই নেই। বিশ্ব-সংসার আমার কাছে লুপ্ত হয়ে গেছে।

    তার পর এক সময়ে সেই পাগল-করা দুর্দান্ত শব্দটা হঠাৎ থেমে গেল। নদীগর্ভের বিপদ-ঝঞ্ঝা পার হয়ে গাড়িটা যেন আবার নিরাপদ মাটির পৃথিবীতে ফিরে এল। তখনও সেই দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে আছি। সামনে যতদূর চোখ যায়, বিস্তৃত খোলা মাঠ। সেই দিকে চেয়ে মনে হল, ওটা যেন আমারই অনাগত জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমার সামনেও অমনি অবাধ উন্মুক্ত মুক্তি।

    গাড়ির গতি মন্থর হয়ে গেল। দেখলাম, সেই একটানা মাঠ আর নেই, এখানে ওখানে দু-চারখানা বাড়িঘর, গাছপালা, রাস্তাঘাট, চলন্ত আলো। ক্রমশ আরও বাড়ি, আরও আলো, মানুষের কোলাহল। স্বপ্নের জাল ছিঁড়ে হঠাৎ যেন একটা পরিপূর্ণ জীবজগতের মধ্যে জেগে উঠলাম।

    একটা কোন্ স্টেশনে এসে গাড়ি থামল। আমি যে দরজায় দাঁড়িয়েছিলাম তার উল্টো দিকে প্লাটফরম্। এদিকে দৃষ্টি ফেরাতেই চোখে পড়ল মন্দার শূন্য শয্যা। মুহূর্তমধ্যে কে যেন একটা ভীষণ ঝাঁকানি দিয়ে আমাকে একেবারে রূঢ় বাস্তব নগ্ন সত্যের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিল। অগোছালো এলোমেলো বিছানাটার দিকে চেয়ে ভয়ে সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। তবু সেখান থেকে চোখ ফেরাতে পারলাম না।

    এর পরের কয়েকটা মিনিট ঠিক কী ভাবে কেটেছিল, আজ আর মনে করতে পারছি না। মনের পরদায় যে-সব চিন্তার রেখা ছায়াছবির চেয়েও অনেক দ্রুত গতি নিয়ে ফুটেছিল এবং মিলিয়ে গিয়েছিল, এতদিন পরে সেগুলোকে গুছিয়ে তোলা অসম্ভব। তার কোনো প্রয়োজনও নেই। যে-জাতীয় খুনী মানুষের মনস্তত্ত্ব আপনাকে আকর্ষণ করে থাকে, আমি তাদের থেকে আলাদা। এক্ষেত্রে আপনার কৌতূহল না থাকাই স্বাভাবিক। সুতরাং মানসিক বিশ্লেষণে অযথা সময় নষ্ট না করে ঘটনার দিকে যাওয়া যাক।

    প্রথমটা যে খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম, সেকথা লুকোতে চাই না। একবার মনে হয়েছিল পালাই। নামতে গিয়ে থেমে গেলাম। কোথায় পালাবো? কদ্দিন থাকবো পালিয়ে? তার পর? গাড়ির কামরা থেকে একটি অসুস্থ স্ত্রীলোকের এই আকস্মিক অন্তর্ধান বেশী দিন চাপা থাকবে না! গ্রীষ্মের পাহাড়ী নদীর শুকনো চড়ায় মৃতদেহটাই হয়তো তার সন্ধান দেবে। সেই সুত্র ধরে পুলিস যখন তার একমাত্র সহযাত্রীকে খুঁজে বের করবে, তখন তার এই নীরব পালিয়ে যাওয়াই তার বিরুদ্ধে সব চেয়ে সরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে। দরজার হাতলটা খুলতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। হঠাৎ নজর পড়ল উপরের বার্থে। হোলড-অন-এর বাঁধন থেকে বিছানাটা খুলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল—আমার ভায়রাভাই-এর চাকরটা বোধহয় করেছিল কাজটা—কিন্তু সন্ধ্যা থেকে সেটা স্পর্শ করা হয় নি। এতক্ষণে তার প্রয়োজন দেখা দিল। শুধু স্পর্শ নয়, বেশ করে ঘেঁটে চাদরটাকে এখানে ওখানে কুঁচকে দিলাম। তারপর সোজা গিয়ে শেকলটা টেনে ধরলাম।

    গার্ড এসে জানতে চাইলেন, কী ব্যাপার?

    —আমার স্ত্রীকে পাওয়া যাচ্ছে না!

    —কোথায় ছিলেন তিনি?

    —এইখানে ঘুমোচ্ছিলেন।

    —আর আপনি?

    —ওপরের বার্থ-এ।

    —কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না?

    ভুল করলাম। ব্রীজটা বোধহয় তখনও আমার মধ্যে ঘুরছিল, বললাম, ব্রীজের পর থেকে।

    গার্ড কপাল কোঁচকালেন—”ব্রীজের পর থেকে! এতক্ষণ শেকল টানেন নি কেন?”

    এ প্রশ্নের উত্তর আমার মাথায় যোগায় নি। বেশ কিছুদিন পরে যুগিয়েছিল আমার উকিলের মাথায়। আসামীর এই সন্দেহজনক আচরণ সরকারপক্ষের হাতে একটি ধারালো অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তিনি এক কথায় তাকে ভোঁতা করে দিয়েছিলেন। সেসন্স জজের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ইয়েস, ইওর অনার, ব্রীজ ছাড়বার পরেই আসামী দেখতে পেয়েছিল, তার স্ত্রী বিছানায় নেই। ওপর থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখেছিল। রুগ্না স্ত্রীর সম্বন্ধে তার মনে গভীর উদ্বেগ ছিল তার ফলেই দেখা। দেখে তার পক্ষে যেটা সহজ ও স্বাভাবিক সেই কথাই ভেবেছিলেন—স্ত্রী বাথরুমে গেছেন। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। মনে রাখবেন, তখন গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়াটা অপরাধ নয়। আমার মক্কেলের একমাত্র অপরাধ— যক্ষ্মারোগাক্রান্তা স্ত্রীর মনে যে আত্মহত্যার বীজাণু বাসা বেঁধেছে, সেটা সে কিছুমাত্র সন্দেহ করতে পারে নি। স্ত্রী যদি কাছে থাকত, হয়তো বুঝতে পারত। কিন্তু মেয়েটির দেহে এবং মনে যখন এই দুটি বীজাণুর আক্রমণ দেখা দেয়. ঘটনাচক্রে তখন সে স্বামীর কাছ থেকে দূরে গিয়ে পড়েছিল।

    আত্মহত্যার ব্যাপারটাকে প্রতিপন্ন করতে গিয়ে সুচতুর উকিলবাবু মন্দাকিনীর সমস্ত গার্হস্থ্য জীবনটাকে বিচারকের সামনে তুলে ধরেছিলেন (সে সম্পর্কে কয়েকজন প্রতিবেশীর সাক্ষ্য আগেই নিয়ে রাখা হয়েছিল)। তারপর শ্রদ্ধাপ্লুত গম্ভীর সুরে বলেছিলেন, এই মেয়েটি বয়সে নবীনা হলেও আদর্শে প্রাচীনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষা সে পায় নি, কিন্তু হিন্দুনারীর যেটা সর্বোচ্চ শিক্ষা, তা সে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত করেছিল। শুধু শিক্ষা নয়, বলব ধর্ম। স্বামীসেবা। সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে দেখা গেছে, এই মহৎ আদর্শে সে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়োগ করেছিল। স্বামীকে সে একটি সন্তান উপহার দিতে পারে নি, তারই অপরাধে স্বামীর বংশ লোপ পেতে বসেছে—এজন্যে নিজের উপর তার একটা গম্ভীর ধিক্কার ছিল। যে-সেবা ছিল তার মহান ব্রত, স্বাস্থ্য সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এজন্যেও তার মনোবেদনার অন্ত ছিল না। তারপর যেদিন সে জানতে পারল, স্বামীর আদেশে রোগ সারাতে এসে সে তার চেয়ে অনেক বেশী মারাত্মক, একটা সংক্রামক রোগ বয়ে নিয়ে চলেছে, তখন সে আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারে নি। যে-জীবন তার স্বামীর সেবায় লাগল না, তাকে সে স্বেচ্ছায় এবং স্বচ্ছন্দে শেষ করে দিল।

    জজ এবং জুরি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। আমিও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। মনে পড়ছিল, মন্দার সেই শেষ কথাগুলো—”এবার আমি দু-দিনেই সেরে উঠবো… সত্যি দেখো তুমি।” সে মরতে চায় নি, অসম্ভব জেনেও বেঁচে উঠতে চেয়েছিল।

    একজন বিরুদ্ধ সাক্ষীর উক্তি জজসাহেবের মনে কিছুটা ছায়া ফেলে থাকবে। পাশের কামরার এক ভদ্রলোক। স্ত্রীলোকের গলার একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু একেবারের বেশী আর শুনতে পান নি। মনে করেছিলেন ওটা হয়তো তাঁর ভ্রম।

    ‘এই একবারের বেশী না শোনাটা’কে পুলিস এবং সরকারী উকিল আমার বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলেন। আমার উকিল জেরার ঘায়ে ভদ্রলোককে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লেও জজের মনকে সন্দেহমুক্ত করতে পারেন নি। কিন্তু ‘সন্দেহ’কে ‘প্রমাণে’ দাঁড় করাবার মতো কোন হাতল জজসাহেব শেষ পর্যন্ত খুঁজে পেলেন না। কোনো একটা “মোটিভ”-এর জন্যে তিনি আকাশ-পাতাল হাতড়ে বেরিয়েছেন। খামকা এই লোকটা নিজের স্ত্রীকে খুন করতে যাবে কেন? মোটিভটা কী? তিনি সেই পুরনো থিওরি আঁকড়ে ধরে ছিলেন—খুন মাত্রেরই পিছনে একটি দু-অক্ষরের শব্দ থাকবে—নারী অথবা বিত্ত। হয় ইংরেজী ‘love’, নয়তো বাংলা ‘লাভ’। তার কোনোটাই যেখানে নেই সেখানে ন্যায়দণ্ড প্রয়োগ করা চলে না।

    একথা তিনি একবারও ভাবেন নি, যে মন দিয়ে মানুষ তার অনেকদিনের প্রিয় সঙ্গী এক পাটি ছেঁড়া জুতো টান মেরে ফেলে দেয়, সেই মন নিয়েই সে তার বহুব্যবহারে জীর্ণা, ব্যাধিগ্রস্তা শয্যাসঙ্গিনীকেও ট্রেন থেকে ঠেলে দিতে পারে।

    ‘মানুষে’র এই চেহারাটা হয়তো জজসাহেবের নজরে পড়ে নি, যদিও পড়া উচিত ছিল। তবু তাঁকে ক্ষমা করা যায়। আসামীকে তাঁরা দেখেন নথিপত্রের ভিতর দিয়ে। সে সংযোগ পরোক্ষ এবং সাময়িক। আপনার কয়েদীর সঙ্গে আপনার যে সুযোগ, সেটা প্রত্যক্ষ এবং দীর্ঘদিনব্যাপী তাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আপনি দেখতে পেয়েছেন। তবু যে এই জাতীয় একটা খুনী আপনার নজরে পড়ে নি, একথা কেমন করে বিশ্বাস করি? আমার মনে হয়, পড়েছে আপান ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছেন। তার কারণ যাই হোক, এ ত্রুটি ক্ষমা করা যায় না। শুধু ত্রুটি নয়, অপরাধ— আপনি সত্য গোপনের অপরাধে অপরাধী।

    চিঠির শেষে অংশটা পড়তে পড়তে শ্রীকান্তর কয়েকটি উক্তি আমার মনে পড়ল। অন্নদাদদির প্রসঙ্গে সে এক জায়গায় বলেছিল, “সংসারে পিশাচী কি নাই? নাই যদি, তবে পথে ঘাটে এত পাপের মূর্তি দেখি কাহাদের? সবাই যদি সেই ইন্দ্রর দিদি, তবে এত প্রকার দুঃখেরে স্রোত বহাইতেছে কাহারা? তবু কেমন করিয়া যেন মনে হয়, এ সকল তাদের বাহ্য আবরণ।… বন্ধুরা বলেন, ইহা আমার একটা শোচনীয় ভ্রুণ মাত্র। আমি তাহারও প্রতিবাদ করি না… শুধু বলি ইহা আমার যুক্তি নয়, আমার সংস্কার।”

    আমার বিরুদ্ধে এই পত্রলেখকের যে অভিযোগ আমিও তার প্রতিবাদ করছি না। যে রাজ্যে আমি দীর্ঘজীবন কাটিয়ে এলাম, সেখানে, ‘পিশাচে’র অভাব নেই, ‘পাপের মূর্তি’- ও কম দেখি নি। তবু মনে হয়েছে, সেইটাই সবটুকু নয়, তার অন্তরালে আরও কিছু আছে। কারও কারও বেলায় সেই ‘আরও কিছু’-টাই আমার চোখে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। আজও কোনো নির্জন অবসরে যখন পিছন ফিরে তাকাই সেই কটা লোকই সামনে এসে দাঁড়ায়—সেই বদর মুন্সী, কাশিম ফকির, মংখিয়া জং, জ্ঞানদা, পরিমল ব্রহ্মচারী সদানন্দ। তাদের কাছে ম্লান হয়ে যায় অনাথ, কুসুম, রাজাবাহাদুর এবং এই পত্রলেখকের মতো আরও যাদের দেখেছি।

    হয়তো শ্রীকান্তের মতো আমারও এটা একটা সংস্কার। তার মধ্যে অপরাধ থাকে, সে-অপরাধ আমি অকপটে স্বীকার করছি।

    ।। সমাপ্ত।।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপ্যারাডাইস লস্ট – জন মিল্টন
    Next Article ১৯৮৪ (নাইন্টিন এইটি-ফোর) – জর্জ অরওয়েল
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.